অনুকরণ না হনুকরণ

অনুকরণ না হনুকরণ

আগে-ভাগেই বলে রাখছি, এ-লেখা সমালোচনা নয়।

সমালোচনা লেখবার মতো শক্তি–দুষ্টলোকে বলে, শক্তির অভাব আমার এবং আমার মতো অধিকাংশ লোকের নেই। গল্পচ্ছলে নিবেদন করি :–

প্রতি রোববারে এক বঁড়শে সকাল থেকে সন্ধে অবধি মাছ ধরে। বড় মাছের শিকারি, তাই ফাতনা ডোবে কালেকস্মিনে, আকছার রোববারই যায় বিন-শিকারে। তারই একটু দূরে আরেকটা লোক প্রতি রোববারে এসে বসে, এবং তামাম দিনটা কাটায় গভীর মনোযোগের সঙ্গে ওর মাছধরা দেখে দেখে। দু জনায় আলাপ-পরিচয় নেই। মাস তিনেক পর শিকারি লোকটার ‘আলসেমি’ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পর একটু বিরক্তির সুরে শুধাল, ‘ওহে, তুমি তা হলে নিজেই মাছ ধর না কেন?’

লোকটা আঁতকে উঠে বলল, ‘বাপস! অত ধৈর্য আমার নেই।’

সমালোচনা লেখার ধৈর্য আমার নেই।

আর কীই-বা হবে সমালোচনা লিখে ক’টা সুস্থ লোক সমালোচনা পড়ে? কটা বুদ্ধিমান-মাছ টোপ গেলে? আলগোছে তফাতে থেকে সমালোচক প্রবন্ধে একটু-আধটু ঠোক্কর দেয় অনেককেই– অর্থাৎ রোক্কা পয়সা ঢেলে মাসিকটা যখন নিতান্তই কিনেছে। তখন পয়সার দাম তোলবার জন্য একটু-আধটু খোঁচাখুঁচি করে। ফলে, চারের রস যত না পেল বঁড়শির খোঁচাতে তার চেয়ে বেশি জখম হয়ে ‘দুত্তোর ছাই’ বলে তাস-পাশাতে ফিরে যায়।

সমালোচকরা ভাবেন, পাঠকসাধারণ বোকার পাল। ওরা তাদের মুখে ঝাল চেখে বই কেনে। তা হলে আর দেখতে হত না। মারোয়াড়িরা সস্তায় রাবিশ পাণ্ডুলিপি কিনে পয়সা দিয়ে উক্তৃষ্ট সমালোচনা লিখিয়ে রাবিশগুলো খুচকারি (অর্থাৎ খুচরোর লাভে, পাইকারির পরিমাণে) দরে বিক্রি করে ভুঁড়ি বাড়িয়ে নিত–ফাও হিসেবে দেশে নামও হয়ে যেত, সসাহিত্য’ তথা সমালোচকদের পৃষ্ঠপোষকরূপে।

আমার কথা যদি চট করে বিশ্বাস না করতে পারেন তবে চিন্তা করে দেখুন আপ্তবাক্য নিবেদন করছি, ‘পয়সা দিয়ে সমালোচনা লেখানো যায়, পয়সা দিয়ে কবিতা লেখানো যায় না।’ নাহলে আমেরিকায় ভালো কবির অভাব হত না। সমালোচকের অভাব সেখানে নেই এবং বর্ণে-গন্ধে তাঁরা অম্মদ্দেশীয় সমালোচকদেরই মতো।

পলিটিশিয়ানরাও ভাবেন প্রোপাগান্ডিস্ট (অর্থাৎ সমালোচকদের দিয়ে নিজ পার্টির প্রশংসা কীর্তন করিয়ে নিয়ে বাজিমাত করবেন। কিন্তু ভোটার ভোটার যা পাঠকও তা– আহাম্মক নয়, যদিও সরল বলে সত্য বুঝতে তার একটু সময় লাগে। নাহলে আওয়ামীরা মুসলিম লীগকে কস্মিনকালেও হটাতে পারত না।

আমিও মাঝেমধ্যে সমালোচনা পড়ি, কারণ আমিও আর পাঁচজন পাঠকের মতো পয়সা ঢেলেই কাগজ কিনি। তবে আমার পড়ার ধরন নিয়ার্ডদের রুটি খাওয়ার মতো। শুনেছি, স্পানিয়ার্ডরা বছরের পয়লা দিন গির্জায় উপাসনা সেরে এসে একটুকরো রুটি চিবোয়– কারণ প্রভু যিশুখ্রিস্ট তাঁর প্রার্থনায় বলেছেন, ‘আর আমাদের অদ্যকার রুটি দাও।’ খানিকটে চিবিয়ে থু থু করে ফেলে দিয়ে বলে, ‘তওবা, তওবা, সেই গেল বছরে রুটিরই মতো যাচ্ছেতাই সোয়াদ।’ তার পর বছরের আর ৩৬৪ দিন সে খায় কোর্মাকালিয়া কটলেট মমলেট। আমিও সমালোচনার শুকনো রুটি বছরের মধ্যে চিবুই মাত্র একদিন এবং প্রতিবারই হৃদয়ঙ্গম হয়, সমালোচনার স্বাদ-গন্ধ সেই গেল বছরের মতো এক বছরে কিছুমাত্র উন্নতি করতে পারেনি।

কথাটা যেভাবে বর্ণনা করলুম, তাতে পাঠকের ধারণা হওয়া বিচিত্র নয় যে, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কিন্তু মোটেই তা নয়। অভিজ্ঞতাটা পাঠক-সাধারণ মাত্রেরই নিদারুণ নিজস্ব। অবশ্য সমালোচকদের কথা স্বতন্ত্র। তারা একে অন্যের সমালোচনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ে থাকেন। কেন পড়েন? জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য? রাম রাম! শুধুমাত্র দেখবার জন্যে কে তার মতে সায় দিয়েছে, কে দেয়নি এবং সেই অনুযায়ী দল পাকানো, ঘোট বাড়ানো, শক্তি সঞ্চয় করে রুটিটা আণ্ডাটা– থাক।

অবশ্য সমালোচকদের সমালোচনা করার কুবুদ্ধি যদি আমার কখনও হয়– এতক্ষণ যা করলুম সেটা তারই সেতার বাধা মাত্র– তা হলে সেটা আপনাদেরই পাতে নিবেদন করব। তবে ধর্মবুদ্ধি তখনও আপনাদের সাবধান করে দেবে, ও লেখাটা না পড়তে।

***

মূল বক্তব্যে আসি। ইদানীং আমি বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে, এবং বাঙলার বাইরে থেকেও কয়েকখানা চিঠি পেয়েছি। এঁরা প্রশ্ন জিগ্যেস করেছেন, কী প্রকারে ভালো লেখক হওয়া যায়?

প্রথমটায় উল্লসিত হয়েছিলুম। যাক, বাঁচা গেল। বাঙলা দেশ তা হলে স্বীকার করেছে, আমি ভালো লেখক। এবারে তা হলে কলকাতা-দিল্লিতে গিয়ে কিঞ্চিৎ তদ্বির করলেই দু চারটে প্রাইজ পেয়ে যাব, লোকসভার সদস্যগিরি, কলচেরল ডেলিগেশনের মেম্বারি এসবও বাদ যাবে না। বিদেশ যাবার সুযোগও হয়ে যাবে– বিলেত দেখার আমার ভারি শখ, অর্থাভাবে এতদিন হয়ে ওঠেনি। ইংরেজিটা জানিনে, এতদিন এই একটা ভয় মনে মনে ছিল। এখন বুলগানিন, চু-এন-লেইয়ের কল্যাণে সেটাও গেছে। এঁরা ইংরেজি না জেনে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু হায়, এত সুখ সইবে কেন? আমার গৃহিণী নিরক্ষরা টিপসই করে হালে আদালতে তালাকের দরখাস্ত করেছেন। তালাকটা মঞ্জুর না হওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গেই আছে। তাঁর কাছে চিঠিগুলো পড়ে নিজের মূল্য বাড়াতে গিয়েছিলুম। তিনি করলেন উল্টো অর্থ। সেটা আরও সরল। ব্যবসাতে যে দেউলে হয়েছে, তারই কাছে আসে লোক সলার সন্ধানে; ফেল-করা ছেলে পাস-করার চেয়ে ভালো প্রাইভেট ট্যুটর হয়।

এর উত্তর আমি দেব কী? গৃহিণী যে ক’টা গল্প জানেন সব কটাই আমার সঙ্গে টায়-টায় মিলে যায়। মনে হয় আমার পূজ্যপাদ শ্বশুর-শাশুড়ি ছেলেবেলা থেকে তাকে এই তালিমটুকুই শুধু দিয়েছেন, স্বামীর গোদা পায়ের গোদটি কী প্রকারে বারে বারে দেখিয়ে দিতে হয়। অবশ্য তার জন্য যে বিশেষ তালিমের প্রয়োজন হয় সেটা অস্বীকার করলেও চলে। ওটা তাদের বিধিদত্ত জন্মলব্ধ অশিক্ষিতপটুত্ব। যেসব সমালোচকদের কথা পূর্বে নিবেদন করেছি, তাদের বেলাও এই নীতি প্রযোজ্য।

ব্রাহ্মণীয় আপ্তবাক্য আমি মেনে নিয়েছি। তিনি তালাকের দরখাস্তটি উইথড্র করেছেন– শুনে দুঃখিত হবেন।

***

শঙ্করাচার্য দর্শনরণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়ে বলেছিলেন, ‘সাংখ্যমল্লকে আহ্বান কর। সে-ই মল্লদের অধিপতি। তাকে পরাজিত করলে অন্যান্য সফরি-গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করে অযথা কালক্ষয় করতে হবে না।’ আমি শঙ্কর নই! তাই সবচেয়ে সরল প্রশ্নটির উত্তর দেবার চেষ্টা করব।

প্রশ্নটি এই : ‘মপাসাঁ’র ছোটগল্প অপার আনন্দ দেয়, কিন্তু তাঁর অনুকরণকারীদের গল্প এত বিস্বাদ কেন? অপিচ, মপাসাঁ ছোটগল্প লেখার যে কাঠামো তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন তার অনুকরণ না করে গল্প লিখিই-বা কী প্রকারে?”

যাঁরা সঙ্গীত আয়ত্ত করবার চেষ্টা করেছেন তাঁরাই জানেন, ওস্তাদ যেভাবে গান গান তারই হুবহু অনুকরণ করতে হয় ঝাড়া দশটি বছর ধরে। ভারতনৃত্য শিখতে গেলে মীনাক্ষীসুন্দর পিল্লের নৃত্য অনুকরণ করতে হত ততোধিক কাল। স্যাকরার শাগরেদকে কত বছর ধরে একটানা গুরুর অনুকরণ করে যেতে হয়, তার ঠিক ঠিক খবর আমার জানা নেই। ভারতবর্ষে এই ছিল রেওয়াজ।

সাহেবরা এ দেশে এসে বলল, ‘এত বেশি অনুকরণ করলে নিজস্ব সৃজনশক্তি (অরিজিনালিটি) চাপা পড়ে যায়। ফলে কোনও কলার আর উন্নতি হয় না।’ কথাটা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর মধ্যে অনেকখানি সত্য লুকনো আছে।

কিন্তু তার বাড়াবাড়িতে কী হয়, সেটাও তো নিত্য নিত্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গুণীজনের উচ্চাঙ্গ সৃষ্টি অধ্যয়ন না করেই আরম্ভ হয়ে যায়, ‘এপিক’ লেখা, দু কদম চলতে না শিখেই ডানস্ ‘কম্পোজ’ করা, আরও কত কী, এবং সর্বকর্মে নামঞ্জুর হলে সমালোচক হওয়ার পন্থা তো সবসময়েই ভোলা আছে। সেই যে পুরনো গল্প– শহর-পাগলা ভাবত, সে বিধবা মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী। পাগল সেরে গেছে এই রিপোর্ট পাওয়ার পর পাগলাগারদের বড় ডাক্তার তাকে ডেকে পাঠিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে শুধালেন, ‘তা তুমি খালাস হওয়ার পর করবে কী?’ সুস্থ লোকের মতো বলল, ‘মামার বড় ব্যবসা আছে, সেখানে ঢুকে যাব।’ ‘সেটা যদি না হয়?’ চিন্তা করে বলল, ‘তা হলে আমার বিএ ডিগ্রি তো রয়েছেই– টুইশনি নেব।’ তার পর একগাল হেসে বলল, ‘অত ভাবছেন কেন, ডাক্তার? কিছু নাহলে যেকোনো সময়ই তো আবার মহারানির স্বামী হয়ে যেতে পারব।’ সমালোচক সবসময়ই হওয়া যায়।

তৃতীয় দল অন্য পন্থা নিল। ওস্তাদদের হুবহু নকল তারা করল না– তাতে বয়নাক্কা বিস্তর। আবার বিন-তালিমের ‘অরিজিনালিটি’ পাঠক-সাধারণ পছন্দ করে না। উপায় কী? তাই তারা ওস্তাদদের কতকগুলো বাছাই বাছাই জিনিস অনুকরণ করল এবং শুধু অনুকরণেই না, বাছাই বাছাই জিনিসগুলোর মাত্রা দিল বাড়িয়ে।

চার্লি চ্যাপলিন একবার নাম ভাঁড়িয়ে গোপনবাসের জন্য গেছেন চিলির এক অজানা শহরে। বেড়াতে বেড়াতে দেখেন, দেয়ালের গায়ে বিজ্ঞাপন ‘সোমবার রাত্রে শহরের কনসার্ট ঘরে চার্লি চ্যাপলিনের নকল করার প্রতিযোগিতা হবে। ভ্যাগাবন্ড চার্লির বেশভুষা পরিধান করে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে স্টেজের ইসপার উসপার হতে হবে চার্লি ধরনে। সর্বোৎকৃষ্ট অনুকরণের পুরস্কার পাঁচ শ টাকা।

চার্লি ভাবলেন, এখানে তো কেউ তাকে চেনে না, দেখাই যাক না, প্রতিযোগিতায় ছদ্মনামে কী হয়।’

ছাব্বিশজন প্রতিযোগীর ভিতর চার্লি হলেন তেরো নম্বর।

তার সরল অর্থ, ওই ছোট শহর, ধেড়ধেড়ে ডিহি গোষ্ঠীপুরে বারোজন ওস্তাদ রয়েছেন যাঁরা চার্লিকে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন চার্লির পার্ট কী করে প্লে করতে হয়।

চার্লি শিরে করাঘাত করে বলেছিলেন, ‘হে ভগবান, আমার অভিনয় যদি এই বারোজনের মতো হয় তবে আমি আত্মহত্যা করে মরব।’

ব্যাপারটা হয়েছে, চার্লি যেখানে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা দিয়ে হৃদয়ের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেন এঁরা সেটাকে দশগুণ বাড়িয়ে দিয়ে মশকরাতে পরিণত করেছেন; চার্লি যেখানে চোখের জলের রেশ মাত্র দেখিয়েছেন, এঁরা সেখানে হাউমাউ করে আসমান-জমিন ফাটিয়ে আড়াই ঘটি চোখের জল ফেলেছেন; চারুকলার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে চার্লি যেখানে অখণ্ড সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রশান্ত শিব সৃষ্টি করেছেন সেখানে তারা প্রত্যেক অঙ্গে ফাইলেরিয়ার গোদ জুড়ে বানিয়ে তুলেছেন এক-একটি বিকট মর্কট।

ঘরোয়া উপমা দিতে হলে বলি, ভেজাল সরষের তেলেরই বড় বেশি সোনালি ঝাঁঝ– মারাত্মক তুখোড়।

রবীন্দ্রনাথের ‘দোদুল-দোলা’, ব্যা’কুল রেণু’, ‘উদাস হিয়াকে’ ‘দোলাতর’, ‘বেণুতর’ করে নিত্য নিত্য কত না নব নব মশকরা হচ্ছে। কিন্তু তবু চার্লি বেঁচে গেছেন। কারণ আর যা-ই হোক মার্কিন মুলুক পরশুদিনের গড়া নবীন দেশ। ভেজালে এদের অভিজ্ঞতা আর কতটুকু? প্রাচীন চীনের কাহিনী শ্রবণ করুন।

একদা চীন দেশে এক গুণীজ্ঞানী, চরিত্রবলে অতুলনীয় বৌদ্ধ শ্রমণের আবির্ভাব হয়। যেমন তার মধুর সরল শিশুর মতো চলাফেরা-জীবনধারা, তেমনি তাঁর অদ্ভুত বচনবিন্যাস। বুদ্ধের কীর্তিকাহিনী তিনি কখনও বলতেন বলদৃপ্ত কণ্ঠে, কখনও সজল করুণ নয়নে– তথাগতেরই মতন তখন তার সৌম্যবদন দেখে, আর উৎসাহের বচন শুনে বহু শত নরনারী একই দিনে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করত। ক্রমে ক্রমে তাঁর মাতৃভূমির সর্বত্র বৌদ্ধধর্মের জয়ধ্বনি বেজে উঠল, বুদ্ধের জীবনাদর্শ বহু পাপীতাপীকে ধর্মের মার্গ অনুসরণে অনুপ্রাণিত করল।

দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসর ধরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করার পর তাঁর মৃত্যুক্ষণ কাছে এল। তাঁর মন কিছু শান্ত, তাঁর চিত্ত নিষ্কম্প প্রদীপশিখাবৎ। শুধু একটি চিন্তাবাত্যা ক্ষণে ক্ষণে তাঁর মুমূর্ষ প্রদীপশিখাকে বিতাড়িত করছে। শিষ্যেরা বুঝতে পেরে সবিনয় জিগ্যেস করলে, সেবাতে কোনও ত্রুটি হচ্ছে কি না।

গুরু বললেন, ‘না। ইহলোক ত্যাগ করতে আমার কোনও ক্ষোভ নেই। আমার মাত্র একটি ভাবনা। আমার মৃত্যুর পর আমার কাজের ভার কে নেবে?’

শিষ্যেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তাঁর চরিত্রবল কে পেয়েছে, তাঁর বক্তৃতাশক্তি কার আছে যে এ কঠিন কাজ কাঁধে তুলে নেবে?

গুরু দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

এমন সময় অতি অজানা এক নতুন শিষ্য সামনে এসে বলল, ‘আমি এ ভার নিতে পারি।’

গুরুর বদনে প্রসন্নতার দিব্য জ্যোতি ফুটে উঠল। তবু ঈষৎ দ্বিধার কণ্ঠে শুধালেন, কিন্তু বৎস তোমাকে তো আমি চেনবার অবকাশ পাইনি। তুমি কি সত্যই এ কাজ পারবে? ওই দেখ, আমার দীর্ঘদিনের শিষ্যেরা সাহস না পেয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা দেখি, তুমি অমিতাভের জীবনের যেকোনো বিষয় নিয়ে একটি বক্তৃতা দাও তো।’

বিস্ময়! বিস্ময়!– সেই শিষ্য তখন গলা খুলে, গাধার মতো– হুবহু গাধার মতো চেঁচিয়ে উঠল। কিছু না, শুধু গাধার মতো চেঁচাল।

সবাই বাক্যহীন নিস্পন্দ।

ব্যাপার কী?

গুরুর মাত্র একটু সামান্য ত্রুটি ছিল। তিনি বক্তৃতা দেবার সময় অন্য বক্তাদের তুলনায়। একটু বেশি চিৎকার করে কথা বলতেন, উঁইফোড় শিষ্য ভেবেছে ভালো করে চেঁচাতে পারাতেই উত্তম বক্তৃতার গূঢ় রহস্য। ওই কর্মটি সে করতে পারলে তাবৎ মুশকিল হবে। আসান। তাই সে চাঁচানোর চ্যাম্পিয়ন রাসভরাজের মতো চেঁচিয়ে উঠেছে।

আমার গুরুদেবের পিতৃতুল্য অগ্রজ সত্যদ্রষ্টা, প্রাতঃস্মরণীয় ঋষি দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেছেন,

‘To imitate-এর বাঙলা, অনুকরণ।

To ape-এর বাংলা, হনুকরণ।’

এস্থলে রাসভকরণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *