গাঁজা

গাঁজা

কিংবা গুলও বলতে পারেন। সদাশয় ভারত সরকার যখন আমাকে কিছুতেই ‘পদ্মশ্রী’ ‘পদ্মবিভূষণ’ জাতীয় কোনও উপাধিই দিলেন না, এবং শেষপর্যন্ত শিশির ভাদুড়ী পেয়েও সেটি বেয়ারিং চিঠির মতো ফেরত দিলেন তখন হাজরা রোডের রকফেলাররা (অর্থাৎ যাঁরা রকে অন্তত এক লক্ষ গুল মেরে লক্ষপতি রক্‌ফেলার হয়েছেন) সাড়ম্বরে আমাকে ‘গুলমগির’ উপাধি দিলেন।

হালের কথা। বর্ষার ছদ্মবেশ পরে শরৎ নেমেছেন কলকাতার শহরে। বাড়ির আঙিনায় হাঁটুজল, রাস্তায় কোমর। সেই জল ভেঙে ভিজে জগঝম্প হয়ে তাবৎ ‘ফেলাররাই’ উপস্থিত, এসেই বসলেন টেলিফোনটি মাঝখানে রেখে। তার পর সবাই আপন আপন আপিস আদালত কারখানা-শুড়িখানাতে খবর পাঠালেন, কী ভয়ঙ্কর জল দাঁড়িয়েছে রাস্তায়। বাড়ি থেকে বেরুনো সম্পূর্ণ অসম্ভব। নৌকো ভাড়ার চেষ্টা করছি। আপিসে আজ না আসতে পারলে কয়েকটা ভিজিটার ফিরে যাবে। সর্বনাশ হবে। কী করি বলুন তো?

মশাদা’র এরকম সকরুণ বেদনার গন্ধটলা আপিস-প্রীতি এর পূর্বে আমি কখনও দেখিনি। রকে আসতে তাকে বুক ভেজাতে হয়েছে, এখন তার চোখ ভেজা অথচ তার বাড়ি থেকে যেদিকে আপিস সেদিকে যেতে হাঁটু পর্যন্ত ভেজাতে হয় না।

আমাদের রকটি সংমিশ্রিত; অর্থাৎ দু-চারটি চিংড়ি সদস্যও আছেন। আবার ফণি-কাকার বয়স ষাট পেরিয়েছে, গুড়গুড়ির বয়স পাঁচ পেরোয়নি। এরা মাঝে-মধ্যে থাকলে আমাদের একটু সামলে-সুমলে কথা কইতে হয়।

মশাদার প্যাঁচটা দেখে টেটেন মারল ডবল প্যাঁচ। অজন সেনকে বলল, ‘অজনদা, আমার আপিসকে ঝপ করে একটা ফোন করে দিন তো, আমি আপিসে বেরিয়ে গিয়েছি, পৌঁছেছি কি না!’

অজনদা আরও তৈরি মাল। নম্বর পেয়ে খবরটা দিয়ে কী একটা শুনে আঁতকে উঠে বললে, ‘কী বললেন? পৌঁছয়নি? বলেন কী মশাই? বড় দুশ্চিন্তায় ফেললেন তো!’

নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

অজনদার নিজের কোনও ভাবনা নেই। তার আপিসে মাত্র একটি কল। সেটা সে প্রায়ই আপিস ছাড়ার পূর্বে বে-কল করে আসে।

এবারে আমরা শান্ত মনে সমাহিত চিত্তে কর্তব্যকর্মে মন দিলাম।

অজন বুঝিয়ে বলে, ‘আলম অর্থাৎ দুনিয়া জয় করে পেলেন বাদশা আওরঙ্গজেব ওই আলমগির নাম। সেই ওজনে আপনি গুলমগির।’

আমি বললুম, ‘হাসালি রে হাসালি! এ আর নতুন কী শোনালি? প্রথম আমি পরীস্তানে ছিলুম গুল্-ই-বকাওলি, তার পর লন্ডনে নেমে হলুম ডিউক অব গুলস্টার, তার পর ফ্রান্সে হলুম দ্য গুল, তার পর পাকিস্তানে হলুম গুল মুহম্মদ, এখানে এসে হলুম গুলজারিলাল নন্দ। তা ভালো, ভালো। গুলমগির! বেশ বেশ।’

বড়দা উপর থেকে রকে নামেন ক্বচিৎ-কস্মিন। বললেন, ‘ল্যাটে– ল্যাটে বুঝলেন।’ বড়দার মুখ হামেহাল পানের পিকে ভর্তি। তারই মহামূল্যবান একফোঁটা পাছে বরবাদ হয়, সেই ভয়ে তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে স্বর্গের দিকে ঠোঁটদুটি সমান্তরাল করে সেই দুটিকে মুখের ভিতরের দিকে বেঁকিয়ে দিয়ে ‘ত’, ‘দ’-কে ‘ট’, ড’, করে কথা বলেন– অল্পই।

তার এসব কল-কায়দা করা সত্ত্বেও আমরা তখন পাখা, খবরের কাগজ হাতের কাছে যা পাই তাই দিয়ে মুখ ঢাকি। আমি স্বয়ং ছাতা ব্যবহার করি।

অজনদা বলল, এবারে আপনি আপনার উপাধি-প্রাপ্তির সম্মানার্থে একটি সরেস গুল ছাড়ুন তো, চাচা।’

মশা বলল, ‘কিংবা, গাঁজা।’

 আমি বললুম, ‘যদি ছাড়ি গাঁজার গুল?’

ঘেন্টু বলল, ‘চাচাকে নিয়ে তোরা পারবিনে রে, ছেড়ে দে।’ ঘেন্টুর পাড়াদও নাম ঘন্টু। আমি নাম দিয়েছি ঘেন্টু। যবে থেকে আমার চর্মরোগ হয়েছে। ঘেন্টু চর্মরোগের জাগ্রতা দেবী। বিশ্বেস না হলে চলন্তিকা খুলে দেখুন।

আমি বললুম, ‘তবে শোন্। কিন্তু তার পূর্বে টেটেনকে সাবধান করে দিচ্ছি, সে যেন আমার গাঁজার গুল নিয়ে কোনও সোসিয়ো-পোলিটিকো-ইকনমিক-স্টাটিসটিকস সঞ্চয় না করে। সে আজকাল ওই নিয়ে মেতেছে।’

টেটেন নানাবটি কেস পড়ছিল। বলল, ‘আপনি কিসসুটি জানেন না, চাচা। আপনার জানা নেই, এ সংসারে মিথ্যাবাদী আছে এবং তার চেয়ে বড় মিথ্যাবাদীও আছে এবং সর্বশেষে স্টাটিসটিশিয়ানদের কথা ভুলবেন না। ওদের মাল নিয়েই তো সরকার গুল মারে। নিত্যি নিত্যি কাগজে দেখতে পান না? আমি আপনার দোরে যাব কেন?’

‘তবে শোন’, নিশ্চিন্ত হয়ে বলি।

‘পার্টিশেনের বছরখানেক পরের কথা। আমার মেজদা ওপার বাংলার কোথায় যেন কী একটা ডাঙর নোকরি করেন। তাঁর সঙ্গে দেখা। আমরা এখন দুই ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন দেশের অধিবাসী। কিন্তু আমাদের ভিতর কোনও ঝগড়া-কাজিয়া নেই। এই অ্যাদ্দিন বাদে নেহরুজি আর আইয়ুব খান সায়েব সেটা বুঝতে পেরে আমাদের শুভ-বুদ্ধি এক্তেয়ার করেছেন। তা সে যাক গে।

হিন্দুস্থানের বিস্তর দরদ-ভরা তত্ত্বতাবাশ করে মেজদা শুধাল, ‘তোদের দেশে গাঁজার কী পরিস্থিতি?’

আমি একগাল হেসে বললুম, ‘স্বরাজ পেয়ে বাড়তির দিকে।’

মেজদা আশ্চর্য হয়ে শুধাল, ‘সে কী রে! কোথায় পাচ্ছিস? আমি তো চালান দিতে পারছিনে!’

আমিও অবাক। শেষটায় বোঝা গেল, দাদা ছিলিম মেরে শিবনেত্র হওয়ার সত্যিকার গাঁজার কথা বলছে। আমি কী করে জানব? আমি পাষণ্ড বটি, –দাদা ধর্মভীরু, সদাচারী লোক।

দাদা বলল, ‘শোন্।’

পার্টিশেনের ফলে মেলা অচিন্তিত প্রশ্ন, নানা ঝামেলা মাথাচাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে উঠল এবং তারই সর্বপ্রধান হয়ে উঠে দাঁড়াল গঞ্জিকা-সমস্যা।

গাঁজার এত গুণ আমি জানতুম না। শুনতে পেলুম, স্বয়ং জাহাঙ্গীর বাদশা নাকি গাঁজা খেয়ে উভয়ার্থে অচৈতন্য হয়েছিলেন। সেটা নাকি তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরিতে আছে। গাঁজা ছাড়েন শেষটায় তিনি মনের দুঃখে। এর দাম অতি সস্তা বলে সেটা পোষায় না রাজা-বাদশাদের রাজসিক জাত্যভিমানে। সে কথা যাক।

আমার এলাকায় পৃথিবীর বৃহত্তম গাঁজার চাষ এবং গুদোম। ভারতে গাঁজার চাষ প্রায় নেই। আমি এসব তত্ত্ব জানতুম না– সমস্ত জীবন কাটিয়েছি আসামে, বরঞ্চ চায়ের খবর কিছুটা রাখি; এসব গুহ্য রহস্যের খবর দিয়ে গাঁজা ফার্মের ম্যানেজার আমাকে একদিন দুঃসংবাদ দিল, সে বছরের গাঁজা গুদোমে পচে বরবাদ হব-হব করছে। ইন্ডিয়াতে চালান দেবার উপায় নেই অথচ সেখানেই তার প্রধান চাহিদা।’

আমি শুধলুম, ‘কেন? তুমি নিজে খাও না বলে অন্য লোকেও খাবে না? এ তো বড় জুলুম।’

দাদা বলল, ‘কী জ্বালা! আমি শ্রীঘরবাস পছন্দ করিনে; তাই বলে আমি জেল তুলে দিয়েছি নাকি? সাধে কি বলি তুই একটি চাইল্ড় প্রডিজি– ওয়ান্ডার চাইলড– চল্লিশ বছরে তোর যা জ্ঞানগম্যি হল, আল্লার কুদরতে পাঁচ বছর বয়েসেই সেটা তুই অর্জন করে নিয়েছিলি।’

আমি চটে গিয়ে বললুম, ‘আর তুমি বিয়াল্লিশে।’ দাদা আমার চেয়ে দু বছরের বড়।

দাদা বলল, ‘তোর রসবোধ নেই। ঠাণ্ডা হ।’

রকফেলারদের দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘এসব মাইনর বর্ডার ইনসিডেন্ট আমাদের ভিতরে কালে-কস্মিনে হয়, কিন্তু মিটমাট হয়ে যায় ‘আকাশ-বাণী’, ‘ঢক্কা-ডিংডমে’ পৌঁছবার পূর্বেই।’

অজনদা শুধোল, ‘ঢক্কা-ডিংডমটা কী চাচা?’

 ‘ডিংডম্ মানে জগঝম্প, বিরাট ঢাক, যার থেকে ইংরেজি ‘টমটম’ ‘টমটমিং’ শব্দ এসেছে। অর্থাৎ ঢাকার বেতার কেন্দ্র। তার পর শোনো :

দাদা বলল, ‘ভয়ংকর পরিস্থিতি। ভারতের ষাট হাজার সন্ন্যাসী নাকি রাষ্ট্রপতির কাছে সই, হাতের টিপ দিয়ে আবেদন জানিয়েছেন, গাঁজার অভাবে তাঁদের নানাবিধ কষ্ট হচ্ছে, আত্মচিন্তার ব্যাঘাত হচ্ছে।–’

আমি গোশা করে বললুম, ‘দেখো দাদা, পিতা গত হওয়ার পর অগ্রজ পিতৃতুল্য। কিন্তু তুমি যদি আমাদের সন্ন্যাসীদের নিয়ে মশকরা করো—’

বাধা দিয়ে দাদা বেদনাতুর কণ্ঠে বলল, ‘দেখ ভাই, তুই কখনও দেখেছিস যে আমি কাউকে নিয়ে–’

এবারে আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘থাক থাক। তুমি বলো।’ দাদার ওই গলাটা আমি বড়ই ডরাই। ওটা দাদা ব্যবহার করে পঞ্চাশ বছরে একবার। দাদার বয়স তখন বিয়াল্লিশ।

দাদা তো আমাকে মাফ করবার জন্য তৈরি। চশমার পরকলা দুটো পুঁছে নিয়ে বলল, ‘পূর্বেই বলেছি, পার্টিশেনের ফলে বিস্তর অভাবিতপূর্ব সমস্যা দেখা দিল– এটা তারই একটা। পার্টিশেনের পূর্বে সান্তাহারের গাঁজা যেত হরিদ্বারে অক্লেশে, বাঙালোরের বিয়ার আসত ঢাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে। এখন মধ্যিখানে এসে দাঁড়াল এক দুশমন। জিনিভাতে কবে কে আইন করেছিল বিশ্বজনের কল্যাণার্থে কল্যাণ না কচু তার সারমর্ম এই : আপন দেশে তুমি সার্বভৌম রাজা, যা খুশি করতে পার, যত খুশি তত আফিঙ ফলিয়ে বিক্রি করতে পার, গাঁজা চালাতে পার– কিন্তু ভুলো না, আপন দেশের চৌহদ্দির ভিতর। এস্পোর্ট করতে গেলেই চিত্তির। তখন জিনিভার অনুমতি চাই। যেমন মনে কর, ফিনল্যান্ড জিনিভার মারফতে তোদের কাছে চাইল দু মণ আফিঙ– ওষুধ বানাবার জন্য। জিনিভা সন্দেহে গোয়েন্দা লাগাবে জানবার জন্যে, সত্যি ওষুধ বানাবার জন্য ফিনল্যান্ডের অতখানি প্রয়োজন কি না, কিংবা ওরই খানিকটে আক্ৰা দরে বাজারে বিক্রি করে, দেশের লোককে আফিঙখোর বানিয়ে দু পয়সা কামিয়ে নিতে চায় কি না। কারণ কোনও কোনও দেশ নাকি বিদেশের ওষুধ বানানেওয়ালাদের সঙ্গে ষড় করে ওষুধের অছিলায় বেশি বেশি হশিশ, ককেইন রপ্তানি করে সেসব দেশের বহু লোকের সর্বনাশ করেছে। আইনগুলো আমি পড়ে দেখিনি, তাই ঠিক ঠিক বলতে পারব না– নির্যাসটি জানিয়েছিল গাঁজা ফার্মের ম্যানেজার। এখন নাকি জিনিভার পারমিশন চাই, সেটা পেতে কতদিন লাগবে তার ঠিকঠিকানা নেই, কতখানি পাঠানো যাবে তার স্থিরতা নেই।

ইতোমধ্যে উপস্থিত হল আরেক সঙ্কট।

গেল বছরের গাঁজাতে গুদোম ভর্তি। এদিকে হাল বছরের গাঁজা ক্ষেতে তৈরি। তুলে গুদোমজাত করতে হবে। নতুন গুদোম এক ঝটকায় তৈরি করা যায় না– শেষটায় হয়তো জিনিভা কোনও পারমিটই দেবে না, কিংবা এত অল্প দেবে যে বেবাক ব্যবসাই গুটোতে হবে। নয়া গুদোমের কথাই ওঠে না।

তখন নানা চিন্তা, বহু ভাবনা, ততোধিক কর্তৃপক্ষকে আলোচনা করে স্থির করা হল, ‘গেল বছরের গাঁজা পোড়াও–’

আড্ডার কেউই গঞ্জিকা-রসিক নয়। তবু সবাই– টেটেন ছাড়া– এক কণ্ঠে হায় হায় করে উঠল। খাই আর না-ই খাই, একটা ভালো মাল বরবাদ হতে দেখলে কার না দুঃখ হয়! রায়টের সময় পার্ক সার্কাসের মদের দোকানে বোতল ভাঙা হচ্ছে দেখে এক টেম্পারে পাদ্রিকে পর্যন্ত আমি শোক করতে দেখেছি।

স্টাটিসটিশিয়ান টেটেন বলল, ‘আপনারা এতে এমন কী নতুন শোক পাচ্ছেন? মার্কিনরা যে দু দিন অন্তর অন্তর অঢেল গম লিটুরিলি অ্যান্ড মেটফরিক্লি দরিয়ায় ভাসিয়ে দেয় সে বুঝি জানেন না?’ টেটেনই আমাদের মধ্যে ইংরেজিতে এম-এ। ওর উচ্চারণ আমাদের বুঝতে কষ্ট হয়।

সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ বলার পর আমি গল্পের খেই ধরে এবং সিগারেট ধরিয়ে বললুম, ‘তার পর?’ দাদা বলল, ‘গুদোমেতে নতুন মাল পোরা হবে। ম্যানেজারকে বললুম, আমি অমুক দিন যাব, সেদিন পুরনো মাল পোড়ানো হবে। কারণটা তাকে আমি আর বললুম না। সেই যে তুই জানিস নাকি? বড়দা তোকে বলেছেন, তিনি যখন জাপানি বোমার সময় ট্রেজারি অফিসার ছিলেন তখন হুকুম এল জাপানি বোমা পড়লে, ব্যাপক বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে ট্রেজারির তাবৎ করেনসি নোট পুড়িয়ে ফেলবে। ভাইজাগা না কোথাকার এক সুবুদ্ধিমান একটিমাত্র বোমা পড়ামাত্রই সরকারকে খবর দিল সে সব নোট পুড়িয়ে ফেলেছে। তার পর দু বছর বাদে তাজ্জবকি বাত, বাজারে সেসব নোটের দর্শন পাওয়া যেতে লাগল। পোড়ায়নি। সরিয়ে ফেলেছিল। আমার তাই ভয়, গাঁজার বেলাও ওই যদি হয়।

আগেভাগে দিনক্ষণ দেখে অর্থাৎ টুর প্রোগ্রাম যথা-যথাস্থানে পাঠিয়ে দিয়ে বেরোলুম গাঁজা পোড়াতে।’

আমি আঁতকে উঠে বললুম, ‘কী বললে?’

দাদা ঈষৎ চিন্তা করে বলল, ‘হ্যাঁ তা তো বটেই।’ “গাঁজা পোড়ানো” কথাটার অর্থ “গাঁজা খাওয়া”ও হয়। তাই শুনেছি, ছোকরা নাতির হাতে সিগারেট দেখে যখন ঠাকুরদা গম্ভীরকণ্ঠে তাকে বলল, ‘জানিস, সিগারেট মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু’– সে তখন শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল, ‘তাই তো ওকে পোড়াতে যাচ্ছি।’

মোকামে পৌঁছে দেখি বিরাট ভিড়। বিশখানা গাঁয়ের বাছাই বাছাই লোক জমায়েত হয়েছেন সেখানে গাঁজা পোড়ানো দেখবেন বলে। আমি তো অবাক। বাঁশ-পাতা পোড়ানো আর গাঁজা-পাতা পোড়ানোতে এমন কী তফাত যে দুনিয়ার লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে জমায়েত হবে? তা সে যাক গে।

হুদো হুদো গাঁজা ওজন করে হিসাব মিলিয়ে ডাঁই ডাঁই করে মাঠের মধ্যিখানে রাখা হল। তার পর চোখের জল মুছতে মুছতে ম্যানেজারই মুখাগ্নি করল। সে-ই তার জনক– একে দিয়ে তার বহু পয়সা কামাবার কথা ছিল।

সেদিন বাতাসটা ছিল একটু এলোমেলো। গাঁজার ধুঁয়ো ক্ষণে এদিকে যায়, ক্ষণে ওদিকে যায়। আর তখন দেখি অবাক কাণ্ড! পাতা পোড়াবার সময় যেদিকে ছুঁয়ে যায় মানুষ সেদিক হতে সরে যায়। আজ দেখি উল্টী বাত। জোয়ান-বুড়ো, মেয়েমদ্দে– হ্যাঁ, কয়েকটি মেয়ে-ছেলেও ছিল– ছোটে সেদিকে।

আর সে কী দম নেওয়ার বহর! সাঁই সাঁই শব্দ করে সবাই নাভিকুণ্ডুলী পর্যন্ত ভরে নিচ্ছে সেই নন্দন-কাননের পারিজাত-পাপড়ি পোড়ানোর খুশবাই– অন্তত তাদের কাছে তাই। আমার নাকে একবার একটুখানি ঢোকাতে আমি তো কেশে অস্থির। আর ওরা ফেলছে কী পরিতৃপ্তির নিশ্বাস—‘আহ, আহ্!’ কেউ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে, কোমরে দু হাত রেখে, আকাশের দিকে জোড়া মুখ তুলে নাসারন্ধ্র স্ফীত করে নিচ্ছে এক-একখানা দীর্ঘ দম, আর ছাড়ছে দীর্ঘতর ‘আহ্–!’ শব্দ। কেউ-বা মাটিতে বসে ক্যাবলাকান্তের মতো মুখ হাঁ করে আস্য মার্গ দিয়ে যৌগিকধূম্র গ্রহণ প্রশস্ততর মনে করছে।

হঠাৎ হাওয়া ওলটাল। তখন পড়িমড়ি হয়ে সবাই ছুটল সেদিকে। আমি, ম্যানেজার, সেরেশতাদার ততোধিক পড়িমড়ি হয়ে ছুটলুম অন্যদিকে। দু একটি চাপরাসি দেখি মনস্থির করতে পারছে না। তাদের আমি দোষ দিইনে।

ভেবে দেখ, পৃথিবীতে এ ঘটনা ইতিপূর্বে আর কখনও হয়েছে? গাঁজা তো আর কোথাও ফলানো হয় না। তারই মণ মণ পুড়িয়ে একচ্ছত্র গঞ্জিকাযজ্ঞ। চতুর্দিকে গরিব-দুঃখী বিস্তর। এক ছিলিমের দম বাজারে কিনতে গেলে এদের দম বেরিয়ে যায়। আর এখানে লক্ষ লক্ষ তাওয়া পোড়ানো হচ্ছে আকাশ-বাতাস টইটম্বুর করে। হয়তো ধরণীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে এই শেষ যজ্ঞ।

আমি তো সায়েন্সের ছাত্র ছিলুম। তোদের কোনও এক ঔপন্যাসিক নাকি সদর রাস্তায় মদের পিপে ফেটে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছে। আমি তার ট্রেলার বাইস্কোপে দেখেছি। কিছু না। ধুলোখেলা। সেখানে সবাই করছে মালের জন্য হুটোপুটি একই দিকে। এখানে বিরাট জিরগা-জলসার জনসমাজ দিকনির্ণয় যন্ত্রের অষ্টকোণ চষে ফেলছে– ধুয়ো যখন যেদিকে যায় সেদিকে। এবং সঙ্গে সঙ্গে উল্টোদিকে ছুটছি আমরা কয়েকজন। রবীন্দ্রনাথ নাকি “জাগ্রত ভগবান”কে ডেকেছিলেন তাঁকে “জনসমাজ-মাঝে” ডেকে নেবার জন্যে! আমি পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়ছি, অবশ্য মনে মনে– আল্লাতালা যেন এই আমামুন্নাস, এই “জনসমাজ” থেকে আমাকে তফাত রাখেন।

আমি ততক্ষণে হাসতে হাসতে প্রায় কেঁদে ফেলেছি। দাদা আমার গম্ভীর রাশভারি প্রকৃতির লোক, চোখে-মুখে কোনওরকম ভাব প্রকাশ করে না, অবশ্য দরদি লোক বলে মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাস্য দেখা যায়– যা-ই হোক, যা-ই থাক, আমার মতো ফাজিল-পঞ্চানন নয়। কোটপাতলুন তুর্কি টুপি পরা সেই লোক খনে এদিক খনে ওদিক ধাওয়া করছে, টুপির ফুন্না বা ট্যাসেল চৈতন্যের মতো খাড়া হয়ে এদিক-ওদিক কম্প্রমান এ দৃশ্যের কল্পনা মাত্রই বাস্তবের বাড়া।

দাদা বলল, ‘তুই তো হাসছিস। আমার তখন যা অবস্থা। শেষটায় দেখি, মাথাটা তাজ্জিম তাজ্জিম করতে আরম্ভ করেছে। এত হুটোপুটি সত্ত্বেও ঘিলুতে খানিকটে ধুঁয়ো ঢুকে গিয়েছে নিশ্চয়ই। তার পর মনে হল বেশ কেমন যেন ফুর্তি ফুর্তি লাগছে, কীরকম যেন চিত্তাকাশে উড়ু উড়ুক্কু ভাব। তার পর দেখি, ম্যানেজারটা আমার দিকে কীরকম বেয়াদবের মতো ফিক ফি করে হাসছে। ওর তা হলে হয়েছে। কিংবা আমার। অথবা উভয়ের।

আর এস্থলে থাকা নয়।

টলটলায়মান, পড়পড়ায়মান হয়ে জিপে উঠলুম। সে-ও এক বিপদ। দেখি দুখানা জিপ। দুটোই ধুয়োটে কিন্তু হুবহু একইরকম। কোনটায় উঠি? শেষটায় দেখি আমার পাশে আমারই মতো কে একজন দাঁড়িয়ে। হুবহু আমারই মতো, আর টুপির ফুন্নাটি পর্যন্ত। দু জনাতে দুই জিপে উঠলুম।’

আমি বললুম, ‘দুটো জিপ না কচু!’

দাদা বলল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, তোকে আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। শান্ত হয়ে শোন্। তার পর গাড়ি যায় কখনও ডাইনে ঢাকা, আর কখনও বায়ে মতিহারী। তবে কি ড্রাইভারটা–? সে তো সর্বক্ষণ আমারই পিছনে ছিল। তার পর দেখি সেই অন্য জিপটাও ঢাকা-মতিহারী করছে একদম পাশে পাশে থেকে। ওমা! তার পর দেখি চারটে জিপ। সে ও না-হয় বুঝলুম। কিন্তু তার পর, মোশয়, সে কী কাণ্ড! চারখানাই উড়তে আরম্ভ করল।’

আমি শুধালুম, ‘উড়তে!’

‘হ্যাঁ, উড়তে। জিপটাই তো ছিল ঠায় দাঁড়িয়ে। ধুয়ো খেয়েছিল আমাদের চেয়েও বেশি।

হাওয়ায় উড়তে উড়তে ঘুমিয়ে পড়লুম। এবং শেষপর্যন্ত বাঙলোয় পৌঁছলুম।

ভাগ্যিস বেশি ধুঁয়ো মগজে যায়নি। আপন পায়েই ঘরে ঢুকলুম।

সামনেই দেখি তোর ভাবী। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকালেন। বাপ! তার পর অতি শান্ত কণ্ঠে– কিন্তু কী কাঠিন্য কী দার্চ সে কণ্ঠে– শুধালেন, “আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?”

‘আমি কিছু বলিনি।’ দাদা থামলেন।

আমি আড্ডাকে বললুম, ‘আমার ভাবী সাহেবা অতিশয় পুণ্যশীলা রমণী, পাঁচ বেকৎ নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, তসবি টপকান। শমসুল-উলেমার মেয়ে।’

রক শুধাল, ‘ওটার মানে কী চাচা?’

আমি বললুম, ‘পণ্ডিত-ভাস্কর। তোদের মহামহোপাধ্যায়ের অপজিট নাম্বার।’

 রক শুধাল, ‘তার পর?’

আমি বললুম, ‘তদনন্তর কী হল জানিনে। বউদি দাদার হাল থেকে কতখানি আমেজ করতে পেরেছিলেন তা-ও বলতে পারিনে, কারণ ঠিক সেই সময়ে ভাবী সায়েবা তাঁর স্পিশিলাটি চারপতি পরোটা ও দেখতে বজ্রের মতো কঠোর খেতে কুসুমের মতো মোলায়েম শবৃডেগ নিয়ে ঢুকলেন। আমরা খেতে পেলুম বটে কিন্তু কাহিনীটি অনাহারে মারা গেল।’

.

মশাদা বলল, ‘বিলকুল গুল।’

আমি পরম পরিতৃপ্তি সহকারে বললুম, ‘সাকুল্যে। তাই না বলেছিলুম, গাঁজার গুল। অর্থাৎ গুলের রাজা গুলমগির। তোরা আমাকে আজ ওই টাইটেলটি দিলি না?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *