মানবের ভাগ্যবিমানে দুঃখময় কালমেঘ দেখা দিলে, সে দিকে কাহারো দৃষ্টি পড়ে না, ভ্রমেও কেহ ফিরিয়া দেখে না। ভাল মুখে দু’টি ভাল কথা বলিয়া তাহার তাপিত প্রাণ শীতল করা দূরে থাকুক, মুখ ফুটিয়া কথা কহিতেও ঘৃণা জন্মে, সে দিকে চক্ষু তুলিয়া চাহিতেও অপমান জ্ঞান হয়। সে উপযাচক হইয়া মিশিতে আসিলেও নানা কৌশলে তাড়াইতে ইচ্ছা করে। আত্মীয়-স্বজন, পরিজন ও জ্ঞাতি কুটুম্বের চক্ষেও দুর্ভাগার আকৃতি চক্ষুশূল বোধ হয়। একপ্রাণ, একআত্মা, হৃদয়ের বন্ধুও সে সময় সহস্র দোষ দেকাইয়া ক্রমে সরিতে থাকেন। দুঃখের সময় জীবন কাহার না ভারবোধ হয়? শনি-গ্রস্ত জীবের কোথায় না অনাদর? রাহু-গ্রস্ত বিধুর অপবাদই বা কত? ভবের ভাব বড়ই চমৎকার। কালে আবার সেই আকাশে,-সেই মানবের ভাগ্য আকাশে, মৃদু মৃদু ভাবে সুবাতাস বহিয়া কাল মেঘগুলি ক্রমে সরাইয়া সৌভাগ্য-শশীর পুনরুদয় হইলে, আর কথা নাই। কত হৃদয় হইতে প্রেম, প্রণয়, ভালবাসা, আদর, স্নেহ, যত্ন এবং মায়ার স্রোত প্রবাহ ধারা,-যাহা বল ছুটিতে থাকে, বহিতে থাকে। কত মনে দয়ার সঞ্চার, মিলনের বাসনা এবং ভক্তির উদয় হইতে থাকে। কত চক্ষু সরলে, বঙ্কিমে, দেখিতে ইচ্ছা করে। কত মুখে সুযশ সুখ্যাতি গাহিতে ইচ্ছা করে, শতমুখে সুকীর্তির গুণ বর্ণিত হইতে থাকে। আর যাচিয়া প্রেম বাড়াইতে হয় না, ডাকিয়াও কাছে বসাইতে হয় না। পরিচয় না থাকিলেও পরিচয়ের পরিচয় দিয়া, দাপিয়া চাপিয়া বসিয়া থাকে। আজ এজিদের ভাগ্য-বিমান হইতে কালমেঘ সরিয়া সৌভাগ্য-শশীর উদয় হইয়াছে-ওমর আলী বন্দি। শত শত ঘোষণা দিয়া, দ্বিগুণ বেতনের আশা দেখাইয়াও আশার অনুরূপ সৈন্যসংগ্রহ করিতে সক্ষম হয় নাই। ওমর আলী বন্দি, শূলদণ্ডে তাঁহার প্রাণবধের ঘোষণা শুনিয়া দলে দলে সৈন্যদলে নাম লিখাইতেছে; স্বার্থের আশায়, অর্থের লালসায়, কত লোক বিনা বেতনে এজিদপক্ষে মিশিতেছে। অপরিচিত বিদেশী বোধে যাহাদিগকে গ্রহণ করিতে মারওয়ানের অমত হইতেছে, তাহাদের কেহ কেহ স্ব স্ব গুণ দেখাইয়া, কেহবা, বাহুবলের পরিচয় দিয়া সৈন্যশ্রেণীতে প্রবেশ করিতেছে। কেহবা কোন সৈন্যাধ্যক্ষকে অর্থে বশীভূত করিয়া তাহার উপরোধে প্রবেশপথ পরিষ্কার করিয়া লইতেছে। সকলেই যে সমরক্ষেত্রে শত্রুর সম্মুখীন হইবে তাহা নহে। জয়ের ভাগ, যশের অংশ গ্রহণ করাই অনেকের অন্তরের নিগূঢ় আশা। আজ ওমর আলীর জীবন শেষ, কাল হানিফার পরমায়ু শেষ, যুদ্ধের শেষ-এই বিশেষ তত্ত্বেই স্বদেশী বিদেশী বহুলোকের সৈন্যদলে প্রবেশ। আবার ইহাও অনেকের মনে,-যদি বিপদ সম্ভব বিবেচনা হয়, পরাজয়ের লক্ষণ দেখা যায়, তবে ভবের ভাব, প্রকৃতির স্বভাব, সময়ের তাৎপর্য দেখাইয়া ক্রমে সরিতে থাকিব। কিন্তু জয়ের সম্ভাবনাই অধিক। ওমর আলীর প্রাণবধ-হানিফার দক্ষিণ বাহু ভগ্ম, একই কথা। একা হানিফার এক হস্তে কি করিবে? জয়ের আশাই অধিক। এজিদের ভাগ্যবিমানে সুবায়ু প্রতিঘাতে কালমেঘের অন্তর্ধান অতি নিকট। এজিদ্-শিবিরের চতুষ্পার্শ্বে বিষম জনতা-সকলের দৃষ্টিই শূলদণ্ডের সূক্ষ্ম অগ্রভাগে।
ওদিকে মোহাম্মদ হানিফার প্রাণ ওষ্ঠাগত, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের কণ্ঠ শুষ্ক, সৈনিক দলে মহা আন্দোলন। “হায়! হায়! এমন বীর বিপাকে মারা পড়িল! ভ্রাতৃ-আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে অকাল কালের হস্তে নিপতিত হইল! কি সর্বনাশ! এজিদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিও না, এই কথাতেই আজ ওমর আলী কিশোর বয়সে শত্রুহস্তে শূলে বিদ্ধ হইতে চলিল! ধন্য রে ভ্রাতৃভক্তি! ধন্য রে স্থির প্রতিজ্ঞা! ধন্য আজ্ঞা পালন! ধন্য ওমর আলী!”
সমরক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া সৈন্য সংগ্রহ করা বড় বিষম ব্যাপার। বিপদকালেই দূরদর্শিতার পরিচয়, ভবিষ্যৎ জ্ঞানের পরিচয়ের পরীক্ষা হয়। সুখের সময় দুশ্চিন্তা, ভবিষ্যৎ ভাবনা, প্রায় কোন মস্তকই বহন করিতে ইচ্ছা করে না।
মোহাম্মদ হানিফা শুধু আক্ষেপ করিয়া ক্ষান্ত হন নাই! গাজী রহমানও কেবল বিলাপ বাক্য শুনিয়াই নিশ্চিন্ত হন নাই। তাঁহাদের মস্তিষ্কসিন্ধু আজ বিশেষরূপে আলোড়িত হইয়াছে। সহসা এজিদ্ শিবির আক্রমণ করিবেন না অথচ ওমর আলীকে উদ্ধার করিবার আশা অন্তরের এক কোণে বিশেষ গোপনভাবে রহিয়াছে। বিনা বেতনের চাকরে গৃহকার্যের সুবিধা নাই, তাহাতে আবার যুদ্ধকাণ্ডে! অবৈতনিক সৈন্য কি ভয়ানক কথা। কি সাংঘাতিক ভ্রম! এ ভ্রম কাহার?
এজিদ্ বস্ত্রমণ্ডপে দরবার আহ্বান করিয়া, স্বর্ণময় আসনে মহাগর্বিতভাবে বসিয়াছে। রাজমুকুট শিরে শোভা পাইতেছে। মন্ত্রীপ্রবর মারওয়ান দক্ষিণপার্শ্বে দণ্ডায়মান। সৈন্যশ্রেণী দরবারসীমা ঘিরিয়া গায় গায় মিশিয়া, অসি হস্তে খাড়া হইয়াছে। পঞ্চবিংশতি রথী নিষ্কোষিত কৃপণ হস্তে ঘিরিয়া বন্ধনদশায় ওমর আলীকে দরবারে উপস্থিত করিল।
মারওয়ান ওমর আলীকে বলিল, “ওমর আলী! তুমি যে বন্দি, সে কথা তোমার জ্ঞান আছে?”
ওমর আলী বলিলেন, “এইক্ষণে তোমাদের হস্তে বন্দি-সে কথা আমার বেশ জ্ঞান আছে।”
“বন্দির এত অহঙ্কার কেন? নতশিরে যোড়করে রাজ সমীপে দণ্ডায়মান হওয়া কি তোমার এ সময়ে উচিত নহে? রাজাকে অভিবাদন করা কি এ অবস্থায় কর্তব্য নহে? মুহূর্ত পরে তোমার কি দশা ঘটিবে তাহা কি তুমি মনে কর না?”
“আমি সকলই মনে করিতেছি। তোমাদের যাহা ইচ্ছা হয় কর, অনর্থক বাক্বিতণ্ডায় প্রয়োজন নাই। আমি কোনরূপ অনুগ্রহের প্রত্যাশা করি না যে, নতশিরে ন্যূনতা স্বীকারে দরবারে খাড়া হইব!”
“সাবধান! সর্তক হইয়া জিহ্বা চালনা করিও। নম্রভাবে কথা কহা কি তোমাদের কাহারো অভ্যাস নাই? এ রাজ-দরবার-সমর-প্রাঙ্গণ নহে।”
“আমি প্রথমেই তোমাকে বলিয়াছি, বাক্বিতণ্ডার প্রয়োজন নাই। আমাকে জ্বালাতন করিও না! আমি তোমার সহিত কথা কহিতে ইচ্ছা করি না।”
এজিদ্ হাসিয়া বলিল, “আচ্ছা আমার সহিত কথা বল।”
ওমর আলী বলিলেন, “তুমিই এমন পবিত্র শরীর ভবধামে অধিষ্ঠান করিয়াছ যে, নিজের গৌরব নিজেই প্রকাশ করিতেছ। তোমার সহিত কথা বলিলে কি আমার গৌরব বৃদ্ধি হইবে?”
“গৌরব বৃদ্ধি হউক বা না হউক, অতি অল্প সময়ও যদি জগতের মুখ দেখিতে পাওয়া যায় তাহাতে ক্ষতি কি? তুমি আমার বশ্যতা স্বীকার কর, প্রভু বলিয়া মান্য কর, আমি তোমাকে প্রাণদণ্ড হইতে মুক্ত করিতেছি।”
“কি ঘৃণা! কি লজ্জা! এজিদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা! এজিদের আশ্রয় গ্রহণ! মারিয়ার পুত্রের বশ্যতা স্বীকার! ছি ছি, তুমি আমার প্রভু হইতে ইচ্ছা কর? তোমার বংশাবলীর কথা, তোমার পিতার কথা একবার মনে কর। ছি! ছি! বড় ঘৃণার কণা! এজিদ্, এত আশা তোমার-তুমি আবার মহারাজ!”
এজিদ্ রোষে অধীর হইয়া বলিল, “তোমার গর্দান লইতে পারি, তোমাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া শৃগাল কুকুরের উদরস্থ করিতে পারি। তুমি আমার নিকট প্রার্থনা জানাও যে, ‘মহারাজ! মহাকষ্টে যেন আমাকে বধ করা না হয়’।”
ওমর আলী ক্রোধে বলিলেন, “ধিক্ তোমার কথায়! আর শতাধিক্ আমার জীবনে! সহজে প্রাণ বধ করা হয় ইহাই আমার প্রার্থনা! তোমার যাহা করিবার ক্ষমতা থাকে কর, আমি প্রস্তুত আছি।”
“মরণের পূর্বে যে লোকে বিকারগ্রস্ত হয়, এ কথা সত্য! তোমার কপাল নিতান্ত মন্দ, আমি কি করিব?”
“তুমি আর কি করিবে? যাহা করিবে তাহার দ্বিগুণ ফল ভোগ করিবে।”
এজিদ্ সক্রোধে বলিল, “মারওয়ান, ইহার কথা আমার সহ্য হয় না! প্রকাশ্য স্থানে যাহাতে সর্বসাধারণে দেখিতে পায়, বিপক্ষগণ দেখিতে পায়, এমন স্থানে শূলে চড়াইয়া এখনই ইহার প্রাণবধ কর। কার্যশেষে আমাকে সংবাদ দিও!”
ওমর আলী বলিলেন, “কার্য শেষ করিলে তোমাকে আর সংবাদ শুনিতে হইবে না। তোমারই সংবাদ অনেকে শুনিবে।”
মহাক্রোধে এজিদ্ বলিল, “আর সহ্য হয় না। মারওয়ান! শীঘ্র ইহাকে শূলে চড়াও।” মারওয়ান নতশিরে সম্ভাষণ করিয়া বন্দিসহ দরবার হইতে বহির্গত হইল।
শিবিরের বাহিরে লোকে লোকারণ্য। নির্দিষ্ট বধ্যভূমিতে বন্দিসহ গমন করা বড়ই কঠিন। মারওয়ান শিবিরের দ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া চিন্তা করিতে লাগিল, ‘দর্শকগণের মনে কোন প্রকার কষ্ট না হয়, রাজাজ্ঞাও প্রতিপালন হয়। আবার শত্রুপক্ষ অতি নিকট। তাহারাই বা কি কাণ্ড করিয়া বসে, তাহারই বা বিচিত্র কি? প্রকাশ্য স্থানে শূলে চড়াইয়া প্রাণবধ করিতে হইবে, এ কথাও তাহারা শুনিয়াছে। শূলদণ্ড যে দণ্ডায়মান হইয়াছে, তাহাও স্পষ্টভাবেই দেখিতেছে। ইহাতে যে তাহারা একেবারে নিশ্চিন্ত থাকিবে, নির্বাকে দণ্ডায়মান হইয়া ওমর আলীর বধক্রিয়া স্বচক্ষে দেখিবে, এ ও কখনোই বিশ্বাস হয় না। হয় তো কোন নূতন কাণ্ড করিয়া তুলিবে।’
মারওয়ান বিশেষ চিন্তা করিয়া আদেশ করিল, “বধ্যভূমি পর্যন্ত যাইবার সুপ্রশস্ত পথ মধ্যে রাখিয়া উভয়পার্শ্বে সৈন্যশ্রেণী দণ্ডায়মান করা হইবে। প্রহরী এবং প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ ব্যতীত সামান্য সৈন্য কি কোন প্রাণী আমার বিনানুমতিতে এ পথে বধ্যভূমিতে যাইতে পারিবে না।”
আদেশ মাত্র নিষ্কোষিত অসি হস্তে সৈন্যগণ গায় গায় মিশিয়া বধ্যভূমি পর্যন্ত গমনোপযোগী প্রশস্ত স্থান রাখিয়া দুই শ্রেণীতে পরস্পর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। তখন শিবির-দ্বার হইতে শূলদণ্ডের অগ্রভাগ স্পষ্টভাবে দেখা যাইতে লাগিল। মারওয়ান পুনরায় আজ্ঞা করিল, “শূলদণ্ডের চতুষ্পার্শ্বে চক্রাকার কতক স্থান রাখিয়া শূলদণ্ডসহ ঐ চক্রাকার স্থান সজ্জিত সৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হইবে। একশ্রেণীতে চক্রাকারে ঐ স্থান বেষ্টন করিলে শঙ্কা দূর হইবে না। সপ্তচক্র সৈন্য দ্বারা ঐ স্থান বেষ্টন করিতে হইবে। চতুর্দিকে প্রহরী নিযুক্ত থাকিবে! বিপক্ষদল হইতে সামান্য একটি প্রাণীও আমাদের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করিয়া না আসিতে পারে-সে বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। আবার এদিকেও শিবিরদ্বার চতুষ্টয়ে এবং সীমান্ত স্থানে রক্ষীদিগের উপরেও সজ্জিত সৈন্য দ্বারা বিশেষ সতর্কে শিবির রক্ষা করিতে হইবে।”
মারওয়ান সৈন্যাধ্যক্ষগণকে আহ্বান করিয়া আরো আজ্ঞা করিল “যে সকল সৈন্য বিশেষ শিক্ষিত ও পুরাতন, তাহাদের দ্বারা শিবির এবং শিবিরদ্বার চতুষ্টয় রক্ষা করিতে হইবে। উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ সীমার প্রত্যেক সীমায় সহস্র সহস্র সৈন্য তীর, বর্শা ও তরবারিহস্তে রক্ষীরূপে দণ্ডায়মান থাকিবে। শিবিরের মধ্যে যেখানে যেখানে প্রহরী নিযুক্ত আছে, সেই সেই স্থানে দ্বিগুণিত প্রহরী ও সম্ভব মত সৈন্য নিয়োজিত করিয়া শিবির রক্ষা করিতে হইবে। সৈন্যাধ্যক্ষগণ আপন আপন সৈন্যদলের প্রতি বিশেষ সতর্কিতভাবে দৃষ্টি রাখিবেন।”
“ওমর আলীর বধসাধন হইতে কল্য প্রভাত পর্যন্ত সাধ্যাতীত সতর্কতার সহিত থাকিতে হইবে। সৈন্যাধ্যক্ষগণ অশ্বারোহী হইয়া মুহূর্তে মুহূর্তে শিবিরের চতুষ্পার্শ পরিবেষ্টন করিবেন। ওমর আলীর বধসাধনে হর্ষ, বিপদ, বিষাদ সকলই রহিয়াছে, সকল দিকেই দৃষ্টি রাখিতে হইবে। সাবধান, আমার এই আজ্ঞার অণুমাত্রও যেন অন্যথা না হয়। যে সকল সৈন্য নূতন গ্রহণ করা হইয়াছে, তাহাদিগকে কখনোই শিবির রক্ষার কার্যে, কি সীমা রক্ষার কার্য, কি প্রহরীর কার্যে, কোনরূপ কার্যে নিযুক্ত করা হইবে না। এমন কি আমার দ্বিতীয় আদেশ পর্যন্ত তাহারা শিবির মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে না। প্রকাশ্যভাবে তাহাদিগকে এ সকল কথা না বলিয়া বাহিরের অন্য কোন কার্যে, কি শূলদণ্ড যে প্রণালীতে রক্ষা করার আদেশ হইয়াছে, তাহাতেই নিযুক্ত করিতে হইবে। কিন্তু সে সপ্তচক্রের সীমাচক্রে, কি ষষ্ঠ বা পঞ্চম চক্রে তাহাদিগকে নিযুক্ত করা হইবে না। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চক্রেই তাহাদের স্থান,-শূলদণ্ডের নিকট হইতে উপরোক্ত চক্রত্রয় ভিন্ন অন্য কোন চক্রে তাহারা না যাইতে পারে-সে বিষয়ে বিশেষ সাবধান হইতে হইবে।”
মারওয়ান এই সকল আদেশ করিয়া, বন্দিসহ বধ্যভূমিতে যাইতে উদ্যত হইল। বন্দি ওমর আলী চতুর্দিকে চাহিয়া বধ্যভূমিতে যাইতে অসম্মত হইলেন।
মারওয়ান বলিল, “ওমর আলী! তুমি জানিয়া শুনিয়া কেন বিহ্বল হইতেছ? বন্দিভাবে রাজ আজ্ঞা অবহেলা! তুমি স্বেচ্ছাপূর্বক বধ্যভূমিতে না গেলে আমি কি তোমাকে শূলে চড়াইয়া মারিতে পারিব না? তুমি এখনও যদি মহারাজ এজিদের বশ্যতা স্বীকার কর, প্রভু বলিয়া মান্য কর, অপরাধ মার্জনাহেতু যোড়করে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তবে এখনও তোমার প্রাণ রক্ষা হইতে পারে। আমি মহারাজের রোষাগ্মি করিতে করিতে চেষ্টা করিব। বধ্যভূমিতে যাইব না,-এ কি কথা? সাধ্য কি যে তুমি না যাইয়া পার? তোমাকে নিশ্চয়ই ঐ শূলদণ্ডের নিকট যাইতে হইবে,-নিশ্চয়ই ঐ শূলে আরোহণ করিতে হইবে,-বিদ্ধ হইতে হইবে,-মরিতে হইবে। মহারাজ এজিদের আজ্ঞা অলঙ্ঘনীয়।”
ওমর আলী বলিলেন, “তুমি যদি আমাকে লইয়া যাইতে পার, লইয়া যাও-শূলে দাও। কিন্তু আমি ইচ্ছাপূর্বক শূলদণ্ডের নিকট যাইব না,-শূলে আরোহণ করা তো শেষের কথা। আমার প্রাণবধ করাই তো তোমাদের ইচ্ছা; তরবারি আছে আঘাত কর,-তীর আছে, বক্ষ’পরি লক্ষ্য কর,-বর্শা আছে, বিদ্ধ কর,-গদা আছে, মস্তক চূর্ণ কর,-ফাঁস আছে, গলায় দিয়া শ্বাস বন্ধ কর, যে প্রকারে ইচ্ছা হয় প্রাণ বাহির কর। আমি শূলে চড়িব না।”
“আমি তোমাকে শূলে চড়াইব। মহারাজ এজিদের আজ্ঞা প্রতিপালন করিব। তুমি তোমার প্রাণ বাহির করিবার দশটি উপায় বাহির করিলেও তাহা গ্রাহ্য হইবে না। ঐ একমাত্র শূলদণ্ডেই তোমার জীবন শেষ-কেন আমাকে বিরক্ত কর?”
“তোমার ক্ষমতা থাকে, আমাকে লইয়া যাও।”
“কেন? শূলে চড়িয়া প্রাণ দিতে কি লজ্জা বোধ হয়? হায় রে লজ্জা! এমন অমূল্য জীবনই যদি গেল তবে সে লজ্জায় ফল কি?”
“আমি তোমার কথা শুনিতে ইচ্ছা করি না। তোমার কার্য তুমি কর, আমি আর এক পদও অগ্রসর হইব না।”
“মুহূর্ত পরে যাহার জীবনকাণ্ড শেষ অভিনয় হইয়া, জীবনের মত যবনিকা পত্তন হইবে, তাহার আবার আস্পর্ধা?”
“দেখ্ মারওয়ান! সাবধান হইয়া কথা বলিস্! আমার হস্ত কঠিন বন্ধনে বাঁধা আছে, নতুবা তোর মুখের শাস্তি করিতে ওমর আলীকে বেশি দূর যাইতে হইত না!”
মারওয়ান মহাক্রোধে ওমর আলীকে পশ্চাদ্দিক হইতে সজোরে ধাক্কা দিয়া বলিল, “চল, তোকে পায় হাঁটাইয়া লইয়া শূলে চড়াইব।”
ওমর আলী নীরব। মারওয়ান অনেক চেষ্টা করিল, তিল-পরিমাণ স্থানও ওমর আলীকে সরাইতে পারিল না। লজ্জিত হইয়া বলিল, “সকলে একত্রে একযোগে ধরিয়া তোকে শূন্যে শূন্যে লইয়া যাইব।”
ওমর আলী হাস্য করিয়া বলিল, “মারওয়ান তুমি তো পারিলে না। সকলে একত্র হইয়া আমাকে শূলদণ্ডের নিকট লইয়া যাইবে, ইহাতে তোমার গৌরব কি? তুমি সুখী হও কোন্ মুখে?”
“আমি সুখী হই বা না হই, তোকে শূলে চড়াই?”
“এখান হইতে লইয়া যাইতে পারিলে তো শূল?”
মারওয়ান প্রহরিগণকে বলিল, “তোমরা অস্ত্রশস্ত্র রাখিয়া সকলে ইহাকে ধর, শূন্যে শূন্যে লইয়া আমার সঙ্গে আইস।”
প্রহরিগণ প্রভু-আজ্ঞা পালন করিল বটে, কিন্তু ওমর আলী সেই পাষাণ, সেই পাষাণময়-অচল। তিনি যে পদ যেখানে রাখিয়াছিলেন, সে পদ সেই খানেই রহিয়া গেল। প্রহরিগণ লজ্জিত-মারওয়ান রোষে অধীর।
মারওয়ান পুনরায় বলিতে লাগিল, “মহা বিপদ! এখান হইতে বধ্যভূমি পর্যন্ত লইতেই এত কষ্ট, শূলের উপর চড়ান তো সহজ কথা নহে।”
ওমর আলী বলিলেন, “মারওয়ান! চিন্তা কি? তুমি যদি আমাকে বধ্যভূমি পর্যন্ত লইয়া যাইতে পার, তাহা হইলে আমি ইচ্ছা করিয়া শূলে চড়িব। তুমি চিন্তা করিও না। যতক্ষণ থাকি, জগতে হাসি তামাসা করিয়া চলিয়া যাই। মরণ কাহার না আছে? আজ আমার এই প্রকার মরণ হইতেছে; কাল না হউক, কালে তোমাকেও অন্য প্রকারে মরিতে হইবে।”
মারওয়ান মনে মনে বলিতে লাগিল, “এখান হইতে ধরাধরি করিয়া লইয়া গেলেও তো শূলে চড়ান মহাবিপদ দেখিতেছি। আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে ডাকি।” এই স্থির করিয়া প্রকাশ্যভাবে বলিল, “আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে ডাকিয়া আন, আর তাহার অধীনে কয়েকজন বলবান্ সৈন্য গতকল্য সৈন্যদলে নাম লিখাইয়াছে, তাহাদিগকেও এখানে আসিতে বল।”
ওমর আলী বলিলেন, “ওহে মন্ত্রী! কোন্ আবদুল্লাহ্ জেয়াদ? কুফানগরের জেয়াদ?-সেই নিমকহারাম জেয়াদ? বিশ্বাসঘাতক জেয়াদ? না অন্য কেহ?”
“তাহাতে তোমার প্রয়োজন কি?”
“প্রয়োজন কিছুই নাই-তবে পাপাত্মার মুখখানা চক্ষে দেখিবার ইচ্ছা অনেক দিন হইতে আছে। শীঘ্র আসিতে বল, মরণকালে দেখিয়া যাই।”
“তোমার অন্তিমকাল উপস্থিত-এ সময়েও তোমার হাসি তামাসা-এ সময়েও আমাদিগকে ঘৃণা!”
“আমি তো আর তোমার মত মূর্খ নহি যে, কারণ, কার্য ও যুক্তি অবহেলা করিয়া কেবল ঈশ্বরের প্রতি চাহিয়া থাকিব? তুমি মনে করিয়াছ যে আমরা তোমার প্রাণবধ করিতে পারিব না,-আমাদের হস্তে মরিবে না। ওমর! অঙ্গারও যদি হরিদ্রার কান্তি পায়, মশকও যদি সমুদ্র শুষিয়া ফেলে, অচল যদি সচলভাব ধারণ করে, সূর্যদেবও যদি পশ্চিমে উদিত হয়, তথাচ তোমার জীবন কখনোই রক্ষা হইতে পারে না। মারওয়ানের হস্ত হইতে বাঁচিয়া প্রাণ বাঁচাইতে পারিবে না। মুহূর্ত পরেই তোমার চক্ষের পাতা ইহকালের জন্য বন্ধ হইবে। শূলদণ্ড তোমার মস্তক ভেদ করিয়া বহির্গত হইবে। এখনও বাঁচিবার আশা-জেয়াদকে দেখিবার আশা?”
“অত বক্তৃতা করিও না, অত অদৃষ্ট দিয়াও আমাকে বুঝাইও না। ঈশ্বরের মহিমার পার নাই। তিনি হজরত ইব্রাহিমকে অগ্নি হইতে, ইউসুফকে কূপ হইতে, নুহ্কে তুফান হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন! কত জনকে কত বিপদ, কত কষ্ট, কত দুঃখ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, করিতেছেন এবং করিবেন। আর আমাকে এই সামান্য বন্ধন হইতে এজিদের আদেশ হইতে, আর নিতান্ত আহম্মক! মন্ত্রী মারওয়ানের হস্ত হইতে উদ্ধার করা তাঁহার কতক্ষণের কার্য!”
“তোমার ঈশ্বর, যুক্তি ও কারণের নিকট পরাস্ত। আমি যদি তোমার এ বন্ধন না খুলিয়া দেই, তোমার ঈশ্বর অদৃশ্যভাবে খুলিয়া দিন্ দেখি? কারণ ব্যতীত কোন্ কালে কোন্ কার্য হইয়াছে? দৈব কথা দৈবশক্তি ছাড়িয়া দাও,-না হয় তোমার বস্ত্রাঞ্চলে বাঁধিয়া রাখ, ও কথায় মারওয়ানের মন টলিবে না।”
“মন টলিবে না বটে, টলিতে পারে।”
“পূর্বেই বলিয়াছি-মারওয়ান তোমার মত পাগল নহে।”
এদিকে বীরবর আবদুল্লাহ্ জেয়াদ কয়েকজন সজ্জিত সৈন্যসহ মারওয়ানের নিকট উপস্থিত হইয়া উপস্থিত ঘটনা দেখিল-শুনিয়া আরো চমৎকৃত হইল। ক্ষণকাল পরে জেয়াদ গম্ভীর স্বরে বলিল, “আমি ওমর আলীকে বধ্যভূমিতে লইতেছি। কি আশ্চর্য, ওমর আলীকে মৃত্তিকা হইতে শূন্যে উত্তোলন করা যায় না, এ কি কথা! অস্ত্রের সাহায্যে সকলেই সকল করিতে পারে।”
জেয়াদ ওমর আলীর নিকট যাইয়া তাঁহাকে মৃত্তিকা হইতে শূন্যে তুলিতে অনেক চেষ্টা করিল,-পারিল না। লজ্জা রাখিবার আর স্থান কোথায়? বিরক্ত ভাবে বলিল, “বাহরাম! তুমি তো আপন বাহুবলের ক্ষমতা অনেক দেখাইয়াছ-উঠাও।”
মারওয়ান বলিল, “বাহরামের বাহুবল দেখিয়া আমি চমৎকৃত হইয়াছি। সত্য কথা বলিতে কি ঐ গুণেই আমি বাহরামকে সৈন্যদলে আদরে গ্রহণ করিয়াছে। এখন পদোন্নতি-পুরস্কার সকলই যদি ওমর আলীকে-”
বাহরাম মারওয়ান এবং জেয়াদকে অভিবাদন করিয়া বলিল, “গোলাম এখনই হুকুম তামিল করিতেছে।”
ওমর আলী আড়নয়নে বাহরামকে দেখিয়া বলিলেন, “জেয়াদ! কত জনকে ঠকাইতে চাও? স্বপ্ন-বিবরণে প্রভু হোসেনকে ঠকাইয়াছ, মদিনার বিখ্যাত বীর মোসলেমকে ঠকাইয়াছ, আজ আবার কাহাকে ঠকাইবে?”
জেয়াদ বলিল, “তোমার অস্ত্রের ধার বদ্ধ হইয়াছে, কিন্তু কথার ধারটুকু এখনও আছে। এখনই সে ধার বদ্ধ হইবে! উপযুক্ত লোক আনিয়াছি।”
“উপযুক্ত লোক হইলে অবশ্যই পরাভব স্বীকার করিব। সে যাহা বলিবে, বিনা বাক্যব্যয়ে শুনিব। কিন্তু মরা বাঁচা ঈশ্বরের হাত।”
“আরে মূর্খ! এখনও মরা বাঁচা ঈশ্বরের হাত? তোমার ঈশ্বর এখনও তোমাকে বাঁচাইবেন,-ভরসা আছে? ইচ্ছা করিলে কেবল মহারাজ এজিদ্ বাঁচাইলে বাঁচাইতে পারেন।”
“রে বর্বর জেয়াদ! তুই ঈশ্বরের মহিমা কি বুঝিবি-পামর?”
“তোমার হিতোপদেশ আর শুনিতে ইচ্ছা করি না। এখন গাত্রোত্থান করুন, যমদূত শিয়রে দণ্ডায়মান।”
ওমর আলী জেয়াদের কথায় কোন উত্তর করিলেন না, সেই পূর্ববৎ দণ্ডায়মান, সেই অটল-অচল।
জেয়াদ বাহরামকে পুনরায় বলিল, “আর দেখ কি? উহাকে বধ্যভূমিতে লইয়া চল।”
বাহরাম সিংহ বিক্রমে ওমর আলীকে ধরিল এবং ‘জয় মহারাজ এজিদ্’ শব্দ করিয়া একেবারে শূন্যে উঠাইয়া বলিল, “হুকুম হয়ত এই স্থানে ইহার বধ-ক্রিয়া সমাধা করিয়া দেই। এক আছাড়েই অস্থি চূর্ণ করিয়া মজ্জা বাহির করি।”
বাহরামের বাহুবল দেখিয়া মারওয়ান জেয়াদ শত মুখে প্রশংসা করিতে লাগিল। মারওয়ান উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, “বাহরাম! ওমর আলীকে মারিয়া ফেলিও না। রাজাজ্ঞা তাহা নহে। শূলে চড়াইয়া মারিতে হইবে। শিবিরের মধ্যে প্রাণ বধের ইচ্ছা থাকিলে অনেক উপায় ছিল। শূলদণ্ড পর্যন্ত ইহাকে শূন্যভাবে লইয়া যাইতে হইবে।”
“যো হুকুম” বলিয়া বাহরাম এজিদের জয় ঘোষণা করিতে করিতে ওমর আলীকে তৃণবৎ লইয়া চলিল। মারওয়ান ও জেয়াদ হাসিতে হাসিতে আর আর সঙ্গীসহ চলিল। কি ভয়ানক! সকলের চক্ষেই ভীম-দর্শন। শূলদণ্ডের চতুষ্পার্শ্বে চক্রাকারে সৈন্যশ্রেণী দণ্ডায়মান। দর্শকগণের চক্ষু,-শূলের অগ্রভাগে। কাহারো মুখে কথা নাই। সকলেই নীরব। প্রান্তর নীরব।
বাহরাম ওমর আলীকে শূলদণ্ডের নিকট লইয়া ছাড়িয়া দিলেন, জেয়াদ ও মারওয়ান পুনঃ পুনঃ বাহরামের প্রশংসাবাদ করিতে লাগিল, অবশেষে বলিল, “বীরবর বাহরাম! তুমি ওমর আলীকে শূলদণ্ডে চড়াইয়া রাজাজ্ঞা প্রতিপালন কর।”
জেয়াদ মারওয়ানকে বলিল, “আমার ইচ্ছা, যে পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ না হয়, সে পর্যন্ত ওমর আলী শূলদণ্ডেই বিদ্ধ থাক্!”
মারওয়ান বলিল, এ “কথাটা বড় গুরুতর! মহারাজের অভিপ্রায় জানা আবশ্যক। শত্রুর মনে কষ্ট দিতে, তোমার এ যুক্তি সর্বপ্রধান বটে-কিন্তু রাজাজ্ঞা তাহা নহে। আমার মতে মৃত দেহে শত্রুতা নাই, কিন্তু হানিফার বিশেষ মনোকষ্টের কারণ হইবে তাহাতেও সন্দেহ নাই। শত্রুকে জব্দ করাই তো কথা। তোমার মত প্রকাশ করিয়া মহারাজের নিকট হইতে ইহার মীমাংসা করিয়া আসিতেছি। তুমি এদিকের কার্য শেষ কর। আমার প্রতি যে ভার অর্পিত হইয়াছিল, আমি সে ভার তোমাকে অর্পণ করিলাম। তুমি ওমর আলীকে মহারাজের আজ্ঞামত বধ কর। আমি মহারাজের নিকট হইতে ঐ কথার মীমাংসা করিয়া এখনি আসিতেছি।”
জেয়াদ বাহরামকে বলিল, “বাহরাম! বন্দিকে জিজ্ঞাসা কর, এখন তার আর কথা কি? এখনও মহারাজ এজিদ্ দয়া করিলে করিতে পারেন।”
বাহরাম জিজ্ঞাসা করিল, “ওমর আলী! তোমার অন্তিমকাল উপস্থিত! কোন কথা বলিবার থাকে বল,-আর বিলম্ব নাই।”
ওমর আলী বলিলেন, “এতক্ষণ অনেকবার বলিয়াছি, আর কোন কথা নাই। তবে ইচ্ছা যে, যাইবার সময় একবার ঈশ্বরের উপাসনা করিয়া যাই। কিন্তু আমার হস্ত পদ যে কঠিন বন্ধনে বাঁধা আছে, ইহাতে সম্পূর্ণরূপে উপাসনার ব্যাঘাত হইতেছে। যদি তোমাদের সাহস হয়, তবে আমার হস্তের বন্ধন খুলিয়া দাও। আমি অন্তিম সময়ে একবার পরম কারুণিক পরমেশ্বরের যথার্থ নাম উচ্চারণ করিয়া আমার জাতীয় উপাসনায় অন্তরকে পরিতৃপ্ত করি।”
জেয়াদ বলিল, “ওমর! আমি তোমার হস্তের বন্ধন খুলিয়া দিতেছি। তুমি স্বচ্ছন্দে তোমার ইষ্ট-দেবতার নাম কর, তোমার ঈশ্বরকে যথাবিধি পূজা কর, মৃত্যুকালে ঈশ্বরের নাম করিতে আমি কখনোই বাধা দিব না। ঈশ্বর তোমাকে যে এখনও রক্ষা করিতে পারেন এ ভ্রমও পরীক্ষা কর। আমি তোমাকে তোমার ইষ্ট-দেবতার শপথ দিয়া বলিতেছি তোমার উদ্ধারের জন্য কায়মনে তোমার নিরাকার নির্বিকার দয়াল প্রভুর নিকট আরাধনা কর।” এই বলিয়া জেয়াদ স্বহস্তে ওমর আলীর বন্ধন মোচন করিয়া দিল!
ওমর আলী, মৃত্তিকা দ্বারা (জলাভাবে মৃত্তিকাদ্বারাও শরীর পবিত্র করিবার বিধি আছে, তাহার নাম “তয়ন্মুখ।”) “আজু” ক্রিয়া সমাপন করিয়া যথারীতি ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন। উপাসনার পর দুই হস্ত তুলিয়া মহাপ্রভুর গুণানুবাদ করিতে করিতে শূলদণ্ডের চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন এবং বীরত্বের সহিত ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। ওমর আলীর সঙ্গে সঙ্গে বাহরাম বলিয়া উঠিলেন, “জেয়াদ! বিশ্বাসঘাতকতার ফল গ্রহণ কর। মোসলেমের প্রতিশোধ গ্রহণ কর! ওমর আলীকে উদ্ধার করিতে আসিয়া তোমাকে সুযোগমতে পাইয়াছি-ছাড়িব না।” এই বলিয়া সজোর আঘাতে জেয়াদ-শির দেহবিচ্ছিন্ন হইলে, শিরসংযুক্ত কেশগুচ্ছ ধরিয়া, শিরহস্তে বাহরাম বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্মী এজিদ্! দেখ, কি কৌশলে বাহরাম ওমর আলীকে লইয়া চলিল। কেবল ওমর আলীকে উদ্ধার করিবার জন্যই বাহরাম ছদ্মবেশে তোমার প্রিয় সেনাপতি জেয়াদের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। আমি মোহাম্মদ হানিফার দাস। যুদ্ধ সময়ে আগন্তুক সৈন্য গ্রহণ করার এই প্রতিফল! সৈন্য বৃদ্ধি লালসায় ভবিষ্যৎ চিন্তা ভুলিয়া যাওয়ার এই ফল। দেখ্-এই দেখ্ আজ কি ঘটিল। আগন্তুক সেনায় বিশ্বাস নাই বলিয়া তোমার মন্ত্রীপ্রবর শূলদণ্ডের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চক্রে নূতন সেনা সন্নিবেশিত করিয়াছেন। ইহারা বাহির চক্রে থাকিলে কি জানি কি বিপদ ঘটায় তাঁহার এই দুশ্চিন্তায় ঈশ্বর আমাদেরই মঙ্গল করিয়াছেন। এখন দেখ্! বাহরাম জেয়াদের শির লইয়া বীরত্ব প্রকাশে ওমর আলীকে সঙ্গে লইয়া চলিল।”
ওমর আলী জেয়াদের কটিবন্ধ হইতে তরবারি সজোরে টানিয়া লইয়া বলিতে লাগিলেন, “মোহাম্মদীয় ভ্রাতাগণ! আর কেন? প্রভুর নাম ঘোষণা করিয়া ঈশ্বরের গুণগান করিতে করিতে শিবিরে চল। ওমর আলী সহজেই উদ্ধার হইলেন। আর আত্মগোপনে প্রয়োজন কি?” প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় চক্রের সেনাগণ সমস্বরে, “আল্লাহ আকবর, জয় মোহাম্মদ হানিফা! জয় মোহাম্মদ হানিফা!” বলিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে দেখিতে চতুর্থ এবং পঞ্চম চক্র ভেদ করিয়া ষষ্ঠ চক্রে গিয়া পড়িল। ঘোর সংগ্রাম-অবিশ্রান্ত অসি চলিতে লাগিল। এজিদের বিশ্বাসী সৈন্যগণ, যাহারা ষষ্ঠ এবং সপ্তম চক্রে ছিল, হঠাৎ স্বপক্ষীয় সৈন্যদিগের বিদ্রোহিতা দেখিয়া মহা ভীত হইল! বাহিরের শত্রু ওমর আলীকে না লইতে পারে, ইহাই তাহাদের মনের ধারণা, তাহাতেই মনঃসংযোগ ও সতর্কতা। হঠাৎ বিপরীত ভাব দেখিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিল না। কোথা হইতে কি ঘটিল, কি কারণে সৈন্যগণ বিদ্রোহী হইল, কিছুই সন্ধান করিতে পারিল না। জেয়াদের খণ্ডিত শির অপরিচিত সৈন্যহস্তে দেখিয়া মহারাজ এজিদ্ বাঁচিয়া আছেন কি না, ইহাই সমধিক শঙ্কার কারণ হইল। চক্র টিকিল না, মুহূর্তমধ্যে চক্র ভগ্ন করিয়া ওমর আলী এবং বাহরাম সঙ্গিগণসহ বাহিরে আসিলেন। যাহারা সম্মুখে পড়িল তাহারাই রক্তমাখা হইয়া মৃত্তিকাশায়ী হইল।
আশা ছিল কি?-ঘটিল কি? কোথায় ওমর আলীর শূলবিদ্ধ শরীর সকলের চক্ষে পড়িবে,-না জেয়াদের খণ্ডিত দেহ দেখিতে হইল। মারওয়ানের দুঃখের সীমা নাই। ওদিকে হানিফা শিবিরে শত সহস্র বিজয় নিশান উড়িতেছে, সন্তোষসূচক বাজনায় দামেস্ক প্রান্তর কাঁপাইয়া তুলিতেছে। এজিদ্ এ সংবাদে ক্ষিপ্ত প্রায় হইয়া বধ্যভূমিতে আগমন করিল এবং বলিতে লাগিল “হায় হায়! কার বধ কে করিল? যাহা হউক হানিফার উচ্চ চিন্তার বলে ওমর আলী কৌশল করিয়া প্রাণ বাঁচাইল। আমাদেরও শিক্ষা হইল। সমরক্ষেত্রে আগন্তুক সৈন্যকে বিশ্বাস করিয়া সৈন্যশ্রেণীতে গ্রহণ করার ফল, প্রত্যক্ষ প্রমাণসহ স্পষ্টভাবে দেখাইয়া দিল। আমাদের অজ্ঞতা, অদূর শিক্ষার কার্যফল, হাতে হাতে প্রাপ্ত হইতে লাগিল। আমার ইহাতে দুঃখ নাই। কিন্তু জেয়াদের শিরশূন্য দেহ দেখিয়া কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিতেছি না। জেয়াদের শির আজ হানিফার শিবিরে যাইবে, একথা কাহার মনে ছিল?-কে ভাবিয়াছিল?-কিন্তু চিন্তা কি? এখনই প্রতিশোধ, এখনই ইহার প্রতিশোধ লইব। এ শূলদণ্ড যে ভাবে আছে, সেই ভাবেই রাখিব। ভবিষ্যৎ বিপদ গণনা করিয়া আর বিরত হইব না। আর কাহারো কথা শুনিব না। যাও-এখনই দামেস্কে যাও। জয়নাল আবেদীনকে বাঁধিয়া আন। ঐ শূলদণ্ডে তাহাকে চড়াইয়া প্রিয় বন্ধু জেয়াদের শোক নিবারণ করিব,-মনের দুঃখ নিবারণ করিব। জয়নাল বধে শত শত বাধা দিলেও এজিদ্ আজ ক্ষান্ত হইবে না। শূলে চড়াইয়া শত্রুবধ করিতে পারি কি না হানিফাকে দেখাইতে এজিদ্ কখনোই ভুলিবে না! বন্দিকে ধরিয়া আনিয়া শূলে চড়াইব, ইহাতে আর আশঙ্কা কি? শঙ্কা থাকিলেও আজ এজিদ্ কিছুতেই সঙ্কুচিত হইবে না। এখনই যাও। মারওয়ান এখনই যাও, জয়নালকে করিয়া আন-এজিদ্ এই বধ্যভূমিতেই রহিল। ভেরীর বাজনার সহিত, ডঙ্কার ধ্বনির সহিত, নগরে, প্রান্তরে, সমরক্ষেত্রে, হানিফার শিবিরের নিকটে ঘোষণা করিয়া দাও যে, ওমর আলীর জন্য যে শূলদণ্ড স্থাপন করা হইয়াছিল, সেই শূলদণ্ডে জয়নালকে চড়াইয়া জেয়াদের প্রতিশোধ লওয়া যাইবে।”
মারওয়ান আর দ্বিরুক্তি করিল না। রাজাদেশ মত ঘোষণা প্রচারের আজ্ঞা করিয়া সপ্তবিংশতি অশ্বারোহী সৈন্যসহ অশ্বরোহণে তখনই নগরাভিমুখে ছুটিল।