চাঁদুবাবু
আপনাদের মধ্যে যাঁরা ‘জঙ্গল মহল’ পড়েছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই ‘আউ গুট্টে দিয়ন্তু’ গল্পটির কথা মনে আছে। সেই গল্পটি চাঁদুবাবুরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।
চাঁদুবাবুরা বাঙালি হলেও ওড়িশাতেই থিতু হয়ে গেছেন। ওঁর বাবা অমরবল্লভ দে ছিলেন বামরার করদ রাজ্যের দেওয়ান। চাঁদুবাবুর ছোট ভাই খুব নামী গায়নাকোলজিস্ট—বিদেশ থেকে পাস করে এসে সম্বলপুরের বুড়লা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। তবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন কি না জানি না।
চাঁদুবাবুর বাড়ি ছিল কটক শহরের বাখরাবাদে। ভাল নাম সমরেন্দ্রনাথ দে। তবে ভাল নামে ডাকে না কেউই। আমার সঙ্গে যখন চাঁদুবাবুর পরিচয় হয় পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে। তার অল্প কিছুদিন আগেই কটকের খবরের কাগজে তাঁর ছবি বেরিয়েছিল। তার নিচে ক্যাপশন ছিল ‘হেট্টাবাঘ শিকারি’।
শহরের মধ্যে কোথা থেকে এক হায়না এসে পড়েছিল এবং সে যখন এক প্রতিবেশীর টয়লেটে ঢুকে পড়ে তখন বাইরে থেকে কড়া, দড়ি দিয়ে বেঁধে চাঁদুবাবুকে ডেকে পাঠান ওঁরা এবং চাঁদুবাবু বন্দুক নিয়ে গিয়ে তাকে এক গুলিতে ধরাশায়ী করেন।
সেই ছবি ছাপা হওয়ার পরে তাঁর বন্ধুবান্ধব, চেনা পরিচিত সকলেই ঠাট্টা করে তাঁকে ‘হেট্টাবাঘ শিকারি’ বলে ডাকতেন।
মহানদীর কাছেই বিধবা এবং পরমাসুন্দরী মায়ের সঙ্গে পেছনে ছোট্ট বাগানওয়ালা দোতলা বাড়িতে থাকতেন এবং এখনও থাকেন। খুব যে একটা লম্বা ছিলেন, তা নয়, তবে দুর্দান্ত স্বাস্থ্য ছিল। ওঁর বিল্টটা ছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো—কোমর থেকে ওপরে এবং দু’হাতে সব শক্তি জমা হয়েছিল। একটু তোতলা ছিলেন এবং তাঁর হাঁপানি ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বিশেষ না করলেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন নানা বিষয়ে। বন্যপ্রাণী, বনের নানা আদিবাসীদের সম্বন্ধে ওঁর খুব জ্ঞান ছিল। ওঁর এক প্রতিবেশী বন্ধু সনাবাবুর জমিজিরেত ছিল কটকের কিছু দূরে জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে নিয়মিত গিয়ে বন্ধুর তরফে চাষবাস যেমন দেখতেন, তেমন শিকারও করতেন। তা ছাড়া, কটকের বিখ্যাত ঠিকাদার ও কাঠের ব্যবসায়ী নরেন্দ্রনাথ ও ধীরেন্দ্রনাথ সুরের ছেলেরাও চাঁদুবাবুর কাছের মানুষ ছিলেন।
সারা ভারতবর্ষেই বর্ষার সময়ে জঙ্গলে প্রবেশ নিষেধ। জঙ্গল খোলে পয়লা অক্টোবরে। প্রতি বছর অঙ্গুলে ডি এফ ও—র অফিসে অঙ্গুল ডিভিশনের নানা জঙ্গল নিলাম হত। যে সব জঙ্গল নিলামে উঠবে সেই সব জঙ্গল সম্বন্ধে বিভিন্ন বড় বড় ঠিকাদার আগেই লোক পাঠিয়ে এবং জঙ্গলের মধ্যের গ্রামের (যেখানে গ্রাম থাকত) মানুষদের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে সে জঙ্গলে কী কী গাছ আছে, কতদিনের পুরনো গাছ, জঙ্গলে পৌঁছবার পথ আছে কি নেই, এই সব তথ্য সম্বন্ধে খোঁজখবর করে রাখতেন। তা সত্ত্বেও নিলামে জঙ্গল ডাকার মধ্যে একটা জুয়া খেলার ব্যাপার থেকেই যেত।
জঙ্গলে রাস্তা বানাতে হত ঠিকাদারদেরই। সে এক রোমহর্ষক ব্যাপার। হাতিদের চলার পথ ধরে পাহাড়ে উপত্যকাতে মার্সিডিস ট্রাক যাওয়ার পথ বানাতে হত। দশপাল্লার বিরিগড় নামের খন্দ আদিবাসী অধ্যুষিত খুব উঁচু পাহাড়ে ওঠার রাস্তাটি এতই খাড়া ছিল যে ফাঁকা ট্রাক ওঠার সময় বড় বড় পাথর ভর্তি করে উঠতে হত। ওপরের মালভূমিতে পৌঁছে সেই পাথর সব ফেলে দিয়ে কাঠের লগ নিয়ে নামত ট্রাক। ওই বিরিগড়ের পটভূমিতেই আমার ‘পারিধী’ উপন্যাস লিখেছিলাম। অনেকে বলতেন, বুদ্ধদেব গুহ অশিক্ষিত, তাই ‘পরিধি’ বানানটিও জানেন না। কিন্তু ‘পারিধী’ একটি খন্দ শব্দ। মানে, শিকার।
এই উপন্যাসের যিনি নায়ক তাঁর নাম চন্দ্রকান্ত। এই চন্দ্রকান্তর মধ্যে চাঁদুবাবুর ছায়া ছিল। আর নায়িকা চন্দনী ছিল ওই নামেরই একটি খন্দ মেয়ে। পারিধীর পরের খণ্ডও লিখেছিলাম, তার নাম দিয়েছিলাম ‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’।
জঙ্গল নিলামে কিনে নেওয়ার পর থেকেই নরেনবাবুর দুই ছেলে প্রভাত এবং অশোক (ফুটু এবং হোঁদল) চাঁদুবাবুকে ট্যাঁকস্থ করে জিপে উঠতেন। প্রায় ষাট বছর আগের কথা, তখন মহানদীর দুপারে যে গভীর আদিম জঙ্গল ছিল, তা আজ অনুমান পর্যন্ত করা যায় না। অনেক বনের ঠিকাদারেরা আমাদের মক্কেল ছিলেন বলে বিহার (তখন তো ঝাড়খণ্ড হয়নি), আসাম এবং ওড়িশার অনেক আদিম বনের ধ্বংসের নিরুপায় ও নীরব সাক্ষী ছিলাম আমি। এক একটি মহীরুহ যখন তাদের আকাশচুম্বী মাথা, অগণ্য পাখি ও সাপের আশ্রয়স্থলকে নয়ছয় করে মাটিতে সশব্দে আছড়ে পড়ত তখন আমার বুকের মধ্যে হাহাকার উঠত। সেই মহীরুহ কাটত বিরাট বিরাট করাত দিয়ে করাতিরা। মাটিতে পড়লে, সেই সব গাছকে কেটেকুটে বড় বড় ‘লগ’ করা হত। তবে এত বড় নয় যে ট্রাকে আঁটে না। কাঠের লগ সাইজমতো কাটা হলে মোষ দিয়ে বা বলদ দিয়ে সেই কাঠ পথের পাশে এমন জায়গাতে সাজিয়ে রাখা হত যাতে ট্রাকে লোড করতে সুবিধে হয়। এই প্রক্রিয়াকে ‘ঢোলাই’ বলা হত। ঠিকাদারদের মুহুরিরা কাগজ—কলম নিয়ে চশমা পরে বসে সন্ধের পরে ক্যাম্পে বা পাতায় ছাওয়া ঘরে লন্ঠনের বা হ্যাজাকের আলোতে কত বর্গফুট কাঠ হল তার চুলচেরা হিসেব করত। এই মুহুরিরা কেউ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ছিল না, অধিকাংশই ‘সপ্তম ফেল’ বা ‘অষ্টম ফেল’। কিন্তু হাবেভাবে তারা ছিল বুর্জোয়া। ধুতি, রাবারের বা প্লাস্টিকের পাম্প শু, রঙিন টেরিলিনের পাঞ্জাবি, কবজিতে এইচ এম টি ঘড়ি, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে তারা তাদের ‘অথরিটি’ নিয়ে গরিবস্য গরিব করাতিদের শাসন করত। করাতিরা সারাদিন, সূর্যোদয় থেকে প্রায় সূর্যাস্ত হাড়ভাঙা খাটুনির পর শীত—গ্রীষ্ম খালি গায়ে তাদের ঝুপড়ির মধ্যে পাশাপাশি শুয়ে থাকত। আর দূর গ্রামে ফেলে—আসা তাদের যুবতী—স্ত্রী, শিশুপুত্র ও কন্যাদের কথা অথবা প্রেমিকাদের কথা ভাবত। বাইরে কাঠের আগুনে তাদের সাধের ভাত বা ‘জাউ’ ফুটত। তার মধ্যে একটু নুন আর আফিঙের গুঁড়ো ফেলে দেওয়া হত। ওই গভীর বনে তরকারি কোত্থেকে পাওয়া যাবে? তাদের ডালও জুটত না। সেই ভাত রান্না হয়ে গেলে, তা খেয়ে, পাশাপাশি তারা নিজেদের দেহের উষ্ণতাতে উষ্ণ হয়ে রাত কাটাত। গরমের দিনেও রাতের বেলা নানা বন্য জন্তু ও সাপের ভয়ে তারা বাইরে শুত না। চাঁদুবাবু যতদিন ক্যাম্পে থাকতেন ততদিন তিনিই ছিলেন তাদের রক্ষাকর্তা। হাতি, বাঘ, চিতা, বাইসন এ সব কিছুর হাত থেকেই রক্ষা করতেন তাদের চাঁদুবাবু তাঁর দোনলা বন্দুক নিয়ে। অত্যন্ত রসিক এবং গরিব—দরদী বলে চাঁদুবাবু করাতিদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়ও ছিলেন। টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারতেন না অবশ্য, কিন্তু তাঁর রসিকতাতে তাদের সকলকে ‘গুড হিউমারে’ রাখতেন। সেটাই ছিল তাদের কাছে মস্ত পাওনা।
