কেবলই ছায়া – ২

দুই

পাখি ডাকে। শহরেও পাখি ডাকে। চরণদাসের বিলে ভোরে পদ্ম ফোটে। জলপিপি নেচে নেচে বেড়ায়। বিলের উত্তরে একটা পাথর পড়ে আছে। ওই পাথরে বসে বাবা মাছ ধরতেন। আমি কতদিন পাশে বসে বসে মাছ ধরা দেখেছি। সেই ছিপ আর হুইলটা পড়ে আছে। মানুষ চলে গেছেন কোথায় কে জানে! কেউ বলতে পারে না, মানুষ আসে কোথা থেকে, মানুষ যায় কোথায়!

গ্রামের মেলা থেকে একবার একটা বেলুন কিনেছিলুম। ঘোর বেগুনি রঙের। গায়ে যেন মেঘ ভাসছে। নাড়াচাড়া করতে করতে দুম করে ফেটে গেল। প্রায় কেঁদে ফেলি আর কি। এমন সময় পেছন দিক থেকে কাঁধের ওপর ভারী একটা হাত এসে পড়ল। চমকে তাকিয়ে দেখি গেরুয়া পরা এক সন্ন্যাসী। সাদা সাদা দাড়ির ফাঁকে ফরসা টকটকে মুখ। চোখ দুটো যেন হিরের মতো জ্বলছে। ঠোঁটে অল্প একটু হাসি,

কী হল রে?

বললুম, ফেটে গেল, আমার বেলুন।

কাঁদছিস কেন? বোকা। ভেতরের হাওয়া বাইরের হাওয়া মিশে গেল।

সবই তো হাওয়ারে গাধা। খোলসের কী দাম আছে। সেটা তো একটুকু হয়ে চামচিকির মতো পড়ে আছে তোর পায়ের কাছে।

আয় বোস এখানে।

বটতলার ফাটা বেদিতে আমরা দুজনে বসলুম। সন্ন্যাসীর সারা গা থেকে কেমন একটা মন্দির মন্দির গন্ধ বেরোচ্ছে। মনে হচ্ছে পাশেই যেন ধূপ জ্বলছে। আমার মুখের খুব কাছেই তাঁর হাসি হাসি মুখ। আমার কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি মেরে বললেন, শোন তাহলে একটা গান ধরি।

হাতের মুঠোয় আঙুলের টোকা মেরে মেরে সন্ন্যাসী গান ধরলেন, সেই গান আজও ভুলিনি।

 কে ধরবি ধর তারে হুমা কলে জ্বলছে বাতি,

 হাওয়া তার বাহিরে।।

 আগুন, পানি, মাটি, হাওয়া, এই চারজন কেবল আসা যাওয়া,

 আছে মানুষ ত্রিপিনি বাঁকা, কোনখানে বসে কল ঘুরাইছে রে।

 হাওয়ার খবর যে পাইয়াছে, সে বুঝি বাইরে পইড়াছে

 চশমার নিরিখ যে মাইরাছে মন্দিরে মানুষ ধইরাছে রে।।

যেমন গলা তেমনি সুর। দেখতে দেখতে চারপাশে লোক জড়ো হয়ে গেল। ভিড় দেখে সন্ন্যাসী গান থামিয়ে ঝট করে উঠে পড়লেন। চল্লুম রে, তোর সঙ্গে পরে আবার দেখা হবে।

মাঠ—ময়দান ভেঙে হনহন করে চলে গেলেন। দূর থেকে দূরে। মানুষের ভয়ে পালিয়ে গেলেন। মানুষকে এত ভয়! গানের কী মানে! হুমা কলে জ্বলছে বাতি। বাতি মানে কী প্রাণ? তাই হয়তো হবে। আছে মানুষ ত্রিপিনি বাঁকা। তারই বা কী মানে?

আজ আমার জীবনকাহিনি লিখতে বসে, দেখতে পাচ্ছি, অনেক কিছুরই মানে জানি না। নিজের মতো মানে করে ভাবে বিভোর হয়ে আছি। সারাটা জীবন ভাবের ঘোরে থেকেছি বলেই জীবন কখনও আমাকে কাবু করতে পারেনি। কত মানুষই তো দেখলুম! উঠল, পড়ল, রাজা ফকির হল, ফকির রাজা হল। আমি কী থেকে কী হলুম আজও জানা হল না। খালি গুনগুন করি, কে ধরবি ধর তারে হুমা কলে জ্বলছে বাতি।

আমার পাগলামামা কোথা থেকে একটা তোলা উনুন নিয়ে এলেন। উঠোনে সেটা নামিয়ে নৃত্য শুরু করলেন, দিদির সংসার শুরু হয়ে গেল। ওরে তোরা তোপধ্বনি কর। ওই ফাগুনের আগুন লাগে, তোরা সব তোপধ্বনি কর। একপাশে একটা অ্যালুমিনিয়ামের তাল—তোবড়ানো হাঁড়ি পড়েছিল, সেইটাকে বুকের কাছে চেপে ধরে, পটপটাপট বাজাতে লাগলেন। দোতলার সেই মেয়েটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে আর বলছে, বাঃ, বাঃ, ঘুরে ঘুরে হোক, ঘুরে ঘুরে হোক। মা বললেন, একটা উনুন এনে খুব তো নাচন—কোঁদন হচ্ছে, কয়লা কোথায়, ঘুঁটে কই, চাল, ডাল, আলু, পটল, এসব আসবে কোথা থেকে?

মাতুল বললেন, ভেবো না, ভেবো না সই। যে খায় চিনি, তারে জোগান চিন্তামণি। ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন। নাঃ, ডায়ালগটা ঠিক হল না। ওটার সঙ্গে এটা যায় না।

রকে থেবড়ে বসে পড়লেন। সামনে নতুন তোলা উনুন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মামা কপালে টোকা মারতে লাগলেন।

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, অমন করছ কেন গো?

খিঁচিয়ে উঠলেন, গাঁইয়াদের মতো গো গো করসিনি তো। সব কথাতেই গো। জানিস, মাথা হল নস্যির ডিবে। বুদ্ধি হল নস্যি। যত টোকা মারবি তত থিতোবে। পয়সা রোজগার হল বুদ্ধির কাজ। বুদ্ধুর কাজ নয়, চুপ কর পাশে বোস। বুদ্ধিতে একটু ঢেউ তুলি।

সে আবার কী জিনিস বাবা! নদীতে ঢেউ তোলা যায়, বুদ্ধি কি নদী!

মামা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, জানিস তো বুদ্ধির দোষে হা ভাত, বুদ্ধির গুণে খা ভাত। কী বুঝলি?

দাদু বলতেন, বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য নির্বুদ্ধেস্তু কুতঃ বলং।

বাঃ বাঃ, এইটেই হবে। বেশ ভালো রোজগার হবে। শোন আমরা হলুম বামুনের ছেলে কেমন? আমারও পইতে আছে, তোরও পইতে আছে।

আমার তো এখনও পইতে হয়নি।

ও হয়ে যাবে। কতক্ষণের আর ব্যাপার! আমারটা বেশ মোটা, হাফাহাফি করে পরা যাবে।

পইতে পরলেই রোজগার?

তুই একটা গবেট গাধা। মানুষের মতো দেখতে হলে হবে কী! মাথায় তোর মা ভগবতীর পেছনের ভড়ভড়ে জিনিস ঠাসা। আচ্ছা বল তো, মানুষ কীসে কীসে খরচা করে?

এক খিদে পেলে করে, আর অসুখ করলে করে।

মন্দ বলিসনি, তবে সে খরচ আর কত? খরচের মতো খরচ করে, ভেগে আর ধর্মে, তার মানে পাপে আর পুণ্যে। মামা হয়ে তোকে পাপের কথা বলি ক্যামনে। তাছাড়া সে পথে যে টাকা উড়ছে তা ধরার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা ধর্মের পথে রোজগার করব এই পইতের জোরে। ভাগনে তাহলে হাতে হাত মেলাও।

তুমি যে কী বলতে চাইছ আমার মাথায় ঢুকছে না। পইতে গলায় লোকের সামনে দাঁড়ালেই টাকা দিয়ে দেবে?

আজ্ঞে না। টাকা রোজগার অত সহজ নয়। আমরা দুজনে পুরুতগিরি করব। বড়ো বড়ো যজমান ধরব। দোল, দুর্গোৎসব, সত্যনারায়ণ। আরে মূর্খ বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। নে ওঠ, লেগে পড়ি। পইতেটা ভাগাভাগি করে পরি।

তারপর?

তারপর সে হবে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। যজমান ধরিব খাইব সুখে। ঘি, আলোচাল, ফল, সন্দেশ, দই, ঘোল। ওঃ তোফা তোফা। মিছে কেন ভাবনা করিস মন, এবার হবে গোদের ওপর বিষফোঁড়া। ওরে কেন ভাবনা করিস মন—

মামা আবার নাচতে লাগলেন।

দোতলার বারান্দা থেকে বাঘের মতো গলায় মহীতোষবাবু বললেন, কী হল হে ভবতারণ? অত নর্তন—কুর্দন কীসের? রেঞ্জার্সের লটারি পেলে নাকি?

আজ্ঞে না দোদা, একটা তোলা উনুন পেয়েছি।

অ্যাঁ, তোলা উনুন! লাস্ট প্রাইজ বুঝি?

আজ্ঞে প্রাইজ না। হাফ প্রাইসে কিনলুম।

উনুন হাফ প্রাইসে? সে কী হে, উনুনও সেকেন্ড হ্যান্ড পাওয়া যায়?

ওই যে কোর্টের অর্ডারে মোড়ের বাড়ির ভাড়াটের মালপত্তর সব ক্রোক করলে। বেলিফের হাতে একটা আধুলি গুঁজে দিয়ে পাশ থেকে সুট করে উনুনটা তুলে নিয়ে এলুম। হেঃ হেঃ বাবা, আমার নাম গ্রেট ভবতারণ মুকুজ্যে। ইংরেজিতে জি বি টি এম।

বেশ উনুন তো হল, এবার ঘুঁটে, কয়লা, চাল, ডাল, তেল, নুনের কী হবে?

হবে, হবে, সবই হবে। ভগবান যখন দেন ছপ্পর ফুঁড়ে দেন, আবার যখন নেন ছিবড়ে করে নেন।

তাহলে আকাশের দিকে দু—হাত তুলে নাচো, নেচে যাও—আল্লা ম্যাঘ দে, আল্লা পানি দে।

শুঁড় তোলা চটির ফ্যাট ফ্যাট আওয়াজ তুলে মহীতোষবাবু নিচে নেমে এলেন। একেবারে মহাদেবের মতো চেহারা। ঘাড়ের কাছে লুটোচ্ছে বড়ো বড়ো চুল। পরে আছেন সিল্কের ধুতি। সিল্কের গেঞ্জি। কপালে এতখানি একটা সিঁদুরের টিপ। নিচের উঠোনে নেমে গমগমে গলায় ডাকলেন, কই আমার দিদি কোথায়? দিদি, দিদি!

মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ভেবেছিলুম খুব ভয়, কি লজ্জা পাবেন। না, একেবারে সহজ, সরল। মাথায় ঘোমটাও নেই। বেরিয়ে এসে বললেন, এই যে ভাই।

মায়ের ব্যবহারে অতবড়ো মানুষটা থতোমতো খেয়ে গেলেন। মাকেও অসাধারণ দেখাচ্ছে। স্বপ্নে দেখা দেবীর মতো। মায়ের চোখ দুটো কী সুন্দর!

মহীতোষবাবু নিচু হয়ে মায়ের পায়ের ধুলো নিলেন। ভেবেছিলুম মা হয়তো সরে যাবেন। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মন্দিরের দেবীর মতো।

মহীতোষবাবুর মাথার পেছনে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললেন, সব বিপদ কেটে যাক, তুমি জয়ী হও।

মহীতোষবাবু ছলছলে চোখে বললেন, আমি মদ্যপ, আমি পাপী, আমি থিয়েটারে অভিনয় করি।

মা বললেন, সে তো তোমার বাইরেটা। তোমার ভেতর?

ভেতরের খবর আমি রাখি না। আমি বাইরে নিয়েই মেতে আছি।

আমরা তো কেউই চন্দ্র—সূর্যের খবর রাখি না, তাঁরা কিন্তু তাঁদের কাজ ঠিক করে যাচ্ছেন। তোমার ভেতর, ভেতরের কাজ ঠিকই করে যাচ্ছে। যাকে অনেকে মানে জানবে তার ভেতর ঈশ্বর আছেন।

মহীতোষবাবু বললেন, তুমি যখন ভবতারণের দিদি তখন আমারও দিদি। ঠিক কিনা!

মা হাসলেন।

তাহলে তোমার সব ভার আমার।

মা আবার হাসলেন। হেসে বললেন, তুমি আমার মধ্যে এমন কী পেলে?

বড়ো শান্তি পেলুম। আমার ভেতরটা সবসময় আগুনের মতো জ্বলে। তোমার সামনে এসে দাঁড়াতেই মনে হল গঙ্গায় অবগাহন করেছি। আমার রাত একরকম। সূর্য যত নিচে নামতে থাকে, অন্ধকার যত ঘনিয়ে আসে, পোড়ো মন্দিরের ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বাদুড় একটা একটা করে উড়ে যায়। পৃথিবীর যেখানে যত উদ্যান আছে, সেখানের গাছে গাছে তাজা ফলে বসে চুষতে থাকে। সারারাত। যতক্ষণ না ভোর হচ্ছে। আমি দিনে এক মানুষ, রাতে আর এক মানুষ।

মামা ফটফট করে হাততালি দিয়ে বললেন, এনকোর, এনকোর। কী ডায়লগ!

মহীতোষবাবু ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, এই গাধা এদিকে আয়।

ছেলেবেলায় শুনে শুনে ছড়া কাটতুম, মামা ধামা বাজাব। মামি এলে স্যাকরা ডেকে গয়না গড়াব। মামাকে গাধা বলায় মনে মনে বড়ো রেগে গিয়েছিলুম। পরে বুঝেছিলুম, মানুষের মধ্যে যেসব মানুষ গুণে অনেক বড়ো হয়ে যান, তাদের মাপে অন্য সকলে গাধাই। একেবারে নিরেট গাধা। রাগের কিছু নেই।

মামা কাছে এসে দাঁড়াতেই মহীতোষবাবু কাঁধে একটা হাতে রেখে বললেন, দুটো সংসার আজ থেকে এক করে দে। দুই দুই ভালো নয় বুঝলি! জয়েন্ট ফ্যামিলি সব ভেঙে টুকরো টুকরো। যারা ভাঙচে ভাঙুক আয় আমরা গড়ি।

মামা বললেন, ফ্যামিলি? আমরা তো তোমার ভাড়াটে গো। তিন মাস ভাড়া বাকি পড়েছে। ট্যাঁক গড়ের মাঠ। তুমি বলছ, ফ্যামিলি জুড়ে দে।

আরে গাধা, রক্তের সম্পর্কে দেখছিস তো বিষ ঢুকে গেছে। রক্তের বাইরে হয়তো সম্পর্ক টিকবে। ফ্যাচ ফ্যাচ না করে, দিদিকে ওপরে নিয়ে যা। ওরে প্রতিষ্ঠা কর, প্রতিষ্ঠা। আজ বৈশাখী পূর্ণিমা। দিনটা বড়ো ভালোরে।

মহীবাবু ভারি গলায় মাকে বললেন, দিদি, তুমি বলো? তোমার অমত নেই তো! মা মৃদু হাসলেন। হেসে বললেন, আমি একজনকে বিশ্বাস করি ভাই।

কে সে?

ঈশ্বর। সেই ওপরওয়ালা। যাঁর নির্দেশে, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র চলছে। যাঁর ইচ্ছে ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না। মানুষের কাছে দুঃস্থ মানুষ এলে দূর দূর করে। তুমি করলে তার উলটো। কেন করলে? কার ইচ্ছেয় করলে?

যদি বলি, আমারও স্বার্থ আছে।

কী সেই স্বার্থ!

আমি একজন অভিভাবিকা চাই। আমার ভাঙা সংসার আরও ভেঙে যাক, তা আমি চাই না। আমার আর ক—দিন। আজ আছি কাল নেই।

কে বলেছে, তুমি আজ আছ কাল নেই?

আমার পেট, আমার লিভার। তুমি তো জানো না দিদি, বোতল, বোতল মদ খেলে মানুষ বেশিদিন বাঁচে না। তার ওপর রাতের পর রাত জাগা!

মা আবার হাসলেন, মদ আর রাতজাগা তোমার কিছু করতে পারবে না। একজন তোমার হাত ধরে আছে।

কে ভগবান?

না, তোমার স্ত্রী।

আমার স্ত্রী! আমি যে বিয়ে করেছিলুম, এ খবর তো কেউ জানে না। সে তো বছর দুয়েকের খেলা ছিল! তুমি জানলে কী করে দিদি? কে তোমাকে বলেছে!

মা একটু থতোমতো খেয়ে গেলেন। মায়ের চোখে আবার সেই দৃষ্টি। যেন বহুদূরের কিছু দেখছেন। চোখের পাতা পড়ছে না। পাথরের মূর্তির মতো স্থির।

মহীবাবু ভয়ে ভয়ে বললেন, কী হল, কী হল কী তোমার?

মায়ের যেন ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙল। চারপাশে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, আমাকে তোমরা আর প্রশ্ন কোরো না। আমার কী যেন হয়েছে নিজেই জানি না।

মহীবাবু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মায়ের এই ভাব দেখলে আমিও ভয় পেয়ে যাই। এ মা আমার অন্য মা। এ মাকে আমি চিনি না। মায়ের এই চেহারা আমি ট্রেনে দেখেছি। দেখেছি সেদিন যেদিন মাকে গুন্ডায় ধরেছিল গ্রামের পথে।

গোলগাল টুকটুকে চেহারা বিহারি একটি ছেলে ঢুকল, কই আমার রাজাবাবু কোথায়, রাজাবাবু।

ছেলেটির হাতে রঙবেরঙের গোটাকতক শিশি ঝুলছে, গলায় দড়ি বাঁধা।

এ আবার কে রে বাবা?

মহীবাবু বললেন, এসেছিস গোলাপ, এসেছিস, আয় আয়।

গোলাপ হল তেলমালিশঅলা। রকে একটা মাদুর বিছিয়ে মহীবাবু শুয়ে পড়লেন। গোলাপ তার সাজপোশাক ছেড়ে একটা ছোটো প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। হরেক রকমের তেল। ভুরভুরে গন্ধ। মহীবাবুর চেহারা যেন শিবের মতো। টকটক করছে গায়ের রঙ। মাথায় বড়ো বড়ো লাল লাল চুল। বড়ো বড়ো টানা টানা চোখ। কোনো মন্দিরে বেদিতে বসিয়ে দিলে বাবা মহাদেব।

শিব তুষ্ট হলে মানুষের সব হয়। আমরা মাঠকোঠা থেকে একেবারে দালান কোঠায়। একতলা থেকে দোতলায়। সেখানে বড়ো বড়ো ঘর। সাজানো গোছানো। বড়ো বড়ো জানলা। জানলার মাথার ওপর লাল, নীল, হলদে, সবুজ কাচ বসানো। আলো ঢুকছে রামধনুর মতো। ছাদ কত উঁচুতে! কী সুন্দর সাজানো! বড়ো বড়ো খাট। বিশাল বিশাল চেয়ার টেবিল। স্বর্গ কাকে বলে জানি না। মনে হল এই আমার স্বর্গ। দেয়ালে বড়ো বড়ো ছবি। পরে জেনেছিলুম, সে সব ছবি হল বড়ো বড়ো অভিনেতার। গিরিশ ঘোষ, দানিবাবু, বিনোদিনী। উত্তর, দক্ষিণ, পুব, পশ্চিম সব দিক খোলা একটা ঘরে শুয়ে আছেন মহীবাবুর মা। বয়েস হয়েছে। তবু কী সুন্দরী! জানলার বাইরে গাছের ডালে বসে শালিক পাখি ডাকছে। বৃদ্ধার চোখ সেই দিকে। দেয়ালের গায়ে ঝুলছে গোটা গোটা রুদ্রাক্ষের মালা। ঘরে ধূপের গন্ধ। একপাশে একটা ঝকঝকে সুন্দর টেবিল। তার ওপর গোটাকতক বই। একটা খাতা, কলম। কলমের মাথাটা সোনার। বড়োলোক না হলে জীবন সুন্দর হয় না। এই ধারণা সেই ছেলেবেলা থেকেই আমাকে পেয়ে বসেছিল। সুন্দর পঙ্গু হলেও পড়ে আছে বড়োলোকের ঘরে। আর যতকিছু অসুন্দর, কুৎসিত সব চলে এসেছে গরিবের এলাকায়। বস্তি, ধোঁয়া, ধুলো, আবর্জনা, মামলা, অসুখ—বিসুখ।

আমি ভেবেছিলুম, আমার মা হয়তো মহীবাবুর মায়ের সামনে রাঁধুনির মতো গিয়ে দাঁড়াবেন। দাসীর মতো মুখ করে। আর আমি হব দাসী—পুত্র। ভাবামাত্রই খারাপ লাগছিল।

মা যেন আমার রানির মতো। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মহিলাকে লক্ষ করছেন। গাছের ডাল থেকে তাঁর চোখ ফিরে এল মায়ের দিকে। একটু যেন অবাক হয়েছেন। মা এগিয়ে গেলেন খাটের মাথার দিকে। মহিলার কপালে ডান হাত রাখতেই, তিনি ধীরে ধীরে চোখ বোজালেন। মুখের টান টান যন্ত্রণার ভাব অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন বেশ আরাম পাচ্ছেন। ধীরে ধীরে চোখ খুলে মৃদু—গলায় বললেন, ‘কে আপনি?’

মা মৃদু গলায় বললেন, ‘আমি ভবর দিদি।’

কাল এসেছেন, তাই না?

হ্যাঁ, দিদি।

আর কী হবে? আমাকে তো সারাজীবন এইভাবেই শুয়ে থাকতে হবে।

খাট থেকে ঘাট এই আমার বরাত দিদি!

কী করে বুঝলেন? তা নাও তো হতে পারে!

কতরকমের চিকিৎসাই তো হল! কিছু হল না। কয়েক বছর আগে একটা পা একটু নাড়তে পারতুম, এখন আর তাও পারি না। একেবারে অসাড়।

আপনার তো ওষুধে হবে না দিদি। আপনার রোগ বসে আছে মনে। মেয়ের জন্যে অত চিন্তা কেন দিদি? অমন তো হতেই পারে।

মহিলা চমকে মায়ের মুখের দিকে তাকালেন। রাধাদির জীবনেও তাহলে রহস্য আছে। অমন যে সুন্দরী তার জীবনেও দুঃখ আছে নাকি! সেই সাধু বলেছিলেন, গোলাপ দেখেছিস তো কত সুন্দর, ভুরভুরে গন্ধ। পাপড়ি উলটে দ্যাখ থিকথিক করছে পোকা।

মায়ের চোখে আবার সেই দূরের দৃষ্টি ফিরে আসছে। জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস ঢুকছে। সেই বাতাসে মায়ের রুক্ষ চুল উড়ছে। সাদা ধবধবে শাড়ি। কালো সরু পাড়।

মহিলা মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী করে জানলেন দিদি! কেউ তো জানে না সে সব কথা। মায়ের চোখ থেকে দূরের দৃষ্টি সরে গেল ধীরে ধীরে। মৃদু গলায় বললেন, কেউ বলেনি দিদি। কেউ কোনো কথা বলেনি, আমার কী হয়েছে জানি না, আমি অতীত দেখতে পাই।

ভবিষ্যৎ?

হ্যাঁ, তাও পাই।

এ সংসারের ভবিষ্যৎ কী দিদি?

সে আমি আর একদিন বলব। আজ আমার ঘোর কেটে গেছে। আবার এলে বলব। আপনি এখন শান্ত হয়ে বসে থাকুন। জেনে রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমার দিকে মহিলার চোখ পড়ে গেল। পায়ের দিকে দাঁড়িয়েছিলুম।

জিজ্ঞেস করলেন, কে গো তুমি?

মা বললেন, আমার ছেলে। ওই আমার একমাত্র সন্তান। অল্পবয়েসেই বাপকে হারাল।

আয়, কাছে আয়।

পাশে সরে গেলুম। একটা হাত ধরে বললেন, লেখাপড়া শিখছিস।

ঘাড় নাড়লুম।

আমাকে বই পড়ে শোনাতে পারবি?

আবার ঘাড় নাড়লুম। হাতটা মাখনের মতো নরম। দুধের মতো সাদা।

হাতের লেখা কেমন রে?

খুব একটা খারাপ নয়। কোনোরকমে জড়িয়ে জড়িয়ে বললুম।

ভয় পাচ্ছিস কেন বাবা? আমি বাঘ না ভাল্লুক।

হঠাৎ বলে ফেললুম, আপনি কী সুন্দর!

হাতের দুটো আঙুল দিয়ে আমার গাল নেড়ে দিয়ে বললেন, তুইও তো সুন্দর দাদা। আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি।

নিচে থেকে মহীদার গলা ভেসে এল—কই গো আমার দিদি কোথায়? একটু গরমজলটল হবে না! মা ঘর থেকে এখন আসি বলে বেরিয়ে গেলেন।

মহিলা বললেন, তুই ওই ডায়েরি আর কলমটা নিয়ে আয়।

ডায়েরির মলাটটা রেশমের। ঘোর বেগুনি তার রঙ। সোনার জলে ‘বছর’ লেখা। কলমটা সোনার। দুটো জিনিসই হাত দিতে ভয় করছে। সাবধানে বিছানায় নিয়ে এলুম।

একপাশে পা তুলে বাবু হয়ে বোস।

গোদা গোদা পায়ে অনেক ধুলো। এ কি শহরের পা? এ হল গ্রামের পা। পায়ের পাতা এই বয়েসেই বাইশ শো বাইশ। দাদু বলতেন, এ ব্যাটার পায়ের জুতো কোনো দোকানে মিলবে না। আস্ত একটা গোরু লাগবে। অর্ডার দিয়ে বানাতে হবে।

আমার ইতস্তত ভাব দেখে মহিলা বললেন, কিচ্ছু ভাবিসনি, পা তুলে বোস। তুই আমার নারায়ণ।

পা তুলে বসলুম।

আজকের তারিখের পাতাটা খোল।

ডায়েরিতে মুক্তোর অক্ষরে পাতায় পাতায় কত কী লেখা! পড়তে ইচ্ছে করছে। সাহস হচ্ছে না। ডায়েরিতে মানুষের গোপন কথা লেখা থাকে। কী রে কী দেখছিস অমন অবাক হয়ে?

এত সুন্দর কার হাতের লেখা মাসিমা?

নিজে থেকেই একটা সম্পর্ক পাতিয়ে ফেললুম কেমন সহজে। বাপ—মরা ছেলেরা অল্পবয়সেই বেশ ওস্তাদ হয়। এই নিজেকে দেখেই বুঝছি।

রাধার হাতের লেখা। আমি বলে গেছি, ও লিখে গেছে। সব কবিতা। কেমন হয়েছে জানি না। কিছুই হয়তো হয়নি। আমার তো তেমন বিদ্যে নেই। মহী নাটক—টাটক করে, লেখে। ও বলছিল খুব ভালো হচ্ছে মা। একদিন কেউ—না—কেউ তোমার এই কবিতা আবিষ্কার করবে। কে করবে মহাকালই জানেন। যে—কোনো একটা পড় তো। বেশ ভালো করে পড়বি। কোথাও যেন না আটকায়।

প্রথম পাতার প্রথম কবিতাটাই পড়ে ফেললুম।

আমাকে তোমার করে নাও

এসেছি অনেকদিন

সব খেলা শেষ হল

এবারে দুয়ার খুলে দাও।।

যেখানে দিন নেই, রাত নেই

অমলিন ভালোবাসা

মৃত্যুর হাত ধরে

সেইখানে চলে যেতে দাও।।

বাঃ, বেশ পড়েছিস। তোর বেশ ভাব আছে। গান জানিস?

না শিখিনি কোনোদিন। শুনে শুনে একটা দুটো গাই।

কী গান? রবীন্দ্র?

না, আমাদের গ্রামের বাউল গান।

শোনাবি একটা?

আমার লজ্জা করবে।

মায়ের কাছে ছেলের লজ্জা? নে গা।

বাইরে জানলার দিকে তাকালুম। গাছের পাতা বাতাসে কাঁপছে। পাখি সব উড়ে গেছে। ভীষণ লজ্জা করছে। মাসিমার মুখটা কী সুন্দর, ঠিক রাধাদির মতো। খাড়া তলোয়ারের মতো নাক। দেয়ালঘড়ি আপন মনে ঠক ঠক করে সময়ের হাতুড়ি ঠুকছে।

কী রে ধর। চোখ বুজিয়ে কর। তাহলে আর লজ্জা করবে না।

বার দুই হুঁ হুঁ করে ধরে ফেললুম,

আরও কী ধন চাও দীন বন্ধুরে আমি আরও কী ধন দিব।

আমার দেহে আছে, শুধু প্রাণরে নিবার হয় তা ন্যাও।।

ধন দিলাম প্রাণ দিলাম রে দিলাম দুই নয়ন

আমি যাচিয়া যৌবন দিলাম রে

নিবার হয় তা ন্যাও।।

গাছের বল শিকড়লতারে, হারে মৎসের বল রে পানি

দুগ্ধর বল খিরসা ননিরে, আমার বল হও তুমি।।

শুকাইল সাগর দরিয়ারে, মৎস্য লুটে চিলে

তুমি কিঞ্চিৎ বিলম্ব করেরে আমায় দেখা দেও।।

কী গাইলাম, কেমন গাইলাম কে জানে। আমার নতুন মাসিমা গান শেষ হতেই, বাঃ বাঃ করে উঠলেন।

বেশ গেয়েছিস। সুন্দর গেয়েছিস। হ্যাঁরে খোঁকা, এর পাশে আমার গান থাকবে? আমার ওই গানটা একটু সুরে গা না।

আমি যে সুর করতে জানি না মাসিমা।

এই সুরেই বসিয়ে দে না।

তাতে কী হবে?

চেষ্টা করে দেখ না। আমার যে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে!

বেঁচেই তো আছেন মাসিমা।

এ বাঁচা সে বাঁচা নয়রে খোকা। অনেক অনেক বছর ধরে মানুষের মনে বেঁচে থাকতে চাই। সে কী আর হবে? সে তো সহজ নয়। মানুষ আসে মানুষ চলে যায়। চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব মুছে যায়। এ যেন স্লেটের লেখা। ভগবান রোজ কিছু মুছছেন, রোজই আবার নতুন করে কিছু লিখছেন।

আসা যাওয়ার নিত্য লীলায়

ফুলের মতো ফুটছে জীবন

ফুলের মতো ঝরে।

কোথা থেকে কেন এলাম

কীই বা হল এসে

যাবার আগে ভাবতে বসে

কিছুই না পাই ভেবে।।

মাসিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। চোখে আলো পড়েছে। মনে হচ্ছে পাথরের নীল চোখ। কোণা দুটো চিকচিক করছে।

হাতের মুঠোয় আমার একটা হাত ধরে মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এখনও খুব পবিত্র আছিস। গায়ে সংসারের পাঁক মেখে নিজেকে নোংরা করে ফেলিসনি। এ বড়ো কঠিন ঠাঁই। আগুন জ্বেলে ঘুরে বেড়া। সব পোড়াতে পোড়াতে এগিয়ে যা। কোন পাপে আমার শরীরটা পড়ে গেল কে জানে!

মাসিমা আবার আকাশের দিকে চোখ ফেরালেন। চোখের সাদা অংশ জলে ভাসছে। ভীষণ মায়া হচ্ছে। আবার পালাবার জন্যে ভেতরটা ছটফট করছে।

মাসিমা আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, কিছু খেয়েছিস সকালে?

ঘাড় নাড়লুম, না।

সে কী রে? এত বেলা হল, এখনও কিছু খাসনি। ওই তাকে একটা কৌটোয় সন্দেশ আছে। দুটো খেয়ে জল খা।

ডায়েরিটা রেখে দেব মাসিমা?

আজকের তারিখের পাতায় লেখ, যা বলি তাই লেখ।

আমার হাতের লেখা তেমন ভালো নয়।

ধরে ধরে লেখ। ভালো হাতের লেখা করার চেষ্টা কর। চেষ্টায় সব হয়।

এমন হাতের লেখা কি সহজে হয়।

তুই দুপুরে রাধার কাছে হাতের লেখা অভ্যাস করবি। নে এখন যা বলি ধরে ধরে লেখ। তুমি কখন কী ভাবে রাখো, কখন কাকে কার কাছে পাঠাও, কিছুই জানি না। আমি দ্রষ্টা, তুমি স্রষ্টা। তুমি আছ, সেই বার্তা প্রতি মুহূর্তে পাচ্ছি। শুধু কোথায় আছ তা জানি না। যেদিন জানব, সেদিন জানাবার মতো আমার আর কিছুই থাকবে না। নদী কি মোহনা থেকে ফিরে আসে? যে কাঠ পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তাতে কি আর আগুন থাকে? বড়ো শান্তি, বড়ো অশান্তি। বড়ো ব্যথা, বড়ো আনন্দ। নে ডায়েরিটা এখন তুলে রাখ। পরে আবার হবে। তুই সন্দেশ খেয়ে জল খা।

উঠোন থেকে মহীদার হো হো হাসি ভেসে এল। যেন রাজার হাসি। রাধাদি এক গেলাস গরম দুধ নিয়ে ঢুকল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ঠোঁটে গুঁড়ো গুঁড়ো কী লেগে আছে?

সন্দেশ?

দুধ খাবে?

না গো, দুধ আমি কোনো দিনই খাইনি। মনে মনে বললুম, আমি দুধের ঘরের ছেলে নই গো দিদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *