মদ্যপায়ীর সুখে-দুঃখে সমান ভাব। সকল অবস্থাতেই মদের প্রয়োজন। মনকে প্রফুল্ল করিতে, মনের দুঃখ দূর করিতে; মনে কিছুই নাই অর্থাৎ কালি নাই, বালি নাই, ময়লা নাই, একেবারে সাদা-সে সময়ও মদের প্রয়োজন। গগনে শুকতারা দেখা গিয়াছে-প্রভাত নিকটে। এজিদের চক্ষে ঘুম নাই, ক্রমে পেয়ালা পূর্ণ করিতেছে, উদরে ঢালিতেছে। কিছুতেই মন প্রফুল্ল হয় না, আনন্দও জন্মে না-মনের চিন্তাও দূর হয় না। ঐ কথা-ঐ ওমর আলীর নিষ্কৃতির কথা-জয়নালের নিরুদ্দেশের কথা-মধ্যে মধ্যে আবদুল্লাহ্ জেয়াদের খণ্ডিত শিরের কত কথা মনে পড়িতেছে,-পেয়ালা চলিতেছে। ক্রমেই চিন্তার বেগ বৃদ্ধি, পূর্বকথা স্মরণ। প্রথম সূচনা-পরে অনুতাপের সহিত চক্ষে জল। আবার পাত্র পরিপূর্ণ হইল। এজিদ্ পাত্রহস্তে করিয়া একটু চিন্তার পর উদরে ঢালিল,-জ্বলন্ত হৃদয় জ্বলিয়া উঠিল, মনের গতি মুহূর্তে পরিবর্তন হইল,-মুখে কথা ফুটিল। “কেন হেরিলাম? সে জ্বলন্ত রূপরাশির প্রতি কেন চাইলাম? হায়! হায়!! সেই এক দিন, আর আজ এক দিন! কী প্রমাদ! প্রেমের দায়ে কী না ঘটিল! কত প্রাণ-ছি! ছি! কত প্রাণ বিনাশ হইল! উহুঃ কী কথা মনে পড়িল। সে নিদারুণ কথা কেন এখন মনে হইল! আমি সীমার-রত্ন হারাইয়াছি, অকপটমিত্র জেয়াদ-ধনে বঞ্চিত হইয়াছি। এখন মারওয়ান, ওত্বে অলীদ এবং ওমর-এই তিন রত্ন জীবিত; কিন্তু শত্রুমুখে বক্ষঃবিস্তারে দাঁড়ায় কে? ওমর বৃদ্ধ, মারওয়ান বাক্চাতুরিতে পটু, বুদ্ধি চালনায় অদ্বিতীয়, অস্ত্রচালনায় একেবারে গণ্ডমূর্খ। বল-ভরসা একমাত্র ওত্বে অলীদ। অলীদেরও পূর্বের ন্যায় বলবিক্রম নাই, মস্হাব কাক্কার নামে কম্পমান। কাক্কার নাম শুনিলে সে কি আর যুদ্ধে যাইবে? যুদ্ধ কিসের? কার জন্য যুদ্ধ? এ যুদ্ধ করে কে? কি কারণে যুদ্ধ? জয়নাল আবেদীন কোথা-এ কথার উত্তর কি?”
আরো একপাত্র হইল। আবার কোন চিন্তায় মজিল, কে বলিবে? মুখে কথা নাই-নীরব! অগ্নির দাহনকারিতা, জলের শীতলত্ব, প্রস্তরের কাঠিন্য, আর মদের মাদকতা কোথায় যাইবে? আবার সাধ্যাতীত হইলেও সুরা মহাবিষ।
মায়মুনা ও জায়েদার অঙ্গীকার পূর্ণ পর্বোপলক্ষে, পাঠকগণ এজিদের সুরাপান দেখিয়াছেন। সে সময়ে এজিদের চক্ষে জল পড়িয়াছিল, এখন এজিদের চক্ষে জল নাই। বিশাল বিস্ফারিত যুগল চক্ষে এখন আর জল নাই। কিছু যে না-আছে তাহা নহে, তরলতায় বেশি প্রভেদ বোধ হয় নাও থাকিতে পারে, কিন্তু বর্ণে একেবারে বিপরীত-টক্টকে লাল, জবাফুল পরাস্ত। তাহাতেই বলিতেছি, এজিদের চক্ষে জল নাই। যদি পড়িবার হয়, যদি এজিদের অক্ষিদ্বয় হইতে এইক্ষণে কিছু পড়িবার থাকে, তবে কী পড়িবে? সে রক্তজবা সদৃশ লাল চক্ষু হইতে এইক্ষণে কী পড়িবে? না-না-না, সে জল নহে! যে দুই-এক ফোঁটা পড়িবে সেই দুই-এক ফোঁটা জল নহে। জল হইবার কথা নহে। মর্মাঘাতের আঘাতিত স্থানের বিকৃত শোণিত-ধার, মর্মাঘাতের ক্ষত স্থানের রক্তের ধার দুই চক্ষু ফাটিয়া পড়িবে! জগৎ দেখিবে, এজিদের চক্ষে জল পড়ে নাই। এজিদ্ও দেখিবে তাহার চক্ষু জলে পরিপূর্ণ হয় নাই-সে বিশাল নেত্রযুগল হইতে আজ জলধারা প্রবাহিত হয় নাই। হৃদয়ের বিকৃত শোণিত-ধার চক্ষু দ্বারে বহির্গত হইয়া, সে পাপ-তাপ অংশের তেজ কথঞ্চিৎ পরিমাণ হ্রাস বোধ জন্মাইবার জন্যই বোধ হয়, যদি পড়িতে হয়, দুই-এক ফোঁটা পড়িবে। বিশাল বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয় ঘোর রক্তিমা বর্ণ ধারণ করিয়াছে, তেজ ফুটিয়া বাহির হইতেছে, চক্ষু তারা লোহিত সাগরে হাবুডুবু খেলিতেছে। আজ অপাত্রের হস্তে পাত্র উঠিয়াছে। সুরপ্রিয় অনন্তসুধা মূর্খ হস্তে পড়িয়া মহাবিষে পরিণত হওয়ার উপক্রম হইয়াছে। আবার পেয়ালা পূর্ণ হইল। চক্ষের পলকে চক্ষুদ্বয় আরো লোহিত হইল। মস্তক অপেক্ষাকৃত ভারী, পদদ্বয় বেঠিক। মানসিক ভাব বিলীন, পশুভাব জাগ্রত। বাক্শক্তির শক্তি বৃদ্ধি, কিন্তু অযৌক্তিক-অস্বাভাবিক এবং অসঙ্গতভাবেই পূর্ণ-মনে মুখে এক।
এজিদ্ বলিতেছে-সুরাপূর্ণ পেয়ালা হস্তে করিয়া বারবার পেয়ালার দিকে চাহিতেছে আর বলিতেছে, “এ স্বর্গীয় সুরা ধরাধামে কে আনিল? এ যন্ত্রণা নিবারক, মনোদুঃখাপহারক, মনস্তাপ-বিনাশক, প্রেমভাব উত্তেজক, ভ্রাতৃভাব সংস্থাপক, ষড়রিপু সংহারক, নবরস উদ্দীপক, দেহকান্তি পরিবর্ধক, কণ্ঠস্বর প্রকাশক, এই নবগুণ বিশিষ্ট অমৃত ধরাধামে কে আনিল? মরি মরি! আহা মরি মরি! এ স্বর্গীয় অমৃত ধরাধামে কে আনিল? অহো করুণা! অহো দয়া! কথা বলিব? মনের কথা বলিব, সত্য কথা বলিব?
পরিপূর্ণ পাত্র আবার মুখে উঠিল, গলাধঃ হইল, জ্বলিতে জ্বলিতে পাকযন্ত্র পর্যন্ত যাইল, তখনই শেষ-পাত্রের শেষ। এজিদ মত্ততায় অধীর হইয়া মনের কপাট খুলিয়া দিয়াছে, অকপটে মনের কথা প্রকাশ করিয়া দশজনকে শুনাইতেছে। “আজ উচিত পথে চলিবে। সীমার মরিয়াছে, ভালই হইয়াছে। বেশ হইয়াছে, (হস্তের উপর হস্ত সজোরে আঘাত করিয়া) বেশ হইয়াছে, যেমন কর্ম তেমনি ফল পাইয়াছে। হোসেন আমার শত্রু, (তেজের সহিত) তা’র কী? সীমারের কী? রে পাষণ্ড সীমার! তোর কী? তুই তাহার মাথা কাটিলি কেন? যে ব্যক্তি টাকার লোভে মানুষের মাথা কাটে, তার ঘাড়ে কি মাথা থাকিবে? (পেয়ালার প্রতি চাহিয়া) তার মাথা কাটা পড়িবে না? জেয়াদ্ গিয়াছে, মন্দ কী? বিশ্বাসঘাতকের ঐরূপ শাস্তি হওয়াই উচিত, যেমন কর্ম তেমনি ফল। আগে করেছে, পাছে ভুগেছে, শেষে জাহান্নামে গিয়াছে। এজিদের কি? বাহাদুরি করিয়া শত্রুর হস্তের বন্ধন খুলিয়া দিল কেন? সে হাতে মরণ নাই, সেই পরম সৌভাগ্য! ও যে বাহরাম নয়, হানিফার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা-আক্কেল আলী। আবার পাত্র-(নিঃশ্বাস ছাড়িয়া) সৈন্যদের কথা কিছুই নহে। বেতনভোগী চাকর, টাকা দিয়াছি, জীবন লইয়াছি। এজিদের জন্যই আমার মরণ-কেন জয়নাবকে এজিদ্ চক্ষু তুলিয়া দেখিল? কেন আবদুল জাব্বারকে প্রতারণা করিল? কেন মাবিয়ার বাক্য উপেক্ষা করিল? কেন নিরপরাধে মোস্লেমকে হত্যা করিল? কেন হাসানকে বিষপান করাইল? যে আমায় ভালবাসিল না, যে জয়নাব এজিদকে ভালবাসিল না, এজিদ তাহার জন্য এত করিল কেন? স্ত্রী-হস্তে স্বামী বধ! মানিলাম, এজিদের মনে ইহকাল ও পরকাল আগুন জ্বালাইয়া হাসান জয়নাব লাভ করিয়াছিল। হাসান মরিয়া গেল, এজিদের মনের আগুন জ্বলিতে থাকিল। জ্বলুক, আরো পুড়ুক জ্বলুক, শাস্তি ভোগ করুক। কিন্তু হোসেন কে? নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়াছিল, যত্নে রাখিয়াছিল। ছি! ছি! তাহারই জন্য সমর! ছি! ছি! তাহারই জন্য কারবালায় রক্তপাত। তাহাতেই-বা কী হইল? জয়নাব সেই প্রথম দর্শনেই এজিদকে যে চক্ষে দেখিয়াছিল আজিও সেই চক্ষে দেখিয়া থাকে, লাভের মধ্যে বেশির ভাগ ঘৃণা। থাক্-ও-কথা থাক্। হানিফার অপরাধ? আমি তাহার মাথা কাটিতে চাহি কেন? তওবা! তওবা! আমি কেন তাহার প্রাণ লইতে চাহি! আর একটি কথা বড় মূল্যবান্, এজিদের বন্দিগৃহে জয়নাল আবেদীন নাই। থাকিবে কেন? সে সিংহশাবক শৃগালের কুটীরে থাকিবে কেন? সে বীরের বেটা বীর, তীর না ছুঁড়িয়া থাকিবে কেন?”
এমন সময় সেনাপতি ওমর আসিয়া করজোড়ে বলিল, “বাদশা নামদার! প্রহরিগণ বলিতেছে, নিশীথ সময় প্রধানমন্ত্রী মারওয়ান এবং সৈন্যাধ্যক্ষ ওত্বে অলীদ ছদ্মবেশে শিবির হইতে বহির্গত হইয়াছেন। রাত্রি প্রায় প্রভাত হইয়া আসিল, তাঁহারা এখনো শিবিরে আসিলেন না। সন্ধানী অনুচরেরাও কোন সন্ধান করিতে পারে নাই, বোধ হয় তাঁহাদের কোন অমঙ্গল ঘটিয়া থাকিবে।”
এজিদ্ প্রসন্নমুখে, জড়িত রসনায়, আরক্তিম লোচনে বলিল, “পরকে-উঃ-পরকে ঠকাইতে গিয়াছিলেন, নিজেই ঠকিয়াছেন। আপনিও তো সেনাপতি। বলুন তো, ছলচাতুরি করিয়া কে কয়দিন বাঁচিয়াছে? সেনাপতি মহাশয়! একথা নিশ্চয় যে, তেজশূন্য শরীর, বলশূন্য হস্ত, সাহসশূন্য বক্ষ, বুদ্ধিশূন্য মজ্জা, ইহারাই সম্মুখ সমরে ভীত হইয়া ছদ্মবেশে চোরের ন্যায় শত্রুগৃহে প্রবেশ করে এবং শৃগালের ন্যায় শঠতা করিয়া কার্যোদ্ধারের পথ দেখে। ওমর! ভয় কি? কোন চিন্তা করিয়ো না। নিশাও শেষ, যুদ্ধের শেষ-আমারও শেষ। আর যাহার যাহার শেষ তাহাও বুঝিতে পার। তাই বলিয়া দামেস্করাজ যুদ্ধে ক্ষান্ত দিবেন না। বিন্দুপরিমাণ শোণিত থাকিতে দামেস্করাজ নিরাশ হইবেন না। মারওয়ান মারা গিয়াছে-ক্ষতি কি? তুমিই সেনাপতি; যদি মারওয়ান যমপুরী না গিয়া থাকে ভালই, উভয়েই সেনাপতি-উভয়েই মন্ত্রী। যুদ্ধনিশান উড়াইয়া দাও, রণবাদ্য বাজিতে থাকুক। মারওয়ান-অলীদ শিবিরে আসিলেও যুদ্ধ, না-আসিলেও যুদ্ধ। দেখ ওমর! তুমি নামমাত্র সেনাপতি, আজ মহারাজ স্বয়ং যুদ্ধে যাত্রা করিবেন! চিন্তা কী?”
অকস্মাৎ ভেরী বাজিয়া উঠিল। এজিদ্-শিবিরে যাহারা জাগিয়াছিল, তাহারা শুনিল, ভেরী বাজাইয়া বলিতেছে, “শিবিরে রক্ষকদের কৌশলে আজ নিশীথ সময়ে তিনজন লোক ধৃত হইয়া মোহাম্মদ হানিফার শিবিরে নজরবন্দি মতে কয়েদ আছে! যদি কাহারো ইচ্ছা হয়, যাচ্ঞা করিলে ভিক্ষাস্বরূপ আমাদের প্রভু তাহাদিগকে ছাড়িয়া দিতে সম্মত আছেন।”
শিবিরস্থ সকলেই ঘোষণা শুনিয়া আশ্চর্যান্বিত হইলেন। “আমাদের কেহই নহে! আমাদের শিবিরের তো কোন প্রভু নহে?” এইরূপ কথার আন্দোলন হইতে লাগিল। এজিদ্ মহামতিও স্বকর্ণে ঘোষণা শুনিল।
ওমর বলিল, “মহারাজ! অনুমানে কী বুঝা যায়?”
“তোমাদের প্রধানমন্ত্রী আর ওত্বে অলীদ।”
“তবে তিনজনের কথা কেন?”
“বোধ হয় মন্ত্রীবরের সহিত কোন সেনা গিয়া থাকিবে, কি শিবিরের অন্য কেহ হইবে। কী চমৎকার বুদ্ধি। হানিফার নিকট আমি ভিক্ষা করিব, ধিক্ এজিদে! অমন সহস্র মারওয়ান বন্দি হইলেও এজিদ্ কাহারো নিকট ভিক্ষা করিবে না। আমি প্রস্তুত, কেবল অস্ত্রধারণ করিতে বিলম্ব। ওমর! তুমি সৈন্যসহ যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করিয়া এক শ্রেণীতে সমুদয় সৈন্য দণ্ডায়মান করাইয়া দাও। আজ হানিফার প্রাণবধ না করিয়া ছাড়িব না। এখনই যুদ্ধ নিশান উড়াইয়া রণভেরী বাজাইয়া দাও।”
ওমর অভিবাদন করিয়া বিদায় হইল। “কেবল অস্ত্র লইতে বিলম্ব”-এই বলিয়া এজিদ্ ওমরকে বিদায় করিল। কিন্তু সুরার মোহিনীশক্তিতে তাহাকে শয্যায় শায়িত করিল! সুরে! আজ অপাত্রের হস্তে পড়িয়া দুর্নামের ভাগী হইলে, কুখ্যাতির ধ্বজা উড়াইয়া দিলে, অতি তুচ্ছ হেয় বলিয়া ভদ্র সমাজে অস্পৃশ্য হইলে, দশ বার বলিব, তোমারই কল্যাণে, তোমারই কুহকে, মহারাজ এজিদ্ যুদ্ধসাজে সজ্জিত না হইয়া শয্যাশায়ী হইল। যুদ্ধের আয়োজনই বা কী চমৎকার! সুরে! তোমারই প্রসাদে আজ এজিদের এই দশা! তুমি দূর হও, বীরের অন্তর হইতে দূর হও, জগতের মঙ্গলাকাক্সক্ষীর হৃদয় হইতে দূর হও-সমাজের হিতাকাক্সক্ষীর চিত্ত হইতে দূর হও, সংসারীর নয়নপথ হইতে দূর হও-দূর হও-তুমি দূর হও! জগৎ হইতে দূর হও।”