বাবা গাছ কাটতে কাটতে গাছ চাপা পড়ে মারা গেলে পনেরো বছরের ছেলে বাবার শ্রাদ্ধ করে কোরা ধুতি পরে গামছা কাঁধে কুড়ুলটি কাঁধে ফেলে এসে দাঁড়াত। করাতির ছেলে করাতি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। করাতিদের প্রত্যেকের লিভার বড় ছিল ভাতের সঙ্গে নিয়মিত আফিঙ খেয়ে খেয়ে। তাদের গড় আয়ু ছিল চল্লিশ বছর।
মুহুরিদের মধ্যে কেউ কেউ ভাল ও সাহসী শিকারিও ছিল। ঠিকাদারেরাই তাঁদের নিজেদের বন্দুক ও গুলি দিয়ে রাখতেন তাঁদের। বিপদ—আপদ থেকে করাতিদের রক্ষার জন্যে। আর নিজেরা যখন ক্যাম্পে যেতেন মুরগিটা, ময়ূরটা, শজারুটা, হরিণটা আর শুয়োরটা মেরে আনবার জন্যে। Pot-hunting। জঙ্গলে ও ছাড়া তো কোনও উপায়ও ছিল না। তবে চাঁদুবাবু ফুটুদা এবং এ বি কাকুর (অনন্ত বিশ্বাস, চৌরঙ্গির ইস্ট ইন্ডিয়া আর্মস কোম্পানির এক মালিক এবং যিনি সুরবাবুদের জামাই হতেন) সঙ্গে যখন যেতাম, রাইফেল দিয়ে বড় জানোয়ার, যেমন শম্বর বা নীলগাই মেরে দেওয়ার জন্যে কাকুতি—মিনতি করত করাতিরা। হরিণ জাতীয় জানোয়ারের মাংসকে (venison) ওরা বলত ‘শিকার’। শিকার আর মাংস ওদের কাছে সমার্থক ছিল—শুধু ওড়িশাতেই নয়, দক্ষিণী রাজ্যগুলি ছাড়া পূর্বী, উত্তর ও মধ্যপ্রদেশের সব রাজ্যের জঙ্গলের অধিবাসীদের কাছেই। ওদের কারোরই তো চিকেন, মটন বা পর্ক কিনে খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না, আজও নেই—তাই শিকার করা মাংসই ওদের কাছে একমাত্র অ্যানিমাল প্রোটিন ছিল—তাও তা জুটত ন’মাসে ছ’মাসে একবার। তবে ওদের বিয়ে—চুড়োতে শুয়োরের মাংস খাওয়াটা মান্য প্রথা ছিল। সঙ্গে স্থানীয় মদ। রুখু রাজ্যগুলিতে ভাত খাওয়াও এক বিলাসিতা ছিল। বিয়ে—চুড়ো ছাড়া ভাতও খেতে পায় না ওরা। চিনামিনা ধানের ভাত, জওয়ার, কখনও মকাই এবং বেশিভাগই শুখা মহুয়া খেয়েই থাকে ওরা। স্থানীয় মদ বলতে হাঁড়িয়া, মহুয়া, পানমৌরি এই সব। আমার ‘কোজাগর’ উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা কিছুটা জানবেন।
কী বলতে বসে কী বললাম এতক্ষণ। আবার চাঁদুবাবুতেই ফিরি। চাঁদুবাবুর এক জোড়া ছুঁচোল গোঁফ ছিল। চোখ দুটি ছিল জবা ফুলের মতো লাল। মাথাতে বড় বড় চুল। ছেচল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। মুখে সব সময়েই এক মিচকে হাসি। জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ কেউ বন্দুকধারী অপরিচিত চাঁদুবাবুকে দেখলে ডাকাত বলে ভুল করতে পারত সহজেই। তার ওপরে হাঁপানির হাঁপ এবং তোতলামির জন্যে থেমে থেমে বলা কথা শুনলে লোকে আরও ঘাবড়ে যেত। চাঁদুবাবু নিজেই মজা করে একটা গল্প বলতেন। এক জঙ্গলের এক রেঞ্জার চাঁদুবাবুকে প্রথমবার দেখে আঁতকে উঠে তাঁর ঘনিষ্ঠ একজনকে বলেছিলেন ‘অমরবল্লভ দে এত্তে বড্ড মানুষ থিলা আর তাংকু এ পুওটা গুট্টে বারুংগা হেল্বা!’
ওড়িয়াতে বারুঙ্গা মানে ভ্যাগাবন্ড।
চাঁদুবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় পুরুনাকোটে। সুরবাবুদের ওই বাড়িতেই। এক দারুণ শীতের রাতে। আমি তখনও ছাত্র।
জ্যোৎস্না রাতে চাঁদুবাবু বহুদিন মাংস না—খাওয়া তাঁর এক চেলার পাল্লাতে পড়ে একটি ময়ূর মারার চেষ্টা করেছিলেন। সেই গল্প এবং ‘আউ গুট্টে দিয়ন্তু’র গল্প শুনে যেমন হেসেছিলাম তেমন বহুদিন হাসিনি। পুরুনাকোট থেকে টিকরপাড়া যাওয়ার কাঁচা পথের ওপরে নরেনবাবুদের জঙ্গলের কাজ দেখাশোনার জন্যেই এক কামরা আর বারান্দাওয়ালা একটি ছোট টিনের চালের বাড়ি ছিল। তার পেছনেই গভীর জঙ্গল আর পাহাড় উঠে গেছে। পুরুনাকোটের চারপাশ ঘিরে ছিল নানা বিখ্যাত বন। বাঘ্বমুণ্ডা, টুল্বকা, লবঙ্গী ইত্যাদি। মহানদীর অন্য পারে ছিল দশপাল্লা, বৌধ এবং ফুলবানি। টিকরপাড়াতে বড় বড় গোঁফওয়ালা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্বাদু মহাশোল মাছ আর নানা কুমিরের মেলা ছিল। সেই কুমিরেরা শুধু মাছই নয়, মানুষও খেত। নরেনবাবুর মুখে এক সাহেব শিকারির কুমিরের মুখে মৃত্যুর মর্মন্তুদ কাহিনি শুনেছিলাম। হাপুসনয়নে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কিশোর পুত্র আর স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে মেমসাহেবের টি—এইট মডেলের ফোর্ড গাড়ি চালিয়ে ধীরে ধীরে পুরুনাকোটের পথ বেয়ে কটকের দিকে চলে যাওয়ার ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠত আমাদের, সেই গল্প শুনে।
লবঙ্গীর জঙ্গলে এক সকালে চাঁদুবাবুর সঙ্গে মাইল ছয়েক পাহাড়ে পাহাড়ে হেঁটে একটি বড় পাহাড়ের চুড়োতে পৌঁছে চাঁদুবাবু এক গভীর জঙ্গলাকীর্ণ উপত্যকা দেখিয়েছিলেন আমাকে। সেই ছায়াচ্ছন্ন বনে মেয়ে হাতিরা বাচ্চচা প্রসব করত। তখন সেই বনে কোনও মানুষ গিয়ে পড়লে তার মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী। তখন হস্তীযূথের পৌনঃপুনিক বৃংহনে সমস্ত বনভূমি প্রতিধ্বনিত হত। ওই অঞ্চলে প্রচুর হাতি ছিল তখন। বাঘ্বমুণ্ডার দিক থেকে অন্ধকার বা চাঁদনি রাতে তারা দলবদ্ধ হয়ে হেঁটে আসত পুরুনাকোটের বিস্তীর্ণ ধানখেতের পেকে—ওঠা ধান খেতে। ছোট ছোট খড়ের চালের মাচার ওপরে ছেঁড়া বালিশ ও তেলচিটে শতরঞ্চির ওপরে গায়ে কাঁথা আর দু’পায়ের মধ্যে কাঠকয়লার আগুনের কাঙরি নিয়ে নিজেদের পশ্চাৎদেশ গরম রেখে তারা সারা রাত ক্যানেস্তারা বাজিয়ে হাতি তাড়াবার বিফল চেষ্টা করত। নবান্নর জন্যে সামান্য ধানই বাঁচাতে পারত তারা।
বাঘ্বমুণ্ডার হাতিরা ক্রিশ্চান ছিল কি না জানা নেই, তবে তারা হাতিগির্জা পাহাড়ে জমায়েত হয়ে প্রার্থনা করত। পাহাড়টির নাম হাতিগির্জা ছিল বলেই হাতিদের ক্রিশ্চান ভাবা হত। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে, আমার প্রথম দিকের উপন্যাস ‘নগ্ননির্জন’ এবং পরবর্তীকালের ‘পর্ণমোচী’তে এই বাঘ্বমুণ্ডার কথা আছে। ‘নগ্ননির্জন’ আনন্দ পাবলিশার্স—এর দশটি উপন্যাসের মধ্যে আছে এবং ‘পর্ণমোচী’ দে’জ পাবলিশিং—এর বই।
চাঁদুবাবুর সঙ্গে দিনের বেলা পায়ে হেঁটে ও রাতের বেলা মাচাতে বসে কত কিছু না শিখেছি তা বলার নয়। টুল্বকা বন—বাংলোর কাছেই ভীমধারা নামের একটি প্রপাত ছিল। তার নিচে ছিল একটা দহ। তাতে মাছও ধরতাম আমরা। ওপরের সমতল মালভূমি দিয়ে বয়ে আসা মিনি—নায়াগ্রার মতো ভীমধারার জলরাশি নানা ভাগে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত নীচে প্রপাত হয়ে। ওই অঞ্চলে তখন এতসংখ্যক বড়কি ও ছোটকি ধনেশ ছিল যে বলার নয়। বড়কি ধনেশ মানে, Greater Indian Hornbill আর ছোটকি ধনেশ মানে, Lesser Indian Hornbil। ওড়িয়া নাম ছিল ‘কুচিলা খাঁই’ ও ‘ভালিয়া খাঁই’। কুচিলা, অর্থাৎ Nux vomica গাছে বসে বড় ধনেশরা ফল খেত। ভালিয়া নামের অন্য এক রকম গাছের ফল খেত ভালিয়া খাঁই অর্থাৎ ছোটকি ধনেশ। সূর্য ডোবার আগে ছাইরঙা ভালিয়া খাঁই এরা গ্লাইডিং করে ভেসে ভেসে যখন ডুবন্ত সূর্যকে ধাওয়া করে সূর্যের মধ্যে সেঁধিয়ে যেত, তখন মনে হত অন্য কোনও গ্রহে বসে রয়েছি।
বড় বড় বাদামি লেজওয়ালা কাঠবিড়ালিরা শীতের ভোরে ঝরঝরিয়ে শীতের শিশিরের বৃষ্টি ঝরিয়ে বড় বড় গাছের এক মগডাল থেকে অন্য মগডালে ঝাঁপাঝাঁপি করত। সে এক দারুণ দৃশ্য ছিল। সংখ্যাতে তারা ছিল অগুনতি।
টুল্বকা বাংলোর সামনে থেকে একটি পথ ভীমধারার জলের পাশ কাটিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে লবঙ্গীতে গিয়ে পৌঁছেছিল। সেই পথের প্রাকৃতিক দৃশ্যর তুলনা ছিল না। উঁচু পাহাড় থেকে নিচের উপত্যকার নালার পাশে এক ঠিকাদারের কামিনদের চান করার পর মেলে—দেওয়া বহুবর্ণ শাড়ির মেলা দেখেছিলাম একবার। সে ছবি চোখে গেঁথে আছে। সেই ঠিকাদারের (নাম ইচ্ছে করেই বলছি না) শিকার এবং নারীর শখ ছিল তাই সে কামিন হিসেবে অনেক নারীই রাখত। দিনে বন্যপ্রাণী শিকার এবং রাতে নারী শিকারই ছিল তার উপরি পাওনা। তার কাছে কাজ করতে আসা কোনও নারীরই রেহাই মিলত না। তার শয্যাসঙ্গী হতেই হত। তাদের বাঁচাবার জন্যে না ছিল কোনও নকশাল ছেলে, না কোনও ট্রেড ইউনিয়ন। সে—ই জঙ্গলের রাজা ছিল। ওই অঞ্চলের কোনও কোনও পাহাড়ি নদীর বালিতে সোনার গুঁড়ো পাওয়া যেত। কামিনদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সেই সব নদীর বালি ছেঁচে সোনার গুঁড়ো উদ্ধার করতে হত। করাতিদের প্রচণ্ড শ্রমসাধ্য কাজের জন্যে অধিকাংশ নারীই উপযুক্ত ছিল না। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ওই কাজই করত। নগ্নিকা হয়ে বালি ছাঁকত তারা সংস্কারবশে। তাদের সংস্কার ছিল উলঙ্গ না হয়ে ওই কাজ করলে দেবতা অপ্রসন্ন হয়ে সোনা থেকে তাদের বঞ্চিত করবেন।
ওই অঞ্চলের পাহাড়ে ঘন নীলরঙের অনেক Rock Pegion—ও দেখেছি। পাহাড়গুলিতে ছিল ঝাঁক ঝাঁক সবুজ পায়রা বা হরিয়াল। বট অশ্বত্থের ফল খেত তারা। তাদের গায়ের সবুজ রঙ আলো—চমকানো পাতার সবুজ রঙের সঙ্গে মিশে যেত।
চাঁদুবাবু একজন ন্যাচারালিস্টও ছিলেন। কত গাছগাছালি পোকা—মাকড়, পাখি ও প্রজাপতি যে তাঁর জানা ছিল, তা বলার নয়।
চাঁদুবাবু প্রায়ই আমাকে রেঢ়াখোলের জঙ্গলের গল্প বলতেন। সম্বলপুর থেকে একটি পথ চারমল, রেঙ্গানি—কানি ও আরও নানা গভীর বনের মধ্যে দিয়ে এসে রেঢ়াখোলে পৌঁছেছিল। বন্য প্রাণীতে সে জঙ্গল গিজগিজ করত। রেঢ়াখোল হয়ে পথ পৌঁছেছিল অঙ্গুলে। চাঁদুবাবুর সঙ্গে কখনও রেঢ়াখোলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, কারণ কটক থেকে অনেক দূর পড়ত বলে ওই জঙ্গল সুরবাবুরা কখনওই ডাকেননি। চাঁদুবাবুর সঙ্গে যেতে পারিনি কিন্তু বছর দশেক আগে মহানদী কোলফিল্ডস—এর অতিথি হয়ে ঝাড়সুগুদা হয়ে সম্বলপুরে গিয়ে যখন ছিলাম কিছুদিন, তখন গাড়ি নিয়ে সম্বলপুর থেকে রেঢ়াখোলে গেছিলাম এক ঘনঘোর বর্ষার দিনে। সে এক অভিজ্ঞতা! ওই অঞ্চলে অনেক কুরুবকের গাছও দেখেছিলাম যা অন্যত্র দেখিনি। কুরুবকের দেশে’ নামের একটি উপন্যাসও (ঋজুদা কাহিনি) ২০০৭—এর কলকাতা বইমেলাতে সাহিত্যম থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এখন সম্বলপুর থেকে অঙ্গুল পর্যন্ত রেল—লাইনও বসে গেছে। সিঙ্গল লাইন। মাঝে মাঝেই ট্রেনের গতি ব্যাহত হয় হাতির দলের জন্যে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে যে রেলপথ রাজাভাতখাওয়া ইত্যাদি জায়গাতে গেছে সেই রেলপথেরই মতো। সেই রেলপথে মাঝে মাঝেই হাতিতে যাত্রা ব্যাহত করে এবং রাতের বেলা হাতি ট্রেনে কাটাও পড়ে।
আগেই বলেছি, চাঁদুবাবু খুব পড়াশুনাও করতেন। উনিই আমাকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দুটি জীবনীর হদিশ দিয়েছিলেন। হেমিংওয়ে আমারও প্রিয় লেখক এবং বিদেশি লেখকদের মধ্যে হেমিংওয়ে, ওয়াল্ট হুইটম্যান এবং রবার্ট ফ্রস্ট আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছিলেন। বই দুটির নাম Ernest Hemingway—প্রফেসর কার্লোস বেকারের লেখা—হেমিংওয়ের একটি অসাধারণ জীবনী এটি। অন্যটি হেমিংওয়ের বন্ধু A. E. Hotchner—এর লেখা Papa Hemingway। এই বইটিতে কয়েকটি ফোটো আছে। তার মধ্যে একটিতে হেমিংওয়ের জন্মদিনের পার্টিতে উপস্থিত কোচবিহারের মহারাজা, (ভাইয়া) জয়পুরের মহারানির দাদার ছবি আছে। উনিও দারুণ স্পোর্টসম্যান ছিলেন এবং হেমিংওয়ের বন্ধু ছিলেন। এ কথা কম মানুষই জানেন। চাঁদুবাবু আমেরিকান শিকারি Bob Ruark—এর একটি বইয়ের হদিশও দিয়েছিলেন। যদিও সিরিয়াস বই নয়, তবে প্রচণ্ড রসবোধসম্পন্ন। পূর্ব—আফ্রিকার নানা শিকারের কথা তাতে আছে। সুখপাঠ্য বই।
একবার একটি গুন্ডা হাতির খোঁজে চাঁদুবাবুর সঙ্গে লবঙ্গীর গোণ্ডুলিবনের উপত্যকাতে এক চাঁদের রাতে অনেক মাইল ঘুরেছিলাম। মনে হচ্ছিল অগণ্য নগ্নিকা শ্বেতাঙ্গিনীদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অনেক বছর আগে লানডান—এ ‘OH CALCUTTA’—র নাটক দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা মনে হয়ে গা—শিরশির করে উঠেছিল। ওই নাটকের সব পাত্রপাত্রীই জন্মদিনের পোশাকে মঞ্চে আসতেন। সত্তরের দশকে ওই নাটক লানডান—এর নাট্যজগতে হইচই ফেলে দিয়েছিল।
গেন্ডুলি গাছেদের বটানিকাল নাম আমার জানা নেই, যেমন জানা নেই অনেক কিছুই। আমি ন্যাচারালিস্ট নই, অর্নিথলোজিস্ট নই, লেপিডপটারিস্টও নই। খুবই অল্প জানি আমি। আমার একমাত্র দাবি এই যে আমি ভালবাসতে জানি। প্রকৃতিকে আমি প্রেমিকের চোখ দিয়ে দেখেছি। চাঁদুবাবু এবং জঙ্গলের আরও অনেক বন্ধুবান্ধবরা অন্য ধাতুতে তৈরি ছিলেন। বাইসন—এর (ভারতীয় গাউরের) চামড়া ছাড়াবার সময়ে চাঁদুবাবুকে আমি দূর থেকে দেখেছি তার পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে তার যকৃৎ কেটে নিয়ে সারা গা মাথা হাত পা রক্তে লাল করে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে। শিকার আমি অনেকই করেছি এবং খুব ভাল মার্কসম্যান হিসেবে এই সব অঞ্চলে আমার অত্যন্ত খ্যাতি ছিল। রাইফেলই বেশি ব্যবহার করতাম—অস্ট্রিয়া থেকে ইমপোর্ট করে আমাকে বাবা উপহার দিয়েছিলেন একটি ম্যানলিকার শুনারের সিঙ্গল ব্যারেল .৩৬৬, ৯.৩ রাইফেল। সেইটি এবং একটি ইংলিশ ‘বারো বোরের’ দোনলা বন্দুক, ডব্লু ডব্লু গ্রিনার কোম্পানির, ডবল ইজেক্টার, ডবল চোক, বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলের। এই দুটিই ছিল আমার প্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। এই বন্দুকটিও বাবা ইমপোর্ট করিয়েছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। হেভি বোরের ও লাইট বোরের একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্ত্বেও এই দুটিই ছিল আমার ‘হাতের অস্ত্র’, যেমন সব শিকারিরই থাকে, ক্রিকেটারের ‘হাতের ব্যাটে’র বা টেনিস বা র্যাকেট প্লেয়ারের হাতের র্যাকেটেরই মতো।
পূর্ণিমা রাতের ওই গেন্ডুলিবনের মতো সুন্দর দৃশ্য আমার দেশে খুব বেশি দেখিনি। ওই নৃত্যরতা মসৃণগাত্রর বিবসনা সুন্দরীদের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে যেন পেত্নীতে পেয়েছিল আমাকে। গুন্ডা হাতি মারা আমাদের হয়নি। আমি ফিরে আসার পরে চাঁদুবাবু বেশ কয়েক মাস পরে তাকে মেরেছিলেন।
আমার প্রায় সব জঙ্গলের বন্ধুরাই আমার চেয়ে অনেক ভাল শিকারি ছিলেন এবং জঙ্গলকেও তাঁরা আমার চেয়ে অনেক ভাল জানতেন। কিন্তু আমি লিখতে পারি বলেই ওঁদের সকলের পরিচিতির চেয়ে আমার পরিচিতি বেশি। এটা আমার কাছে এমবারাসমেন্টের ব্যাপার। তবে এ কথাও ঠিক, পৃথিবীর এবং আমার দেশের নানা জায়গার প্রকৃত ভাল শিকারিদের কাছ থেকে দেখেই বলছি যে, যাঁরা প্রকৃতই ভাল শিকারি, তাঁরা অনেকেই লেখাপড়া জানেন না, আর যাঁরা জানেন, তাঁরা অত্যন্ত মিতভাষী এবং এ ব্যাপারে আলস্যপরায়ণ। তা ছাড়া, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই নিজের অভিজ্ঞতার কথা সাতকাহন করে বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন—তাঁদের প্রত্যেকেই স্বভাব—বিনয়ী। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত তাঁদের প্রত্যেককেই আমার প্রণাম জানাই।
শিকারিদের মধ্যে এই ব্যাপারে আমার জানা একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত জিম করবেট। রুডইয়ার্ড কিপলিং সাহেব নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন বটে কিন্তু আমার মতে করবেট ওঁর চেয়ে অনেক বড় লেখক। তার চেয়েও বড় কথা, জিম করবেট—এর মতো ভারত—প্রেমিক, গরিব—প্রেমিক ভারতে খুব কমই হয়েছেন। অথচ আমরা এতই অকৃতজ্ঞ যে, সেই মানুষটিকে এমনই অপমান করলাম, যে ‘My India’—র অশক্ত, বৃদ্ধ লেখককে শেষজীবনে সুদূর কিনিয়াতে গিয়ে মরতে হল। আমরা ঘৃণ্য।
অনেক ভারতীয়, যাঁরা শিকার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, কেনেথ অ্যান্ডারসন—এর সঙ্গে জিম করবেট—এর তুলনা করেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অ্যান্ডারসনের বাস ছিল ব্যাঙ্গালোরে। আমার অ্যাংলো—ইন্ডিয়ান শিকারি বন্ধু কেনেথের স্ত্রী জিন—এর কাছ থেকে যা শুনেছি এবং তার লেখা পড়েও যা মনে হয়েছে তাতে আমারও দৃঢ় ধারণা যে এঁদের দুজনের মধ্যে কোনও তুলনাই হয় না। জিন—এর বাড়ি ছিল বাঙ্গালোরের কাছে হোয়াইট ফিল্ড—এ। অ্যান্ডারসন সেখানেরই বাসিন্দা ছিলেন। হোয়াইটফিল্ড ম্যাকলাস্কিগঞ্জের মতো একটি অ্যাংলো—ইন্ডিয়ান কলোনি ছিল। কেনেথ সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস—এর মেম্বার থাকাকালীন অবসর নেন। হোয়াইটফিল্ডেই গিয়ে শেষ জীবনে থিতু হন। এখন কেনেথ নেই। বহু বছর জিন—এর খবরও পাই না।
লবঙ্গীর ওই গ্রীষ্মকালের গেন্ডুলিবনেরই মতো সুন্দর এক বন দেখেছিলাম পালাম্যুতে, কোয়েলের উপত্যকাতে, শীতকালে। বিরাট বিরাট আমলকী গাছে ফল এসেছে তখন, ফলের ভারে যেন নুয়ে পড়েছে গাছগুলি। সেই আমলকী বনেরই পাশে ছিল সেই সাদা ধবধবে গাছেদের বন। স্থানীয় নাম চিলবিল। তখন ‘কোজাগর’ লেখার জন্যে কেঁড় বাংলোতে গিয়ে রয়েছি—মারুমার—এও ছিলাম কিছুদিন। ‘কোজাগরে’র পটভূমি ভালুমার আসলে মারুমারই, যেমন ‘কোয়েলের কাছে’র পটভূমি রুমান্ডি আসলে কুমান্ডি। লিখতে গেলে অনেক ছল—চাতুরির আশ্রয় নিতে হয় প্রয়োজনবশে।
আমার অনুমান গেন্ডুলি এবং চিলবিল এই দুইই আসলে একরকমের soft wood—সম্ভবত যা কাগজের কলগুলিতে চালান যেত। বটানিস্টরাই বলতে পারবেন।
এইসব প্রসঙ্গ এলেই আমার অ্যামেরিকান কবি এমার্সনের কটি পঙক্তি মনে পড়ে যায়, যে পঙক্তিগুলি প্রথম যৌবনের লেখা গল্প ‘কুচিলা খাঁই’—তে প্রথমবার ব্যবহার করি এবং তার পরেও বহু লেখাতেই করেছি।
‘‘Bold as the Engineer who fells the wood
Love not the flower they pluck and know it not
And all their botany is Latin names.’’
কেনেথ অ্যান্ডারসনের কথাতে ফিরে আসি আবার। ‘‘I must pay the Devil his dues.’’ অ্যান্ডারসন কিন্তু কথার জাদুকর ছিলেন। ছিলেন বলছি, কারণ আমি জানি না তিনি বেঁচে আছেন কিনা। ওঁর মতো ভাল শিকারের গল্প—বলিয়ে খুব কমই হয়েছেন। অসাধারণ মুন্সিয়ানা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর অধিকাংশ বইয়ে। অভিজ্ঞতার দাম অবশ্যই আছে কিন্তু সত্যিই অসাধারণ তিনি তাঁর গল্প বলার ঢঙে। এ বাবদে তিনি কিপলিং এবং করবেটকেও অনেক পেছনে ফেলে গেছেন।
চাঁদুবাবু পনেরো—কুড়ি বছর হল জঙ্গলের ছবি আঁকছেন। হাঁপানির কষ্ট আরও বেড়েছে। বয়স এখন পঁচাত্তরের বেশি। নানারকম বৈকল্য এসেছে শরীরে। যে মানুষটি হাসতে হাসতে বন্দুক কাঁধে এক দৌড়ে পাহাড়ের মাথাতে পৌঁছে যেতেন আমার পাশে পাশে আবার এক দৌড়ে নেমেও আসতেন, তিনিই এখন প্রায় চলচ্ছক্তিহীন। চলাফেরা সবই একটি luna মোটরসাইকেলেই সারেন, তাও বাড়ির দরজা থেকে কারও সাহায্যে চড়তে হয়। বছর কয়েক আগে আমি যখন ভুবনেশ্বর বইমেলার সমাপ্তি অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম, তখন ভুবনেশ্বর থেকে কটকে চাঁদুবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমি ভুবনেশ্বরে আসছি শুনে ফুটুদা, এ বি কাকু এবং চাঁদুবাবুও কটক থেকে ভুবনেশ্বরে বইমেলাতে এসেছিলেন। জলরঙ এবং অ্যাক্রিলিকেই বেশি আঁকেন উনি। তবে ছবির চেয়েও বেশি করেন কোলাজের কাজ। নানা ধরনের কাগজ তো বটেই, চামড়ার কোলাজও করেন। চিঠি এবং টেলিফোনের মাধ্যমে জানতে পাই যে তাঁর খুবই নাম হয়েছে চিত্রী হিসেবে ওড়িশাতে এবং নানা পুরস্কারও নাকি পেয়েছেন। তাঁর ছবি দিল্লি এবং অন্য নানা জায়গাতে প্রদর্শিত হয়েছে। ওড়িশার দূরদর্শনের নানা চ্যানেলেও তাঁকে এবং তাঁর ছবি দেখানো হয়েছে এবং প্রায় নিয়মিতই হচ্ছে। জেনে ভাল লাগে। খুবই ভাল লাগে।
এ জীবনে অনেক বীর দেখলাম, অনেক অসাধ্যসাধনকারী, দুর্জয় সাহস ও শারীরিক শক্তির মানুষ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তাঁদের সকলকেই, দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে কোনও না কোনও সময়ে বয়স এবং জরা—কবলিত হতে হয়ই। হেরে যেতে হয়। এই শত্রুকে কোনও বন্দুক—রাইফেল দিয়েই পরাস্ত করা যায় না, পড়ে পড়ে তার হাতের মার খেতে হয়। বসির মিঞা, মধ্যপ্রদেশের এক শিকারি বন্ধু, যিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেকই বড় এবং আজ চলেও গেছেন, একটি কথা বলতেন প্রায়ই। বলতেন, ‘জওয়ানি যব আতি হ্যায় তব সাঁতাতি হ্যায়, ঔর যব যাতি হ্যায় তব ঔর ভি জাদা সাঁতাতি হ্যায়।’
যৌবন যে ঈশ্বরের কত বড় দান তা যৌবন যখন থাকে তখন বোঝা যায় না। যৌবন যখন আসে তখন বুকের মধ্যে নাড়া দিয়ে আসে আর যখন যায় তখনও কামড় দিয়ে যায়। যৌবন আসার আনন্দ যেমন পীড়াদায়ক, যৌবন যাওয়ার দুঃখও তেমনই দুঃসহ।