৪.
এদিকে ফায়জুর হেমাকে পড়াতে পড়াতে দুজনের মধ্যে প্রথমে প্রেম ও পরে বিয়ে করে শ্বশুরের পয়সায় বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসে। তারপর শ্বশুরেরই সাহায্যে ব্যবসা করে বাড়ি-গাড়ি করেছে। বিয়ের আগে হেমা ভাইয়ার কাছে তাদের বাড়ির সব হিস্ট্রি শুনেছে। তখন কিছু বলেনি। কিন্তু বিয়ের পর স্বামীকে অনেকবার বুঝিয়ে বলেছে, তোমার দেশের বাড়ির খোঁজ খবর নেয়া উচিত। বাবার সঙ্গে রাগ করে যা কিছু করেছ সব ভুলে গিয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াও। দেখবে, তিনি তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন। হাজার হোক বাবা। তো। ওঁর বয়স হয়েছে, এতদিনে সে সব কি আর মনে রেখেছেন। তাছাড়া তুমি তার একমাত্র সন্তান, সে কথাটা মনে রাখা উচিত। রাবুরও খোঁজ খবর নেয়া উচিত। স্ত্রীর কথা শুনে ফায়জুর গম্ভীর হয়ে বলছে, দেখ হেমা, আমার অতীতের ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপারে আর কোনো দিন কিছু বলবে না। অতীতে যা হয়ে গেছ তা খুব দুঃখজনক, সেসব কথা মনে করিয়ে দিলে খুব দুঃখ পাব। আমি অতীতকে ভুলে বর্তমানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। বাবার বিষয় সম্পত্তির উপর আমার লোভ নেই। আমাকে কোনোদিন দেশে যাবার কথা বলবে না।
হেমা তারপর থেকে স্বামীকে আর কোনোদিন কিছু বলেনি। তাদের একমাত্র সন্তান মনসুর। ডাকনাম সৈকত। সে এখন মেডিকেলে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ফায়জুর ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সৈকত রাজি হয়নি।
সৈকত যখন হাই স্কুলে পড়ত তখন তার এক গরিব বন্ধু লোকমানের বাবাকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখেছিল। সেই সময় প্রতিজ্ঞা করেছিল, ডাক্তার হয়ে গরিবদের চিকিৎসা করবে। তাই বাবা যখন তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কথা বলে তখন সে দৃঢ়কণ্ঠে মেডিকেলে পড়বার কথা জানায়। ফায়জুর একমাত্র ছেলের জিদের কাছে হার মানে।
সৈকতের অনেক বন্ধু-বান্ধবী। তাদের মধ্যে জহির ও ফরিদার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। জহিরও বড়লোকের ছেলে। সে সৈকতের ক্লাসমেট। আর ফরিদা সৈকতের একমাত্র মামার একমাত্র মেয়ে। দেখতে শুনতে যেমন সুন্দরী, পড়াশুনাতেও তেমনি ভালো। সে মেডিকেলের থার্ড ইয়ারের ছাত্রী।
একদিন ক্লাসের অফ পিরিয়ডে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৈকত, জহির ও ফরিদা গল্প করছিল। হাতে-পায়ে মোজা ও বোরখা পরা একটা মেয়েকে বই খাতা হাতে নিয়ে তাদের পাশ দিয়ে যেতে দেখে সৈকত ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, অনেক বোরখা পরা মেয়ে দেখেছি, কিন্তু সেই সঙ্গে হাতে পায়ে মোজা পরা মেয়ে কখনো দেখিনি। মনে হয় মেয়েটা কোনো মৌলবী সাহেব বা পীর সাহেবের মেয়ে হবে। আরে বাবা এতই যদি পর্দা, তবে মেডিকেলে পড়তে এসেছে কেন? এখনও মৌলবীদের গোঁড়ামি গেল না।
মেয়েটি কথাগুলো শুনতে পেয়ে একপলক তাদের দিকে চেয়ে চলে গেল।
ফরিদা মেয়েটিকে প্রথমে দেখেনি। সৈকতের কথায় তার দিকে চেয়ে বলল, তোমার কথা হয়তো ঠিক। মেয়েটিকে আমি চিনি। আমাদের সঙ্গে পড়ে। ক্লাসের মধ্যে সেরা ছাত্রী। ওর স্মরণশক্তি ভীষণ। স্যারেরা ওকে খুব ভালোবাসেন। আমার রেকর্ড ঐ মেয়েটা কেড়ে নিয়েছে। ফাস্ট ইয়ার থেকে আমাকে ফার্স্ট হতে দিচ্ছে না।
সৈকত বলল, তাই নাকি? আমার মনে হয় ও ঢাকার মেয়ে নয়।
ফরিদা বলল, তোমার অনুমান ঠিক। আমি ও আমার এক ক্লাসমেট জেসমিন ওর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিলাম। খুব সেলফিস আর অহংকারী মেয়ে। আমরা ওর পরিচয় জানতে চাইলে শুধু বলল ঝিনাইদহের কোনো এক গ্রামে বাড়ি। তারপর আমাদের কাছ থেকে চলে গেল। তবে মেয়েটার চোখ দু’টো দারুণ, আর গলার স্বরও খুব মিষ্টি। পরে ওর রুমমেটের কাছে জানতে পারি ওর নাম আসিয়া। আরও জানতে পারি ওর গায়ের রং নাকি ভীষণ কালো। তাই সব সময় ঐ রকম পোশাক পরে থাকে।
সৈকত বড়লোকের খামখেয়াললি ছেলে। ফরিদার কথা শুনে কৌতূহল অনুভব করে ভাবল, মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করতে হবে।
একদিন সৈকত নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে একটা বই কেনার জন্য নিউমার্কেটের তিন নাম্বার গেটে গাড়ি পার্ক করে গেটের কাছে এসেছে, এমন সময় বোরখা পরা একটা মেয়ের হাত-পায়ে মোজা পরা দেখে ভাবল নিশ্চয় আসিয়া। সৈকত দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়েটা মার্কেটে ঢুকে পড়ার পর সেও দূরত্ব রেখে পিছন থেকে তাকে ফলো করল।
আসিয়াও একটা বই কেনার জন্য এসেছে। সে সব সময় “মল্লিক ব্রাদার্স” থেকে বই কিনে। মল্লিক ব্রাদার্স লাইব্রেরি মার্কেটের পশ্চিম দিকে শেষ প্রান্তের মাঝখানে। আসিয়া কোনোদিন মার্কেটের বারান্দা দিয়ে লাইব্রেরিতে আসে না। সব সময় গেট দিয়ে ঢুকে মার্কেটের আঙ্গিনা দিয়ে সোজা হেঁটে এসে লাইব্রেরিতে ওঠে। আজও তাই করল। লাইব্রেরিতে এসে দরকারি বইটা কেনার আগে খুলে দেখতে লাগল।
সৈকত বারান্দা দিয়ে আসিয়াকে ফলো করে সেখানে এসে তার বইটা চাইল। একজন সেলসম্যান বইটা এনে দিলে খুলে দেখার সময় বারবার আড়চোখে আসিয়াকে দেখতে লাগল। এমন সময় আসিয়া দরদাম না করে সেলসম্যানকে বলল, বইটা মেমো করে দিন।
সেলসম্যান মেমো করে বইটা একটা পলিথিন ব্যাগে ভরে আসিয়ার হাতে দিল।
আসিয়া মেমো দেখে টাকাটা দিয়ে বই নিয়ে চলে গেল।
সৈকত আসিয়ার গলার স্বর শুনে খুব অবাক হলো। সত্যি মেয়েটার গলার স্বর খুব মিষ্টি। সেও তার বইটা কিনে নিয়ে তাড়াতাড়ি গেটের দিকে এগোল। গেটে এসে দেখল, আসিয়া ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চুলের ফিতে কিনছে। গেটের বাইরে এসে সৈকত তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে আসিয়াকে আসতে দেখে কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, কিছু মনে নেবেন না? আপনি কি মেডিকেলের ছাত্রী?
আসিয়া থমকে দাঁড়িয়ে রাগের সাথে বলল, তা জেনে আপনার লাভ?
: লাভ না থাকলেও ক্ষতি তো নেই?
: মানে?
: মানে আবার কি? জানার ইচ্ছা হলো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
: এই রকম ইচ্ছা আর কয়টা মেয়ের কাছে প্রকাশ করেছেন?
: দেখুন, আপনি যা ভাবছেন তা ঠিক নয়। কোথায় যাবেন চলুন, আমার। গাড়ি আছে, আপনাকে পৌঁছে দিই। দেখছেন না, লোকজন আমাদের দিকে। কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে?
আসিয়া সৈকতের সাহস দেখে খুব রেগে গেলেও সংযত স্বরে বলল, আমি রিকশায় যাব। আপনি আপনার গাড়িতে যান।
: আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেন নি?
: আপনি নিশ্চয় মেডিকেলের ছাত্র?
: হ্যাঁ।
: কী করে বললাম বলুন তো?
: নিশ্চয় আমাকে লাইব্রেরি থেকে মেডিকেলের বই কিনতে দেখছেন। আর তার না হলে আমার হাতের বইটা দেখে বলছেন।
: আপনি একটা বোকা গাধা অথবা বখাটে ছাত্র। সৈকত ভাবতেই পারেনি, মেয়েটা তাকে এতবড় অপমান করবে। তার। স্পর্ধা দেখে রাগে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না। রাগের সঙ্গে কিছু। বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আসিয়া ততক্ষণে হাঁটতে শুরু করেছে। সৈকত দ্রুত তার। সামনে এসে পথ আগলে বলল, আমাকে অপমান করলেন কেন?
আসিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, জানা সত্ত্বেও কেউ যদি আপনাকে এরকম প্রশ্ন করত, তাহলে আপনি তাকে কী বলতেন? তারপর পাশ কাটিয়ে একটা রিকশায় উঠে চলে গেল।
আসিয়া বোরখা পরলেও মুখের উপর নেকাব ঝুলিয়ে রাখে না। চোখ দুটো বাদ দিয়ে, নেকাবটা নাকের উপর দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখে। সৈকত তার চোখ ও মিষ্টি গরার স্বর শুনে খুব মুগ্ধ হয়েছে। আসিয়া চলে যাবার পর তার রিকশার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। তখন তার ফরিদার কথা মনে পড়ল। “মেয়েটা খুব মেধাবী ও তুখোড়। আর তার চোখ দুটো খুব সুন্দর এবং কণ্ঠস্বরও খুব মিষ্টি।” ফরিদার কথার প্রমাণ পেয়ে সৈকতের জিদ চেপে গেল। ভেবে রাখল, সুযোগ মতো যেমন করেই হোক তার সাথে আলাপ করবে।
এরপর থেকে কলেজে সৈকতের চোখ আসিয়াকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। মাঝে মধ্যে দেখতে পেলেও সময় সুযোগ পায় না।
মাস তিনেক পরে একদিন সৈকত কলেজ লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিয়ে দরজা দিয়ে বেরোবার সময় আসিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। দু’জনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে একে অপরের দিকে অপলক নয়নে চেয়ে রইল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সৈকত নিজেকে সামলে নিয়ে বেরিয়ে এসে বারান্দায় একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
আসিয়া লাইব্রেরিতে ঢুকে গেল। সেও একটা বই নেবার জন্য এসেছে। বই নিয়ে বেরিয়ে এসে সৈকতকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে লাগল।
সৈকত তার পিছনে পিছনে আসতে আসতে বলল, শুনুন।
আসিয়া দাঁড়াল না, কিন্তু চলার গতি কমিয়ে ফেলল।
সৈকত তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমি আপনাকে ডাকলাম, আর আপনি চলে যাচ্ছেন?
: চলে গেলে আমাকে ধরার জন্য আপনাকে ছুটতে হতো। কী বলতে চান বলুন।
: আপনি ওরকম চটাং চটাং কথা বললে বলব কী করে?
: কেন? যেভাবে বলছেন ঐ ভাবেই। ও আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।
: বেশ তো বলুন।
: একটু নিরিবিলি জায়গায় হলে ভালো হতো।
: খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে কেটে পড়ন। আর তা যদি না হয়, তা হলে দ্বিধা করে চটপট বলে ফেলুন।
: আপনার নামটা বলবেন?
: নাম জেনে কী হবে? মেয়েদের যে কোনো একটা নাম ধরে নিতে পারেন।
: সঠিক নাও হতে পারে?
: আমার মনে হয়, জেনেও জিজ্ঞেস করছেন।
সে দিন মার্কেটে ও আজ সৈকত যতটুকু আসিয়ার সঙ্গে কথা বলেছে; তাতে করে সে বারবার তার কাছে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে ফেলেছে। ভাবল, মেয়েটা সত্যিই খুব তুখোড়। বলল, আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই।
: আপনার তো বন্ধু-বান্ধবীর কোনো অভাব নেই। আরও যদি করতে চান, তা হলে ছেলেমেয়ের অভাব নেই।
: তা নেই, তবে আপনিও তো তাদের একজন।
: না, আমি তাদের থেকে ভিন্ন। এখানে লেখাপড়া করতে এসেছি, বন্ধুত্ব করতে নয়।
: এখানে আমরাও সবাই লেখাপড়া করতে এসেছি। বন্ধুত্ব করলে লেখাপড়ার ক্ষতি হয় না বরং অনেকে একে অপরের কাছ থেকে সাহায্য পায়।
: আপনার কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে আমি তো আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না।
কথা বলতে বলতে তারা বারান্দার শেষ প্রান্তে এসে দু’জনের মনের অজান্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা বলছিল।
সৈকত আসিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, চলুন ক্যান্টিনে গিয়ে একটু চা খাওয়া যাক।
তা খাওয়া যেতে পারে। আমারও চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। এই কথা বলে হাঁটতে শুরু করল।
সৈকতও তার পাশে পাশে এসে এক কোণের টেবিলে দু’জনে মুখোমুখি বসল।
বেয়ারার এলে সৈকত তাকে চারটে মিষ্টি ও চারটে সিঙ্গাড়া দুটো প্লেটে দিতে বলল।
অসিয়া বলল, আপনি তো চা খাবার কথা বললেন?
সৈকত বলল, চায়ের সঙ্গে টানা হলে কি চা খেয়ে মজা পাওয়া যায়?
আসিয়া হেসে উঠে বলল, তা অবশ্য ঠিক। আবার সেই সঙ্গে চাঁদমুখ থাকলে আরও বেশি মজা পাওয়া যায়, তাই না?
সৈকতও হেসে উঠে বলল, আপনি ঠিক সময়ের মতো এমন কথা বলেন, যা শুনে আমি বারবার আশ্চর্য হচ্ছি। সত্যি আপনি খুব জিনিয়াস।
আসিয়া হেসে উঠে বলল, অত পাম্প দেবেন না, বেলুনের মতো ফেটে যাব।
সৈকত হাসতে হাসতে বলল, আপনি বেলুন না, বেলুন ফুলাবার গ্যাস সিলিণ্ডার।
এই কথায় দু’জনেই হেসে উঠল, এমন সময় বেয়ারার মিষ্টি সিঙ্গাড়া নিয়ে এলে তাকে সৈকত বলল, দুকাপ চা দিয়ে যাও। তারপর আসিয়াকে বলল, নিন শুরু করুন।
আসিয়া খাবার জন্য মুখের কাপড় সরিয়ে দিল।
সৈকত তার মুখের দিকে চেয়ে ফরিদার কথার সত্যতার প্রমাণ পেল। সত্যি সে খুব কালো। তবে কালো হলেও মুখের শ্রী খুব সুন্দর। তন্ময় হয়ে চেয়ে রইল।
: আসিয়া বলল, আমি খুব কালো তাই না?
: সৈকত লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ তাই।
: খুব ঘেন্না হচ্ছে বুঝি?
: এবার আমিও যদি বলি, আপনি একটা বোকা-গাধা অথবা বখাটে ছাত্রী?
: আসিয়া মৃদু হেসে বলল, তাই মনে হচ্ছে বুঝি?
: আপনার সম্বন্ধে সবকিছু জানি, সে কথা আপনিই বলেছেন। তবু এই কথা বলে নিজেই তা প্রমাণ করলেন না কি?
আসিয়া মৃদু হেসে বলল, আপনার কাছে এসে আমিও আপনার মতো হয়ে গেছি। নচেৎ আগে আমি এ রকম ছিলাম না। তারপর একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে বলল, কারো সঙ্গে আলাপ করতে এলে প্রথমে নিজের নামটা প্রথমে জানাতে হয়।
সৈকত নিজের নাম বলে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দিন।
: আপনি প্রথম দিন থেকে অনেক ভুল করেছেন, কোনটা ক্ষমা করব?
: আগেরগুলো ক্ষমা যে পেয়েছি তা জানি।
: কী করে জানলেন? আপনি নিজেই তো জানেন না, কী কী ভুল করেছেন।
: সঙ্গে সঙ্গে ভুলগুলো জানতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরেছি। আর এও বুঝতে পেরেছি, সেগুলো ক্ষমা করেছেন বলেই আমার সঙ্গে ক্যান্টিনে এসেছেন।
আসিয়া আবার মৃদু হেসে বলল, এবার দেখছি আপনার বুদ্ধি খুলতে শুরু করেছে। তারপর পানি খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনার নামের অর্থ নিশ্চয় জানেন?
: হ্যাঁ, জানি।
: আচ্ছা আপনার ভালো নাম আছে, না শুধু ঐ নাম?
: ভালো নাম থাকবে না কেন? আমার ভালো নাম মনসুর।
: ঐ নামেরও অর্থ জানেন?
: না।
: মনসুর অর্থ বিজয়ী।
: আপনার নামের অর্থটা বলুন।
: স্তম্ভ। তারপর বলল, এবার আসল কথাটা বলে ফেলুন তো? দুজনের অনেক সময় নষ্ট হল।
সৈকত বলল, আমার মামাত বোন ফরিদা আপনার সঙ্গে পড়ে। তার কাছে আপনার অনেক গুণগান শুনে আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার আগ্রহ চেপে রাখতে পারিনি। তাই বন্ধুত্ব করতে চাই।
: ফরিদাকে আমি চিনি। সে শুধু গুণগান করল? দোষের কথা কিছু বলে নি?
: বলেছে, তবে এটা সবাই জানে, যার গুণ আছে তার কিছু না কিছু দোষও আছে। কোনো মানুষই নির্দোষী হয় না। কথাটা যে ইউনিভার্সাল ট্রুথ, সে কথা নিশ্চয় মানেন?
: মানি, কিন্তু আপনি কি সত্যিই আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চান?
: নিশ্চয়ই।
: কিন্তু আমার তো কোনো ছেলেবন্ধু নেই।
: তাতে কী হয়েছে? আমিই আপনার প্রথম ছেলেবন্ধু হব।
: ইসলামে ছেলে মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ।
: আপনি জোক করছেন। বন্ধুত্ব বন্ধুত্বই। ইসলামে নিষেধ থাকবে কেন? আর থাকলেই বা কী?
: আপনি ইসলাম সম্বন্ধে কতটুকু পড়াশুনা করেছেন?
: কিছুই করিনি।
: তাহলে এরকম কথা বললেন কেন?
সৈকত এই কথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
আসিয়া বলল, যার যে বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই, তার সে বিষয়ে কমেন্ট করা উচিত না। আপনি চাইলেও আমি আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারি না। ইসলাম সম্বন্ধে আমার যদি কোনো জ্ঞান না থাকত, তা হলে হয়তো পারতাম।
: আপনি ডাক্তারি পড়ছেন, আপনার কাছ থেকে এ রকম কথা আশা করিনি।
: ডাক্তারি পড়ছি বলে ইসলামের আইন জেনেশুনে অমান্য করব, এটা ভাবছেন কেন? ইসলাম অন্যায় ছাড়া কোনো কিছু করতে নিষেধ করেনি। তবে সব কিছু করার নিয়ম ও সীমা বেঁধে দিয়েছে। মুসলমান হয়ে ইসলাম সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, শুনে খুব দুঃখ পেলাম। শুধু আপনাকেই বা দোষ দেব কি, আজকাল উচ্চ সমাজের লোকেরা ও তাদের ছেলে-মেয়েরা বড় বড় ডিগ্রি নেবার জন্য এবং ভবিষ্যৎ জীবন সুখে কাটাবার জন্য কত শ্রম ব্যয় করছে। কিন্তু মুসলমানের পরিচয় কী? ইসলাম কী? এ সম্বন্ধে জানার এতটুকু আগ্রহ যেমন নেই, তেমনি এতটুকু চেষ্টাও করে না। তারা নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের ঘুণে ধরা সমাজকে দেখে অসভ্য, ইতর ও ছোটলোক ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আসলে তারা যদি ইসলামকে জেনে ইসলামি জিন্দেগী অনুসরণ করত, তা হলে নিম্ন সমাজের মুসলমানদেরকে ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে না দিয়ে সেই সমাজের সংস্কার করে তাদের সঙ্গে শান্তিতে জীবন-যাপন করত। আপনাকে একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?
: বলুন।
: আপনি বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে ঘোরাফেরা কমিয়ে দিয়ে ইসলামকে জানতে চেষ্টা করুন। আর সে জন্য আপনাকে ইসলামিক বই পড়তে হবে।
সৈকত আসিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারবার তার চোখের দিকে চেয়ে এবং তার গলার মিষ্টি স্বর শুনে ক্রমশঃ নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। মনে হলো, আসিয়ার মায়াবী চোখে জাদু আছে। আর মানুষের গলার স্বর যে এত মিষ্টি হয়, তা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাকে কাছে পাবার মোহ সৈকতকে গ্রাস করল। আসিয়ার কথা শুনে বলল, প্রথমে কি বই পড়ব বলুন।
: প্রথমে গোলাম মোস্তফার লেখা বিশ্বনবী পড়ন। সেটা পড়লেই পরবর্তী কী বই পড়তে হবে, নিজেই বুঝতে পারবেন। তারপর রিস্ট ওয়াচের দিকে চেয়ে বলল, এবার উঠি চলুন। ক্লাস শুরু হবার সময় হয়ে গেছে। এই কথা বলে আসিয়া উঠে দাঁড়াল।
সৈকতও দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ চলুন। তারপর বিল মিটিয়ে দিয়ে ক্যান্টিনের বাইরে এসে বলল, আবার কবে আপনার দেখা পাব?
: দেখা হওয়ার আর কি দরকার আছে?
: আছে বলেই তো জিজ্ঞেস করছি।
আসিয়া কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, দেখা হতে পারে তবে তার আগে আপনাকে বিশ্বনবী পড়ে শেষ করতে হবে।
: তা তো পড়বই, কিন্তু আপনাকে পাব কোথায়?
: ঠিক এক মাস পর, মানে আজ তো মাসের পাঁচ তারিখ, আগামী মাসের পাঁচ তারিখে ঐ সময়ে আমি লাইব্রেরিতে বইটি ফেরত দিতে আসবে। সেই সময় ওখানে আমাকে পাবেন। তবে বিশ্বনবী পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন না। আসি আল্লাহ হাফেজ বলে আসিয়া ক্লাস করার জন্য চলে গেল।
সৈকত তার দিকে চেয়ে রইল। আসিয়া আড়াল হয়ে যেতে সেও নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেল।
জহিরকে সৈকত বলেছিল সে লাইব্রেরিতে একটা বই নিতে যাচ্ছে। দেরি দেখে জহির তাকে খুঁজতে লাইব্রেরিতে গিয়ে না পেয়ে এদিকে ওদিকে অনেক খুঁজেছে। তারপর ক্লাসে এসে বসেছিল। সৈকত আসার পর বলল, কী রে কোথায় গিয়েছিলি? আমি তোকে খুঁজতে লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম।
সৈকত বলল, লাইব্রেরি থেকে একজনের সঙ্গে ক্যান্টিনে গিয়েছিলাম। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।
: একজনটা কে? ফরিদা না অন্য কেউ?
জহির ফরিদাকে ভালোবাসে। সেকথা একদিন তাকে বলতে ফরিদা খুব রেগে গিয়ে বলল, একথা আর মুখে আনবেন না। আপনি সৈকত ভাইয়ের বন্ধু, নচেৎ বিশ্রী সীনক্রিয়েট করে ফেলতাম।
জহির বলল, আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি ফ্রাঙ্কলি কথাটা বললাম, এতে মাইণ্ড করার কী আছে। আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন। মনের কথা প্রকাশ করার স্বাধীনতা সবারই আছে।
ফরিদা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, সরি, রেগে যাওয়াটা আমার ভুল হয়েছে। মাফ করে দিন। আর আপনার কথার উত্তরে বলছি, আমি সৈকত ভাইকে ভালোবাসি।
জহির কাচুমাচু হয়ে বলল, এক্সট্রিমলি সরি। আগে জানতে পারলে বলতাম না। দারুণ ভুল করে ফেলেছি। আপনিও আমাকে মাফ করে দিন।
ফরিদা বলল, দু’জনেই ভুল করেছি এবং সে জন্য দু’জনে মাফও চেয়েছি। এরপর আর কারো মনে কিছু থাকা উচিত না, কি বলেন?
জহির বলল, তা তো বটেই, যদি মনে কিছু না করেন, তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
: বলুন কী জানতে চান।
: সৈকত কি জানে, আপনি তাকে ভালোবাসেন?
: সে কথা বলব না।
: তা না হয় নাই বললেন, সৈকতও কি আপনাকে ভালোবাসে?
: তাও বলব না। একটা কথা বলি মাইন্ড করবেন না। ভবিষ্যতে আমাদের ব্যাপারে আর কখনো ইন্টারফেয়ার না করলে খুশি হব।
এই ঘটনার পর জহির একদিন সৈকতকে জিজ্ঞেস করল, তুই কি কোনো মেয়েকে ভালোবাসিস?
: হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
: হঠাৎ মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করছি।
: তুই আমার একমাত্র অন্তরঙ্গ বন্ধু। সে রকম কিছু হলে নিশ্চয় তোকে বলতাম। তুই কি কাউকে ভালোবাসিস?
জহির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ।
: কই আমাকে তো বলিস নি? তা হলে কি আমাকে তুই অন্তরঙ্গ বন্ধু মনে করিসনি?
: এ কথা বলতে পারলি? তোর অনেক বন্ধু-বান্ধবী থাকলেও তুইই আমার একমাত্র বন্ধু।
: তা হলে ঐ কথা আমাকে বলিসনি কেন?
: অনেক দিন থেকে একটা মেয়েকে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে কি না বুঝতে না পেরে কয়েকদিন আগে তাকে কথাটা বলেছিলাম। শুনে খুব রেগে গিয়েছিল। আমি ক্ষমা চাওয়ার পর বলল, সে একজনকে ভালোবাসে।
: তা মেয়েটা কে বল তো শুনি? নিশ্চয় আমাদের পরিচিত।
: হ্যাঁ পরিচিত। বললে তুই মাইণ্ড করবি।
: না করব না, তুই বল। ও সত্যি বলছিস?
: হ্যাঁ সত্যি বলছি। তুই এত দ্বিধা করছিস কেন? তোর কথায় মাইণ্ড করব, এ কথা ভাবলি কী করে?
: তা হলে শোন, মেয়েটি ফরিদা, যে তোকে ভালোবাসে।
: কী বললি?
: হ্যাঁ, ফরিদা তাই তো বলল।
সৈকত জহিরকে জড়িয়ে ধরে বলল, এই কথা জানিয়ে তুই প্রকৃত বন্ধুর মতো কাজ করলি। তুই তো জানিস, ফরিদা আমার মামাতো বোন। আমার কোনো ভাই বোন নেই। সেই জন্য তাকে আমি আপন ছোটবোনের মতো মনে করে খুব স্নেহ করি। যা আব্দার করে, তাই পূরণ করি। আর সে কি-না সেটাকে অন্যভাবে নিল? আজ তুই যে আমার কত বড় উপকার করলি, তা তোকে ঠিক বুঝাতে পারব না। ফরিদার সঙ্গে কথা বলে, তার ভুল ভাঙিয়ে দেব। তুই ফরিদাকে ভালোবাসিস শুনে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। এ ব্যাপারে বন্ধু হিসেবে যা করার আমি করব।
জহির আতঙ্কিত হয়ে বলল, তুই কিছু বললে হীতে বিপরীত হবে। ফরিদা মনে করবে আমি তোকে তার কথা জানিয়েছি। ফলে সে আমার উপর খুব রেগে গিয়ে আমাকে নীচ ভাববে।
সৈকত তাকে ছেড়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল, তুই কি আমাকে এতই বোকা ভেবেছিস, এই জ্ঞানটাও আমার নেই? তুই চিন্তা করিস না। আমি এমনভাবে ম্যানেজ করব, সে তোকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করবে না। দেখে নিস আমার কথা শোনার পর সে তোকে ভালোবাসবেই।
: তবু আমার ভয় হচ্ছে। তাছাড়া ভালোবাসা মনের ব্যাপার। কারো কথা শুনে কেউ কাউকে ভালোবাসে না।
: সে কথা আমিও জানি। তবে কি জানিস, মানুষ যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন সে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা করে ফেলে। এটুকু জেনে রাখ, আমাকে যদি তুই সত্যিকার বন্ধু মনে করে থাকিস, তাহলে এমন কোনো কাজ করব না, যাতে করে তোকে ছোট করা হবে। যা বললাম, তার প্রমাণ সময়ই তোকে বলে দেবে।
: সে কথা জানি বলেই তো ফরিদার কথাটা অকপটে বললাম।
এই ঘটনাটা বেশ কিছুদিন আগের হলেও আজও সৈকত ফরিদাকে কিছু বলেনি। কারণ, ভেবেছে, সরাসরি ফরিদাকে কথাটা বললে, ফরিদ জহিরকে সন্দেহ করবেই। ফলে তাকে সে জীবনে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে না। তাই ঠিক করেছে, সে কোনো মেয়েকে ভালো না বাসলেও তার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করবে। তখন ফরিদা জানতে পারলে নিশ্চয় আমকে তার ভালোবাসার কথা জানাবে। সেই সময় যা কিছু বলার বলবে। তারপর হঠাৎ যে দিন ফরিদা কলেজের বারান্দায় আসিয়ার কথা বলে, সেই দিন মনে মনে ভাবল, আসিয়ার সঙ্গে সত্য হোক আর মিথ্যা হোক ভালোবাসার অভিনয় করবে। তারপর থেকে সে আসিয়ার পিছনে লাগল। কিন্তু আসিয়ার সঙ্গে মাত্র দুদিন আলাপ হয়েছে। তাতেই সে তাকে অন্তরের মণিকোঠায় বসিয়ে ফেলেছে। তার মনে হয় আসিয়াকে না পেলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে।
তাই আজ জহিরের কথা শুনে বলল, ফরিদা যাতে তোকে ভালোবাসে সেই ব্যবস্থা করার জন্য একটা মেয়ের পিছনে লেগেছি।
জহির বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না, ক্লিয়ার করে বল।
: তুই দেখছি, ফরিদাকে ভালোবেসে বুদ্ধিশুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিস। আরে বোকা, ফরিদা যখন জানবে, আমি অন্য মেয়েকে ভালোবাসি তখন সে নিশ্চয় আমাকে প্রেম নিবেদন করবে। আমি সেই সময় এমন অস্ত্র ব্যবহার করব, যা সে সহ্য করতে না পেরে তোর কাছে আশ্রয় নেবে। কথা শেষ করে হেসে উঠল।
: কী জানি হয়তো তোর কথা ঠিক। তা সেই মেয়েটা কে বলবি না?
: আসিয়া।
: আসিয়া কে?
: না সত্যি সত্যি ফরিদার চিন্তা তোর সবকিছু লোপ করে দিচ্ছে। আরে ঐ যে একদিন আমি, তুই ও ফরিদা কলেজের বারান্দায় গল্প করছিলাম, তখন হাত পায়ে মোজা ও বোরখা পরা একটা মেয়ে আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে ফরিদা তার পরিচয় বলল।
: ও হা হা, মনে পড়ছে।
: আমি তার পেছনে লেগেছি। তারপর নিউ মার্কেটে বই কিনতে যাবার দিনের ঘটনা ও আজকের ক্যান্টিনে যে সমস্ত কথাবার্তা হয়েছে বলল।
: দারুণ ফ্যান্টাস্টিক তো? ফরিদা ঠিকই বলেছে, মেয়েটা খুব তুখোড়।
সৈকত হেসে উঠে বলল, হ্যাঁ তাই। তবে কী জানিস, ওর চোখে ও গলার স্বরে জাদু আছে। ভালোবাসার অভিনয় করতে গিয়ে সেই জাদুর জালে আটকে গেছি। মনে হচ্ছে ওকে না পেলে আমি বাঁচব না।
: সেদিন ফরিদা তো বলল, মেয়েটা খুব কালো। তাই সে ঐ রকম পোশাক পরে।
: ফরিদা সত্য বলেছে। তবে খুব কালো হলে কী হবে, দেখতে খুব সুশ্রী।
: তোর কথা শুনে আমারও তার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছা হচ্ছে। তুই যেন। আবার ভুল বুঝিসনি।
: ভুল বোঝার প্রশ্নই ওঠে না, তুই তার কাছে ঘেঁষতেই পারবি না।
: কেন? খুব ধার বুঝি?
ও ধার মানে? এত তীক্ষ্ণ ধার যে, যে কেউ সামনে যাবে সে কেটে খান খান। হয়ে যাবে। এই কথায় দু’জনেই হেসে উঠল।
হাসি থামিয়ে সৈকত বলল, মেয়েটা খুব ইসলামিক মাইণ্ডেড। মনে হয় ইসলাম সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞান রাখে, এবং ইসলামের আইনও যথাসাধ্য মেনে চলে। আমাকে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করার কথা বলে, প্রথমে বিশ্বনবী পড়তে বলল।
: তা পড়বি না কি?
: না পড়ে উপায় নেই। সে জন্য এক মাস সময় দিয়ে বলেছে, বইটা পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা যেন না করি।
: তাই না কি?
: হারে তাই। ভাবছি আজকেই বইটা কিনে পড়তে শুরু করব।
জহিরও খুব ইসলামিক মাইণ্ডেড। নিয়মিত নামায-রোযা করে। কিছু কিছু ইসলামিক বইও পড়ে। বিশ্বনবী ছাড়াও সাহাবা চরিত, কাসাসুল কোরআন, তাজকেরাতুল আউলিয়া এবং কোরআন হাদিসের ব্যাখাও কিছু কিছু পড়েছে। মাঝে মাঝে সৈকতকে নামায পড়তে বলে। সৈকত বলে নামায পড়ে কী হবে। এই যে তোরা নামায পড়িস, তাতে কী লাভ হচ্ছে বলতে পারিস? জহির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, যদি ধর্মীয় বই পড়তিস, তাহলে একথা বলতে পারতিস না।
জহির এখন তার কথা শুনে বলল, এতদিন তো আমার কথায় তুই ইসলামিক বই পড়লি না, এবার আসিয়ার কথায় পড়বি। সে জন্যে আসিয়াকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
সৈকত বলল, মোবারকবাদ আবার কিরে?
: ওটা উর্দু শব্দ। বাংলায় আমরা যাকে ধন্যবাদ বলি।
সত্যি সত্যি সে দিন সৈকত ‘বিশ্বনবী’ কিনে বাড়ি ফিরল। তারপর অবসর সময়ে পড়তে লাগল।
একদিন বিকেলে ফরিদা তাদের বাড়িতে এসে সৈকতকে পড়তে দেখে অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার এখন কী পড়ছ, চল বেড়াতে যাই।
সৈকত বলল, তুই যা, দেখছিস না পড়ছি।
এখন পড়ার সময় নাকি বলে ফরিদা এগিয়ে এসে বইটা দেখে আরও বেশি অবাক হয়ে বলল, আরে এতো দেখছি বিশ্বনবী। এই বই পড়ছ কেন?
: কেন রে, পড়তে দোষ আছে নাকি?
: দোষ কেন থাকবে; ভাবছি পাঠ্য বই না পড়ে এই বই পড়ছ? কী ব্যাপার বল তো, আমাকে কদিন থেকে এড়িয়েও চলছ?
সৈকত ফরিদাকে এখনও তুই করে বলে। বলল, তোকে এড়িয়ে চলব কেন? একজন বইটা পড়তে বলল, তাই কয়েকদিন আগে কিনে এনে পড়ছি। জানিস, আমাদের নবী (দঃ)-এর চরিত্র এত উন্নত যা পৃথিবীর কোনো মহামণিষীদের নেই। আমরা না জেনে নবী (দঃ)-কে কত কটুক্তি করি। এটা যে কত বড় অজ্ঞতা ও অন্যায় তা তোকে বোঝাতে পারব না। আমার পড়া হয়ে গেলে তোকে দেব, তুইও পড়বি। পড়লে আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবি।
ফরিদা গম্ভীর হয়ে বলল, তা না হয় পড়ব, কিন্তু কার কথায় তুমি এই বই পড়ছ?
সৈকত বলল, সে কথা পরে শুনিস, এখন এখান থেকে যা দেখি, আমি আরও কিছুক্ষণ পড়ব।
ফরিদা গম্ভীর হয়ে ফিরে আসার সময় চিন্তা করতে লাগল, সে কে হতে পারে? যার কথায় বেড়ান বন্ধ করে, পাঠ্য বই না পড়ে, বিশ্বনবী পড়ছে। তাহলে কি কোনো হুজুরের পাল্লায় পড়েছে? দেখা যাক কতদূর কী হয়। এইসব চিন্তা করতে করতে ফুপুর কাছে গেল।
হেমা ভাইঝির গম্ভীর মুখ দেখে বললেন, কিরে তোর মুখের অবস্থা অমন কেন? সৈকতের সঙ্গে নিশ্চয় কিছু হয়েছে? হেমা ভাইঝিকে বউ করবে বলে স্বামীকে বলে রেখেছেন। ফয়জুর রহমানও অমত করেননি।
ফরিদা বলল, না ফুপু সৈকত ভাইয়ের সঙ্গে কিছু হয়নি। কয়েকদিন সে আমাদের বাড়ি যায়নি। সে কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি, সে বিশ্বনবী পড়ছে। বেড়াতে যাবার কথা বলতে, না করে তাড়িয়ে দিল। এখন আর তেমন আমার সঙ্গে মেলামেশাও করে না।
হেমা বললেন, ওমা তাই নাকি? চল তো দেখি তার কাছে যাই।
ফরিদা বলল, না ফুপু এখন তার কাছে আমি আর যাব না। তারপর ফুপু কিছু বলার আগে বাড়ি চলে গেল।
হেমা ভাবলেন, সৈকতের উপর মেয়ের খুব অভিমান হয়েছে। এক সময় ছেলেকে বললেন, হ্যাঁরে তুই নাকি ফরিদার সঙ্গে মেলামেশা করিস না?
সৈকত হেসে উঠে বলল, সে বুঝি আজ তোমার কাছে নালিশ করে গেছে?
: আমার কাছে নালিশ করবে না তো কার কাছে করবে, তোর মামা-মামি জানতে পারলে কী মনে করবে বল দেখি? তারা তোকে কত ভালোবাসে।
: মামা-মামি ভাগনাকে ভালোবাসবে না তো রাস্তার ছেলেকে ভালোবাসবে? কয়েকদিন ধরে বিশ্বনবী বইটা পড়ছি। তাই বাড়িতে যেতে পারিনি। কোথাও বেড়াতেও যাইনি। এতে আমি দোষ করলাম কোথায়?
: তা না হয় হল, কিন্তু ফরিদা তোকে নিয়ে বেড়াতে যাবে বলে এসেছিল, তাকে ফিরিয়ে দেয়াটা তোর ঠিক হয়নি।
: কেন ঠিক হয়নি? আমার কি ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই? যে যা বলবে তাই শুনতে হবে। ফরিদা ছাড়া অন্য যে কোনো বান্ধবী এলে তাকেও ফিরিয়ে দিতাম।
হেমা হেসে উঠে বললেন, পাগল ছেলের কথা শোন। আমি কি তাই বললাম। ফরিদাকে তুই তোর অন্য বান্ধবীদের সঙ্গে তুলনা করবি না।
: কেন? সে তো মামাত বোন?
: মামাত বোন তো বটেই। তাছাড়াও এর মধ্যে একটা কথা আছে, যা তোকে জানান হয়নি। এখন বলছি শোন, আমি ও তোর বাবা ভেবেছি, তোর সঙ্গে ফরিদার বিয়ে দেব।
: কী বললে মা? না-না এ কখনও সম্ভব নয়।
: কেন ফরিদাকে কি তোর পছন্দ নয়?
ও অপছন্দের মতো মেয়ে ফরিদা নয়। কিন্তু আমি তাকে নিজের বোনের মতো মনে করি। তাকে বিয়ে করা একেবারেই অসম্ভব।
: আরে বোকা, বোন সম্পর্কের সঙ্গেই তো বিয়ে হয়।
: তা হোক, তবু আমি পারব না। যাকে জ্ঞান হবার পর থেকে আপন ছোট বোনের মতো স্নেহ করে এসেছি, তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারব না। তোমরা আমাকে মাফ কর মা।
হেমা তবু হাল ছাড়লেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন, ফরিদা যদি রাজি থাকে এবং তোর মামা-মামি যদি চায়, তবু করবি না?
সৈকত আর্তনাদ করে উঠে বলল, না মা, না। একথা আর বল না। কিছুতেই আমি এটা করতে পারব না। তুমি বাবাকে আমার কথা জানিয়ে দিও।
হেমা আরও গম্ভীর গলায় বললেন, আমরা যদি জোর করে এই কাজ করি?
সৈকত চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, তার পরিণামের জন্য তোমরা পস্তাবে।
: আমাদের সকলের মনে কষ্ট দিয়ে তুই সুখী হতে পারবি?
এবার সৈকত মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে বদদোয়া করা না মা। তোমাদের একমাত্র সন্তানকে তোমরা সুখী দেখতে চাও না? আমি ধ্বংস হয়ে যাই, এটাই কি তোমরা চাও?
ও কার্যকলাপে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। সৈকতকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বললেন, আমরা তোকে বদদোয়া করব এটা ভাবতে পারলি? তুই আমাদের একমাত্র নয়নের মণি। তোর কিছু হলে আমরা বাঁচব কাকে নিয়ে? তারপর ছেলের মাথায় চুমো খেয়ে, চোখ মুখ মুছে দিয়ে বললেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ঠিক উত্তর দিবি তো?
: তোমার ছেলেকে মিথ্যা বলতে তুমি কি শিখিয়েছ? বল কী জানতে চাও।
: তুই কি কোনো মেয়েকে পছন্দ করিস?
সৈকত মায়ের আঁচল দিয়ে তার চোখ মুখ মুছতে মুছতে বলল, এতদিন করিনি। তবে দু’তিন মাস হল একটা মেয়ে আমার মনে দাগ কেটেছে।
: দাগ কেটেছে মানে, এখন তাহলে তার সঙ্গে পরিচয় হয়নি?
ও পরিচয় তেমন হয়নি, তবে কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে কিছু আলাপ হয়েছে। মেয়েটা খুব ধার্মিক। হাতে-পায়ে মোজা ও বোরখা পরে কলেজে আসে। ফরিদার সঙ্গে পড়ে।
হেমা অবাক হয়ে বললেন, হাতে-পায়ে মোজা দিয়ে বোরখা পরে এমন কথা কখনও শুনিনি। তা মেয়েটাকে একদিন আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবি। তার বাবা-মা’র খোঁজ-খবর নিয়েছিস?
: তুমি যে কী বল মা, যে মেয়ে নাম বলতে চায় না, সে বাবা-মা’র পরিচয় বলবে? প্রথমে আমাকে পাত্তাই দেয়নি। অনেক কায়দা করে সেদিন ক্যান্টিনে চা খাওয়াবার সময় কিছু আলাপ হয়েছে।
: তুই তাহলে মেয়েটার নামও জানিস নি?
: জানি, আসিয়া। তবে সে বলেনি, ফরিদার কাছে শুনেছি।
: ফরিদা হয়তো তার সব খবর জানে, তাকে জিজ্ঞেস করিস নি?
: না করিনি।
: যে মেয়ে তোকে পাত্তা দেয় না, তার সঙ্গে আলাপ করতে গেলি কেন? তুই না পুরুষ ছেলে, তোর সম্মানে বাধল না?
: তোমার এই প্রশ্নের উত্তর এখন দেব না। তবে কিছু দিনের মধ্যে নিশ্চয় দেব।
: ফরিদা বলল, তুই নাকি কলেজের বই না পড়ে বিশ্বনবী পড়ছিলি?
: হ্যাঁ পড়ছিলাম। আসিয়া পড়তে বলেছে।
: তুই এসব খেয়াল এখন ছেড়ে দে। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। কোথাকার কোন হুজুর-টুজুরের মেয়ে হবে হয়তো, তার চিন্তা বাদ দে, নচেৎ পড়াশোনার ক্ষতি হবে।
: তোমার ছেলেকে অত কাঁচা ভেব না। যা কিছু করি না কেন, পড়াশোনার অবহেলা করব না।
হেমা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে, যা মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর ফরিদাকে বিয়ে না করলেও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবি না। তার মনে কষ্টও দিবি না।
সৈকত বলল, সে তো আমার বোন। তার সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার করতে পারি; না তার মনে কষ্ট দিতে পারি? এই কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল।
সৈকত বিশ্বনবী বইটা পনেরো দিনের মধ্যে পড়ে শেষ করলেও আসিয়ার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করল না। দু’তিন মাস পরে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা, মায়ের কথা স্মরণ করে পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত রইল। ভেবে রাখল পরীক্ষার পর তার সঙ্গে দেখা করবে।
.