আবারও শিলিগুড়ির দুর্গা রায় এবং সারান্ডার বিষ্টু দত্ত

আবারও শিলিগুড়ির দুর্গা রায় এবং সারান্ডার বিষ্টু দত্ত

শিলিগুড়ির দুর্গা রায়ের ব্যবসা ছিল উত্তরবঙ্গের ঘুম, দার্জিলিং, কালিম্পং এবং পুরো ডুয়ার্সের যত চা—বাগান ছিল সব বাগানেই পেট্রল সরবরাহ করা। সম্ভবত বার্মা শেল কোম্পানির তেল। আজ আর মনে নেই। অনেকগুলি ছোট ছোট ট্যাঙ্কার ছিল ওঁর। তাতে করে নেপালি ড্রাইভারেরা তেল নিয়ে যেত। ট্যাঙ্কারের ফ্লিট ছিল। তখনও অনেক সাহেব কোম্পানি ছিল চা—বাগানের মালিক। ম্যাকনিল অ্যান্ড মেগর, ডানকান এবং আরও অনেক কোম্পানিই। বাঙালি মালিকদেরও কিছু বাগান ছিল যেমন সরস্বতীপুর, মোহরগাঁগুলম ইত্যাদি। চা—বাগানে তখনও মাড়োয়ারিদের প্রবেশ ঘটেনি। জ্যোতি বসুর বউদিরও দুটি বাগান ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের মধ্যে। শিকারপুর ও ভান্ডাগুড়ি।

চা—বাগানের মালিকানা যদিও ছিল ইংরেজ সাহেবদের সে সব বাগানের ম্যানেজারেরা অধিকাংশই স্কটসম্যান ছিলেন। মালবাজারে দুর্গাকাকুর একটি পেট্রল পাম্পও ছিল। সেটি দেখতে সম্ভবত দুর্গাকাকুর বড় ছেলে।

তাঁর আয়কর সংক্রান্ত কোনও ঝামেলার কারণে আমাদের পুরনো মক্কেল ক্লেব্যান বোট কোম্পানির শ্রীগোপেন্দ্রকৃষ্ণ বাগচী এক রবিবারের সকালে দুর্গাকাকুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলেন। বাবা আমাকে ডাকলেন, বললেন, উত্তরবঙ্গের খুব বড় একজন শিকারি এসেছেন, আয়, আলাপ করবি।

বসবার ঘরে গিয়ে দেখি একজন বেশ বেঁটেখাটো অত্যন্ত সুগঠিত চেহারার ভদ্রলোক অলিভ—গ্রিন রঙা শিকারের পোশাক এবং বাটার লাল—রঙা রুপোলি চুল, আর্মির জেনারেলদের যেমন হয়ে থাকে। পরে জেনেছিলাম, স্কচ—হুইস্কি খেলে চুলের রঙ অমন ঝকঝকে সাদা হয় আর দেশি হুইস্কি বা বাংলা খেলে লালচে পাটের মতো ম্যাড়মেড়ে হয়। বাস ও ট্রাক ড্রাইভারদের চুল যেমন।

দুর্গাকাকু তখন আমাদের বাড়ির কাছেই শরৎ ব্যানার্জি রোডের জলপাইগুড়ির রায়কত রাজের রানির বাড়ি ‘জলপাইগুড়ি ‘হাউস’—এ থাকতেন। জ্যোতিবাবুর দাদা ডঃ কিরণ বোস তাঁর বন্ধু হতেন এবং রায়কত রাজা প্রসন্নদের রায়কতের একমাত্র সন্তান রাজকুমারী প্রতিভাদেবী ছিলেন ডক বোসের স্ত্রী। কিরণকাকুরাও আমাদের মক্কেল হন পরে। দুর্গাকাকুই নিয়ে আসেন। এবং আমি রাজ এস্টেটের অনেক কাজ এবং রাজকুমারীর জামাইদেরও অনেক কাজ করেছি বহুদিন পর্যন্ত। অনেক ট্রাইব্যুনাল আপিল এবং সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডায়রেক্ট ট্যাক্সেও এস্টেট—ডিউটির আপিল করেছি। রাজকুমারীর বড় জামাই ছিলেন দিলীপ রায়চৌধুরি, কলকাতার এককালীন শেরিফ। এবং ছোট জামাই আর এফ বি—র বিজন নাগ।

পরে এক সময়ে দুর্গাকাকু আমাদের রাজা বসন্ত রায় রোডের ‘কনীনিকা’তেও থাকতেন। তারও পরে বেঙ্গল ল্যাম্পের গেস্ট হাউসে। একেবারে শেষজীবনে অশক্ত শরীরে মালবাজারেই থাকতেন।

সুকনা রোডে, যেখান থেকে পাহাড় শুরু হয়েছে, বাঁদিকের শালমাড়াতে ওঁর একটি খামারও ছিল—পুকুর যেমন ছিল, যাতে এ দেশে নতুন আসা তেলাপিয়া মাছের চাষ হত আবার সিলভার কার্প—এর চাষও হত। তখন একটি হাতিও ছিল সেই খামারে। সেই হাতিতে চড়ে শিকার করতেন মাঝে মাঝে।

সকাল থেকে রাত অবধি শহরেও তাঁর পোশাক ছিল শিকারির। আমাদের সঙ্গে বহু জায়গাতেই তিনি শিকারে গেছিলেন, সুন্দরবন, পালামৌ, ওড়িশার বিভিন্ন বনে, কালাহান্ডিসুদ্ধু। শুধু তিনিই নন, ওঁর চা—বাগানের একাধিক সাহেব বন্ধু, ডঃ কিরণ বোস এবং আরও অনেকে গেছিলেন।

দুর্গাকাকুর প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা কী ছিল আমার জানা নেই কিন্তু সাহেবদের সঙ্গে মিশে মিশে ইংরেজিটা বলতেন এবং লিখতেনও চমৎকার। হিন্দি, উর্দু এবং নেপালিও বলতে ও লিখতে পারতেন। কংগ্রেসি আমলের সব মন্ত্রী ও রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সব সেক্রেটারির সঙ্গে তাঁর খুব দোস্তি ছিল এবং সেই সূত্রে প্রচুর ব্যবসায়ীর নানা সঙ্কটমোচনও করতেন।

তাঁর ওই পোশাক নিয়ে একজন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার ওঁকে খুব বেকায়দাতে ফেলেছিলেন। আমাদের বাড়িতে উনি যে সময়ে থাকতেন সেই সময়ে বাবার সঙ্গে ইনকাম ট্যাক্সের নানা বাড়িতেও যেতেন। তা আয়কর ভবনে একদিন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার শিশির বোস তাঁকে বলেছিলেন, আচ্ছা দুর্গাবাবু, আপনি সব সময়ে শিকারের পোশাক কেন পরে থাকেন?

দুর্গাকাকু দুটি হাত দু—দিকে তুলে এবং ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘কে জানে! কখন ডাক আসে!’

শিশিরবাবু বলেছিলেন, ‘কিছু মনে করবেন না দুর্গাবাবু, ডাক এলে কি প্যান্টুলুনটা ছাড়বার সময় পাবেন না?’

খুবই অপ্রতিভ হয়েছিলেন দুর্গাকাকু।

দুর্গা রায়ের মতো এমন প্রায়—সর্বজ্ঞ এবং সর্ববিদ্যা পারঙ্গম সঙ্গী সত্যিই দুর্লভ ছিল। এমন রসিক মানুষ এবং সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সমানভাবে মেশার অবাক—করা ক্ষমতা খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। তাঁর গুণেরও শেষ ছিল না। জঙ্গলে রান্না করাতে ওঁর জুড়ি ছিল না। গাড়ি বা জিপ খারাপ হলে ইঞ্জিনিয়ার না হয়েও তিনি পরিত্রাতা হতেন। প্রয়োজন হলে অত্যন্ত সমর্থ শরীরে জিপ ঠেলেও দিতেন বিনা—অহং—এ। তিনি সঙ্গে থাকলে একটি মুহূর্তও নিরস লাগত না। সব সময়েই হাসতে হত। মোসাহেবিতেও তিনি ক্লাস ওয়ান গ্রেড ওয়ান ছিলেন। তাই সাহেব—সুবো থেকে রাজা—মহারাজা, শিল্পপতি সকলেই তাঁকে ভালবাসতেন।

তাঁর শিকারের নানা গল্প, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে এবং তিস্তার চরের বাঘ—শিকারের রোমহর্ষক সব গল্প অনেক শুনেছি তাঁর কাছে। কিন্তু এও ঠিক যে সারা জীবনে তাঁর রাইফেলের নল—নিঃসৃত গুলির সঙ্গে কোনও জানোয়ারের শরীরের যোগাযোগ ঘটতে আমি অন্তত কখনও দেখিনি।

জঙ্গলের বন্ধু হিসেবে বাবার কাছের মানুষ হলেও একটা সময়ে বাবার সর্বক্ষণের সঙ্গীও ছিলেন। সকাল থেকে রাত অবধি বাবার সঙ্গেই থাকতেন। এবং মুখ্যত ওঁরই পরামর্শে ডায়মন্ডহারবার রোডে জোকার কাছে কোনচৌকি গ্রামে ধীরে ধীরে ধানজমির ছোট ছোট প্লট কিনে প্রায় পঁচাত্তর বিঘের খামারবাড়ি গড়ে তোলেন বাবা। আমি অফিসের ভার নেওয়ার পর থেকেই অবসর নিয়ে ওই খামারেই থাকতেন বেশি সময়। খামারে প্রায় পৌনে একমাইল লম্বা খাল কেটে মাটি তুলে তার ওপরে গাছগাছালি, খামারবাড়ি গড়ে তোলেন। রাশিয়ান ট্রাঙ্কর, জাপানিজ পাওয়ার টিলার, মাছের চাষ, নানারকম ধানের এক্সপেরিমেন্ট, কেরলের বেঁটে নারকেল গাছ, মুর্শিদাবাদ ও লক্ষ্নৌয়ের আম, শোনপুরের হাট থেকে জার্সি গরু এসবের পেছনেও দুর্গাকাকুর প্ররোচনা ছিল। লেগহর্ন ও রোড আইল্যান্ড মুরগি, খাকি ক্যাম্পবেল এবং পাতিহাঁসের আমদানিও তাঁরই মন্ত্রণায়। উনি বাবার এতই কাছের মানুষ ছিলেন যে এক পুলিশ অফিসারের বীরভূমের নলহাটির ত্রিশ বিঘা একটি পুকুর কিনে ফেললেন বাবা ওঁর বুদ্ধিতে মাছের চাষ করবেন বলে। কয়েক বছর পরে অনেক বেগ পেশাদারের পক্ষে বীরভূমের সুদূর নলহাটিতে মাছের চাষ করা যে অসম্ভব এ কথা আমার বাবার মতো বাস্তববোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষে দুর্গাকাকুর দুর্বুদ্ধি ছাড়া সম্ভব হত না।

দুর্গাকাকু নিজেই বলতেন, ছিলাম মক্কেল, হয়েছি বিক্কেল।

দুর্গাকাকুর কাছ থেকে অল্পবয়সি আমি অনেক শিখেছি। বাংলাটাও উনি চমৎকার লিখতেন। সুন্দর হাতের লেখা ছিল। দুর্গাকাকু পরম কালীভক্ত ছিলেন। গরু খেতেন না এবং তাঁর চরিত্রের এই দাঢ্যর জন্যে চা—বাগানের সব সাহেব তাঁকে সত্যিই খুব সম্মান করতেন। নিজের চোখে দেখা। তাঁর সঙ্গেই সি এ পরীক্ষার ছাত্র আমি বহু চা—বাগানের সাহেবদের কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছি।

তৎকালীন কলকাতার ক্যালকাটা ক্লাবের অন্য ঐতিহ্য ছিল। আমি নিজে মেম্বার হয়েছি অনেক বাদে। কিন্তু ক্যালকাটা ক্লাবেও তাঁর পরিচিতদের কারণে নিত্য যাতায়াত ছিল। কলকাতার ক্রিম অফ দ্যা সোসাইটিতে ওঁর একটি জায়গা ছিল। ওঁর বন্ধু ছিলেন আইভান স্যুরিটা, উত্তরবঙ্গের কমিশনার, পিয়ার্সন স্যুরিটার দাদা, রঞ্জিত গুপ্ত যখন উত্তরবঙ্গের ডি আই জি (তখন আজকের মতো গণ্ডা—গণ্ডা আই এ এস—আই পি এস দেখা যেত না) তখন তাঁর জলপাইগুড়ির বাংলোতে, করোলা নদীর পাশে তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী মীনা গুপ্তর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই—পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকের কথা।

‘জংলি মহল’—এর কথা বলতে বসে শহর—মহলে চলে এলাম কিন্তু না বলেও উপায় নেই।

বাবা চলে যাওয়ার পরেও দুর্গাকাকু কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন। বাবাকে উনি গুহসাহেব বলে ডাকতেন। সকলকে বলতেন, ‘গুহসাহেব বিলিভস দ্যাট দ্যা ওনলি ওয়ে টু দ্যা হার্ট ইজ থ্রু দ্যা স্টম্যাক গুহসাহেবের বাড়ি এলেই দেখা যাবে যে, দ্যা হোল ফ্যামিলি ইজ অ্যাট দ্যা ডাইনিং টেবল। আর হরিদাস ভট্টাচার্যের (কাননদেবীর স্বামী) বাড়ি গেলেই দেখা যাবে তিনি একটি তাকিয়া ছড়ানো ফরাসে শুয়ে আছেন একটি তাকিয়া ছুড়ে দিয়ে বলবেন, দুর্গাবাবু, শুয়ে পড়ুন।’

বাবা মদ খাওয়া একেবারেই পছন্দ করতেন না আর বলতেন শিকারের সব ভাল, শুধু মদ আর মেয়েমানুষ ছাড়া। দুর্গাকাকু মদ রোজই পান করতেন। বনবাংলোর রান্নাঘরে গিয়ে ‘খিচুড়িটা কেমন হচ্ছে?’ এই অছিলাতে উনি আর এ বি কাকুর দাদা প্রশান্তকাকু সেখানে সযতনে লুকিয়ে রাখা বোতল থেকে চুমুক দিয়ে আসতেন। বাবার সামনে খেতেন না।

আমরা একবার ওড়িশার বামরাতে গেছিলাম পালামৌর মোহন বিশ্বাসের কাকা বীরেন বিশ্বাসের অতিথি হয়ে। বাবা তো ছিলেনই সঙ্গে দুর্গাকাকু ও এ বি কাকুর দাদা প্রশান্তকাকুও ছিলেন। জিপে করে কনসর নদী পেরিয়ে যখন আমরা কিলবগার দিকে যাচ্ছি তখন দুর্গাকাকু বললেন : একটা আফিং—খেকো লোক রোজ চিৎকার চেঁচামেচি করত। সেই বাড়িতেই আরেকজন ছিলেন যিনি নিত্য পান করতেন। আফিংখোরের চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে আফিংখোরকে একদিন তিনি বললেন :

‘দারু পিয়া তো ক্যা বাফা?

দিল খুশ ঔর পেট সাফা।

আফিং পিয়া তো ক্যা বাফা?

গাঁড় তংক ঔর দিল খাফা।’

অর্থাৎ, মদ খাওয়ার সুফল কী? মনে খুশি আর পেট পরিষ্কার। আর আফিং খেলে কী হয়? পেট টাইট হয়ে যায় আর মনও চটিতং হয়ে থাকে। খাফা মানে খাপ্পা।

এই চৌপদী শুনে বাবার মতো রক্ষণশীল মানুষও হাসি চাপতে পারেননি। এবং বলা বাহুল্য এই চৌপদী আবৃত্তি করার পেছনে টিটোটালার আমাদের বাবার মদ সম্বন্ধে মনোভাব কিঞ্চিৎ দ্রব করার বদ—মতলবও বিলক্ষণ ছিল।

দুর্গাকাকু সঙ্গে থাকলে, সে বাংলোর বারান্দাতেই হোক, কী ট্রেনে, কী জিপে, মনের গুমোট সকলের কেটে যেতই সব সময়ে। এরকম মজাদার ও বহুজ্ঞানে জ্ঞানী চৌকস মানুষ আজকাল আর দেখতেই পাই না। এখন সকলেরই ওয়ান—ট্র্যাক্ট মাইন্ড। জীবিকার্জন করেই সকলে ফুরিয়ে যাচ্ছে নিঃশেষে।

ওড়িশাতে গ্রেটার ইন্ডিয়ান হর্নবিল, মানে বড়কি ধনেশকে বলে ‘কুচিলা খাঁই’ আর লেসার ইন্ডিয়ান হর্নবিলকে বলে ‘ছোটকি ধনেশ’। এর কারণ, এদের কুচিলা (নাক্স ভমিকা) এবং ভালিয়া গাছে বেশি দেখা যায়। এই দুই গাছের ফল খেতে ওরা খুব ভালবাসে। একবার টুল্বকার প্রথম সকালে হাঁকা হচ্ছে প্রথম সকালবেলা। মাচাও বাঁধা হয়েছে প্রায় পাঁচ—ছটি। টুল্বকা এক সময়ে বড় বাঘ, গাউর আর হাতির জন্যে বিখ্যাত ছিল। বাঘের খবরও ছিল। ভিমধারায় একজোড়া বাঘ সেই মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের সন্ধেবেলা প্রতিদিন জল খেতে আসত। তাদের যাওয়ার দাগ দেখে নারাণ আর দুর্গা তাদের রাহান সাহানের খোঁজ করে গভীর জঙ্গলের ভেতরে মাচা বাঁধিয়েছিল। কিন্তু প্রায় আধঘণ্টা হাঁকা করার পরেও একদল মাই—শম্বর আর একদল গাউর ছাড়া কিছুই বেরোল না। দুর্গাকাকুর মাচা ছিল আমার মাচার ডানদিকে। হাঁকা যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে দুর্গাকাকুর মাচার দিক থেকে কোনও জানোয়ার ঝোপঝাড় ভেঙে দৌড়ে গেল। তার শব্দ শোনা গেল আমার মাচা থেকে। ভাবছিলাম, কী জানোয়ার হতে পারে। বাঘা বা চিতা অবশ্যই নয়। প্রথমত অনেক সময়েই হাঁকা শেষ হওয়ার সময়েই হাঁকাওয়ালাদের পায়ে পায়ে, মানে সামনে তারা আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয়ত, তারা নিঃশব্দচারী প্রাণী। তারা এসে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত বোঝা যায় না যে তারা এল।

হাঁকা যখন শেষ হয়ে গেল, সশস্ত্র শিকারিরা সকলেই মাচা থেকে নামলেন, আমি দুর্গাকাকুকে শুধোলাম, কী গেল আপনার মাচার নিচ দিয়ে?

দুর্গাকাকু বললেন, আর বলো না। একটা ভাল্লুক খাঁই।

মানে?

মানে, ভাল্লুকের বাচ্চচা।

দুর্গাকাকুর সঙ্গে পশ্চিমবাংলার, সবিশেষ উত্তর বাংলার বনবিভাগের আদায়— কাঁচকলায় সম্পর্ক ছিল। জমিদার অ্যাবলিশান অ্যাক্টের পরে রায়কত রাজের এবং বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলও সরকারের হয়ে যাওয়াতে প্রচণ্ড গাত্রদাহ ছিল দুর্গাকাকুর কারণ এ জঙ্গল ছিল তাঁর অবাধ বিচরণক্ষেত্র। আমি যখন প্রথমবার ওঁর সঙ্গে যাই বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে, তখনও দেখেছি আদিম অরণ্য। দিনমানেও শীতের সকালে কাঁচা পথের দু’পাশের মহীরুহদের চন্দ্রাতপ ভেদ করে সূর্যের আলো পড়ত না পথে। ‘আনন্দমঠ’—এ উল্লিখিত সন্ন্যাসীকাটা হাটের পাশেই ছিল রাজকুমারী প্রতিভা দেবীর শিকারপুর চা—বাগান।

তখন মুখ্য বনপাল ছিলেন কনকেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। হলং—এর বনবাংলোটি ওঁরই বানানো। প্রতিটি ঘরই আলাদা আলাদা কাঠের। লাহিড়ী সাহেবের মতো সৎ এবং দক্ষ প্রশাসক খুব বেশি দেখা যেত না আর আইন অমান্য করে শিকার করতেন বলে দুর্গাকাকুর ওপরে তাঁর জাতক্রোধ ছিল। দুর্গাকাকুও দু’চোখে দেখতে পারতেন না তাঁকে।

আমাকে নিয়ে সকালে ব্রেকফাস্ট করে শিলিগুড়ির ডেরা থেকে জিপে করে শিকারপুরের উদ্দেশে তিনি বেরোলেন। একটি প্রকাণ্ড আনারস এবং গোটা চারেক হাঁসের ডিমের ওমলেট এবং গোটা ছয়েক টোস্ট মার্মালেড এবং পুরু করে মাখন মাখিয়ে মকাইবাড়ির চা সহযোগে ব্রেকফাস্ট হল আমার, দুর্গাকাকুর নির্দেশে। ১৯৫৭ সালের কথা বলছি। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের কথা। সেবক রোডে বৈকুণ্ঠপুরে ঢোকার যে কাঁচা পথ চলে গিয়েছিল ডানদিকে সেখানে একটি ফরেস্ট চেকপোস্ট ছিল। বাঁদিকে বন বিভাগের একটি গুমটি। তাতে ফরেস্ট—গার্ড আছেন দুজন। শাল কাঠের মোটা খুঁটির চেকপোস্ট। তাতে ইয়াব্বড় তালা মারা। জিপ থামিয়ে জিপ থেকে নেমে দুর্গাকাকু বললেন, খোল তালা।

ফরেস্ট—গার্ডরা বলল, অর্ডার নেই। এই জঙ্গলে তো কোনও বন—বাংলোও নাই। আপনে যাবেন কই?

দুর্গাকাকু জিপের পেছন থেকে তাঁর পয়েন্ট ফোর ফিফটি ফোর হান্ড্রেড রাইফেলটা বের করে বললেন, শালা। খোল তালা। না হলে গুলি কইর‌্যা তালা ভাইঙ্গা ফেলাইমু নয় তোদেরই গুলি কইর‌্যা মাইর‌্যা দিমু।

ফরেস্ট গার্ডেরা কুখ্যাত দুর্গা রায়কে বিলক্ষণ চিনত।

দুর্গাকাকু বললেন, তোগো লাহিড়ী সাহেবরে কইস যে দুর্গা রায় আইছিল।

তারা দুজনে মুখ চাওয়া—চাওয়ি করে চাবি নিয়ে গিয়ে তালা খুলে দিল।

এই সব হরকত, উনি শিকার করার জন্যে যতটা করতেন তার চেয়ে অনেক বেশি করতেন লাহিড়ী সাহেবকে অপদস্থ করতে। তবে লাহিড়ী সাহেবও একবার তাঁকে বাগে পেয়ে বদলা নিয়েছিলেন ইনকাম ট্যাক্সের চিফ কমিশনার (তখন ওই পদ ছিল না, বলত সি আই টি ডব্লু বি ওয়ান) কেনেথ জনসনকে চিঠি লিখে। জনসন সাহেবকে দিয়ে পারমিট ছাড়া বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে দুর্গাকাকু হাতির পিঠ থেকে শিঙাল হরিণ মারিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিলেন জ্যোতিবাবুর বড় ভাই ডঃ কিরণ বোস। দুজনেই কলকাতা থেকে দুর্গাকাকুর অতিথি হয়ে দুর্গাকাকুর সঙ্গেই গেছিলেন। সে গল্প গত বছরের জংলি মহল—এ বলেছি বলে এখানে আর বললাম না।

তার ত্রিশ বছর পরে ক্যালকাটা ক্লাবে পুরাতনী গানের একটি অনুষ্ঠানে আমার গান শুনতে আসেন কে এন লাহিড়ী সাহেব এবং শ্রীমতী লাহিড়ী। গানের পর আমার সঙ্গে যেচে আলাপ করেন এবং আমৃত্যু যোগাযোগ রাখেন। উনি সত্যিই আমার লেখা ও গানের মস্ত অনুরাগী ছিলেন। অল্প কদিন আগে সন্তাোষের রাজাদের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে একটা নারী সংগঠনের সভাতে বউদির সঙ্গে দেখা এবং কথা হল। শ্রীমতী লাহিড়ীকে বনবিভাগের বড় বড় আমলারা আজও অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও মান্য করেন যদিও তিনি চলে গেছেন বেশ কয়েক বছর এবং লাহিড়ী সাহেবের জন্মদিনে তাঁর বাড়িতে যান। স্বামীর সততা ও দক্ষতার এই তো সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। পুরস্কার।

বনবিভাগের সঙ্গে দুর্গাকাকুর মতো এই রকম অহি—নকুলের সম্পর্ক ছিল সারান্ডার বিষ্টু দত্তরও। ওই অঞ্চলে যাঁরাই গেছেন তাঁরাই তাঁর কথা জানেন। থাকতেন বড়জামদাতে। আমাদের এক মক্কেলের অতিথিশালা ছিল বড়জামদার কাছেই বড়বিল—এ। বড়জামদা ছিল বিহারে (এখন ঝাড়খণ্ড) আর বড়বিল ছিল ওড়িশাতে। সেখানে বছর পঁয়ত্রিশ আগে একবার গেছিলাম। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে। তখন ‘জঙ্গল মহল’ বইখানি প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছুদিন হল। সেই বই বিষ্টুদার ঠোঁটস্থ ছিল। তারপরে প্রকাশিত অন্যান্য বইও পড়েছিলেন এবং আমার অত্যন্ত ভক্ত পাঠক ছিলেন। আগমনবার্তা পেয়ে বড়বিলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। এবং জোর করেই আমাকে নিয়ে একরাতে সন্ধে থেকে ভোররাত জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছিলেন। তখনই নিজচোখে দেখেছিলাম তাঁর প্রতাপ। এবং লৌহ আকর ও ম্যাঙ্গানিজ আকরবাহী লাল—নীলরঙা পাহাড়ি নদী। তখন পর্যন্ত যত বই প্রকাশিত হয়েছিল সবই তিনি পড়েছিলেন। পরেও কারও—কোয়েল—কয়না ও সাতশ পাহাড়ে দেশ সারান্ডাতে বেশ কয়েকবার গেছি কিন্তু। বিষ্টুদার সঙ্গে নয়।

সেদিক দিয়ে দুর্গাকাকুর কথাও বলতে হয়। সাহিত্য এবং সঙ্গীতের সঙ্গে ওঁর কোনও সম্পর্ক তো ছিলই না উল্টে আমি লিখতাম ও গান গাইতাম বলে আমাকে বিদ্রুপও করতেন। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলতেন ‘শান্তিনিকেতনী’। ওঁর সাহিত্যচর্চা বঙ্কিমে এসেই থেমে গেছিল। প্রচণ্ড কালীভক্ত ছিলেন। গানও গাইতেন খারাপ নয়, তবে শুধুই শ্যামাসঙ্গীত। জঙ্গলের বাংলোর বারান্দাতে বসে অন্ধকার রাতে ঈশ্বরে পরম—অবিশ্বাসী আমার বাবাকে ‘শ্যামা মা যে আমার কালো, কালো রূপে দিগম্বরী হৃদি পদ্ম করে যে আলো’ গেয়ে শোনাতেন পরম ভক্তিভরে।

তাঁর গান আজও কানে ভাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *