কল্কেকাশির কাণ্ড

কল্কেকাশির কাণ্ড

প্রফুল্ল গোড়া থেকেই বিষণ্ণ মেরে আছে। হ্যাঁ, ভারি তো কাজ! তার জন্যে আবার কল্কেকাশিকে তার ল্যাজে বেঁধে দেওয়া। হোন না গে তিনি একজন নামজাদা ডিটেকটিভ (প্রফুল্ল শুনেছিল কোরিয়া অঞ্চলে কল্কেকাশির মতো অতবড়ো গোয়েন্দা আর নেই নাকি!) তবু এই সামান্য একটা মশা মারার ব্যাপারে অত ভারী কামান কাঁধে বয়ে আনতে প্রফুল্লর আত্মসম্মানে ঘা লাগে বইকি। সত্যি বলতে, কামাস্কাটকা থেকে টাটকা উনি না এলেও কামটা কিছু আটকাত না।

বোম্বের একটা বিখ্যাত রেস্তোরাঁর এক কোণের টেবিলে কল্কেকাশির মুখোমুখি বসে গুম হয়ে এইসব কথাই সে ভাবছিল। সামনে সাজানো চপ-কাটলেট-ডেভিল-ডিম-কেক-পুডিং-এর সমারোহ সত্ত্বেও তার জিভ সরছিল না। বাস্তবিক এত বড়ো অপমান হজম করবার পর খেতে কারু রুচি থাকে?

কিন্তু মি. কল্কেকাশি বেপরোয়া। ডিশের পর ডিশ তিনি সাবড়ে চলেছেন— কাঁটা-চামচের তাঁর কামাই নেই। এক ফাঁকে সামনের ভদ্রলোকের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ে। এ কী! কল্কেকাশি একটু অবাকই হন। একজন খুনে একটার পর একটা দশটা খুন করেছে, নিজের চোখেই এ রকম দৃশ্য তাঁর জীবনে একাধিকবার তিনি দেখেছেন কিন্তু বিস্মিত হতে পারেননি। তাঁর এক আসামি তাঁর ট্রেন থেকে আর এক ট্রেনে, দুটোই বেশ চালু, লাফিয়ে পালিয়েছে চোখের ওপর দেখেও তিনি চমকাননি। কিন্তু এ ভদ্রলোক দশ-দশটা প্লেটের সামনে একেবারে নির্বিকার! একদম জগন্নাথ হয়ে বসে আছেন, একটাকেও কাবু করতে পারছেন না! তাঁর সুদীর্ঘ জীবনস্মৃতির মধ্যে এবম্বিধ কাণ্ড তাঁর স্মরণে পড়ে না।

বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে। কল্কেকাশির বিরাট বপু-পরিধির তুমুল আন্দোলন (অবশ্য খাবার সময়েই সবচেয়ে সেটা লক্ষণীয় হয়) অকস্মাৎ থেমে যায়; মাছের চোখের মতো ড্যাবডেবে চোখ ঈষৎ প্রসারিত হয়। ‘প্রফুল্লবাবুর প্রফুল্লতর হওয়ার পক্ষে কী বাধা হচ্ছে, জানতে পারি কি?’ তিনি প্রশ্ন করেন।

প্রশ্নটা করেন বাংলাতেই। সোজা পরিষ্কার বাংলায়। কামাস্কাটকার লোক হলে কী হবে, বাংলা, হিন্দি, (এবং কোনও কোনও জানোয়ারের ভাষাও) ভালোভাবেই তাঁর আয়ত্ত। তবে কামাস্কাটকার ভাষায় তাঁর দখল আছে কি না বলা যায় না। এ বিষয়ে প্রফুল্লর সন্দেহ থাকলেও পরীক্ষক হওয়ার সাহস তার হয় না। কেননা সে নিজেও কামাস্কাশিয়ানে অজ্ঞ, দারুণ নিরক্ষর। কোরিয়ার লোকরা কী করে যে এত পারদর্শী হয় কে জানে!

প্রফুল্ল আরও বেশি গম্ভীর হয়ে যায়; মাথা চুলকোতে চুলকোতে উত্তর দেয়, ‘ভাবনায় মশাই, ভাবনায়। কী রকম গুরুদায়িত্ব মাথার ওপরে, বুঝতেই তো পারছেন।’

‘বুঝতে পারছি বইকি’, কল্কেকাশি ঘাড় নাড়েন, ‘মি, ব্যানার্জির কবে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছবার কথা, অথচ তিনি কি-এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় বিলেতে আটকে গেছেন। তিনি আসতে পারলেন না। তাঁর সই করা নমিনেশন পেপার মেল-এ কাল বিকেলে বোম্বে পৌঁছেছে; তাঁর অ্যাটর্নি গলস্টোন কোম্পানির আপিসের জিম্মায় রয়েছে। সেই নমিনেশন পেপার আজই সঙ্গে নিয়ে কলকাতা ছুটতে হবে আমাদের। তবেই আঠারো তারিখের আগে সেই নমিনেশন পেপার ফাইল হতে পারবে। আঠারোই হচ্ছে ফাইলিং-এর শেষ দিন। তা না হলে মি. ব্যানার্জির আর কাউন্সিলে যাওয়া হবে না এযাত্রা।’

‘বিলেতে মি. ব্যানার্জির আকস্মিক দুর্ঘটনার মূলে কি কোনও রহস্যজনক কারণ আছে আপনি মনে করেন?’ প্রফুল্ল জিজ্ঞেস করে।

কল্কেকাশি এর জবাব দেন না। ‘এই নমিনেশন পেপার ডাকে পাঠানো নিরাপদ নয়। কোনও কারণে একদিন কিম্বা কয়েক ঘণ্টা লেট হলেই সমস্ত পণ্ড, তার চেয়েও বড়ো আশঙ্কা হচ্ছে নমিনেশন পেপার মারা যাওয়ার।’

‘মারা যাওয়ার?’ প্রফুল্লর চোখ ছানাবড়া হয়, ‘কেন, নমিনেশন পেপার মেরে কার কী লাভ? ওটা কি কোনও মার্তব্য বস্তু?’

‘হ্যাঁ, ডাকে পাঠালে, এমনকি রেজিস্ট্রি করে ইনসিওর করে পাঠালেও যথাস্থানে যথাসময়ে যথাযথ জিনিসটা পৌঁছবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে। কার কী লাভ আপনি জিজ্ঞাসা করছেন? বাংলাদেশে দুটি বড়ো দল আছে তা আপনি জানেন?

‘উঁহু,’ প্রফুল্ল বলে, ‘জানি না তো! না, দলাদলির কোনও খবর আমি রাখি না।’

‘এই দুটি দলই কাউন্সিলে ঢুকতে চায়। দু-দলে ভীষণ রেষারেষি। কাউন্সিলে যে দল ভারী হতে পারবে তাদেরই সারা বাংলায় আধিপত্য হবে কিনা। একটি দলের নাম হচ্ছে ফ্লু-ফ্লুকস-ফ্যান, যারা ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভোগে, রেস খেলে আর ফ্যানের তলায় হাওয়া খায় তারা মিলেই এই দল গড়েছে; আমেরিকার বিখ্যাত ক্লু-ক্লুকস-ক্ল্যানের সঙ্গে এদের কোনও সম্বন্ধ নেই, একমাত্র দুই নামের এই ধ্বনি মাহাত্ম্যর গোঁজামিল ছাড়া।’

‘বটে!’ প্রফুল্লর নিশ্বাস পড়ে কি পড়ে না! ‘আর-একটা দল কারা?’

‘মি. ব্যানার্জি হচ্ছেন এই ফ্লু-ফ্লুকস-ফ্যান-এর পাণ্ডা। অন্য দলের নাম হচ্ছে বাই হুক অর ক্রুক। এই বাই হুক অর ক্রুক পার্টির নেতা হচ্ছেন মি. সরকার। যেমন করেই হোক নিজেদের মতলব হাসিল করতে এঁরা সিদ্ধহস্ত।’

আপনি কি তাহলে বলতে চান যে সরকারি চালে মি. ব্যানার্জি বিলেতে আটকা পড়েছেন?

‘আপাতত আমি কোণের ওই লোকটার দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি।’ বলে কল্কেকাশি চোখ টিপে ইশারা করেন।

এতক্ষণে কল্কেকাশির ওপরে প্রফুল্লর কিঞ্চিত শ্রদ্ধার সঞ্চার হয়েছিল। সত্যি, অনেক খবর রাখেন ভদ্রলোক। এইজন্যে অপর দিক থেকে সহসা ‘তুমি’ সম্বোধনেও সে অপ্রসন্ন হতে পারে না, কল্কেকাশির ইঙ্গিতের অনুসরণ করে সে।

‘ওই যে কাঠখোট্টা-গোছের চেহারা, মাথার চুল ক্রপ করা, চোখে কুটিল চাহনি ওই কোণের ছোট্ট টেবিলে বসে অমলেটের সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি করছে— ওকে লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝতে পারবে। এরকম ফ্যাশনেবল রেস্তোরাঁয় গতিবিধি ওর স্বভাবসিদ্ধ নয়। কাঁটা-চামচের কসরতে এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। খাদ্যের সঙ্গে কাটাকাটি নয়, হাতাহাতিতেই ও পরিপক্ক। উনি এখানে এসেছেন তোমায় অনুসরণ করে।’ কল্কেকাশি জানান।

‘আমায়?” প্রফুল্লর বিশ্বাস হয় না, ‘তার মানে?’

‘একটু কায়দা করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে, চোখ ওমলেটের ওপর থাকলেও মনোযোগ ওর আমাদের দিকেই। কলকাতার একটি বিখ্যাত চিজ। ওর মতো কৌশলী এবং ভয়লেশহীন ভদ্র-গুণ্ডা আর দুটি আছে কি না সন্দেহ। ওই শ্রেণির ক্রিমিনাল ব্রেনের আমেরিকায় জোড়া মিলতে পারে, কিন্তু এদেশে দুর্লভ। মি. ব্যানার্জির পার্টি আমাকে যে তোমার সঙ্গে দিয়েছেন, উনিই হচ্ছেন তার একমাত্র কারণ।’

প্রফুল্লর সহজে বাকস্ফূর্তি হয় না, সমস্ত ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করবার চেষ্টা করে বলে, ‘ওর নাম?’

‘ওর নাম হচ্ছে সমাদ্দার ওরফে সমরেশ ঠাকুর ওরফে গোপাল হাজরা ওরফে নটবর রায় ওরফে পোড়া গণেশ ওরফে আরও এক ডজন। প্রেসিডেন্সি জেল আর হরিণবাড়ির ফেরত। আমার সঙ্গে ওর অনেক দিনের পরিচয়— অনেকটা হৃদ্যতার সম্বন্ধই বলতে পারো। এই কারণে আমাকে তোমার সঙ্গে দেখে ও একটু সংকোচ বোধ করছে, নইলে এতক্ষণে সে তোমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে একটুও দ্বিধা করত না।’

প্রফুল্ল চমকে ওঠে— ‘বলেন কী মশাই?’

‘এই রকমই।’ কল্কেকাশি যৎসামান্যই হাসেন। ‘সরকারের দল ওকে লাগিয়েছে তোমার পেছনে, ব্যানার্জির নমিনেশন পেপার নিয়ে তুমি যথাসময়ের আগে যথাস্থানে যাতে না পৌঁছতে পারো সেইজন্যেই। এজন্যে তোমাকে খুন করতেও ও পেছপা হবে না; তবে, কৌশলে কাজ উদ্ধার করতেও ভালোবাসে— খুনোখুনি করার তেমন পক্ষপাতী নয়। এ বিষয়ে একটু যেন সংকোচই আছে লোকটার।’

প্রফুল্ল আশ্বস্ত হতে পারে না, ‘আপনি কেন ওকে অ্যারেস্ট করছেন না তা হলে? গ্রেপ্তার করে ফেলুন! এই দণ্ডে— এক্ষুনি!’

‘এখন পর্যন্ত ও কোনও অপরাধ করেনি তো, কেবল মনের মধ্যে এঁচেছে মাত্র এবং মনের আঁচার জন্যেই যদি গ্রেপ্তার করা শুরু করতে হয় তা হলে এত লোককে ধরতে হয় যে জেলে তার জায়গা কুলোবে কি না সন্দেহ। কেবল মনের মধ্যেকার প্ল্যানের জন্যে কাউকে তো জেলে পোরা যায় না।’

‘তা হলে— তা হলে তো ভারি মুশকিল!’ প্রফুল্ল ভীতই হয়, ‘বেশ, আমাকে খুন করে ফেলবে তবে?’

‘যদি করেই ফেলে, তখন— হ্যাঁ, তখন ওকে হাতেনাতে ধরে ফেলতে আমার দেরি হবে না, নিতান্তই যদি পালিয়ে না যায়। তবে, সমাদ্দারের সঙ্গে হৃদ্যতারই সম্পর্ক; আমাকে দেখে অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরেও তোমাকে একেবারে খতম করবে এমন আমার মনে হয় না। ভয় কী তোমার?’

বিশেষ ভরসাও পায় না প্রফুল্ল।

‘এজন্যেই বলেছিলাম, ভয়ানক গুরুদায়িত্ব তোমার মাথায়। যদি নমিনেশন পেপার নিয়ে আঠারোই এগারোটার মধ্যে কলকাতায় না পৌঁছতে পারো তা হলে ব্যানার্জির আর কাউন্সিলে যাওয়া হল না— সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দলের দফাও রফা। মি. সরকারের দলেরই একছত্র আধিপত্য হবে কাউন্সিলে; মন্ত্রিসভা ইত্যাদিও দখল করে বসবেন তাঁরাই। সামান্য একটা সই করা কাগজের ওপরে একটা পার্টির কতখানি নির্ভর করছে ভেবে দেখো। সে ফের যে-সে পার্টি নয়, আদি ও অকৃত্রিম, ফ্লু ফ্লুকস ফ্যান।’

image4.jpg

‘অর্থাৎ আপনার ভাষায় যারা ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভোগে, রেস খেলে, রেসে ফ্লুকসের ঘোড়া ধরে ইত্যাদি। কিন্তু আমি তো এদের দলের কেউ নই। বিন্দুবিসর্গও জানি না। আমাকে এই মারাত্মক কাজে পাঠাবার মানে?’ প্রফুল্ল বিরক্তিই প্রকাশ করে।

‘তার মানে, তুমি যে-আপিসের কেরানি তার বড়োকর্তা ওই দলের একজন হোমরাচোমরা। তিনি তো ফ্যানের হাওয়া খান, তা হলেই হল। এসব কাজে অজ্ঞ এবং আনাড়িকে পাঠানোই হচ্ছে যুক্তিযুক্ত, নাড়িজ্ঞানওয়ালা লোক অনায়াসেই অন্য দলের ঘুস খেয়ে— বুঝতেই পারছ! তা ছাড়া, তোমার ওপর ওনাদের বিশ্বাস আছে। এত বড়ো দায়িত্বপূর্ণ কাজ তোমার ওপর দেওয়ায় সেটা প্রমাণ হয় না কি?’

‘আমার গায়ে জোরও যথেষ্ট!’ প্রফুল্ল কোটের হাতা তুলে মাসল কন্ট্রোল করে কল্কেকাশিকে দেখায়। ‘সহজে যে কেউ আমার কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নিতে পারবে তা আমার প্রাণ থাকতে নয়।’

‘এসো, সমাদ্দারের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই’— কল্কেকাশি প্রফুল্লকে আহ্বান করেন, ‘কী ছুতোয় যে গায়ে পড়ে তোমার সঙ্গে ভাব জমাবে ভেবে ভেবে কাহিল হয়ে উঠছে বেচারা।’

‘ওর সঙ্গে আলাপ!’ দারুণ বিস্মিত হয় প্রফুল্ল, ‘বলেন কী আপনি!’

‘ক্ষতি কী তাতে? গিলে ফেলবে না তোমায়।’ কল্কেকাশি প্রফুল্লকে টেনে নিয়েই চলেন, ‘এই যে সমাদ্দার! অনেক দিন পরে দেখা; ভালো আছো তো?’

সমাদ্দার চমকে ওঠে, ‘মি. কল্কেকাশি যে! এখানে এখন এইভাবে আপনাকে দেখতে পাব আশা করিনি।’

‘আমি কিন্তু আশা করেছিলাম। পরশু সন্ধ্যায় আমাদের বোম্বে মেল-এ তোমাকে যখন উঠতে দেখলাম—’

‘বটে?’ সমাদ্দার যেন একটু অপ্রস্তুত হয়, ‘আপনারা তা হলে আজ সকালেই বোম্বে পৌঁছেছেন? উনি আপনার বন্ধু বুঝি?’

‘হ্যাঁ, এই একটু আগেই পৌঁছলাম তো! নেমেই এই রেস্তোরাঁতেই প্রাতরাশের চেষ্টা করছিলাম। এমন সময়ে— হ্যাঁ, কী জিজ্ঞেসা করছিলে? ইনি? ইনি হচ্ছেন বাবু প্রফুল্লকুমার রায়— কেন যে এঁর বোম্বে আগমন তো তোমার ভালোমতোই জানা আছে ভাই!’

‘আমার?’ সমাদ্দার থতমত খায়, ‘না তো! তবে, ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলে বিশেষ আপ্যায়িত হব।’

‘তা তো হবেই! হওয়ার কথাই। বেশ, তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি আমার বন্ধু প্রফুল্লবাবু, আর ইনি হচ্ছেন মি. সমাদ্দার, আমার বন্ধুই। অন্তত আমার শত্রু নন। এঁর পরিচয় তো টেবিলে বসেই তোমাকে দিয়েছি। প্রফুল্ল, তুমি সমাদ্দারকে নমস্কার করলে না? প্রথম পরিচয়ে নমস্কার করাই তো ভদ্র রীতি।’

প্রফুল্ল আর সমাদ্দার বোকার মতো পরস্পরকে প্রতি-নমস্কার করে। ‘আপ্যায়িত হলাম প্রফুল্লবাবুর সঙ্গে আলাপিত হয়ে’ সমাদ্দার জানায়।

‘হবেই তো।’ কল্কেকাশি যোগ করেন, ‘নিশ্চয়! এইজন্যেই কি কলকাতা থেকে এতটা পথ তোমাকে আসতে হয়নি? বলো? ভাগ্যিস আমি ছিলাম এখানে! বন্ধুবান্ধবের উপকার করতে কখনই আমি পেছপা নই বলেই গায়ে পড়ে তোমাদের এই আলাপ করিয়ে দিলাম।’

‘সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে মি. কল্কেকাশি!’ সমাদ্দার বিস্ময়ের ভান করে, ‘কিন্তু আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘সত্যি বলছ? কল্কেকাশি আকাশ থেকে পড়েন। ‘আমার সঙ্গে তুমি জোচ্চুরি করবে বিশ্বাস করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না।’

‘সত্যি, আপনার কথার কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এখানকার একটা ফিল্ম স্টুডিয়োয় চাকরির চেষ্টাতেই আমার বোম্বে আসা।’

‘তাই নাকি? তবু তোমাকে বলে রাখছি, যদি তোমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকে তা হলে আমার কথাগুলো কাজে লাগবে। এখান থেকে প্রফুল্লবাবু যাবেন গলস্টোন কোম্পানির আপিসে। সেখানে তাঁর কী কাজ আছে। আমি অবশ্য ওঁর সঙ্গে যাচ্ছি না। আর একটা জরুরি খবর, আমরা উঠেছি তাজমহল হোটেলে১০। তারপর আজ রাত্রের গাড়িতেই ফিরছি আমরা কলকাতা। আচ্ছা, এখন আসা যাক, হোটেলেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হচ্ছে আশা করি?’

হতভম্ব সমাদ্দারের কাছ থেকে দুজনে বেরিয়ে আসে। প্রফুল্ল অসন্তোষ প্রকাশ করে— ‘মি. কল্কেকাশি! আপনি একজন খুব বড়ো গোয়েন্দা হতে পারেন—’

‘উঁহু, উঁহু, আদৌ না! এই বরাতের জোরেই যা করে খাচ্ছি ভাই!’

‘কিন্তু আপনি কি অনেক গুপ্ত খবর ওকে দিয়ে দিলেন না?’

‘কাকে? সমাদ্দারকে?’ কল্কেকাশি অবাক হন, ‘কী রকম গুপ্ত?’

‘এই, আমার গলস্টোন আপিসে যাওয়ার খবর, এবং তাজমহল হোটেলে আমাদের ওঠার কথা। তারপর আজ রাত্রেই কলকাতা মেলে ফেরা—’

‘কেন, কী হয়েছে তাতে? ওর কত কষ্ট লাঘব হয়ে গেল। কত সুবিধা করে দিলাম ওর! বেচারাকে এসব খুঁজে বের করতে আর হাঙ্গামা পোহাতে হবে না।’

‘সেটা কি ভালো হল?’ প্রফুল্ল বিরক্তি চাপতে পারে না।

‘আহা! বুঝতে পারছ না? যতই ওকে কম হাঙ্গামা পোহাতে হবে, ততই বেশি ও ভাববার সময় পাবে। আর যতই ও ভাবতে পারবে, ভাবিত হবে ততই নিজের কাজ মাটি করবে— তা জানো?’

অতঃপর প্রফুল্ল কল্কেকাশির কাছে বিদায় নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসে। একটু পরেই আর একখানা ট্যাক্সি প্রফুল্লর গাড়ির পিছু নেয়, এই ট্যাক্সিটা সমাদ্দারের। পরমুহূর্তেই আরও একখানা গাড়ি দূর থেকে দুজনকে অনুসরণ করে চলে; এ গাড়িতে আর কেউ নয়, স্বয়ং শ্রীযুক্ত কল্কেকাশি মহাশয়।

তিনখানি গাড়িই অনেক ঘুরেফিরে শহরের উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হয় চারধারে বাগান-ঘেরা প্রকাণ্ড এক বাড়ির ফটকে। গলস্টোন কোম্পানির বড়োসাহেবের রেসিডেন্স। প্রফুল্লর গাড়ি ফটকের ভেতর ঢোকে। একটু দূরে সমাদ্দারের গাড়ি থামে। কল্কেকাশির গাড়ি দ্বিতীয় গাড়ির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় যেতে যেতে অকস্মাৎ যেন থেমে যায়।

‘সমাদ্দারমশাইকে এখানে এ অবস্থায় দেখব আশা করতে পারিনি।’ কল্পেকাশি বলেন। তাঁর মুচকি হাসিটিও লক্ষ করবার।

‘এই, একটু শহর দেখতে বেরিয়েছি!’ সমাদ্দার থতমত খায়, ‘হাওয়া খেতেও বটে!’

‘শহর দেখতে শহরের বাইরে? মন্দ নয়! ফিল্ম-আর্টিস্টের কাজটা তোমার পাকা তা হলে!’ কল্কেকাশি গলা পরিষ্কার করেন, ‘আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম, যাচাই করে নিতেই এতদূর আসা। যাক, আমার কাজ আছে শহরেই আমি ফিরলাম।’ তারপর একটু হাসেন, ‘হ্যাঁ, হয়তো তোমার জানাই আছে, তবু খবরটা তোমাকে দিয়ে রাখাই ভালো। ওই বাড়িটাই মি. গলস্টোনের। ব্যানার্জির নমিনেশনের কাগজপত্র আনতে প্রফুল্লবাবু ওখানেই গেছেন। দ্যাখো চেষ্টা করে যদি তোমার বরাত খুলে যায়! বন্ধুবান্ধবের শুভাকাঙ্ক্ষা করাই আমার দস্তুর, জানোই তো ভায়া!’

কল্কেকাশির গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যে পথে এসেছিল সেই দিকেই ফিরে চলে। সমাদ্দার কোনও জবাব দিতে পারে না।

তারপরে আরও খানিকক্ষণ সমাদ্দারকে অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে প্রফুল্লর গাড়ি বাইরে বেরোয়। সমাদ্দারের আবার অনুসরণ। প্রফুল্লর ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় তাজমহল হোটেলের সামনে। সমাদ্দারেরও । প্রফুল্ল নেমেই ট্যাক্সিওয়ালার পাওনা চুকিয়ে সটান তেরো নম্বর ঘরে ঢুকেই খিল আঁটে। সমাদ্দার গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কী বন্দোবস্ত করে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে কল্কেকাশির অভ্যুদয় হতেই প্রফুল্ল রুদ্ধনিশ্বাসে ছুটে যায়— ‘সর্বনাশ হয়েছে, মি. কল্কেকাশি!’

কল্কেকাশি কিছুমাত্র বিচলিত হন না— ‘কী সর্বনাশ?’

‘সমাদ্দার এসে উঠেছে এখানে! আমাদের পাশের বারো নম্বর ঘরেই!’

‘তাই নাকি? তা হলে তো ওকে মধ্যাহ্নভোজনের আমন্ত্রণ করতে হচ্ছে। আমিও ওর শুভাগমন আশা করছিলাম।’

কল্কেকাশি রসিকতা করছেন, প্রথমটা প্রফুল্ল তাই ভেবেছিল, কিন্তু সত্যিই ডিনারের টেবিলে সমাদ্দারের পাশে বসে নিজের চক্ষু কর্ণকে ওর বিশ্বাস করতে হল। ওর চিরকালের ধারণা, গোয়েন্দায় আর বদমাইশে মুখোমুখি হলেই ঝটাপটি বেধে যায়। শেষোক্তরা স্বভাবতই পলায়নপর এবং প্রথমোক্তরা সর্বদাই ওদের পশ্চাদ্ধাবনে ব্যতিব্যস্ত। মাসিকপত্রের পাতায় আর গোয়েন্দা-গ্রন্থমালার কাহিনি পড়ে পড়ে এইরকমের একটা বিশ্বাস ওর বদ্ধমূল হয়েছিল। কিন্তু এখন ওদের পরস্পরকে অন্তরঙ্গের মতো কথাবার্তা কইতে দেখে তার সে ধারণা দস্তুরমতো টলে গেল।

মধ্যাহ্নভোজ প্রফুল্লর মাথায় উঠে গেল, মাঝে মাঝেই তার কোটের বুকপকেটে হাত পুরে গুরুতর বস্তুটির অস্তিত্ব অনুভব করতে লাগল। যে কাগজের টুকরোটির ওপর একটা পার্টির জীবনমরণ নির্ভর করছে তাকে সে যত্নের সহিত কোটের লাইনিঙের সঙ্গে সেলাই করে রেখেছে। জিনিসটার সেখান থেকে অকস্মাৎ উবে যাওয়ার কথা নয় কিছুতেই, তবু সে বারংবার যাচাই করে আপনাকেই যেন ভরসা দিতে চাচ্ছিল।

ওর হাতের কসরৎ কল্কেকাশির নজরে পড়ে একবার। তিনি হাসতে থাকেন— ‘ভয় নেই প্রফুল্লবাবু! ও নিরাপদেই আছে, এবং থাকবেও, যদি না তোমার কোট তুমি খোয়াও।’ কল্কেকাশির কথায় প্রফুল্লর ভারি রাগ হয়, তার মুখ লাল হয়ে ওঠে। কল্কেকাশি তা বুঝতে পারেন। ‘আমি কি কোনও গুপ্তকথা ফাঁস করে দিলাম নাকি? মোটেই না, প্রফুল্লবাবু! সমাদ্দার জানত যে কোথায় তুমি নমিনেশন পেপারটা রেখেছ। কি হে সমাদ্দার, জানতে না?’

সমাদ্দার সহাস্য মুখে ঘাড় নাড়ে— ‘নিশ্চয়ই! কোটের লাইনিং, ওইখানেই তো দামি জিনিস রাখবার জায়গা! সকলেই রাখে এবং সব্বাই জানে।’

গোয়েন্দা এবং বদমায়েশ দুজনে মিলে অকপটে হাসতে থাকে। প্রফুল্ল ভারি মুষড়ে পড়ে। হতে পারে কোটের লাইনিংই মূল্যবান কাগজপত্র রাখার একমাত্র জায়গা এবং সকলেই তা জানে, তবু কী দরকার ছিল মি. কল্কেকাশির সমাদ্দারকে এই খবরটা দেওয়ার? বরং যাতে সমাদ্দারের মনে এরকম সন্দেহ না জাগে বা জেগে থাকলেও তা দূর হয় সেই চেষ্টা করাই কি তাঁর উচিত ছিল না? কল্কেকাশির গোয়েন্দাপনায় সে ঘাবড়ে যায় সত্যিই।

যাক, প্রফুল্লর আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই। যতক্ষণ সে জেগে আছে ততক্ষণ তার কাছ থেকে কিছু— কোটের কোটরের বা তার বাইরের কিছু ছিনিয়ে নেওয়া কারও ক্ষমতার বাইরে— এবং রাত্রে, রেলগাড়িতে, হয় সে গা থেকে কোট খুলবেই না, আর খোলেও যদি বা, তা হলে বালিশের মতোই সেটাকে ব্যবহার করবে, সে ঠিক করে রাখল। তার ভারি সজাগ ঘুম, তার মাথার তলা থেকে কোট নেয় কার সাধ্য?

খাওয়া শেষ হলে কল্কেকাশি বলেন— ‘এসো সমাদ্দার, একটু দাবায় বসা যাক। প্রফুল্ল, জানো নাকি দাবা খেলা?’

‘জানি সামান্যই’—প্রফুল্ল মুখ গোঁজ করে বলে।

‘আমার আপত্তি নেই’— সমাদ্দার জবাব দেয়।

অল্পক্ষণের মধ্যেই খেলা বেশ জমে ওঠে। কল্কেকাশি ও সমাদ্দারের তো ভালোই জানা আছে; প্রফুল্লও নেহাত কম যায় না। ক্রমশই ওর উৎসাহ বাড়তে থাকে, সমাদ্দারের চাল কেড়ে নিয়ে নিজে চাল দেয়। প্রফুল্ল উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তার গরম বোধ হয়, সে কোট খুলে ফ্যালে— সমাদ্দারের উপস্থিতি সম্বন্ধে ওর হুঁশই নেই তখন। সমাদ্দারও নিজের কোট খোলে এবং প্রফুল্লর কোটের পাশেই রাখে। খেলা চলতে থাকে।

খানিক বাদে সমাদ্দার উঠে পড়ে— ‘প্রফুল্লবাবু, ভুল করে নিজের কোট ফেলে আপনার কোট নিয়ে গেছি, কিছু মনে করবেন না!’ কোট খুলতে খুলতে সে বলে।

প্রফুল্ল তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে নিজের কোট কেড়ে নেয়। যেখানে নমিনেশন পেপার ছিল সেখানটা অনুভব করে। পরমুহূর্তেই সে সমাদ্দারের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে উদ্যত হয়। কল্কেকাশি মাঝে পড়ে বাধা না দিলে তার বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে বদমায়েশটাকে হয়তো সেই দণ্ডেই টুঁটি টিপে খুন করে বসত!

‘প্রফুল্লবাবু করছ কী? কী ব্যাপার?

‘ওই চোর—’

‘আহা, গালাগালি কেন? কী হয়েছে?’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না! এই লোকটা এইমাত্র আমার কোট থেকে নমিনেশন পেপার চুরি করেছে।’

কল্কেকাশি তেমনই অবিচলিত থাকেন— ‘তাই নাকি হে সমাদ্দার? তাই নাকি?’

‘প্রফুল্লবাবু তো সেই রকমই ভাবছেন!’ সমাদ্দার বলে, ‘কিন্তু আমি নিজেই বুঝতে পারছি না কখন করলুম!’

সমাদ্দার উচ্চহাস্য করে, কল্কেকাশিও হাসতে থাকেন। প্রফুল্ল রেগে আগুন হয়ে ওঠে, কিন্তু একা সে কী করবে? আপন মনেই সে ফুলতে থাকে। আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটাই তার কেমন-কেমন ঠেকে। সমাদ্দার ও কল্কেকাশির মধ্যে যে রকম অন্তরঙ্গতা তাতে ওর নিদারুণ সন্দেহ হতে থাকে— ওরা দুজনে নিতান্তই মাসতুতো ভাই নয় তো?

‘তুমি যদি এক্ষুনি আমার কাগজ না ফিরিয়ে দাও তোমার হাড় ভেঙে আমি ছাতু করব’-প্রফুল্ল ঘুসি বাগিয়ে প্রস্তুত।

‘আহা, হচ্ছে কী এসব! মারামারি কী ভদ্রলোকের কাজ?’ কল্কেকাশি ওকে সামলাতে যান।

‘আপনি থামুন মশায়! আপনারা এক গোত্র! আমি বেশ বুঝেছি। গোড়াতেই ধরতে পেরেছিলাম, কিন্তু— সে যাক। আপনার কোনও কথা আমি শুনছি না আর!’ প্রফুল্ল মরিয়া হয়ে ওঠে।

এবার সমাদ্দার কথা বলে— ‘আপনি যদি আমার গায়ে হাত দেন প্রফুল্লবাবু, তা হলে আমি এক্ষুনি হোটেলের ম্যানেজারকে ডেকে আপনাকে পুলিশে দেব। আপনার কাগজ যে আমি নিয়েছি তার প্রমাণ কী?’

‘বেশ, আমি তোমাকে সার্চ করব! তোমার কামরাও!’

‘স্বচ্ছন্দে। এক্ষুনি।’ সমাদ্দার কল্কেকাশির দিকে ফেরে, ‘আপনিও কি সার্চ করতে চান মশাই? আসুন আমার সঙ্গে, আমার আপত্তি নেই!’

‘বাজে কাজে সময় নষ্ট করি না আমি’— কল্কেকাশি একটা সিগারেট ধরান। ‘তুমি যদি সত্যিই ও-কাগজ নিয়ে থাকো সমাদ্দার, তা হলে এখন তোমাকে সার্চ করে কোনও লাভ নেই। কোথায় তুমি তা রেখেছো তাই যদি ভেবে বার করতে পারি, তা হলে তা পেতে আমার বিলম্ব হবে না।’

‘আপনি কি তা হলে সার্চ করতে প্রস্তুত নন?’ প্রফুল্ল এবার ক্ষেপে ওঠে।

‘উহুঁ!’ কল্কেকাশির সংক্ষিপ্ত জবাব। ‘আপাতত না।’

‘বেশ, আমি নিজেই করব তা হলে।’

প্রফুল্ল সমাদ্দারের ঘরে যায়, ওর আপাদমস্তক অনুসন্ধান করে, সবগুলো জামার ভেতরের বাইরের সমস্ত পকেট হাতড়ায়, কোটের যাবতীয় লাইনিং পরীক্ষা করে; অবশেষে মুহ্যমানের মতো যখন নিজের কামরায় ফেরে তখনও কল্কেকাশি জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। মুখ না ফিরিয়ে তিনি বলেন— ‘তখনই বললাম, প্রফুল্লবাবু! এখন ওকে সার্চ করে কোনোই ফল নেই। কোথায় ও জিনিসটা সরিয়েছে যতক্ষণ তাই না আন্দাজ করতে পারছি—’

সমাদ্দার ফিরতেই কল্কেকাশির কথায় বাধা পড়ে। প্রফুল্ল কোনও জবাব দেয় না। নিজের মধ্যে নিজেই সে নেই তখন, এতই সে দমে গেছে।

‘তবে সত্যি বলতে কী, দোষ তোমার নিজেরই প্রফুল্লবাবু! তুমিই বলো, তোমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল কি না?’ কল্কেকাশি তাঁর কথাটা শেষ করেন।

কিন্তু এ-কথায় প্রফুল্লর এখন আর সান্ত্বনা কোথায়? সে গুম হয়ে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

কল্কেকাশি সমাদ্দারকে বলেন— ‘ভারি দমিয়ে দিয়েছ তুমি বেচারাকে! ওর মুখ দেখলে মায়া হয়!’

সমাদ্দার ঘাড় নাড়ে। স্বভাবতই সে কোমল-হৃদয়, সত্যিসত্যিই দুঃখ হয় তার। ‘বিজনেস, মিস্টার কল্কেকাশি’ সে বলে ‘ভারী কড়া জিনিস।’

‘সেকথা হাজার বার। কিন্তু ভেবে দেখো দিকি কী সর্বনাশ হল ওর! হয়তো চাকরিই থাকবে না আর। ও তো ভেঙে পড়েছেই, আমিও খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না।’ কল্কেকাশি সমাদ্দারের চোখের ওপর চোখ রাখেন— ‘কাগজখানা রাখলে কোথায় হে সমাদ্দার?’

সমাদ্দার হাসে— ‘আমি যে রেখেছি আমি তো তা স্বীকারই করিনি।’

‘না। এবং তোমাকে স্বীকার করতে বলছিও না। কিন্তু এ কথাও ঠিক, ও-কাগজ নিয়ে সটকাতে পারছ না তুমি। হাওড়ায় নেমেই আমি তোমাকে আটকাব এবং খানাতল্লাশি করাব— যাকে বলে পুলিশের খানাতল্লাশি।’

সমাদ্দার আতঙ্কিত হয়। ‘সেটা কি সঙ্গত হবে মি. কল্কেকাশি? কাগজখানা যে আমার কাছে তার বিন্দুমাত্র প্রমাণও আপনি পাননি।’

‘না পাই। কিন্তু কাগজখানা আমি পেতে চাই।’

কল্কেকাশির সংকল্প শুনে সমাদ্দারের শঙ্কা হয়। সে তৎক্ষণাৎ নিজের ঘরে যায়, গিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে। অনেক ভেবে সে একটা উপায় আবিষ্কার করে। দরজায় খিল আঁটে। তারপর নিজের সুটকেস বার করে এক কোণের একটা গুপ্ত বোতাম টেপে, তার ফলে ডালার দিকে একটা লুকানো খুপরি খুলে যায়। তার ভেতর থেকে সদ্য অপহৃত নমিনেশন পেপার বেরিয়ে পড়ে।

সমাদ্দার কাগজটা পরীক্ষা করে। সেই সঙ্গে আর একখানা অনুরূপ নমিনেশন পেপারও। দ্বিতীয় কাগজখানা ফাঁকা, এখানা তাকে দেওয়া হয়েছিল আসল কাগজ চেনার সুবিধার জন্য। সমাদ্দার দ্বিতীয় কাগজের যথাস্থানে প্রথম কাগজের দেখাদেখি ব্যানার্জির সই নকল করে বসিয়ে দেয়। হঠাৎ দেখলে মনে হবে একই কাগজ, হুবহু একই সই, কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করলেই এ সইটা যে জাল-করা তা স্পষ্টই ধরা পড়ে যাবে।

অবশেষে জাল কাগজখানা গুপ্ত ডালার মধ্যে এঁটে রেখে, আসল কাগজটা একখানা লেফাফায় ভরে। খামের ওপরে লেখা মি. সরকারের নাম আর ঠিকানা। কাগজটা সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয় দেখে, রেজিস্ট্রি করে পাঠানোই সে সমীচীন মনে করে। ডাকে গেলেও তার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় পৌঁছাবে এবং একেবারে তার নিয়োগকর্তার স্বহস্তেই, সুতরাং তার অসুবিধের কিছু নেই। তারপর দরজায় তালা লাগিয়ে, কাছাকাছি পোস্ট অপিসের উদ্দেশ্যে সে রওনা হয়।

প্রফুল্ল ঘরে ঢোকে। আপন মনেই যেন কয়, ‘দরজায় তালা লাগিয়ে সমাদ্দারকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম।

‘তাই নাকি?’ কল্কেকাশি সিগারেটের ভুক্তাবশেষটা ছুঁড়ে ফেলে দেন, ‘তা হলে তো ওর ঘরটা একবার তল্লাশ করতে হয়। এই তো সেরা সুযোগ।’

সব-খোল-চাবির সাহায্যে সহজেই তালা খুলে যায়। প্রফুল্লকে নিয়ে তিনি ঢোকেন।

‘কোথায় কোথায় তুমি খুঁজেছিলে?’

তদুত্তরে প্রফুল্ল তার অনুসন্ধান-বৃত্তান্ত ব্যক্ত করে।

‘এই সুটকেসটা দেখেছিলে?

হ্যাঁ। ওর ভেতরেও দেখেছি।

ওখানে নেই।

‘দেখেছ ঠিকই, তবু আরেকবার দেখা যাক।’

কল্কেকাশি সুটকেসটাকে উন্মুক্ত করেন, ভেতরের যা কিছু জিনিসপত্র সব তাঁর পায়ের গোড়ায় উজাড় হয়।

‘দেখলেন তো! বললাম ওতে নেই!’ প্রফুল্ল বলে।

কল্কেকাশি ওর কথায় কান দেন না। খুঁজতে খুঁজতে সেই গুপ্ত বোতাম বেরিয়ে পড়ে। ‘পেয়েছি প্রফুল্লবাবু, এতক্ষণে পেয়েছি।’

‘কী?’

‘এই দ্যাখো।’ চাবি টিপতেই সেই লুকানো ডালা প্রকাশ পায়। তার মধ্যে একটা লম্বা লেফাফা। লেফাফাটা না খুলেই তিনি প্রফুল্লর হাতে দেন। ‘এই নাও। কিন্তু সাবধান, আবার যেন না খোয়া যায়।’

প্রফুল্ল কম্পিত হাতে লেফাফা খোলে। কাগজখানা দেখেই সে লাফিয়ে ওঠে। তারপর দুহাতে কল্কেকাশির একখানা হাত চেপে ধরে— ‘আপনাকে সন্দেহ করেছিলাম, আমাকে মাফ করুন—’

উত্তরে কল্কেকাশির শুধু একটু মৃদু হাসি দেখা যায়। সমস্ত জিনিস যথাযথ রেখে তেমনি তালা এঁটে তাঁরা বেরিয়ে আসেন।

সমাদ্দার হোটেলে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকেই, তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে কল্কেকাশির কাছে। ‘এটা কি ভালো কাজ আপনার মশাই? আমার অবর্তমানে আমার ঘরে ঢুকে সুটকেস খুলে—’

কল্কেকাশি বাধা দেন— ‘আমরাই যে তোমার সুটকেস খুলেছি তার কী প্রমাণ তুমি পেয়েছ? প্রমাণ ছাড়া তুমি তো চলো না সমাদ্দার!’

প্রফুল্ল এতক্ষণে মন খুলে হাসতে পারে।

সমাদ্দার গজরাতে থাকে, ভয়ানক রাগের ভান করে, কিন্তু সেও মনে মনে হেসে নেয়।

আর মি. কল্কেকাশি? তাঁর মুখে হাসির কোনও চিহ্ন দেখা যায় না।

সমাদ্দার চলে গেলে প্রফুল্ল মুখ খোলে— ‘একবার বাগাতে পেরেছে, আর পারবে না। এ-কোট আমি আর গা থেকে খুলছি না। রাত্রেও নয়।’

‘ঠেকে শেখা ভয়ানক শেখা প্রফুল্লবাবু’ কল্কেকাশি ঘাড় নাড়েন, ‘এবং সেটা একবারই একটা মানুষের পক্ষে যথেষ্ট।’

‘আচ্ছা মি. কল্কেকাশি, সুটকেশটায় যে একটা গোপন খুপরি আছে কী করে আপনি বুঝলেন?’

‘তোমার কোটের লাইনিং আছে যেমন করে সমাদ্দার বুঝেছিল।’ কল্কেকাশি ব্যাখ্যা করে দেন— ‘ও থাকতেই হবে। তোমার কি ডিটেকটিভ উপন্যাস একেবারেই পড়া নেই প্রফুল্লবাবু?’

প্রফুল্ল নিজের বিদ্যাবত্তা জাহির করতে লজ্জা পায়। একেবারেই যে এক-আধখানা ওর পড়া নেই তা নয়, তবু সে সসঙ্কোচেই বলে— ‘এবার থেকে পড়ব কিন্তু।’

কলকাতা ফেরার পরদিনই, কল্কেকাশি সমাদ্দারের আড্ডায় গিয়ে আবির্ভূত হন। ‘আসতে পারি ভেতরে?’

‘আসুন, আসুন! আমার কী সৌভাগ্য, আপনি এসেছেন!’ সমাদ্দার শশব্যস্ত হয়ে ওঠে।

‘সরকারদের কাছ থেকে টাকাটা পেয়ে গেছ তো?’ কল্কেকাশি জিজ্ঞাসা করেন।

‘হ্যাঁ, কালই দিয়েছে। নগদ পাঁচটি হাজার’, সমাদ্দার উত্তর দেয়, ‘কেন, কী হয়েছে তার?’

‘না, এমন কিছু না।’ কল্কেকাশি তাঁর হাতঘড়ির দিকে তাকান। ‘এখন দশটা, আর এক ঘণ্টা পরেই প্রেসিডেন্সি কোর্টে নমিনেশন পেপার সব দাখিল হবে কিনা তার আগেই তোমাকে আমি কেটে পড়তে বলি। নেহাত বন্ধু হিসেবেই বলতে এসেছি অবশ্যি।’

‘কেটে পড়ব? আমি? কেন?’ সমাদ্দার সচকিত হয়। —’কাটব কেন?’

‘সরকারদের পার্টির কাছ থেকে ফাঁকি দিয়ে টাকা নিয়েছ এইজন্যে। ওদের হাতে খুনে গুণ্ডার তো কমতি নেই, যাদের তুলনায় তুমি আস্ত দেবশিশু!’

‘ফাঁকি দিয়ে নিয়েছি কী রকম?’ সমাদ্দার হাসে এবার, ‘আপনি কি এখনও বুঝতে পারেননি, মিস্টার কল্কেকাশি, আমার সুটকেস থেকে যে কাগজ আপনি বের করে নিয়েছিলেন তা আসলে জাল-সই করা?’

‘আগাগোড়াই তা আমি জানতাম।’ কল্কেকাশির গলার স্বর গম্ভীর।

‘তবে?’

‘আসলে একটা কথা তুমি নিজেই এখনও বুঝতে পারনি, সমাদ্দার। প্রফুল্লর পকেট থেকে যে কাগজ তুমি বাগিয়েছিলে সেটাও জাল ছাড়া কিছু না।’

‘য়্যা?’ এবার সত্যিই চমকে ওঠে সমাদ্দার। ‘তাই নাকি?’

‘নিশ্চয়! যে সময়ে তুমি সেই বাগানবাড়ির গেটে প্রফুল্লর জন্যে অপেক্ষা করছিলে সেই সময়ে আমি শহরে ফিরে গলস্টোন কোম্পানির আপিস থেকে আসল কাগজখানা হস্তগত করি। স্টেশনে নেমেই গলস্টোন সাহেবকে ফোন করে রেখেছিলাম যাতে সাহেবের বাড়ি থেকে প্রফুল্লকে একখানা নকল নমিনেশন পেপার দেওয়া হয়— এখন সব বুঝতে পারছ তো? যাতে তোমার নজর একেবারেই আমার ওপর না পড়ে সেইজন্যেই আমার এত কাণ্ড করা। প্রফুল্লকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া এবং সবকিছু। অমন মূল্যবান কাগজ আমি নিতান্ত অবহেলাভরে আমার এই কোটের পকেটে করে নিয়ে এসেছি, ইচ্ছেমতো জামা খুলেছি, রেখেছি তুমি তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারনি। প্রফুল্লও তা জানে না। কোনোদিন জানবেও না। যাক, বেচারা আনন্দেই রয়েছে, ওর বেতন বেড়ে গেছে খবর পেলাম’—

***

টীকা

 ১. কোরিয়া: চিন, রাশিয়া এবং জাপানের মধ্যবর্তী অংশে, কোরিয়ান পেনিনসুলায় অবস্থিত কোরিয়া বর্তমানে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ এই দুটি দেশে বিভক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে দুই মহাশক্তি, সোভিয়েত রাশিয়া অধিকৃত কোরিয়ার উত্তরাঞ্চল উত্তর কোরিয়া এবং আমেরিকার দখলে থাকা দক্ষিণ অংশ দক্ষিণ কোরিয়া হিসেবে চিহ্নিত। উত্তরের রাজধানী পিয়ং ইংয়ং, দক্ষিণের সিওল বা সোল। ৯১৮ স্টাব্দ থেকে ১৩৯২ স্টাব্দ পর্যন্ত গোণ্ডরেয় (Goguryeo) বা গোয়েয় (Goryeo) রাজবংশ কোরিয়া অঞ্চল শাসন করেন। তাদের রাজ্যের নামও ছিল গোরেয়। সেই থেকে কোরিয়া নামের উৎপত্তি। কোরিয়া এবং জাপানের মধ্যে জাপান সাগর অবস্থিত। বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে কোরিয়া ছিল জাপানের পদানত। জাপানি অধিকার থেকে কোরিয়া মুক্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে।

২. কামস্কাটকা: রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত অঞ্চল। নাম কামচাটকা ক্রাই (Kamchatka Krai) রাশিয়ার একটি রাজ্য হিসেবে গণ্য হয়। রাজধানী পেট্রোপাভলোভসু-কামচাটস্কি। আয়তন প্রায় ৪,৭২,৩০০ বর্গ কিলোমিটার।

৩. নমিনেশন পেপার: বাংলা অনুবাদে মনোনয়ন পত্র। ভোটে দাঁড়াতে হলে যে ফরমে দস্তখত করে জমা দিতে হয়।

৪. অ্যাটর্নি: অ্যাটর্নি অ্যাট ল’র সংক্ষিপ্ত রূপ। বিভিন্ন দেশে উকিলদের অ্যাটর্নি বলা হত। অনেক দেশে এখনও বলা হয়। ১৮৭৩ সাল থেকে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এবং ইংল্যান্ডের অধীনস্থ দেশগুলিতে অ্যাটর্নির বদলে সলিসিটর অভিধা প্রচলিত হয়। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সরকার উকিলকে এখনও অ্যাটর্নি জেনারেল বলা হয়। ইংল্যান্ডের প্রথা অনুসারে অ্যাটর্নি বা সলিসিটাররা আদালতে শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন না। সেই কাজ করেন ব্যারিস্টাররা।

৫. গলস্টোন কোম্পানি: যেহেতু ইংরেজ পদবির শেষে কখনও ‘স্টোন’ বা ‘স্টন’ থাকতে দেখা যায়, যেমন গ্ল্যাডস্টোন, জনস্টন, সেই সুযোগে গলস্টোন নামটির ব্যবহার নিছকই একটি শিব্রামী মজা। গলস্টোন শব্দের অর্থ পিত্তকোষ বা গলব্লাডারের পাথর।

৬. লেজিসলেটিভ কাউন্সিল বা বিধান পরিষদ। পরশুরামের ‘দক্ষিণরায়’ গল্পে দেখা যায় বকুলাল দত্ত এবং তাঁর বন্ধু রামজাদু অ্যাটর্নিকে কাউন্সিলে ঢোকার জন্য তদ্বির করতে এবং ভোটে দাঁড়াতে।

৭. ক্লু ক্লুকস ক্ল্যান: আসলে কু ক্লুকস ক্লান। Ku Klux Klan। সংক্ষেপে KKK। মার্কিন সংস্থা। প্রথম উদ্ভব ১৮৬০ এর দশকে। এরা হল শ্বেতাঙ্গদের প্রভুত্বে বিশ্বাসী। কৃষ্ণাঙ্গদের বিরোধী। আমেরিকায় বহিরাগতদের প্রবেশের বিরোধী। কখনও কমিউনিজমের বিরোধিতা করতে দেখা গিয়েছে। এদের বিরোধিতার পন্থা কখনও উগ্র ধরনের। এদের সদস্যরা মুখোশ এবং আলখাল্লা ব্যবহার করে সংস্থার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের সময়ে। বেশিরভাগ অনুষ্ঠান রহস্যময় এবং গোপনে সংঘটিত হয়। প্রথম উদ্ভবের বছর দশেক পরে এই সংঘ বা সংস্থা নিজেদের গুটিয়ে নেয় এবং অনেক পরে, ১৯১৫ নাগাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪-এ আবার নির্জীব হয়ে পড়ে এদের কর্মকাণ্ড। তৃতীয়বার এই সংঘ উদ্ভুত হয় ১৯৪৬-এ এবং এখনও এদের উপস্থিতির খবর পাওয়া যায়। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। আমেরিকায় অনুষ্ঠিত বহু বড়ো অপরাধের মূলে রয়েছে কু-ক্লুকস ক্ল্যানের সদস্যরা।

৮. প্রেসিডেন্সি জেল : ১৭৬৭-র কলকাতায় ছিল দুটি জেলখানা। একটি লালবাজারে, অন্যটি বড়োবাজারে, ১৭৭৮-এ নতুন জেল নির্মাণ করা হয় প্রেসিডেন্সি জেনারেল হসপিটালের কাছাকাছি। ১৮৬৫ সাল থেকে এই জেলের নাম হয় প্রেসিডেন্সি জেল। ১৯০৯ সালে আলিপুর নতুন কারাগার তৈরি হয় এবং তারপর পুরোনো জেলখানা ভেঙে ফেলা হয়েছিল ওই জায়গায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল নির্মিত হওয়ার কারণে।

৯. হরিণবাড়ি: কলকাতার প্রাচীন জেলখানা। প্রচলিত ব্যবহারে, যে-কোনো কারাগার বোঝানো হয়। বৌবাজার অঞ্চলে একটি রাস্তার নাম হরিণবাড়ি লেন। অধুনালুপ্ত হরিণবাড়ি জেল ওই রাস্তাতেই অবস্থান করত। আবার সুন্দরবনে, কাকদ্বীপের কাছাকাছি হরিণবাড়ি নামে একটি গ্রাম আছে।

১০. তাজমহল হোটেল: মুম্বই শহরে, আরব সাগরের তীরবর্তী, অ্যাপোলো বন্দরের সন্নিকটে, গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার কাছে অবস্থিত পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী বিলাসবহুল হোটেল। প্রতিষ্ঠাতা স্যর জামশেদজী টাটা। সম্পূর্ণ নাম ‘দ্য তাজমহল প্যালেস অ্যান্ড টাওয়ার’। এই পাঁচতারা হোটেল খোলা হয় ১৯০৩ এর ষোলোই ডিসেম্বর। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে স্যর জামশেদজী এই হোটেল খোলেন শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত ওয়াটসন’স হোটেলে প্রবেশাধিকার না পেয়ে, প্রতিশোধস্পৃহা বশত। কিন্তু এই গল্প অনেকেই সত্যি বলে মনে করেন না। সীতারাম খাণ্ডেরাও বৈদ্য এবং ডি এন মির্জার নক্সায় ইন্দো-সেরাসনিক স্থাপত্যরীতিতে মূল প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল। টাওয়ারটি নির্মিত হয় ১৯৭০-এর দশকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হোটেলের বাড়িটি ব্যবহৃত হয়েছিল ছ’শো শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হিসেবে। ভারতের প্রথম বাষ্প-চালিত লিফট-টি এই হোটেলে বসানো হয়। একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, আমেরিকান ফাস্ট লেডী, নরওয়ের রাজা ও রানি, ইংল্যান্ডের রাজপরিবারভুক্ত মানুষ, হলিউডের অভিনেতা, দেশি ও বিদেশি খেলোয়াড় প্রভৃতি এই হোটেলে অতিথি হিসেবে থেকেছেন বিভিন্ন সময়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *