আশা মিটিবার নহে। মানুষের মনের আশা পূর্ণ হইবার নহে। ঘটনার সূত্রপাত হইতে শেষ পর্যন্ত অনেকের মনে অনেক প্রকারের আশার সঞ্চার হয়। আশার কুহকে মাতিয়া, অনেকে পথে অপথে ছুটিয়া বেড়ায়। ঘটনাচক্রে যতদূর গড়াইয়া লইয়া যায়, তাহাতেই বোধ হয় যেন পূর্ব আশা পূর্ণ হইল। এই পূর্ণ বোধ হইতে হইতে দুই তিন চারি, এমন কি, পঞ্চ প্রকারে আশা পঞ্চাশ ভাগে পঞ্চাশৎ বিভাগে ঘটনা-লিপ্ত মানুষের হৃদয়াকাশে সচঞ্চল চপলার ন্যায় ছুটিতে থাকে,-খেলিতে থাকে। জীবনের সহিত আশার সম্বন্ধ। আকাঙ্খার নিবৃত্তি আশার শান্তি, জীবনের ইতি, এই তিনেই এক, আবার একেই তিন। সুতরাং জীবন্ত দেহে মনের আশা মিটিবার নহে। আশা মিটিল না, মোহাম্মদ হানিফার মনের আশা পূর্ণ হইল না।
যুগল অশ্ব বেগে ছুটিয়াছে। এজিদের অশ্ব অগ্রেই রহিয়াছে। হানিফার মনের আশা, এজিদকে না মারিয়া জীবন্ত ধরিবেন, পূর্ব প্রতিজ্ঞানুসারে তাঁহাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিবেন,-কিন্তু তাহা পারিতেছেন না। এজিদ্ অশ্ব চালনায় পরিপক্ব, প্রাণের দায়ে পথ, অপথ, বন, জঙ্গল মধ্য দিয়া অশ্ব চালাইতেছে। পলাইতে পারিলেই রক্ষা-কিন্তু পারিতেছে না। হানিফাকে দূরে ফেলিয়া আত্মগোপন করিতে সক্ষম হইতেছে না, সেই সমান ভাব। যাহা কিছু প্রভেদ-অগ্র আর পশ্চাৎ। এজিদ্ প্রাণপণে অশ্ব চালাইতেছে, কিন্তু হানিফাকে দূরে ফেলিয়া তাঁহার চক্ষুর অগোচর হওয়া দূরে থাকুক, হস্তস্থিত তরবারির অগ্রভাগ হইতে সূচ পরিমাণ স্থানও অগ্রে যাইতে পারিতেছে না। সূর্যতেজ কমিতেছে, মোহাম্মদ হানিফার রোষও বাড়িতেছে। যতই ক্লান্ত ততই রোষের বৃদ্ধি।
মোহাম্মদ হানিফা অশ্ব বল্গা দন্তে ধারণ করিয়া এজিদকে ধরিবার নিমিত্ত দুই হস্ত বিস্তার করিয়াছেন। দুল্দুল্ প্রাণপণে দৌড়িতেছে, কিন্তু ধরিতে পারিতেছেন না। এই ধরিলেন, এই বারেই ধরিবেন আর একটু অগ্রসর হইলেই ধরিতে পারিবেন, অশ্ব হইতে চ্যুত করিবেন। কিন্তু কিছুতেই পারিতেছেন না।
এজিদ্ প্রাণভয়ে পলাইতেছে। অন্য কোন কথা সে সময়ে মনে উদয় হইবার কথা নহে। প্রাণ বাঁচাইবার পন্থাই নানা প্রকারে মনে মনে আঁটিতেছে। আর একটা কথাও বেশ বুঝিতেছিল যে, মোহাম্মদ হানিফা তাহার প্রাণবধের ইচ্ছা করিলে, বহুপূর্বে শেষ করিতে পারিতেন, অথচ তাহা করিতেছেন না। মন ডাকিয়া বলিতেছে, “এজিদ্কে হানিফা ধরিবেন, মারিবেন না। প্রাণে মারিবেন না। হইতে পারে, এজিদের উপর অস্ত্র নিক্ষেপ নিষেধ। এ দুয়ের এক না হইয়া এরূপভাবে বীরের সম্মুখে-বীরের অস্ত্রের সম্মুখ হইতে এতক্ষণ পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকা সৌভাগ্যের কথা। এখন কোন উপায়ে ইহার চক্ষুর অগোচর হইতে পারিলেই রক্ষা। হানিফা চিরদিন দামেস্কে বাস করিবেন না। এই সন্ধ্যা পর্যন্ত যমের হস্ত হইতে বাঁচিতে পারিলেই প্রাণ বাঁচে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই প্রকার ঘোরা ফেরা করিয়া কাটাইতে পারিলেই আর ভয়ের কারণ নাই। আমার পরিচিত ও হানিফার অপরিচিত দেশ এবং পথ। আমি অনায়াসেই অন্ধকারে চলিতে পারিব। আজিকার অস্তই আমার শুভ অস্ত, জীবন রক্ষার একমাত্র উপায়।”
এই সকল চিন্তা শ্রেণীবদ্ধরূপে যে এজিদের মনে উদয় হইয়াছিল তাহা নহে। প্রাণান্ত সময়ের পূর্ব লক্ষণ, ক্ষণকাল বিকার, ক্ষণকাল অজ্ঞান, ক্ষণকাল ঘোর অচৈতন্য, ক্ষণকাল সজ্ঞান। সেই সজ্ঞান সময়টুকুর মধ্যে ঐরূপ চিন্তার ঢেউ সময়ে সময়ে এজিদের মনে উঠিতেছিল। এজিদ্ হস্ত হইতে অশ্ববল্গা ছাড়িয়া দিয়া-সজোরে কশাঘাত করিতে লাগিল। এখন আর দিগ্বিদিক্ জ্ঞান নাই। অশ্বের স্বেচ্ছাধীন গতিই তাহার গতি। অশ্বের মনোমত পথই তাহার বাঁচিবার পথ-আর দক্ষিণ বামে ফিরাইয়া পলাইবার চেষ্টা করিতেছে না। ঘোড়া আপন ইচ্ছামত ছুটিয়াছে।
হানিফা কিঞ্চিৎ দূরে পড়িলেন। উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিতে লাগিলেন-“এজিদ্! হানিফার হস্ত হইতে আজ তোমার নিস্তার নাই। কিন্তু এজিদ্! এ অবস্থায় তোমায় প্রাণে মারিব না, জীবন্ত ধরিব। তোমার খণ্ডিত শিরের ধরালুণ্ঠিত ভাব, শিরশূন্য দেহের স্বাভাবিক ক্রিয়ার দৃশ্য,-হানিফা একা দেখিতে ইচ্ছা করে না। বিশেষ বীরের আঘাত চারি চক্ষু একত্র করিয়া। আমি কাপুরুষ নহি যে, তোমার পশ্চাদ্দিক হইতে অস্ত্র নিক্ষেপ করিব। হানিফার অস্ত্র আজ পর্যন্ত কাহারো পৃষ্ঠদেশে নিক্ষিপ্ত হয় নাই, অগ্রে চক্ষে ধাঁধা না লাগাইয়া অদৃশ্যভাবে কাহারো শরীরে প্রবেশ করে নাই। তুমি মনে করিয়ো না যে তোমার পিছনে থাকিয়া পৃষ্ঠে আঘাত করিব। তুমি জঙ্গলে যাও, পাহাড়ে যাও, হানিফা তোমার সঙ্গ ছাড়া নহে।”
এজিদ্ হানিফার রক্তমাখা শরীর প্রতি একবার মাত্র দৃষ্টি করিয়াছে, একবার মাত্র চারি চক্ষু একত্র হইয়াছে। এজিদ্ হানিফার দিকে দ্বিতীয়বার চাহিতে সাহসী হয় নাই। কিন্তু সে রক্তজবা সদৃশ আঁখি, রক্তমাখা তরবারি তাহার চক্ষের উপর অনবরত ঘুরিতেছে, হৃদয়ে জাগিতেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে প্রাণ কাঁপিতেছে। আতঙ্কে দক্ষিণে বামে দেহ দুলিতেছে, কোন কোন সময়ে সম্মুখে ঝুকিতেছে। অশ্ব চালনে বিশেষ পরিপক্বতা হেতুতেই আসন টলিতেছে না।
মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় উচ্চৈঃস্বরে বীরবিক্রমে বলিতে লাগিলেন, “এজিদ্! বহু পরিশ্রমের পর তোর দেখা পাইয়াছি। কখনোই চক্ষের অন্তরাল হইতে পারিবি না। তুই জানিস্, হানিফার বল বিক্রম প্রকাশের আজই শেষ দিন। আজই হানিফার ক্রোধাঙ্কের শেষ অভিনয়। আজই বিষাদের শেষ,-বিষাদ-সিন্ধুর শেষ,-তোর জীবনের শেষ। ঐ দেখ, সূর্য অস্ত যায়। এই অস্তের সহিত কত অস্তের যে যোগ আছে তাহা কে বলিতে পারে? আমি দেখিতেছি, তিন অস্ত একত্রে মিশিবে, এক সঙ্গে একযোগে ঘটিবে-তোর পরমায়ু, দামেস্কের স্বাধীনতা এবং উপস্থিত সূর্য। চাহিয়া দেখ্, যদি জ্ঞানের বিপর্যয় না ঘটিয়া থাকে, তবে চাহিয়া দেখ্ গমনোন্মুখ সূর্য কেমন চাক্চিক্য দেখাইয়া স্বাভাবিক নিয়ম রক্ষা করিতেছে, নির্বাণোন্মুখ দীপও ঐরূপ তেজে জ্বলিয়া উঠে। প্রাণবিয়োগ সময়ে শয্যাশায়ী রোগীর নাড়ীর বলও ঐরূপ সতেজ হয়। তোর কিঞ্চিৎ অগ্রসরতাও তাহাই। আর বিলম্ব নাই। যে একটুকু অগ্রসর হইয়াছিস্ সে বাঁচিবার জন্য নহে, মরিবার জন্য। মরুভূমিতে ঘুরিয়াছ, বনে প্রবেশ করিয়াছ, পর্বতে উঠিয়াছ, চক্ষু হইতে সরিয়া যাইতে কত চক্রই খেলিয়াছ, সরিতে পার নাই,-হানিফার চক্ষে ধূলি দিয়া চক্ষের অন্তরাল হইতে সাধ্য নাই। এখন নিকটে বন জঙ্গল নাই যে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া বাঁচিয়া যাইবি। তুই নিশ্চয় জানিস, এই রঞ্জিত অসি, তোর পরিশুষ্ক হৃদয়ের বিকৃত রক্তধারে আবার রঞ্জিত করিব। সূর্যরাগে মিশাইয়া উভয় অস্ত একত্র দেখিব। তুই যাবি কোথা? তোর মত মহাপাপীর স্থান কোথা?”
অশ্বারোহী যদি বাগডোরে জোর না রাখে, ঘোড়ার ইচ্ছানুযায়ী গতিতে যদি বাধা না দেয় তবে অশ্বমাত্রই আপন বাসস্থানে ছুটিয়া আসিতে চেষ্টা করে। এজিদ্ নিরাশ হইয়া হস্তস্থিত অশ্ববল্গা ছাড়িয়া দিয়াছে। কোথায় যাইবে কি করিবে, কোন্ পথে কোথায় গেলে পশ্চাদ্ধাবিত যমের হস্ত হইতে রক্ষা পাইবে, স্থির করিতে না পারিয়াই তুরঙ্গ-গতিস্রোতে অঙ্গ ভাসাইয়া দিয়াছে। রাজ অশ্ব রাজধানী অভিমুখেই ছুটিয়াছে। দামেস্ক এজিদের রাজ্য। পথ ঘাট সকলই পরিচিত, রাজধানী অভিমুখে অশ্বের গতি দেখিয়া, তাহার নিরাশ হৃদয়ে নূতন একটি আশার সঞ্চার হইল-রাজপুরীমধ্যে যাইতে পারিলেই রক্ষা। মনের ব্যগ্রতায় এবং প্রাণের মায়ায় আকুল হইয়া দুই হস্তে অশ্বে কশাঘাত করিতে লাগিল। রাজপুরী-মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিলেই যেন প্রাণ বাঁচাইতে পারে। যুগল অশ্ব বেগে দৌড়িতে থাকুক, এই অবসরে এজিদের নূতন কথাটা ভাঙ্গিয়া বলি।
হজরত মাবিয়ার লোকান্তর গমনের পর, এজিদ্ মারওয়ানের মন্ত্রণায় দামেস্কপুরী সংলগ্ন উদ্যান মধ্যে, ভূগর্ভে এক সুন্দর পুরী নির্মাণ করিয়াছিল। এ গুপ্তপুরীর প্রবেশদ্বারও এমন সুন্দর কৌশলে নির্মিত হইয়াছিল যে, উদ্যানালঙ্কার নিকু ভিন্ন, দ্বার বলিয়া কেহই নির্ধারণ করিতে পারিত না। যে সময়ের অপেক্ষায় ঐ পুরী আজ সেই সময় উপস্থিত। এজিদের প্রিয় পরিজন, আত্মীয়-স্বজন প্রাণভয়ে সকলেই ঐ গুপ্তপুরীর মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে। তাহার প্রমাণও পূর্বে পাওয়া গিয়াছে। যেখানকার যে জিনিস সেইখানেই পড়িয়া আছে, জনপ্রাণী মাত্র নাই। কোথায় যাইবে, শত্রু-সেনাপরিবেষ্টিত পুরীমধ্য হইতে কোথায় পলাইবে? ঐ গুপ্তপুরীই প্রাণরক্ষার উপযুক্ত স্থান। এজিদের মনে সেই আশা। সে নীরস হৃদয়ক্ষেত্রে এ একমাত্র আশা-বীজের নব অঙ্কুর। পুরীর কথা মনে পড়িতেই পরিবার-পরিজনের কথা মনে হইয়াছে। কিঞ্চিৎ আশ্বস্তও হইয়াছে। রাজপুরী পরহস্তগত হইলেও পরিবার-পরিজন কখনোই পরহস্তগত হইবে না। দামেস্কপুরী তন্নতন্ন করিলেও তাহাদের বিষাদিত কায়া চক্ষে পড়া দূরে থাকুক, ছায়া পর্যন্ত নজরে আসিবে না। এখন উদ্যান পর্যন্ত যাইতে পারিলেই আর পায় কে? লতা-পুষ্প-ছড়িত কু পর্যন্ত যাইতে পারিলেই হানিফা দেখিবেন যে, এজিদ্ লতাপাতায় মিশিয়া গেল, পরমাণু আকারে পুষ্প-রেণু সহিত মিশিয়া পুষ্প-দলে ঢাকিয়া ফেলিল। যাহাই হউক, উদ্যান পর্যন্ত যাইতে পারিলেই এজিদের জয়। নগরও নিকটবর্তী, এজিদ্ জন্মের মত দামেস্ক নগরের পতন দৃশ্য দেখিয়া চলিল। দেখিতে দেখিতে নগরের সুরঞ্জিত সিংহদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল। দ্বার অবারিত, প্রহরী বর্জিত! মৃতদেহে রাজপথ পরিপূর্ণ। শবাহারী পশুপক্ষিগণ মহা আনন্দিত। চক্ষের পলকে দ্বার পার হইয়া নগরে প্রবেশ করিল। রাজপুরী চক্ষে পড়িতেই দেখিল, উচ্চ উচ্চ মঞ্চে নানা আকারে নূতন পতাকাসকল নগরস্থ লোহিত আভায় মিশিয়া অর্ধচন্দ্র এবং পূর্ণতারা প্রত্যক্ষভাবে দেখাইয়া দামেস্কের পতন-দৃশ্য দর্শকগণকে দেখাইতেছে, বিজয়-বাজনা তুমুল বেগে কর্ণে আসিতেছে। ক্রমেই নিকটবর্তী, রাজপুরী অতি নিকটে। বন্দিগৃহ দূর হইলেও দৃষ্টির অদূর নহে। চক্ষে পড়িল। এজিদের চক্ষে দামেস্কের বন্দিগৃহ পড়িতেই মন যেন কেমন করিয়া চমকিয়া উঠিল। এমন সঙ্কট সময়েও এজিদের মন যেন কেমন করিয়া উঠিল। যে রূপ হৃদয়ের নিভৃত স্থানে লুকাইয়া ছিল, সরিয়া আসিল। কিন্তু বেশিক্ষণ রহিল না। চিত্তক্ষেত্র হইতে সে রূপরাশি একেবারে সরিয়া গেল। নামটি মনে উঠিল, মুখে ফুটিল না, দীর্ঘ-নিশ্বাসও বহিল না। প্রমাণ হইল-প্রমদা অপেক্ষা প্রাণের দায়ই সমধিক প্রবল। এই সামান্য অন্যমনস্কতায় অশ্বগতি কিঞ্চিৎ শিথিল হইল।
মোহাম্মদ হানিফা এই অবসরে ঐ পরিমাণ অগ্রসর হইয়া গভীর-গর্জনে বলিতে লাগিলেন, “এজিদ্ মনে করিয়াছ যে, পুরীমধ্যে প্রবেশ করিলেই আজিকার মত বাঁচিয়া যাইবে। তাহা কখনোই মনে করিও না। এই সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বলিতে জ্বলিতে তোমার জীবন-প্রদীপ নির্বাণ হইবে। তোমার পক্ষে দামেস্ক-রাজপুরী এইক্ষণ সাক্ষাৎ যমপুরী। কি কি আশায় সে দিকে দৌড়িয়াছ? দেখিতেছ না? উচ্চ মঞ্চে কাহার নিশান উড়িতেছে, দেখিতেছ না? রে নরাধম! তুই সেই এজিদ্ যে আরবে সর্বপ্রধান বীর হাসানকে কৌশল করিয়া মারিয়াছিস্! ওরে! তুই কি সেই পামর, যে সীমার দ্বারা হোসেনের মস্তক কাটাইয়া লক্ষ টাকা পুরস্কার দিয়াছিলি?”
মোহাম্মদ হানিফা ক্রোধে অধীর হইয়া অশ্বে কশাঘাত করিলেন। দ্রুতগতি অশ্বপদ শব্দে পুরজনগণ চমকিয়া উঠিলেন। বিজয় বাজনা, আনন্দ রোল, জয়রবের কোলাহল ভেদ করিয়া, অশ্ব-শব্দ মহাশব্দে সকলের কর্ণে প্রবেশ করিল। যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, শশব্যস্ত হইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে সিংহদ্বার দিকে ছুটিলেন। এজিদ্ অশ্ব হইতে প্রথমে উদ্যান, শেষে পুষ্পলতাসজ্জিত নিকু দেখিয়া একটু আশ্বস্ত হইল।
মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি মহারথিগণ, কেহ অশ্বে কেহ পদব্রজে দ্রুতপদে অসি-হস্তে আসিতেই হানিফা উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতৃগণ! ক্ষান্ত হও! দোহাই তোমাদের ঈশ্বরের-ক্ষান্ত হও। এজিদ্ তোমাদের বধ্য নহে। বাধা দিয়ো না। এজিদের গমনে বাধা দিয়ো না। এজিদের প্রতি অস্ত্র-নিক্ষেপ করিয়ো না।”
মোহাম্মদ হানিফার কথা শেষ হইতে-না-হইতেই, এজিদ্ একলম্ফে অশ্ব হইতে নামিয়া উদ্যান অভিমুখে চলিল। হানিফাও ত্রস্তভাবে দুল্দুলের পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিয়া অসিহস্তে এজিদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িলেন! এজিদ্ যথাসাধ্য দৌড়িয়া উদ্যানস্থ নির্দিষ্ট নিকুঞ্জ মধ্যে যাইয়া ফিরিয়া তাকাইতেই দেখিলেন, মোহাম্মদ হানিফাও অতি নিকটে। বিকৃত এবং ভগ্নস্বরে বলিল, “হানিফা ক্ষান্ত হও। আর কেন? তোমার আশা তোমার প্রতিজ্ঞা, তোমার মুখেই রহিল, এজিদ্ চলিল।” এই কথা বলিয়াই এজিদ্ গুপ্তপুরী প্রবেশদ্বার-কূপ-মধ্যে প্রবেশ করিল।
মোহাম্মদ হানিফা রোষে অধীর হইয়া, “যাবি কোথা, নরাধম।” এই কথা বলিয়া বীর-বিক্রমে হুঙ্কার ছাড়িয়া অসি হস্তে কূপমধ্যে লম্ফ দিবার উপক্রমেই বজ্রনাদে শব্দ হইল, “হানিফা! এজিদ্ তোমার বধ্য নহে।”
মোহাম্মদ হানিফা থতমত খাইয়া ঊর্ধ্বদিকে চাহিতেই প্রভু হোসেনের তেজোময় ছায়া দেখিয়া চমকিয়া পিছে হটিলেন এবং ভয়ে চক্ষু বন্ধ করিলেন।
পুনরায় গভীর নিনাদে শব্দ হইল, “হানিফা ক্ষান্ত হও, এজিদ্ তোমার বধ্য নহে।”
মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় চক্ষু মেলিয়া তাকাতেই দেখিলেন, মহা অগ্নিময় মহাতেজ অসংখ্য শিখা বিস্তারে সহস্র অশনিপাত সদৃশ বিকট শব্দ করিয়া নিকু মধ্যস্থ কূপমধ্যে মহাবেগে প্রবেশ করিল। এজিদের আর্তনাদে উদ্যানস্থ পক্ষিকুল বিকট কণ্ঠে ভয়ে ডাকিয়া উঠিল, বাসা ছাড়িয়া, শাখা ছাড়িয়া, দিগ্বিদিকে উড়িয়া বেড়াইতে আরম্ভ করিল। ভূকম্পনে তরুলতা সকল ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। গাজী রহমান, মসহাব কাক্কা, ওমর আলী, আক্কেল আলী প্রভৃতি উপস্থিত ঘটনা দেখিয়া নির্বাকে হানিফার পশ্চাতে দণ্ডায়মান রহিল। মোহাম্মদ হানিফার ভাব ভিন্ন। মুখাকৃতি বিকৃত অথচ হিংসায় পরিপূর্ণ। হৃদয় হিংসানলে দগ্ধীভূত। স্থিরনেত্রে ঊর্ধ্বমুখ হইয়া দণ্ডায়মান। তরবারি-মুষ্টি দক্ষিণ হস্তে, অগ্রভাগ বামস্কন্ধে স্থাপিত।
আবার দৈববাণী, “হানিফা! দুঃখ করিয়ো না। এজিদ্ কাহারো বধ্য নহে। রোজ কেয়ামত (শেষ দিন) পর্যন্ত এজিদ্ এই কূপে-এই জ্বলন্ত হুতাশনে জ্বলিতে থাকিবে, পুড়িতে থাকিবে, অথচ প্রাণ বিয়োগ হইবে না।”
মোহাম্মদ হানিফা চমকিয়া উঠিলেন। তরবারির অগ্রভাগ স্কন্ধ হইতে মৃত্তিকা স্পর্শ করিল। অশ্ব বল্গা বামহস্তে ধরিয়া বলিতে লাগিলেন, “এজিদ্ আমার বধ্য নহে। আর কি করিব? ইচ্ছা করিলে এক তীব্র তীরে নরাধমের কলিজা পার করিতে পারিতাম; হৃদয়ের রক্তধারে তরবারির দ্বারাই নারকীয় দেহ দুই খণ্ডে বিভক্ত হইত। তাহা করি নাই। চক্ষে চক্ষে সম্মুখে সম্মুখে না যুঝিয়া, অস্ত্রের চাক্চিক্য না দেখাইয়া কাহারো প্রাণসংহার করি নাই। ইহজীবনে কাহারো পৃষ্ঠে আঘাত করি নাই। এজিদ্ পৃষ্ঠ দেখাইল। আর অস্ত্রের আঘাত কি? জীবন্ত ধরিব, সকলের সম্মুখে ধরিয়া আনিব, একত্র একসঙ্গে মনের আগুন নির্বাণ করিব, তাহা হইল না। মনের আশা মিটিল না। এত পরিশ্রম করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। এখন কি করিব? প্রিয় গাজী রহমান! ভাই মস্হাব! হানিফার মনের আগুন নিবিল না। আশা পূর্ণ হইল না! কী করি?”
এই বলিয়া মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় অশ্বে আরোহণ করিলেন,-চক্ষের পলকে উদ্যান হইতে বাহির হইলেন। গাজী রহমান মহাসঙ্কটকাল ভাবিয়া মসহাব কাক্কা, ওমর আলী প্রভৃতিকে বলিলেন-“ভাবিয়াছিলাম, আজই বিষাদের শেষ। ভাবিয়াছিলাম, আজই বিষাদ-সিন্ধু পার হইয়া সুখ-সিন্ধুর সুখতটে সকলে একত্র উঠিব, বোধ হয় তাহা ঘটিল না। শীঘ্র আসুন! বিলম্ব করিবেন না, আমি ভবিষ্যৎ বড়ই অমঙ্গল দেখিতেছি, আম্বাজাধিপতির মতি গতি ভাল বোধ হইতেছে না। শীঘ্র অশ্বে আরোহণ করুন। বড়ই কঠিন সময় উপস্থিত, দয়াময়ের লীলা বুঝিয়া উঠা মানুষের সাধ্য নহে।”