কৈলাসে কেলেঙ্কারি – ২

॥ ২ ॥

দুর্ঘটনার কথা বলার আগে আরেকটা জরুরি কথা বলা দরকার। সিধুজ্যাঠার আন্দাজ যে ঠিক সেটা পরদিনের আনন্দবাজারেই জানা গেল। আমিই প্রথম পড়লাম খবরটা—

মস্তকহীন যক্ষী

ভারতীয় স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ভুবনেশ্বরের রাজারাণী মন্দিরের গাত্র থেকে একটি যক্ষীমূর্তির মস্তকাংশ অপহৃত হয়েছে। সেই সঙ্গে মন্দিরের প্রহরীটিকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ওড়িশার প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এ ব্যাপারে পুলিশি তদন্তের আয়োজন করেছে বলে জানা গেল।

খবরটা পড়ে ফেলুদাকে বললাম, ‘তার মানে পাহারাদারই মাথাটা চুরি করেছে?’

ফেলুদা তার ফরহ্যানসের টিউবটা টিপে আধ ইঞ্চি পেস্ট বার করে ব্রাশের উপর চাপিয়ে বলল, ‘এ চুরি কি আর পাহারাদারে করে? গরিব লোকের অত সাহস হয় না। চুরি করেছে ভদ্রলোকে। সে মোটা ঘুষ দিয়েছে প্রহরীকে, প্রহরী তাই আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে।’

সিধুজ্যাঠা নিশ্চয়ই খবরটা পেয়েছে। আমার মন বলছিল যে তাঁর আন্দাজ ঠিক হয়েছে জেনে তিনি নিশ্চয়ই সদর্পে সেটা ঘোষণা করতে আসবেন। শেষ পর্যন্ত এলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা চার ঘণ্টা পরে, সাড়ে দশটার সময়। আজ বিষ্যুদবার, নটা থেকে আমাদের বাড়ির বিজলি বন্ধ হয়ে গেছে, এদিকে আকাশে মেঘ করে গুমোট হয়ে রয়েছে, বৈঠকখানায় বসে ঘামছি, এমন সময় দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা। দরজা খুলতেই আবার সেই হুমড়ি দিয়ে ভেতরে ঢোকা, চায়ের হুকুম, আর পরক্ষণেই ধপ্ করে সোফায় বসা। ফেলুদা ভুবনেশ্বরের কথাটা উচ্চারণ করতেই তিনি এক দাবড়ানিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ও সব ছাড়ো। ওগুলো ফালতু কথা। রেডিয়ো শুনেছ?’

‘কই না তো। আসলে আজ—’

‘জানি। বিষ্যুদবার। অথচ তাও একটা ট্রানজিস্টার কিনবে না। যাক্‌গে…সাংঘাতিক খবর। কাঠমান্ডুর প্লেন ক্র্যাশ করেছে। কলকাতার কাছেই। এক ঘণ্টা ডিলে ছিল। সাড়ে সাতটায় মাটি ছেড়েছে, ফিফ্‌টিন মিনিটসের মধ্যে ক্র্যাশ করেছে। ঝড়ে পড়েছিল। বোধহয় ফিরে আসবার চেষ্টা করছিল। কার সারারাত কীরকম ঝোড়ো বাতাস ছিল সে তো জানই। আটান্নজন যাত্রী, অল ডেড। মার্কিন ব্যাঙ্কার সল সিলভারস্টাইন তার মধ্যে ছিলেন সে কথা রেডিয়োতে বলেছে।’

খবরটা শুনে আমরা দুজনেই একেবারে থ। ফেলুদা বলল—‘কোথায় ক্র্যাশ করেছে? জায়গার নাম বলেছে?’

‘সিদিকপুর বলে একটা গ্রামের পাশে। হাসনাবাদের দিকে। ফেলু, মনে মনে প্রার্থনা করছিলুম সে মূর্তি যেন দেশ ছেড়ে না যায়। সে প্রার্থনা যে এমনভাবে মঞ্জুর হবে তা কি আর জানতাম?’

ফেলুদা হাতের রিস্টওয়াচের দিকে দেখল। সে কি সিদিকপুর যাওয়ার মতলব করছে না কি?

সিধুজ্যাঠারও কেমন যেন তটস্থভাব। বললেন, ‘আমি যা ভাবছি, তুমিও নিশ্চয় সেই কথাই ভাবছ। প্লেন মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা এক্সপ্লোশন হয়। যাত্রীর সঙ্গে তার ভেতরের জিনিসপত্রও চারদিকে ছিটকে পড়ে। যেমন সব ক্র্যাশেই হয়। সেই জিনিসপত্রের মধ্যে যদি……’

ফেলুদা দু মিনিটের মধ্যে ঠিক করে ফেলল যে প্লেন যেখানে ক্র্যাশ করেছে সেখানে গিয়ে খোঁজ করবে যক্ষীর মাথাটা পাওয়া যায় কি না। তিন ঘণ্টা হল ক্র্যাশটা হয়েছে, যেতে লাগবে ঘণ্টা দেড়েক। এর মধ্যে নিশ্চয়ই এয়ারলাইনের লোক, দমকল, পুলিশ ইত্যাদি সেখানে গিয়ে তাদের কাজকর্ম খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করে দিয়েছে। আমরা গিয়ে কী দেখতে পাব জানি না; তবু যাওয়া দরকার। সুযোগ যখন আশ্চর্যভাবে এসে গেছে তখন সেটার সদ্ব্যবহার না করার কোনও মানে হয় না।

সিধুজ্যাঠা বললেন, ‘ছবিগুলো বিক্রি করে আমার হাতে কিছু কাঁচা টাকা এসেছে। আমি তার থেকে কিছুটা তোমাকে দিতে চাই। আফটার অল, আমার কথাতেই তো তোমাকে এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে, সুতরাং—’

‘শুনুন, সিধুজ্যাঠা’, ফেলুদা বাধা দিয়ে বলল, ‘প্রস্তাবটা আপনার কাছ থেকে এসেছে ঠিকই, কিন্তু আমি যদি নিজে এ ব্যাপারে উৎসাহ বোধ না করতাম তা হলে এগোতাম না। আমি কাল রাত্রে এ নিয়ে অনেক ভেবেছি, আর যত ভেবেছি ততই মনে হয়েছে যে, আপনার কথাটা ষোলো আনা সত্যি। দেশের মন্দিরের গা থেকে মূর্তি ভেঙে নিয়ে যারা বিদেশিদের বিক্রি করে, তাদের অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই।’

‘ব্রাভো!’ সিধুজ্যাঠা চেঁচিয়ে উঠলেন। —‘তবে একটা কথা বলে রাখি। আর্থিক না হলেও, অন্যরকম হেলপ তোমার লাগতে পারে। হয়তো আর্টের ব্যাপারে কোনও তথ্য জানার দরকার হতে পারে। তার জন্য আমার কাছে আসতে দ্বিধা কোরো না। যদি সম্ভব হয়, তুমি নিজেও একটু আর্ট নিয়ে পড়াশুনা করে ফেলো—তা হলে উৎসাহটা আরও বেশি পাবে।’

ঠিক হল মাথাটা যদি পাওয়া যায় তা হলে সেটা সোজা আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভের আপিসে গিয়ে জমা দিয়ে আসা হবে। কে চুরি করেছিল সেটা জানা না গেলেও, অন্তত চোরাই জিনিসটা তো উদ্ধার হবে।

ঝড়ের স্পিডে তৈরি হয়ে নিয়ে একটা হলদে ট্যাক্সিতে চেপে আমরা যখন সিদিকপুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম তখন ঠিক এগারোটা বাজতে পাঁচ। ফিরতে হয়তো বেলা হবে, এদিকে খাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই—আমাদের বাড়িতে একটার আগে খাওয়া হয় না—তাই ঠিক হল ফেরার পথে যশোহর রোডে কোনও একটা পাঞ্জাবি দোকানে খেয়ে নেওয়া যাবে। ওদিক দিয়ে লরি যাতায়াত করে। লরির লোকেরা এইসব দোকানে খায়। রুটি, মাংস, তড়কা—দেখেই জিভে জল আসে। ফেলুদাকে দেখেছি ও সবরকম খাওয়াতে অভ্যস্ত। ওর দেখাদেখি আমিও সেই অভ্যাসটা করে নিতে চেষ্টা করছি।

কলকাতার ভিড় ছাড়িয়ে ভি আই পি রোডে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তারপর দমদম ছাড়াবার কিছু পরেই মেঘ সরে গিয়ে রোদ উঠল। হাসনাবাদ কলকাতা থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল। যশোহর রোড দিয়েই যেতে হয়। আমাদের ড্রাইভার বললেন রাস্তা পিছল না থাকলে এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে দিতেন। —‘ওদিকে একটা প্লেন ক্র্যাশ হয়েছে জানেন তো স্যার? রেডিয়োতে বলল।’

ফেলুদা যখন বলল যে ওই ক্র্যাশের জায়গাতেই আমরা যাচ্ছি, তখন ভদ্রলোক ভারী উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আপনার রিলেটিভ কেউ ছিল নাকি স্যার প্লেনে?’

‘আজ্ঞে না।’

ফেলুদার পক্ষে ব্যাপারটা খুলে বলা মুশকিল, অথচ ড্রাইভারবাবুর কৌতূহল মেটে না।

‘সব তো পুড়ে ঝামা হয়ে গেচে শুনলাম। কিছু কি আর দেখতে পাবেন গিয়ে?’

‘দেখা যাক।’

‘আপনি কোনও সাংবাদিক-টাংবাদিক বোধহয়?’

‘আজ্ঞে না।’

‘তবে?’

‘গপ্পো-টপ্পো লিখি আর কী।’

‘অ। দেখে-টেখে সব নোট-টোট করে পরে বইয়ে-টইয়ে লাগিয়ে দেবেন।’

বারাসত ছাড়িয়ে মাইল দশেক যাবার পর থেকেই আমরা মাঝে মাঝে থেমে রাস্তার লোকের কাছ থেকে সিদিকপুরের নির্দেশ নিচ্ছিলাম। শেষটায় একটা বাজার টাইপের জায়গায় এসে একটা সাইকেলের দোকানের সামনে দাঁড়ানো কয়েকজন লোককে জিজ্ঞেস করতেই তারা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল যে আর দু মাইল গেলেই বাঁ দিকে একটা কাঁচা রাস্তা পড়বে, সেটা ধরে মাইল খানেক গেলেই সিদিকপুর। এদের হাবভাবে বোঝা গেল এরা অনেককেই আগে রাস্তা বাতলে দিয়েছে।

কাঁচা পথটা একেবারেই গেঁয়ো। মাঝে মাঝে জল জমেছে, আর নানারকম টায়ারের দাগ পড়েছে কাদার উপর। ভাগ্যে এটা জুন মাস, সবে বর্ষা পড়েছে। আর এক মাস পরে হলেই এ রাস্তা দিয়ে আর গাড়ি যেত না। আজ সকালের বৃষ্টিটা যে এদিকেও হয়েছে সেটা মাঠঘাটের চেহারা দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। এই শান্ত পাড়াগাঁয়ের মাঝখানে একটা ফকার ফ্রেন্ডশিপ জেট প্লেন ক্র্যাশ করেছে ভাবতেও অবাক লাগছিল। ইতিমধ্যে আমাদের পাশ দিয়ে পর পর তিনখানা অ্যাম্বাসাডর মেন রোডের দিকে চলে গেল। পায়ে হাঁটা লোকও কিছু পথে পড়ল—কেউ যাচ্ছে, কেউ ফিরছে।

সামনে একটা মোড়ের মাথায় একটা বটগাছের ধারে বেশ ভিড়। একটু এগিয়ে কয়েকটা গাড়ি ও একটা জিপ রাস্তার ধারে দাঁড় করানো রয়েছে। আমাদের ট্যাক্সি সেই গাড়িগুলোর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। ক্র্যাশের কোনও চিহ্ন নেই, তাও বুঝতে পারলাম এখানেই আমাদের নামতে হবে। ডানদিকে কিছু দূরে একটা গাছপালায় ভর্তি জায়গা, তারও কিছু দূরে বাঁদিকে একটা গ্রামের ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম সেটাই নাকি সিদিকপুর। ক্র্যাশের জায়গা, কোথায় জিজ্ঞেস করাতে বলল, ‘ওই যে গাছগুলো দেখা যাচ্ছে, ওর পিছনে। একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন।’

আমাদের ড্রাইভার (নামটা জেনে গেছি—বলরাম ঘোষ) গাড়িতে চাবি দিয়ে চললেন আমাদের সঙ্গে ক্র্যাশ দেখতে। আমরা মাঠের মধ্যে হাঁটা পথ দিয়ে এগিয়ে গেলাম।

দূর থেকে যেটাকে বন বলে মনে হচ্ছিল, সেটা আসলে আট-দশটা বড় বড় আম কাঁঠাল তেঁতুল গাছ ছাড়া আর কিছুই না। সেগুলো পেরিয়েই একটা কলা বাগান, আর সেইখানেই যত কাণ্ড।

গাছের মধ্যে যেগুলো এখনও নেড়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো সব ঝলসে কালো হয়ে গেছে। ডানদিকে কিছু দূরে একটা নেড়া গাছ, ফেলুদা বলল সেটা শিমুল। তার বড় বড় ডালগুলো যেন তলোয়ারের কোপে কেটে ফেলা হয়েছে, আর যা দাঁড়িয়ে আছে তা পুড়ে ছাই। সমস্ত জায়গাটা লোকজন পুলিশ এয়ারপোর্টের কর্মচারীতে ভরে আছে, আর তাদের আশেপাশে প্রায় একশো গজ জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে ফকার ফ্রেন্ডশিপের ভগ্নাবশেষ। এখানে ডানার একটা অংশ, ওখানে ল্যাজের টুকরো, ওইদিকে আবার থুবড়োনো নাকের খানিকটা। তা ছাড়া ভাঙাছেঁড়া ফাটাফুটো দোমড়ানো মোচড়ানো পোড়া আধপোড়া সিকিপোড়া কত কী যে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। একটা অদ্ভুত কড়া গন্ধে চারিদিকটা ছেয়ে রয়েছে যেটার জন্য আমার নাকে রুমাল দিতে হল। ফেলুদা জিভ দিয়ে ছিক করে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল, ‘যদি আর ঘণ্টাখানেক আগেও আসতে পারতাম!’

আসলে, পুলিশ জায়গাটাকে ঘিরে ফেলেছে, তাই কাছে যাবার কোনও উপায় নেই।

আমরা অগত্যা ঘেরাও-করা জায়গাটার পাশ দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। পুলিশ মাটি থেকে জিনিস তুলে তুলে দেখছে। কোনওটাই আস্ত নেই, তবে ভাঙা বা আধপোড়া অবস্থাতেও অনেক জিনিস দিব্যি চেনা যাচ্ছে। একটা স্টেথোস্কোপের কানে দেবার অংশ, একটা ব্রিফ কেস, জলের ফ্লাস্ক, একটা বোধহয় হ্যান্ডব্যাগের আয়না—যেটা একটা পুলিশ হাতে নিয়ে এদিক ওদিক নাড়ার ফলে তার থেকে রোদের ঝিলিক বেরোচ্ছে।

আমাদের ডান দিকে ক্র্যাশের জায়গা, আমরা তার পাশ দিয়ে গোল হয়ে ঘুরে এগিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ বাঁ দিকের একটা আমগাছের দিকে চেয়ে থেমে গেল।

একটা ছেলে গাছের একটা নিচু ডালের উপর উঠে বসেছে, তার হাতে একটা কালসিটে পড়া সু-জুতো, যেটা নিশ্চয়ই চামড়ার ছিল, আর যেটা নিশ্চয়ই ছেলেটা এই জঞ্জালের মধ্যে থেকেই পেয়েছে।

ফেলুদা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল।

‘তোরা অনেক জিনিস পেয়েছিস এই জঞ্জাল থেকে, না রে?’

ছেলেটা চুপ। সে একদৃষ্টে ফেলুদার দিকে চেয়ে আছে।

‘কী হল? বোবা নাকি?’

ছেলেটা তাও চুপ। ফেলুদা ‘হোপলেস’ বলে এগিয়ে চলল ক্রাশের জায়গা ছেড়ে গ্রামের দিকে। বলরামবাবুর কৌতূহল আবার চাগিয়ে উঠেছে। বললেন, ‘আপনি কিছু খুঁজছেন নাকি স্যার?’

‘একটা লাল পাথরের মূর্তি’, ফেলুদা জবাব দিল,—‘শুধু মাথাটা।’

‘শুধু মাথাটা……হুঁ……’ বলে বলরামবাবু দেখি এদিক ওদিক ঘাসের উপর খোঁজা আরম্ভ করে দিয়েছেন।

আমরা একটা অশ্বথ গাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। গাছের তলায় একটা বাঁশের মাচা; তার উপর তিনজন আধবুড়ো বসে তামাক খাচ্ছে। যে সবচেয়ে বুড়ো সে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপন্যারা কোত্থিকে আয়লেন?’

‘কলকাতা। খুব জোর বেঁচে গেছে আপনাদের গ্রামটা!’

‘হাঁ তা গ্যাচে বাবু। আল্লার কৃপা ঘর-বাড়ি ভাঙেনি মানুষজন মরেনি—বাছুর একটা বাঁধা ছিল করিমুদ্দির সেডা মোরেচে আর আলম শ্যাখের—’

‘আগুন লাগল কখন?’

‘মাটিতে য্যামন পড়ল অমনি য্যামন বোম ফাটার শব্দ ত্যামন শব্দ আর দাউ দাউ করে আগুন আর ধোঁয়া গোটা গেরামটা ধোঁয়ায় ধোঁয়া। আর তারপর অ্যালো বৃষ্টি, দমকল অ্যালো—’

‘দমকল আসা অবধি আগুন জ্বলছিল?’

‘আগুন নেভেছে বৃষ্টির জলে।’

‘আপনি কাছাকাছি গিয়েছিলেন আগুন নেভার পর?’

‘আমি বুড়ো মানুষ আমার অতো কী গরজ…’

‘ছেলে ছোকরারা যায়নি? ওখান থেকে জিনিসপত্তর তুলে নেয়নি?’

বুড়ো চুপ। অন্য দুজনও উসখুস করছে। ইতিমধ্যে আট দশজন ছেলে জড়ো হয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছে। ফেলুদা তাদের একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর নাম কী রে?’

ছেলেটি ঘাড় কাত করে বলল, ‘আলি।’

‘এদিকে আয়।’

ফেলুদা নরম সুরে কথা বলছিল বলেই বোধহয় ছেলেটা এগিয়ে এল।

ফেলুদা তার কাঁধে হাত দিয়ে গলাটা আরও নামিয়ে বলল, ‘ওই ভাঙা প্লেনটা থেকে অনেক জিনিস ছড়িয়ে বাইরে পড়েছিল, জানিস তো?’

ছেলেটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

‘সেই সব জিনিসের মধ্যে একটা লাল পাথরের তৈরি মেয়েমানুষের মাথা ছিল। কুমোর যেমন মাথা গড়ে, সেইরকম মাথা!’

‘এই ও জানে।’

আলি আরেকজন ছেলের দিকে দেখিয়ে দিল। ফেলুদা একেও জিজ্ঞেস করল, ‘তোর নাম কী রে?’

‘পানু।’

ফেলুদা বলল, ‘আর কী নিয়েচিস তা আমার জানার দরকার নেই; মাথাটা ফেরত দিলে তোকে আমি বকশিশ দেব।’

পানুর মুখেও কথা নেই।

‘বাবু জিজ্ঞেস করচে জবাব দে—’, তিন বুড়োর এক বুড়ো ধমক দিয়ে উঠল।

‘ওর কাছে নেই।’

কথাটা বলল পানুরই বয়সী, মুখে বসন্তের দাগওয়ালা আরেকটি ছেলে।

‘কোথায় গেল?’ চাবুকের মতো প্রশ্ন করল ফেলুদা।

‘আরেকজন বাবু এসেচিল, তিনি চাইলেন, তাকে দিয়ে দিয়েচে।’

‘সত্যি কথা?’ ফেলুদা পানুর কাঁধ ধরে প্রশ্ন করল। আমার বুক ঢিপঢিপ করছে। পেতে পেতেও ফসকে যাবে যক্ষীর মাথা? পানু এবার মুখ খুলল।

‘একজন বাবু এলেন যে গাড়ি করে একটুক্ষণ আগে।’

‘কীরকম গাড়ি?’

‘নীল রঙের!’—তিন চারটি ছেলে একসঙ্গে বলে উঠল।

‘কীরকম দেখতে বাবু? লম্বা? রোগা? মোটা? চশমা পরা?…’

কৈলাসে কেলেঙ্কারি - ২

ছেলেদের বর্ণনা থেকে বোঝা গেল মাঝারি হাইটের ভদ্রলোক, প্যান্ট শার্ট পরা, রোগাও না মোটাও না ফরসাও না কালোও না, বয়স ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে; আমরা এসে পৌঁছানোর আধ ঘণ্টা আগে এসে একে তাকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে পানুর কাছ থেকে সামান্য কিছু বকশিশ দিয়ে একটা লাল পাথরের তৈরি মানুষের মাথা উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন। তার নীল রঙের গাড়ি।

আমরা যখন গ্রামের পথ দিয়ে গাড়িতে করে আসছিলাম তখন উলটো দিক থেকে একটা নীল রঙের অ্যাম্বাসাডরকে আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম।

‘চল তোপ্‌সে—আসুন বলরামবাবু!’

খবরটা শুনে ফেলুদা যদি হতাশও হয়ে থাকে, সে ভাবটা যে সে এর মধ্যে কাটিয়ে উঠে আবার নতুন এনার্জি পেয়ে গেছে সেটা তার ট্যাক্সির উদ্দেশে দৌড় দেখেই বুঝলাম। আমরাও দুজনে ছুটলাম তার পিছনে। কী আছে কপালে কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *