৯.
আসিয়ার রেজাল্ট বেরোবার দিন থেকে এই কয়েকদিন সৈকতের চিন্তায় ছটফট করছে। রেজাল্ট বেরোবার দুদিন আগে সৈকতের সঙ্গে কাফে ঝিলে দু’আড়াই ঘণ্টা গল্প করেছে। অথচ আজ ছয়-সাত দিন হতে চলল তার পাত্তা নেই। কোথাও তাকে আসিয়া খুঁজে পাচ্ছে না। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তবে তাদের বাড়িতে খোঁজ নিতে সাহস করেনি। আসিয়ার ধারণা হলো, সৈকতের নিশ্চয় কোনো কঠিন অসুখ হয়েছে, নচেৎ আমার রেজাল্টের দিন থেকে আসছে না কেন? এই কথা ভেবে আরও বেচায়েন হয়ে পড়ল। একদিন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে ফরিদার দেখা পেয়ে বলল, রেজাল্টের দিন থেকে সৈকতের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। তার কি কোনো অসুখ করেছে?
বেশ কিছুদিন আগে সৈকত আসিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা ও তার। পরিচয় বলে বলেছিল, এসব কথা কাউকে বলবি না। এখন আসিয়ার কথা শুনে ফরিদা খুব অবাক হয়ে বলল, সে কী? সৈকত ভাই গতকালও তো আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। তার মুখেই তো শুনলাম, প্রিন্সিপাল আপনাকে বিদেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। অথচ এতদিন আপনার সাথে দেখা করেনি। খুব আশ্চর্যের কথা? তারপর আসিয়ার করুণ মুখ দেখে বলল, ঠিক আছে, আজই তার সঙ্গে দেখা করে আপনার কথা বলব।
সৈকত সুস্থ আছে তবু আমার রেজাল্টের কথা শুনেও দেখা করল না কেন, এই কথা চিন্তা করে আসিয়া মনে খুব ব্যথা পেল। চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে বলল, আপনি তাকে আমার কথা কিছু বলবেন না। এই অনুরোধটা আপনাকে রাখতেই হবে। তারপর সে আর সেখাকে দাঁড়াল না। হোস্টেলে নিজের রুমে এসে বালিশে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। সেদিন সারারাত সৈকতের না আসার কারণ চিন্তা করতে লাগল। তার কেবলই মনে হতে লাগল, আমি কালো মেয়ে বলে সৈকত সরে গেল। বড়লোকের ছেলেদের সম্বন্ধে অনেক আজেবাজে কথা শুনেছে। তা হলে, সৈকতও কি তাদেরই একজন? রাত আড়াইটার সময় তাহাজ্জুদের নামায পড়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মোনাজাত করল, “হে রাব্বল আলামিন, এই পাপী বান্দির সারাজীবনের গুনাহ খাতা মাফ কর। তুমি মাফ না করলে, কে করবে? তুমি তোমার সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানব জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ করে পয়দা করেছ। আমিও সেই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির একজন নাদান বান্দি। তুমি আমার মনে যে আশার বীজ বপন করিয়েছিলে, তা থেকে আমাকে বঞ্চিত কর না। আর সেই আশা যদি পূরণ হওয়া আমার তকদীরে লেখা না থাকে, তা হলে আমাকে সবর করার তওফিক দাও। তোমার ইশারাতেই আমার মনে আশার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। আবার তোমার ইশারাতেই যদি সেই অঙ্কুর বিনাশ হয়, তা হলে তুমি সবর করার তওফিক না দিলে আমি বাঁচব কেমন করে? তোমার হাতে কুলমখলুকাতের। জীবন মরণ। তোমার ইচ্ছার উপর আমি নিজেকে সঁপে দিলাম। তবু তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির একজন হয়ে তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি, তুমি আমার মনের নেক বাসনাগুলো পূরণ কর। তোমার হাবিবে পাকের উপর শত কোটি দরুদ ও সালাম জানিয়ে বলছি, তুমি আমার দোয়া কবুল কর। আমিন, সুম্মা আমিন।”
আসিয়া মোনাজাত শেষ করে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে লাগল। তারপর ফজরের আজান হবার পর নামায পড়ে সৈকতের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।
আসিয়ার রুমমেট কুলসুমও পাস করেছে। সে রেজাল্ট বেরোবার পরের দিন বাড়ি চলে গেছে। বেলা ন’টার সময় হোস্টেলের একজন পরিচারিকা নাস্তা খাওয়ার জন্য আসিয়াকে ডেকে জাগিয়ে দিয়ে গেল।
আসিয়া গোসল করে রুমে এসেছে, এমন সময় দারোয়ান তাকে একটা স্লিপ দিয়ে গেল।
আসিয়া স্লিপটা পড়তে লাগল–
“প্রাণের আসিয়া, ভালো জামা কাপড় পরে অতি সত্ত্বর চলে আসবে। আমি গেটে অপেক্ষা করছি।
স্লিপটা পড়ে আনন্দে আসিয়ার হৃদয় ছলকে উঠল। সেই সাথে চোখ পানি এসে গেল। বিড়বিড় করে বলল, আল্লাহপাক, তোমার কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। তোমার প্রশংসা করে শেষ করতে পারব না। তবু তোমার পাক দরবারে জানাই শতকোটি শুকরিয়া।
তখন তার সৈকতের উপর খুব অভিমান হল। তাকে দেরি করে শাস্তি দেবার জন্য প্রথমে নাস্তা খেয়ে এল। তারপর ধীরে সুস্থে স্যুটকেস থেকে গত ঈদের জামা কাপড় বের করে পরে গেটের কাছে আসতে একঘণ্টা সময় লাগাল।
সৈকত স্লিপ পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তার মনে হল, কারো জন্য অপেক্ষা করার মতো কঠিন কাজ বুঝি পৃথিবীতে আর নেই। সে এতক্ষণ পায়চারি করছিল আর চিন্তা করছিল, এতদিন তার সাথে দেখা করিনি বলে আসিয়া হয় খুব রেগে আছে অথবা ভীষণ অভিমান করেছে। তাই দেরি করে শাস্তি দিচ্ছে। একঘণ্টা পার হয়ে যেতেও যখন আসিয়া এল না তখন আবার একটা স্লিপ লিখে দারোয়ানকে দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় আসিয়াকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আসিয়া কাছে এসে থমথমে মুখে সালাম দিল।
সৈকত তার চোখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারল, দেরি করার কৈফিয়ত চাইলে চোখ দিয়ে পানি পড়বে। এই কয়েকদিন যে ভালো করে ঘুমায়নি তাও বুঝতে পারল। তাই সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমার অপরাধ গুরুতর, তবু কি ক্ষমা পেতে পারি না?
আসিয়া কোনো কথা বলতে পারল না। সৈকতের মুখের দিকে চেয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
সৈকত এগিয়ে এসে তার হাত ধরে গাড়িতে বসাল। তারপর নিজেও উঠে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, একটা ব্যাপারে এই কয়দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই তোমার রেজাল্টের এতবড় খবর জেনেও আসতে পারিনি। সে জন্যে আবার ক্ষমা চাইছি। আর ক্ষমা যদি করতে না পার, তা হলে তোমার মনে যা চায়, তাই শাস্তি দিও। তবু চুপ করে থেক না। তোমার গলার স্বর শোনার জন্য খুব অস্থির হয়ে আছি।
আসিয়া ভিজে গলায় বলল, বারবার ক্ষমা চেয়ে আমাকে বেশি অপরাধী কর না। তারপর আর কথা বলতে পারল না। কান্নায় তার গলা বুঝে এল।
সৈকত আর কোনো কথা না বলে একদম কাজী অফিসের সামনে গাড়ি পার্ক করল। তারপর আসিয়াকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে সালাম দিল।
কাজী সাহেব ও জহির সালামের উত্তর দিল।
আসিয়া দেখল, সেখানে জহির ফরিদা ও তার মুখচেনা একটা ছেলে রয়েছে। খুব অবাক হয়ে সবাইয়ের দিকে একবার চেয়ে সৈকতের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এমনকি সে সালাম জানাতেও ভুলে গেল।
ফরিদা সৈকতকে উদ্দেশ করে বলল, ভাইয়া তোমরা এত দেরি করলে কেন?
সৈকত কিছু বলার আগে জহির বলল, সে কৈফিয়ত পরে হবে। আগে বিয়ের কাজ মিটে যাক। তারপর সৈকতের দিকে কাবিননামা এগিয়ে দিয়ে বলল, পড়ে দেখ, তোদের আসতে দেরি দেখে আমি কাজী সাহেবকে দিয়ে তোর কথামত সব লিখিয়ে রেখেছি। এখন তোরা শুধু সই করলে বিয়ে পড়ানোর কাজটা সেরে ফেলব।
গতকাল সৈকত একটা কাগজে নিজের ও আসিয়ার নাম-ধাম ও দেনমোহরের টাকা লিখে জহিরের হাতে দিয়ে বলেছিল, তোর জানাশোনা একটা ছেলেকে নিয়ে আজ নটার দিকে এখানে আসবি।
সৈকত কাবিননামার উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ঠিক আছে। তারপর সেটা আসিয়ার হাতে দিয়ে বলল, তুমি পড়ে সই কর, পরে আমি করব।
আসিয়ার মনে হলো, সে স্বপ্ন দেখছে। একইভাবে সৈকতের দিকে তাকিয়ে রইল।
সৈকত তার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, এমনি আমরা আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছি; তারপর আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। এরা সেই ন’টা থেকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। এরপরও যখন আসিয়ার পরিবর্তন হল না তখন সৈকত তার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ স্বরে বলল, এই চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? একটা সারপ্রাইজ দেব বলে এবং এই ব্যাপার নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। সেইজন্য তোমার সঙ্গে দেখা করিনি।
সৈকতের কথা শুনে আসিয়ার খুব লজ্জা পেল। তবু কাবিননামা পড়ে সই করল।
তারপর সৈকতও সই করে কাবিননামা কাজী সাহেবকে দিল।
কাজী সাহেব শমতো বিয়ে পড়িয়ে দিলেন।
কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে সৈকত সবাইকে নিয়ে একটা হোটেলে গিয়ে বিরানী খাইয়ে ওদেরকে বিদায় দেবার সময় ফরিদাকে বলল, কী রে, তুই আমাদের সঙ্গে যাবি নাকি?
ফরিদা জিজ্ঞেস করল, তোমরা এখন কোথায় যাবে আগে বল।
: বোকার মতো কথা বলছিস কেন? বিয়ের পর মা-বাবার দোয়া নিতে হবে না?
: তা হলে নিশ্চয় যাব।
জহির ও যে ছেলেটা তার সাথে এসেছিল, তারা চলে যাবার পর সৈকত আসিয়া ও ফরিদাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। বাড়িতে যখন তারা পৌঁছাল তখন বেলা প্রায় দু’টো।
হেমা ও ফায়জুর রহমান খাওয়া-দাওয়ার পর সৈকতকে বিদেশে পড়াতে পাঠাবার কথা আলোচনা করছিলেন।
এক সময় ফায়জুর রহমান বললেন, তা হলে সৈকতের ঘাড় থকে সেই কালো মেয়েটা নেমে গেছে?
হেমা বললেন, আমার তো তাই মনে হয়। তা না হলে কী যে হতো বলা যায় না। তবে মেয়েটা কালো হলে কী হবে, খুব ব্রিলিয়্যান্ট ছাত্রী। ফরিদার মুখে শুনলাম, স্কলারশিপ নিয়ে পাস করেছে। কলেজের প্রিন্সিপাল নিজে তাকে বিদেশে পড়তে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন।
ফায়জুর রহমান বললেন, তাই নাকি? তা হলে তো মেয়েটার ভাগ্য খুব ভালো?
ঠিক সেই সময় সৈকত মা বলে ডেকে আসিয়া ও ফরিদাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
হেমা ও ফায়জুর রহমান ছেলের সঙ্গে ওদের দুজনকে দেখ বেশ অবাক হলেন।
হেমা সামলে নিয়ে বললেন, তোরা ডাইনিং রুমে যা, আমি আয়াকে দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করছি।
সৈকত বলল, আমরা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। তারপর আসিয়াকে ইশারা করে প্রথমে বাবাকে ও পরে মাকে কদমবুছি করে বলল, আসিয়াকে আজ বিয়ে করে নিয়ে এলাম। তোমরা আমাদেরকে দোয়া কর।
ঘরের ভিতর বজ্রপাত হলেও বোধ হয় এতটা ওঁরা অবাক হতেন না। ছেলের কথা শুনে দু’জনেই চমকে উঠে বোবা দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।
আসিয়া পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে এলে ফায়জুর রহমান পা সরিয়ে নিয়ে রাগে লাল হয়ে বললেন, খবরদার, আমাদেরকে সালাম করবে না। তোমার মা ও নানির জন্য আমি সবকিছু হারিয়েছি। তারা আমার জন্মদাতা বাবাকেও কেড়ে নিয়েছে। তুমি আবার আমাদের ছেলেকে কেড়ে নিতে এসেছ? তোমাদের এ বিয়ে আমি স্বীকার করি না। বেরিয়ে যাও এখান থেকে। নচেৎ তোমাকে। আমি এক্ষুনি খুন করে ফেলব। যাও বেরিয়ে যাও। আর কখনো এদিকে আসবার চেষ্টা করলে পুলিশের হাতে তুলে দেব।
আসিয়া লজ্জায় ও অপমানে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগল। তার তখন মনে হলো, এর থেকে মৃত্যু অনেক ভালো ছিল।
বাবার কথা শুনে সৈকত খুব রেগে গেলেও ধৈর্য হারাল না। দৃঢ়কণ্ঠে বলল, বাবা তুমি এসব কী বলছ? ও তোমার ভাগ্নি না? তাছাড়া ওকেই বা বকছ কেন? ও তো স্বেচ্ছায় এখানে আসেনি। আমিই ওকে নিয়ে এসেছি। ও এখন তোমাদের পুত্রবধূ। ওর মা-নানি কী করেছেন না করেছেন, সেটা এতদিন তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করনি কেন? আমি আসিয়ার পরিচয় পাবার আগে তাকে ভালোবেসেছি। আসিয়াও আমার পরিচয় পাবার আগে আমাকে ভালোবেসেছে। সে তো প্রথমে আমাকে পাত্তাই দেয়নি। শেষে যখন আমি নাছোড়বান্দার মতো ওর পিছনে লাগলাম তখন সেও আমাকে ভালো না বেসে পারেনি। অনেক আগে মায়ের কাছে তোমার দেশের বাড়ির কিছু কথা শুনেছিলাম। সেসব একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। আসিয়ার সঙ্গে ভালোবাসা হবার পর তার পরিচয় জেনে। কেমন যেন একটু সন্দেহ হয়। তখন মায়ের কাছ থেকে আবার তোমার দেশের বাড়ির সব খবরাখবর জেনে সন্দেহটা আরও বেড়ে যায়। তারপর একদিন দীঘিরপাড়ায় গিয়ে দাদা, দাদি ও ফুপুর সঙ্গে দেখা করি। তারা আমার পরিচয় পেয়ে হাতে যেন কোটি কোটি টাকার গুপ্তধন পেলেন। তোমার জন্য তাদের কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেলি। দাদা আমাকে তার ও তোমার পুরো ইতিহাস বলেছেন। শুনে তখন তোমার প্রতি আমার খুব দুঃখ হল। ভাবলাম, বাবা এতবড় শিক্ষিত লোক হয়ে কী করে দাদার প্রতি এতবড় অবিচার করল। আমি কখনও গ্রামে যাইনি। সেইজন্য গ্রামের মানুষকেও চিনতাম না। সেবারে গিয়ে জানলাম, গ্রামের মানুষ কত সৎ কত ভালো। মায়ের কথায় আসিয়াকে একদিন এখানে এনেছিলাম। তাকে দেখে মা আমাকে তোমার কথা বলে রাগারাগি করে এবং তার কাছ থেকে সরে আসতে বলে। কিন্তু ততদিনে আমি তার সংস্পর্শে এসে আমাদের ধর্মকে জানতে পারি। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ)-কে চিনতে পারি। তোমরা তো আমাকে তাদেরকে চিনবার মতো শিক্ষা দাওনি। অথচ তুমি একজন আলেমের ছেলে। তুমি দাদার রাগকে বড় করে দেখলে? আলেম লোকের ছেলে হয়ে বাবার দোষ ধরলে। তারপর এতবছর পর্যন্ত তিনি বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন, তাও খোঁজ নাওনি। এটা কি কোনো উচ্চশিক্ষিত ছেলের কাজ?
ফায়জুর রহমান ছেলের স্পর্ধা দেখে যেমন অবাক হলেন, তেমনি আরও বেশি রেগে গিয়ে গর্জন করে বললেন, সৈকত, তুই একটা কালো মেয়েকে ভালোবেসে এত নিচে নেমে যাবি ভাবতেও পারছি না। তোর এতবড় সাহস, তুই তোর বাবার ভালোমন্দ বিচার করছিস? তোর মতো নীচ মনের ছেলের আমি বাবা, সে কথা ভাবতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। তুইও বেরিয়ে যা এখান থেকে। তোর মুখ আমি আর দেখতে চাই না। জানব, আমাদের ছেলে অ্যাকসিডেন্ট করে মারা গেছে। এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে। কোনোদিন আর এ বাড়িতে আসবি না। যদি আসিস, তাহলে তোকেও আমি গুলি করে মেরে ফেলব।
সৈকত ধরা গলায় বলল, আসিয়াকে এখানে স্থান না দিলে, তুমি না বললেও আমি চলে যেতাম। দাদা, দাদি ও ফুপুর উপর কেন তোমার এত রাগ এবং কেন তুমি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ, সবকিছু দাদা আমাকে বলেছেন। ফুপু কালো বলে তাকে তুমি বিয়ে করতে চাওনি। ছোট দাদা মারা যাবার সময় বড় দাদিও মারা যান। তারপর দাদা ছোট দাদিকে শরীয়ত মোতাবেক নিকে করেছিলেন। তুমি শরীয়তের কোনো কিছু জানতে না। তাই এই বিয়ে মেনে নিতে না পেরে দাদা ও ছোট দাদির উপর তোমার খুব রাগ। তোমার বোঝা উচিত ছিল, দাদা এই নিকে করে কোনো অন্যায় করেননি। ফুপু কালো বলে তার বিয়ে দেয়া খুব সমস্যা ছিল। যদিও একজন রাজি হয়েছিল, সে ছোট দাদার অংশ মতো সব সম্পত্তি দাবি করেছিল। দাদা রাজি হননি। তিনি ভেবেছিলেন, অর্ধেক সম্মত্তি বেরিয়ে গেলে, সংসারের অবস্থা সচ্ছল থাকবে না। তাই তোমার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে দাদা ফুপুর সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর ছোট দাদিও ভাসুরকে নিকে করতে একদম রাজি ছিলেন না। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। রাবু ফুপুর কথা চিন্তা করে তা করেননি। শেষে তার বাবা নিজের দুরবস্থার কথা বলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এই কাজ করিয়েছিলেন। আর তুমি কিনা সবাইকে ভুল বুঝে তাদেরকে দুশমন ভেবে আজ পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ খবর রাখনি। তোমার জন্য সাজেদা দাদির কান্না দেখে মনে হলো, নিজের পেটের ছেলে মারা গেলেও কোনো মেয়ে অমন করে কাঁদেনি। তুমি বোধ হয় কখনো চিন্তা করে দেখনি, তোমাকে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে? আমিও তোমার মতো শুধু স্কুল, কলেজের এডুকেশন নিয়ে গ্রামের মানুষকে অসভ্য ইতর ভাবতাম। গরিবদেরকে মানুষ বলে গণ্য করতাম না। আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে আসিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়ে তারই অনুরোধে ইসলামিক বই পুস্তক পড়ে আমার সেই অজ্ঞানতা দূর হয়েছে। তোমাদেরকেও বলছি, তোমরাও ইসলামিক বই পুস্তক পড়ে ইসলামকে জান, আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) এর পরিচয় এবং নিজেদের পরিচয় জানার চেষ্টা কর। জেনে রাখ বাবা, সবাইকে একদিন না একদিন মরতেই হবে। তোমরাও তা থেকে রক্ষা পাবে না। তখন তোমাদের এই বাড়ি, গাড়ি ও টাকা পয়সা কী হবে চিন্তা করেছ?
ফায়জুর রহমান আর রাগ সহ্য করতে পারলেন না। উঠে আলমারি থেকে পিস্তল বের করে এনে সৈকতের দিকে তাক করে বললেন, এই মুহূর্তে ঐ কালো মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যা। আর যদি একটা কথা বলিস, তা হলে তোদের দু’জনকেই কুকুরের মতো গুলি করে মেরে ফেলব।
আসিয়া দ্রুত সৈকতের সামনে এসে তাকে আড়াল করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, মামা, এই কালো মেয়েটাকে মেরে ফেলুন। আমার জন্য আপনার একমাত্র সন্তানকে হারাবেন কেন? আমি আপনার দুশমনদের একমাত্র বংশধর। আমাকে মেরে ফেললে আর কেউ কোনোদিন আপনাকে বিরক্ত করতে আসবে না। এরপর আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমাকে মেরে ফেলুন মামা, মেরে ফেলুন। আমি আর বাঁচতে চাই না। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
ফরিদা এতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আসিয়ার কথা শুনে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে তাকে আড়াল করে বলল, ফুপা আপনি একি করছেন? এদেরকে মারার আগে আমাকে মেরে ফেলুন। এদের কিছু হলে আমি আপনাকে ক্ষমা করব না। তারপর ফুপুকে বলল, ফুপু তুমি ফুপার হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নাও।
ফরিদা আড়াল না করলে ফায়জুর রহমান হয়তো এতক্ষণ গুলি করে ফেলতেন। রাগ তখনও পড়েনি। বললেন, ফরিদা, তুমি সরে যাও। আমি ওদেরকে গুলি করে …… কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না। দরজা দিয়ে আব্বা, চাচি ও রাবুকে ঢুকতে দেখ ভূত দেখার মতো চমকে উঠে হাঁ করে তাদের দিকে চেয়ে রইলেন।
হাফিজুর রহমানের গতকাল সবাইকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা হোটেলে উঠেছিলেন। আজ সকালে নাস্তা খাওয়ার পর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে একটা বেবিতে করে আসিয়ার হোস্টেলের গেটে এলেন। তিনি মেয়েদের হোস্টেলের নিয়ম কানুন আগে কয়েকবার এসে জেনেছেন। তাই একটা স্লিপ লিখে দারোয়ানের হাতে যখন দিলেন তখন বেলা এগারোটা।
দারোয়ান এখানে অনেকদিন দারোয়ানি করছে। হোস্টেলের অনেক মেয়েদেরকে যেমন চিনে, তেমনি মেয়েদের সঙ্গে যারা দেখা করতে আসে, তাদের অনেককেও চিনে। হাফিজুর রহমানকেও চিনে। তাই স্লিপটা হাতে নিয়ে বলল, আসিয়া আপা প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে একটা ছেলের সঙ্গে বাইরে গেছে।
: আপনি ছেলেটাকে চেনেন?
: জ্বি চিনি। সৈকত ভাইয়ের সঙ্গে গেছে।
হাফিজুর রহমান ঠিক আছে, বলে ওদের কাছে বললেন, আসিয়া হোস্টেলে নেই। ঘণ্টাখানেক আগে সৈকতের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। আমরা তার বাড়িতে যাই চল।
রাবু বলল, তাই চল আব্বা।
বেবির জন্য অপেক্ষা করতে করতে হাফিজুর রহমান পকেট হাতড়াতে লাগলেন। তাই দেখে রাবু জিজ্ঞেস করল, কী খুঁজছ?
হাফিজুর রহমান বললেন, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সৈকতের ঠিকানাটা পকেটে রেখেছিলাম। মনে হয় কোথাও পড়ে গেছে।
রাবু বলল, ঠিকানাটা আমি একবার পড়েছিলাম। বাড়ির নাম্বার মনে নেই। তবে জায়গাটার নাম মনে আছে, ধানমণ্ডি দশ নাম্বার লাইন।
হাফিজুর রহমান বললেন, ওতেই হবে। ওখানে গিয়ে বাড়ি খুঁজে বের করব। তারপর একটা বেবিতে করে তাদেরকে নিয়ে উঠলেন।
ধানমণ্ডির দশ নাম্বার লাইনের মোড়ে বেবি বিদায় করে প্রত্যেক বাড়ির গেটে দারোয়ানের কাছে সৈকতের কথা জিজ্ঞেস করতে করতে এক সময় তাদের বাড়ির খোঁজ পেলেন। দারোয়ানকে বললেন, আমরা সাহেবের আত্মীয়, দেশ থেকে এসেছি।
দারোয়ান কিছুক্ষণ আগে ছোট সাহেব ও ফরিদা আপার সঙ্গে একজন বোরখা পরা মেয়েকে যেতে দেখছে। ভাবল, ইনি মুরুব্বি মানুষ, সঙ্গে দু’জন বোরখাপরা মহিলা। ইনারা হয়তো আগের বোরখা পরা মহিলার কোনো আত্মীয়। তাই অচেনা কাউকে ভিতরে যেতে দেওয়া বড় সাহেবের নিষেধ সত্ত্বেও তাদের যেতে দিল।
হাফিজুর রহমান স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় এসে ফায়জুর রহমানের গলার উচ্চ আওয়াজ শুনে সেই দিকে এগোলেন। রুমের দরজার কাছে এসে পর্দার আড়াল থেকে ছেলের ও নাতির তর্কাতর্কি শুনতে লাগলেন।
ফায়জুর রহমান যখন ফরিদাকে সরে যেতে বলে গুলি করার কথা বলতে যাচ্ছিলেন তখন হাফিজুর রহমান ওদেরকে নিয়ে পর্দা ঠেলে রুমের ভিতরে ঢুকলেন।
তাদেরকে দেখে সবাই চমকে অবাক হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল। হাফিজুর রহমান আগেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলেন। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। নির্বাক হয়ে আব্বার দিকে তাকিয়ে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। রুমের মধ্যে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করতে লাগল।
এক সময় ফায়জুর রহমানের হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল।
হাফিজুর রহমান এগিয়ে এসে পিস্তল উঠিয়ে ছেলের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, নে, এবার আমাদের প্রত্যেককে গুলি করে শেষ করে দে। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। শুধু সৈকতকে মারবি না। ও আমার বংশের একমাত্র চেরাগ। দেরি করছিস কেন? চালা, চালা গুলি। জানিস না, শত্রু হাতের মুঠোয় এলে দেরি করতে নেই?
এত বছর পর আব্বাকে দেখে এবং তার কথা শুনে ফায়জুরের ভাবান্তর হলো। কোনো কথা বলতে পারলেন না। এক সময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তারপর বসে পড়ে আব্বার পা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।