কেবলই ছায়া – ৬

ছয়

ইস্কুলে আমার এক প্রাণের বন্ধু ছিল। অরূপ তার নাম। এখন কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি না, আমার জানা নেই। লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। দেখতেও খুব সুন্দর ছিল। মেয়ে হলে বলা যেত, গুণে সরস্বতী, রূপে লক্ষ্মী। বছর দশেক আগে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল পুনায়। আমার গানের অনুষ্ঠান ছিল। শেষ রাতে গান ছাড়ার পর দর্শকদের আসন থেকে উঠে এসে সে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তার দু—চোখ বেয়ে জল পড়ছে। দরবারি কানাড়া রাগটা আমি ভালোই গাই। বিচ্ছেদের রাগ। আমি তো বিচ্ছিন্নই। সমাজ থেকে, সংসার থেকে, প্রতিষ্ঠান থেকে, জীবন থেকে। বাওরা না হলে কানাড়া হয় না। আমার গুরুজি তাই বলতেন।

তখনই জেনেছিলুম, অরূপ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পুনায় এসেছিল। আছেও দীর্ঘদিন। ডাক্তারের সন্দেহ লিভার ক্যানসার। বাঁচবে না বেশিদিন। দশ বছর হয়ে গেল। অরূপ মনে হয় নেই। আমি আছি। আমি এখনও বসে আছি। অনেকের স্মৃতি নিয়ে। অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে। আমার মহীদা পাহাড় ভীষণ ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন ঝরনা, গাছপালা পশু পাখি। নীল আকাশ। আর মানুষ। যে মানুষ যত বিচিত্র, পাগলাটে, সে ততই মহীদার ভালোবাসার পাত্র হয়ে উঠত। আজ আমি যেখানে আছি, সেখানকার আকাশের গায়ে পাহাড়ের নীল রেখা। বিশাল বিশাল গাছ। এক একটা গাছ এত পুরনো যেন এক একটি ইতিহাস। ঝরনা আছে কিছু দূরে। পাহাড়ি নদী বয়ে যায় চুনাপাথরের ওপর দিয়ে কুলকুলু রবে। এখানে বৃষ্টিও তেমন হয় না। আকাশের রঙ স্বচ্ছ নীল। মা আমার বেশ সুন্দর জায়গাতেই আশ্রম বানিয়েছিলেন। মায়ের সাধনার জায়গা হয়েছে আমার বার্ধক্যের বারাণসী। ভালো ভাস্করকে দিয়ে মায়ের একটি মর্মর মূর্তি তৈরি করিয়ে স্থাপনা করেছি। শিষ্য—শিষ্যারাই সব দেখাশোনা করে। আমি পড়ে থাকি একপাশে আমার নিজের খেয়ালে। মহীদা থাকলে এখানে এসে আনন্দ পেতেন। কলকাতা মহীদার একটা মূর্তি স্থাপন করছে না কেন?

বয়েসের এই দোষ। এক কথা বলতে আর এক কথায় চলে যাই।

অরূপদের বাড়িটা বড়ো বিচিত্র ছিল। অরূপের বাবা ছিলেন ম্যাথেমেটিসিয়ান। আর অরূপের ঠাকুরদা ছিলেন জীববিজ্ঞানী। কোন এক স্টেটের চিড়িয়াখানার ডিরেক্টার ছিলেন। শেষের দিকে তাঁর মাথাটা মনে হয় একটু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক ছিল না। যেমন এখন আমার হয়েছে। কে যেন আমাকে ওই পাহাড়ি নদীর দিকে ডেকে ডেকে নিয়ে যায়। ঘুটিংসের ওপর দিয়ে নদী বয়ে চলেছে ছিরছির করে। চারপাশ সাদা। অন্ধকার রাতেও চাপা আলোর খেলা। মৃত্যু যেন গোল গোল পাথর হয়ে গড়াচ্ছে। মৃত্যু যেন হাসছে। এইখানেই রাধাকে সৎকার করা হয়েছিল। এখানে এলেই মনে হয়, যাদের নিয়ে জীবন শুরু করেছিলুম, তাঁরা যেন সবাই এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাতের অন্ধকারে। মা বসে আছেন একপাশে পূজার আসনে। পাথরের ওপর একটা পা তুলে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন মহীদা। মাথায় রাজমুকুট। রাধা জলে পায়ের পাতা ডুবিয়ে আপন মনে খেলা করছে। সে তো ওইরকম ছেলেমানুষই ছিল চিরটা কাল। তাকে কজন বুঝত, আমি ছাড়া। মাথার ওপর বাটির মতো উপুড় হয়ে থাকা আকাশ যেন আমার দুঃখী পিতার মুখ। জল ঝরে না, তাই বেদনা অত গভীর?

আমি ঠিক পাগল নই। ওই অরূপের ঠাকুরদার মতো একটু অপ্রকৃতিস্থ। নিজের খেয়াল নিয়ে থাকি। নিজের বিশ্বাস নিয়ে থাকি। আমি যা জানি তা জানি। যা জানি না তা জানি না। আমার জগৎ ছোটো না বড়ো সে আপেক্ষিক খবরও আমি রাখি না। আমার ধারণা আমার চোখ আছে তাই বাইরেটা আছে। জানালা দিয়ে আমরা যেন ঘরের বাইরেটা দেখি। চোখ না থাকলে বা বন্ধ করে রাখলে ভেতরটা আছে। আমার একটা গান ছিল—খাঁচার খাঁচা তস্য খাঁচা, খাঁচার ভেতর বন্দি পাখি।

অরূপ একদিন দুপুরবেলা আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেল। বাগান ঘেরা বিশাল বাড়ি। মনে হয় কোনো সায়েবের তৈরি। অনেকটা বাংলোর মতো। বাগানের এখানে ওখানে কয়েকটা মূর্তি ছিল। মহীদা পরির মূর্তি ভালবাসতেন। পরি ছিল কি—না মনে নেই। বাড়ির পেছন দিকে থাকতেন অরূপের ঠাকুরদা। সেটা ঘর নয়, বিশাল একটা খাঁচা। বিশাল খাঁচা তার আবার দুটো দরজা। প্রথম দরজাটা বড়ো। তার পরের দরজাটা ছোটো। গুহার মুখের মতো। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। ঘরকে খাঁচা বানানো হয়েছে। বড়ো বড়ো জানলায় তারের জাল। বিভিন্ন আকার আকৃতির গাছের গুঁড়ি আর ডাল চারপাশে সুন্দর করে সাজানো। সেই ঘরে শুধু পাখি আর পাখি। নানা জাতের, নানা রঙের। শুকনো ডালে ডালে বাসা ঝুলছে। একটা বাথটবে জল। সেই ঘরেই টেবিল—চেয়ার নিয়ে বসে থাকেন অরুপের ঠাকুরদা। চোখে গোল চশমা। মুখে ঋষিদের মতো একমুখ দাড়ি। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা পাকা চুল। সায়েবদের মতো গায়ের রঙ। পরনে দুধের মতো সাদা একটা আলখাল্লা। টেবিলে বিশ—বাইশটা নানা মাপের টাইমপিস, একসঙ্গে খিচখাচ শব্দ করে চলেছে।

ঠাকুরদা বললেন, এসো, এসো।

আমরা দুজনে হামা দিয়ে ঢুকলুম। তিনি হাসতে লাগলেন। ফরসা মুখে সোনার চশমা।

হাসতে হাসতে বললেন, চতুষ্পদ হয়ে কেমন লাগছে? মানুষের চেয়ে ভালো না?

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ।

তিনি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। বেশ লম্বা আর ঋজু চেহারা। বুকের কাছে আমাদের মাথা। ধবধবে নীলচে সাদা পোশাক, চিকচিক করছে পেতলের বোতাম।

তিনি হাসতে হাসতেই বললেন, কী বুঝলে তাহলে, দ্বিপদে সুখ, না চতুষ্পদে? চতুষ্পদের জমির ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ?

বাতাসে শূন্যে মাথা যত তুলবে তত নিরালম্ব মনে হবে। সে অধিকার একমাত্র থাকা উচিত গাছের। গাছ একা ওঠে না। ওঠে ডালপালা সমেত, পত্র—পল্লব নিয়ে। মানুষ উঠতে চায় একা। শূন্যে কোনও দোসর খুঁজে পায় না। যত উঠবে তত নিঃসঙ্গতা বাড়বে।

আমাদের বসতে বললেন।

বাইশটা ঘড়ি একসঙ্গে খিচ—খিচ করছে। ফড়ফড় করে পাখি উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। মাঝে মাঝে ডানার ঝাপটা মেরে যাচ্ছে। ঠক করে টেবিলে এসে বসছে। চোখে কোনও শঙ্কা নেই। শুধু কৌতূহল। ছোট্ট বুক ওড়ার উত্তেজনায় উঠছে—নামছে। মসৃণ পালক।

কী উড়ছে বলো তো?

পাখি?

পাখি নয়, পাখি নয়। আনন্দ। ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে আনন্দ।

কী চলছে বলো তো?

ঘড়ি।

ঘড়ি নয়, ঘড়ি নয়, সময়ের অর্কেস্ট্রা। অনাদি, অনন্ত সময়ের ঐকতান।

তোমার সময়, আমার সময়।

সব মানুষের সময়। এ কি পথিক থামতে জানে না। কাল থেকে কালান্তরে শুধু চলেই যায়, ফিরে আর আসে না।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে একসময় তিনি বসে পড়লেন। টেবিলে চামড়া বাঁধাই চওড়া একটা খাতা। পলকাটা গেলাসে গোটাকতক সোনার কলম গোঁজা। বেতের ঝুড়িতে নানারকমের ফল। সবুজ কলার ছড়া। গাছের শুকনো শাখায় ঝুলছে নানা মাপের পাত্র। তাইতে রয়েছে পাখির খাবার। পাখির ডাক ঘড়ির শব্দ, তার মাঝে ঠাকুরদার কথা। খাঁচায় তেমন চড়া আলো ঢোকে না। ছায়া—ছায়া অন্ধকার। দুপুর বেলায় জঙ্গলের মতো। এক একটা পাখি আবার সুন্দর শিস দিচ্ছে। এপাশ থেকে ওপাশে উড়ে যাবার সময় ডানার বাতাসের ঝাপটা লাগছে।

এই খাতাটায় কি আছে জানো? পাখির কথা। স্বভাব, চরিত্র, ব্যবহার। পাখি হল জীবনের উচ্চাবস্থা। খাদ্য অতি অল্প। পরিত্যাগ সামান্য। কোনো দুর্গন্ধ নেই। খেচর প্রাণী। উদাসীন। ঈশ্বরমুখী। যতদিন বাঁচে ততদিন নিজের আনন্দে বাঁচে। পরিপূর্ণ সন্ন্যাসী। আকাশের অধিবাসী।

বৃদ্ধ বলে চলেছেন। মাঝে মাঝে একটা দুটো পাখি, হয় মাথায়, না হয় কাঁধে, না হয় টেবিলে এসে বসছে। টুকটুক করে ঘড়িতে ঠোক্কর মারছে। টেবিলের ওপর ঝুড়িতে রাখা ফলে ঠোঁটের খোঁচা মেরে, কিচকিচ করে আনন্দে নেচে উঠছে। সারা টেবিল জুড়ে সে কি নাচ ঘুরে ঘুরে!

বৃদ্ধ ঠাকুরদার সঙ্গে পাখিদের ভীষণ ভাব। কাঁধে বসে গালে আদরের ঠোকর। মাঝারি মাপের সাদা পাথরের বাটিতে ভিজে কিশমিশ। মাঝে মাঝে এক আধটা তুলে মুখে ফেলছেন। হাতের তালুতে রাখছেন পাখির জন্যে। তারা টুকটুক করে তুলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

বৃদ্ধ অরূপকে বললেন, বন্ধুকে কী খাওয়ালে?

প্রশ্ন করেই উঠে দাঁড়ালেন। একপাশে একটা বিশাল আলমারি। আলমারির পাল্লা খুলতেই খাঁচা ভরে গেল খাবারের গন্ধে। ভেতরে থরে থরে সাজানো ফল, খেজুর, কেক, মিষ্টি। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা খাবে খেয়ে যাও। কোনো লজ্জা নেই।

একসঙ্গে এত খাবার জীবনে দেখিনি। গরিবের ছেলে আমি। দু—বেলা ডাল—ভাত খেয়ে মানুষ। বৃদ্ধ আমার ইতস্তত ভাব দেখে মুঠো মুঠো কিশমিশ, মনাক্কা, বাদাম আর খেজুর হাতে তুলে দিলেন।

খাও খাও প্রাণ খুলে খাও। জীবন বড়ো ছোটো। যত পারো খেয়ে যাও। জীবন বড়ো ছোটো, যত পারো জেনে যাও। জীবন বড়ো ছোটো, যত পারো দিয়ে যাও। জীবন বড়ো ছোটো, যত পারো জেগে থাকো, ঘুমিয়ো না। ওই দ্যাখো, ওই শোনো, সময় সৈনিকের মতো মার্চ করছে। তালে তালে ছোটো। মনটাকে পাখির মতো, ঘুড়ির মতো আকাশে ওড়াও।

অরূপ আমার হাত ধরে টান মারল। ফিসফিস করে বললে, এবার পালিয়ে চল।

এখন ভাবি বৃদ্ধ কী সত্যিই পাগল ছিলেন? মনে হয় না। যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা একটু পাগলাটেই হন। শিল্পীরাও পাগল, লেখক পাগল। সাধক তাঁরাও পাগল। তা না হলে সংসার ছেড়ে ভোগ ছেড়ে ঈশ্বর ঈশ্বর করবেন কেন?

অরূপের ফুটফুটে সুন্দর একটা বোন ছিল। তার নাম ছিল রুবি।

নাম জিজ্ঞেস করলেই বলত, আমার নাম রএ হ্রস্বউ বএ হ্রস্বই। বলেই খুব হাসত। বড়ো বড়ো মার্বেলের মতো চোখ। একমাথা চুল রিবন বাঁধা। লাল ঠোঁট। ছোট্ট হাঁ। মনে হত কোনো দেবী জন্মেছে। এই রুবির সঙ্গে আমার ভীষণ ভাব হয়েছিল। রুবির টানে প্রায়ই চলে আসতুম অরূপদের বাড়ি। ওদের একটা ছোটো আইসক্রিম কল ছিল। সন্ধেবেলা সেই কল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অরূপের মা আইসক্রিম বানাতেন। আমরা ফুরফুরে হাওয়ায় ছাতে বসে বসে হুসহাস শব্দে সেই আইসক্রিম খেতুম আর গল্প করতুম। দমকা হাওয়ায় গাছের পাতা ভীষণ দুলে দুলে উঠত। নারকেল গাছের পাতা থেকে কাক খসে পড়ত তাল সামলাতে না পেরে। ছেলেবেলার কথা মানুষ সহজে ভোলে না। আবার যত বয়েস বাড়ে ছেলেবেলার কথা তত বেশি মনে পড়তে থাকে। ওইজন্যে বলে ছেলেবেলা মনে পড়লেই বুঝবে বয়েস বাড়ছে।

অরূপদের ছাতে রুবি একদিন আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছেলেবেলায় আমার খুব বিয়ের বাতিক ছিল। সুন্দর মেয়ে দেখলেই বিয়ে করব বলে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসতুম। বড়োমা তখন সামাল দিতেন, বড়ো হও বাবা, তখন তোমার বউ এনে দোবো।

পূর্ণিমা রাত। কোলে মাথা রেখে রুবি ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার ভেতরটা কেমন যেন অস্থির অস্থির। গভীর শ্বাসে বুকের ওঠাপড়া। মনে অনেক রকমের ইচ্ছে। ঘোড়ায় আমি কোনোদিন চাপিনি। সেদিন মনে হয়েছিল তেজি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে আছি, প্রাণপণে লাগাম টেনে। মনে মনে বলছি, পড়ে যাস না খোকা। বেচাল হোসনে খোকা।

নিজেকে দিয়েই নিজেকে সামলাতে হয়। আমার গুরু অজ্ঞাতবাবা বলতেন, তুমিই তোমার বন্ধু, তুমিই তোমার শত্রু। সুপথে থাকার জন্যে নিজেকেই নিজে আদেশ করবে। বিপথে গেলে নিজেকেই নিজে ধমক লাগাবে। নিজের মন নিজেকেই দেখতে হয়। নিজের গৃহ নিজেকেই সংস্কার করতে হয়।

পূর্ণিমার সেই রাত, কোলে রুবির মাথা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসেছিলুম। বুকে ঢেউ উঠছে। সমুদ্র উত্তাল হলে নাবিকরা জলে তেল ঢেলে দেয়। আমি মনে মনে অজ্ঞাতবাবাকে স্মরণ করেছিলুম। দেখো বাবা টলিয়ে দিয়োনা। আমি পবিত্র থাকতে চাই। সেদিন পরীক্ষায় পাশ করে গিয়েছিলুম। ফুল মার্কস। পায়ে ঝিনঝিন ধরে গেছে। পাছে রুবির ঘুম ভেঙে যায়, পা সরাতে বা নাড়াতে পারছি না। গুনগুন করে গান গেয়ে চলেছি :

পড়িয়ে ভবসাগরে ডুবে মা তনুর তরী
মোহঝড় মায়াতুফান ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করী।।

এসব গানের মানে বোঝার বয়েস আমার হয়নি তখনও। তবু গেয়ে চলেছি। তখন তো অন্য কোনো গান তেমন শোনা যেত না। মানুষ ধার্মিক না হোক ধর্মের খুব প্রভাব ছিল। ঘরে ঘরে পুজো। মন্দিরে আরতি। পালাপার্বণে উপোস।

চাঁদের আলোয় বাতাস ঠান্ডা হয়ে যায়। বেশ শীত শীত করছে। রুবির মুখে চাঁদের আলো পড়েছে। মনে হচ্ছে রুপো আর পেতল গলিয়ে ঢালাই করে তৈরি। ঠান্ডা বাতাসে শরীরের এক পিঠ ঠান্ডা আর এক পিঠ গরম। আমার কোল গরম হয়ে উঠেছে দেহের ভারে। রাতের আকাশে অশরীরীরা কি কাঁদে? মাঝে মাঝে দু—এক ফোঁটা জল পড়ছে গায়ে। নীল, মেঘশূন্য আকাশ থেকে জল পড়ে কী করে? নক্ষত্রের জল। এই কি সেই স্বাতীনক্ষত্রের জল। ঝিনুকে পড়লে মুক্তো হয়। কার কৃপায় জানি না, সেই রাতের সেই বসে থাকায়, নিজেকে জোর করে ধরে রাখতে পারায়, একটা জিনিস হয়েছিল, সহজে কেউ আমাকে টলাতে পারত না। কাম জয় করা ভীষণ কঠিন। কথায় আছে পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়ে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ কাঁদে।

অজ্ঞাতবাবা বলেছিলেন, মেয়েদের ঘৃণা করে মুক্তি পাবে না কোনোদিন। যাঁরা বলেছেন, নারী নরকস্য দ্বার, তাঁরা সহজে মুক্তি পেয়েছেন বলে মনে হয় না। উলটে সেই নরকেই পড়েছেন। চণ্ডীর শিক্ষাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। স্ত্রীয়া সমস্তা সকলা জগৎসু। নারীকে মাতার আসনে বসিয়ে দাও। ব্যস, আর কোনো ভয় নেই।

অজ্ঞাতবাবার ওই শিক্ষা আমার জীবনকে কত বিপদ, কত ফাঁদ থেকে যে বাঁচিয়েছিল! খুব কষ্ট হত। যতই হোক আমি মানুষ তো। দেবতা বলে ভাবলেই তো আর দেবতা হওয়া যায় না। সাধনা চাই। ইন্দ্রিয়কে যত ইন্ধন জোগাবে, ততই সে আগুন বাড়বে। ভোগে নিবৃত্তি নেই। ভোগে শান্তি নেই, ত্যাগেই শান্তি। জীবনকে যত জড়াবে তত দুঃখ বাড়বে। জালে পড়া সিংহের মতো তখন মুক্তি খুঁজতে হবে মূষিকের কাছে। নারী মানে মায়া, মায়া মানে সংসার, সংসার মানে বন্ধন। রোগ, শোক, জরা, দাসত্ব।

অরূপের ঠাকুরদা বলতেন, পাখি হও পাখি, আর সময়ের শব্দ শোনো। তাঁর টেবিলের সামনের দেয়ালে নানারকম উদ্ধৃতি গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রাখতেন। একদিন দেখি কবি টেনিসনের দুটি লাইন লিখে রেখেছেন :

which is today
Tomorrow will be yesterday.

যাকে তুমি আজ বলছ, কালই তা হয়ে যাবে গতকল্য। একদিন দেখি লিখে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা কয়েকটি লাইন:

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে—পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।।

একদিন বললেন চৈত্রের পাতার মতো পায়ের তলায় জীবনের দিন ঝরে ঝরে পড়ছে। যা যাচ্ছে তা আর কোনোদিন ফিরবে না। খেলনা দিয়ে নিজেকে আর কত ভোলাবে। সত্যের মুখোমুখি হও। জীবনের সত্য কি? বিচ্ছেদ, বেদনা। যে ছিল সে নেই। যে আছে সে থাকবে না। তবে এত উল্লাস কিসের? মানুষ কি ছাগল? মাংসের দোকানে ছাল—ছাড়ানো পাঁঠা ঝুলছে। কিছু পরেই যে পাঁঠাটা জবাই হবে মনের সুখে চোখ বুজিয়ে বটপাতা চিবোচ্ছে। মানুষ কি পাঁঠা? দিন চলে যাচ্ছে। আয়ু ঝরে যাচ্ছে, তবু, তবু মানুষের চেতনা নেই। খাচ্ছে—দাচ্ছে আর মনের সুখে বংশ বৃদ্ধি করছে। তোরা ওই শয়তানের চাকায় ঘুরিস নে। কেটে বেরিয়ে যা, ছিঁড়ে বেরিয়ে যা, সব খুলে বেরিয়ে যা। অনন্তের মুখোমুখি জিজ্ঞাসা নিয়ে দাঁড়া। কে আমি? কেন আমি?

একদিন দেখি লিখে রেখেছেন গীতার একটি শ্লোক :

অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিবেদনা।।

রোজ কী লিখলেন দেখার জন্যে রোজ আসা। প্রথম প্রথম নিজেকে প্রশ্ন করতুম, হ্যাঁরে খোকা কীজন্যে আসিস, পাখির জন্যে? বৃদ্ধ মানুষটির জন্যে? না রুবির জন্যে? উত্তর যা পেতুম তাতে ভীষণ ভয় পেয়ে যেতুম। কিন্তু ওই পূর্ণিমা রাতের পর প্রশ্নের উত্তর এল অন্যরকম। মন সেইদিনই জোর গলায় প্রথম বললে, পাখি দেখতে, ঘড়ির অর্কেস্ট্রা শুনতে বৃদ্ধ কী লিখেছেন দেখতে।

রুবি আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল। তাতে ছিল সেই চিরকালের কথা। যে কথা প্রথম যৌবনে সব মেয়েই কোনো—না—কোনো ছেলেকে লেখে। তারপর একদিন সব ভুলে যায়। যার সঙ্গে সংসার পাতার তার সঙ্গে সংসার পেতে মা হয়। ঠাকুমা হয়। প্রথম যৌবনের প্রেম ভুলে যায়। স্মৃতিতেও কিছু থাকে না। মেয়েদের মন আমার অজানা নয়। প্রেম বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তা প্রথম বয়েসে নেই। থাকলে শেষ বয়েসে আছে। দেহ যখন মরে এসেছে, মন আর জ্ঞান যখন বড়ো হয়ে উঠেছে।

শেষ শীতে খাঁচার পাখি ডিম পেড়েছে। বৃদ্ধের সে কী আনন্দ। ডিমের খোলার ভেতর ঘুমিয়ে আছে জীবনের সম্ভাবনা। আমাদের বললেন, বুঝলে, জীবনের বিকাশের জন্যে দুটো জিনিসের প্রয়োজন, সময় আর উষ্ণতা। মানুষের ডিম হয় না, মানুষ তাই বোঝে না। সেই কারণেই মানুষ এত নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন। শীতল। সেদিন তাঁর দেয়ালে লেখা ছিল, তিনটি লাইন:

 পূর্ণপ্রাণে চাবার যাহা
 রিক্ত হাতে চাস নে তারে;
 সিক্ত চোখে যাস নে দ্বারে।

সমস্ত গাছে এসে গেছে নতুন পাতা। টলটলে সবুজ রঙ গুলে কে যেন হুড়হুড় করে ঢেলে দিয়েছে প্রকৃতিতে। আমরা সবাই ছাতে বসে কেরাম খেলছি। নিচে অরূপের মা কেঁদে উঠলেন।

বৃদ্ধ মারা গেছেন। টেবিলের ওপর মাথা। দুটো হাত ঝুলে আছে চেয়ারের পাশে। একমাথা সাদা চুল যেন আরও সাদা। ধবধবে সাদা আলখাল্লা লুটোচ্ছে চেয়ারের তলায়। মাথার কাছে খাঁচার সমস্ত পাখি সার সার বসে আছে নিস্তব্ধ ধ্যানে। খাঁচার ভেতর দেহ খাঁচা তার ভেতর ছিল প্রাণপাখি। সে পাখি কখন উড়ে গেছে। সাক্ষী ছিল বন্দি পাখির দল। সেই নিস্তব্ধতায় অসংখ্য ঘড়ি শুধু টিকটিক করে চলেছে। বৃদ্ধ বলতেন সময়ের অর্কেস্ট্রা। মনে হল দেয়ালে লিখে রেখে যাই শেষ লেখা : মন্দচরণে চলি পারে/যাত্রা হয়েছে মোর সাঙ্গ/সুর থেমে আসে বারে বারে/ক্লান্তিতে আমি অবশাঙ্গ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *