কৃত্তিবাস রহস্য – ১৫

১৫

ভিনিতার বিশাল ডাইনিং হলে বসে লাঞ্চ করছিল অরণ্য, দিয়া আর ক্রেট। এলাহি ব্যবস্থা। ক্রেট নিজে ভেজিটেরিয়ান। খাবার টেবিলে বসে এই তথ্যটি যখন অরণ্য জানল তখন ও আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারেনি। সরাসরি প্রশ্ন করে ফেলেছিল? 

আপনি কি ছোটোবেলা থেকেই নিরামিষাশী? 

বলতে পারো। অনেক ছোটো বয়েসেই আমাকে এত বেশি পশুকাটা দেখতে হয়েছে যে আমি মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিই। 

তাই! কী ঘটনা স্যার? জিজ্ঞাসা করেছিল দিয়া। 

ক্রেট বললেন এক আশ্চর্য ঘটনা। একবার ক্রেটের বাবা তার বাড়িতে একটি ছোটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে তিনি কিনে নিয়ে এসেছিলেন একটি জ্যান্ত শুয়োর। সেই শুয়োরকে দুপুরে মারার সময় যে নৃশংস পদ্ধতি নিয়েছিলেন বাবা এবং শুয়োরটির হৃদয়বিদারক চিৎকার শুনে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল ক্রেট। তারপর বেশ কয়েকদিন সে অসুস্থ ছিল এবং তারপর থেকেই মাছ-মাংসের প্রতি অরুচি জন্মাতে থাকে ক্রেটের। 

আসলে কী জানো মাছ, মাংস দেখলেই আমি সেই শুয়োরটার চিৎকার শুনতে পেতাম। আমার বমি আসত। আসলে আমি খুব ছোটোবেলা থেকেই ভীতুপ্রকৃতির। কোনোরকম মারামারি কাটাকুটি আমি সহ্য করতে পারতাম না। আমার শরীর খারাপ করত। কিন্তু আমার মা এবং বাবা দুজনেই ছিলেন খুব শক্ত মনের মানুষ। তারা দুজনেই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন কারণ এত ভীতু, এত নরম মনের যে কোনোরকম নৃশংসতা আমি সহ্য করতে পারতাম না। বাবা চেষ্টা করতেন যাতে আমি ধীরে ধীরে শক্ত মনের পুরুষ হয়ে উঠি সেজন্য তিনি মুরগি, হাঁস, বাছুর কিংবা শুয়োর বাড়িতে এনে জবাই করতেন এবং আমাকে সেই সময় সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতেন আর আমি প্রায় প্রতিবারই হয় বমি করতাম অথবা অজ্ঞান হয়ে যেতাম। পরে এই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আমার ঘনঘন হতে শুরু করে, আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে শুরু করি। আমি স্বপ্নেও দেখতাম ওইসব রক্তাক্ত ঘটনা। ভয়ে আমার ঘুম ভেঙে যেত, কখনো ঘেমে উঠতাম, কখনো জ্বর এসে যেত— তখন ডাক্তার বলেন আমাকে সেসব নৃশংসতা থেকে রেহাই দিতে। বাবা আমাকে রেহাই দেন। আর আমিও তারপরেই পুরোপুরি নিরামিষাশী হয়ে যাই। 

মানে ডিমও খান না? 

নাঃ ডিম আমি কিছুদিন খেয়েছি, তারপর সেটাও ছেড়ে দিয়েছি, মনে হতো ডিমের ভেতরে হয়তো একটা হাঁসের কিংবা মুরগির ছানা জ্যান্ত রয়ে গেছে। 

অরণ্য আর দিয়া দুজনেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কী অদ্ভুত লোক! খাবার অর্ডার দেওয়ার সময় অরণ্য বলল স্যার আজ আমরাও আপনার সঙ্গে নিরামিষই খাই। 

উঁহুঁ তা হওয়ার নয়। আজ তোমরা আমার অতিথি। তোমাদের যা খুশি তাই খাবে। আর আমার সামনে কেউ কিছু খেলে আমার কোনো প্রভাব পড়ে না। আমি তো আর শিশু নই তাই না? সেজন্য কোনোরকম ইতস্তত কোরো না তোমরা। 

আপনাকে স্যার যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। সত্যি আমাদের সৌভাগ্য যে আপনার মতো একজন মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হলো। 

কেন ভাই আমাকে কি তোমাদের মহাপুরুষ বলে মনে হচ্ছে? 

না স্যার, মহাপুরুষ তো কোনোদিন চোখে দেখিনি, তবে ভালোমানুষও খুব কম দেখেছি। আপনি সেই সামান্য ভালোমানুষদের মধ্যে একজন যারা অন্যের জন্য বাঁচেন। যাদের মন অনুভূতি এখনো পাথর তো হয়নি, এত ব্যস্ত তার মধ্যেও আপনি অসহায় মানুষের কথা ভাবেন, শুধু তাই নয় তাদের জন্য এত কাজ করেন এটা সত্যিই যে… 

দেখো তোমাকে একটা কথা বলি, আমি যে সামান্য কাজটুকু করি সেটা আমার দায়িত্ব মনে করেই করি। আমার এটুকুই সাধ্য। আসলে নিজে ছোটোবেলায় দারিদ্র্য, কষ্ট ঢের দেখেছি, তাই ইচ্ছে হয়, পৃথিবীর মানুষ যেন কষ্টে না থাকে। তবে আমার আর সাধ্য কতটুকু বলো? আরও কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন ক্রেট। দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, শর্ত মনে রয়েছে আশা করি? কোনো সাক্ষাৎকার নয় কিন্তু। 

না না স্যার কোনো সাক্ষাৎকার নিচ্ছি না। বলে হেসে উঠল দিয়া। 

আমার ইচ্ছে রয়েছে বেশ কিছু হাসপাতাল তৈরি করার। পৃথিবীর কত মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যান। এটা হতে পারে না। দেখি শেষ পর্যন্ত পারি কি না। হাসপাতাল বানানোর খরচ তো বিপুল। 

নিশ্চয়ই পারবেন স্যার। ঈশ্বর আপনাকে দিয়ে করিয়ে নেবেন!

শুনে মুচকি হেসে ক্রেট ধন্যবাদ দিলেন অরণ্যকে। 

মিলিয়ে মিশিয়ে খাবারের অর্ডার দেওয়া হলো। নিরামিষ আমিষ দুই প্রকারই। খাবার এলো। ক্রেট খুবই স্বল্পাহারী। অবশ্য দিয়া আর অরণ্যও যে প্রচুর পরিমাণে খায় তা নয়। অরণ্যর মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো মেসেজ আসার। 

বাঁহাত দিয়ে মোবাইল বার করে দেখল সিদ্ধার্থ মেসেজ করেছেন। ডক্টর মানস বোরার ঠিকানা। ঠিক তিনটের সময়ে ওখানে পৌঁছতে হবে। অরণ্য রিপ্লাই করল, ডান। 

১৬

ডক্টর বোরার ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে বসে রয়েছে অরণ্য, দিয়া আর সিদ্ধার্থ। মানসবাবুর বয়স চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন হবে। সাদা ব্যাকব্রাশ করা চুল। সাদা ফতুয়া আর পায়জামা পরে। ড্রয়িংরুমটা চমৎকার সাজানো। নানারকমের লোকশিল্পের নিদর্শন ঘরে শোভা পাচ্ছে। দুটো দেওয়ালজোড়া আলমারিতে অসংখ্য বই। ড্রয়িংরুমে ঢুকলেই বাড়ির কালচার সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়ে যায়। ডক্টর বোরা দিব্যি বাংলা বলতে পারেন। অসমিয়া এবং বাংলা ভাষার মধ্যে খুব দূরত্ব নেই। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে বা পড়লে মোটামুটি ভাষার ভাব বুঝে ফেলা যায়। অরণ্য এবং দিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি খুবই খুশি। পশ্চিমবঙ্গ তার খুবই প্রিয় স্থান, বহুবার তিনি গিয়েছেন কখনো বেড়াতে, কখনো কাজের সূত্রে। কলকাতা তো বটেই, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, হুগলি ইত্যাদি জেলাতেও তিনি একাধিকবার গিয়েছেন। অনেক বন্ধুও রয়েছেন তাঁর পশ্চিমবঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব হলো তারপর সিদ্ধার্থ মূল বিষয়ে এলেন। স্যার আপনার কাছে যে কারণে এসেছি সেটা এবার বলি। একটা কেসের ব্যাপারে আপনার কাছে কিছু ইনফরমেশন দরকার। 

বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি? 

সিদ্ধার্থ বললেন, স্যার গৌহাটি বা আসামে সূর্যমন্দির কোথায় রয়েছে কি আপনি জানেন? গোয়ালপাড়ায় সূর্যপাহাড় রয়েছে জানি, কিন্তু সেখানে তো সূর্যমন্দির কিছু নেই। 

মিস্টার বোরা সামান্য গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন আসলে সূর্য পাহাড় নামটার মধ্যেই সূর্যের কথা লুকিয়ে রয়েছে। 

অরণ্য বলল আচ্ছা সূর্যপাহাড়ের ব্যাপারটা আমাকে একটু বলবেন? 

বোরা বললেন, সূর্যপাহাড় হলো গৌহাটি থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে গোয়ালপাড়া জেলার একটা অঞ্চল। খুবই প্রাচীন এক জায়গা। অনেক পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এখানে। নামটা থেকেই আন্দাজ করতে পারছ যে পুরাকালে এখানে সূর্যের উপাসনা হতো। কালিকাপুরাণেও সূর্যের উপাসনা কেন্দ্র হিসেবে এই অঞ্চলের নাম রয়েছে। একটা সময়ে এই স্থান হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের মিলনস্থল হয়েছিল। এই তিন ধর্মেরই নানা নিদর্শন ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে সূর্যপাহাড়ে। 

মানে আসামে শুধু কামাখ্যা বা মাদুর্গার মন্দিরই প্রধান নয় বলছেন? 

না না একেবারেই নয়। সিদ্ধার্থর প্রশ্নের উত্তরে বললেন বরং একটা সময় এই রাজ্যে সূর্যের উপাসনাই হতো সব থেকে বেশি। আপনি মার্কন্ডেয় পুরাণের ১০৯ নম্বর অধ্যায় খুলে দেখুন সেখানে লেখাই রয়েছে কামরূপ হলো সূর্য উপাসনার সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। তাছাড়া কালিকাপুরাণ, যোগিনীতন্ত্র, এমনকি পুরোনো অসমিয়া সাহিত্যেও আপনি সূর্যদেবের অনেক উল্লেখ পেয়ে যাবেন। আসলে এই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাজুড়েই এক সময় সূর্যের উপাসনা হতো। এই যে তেজপুর এর আসল নাম হলো সৌর তেজপুর। এই নামটার মধ্যেও তো সূর্যদেবই রয়েছেন। তারপর আসামের পূর্বদিকে দিক্করবাসিনির কথা ভাবুন, দিক্কর শব্দের অর্থও সূর্য। অর্থাৎ আসামের পুবদিকেও এক সময় সূর্যপুজো হতো। মানে পুরো আসামেই এক সময় সূর্যপুজোর যথেষ্ট প্রচলন ছিল। দেবীপুজোর অনেক আগে। 

অরণ্য বুঝতে পারল ডক্টর বোরা ইতিহাসের একজন অথেন্টিক পার্সন। প্রচুর জ্ঞান রয়েছে। ও জিজ্ঞাসা করল আচ্ছা স্যার সূর্যপাহাড়ে কি এখনো সূর্যমন্দির রয়েছে? মানে আমি বলতে চাইছি পুজোআচ্ছা নিয়মিত হয় এমন মন্দির… 

না নেই। 

তাহলে? 

হুঁ…তাহলে…তাহলে বলতে বলতে বোরা একটি সিগারেট ধরালেন। দেখুন এই বড়ো রাজ্যে কোথায় কোন মন্দির রয়েছে তা কারও একার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ভারতবর্ষের হিন্দুদেরই তেত্রিশ কোটি দেবতা এবং অলিগলিতে মন্দির। কটার হদিসই বা আমরা জানি? প্রাচীন মন্দির হলে তবু সামান্য আমার নলেজে রয়েছে কিন্তু নতুন মন্দির হলে তা বলা কঠিন } সূর্যমন্দির বললেন তাই না? 

হ্যাঁ স্যার এবং সেখানে সারাক্ষণ সূর্যের স্তবগান চলে। মানে মোস্টপ্রোবাবলি সিডিতে, এইরকম কোনো মন্দির…? 

সূর্যের স্তবগান চলে? আচ্ছা? কী যেন চিন্তা করলেন বোরা। তারপর টেবিলের ওপরে রাখা মোবাইল তুলে কাকে যেন রিং করলেন। ওপারে রিং রিসিভ হওয়ার পর অসমিয়া ভাষায় বোরা তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। অরণ্য আর দিয়ার বুঝতে অসুবিধা হলো না সেই কথোপকথন। ফোন রেখে বোরা বললেন আমি একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার স্টুডেন্ট। এখন মন্দির নিয়েই গবেষণা করছে। ওর এসব ব্যাপারে ভালো খোঁজখবর রয়েছে। যদি পারে ওই পারবে। দেখি। 

আরও বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পর সকলে উঠল। বাইরে বেরিয়ে সিদ্ধার্থ বললেন, কেসটা কোনদিকে যাচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মিস্টার বোরা যদি সন্ধান না দিতে পারেন তাহলে কী করা যেতে পারে কিছু ভেবেছেন? 

দিয়া উত্তর দিলো, এই মুহূর্তে কিছু মাথায় আসছে না। দেখা যাক বোরা স্যার কোনো হদিস দিতে পারেন কি না। না হলে আবার নতুন কিছু ভাবতে হবে। 

সিদ্ধার্থর মোবাইল বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করলেন। হ্যাঁ বলো।…হুঁ আবার! …আচ্ছা…কী…এসপি সাহেব…এই রে…আচ্ছা ঠিক আছে আমি আসছি। হুঁ…। 

 মোবাইল পকেটে ভরে সিদ্ধার্থ বলে উঠল পুলিশের চাকরির যে কত জ্বালা!

অরণ্য হেসে বলল, তা ঠিক। 

আর বলবেন না, এটুকু শহরেও যে কত ঝামেলা! এসপি সাহেব ফোন করে আমাকে খুঁজছেন। ওর কান পর্যন্ত এই কেসটা পৌঁছল কীভাবে সেটাই ভাবছি। 

কোনটা স্যার? এই ব্যাগের কেস? 

না না এটা আবার পুরো ডিফারেন্ট ইসু। 

আচ্ছা। 

সিদ্ধার্থ বললেন, আসলে গৌহাটিতে…শুধু গৌহাটিতে নয় অবশ্য আসামের আরও দু-একটা জায়গা থেকে এমন কমপ্লেন এসেছে। মানে দু- চারজন ফুটপাতবাসী মিসিং হয়েছে। তার বেশিও হতে পারে। তবে এদের তো মিসিং ডায়ারি হয় না জেনারেলি…কে আর খোঁজ রাখে? 

সেই গরিবের দেশ আমাদের অথচ গরিব মানুষেরই খোঁজ রাখার জন্য কেউ নেই। 

সিস্টেমটাই এমন ম্যাডাম। দিয়ার কথায় উত্তর দিলেন সিদ্ধার্থ। তবে এই ঘটনাটা ঘটছে। কী ব্যাপার কে জানে… 

শুধুই কি ফুটপাতবাসী? 

আমার এরিয়া থেকে একটাই রিপোর্ট পেয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন ঐ ফুটপাতবাসীদেরই একজন এসেছিল জানাতে। সত্যি বলতে রিটেন রেকর্ড করিনি। কিন্তু এসপি সাহেবের কানে খবরটা পৌঁছল কীভাবে সেটাই ভাবছি। বেশ চিন্তায় পড়ে গেল সিদ্ধার্থ। 

কেন মিসিং ডায়ারি নেননি? 

আসলে এদের তো কোনো ডকুমেন্টস নেই। কোনো আইডেন্টিটি নেই। এরা এই দেশে থেকেও দেশের নাগরিক নয় রকমের ব্যাপার। এদের জন্মমৃত্যু কোনোকিছুরই রেকর্ড থাকে না। তাই আর কী অত গুরুত্ব দিইনি। 

হুঁ…দেখুন কী হয়। বাই দা ওয়ে অ্যাকিনের কোনো খবর পেয়েছেন কি?

নাঃ এখনো পাইনি। তবে দেশ ছেড়ে বেরোয়নি এটুকু শিয়োর। 

কথা বলতে বলতেই দিয়া আর অরণ্য গাড়িতে উঠল। সিদ্ধার্থ ওদের হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে জিপে চড়লেন। 

অরণ্য আর দিয়া আজ সন্ধেটা এমনিই ঘোরার প্ল্যান করেছে। 

১৭

সিদ্ধার্থর ফোন এলো রাত আটটা নাগাদ। অরণ্য আর দিয়া তখন একটা রেস্টুরেন্টে বসে ডিনার করছিল। এই রেস্টুরেন্টের ঠিকানাটা সিদ্ধার্থই দিয়েছিলেন, এখানে আসামের ট্র্যাডিশনাল ডিশ পাওয়া যায়। কাঁসার থালা এবং অজস্র ছোটো ছোটো বাটিতে নানা রকমের আইটেম। অনেকগুলোই অচেনা। দিব্যি খেতে। বেশ তরিজুত করেই খাচ্ছিল দুজনে। ছিমছাম ফ্যামিলি রেস্তোরাঁ। প্রতিটি টেবিলই ভরতি। খেতে খেতেই ফোন রিসিভ 

করল অরণ্য। 

হ্যাঁ স্যার বলুন। 

সিদ্ধার্থ অরণ্যর রিপ্লাই শুনে বুঝতে পারলেন অরণ্যর মুখে খাবার। বললেন ডিনারের সময় বিরক্ত করলাম বোধহয়। 

না না কোনো ব্যাপার না, বলুন। খাওয়া শেষ। 

মিস্টার বোরা ফোন করেছিলেন। 

সিদ্ধার্থর কথা শুনতে শুনতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল অরণ্যর। কথা শেষ করে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রেট! 

১৮

বিশাল এলাকাজুড়ে রামচরণ সেবাশ্রম। তারই ভেতরে এখন অরণ্য আর দিয়া। পুরো এলাকাটাই মস্ত উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। তেমনই উঁচু ফটক। ভেতরে ঢুকলে মনে হয় যেন বৈদিক যুগে পিছিয়ে এসেছে এই অংশটুকু। আশ্রমটি খুব বেশিদিনের পুরোনো নয়, মাত্র বছর পাঁচেক হবে। তবে এই কয়েকবছরের মধ্যেই বিশাল আকার ধারণ করেছে। আজ ভোরবেলাতেই অরণ্য আর দিয়া গাড়িতে রওনা হয়েছিল আশ্রমের দিকে। গৌহাটির পুবদিকে চন্দ্রপুরের বিখ্যাত পবিতরা জঙ্গল। সে জঙ্গলের মধ্যেই আশ্রম। প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। বেশ সুন্দর রাস্তা। পথে নারেঙ্গির আর্মি ক্যাম্প, পরিত্যক্ত রেললাইন, চড়া পড়ে থাকা ব্রহ্মপুত্র আর সারি সারি পাহাড়ের শোভা উপভোগ করতে চলেছিল ওরা। ভারি সুন্দর লাগছিল। ড্রাইভার গুলাব সিং-এর কাছে জানল এই অঞ্চলে শীতকালে প্রচুর পিকনিক হয়। যদিও পবিতরার ঘন জঙ্গলে কাউকে অ্যালাউ করা হয় না, কারণ ওই জঙ্গলে বাঘ রয়েছে। 

বাঘ! বলো কী! 

হ্যাঁ স্যার শের রয়েছে। তবে রাস্তায় বেরোয় না। 

গুলাব সিং-এর বয়স বছর ত্রিশ। শিখ। সিদ্ধার্থ কলিতার খাস লোক। পেশায় ড্রাইভার হলেও সিদ্ধার্থর নানা গোপন খবর আদানপ্রদানে সাহায্য করে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেই গুলাবের ডাক পড়ে, যেমনই বুদ্ধিমান তেমনই দুঃসাহসী। আপাতত ওর কাজ হলো কয়েকদিন অরণ্য আর দিয়া ম্যাডামের সাহায্য করা। ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রায় একশো একর জমি নিয়ে বিরাজমান এই রামচরণ সেবাশ্রম। বিশাল ফটক, চারদিকে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের ভেতরে এলাহি ব্যবস্থা। খানিকটা মায়াপুরের ইস্কনের কথা মনে পড়ে যায়। যদিও আকারে ঠাটে অত বড়ো নয় তবু ছোটো আকারে ওইরকমই। এখানে অনেক আশ্রমিক, সকলের পরনে সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা এবং গায় হাফহাতা সাদা ফতুয়া। গতকাল রাতেই সিদ্ধার্থর কাছে এই আশ্রম সম্পর্কে বেশ কিছু ইনফরমেশন পেয়ে গিয়েছিল অরণ্য আর দিয়া। এই আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা রামচরণ বাবাজি। তিনি খুবই বিখ্যাত, আসামে তো বটেই দেশের নানাপ্রান্তে তার ভক্ত ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতি সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট চ্যানেলে তিনি আধ্যাত্মিকতা নিয়ে নানা উপদেশ ইত্যাদি দেন। তবে ধর্মগুরু হলেও রামচরণবাবাজি নানা সামাজিক সেবামূলক কাজে জড়িত। আশ্রমের মূল মন্দিরটিতে শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষণ এবং সীতামায়ের শ্বেতপাথরের বিশাল মূর্তি তার নিচে ধ্যানমগ্ন রামচরণবাবাজির মস্ত ফটো। এছাড়াও আশ্রমচৌহদ্দির মধ্যে আরও কয়েকটি ছোটোখাটো মন্দির রয়েছে। এই আশ্রমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা বাবাজির কাছে আসেন। কেউ আসেন বাবাজির শিষ্যত্ব নিতে, কেউ আশীর্বাদ নিতে, কেউ বাবাজির উপদেশামৃত শুনতে। মন্দিরচত্বরে অনেকক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে বেশ হতাশই হয়ে পড়ছিল অরণ্য আর দিয়া। অত বড়ো এলাকা ঘণ্টাকয়েকের মধ্যে ঘুরে দেখা অসম্ভব, তবু অরণ্য আর দিয়া আলাদা আলাদাভাবে আশ্রম এলাকার বিভিন্ন দিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির, কৃত্তিবাস মন্দির, মাধব কন্দলী মন্দির, চণ্ডীদেবীর মন্দির, শংকরদেবের মন্দির। মূল মন্দিরটি মস্ত বড়ো কিন্তু বাকিগুলো আকারে যথেষ্টই ছোটো এবং একটি অন্যটির থেকে অনেকটা দূরে ছড়িয়েছিটিয়ে। আশ্রমটির ভেতরেও যথেষ্ট পরিমাণে গাছপালা থাকার কারণে সবটা একবারে নজরে আসে না। অরণ্য আর দিয়া এলোপাথাড়ি ঘুরছিল আর যে কারণে এখানে আসা সেটা খুঁজে চলেছিল। নাঃ নেই। অবশ্য মিস্টার বোরা সিদ্ধার্থকে বলেই ছিলেন খবরটা তার শোনা, উনি নিজে চোখে দেখেননি ফলে কতটা সঠিক তা বলতে পারবেন না। অরণ্য ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল একটা গাছের নিচে বাঁধানো বেদিতে। তখনই দিয়ার ফোন, এই শোন জাস্ট পেয়ে গিয়েছি। শিগির আয়। দিয়ার গলায় উচ্ছ্বাস ফেটে পড়ছে। 

দিয়ার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল অরণ্য। সত্যি বলছিস!

ইয়েস ডার্লিং। শিগগির আয়। 

কোন দিকে বল? 

মেইন মন্দিরের ঠিক ডানপাশের রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে আয়। বাঁদিকে একটা দোতলা বেশ বড়ো সাদা রঙের গেস্ট হাউজ মতো দেখতে পাবি। ওর পাশ দিয়ে একটা রাস্তা পেছনদিকে গেছে সেখান দিয়ে সোজা হেঁটে আয়, ওখানেই দেখতে পাবি। আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। 

ও কে বলে ফোন পকেটে গুঁজে হনহন করে দিয়ার বলা নির্দেশমতো হাঁটতে শুরু করল অরণ্য। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল যেখানে একটা ছোটো মন্দিরের সামনে দিয়া দাঁড়িয়ে। 

এই যে এদিকে আয়। 

অরণ্য গেল। 

দিয়া চাপা গলায় খুব উত্তেজিতভাবে বলল এই দেখ পেয়ে গেছি। 

অরণ্য মন্দিরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখার আগেই ওর কানে যে স্তবগানটি পৌঁছল তাতেই ডানহাত মুঠি পাকিয়ে ‘ইয়েস’ বলে উঠল। 

এবার মন্দিরের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে আয়। 

মন্দিরটা আকারে খুব বড়ো না হলেও দালান বেশ উঁচু নিচে দাঁড়িয়ে ভেতরে দেখার উপায় নেই। খান কুড়ি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তারপর মন্দিরের ভেতর ঢোকা যায়। 

মিলেছে? 

পুরো। 

চল আরেকবার দেখি। 

নিচে জুতো খুলে দুজনেই উঠল মন্দিরের দালানে। দালান পেরিয়ে মন্দিরের দরজা। সাউন্ডবক্সে গুনগুন করে চলছে- 

ওং ঘূণিঃ সূর্যাদিত্তম 
ওং ঘৃণিঃ সূর্য আদিত্য শ্ৰী 
ওং হ্রাং হ্রীং হৌং সঃ সূর্যাং নমঃ 
ওং হ্রীং হ্রীং সূর্যায় নমঃ 

মন্দিরের ভেতর সোনার রঙের এক দেবতার মূর্তি। দেবতা বসে রয়েছেন একটি রথে সেই রথের সামনে সাতটি সাতরঙের ঘোড়া ছুটছে। সাতটি ঘোড়ার রাশ ধরে বসে রয়েছে এক সারথি। মূর্তিটির উচ্চতা কম করে ছয় ফুট হবেই। ঝকঝক করছে। দেখে মনে হয় যেন এইমাত্র পালিশ করা হয়েছে। মূর্তির সামনে বসে রয়েছেন একজন মাঝবয়সি সেবাইত। তার পরনেও সাদা ধুতি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি। তিনি মূল মন্দিরের দরজার সামনেই বসে রয়েছেন, সামনে একটা থালায় অনেক কুচো ফল। 

অরণ্য আর দিয়াকে ইশারায় কাছে ডাকলেন তিনি। দুজনে এগিয়ে গেল। তিনি অল্প ফলপ্রসাদ তুলে ওদের দুজনের হাতে দিলেন। প্রসাদ মুখে দিয়ে অরণ্য লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল আপনি কি পূজারি? 

লোকটা হিন্দিতে উত্তর দিলো হ্যাঁ। 

এই মূর্তি কি সূর্যদেবের? 

হ্যাঁ সূর্যদেবের। তবে এই পৌষমাসে ওঁর নাম বিষ্ণু। 

মানে বিষ্ণু তো আলাদা দেবতা। 

পূজারি মৃদু হেসে বললেন সূর্যের এক এক মাসে এক একটি নাম হয়, বলে ইশারায় ওদের দুজনকে বসতে বললেন। শীতের সকালে শ্বেতপাথরের মেঝে যথেষ্ট ঠান্ডা, তার মধ্যেই বসে পড়ল দুজনে। 

পূজারিজি বললেন, আসলে সূর্যদেব বিবাহ করেছিলেন বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞাকে। কিন্তু বিয়ের পর সূর্যের তেজ কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না সংজ্ঞা, তাই বাবাকে জানালেন নিজের দুঃখের কথা। তখন বিশ্বকর্মা সূর্যকে মোট বারোটি ভাগে ভাগ করে ফেললেন। সেই বারোটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন মাসে উদিত হয়। যেমন বৈশাখের অংশ হলো তপন, জ্যৈষ্ঠর অংশ ইন্দ্র, আষাঢ়ের রবি, শ্রাবণের গভস্তি, ভাদ্রমাসে যম, আশ্বিনে হিরণ্যরেতাঃ, কার্তিক মাসে উদিত হয় দিবাকর, অগ্রহায়ণে চিত্র, এই পৌষে বিষ্ণু, মাঘে হবেন অরুণ, ফাল্গুনে নাম হবে সূর্য আর শেষে চৈত্রে বেদজ্ঞ। 

অরণ্য আর দিয়া দুজনেই অবাক। সূর্যেরও যে এত নাম থাকতে পারে তা ওদের আইডিয়ার বাইরে ছিল। 

আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? 

দিয়া বলল কলকাতা থেকে। 

পূজারি বললেন ওখানে কালীঘাট রয়েছে মাকালীর মন্দির, আমি বহুকাল আগে মাকে দর্শন করতে গিয়েছিলাম। তারপরেই জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা কি বাবাজির শিষ্য? 

অরণ্য চট করে বুঝে গেল বাবাজি মানে এই আশ্রমের প্রধান রামচরণবাবাজির কথাই বলতে চাইছেন তিনি। ও সঙ্গে সঙ্গে বলল না এখনো হইনি। তবে হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। সেই কারণেই এখানে আসা। 

হয়ে যান। আজ হলো শুক্রবার, প্রতি মঙ্গলবার বাবাজি দীক্ষা দেন। 

দিয়া বলল, আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? 

হ্যাঁ বলুন মা। 

এই আশ্রম কতদিনের পুরোনো? 

খুব বেশি পুরোনো নয় মা, বছর পাঁচেক। আমি এসেছি দুবছর হলো।

মানে এখানে যে মন্দিরগুলো দেখছি সবই নতুন? 

হ্যাঁ। 

আচ্ছা পূজারিজি এখানে দীক্ষা নিতে গেলে কী করতে হবে? 

সে কি আপনারা কিছুই জেনে আসেননি? তাহলে এসেছেন কী কারণে? কার কাছে জেনেছেন? 

জেনেছি আমার এক বন্ধুর কাছে। আমার ওই বন্ধু বাবাজির ভক্ত। ওর কাছে বাবাজির অনেক কথা শুনেছি তাই ইচ্ছে হলো আমরা দুজনে মিলে বাবাজির কাছে দীক্ষা নিই। 

আপনারা কি… 

আমরা স্বামী-স্ত্রী। এই সদ্য বিয়ে হয়েছে আমাদের। 

অ। বলে দিয়ার দিকে ভালো করে দেখলেন উনি। বিবাহিতা মেয়ের কোনো চিহ্ন নেই দেখে বেশ অবাক হলেন। 

দিয়া বলল আমাদের রিসেন্ট রেজিস্ট্রি হয়েছে শুধু। অনুষ্ঠান করে বিয়ে নেক্সট মাসে হবে, তার আগে দুজনে বাবাজির কাছে দীক্ষাটা নিয়ে নিতে চাইছি। কী করতে হবে একটু বলবেন? 

বেশ বেশ খুব ভালো। সম্পর্কটা রেজিস্টার্ড শুনে মনে মনে খুশি হলেন তিনি। বললেন তাহলে টিকিট করে নিন। দেখবেন রামমন্দিরের ঠিক ডানদিকে অফিসঘর রয়েছে, ওখান থেকে টিকিট পাবেন। পাঁচশো টাকা করে প্রণামি। আর যদি গেস্ট হাউজে থাকতে চান তার জন্য আলাদা ঘর নিতে পারেন। 

আরেব্বাস এখানে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে গ্রেট! উত্তেজিত হয়ে হাঁটুতে থাপ্পড় মারল অরণ্য। 

হ্যাঁ, অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ বাবাজির কাছে দীক্ষা নিতে আসেন তারা থাকবেন কোথায় তার জন্য গেস্ট হাউজের ব্যবস্থা। দেখুন ফাঁকা থাকলে পেয়ে যাবেন। 

খুব ভালো, আমরা আজ এখন উঠছি পূজারিজি, বুকিংটা করে নিই। পরে আবার আসছি আপনার কাছ থেকে অনেককিছু জানার রয়েছে। বলল দিয়া। উঠে দাঁড়াল দুজনেই। হাঁটা শুরু করল অফিসঘরের দিকে। দিয়া বলল, গুরু এ তো মেঘ না চাইতেই জল! বুকের ভেতর উত্তেজনায় টিপটিপ শব্দ করছে। অফিসরুমে গিয়ে আগে আগামীকাল থেকে একটা রুম বুক করে ফেলল। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়। দিয়া অফিসরুমে ঢোকেনি বাইরে দাঁড়িয়েছিল। বাঙালি স্ত্রীর ড্রেসআপ করে না এলে সন্দেহ হতে পারে, ডিটেল জানতে চাইলে মুশকিল হবে। যদি রুম পাওয়া যায় তাহলে পরের দিন পুরো রেডি হয়ে আসতে হবে। একটু পরেই অরণ্য অফিসঘর থেকে বেরিয়ে হাসিমুখে ইশারায় বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে দেখাল। মানে রুম মিলে গেছে। এবার শুরু হবে নতুন অভিযান। 

১৯

দুই তলার মোট তিনটে বিল্ডিং। প্রতি ফ্লোরে চারটে করে এক কামরার ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাটগুলো শুধু বাবাজির কাছে যারা ভিনরাজ্য থেকে দীক্ষা নিতে আসেন তাদের জন্য। দিনকয়েক থাকার অনুমতি মেলে। নামমাত্র ঘরভাড়া। দুবেলা ভোগপ্রসাদ খাওয়ার খরচও খুব কম। অরণ্য আর দিয়া ফিরে গিয়েছিল হোটেলে। তারপর রাতে হোটেলের রুমে সিদ্ধার্থর সঙ্গে বসেছিল মিটিং। সূর্যমন্দির এবং সেই স্তবগান মিলে গেছে, কিন্তু এটুকুই ক্লু যথেষ্ট নয় এবং গভীরে তদন্ত করতে হলে ওখানে থাকতেই হবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যাবে না, কিন্তু একটা হদিস মিলেছে যখন তার শেষ দেখতেই হবে। 

সিদ্ধার্থ অরণ্য আর দিয়ার কাছে ওদের স্ট্র্যাটেজিটা মোটের ওপর শুনে নিয়েছিলেন এবং যথেষ্ট খুশি হয়ে বলেছেন এগিয়ে যেতে, তার কাছ থেকে সবরকমের সহায়তা পাবে। 

কীরকম সহায়তা পাব স্যার? 

সবরকমের। নিশ্চিন্তে আপনারা এগিয়ে যান। বাই দা ওয়ে আপনাদের কাছে কি কোনো ওয়েপন রয়েছে? 

না স্যার। 

সিদ্ধার্থ একটু ভেবে বলেছিলেন ঠিক আছে দরকার নেই। ওসব থাকলে সমস্যা হতে পারে। আচ্ছা ওখানে চেকিং কেমন? 

নাঃ চেকিং তো কিছু নেই দেখলাম। 

গুড। আপনাদের কয়েকটা জিনিস সঙ্গে দেবো, প্রয়োজনে কাজে লাগবে বলে একটা ছোটো ব্যাগ থেকে বেশ কিছু জিনিস বার করেছিলেন উনি। নাইট ভিশন মাইক্রো স্পাই ক্যামেরা, ওয়্যারলেস স্পাই ক্যামেরা, আরও বেশ কয়েকটি উন্নত প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক গ্যাজেট যেগুলো তদন্তের ক্ষেত্রে এবং নিজেদের সুরক্ষার জন্যও যথেষ্ট সাহায্য করবে। প্রতিটা গ্যাজেটের ব্যবহার প্রণালিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উনি। অরণ্যের মোবাইলটা নিয়ে তাতে একটা বিশেষ সফটওয়্যারও ডাউনলোড করে দিলেন উনি। তারপর আরও কিছু প্ল্যানিং, স্ট্র্যাটেজি ইত্যাদি নিয়ে কথা সেরে সিদ্ধার্থ চলে গেলেন। দিয়া অফিসের অঞ্জনদাকে ফোন করে পুরো ডিটেল জানিয়েছিল, অঞ্জন সব শুনে বলেছিল তোদের অনুমান যদি সত্যিই হয় তাহলে কিন্তু সিংহের গুহায় ঢুকতে যাচ্ছিস, খুব সাবধান। জায়গার যেমন ডেসক্রিপশন দিচ্ছিস তাতে পাঁচিলের বাইরে চারদিকে ঘন জঙ্গল কথাটা বেশ চিন্তার। বিপদে পড়লে ওখান থেকে পালানোর উপায়ও পাবি না। আমি ডিসকারেজ করছি না কিন্তু ভেবে দেখিস। দিয়া শুধু উত্তর দিয়েছিল, ব্যাপারটা এতই সিরিয়াস আর ভয়ংকর যে পেছনে ফেরার উপায় নেই অঞ্জনদা। এর শেষ আমরা দেখতে চাই। তুমি শুধু একটু সাপোর্ট দিয়ো বাস। 

অঞ্জন বলেছিল তথাস্তু। আমার সবরকম আশীর্বাদ রইল। 

আজ সকালে হোটেল ছেড়ে গুলাব সিং-এর গাড়িতে এখানে আবার চলে আসা। আজ অবশ্য দিয়া একেবারে টিপিক্যাল বাঙালি বউয়ের বেশে। হাতে শাঁখা-পলা না পরলেও সিঁথিতে হালকা সিঁদুর ছুঁইয়ে নিয়েছে। আয়না দেখে কপালের ওপরে সিঁদুর দেওয়ার সময় অরণ্য বলেছিল কিরে নিজেই নিজেকে বিয়ে করে নিলি, আমার জন্য একটু অপেক্ষা করতে পারলি না। চাকরিটা আমি পেয়ে গিয়েছি বেলা শুনছ… 

তুই আর চাকরি পেয়েছিস…আমাকেই খাওয়াতে হবে আজীবন বুঝে গিয়েছি। পালটা উত্তর দিয়েছিল দিয়া। 

তারপর দুজনেরই হাসি। 

বেলা দশটার মধ্যে গুলাব এসে পৌঁছে দিলো ওদের। যাওয়ার আগে বলে গেল, কোনোরকম দরকার লাগলে যখন খুশি যেন একবার ফোন করে গুলাব ঠিক হাজির হয়ে যাবে। 

গুলাব চলে গেল। ওরা দুজনে গিয়ে উঠল ওদের জন্য অ্যালটেড রুমে। ছোটো একটা ঘর। অ্যাটাচ বাথরুম রয়েছে। ঘরের মধ্যে একটা ডবল বেড আর একটা স্টিলের আলমারি বাস। আর কিছু নেই। আজ শনিবার। মঙ্গলবার বাবাজি দীক্ষা দেন। বুধবার সকালের মধ্যে রুম ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম। মানে হাতে রয়েছে মাত্র শনি, রবি, সোম আর মঙ্গলবারের রাত। তার মধ্যেই এই বিশাল জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে আদৌ কিছু আছে কি না তা জানতে হবে। হয়তো কিছুই নেই। পুরোটাই ফালতু পরিশ্রম করতে হবে কিন্তু উপায় নেই। মন্দির যখন পাওয়া গেছে তখন সেখানে দেবতা রয়েছে কি না তাও উঁকি দিয়ে দেখা দরকার। 

খাটের ওপর দুজনে বসল কৌশল সাজাতে। 

দিয়া জিজ্ঞাসা করল কীভাবে শুরু করবি? 

শোন আমাদের সকালে একরকমের কাজ আর রাতে আরেকরকমের কাজ করতে হবে। আজ সকালে শুধু দুজনে আলাদাভাবে পুরো এরিয়াটা চষে ফেলি। এবং যে জায়গাগুলো সন্দেহজনক মনে হবে সেগুলো স্পট করে মোবাইলে ছবি তুলব। এবং যদি সেইরকম খুব ইম্পর্ট্যান্ট কিছু মনে হয় তাহলে আমাদের দুজনের কাছেই স্পাই ক্যামেরা রয়েছে সেটা ইউজ করব। ও কে? 

ও কে বস। আমার সিঁথির সিঁদুরের দিব্যি, এখানে একটা কিছু পাবই পাব।

দিয়ার কথায় হো-হো করে হেসে উঠল অরণ্য। তারপর শুরু হলো ওদের অভিযান। আশ্রমের মেইন গেটের সামনেই একটা ম্যাপ রয়েছে। সেটা দেখে বোঝা যায় পুরো আশ্রমচত্বরটি গোলাকার। এবং কোন মন্দির কোথায় রয়েছে সেটাও ম্যাপে উল্লেখ করা রয়েছে। ওই ম্যাপের একটা ছবি মোবাইলে আগেই তুলে নিয়েছিল দিয়া। সেটা দেখে দুজনে ঠিক করে নিল অরণ্য মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমভাগে দেখবে আর দিয়া দেখবে দক্ষিণ-পূর্বদিক। 

প্ল্যানমাফিক দুজনে দুদিকে চলে গেল। অরণ্য যেদিকে গেল সেদিকে সূর্যমন্দির, হনুমান মন্দির, বাল্মীকি আর মাচণ্ডীর মন্দির রয়েছে। দিয়ার দিকে রয়েছে মাধব কন্দলী, কৃত্তিবাস, রাধেশ্যাম আর শংকরদেবের মন্দির। প্রতিটা মন্দিরে ঢু দিতে হবে। তাছাড়াও পুরো এলাকায় কোথাও সন্দেহজনক কিছু রয়েছে কি না তা দেখতে হবে। 

শুরু হলো তদন্ত। দিয়া আর অরণ্য যতই ঘুরছিল ততই অবাক হচ্ছিল আশ্রমটিকে দেখে। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে বিশাল উঁচু পাঁচিলের ভেতরে এক আশ্চর্য জগৎ বটে এই রামচরণবাবাজির আশ্রম। আশ্রমের ভেতরেও এত বড়ো বড়ো গাছ যে পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রবল। দিয়া আর অরণ্য দুজনেই মোবাইলে ম্যাপের ছবি দেখে এগোতে থাকল। আশ্রমের মানুষজন, রাস্তা, কর্মকাণ্ড। অনেককিছু। আশ্রমের ভেতরে সবজি এবং ভেষজ চাষ হয়, মস্ত বড়ো গোয়াল রয়েছে। তাছাড়া ফুল-ফলের বাগান, পক্তিভোজনের জায়গা যেখানে দুই-একশো মানুষ অনায়াসে মাটিতে বসে খেতে পারে। পাকশালাটিও স্বাভাবিকভাবে বিশাল বড়ো। অন্তত জনা পনেরো মানুষ সেখানে বিশাল বিশাল হাঁড়ি-কড়াইতে রান্নায় ব্যস্ত। এখানে প্রতিদিন গড়ে একশো মানুষ দুবেলা খায়। তাদের রান্নার আয়োজন নেহাত কম নয়। ওরা যত দেখছিল ততই অবাক হচ্ছিল। 

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক দুজনে মিলে ঘুরল। আলাদাভাবে সন্দেহ করার মতো কিছুই চোখে পড়ল না। তবে প্রতিটা মন্দিরে আলাদা আলাদা স্তবগান বাজছে সেটা দুজনেই খেয়াল করল। এই আশ্রমে যারা আশ্রমিক তারা যে শুধু অসমিয়া তা নয়, বরং হিন্দিভাষী অনেক রয়েছেন। আর দীক্ষা নেওয়া অথবা বাবাজির দর্শন করতে যারা আসেন তাদের চেহারা কথাবার্তা দেখলে আন্দাজ করা যায় খুব উচ্চবিত্ত বা একেবারে নিম্নবিত্ত কেউ নয়, সকলেই মিডলক্লাস ফ্যামিলির। এবং নর্থ ও সাউথ ইন্ডিয়ার ভক্তই বেশি। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, এমন জঙ্গলের মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রায় নষ্ট না করেই এমন চমৎকার একটা আশ্রম বানানো সত্যিই কোনো পাকা মাথার কাজ। এমনভাবে পুরোটা ডিজাইন করা যেন মনে হয় প্রকৃতির মধ্যেই স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে এই আশ্রমটি। প্রতিটি মন্দিরই শ্বেতপাথরের। এবং এত মানুষ থাকলেও কোনো কোলাহল নেই। আশ্রমিক যারা রয়েছেন তারা তো রোবটের মতো চুপচাপ নিজেদের কাজ করে চলেছে আর যারা বাবাজির ভক্ত তারাও কেউ হইহই করছে না। আশ্রমের প্রবেশদ্বারে সাইনবোর্ডে যে নির্দেশাবলি লেখা রয়েছে তার মধ্যে দ্বিতীয় পয়েন্টেই লেখা ছিল নীরবতা ও শান্তি বজায় রাখবেন। বেলা একটা থেকে এখানে দুপুরের ভোগ খাওয়ানো শুরু হয়। আড়াইটা পর্যন্ত চলে। তার মধ্যেই খেতে হবে। অরণ্য দেখল হাতে এখনো ঘণ্টাখানেক রয়েছে। শীতের দুপুর থেকে সন্ধে নামতে খুব বেশি সময় নেয় না। ফলে তার আগেই আজকের ঘোরাঘুরি শেষ করতে হবে। দিয়াকে ফোন করল ও। 

দিয়া উত্তর দিলো, কৃত্তিবাস মন্দিরে রয়েছি। খুব ইন্টারেস্টিং কেস।

তাই নাকি? কিছু পেলি? বলছি গিয়ে। 

তুই কোথায়? আমার ঘোরাঘুরি প্রাথমিকভাবে শেষ। এবার খিদে পেয়েছে। চলে আয়, বলল অরণ্য। 

ও কে। কোথায় আছিস? 

সরাসরি খাবারের জায়গায় আয়। ওখানেই যাচ্ছি।

বেশ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *