কেবলই ছায়া – ৭

সাত

মহীদা আয়নার সামনে বসেছিলেন। চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে চিরুনি হঠাৎ থেমে গেল। আমাকে ডাকলেন, খোকা এদিকে আয়। দ্যাখ তো এটা কী?

একটা পাকা চুল।

তোল তোল। সমূলে উৎপাটিত কর।

চুলটা তুলে তাঁর হাতে দিলুম। দু—আঙুলে ধরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ।

আর আছে? হ্যাঁরে, আর আছে?

ভালো করে দেখে বললুম, না, আর নেই।

ঠিক বলছিস?

সত্যিই আর নেই। পাশের দিকে ওই একটাই ছিল।

চিরুনি রেখে দু—আঙুলে চুলটা চোখের সামনে ধরে মহীদা অনেকক্ষণ স্থির হয়ে রইলেন। তারপর মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটল। নিজেকেই প্রশ্ন করলেন।

কত হল মহী?

নিজেই উত্তর দিলেন, মাত্র পঁয়ত্রিশ।

মাত্র? পঁয়ত্রিশটা বছর তোমার কাছে মাত্র? আর পাঁচ বছর পরে চল্লিশ। দশ বছর পরে পঞ্চাশ। কিছুই তো করা হল না! নিজের জন্যে তো কিছুই করা হল না! সঞ্চয় নেই, আয়োজন নেই, আলমগির! এবার তোমার কী হবে? যাদের জন্যে রাতের পর রাত নেচ্ছে—কুঁদেছ, তারা তোমায় দেখবে মহী? জানো না, বৃদ্ধ নট আর বিগতযৌবনা বেশ্যা পথের কুকুরের মতো অবহেলায় মরে।

আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, একটা পাকা চুলের জন্যে আপনি ভয় পাচ্ছেন? মাথায় তো এখনও আপনার অনেক চুল? তাছাড়া আপনি তো সবসময়েই পরচুল পরে অভিনয় করেন।

মহীদা চুলটা ফেলে দিলেন, বুঝলি খোকা, বার্ধক্য এক জন্তু। জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করেছে। চুলে তার উপস্থিতি। এইবার ধীরে ধীরে সে দেহে নামবে, নেমে আসবে মনে, চোখের দৃষ্টি মরে যাবে। নায়ক থেকে বৃদ্ধ : বৃদ্ধ শেষে বহিষ্কৃত। তখন কোথায় আমার জনপ্রিয়তা! কোথায় হাততালি! কোথায় পুষ্পবৃষ্টি! কে তখন আমাকে দেখবে? কে আমাকে খাওয়াবে? তুই আমাকে দেখবি খোকা?

নিশ্চয় দেখব। আপনি আমার বাবার মতো, কিন্তু আমার তো কিছু নেই!

তুই আমার উত্তরাধিকারী হবি?

কীসের উত্তরাধিকারী?

অভিনয়ের। না, তা হয় না রে, প্রতিভার উত্তরাধিকারী হওয়া যায় না। তোকে অন্য রাস্তা ধরতে হবে। কী সে রাস্তা। বড়ো তোকে হতেই হবে। খোকা, আগুন চাই আগুন। আগ্নেয়গিরির মতো বাঁচতে হবে। যে কটা দিন বাঁচা যায়। সেই গান।

মহীদা ভরাট গলায় গান ধরলেন,

দিন কি এমনি যাবে বিফলে।
তাকে ধরতে জানলে ধরা দেবে
মিছে ঘুরিস পথে পথে,
দিন কি এমনি যাবে বিফলে।।

কী নেই মহীদার! রূপ, অভিনয়ের ক্ষমতা, সেই সঙ্গে গান। বড়ো ওস্তাদের কাছে গান শিখেছিলেন অনেক দিন।

আমাকে গান শেখাবেন?

গান তুই বুঝিস? গানের কান আছে?

কী করে বলব? তবে গান শুনলে মনটা কেমন করে।

বেশ পরীক্ষা হয়ে যাক। আমি যে গানটা গাইলুম, তুই আমাকে গেয়ে শোনা।

প্রথমে আমার খুব লজ্জা করছিল। তারপর ভাবলুম পরীক্ষা হল পরীক্ষা। চোখ বুজিয়ে ধরে ফেললুম। দিন কি এমনি যাবে বিফলে। চারটে লাইন মহীদা যে ভাবে গেয়েছিলেন ঠিক সেই ভাবে গেয়ে চোখ মেলে তাকালুম। মহীদা অবাক হয়ে চেয়ে আছেন।

আয় কাছে আয়।

মহীদা আমার মাথায় হাত রাখলেন, তোর হবে। ভেতরে জিনিস আছে।

তুই শ্রুতিধর। মানুষ নিয়ে আসে বুঝলি? নিয়ে এসে দিয়ে যায়। সামান্য একটু ঘষামাজা। বটের বীজে বট থাকে, নিমের বীজে নিম। বটে নিম, নিমে বট হয় না। ঠিক আছে তোর তালিমের ব্যবস্থা করব। আমার সময় হবে না। তোকে আমি প্রথম থেকেই ভালো গুরুর কাছে ফেলে দেবো।

মহীদা উঠে পড়লেন। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। থিয়েটারে যাবার সময় হল। আজ আবার কম্বাইনড নাইট। হবে বঙ্গে বর্গি। অন্য স্টেজের বাঘা বাঘা অভিনেতা—অভিনেত্রীরা আসছেন।

থিয়েটার পাড়ায় আজ হইহই ব্যাপার। পোস্টারে পোস্টারে শহরের দেয়াল ভরে গেছে।

মায়ের সঙ্গে আমার আর তেমন যোগাযোগ হয় না। মা এখন সংসার নিয়ে বড়োই ব্যস্ত। মাসিমা আর রাধাদি আর মহীদা থাকলে মহীদাকে নিয়েই আমার দিন কাটে। সন্ধেবেলা রাধাদির সঙ্গে বসে বসে লুডো খেলি।

আমি এখন বৃদ্ধ। প্রায় অথর্ব। স্মৃতি ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসছে। তবু দূর অতীতের সেই সব মধুর সন্ধ্যার স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনি। রাধা যে বিধবা সে কথা জেনেছিলুম অনেক পরে। মাত্র এক বছর। এক বছর পরেই ফিরতে হয়েছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে সব মুছে ফেলে, সব ভেঙে ফেলে। স্বামী আত্মহত্যা করেছিল। কেন করেছিল? রহস্য রহস্যই থেকে গেছে। রাধার মতো মেয়ে হয় না। শান্ত। কথা বলে, কান পেতে শুনতে হয়। সব দিকে সজাগ দৃষ্টি। সেবাপরায়ণা। জীবনের সব দুঃখ হাসি দিয়ে মেজে রেখেছে। এমন মেয়ের জীবন শুরুতেই কেন শেষ হয়ে গেল? কে উত্তর দেবেন? বিধাতা! তিনি মানুষের কোন প্রশ্নের উত্তর দেন? কোন রহস্য তিনি সমাধান করেন? সমস্ত মানুষকে লাট্টুর মতো ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। পৃথিবী ঘুরছে, মানুষও ঘুরছে। যার যখন দম ফুরোচ্ছে কেতরে কোর্টের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমার গুরু অজ্ঞাতবাবা বলেছিলেন, প্রশ্ন কোরো না। বিশ্বাস কোরো। আমরা আছি না নেই সেই রহস্যেরই তো সমাধান পাওয়া গেল না। জগৎ এক দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্ন। ব্রহ্ম নিদ্রিত তাই জগৎ জাগ্রত। ঈশ্বরের যাবতীয় অবিচারের কথা তুললে, অজ্ঞাতবাবা হাসতেন, বলতেন, যা করে এসেছিস সবই তো ভুলে বসে আছিস। তোর পেছনে পড়ে আছে লক্ষ জন্ম, লক্ষ কর্ম। সামনেও তাই। এক জন্মের দেনাপাওনা এক জন্মে শেষ হয়ে যায় না বাবা। এই সত্যটি বুঝে নিয়ে সাবধানে এগিয়ে চলো। আগামী জন্মের ভিত তৈরি করো।

রাধাদি লুডোর ছক নাড়াতো খুটুর খুটুর শব্দে, আর আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকতুম। গোল গোল হাতে চুড়ি বাজছে ঠিনি ঠিনি। মানুষের হাত কত সুন্দর। এই সুন্দর হাতে মানুষ কেন পাপ কাজ করে! হাত তো দেবতার! হাত ছাড়া পৃথিবীর সব কাজই তো বন্ধ হয়ে যাবে। অজ্ঞাতবাবা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, মাঝে মাঝে নির্জনে নিজের কোলের ওপর হাত দুটোকে ফেলে রাখবি আলতো আলগোছে। তাকিয়ে থাকবি একদৃষ্টে। মনে মনে বলবি, এ হাত তোমার। তোমার কাছেই যেন ব্যস্ত থাকে সারাজীবন। হাত তুমি ময়লা স্পর্শ কোরো না। হাত নিজের উপার্জন ছাড়া অন্য কিছু স্পর্শ কোরো না। হাত তুমি সৃষ্টির, তুমি ধ্বংসের নও। হাত তুমি পূজার, অনাচারের নও। বলতে বলতে একেবারে বুঁদ হয়ে যাবি। এরপর দেখবি মনের অন্যায় নির্দেশ হাত আর শুনছে না। দেবী কেন দশভুজা? পুণ্যের হাত দ্বিভুজ থেকে দশভুজের শক্তি পায়। বিশ্বাস করে দেখ।

আমাকে ওইভাবে তাকাতে দেখে রাধাদি বলত, কি দেখিস বল তো অমন করে?

তোমার হাত, তোমার আঙুল।

কী আছে হাতে?

ভগবান।

রাধাদি হেসে ফেলত, তুই মহাগাপল। যেমন পুতুল পুতুল দেখতে। তুই এত সুন্দর হলি কী করে?

আমি সুন্দর? তোমার চেয়ে সুন্দর আর কে আছে? আমি তো বোকা, গবেট!

তুই সারাজীবন এমন বোকাই থাক। চালাক হয়ে দরকার নেই।

এই লুডো খেলার সঙ্গী, কীভাবে আমার জীবনখেলার সঙ্গী হয়ে উঠল। জীবন, তুমিই জানো কোথা থেকে কোথায় যাবে, কাকে জড়িয়ে নেবে চলার পথে। কোথা থেকে শুরু করে কোথায় গিয়ে মিলিয়ে যাবে!

এই রাত! উতলা পাহাড়ি বাতাস হুহু করে বয়ে আসছে। বাতাস? যেখানে কেউ নেই সেখানেও বইছ, যেখানে আছে সেখানেও প্রবাহিত। শ্মশানের চিতা কাঁপছে, সুন্দরীর আঁচল উড়ছে, চূর্ণকুন্তল উড়িয়ে আনছ কপালে, নটের উত্তরীয় উড়ছে। তুমি কৈশোর, যৌবন, জন্ম—মৃত্যু সব উড়িয়ে দিচ্ছ উদাসী খেয়ালে। তুমি যে জীবন! যখন যে দেহে বইছ, জীবনের বাঁশি বেজে উঠছে জীবনের সুরে। রাধাদির কথা মনে পড়লেই চলে যাই ওই পাহাড়ি নদীর ধারে। সাদা চুনাপাথরের গোল গোল নুড়ি ছড়িয়ে আছে চারপাশে প্রেতের ত্বকের মতো। কোথাও ঘাস নেই এতটুকু। কোনো গাছ নেই। দূরে দূরে পাহাড় বসে আছেন অটল ধ্যানে। রাশি রাশি শিলাখণ্ড একের পর আর এক, যেন যুগ যুগের মানুষের আশা—আকাঙ্ক্ষার টুকরো দিয়ে সাজানো ঘর অমোঘ নিয়তির অঙ্গুলি সঙ্কেতে ধসে পড়েছে। নিস্তব্ধ তারকাখচিত রাতের আকাশের তলায় জীবনের সেই এক সত্যের পীঠস্থান—এই হল জীবন, থাকে না, থাকে না কিছুই। সব একদিন শেষ হয়ে যায়। স্রোতধারার অস্ফুট বাণী কুলু কুলু স্বরে, বয়ে যাও, বয়ে যাও, জীবন হল বহতাপানি। চলো, চলো, চলে যাও। পথ পেলেই এগিয়ে যাও। প্রশ্ন কোরো না—চলেছি কোথায়?

সে ছিল শীতের রাত। বনস্থলিতে হিম কুয়াশার মায়াবী আঁচল ফাঁকে ফাঁকে উড়ছে পাহাড়ের মাথায় মেঘ মেলেছে জটায়ুর ডানা। রাধাদির শরীর পুড়ছে ধিকি ধিকি চিতার আগুনে। চুল পুড়ছে, পুড়ছে সেই সুন্দর দেহ, সেই গোল দুটি হাত, চাঁপার কলি আঙুল। আমরা আশ্রমবাসীরা স্তব্ধ হয়ে আছি। চোখের সামনে দেখছি জীবনের শেষ পরিণতি। মাঝে মাঝে সমস্বরে আমরা বলে উঠছি—হরি ওম। সমস্ত উপত্যকা কেঁপে কেঁপে উঠছে সেই শব্দে। অজ্ঞাতবাবা আমাকে বলেছিলেন, শব্দ হারায় না। শক্তি হারায় না। শক্তির রূপান্তর হয়। আমি চেষ্টা করি। বারেবারে ফিরে ফিরে আসি। মনে করি হয়তো একদিন বিদেহী রাধাদির সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। হয়তো হবে, যদি আমার ধৈর্য থাকে। অজ্ঞাতবাবা বলেছিলেন, তরঙ্গে তরঙ্গ মেলাতে পারলে সবই দেখা যায়, সবই শোনা যায়। দর্শন, শ্রবণ সবই সহজ হয়ে যায়।

এখন আমার অখণ্ড অবসর। জীবনের সব কাজ শেষ। অতীতকে মেলে দেখতে পারি। ভবিষ্যতে আমার জন্যে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নেই। বর্তমানের ভাবনা নেই। ফল যখন কাঁচা থাকে তখন তার পেকে ওঠার ভাবনা থাকে। পাকার আগে ঝরে পড়ার দুশ্চিন্তা থাকে। পাকা ফলের ভাবনা কীসের? মৃত্যুর নৈবেদ্য তো হবেই।

রাধাদি কী আমার মামাকে ভালোবেসেছিলেন? আমার সেই অদ্ভুত বাউণ্ডুলে মামাটিকে। মামা একদিন গাছপালা শেকড়বাকড় নিয়ে বাড়ি ঢুকছেন। রকে মহীদার তখন তেল মালিশ চলেছে। জিজ্ঞেস করলেন, কী হে কোথা থেকে অরণ্য নিয়ে এলে? বনমহোৎসব হবে না কি?

ডালপালা রকে ফেলে, মামা একপাশে বসে বললেন, আর ভাবনা নেই। তিন দিনের মধ্যে মাল বাজারে ছাড়ছি। হইহই হয়ে যাবে। কেউ আর আমাকে বাঁচতে পারবে না।

সে আমি জানি। অপঘাতেই তোমার মৃত্যু আছে। বাজারে ছাড়ার আগে নিজে খেয়ে দেখো। তাতেই যদি মুক্তি পাও তো বেঁচে গেলে, আর তা না হলে আড়ং ধোলাই। সে ধোলাই হজম করার ক্ষমতা তোমার হবে না বি টি এম। তুমি তো আর পকেটমার নও।

ক্লান্ত মামা আবার হাসলেন। ইশারায় রাধাদিকে বললেন, জল।

মামার যত আবদার সব রাধার কাছে। মাঝেমধ্যে ধারদেনাও হয়। সেসব ধার কোনোদিন শোধও হয় না। এই গাছপালাও মনে হয় রাধাদির পয়সায় কেনা। মামা খালি স্বপ্ন দেখেন। রোজই নতুন নতুন স্বপ্ন। বাড়ি হচ্ছে, গাড়ি হচ্ছে। অজ্ঞাতবাবা বলতেন, তুমি এক বৈদান্তিক। আত্মগোপন করে আছো। এ পৃথিবীতে তোমার মতো সুখী ক—জন আছে।

বড়ো বড়ো মাটির হাঁড়ি এসে গেল। সারা দুপুর কাটাই, ঝাড়াই, বাছাই, সেদ্ধ চলল। মা, মামা আর রাধাদি, তিনজনেরই দম ফেলার অবসর নেই। নানারকম গন্ধে বাড়ি ভরপুর। মাসিমা বলতে লাগলেন, না, ভবতারণ এবার ভালো লাইন ধরেছে। আহা! জনসেবা বড়ো ভালো কাজ। অক্ষয় পুণ্য হবে।

মহীদা একবার উঁকি মেরে গেলেন। কীসের ওষুধ দিয়ে শুরু করছ?

মালকোঁচা মারা ধুতি। গায়ে গেঞ্জি। কপালের পাশ দিয়ে ঘাম ঝরছে দরদর করে।

ওষুধ তো একটাই দাদা। সর্বরোগহর। ব্রহ্মাস্ত্র। সব রোগেরই তিনটি কারণ, বায়ু, পিত্ত, কফ। বায়ু যখন যেখানে প্রবল সেইখানেই বাত। যখন হৃদয়ে তখন হৃদরোগ। যখন মাথায় তখন পাগল। পিত্ত থেকে জ্বর, পেটের গোলমাল। কফ থেকে হাঁপানি। আর তিনটেই যখন বাঁকা তখন মৃত্যু। আমার এই এক ওষুধেই তিন শর্মা কাত।

তার আগেই তো তোমরা তিনজন কাত হয়ে যাবে। চেহারার যা অবস্থা দেখছি।

কাত কী দাদা? আমরা তিনজনেই ক্রমশ চাঙ্গা হয়ে উঠছি স্রেফ গন্ধে।

তাও তো এখনও একটা জিনিস পড়েনি।

কী জিনিস?

বিশ্বাস।

বিশ্বাস কীভাবে মেশাবে?

কথা দিয়ে। জানবেন দাদা, মনে করলেই সব হয়। অবশ্য মনের জোর থাকা চাই।

তুমি পাকা চুল কাঁচা করতে পারো?

হ্যাঁ পারি। নিজের চুল।

অন্যের চুল।

সে ক্ষমতা এখনও আসেনি।

কেন যে রঙে তোমার হবে, সে রঙে আমার হবে না কেন?

রঙ তো মনে ধরাতে হবে দাদা। শুধু হাসতে হবে। মনে মনে সবসময় হাসতে হবে। আসুক দুঃখ, আসুক ঝড়, মনে মনে কেবল হেসে যাও।

মহীদা চলে গেলেন। মামা আবার লেগে গেলেন কোমর বেঁধে। নতুন গামছায় আরক ছাঁকা শুরু হয়ে গেল। সার সার বোতল সাজানো। রাত বারোটায় সব শেষ হল সর্বরোগহর অমৃত।

তিন—চারদিন পরে কে একজন এসে বললে, তোমাদের ভবতারণকে দেখে এলুম অফিসপাড়ার ফুটপাথে, শেকড়বাকড়, গাছগাছড়া, বোতল মোতল নিয়ে বসে আছে। পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছে জ্যোতিষীর ছক। হাতে একটা হাত দেখা লেনস। ছোকরা বেশ জমিয়ে ফেলেছে।

ভদ্রলোকের কথা শুনে মহীদার মুখ বেশ গম্ভীর হল। রাধাদি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। সন্ধের দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গালে হাত রেখে। পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, আজ তোমার এত মন খারাপ কেন?

প্রথমে আমার প্রশ্ন কানেই গেল না। আবার একবার জিজ্ঞেস করলুম। ধীরে ধীরে মুখ ঘুরল। চোখ দুটো ছলছলে। ধরা ধরা গলা, দুটো পয়সার জন্যে সারাদিন যে কী করে। খাওয়া নেই দাওয়া নেই। আমরা তো বেশ মজা করে খাচ্ছি, দাচ্ছি, বসছি, শুচ্ছি। এই গরমকাল! সারাদিন ফুটপাথে বসে থাকা!

মামার জন্যে কে এত ভাবে! একটা মানুষ আসে যায়, লাফায় গায়, মজার মজার কথা বলে। মামার ভেতরের খবর, মনের খবর একজনই রাখে। মামাকে রাধাদি ভালোবেসে ফেলেছিলেন। আমার আত্মভোলা মামা হয়তো সে খবর রাখতেন না! অথবা রাখতেন। তা না হলে প্রথম দিনের রোজগারের টাকায় একহাঁড়ি রাবড়ি কিনে রাধাদির হাতে দেবেন কেন? রাধাদি কী খেতে ভালোবাসে, কী পরতে ভালোবাসে, মামার মতো কে আর খবর রাখতেন।

রাধাদি বললেন, ওই উঞ্ছবৃত্তির জিনিসে হাত দিতে আমার ঘেন্না করে।

মামার মুখটা কেমন হয়ে গেল! উঞ্ছবৃত্তি। কী বলছ তুমি। আমার পরিশ্রমের রোজগার।

কে তোমাকে ফুটপাথে বসে ভিক্ষে করতে বলেছিল?

ভিক্ষে? আমি চিকিৎসক। রুগি দেখে, ওষুধ বেচে উপার্জন করেছি। অসৎ পথে নয়, সৎ পথে।

রাখো তোমার সৎ পথ। তোমার জ্যোতিষী হল ধাপ্পা। তোমার ওই ওষুধ হল জোচ্চুরি।

সে কী, এ তুমি কী বলছ? দৈবের জোরে দিদি আজ সুস্থ। এই বাড়ির মেয়ে হয়ে তুমি বিধর্মীর মতো কথা বলছ?

আমি ঈশ্বর—টিশ্বর মানি না। ঈশ্বর আমার জন্যে কী করেছে? কাঁচাকলা!

এ তোমার রাগের কথা, অভিমানের কথা। ঈশ্বর কী দোকানদার? ভোগ দেবেন, সুখ দেবেন, ধন দেবেন, দৌলত দেবেন? যাকে যা দেবার তাকে ঠিকই দেবেন। তুমি রাগ কোরো না রাধা। এ আমার সেন্ট পার্সেন্ট সৎ পথের রোজগার। দ্যাখো এতবড়ো একটা দামড়া লোক, রোজগার না করলে কে আমাকে খাওয়াবে? তুমিই বলো বসে বসে মহীদার অন্ন ধ্বংস করা ঠিক নয়।

এই করে তোমার ক—টা টাকা রোজগার হবে?

যা হয়! কাঠবেড়ালি সমুদ্রবন্ধনে গিয়েছিল। হনুমান হেসেছিল। রামচন্দ্র আহা আহা করে গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। মনে পড়ে সে সব কথা?

গভীর রাতে মহীদা বাড়ি ঢুকে চিৎকার করলেন, কোথায় সেই গাধাটা?

মামা তিনতলায় ছাদের আলসে দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, খোদাবন্দ, বান্দা এখানে তসরিফ রেখেছে। জুতো রেডি আছে জনাব।

জুতো! জুতো কী হবে রে বাঁদর!

প্রভু, পেটাই হবে পেটাই।

নিচে নেমে আয় রাসকেল। তুমি আমার প্রেসটিজ ধুলোয় লোটাতে চাও। এই তামাম ভূখণ্ডে মহীর নাম জানিস? আমি হাসাই, আমি কাঁদাই। আমার ভাই হয়ে তুমি ফুটপাতে বসে লোক ঠকাবে!

মহীদার চিৎকারে সকলের ঘুম ভেঙে গেছে। মামা জোড় হাতে সামনে এসে দাঁড়ালেন, মারতে হয় মারুন, রাখতে হয় রাখুন। আজ আমার বিচারের দিন। ইচ্ছে হলে ফায়ার করে দিন।

ভবতারণ মহী কী খুব গরিব হয়ে গেছে? গরিব? পপার?

কোন জানোয়ারে বলে?

মহী স্বার্থপর?

কে বলেছে জনাব?

তুমি? তুমি বলেছ ইডিয়েট। তুমি অফিস পাড়ায় কাপড় বিছিয়ে ভিক্ষে করতে বসেছিলে।

আমার জীবিকা। এর বেশি আমি কী করতে পারি? আমার যে আর কিছু নেই। কতকাল আমি বসে বসে আপনার অন্ন ধ্বংস করব? আমার তো কিছু একটা করা চাই।

কেন, তোমার পেট চলছে না? তোমার হাতখরচ মিলছে না?

সব, সব আছে আমার। আমি রাজার হালে আছি। কেবল আমার শান্তি নেই। আমি দিন দিন কুঁকড়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছি। আমি কিছু করার জন্যে কলকাতায় এসেছিলুম দাদা। ভাগ্য ভালো ছিল, তাই আপনার মতো শিবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। যেদিন আপনি থাকবেন না, সেদিন আমার কী হবে?

তুমি আমার মৃত্যু—চিন্তা করছ। তুমি ভাবছ আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার দিন শেষ হয়ে আসছে? জেনে রাখো, আমি একশো বছর বাঁচব। একশো বছর ধরে আমি বঙ্গ—রঙ্গমঞ্চ কাঁপাব। সব সমান, সব সমান।

মহীদা রকে বসে পড়লেন থেবড়ে, সব সমান ভবতারণ, সব সমান। নিজে পছন্দ করে রাধার বিয়ে দিয়েছিলুম সুখী হবে বলে। সে ছোকরা কী করলে! কী করে গেল শয়তান?

মাসিমা অন্ধকার কোণ থেকে বললেন, আঃ, কী হচ্ছে মহী? এত রাতে ওই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে?

কেন মা? তোমাদের ঘুমের অসুবিধে হচ্ছে? তোমরা শুয়ে পড়ো। শুয়ে পড়ো। আমার আকাশ আছে, বাতাস আছে। আমার দুঃখের কাহিনি তারা শুনবে। আমার দগদগে ঘায়ে বাতাস হাত বোলাবে। আমি মহী। আমি এসেছি একা, আমি যাবো একা। ভবতারণ!

বলুন দাদা?

বোসো, এখানে বোসো আমার পাশে। আজ জীবনের জমা—খরচের হিসেব হবে। কী দিয়েছি, কী পেয়েছি। মাঝে মাঝে হিসেব করতে হয়। বেহিসেবি হওয়া ভালো নয় ভবতারণ। খরচ বেশি হয়ে যায়। মাসের শেষে লোকের কাছে হাত পাততে হয়। নাও খাতার একদিকে লেখ জমা আর একদিকে লেখ খরচ। ভবতারণ, আমি রাধার আবার বিয়ে দোবো, সে বিয়ে হবে তোমার সঙ্গে।

মামা ঝড়ের বেগে ঘরে পালিয়ে গেলেন।

মহীদা বললেন, পালালি কেন? ভীরু, কাপুরুষ। পালালি কেন? তোর চোখ নেই, তোর মন নেই, তুই দেখতে পাস না ব্যাটা ভণ্ড জ্যোতিষী। মেয়েদের মন তুই পড়তে পারিস না, তুই ধরতে চাস মানুষের দেহে রোগের ষড়যন্ত্র! ভবতারণ, আমিও পারিনি রে! মেয়েদের মন আমিও পড়তে পারিনি। আমার অক্ষরজ্ঞান হয়নি, ভাষা জানি না। আমি এক মূর্খ পণ্ডিত।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মা। মহীদার দুটো হাত ধরে বললেন, মহী, রাত অনেক হল। ওঠো শোবে চল।

ছোটো মা, তুমি এখনও ঘুমোওনি!

আমার ঘুম অনেক কমে গেছে বাবা। মানুষ শান্তিতে ঘুমোয়, মানুষ ক্লান্তিতে ঘুমোয়। আমার শান্তিও নেই, ক্লান্তিও নেই।

কে, কে আমার ছোটো মায়ের শান্তি কেড়ে নিয়েছে? হতভাগা ভবতারণ?

না বাবা, কেউ কারুর শান্তি কেড়ে নিতে পারে না। নিজের মনই শান্তির শত্রু। মন—ঘোড়া দেহের আস্তাবলে দিনরাত পা ঠুকছে! ঘোড়া ঘুমোতে জানে না বাবা! তুমি ওঠো। অনেক রাত হল। পৃথিবীকে এবার ঘুমোতে দাও।

ছোটোমা, আমাকে আজ তুমি একটু কাঁদতে দাও। আমি রাধার জীবন নষ্ট করেছি। আমি স্বর্ণলেখার জীবন—স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছি। আমি মহীতোষ নই, আমি মহীরাবণ।

বাবা, কেউ কারুর জীবন নষ্ট করতে পারে না। যার যা হবার তা আগে থেকেই ঠিক হয়ে থাকে। এ যেন অদৃশ্য, অলিখিত একটা বই। শুধু পাতা উলটে যাওয়া। কেন তুমি কষ্ট পাচ্ছ।

যা লেখা আছে, আমি সব কেটেকুটে নতুন করে আবার লিখব। কে লেখে সেই বই! এ প্রশ্নের একটিই জবাব এবং সেটিও একটি প্রশ্নে, কে খেলায়, আমি খেলি বা কেন?

 সৃষ্টি—জোড়া তোমার মায়া
 মায়া নাই কেবলি ছায়া
 মাঠের মাঝে আকাশ ধরা
 ঘুরে সারা চারিধারে।

আমার মা হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলেন। অন্ধকারে মনে হল মায়ের শরীর থেকে যেন একটা চাপা আলো বেরোচ্ছে। এ মাকেও আমি চিনি। আমার গুরু অজ্ঞাতবাবা বলতেন, বৃহতের মাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রের মাঝে বৃহৎ। ছুঁচের মধ্যে দিয়ে হাতিও সময় সময় গলে যায়।

মারকে বসে পড়েছেন। কাঁদছেন আর গাইছেন,

 কে তোমারে জানতে পারে
 তুমি না জানালে পরে?
 বেদ বেদান্ত পায় না অন্ত
 খুঁজে বেড়ায় অন্ধকারে।।

মায়ের সেই অপূর্ব অবস্থা দেখে মহীদার নেশা ছুটে গেল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। প্রায় ছ—ফুট লম্বা। মায়ের সামনে বুকে হাত মুড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর শুরু করলেন পালা। নিমাই সন্ন্যাসের সেই বিখ্যাত অংশ। নিমাই এসেছেন জগন্নাথদেবের মন্দিরে। ভাবে বিভোর। মহীদা যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো চরিত্রের সঙ্গে এক হয়ে যেতে পারেন। আর সেই মুহূর্তে মহীদা অন্য মানুষ।

 রে নির্দয়? তুমি কি জান না
 জগৎ শূন্য হেরি তোমা বিনা,
 আরে বনমালি!
 চতুরালি না জানি কেমন তোর?
 তোমা বিনা পলকে প্রলয়,
 দিক তমোময়।।

সেই অন্ধকার উঠোনে সময় যেন সহসা পাঁচশো বছর পেছিয়ে গেল। দু—হাত তুলে মহীদা নেচে বেড়াচ্ছেন,

 শূন্য দেহে প্রাণ নাহি রয়
 তবু চিত—চোর এ কি রীতি তোর,
 প্রাণ মম মজায়ে লুকাও?
 আর তোরে ছেড়ে নাহি দিব
 ভুজ—পাশে বাঁধিয়া রাখিব

কত অসাধারণ সব মুহূর্তে মেঘের মতো ভেসে চলে গেছে জীবনের ওপর দিয়ে স্নিগ্ধ বারিপাতে। অজ্ঞাতবাবা বলতেন, তুমি শুদ্ধ যোনিসম্ভূত, তোমার পিতা আর মাতা দুজনেই হল উচ্চকোটির মানুষ। জীবন হেলায় হারিয়ো না। ধীর হও, ধীমান হও, সোজা চলে যাও, আঁকাবাঁকা পথ ধোরো না,

 মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব।
 আচার্যদেবো ভব। অতিথিদেবো ভব।
 যান্যনবদ্যানি কর্মাণি তানি সেবিতব্যানি, নো ইতরাণি।
 যান্যস্মাকং সুচরিতানি তানি ত্বয়োপাস্যানি।।

তৈত্তিরীয় উপনিষদের এই শ্লোকটি আমার জীবনের ধ্রুবতারা। মাতা তোমার দেবতা। পিতা তোমার দেবতা। আচার্য তিনিও তোমার দেবতা। অতিথিও দেবতা। অনিন্দ্য কর্মই তোমার কর্ম, অন্য কর্ম অকর্ম। সু আচরণই গ্রহণীয়।

আমি একটা কথাই সকলকে বলতে চাই, কেন নষ্ট হয়ে যাবে তোমরা। দীর্ঘ বারো ঘণ্টা ধরে সূর্যের প্রখর উত্তাপ সমস্ত পুড়িয়ে দিচ্ছে, অগ্নিশুদ্ধ করে দিচ্ছে, সন্ন্যাসীর গৈরিক উত্তরীয়ের মতো জলে, স্থলে, নভে, রশ্মিজাল উড়ছে। এই তেজোময় পৃথিবীতে পাপের স্থান নেই, সঙ্কীর্ণতার স্থান নেই। তাকিয়ে দ্যাখো একবার, কী বিশাল আয়োজন! গগনচুম্বী পর্বতমালা, আদিগন্ত সমুদ্র, মরুভূমি, গভীর গভীর অরণ্য, অনন্ত আকাশ, কোটি কোটি জ্যোতিষ্ক, এখানে ক্ষুদ্রের স্থান নেই। বেদের পুরুষ—সূক্ত একবার উচ্চারণ করো,

 সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ
 স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্।।

সেই পুরুষের মস্তক সহস্র, সহস্র নয়ন, সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছেন। তিনি সেই দশাঙ্গুলি পরিমিত ব্রহ্মাণ্ডকেও অতিক্রম করে অবস্থান করছেন।

বলতে চাই, কিন্তু বলি না। আমার গুরু বলতেন, অবিশ্বাসীর কাছে বিশ্বাসের কথা বোলো না। সবই বলা আছে। নতুন করে কিছু বলার নেই। যার যেমন আধার, সে সেইরকম পথই বেছে নেবে। মাছি বিষ্ঠায় বসবে। ভ্রমর বসবে ফুলে।

এই আশ্রম স্থাপন করেছিলেন আমার মা। সাধন জীবনে তাঁর নাম হয়েছিল বিশুদ্ধা মাতা। এই স্থানটির নাম রাখা হয়েছে ইষ্টপুর। ধীরে ধীরে কেমন করে এসব গড়ে উঠল! একরের পর একর জমি। আশ্রম, সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনীর থাকার জায়গা, সাধনকুটীর, মন্দির, চিকিৎসালয়, স্কুল, সমাজসেবা কেন্দ্র। সেই অদৃশ্য, অলিখিত বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে, এক এক অধ্যায়ে এক এক প্রাপ্তি। মামা এখনও আছেন। সেই গ্রেট বি টি এম। অনেক বয়েস হয়েছে। ঠিক যেন সেই অরূপের বৃদ্ধ ঠাকুরদা। জানি না বয়েস কত। তবে নব্বই তো হবেই। এখনও সেই একই রকম মন। জীবন নিয়ে সেই একই রকম রসিকতা। আয় না ঢাকনা খুলে দেখি, কৌটো থেকে কি বেরোয়! আয় না দরজা ঠেলে দেখি ভেতরে কে বসে আছে। কৌটো থেকে সাপ বেরোতে পারত। ঘর থেকে বাঘ বেরোতে পারত। ভ্রূক্ষেপ ছিল না। অনেক দূরে ওই উত্তর—পশ্চিম কোণে ওখানে একটা ঘরে আলো জ্বলছে, বসে আছেন বি টি এম। অরূপের বৃদ্ধ ঠাকুরদা। সময়ের ঐকতান শুনছেন। সেই নৌকোর যাত্রী, যে নৌকো এপার থেকে ওপারের দিকে সরে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই তিনি চলে যাচ্ছেন, আমাদের থেকে দূরে আরও দূরে। জীবন তাঁকে হাত ভরে কিছু না দিলেও তাঁর দুঃখ নেই। কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের পাবার চেষ্টাতেই আনন্দ। হঠাৎ কিছু পেয়ে গেলে বিব্রত হয়ে পড়েন।

নেশার ঘোরে মহীদা বলেছিলেন, রাধার সঙ্গে বিয়ে দেবেন। পরের দিন সকাল থেকেই গ্রেট ভবতারণ মুকুজ্যেকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। উধাও। সে এক মজার সকাল। মামার অদ্ভুত প্রচারে লাইন দিয়ে সব রুগিরা এসে বসে আছে। হাঁপানি আছে, বাত আছে, ন্যাবা আছে, হিস্টিরিয়া আছে। বুড়ো, বুড়ি, যুবক, যুবতী। সব ঝেঁটিয়ে চলে এসেছে। উঠোনে তিলধারণের স্থান নেই। হাঁপানির রুগিরা এত জোরে শ্বাস নিচ্ছেন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব বায়ু শেষ হয়ে যাবে। আমাদের নেবার জন্যে আর কিছু থাকবে না। বাতের রুগিরা কোঁত পাড়ছেন, আর বলছেন, অ—বউমা, আর যে বসতে পারছি না। যা হয় একটা কিছু করো। হিস্টিরিয়া রুগিদের বিবর্ণ, বিষণ্ণ চেহারা।

ঘুম থেকে উঠেই উঠোনে হরিহর ছত্রের এই মেলা দেখে মহীদার চক্ষুস্থির। কোথায় ভবতারণ? ভবতারণ পগার পার। কী হবে? কে সামলাবে এদের?

মা বললেন, তুমি কিছু ভেবো না মহী। এরা বাড়িঘর ভাঙার ক্ষমতা রাখে না। তাকালেই দেখবে এদের জ্যোতির্ময় শরীর মলিন হয়ে গেছে। এরা দুটো আশার কথা, সহানুভূতির কথা শুনতে চায়। আমরা যেমন পাপীকে ঘৃণা করি, সেইরকম অসুস্থ মানুষকেও ঘৃণা করি। তুমি ব্যস্ত হয়ো না। ভবা পালালেও আমি আছি।

অজ্ঞাতবাবা পরে দীক্ষার দিন মাকে বলেছিলেন, তোমার দীক্ষা সেই দিনই হয়ে গেছে। দীক্ষা মানে জাগা। দীক্ষা মানে সেবা। ঈশ্বরের সেবা, জীবের সেবা। দীক্ষা মানে অভ্যস্তকে ফেলে দিয়ে অনভ্যাসকে অভ্যাসে আনা।

সেই ষাট—সত্তর জন কাতর মানুষকে মা একে একে ওষুধ আর আশা দিয়ে বিদায় করলেন। ঘড়িতে তখন বেলা দ্বিপ্রহর। মায়ের হাতে তুলে দেওয়া মামার ওষুধে অনেকেই কিন্তু আরোগ্য লাভ করেছিলেন। ওষুধের নাম হয়ে গেল বি টি এম। অনেকেই সেদিন ওষুধের দাম নেবার জন্যে ঝুলোঝুলি করেছিলেন। মা নেননি। বলেছিলেন দৈব ওষুধে দাম নিতে নেই।

ওষুধের এত সাফল্য; কিন্তু মামা নিরুদ্দেশ। একদিন গেল, দু দিন গেল, মামার পাত্তা নেই। মহীদা চিন্তায় অস্থির। ছেলেটা গেল কোথায়। আত্মহত্যা করে বসল না তো। থানায় তাহলে একটা ডায়েরি লিখিয়ে আসি। মায়ের কিন্তু কোনো দুশ্চিন্তা নেই। মহীদাকে বললেন, অকারণে ভেবো না। ও নিজের কাছ থেকে পালাতে চাইছে। ও কী চায় নিজেই জানে না। আগুন পোড়াবার মতো কিছু না পেলে নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

দুপুরে মা আমাকে বললেন, আজ একটা জিনিস চেষ্টা করে দেখব। এতদিন শুনেই এসেছি। আজ হবে পরীক্ষা।

কী সে জিনিস? নখদর্পণ। নখের দর্পণে মা দেখবেন, মামা কোথায়?

রাধাদি আর আমি ঘরের বাইরে বসে আছি। মা ভেতরে। ব্যাপারটা কী আমাদের জানা নেই। কেউ না বুঝুক, আমি বুঝি পৃথিবীতে মামার সবচেয়ে আপনজন রাধাদি। মহীদাও বুঝেছিলেন। নেশার ঘোরে বলে ফেলেই বিপদ করেছেন।

ঘণ্টা পার হয়ে গেল, ঘর থেকে মায়ের বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণ নেই। মায়ের বেরোতে যত দেরি হচ্ছে, রাধাদির মুখচোখের অবস্থা ততই যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। শেষে মা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ভয়ে ভয়ে মুখের দিকে তাকালুম। হাসছেন।

রাধাদি জিজ্ঞেস করলেন, কী হল মা?

মা বললেন, হয়েছে। পেরেছি, আমি পেরেছি।

মায়ের ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখে আয়নায় যেমন প্রতিবিম্ব পড়ে, ঠিক সেরকম, মামা ভেসে উঠেছেন। যেখানে আছেন, যেভাবে আছেন, ঠিক সেই ভাবে।

মায়ের অনেক অলৌকিক ক্ষমতা এসে গিয়েছিল। আমি দেখেছি। বিশ্বাস করতে গিয়ে প্রশ্ন এসেছে। অজ্ঞাতবাবা বলতেন, প্রশ্নে এর সমাধান নেই। প্রশ্ন আসে মনের অনেক নিচের সন্দেহবাদী স্তর থেকে। যেখানে জ্ঞানের আলো অজ্ঞানকে সামান্য একটু খোঁচা মেরেছে। বিশ্বাস অনেক উঁচু স্তরের জিনিস। তুমি দেখছ হচ্ছে, ঘটছে, তুমি তার ফল ভোগ করছ, এরপর আবার সন্দেহ কেন? প্রশ্নই বা কীসের?

কথা বলতে বলতে অজ্ঞাতবাবা বাতাসে হাত ঘুরিয়ে হাত মুঠো করে কী যেন একটা ধরলেন, নে খা।

অবাক হয়ে দেখলুম, টুসটুসে পাকা একটা আম।

প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলুম, বললেন, আবার প্রশ্ন। খেয়ে দেখোই না, ওটা আম কি না। যদি আমই হয় আবার প্রশ্ন কীসের?

আমটা খেয়ে ফেললুম। অসময়ে অমন সুস্বাদু আম কোথা থেকে এল? বাতাস থেকে? অবিশ্বাসী মনে প্রশ্ন আসবেই।

অজ্ঞাতবাবা মনের চিন্তা ছবির মতো দেখতে পেতেন। তাঁর সামনে বসে থাকতে আমার কেন, সকলেরই ভয় করত। মাঝে মাঝে হঠাৎ উঁহুঁ, উঁহুঁ করে উঠতেন। কখনও বলেও ফেলতেন, ও—পথে নয়, বাবা ও—পথে নয়। ওঁর সামনে বসে একদিন আমি খুব খারাপ চিন্তা করে ফেলেছিলুম। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে একটা চড় মেরেছিলেন। সেই এক চড়েই মন আমার চিরকালের জন্যে নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল। মনের অন্ধকার দিকে ধীরে ধীরে আলো ফেলার কায়দা শিখে গিয়েছিলুম। অজ্ঞাতবাবা বলতেন, ঋষি না হতে পারো ঋষির জীবনযাপন করার অভ্যাস করো।

আম খেয়ে, হাত ধুয়ে এসে বসার পর তিনি বললেন, একে কী বলে জানো, পাওয়ার অফ মেটিরিয়েলাইজেসান। মনে পড়ে বাইবেলের সেই কথা, লেট দেয়ার বি লাইট অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট। বাতাসে সবকিছু সম্ভাবনাই ঘুরছে। বাতাসহীন অস্তিত্বের কথা ভাবা যায় না। বাইবেল শুনবে,

ঈশ্বর আমাকে ধরে অস্থির উপত্যকায় ফেলে দিলেন।

আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি, চারপাশে হাড় আর হাড়। শুষ্ক বিশুষ্ক অস্থির স্তূপ।

তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, পুত্র, এই হাড়টি প্রাণ পেতে পারে।

আমি বললাম, প্রভু, আপনিই জানেন।

তিনি বললেন, দ্যাখো আমি তোমার মধ্যে প্রাণবায়ুর প্রবেশপথ করে দিচ্ছি, তুমি জীবন পাবে।

আমি তোমার অস্থির ওপর, শিরা, উপশিরার জাল বুনে দিচ্ছি, তার ওপর মাংস আর চামড়ার আচ্ছাদন পরিয়ে দিচ্ছি, ভরে দিচ্ছি বাতাস, তুমি তখন জীবন হয়ে স্বীকার করবে আমিই ঈশ্বর।

সৃষ্টির রহস্যই হল পঞ্চভূত। নেই থেকে আছে। আছে থেকে নেই। অস্তি আর নাস্তি এই হল রহস্য। আসলে কিছুই নেই, আবার সবই আছে। মায়া। সবই মায়ার খেলা—মাং ঐর্শ্বয্যংযাতি প্রাপ্নোতি যতঃ স মায়া।

অজ্ঞাতবাবা বলেছিলেন, মন স্থির হলে, মানুষের নানারকম ক্ষমতা জন্মায়। অবাক হবার কিছু নেই, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমরা বিশ্বসৃষ্টির অংশ। জগৎ আমাদের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। একই বাড়িতে থাকলে, দোতলার মানুষ জানতে পারে একতলায় কী হচ্ছে। এ ঘরের মানুষ জানতে পারে ওঘরে কী হচ্ছে। বহু দূর থেকে সানাইয়ের সুর আমাদের কানে ভেসে আসে। কান আমাদের শব্দ ধরার যন্ত্র। চোখ আমাদের দর্শনযন্ত্র। ইন্দ্রিয়ের বিভিন্ন অনুভূতি গ্রহণের ক্ষমতা। অধিকাংশ সভ্য মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঘুমিয়ে পড়েছে। অরণ্যচারী মানুষে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জাগ্রত ছিল।

নখ—দর্পণে মা সেদিন মামাকে দেখেছিলেন। মন্দিরের সিঁড়িতে বসে আছে। দুঃখ কোনোদিনই মামার মুখের হাসি কেড়ে নিতে পারেনি। মামা যখন যেখানে তখন তাদেরই পরম আত্মীয়। পনেরো বছর পরে ফিরে এসেছিলেন অনেক প্রবীণ হয়ে। মহীদা তখন চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। মহীদার সব স্মৃতি তখন প্রায় মুছে গেছে। রঙ্গমঞ্চ তাঁকে ভুলে এসেছে। কলকাতার সেই বিশাল বাড়ি আর নেই। বুদবুদের মতো সব ফেটে চুরমার হয়ে গেছে। সে আর এক কাহিনি। কোথা থেকে কী হয় বলা যায় না।

এই আশ্রমের সর্বময় কর্ত্রী অমৃতা মা। তিনি বিদেশিনী। আশ্রমে স্নেহ—ভালোবাসার স্থান নেই। মান—অভিমানের তোয়াক্কা কেউ করে না। সব নিয়মে বাঁধা। শৃঙ্খলে বাঁধা। আমার মা এঁদের সকলেরই গুরুমাতা ছিলেন। অজ্ঞাতবাবা ছিলেন মায়ের গুরু। মাকে তিনি উজাড় করে সব দিয়েছিলেন। শেষের দিকে ভয়ে আমি মায়ের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারতুম না। শ্বেতপাথরের মতো চেহারা হয়ে গিয়েছিল। যেখানে বসতেন তার পেছনের দেয়ালে স্নিগ্ধ আলোর একটা আভা ছড়িয়ে পড়ত। কাছে গেলে গায়ে একটা শীত শীত ভাব হত। তাকাতেন সুদূরের দৃষ্টিতে। আমি তাঁর সন্তান, দৃষ্টিতে সেরকম বিশেষ কোনো ভাব ফুটে উঠত না। এই জগতে এই দেহে থেকেও যে বহু দূরে চলে যাওয়া যায় তা আমি বুঝেছিলুম।

কোনো এক নেটিভ স্টেটে রাতের আসরে গান গাইছিলুম। আমার সেই প্রিয় রাগ দরবারি কানাড়া। হঠাৎ প্যান্ডেলে আগুন লেগে গেল। প্রাণভয়ে সবাই পালাচ্ছে। আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার কোনো খেয়ালই ছিল না। মহারাজার মন্ত্রী আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এলেন। প্রাসাদের অতিথিভবনে ফিরে, হাসতে হাসতে বললেন, ওস্তাদজি, সুর আর সুরা দেখছি একই চিজ। একদম বেহুঁশ। এখুনি আপনার দাড়িতে আগুন লেগে যেত।

অজ্ঞাতবাবা যেমন আমার মাকে উজাড় করে সব দিয়েছিলেন, আমার মহারাষ্ট্রীয় সংগীতগুরুও উজাড় করে আমাকে সব দিয়েছিলেন। তিনি ভীষণ রাগী ছিলেন। জীবনে কত হাতে যে মার খেয়েছি। একটু ভুল হলেই চড়—চাপড় মেরে দিতে। উল্লু বলতেন। মেজাজ ভালো থাকলে, বেটা বলতেন। ভেবেছিলেন কন্যার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন। তা আর সম্ভব হয়নি। ঈশ্বর মৃত্যুর রূপ ধরে আমাদের দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। সেই সময় যক্ষ্মা হলে সারত না। আর যক্ষ্মা ছিল সংগীতশিল্পীদের প্রেমিকা। এক শীতের রাতে সে চলে গেল। গুরুজি কন্যার স্মরণে একটি রাগিণী রচনা করলেন, চন্দ্রিমা। চন্দ্রিমা সুর হয়ে আমার জীবনে রয়ে গেল। বড়ো কোমল রাগিণী। শুদ্ধ স্বর নেই বললেই চলে। কড়ি মধ্যমবাদী স্বর। সমবাদী কোমল নিখাদ। ইমনের সঙ্গে মিল আছে মনে হলেও, শেষ রাতের সুর। চাঁদ যখন পশ্চিম আকাশে ক্লান্ত চরণে বিদায়ী, অতন্দ্র তারার চোখ যখন রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত, সমস্ত কুঁড়ি যখন অর্ধস্ফুট ফুল, বাতাস যখন সব উষ্ণতা হারিয়ে পবিত্র দেহের মতো শীতল, আকাশের সীমান্তে যখন মন্দিরের রেখা সুস্পষ্ট, নদীর জলে যখন ভোরের আলোর ডানা কাঁপছে, সাগরের ঢেউ যখন বেলাভূমিতে আর পারি না বলে পাশ ফিরছে, তখনই এই রাগ চন্দ্রিমা আমার কণ্ঠে মোচড় মারে। আমি তাকে দেখতে পাই, যে আমার জীবনসঙ্গিনী হতে পারত। আজ পর্যন্ত আমি একজনও শ্রোতা পাইনি যাঁর চোখে জল আসেনি এই সুর শুনে। অনেকেই বলেন, আমি চন্দ্রিমাসিদ্ধ। তাঁরা জানেন না এর পেছনের কী ইতিহাস আছে! জীবনসমুদ্রে বুদবুদের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। পাশাপাশি, কাছাকাছি, ভেসে আসা, দূরে যাওয়া। এর বেশি কিছু নয়। কে রাখে কার জীবনের খবর?

রাধার সেই চিঠিটা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে, যে চিঠিটা সে আমাকে লিখেছিল পুনায়। দাদার মৃত্যুর পর কলকাতা আমার আর ভালো লাগছে না। দেহ থেকে যৌবনও সহজে বিদায় নিতে চাইছে না। বড়ো উৎপাত, বড়ো উপদ্রবে দিন কাটছে। তুমি এখন বড়ো, মস্ত বড়ো। আমার কথা কী তোমার মনে আছে? তোমার সেই রাধাদিকে। যদি থাকে, আমাকে তোমার আশ্রয়ে রাখো। আমি বড়ো অসহায়। দড়িতে ঝোলানো ছালছাড়ানো পাঁঠার মতো ঝুলছি। তুমি আমাকে বাঁচাও।

আমি বাঁচাতে পেরেছিলুম কিনা জানি না, তবে আমি নিজে বেঁচেছিলুম। নিজের সব দায়দায়িত্ব পোঁটলা বেঁধে ফেলে দিয়েছিলুম তার হাতে। মা আর দিদিতে বিশেষ তফাত নেই। জীবনের যে—কটা বছর আমাদের একসঙ্গে কেটেছিল, সেইকটা বছরই ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সাফল্যে, আনন্দে ভরপুর। বয়েসের তুলনায় আমাকে একটু বেশি বয়স্ক দেখাত। রাধাদিকে সবাই ভাবত আমার মেয়ে। আমি তাকে গানও শিখিয়েছিলুম। জীবনের এই শেষদিনে বাতি যখন গলে গলে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পলতে নিবু নিবু, রাধাদি যদি আমার পাশে থাকত কত সুন্দর হত।

অজ্ঞাতবাবা আমাকে বলেছিলেন, মন যা চায় তার বিপরীতে অভ্যস্ত হবি। যখন ঠান্ডা চাইছে তখন গরম দিবি। যখন নরম বিছানা চাইছে তখন শক্ত কাঠের ওপর ফেলে রাখবি। যখন বিশ্রাম চাইছে, তখন খুব পরিশ্রম করবি। যখন আশ্রয় চাইছে তখন নিরাশ্রিত করবি। সবসময় প্রত্যাখ্যান করবি। এইভাবেই মনের প্রভু হওয়া যায়। মনের দাসত্ব করবি কেন।

তিরোধানের আগে মা আমাকে একটা কথাই বলেছিলেন—মুক্ত হও।

আমি সত্যিই এখন মুক্ত। যাঁরা একে একে আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের জন্যে আমার বড়ো বেদনা ছিল। কত কী করার ছিল করা হয়নি। সেদিন আশ্রমে রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ড পড়া হচ্ছিল। একপাশে চুপ করে বসে শুনতে শুনতে মন বেশ খালি হয়ে গেল। রাজা দশরথ দেহ রেখেছেন। ভরত বাসে আছেন বিষণ্ণ হয়ে। শ্রীরামচন্দ্র ভরতকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আহা! কী সুন্দর!

রাম বলছেন, ভরত, মানুষের ইচ্ছামতো কিছু কি হয়। হয় না। কাল সকলকে আকর্ষণ করছে। সঞ্চয় আর সংযোগের পরিণতি বিয়োগে। জীবনের সমাপ্তি মৃত্যুতে। রাত্রি আর নদী একবার গেলে আর ফেরে না। সূর্য শোষণ করছে জল, কাল হরণ করছে আয়ু। মৃতের জন্যে শোক করে কী হবে? নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা করো। মৃত্যুর ছায়ার মতো আমাদের পাশে পাশে চলছে। বিদায় নেবে শেষের দিনে। জরা, বার্ধক্য আর দৈব মানুষের প্রতিরোধ শক্তির বাইরে। সূর্যোদয়ে সূর‍্যাস্তে ঋতুর পরিবর্তনে মানুষ প্রফুল্ল হয়, এদিকে প্রতিদিন যে আয়ুক্ষয় হচ্ছে, সে ভাবনা মানুষের নেই। সমুদ্রে দুটো নৌকো এক হয়, আবার ভাসতে ভাসতে দূরে সরে যায়, সেইরকম মানুষের স্ত্রী—পুত্র—জ্ঞাতি সম্পদের বিচ্ছেদও চিরন্তন। নিয়মিত লঙ্ঘন করা অসম্ভব। অগ্রগামী পথিকের মতো কালের পথে পাড়ি দিয়েছেন আমাদের পিতপুরুষগণ। সকলেরই ওই এক পথ। বৃথা শোক। স্রোতের জলের মতো যা গেল তা গেল। আর ফিরবে না। যতদিন জীবন ততদিন আত্মার প্রীতিকর কর্ম করাই ভালো।

অজ্ঞাতবাবা বলেছিলেন, কোথাও শেকড় গেড়ো না, নামরূপের দাসত্ব কোরো না। এখানে আমি বেশ কিছুদিন আছি। এক সময় আমি গান শেখাতুম। এখন আর শেখাই না। একেবারেই বেকার। গলগ্রহ। আমাকে এবার যেতে হবে। দেখি না আকাশের নিচে বাসা মেলে কী না! কীসের অন্ধকার! ভয়ই বা কীসের! কোথাও কোনো তীর্থস্থানে মন্দিরের পাশে গিয়ে বসব। একটিমাত্র গানই গাইব, কবিরদাসজির ভজন—ভজো রে ভৈয়া রাম গোবিন্দ হরী। বৃদ্ধের প্রয়োজন সামান্যই। কেউ কিছু দিলে খাব। না দিলে চাইব না। সম্পূর্ণ আকাশবৃত্তি। আর ক—দিনই বা! তারপর সবাই দেখবে, বৃদ্ধ মরে পড়ে আছে। মুখে লেগে আছে একচিলতে বিদায়ের হাসি।

আবার সেই দৃশ্য! সেই অদ্ভুত চোখের ভুল। দূরে একচিলতে কাঁকুরে জমি ল্যাম্পপোস্টের বৃত্তাকার আলোয় স্পষ্ট। যেন কোনো নাটকের মঞ্চ। কে যেন দাঁড়িয়ে ওখানে। দীর্ঘ স্বচ্ছ দেহ। যেন কাচের মানুষ! কে? ওই তো আমি। আমার আমি আমাকে ছেড়ে অত দূরে চলে গেছে। দাঁড়াও আমিও যাব। আমার নেবার কিছু নেই। যা দেবার সবই দিয়ে দিয়েছি। যেয়ো না, তুমি একটু দাঁড়াও। আমার মাকে, আমার গুরু অজ্ঞাতবাবাকে একবার প্রণাম করে আসি এই তো শেষ পাতা। এরপর আর পাতা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *