॥ ৭ ॥
কৈলাস থেকে ফেরার পথে ফেলুদার হঠাৎ কেন জানি গেস্ট হাউসে যাবার ইচ্ছে হল। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘একবার খোঁজ করে আসি এখানে খবরের কাগজ আসে কি না।’ আমরা বাংলোয় চলে গেলাম। আমাদের দুজনেরই খিদে পাচ্ছিল, তাই লালমোহনবাবু চৌকিদারকে হাঁক দিয়ে চা আর বিস্কুট অর্ডার দিলেন। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেই ডাইনিং রুম। তার ডান দিকের এক নম্বরের ঘরটা আমাদের। আমাদের পরের ঘরটা দু নম্বর, সেটা খালি। ডাইনিং রুমের উলটো দিকে আরও দুটো ঘর। তার মধ্যে আমাদের ঠিক উলটো দিকের ঘরটায় থাকেন এলাহাবাদি, আর তার পাশের চার নম্বরে ফেলুদা।
আগেই বলেছি, লালমোহনবাবুকে মাঝে মাঝে গোয়েন্দাগিরিতে পেয়ে বসে। ওঁর এখন বোধ হয় সেই রকম একটা মেজাজ এসেছে। ঘরে বসে চা খেতে খেতে বললেন, ‘সাহেবকে না হয় ছেড়েই দিলাম; অন্য যে তিনজন আছে তার মধ্যে দুজনের বিষয় তো তবু কিছু জানা গেছে—সত্যি হোক মিথ্যে হোক—কিন্তু আমাদের বাংলোর বাবুটির তো নাম পর্যন্ত জানা যায়নি। ওঁর ঘরটায় একবার উঁকি দিয়ে এলে হত না? মনে হল দরজায় চাবি লাগায়নি!’
আমার আইডিয়াটা ভাল লাগছিল না, তাই বললাম, ‘চৌকিদার যদি দেখে ফেলে!’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘আমি যাই, তুমি পাহারা দাও। চৌকিদার এদিকে আসছে মনে হলে গলা খাক্রানি দিলেই আমি চলে আসব। তোমার দাদার কাজ একটু এগিয়ে রাখতে পারলে উনি খুশিই হবেন। এলাহাবাদির সুটকেসটাও রীতিমতো ভারী বলেই মনে হল।’
আমি এরকম ব্যাপার কখনও করিনি। অন্তত ফেলুদা ছাড়া অন্য কারুর জন্য নয়। কিন্তু ব্যাপারটার মধ্যে একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ থাকায় শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম। আমি চলে গেলাম পিছনের বারান্দায়। সামনে একটা খোলা জায়গার পরেই বাবুর্চিখানার পাশে চৌকিদারের ঘর। চৌকিদারের একটা সাইকেল আছে আগেই দেখেছি, এখন দেখলাম তার দশ বারো বছরের ছেলেটা খুব মন দিয়ে সেটাকে পরিষ্কার করছে। একটা ক্যাঁচ শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আড় চোখে দেখলাম, লালমোহনবাবু চোরের মতো তিন নম্বর ঘরে ঢুকলেন। মিনিট তিনেক পরে আমার বদলে উনিই একটা গলা খাক্রানি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে ওঁর তদন্তের কাজ শেষ। ঘরে ফিরে যেতে ভদ্রলোক বললেন, ‘পুরনো সুটকেস, ভাবলুম হয়তো চাবি লাগে না, কিন্তু টান দিয়ে খুলল না। টেবিলের ওপর দেখলুম একটা চশমার খাপ—তাতে কলকাতার স্টিফেন কোম্পানির নাম, একটা সোডা মিন্টের বোতল, আর একটা ওডোমসের টিউব। আলনায় সবুজ ডোরা-কাটা শার্ট আর পায়জামা, মেঝেতে এক জোড়া পুরনো চটি—কোম্পানির নাম উঠে গেছে। এ ছাড়া আর কিছু—’
লালমোহনবাবুর কথা থেমে গেল। ফেলুদা প্রায় নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে।
‘কার জিনিসের ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছে?’
ওকে ব্যাপারটা বলতেই হল। ও কিন্তু শুনে বিশেষ রাগটাগ করল না, খালি বলল, ‘লোকটাকে সন্দেহ করবার কোনও কারণ ঘটেছিল কি?’
লালমোহনবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ‘কিছুই তো জানা যায়নি ওর সম্বন্ধে। এমন কী নামটাও না। এদিকে কী রকম ষণ্ডামার্কা চেহারা…একটা গ্যাঙের কথা বলছিলেন না?—তাই ভাবলুম, মানে…’
‘সন্দেহের কারণ না থাকলে এগুলো করতে যাওয়া অযথা রিস্ক নেওয়া। ভদ্রলোকের নাম আর এন রক্ষিত। সুটকেসের বাঁ ধারে ফ্যাকফেকে সাদা অক্ষরে লেখা, চোখ থাকলেই দেখা যায়। আপাতত এর বেশি জানার কোনও দরকার আছে বলে মনে করি না।’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘তা হলে বাকি রইল এক সাহেব।’
ফেলুদা বলল, ‘সাহেবের নাম স্যাম লইসন। এও ইহুদি, এও ধনী। নিউ ইয়র্কে এর একটা আর্ট গ্যালারি আছে।’
‘কী করে জানলে?’ আমি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘গেস্ট হাউসের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ হল। বেড়ে লোক। ডিটেকটিভ গল্পের পোকা। মূর্তি চুরির কথা কাগজে পড়ে অবধি দিন গুনছে কবে এইখানে সেই চোরের আবির্ভাব হবে।’
‘তোমার পরিচয় দিলে?’
ফেলুদা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে বলল, ‘ওকে হাতে রাখা দরকার। লোকটা অনেক হেলপ করতে পারবে। ভুললে চলবে না, মল্লিক গেস্ট হাউসে থাকে। সে নাকি অলরেডি বম্বেতে একটা কল বুক করেছিল, লাইন পায়নি।’
রাত্রে ডিনার আমরা চারজনে একসঙ্গে বসে খেলাম। ফেলুদা একটাও কথা বলল না। সেটা তার ছদ্মবেশের জন্য, না মাথায় কোনও চিন্তা ঘুরছে বলে, তা জানি না। মিস্টার রক্ষিত একবার লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ইন্ডিয়ান হিস্ট্রির কোনও বিশেষ পিরিয়ড নিয়ে তিনি চর্চা করেন কি না। তার উত্তরে লালমোহনবাবু অড়র ডালে ভেজানো হাতের রুটি চিবোতে চিবোতে বললেন যে পিরামিড নিয়ে তাঁর বিশেষ পড়াশুনো নেই, যদিও সেটা যে মিশরে রয়েছে সেটা তিনি জানেন। এতে রক্ষিত একটু থতমত খেয়ে আমার দিকে চাইলে আমি নিজের কানের দিকে দেখিয়ে লালমোহনবাবু যে কানে খাটো সেটা বুঝিয়ে দিলাম। এর পরে ভদ্রলোক আর ‘মেজো মামাকে’ কোনও প্রশ্ন করেননি।
খাওয়ার পরে আমি আর লালমোহনবাবু যখন বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়ালাম (ফেলুদা তার ঘরে চলে গিয়েছিল) তখন একটা ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে, আর টুকরো টুকরো মেঘের ফাঁক দিয়ে একটা ফিকে জ্যোৎস্না এসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কোত্থেকে জানি হাসনাহানা ফুলের গন্ধ আসছে, মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে, লালমোহনবাবু আ-আ-আ করে একটা ক্ল্যাসিক্যাল তান দিতে গিয়ে একদম বেসুরে চলে গেছেন, এমন সময় দেখলাম গেস্ট হাউসের দিক থেকে একজন লোক আমাদের দিকে আসছে। আরেকটু কাছে আসতেই চিনতে পারলাম। শুভঙ্কর বোস। জটায়ু গান থামিয়ে টান হয়ে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমার দাদা থাকলে ভাল হত।’
‘আপনারাও হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন দেখছি!’
শুভঙ্করবাবুর মধ্যে একটা উসখুসে ভাব লক্ষ করলাম। দুবার গলা খাকরালেন তিনবার পিছন দিকে চাইলেন, তারপর দুপা এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বললেন, ‘ইয়ে—আপনারা নীল শার্টপরা বাঙালি ভদ্রলোকটিকে চেনেন?’
এর কাছে লালমোহনবাবুর কালা সাজা চলবে না, কারণ আগে অনেক কথা হয়েছে। বললেন, ‘কই না তো। কেন, উনি কি আমাদের চেনেন বলে বললেন নাকি?’
শুভঙ্কর বোস আরেকবার পেছনদিকে দেখে বললেন, ‘লোকটি, মানে, পিকিউলিয়ার। বলছে এলোরায় প্রথম এল, আর্টে ইন্টারেস্টেড, অথচ কৈলাস দেখে একটিবার পর্যন্ত তারিফ করল না, আহা উহু করল না। আমি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এলাম, অথচ সেই প্রথমবারের মতোই থ্রিল অনুভব করলাম। ভালই যদি না লাগে তো আসাই বা কেন, আর ভান করাই বা কেন!’
আমরা দুজনে চুপ। এই কথাটাই কি বলতে এলেন ভদ্রলোক?
কাছেই একটা গাছ থেকে একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকতে আরম্ভ করেছে। ছোট্ট শহরটা মনে হচ্ছে এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে, অথচ বেজেছে মাত্র দশটা।
‘ইয়ে, ইদানীং খবরের কাগজ পড়েছেন?’ শুভঙ্কর প্রশ্ন করলেন।
‘কেন বলুন তো?’ জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন।
‘ভারতবর্ষের শিল্পসম্পদ নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে। মন্দির থেকে মূর্তি লোপাট হয়ে যাচ্ছে।’
‘সত্যি? খবরটা জানতুম না তো! কী অন্যায়! ছি ছি ছি।’
লালমোহনবাবুর অ্যাকটিং খুব পাকা নয়, তাই একটু অসোয়াস্তি লাগছিল। কিন্তু শুভঙ্কর বোসের সেদিকে লক্ষই নেই। আরেক পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘ভদ্রলোক কিন্তু গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে গেছেন!’
‘কোন ভদ্রলোক?’
‘মিস্টার মল্লিক।’
‘বেরিয়ে গেছেন?’
প্রশ্নটা আমরা দুজনে একসঙ্গে করলাম। সত্যি, ফেলুদার এখানে থাকা উচিত ছিল।
‘একবার যাবেন নাকি?’ শুভঙ্কর বোসের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
‘এখন? কোথায়?’ লালমোহনবাবুর গলা শুকিয়ে গেছে।
‘গুহার দিকে।’
‘গুহায় পাহারা নেই?’ লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
‘আছে, তবে চৌত্রিশটা গুহার জন্য মাত্র দুজন লোক। কাজেই বুঝতেই পারছেন…। আর ভদ্রলোক একটা ব্যাগ নিয়ে ঘোরেন—লক্ষ করেছেন তো? উনি আর আপনাদের বাংলোর হিপি-টাইপের লোকটি—দুজনেই ব্যাগ নিয়ে ঘোরেন। ওরও কিন্তু ভাবগতিক ভাল না। উনি কে সেটা জানতে পেরেছেন?
লালমোহনবাবু বিষম খেতে গিয়ে সামলে নিলেন।
‘উনি? উনি ফটোগ্রাফ তোলেন। ফার্স্ট ক্লাস ফটো। আমাদের দেখিয়েছেন। এলোরার ফটো তুলছেন। চুংকিং-এর কী একটা পত্রিকার জন্য।
বাংলো থেকে কে বেরোল? মিস্টার রক্ষিত। এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে টর্চ, গায়ে ঢাউস রেনকোট। ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর কানের কাছে এসে তারস্বরে ‘আফটার ডিনার ওয়ক এ মাইল!’—বলে হেসে গেস্ট হাউসের দিকে চলে গেলেন।
শুভঙ্কর বোসও ‘গুড নাইট’ বলে রক্ষিতের পথ ধরলেন। লালমোহনবাবু ভ্রূকুটি করে বললেন, ‘এক মাইল হাঁটতে বললে কেন বলো তো লোকটা?’
আমি বললাম, ‘ভাল হজম হবে বলে। …চলুন, এখন তো বাংলো খালি, একবার ফেলুদার খোঁজ করা যাক। ওকে খবরগুলো দেওয়া দরকার। এরা সবাই গুহার দিকে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।’
একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে বাংলোয় ঢুকলাম। মিস্টার বোস সত্যি বললেন কি মিথ্যে বললেন জানি না, কিন্তু আমার মন বলছে একবার গুহার দিকে যাওয়া উচিত। যদি কিছু ঘটে তা হলে রাত্রেই ঘটবে। এখনও আলো রয়েছে, গুহার আশেপাশে কেউ ঘোরাফেরা করলে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে।
বাংলোর ভিতরে অন্ধকার। বাইরের চৌকিদারের ঘরে বোধহয় একটা লণ্ঠন জ্বলছে। আর কোথাও আলো নেই। কোনও শব্দও নেই।
রক্ষিতের ঘরের দরজা বন্ধ থাকবে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু ফেলুদার দরজাও বন্ধ কেন? আর দরজার তলার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে না কেন? ও কি এই সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?
বারান্দার দিকে ঘরের জানালা। পা টিপে টিপে গেলাম সেদিকে। জানালার পর্দা টানা। এগিয়ে গিয়ে পর্দা ফাঁক করে দুবার চাপা গলায় ফেলুদার নাম ধরে ডাকলাম। কোনও উত্তর নেই। ও যদি বেরিয়েও থাকে, সামনের দরজা দিয়ে বেরোয়নি সেটা আমরা জানি। তা হলে কি চৌকিদারের ঘরের পাশে খিড়কি দরজাটা দিয়ে বেরোল?
আমরা দুজন আমাদের ঘরে ফিরে এলাম। বাতিটা জ্বালাতেই জানালার সামনে মেঝেতে পড়ে থাকা কাগজটা দেখতে পেলাম। তাতে ফেলুদার হাতে লেখা দুটো কথা—
‘ঘরে থাকিস।’
‘একটা কথা বলব তোমায়?’ লালমোহনবাবু বললেন। ‘এবার কিন্তু তোমার দাদাটিই আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছেন। আমি তো এমনিতে আর বিশেষ কোনও রহস্য খুঁজে পাচ্ছি না, তবে তোমার দাদার কার্যকলাপ পদে পদে রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে।’
ফেলুদা ঘরে থাকতে বলেছে, কিন্তু কখন ফিরবে সেটা বলে যায়নি। অথচ ও যতক্ষণ না ফেরে ততক্ষণ ঘুমোনোর কোনও কথাই ওঠে না। কী আর করি—আধ ঘণ্টা কোনওরকমে লালমোহনবাবুর সঙ্গে কাটাকুটি খেলে কাটিয়ে দিলাম। তারপর লালমোহনবাবু বললেন যে ওঁর লেটেস্ট গল্পের প্লটটা আমায় বলবেন। —‘এবার একটা নতুন রকমের ফাইট ইন্ট্রোডিউস করিচি যাতে হিরোর হাত-পা বাঁধা রয়েছে—কিন্তু তাও শুধু মাথা দিয়ে ভিলেনকে ঘায়েল করে দিচ্ছে।’
মাথা দিয়ে মানে বুদ্ধি দিয়ে না মাথার গুঁতো দিয়ে সেটা জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় দেখি ফেলুদা হাজির। আমরা দুজনেই চুপ, কারণ জানি ও নিজে থেকে কিছু বলতে চাইলেই বলবে, জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হবে না।
ফেলুদা গম্ভীর গলায় বলল, ‘লালমোহনবাবু, অন্যান্যবারের মতো এবারও কি আপনার সঙ্গে কোনও অস্ত্র আছে নাকি?’
এখানে বলে রাখি লালমোহনবাবুর অস্ত্র সংগ্রহ করার বাতিক আছে। সোনার কেল্লার ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে একটা ভূজালি ছিল, আর বাক্স-রহস্যের ব্যাপারে ছিল একটা বুমেরাং। ফেলুদার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোকের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল। বললেন, ‘এবার আছে একটা বম্ব!’
‘বম্ব?’ আমি আর ফেলুদা একসঙ্গে প্রশ্ন করে উঠলাম। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না।
‘বম্ব। বোমা।’
লালমোহনবাবু তাঁর সুটকেসের দিকে এগিয়ে গেছেন। —‘আমাদের পাড়ার দ্বিজেন তরফদারের ছেলে উৎপল আর্মিতে আছে। সে মার্চ মাসে এসেছিল। এইটে আমায় এনে দিয়ে বললে—কাকাবাবু দেখুন আপনার জন্য কী এনিচি! বড় বড় যুদ্ধে ব্যবহার হয়। —ছোঁড়া আমার লেখার খুব ভক্ত।’
একটা মাঝারি সাইজের টর্চলাইটের মতো লম্বা খয়েরি রঙের একটা বেশ ভারী পাইপ জাতীয় জিনিস লালমোহনবাবু সুটকেস থেকে বের করে ফেলুদার হাতে দিলেন। ফেলুদা সেটা কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে দেখে বলল, ‘এটা আমার কাছেই থাক। আপনার পক্ষে জিনিসটা বড় বেশি ডেঞ্জারাস।’
‘কত মেটাগন হবে বলুন তো?’
কথাটা আসলে মেগাটন, আর সেটা ব্যবহার হয় অ্যাটমবোমা সম্পর্কে। এক মেগাটন মানে দশ লক্ষ টন। ফেলুদা লালমোহনবাবুর প্রশ্নে কান না দিয়ে বোমাটা ঝোলায় পুরে বলল, ‘একবার বেরোনো দরকার। সবাই বেরিয়েছে, আমাদের ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।’
ডাক বাংলো থেকে যখন বেরোলাম তখন সাড়ে এগারোটা। ঝিঁঝিঁটা এখনও ডাকছে। চাঁদের আলো কমছে-বাড়ছে, কারণ আকাশ টুকরো টুকরো চলন্ত মেঘে ছেয়ে গেছে। গেস্ট হাউসের একটা ঘরে দেখলাম আলো জ্বলছে। সেটা নাকি সেই আমেরিকানের ঘর। কে কোন ঘরে থাকে সেটাও নাকি ফেলুদা ম্যানেজারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। মল্লিক আর শুভঙ্কর ফিরেছে কি না বোঝা গেল না।
কিছুক্ষণ থেকেই ঘন ঘন মেঘ ডাকছিল; যখন বড় রাস্তার উপর এসে পড়েছি তখন একটা বড়রকম গর্জন শুনে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি পুব দিকটা কালো হয়ে আসছে। ‘এই মরেছে! বৃষ্টি আসবে নাকি?’ বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।
‘এত গুহা থাকতে বৃষ্টি এলে আশ্রয়ের অভাব হবে না’, বলল ফেলুদা।
কৈলাসের দিকে উঠে গিয়ে মন্দিরে ঢোকার কোনও চেষ্টা না করে ফেলুদা বাঁ দিকের পথ ধরল। কিন্তু সে পথেও বেশি দূর না। খানিকটা গিয়েই সে দেখি পথ ছেড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করেছে। ওর কায়দাকানুন একটু আধটু জানি বলে আন্দাজ করলাম যে সামনের দিক দিয়ে ছাড়া গুহায় ঢোকার কোনও রাস্তা আছে কি না সেটাই ও একটু ঘুরে দেখতে চাইছে। আশেপাশে ঝোপঝাড় আর পাথরের টুকরো, কিন্তু এখনও চাঁদের আলো থাকায় সেগুলো কোনও বাধার সৃষ্টি করছে না।
এইবার ফেলুদা ডান দিকে মোড় নিল। বুঝলাম যে-দিক থেকে এসেছি সেদিকেই ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু রাস্তা দিয়ে নয়; পাহাড়ের গা দিয়ে—রাস্তা থেকে অনেকটা ওপরে।
খানিকটা গিয়েই ফেলুদা হঠাৎ থেমে গেল। তার দৃষ্টি ডান দিকে। আমরা থেমে সেইদিকে দেখলাম।
দূরে পশ্চিম দিকে ঠিক যেন মনে হচ্ছে জমির উপর একটা সিল্কের ফিতে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। আসলে সেটা শহরে যাবার রাস্তা, চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে।
সেই রাস্তা দিয়ে একজন লোক দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে গেস্ট হাউসের দিকে। অথবা বাংলোর দিকে। কারণ রাস্তা একটাই।
‘মিস্টার রক্ষিত নন’, ফিসফিস করে বললেন লালমোহনবাবু।
‘কী করে বুঝলেন?’ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
‘রক্ষিতের গায়ে রেনকোট ছিল।’
কথাটা ঠিকই বলেছেন লালমোহনবাবু।
লোকটা একটা মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা আবার এগিয়ে চললাম।
খস্স্…খস্স্…খস্স্…খস্স্…
একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনে আমরা তিনজন আবার থেমে গেলাম। কোত্থেকে আসছে আওয়াজটা?
ফেলুদা বসে পড়ল। আমরাও। সামনে একটা প্রকাণ্ড মনসার ঝোপ। সেটা আমাদের আড়াল করে রেখেছে।
আওয়াজটা আরও কিছুক্ষণ চলে থামল। তারপর সব চুপ।
এ কী—চারদিক হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল কেন? আকাশের দিকে চেয়ে দেখি সেই কালো মেঘটা চাঁদটাকে ঢেকে ফেলেছে। আমরা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম। খানিকটা হাঁটার পর ডানদিকে কৈলাসের খাদটা পড়ল। খাদের পাশেই…ওই যে মন্দির। মন্দিরের চুড়ো এখন আমাদের সঙ্গে সমান লেভেলে। চুড়োর পিছনে বেশ খানিকটা নিচুতে একটা ছাত—তার মাথায় চারটে সিংহ চারিদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওই যে নীচে দূরে হাতি দুটো দেখা যাচ্ছে।
আমরা আরও এগিয়ে চললাম। আওয়াজটা এদিক থেকেই এসেছে সেটা বুঝেছিলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না। হয়তো আছে, অন্ধকার বলে দেখা যাচ্ছে না। আমি জানি ফেলুদা টর্চ জ্বালাবে না, কারণ তা হলে অন্য লোক আমাদের কথা জেনে যাবে।
কৈলাসের খাদের পর কিছু দূর গিয়ে আরেকটা খাদ। এটা পনেরো নম্বর গুহা। সেটা ছাড়িয়ে তার পরের গুহাটার দিকে এসেছি। এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ থেমে টান হয়ে গেল। তারপর ফিসফিস কথা—
‘টর্চ জ্বেলেছে। পনেরো নম্বর গুহার ভিতরে। তার ফলে গুহার বাইরের আলোটা একটু বেড়েছে।’
আমি ব্যাপারটা লক্ষ করিনি। লালমোহনবাবুও না। ফেলুদার চোখই আলাদা।
দু মিনিট প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ফেলুদা একটা ব্যাপার করল। একটা ছোট্ট নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে সেটাকে ওপর থেকে গুহার সামনের চাতালটায় ফেলল। টুপ করে একটা শব্দ পেলাম।
তারপর বুঝতে পারলাম চাতালটা হঠাৎ যেন আরও বেশি অন্ধকার হয়ে গেল। তার মানে টর্চটা নিভল। আর তার পরেই একটা লোক নিঃশব্দে চোরের মতো গুহা থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেল।
‘মিস্টার রক্ষিত না’, আবার ফিসফিস করে বললেন লালমোহনবাবু। লোকটাকে চিনতে না পারলেও, তার গায়ে যে রেনকোট নেই সেটা আমিও বুঝেছিলাম।
এরপর এল আমার জীবনের সবচেয়ে লোমখাড়া করা সময়। ফেলুদা ইতিমধ্যে নীচে যাবার একটা রাস্তা বার করে ফেলেছে। রাস্তা না বলে বোধ হয় উপায় বলা উচিত। খানিকটা লাফিয়ে, খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে, খানিকটা বাঁদরের মতো ঝুলে, খানিকটা মাটির উপর ঘসটে, সে দেখতে দেখতে নীচে গুহার সামনেটায় পৌঁছে গেল। লালমোহনবাবু চাপা গলায় বললেন, ‘গোয়েন্দাগিরিতে ফেল করলে সার্কাসের চাকরি বাঁধা।’ পরমুহূর্তেই দেখলাম সে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মানে গুহার ভিতর ঢুকেছে। আমার কিন্তু ঘাম ছুটে লোমটোম খাড়া হয়ে গেছে।
প্রায় তিন মিনিট (মনে হচ্ছিল তিন ঘণ্টা) পরে আবার দেখতে পেলাম ফেলুদাকে। তারপর আরম্ভ হল উলটো কসরত। উপর থেকে নীচের বদলে নীচের থেকে উপরে। এক হাতে টর্চ কাঁধে ব্যাগ আর কোমরে রিভলভার নিয়ে কীভাবে এরকম ওঠা নামা সম্ভব তা ও-ই জানে। উপরে উঠে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এটার নাম দশাবতার গুহা। দোতলা। দুর্দান্ত সব মূর্তি আছে। লোভনীয়।’
‘লোকটা কে ছিল বুঝলে?’—ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
ফেলুদার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘যত সহজ ভাবছিলাম, তা নয়। প্যাঁচ আছে। রহস্য আছে। মাথা খাটাতে হবে।’
পাহাড় থেকে নেমে এসে বুঝলাম তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। ফেলুদা কৈলাসের সামনে গিয়ে পাহারাদারের সঙ্গে দেখা করল। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল সে গত ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোনও গোলমেলে ব্যাপার লক্ষ করেনি। অবিশ্যি ও যেখানে পায়চারি করছে সেখান থেকে খাদের উপরটা দেখা যায় না; মন্দিরের চুড়োয় ঢাকা পড়ে।
‘কোনও শব্দ-টব্দ শোনোনি?’—ফেলুদা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল।
না, শব্দও শোনেনি। এমনিতেই মেঘ ডাকছে ঘন ঘন, শব্দ কী করে শুনবে?
‘একবার মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখতে পারি?’
জানতাম লোকটা না বলবে, আর বললও তাই।
‘নেহি বাবু, অর্ডার নেহি হ্যায়।’
ফেরার পথে বাংলোর কাছাকাছি এসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। আমরা আসছিলাম পুব দিক দিয়ে। বাংলোর পুব দিকের দেয়ালে দুটো জানালা রয়েছে—একটা রক্ষিতের ঘরের, একটা ফেলুদার ঘরের। ফেলুদার ঘরটা অন্ধকার। কিন্তু রক্ষিতের ঘরের ভেতর একটা আলোর তাণ্ডব চলেছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে সেটা টর্চের আলো, কিন্তু সেটা কেন যে পাগলের মতো এদিক ওদিক করছে সেটা বোঝা মুশকিল। একবার আলোটা জানালার কাছে এল। বুঝলাম সেটা গেস্ট হাউসের দিকে ফেলা হচ্ছে। আলোটা ঝোপঝাড়ের উপর ঘোরাফেরা করে আবার ঘরে ফিরে গেল। ফেলুদা চাপা গলায় মন্তব্য করল, ‘হাইলি ইন্টারেস্টিং।’
আমরা নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম বাংলোর দিকে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।