কৃত্তিবাস রহস্য – ২০

২০

ভাত, ডাল, একটা সবজি, ভাজা, চাটনি আর একটা লাড্ডু— একেবারে সাদামাটা খাবার তবে সুস্বাদু। প্রথম ব্যাচে প্রায় পঞ্চাশজন খেতে বসেছিলেন। আশ্রমিকরা খাবার পরিবেশন করছিলেন। একজন মাঝবয়সি মোটাসোটা মাতব্বর টাইপ বাবাজি খাবারের তদারকি করছিলেন। যারা খেতে বসেছেন তাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। অরণ্য বুঝতে পারছিল লোকটা আশ্রমের একজন কেউকেটা হবেন। দিয়ার পাশে বসে যে ভদ্রলোক হাপুসহুপুস খাচ্ছিলেন তাকে দিয়া জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা ওই বাবাজির নাম কী? 

উনিই তো লাল্টু মহারাজ, ছোটো বাবাজি। খেতে খেতেই উত্তর দিলেন তিনি। 

ওঃ আচ্ছা। 

এবার লোকটি জিজ্ঞাসা করল, আজই এলেন নাকি? 

হ্যাঁ। 

দীক্ষা নেবেন? 

হুঁ। 

আমিও। 

আপনি কোথা থেকে এসেছেন? 

বেগুসরাই। আমরা পাঁচটা পরিবার এসেছি। 

ও আচ্ছা আচ্ছা। 

আপনারা কি কলকাতা থেকে? 

হুঁ।

খুব ভালো। কপালে না থাকলে বাবাজির শিষ্য হওয়া যায় না। আমরা অনেকদিন ধরে চেষ্টা করে অবশেষে সুযোগ পেয়েছি। ভারতে বাবাজির প্রচুর শিষ্য রয়েছেন। 

ওঃ তাই! সকলে এখানে এসেই দীক্ষা নেন? 

না না সকলে এখানে কেন আসবেন? বাবাজির তো হরিয়ানা আর দিল্লিতেও আশ্রম রয়েছে। উনি একটা আশ্রমে থাকেন না তো। হরিয়ানা দিল্লি আর এই পবিতরার আশ্রমে পালা করে থাকেন। 

তাই! শুনে বেশ অবাক হলো অরণ্য আর দিয়া। তাই উনি এখানে সব সময় থাকেন না? 

না না, কেন আপনারা বাবাজি সম্পর্কে কিছু জানেন না? বেশ বিস্ময় প্রকাশ করেই পালটা প্রশ্ন করল লোকটা। 

না খুব যে জানি তা নয়, মার এক বন্ধু বাবাজির শিষ্য। ওনার কাছে বাবাজির অনেক প্রশংসা শুনেছি, অনেক অলৌকিক শক্তির কথা শুনেছি তাই ভাবলাম দীক্ষা নিলে ওনার কাছেই নেওয়া ভালো। 

হ্যাঁ উনি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের সন্তান, বলে এঁটো ডানহাতটা মুঠো করে কবজির উলটো পিঠ কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন বাবাজিকে। তারপর আবার বললেন শুনেছি পুরো ইন্ডিয়াতে হাজার হাজার শিষ্য রয়েছে বাবাজির। 

হাজার হাজার! 

হুঁ। বলে খাওয়া শেষ করে উঠলেন তিনি। ব্যাচ শেষ হয়েছে, দিয়া আর অরণ্যও উঠল। বাইরে হাত ধোয়ার জন্য লম্বা বেসিন। হাত ধোয়ারও লাইন পড়েছে। অরণ্য দিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝছিস? 

বেশ ইন্টারেস্টিং। 

সে তো আমিও বুঝছি। কিন্তু ইন্টারেস্টের বাইরে কিছু পেলি? 

হুঁ। কৃত্তিবাস আর মাধব কন্দলীর মন্দিরে গিয়ে অনেককিছু জানতে পারলাম বুঝলি। আমি ওই মাধব মন্দিরের পূজারির সঙ্গে কথা বলে অনেককিছু জানতে পারলাম। এবং তারপর একটা জিনিস খুব ভালোমতো ক্লিয়ার হয়ে গেছে যে এখানে যতগুলো মন্দির রয়েছে তা ইন্টাররিলেটেড। 

তাই! 

হ্যাঁ। কীভাবে? 

চল, বসে বলছি। 

হাত ধুয়ে দুজনে একটা খোলা জায়গায় বসল।

দিয়া বলল কৃত্তিবাস বললে তোর কী মনে পড়ে? 

বাংলায় রামায়ণ রচনাকার। 

বেশ এবার হনুমান মন্দিরের কথা বাদ দিলাম কারণ রামমন্দিরে হনুমান থাকবে তা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু রাম মন্দিরে রয়েছে কবি কৃত্তিবাসের মন্দির। আচ্ছা এবার বল মাধব কন্দলীর নাম শুনেছিস তুই? 

নাঃ শুনিনি। এখানেই প্রথম শুনলাম, কে উনি? 

আমি জানলাম। ইতিহাস বলছে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহর্ষি বাল্মীকি সংস্কৃতে রামায়ণ রচনা করলেন। এই রামচন্দ্র কোন বংশের? সূর্যবংশীয়। অর্থাৎ সূর্যদেবের মন্দির এখানে কেন তার একটা সূক্ষ্ম সূত্র পাওয়া গেল। এবার আরও জেনে অবাক হলাম পূজারিজি বললেন কবি কৃত্তিবাস যেখানে চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলায় প্রথম রামায়ণ অনুবাদ করলেন তার দুশো বছর পর অসমিয়া ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন এই মাধব কন্দলী। তিনি অবশ্য পুরোটা অনুবাদ করলেও শেষদিকের বেশ কিছু পুথি হারিয়ে গিয়েছিল ফলে পরে সেই বাকি অংশ লেখেন শংকরদেব। তাহলে মাধব কন্দলী আর শংকরদেবের মন্দির কেন রয়েছে সেটা ক্লিয়ার হলো? 

হ্যাঁ তা হলো। কিন্তু সূর্যের কেসটা এটুকুই? 

রোসো। সবই বলছি বস। বলে হাসল দিয়া। তারপর বলল, আমরা জানি রাবণকে বধ করার জন্য শ্রীরামচন্দ্র অকালবোধন করেছিলেন, মানে মাদুর্গার পুজো করেছিলেন। রাইট? 

রাইট। 

কিন্তু সেটা হলো কৃত্তিবাসের মতো। কিন্তু অন্য একটি মতো… কী বৃহদ্ধর্ম পুরাণ না কী যেন বললেন উনি, সেখানে নাকি বলছে শ্রীরামচন্দ্র আসলে রাবণ বধের জন্য সূর্যদেবের পুজো করেছিলেন। কারণ উনি নিজেও ছিলেন সূর্যবংশীয় তাই এত বড়ো যুদ্ধের আগে সূর্যপুজো করবেন সেটা স্বভাবিক। দুর্গার পুজো করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। আর সূর্যপুজোর পর শ্রীরামচন্দ্র যেটা করেছিলেন তা হলো শ্রীচণ্ডীর হোম। এবারে পুরো কেসটা মিলিয়ে দেখ। 

হুঁ। রাম, কৃত্তিবাস, মাধব, সূর্য, শংকরদেব, চণ্ডী সকলেই পারস্পরিক যুক্ত। এবারে একটা জিনিস ক্লিয়ার হলো যে মন্দিরগুলো এমনি এমনি তৈরি হয়নি। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের তদন্তের যোগ কী? আমরা তো শুধু সূর্যদেবের মন্দিরকে টার্গেট করেছি 

উঁহুঁ এখানেই আমার বক্তব্য। দিয়া মাথা নেড়ে বলল। ব্যাপারটা ভেবে দেখ, মন্দিরগুলো যদি ইন্টাররিলেটেড হয়ে থাকে আর আমরা যদি শুধু একটা সাবজেক্ট নিয়ে ভেবে যাই তাহলে কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। 

তাহলে? 

তাহলে আমাদের শুধু সূর্যদেবের মন্দির নিয়ে না ভেবে আরেকটু বেশি করে ভাবা উচিত। একবেলা পেরিয়ে গেল শুধু জায়গাটা এমনি ঘুরে দেখতেই। একটা মন্দিরকেই ভালো করে অবজার্ভ করা হয়নি এখন তুই বলছিস এতগুলো মন্দির নিয়ে… 

কিছু করার নেই। করতে হবে। তুই কিছু পেলি? 

হ্যাঁ। কয়েকটা ইনফো জাস্ট। 

যেমন? 

যেমন আমি সূর্যদেবের মন্দিরে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছি। তবে আজ ওখানে একটা ব্যাপার ঘটল, আজ যখন সূর্যমন্দিরে গেলাম। তখন গতকালের পূজারি আমাকে চিনতে পারলেন না মাইরি। গতকালই কত কথা বললেন আর আজই অচেনা। 

সে হয়তো সত্যিই ভুলে গেছেন। সারাদিনে কত মানুষ দেখছেন উনি সকলকে মনে রাখা সম্ভব নাকি? 

উঁহু, মানতে পারলাম না। প্রথমত, একমাত্র রামমন্দির ছাড়া আমার মনে হয় না আর বাকি মন্দিরগুলোতে খুব বেশি ভক্ত আসেন বলে। অন্তত আমি যে কটা দেখলাম। 

হুঁ সেটা ঠিক। সায় দিলো দিয়া। 

তাহলে একেবারে চিনতেই পারবেন না সেটা ভাবা কিন্তু বেশ কষ্টকর। ইনফ্যাক্ট আজ ওকে দেখে বেশ অন্যমনস্ক মনে হচ্ছিল। বেশ ডিপ্রেসড। এবং আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম একটি অল্পবয়সি ছেলে এই ধর একুশ- বাইশ বছর বয়স হবে, তার সঙ্গে ওই ভদ্রলোকের বেশ কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। ছেলেটার পরনেও ওই পূজারির পোশাক। সম্ভবত জুনিয়র পূজারি হবে। দুজনেই পরস্পরকে একটা কিছু ব্যাপারে দোষারোপ করছিল। বিশেষ করে ওই বড়ো পূজারি ছোটোজনকে খুব ধমকাচ্ছিল। আমি যেতেই চুপ করে গেল। 

তো? হতেই পারে। 

হ্যাঁ হতেই পারে। কিন্তু যেটা হতে পারে না সেটা এবারে শোন। ওদের দুজনের বেশ কিছুক্ষণ ঝগড়া হওয়ার পর ওই বয়স্ক পূজারি রেগেমেগে উঠে গেলেন। ওর আসনে বসল ছেলেটি। আমি ছেলেটির কাছে এমনিই কৌতূহলবশত গিয়ে সামান্য হেসে বললাম আপনিও বুঝি সূর্যমন্দিরের পূজারি? ছেলেটা উত্তর দিলো না। শুধু বিরসবদনে আমার দিকে কুশিতে করে খানিকটা চরণামৃত এগিয়ে দিলো। আমি খেয়ে মাথায় মুছে সামান্য হেসে বললাম রেগে গেছেন বোধহয়, যাক গে বয়স্ক মানুষের সঙ্গে অশান্তি করে কী লাভ? 

ছেলেটা অমনিই গজগজ করে উঠল, হুঁ বয়স্ক! সারাজীবন আমার ওপর শুধু খবরদারি করে এলো। 

সারাজীবন কথাটা কানে লাগল আমার। জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কে হন আপনার? বাবা? 

না। চাচা। আমার দুর্ভাগ্য! 

না না এমন কেন বলছেন? 

ঠিকই বলছি। নিজের জীবনটা শেষ করেছে এবার আমার জীবনটাকেও করবে। বলেই ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে বেশ রেগেমেগে জিজ্ঞাসা করল, এখানে কেন এসেছেন? বাবাজির শিষ্য নাকি? 

আমি বললাম এখনো হইনি। হতে এসেছি। 

খুব ভালো করেছেন। যান মরুন এবার। 

আমি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম। তা কেন বলছেন? 

ছেলেটা তখন যেন একটু রাগের বশ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না না ও কিছু না। 

আমিও চেপে ধরে বললাম, বলুন না কী অসুবিধা? কোনো সমস্যা রয়েছে? আমি কাউকে বলব না। 

ছেলেটা ততক্ষণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বলল না না আমি কিছু বলিনি। আপনার ঠাকুর দর্শন হয়ে থাকলে এবার আসুন। 

হ্যাঁ ঠাকুর দেখা হয়ে গেছে। আপনি কিন্তু বললেন না। 

আপনার যা জানার বাবাজির কাছে জানবেন। এই মন্দির খুব ভালো। বাবাজি ভগবান। আমি এটুকুই জানি। 

ছেলেটা যে এই কথাগুলো মোটেও মন থেকে বলছিল না, বরং বলার মধ্যে ঘৃণা আর হতাশা মিশে ছিল তা দিব্যি টের পাচ্ছিলাম। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। বেশ চলে যাচ্ছি, শুধু একটা কথা বলবেন? এই সূর্যমন্দিরে এই স্তবগানটা কি সারাক্ষণ বাজে? 

ছেলেটা বলল হ্যাঁ চব্বিশ ঘণ্টা। 

আর ঠাকুরের গায়ে ওটা নোংরামতো কী লেগে রয়েছে? 

নোংরা! কোথায়? 

ওই যে ডানদিকে। 

কই দেখতে পাচ্ছি না তো। 

এই তো আমি দেখতে পাচ্ছি। কালোমতো কী একটা লেগে।

ছেলেটা কনফিউজ্‌ড হয়ে উঠে গেল ঠাকুরের দিকে। আমিও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছি। 

কোথায় নোংরা লেগে? ছেলেটা ঠাকুরের দিকে ঝুঁকে ময়লা খুঁজতে লাগল আর আমিও ওই ফাঁকে উঠে দাঁড়ালাম। 

কোথায় নোংরা দেখছেন আপনি? 

ওই তো ডানদিকের কাঁধের দিকে দেখুন। হ্যাঁ আরেকটু নিচের দিকে। বলতে বলতে আমি টুক করে মোক্ষম কাজটা সেরে ফেললাম। তারপর ছেলেটাকে বললাম ওঃ না না ময়লা নয়, কীসের একটা ছায়া পড়েছে বলে অমন কালো লাগছিল। আচ্ছা চলি বলে চলে এলাম। 

তা কী মোক্ষম কাজ করলি শুনি?

অরণ্য মুচকি হেসে বলল, বলছি। 

২১

হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল ক্রেটের। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। নিউদিল্লির কনটপ্লেসের একটি বিলাসবহুল হোটেলের ইলেভেন্থ ফ্লোরের একটি সুইটের নরম বিছানায় শুয়েছিলেন তিনি। অনেক রাত জেগে কাজ করার পর শুয়েছিলেন। এবং কিছুক্ষণ ঘুমোনোর পরেই আচমকা আবার স্বপ্ন এবং ঘুম ভেঙে গেল। বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ধরে একটা স্বপ্নই ক্রেটকে রাতের পর রাত তাড়া করে বেড়ায়। এই স্বপ্ন থেকে তার মুক্তি নেই। জীবনে শেষ কবে নিশ্চিন্তে শান্তিতে ঘুমিয়েছিলেন তিনি আর মনে পড়ে না। কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়েও সেই অভিশপ্ত স্বপ্ন থেকে তার মুক্তি নেই। চোখে একটু তন্দ্রা এলেই তিনি দেখতে পান কতকগুলো টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসে না। পৃথিবীর সেরা দশজন ফ্যাশন ডিজাইনারের একজন ক্রেট, যার ডিজাইন করা পোশাকের জগৎজোড়া নাম। অভিনেতা থেকে মডেল, ধনকুবের শিল্পপতি থেকে রাজনীতিক, ক্রিকেটার সকলে ক্রেটের পোশাক, একসেসরিজ ব্যবহার করতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করেন সেই ক্রেট দীর্ঘবছর ঘুমোন না। একটা আতঙ্কের স্বপ্ন তাকে বছরের পর বছর ঘুমোতে দেয় না। জাগিয়ে রাখে। 

বিছানা ছেড়ে বেডরুমের উত্তর ইংল্যান্ডের ছোট্ট একটা গ্রাম। সেই গ্রামের একটি হতদরিদ্র পরিবার, পল তার স্ত্রী মোনা আর তাদের একটি ছোটো ছেলে ক্রিস্টোফার। পল পেশায় একজন মুচি। নিজের কাজে অত্যন্ত সৎ পল জুতো সেলাইয়ের কাজেও খুব পারদর্শী। কিন্তু গরিবের গ্রামে তাদের কাজের মূল্য কে দেবে? তাই দিন আনি দিন খাই জীবন। একবেলা জোটে তো আরেকবেলা জোটে না। কিন্তু পল ওই অতি অল্পের জীবনেই বেশ খুশি। স্ত্রী মোনারও এমন কঠিন জীবনে কোনো অভিযোগ নেই। সন্ধে হলেই মোনা তার পুরোনো বাইবেলটি খুলে বসে। একখণ্ড ভালো চামড়া দিয়ে তার প্রিয় বাইবেলখানি বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য সে অনেকবার স্বামী পলকে অনুরোধ করেছে কিন্তু পল সে অনুরোধ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রাখতে পারেনি। কারণ সামান্য চামড়াও মহার্ঘ্য। মোনা বাইবেল পড়ে শোনায়। শ্রোতা পল। অনেক সময় পলের দুই-চারজন বন্ধুও চলে আসে শুনতে। ক্রিস্টোফারকেও বসে থাকতে হয়। তেরো বছরের ক্রিস্টোফারের ওইসব কথা অসহ্য লাগে। রাগ হয়। নিত্যদিনের এই দারিদ্র্য, এই খিদে, এই না-পাওয়া তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয় ওর মনে। আরও রাগ হয় বাপ-মায়ের প্রতি। পরিবারের এই প্রতিদিনের অভাবকে দূর করার কোনো চেষ্টা তো নেই-ই তাদের উপরন্তু এতেই নির্লজ্জের মতো খুশি মানুষদুটো! কেন এমন হবে? অথচ ওদের গ্রাম থেকে একটু দূরেই যে শহর যেখানে ক্রিস্টোফার মাঝে মাঝেই যায় তার বাবার সঙ্গে। কারণ অনেক সময় শহর থেকেও কাজের অর্ডার নিয়ে আসে পল, কখনো নিজেও চামড়ার জুতো, বেল্ট, জ্যাকেট, টুপি ইত্যাদি বানিয়ে নিয়ে যায় শহরের বাজারে বিক্রি করতে। আর সেই দিনগুলোয় ক্রিস্টোফার শহর ঘুরে ঘুরে দেখে। দেখে শহরের আনন্দ, বৈভব আর দেখে তারই বয়সি ছেলেমেয়েদের ঝলমলে খুশির জীবন। তাদের পোশাক, হইহই, জীবনযাত্রার টুকরো ছবিগুলো যেন বালির মতো কড়কড় করে ওর চোখে। মনে হয় আমি কেন পেলাম না, আমার কী দোষ? কখনো বাবাকে বা মাকে এই অভিযোগ জানালে তারা দুজনেই বাইবেলের কথা শোনান। বলেন জীবনে চাহিদা কম থাকাই আনন্দে থাকার একমাত্র পথ। এই পথকে আসলে ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল বলে মনে হয় ক্রিস্টোফারের। রাগ হয়, পৃথিবীর সবকিছুর প্রতি রাগ বাড়তে থাকছিল তার। একদিন ঐ ছোটো পরিবারটিতে ঘটে গেল একটি ভয়ংকর দুর্ঘটনা। পল আর মোনা আচমকাই দুজনে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। একা হয়ে গেল ক্রিস্টোফার। কয়েকদিন এলোমেলো ঘুরল। প্রতিবেশীরা পরামর্শ দিলো বাবার শেখানো কাজ ধরতে। মানে জুতো, টুপি বানানো, সারানো। ইচ্ছে ছিল না ক্রিস্টোফারের। চামড়ার জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলেই ওর সেই মৃত পশুগুলোর কথা মনে পড়ত। কষ্ট হতো। কিন্তু বাবার শেখানো ওই বিদ্যেটুকু ছাড়া পেট চালানোর মতো আর কিছু ছিল না ওর। কিন্তু আরেকটা জিনিস ছিল ওর মনে। তা হলো প্রখর বুদ্ধি, অসামান্য কল্পনাশক্তি, কোনোকিছু একবার দেখে নিলে তা হুবহু মনে রেখে দেওয়ার ক্ষমতা, আর…আর ছিল অনেক উঁচুতে ওঠার অদম্য জেদ। বাপ-মায়ের জীবনকে ঘেন্না করত ক্রিস্টোফার, বারবার মনে হতো এই অবহেলার জীবনযাপনের জন্য সে জন্মায়নি। বাবা-মা আর সঙ্গে না-থাকার ফলে সে যতটা না কষ্ট পেল তার থেকে অনেক অনেক বেশি মুক্তিলাভ করল যেন। শুরু করল নিজের মতো করে কাজ। শহরে গিয়ে নামিদামি দোকানগুলোর বাইরে দাঁড়িয়ে, কখনো সুযোগ পেলে ভেতরে ঢুকে দেখত দামি ব্র্যান্ডের জিনিসপত্রের ডিজাইন, তার মেকিং প্রসেসটা মনে মনে কল্পনা করত। তারপর ঘরে ফিরে দিনরাত জেগে সেমতো একটা কিছু বানানোর চেষ্টা করত। সঠিক প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না-থাকার ফলে যা বানানোর চেষ্টা করত তা শেষ পর্যন্ত পেরে উঠত না, কিন্তু কখনো সখনো একটা-দুটো হয়েও যেত। হুবহু না হলেও অন্যরকম। একদিন ক্রিস্টোফারকে চোখে পড়ে গেল শহরের এক নামি ব্যবসায়ীর। তিনি কাজ দিলেন। তার শুধু চামড়ার ব্যবসা নয়, জামাকাপড়ের দোকানও ছিল। সেখানে হাতেকলমে কাজ শিখতে শুরু করল ক্রিস্টোফার। থাকা-খাওয়া ফ্রি, মাস গেলে হাতে সামান্য টাকা, কিন্তু দিনরাত কাজ। কোনো ছুটি নেই। ছুটি চাইতও না ক্রিস্টোফার বরং সারাদিন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত কাজে। আর অবসর সামান্য সময় পেলেই দোকানের নামিদামি জুতো, টুপি, জ্যাকেট, শার্ট, ট্রাউজার, বেল্ট সবকিছু নেড়েঘেঁটে দেখত, বোঝার চেষ্টা করত। মালিক একদিন তাকে পাকড়াও করলেন ফ্যাশনের একটা পুরোনো বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থাকতে দেখে। আরও জানলেন ওই ম্যাগাজিন থেকে কিছু কিছু ছবি দেখে ক্রিস্টোফার তার ছেঁড়া খাতায় নিজেও নতুন করে ডিজাইনের চেষ্টা করে। মালিক মানুষটি ছিলেন ভালো। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই ছোকরা শুধু কারিগর হওয়ার জন্য জন্মায়নি। ছেলেটির হাত ধরে টেনে তুলেছিলেন তিনি। পুরোনো ডায়ারির পৃষ্ঠায় আঁকা ডিজাইনগুলো উলটে পালটে দেখে তারপর বলেছিলেন কাল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। 

নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য এক শহরে। সেখানে শেখানো হয় হরেক রকমের ডিজাইন। ছেলেটির ভাগ্য খুলে গেল। রাতদিন পার করে শিখতে শিখতে সাফল্যের একটা করে ধাপ পেরোতে পেরোতে সে উঠতে থাকল উঁচুতে আরও উঁচুতে। নামি কোম্পানির চাকরি, সেই চাকরি ছেড়ে এক সময় নিজেরই কোম্পানি তৈরি করা, নিজের কাজকে গোটা বিশ্বের দরবারে সুন্দরী নারী, বিলাসবহুল জীবন সবই আসতে শুরু করল তার কাছে। প্রথম জীবনের না-পাওয়াগুলোকে প্রাণপণে ভুলতে চেষ্টা শুরু করল ক্রিস্টোফার। নিজের নাম বদলে ফেলল একদিন। বদলে ফেলল নিজের চুলের স্টাইল, কিন্তু সবকিছু বদলে গেল, শুধু বদলাল না একট স্বপ্ন বা বলা ভালো একটা দুঃস্বপ্ন যা গরিব অচেনা ক্রিস্টোফার থেকে বিশাল ধনী বিখ্যাত ক্রেটেরও প্রায় প্রতিটা রাত্রিকে ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিত। ঘুমোতে ভয় হতো, ঘুমোলেই বুঝি সেই স্বপ্নটা আসবে। প্রাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করে ক্রেট। তবু মানুষের শরীর, তার ক্লান্তি আছে, ঘুম প্রয়োজন। ঘুম আসে, আর সেই ঘুমে কখনো আচমকাই ধূর্ত শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বপ্নটা। ঘুম ভেঙে যায়। আর তারপরে ঘুম আসে না। 

দারিদ্র্যকে ঘৃণা করত ক্রিস্টোফার, ক্রেটও দারিদ্র্যকে ঘৃণা করে। তৃতীয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে তিনি তার দয়ার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার আনুকূল্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং আফ্রিকার বেশ কয়েকটি গরিব দেশে গড়ে উঠেছে অনাথাশ্রম, বৃদ্ধাবাস। এমন আরও সংস্থা গড়বেন তিনি। শুধু মানুষের জন্য নয়, বন্যপশুদের সুরক্ষা নিয়েও তিনি বহুকাজ করেন। তার কোম্পানিতে সবকিছু রয়েছে কিন্তু আসল পশুর চামড়ার কিছু পাওয়া যায় না। এমন চ্যারিটি আরও করার ইচ্ছা তার। এবারের এশিয়া টুরে তিনি ভারতের কাজ মিটিয়ে যাবেন শ্রীলঙ্কা। সেখান থেকে আবার দেশে ফিরবেন। 

চুরুট ধরিয়ে দেওয়ালজোড়া কাচের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রেট বাইরে অন্ধকার শহরটির দিকে তাকিয়েছিলেন। দামি তামাকের গন্ধে ভরে যাচ্ছে ঘর। শেষরাতের দিল্লি শহর শীতের কুয়াশায় ঢাকা। অনেক নিচের মাটিতে কিছু আলো ঝাপসাভাবে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কাচের জানালায় জমে রয়েছে বিন্দুবিন্দু জলকণা। ঠান্ডা কাচের জানলায় নিজের হাত রাখলেন ক্রেট। হাতের ছাপ পড়ল। সেটা পরক্ষণেই মুছে দিলেন তিনি। বরাবর নিজেকে সবকিছুর থেকে আড়ালে, নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করেন। এত খ্যাতি, প্রতিপত্তির পরও আলোর সামনে আসতে তার অস্বস্তি হয়, নিজের সম্পর্কে কিছু বলা তো অনেক দূরের কথা নিজের প্রোডাক্ট নিয়ে কিছু বলা, কোনো সেমিনার, পার্টি, কনফারেন্সও যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে ভালোবাসেন ক্রেট। মিডিয়া তার সম্পর্কে জানতে দীর্ঘকাল ধরে প্রবল আগ্রহী। কিন্তু তাদের বরাবর নিরাশ করে এসেছেন ক্রেট। কেউ জানে না তার জীবন, তার কাজ। 

ইন্ডিয়ান মেয়েটি…দিয়া ইয়েস, মেয়েটি ভালো। বুদ্ধিদীপ্ত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী তার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে, এমন চেষ্টা আগেও অনেক জার্নালিস্ট করেছে, ভবিষ্যতেও অনেকে করবেন কিন্তু ক্রেটের নিজের ইচ্ছে না হলে তার মুখ থেকে একটি শব্দও আদায় করা খুব কঠিন। ওই ইন্ডিয়ান মেয়েটিকে নেহাত ইচ্ছে হয়েছিল বলেই দুই-চারটি কথা বলেছেন। মেয়েটি হয়তো ভেবেছে যে সে ক্রেটের কাছ থেকে নিজের ক্ষমতায় সেই কথাগুলো আদায় করছে, কিন্তু সে জানে না, ক্রেটের নিজের ইচ্ছে না হলে তার কাছ থেকে একটি শব্দও আদায় করা কঠিন। আসলে যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, জেদি, অথচ ব্যবহারে নম্র-ভদ্র এমন চরিত্রের অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদেরকে ক্রেট পছন্দ করেন। কিন্তু দিয়াকে আলাদাভাবে পছন্দ করার একমাত্র কারণ তাই নয়। আরও বিশেষ একটি কারণ রয়েছে। আর সেটা দিয়াকে প্রথমবার যখন উনি দেখেছিলেন তখনই বুঝতে পেরেছিলেন। মিল। কী আশ্চর্য মুখের মিল! চোখে প্রায় সর্বক্ষণ পরে থাকা কালো চশমার আড়াল থেকে তিনি বারবার দেখেছিলেন দিয়াকে। এমন মুখের মিল হয়! এ যেন অবিকল… স্রেফ ওই মিলটুকুর জন্যই গৌহাটিতে যে কদিন ছিলেন তরুণী মেয়েটির সঙ্গ নিয়েছিলেন তিনি। যদিও একমুহূর্তের জন্যও তার কারণ তিনি প্রকাশ করেননি, কোনোপ্রকার আলাদা দুর্বলতাও দেখাননি স্বভাব-সংযমী ক্রেট। তার বাইরের আচরণ বরাবরই নিস্পৃহ, আবেগবর্জিত, উচ্ছ্বাসহীন। দিল্লিতে যে কারণগুলোর জন্য তিনি এসেছেন তার মধ্যে অনেকগুলো কাজ হয়ে গেছে। আর সামান্যই বাকি। আজ সকালে তিনি যাবেন আগ্রায়। দুদিন ধরে আগ্রার গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন তিনি। অবশেষে একটি জায়গা তার পছন্দ হয়েছে, ওখানে অনাথ শিশুদের জন্য একটি হোম বানাতে চান। সরকারি পর্যায়ে কথাও হয়েছে খানিকটা। ভারতবর্ষ দেশটিকে ক্রেট পছন্দ করেন। এই দেশের হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে পোভার্টি নেই, অন্নহীন, গৃহহীন মানুষের ছড়াছড়ি। আবার ধনীর সংখ্যাও অনেক। বিচিত্র দেশ। এই দরিদ্রদের জন্যই ক্রেট রয়েছেন। সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতে স্বচ্ছন্দবোধ না করলেও অনাথ, অসহায় দরিদ্র মানুষের সঙ্গে ক্রেট খুব সহজেই মিশতে পারেন। এই ব্যাপারটা যদিও জানেন ক্রেটের খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মচারী এবং সেসকল সংস্থার মানুষ যারা ক্রেটের নীরব অবদানের সাক্ষী। 

স্টেলা…দিয়া নামের ইন্ডিয়ান মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝেই স্টেলার কথা মনে পড়ছে ক্রেটের। বহুবছর আগে এমনই এক বছরশেষে যখন সকলে বড়োদিনের আনন্দে মত্ত, তখন স্টেলা চলে গিয়েছিল। চিরকালের মতো ক্রেটকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে। শুধু রয়ে গিয়েছে খানিক স্মৃতি, যার কিছুটা ক্রেটের মনে আর কিছুটা তার ব্যক্তিগত ঘরের শোকেসে। বাবা আর মায়েরও শেষ স্মৃতি রয়েছে ওই আলমারিতেই যা ক্রেট কখনো কোনো পরিস্থিতিতেই নিজের কাছছাড়া করেননি। করবেনও না। একার জীবনে ওইটুকুই যা নিজের পরিজনের সাহচর্য। 

২২

আজ সকাল থেকেই গোটা আশ্রমে হইহই ব্যাপার। আশ্রমের মূল বাবাজি মানে রামচরণবাবাজি আজ আসছেন। সাজোসাজো ব্যাপার। আগামী পরশু দীক্ষাদানের অনুষ্ঠান। ইতোমধ্যেই আশ্রমে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়েছে। আশ্রমের গেস্ট হাউজগুলোর একটি ঘরও খালি নেই। বাবাজিকে দর্শন করার জন্যও অনেক ভক্ত এসে উপস্থিত। বাবাজি আজ কাল আর পরশু থাকবেন। তারপর আবার উড়ে চলে যাবেন অন্য আশ্রমে। ইন্টারনেটে রামচরণবাবাজি সার্চ করে আর সিদ্ধার্থ কলিতার কাছ থেকে যেটুকু তথ্য দিয়া আর অরণ্য জানতে পেরেছে তা বেশ চাঞ্চল্যকর। ভারতবর্ষে এই বাবাজির যেকটি আশ্রম রয়েছে প্রতিটাই আকারে-প্রকারে বড়ো এবং জাঁকজমকপূর্ণ। এই বাবাজির উত্থান মাত্র বছরকয়েক। তার আগে ইনি বেনারসের একটি মন্দিরের পূজারি ছিলেন, খুব ভালো শাস্ত্রজ্ঞান এবং বাগ্মিতার জন্য তার কাছে প্রতিদিন বিকেলে অনেক মানুষ আসতেন, তার কথা শুনতে। বাবাজির গানের গলাও সুন্দর। ভজন গাইতে পারতেন চমৎকার এসব কারণে ভক্ত বাড়তে থাকে তার। এক সময় তিনি পুরোনো মন্দিরের পুরোহিতের কাজের পাশাপাশি দীক্ষা দেওয়া শুরু করলেন। শিষ্যের সংখ্যা বাড়তে থাকল। তাদের মধ্যে ধনী প্রভাবশালী কয়েকজন শিষ্যও পেলেন। তাদের দানে তৈরি করলেন প্রথম আশ্ৰম। তারপর আশ্রম এবং শিষ্য দুইয়ের সংখ্যাই বাড়তে বাড়তে কয়েকবছরের মধ্যেই বিশাল ব্যাপার। গতরাতে ইউটিউবে বাবাজির বেশ কয়েকটা ধর্মীয় বক্তৃতার অংশও শুনেছে দুজনে। বলার স্টাইল যথেষ্ট কনভিন্সিং। হাবিজাবি অযৌক্তিক কিছু বকেন না। যা বলেন তার মধ্যে জ্ঞানও যেমন থাকে আবার বলার সারল্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে চমৎকার প্যাকেজ। আর বাবাজির চেহারাটিও বেশ আকর্ষণীয়। 

বেলা এগারোটা নাগাদ আশ্রমের প্রধান দরজা খুলে দেওয়া হলো। দুই ধারে ভক্ত-শিষ্যরা দাঁড়িয়ে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবাজি আসছেন। দিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে সকলের ভিড়ে। অরণ্য নেই। ও গেছে সূর্যমন্দিরে। গতকাল যে ছিপ ফেলে এসেছিল তা এখন তুলতে গেছে। দিয়া মনে মনে বেশ টেনশনে রয়েছে। অবশ্য টেনশনে ওরা দুজনেই। হাতে আর মাত্র দুটো দিন। আজ আর কাল। এর মধ্যে আদৌ কিছু করে ওঠা যাবে কি না কে জানে। হয়তো এখানে কিছুই নেই, বা হয়তো থাকলেও তার ধারেকাছে পৌঁছনো গেল না। অথচ যে কারণে এই গৌহাটিতে আসা সেই অ্যাসাইনমেন্টের কিছুই এখনো করা হয়নি। বড়োদিন আসতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এর মধ্যে কী হবে কে জানে…রহস্যের তদন্ত করতে তো কোম্পানি ওকে খরচ করে পাঠায়নি। যতই অফিসের সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকুক অ্যান্ড অফ দা ডে মানুষ আউটপুটটাই দেখে। শেষে যদি দেখা গেল রহস্যোরও কোনো সমাধান করা গেল না, আর ওদিকে মেইন অ্যাসাইনমেন্ট কভার করার সময়ও পেরিয়ে গেল তাহলে পুরোপুরি খালি হাতে ফিরতে হবে। সিনিয়ররা মুখে হয়তো কিছু বলবে না, কিন্তু মনে মনে কিছু তো ভাববে। সেটা বড়ো অস্বস্তির। 

এসব ভাবতে ভাবতেই দিয়া হঠাৎ দেখল গেটের দুই ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ভক্তকুল দুহাত তুলে জয় বাবাজির জয়, জয় বাবাজির জয় বলে ধ্বনি দিয়ে উঠলেন। আশ্রমের অন্য আবাসিকরাও গলা মেলালেন। হাসি পেয়ে গেল দিয়ার। সামনে তাকিয়ে দেখল গেটের ভেতরে ঢুকল দুটো গাড়ি। সামনেরটা টাটাসুমো পেছনেরটা হনডা সিটি। দুটো গাড়িই থামল। পেছনের গাড়ির দরজা খুলে দিলেন আশ্রমের একজন, গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়। দিয়ার পুরো তাক লেগে গেল দেখে। সত্যিই নজর কাড়ার মতো দেখতে। কাঁধপর্যন্ত সাদা চুল। গালভরা সাদা দাড়িগোঁফ, ঘন ভুরুর নিচে দীর্ঘ চোখদুটি অন্তর্ভেদী, উজ্জ্বল। পরনে সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা আর সাদা পাঞ্জাবির ওপর ফিকে গেরুয়া একটা উত্তরীয় জড়ানো। পায়ে খড়ম। লেস দেওয়া খড়ম নয় একেবারে প্রাচীনকালের স্টাইলের কাঠের খড়ম। উনি নেমে স্মিত হেসে তার ভক্তদের উদ্দেশে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে দুহাত তুললেন। 

সকলে আবার বাবাজির নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলেন। বাবাজি জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, বলো বলো শ্রীরামচন্দ্র কি…. 

জয়! সমবেত কণ্ঠ ধ্বনী উঠল। 

তিনবার শ্রীরামের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে তিনি তার অনুচরবেষ্টিত হয়ে চলে গেলেন। 

অরণ্য ফোন করল দিয়াকে। তোর কদ্দূর? তিনি এসেছেন? 

হ্যাঁ এসেছেন, এসে নিজগৃহে প্রবেশও করেছেন। 

কেমন? 

খাসা। 

বেশ আমার কাজ হয়ে গেছে একবার রুমে আয়।

ও কে। বলে দিয়া হাঁটা লাগাল গেস্টরুমের দিকে। 

২৩

দুজনে স্থির হয়ে বসে তাকিয়েছিল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার রেকর্ডিং। গতকাল দুপুরে সূর্যমন্দিরে গিয়ে সেজুনিয়র পূজারির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওর নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে খুব দ্রুত একটি মাইক্রো স্পাই ক্যামেরা বসিয়ে দিয়ে এসেছিল দরজার এমন একটি কোণে যেখানে কারও নজর পড়া কঠিন কিন্তু ঘরের ভেতরে পুরোটাই দেখা যায়। কাল দুপুর থেকে আজ বেলা পর্যন্ত ক্যামেরা তার কাজ করে গেছে। ক্যামেরা থেকে চিপ বার করে কার্ডরিডারে চিপটা দিয়ে ল্যাপটপে গুঁজে দেখছিল অরণ্য। চব্বিশ ঘণ্টার ফুটেজ পুরো দেখার দরকার নেই। ফরওয়ার্ড করে করে খুঁজছিল ইম্পর্ট্যান্ট কিছু আছে কি না। বেশিরভাগটাই মন্দিরে সূর্যদেবতা একা বসে রয়েছেন। আর সেই স্তবগান চলেছে। একটা জায়গায় এসে থেমে গেল অরণ্য। ক্যামেরার টাইমে সন্ধে পৌনে সাতটা। ঠাকুরঘরে তখন পূজারির ছেলে বসে রয়েছে, দেখা গেল সেই বয়স্ক পূজারি এসে ঢুকলেন। তিনিও বসলেন ছেলের মুখোমুখি। কারও মুখে কথা নেই। তারপর ছেলেটা গ্রাম্য হিন্দিতে বলল, আমি বাড়ি যাব। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন। 

পূজারি সঙ্গে সঙ্গে মুখ খিঁচিয়ে বলল, বাড়ি গিয়ে কী করবি? 

কিছু করব না বসে থাকব। 

এই বয়সের ছেলে ঘরে বসে বসে খাবি লজ্জা করবে না? 

.

আমি অন্যকিছু করব। দয়া করো আমাকে। এই নরকে আমি থাকতে পারছি না। আমার বমি পায়, ইচ্ছে করে পালিয়ে যাই। 

তোকে বলেছি না, এখানে ঢোকার উপায় রয়েছে, বেরোনোর পথ নেই। তোকে গেটের বাইরে পা রাখতে দেবে না। এখানের নিয়ম জানিস না? আর পালাতে গেলে মেরে ফেলবে। পাঁচিল টপকে জঙ্গল দিয়ে পালাতে গেলে জঙ্গলে পথ ভুলে মরবি। অথবা বাঘ-ভালুকে খেয়ে নেবে। 

আমি আপনার কী ক্ষতি করেছিলাম? আমার এমন সর্বনাশ কেন করলেন? ছেলেটা কাতরভাবে বলে উঠল। এখানে থাকলে আমি মরে যাব। 

হেসে উঠল বৃদ্ধ। তোর মতো ভীতু, অপদার্থকে আমার ছেলে বলতে লজ্জা হয়। তোর মরে যাওয়াই উচিত। লোকটা চূড়ান্ত নিষ্ঠুরের মতো বলে উঠল কথাগুলো। কথা বলতে বলতেই লোকটার বুক পকেট থেকে মোবাইল বেজে উঠল। লোকটা ফোন তুলল, তারপর শুধু দুটো কথা বলল। প্রথমটা, শুধু কোড নম্বর উচ্চারণ করল লোকটা। কে আর টু জিরো ফাইভ এইট। কোডটা আসলে ফোনের ওইপ্রান্ত থেকে বলা হয়েছিল, ইনি শুধু সঠিক শুনেছেন কি না সেটা কনফার্ম করলেন। তারপর ফোন কেটে দিয়ে নিজে একটি নম্বরে ডায়াল করলেন। 

হ্যালো কে আর টু জিরো ফাইভ আইটেম তৈরি। কাল ডেলিভারি দেবো?…পরশু? আচ্ছা এয়ারপোর্ট রোড…হোটেল…হুঁ… নাম কী বললেন?…হ্যাঁ ঠিক আছে…হুঁ। ফোন কেটে পকেট থেকে বার করলেন ছোটো একটি নোটবই। পৃষ্ঠা উলটে একটি পৃষ্ঠায় থেমে নোটবইটা খোলা অবস্থায় উলটে রাখলেন। তারপর পকেট থেকে বার করলেন একটা সিম। মোবাইল খুলে পুরোনো সিম বার করে নতুনটা গুঁজে মোবাইলে কোনো একটি নম্বর টাইপ করলেন, হ্যালো কে আর টু জিরো ফাইভ এইট মাল তৈরি। পরশু ডেলিভারি দিতে হবে। সকাল সাড়ে সাতটায় এয়ারপোর্ট মেইন এন্ট্রান্সে। বাকি সব ডিটেল কাল জানানো হবে। বলে আবার ফোন কেটে ওই সিমটা বার করে পুরোনো সিম গুঁজল মোবাইলে। তারপর ছেলেটাকে বলল, এখানে কাজ করবি তো রাজা হয়ে যাবি, নইলে গ্রামে পচে মরবি। তোর কী অসুবিধা, নিজে হাতে তো তোকে কিছু করতে হচ্ছে না। আমার কাজটা করবি শুধু। ফ্যাক্টরিতে কাজ পড়লে না হয়… 

সবটাই খারাপ। এসব পাপ। আমাকে ছেড়ে দিন দয়া করে। 

বুড়োটা আচমকা ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারল ছেলেটির গালে। তারপর গালাগাল দিয়ে উঠে পড়ল। আর ফিরল না। ছেলেটা চুপ করে বসে রইল। 

এরপর আর বিশেষ কিছু নেই। ছেলেটা কখনো বসে থাকছে, কখনো উঠে ঠাকুরঘরে পায়চারি করছে। একবার উঠে দেওয়ালে নিজের মাথা ঠুকল। খুব আপসেট আর অস্থির তা স্পষ্ট। একটা সময় সেই বৃদ্ধ আবার এলো। ছেলেটি বেরিয়ে গেল। এবার দুজনে কোনো কথা হলো না। ক্যামেরায় টাইম দেখাচ্ছে রাত ন-টা। বড়ো পূজারি ঠাকুরঘরের দরজা বাইরে দিয়ে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন। তারপর আর কিছু নেই। এরপর টাইম সকাল ছ-টা। বুড়ো পূজারি এসে ঘর খুললেন। মিউজিক বক্সে আবার গান শোনা যাচ্ছে। তিনি নিজে ঠাকুর মার্জনা করলেন। তারপর একজন সেবাইত এসে ঘর মুছল। পূজারি পুজোর আয়োজন করলেন। তারপর গতানুগতিক। আর বিশেষ কিছু নেই। 

পুরোটা দেখার পর অরণ্য আর দিয়া পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

অরণ্য জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলি? 

চশমার চ আর শিয়ালের তালব্য শ। 

একেবারেই ঠিক বলেছিস। তাহলে কী কী ক্লিয়ার হলো? এক নম্বর, ওই ছেলেটিকে জোর করে এখানে আনা হয়েছে বা জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। দুই, এখানে এমন কিছু কাজ হয় যা ছেলেটির কাছে অপরাধ এবং সেটা ওই ছেলেটি করতে চায় না। তিন, ওই বুড়োর সঙ্গে ছেলেটার বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। বাপ-ছেলে বা ওই জাতীয় কিছু। চার, বুড়ো কোনো একটি কাজের মিডলম্যান। সে কোনো একটি প্রোডাক্ট এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছনোর জন্য ফোনাফুনির দায়িত্বে রয়েছে। 

এবং ওয়ান পয়েন্ট টুবি নোটেড যে যাকে ফোন করেন তিনি এই পূজারির কথা ছাড়াও সূর্যদেবের স্তবগানও হালকা করে শুনতে পান। আশা করি তোর কিছু মনে পড়ছে? 

খুব ভালোমতো। শান্তিলালকে যতবার ফোন করা হয়েছিল তার মধ্যে দুবার ও সূর্যের এই স্তবগান শুনেছিল। উত্তর দিলো অরণ্য। 

রাইট। নেক্সট বল, দিয়া ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত। সেটা ওর শ্বাসপ্রশ্বাসেই স্পষ্ট। 

নেক্সট হলো আরেকটা ক্যামেরা কৃত্তিবাস মন্দিরে রেখে এসেছিলাম সেটা দেখা। 

কিন্তু সেই চিপটায় দেখা গেল উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। ওখানেও দুজন পূজারি রয়েছে। একজনের ডিউটি শেষ হলে অন্যজন এসে বসেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণ মিউজিকে ক্রমাগত গুনগুন করে বাজতে থাকে। কিছুই তেমন নেই। তবে এই কৃত্তিবাসের পূজারিজি মন্দিরের দরজার সামনে এমন গ্যাঁট হয়ে বসেছিলেন যে তার নজর এড়িয়ে ক্যামেরাটাকে অরণ্য কিছুতেই ভালোমতো জায়গায় প্লেস করতে পারেনি। দরজার পাশেই একটা থামের খাঁজে দরজার ঠিক মুখোমুখি বসিয়ে দিয়ে এসেছিল। এর ফলে মন্দিরের ভেতরটা পুরো আসেনি। শুধু দরজার সামনেটা আর বারান্দা এসছে। ফলে পূজারি আর মন্দিরে যারা সারাদিনে দর্শন করতে এসেছে তাদেরই দেখা যাচ্ছে। কৃত্তিবাস বা সূর্যদেব এই ছোটো মন্দিরগুলোয় ভক্তরা প্রায় আসেই না বলা যায়। সকলেই মূল শ্রীরামচন্দ্রের মন্দিরে ভিড় জমায়। বিশেষ করে কৃত্তিবাস আর সূর্যদেবের মন্দিরটি এতই দূরে এবং বিচ্ছিন্ন আর বড়ো বড়ো গাছগাছালির আড়ালে তৈরি যে এখানে লোকও আসে কম, আর এলেও এটা নজরে পড়া বেশ কঠিন। অরণ্য এই চিপটা ফরওয়ার্ড করে করে দেখছিল। কিছুই নেই। কিছুই না। 

রাতে মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শুধুই অন্ধকার। ক্যামেরা নাইট ভিশন হওয়ার ফলে ঝাপসা একটা আলো আর কিছু পোকার ওড়াউড়ি। 

নাঃ এখানে কিছু পাওয়া যাবে না বলে রাত তিনটে পর্যন্ত রেকর্ডিং ফরওয়ার্ড করে খাপছাড়া দেখে বন্ধ করে দিচ্ছিল অরণ্য। দিয়া বলল, দেখলে পুরোটাই দেখ। 

কিছু নেই মনে হয়। 

তবু শেষ পর্যন্ত দেখতে ক্ষতি কী? 

দিয়ার কথায় দেখতে থাকল। অরণ্য। এবং ক্যামেরার টাইম অনুযায়ী রাত ঠিক তিনটে নাগাদ হঠাৎই দেখা গেল এতক্ষণের অন্ধকার বেশ খানিকটা উজ্জ্বল। যেন অন্য কোথাও থেকে আলো এসে মন্দিরের চাতালে, দেওয়ালে পড়েছে। জোরালো আলো নয়। তবে চোখে পড়ার মতো। অরণ্য থমকে গেল। কী হলো কেসটা? 

আলোটা মন্দির দালানে মেখে রইল কয়েকমিনিট তারপর নিভে গেল। তার কিছুক্ষণ পরই শোনা গেল দরজা খোলার শব্দ। উঁহুঁ মন্দিরের দরজা যে বন্ধ রয়েছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাহলে দরজা খোলার শব্দ কী করে এলো? অরণ্য ওই শব্দটা শোনার জন্য ব্যাক করে আবার শুনল। হ্যাঁ স্পষ্ট দরজা খোলার শব্দ হলো। এই ক্যামেরাগুলোর অডিয়ো ক্যাপচার করার ক্ষমতাও সাংঘাতিক। দরজা খোলার পর শোনা গেল কয়েকজন মানুষের কণ্ঠস্বর। খুব অস্পষ্ট, কিন্তু কয়েকজন মানুষ যে কথা বলছে সেটা আবছা শোনা যাচ্ছে। 

দিয়া ভুরু কুঁচকে অরণ্যকে জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলি? 

কথা বলছে কয়েকজন, কিন্তু কোথা থেকে? 

মন্দিরের আশেপাশে? 

তাহলে দরজা খোলার শব্দ কী করে হবে? এই মন্দিরের সামনে আর কোনো ঘর নেই। 

হুঁ…দেন? 

আমার মনে হচ্ছে মন্দিরের ভেতর থেকে আসছে কথাগুলো। 

ওরা বারবার ওই অংশটুকু শুনে ব্যাপারটা আন্দাজে বোঝার চেষ্টা করল। প্রথমে হালকা আলো পড়ল মন্দিরের দালানে, তারপর দরজা খোলার শব্দ, কয়েকজন মানুষের চাপা কণ্ঠস্বর, কোন ভাষায় সেটা বোঝা গেল না। তারপর ভারী একটা কিছু সরানোর শব্দ। তারপর আবার চুপচাপ। প্রায় আধঘণ্টা পুরো নৈঃশব্দ্য। তারপর আবার ভারী একটা কিছু সরানোর শব্দ এবং দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। আর তারপর আবার বাইরে আলো জ্বলে ওঠা এবং একইসঙ্গে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। আলোটা যে মন্দিরের পেছন থেকে এসেছে এবং গাড়ির আওয়াজটাও স্পষ্ট বোঝা গেল মন্দিরের পেছন থেকেই মিলিয়ে গেল। বাস বাকিটা আর কিছুই না। সকাল ছ-টায় মন্দিরের এক পূজারি এলো, দরজা খুলল, ইত্যাদি। 

হুম্। বলে একটা গম্ভীর শব্দ মুখ থেকে বার করল অরণ্য। 

হাইলি সাসপিসাশ! তুই তো না দেখেই স্কিপ করে যাচ্ছিলি। যেখানে দেখিবে ছাই কথাটা ভুলিস না ভাই। 

ঠিকই বলেছিস। এখানের সাসপেন্স তো আরও সাংঘাতিক রে! 

হুঁ। দিয়া বিড়বিড় করে বলল, রাত তিনটের সময় একটা গাড়ি মন্দিরের পেছনে এসে দাঁড়াল। তারপর মন্দিরের দরজা খুলল না অথচ দরজা খোলার স্পষ্ট শব্দ হলো, তারপর কয়েকজন মানুষের গলার শব্দ শোনা গেল কিন্তু তাদেরও দেখা গেল না। তারপর ভারী একটা কিছু সরানোর শব্দ হলো তারপর সব চুপ এবং আধঘণ্টা পরে পুরো ঘটনাটা রিভার্সে ঘটল। আবার ভারী কিছু সরানোর শব্দ, দরজা বন্ধর শব্দ। গাড়ির ইঞ্জিন এবং লাইট দুটোই ফেডআউট হওয়া। 

ঠিক। তাহলে আমাদের এখন কী করতে হবে? 

হাতে সময় কম। দুটো কাজ করতে হবে। প্রথমত, সূর্যমন্দিরের ওই অল্পবয়সি ছেলেটিই আমাদের একমাত্র অস্ত্র। ওকে যেভাবে হোক আমাদের হাতে পেতে হবে। দিয়া তোর কাজ হলো কৃত্তিবাস মন্দিরে গিয়ে মন্দিরের পেছনে বা আশেপাশে কোনো দরজা রয়েছে কি না তা খুঁজে বের করা। প্লাস এই দুটো ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে যা। মাধব কন্দলী আর তোর মনে হয় এমন কোনো একটা মন্দিরে ক্যামেরা সেট করে ফেলবি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস এখানে কোনো মন্দিরই নিষ্কলুষ নয়। সবকটার ভেতরে অন্য গল্প রয়েছে। তুই এই বেলাটা পুরো ওয়াচ কর, যতটা পারিস। আজ বাবাজি এসে গেছে মানে গোটা আশ্রম তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, আমাদের এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে হবে। কাল সকালে দীক্ষা। পরশু আমাদের চলে যাওয়া। আর হয়তো এক্সট্রা একদিন থাকতে দিতে পারে, কিন্তু বাবাজি থাকতে থাকতেই এই রহস্যের সমাধান করতে হবে। 

ঠিক বলেছিস। 

দিয়া, কৃত্তিবাস শব্দটা শুনলে তোর মাথায় প্রথমে কী আসে? 

রামায়ণ। 

আর তারপরে? 

ছাল। বাঘের ছাল। 

রাইট। এবার বল তোর মনে রয়েছে সেই ব্যাগটায় একটা কোড লেখা ছিল যার শুরুটা ছিল ইংরেজির কে আর। এই পূজারি যে একজনকে ফোনে অর্ডার সাপ্লাইয়ের কথা বলছিলেন সেখানেও কোডের শুরু কে আর। 

কে আর…কে আর…কে আর ফর কৃত্তিবাস! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ও। 

ইয়েস। বাট এটা না হতেও পারে, কিন্তু সম্ভাবনা প্রবল, তবে আমার বিশ্বাস অনেক রহস্য ওই কৃত্তিবাসের ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে। যেভাবেই হোক বার করতে হবে। 

তোর তো মাথায় হেব্বি বুদ্ধি হয়ে গেছে দেখছি। কী করে হলো বল তো? 

দিয়ার ফাজলামোতে অরণ্য হেসে বলল, এক ঘুসি মারব নাকে। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, চল লেগে পড়ি। 

ও কে ক্যাপ্টেন। বেস্ট অফ লাক। দিয়া অরণ্যর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারপর দুজনেই বেরিয়ে পড়ল। 

২৪                                                                                                                                                                                    

ছেলেটা সূর্যমন্দিরের মধ্যে বসেই অঝোরে কাঁদছিল। ফোঁপাচ্ছিল। আর অরণ্য চুপ হয়ে শুনছিল ছেলেটির কথা। গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল ছেলেটি নিজের দুঃখের কথা। অবশ্য সহজে বার করতে চায়নি। অরণ্য মন্দির থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল কখন ছেলেটি একা হবে। বড়ো পূজারি চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর গুটিগুটি পায়ে ওই ছেলেটির পাশে এসে বসেছিল। কয়েকটি কথার পরেই আচমকা সরাসরি ছেলেটিকে চার্জ করেছিল। গতকাল সারাদিনে বড়ো পূজারির সঙ্গে ওর কী কী কথা হয়েছে তা সব যে অরণ্য জানে সব ডিটেলে বলার পর ছেলেটির মুখেচোখে প্রবল ভয় ফুটে উঠেছিল। কোনোক্রমে বলেছিল, আপনি পুলিশ? 

ভেবে নিতে পারো সেরকমই। আমাদের কাছে ইনফরমেশন রয়েছে এখানে মন্দিরের আড়ালে খুব খারাপ কাজকর্ম হয়। শ্রীরামচন্দ্র আমাদের ভগবান। তিনি চিরকাল সত্যের আশ্রয়ে ছিলেন। আমাদেরও শিখিয়েছেন সত্যের পথে চলতে। পৃথিবীর যেখানে শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির রয়েছে তা আমাদের কাছে তীর্থস্থান, শুধু রামচন্দ্র কেন সব দেবদেবীর মন্দিরই আমাদের কাছে পবিত্রস্থান, কয়েকজন অসৎ মানুষ আমাদের ঈশ্বরকে সামনে রেখে তার আড়ালে ঘৃণ্য কাজ চালিয়ে মন্দিরস্থানকে অপবিত্র করবে তা আমরা কিছুতেই হতে দেবো না। তুমি নিজে একজন পূজারি হয়ে কীভাবে এই অন্যায়কে, এই পাপকে সহ্য করছ? ঈশ্বর তোমাকে কখনই ক্ষমা করবেন না। 

অরণ্য আগেই আন্দাজ করেছিল এই ছেলেটি নরম মনের এবং ভীতুপ্রকৃতির। আন্দাজ সঠিকই ছিল। এসব কথাগুলো বলার পরেই ছেলেটি প্রায় হাউমাউ করেই ভেঙে পড়ল। 

বাইশ বছরের ছেলেটির নাম চুনিলাল। রাজস্থানের ভরতপুরে বাড়ি। বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। বাবা-মা পাথর ভাঙার কাজ করে। চুনিলালরা মোট চার ভাইবোন। চুনিলালই বড়ো। ছোটোবেলায় একবার কঠিন রোগ হয়েছিল ওর তারপর থেকে খুব পরিশ্রমের কাজ করতে পারে না। মনটাও নরমসরম প্রকৃতির। বড়ো পূজারি দুলারাম সম্পর্কে চাচা হয়। একই বাড়িতে থাকে না, তবে একই গ্রাম। এই চাচা গ্রামের একটি মন্দিরে পুজোআচ্ছার কাজ করতেন। স্বভাব কোনোকালেই ভালো নয়। যে মন্দিরের কাজ করতেন একদিন সেই মন্দিরেরই বিগ্রহের গয়না চুরি করে ধরা পড়েন। ফলে গ্রামের চাকরি চলে গেল। এরপর তিনি গ্রামের বাইরে রোজগারের জন্য যেতে শুরু করলেন। সেখানেও বিভিন্নভাবে চুরি-জোচ্চুরি আরও নানা অসামাজিক কাজে যুক্ত হলেন তিনি। দুই-একবার পুলিশের কাছে ধরা পড়ে হাজতবাসও করেছেন। তারপরেও তার চরিত্র শোধরায়নি। বছর তিনেক আগে তিনি হঠাৎই গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তারপর মাসকয়েক আগে আবার ফিরে আসেন। ততদিনে তার চেহারা ঠাটবাট অনেক বদলে গিয়েছে। তার কাছেই চুনিলাল এবং তার বাবা-মা দুলারামের কাছে জানতে পারে যে দুলারাম এখন বিশাল একটি আশ্রমে পূজারি হিসেবে যোগ দিয়েছে। এবং সেখানে থাকা-খাওয়া মাইনের কোনোকিছুরই অভাব নেই। চুনিলালের বাবা তখন দুলারামকে অনুরোধ করেন তার রুগ্‌ণ, অপদার্থ বড়ো ছেলেটিকে যদি ওই আশ্রমে একটি কাজ জুটিয়ে দেয়। দুলারাম বাবাকে জানায় আশ্রমে বড়ো বাবাজি দুলারামকে খুবই স্নেহ করেন এবং কাজে ভরসাও করেন তার ওপর আশ্রমের অনেক দায়িত্বও দিয়েছেন তাই তিনি যদি কারও হয়ে সুপারিশ করেন তাহলে বাবাজি সেই অনুরোধ ফেলতে পারবেন না। এই আশ্বাস দিয়ে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে তিনি ফিরে যান। এবং ঠিক দিন কুড়ির মধ্যেই তিনি চুনিলালের বাবাকে চিঠি লিখে জানান কাজের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। চিঠি পাওয়ামাত্র যেন লিখিত ঠিকানায় চুনিলাল বাক্স গুছিয়ে রওনা দেয়। তবে শর্ত একটাই, এই চাকরিতে ঢুকলে যখনতখন বাড়িতে আসা যাবে না। সেটা যেন আগে একবার ভেবে দেখে। অভাবের ঘরে চুনিলাল ছিল বাড়তি বোঝা। কাজেই চুনিকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই তার বাবা খুশি, আর ছেলেটা দুটো পয়সা রোজগার করে ভালো থাকবে এই প্রস্তাবে মাও খুশি হয়েছিল। যদিও চুনিলাল মনে মনে তার চাচাকে পছন্দ করত না। কিন্তু বাবা- মায়ের সিদ্ধান্তকে অমান্য করার সাধ্য চুনিলালের ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত কয়েকদিনের মধ্যেই নিজের জামাকাপড় বাক্সে গুছিয়ে চড়ে বসতে হলো ট্রেনে। আসামের এই পবিতরার জঙ্গলে রামচরণ সেবাশ্রমে প্রবেশের প্রথম কিছুদিন মন্দ কাটেনি। দুলারাম একবার দেখা করিয়েছিল বড়ো বাবাজির সঙ্গে। ওই একবারই। তারপর থেকে যাবতীয় দায়িত্ব দুলারামেরই। প্রথমে কিছুদিন দুলারাম এই আশ্রমের নিয়মকানুন, পুজোআচ্ছা ইত্যাদি শেখালেন। সে পর্যন্ত ঠিক ছিল, তারপর একদিন রাতে দুলারাম চুনিলালকে নিয়ে বসলেন। বললেন বিশেষ জরুরি কিছু কথা রয়েছে। তারপর যা শোনালেন তা শুনে চুনিলাল ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল। মন্দিরের অন্দরে যে এমন ভয়ংকর কাজ চলছে, মানুষের পক্ষে যে সত্যিই এমন নৃশংস কাজ করা সম্ভব তা সত্যিই বিশ্বাস করতে পারেনি চুনি। ভেবেছিল চাচা বুঝি মজা করছে। কিন্তু একদিন বিকেলে সত্যিই যখন চাচা নিয়ে গেল সেখানে… 

উউউফ বিশ্বাস করবেন না দাদা, নরক নরক। আমি বমি করে ফেলেছিলাম। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম ওই বীভৎসতা দেখে। পালাতে চেয়েছিলাম দাদা। কিন্তু ততক্ষণে আমার পালানোর রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে চাচা প্রতিদিন ওই নরকে যেতে লাগল। যাতে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি ওই ভয়ংকর পরিবেশে। কিন্তু বিশ্বাস করুন দাদা আমি আজীবন এখানে থাকলেও এই নৃশংসতায় কখনই অভ্যস্ত হতে পারব না। আমি কোনোদিন মরেই যাব। আমি আর পারছি না বিশ্বাস করুন… 

কোথায় রয়েছে, কী রয়েছে আমাকে বলো। 

আপনারা মরে যাবেন দাদা। এ হলো সিংহের গুহা। পারলে এখান থেকে পালান। ওই গুহায় একবার ঢুকলে আমি তো মরবই আপনারাও মরবেন। এখানে জানেন না সব সময় সকলের ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। আমার চাচাও যে কী নিষ্ঠুর তা আমার কল্পনার অতীত ছিল। যেমন ধূর্ত তেমনই শয়তান। সেজন্য খুব দ্রুত বাবাজির খুব কাছের চ্যালা হয়ে উঠেছে। আমার জীবনটা শেষ করে দিলো আমার চাচা। 

দেখো চুনিলাল মাথা ঠান্ডা করে আমার একটা কথা শোনো। তুমি যেখানে ফেঁসেছ তাতে এমনিও মরবে অমনিও মরবে। আর আমরা হলাম বাঙালির জাত। কোনোকালেই সাহসের অভাব ঘটেনি। সুতরাং যে কাজে নেমেছি সেই কাজ শেষ করেই ছাড়ব। তুমি যদি আমাদের সাহায্য করো তাহলে আমরা যদি বেঁচে যাই তাহলে তুমিও বাঁচবে। পুলিশ অন্তত তোমাকে জেলে ভরবে না সেই গ্যারান্টি আমার, কিন্তু যদি অ্যাকশন করতে গিয়ে আমরা মরি তাহলে হয়তো আমাদের হেল্প করার অপরাধে তুমিও মরবে। কিন্তু চুনিলাল একটা কথা তুমি ভেবে দেখো, এই অন্যায়ের প্রশ্রয় দিয়ে তুমিও কিন্তু প্রতিমুহূর্তে মরছ, এখান থেকে তোমার পালানোর পথও নেই। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তোমার মুক্তি নেই। তাহলে একটা ভালো কাজের জন্য যদি তোমার মৃত্যু হয় সেটা কিন্তু বীরের মৃত্যু হবে, না হলে হবে শয়তানের মৃত্যু। তুমিও জানো, কী ভয়ংকর কাজ এখানে দিনের পর দিন ধরে ঘটে চলেছে, এরা কেউ মানুষ নয়, মানুষ নামের পিশাচ। তুমি কি চাও না এসব নরপশুগুলোর ফাঁসি হোক। 

অরণ্যর কথাগুলোর মধ্যে এমন কিছু ছিল যে সরল চুনিলাল ভেতরে ভেতরে জেগে উঠছিল। ওর চোখমুখ যে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল। চোখের মধ্যে সামান্য হলেও একটু আগুন জ্বলে উঠছিল। অরণ্য কথা শেষ করে বলল, এবার সিদ্ধান্ত তোমার হাতে। বলো কী করবে? 

ছেলেটা আচমকা সূর্যদেবের দিকে ফিরে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকল, তারপর দুহাত তুলে বেশ জোর গলায় বলে উঠল জয় শ্রীরাম, জয় সূর্যদেব। আপনাকে ভগবানই আমার কাছে পাঠিয়েছে দাদা। আমি লড়ব। আপনাদের সবরকমের সাহায্য করব। তাতে আমার যা হবে। হোক। 

শাবাশ চুনিলাল। তবে এটা প্রথমেই ধরে নিয়ো না যে আমরা কাজটা করতে গিয়ে ধরা পড়বই। তাহলে আমরা অসাবধানি হয়ে পড়ব। কাজটা করতেই পারব না। যাতে ধরা না পড়ে এই চক্রকে ভাঙতে পারি সেজন্য খুব সাবধানে আমাদের এগোতে হবে। এবার আমাকে বলো, কোথায় রয়েছে এই নারকীয় কারখানা। 

বলব দাদা, সব বলব। আজ রাত ঠিক দুটোর সময় আপনি কৃত্তিবাস মন্দিরে আসবেন। সঙ্গে কোনো টর্চ বা মোবাইল আনবেন না। মোবাইল আনলেও সাইলেন্ট করে আনবেন। আমি আজ নিয়ে যাব আপনাকে নরক দেখাতে। তারপর কপালে রামজি যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *