কৃত্তিবাস রহস্য – ৫

হোটেল ভিনিতা হচ্ছে গৌহাটির পাঁচতারা হোটেলগুলোর মধ্যে সব থেকে নামি এবং দামি। রাজ গ্রুপের হোটেল। দীপ্তদা কাল রাতেই বলে দিয়েছিল, শোন ক্রেট হোটেল ভিনিতায় উঠেছেন। এখন বেশ কিছুদিন থাকবেন। পুরো মুডের লোক। কোনো মিডিয়ার কেয়ার করেন না, কিন্তু শোনা যায় লোকটা মাঝে মাঝে এই দেশে আসেন। কেন আসেন সেটা জানা যায়নি। তোর ক্যারিয়ারে এই অ্যাসাইনমেন্ট কিন্তু মস্ত একটা চ্যালেঞ্জ। আমি যথারীতি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ফেল করলাম। ওর ম্যানেজার কিছুতেই রাজি হলেন না। এবার তুই কীভাবে ব্যবস্থা করবি সেটা তোর ব্যাপার। একটা হেল্প তোকে আমি করে দিতে পারি। আমার এক সোর্সের মাধ্যমে হোটেলের ম্যানেজারকে অনেক অয়েলিং করে এটুকু ইনফরমেশন আদায় করতে পেরেছি ক্রেট ভিনিতায় দুশো দশ নম্বর সুইটে রয়েছেন এবং আগামীকাল সকাল দশটায় ক্রেটের ম্যানেজার সারাদিনের জন্য একটি কার বুক করেছেন। হোটেলের নিজস্ব কার। বাস, এটুকুই তোকে জানানোর। বাকিটা তোর ক্যালিবার। বেস্ট অফ লাক, বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছিল দীপ্ত। 

পুরো ব্যাপারটা দিয়া অরণ্যকে জানানোর পর অরণ্য বলেছিল, এ তো খুব সোজা। সিমপ্লি কাল সাড়ে ন-টার মধ্যে আমরা ভিনিতায় পৌঁছে যাব। 

তারপর? 

তারপর শুরু হবে পিয়োর বাঙালির ঘ্যানঘ্যানানি। 

হিহি করে হেসে উঠেছিল দিয়া। যাঃ এমন আবার হয় নাকি? অ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকলে অমন জায়ান্ট আমাদের পাত্তা দেবে কেন? আর সাহেবরা ঘ্যানঘ্যানানি মোটেও পছন্দ করে না। 

ধুৎ তুই কিছুই জানিস না, বিশ্বের কত বড়ো বড়ো কাজ শুধু কানের সামনে প্যানপ্যান করে যাওয়ার ফলে হাসিল হয়েছে জানিস? 

তোর না যত উলটা-পালটা ভাবনা। 

সোজা ভাবনায় তো কিছু করা গেল না, সুতরাং উলটো ভাবনায় কী করা যায় দেখা যাক। 

পরদিন সকালে ওরা সাড়ে আটটার মধ্যেই রওনা হয়ে গেল হোটেল ভিনিতার দিকে। এই হোটেলটা থানাপাড়ার জিএস রোডে। দিয়াদের হোটেল থেকে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। সাড়ে ন-টার মধ্যে দুজনে পৌঁছে গেল। বিশাল হোটেল। লাউঞ্জে মিহি সুরে মিউজিক বাজছে। অরণ্য স্মার্টলি ঢুকে গেল রিসেপশনে। 

দিয়া ফিসফিস করে বলল, কী করছিস আবারও ভাব অরণ্য, গলাধাক্কা দিয়ে বার না করে দেয়। 

কিচ্ছু হবে না। চুপচাপ থাক। তুই ক্রেটকে দেখলে চিনতে পারবি তো?

হ্যাঁ আমার কাছে ওর ফটো রয়েছে। 

বাস এবার শুধু কনফার্ম করতে হবে উনি রয়েছেন কি না। 

রিসেপশনে গিয়ে স্মার্টলি অরণ্য বলল, সুইট নম্বর দুশো দশ মিস্টার ক্রেটের আজ সকাল দশটায় হোটেলের কারেই বেরোনোর কথা, উনি বেরিয়ে যাননি তো? 

এক মিনিট স্যার, রিসেপশনিস্ট কোথাও একটা ফোন করল, তারপর বলল, না স্যার উনি বেরোননি। উনি দশটায় বেরোবেন। 

আচ্ছা, আসলে আমাদের দেখা করার কথা রয়েছে। আমরা কি এখানে অপেক্ষা করতে পারি? 

হ্যাঁ নিশ্চয়ই। মিস্টার ক্রেটকে কি খবর দেবো? 

না, কোনো দরকার নেই। উনি জানেন আমরা দশটার মধ্যেই আসব। বেমালুম মিথ্যেটা বলে দিলো অরণ্য। 

তারপর দুজনে গিয়ে বসল মস্ত রিসেপশন হলের একপ্রান্তের একটি সোফাতে। হোটেলের মেইন গেটের সামনে দিয়ে যেই যাওয়া-আসা করবে তাকেই দেখা যাবে। দিয়া বলল অরণ্য আমার কিন্তু খুব টেনশন হচ্ছে, ক্রেট শুনেছি খুব মুডি লোক। আমরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করতে এসেছি শুনলে ঝামেলা করে দেবে না তো? মানে সকলের সামনেই হয়তো অপমান করে দেবে। 

করলে আর কী করা যাবে। তখন আবার অন্যকিছু… আপাতত দেখা যাক। আমাকে একবার ওর ছবিটা দেখা তো? 

হুঁ, দিয়া ওর ফোন থেকে ক্রেটের একটা ফটো বার করে দেখাল। অরণ্য দেখল বেশ লম্বা ছিপছিপে চেহারা, ধপধপে ফরসা, মাথার চুল সাদা একজন লোক, চোখে কালো সানগ্লাস, পরনে কালো টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার। একেবারে হলিউডি গেটআপ। 

ব্যাপক তো! 

হুঁ হবে না, ওয়ার্ল্ডের সেরা দশজন ফ্যাশন ডিজাইনারের মধ্যে উনি একজন।…এই অরণ্য আমার মাইরি হেব্বি টেনশন হচ্ছে। 

আমারও হচ্ছে। লেটস সি। 

ঘড়ির কাঁটায় ঠিক দশটা তিন। লিফট থেকে কয়েকজনের সঙ্গে নেমে এলেন ক্রেট। অরণ্য আর দিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়েছিল লিফটের দিকে। হ্যাঁ ওই তো নেমেছেন ক্রেট। সাদা ব্যাকব্রাশ করা চুল, চোখে কালো চশমা, পরনে অলিভ গ্রিন ক্যাজুয়াল শার্ট আর ব্ল্যাক জিনস। ওর ঠিক সামনেই আরেকজন সুটবুট পরা সাহেব হন্তদন্তভাবে এগোচ্ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে উনিই ম্যানেজার। 

দুজনেই এগোচ্ছিল হোটেলের পোর্টিকোর দিকে। 

অরণ্য বলল, এসে গেছে, দিয়া কুইক। 

দুজনেই উঠে প্রায় দৌড়ে গেল ক্রেটের দিকে। দুধসাদা একটা স্করপিও দাঁড়িয়ে রয়েছে গেটের সামনে। 

স্যার আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল। 

দিয়ার কথায় থমকে দাঁড়ালেন ক্রেট, মৃদু হেসে বললেন বলুন ইয়ং লেডি। 

স্যার আমি আর আমার বন্ধু কলকাতার একটি কাগজে সবে ঢুকেছি। আমাদের চাকরিটা হতে পারে শুধু আপনার জন্য। আপনি কি আমাদের দুজনের ক্যারিয়ারটা তৈরি করতে সাহায্য করবেন স্যার? অনেক আশা নিয়ে আমরা দুই বন্ধু মিলে জমানো টাকা দিয়ে প্লেনের টিকিট কেটে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। 

ক্রেট একটু থমকে দাঁড়ালেন। কালো চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটো দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েদুটিকে যেন পড়ে ফেললেন। 

বলুন কী সাহায্য করতে পারি আপনাদের জন্য? 

আপনার একটা ছোটো ইন্টারভিউ যদি…. 

ক্রেটের ম্যানেজার এবার মুখ খুললেন। প্লিজ এই অনুরোধ করবেন না। আপনারা হয়তো জানেন না… 

হ্যাঁ জানি উনি ইন্টারভিউ দেন না, আর সেজন্যই আমরা স্যারের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য এখানে চলে এসেছি। 

সরি ইয়ংম্যান। তোমার কথার মানে বুঝলাম না। চশমাটা এবার খুলে অরণ্যর দিকে তাকালেন ক্রেট। নীল রঙের চোখের মণি। 

স্যার আপনার সামান্য কিছু স্পিচ আমরা ইউটিউবে শুনেছি, আপনি একবার বলেছিলেন ছোটোবেলা থেকে আপনার এমন জেদ ছিল যেটা কেউ করতে পারবে না, আপনার সেটাই করে দেখানোর। কারণ আপনার মনে হতো, কেউ না করতে পারা মানে তালার সঠিক চাবিটা না জানা। নয়তো পৃথিবীর কঠিনতম তালাটিও সঠিক চাবির সাহায্যে অতি সহজেই খুলে ফেলা যায়। 

অরণ্যর বাকি কথাটা শেষ করল দিয়া। আর স্যার সেজন্য আমাদের মনে হয়েছিল আপনার কাছ থেকে আজ পর্যন্ত যারা ইন্টারভিউ আদায় করতে পারেনি, তারা আসলে আপনাকে বুঝতে পারেনি, নয়তো আপনি গোটা পৃথিবীর কাছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে একটি উদাহরণ। শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে প্রায় শূন্য পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করে আজ এখানে পৌঁছনো যায় সেটা আপনারও নিশ্চয়ই কখনো জানাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু… 

না আমার ইচ্ছে করে না। আচ্ছা চলি তাহলে? 

স্যার, একটা কথা। 

এগিয়ে যেতে যেতেই ক্রেট বলল, হ্যাঁ বলুন, 

আমরা দুজনে মিলে যদি এই চাকরিটা না করে ধরুন আপনার মতোই দুই চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে একটা বিজনেস শুরু করলাম, তারপর একদিন আমাদের বিজনেস আপনার কোম্পানির সমান কি তার থেকেও বড়ো হয়ে গেল, 

সেদিন কোনো বিজনেস ডিলের জন্য যদি আমাদের আপনার মুখোমুখি বসতে হয় এবং আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করি, আপনি কি সেদিন উত্তর দেবেন? 

দিয়া মরিয়া হয়েই শেষ প্রশ্নটা করে ফেলল ক্রেটকে। 

ম্যানেজার এবার কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল প্লিজ এবারে আপনারা আসুন। স্যার বেরোবেন। গাড়ির দরজা খুলে দিলো ম্যানেজার। 

ক্রেট ওর কালো চশমাটা আবার পরে নিলেন। গাড়িতে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন। কী জানতে চাও তোমরা? আমার বিজনেস? আমার ক্যারিয়ার? 

না স্যার, আপনার জীবন, আপনার ভাবনা, আপনার ভালোলাগা, খারাপ লাগা। ওগুলোই আসল। বলল অরণ্য। 

ওয়েল, তোমাদের কথাবার্তা আমার বেশ ভালো লাগল। কারণ আমার সঙ্গে এমনভাবে আগে কেউ কথা বলেনি। সেজন্য আমি তোমাদের একটা সুযোগ দেবো। আজ সারাদিন আমি যেখানে যেখানে যাব, তোমরা আমার সঙ্গে যেতে পারো। তোমরা আমার অ্যাকটিভিটিজ দেখতে পারো, কিন্তু এগুলো কিছুই লিখতে পারবে না। রাজি? 

দিয়া কিছুই না ভেবে বলে দিলো, নিশ্চয়ই রাজি স্যার। 

ঠিক আছে তাহলে চলে এসো আমার গাড়িতে। 

আপনার গাড়িতে…মানে… আপনার সঙ্গেই! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না ওরা দুজন। 

আমার সঙ্গে না গেলে আমার কথা জানবে কীভাবে? চলো। ভেতরে যাও। 

দিয়া তাকাল ক্রেটের ম্যানেজারের দিকে। ম্যানেজার তার বসের এমন খামখেয়ালি আচরণে অভ্যস্ত। সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, আসুন ভেতরে। 

ক্রেট বসল গাড়ির মিডিলের সিটে। দিয়া আর অরণ্য পেছনে আর ম্যানেজার ড্রাইভারের সামনের সিটে। গাড়ি স্টার্ট নিল। 

রাত ন-টা নাগাদ ডাইনিং হলে বসে ডিনার করছিল অরণ্য আর দিয়া। দুজনের মনই খুশিতে উচ্ছল। আজ গোটা দিন এমন অপ্রত্যাশিত ভালো কেটেছে যে আজীবনও ভোলার নয়। ক্রেট নামের মানুষেরা এখনো রয়েছেন বলেই পৃথিবীটা আজও সুন্দর, বাসযোগ্য। কত মানুষ যে নিভৃতে নীরবে কত বড়ো বড়ো কাজ করে চলেছেন তা কেই বা জানে? এই যেমন নিজের খেয়ালখুশির মালিক ক্রেট যখন এক মুহূর্তের সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণ অচেনা দিয়া আর অরণ্যকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন তখনো দিয়া আর অরণ্য জানত না আজ ওদের কী এক্সপিরিয়েন্স হতে চলেছে। পথে ক্রেট শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, আমি যেহেতু কখনো ইন্টারভিউ দিই না তাই আমাকে কোনো প্রশ্ন তোমরা করতে পারবে না। কিন্তু আমি আজ যা যা করব সেগুলো থেকে তোমরা তোমাদের মনে তৈরি হওয়া বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবে আশা করি। এবং আজ যদি আমার সঙ্গ তোমাদের ভালো লাগে এবং আমারও যদি তোমাদের প্রমিসিং মনে হয় তাহলে আমার আগামীকালের যে কর্মসূচি রয়েছে তাতেও তোমাদের ডাকব নইলে আজই বিদায়। এবং তোমাদের প্রমিস করতে হবে, নেক্সট টাইম তোমরা আমার সঙ্গে আর দেখা করার চেষ্টা করবে না? রাজি? 

অরণ্য বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিল হ্যাঁ স্যার রাজি। তবে আগামীকালের জন্য নেমন্তন্নটা আমরা এখনই নিয়ে নিলাম। 

অরণ্যর কথায় ক্রেট সামান্য হেসেছিলেন। 

ঘণ্টাখানেক গাড়ি চলার পর যেখানে পৌঁছেছিল সেই জায়গাটার নাম জালুকবাড়ি। বেশ ছিমছাম জায়গা। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা মস্ত দোতলা বাড়ি। গেটের সামনে সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা মাই হোম। ভেতরে অনেকটা জমি। আর বাউন্ডারির পেছনে মাঠ। বাড়িতে প্রায় শখানেক নানা বয়সের মানুষ থাকেন। তাদের চেহারা দেখে বোঝা যায়, সমাজের একেবারেই প্রান্তিক মানুষ তারা, অনেকেরই মানসিক অবস্থা সুস্থ নয়। দুই তলা মিলিয়ে বিশাল বড়ো চারটে হলঘর। প্রত্যেকটায় কম করে কুড়িটা করে বেড পাতা। প্রত্যেক বেড এক একজন আবাসিকের জন্য বরাদ্দ। কিছুক্ষণ পর ওই হোমের কর্মচারীদের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে অরণ্য আর দিয়া জেনে গিয়েছিল এটা আসলে ভিখারি, ভবঘুরেদের একটা আশ্রয়। আজ থেকে চার বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়েছিলেন এই জালুকবাড়ির কয়েকজন স্থানীয় মানুষ মিলে। উদ্দেশ্য ছিল গৌহাটির নিরাশ্রয়ী, ভবঘুরে, ভিখিরিদের একটা আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা। কিন্তু স্বল্প পুঁজিতে খুব বেশি কিছু করা যাচ্ছিল না। এরা একটা ওয়েবসাইট করে সেখানে সকলের কাছে কিছু ডোনেশন চেয়েছিলেন। কিছু এসেছিল চেনা পরিচিতদের মাধ্যমে। কাজ চলছিল। এই বছর তিনেক আগে হঠাৎই তারা মেইল পান ক্রেটের অফিস থেকে। এখানকার ডিটেল চাওয়া হয়, কর্মকর্তারা কোনো এক্সপেক্টেশন না রেখেই তাদের সব ডকুমেন্টস মেইল করেছিলেন আর তার ঠিক মাসখানেকের মধ্যে ক্রেটের কাছ থেকে একটা মোটা টাকা দান হিসেবে পৌঁছয়। তারপর পরের বছর ক্রেট আচমকাই নিজে চলে আসেন ভিজিট করতে। পুরো একটি বেলা তিনি নিজে কাটান এখানকার আবাসিকদের সঙ্গে, সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে যথেষ্ট খুশি হয়ে ফিরে যান। যাওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মাই হোমকে তিনি আরও বড়ো করবেন। তিনি কথা রেখেছেন তারপর থেকে বার্ষিক অনুদানের পরিমাণও তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। 

শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল অরণ্য আর দিয়া। সেই সুদূর ইংল্যান্ডের এক সাহেব, এক জায়ান্ট বিজনেসম্যন সে কি না চুপিসারে বছরের পর বছর সাহায্য করে চলেছে ভারতের এক ছোটো শহর গৌহাটি সেই শহরেরও অতি ছোটো অচেনা একটা বেসরকারি অর্গানাইজেশনকে। 

অরণ্য চিকেনের বাটিতে রুটির টুকরো ডুবিয়ে বলল, সত্যিই পৃথিবীতে কত রকমের মানুষ রয়েছে, ভাবলে অবাক লাগে। এই লোকটাকে আমরা যখন সকালে প্রথমবার দেখলাম দেখে ভেবেছিলাম চূড়ান্ত অহংকারী, মানুষকে মানুষজ্ঞান না-করা একজন খামখেয়ালি ধনকুবের। কিন্তু এমন ডাউন টু আর্থ মানুষ সত্যিই খুব কম দেখেছি। 

ঠিক বলেছিস, আজ কেমন ওই মানুষগুলোর মধ্যে মিশে গেল দেখলি? নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করল! অথচ কোনো প্রচারের পরোয়া করে না। আমাকে ডেকে শুধু বলল, তুমি কি এই পরিবেশ মন থেকে এনজয় করছ? না করলে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারো আমার গাড়ি তোমাদের ড্রপ করে দেবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমরা প্রতিবছর কয়েকজন বন্ধু মিলে দুর্গাপুজোর সময় এমনই কিছু গরিব মানুষের হাতে সাধ্যমতো নতুন জামাকাপড় তুলে দিই। তাই শুনে খুব খুশি হলেন তিনি। বললেন গ্রেট। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর রয়েছেন, যত মানুষের সেবা করবে তত জীবনে উন্নতি হবে তোমার। আমি ছোটোবেলায় প্রায় চার বছর মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সেখানে আমাদের প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় অসুস্থ, দরিদ্র মানুষের সেবা করতে হতো। সেই থেকে অভ্যাস। তোমার ইন্ডিয়াতে অনেক মহাপুরুষ জন্মেছেন। লর্ড বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, বিবেকানন্দ, আমি তাদের লেখা পড়ি। 

শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল অরণ্য আর দিয়া। সাগরপাড়ের এক বিজনেস টাইকুন, এই ভারতের গৌহাটি শহরের এক অচেনা অজানা হোমে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব-শ্রীচৈতন্যদেবের নাম বলছেন…এও হয়! 

দিয়ার কথায় অবাক হয়ে গেল অরণ্য। তারপর বলল, আমি এক ফাঁকে ওই হোমের যে কেয়ারটেকার তার সঙ্গে খাতির জমিয়ে কিছু কথা জেনে নিয়েছি। এই ক্রেট লোকটা সত্যিই খ্যাপা এবং দিলোদরিয়া। বলে স্যার কখন হঠাৎ চলে আসেন কোনো ঠিক নেই। কখনো নিজে চলে আসেন আবার কখনো লোকও পাঠিয়ে খোঁজ নেন সবকিছু ঠিকঠিক চলছে কি না তা জানার জন্য। বোঝ ব্যাপারটা। এবং এটা শুনলে আরও আশ্চর্য হবি… 

কথাটা শেষ হলো না অরণ্যর মোবাইল বেজে উঠল। ইনস্পেকটর সিদ্ধার্থর নাম্বার ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। বাঁহাতে ফোন তুলে কানে ঠেকিয়ে বলল, হ্যাঁ স্যার বলুন। 

সরি রাতে ডিস্টার্ব করলাম ওদিক থেকে বললেন সিদ্ধার্থ। 

না না স্যার কোনো ব্যাপার না, বলুন। 

আসলে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। ব্যাপারটা জানার পর থেকে আমি পুরো পারপ্লেক্সড হয়ে গিয়েছি। আমার মনে হলো আপনাকে জানানো দরকার। ইনফ্যাক্ট … 

সিদ্ধার্থর গলাতেই সেই উদ্‌বেগ স্পষ্ট। 

আপনি আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন স্যার। এবং আমরা আপনার কোনোরকম সাহায্যে এলে আমাদের ভালো লাগবে। 

হুঁ আসলে আপনার সাহায্য মনে হয় নিতে হতে পারে…আসলে সংক্ষেপে বলি আমার বন্ধু আজ সকালে যে ব্যাগটা নিয়ে গিয়েছিল… 

হ্যাঁ কিছু পাওয়া গেছে ব্যাগ থেকে। 

হুঁ…এবং যা পাওয়া গেছে তা রিয়েলি অবিশ্বাস্য মানে ভয়ংকর।… আপনারা কি কাল সকালের দিকে আমার অফিসে একবার আসতে পারবেন? 

কাল সকালে মানে… 

কোনো প্রবলেম? 

না না প্রবলেম তেমন কিছু নয়, আসলে আমরা আজ যে অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছিলাম, সেটা সাকসেসফুল হয়েছে। হয়তো আমাদের কালও … 

ঠিক আছে আপনারা যদি সন্ধের মধ্যে ফেরেন তাহলে প্লিজ আমার অফিসে চলে আসবেন, আর না হলে সন্ধে নাগাদ আমি আর রাকেশ আপনাদের হোটেলে চলে আসতে পারি। 

আচ্ছা স্যার তাই হবে। আমি আপনাকে ইনফর্ম করে দেবো। 

ও কে থ্যাঙ্ক ইউ। অ্যাকচুয়ালি আই নিড ইয়োর হেল্প। আমার সতেরো বছরের পুলিশ জীবনে এমন কেস কখনো আসেনি। এবং আমারই থানায়। এটা জানাজানি হয়ে গেলে ভয়ংকর বিপদ…ভয়ংকর। 

ফোন কেটে গেল। মোবাইলটা টেবিলের ওপর রেখে দিয়ার দিকে তাকাল অরণ্য। 

কী হলো রে? কোনো ঝামেলা? 

ঠোঁট সরু করে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘নিশ্চিন্ত আর থাকা গেল না রে তোপসে।’ 

সকালে থানায় নিজের চেয়ারে চুপ করে বসেছিলেন সিদ্ধার্থ। কাল সন্ধেবেলায় রাকেশ যখন ওকে ফোন করে ব্যাগের খবরটা দিলো রীতিমতো শিউরে উঠেছিলেন উনি। রাকেশ নিজেও কল্পনা করতে পারেননি ব্যাগটা এমন ভয়ংকর হতে পারে। সিদ্ধার্থর থেকে ব্যাগটা নিয়ে রাকেশ সোজা চলে গিয়েছিলেন ল্যাবে। কৌতূহল রাকেশের বরাবরই বেশি। ওর সিক্সথ সেন্স বলছিল এই ব্যাগের মধ্যেই একটা কিছু রহস্য লুকোনো রয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে নানাভাবে ল্যাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর হতাশ হয়ে সিদ্ধান্তে প্রায় চলে এসেছিলেম যে এই ব্যাগে তেমন কিছুই নেই, তখনই মনে হয়েছিল বাকি শেষ টেস্টটাও করে দেখা যাক। আর সেই শেষ টেস্টের ফল যে এমন ভয়ানক তা ওর কল্পনার অতীত ছিল, স্থির সিদ্ধান্তে আসার আগে উনি বারবার ওই ব্যাগে ফরেনসিক টেস্ট করেছেন প্রতিবারই একই রেজাল্ট! এই কি ভয়ানক! এমনও হয়! সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধার্থকে ফোন করে বলেছিলেন ঘটনাটা। সিদ্ধার্থ প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি। করার কথাও না। ভেবেছিলেন বন্ধু মজা করছে। কিন্তু যখন করলেন ততক্ষণে উনিও ঘেমে গিয়েছিলেন, এই খবর যদি সত্যি হয় আর যদি খবরটা ছড়িয়ে পড়ে তাহলে মুহূর্তের মধ্যে গৌহাটি তো বটেই গোটা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কীভাবে এই রহস্যোর সমাধান করা যায় তার কোনো উপায় মাথায় আসছে না। এই সাংঘাতিক ব্যাগটা পাওয়া গিয়েছে সিদ্ধার্থর থানা এরিয়া থেকে। সুতরাং পুরো দায় ওরই। কাল আরও বড়ো একটা ব্লান্ডার হয়েছে। হোটেলে সেই অ্যাকিন নামের সেই নিগ্রো দৈত্যটি গতকালই ওই হোটেল ছেড়ে উধাও। একেবারে খেয়ালই ছিল না হোটেলে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে রাখতে যে অ্যাকিন হোটেল চেক-আউট করতে চাইলে সেই খবর যেন থানায় আগে জানানো হয়। কাল রাকেশের কাছ থেকে ওই তথ্য পাওয়ার পর আর একমুহূর্ত দেরি করেননি সিদ্ধার্থ, সঙ্গে সঙ্গে জিপ নিয়ে ছুটেছিলেন সেই হোটেলে এবং পৌঁছে অ্যাকিনের খোঁজ নিতেই শুনতে হয়েছিল অ্যাকিন দুপুরেই চেক-আউট করে বেরিয়ে গিয়েছে। হোটেল থেকে অ্যাকিনের পাসপোর্টের ডিটেল নিয়ে নিয়েছেন উনি। ইমিডিয়েট খবরটা প্রয়োজনীয় সব জায়গায় পৌঁছে দিয়ে অ্যাকিনকে অ্যারেস্ট করে জেরা করা যেতেই পারে, কিন্তু তাতে ব্যাপারটা ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আর এ যা ভয়ংকর খবর তাতে দেশজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে এবং অসম সরকারের ওপর কেন্দ্র থেকে যা চাপ সৃষ্টি হবে তাতে সরকারের গদি নড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং আপাতত চুপচাপ ইনভেস্টিগেট করাই ভালো। রাকেশকেও সেই অনুরোধই করেছেন সিদ্ধার্থ। রাজি হয়েছেন রাকেশ। সিদ্ধার্থ ভেবেছিলেন ব্যাপারটা নিজেই সামলাবেন তারপরেই মনে হয়েছে ওই ছেলেমেয়েদুটোর কথা। অরণ্য আর দিয়া। ওদের সম্পর্কে কিছুটা জানা রয়েছে। ডার্কওয়েবের মতো সাংঘাতিক ব্যাপারে ওরা ঢুকে গিয়ে যেভাবে সলভ করেছিল তা সত্যিই থ্রিলিং। এই দুজন ইয়ং এবং ডেয়ারডেভিল, বুদ্ধিও যথেষ্ট। সিদ্ধার্থর মন বলছে রাকেশ ওর ফরেনসিক রিপোর্ট থেকে যা জানিয়েছে তা ডার্কওয়েবের থেকে কোনো অংশে কম ভয়ংকর নয়। এই ছেলেমেয়ে দুজন কি ওকে হেল্প করতে পারবে? আদৌ কি করবে? রাকেশের সঙ্গেও এই বিষয়ে আলোচনা কিছুটা করেছেন সিদ্ধার্থ। রাকেশ বলেছে একটু বাজিয়ে দেখতে। এমন রিস্কি এবং সেনসেশনাল একটা কেস সামান্য জানাজানিও প্রলয় ডেকে আনতে পারে। গোটা দেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়বে এই খবর ছড়ালে। আজ বিকেলে ছেলেমেয়ে দুজনের আসার কথা। রাকেশও অফিস সেরে আসবেন বলেছেন। বলা উচিত কি উচিত নয় এই দোলাচলে পড়েছেন সিদ্ধার্থ। এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। কাল রাত থেকে ঘুম ছুটে গিয়েছে। ভগবান জানেন এই কেস কীভাবে সলভ হবে! 

ফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুললেন সিদ্ধার্থ। 

মালিগাঁও থানার ওসি ফোন করেছে। ওর এলাকায় গতপরশু দুটো স্ট্রিট চাইল্ড মিসিং, মাস দুয়েক আগে সিদ্ধার্থর এরিয়া থেকেও একটা আট-নয় বছরের বাচ্চা উধাও হয়ে গিয়েছিল। ফুটপাতে থাকত ফ্যামিলিটা। ছেলেটার বাবা আর মা হাতে টানা ভ্যান চালায়। এসেছিল পুলিশে খবর দিতে। না, এদের কোনো পরিচয়পত্র, ঠিকানা ইত্যাদি কিছুই নেই। ডায়ারি খাতায় কলমে নেননি সিদ্ধার্থ। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়েছিল। যদিও যারা ফুটপাতে থাকে তারা পুলিশকে খুব ভয় পায়, ফলে তাদের মধ্যে যাই ঘটুক না কেন পুলিশের কাছে আসার সাহস পায় না। কিন্তু তবু এর মধ্যে আসামে বেশ কয়েকটা মিসিং ডায়ারি হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ফুটপাতবাসী। সরকার প্রশাসন থেকে আমজনতা কারোরই এই হতভাগ্য মানুষগুলোর জন্য সামান্য চিন্ত ভিাবনারও অবকাশ নেই। বরং তাদের পরিবেশের আবর্জনা হিসেবে ভাবতেই সকলে অভ্যস্ত। আর এই মানুষগুলোও সভ্য সমাজে থেকেও সভ্য মানুষদের থেকে দশ হাত দূরে থাকে। তবু গত এক বছরে অনেকগুলো মিসিং রিপোর্ট এসেছে রাজ্য পুলিশের কাছে। মানে আসল মিসিং-এর সংখ্যা আরও বেশিই হবে। সিদ্ধার্থর সেন্স বলছে রাজ্যজুড়ে একটা চক্র নিশ্চয়ই সক্রিয় হয়েছে যাদের কাজ হিউম্যান ট্র্যাফিকিং। হয়তো বর্ডার পেরিয়ে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে নাম-ঠিকানানহীন মানুষগুলোকে। এই আন্দাজ যদি সত্যি হয় তাহলে তা ভয়ংকর। মালিগাঁওয়ের ওসি জানতে চাইলেন সিদ্ধার্থর এদিকে নতুন কোনো খবর রয়েছে কি না। 

এমন প্রশ্নের কারণ রয়েছে। কারণ এই মাসকয়েক আগেই সিদ্ধার্থর এলাকায় যখন মিসিং কেসটা হয়েছিল তখন ও নিজে বেশ কিছু বিটে খবরটা দিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই পালটা খোঁজ। 

না, আপাতত এমন খবর নেই। সেই কথা শোনার পর আরও প্রয়োজনীয় দুটো কথা সেরে ফোন রেখে দিলেন সিদ্ধার্থ। এখন মিসিং-এর থেকে ঢের বেশি দরকার ব্যাগ রহস্য মেটানোর। মাথার মধ্যে আচমকাই একটা কথা বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠল। এসআই প্রশান্ত নিজের চেয়ারেই ছিল ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা ওই যে পাতাখোরটাকে দুদিন আগে ধরা হয়েছিল ব্যাগ স্ন্যাচিং-এর জন্য, ছেলেটা রয়েছে তো? 

হ্যাঁ স্যার রয়েছে। আজ ছেড়ে দিন স্যার। ফালতু আটকে লাভ নেই। এরা এমনিতেও শোধরাবার নয়। 

সিদ্ধার্থ বললেন ছেলেটাকে আমার কাছে নিয়ে এসো তো। 

আচ্ছা স্যার। 

একটু পরেই সেই পাতাখোরকে সিদ্ধার্থর সামনে হাজির করল একজন কনস্টেবল। সিদ্ধার্থ কনস্টেবলকে বললেন ঠিক আছে তুমি যাও আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি 

ছেলেটা দুদিন নেশা করতে পারেনি বলে আরও খারাপ অবস্থায়। হাত-পা থিরথির করে কাঁপছে। 

ছেলেটাকে সিদ্ধার্থ জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে নেশা না করে খুব কষ্ট হচ্ছে?

ছেলেটা নিরুত্তর। 

এখানেই থাকতে চাস নাকি ছেড়ে দেবো? 

উত্তর নেই। 

কী হলো বল? 

ছেড়ে দিন। দায়সারাভাবে উত্তর দিলো ছেলেটা। 

হুম্, নাম কী তোর? 

রাসু। 

একটা কথার ঠিক ঠিক উত্তর দিলে তোকে এখনই ছেড়ে দেবো, কিন্তু মিথ্যে বললে আজ তোকে চালান করব কোর্টে। পাঁচ বছরের ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়ব। বুঝেছিস? 

ছেলেটা ঘাড় কাত করল। 

সিদ্ধার্থ মনে মনে হতাশ হলেন। এই ছেলের যা অবস্থা বেঁচে রয়েছে কি না তাই ওর মনে নেই, একে ভয় দেখানো আর আদর করা দুই-ই সমান। নেশা পুরো বোধটাকেই খেয়ে ফেলেছে। তবু চেষ্টা করলেন। 

ভালো করে খুব মন দিয়ে ভেবে দেখ, গত পরশুদিন তুই যে হোটেলের সামনে থেকে একটা ব্যাগ মানে একটা প্যাকেট ছিনতাই করে পালাচ্ছিলি মানে যে কারণে তোকে তারপর এখানে ধরে আনা হয়েছে, সেই প্যাকেটটা কে কাকে দিচ্ছিল তুই চিনিস? 

ছেলেটা বলল ওই কালো লম্বা লোকটাকে চিনি না। শান্তিলালকে চিনি।

শান্তিলাল মানে? যে ওই প্যাকেটটা দিচ্ছিল? 

হ্যাঁ। 

মুহূর্তে রক্তচাপ চরমে পৌঁছে গেল সিদ্ধার্থর। চিনিস! কে শান্তিলাল। বোস বোস চেয়ারে বোস। ঠান্ডা মাথায় ভেবে বল। 

ছেলেটা বসল না। অলসভাবে বলতে থাকল, শান্তিলাল দালাল। সবকিছুর দালালি করে, নেশার জিনিস, আরও অনেক কিছু, আমি সব জানি না। 

আচ্ছা ওর বাড়ি চিনিস? 

না। 

ফোন নম্বর? 

না জানি না। 

ও চেনে তোকে? 

না চেনে না বোধহয়।

ঠিক জানিস, চেনে না? 

না জানি না। তবে আমি এই এলাকার নয়। এদিকে আসিও না তেমন। তবে শান্তিলাল আমাদের নেশার জিনিস কেনাবেচার কাজ করে। তাই ওকে আমি চিনি। যদিও সরাসরি কিছু কেনাবেচা করে না, ওর লোক রয়েছে। 

কোথায় পাওয়া যেতে পারে ওকে? 

শালমোড়া বাজারে মোবাইল সিমকার্ড বেচে রসিকের দোকানে ওকে পাওয়া যায়। 

রসিক? হুঁ। শোন আমাকে চিনিয়ে দিতে পারবি? 

পারব। তবে ও আমাকে চিনে নিয়েছে। দেখতে পেলে মেরে ফেলবে। ও খুব খতরনাক। 

তুই মরতে ভয় পাস নাকি? 

ছেলেটা চুপ। 

শান্তিলালকে চিনিস তাও ওর হাত থেকেই মালটা ছিনিয়ে পালালি কোন সাহসে? 

টাকা দরকার ছিল খুব। 

কেন পুরিয়া কেনার টাকা ছিল না? প্যাকেটের মালটা বেচে তাই দিয়ে নেশা করতিস তাইতো? 

রাসু কিছু উত্তর না দিয়ে অল্প মাথা ঝাঁকাল। 

বুঝতে পারিস নেশা তোর জীবনটাকে কীভাবে খেয়ে ফেলেছে? ধর প্যাকেটের ভেতর বেচার মতো কিছুই না পেতিস কিংবা ওদের হাতে ধরা পড়ে যেতিস তখন? মার খেয়েই তো মরে যেতিস…যাক গে ওসব যদি ভাবার ক্ষমতা তোর থাকত তাহলে তোর এই অবস্থা হতো না, শোন রাসু তোর কোনো ভয় নেই। আমি পুলিশের ড্রেসে যাব না। আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি না। আমার থেকে খানিকটা এগিয়ে থাকবি শুধু ইশারায় একবার চিনিয়ে দিয়ে তুই সরে পড়বি। বাকিটা আমি বুঝে নেব। আর যদি তোকে দেখে চিনতে পেরে অ্যাটাক করে তোকে সেভ করার দায়িত্ব আমার। তোর যা অবস্থা এমনিতেও বেশিদিন বাঁচবি না। পারলে নেশা ছাড়। 

রাসু চুপ। 

চল ওঠ, এখন পাওয়া যাবে ওকে? 

জানি না। 

ঠিক আছে একবার ট্রাই নেওয়া যাক। বলেই সিদ্ধার্থর মনে এলো ওই শান্তিলাল যদি এসব ছুটকো অপরাধে জড়িত হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই কখনো ধরা পড়েছে। হয়তো রেকর্ড বুকে ওর নাম ছবি ইত্যাদি মিলতে পারে। তবে আগে সরেজমিনে গিয়ে একবার চেষ্টা করা যাক। না পেলে রেকর্ডে খোঁজা যাবে। 

তুই দাঁড়া আমি চট করে তৈরি হয়ে নিই। 

চাঁদমারির কাছে শালমোড়া বাজার খানিকটা শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট বা দিল্লির চাঁদনিচক মার্কেট টাইপ। যদি আড়েবহরে অনেকটাই ছোটো তবু ঘিঞ্জি, ছোটোবড়ো নানা দোকানে ভরা সরু সরু গলি। এখানে অচেনা মানুষ ঢুকলে অন্তত একবার হারাবেই। প্রায় সবরকমের জিনিস এখানে পাওয়া যায়। খুচরা পাইকারি সব দরেই জিনিস বিক্রি হয়। ভালোমন্দ আসল-নকল সবকিছুই মেলে এখানে। সেজন্য ভালো লোকের পাশাপাশি খারাপ লোকেরও ভিড় হয়। চুরি, ছিনতাই, চিটিংবাজি, ছোটোখাটো ডাকাতি, মারামারি এসব হামেশাই লেগে থাকে এই বাজারে। সিদ্ধার্থ সিভিল ড্রেসে সঙ্গে রাসু। জিপ বাজারের একটু আগে থামিয়ে নেমে পড়লেন সিদ্ধার্থ। রাসুকে বললেন তুই আমার থেকে একটু এগিয়ে থাকবি। খবরদার পেছন ফিরে আমাকে দেখবি না তাহলে কিন্তু টার্গেট হয়ে যাবি, বুঝেছিস? 

হুঁ। চল এগো এবার। 

রাসু এগোল বাজারের দিকে। দশ ফুট পেছনে সিদ্ধার্থ। বাজারের ভেতরে অজস্র সরু সরু গলি, হাজার হাজার মানুষের ভিড় ক্রেতা বিক্রেতাদের চ্যাঁচামেচি। এখানে ঢুকলে বাইরে দিন না রাত্রি তা বোঝা যায় না। ভিড় ঠেলে রাসুকে ফলো করতে করতে এগোতে থাকলেন সিদ্ধার্থ। অনেকটা ভেতরে ঢোকার পর একটা খুব ছোটো মোবাইলের দোকান। বিভিন্ন সিম কোম্পানির লোগো ঝোলানো রয়েছে দোকানের সামনে। রাসু ওই দোকানটার কাছাকাছি গিয়েই থমকে গেল। সিদ্ধার্থ বুঝলেন টার্গেটে পৌঁছে গেছে। রাসুকে আগেই সিদ্ধার্থ একটা টিশার্ট, কালো সানগ্লাস আর হ্যাট এবং স্যান্ডেল কিনে পরিয়ে দিয়েছেন। সেলুনে ঢুকিয়ে ওর লালচে নোংরা দাড়িগোঁফও শেভ করিয়ে দিয়েছেন। এই নতুন হুলিয়ায় ওকে চট করে চেনা কঠিন। তবু সাবধানের মার নেই। রাসু দোকানের পাশ দিয়ে খুব দ্রুত হেঁটে যাওয়ার সময় একঝলক দোকানের ভেতর চোখ বুলিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর সিদ্ধার্থ যেমন আগে শিখিয়ে রেখেছিল, খানিকটা এগিয়ে গিয়ে হাঁটার গতি স্লো করে দিলো। সিদ্ধার্থ ওর গা ঘেঁষে চলে যাওয়ার সময় রাসু ফিসফিস করে বলল লাল জামা সাদা চটি। তারপরেই রাসু চলে গেল হনহন করে। 

সিদ্ধার্থ টানটান হয়ে দাঁড়ালেন। কোমরে গোঁজা পিস্তলটায় শার্টের ওপর দিয়ে আলতো করে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে লম্বা শ্বাস নিলেন। তারপর ব্যাক করে সটান ঢুকে পড়লেন রসিকের দোকানে। ওইটুকু দোকানের ভেতরে তিন-চারজন লোক। কাউন্টারের ওইপ্রান্তে একজন বসে দুজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে, আর লাল শার্ট সাদা চটি পরা শান্তিলাল দোকানের সামনের দিকে একটা টুলে বসে মোবাইলে কার সঙ্গে বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল। সিদ্ধার্থ কাস্টমার সেজে এটা-ওটা দেখতে থাকলেন। শান্তিলালের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে ও খুব টেনশনে। বারবার ‘ফঁস গয়া, জান চলা যায় গা। দো দিন টাইম’ এই শব্দগুলো ব্যবহার করছিল। সিদ্ধার্থ কিছু বলার আগেই শান্তিলাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাল্লো হ্যাল্লো রুকো, টাওয়ার ডিস্টার্ব হ্যায়। বহার যাকে ফোন করতা হুঁ। 

দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এলো শান্তিলাল। ঘেমে ওঠা কপাল শার্টের হাতা দিয়ে মুছল। তারপর আবার কাউকে ফোন করতে যাবে সিদ্ধার্থ সামনে এসে বললেন, শান্তিলাল। 

কৌন? ভুরু কুঁচকে সিদ্ধার্থর দিকে তাকাল শান্তিলাল। 

তেরা বাপ। চুপচাপ চল মেরে সাথ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *