কালোমেয়ে – ৭

৭.

শেষবার যেদিন সৈকত আসিয়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে নিজেদের মনের কথা বলাবলি করল, সেদিন ফরিদা সৈকতকে নিয়ে বেড়াতে যাবে বলে বিকেলে তাদের বাড়িতে এল। তাকে না পেয়ে ফুপুকে জিজ্ঞেস করল, সৈকত ভাই কোথায়?

হেমা বললেন, সে তো চারটে-সাড়ে চারটের সময় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করতে বলল, একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।

 : আমি তার রুমে যাচ্ছি, আপনি আয়াকে চা করে সেখানে নিয়ে আসতে বলুন। সৈকত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তারপর যাব।

: তাই যা, আমি আয়াকে চায়ের কথা বলছি।

ফরিদা সৈকতের রুমে আগেও অনেকবার এসেছে। তখন তার কোনো জিনিস হাত দেয়নি। আজ এসে খাটে বসে চিন্তা করল, কোথায় যেতে পারে? হঠাৎ মনে হলো জহিরের বাসায় যায়নি তো? জহিরের কথা মনে হতে নিজে নিজে হেসে উঠল। ভাবল, জহির তাকে একদিন প্রেম নিবেদন করেছিল। সৈকতকে ভালোবাসি শুনে তার চেহারা যা হয়েছিল, সেকথা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়। সেদিন বেচারা খুব লজ্জা পেয়েছিল। তারপর থেকে জহির আর টু সাড়া করেনি। তার মন বলে উঠল, জহির তোমাকে মনে প্রাণে ভালোবাসত, তার বন্ধু সৈকতকে তুমি ভালোবাস শুনে সে সামলে নিয়েছে। কারণ তারা দুজন খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু। তবে জহির তোমাকে আজীবন ভালোবাসবে। আর তুমি যে। সৈকতকে ভালোবাস, সে কথা তাকে তো জানাও নি? সে যদি তোমাকে ভালো না বাসে অথবা অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসে, তা হলে কী করবে? ফরিদা মনকে বলল, জানাবার জন্য আজ এসেছি। বসে থাকতে থাকতে ফরিদা বিরক্ত হয়ে বুক সেলফের কাছে গিয়ে বই দেখতে লাগল। ইসলামিক অনেক বই দেখে বেশ অবাক হলো। ভাবল, সৈকত ভাই তা হলে ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বইগুলোর মধ্যে কী এমন আছে জানার জন্য বিশ্বনবী বইটা নিয়ে চেয়ারে বসে পড়তে শুরু করল। তঙ্কালীন আরব দেশের লোকদের সমাজের অবস্থা পড়তে পড়তে হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর জন্মগ্রহণ পর্যন্ত পড়ে ফেলল। তারপরও বন্ধ করল না। তখন তার জানার আগ্রহ বেড়ে গেছে। এদিকে কখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে টের পেল না। যখন লেখাগুলো অস্পষ্ট দেখল তখন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চাইতে বুঝতে পারল সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভাবল, দেরি যখন হয়েছে তখন আজ তাকে মনের কথা জানিয়ে তবে বাড়ি ফিরবে।

এমন সময় আয়া লাইট জ্বালাতে এলে ফরিদা তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের ছোট সাহেব এখনও ফিরেন নি?

আয়া বলল, না আপা, বেগম সাহেব আপনাকে ডাকছেন।

ফরিদা বইটা হাতে করেই ফুপুর কাছে এল।

হেমা বললেন, তুই এতক্ষণ সৈকতের ঘরে কী করছিলি? তারপর হাতে বই দেখে জিজ্ঞেস করলেন, বই পড়ছিলি বুঝি? কথা শেষ করে তিনি আয়াকে চা নাস্তা নিয়ে আসতে বললেন।

ফরিদা বলল, হ্যাঁ ফুপু, সৈকত ভাইয়ের সেলফে পেলাম। এটা বিশ্বনবী। আরও অনেক ধর্মীয় বই রয়েছে। সেখানে ফায়জুর রহমানও ছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে ফরিদা বলল, জানেন ফুপা, বইটার কিছুটা পড়লাম। তাতেই বুঝতে পারলাম, এটা প্রত্যেকের পড়া উচিত।

ফায়জুর রহমান বললেন, হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক। ছাত্র জীবনে আমি একবার পড়েছিলাম, এই বইটা পড়লে একদিকে যেমন আরবের প্রাগৈতিহাসিক যুগের ঘটনা জানা যায়, তেমনি মুসলমানদের নবী (দঃ)-এর জীবন কাহিনি ও সেই সময়কার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় জানা যায়।

এমন সময় সৈকত মসজিদ থেকে মাগরিবের নামায পড়ে বাড়িতে এল। গেটে দারোয়ান তাকে বলল ফরিদা আপা বিকেলে এসেছেন, এখনও ফিরে যাননি। নিজের রুমে এসে চিন্তা করল, যাক ভালোই হলো, আজ যদি সে নিজেই ভালোবাসার কথা বলে, তাহলে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে তারপর আসিয়াকে ভালোবাসার কথা জানাবে। জামা কাপড় পাল্টে মায়ের রুমে এল।

হেমা তাকে দেখে একটু রাগের সাথে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? ফরিদা সেই বিকেল থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

সৈকত বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল। তারপর ফরিদার দিকে চেয়ে বলল, আগের থেকে ফোনে জানাতে পারতিস, তা হলে এরকম হতো না।

আয়া চা-নাস্তা নিয়ে এসে পরিবেশন করল।

সৈকত নিজে কাপে চা ঢেলে নেবার সময় বলল, আমি নাস্তা খেয়ে এসেছি, শুধু চা খাব। তারপর চা খেয়ে নিজের রুমে যেতে যেতে বলল, ফরিদা তুই নাস্তা খেয়ে আমার রুমে আয়।

ফরিদা একটু পরে সৈকতের রুমে এসে গাল ফুলিয়ে বলল, কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে? তার সঙ্গে এত কী কথা হলো যে, ফিরতে এত দেরি হলো?

সৈকত বলল, সে সব তোকে বলা যাবে না। তুই কেন এসেছিস বল, যদি বলিস বেড়াতে যাবি বলে এসেছিলি, তাহলে ভাবব মিথ্যা বলছিস, কারণ বেড়াতে এসে এতক্ষণ তুই আমার জন্য অপেক্ষা করতিস না।

ফরিদা ছলছল নয়নে বলল, কেন এতক্ষণ আছি তা কি তুমি বুঝতে পারনি?

: মানুষের মনের কথা একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। কোনো মানুষই তা জানতে পারে না। তা তোর চোখে পানি কেন?

: সে কথা যদি বুঝতে পারতে, তাহলে জিজ্ঞেস করতে না। আল্লাহ ছাড়া মানুষের মনের কথা অন্য কেউ জানতে পারে না, এটা ঠিক কথা; তবে যারা একে অপরকে ভালোবাসে তারা কিন্তু সবটা না হলেও কিছু কিছু পারে।

: তুই যে ভালোবাসার কথা বলছিস, সেটা হলো, খাঁটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের কথা। আমাদের কথা আলাদা, আমাদের মধ্যে তো সে রকম সম্পর্ক নেই। তোকে আমি জ্ঞান হবার পর থেকে আপন ছোট বোনের মতো স্নেহ করি, ভালোবাসি। আর তুইও নিশ্চয় আমাকে আপন বড় ভাই হিসেবে ভালোবাসিস, শ্রদ্ধা করিস তাই না?

ফরিদা লজ্জায় ও দুঃখে কোনো কথা বলতে পারল না। মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগল।

তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সৈকতের মনটা ব্যথায় ভরে উঠল। মনে। মনে বলল, তুই আমাকে ভালোবেসেছিস এবং আমাকে জীবনসাথি হিসেবে পেতে চাস জেনেও তোকে গ্রহণ করতে পারব না বোন। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, তুই কাঁদছিস কেন? মনে হচ্ছে কিছু বলবি বলে এসেছিলি। তা দ্বিধা না করে বলে ফেল। তোর কান্না থামাবার জন্য যা বলবি তাই করব। বড় ভাই হয়ে যদি ছোট বোনের কান্না থামাতে না পারি, তাহলে বড় ভাই হলাম কীসের?

ফরিদা মাথা তুলে তার দিকে চেয়ে বলল, একটা কথা তোমাকে জানাতে এসেছিলাম। জানাবার আগে তুমি যা বললে, তা আর জানান যাবে না, চলি। তবে যাবার আগে একটা কথা বলে যাই, তুমি বিশ্বাস কর আর নাই কর, তুমি যে প্রেমের কথা বললে, আমি জ্ঞান হবার পর থেকে তোমাকে নিয়ে সেই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি এরকম কথা বলবে স্বপ্নেও ভাবিনি? তারপর যাবার জন্য পা বাড়াল।

পকেট থেকে রুমাল বের করে তার চোখ মুখ মুছে দেবার সময় বলল, তোর কথা আমি বিশ্বাস করেছি। কিন্তু লক্ষ্মী বোন আমার, রাগ করিস না। আর মনে কষ্টও নিস না। মা একদিন আমাকে তার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা বলেছিল। তখন তাকেও এই কথাই বলেছি। আমি মনে করেছিলাম, মা হয়তো তোকে সে সব বলেছে। যাই হোক, এটা ছাড়া, তুই যা চাইবি তাই দেব। তোর সুখের জন্য এমন অসাধ্য সাধন করব, যা তুই ভাবতেই পারবি না। বল তুই আমাকে ক্ষমা করেছিস।

ফরিদা ভিজে গলায় বলল, তুমি বড় ভাই, তোমার দোষ ধরা অন্যায়। তোমাকে ভালোবেসে আমিই অন্যায় করেছি। আমাকে তার শস্তি পেতে হবে। আর তোমার হাতেই সেই শাস্তি পেতে চাই। দাও ভাইয়া দাও, যা মনে চায়। সেই শাস্তি দাও। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

ফরিদার কান্না দেখে সৈকতের চোখেও পানি এসে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে চোখ মুছে তার মাথায় হাত রেখে বলল, যে শাস্তি দেব তা মেনে নিবি তো?

ফরিদা মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ভিজে চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, বললাম তো ছোট বোন হয়ে বড় ভাইয়ের দেয়া শাস্তি একশোবার নেব।

সৈকত বলল, যা বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে আয়, তারপর শাস্তির কথা বলব। নচেৎ এখন যা শাস্তি পেলি, তারপর আবার শাস্তি দিলে সহ্য করতে পারবি না।

ফরিদা বাথরুমে যাওয়ার পর সৈকত বারান্দায় এসে আমাদের বাসায় ফোন করল, ওপারে রিসিভার তোলার পর মেয়েলি কণ্ঠ শুনে বলল, কে মামিমা বলছেন?

: হ্যাঁ বলছি।

: শুনুন, ফরিদার জন্য চিন্তা করবেন না, ও এখানে আছে। খেয়ে-দেয়ে যাবে। আমি ওকে পৌঁছে দেব।

: ঠিক আছে বাবা, তাই কর। তোমরা সবাই ভালো আছ তো?

: হ্যাঁ মামিমা, আমরা সবাই ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?

: আমরাও ভালো আছি, তা তুমি মামা-মামিকে যে একদম ভুলে গেছ?

: ভুলিনি, পরীক্ষা গেল তো; পড়ার খুব চাপ ছিল। আজ ফরিদার সঙ্গে আসছি।

: ঠিক আছে এস, বলে তিনি রিসিভার রেখে দিলেন।

সৈকত রিসিভার রেখে ফিরে এসে দেখল, ফরিদাকে এখন বেশ ফ্রেস দেখাচ্ছে। বলল, তোদের বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিলাম, তুই এখানে আছিস, খাওয়া-দাওয়ার পর ফিরবি।

ফরিদা বলল, ভালোই করেছ। আগেই আমার ফোন করে জানান উচিত ছিল।

সৈকত বলল, যা হবার হয়েছে, ওসব কথা বাদ দিয়ে শাস্তি নেবার জন্য প্রস্তুতি নে। তারপর ফরিদার করুণ মুখের দিকে চেয়ে বলল, ভয় পাচ্ছিস নাকি? ভাই কি বোনকে কঠিন শস্তি দিতে পারে। যা বলছি মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করবি। আমার মনে হয় শাস্তিটা তোকে কষ্ট দেবে না। আমি তোর জন্য অনেক আগে থেকে একটা ছেলে চয়েস করে রেখেছি। ভাবছি কথাটা মামা-মামিকে এবার বলব। অবশ্য ছেলেটা এখনও লেখাপড়া করছে। আমার ইচ্ছা, এখন এনগেজমেন্ট হয়ে থাক, পড়াশুনা শেষ হবার পর বিয়ে হবে। ততদিনে তুইও ডাক্তার হয়ে যাবি। বলা যায় না ভালো ছেলে পেলে অন্য কোনো মেয়ের বাবা টোপ ফেলতে পারে। তুইও ছেলেটাকে চিনিস, আমার বন্ধু জহির। ওর মতো ছেলে পাওয়া আজকাল খুব দুষ্কর। তার সম্বন্ধে তোকে বেশি কি আর বলব। তোর সঙ্গে তো ভালোভাবেই পরিচয় আছে। ভেবে চিন্তে আমাকে জানাবি। যদি রাজি থাকিস, তা হলে মামা-মামির কাছে কথাটা পাড়ব।

ফরিদা কথাটা শুনে মাথা নিচু করে চিন্তা করল, জহির কি তাহলে সৈকত ভাইকে তার ভালোবাসার কথা বলেছে? না সৈকত ভাই নিজেই কথাটা বলেছে? ব্যাপারটা জানা দরকার। এখন তার জহিরের কথা ভাবতে ভালো লাগছে।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সৈকত আবার বলল, এক্ষুনি কিছু বলতে হবে না। বললাম না, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করে বলবি। আর একটা কথা, মনে হয় তুই বিশ্বনবী বইটার কিছু অংশ পড়েছিস। ওটা সঙ্গে নিয়ে যা। সবটা পড়িস। দেখবি ধর্মীয় অন্যান্য বই পড়ার প্রেরণা পাবি। আমার কাছে ঐসব বই অনেক আছে, সেগুলো নিয়ে পড়তে পারিস। ইসলাম ও মুসলমানদের সম্বন্ধে আমিও কিছু জানতাম না। আসিয়ার কথায় বিশ্বনবী পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম এবং আরও জানার জন্য ধর্মীয় বই অনেক কিনে পড়েছি।

ফরিদা খুব অবাক হয়ে বলল, কার কথা বললে?

সৈকত বলল, তোকে বলি বলি করেও বলা হয়নি। তোর ক্লাসমেট আসিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। সে একদিন বিশ্বনবী পড়ার কথা বলেছিল।

ফরিদা বুঝতে পারল, আসিয়ার সঙ্গে সৈকত ভাইয়ের নিশ্চয় কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তা না হলে তার কথায় এত ধর্মীয় বই কিনে পড়তে গেল কেন। জিজ্ঞেস করল, কতদিন আগে তার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে?

: তা বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল।

: কিন্তু সে তো খুব দাম্ভিক মেয়ে, তার সঙ্গে পরিচয় হলো কী করে?

: এমনি হঠাৎ একদিন হয়ে গেল আর কি? তুই যে বলছিস সে খুব দাম্ভিক, আসলে তা নয়। মেয়েটার গায়ের রং খুব কালো। তাই সে কারো সঙ্গে মিশতে চায় না।

: কিন্তু সেই কালো মেয়েটার সঙ্গে তুমিই বা পরিচিত হতে গেলে কেন?

: বললাম না হঠাৎ করে একদিন হয়ে গেল।

: পরিচয় হবার পর এখনও নিশ্চয় তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছ?

: তা রেখেছি।

: এতক্ষণে বুঝলাম, তার কথায় কেন ইসলামিক বই পড়তে শুরু করেছ।

: কী বুঝলি?

: পরে বলব, রাত হয়ে যাচ্ছে, চল খেয়েদেয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *