এক গ্রাম্য ডাক্তার (কিছু ছোট কাহিনি)
নতুন উকিল
আমাদের এক নতুন উকিল আছেন, ড. বুসেফেলাস। তার বাইরের চেহারা দেখে বোঝাই কষ্ট যে তিনি একসময় মেসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের যুদ্ধের ঘোড়া ছিলেন, যদিও বিষয়টা সম্বন্ধে ভালো জানে এমন কারো চোখে দু-একটা জিনিস ধরা পড়বে বটে। হতে পারে, কিন্তু সেদিন আদালত ভবনের সিঁড়িতে আমি দেখলাম যে একজন খুব সাধারণ এক দ্বাররক্ষকও রেস দেখতে যাওয়ার দক্ষ চোখ নিয়ে এই উকিলকে তাকিয়ে দেখল, দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল যে কীভাবে তিনি তার পাগুলো উঁচুতে তুলে তুলে উপরে উঠে যাচ্ছেন, তার পায়ের খুরের প্রতিটা শব্দ কীভাবে মার্বেলের ওপরে ধ্বনি তুলছে।
সবকিছু মিলে বার-সমিতি বুসেফেলাসকে উকিল হিসেবে কাজ করতে সম্মতি দিয়েছে। অসামান্য বোধশক্তিই বলতে হবে যে তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, আজকালকার দিনের সমাজব্যবস্থায় বুসেফেলাস বেশ কঠিন এক অবস্থায় পড়েছেন, আর সে কারণেই, এ ছাড়া তার ঐতিহাসিক অবদানের জন্যও, সবার উচিত তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে এখন আর কোনো আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট নেই। মানতে হচ্ছে, এখনো কেউ কেউ জানে যে কীভাবে মানুষ হত্যা করতে হয়, এমনকি ভোজসভার টেবিলে কীভাবে অন্য পাশে বসা বন্ধুকে বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করে মারতে হয় সেই কুশলতাটাকু আজও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি; অনেক মানুষ আছেন যাদের কাছে মেসিডোনিয়া আজ খুব, খুবই ছোট এক জায়গা, তাই তারা তার বাবা ফিলিপকে গালমন্দও করেন –কিন্তু কেউ, আর কেউই নেই যে আমাদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে পারবে। এমনকি সেই তখনকার দিনেও ভারতের দরজায় পৌঁছানোর কোনো উপায় ছিল না, কিন্তু রাজার তরবারি অন্তত এটুকু দেখিয়ে দিয়েছিল যে কোথায় সেই দরজা। আর আজ ভারতে ঢোকার এই দরজাগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে একদম অন্য কোথাও, আরো দূরে, আরো উঁচু কোনো জায়গায়; কেউ নেই যে পথ দেখাবে; অনেকেরই হাতে তরবারি আছে, কিন্তু তা স্রেফ শূন্যে ঘোরানোর জন্যই, আপনি যদি ওই তরবারি অনুসরণ করতে চান তো দেখবেন আপনার দৃষ্টি তালগোল পাকিয়ে গেছে।
অতএব, তাই, সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে বোধ হয় বুসেফলাস যা করেছেন তা ই করা, আইনের বইয়ের মধ্যে ডুবে যাওয়া। মুক্ত, তার শরীরের দুই পাশে এখন আর কোনো সওয়ারি তাকে আঁকড়ে নেই, আলেকজান্ডারের যুদ্ধগুলোর হট্টগোল থেকে অনেক দূরে, বাতির স্থির আলোয় তিনি পড়ছেন আর ওল্টাচ্ছেন আমাদের প্রাচীন গ্রন্থগুলোর পাতা।
এক গ্রাম্য ডাক্তার
বিরাট দ্বিধার মধ্যে রয়েছি আমি; জরুরি এক ডাকে বেরোতে হবে আমাকে; খুবই অসুস্থ এক রোগী আমার জন্য অপেক্ষা করছে দশ মাইল দূরের এক গ্রামে; তার আর আমার মধ্যেকার বিশাল পথটা ভরে আছে ঘন ঝোড়ো তুষারে; চার-চাকার একটা ঘোড়াগাড়ি আছে আমার, বড় বড় চাকাওয়ালা হালকা এক গাড়ি, আমাদের গাঁয়ের রাস্তার জন্য একদম ঠিক জিনিস; আমার ফারের কোটটায় শরীর মুড়িয়ে নিয়ে, ডাক্তারির জিনিপত্তরের ব্যাগ হাতে ধরে, রওনা দেওয়ার জন্য পুরো তৈরি হয়ে আমি উঠোনে দাঁড়ালাম; কিন্তু ঘোড়াটা কোথাও নেই, ঘোড়াটা। আমার নিজের ঘোড়া কাল রাতে এই বরফমোড়া শীতকালের বেশি খাটাখাটনিতে ক্লান্ত হয়ে মারা গেছে, এখন আমার কাজের মেয়ে সারা গ্রাম দৌড়ে বেড়াচ্ছে একটা ঘোড়া ধার করবে বলে; কিন্তু আমি জানি, ওতে কোনো কাজ হবে না; নিরর্থক আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি এখানে, তুষারে ঢাকা পড়ছি আরো আরো বেশি করে, আর ততই বেশি নড়বার ক্ষমতা হারিয়ে বসছি। কাজের মেয়েটাকে দেখা গেল গেটে দাঁড়িয়ে আছে, একা, হাতের লণ্ঠন দোলাচ্ছে; ঠিকই তো, কে এই এত রাতে এরকম একটা সফরের জন্য তার ঘোড়া ধার দেবে? আবার একবার উঠানে পায়চারি করলাম আমি; কোনো বুদ্ধি মাথায় এল না; না বুঝেই, এরকম এক হতাশ অবস্থায় হাবুডুবু খেয়ে, আমি এক লাথি মেরে বসলাম শুয়োরের খোয়াড়টার পচে যাওয়া দরজায়, খোয়াড়টা ব্যবহার করা হয়নি অনেক বছর। দরজা খুলে গেল, কবজার উপর দাঁড়িয়ে বাড়ি খেতে লাগল এদিক-ওদিক। ভেতর থেকে একটা ভাপ বেরোল, আর ঘোড়ার মতো একটা গন্ধ। ভেতরে একটা দড়িতে ঝুলছে একটা টিমটিমে আস্তাবলের লণ্ঠন। একজন মানুষ পাছায় ভর দিয়ে গুটিগুটি বসে রয়েছে ঐ নিচু ছাউনির খোয়াড়ের মধ্যে, সে তার নীল চোখের অমায়িক মুখ তুলে তাকাল। আমি কি ঘোড়াগুলো জুড়ব গাড়িতে?’ সে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল। কী বলব তা বুঝে পেলাম না আমি, কেবল মাথা নোয়ালাম ঐ খোঁয়াড়ে আর কী আছে তা দেখার জন্য। কাজের মেয়েটা আমার পাশে দাঁড়ানো, সে বলল, ‘নিজের ঘরের মধ্যে কী লুকানো আছে তা নিজেরই কখনো জানার উপায় নেই, আর হেসে ফেললাম আমরা দুজনে। ও ভাই গো, ও বোন গো!’ ডাক দিল সহিস আর দুটো ঘোড়া, পুরু-মোটা পাছার দুই প্রকাণ্ড জীব, একটার পেছনে অন্যটা, স্রেফ ওদের মোচড়ানো শরীরের শক্তি দিয়েই ঘুরে বেরিয়ে এল সামনের দিকে, ওদের পাগুলো শরীরের ভাঁজে টান টান হয়ে আছে, সুঠাম মাথা দুটো নুয়ে আছে উটের মতো; দরজার ফুটো গলে– এটা ভরে গেছে তাদের শরীরের আয়তনে –বেরিয়ে এল ওরা। পরমুহূর্তে লম্বা পায়ের উপরে উঁচু হয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা, ওদের লোম থেকে বেরোচ্ছে একটা ঘন বাষ্পের মেঘ। ‘ওকে একটু সাহায্য করো, আমি বললাম, কাজের-মেয়ে নিজের থেকেই জলদি এগিয়ে এল সহিসকে ঘোড়া জুতবার জিনিসগুলো দিতে। কিন্তু মেয়েটা ঠিকমতো তার কাছে যেতেও পারেনি, সহিস তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, নিজের মুখ চেপে ধরল মেয়েটার মুখে। মেয়েটা চিৎকার করে ছুটে এল আমার কাছে; তার গালে দুই সারি দাঁতের লাল চিহ্ন পড়ে গেছে। অই জানোয়ার, আমি রাগে চিৎকার দিলাম, চাবকানো লাগবে নাকি তোকে? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল যে এ এক অচেনা লোক; আমি জানিও না কোত্থেকে সে এসেছে, আর সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় সে এগিয়ে এসেছে আমাকে সাহায্য করতে, যখন সবাই কিনা আমাকে হতাশ করেছে। যেন সে জানে যে আমি কী ভাবছি, তাই আমার ধমকটাতে কোনো মনঃক্ষুণ্ণ হলো না সে, কেবল –ঘোড়াগুলো নিয়ে ব্যস্ত অবস্থায় –একবার ঘুরে দেখল আমাকে। উঠুন,’ বলল সে, আর আসলেই সবকিছু তৈরি। আমি খেয়াল করলাম, এর আগে কোনো দিন এত সুন্দর দুটো ঘোড়ার গাড়িতে উঠিনি, তাই খুশিমনে চড়ে বসলাম। গাড়ি আমি চালাব, তুমি পথ চেনো না,’ বললাম আমি। অবশ্যই,’ সে বলল, ‘আমি তো আপনার সঙ্গে আসছিই না, আমি রোজের সঙ্গে থাকছি।’ ‘না, তীক্ষ্ণ চিৎকার দিল রোজ, আর নিজের অবধারিত নিয়তিকে ঠিকভাবে অনুমান করতে পেরেই দৌড়ে পালাল ঘরের মধ্যে; আমার কানে এল দরজায় সে শিকল বাঁধছে ঝনঝন শব্দ করে; শুনলাম তালা লাগানোর শব্দও; এমনকি আমি দেখতে পাচ্ছি কীভাবে সে নিভিয়ে দিচ্ছে বসার ঘরের বাতি, তারপর সবগুলো ঘরে দৌড়ে দৌড়ে ওগুলোও অন্ধকার করে দিচ্ছে, যেন তাকে খুঁজে বের করা না যায়। তুমি আমার সঙ্গে আসছে, সহিসকে বললাম আমি, ‘তা না হলে যত জরুরিই হোক না কেন, আমি যাওয়া বাতিল করছি। তোমার ঘোড়ায় চড়ার দাম হিসাবে তো আমি আর মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারি না। হেঁট, হেঁট!’ চিৎকার করল সে; হাত দিয়ে তালি বাজাল; ঘোড়ার গাড়িটা ঘূর্ণি খেয়ে উড়ে গেল স্রোতের মধ্যে কোনো কাঠের টুকরার মতো; আমি কেবল ওটুকুই শুনতে পেলাম যে সহিসের ধাক্কার মুখে আমার বাড়ির দরজা দড়াম করে খুলে ভেঙে পড়েছে, এরপর একটা প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় আমার চোখ, কান আর বাকি সব ইন্দ্রিয় অসাড় হয়ে এল। কিন্তু সেটাও কেবল এক মুহূর্তের জন্য, কারণ মনে হলো আমার নিজের বাসার গেট যেন সোজা খুলে গেছে সেই রোগীর বাসার উঠানে –আমি হাজির; ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে শান্ত হয়ে, বরফ পড়া থেমেছে; চারপাশে চাঁদের আলো; আমার রোগীর বাবা-মা ছুটে এলেন বাড়ির ভেতর থেকে; রোগীর বোন ওদের পেছনে; গাড়ি থেকে আমাকে বলতে গেলে কোলে তুলে নেওয়া হলো; এদের হিজিবিজি কথাবার্তার কিছুই ধরতে পারছি না আমি; রোগীর ঘরের হাওয়ায় প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসবে এমন অবস্থা; ফেলে রাখা স্টোভ থেকে। ধোয়া উঠছে; আমাকে ধাক্কা দিয়ে জানালা খুলতে হলো; কিন্তু সবার আগে আমি চাচ্ছি রোগিকে দেখতে। দুবলা-পাতলা, গায়ে কোনো জ্বর নেই, গা না-ঠান্ডা না-গরম, চোখে শূন্যদৃষ্টি, গা খালি, কিশোর-বয়সী ছেলেটা বিছানার চাদর থেকে শরীর তুলল, আমার গলা জড়িয়ে ধরল আর কানে ফিসফিস করে বলল: ‘ডাক্তার, আমাকে মরতে দিন। আমি তাকালাম চারপাশে কেউ শোনেনি; ছেলের বাবা-মা কোনো শব্দ না করে সামনে ঝুঁকে আছেন আর আমার রায়ের অপেক্ষা করছেন; ওর বোন আমার ব্যাগ রাখার জন্য একটা চেয়ার নিয়ে এসেছে। আমি ব্যাগ খুলে ডাক্তারির জিনিসপত্তরের মধ্যে ঘাটতে লাগলাম; ছেলেটা বারবার তার অনুরোধ মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বিছানা থেকে আমার কাছে আসতে চেষ্টা করছে; ছোট সাঁড়াশিটা হাতে তুললাম আমি, মোমের আলোয় ওটা পরখ করলাম, তারপর আবার রেখে দিলাম ব্যাগের মধ্যে। হ্যাঁ, অধার্মিকের মতো ভাবছি আমি, এরকম অবস্থায় পৌঁছানোর পরে খোদা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, হারানো ঘোড়া ফেরত পাঠান, তাড়া বুঝতে পেরে আরো একটা ঘোড়া যোগ করে দেন, আর ষোলোআনা পূরণ করতেই একটা সহিসও পাঠান’– এ পর্যন্ত এসে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল রোজ মেয়েটার কথা; আমার করার আছেই বা কী, কী করে আমি বাঁচাব ওকে, কী করে ওকে এই সহিসের শরীরের নিচ থেকে টেনে বের করব, ওর থেকে এই দশ মাইল দূরে, আর আমার গাড়িতে এক জোড়া বেপরোয়া ঘোড়া নিয়ে? এই ঘোড়াগুলো, ওদের লাগাম যেন ওরা কী করে খুলে ফেলেছে; বাইরে থেকে গুঁতো দিয়ে কী করে যেন জানালাও খুলেছে, কী করে আমি জানি না; ওরা দুটো দুই আলাদা জানালা দিয়ে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে, আর এ বাসার লোকজনের চিৎকারে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে গভীর মন। দিয়ে দেখছে রোগীকে। খুব শিগগির বাড়ি ফিরছি আমি, মনে মনে বললাম, যেনবা ঘোড়াগুলো আমাকে যাত্রা শুরু করার জন্য ডাকছে, তার পরও আমি বাধা দিলাম না যখন রোগীর বোন –সে ভাবছে আমার খুব গরম লাগছে –আমার ফারের কোট খুলে দিতে লাগল। আমার সামনে রাখা হলো এক গ্লাস রাম, বুড়ো লোকটা আমার কাঁধে চাপড় দিলেন, তার এই মহামূল্যবান সম্পদ আমাকে খেতে দিয়ে তিনি আমার আপন হওয়ার অধিকার পেয়ে গেছেন। আমি মাথা ঝাঁকালাম; বুড়ো মানুষটার চিন্তার সংকীর্ণতা দেখে। আমার নিজেকে অসুস্থ লাগছে; স্রেফ এ কারণেই আমি ফিরিয়ে দিলাম তার রামের গ্লাস। ছেলের মা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছেন ওখানে; আমি তাই করলাম, আর যখন একটা ঘোড়া জোরে চি-হি-হি করে ছাদের দিকে মাথা তুলে ডেকে উঠল, আমি ছেলেটার বুকে মাথা রাখলাম, আমার ভেজা দাড়ির ছোঁয়ায় কাঁপতে লাগল সে। যা আমি এরই মধ্যে আন্দাজ করে ফেলেছি, তাই নিশ্চিত হলো: এই ছেলের কিছুই হয়নি, তার মা দুশ্চিন্তার তোড়ে তাকে এত বেশি কফি খাইয়েছেন যে তার রক্ত চলাচল খানিক ক্ষীণ হয়ে গেছে, কিন্তু ওটুকুই, তার স্বাস্থ্য একদম ভালো, আরো ভালো হয় এক্ষুনি ওকে লাথি মেরে বিছানা থেকে উঠিয়ে দিলে। কিন্তু পুরো দুনিয়া ঠিক করার আমি দায়িত্ব নিয়ে আসিনি, তাই আমি তাকে শুয়ে থাকতেই দিলাম। আমি চাকরি করি জেলা প্রশাসনের আওতায়, আমার কাজ আমি করি একটা মানুষের পক্ষে যতটা করা সম্ভব তার চেয়েও বেশি নিবেদিত প্রাণে। যদিও মাইনে পাই খুব সামান্য, তার পরও মানুষের জন্য আমার দয়ামায়ার কমতি নেই, গরিব মানুষের জন্য আমি সব সময় খাটতে রাজি। রোজের দেখভালের বিষয়টাই আমাকে যা ভাবায়; তারপর এই অসুস্থ ছেলে শুধু নয়, আমি নিজে মরে গেলেও আমার আর দুঃখ থাকবে না। এই বিরামহীন শীতকালে আমি করছিটাই বা কী এখানে! আমার নিজের ঘোড়া হাওয়া হয়ে গেছে, আর গ্রামে একটা লোকও নেই যে তারটা আমাকে ধার দেবে। শুয়োরের খোঁয়াড় থেকে আমাকে এই এক জোড়া বার করতে হলো; ওরা যদি ঘোড়া না হতো, তাহলে আমাকে মাদী শুয়োরের পিঠে চেপে আসতে হতো এখানে। ব্যাপারটা এমনই। আমি মাথা নাড়লাম পরিবারের লোকজনের উদ্দেশে। এরা এসবের কিছুই জানে না, আর যদি জানতও, তবু বিশ্বাস করত না। প্রেসক্রিপশন লেখা সোজা, কিন্তু গাঁয়ের লোকের সঙ্গে মানিয়ে চলা অনেক কঠিন। হুঁ, আমার আজকের ভিজিট তাহলে মনে হচ্ছে এখানেই শেষ; আরো একবার আমাকে জ্বালানো হলো বিনা কারণে; আমার অভ্যাস হয়ে গেছে এসবে, আমার বাড়ির কলিং বেল বাজিয়ে পুরো জেলার লোকজন আমাকে উত্ত্যক্ত করে; কিন্তু তাই বলে এবার যা হলো, রোজকে ফেলে রেখে আসতে হলো, আহারে ফরসা বাচ্চামেয়েটা কত বছর ধরে আমার বাড়িতে, কখনোই বলতে গেলে ওর খেয়ালই নেওয়া হয়নি আমার,– এই কোরবানি অনেক বেশি হয়ে গেছে, যেকোনোভাবে হোক এখন আমাকে এটা মাথার মধ্যে হালকা করে আনতে হবে, না হলে আমার সব রাগ গিয়ে পড়বে এই পরিবারটার ওপর, হায়রে ওরা সারা দুনিয়ার সদিচ্ছা নিয়েও তো আর রোজকে আমার কাছে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু তারপর, আমি যখন আমার ব্যাগ বন্ধ করছি, ফারের কোটটা আমাকে দিতে ইশারা করছি, যখন পুরো পরিবার একসঙ্গে ওখানে দাঁড়িয়ে, ছেলের বাবা রামের গ্লাস নাকে নিয়ে শুঁকছেন, ছেলের মা খুব সম্ভব আমার ব্যাপারে হতাশ হয়ে –আচ্ছা, মানুষ আশা করেটা কী?– চোখ ছলছল করে তার ঠোঁট কামড়াচ্ছেন, আর যখন ছেলের বোন একটা রক্তে ভেজা রুমাল হাতে তুলে নাড়াচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে তখন শেষমেশ আমি মোটামুটি মানতে রাজি হলাম যে ছেলেটা হয়তো আসলেই অসুস্থ। আমি ওর কাছে গেলাম, সে আমার উদ্দেশে হালকা একটু হাসল, যেনবা আমি ওর জন্য সবচেয়ে পুষ্টিকর কোনো স্যুপ নিয়ে এসেছি। আহ্, এখন দুটো ঘোড়াই ডাক ছাড়ছে; কোনো সন্দেহ নেই ওকে আমার পরীক্ষা করে দেখার কাজটা সহজ করার জন্যই উচ্চতর কর্তৃপক্ষ থেকে আদেশ এসেছে এই ডাক দেওয়ার –আর এবার আমি দেখলাম: হ্যাঁ, ছেলেটা অসুস্থ। তার ডান পাশে, পাছা ও কোমরের দিকটায়, আমার হাতের ঢালুর মতো বড় আকারের একটা ক্ষত খুলে বেরিয়ে আছে। গোলাপের মতো লাল অনেক আভা নিয়ে, গভীর অংশে কালো আর কিনারের দিকে রংটা হালকা হয়ে –সূক্ষ্ম দানা দানা মতো, বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত। চুঁইয়ে বেরোচ্ছে –ক্ষতটা হাঁ করে আছে মাটিতে পোতা বোমার মতো। দূর থেকে দেখতে এমনই লাগছে। কাছ থেকে দেখলে বিষয়টা আরো জটিল। কার সাধ্য ওটা দেখবে মুখে হালকা শিস্ না বাজিয়ে? অনেক পোকা, আমার কড়ে আঙুলের মতো মোটা আর লম্বা, ওগুলোরও রক্তগোলাপ রং আর তার সঙ্গে রক্তের ছোপে ভরা, আঁকড়ে আছে ক্ষতের গভীরে, ওদের সাদা সাদা মাথা আর অসংখ্য ছোট ছোট পা নিয়ে কিলবিল করে মুচড়িয়ে উঠে আসতে চাইছে আলোর দিকে। হতভাগা কিশোর, তোমাকে সারিয়ে তোলার আর সাধ্য নেই। তোমার বিশাল ক্ষতটা আমি খুঁজে পেয়েছি, তোমার শরীরের পাশের এই ফুল তোমাকে খতম করে দিচ্ছে। পরিবারটা এখন খুশি, তারা দেখছে আমি মন দিয়ে কাজ করছি; বোনটা বলছে মাকে, মা বলছেন বাবাকে, আর বাবা বলছেন দেখতে আসা কিছু লোককে, যারা পা টিপে টিপে খোলা দরজার চাঁদের আলোর মধ্য দিয়ে, তাদের দুই হাত দুপাশে ভারসাম্য রাখার জন্য বাড়িয়ে, এই ঘরে ঢুকেছেন। আপনি বাঁচাবেন আমাকে? ফোঁপানি দিয়ে ফিসফিস করে জিগ্যেস করল ছেলেটা, তার এই জীবন্ত ক্ষত তাকে একদম হতবিহ্বল করে দিয়েছে। এই হচ্ছে আমার জেলার লোকজন। সব সময় ডাক্তার সাহেবকে অসম্ভব সব আবদার জানানো তাদের স্বভাব। তাদের আগের সেই ধর্মবিশ্বাস আর নেই; পুরোহিত মশাই ঘরে বসে রয়েছেন, তার বেদিতে পরার কাপড়গুলো এক-এক করে ছিঁড়ে কেটে ফেলছেন; কিন্তু ওদিকে ডাক্তারের কাছ থেকে আশা যে তিনি তার শল্যচিকিৎসকের নাজুক হাত দিয়ে অলৌকিক জিনিস ঘটিয়ে দেবেন। তাহলে তা-ই হোক: আমি তো আর স্বেচ্ছায় রাজি হইনি, তোমরা যদি আমাকে পুজো-অর্চনার কাজেও ভুলভাবে লাগিয়ে দাও, আমি তাতেও বাধা দেব না কোনো; এর চেয়ে ভালো আর কীই-বা আমি আশা করব, আমি, বুড়ো এক গ্রাম্য ডাক্তার, যার কাছ থেকে কাজের মেয়েটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে! তারপর এগিয়ে এলেন তারা, পুরো পরিবার এবং গ্রামের সব প্রবীণ লোকজন, তারা সবাই মিলে আমাকে ন্যাংটো করলেন; স্কুলে পড়া বাচ্চাদের একটা ধর্মগীতি গাইয়ের দল, দলের নেতৃত্বে তাদের শিক্ষক, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে খুব সাদামাটা সুরে গাওয়া শুরু করল:
কাপড় খোলো ওর, তবেই তিনি অসুখ সারাবেন
যদি না সারান তো মেরে ফেল তাকে!
এক ডাক্তারই তো তিনি, স্রেফ ডাক্তারই তো শুধু।
ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি, উলঙ্গ, মাথা নিচু করে আর দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে শান্তভাবে দেখছি উপস্থিত সবাইকে। পুরো শান্ত স্থির আমি, এদের সবার চেয়ে উঁচুতে আমার মর্যাদা, আর আমি সেটাই থাকব, যদিও তাতে আমার লাভ হচ্ছে না কারণ তারা এবার আমার মাথা ও পা-দুটো ধরে তুলে ফেলেছেন উপরে আর নিয়ে গেছেন বিছানায়। এরা আমাকে শুইয়েছেন দেয়ালের পাশটায়, ক্ষতের দিকটাতে। তারপর সবাই এরা চলে গেলেন ঘর ছেড়ে; দরজা বন্ধ করা হলো; গান থামল; মেঘ ঢেকে দিল চাঁদকে; আমার চারপাশে পড়ে আছে গরম কাঁথা-কম্বল; খোলা জানালাগুলোতে ঘোড়ার মাথা দুটো সামনে পেছনে দুলছে ছায়ার মতো। আপনি জানেন কি, একটা গলা শুনলাম আমার কানে বলছে, আপনার ওপর আমার তেমন কোনো বিশ্বাস নেই। অন্যদের মতোই আপনাকেও যেন কোত্থেকে ভাসিয়ে আনা হয়েছে, এমনো না যে নিজের পায়ে ভর দিয়ে আপনি নিজেই এসেছেন। আমার উপকার করার বদলে আপনি বেশ আমার মরবার বিছানায় আমার নিজের জায়গাটুকুও দখল করে নিয়েছেন। খুব চাচ্ছি যে আপনার চোখ দুটো খুঁচে তুলে ফেলি।’ ‘তুমি ঠিকই বলেছ,’ আমি বললাম, ‘কী লজ্জা! কিন্তু কী আর করার, আমি তো ডাক্তার। কী করার আছে আমার? বিশ্বাস করো, আমার জন্যও ব্যাপারটা সহজ নয়।
‘আপনার এই অজুহাতে আমি সন্তুষ্ট থাকব চাইছেন? ওহ, মনে হয় তাই থাকতে হবে। সব সময় আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই দুনিয়াতে আমি এসেছি সুন্দর একটা ঘা নিয়ে; আমার সৌন্দর্য বলতে স্রেফ ওটুকুই। বাচ্চা ছেলে বন্ধু আমার, আমি তাকে বলি, তোমার সমস্যা হচ্ছে: তোমার দেখার চোখটা খুব সংকীর্ণ। আশপাশে যত রোগীর ঘর আছে, সব দেখা হয়ে গেছে আমার; তোমায় শুধু এটুকুই বলতে পারি: তোমার ঘায়ের অবস্থা অন্যদের মতো অত খারাপ নয়। কুড়ালের দুটো নিখুঁত বাঁকা আঘাতে এর জন্ম। অনেক লোক আছে যারা তাদের শরীরের পাশটা সামনে বাড়িয়ে দেয়, তারপরও বনে কুড়ালের আওয়াজ তাদের প্রায় কানেই আসে না, আর ওটা যে ওদের কাছে এগিয়ে আসছে সেটা বোঝার কথা তো বাদই দাও। আসলেই তাই? নাকি আপনি আমার জ্বরের সুযোগ নিয়ে আমাকে যা-খুশি মিথ্যা বলছেন?’ ‘সত্যিই তাই, একজন সরকারি ডাক্তার হিসেবে জবান দিচ্ছি তোমাকে।’ সে কথাটা বিশ্বাস করল, স্থির হলো। কিন্তু এবার আমি নিজে এখান থেকে কী করে বেরোব তা ভাবার পালা। ঘোড়াগুলো এখন বিশ্বস্ত দাঁড়িয়ে আছে ওদের জায়গায়। আমি কাপড়চোপড়, ফারের কোট আর ব্যাগ জড়ো করলাম তাড়াতাড়ি; ঠিকমতো সেজেগুজে বের হওয়ার জন্য নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই; ঘোড়া দুটো যে গতিতে এসেছে যদি সেই একই গতিতে ফেরত যায়, তাহলে তো এটা স্রেফ আমার এই বিছানা থেকে নিজের বিছানায় লাফ দেওয়ার ব্যাপার হবে। একটা ঘোড়া বাধ্যগত সেবকের মতো জানালা থেকে সরল; আমি আমার সব জিনিসের পুঁটলিটা ছুঁড়ে মারলাম ঘোড়ার গাড়িতে; ফারের কোটটা উড়ে যাচ্ছিল একটু বেশিই দূরে, এটার এক হাতা কোনোমতে একটা হুকে গিয়ে আটকে গেল। তাতেই চলবে। আমি লাফ দিয়ে উঠলাম ঘোড়ার পিঠে। লাগামগুলো ঢিলে হয়ে হেঁচড়ে চলেছে পেছন পেছন, দুই ঘোড়া বলতে গেলে একসঙ্গে জোড়াই নেই, গাড়িটা পেছনে কোথায় কোনোমতে সঙ্গে চলেছে, শেষমেশ ফারের কোটটা আসছে মাটিতে তুষারে ঘসটে। এবার চল বিদ্যুতের বেগে! আমি চিৎকার করে উঠলাম, কিন্তু কোনো কাজ হলো না তাতে; বুড়োমানুষদের মতো ধীরে আমরা হামা দিয়ে চলেছি তুষারের তেপান্তরে; অনেকক্ষণ ধরে আমরা পেছন দিকে শুনতে পেলাম বাচ্চাদের নতুন কিন্তু ভুল এক গান:
ও রোগীরা সব, ফুর্তি-মনে থাকো
ডাক্তার শুয়ে আছেন বিছানায় তোমাদের পাশে!
এভাবে কোনোদিনও আমি বাড়ি পৌঁছাতে পারব না; আমার ফুলেফেঁপে উঠতে থাকা ডাক্তারি চর্চার এই শেষ; এর পরের জন এসে আমার যা আসে সব কেড়ে নেবে, কিন্তু লাভ কী– আমার জায়গা নিতে কোনো দিনও পারবে না সে; আমার বাড়িতে ঐ জঘন্য সহিস সবকিছু তোড়ফেঁড় করছে; রোজ নামের মেয়েটা তার শিকার; ওসব নিয়ে ভাবতে রাজি নই আমি। উলঙ্গ, সবচেয়ে দুর্ভাগা এই সময়ের তুষারের কাছে অসহায় উন্মুক্ত হয়ে, পার্থিব এক চার চাকার ঘোড়ার গাড়ি আর অপার্থিব ঘোড়াগুলো নিয়ে, এই বুড়ো লোক আমি উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার ফারের কোট গাড়িটার পেছনে থেকে ঝুলছে, কিন্তু ওটার কাছে পৌঁছাতে পারছি না আমি, আর আমার ব্যস্ত রোগীদের দলের কেউ আমাকে সাহায্য করতে একটা আঙুলও তুলছে না। জোচ্চুরি হলো আমার সঙ্গে! জোচ্চুরি হলো! রাতের-ঘণ্টার ভুল আওয়াজে একবার সাড়া দিয়েছে কী– সেই ভুলের মাশুল দেওয়া শেষ হবে না, কোনো দিন।
উপরে, গ্যালারিতে
যদি ধরুন কোনো দুর্বল, যক্ষ্মারোগে ভোগা সার্কাসের চতুর ঘোড়সওয়ারি মেয়েকে তার এক নিষ্ঠুর, চাবুক-ঘোরানো রিংমাস্টার মাসের পর মাস কোনো বিশ্রাম না দিয়ে ক্লান্তিহীন সব দর্শকের সামনে তার পড়োপড়ড়া অবস্থার সার্কাসের ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে ঘোরাতে থাকে আর ঘোরাতেই থাকে, ধরুন ওভাবে সে ঘুরছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে, চুমু ছুঁড়ে মারছে দর্শকদের দিকে, দুলছে কোমরের উপর থেকে, আর ধরুন যদি এই খেলা দেখানো চলতেই থাকে –অর্কেস্ট্রার অবিরাম শিঙ্গাধ্বনি ও বায়ুচলাচল পথের গর্জনের সঙ্গে– অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলতেই থাকে এক ধূসর ভবিষ্যতের দিকে, আর সঙ্গে থাকে উল্লাস করতে থাকা অসংখ্য হাতের হাততালির মিলিয়ে যাওয়া আর আবার উঠতে থাকা, যা সত্যিকার অর্থে বাষ্পেচলা-হাতুড়ির শব্দ ছাড়া আর কিছু নয় –তখন বোধ হয় উপরে ওই গ্যালারিতে বসা এক তরুণ দর্শক দৌড়ে নেমে আসবে গ্যালারির সিঁড়ির লম্বা ধাপ বেয়ে, সারির পর সারির মধ্য দিয়ে, ধুম করে ঢুকে পড়বে রিং-এর ভেতরে আর নিয়ত উপস্থিতমতো সুর বদলানো অর্কেস্ট্রার ট্রাম্পেট-বিউগলের ঝংকারের মধ্যে চিৎকার দিয়ে বলবে: ‘থামো!’
কিন্তু যেহেতু এমনটা ঘটে না, তাই দেখা যায় এক সুন্দরী মহিলা গোলাপি ও সাদা পোশাক পরে উড়ে আসে পর্দাগুলোর ফাঁক দিয়ে, তার জন্য ওগুলো গর্বের সঙ্গে ফাঁক করে ধরেছে তার বিশেষ ইউনিফর্ম-পরা সহচরেরা; সাকার্সের ম্যানেজার সুবিনয়ের সঙ্গে চেষ্টা করেন তার দৃষ্টি আকর্ষণের, পশুর মতো হামা দেওয়া ভক্তিতে ফোঁসফোঁস শ্বাস ছাড়েন মহিলার দিকে; দরদ দিয়ে তাকে তুলে ধরেন ধূসর রঙের উপর গাঢ় ছোপ দেওয়া ঘোড়ার পিঠে, এমনভাবে যেন সে তার অতি আদরের নাতনি যে কিনা বিপজ্জনক কোনো যাত্রা শুরু করেছে; চাবুক দিয়ে ঘোড়াকে সংকেত দেওয়ার ব্যাপারে তিনি মন ঠিক করে উঠতে পারেন না; তবে শেষমেশ, মন না চাইলেও, বেশ জোরে সপাং এক চাবুক মেরে বসেন; মুখ হাঁ করে দৌড়াতে থাকেন ঘোড়াটার পাশে; তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ রাখেন সওয়ারি মহিলার প্রতিটা লাফের দিকে; সওয়ারির দক্ষতার ব্যাপারটা ঠিকভাবে বুঝে উঠতেই পারেন না; চিৎকার করে তাকে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে সাবধান করে দিতে থাকেন সামনের বিপদগুলোর ব্যাপারে; আংটা ধরে থাকা সহিসদের প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে উপদেশ দিতে থাকেন, যেন তারা সর্বোচ্চ সাবধানের সঙ্গে কাজ করে; আর সবচেয়ে বড় সেই ডিগবাজিটার আগে হাত দুটো উপরে তুলে অর্কেস্ট্রা দলকে মিনতি জানান বাজনা একটু থামানোর জন্য; তারপর এতক্ষণে, ছোট এই মহিলাকে তুলে আনেন তার কাঁপতে থাকা ঘোড়ার পিঠ থেকে, তাকে চুমু দেন দুই গালে, আর দর্শকরা যতই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা জানাতে থাকুক না কেন, তার কাছে তা যথেষ্ট মনে হয় না; ওই সময় মহিলা নিজে, ম্যানেজারের গায়ে হেলান দিয়ে, পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে, নিজের চারপাশে ধুলো উড়িয়ে, দুই হাত দুদিকে বাড়িয়ে, মাথা পেছনে নিয়ে, কামনা করতে থাকে পুরো সার্কাস তার আনন্দের সঙ্গী হোক –যেহেতু ব্যাপারটা আসলে এমন, তাই, উপরে গ্যালারির ওই দর্শক রেলিংয়ে গাল ঠেকিয়ে রেখেছে আর সার্কাস শেষ হওয়ার কুচকাওয়াজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে গভীর কোনো এক স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যাওয়ার মতো করে, সে চোখের পানি ফেলতে শুরু করেছে নিজেরই অজ্ঞাতে।
পুরোনো পাণ্ডুলিপির একটি পাতা
আমাদের পিতৃভূমি রক্ষার বিষয়ে মনে হয় অনেক কিছুতেই অবহেলা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে খুব বেশিদিন হয়নি যে আমরা মাথা ঘামিয়েছি, সব সময়ে বরাবরের মতো আমরা আমাদের যার যার কাজকর্ম চালিয়ে গেছি; কিন্তু এই ইদানীংকালে ঘটা কিছু ঘটনা আমাদের উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
সম্রাটের প্রাসাদের সামনে স্কোয়ারে আমার একটা মুচির দোকান আছে। ভোরে আমার দোকানের দরজা ঠিকমতো খোলাও হয়নি, দেখি অস্ত্রহাতে লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে এই স্কোয়ারে আসার প্রতিটি রাস্তার মাথায়। এরা আমাদের সৈন্য না, তবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা সব উত্তরের যাযাবর। আমার বোঝার অগম্য কোনো একটা উপায়ে এরা একেবারে রাজধানী পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে, যদিও সীমান্ত থেকে এ অনেক লম্বা পথ। যেটাই বলি, কথা হচ্ছে ঐ যে ওরা; আর প্রত্যেক সকালেই দেখে মনে হচ্ছে ওদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
যেমন এদের অভ্যাস, এরা তাঁবু খাঁটিয়েছে ভোলা জায়গায়, কারণ স্থায়ী বাড়িঘরে এদের পোষায় না। এদের সময় কাটছে তরবারি শাণ দিয়ে, তিরগুলো ছুঁচালো করার কাজে আর তাদের ঘোড়া চালানোর অনুশীলন করে করে। এরা এই শান্ত স্কোয়ারটাকে– যেটা সব সময় নিখুঁত সাফসুতরো করে রাখা হতো– রীতিমতো একটা শুয়োরের খোয়াড় বানিয়ে ছেড়েছে। আমরা মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি আমাদের দোকানগুলো থেকে ছুটে গিয়ে সবচেয়ে নোংরার নোংরা জিনিসগুলো সরিয়ে দিতে, কিন্তু যত সময় যাচ্ছে আমাদের এ-ব্যাপারটা ততই কমে আসছে, কারণ ওটা করে কোনো লাভ নেই; তা ছাড়া, এতেও ঝুঁকিও আছে, আমরা ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে মরতে পারি, নয়তো চাবুকের বাড়িতে আহত হতে পারি।
এই যাযাবরদের সঙ্গে কথা বলা অসম্ভব। এরা আমাদের ভাষা বোঝে না, সত্যি বলতে এদের নিজেদেরও কোনো ভাষা নেই বললেই চলে। এরা একে অন্যের সঙ্গে কথাটথা বলে অনেকটা দাঁড়কাকের মতো করে। দাঁড়কাকদের এই কর্কশ তীক্ষ্ণ স্বর অবিরাম আমাদের কানে বাজতে থাকে। আমাদের জীবনধারা, আমাদের নানা প্রতিষ্ঠান– এসব এরা না বোঝে, আর না বুঝতে চায়। তার ফলে কোনো ইশারার ভাষাতেও এদের কোনো আগ্রহ দেখি না। আপনি আপনার চোয়াল জায়গা থেকে সরিয়ে দেন কি আপনার হাতের কবজি মুচড়িয়ে হাড়ের জোড়া থেকে খুলে ফেলেন, এরা তখনো আপনাকে বুঝতে পারেনি, আর কোনো দিন পারবেও না। প্রায়ই দেখা যায় এরা মুখ ভেংচাচ্ছে; তারপর এরা এদের চোখের সাদা অংশ দেখাবে আর মুখের ঘন গেঁজা দেখাবে, কিন্তু এমনটা করে এরা যে কিছু বোঝাতে চাইছে তা নয়, এমনকি কোনো হুমকিও নয়; এরা এমন করে স্রেফ এজন্যই যে এমনটাই করা এদের খাসলত। যেটারই এদের দরকার পড়বে, তা এরা নিয়ে নেবে। এটা বলা যাবে না, এরা কাজটা করে জোরজুলুমের মাধ্যমে। যখন এরা কোনোকিছু ছিনিয়ে নিতে আসে, আপনি তখন স্রেফ পাশে সরে দাঁড়ান আর সবকিছু ওদের হাতে ছেড়ে দেন। আমার দোকান থেকেও ওরা ওদের ভাগের যা তা নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার এ নিয়ে নালিশ করার বলতে গেলে কিছুই থাকে না, যখন দেখি, উদাহরণস্বরূপ বলছি, ওই ওখানের কসাইয়ের সঙ্গে তারা কী করেছে। সে তার বিক্রির মাল আনতেও পারেনি, তার আগেই এই যাযাবরগুলো তার কাছে থেকে সব কেড়ে নিয়েছে, তারপর গিলেছে গোগ্রাসে। এমনকি এদের ঘোড়াগুলোও মাংস খায়; প্রায়ই দেখা যায় কোনো সওয়ারি আর তার ঘোড়া শুয়ে আছে পাশাপাশি, দুজনেই দুই দিক থেকে খাচ্ছে মাংসের একটাই টুকরো । কসাই বেচারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তার সাহস নেই মাংসের জোগান বন্ধ করার। আমরা এটা বুঝতে পারি, তাই আমরা চাঁদা তুলে সাহায্য করি তাকে। যাযাবরগুলো যদি মাংস না পায়, তাহলে কে জানে কী এদের মাথায় চড়ে বসবে; সেই অর্থে বললে, কে জানে এরা এদের রোজকার মাংস খেতে পেলেও বা কী করে বসতে পারে।
কদিন আগে এই কসাইর মাথায় একটা বুদ্ধি এল– আমি তো অন্তত পশু জবাইয়ের ঝামেলা থেকে বাঁচতে পারি; পরের দিন সকালে সে নিয়ে এল এক জ্যান্ত ষড়। তাকে এই কাজটা দ্বিতীয়বার আর করতে দেওয়া যাবে না। মনে হয় এক ঘণ্টা হবে, আমি আমার দোকানের একদম পেছনে সোজা মেঝের উপর শুয়ে ছিলাম, আমার সব কাপড়চোপড়, কম্বল, কোলবালিশ গায়ের উপর চাপিয়ে– শুধু যেন আমাকে ষাড়টার ঐ তীব্র আর্তনাদ শুনতে না হয় সেজন্য; যাযাবরগুলো ওর শরীরের সব পাশ থেকে তাদের দাঁত দিয়ে ওর গায়ের মাংস খুবলে খাবে বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি যতক্ষণে দোকান থেকে বেরিয়েছি তার বেশকিছু আগে থেকেই সব শান্ত সুনসান; মদের পিপার চারপাশে যেভাবে মাতালেরা শুয়ে থাকে, সেভাবেই এরা সবাই শুয়ে আছে ষড়টার শরীরের উচ্ছিষ্ট ঘিরে –মহাক্লান্ত।
ঠিক ওই সময়েই মনে হয় আমি স্বয়ং সম্রাটকে একঝলক দেখি তার প্রাসাদের অনেক জানালার একটাতে; তিনি সাধারণত কখনোই এই বাইরের দিকের ঘরগুলোয় পা রাখেন না, সব সময় তিনি থাকেন তার একদম ভেতর দিককার বাগানবাড়িতে; কিন্তু এবার তিনি দাঁড়িয়ে, কিংবা ওরকমই মনে হয় আমার, তার জানালাগুলোর একটায়, মাথা নিচু করে নিচে তার গেটের সামনের হট্টগোলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
‘এবার কী ঘটবে? আমরা নিজেদের মধ্যে জিজ্ঞাসা করি, ‘কতকাল আমরা এই বোঝা, এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারব? সম্রাটের প্রাসাদ লোভ দেখিয়ে যাযাবরদের এখানে টেনে এনেছে, কিন্তু তারা জানে না কী করে এদের খেদাবে। গেট সব সময় তালা দেওয়া থাকছে; দ্বাররক্ষীরা, যারা আগে সব সময় বিরাট আড়ম্বরের সঙ্গে কুচকাওয়াজ করে ভেতরে ঢুকত আর বেরোতো, তারা এখন খিল-আটা জানালাগুলোর ওপাশেই থাকে। শত্রুর হাত থেকে পিতৃভূমি রক্ষার সব দায়িত্ব এখন আমাদের মতো এই কারিগর আর ব্যাপারীদের হাতে ন্যস্ত; কিন্তু অমন একটা কাজের কোনো যোগ্যতা আমাদের নেই; আর না আমরা কোনো দিন দাবি করেছি যে সে যোগ্যতা আমাদের আছে। ব্যাপারটা একটা ভুল-বোঝাবুঝি; আর আমাদের ধ্বংসও নেমে আসবে এ কারণেই।
আইনের দরজায়
আইনের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দারোয়ান। গ্রাম থেকে আসা এক লোক ঐ দারোয়ানের কাছে গিয়ে হাজির হয় আর তাকে আইনের কাছে ঢুকতে দেওয়ার জন্য বলে। কিন্তু দারোয়ান জানায় ঠিক এ মুহূর্তে তাকে ঢোকার অনুমতি সে দিতে পারবে না। মানুষটা চিন্তা করে, পরে জিজ্ঞাসা করে, এর মানে কি এমন যে ভবিষ্যতে কোনো দিন তাকে ঢুকতে দেওয়া সম্ভব। তা সম্ভব,’ বলে দারোয়ান, তবে এখন নয়। যেহেতু আইনের কাছে পৌঁছার ঐ দরজা সব সময়ের মতো আজও খোলা আর দারোয়ান এক পাশে সরে গেছে, লোকটা ঘাড় নিচু করে দরজাপথের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করে ভেতরটা দেখতে। দারোয়ান তা দেখে হাসে আর বলে: ‘এতই যদি লোভ হয় তো আমার নিষেধ সত্ত্বেও চেষ্টা করে দেখো না ভেতরে ঢোকার। কিন্তু মনে রেখো: আমি ক্ষমতাশালী। আর আমি হচ্ছি সবচেয়ে নিশ্চুপদের এক দারোয়ান। ভেতরে হলের পরে হলে অন্য দারোয়ানরা দাঁড়িয়ে আছে, প্রত্যেকেই আগের জনের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। স্রেফ তৃতীয়জনের চেহারার দিকে তাকানোই এমনকি আমার সাধ্যে কুলায় না। গ্রাম থেকে আসা লোকটা এ রকম কঠিন কিছুর আশা করেনি; আইনের কাছে, সে ভাবে, সবারই সব সময় যাওয়ার অধিকার থাকা উচিত; কিন্তু এখন যেই সে আরো কাছের থেকে দারোয়ানকে দেখল– ফারের কোট পরা, লম্বা সুচাল নাক, মুখে লম্বা-পাতলা-কালো তাতারদের দাড়ি, সে সিদ্ধান্ত নিল– ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই তার জন্য বরং ভালো হবে। দারোয়ান তাকে বসার একটা টুল দিয়েছে, আর তাকে দরজার এক পাশে বসতে দিয়েছে। ওখানে সে বসে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। অনেকবার সে চেষ্টা-চরিত্র করে ভেতরে ঢোকার, আর তার অনুনয়বিনয় শুনতে শুনতে দারোয়ান ক্লান্ত হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দারোয়ান তাকে একটু জেরা করার মতো অনেককিছু জিজ্ঞাসা করে– তার বাড়ির ব্যাপারে ও অন্য আরো কিছু নিয়ে; কিন্তু ওগুলো স্রেফ পদস্থ লোকেদের ভাববাচ্যে কিছু জিজ্ঞাসা করার মতোই, আর প্রতিবারই সে এই একই কথা আবার বলে। শেষ করে যে তাকে সে এখনো ঢুকতে দিতে পারবে না। লোকটা তার এই সফরের সব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে, সে তার যা-কিছু আছে, যতটুকু মূল্যবানই তা হোক না কেন, সব ব্যয় করে দারোয়ানকে ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলের জন্য। দারোয়ান সব সময় তাকে যা দেওয়া হয় সব নেয়, কিন্তু নেওয়ার সময় বলে: “আমি নিচ্ছি শুধু যেন তোমার মনে না হয় যে সব চেষ্টা তুমি করোনি’। অনেক বছর হয়ে গেছে লোকটা দারোয়ানকে দেখছে। বিরামহীন। সে ভুলে গেছে অন্য দারোয়ানদের কথা, তার কাছে মনে হচ্ছে এই প্রথম দারোয়ানই তার আইনের কাছে যাওয়ার পথের একমাত্র বাধা। সে তার দুর্ভাগ্যকে গালমন্দ করে, প্রথমদিকের বছরগুলোয় প্রচণ্ডভাবে আর উঁচুগলায়; পরের দিকে, সে যখন বুড়ো হয়ে এসেছে, স্রেফ নিজের সঙ্গে ক্ষুব্ধ অসন্তুষ্ট বিড়বিড়ানিই করে যায়। বাচ্চাদের মতো হয়ে পড়ে সে, দারোয়ানকে এই দীর্ঘকাল ধরে দেখতে দেখতে সে এমনকি দারোয়ানের ফারের কলারের মাছিগুলোও চিনে ফেলে, মাছিগুলোর কাছেও সে মিনতি জানায় দারোয়ানের মন বদলাতে তাকে সাহায্য করার জন্য। অবশেষে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, সে জানে না তার চারপাশে আসলে কি অন্ধকার হয়ে আসছে, নাকি তার চোখ স্রেফ তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। কিন্তু ঐ অন্ধকারের মধ্যে সে আসলেই উপলব্ধি করতে পারে আইনের দরজাপথ থেকে ভেসে আসছে অনির্বাণ একটা দীপ্তি। এখন আর মরার বেশিদিন বাকি নেই তার। মৃত্যুর আগে তার মনের মধ্যে জড়ো হয় এতগুলো দীর্ঘ বছরের সব অভিজ্ঞতা, ওরা সব মিলে একটা প্রশ্নে রূপ নেয়, যে প্রশ্ন সে এখন পর্যন্ত কোনো দিন দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করেনি। সে তাকে কাছে আসতে বলে, কারণ তার শরীর আর চলে না, উঠে দাঁড়াবার কোনো শক্তি তার নেই। দারোয়ানকে একেবারে তার শরীরের উপর ঝুঁকে পড়তে হয়, কারণ এদের দুজনের শরীরের উচ্চতার ফারাকে, লোকটার জন্য অসুবিধা তৈরি করে, অনেক বদল ঘটে গেছে। এখনো তুমি কী জানতে চাচ্ছ?’ দারোয়ান জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার তৃপ্তি কোনো দিন মেটানো যাবে না। নিশ্চিত যে প্রত্যেকেই চেষ্টা করে আইনের কাছে পৌঁছুতে, লোকটা বলে, তাহলে এটা কী করে হয় যে এই এতগুলো বছরে আমি ছাড়া আর অন্য কেউ একবারও আইনের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল না?’ দারোয়ান বুঝতে পারে লোকটা তার জীবনের একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, তার অকেজো হয়ে যাওয়া কানে কথাগুলো যেন পৌঁছায় তাই গলা উঁচু করে সে, জোরে চিৎকার করে তাকে বলে: এখানে অন্য কেউ কোনো দিন ঢুকতে পারত না, কারণ ঢোকার এই দরজা শুধু তোমার একার জন্যই ছিল। এখন আমি ওটা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছি।
শেয়াল ও আরব
মরূদ্যানে তাঁবু গেড়েছি আমরা। আমার সঙ্গীরা ঘুমিয়ে। একজন আরব, লম্বা সাদা পোশাক পরা একজন, পাশ দিয়ে হেঁটে গেল; সে তার উটগুলো দেখাশোনা করছিল, আর এখন যাচ্ছে তার ঘুমানোর জায়গায়।
ঘাসে পিঠ দিয়ে শুলাম আমি; ঘুমাতে চাচ্ছি; পারলাম না; দূরে একটা শেয়ালের বিলাপ করা চিৎকার; আমি আবার উঠে বসলাম। আর অনেক দূরের ঐ জিনিসটা হঠাৎ খুব কাছে চলে এল। আমার চারপাশে গিজগিজ করছে একপাল শেয়াল; জ্যোতিহীন সোনালি চোখগুলো চকচক করছে আর নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে; রোগা শরীরগুলো সুশৃঙ্খল ও ক্ষিপ্র গতিতে নড়ছে, যেন কোনো চাবুকের নির্দেশ মেনে চলছে ওরা।
আমার পেছনদিক থেকে এল একটা, আমার হাতের নিচ দিয়ে গুতো মেরে গায়ের। সঙ্গে ঘেঁষে এল যেন সে আমার গায়ের গরম নিতে চাচ্ছে; তারপর সে প্রায় চোখে চোখ রেখে মুখোমুখি দাঁড়াল আর বলল:
‘এ অঞ্চলের সবচেয়ে বুড়ো শেয়াল আমি। তোমাকে এখানে আজও অভ্যর্থনা জানাতে পারছি এজন্য আমি খুশি। আমি আশা করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম, কারণ আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি যুগযুগ ধরে, গুনে বলা যাবে না কত যুগ; আমার মা অপেক্ষা করে ছিল, তার মা, আর একেবারে সব শেয়ালের প্রথম মা পর্যন্ত সব মা। বিশ্বাস করো!’
‘অবাক হচ্ছি শুনে,’ আমি বললাম, ধোয়া দিয়ে শেয়াল তাড়ানোর জন্য তৈরি করে রাখা কাঠের গাদায় আগুন দিতেও ভুলে গেছি, ‘আমি শুনে খুবই অবাক হয়ে গেলাম। দূরের উত্তর থেকে আমি স্রেফ ভাগ্যচক্রেই এখানে এসেছি, আমার সফরও বেশি দিনের জন্য না। তা তোমরা শেয়ালেরা চাচ্ছটা কী?
আর আমার এই কথাগুলো– খুব সম্ভব বেশি বন্ধুত্বের স্বরে বলে ফেলেছি –তাদের যেন সাহস দিল, তারা আমার অনেক কাছে চলে এল গোল হয়ে; দ্রুত শ্বাস ফেলছে তারা সবাই, তাদের গলায় গরগর শব্দ হচ্ছে।
‘আমরা জানি, সবচেয়ে বুড়োটা শুরু করল, ‘তুমি উত্তর থেকে এসেছ; আমাদের আশাও ঠিক এটার কারণেই। ঐ উত্তরের লোকেরা সবকিছু যেভাবে বোঝে তা এই এখানের আরবেরা বোঝে না। তুমি তো বোঝোই, তাদের শীতল ঔদ্ধত্যের মধ্যে যুক্তিবুদ্ধির সামান্য কোনো ঝলকও নেই। তারা পশু মারে তাদের খাওয়ার জন্য, আর পচা মাংসে তাদের কী অভক্তি।
‘এত জোরে কথা বোলো না,’ বললাম আমি, ‘কাছেই আরবরা শুয়ে আছে।
‘তুমি বোধ হয় আসলেই এখানে একদম নতুন, শেয়াল বলল, না হলে তুমি জানতে কোনো দিন কোনো ইতিহাসে নেই যে কোনো শেয়াল কোনো আরবকে ভয় পেয়েছে। তোমার কেন মনে হয় যে আমরা ওদের ভয় পাব? ওদের মতো প্রাণীদের সঙ্গে যে আমাদের থাকতে পাঠানো হয়েছে, তাই কি যথেষ্ট দুর্ভাগ্য নয়?
‘হতে পারে, হতে পারে,’ বললাম আমি, আমার চিন্তা থেকে অনেক দূরের এমন কোনোকিছুর বিচার করা আমার ধাতে নেই; শুনে মনে হচ্ছে খুব খুবই পুরোনো কোনো বিবাদ এটা; তার মানে সম্ভবত রক্তে বয়ে আসছে এটা; তার মানে রক্তেরই দরকার হবে এটা মিটাতে।
‘তুমি অনেক বুদ্ধিমান, বুড়ো শেয়াল বলল; আর এবার তারা সবাই শ্বাস ফেলছে। আরো ত্বরিত বেগে; এদের ফুসফুসে চাপ পড়ছে, তার পরও সোজা দাঁড়িয়ে আছে এরা; এদের হাঁ-করা মুখ থেকে একটা বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে, আমাকে মাঝেমধ্যে দাঁত কিড়মিড়িয়ে সহ্য করতে হচ্ছে তা, ‘তুমি অনেক বুদ্ধিমান; তুমি যা বললে তা আমাদের একটা প্রাচীন শিক্ষার সঙ্গে মিলে যায়। অতএব, আমাদেরকে ওদের খুন ঝরাতে হবে, তবেই শেষ হবে এই বিবাদ।’
‘ওহ্! আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলাম, যতটা চেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি উত্তেজিত হয়ে, ওরা তো নিজেদের রক্ষা বোঝে; ওদের বন্দুক দিয়ে ওরা তোমাদের গুলি করে মারবে দলে দলে।
‘আমাদের বোঝোনি তুমি,’ সে বলল, “মানুষদের স্বভাবমতোই, মনে হচ্ছে দূরের উত্তরের মানুষদেরও একই স্বভাব। ওদের মেরে ফেলার সামান্য কোনো চিন্তা আমাদের মাথায় নেই। নীল নদের সমস্ত পানি দিয়ে ধুলেও আমাদের কোনো দিন সাফ করা যাবে না। ওদেরকে জ্যান্ত দেখলেই তো আমরা বিশুদ্ধ একটু বাতাসের জন্য দৌড়ে পালাই, সোজা মরুভূমির দিকে, তাই তো ওখানেই আমাদের ঘর।
আর আমাকে ঘিরে থাকা সব শেয়াল, দূর থেকে এসে নতুন অনেকে যোগ হয়েছে বলে সংখ্যায় তারা এখন আরো বেড়েছে, মাথা নিচু করল তাদের সামনের দু-পায়ের মাঝখানে, থাবা দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল পা দুটো দেখে মনে হচ্ছে তারা তাদের ঘৃণা লুকাতে চাচ্ছে, এমন তীব্র সেই ঘৃণা যে আমার মনে হলো একটা বিরাট লাফ দিয়ে এদের এই দল থেকে সোজা পালিয়ে চলে যাই।
‘তাহলে কী করবে বলে ঠিক করেছ তোমরা? আমি জিগ্যেস করলাম, চেষ্টা করছি উঠে দাঁড়াতে, কিন্তু পারলাম না; আমার পেছন দিকে দুটো কমবয়সী জানোয়ার আমার কোট আর জামায় তাদের দাঁত বসিয়ে রেখেছে; আমাকে বসেই থাকতে হলো। ওরা তোমার কাপড়ের পেছনটা ধরে আছে, গম্ভীর গলায় ব্যাখ্যা করল বুড়ো শেয়াল, এটা তোমাকে সম্মান দেখানোর জন্যই। ওদের আমাকে ছাড়তে বল!’ আমি চিৎকার দিলাম, একবার তাকাচ্ছি বুড়ো শেয়ালের দিকে, একবার কমবয়সীগুলোর দিকে। আরে, অবশ্যই ওরা তোমাকে ছেড়ে দেবে, বুড়োটা বলল, যদি তাই তুমি চাও, তা-ই হবে। কিন্তু অল্প একটু সময় লাগবে, কারণ আমাদের প্রথামত ওরা একেবারে গভীর কামড় বসিয়ে দিয়েছে, এখন তো প্রথমে আস্তে আস্তে চোয়াল ঢিলা দিতে হবে। এই মাঝের সময়টুকুতে তুমি যদি একটু আমাদের আবেদনটা শুনতে। তোমাদের আচরণের কারণে আমি কোনোকিছু ঠিক শোনার মেজাজে নেই,’ আমি বললাম। আমাদের অমার্জিত আচরণের জন্য আমাদের ওপর খেপে যেয়ো না, সে বলল, আর প্রথমবারের মতো তার স্বভাবসিদ্ধ কান্নার মতো সুরে বলতে লাগল, ‘আমরা হতভাগা জন্তু, পঁাত ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই; আমরা যা-ই করতে চাই, ভালো হোক বা মন্দ, সবকিছুর জন্য ওই দাঁতই আমাদের একমাত্র ভরসা। তাহলে চাচ্ছটা কী তোমরা, বল?” আমি বললাম, মাথা সামান্য ঠান্ডা হয়েছে।
‘প্রভু, সে চিৎকার দিল, সব শেয়ালও একসঙ্গে বিলাপধ্বনি করে উঠল; অনেক দূরের থেকে যেসব ধ্বনি এল তা আমার কানে শুনতে লাগল কোনো গানের সুরের মতো। প্রভু, আপনাকে এই বিবাদ থামাতে হবে, এই বিবাদে পৃথিবী ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রাচীন শেয়ালেরা বলে গেছে যে আপনিই সেই মানুষ যে কিনা এই বিবাদ থামাতে পারবে। আরবদের হাত থেকে আমরা মুক্তি চাই; চাই সেই বাতাস, যাতে আমরা শ্বাস নিতে পারব; দিগন্তের পুরো বৃত্তটা ওদের বিদায়ে শুদ্ধ হয়ে যাক তা-ই চাই; আরবের চাকুতে জবাই হওয়া কোনো ভেড়ার আর্তচিৎকার আর কোনো দিন না; যত ধরনের পশু আছে সবাই যেন শান্তিতে মরতে পারে; ওই পশুদের রক্ত খেয়ে পুরো খালি করে দেওয়ার সময়, এবং ওদের হাড় পর্যন্ত চেটেপুটে সাফ করার সময় আর যেন কেউ আমাদের ত্যক্ত না করে। শুদ্ধতা, শুদ্ধতাই আমাদের একমাত্র কামনা।’– এবার ওরা সব একসঙ্গে কাঁদছে আর ফোঁপাচ্ছে– “কী করে আপনি এসব এই পৃথিবীতে সহ্য করে যাবেন, আপনার হৃদয় তো শুদ্ধ, আপনার পেটের ভেতরটা তো বিশুদ্ধ! ওদের সাদা কাপড়গুলো নোংরা; ওদের কালোগুলোও নোংরা; ওদের দাড়ি দেখলে তো বমি আসে; ওদের চোখের কোনাগুলো দেখলে থুতু ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না; আর যখন ওরা হাত উপরে তোলে, জাহান্নামের গর্তটা হাঁ করে থাকে ওদের বগলে। সুতরাং, ও প্রভু, সুতরাং, ও আমাদের ভালোবাসার প্রভু, আপনার এই মহা শক্তিশালী হাত দুটো দিয়ে, আপনার এই মহাশক্তিশালী দুই হাতের সাহায্যে, এখানের এই কাঁচিটা তুলে নিন আর ওদের গলা কেটে দিন!’ তারপর বুড়োর মাথা নাড়িয়ে একটা ইশারা, একটা শেয়াল এল দুলতে দুলতে, ওটার মুখের কোনার দিকের একটা দাঁত থেকে ঝুলছে বহু পুরোনো মরচেতে ঢাকা একটা ছোট সেলাইয়ের কাঁচি।
‘আচ্ছা, শেষমেশ তাহলে আমরা কাচি পর্যন্ত চলে এসেছি, যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট! আমাদের কাফেলার আরব নেতা চিৎকার করে বলল, সে বাতাসের উল্টোদিকে হামা দিয়ে দিয়ে আমাদের কাছে চলে এসেছে, আর এখন তার বিশাল চাবুক দিয়ে সপাং সপাং মারছে।
সব শেয়াল দৌড়াল পড়িমড়ি, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল একসঙ্গে জড়ো হয়ে; এতগুলো পশু একসঙ্গে এমন শক্ত আর এটেসেঁটে আছে যে তাদের দেখতে লাগছে একটা ছোট দেয়ালের মতো, তাদের ঘিরে আছে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা আলেয়ার আলো।
‘তাহলে, প্রভু, এবার তো মচ্ছবটা আপনিও দেখলেন আর শুনলেন,’ বলল আরব, ততটাই মন খুলে হাসছে যতটা তার জাতির ভারিক্কি ভাবের মধ্যে কুলায়। তো তুমি জানো, ওই জন্তুগুলো কী চাচ্ছে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম। নিঃসন্দেহে, প্রভু,’ সে বলল, ‘এ তো সবার জানা; যতদিন ধরে আরবেরা আছে তত দিন এই কাঁচি মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত ওটা আমাদের সঙ্গে ঘুরবে। প্রত্যেক ইউরোপিয়ানকেই কাঁচিটা দেওয়া হয়েছে মহান কাজটা সমাধা করার জন্য; তারা যে ইউরোপিয়ানকেই দেখে, তাকেই ভাবে ইনিই সেই লোক যাকে পাঠানো হয়েছে এই মহান কাজ শেষ করার জন্য। কাণ্ডজ্ঞানহীন এক আশা ওদের, ওই জানোয়াগুলোর; ওরা বোকা, সাক্ষাৎ বোকা। আর সেজন্য আমরা ওদের ভালোও বাসি; ওরা আমাদের কুকুর; আপনার যা আছে তার চেয়ে সুন্দর কুকুর। এবার দেখুন, গত রাতে একটা উট মরেছে, আমি মড়াটা এখানে আনার ব্যবস্থা করেছি।’
চার বাহক হাজির হলো, বিশাল মড়া ছুঁড়ে ফেলল আমাদের সামনে। ওটা মাটিতে পড়তেও পারেনি, শেয়ালগুলো তাদের ডাক ছাড়া শুরু করেছে। যেন তাদের প্রত্যেককেই টানা হয়েছে এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে, এভাবে আসছে তারা, ইতস্তত করতে করতে, ওদের পেট ঘসটাচ্ছে মাটিতে। আরবদের কথা তারা ভুলে গেছে, তাদের ঘৃণার কথাও ভুলে গেছে; সবকিছু মিলিয়ে গেছে তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা এই দুর্গন্ধ ছড়ানো মড়ার সামনে। একটা শেয়াল এরই মধ্যে উটের গলা ধরে ঝুলে পড়েছে, প্রথম কামড়েই সোজা দাঁত বসিয়ে দিয়েছে ধমনিতে। এর শরীরের প্রতিটা মাংসপেশি কেঁপে কেঁপে আর ঝাঁকি দিয়ে উঠছে, ঠিক একটা খ্যাপাটে ছোট পাম্পের মতো– নাছোড়বান্দা ও আশাহীন একটা পাম্প– ওটার যেন কাজ পড়েছে দাউদাউ জ্বলতে থাকা কোনো আগুন নেভাবার। এরই মধ্যে মড়াটার উপর ওরা সব ঢিবির মতো উঁচু হয়ে হামলে পড়েছে, প্রত্যেকে ব্যস্ত আগের শেয়ালটার মতো একই রকম।
এ সময়ে নেতা তার চাবুক চালাতে শুরু করল শেয়ালগুলোর পিঠের উপরে –শা শা করে, এদিকে ওদিকে। তারা মাথা তুলেছে; এখনো তাদের পরম খুশি ও ঘোরের মধ্যে অর্ধেক ডুবে আছে; এবার দেখল তাদের সামনে আরবরা দাঁড়িয়ে; এবার চাবুকের কামড় পড়ল তাদের লম্বা চোয়াল বরাবর; তারা পেছন দিকে লাফিয়ে, সরে গেল। কিছুটা। কিন্তু তাতে কী, এরই মধ্যে উটের রক্তে মাটিতে নালা হয়ে গেছে, ভাপ উঠছে উঁচুতে; ওটার শরীরের নানা জায়গাই ছিঁড়ে ফেড়ে হাঁ হয়ে আছে। তারা আর লোভ সামলাতে পারল না; আবার একবার ফিরে এল; আবার একবার নেতা তার চাবুক তুলল; আমি তাকে হাত ধরে আটকালাম।
‘আপনিই ঠিক, প্রভু,’ সে বলল, ‘ওরা ওদের কাজ করুক; তা ছাড়া, তাঁবু গোটানোরও সময় হয়ে এসেছে। যা হোক, আপনি তো ওদের দেখলেন এবার। অদ্ভুত জম্ভ সব, নাকি? আর আমাদের কত ঘৃণা করে ওরা!’
খনি পরিদর্শন
আজ প্রধান প্রকৌশলীরা আমাদের দেখতে নিচে নেমে এসেছে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নির্দেশ জারি করেছেন নতুন একটা টানেল খোঁড়ার কাজ শুরু করতে হবে, তারপরই এসেছে এই প্রকৌশলীদের দল– প্রাথমিক জরিপ সারবার উদ্দেশ্যে। এরা বয়সে কত কম, কিন্তু এ-বয়সেও একজন আরেকজন থেকে কত আলাদা! এরা সব গড়ে উঠেছে স্বাধীনভাবে, আর এরকম কম বয়সেও এদের মধ্যে কেমন সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে যার যার নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো।
একজন, কালো চুলের ও প্রাণবন্ত ধরনের, সব দিকে তাকাচ্ছে, সবকিছুর দিকে।
দ্বিতীয় একজনের হাতে নোটপ্যাড, হাঁটতে হাঁটতে নোট নিচ্ছে, তাকাচ্ছে চারপাশে, পার্থক্য বিচার করছে, আবার লিখছে আরো কিছু।
তৃতীয় একজন, তার জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে –এর ফলে তার সবকিছুই দেখতে লাগছে টান টান, টেনশনে ভরা– হাঁটছে শক্ত, খাড়া হয়ে, কী এক গাম্ভীর্য তার আচরণে; শুধু তার অবিরাম ঠোঁট কামড়ানো দেখেই না বোঝা যাচ্ছে কেমন অধৈর্য আর বাঁধ-না-মানা বয়সের এক যুবক সে।
চতুর্থজন তৃতীয়জনকে কীসব ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে, যদিও সে তার কাছে ঐ ব্যাখ্যা চেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না; সে তৃতীয় জনের চেয়ে খাটো, তার পাশে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে কোনো তদবিরকারীর মতো, তার তর্জনী উঁচুতে তুলে মনে হচ্ছে চারপাশে যা যা আছে সবকিছু নিয়ে সবিস্তারে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে।
পঞ্চম জন, সে-ই মনে হচ্ছে দলের মধ্যে পদের দিক থেকে সবার বড়, কাউকে সঙ্গে হাঁটতে বোধহয় মানা করে দিয়েছে; এই এক্ষুনি সে সামনে, এই আবার একেবারে পেছনে; পুরো দল তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে; এর চেহারা ফ্যাকাশে আর স্বাস্থ্য দুর্বল; দায়িত্বের ভারে এর দু-চোখ কেমন কোটরে ঢুকে গেছে; মাঝেমধ্যে সে কপালে হাত ঠেকিয়ে চিন্তা করে নিচ্ছে।
ষষ্ঠ ও সপ্তম জন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, সামনে একটু ঝুঁকে, মাথা একসঙ্গে করে খুব অন্তরঙ্গ কোনো আলাপ সারছে এরা; এটা যদি এরকম সুস্পষ্ট আমাদের কয়লাখনি না হতো, সবচেয়ে গভীর এক টানেলে আমাদের কাজের জায়গা না হতো, তাহলে এই রোগা, পিণ্ডাকৃতি নাকওয়ালা, মুখে দাড়ি ছাড়া এই ভদ্রলোকদের দেখে যে-কারো মনে হতো, এরা কমবয়সী একদল কেরানি। এ দলের একজন নিজের মনে হাসছে বিড়ালের মতো গরগর আওয়াজ করে; অন্যজন, সেও হাসছে, সে-ই বলছে বেশিরভাগ কথা, আর তার হাত খুশিমতো ঝাঁকিয়ে কেমন যেন সময়ের তাল রেখে চলেছে কথা বলতে বলতে। এ দুজন তাদের চাকরির ব্যাপারে কত নিশ্চিন্ত-নিরুদ্বেগ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমাদের খনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এদের গুরুত্বের প্রমাণ (যদিও বয়সে এরা তরুণ) এরা এরই মধ্যে কত ভালোভাবেই না দিয়েছে যে, এরকম এক জরুরি পরিদর্শনে এসেও, আর একেবারে এদের বসের দুচোখের সামনেই এরা কেমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে এদের ব্যক্তিগত আলাপ সালাপ, কিংবা অন্তত এমন কোনো আলাপ যার সঙ্গে এই এখনকার কাজের কোনো যোগাযোগ নেই। নাকি আসলে এমন হতে পারে যে এদের এই এত হাসাহাসি আর এই গা ছাড়া ভাব আসলে একটা ধোকা– বাস্তবে কোনো সত্যিকারের দরকারি বিষয়ই এদের চোখ এড়াচ্ছে না? এ জাতীয় ভদ্রলোকদের ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনো উপসংহার টানার ঝুঁকি বলতে গেলে কেউই নেবে না।
অন্যদিকে এটা প্রশ্নাতীত যে অষ্টমজন, যতখানি তার কাজে নিবিষ্ট আর বিষয়ে-উপস্থিত তার সঙ্গে অন্য কারোই তুলনা চলে না, নিঃসন্দেহে তা সে ঐ দুজন বা অন্য যে-কারো থেকে বেশি। যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই কোনোকিছু ছুঁয়ে দেখতে হবে তাকে, ছোট এক হাতুড়ি দিয়ে টোকা দিতে হবে, মনে হচ্ছে অনন্তকাল সে এই হাতুড়ি তার পকেট থেকে বার করছে আর ফের ঢুকিয়ে রাখছে। প্রায়ই ধুলোর মধ্যে, তার এই সুন্দর পোশাক সত্ত্বেও, হাঁটু দিয়ে বসছে সে, টোকা দিচ্ছে মাটিতে, তারপর আবার যেতে যেতে টোকা দিচ্ছে খনির দেয়ালে ও মাথার উপরের ছাদে। একবার সে মেঝেতে শুয়ে পড়ল টান টান হয়ে, স্থির পড়ে থাকল; আমরা ভাবা শুরু করেছি যে নিশ্চিত কোনোকিছু ঘটেছে তার; কিন্তু তারপর তার ছিপছিপে শরীরটায় একটা ছোট আঁকি দিয়ে লাফ মেরে সে আবার উঠে দাঁড়াল দুই পায়ে। তার মানে কোনো একটা কিছুর পরীক্ষা করছিল সে। আমাদের ধারণা আমাদের এই খনি আমরা চিনি, এর শিলার স্তর বিষয়েও জ্ঞান রাখি, কিন্তু এভাবে এই প্রকৌশলী সাহেব লাগাতার কী নিরীক্ষা-অন্বেষণ করে চলেছে তা আমাদের মাথায় আসে না।
নবম জন একটা বাচ্চাদের চার চাকার স্ট্রলারের মতো জিনিস ঠেলে নিয়ে চলেছে, ওটার ভেতর সব মাপজোকের যন্ত্রপাতি। প্রচণ্ড দামি জিনিস ওগুলো; একদম সেরা তুলো গজের মধ্যে বসানো। স্ট্রলার ঠেলার কাজ আসলে কোনো পিয়ন-নিয়নের হওয়ার কথা, কিন্তু ওরকম কারো ওপর ভরসা রাখা যায়নি। রীতিমতো একজন প্রকৌশলীই দরকার পড়েছে স্ট্রলার ঠেলতে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এ কাজ সে করছে খুশিমনেই। মনে হয় এর বয়সই সবার চেয়ে কম, সম্ভবত এখনো সে যন্ত্রপাতিগুলো ভালোভাবে চেনেও না, তাতে কী, একনাগাড়ে সে তাকিয়ে আছে ওগুলোর দিকে; এতে করে মাঝেমধ্যে খনির দেয়ালে প্রায় ধাক্কা খেয়ে বসার জোগাড় হচ্ছে তার।
কিন্তু স্ট্রলারটার পাশে হাঁটছে অন্য আরেকজন প্রকৌশলীও, তার কারণেই দেয়ালে ধাক্কা খাওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে ওটা। এটা স্পষ্ট যে এই লোক যন্ত্রপাতিগুলো একদম বিশদভাবে চেনে-জানে, দেখেও মনে হচ্ছে সে-ই আসলে আছে ওগুলোর দায়িত্বে। একটু পর পর স্ট্রলার না-থামিয়েই সে হাতে তুলে নিচ্ছে কোনো একটা যন্ত্র, ওটার ভেতরে তাকাচ্ছে, ওটার ভ্রু খুলছে বা বন্ধ করছে, ওটা ঝাঁকি দিচ্ছে বা টোকা দিচ্ছে, কানের মধ্যে ধরছে, শুনছে; আর শেষে, স্ট্রলার ঠেলতে থাকা লোকটা যেই একটু থেমে দাঁড়াচ্ছে (এমনটা সে করছে নিয়মিতই), ছোট জিনিসটা, যেটা দূর থেকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না ঠিকমতো, সে আবার রেখে দিচ্ছে স্ট্রলারে, খুব সাবধানে, ওটার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায়। এই প্রকৌশলীর আচরণ একটু আধিপত্যসুলভ, কিন্তু সে যদি তা হয়ও,তা স্রেফ ওই যন্ত্রগুলোর কারণেই। তার আঙুলের নীরব ইশারায় আমাদের, স্ট্রলারের কমপক্ষে দশ পা আগে থাকতেও, স্ট্রলার চলার পথ করে দিতে সরে যেতে হচ্ছে, এমনকি যখন পাশে সরার মতো কোনো জায়গা নেই, তখনো।
এই দুই ভদ্রলোকের পেছনে আসছে পিয়নমতো সহচরটা, কোনো কাজ নেই তার। এই ভদ্রলোকেরা –বোঝাই যায় যে তাদের বিশাল জ্ঞানের কারণে –তাদের আচরণের মধ্যে থেকে বহু আগেই যখন কিনা সব অহমিকা ঝেড়ে ফেলেছে, এই পিয়নকে দেখলে। কিন্তু মনে হচ্ছে ওগুলো সব সে জড়ো করে নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে বসেছে। তার শরীরের পেছনে একটা হাত গুঁজে দিয়ে, আর অন্যটা তার ইউনিফর্মের সুন্দর কাপড় কিংবা গিল্টি করা বোতামগুলোতে বোলাতে বোলাতে, সে অনবরত মাথা নেড়ে চলেছে একবার ডান দিকে, একবার বাঁয়ে, তার ভাবটা এরকম যেন আমাদের কাছ থেকে সে বোধ হয় সালাম পেয়েছে, কিন্তু তার ঐ বিরাট উঁচু অবস্থানের কারণে, সে আসলে নিশ্চিত হতে পারছে না। আমরা সত্যি তা তাকে দিয়েছি কি না। এটা তো আর বলতে হয় না যে তাকে এ রকম কোনো সালাম-টালাম আমরা দিইনি, যদিও তার চেহারা দেখে আপনার প্রায় এমনই ধারণা হবে যে আমাদের খনি-কোম্পানির অফিস-পিয়ন হতে পারার মধ্যে সত্যি তাক। লাগানো কোনো ব্যাপার আছে। কোনো সন্দেহ নেই, এ ব্যাটা সামনে গেলে ওর পেছনে। আমরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছি, তবে যেহেতু কোনো বজ্রপাতেরও ক্ষমতা নেই তাকে। পেছনে ফেরায়, তাই যেভাবেই হোক আমাদের কাছে সে এক বোধের অগম্য চরিত্র হিসেবেই রয়ে গেল।
আজ আর বেশি কোনো কাজকর্ম হবে না; নিত্যদিনের কাজে আজকের এই বাধা লম্বা সময় ধরে চলেছে; এরকম একটা পরিদর্শনের তোড়ে সব কাজের চিন্তা মাথা থেকে উড়ে যেতে বাধ্য। তার চেয়ে বরং আমাদের সবারই লোভ হচ্ছে, ওখানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি ঐ ভদ্রলোকদের দিকে যারা এখন অদৃশ্য হয়ে গেছেন পরীক্ষামূলক-টানেলের অন্ধকারের মধ্যে। তা ছাড়া, আমাদের শিফটও তো আর কিছুক্ষণ পরেই শেষ হচ্ছে; তারা যখন ফিরে আসবে তখন আমরা আর এখানে থাকব না।
পাশের গ্রাম
আমার দাদা বলতেন: জীবন আশ্চর্য রকমের ছোট। এখন যখন আমি পেছন ফিরে তাকাই, দেখি আমার স্মৃতিতে সবকিছু এত ঘন হয়ে আছে যে আমি, উদাহরণ হিসেবে বলছি, আমি বলতে গেলে বুঝতেই পারি না কীভাবে কোনো যুবক মনস্থির করে সে ঘোড়ায় করে পাশের গ্রামে যাবে, কীভাবে এ ব্যাপারে তার কোনো ভয় হবে না যে– সম্ভাব্য যেকোনো দুর্ঘটনার কথা বাদই দিলাম– একটা স্বাভাবিক, সুখী জীবনের পুরো সময়কালও ওরকম এক সফরের জন্য একেবারেই যথেষ্ট নয়।
সম্রাটের কাছ থেকে একটি বার্তা
কথিত আছে, সম্রাট তার মৃত্যুশয্যায় তোমার কাছে, কেবল তোমার কাছে– তুমি, যে তার এক দুর্ভাগা প্রজা, যে কিনা সাম্রাজ্যের সূর্য থেকে পালিয়ে যাওয়া এক ক্ষুদ্র ছায়ামাত্র– নির্দিষ্ট করে সেই তোমার কাছেই পাঠিয়েছেন একটি বার্তা। বার্তাবাহককে তিনি তার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসতে বলেছেন, তারপর ফিসফিস করে তাকে বার্তাটা দিয়েছেন; এই বার্তা নিয়ে তার এতই উদ্বেগ যে তিনি বাহককে আবার সেটা তার নিজের কানে ফিসফিস করে পুরো শোনাতেও বাধ্য করেছেন। নিজের মাথা একবার নাড়িয়ে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, হ্যাঁ, বাহক যা বলল তা ঠিক আছে। আর তার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে জড়ো হওয়া সব মানুষজনের সামনে– পথে বাধা তুলে দাঁড়ানো সব দেয়াল ভেঙে ফেলা। হয়েছে, সাম্রাজ্যের গণ্যমান্য যত মানুষ তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐ উপরে উঠে যাওয়া, প্রশস্ত সিঁড়িপথ ধরে –এদের সবার সামনে, তিনি বার্তাবাহককে রওনা করিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ বার্তাবাহক বের হলো তার সফরে; শক্তিশালী, ক্লান্তিহীন এক মানুষ সে; একবার এই হাত সামনে বাড়িয়ে, আরেকবার ওই হাত, সে দৃঢ়ভাবে সামনে আগাতে লাগল জনতার ভিড় ঠেলে; যখনই সে তার পথে বাধা পাচ্ছে, আঙুল তুলে তার বুকের দিকে দেখাচ্ছে –ওখানে আছে সূর্যের প্রতীকী চিহ্ন; আর যে রকম অটল-অনড় স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে তার কোনো তুলনা চলে না। কিন্তু জনতার ভিড় এত বিশাল; এদের বাসাবাড়ির কোনো শেষমাথা নেই; আহ সে যদি খোলা প্রান্তরে পৌঁছাতে পারত তাহলে কি ক্ষিপ্র বেগেই না সে উড়ে চলত, কত জলদিই না তুমি তোমার দরজায় শুনতে পেতে তার মুষ্ঠির রাজকীয় ধুপধুপ আওয়াজ। তার বদলে, সে যা করে যাচ্ছে তা কত খামোকা; এখনো সে কেবল একদম ভেতর-প্রাসাদের শোবার ঘরগুলো ঠেলেঠুলে পার হচ্ছে, কোনো দিন সে পারবে না এগুলোর শেষ মাথায় পৌঁছুতে;”আর যদি সে-চেষ্টায় সে সফলও হয়, তাতে কোনোই লাভ হবে না; এবার সিঁড়ি বেয়ে তাকে লড়াই সংগ্রাম করে নামতে হবে; আর যদি সে-চেষ্টায় সে সফলও হয়, তাতেও কোনো লাভ হবে না; প্রাসাদের উঠানগুলো পেরোতে হবে তাকে; আর উঠানগুলোর পরে দ্বিতীয়, বাইরের দিকের প্রাসাদ; আবারও কত সিঁড়িপথ, কত উঠান; আর আবার একটা প্রাসাদ; এমনটাই হাজার বছর ধরে, আরো আরো; তারপর সবশেষে যদি সবচেয়ে বাইরের তোরণ দিয়ে সে ছিঁড়েফেড়ে বেরও হয় –কিন্তু কোনো দিন, কোনো দিনও তা হবে না– এবার এখনো তার পার হওয়া বাকি থাকবে সাম্রাজ্যের রাজধানী, পৃথিবীর কেন্দ্র তা –উঁচু হয়ে আছে এর গাদে, এর তলানিতে। কেউই পারবে না সেখান থেকে বেরোবার পথ করে নিতে, আর একজন মৃত ব্যক্তির বার্তা নিয়ে তো একেবারেই না।– কিন্তু তুমি, তুমি বসো তোমার জানালায় আর যখন সন্ধ্যা নেমে আসে, স্বপ্ন দেখতে থাকো ঐ বার্তার।
পরিবারের প্রধানের জন্য একটি সমস্যা
এমন কিছু মানুষ আছে যারা বলে ওড্রাডেক শব্দটা এসেছে স্লাভোনিক ভাষা থেকে, আর তারা শব্দটার ব্যুৎপত্তিও ঐ ভাষার মধ্যেই খোঁজে। আবার অন্য অনেকে আছে যারা বলে এটা একটা জার্মান শব্দ; স্লাভোনিক দিয়ে সামান্য প্রভাবিত, এই যা। দুটো ব্যাখ্যাই অনিশ্চিত, তাই সম্ভবত এমন উপসংহার টানা ভুল না যে একটা ব্যাখ্যাও সঠিক নয়, বিশেষ করে যখন দুটোর কোনোটাই এই শব্দের অর্থ উদ্ধারে কোনো সাহায্য করতে পারছে না।
অবশ্য যদি বাস্তবেই ওড্রাডেক নামের কোনো প্রাণী না থাকত, তাহলে এই শব্দটি নিয়ে কেই বা মাথা ঘামাত? প্রথম দেখায় একে মনে হবে এক সমতল ও তারা-আকৃতির সুতোর নাটাই, আর সত্যিই একে দেখতে লাগে সুতো দিয়ে প্যাচানো কিছুর মতো; কিংবা বরং এমন কিছু যা দেখতে বহুদিন আগের কোনো সুতোর ভেঁড়া ছেঁড়া প্রান্তের মতো, বিচিত্র সব রং ও ধরনের, সব একসঙ্গে গিঁট বাঁধা, এমনকি একটা অন্যটার সঙ্গে জট পাকিয়ে আছে বলা যায়। তবে ওটা স্রেফ নাটাই নয়, কারণ তারার মাঝখান থেকে বেরিয়ে আছে একটা ছোট কাঠের ক্রসবার, সেটা থেকে আবার সমকোণে বেরিয়ে গেছে অন্য একটা ছোট ক্রসবার। এক পাশে পরের এই বার আর অন্য পাশে তারার এক বাহুর মাথা, এই দুয়ে মিলে পুরো জিনিসটা মাটিতে দাঁড়াতে পারে খাড়া হয়ে, মনে হবে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আপনার এমন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হবে যে এই কাঠামোটির নকশার মধ্যে আগে একটা প্রায়োগিক ব্যাপার ছিল আর তাই এর এখনকার চেহারাটা আসলে ভাঙা কোনো চেহারা। কিন্তু মনে হয় না ব্যাপারটা তেমন কিছু; অন্তত সেরকম কিছুর আভাস এর মধ্যে নেই; এর কোথাও কোনো চিড়-ফাট কিংবা ভাঙা-কাটার পরের অবশিষ্ট অংশ নেই যা দেখে ওরকম কিছু ভাবা যায়; পুরো জিনিসটাই নিশ্চিত মনে হবে অর্থহীন, তার পরও এর নিজের মতো করে সম্পূর্ণ। এর চেয়ে নির্দিষ্ট করে একে নিয়ে কিছু বলা অসম্ভব, কারণ ওড্রাডেক অস্বাভাবিক সচল আর একে ধরার কোনো উপায়ই নেই।
সে পালা করে বাস করে চিলেকোঠায়, সিঁড়িতে, বারান্দায় আর বাড়িতে ঢোকার পথটায়। কখনো এমন হয় যে একে কয়েক মাস দেখা যায় না; মানে আপনি অনুমান করে নিতে পারেন সে অন্য কোনো বাড়িতে গিয়েছে; কিন্তু তারপর নিশ্চিত একদিন সে আবার ফিরে আসে আমাদের বাসায়। মাঝেমধ্যে যখন আপনি, ধরুন, বেরিয়েছেন আপনার ঘর থেকে, আর একই সময় সে নিচে সিঁড়ির হাতলে ভর দিয়ে খাড়া হচ্ছে, তখন আপনার মন চাইবে এর সঙ্গে কথা বলি। স্বাভাবিক যে একে আপনি কোনো কঠিন প্রশ্ন করবেন না; সবাই একে –এর ক্ষুদ্র আকারের কারণে ব্যাপারটা আরো বেশি হয় –বাচ্চা হিসেবেই দেখে। কী নাম তোমার? আপনি জিগ্যেস করলেন। ওড্রাডেক, সে বলল। তা, তুমি থাকো কোথায়?’ ‘কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, সে বলল আর হাসল; কিন্তু তা এমন একধরনের হাসি যা কেবল ফুসফুস না-থাকলেই হাসা সম্ভব– শুনতে অনেকটা ঝরা পাতার ঝিরঝির আওয়াজের মতো। সাধারণত আলাপের এখানেই শেষ। এমনও হতে পারে, সে হয়তো আপনাকে এত কিছু উত্তর করলই না; প্রায়ই সে বোবা হয়ে থাকে দীর্ঘদিন– তার শরীর যে কাঠ দিয়ে বানানো মনে হয়, সেই কাঠের মতো বোবা।
মিছেমিছি আমি মনে মনে ভাবি, ওড্রাডেকের ভাগ্যে কী আছে। ওর পক্ষে কি মরা সম্ভব? যা-কিছুরই মৃত্যু হয় তার আগে কোনো-না-কোনো লক্ষ্য থাকে, কোনো-না-কোনো ক্রিয়াকর্ম থাকে, দেখা যায় সেই ক্রিয়াকর্ম করতে গিয়েই তার ক্ষয় হয়েছে; ওড্রাডেকের বেলায় এ কথা খাটে না। তাহলে কি এমন হতে পারে যে দেখা যাবে একদিন ওড্রাডেক তখনো সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে –তার পেছনে ঝুলে ঝুলে আসছে সুতোর মাথাগুলো– হাজির হয়েছে আমার ছেলেমেয়ের আর আমার ছেলেমেয়েরও ছেলেমেয়ের পায়ের সামনে? কোনো সন্দেহ নেই, সে কারো কোনো ক্ষতি করে না; কিন্তু এই চিন্তা যে সে এমনকি আমার পরেও বেঁচে থাকতে পারে, এটা ভাবতে আমার কেমন যেন কষ্ট হয়।
এগারো ছেলে
আমার এগারো ছেলে।
প্রথম ছেলের চেহারায় বিশেষত্ব কিছু নেই, কিন্তু সে সিরিয়াস ও বুদ্ধিমান; তা সত্ত্বেও ওকে নিয়ে আমার কোনো উঁচু ধারণা নেই, যদিও আমি ওকে ভালোবাসি আমার অন্য সব ছেলের মতোই। ওর চিন্তাভাবনা আমার কাছে মনে হয় একটু বেশি সোজা। সে ডান-বা কোনো দিকেই তাকায় না আর তার দৃষ্টি খুব দূরে যায় না; সে সারাক্ষণ ছুটে বেড়ায় তার। চিন্তার সীমিত গণ্ডির ভেতরেই, কিংবা বলা যায়, এর মধ্যেই ঘুরপাক খায়।
দ্বিতীয় ছেলে দেখতে সুন্দর, পাতলা গড়নের, সুগঠিত শরীর; তরবারি খেলার সময় নিজেকে সে যেভাবে সামলায় তা দেখে ভালো লাগে। সেও বুদ্ধিমান বটে, আর পৃথিবীতে চলার কায়দায় দড়; অনেক কিছু দেখেছে সে, তাই যারা বাড়িতে থেকে গেছে তাদের চেয়েও আমাদের দেশজ গাছপালা-প্রাণীকুল এসব মনে হয় অনেক ভালো বোঝে সে। তবে তার এই গুণ যে কেবল, কিংবা প্রাথমিকভাবে, তার অনেক ভ্রমণের কারণে হয়েছে কোনোভাবেই তা বলা যাবে নয়; বরং এটার কারণ এই ছেলের অনুকরণীয় সহজাত প্রতিভা, যে প্রতিভার ছাপ, উদাহরণস্বরূপ, যে-কারোই চোখ পড়বে যখন কেউ তার সেই চোখ-ধাঁধানো উঁচু থেকে পানিতে ডাইভ দেওয়া নকল করার চেষ্টা করবে, কত কত বার শরীর মুচড়িয়ে কিন্তু তার পরও সবকিছু কত আবেগ নিয়ে শক্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখে সে। ম্প্রিং-বোর্ডের একদম শেষ মাথা পর্যন্ত তার মতো করে ডাইভ দেওয়ার ইচ্ছা ও সাহস হয়তো ভালোভাবে বজায় থাকবে, কিন্তু তারপর তার নকলকারী ডাইভ দেওয়ার বদলে হঠাৎ বসে পড়বে আর হাত তুলে মাফ চাইতে থাকবে। তবে এসব সত্ত্বেও– যদিও পিতা হিসেবে আমার উচিত এ রকম এক ছেলে নিয়ে গর্ব হওয়া –তার প্রতি আমার অনুভূতি পুরোপুরি পক্ষপাতমূলক নয়। তার বা চোখ ডানেরটার চেয়ে সামান্য ছোট, আর ওটা অনেক বেশি পিটপিট করে; কোনো সন্দেহ নেই, খুব সামান্য একটা খুঁত, যা বরং তার চেহারাকে দিয়েছে আরেকটু বাড়তি আত্মবিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তির ছাপ, আর তার কাছে যাওয়া-যায়-না এমন নির্লিপ্ত ভাবভঙ্গি ও তার ব্যক্তিত্বের নিখুঁত বৈশিষ্ট্যের কারণে কারো কাছেই ঐ ছোট, পিটপিট করা চোখকে কোনো খুঁত বলেও মনে হবে না। কিন্তু আমি, তার বাবা, তা-ই মনে করি। নিশ্চিত, তার এই শারীরিক খুঁত নিয়ে আমার কোনো কষ্ট নেই, আমার কষ্ট তার এই খুঁতের সঙ্গে কীভাবে যেন তাল মেলানো তার এক মানসিক অসমতা। নিয়ে, ওটা তার রক্তের মধ্যে চলা এক বিষের মতো, তার জীবনের ছক –যা শুধু আমিই দেখতে পাই– সুসংহত করার এক বিশেষ অক্ষমতা নিয়ে। অন্যদিকে, বলতেই হবে, ঠিক এই বৈশিষ্ট্যই তাকে বানিয়েছে আমার সত্যিকারের পুত্র, কারণ তার এই দোষ একই সঙ্গে আমাদের পুরো পরিবারেরই দোষ, স্রেফ তার মধ্যে সেটা একটু প্রকট এই যা।
তৃতীয় ছেলেও একই রকম দেখতে সুন্দর, কিন্তু আমি যে ধরনের সুন্দর চেহারা পছন্দ করি তেমনটা নয়। তার সৌন্দর্য গায়কের সৌন্দর্য: বাঁকা ঠোঁট; স্বপ্নিল চোখ; এমন মাথা যার সৌষ্ঠব ঠিকমতো ফুটে ওঠার জন্য পেছনে মঞ্চের পর্দা থাকার দরকার পড়বে; অতিরিক্ত রকমের চিতিয়ে থাকা বুক; দুই হাত যা ঝাঁপটা দিয়ে উপরে ওঠে ত্বরিত গতিতে, আর তারও বেশি তৃরিত গতিতে নিচে নামে; দ্বিধাগ্রস্ত দুই পা, কারণ শরীরের ভার বইবার সামর্থ ওদের নেই। এর ওপরে আরো বলতে হয়: তার গলার স্বরে আছে অপূর্ণতা, ক্ষণিকের জন্য ওটা আপনাকে মিষ্টি কিছুতে ভোলাবে; সমঝদার বিচারক কান খাড়া করবে; কিন্তু একটু পরেই তা মিলিয়ে যাবে কোথাও।– সার্বিক বিচারে যদিও আমার খুব লোভ হয় যে এই ছেলেকে দেখিয়ে জাহির করে বেড়াই, তবু শেষমেশ আমার পছন্দ একে নেপথ্যেই রাখা; সেও নিজেকে সামনের দিকে বেশি ধাক্কা দেয় না, যদিও এ কারণে না যে নিজের ত্রুটিবিচ্যুতি সম্বন্ধে সে জানে, বরং তার সরলতা থেকেই সে এমনটা করে। আরো বলতে হয়, আমাদের এই সময়ের সঙ্গে সে পুরো খাপ খায় না; মনে হবে সে যেন কেবল আমার পরিবারের কেউই না, অন্য কোনো পরিবারেরও একজন, যেটা তার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে বহু আগে, তাই প্রায়ই সে বিষণ্ণ, কোনোকিছুই পারে না তার মনমেজাজ চাঙা করে তুলতে।
আমার চতুর্থ ছেলে সম্ভবত বাকি সবগুলোর চেয়ে বেশি সামাজিক। তার সময়ের জন্য একদম ঠিক একটা মানুষ; সবাই তাকে বোঝে; সবাই যেখানে দাঁড়িয়ে, তার দাঁড়ানোর মাটি সেটাই; আর প্রত্যেকেরই তার দিকে মাথা নাড়াতে শখ হয়। খুব সম্ভব তার প্রতি সবার এই সর্বজনীন হ্যাঁ-বোধক ভাব তার চরিত্রে দিয়েছে একধরনের লঘুতা, তার চলাফেরার মধ্যে একধরনের স্বাধীনচেতা ভঙ্গি, তার বিচারবুদ্ধিতে একধরনের উদাসীনতা। তার অনেক ক’টা কথা আছে যা বার বার আওড়ানোর যোগ্য, কিন্তু কোনোভাবেই তার সব কথার ক্ষেত্রে এটা খাটে না, কারণ মোদ্দা কথা হলো যে সে ভোগে– আবারও বলছি– বাড়তি রকমের লঘুতায়। সে হচ্ছে ওরকম কোনো লোক যে মাটি থেকে উড়াল দিয়েছে চমৎকার, সোয়ালো পাখির মতো উড়ছে বাতাস কেটে, কিন্তু তাতে কী, শেষে দুঃখজনকভাবে গিয়ে পড়েছে নিষ্ফলা ধুলোয়, স্রেফ একটা শূন্য। এসব চিন্তাই এই ছেলের ব্যাপারে আমার সব আনন্দে ইতি টেনে দেয়।
পাঁচ নম্বর ছেলেটা দয়ালু ও ভাল; যতটা সম্ভাবনা দেখিয়েছিল, বাস্তবে অর্জন করেছে তার থেকে বেশি; আগে সে এতই তুচ্ছ কিছু ছিল যে তার উপস্থিতিতে যে-কারোরই আসলে একা থাকার অনুভূতি হতো; কিন্তু এসবের পরেও একধরনের সম্মানের একটা জায়গায় পৌঁছেছে সে। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তা কী করে সম্ভব হলো, আমি ঠিকভাবে জানিও না তখন উত্তরে কী বলব। হতে পারে, এই পৃথিবীর যুদ্ধরত শক্তিগুলোর বিশৃঙ্খলার মধ্যে পথ কেটে যাওয়ার সবচেয়ে ভাল পথই হচ্ছে– সারল্য; আর সরল নিষ্পাপ সে নিঃসন্দেহে। বরং একটু বোধ হয় বেশিই সরল। সবার সঙ্গেই বন্ধুর মতো মেশে সে। একটু বোধ হয় বেশিই বন্ধুত্বপূর্ণ। আমাকে স্বীকার করতেই হবে: মানুষ যখন আমার কাছে তার প্রশংসার গীত গায়, আমি খুশি হই না। আমার এই ছেলের মতো পরিষ্কার প্রশংসার যোগ্য কাউকে যদি ওভাবে প্রশংসা করা হয়, তাহলে তো মনে হবেই যে প্রশংসা পাওয়া খুব সহজ একটা বিষয়।
আমার ছয় নম্বর ছেলে, অন্তত প্রথম দেখায় মনে হবে, বাকি সবগুলোর চেয়ে বেশি গভীর চিন্তায় মগ্ন। সে মাথা ঝুলিয়ে রাখবে নিচের দিকে, কিন্তু একই সঙ্গে সে আবার বাঁচাল প্রকৃতির। এই দ্বিমুখী স্বভাবের কারণে তার সঙ্গে চলা সহজ কথা নয়। যদি সে কখনো হেরে যায়, দেখা যাবে অদম্য এক বিষণ্ণতা গ্রাস করছে তাকে; আর যদি সে থাকে সবার ওপরে, তাহলে আরো বকবক করে জায়গাটা ধরে রাখছে। তার পরও, আমি অস্বীকার করব না তার মধ্যে একধরনের নিঃস্বার্থ আবেগের ব্যাপার আছে; সবার চোখের সামনে দেখা যায় সে নিজের ভাবনাগুলোর সঙ্গে এমনভাবে লড়াই করে চলেছে যেন সে আছে কোনো স্বপ্নের ঘোরে। সে অসুস্থ নয় –তার স্বাস্থ্য বরং বেশ ভালই বলতে হবে– কিন্তু কখনো সখনো, বিশেষ করে দিনের শেষে, হাঁটবে টলমল করে, তবু তার কোনো সাহায্যের দরকার হবে না, কখনোই পড়ে যাবে না সে। সম্ভবত তার শারীরিক বৃদ্ধিই ব্যাপারটার জন্য দায়ী, বয়সের তুলনায় সে খুব বেশি লম্বা। ফলে তার পুরো দেহসৌন্দর্যের মধ্যে একধরনের অপ্রীতিকর ব্যাপার চলে আসে, যদিও অনুপুঙ্খ দেখলে, যেমন তার হাত বা তার পা, আলাদা আলাদাভাবে ওরা চোখে পড়ার মতো সুন্দর। তবে তার কপালটা দেখতে সুন্দর বলা যাবে; তার কপালের চামড়া ও হাড়ের কাঠামো দুটোই আমার কাছে লাগে যেন কুঁচকে রয়েছে।
সপ্তম ছেলেটা বোধ হয় অন্য সবগুলোর চেয়ে বেশি আমার। পৃথিবী তাকে সঠিক মূল্যায়নে অক্ষম; কেউ তার অদ্ভুত ধরনের রসিকতা বুঝতে পারে না। তাকে আমি অতিমূল্যায়ন করছি না; আমি জানি, সে সীমিত আর সামান্য; স্রেফ তার মূল্যায়ন না হওয়াই যদি পৃথিবীর ভুল হয়, তাহলে পৃথিবীর সৌন্দর্যের কোনো হানি হবে না। কিন্তু পারিবারিক পরিমণ্ডলের কথা যদি বলি, এই ছেলে ছাড়া থাকতে আমার ভালো লাগবে না। তার মধ্যে আছে বিশেষ ধরনের এক অস্থিরতা, কিন্তু প্রথার প্রতি শ্রদ্ধার কোনো কমতি নেই তার; অন্তত আমার হিসেবে খুব সফলভাবে এ দুটো বিষয় সে একসঙ্গে মিলিয়েছে, দুয়ে মিলে জন্ম দিয়েছে অকাট্য এক সম্পূর্ণতার । এটা সত্য যে তার নিজের কোনো ধারণা নেই এই সম্পূর্ণ জিনিসটা নিয়ে সে কী করবে; ভবিষ্যতের চাকা সে ঘুরিয়ে দেবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই; কিন্তু তার সামগ্রিক মেজাজ এতখানি উদ্দীপনা জাগাবে, এতখানি আশা জাগাবে যে বলার মতো নয়; আমি চাই তার বাচ্চাকাচ্চা হোক, ওদেরও অনেক সন্তান হোক। দুর্ভাগ্য যে এই চাওয়া পূরণ হওয়ার খুব একটা আশা দেখি না। আমি বুঝি কিন্তু একই সঙ্গে অপছন্দ করি এমন একধরনের আত্মতৃপ্তি নিয়ে– যার সঙ্গে তার ব্যাপারে চারপাশের সবাই যা বলে, তার কোনো মিলই পাই না– সে ঘুরে বেড়ায় নিজের মনে, মেয়েদের দিকে কোনো নজর দেয় না, যদিও কখনোই হারায় না তার রসবোধ।
আমার অষ্টম ছেলে নিয়ে আমার যত সমস্যা, যদিও আমি সত্যি করে জানি না কেন এমন হলো। সে আমার দিকে তাকায় অচেনা লোকের মতো, যদিও আমার তরফে তার প্রতি গভীর পিতাসুলভ টান আমি ঠিকই বোধ করি। সময় অনেককিছু সারিয়ে তুলেছে; আগে স্রেফ তার কথা মনে পড়লেই কেঁপে উঠতাম আমি। সে চলে গেছে তার নিজের পথে; আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন করেছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই, তার শক্ত মাথার খুলি ও ছোট অ্যাথলেটের শরীর নিয়ে– শুধু ছোট থাকতে তার পা একটু দুর্বল ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সে সমস্যা এখন আর নেই– সে তার কাঙিক্ষত গন্তব্যে খুব ভালোমতোই পৌঁছাবে। প্রায়ই আমার মনে হয় তাকে ডেকে ফিরিয়ে আনি; জিগ্যেস করি সবকিছু কেমন যাচ্ছে, কেন সে তার বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আর জীবনে সে কী করতে চায়; কিন্তু এরই মধ্যে সে এত দুরে চলে গেছে আর এত সময়ই পার হয়ে গেছে যে একইসঙ্গে এটাও মনে হবে, সবকিছু বরং যেমন আছে তেমনই থাকুক। আমার কানে আসে, আমার ছেলেদের মধ্যে একমাত্র সেই দাড়ি রেখেছে; তার মতো খাটো লোকে দাড়ি রাখলে কি ভালো দেখায়?
আমার নবম ছেলে খুব কেতাদুরস্ত, আর তার আছে মেয়েদের মন-গলানো এক চেহারা। এত গলে-পড়া চেহারা যে কোনো কোনো সময় এমনকি আমিও তাতে প্রলুব্ধ হয়ে পড়ি, যদিও আমি জানি ঐ স্বর্গীয় ঔজ্জ্বল্য মুছে দেওয়ার জন্য আক্ষরিক অর্থে একটা ভেজা স্পঞ্জই যথেষ্ট। কিন্তু এই ছেলের অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েদের প্রলুব্ধ করার কোনো বাসনাই তার নেই; তার সারা জীবন সোফায় শুয়ে কাটাতে পারলেই সে খুশি, ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সে তার মায়াবী চোখে তাকানোর ক্ষমতা নিঃশেষ করবে, কিংবা তার হিসেবে আরো ভালো হয়, যদি তার চোখের পাতার নিচেই ঐ মায়াবী দৃষ্টির অবলুপ্তি ঘটে। যখন সে তার এই প্রিয় ভঙ্গিমায় শুয়ে থাকে, তখন তার পছন্দ কথা বলা; কথা ভালোই বলে সে, সংক্ষেপে আর স্পষ্টভাবে; কিন্তু তার সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে না গিয়ে; এর বেশি যদি সে করতে যায় –তার চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে যা কিনা ঘটতে বাধ্য– তাহলে দেখা যাবে তার কথাগুলো ফাঁপা শোনাচ্ছে। আপনি যদি এটুকু আশা করতে পারতেন যে, তার ঢুলুঢুলু চোখ দিয়ে সে আসলেই দেখবে, তাহলে আপনি নিশ্চিত তাকে যথেষ্ট হয়েছে বলে এ-সময় ইশারা দিতেন।
আমার দশ নম্বর ছেলের খ্যাতি আছে অসৎ মানুষ হিসেবে। এটা আমি পুরো অস্বীকারও করি না, পুরো নিশ্চিতও করছি না। শুধু এটুকু নিশ্চিত যে চেহারায় তার বয়সের চেয়ে বেশি গাম্ভীর্যের ভাব নিয়ে কেউ যখন তাকে এগিয়ে আসতে দেখে –পরনে সব সময় শক্ত করে বোতাম আঁটা তার ঐ ফ্রক কোট, মাথায় পুরোনো কিন্তু যত্ন করে ব্রাশ-করা একটা কালো হ্যাট, চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি নেই, কেমন যেন বাইরে বেরিয়ে আসা চিবুক, চোখের পাতাগুলো দুচোখের ওপরে ভারী হয়ে ফুলে আছে, মাঝেমধ্যে হাতের দু-আঙুল ঠোঁটের উপর রাখছে –যে-কেউ তাকে এভাবে দেখলেই ভাববে: এই লোক একটা পুরোদস্তুর ভণ্ড। কিন্তু তারপর কেবল শুনুন তার কথা! কীরকম স্বচ্ছ উপলব্ধি; কীরকম বিচারবিবেচনা; একদম সংক্ষেপ আর একেবারে মূল বিষয়ে; আপনার প্রশ্ন সে থামিয়ে দিচ্ছে কেমন চতুর সূক্ষ্মতায়; পুরো পৃথিবীর সঙ্গে কেমন বিস্ময়কর, স্বতঃপ্রমাণিত আর প্রাণবন্ত এক মৈত্রী; এমন এক মৈত্রী যার কারণে তাকে ঘাড় আরো টান টান করতে হচ্ছে, মাথা আরো উঁচু করে রাখতে হচ্ছে। অনেকেই আছে, যারা নিজেদের খুব জ্ঞানী ভাবে; তাই তার এই বাহ্যিক চেহারা দেখে তাদের অসম্ভব বিরক্তি হয় –সেই তারাও তার কথাতে কত বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তা হতে পারে, কিন্তু অন্য অনেকেই আছে তার বাহ্যিক চেহারা নিয়ে যাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু তার কথাকে তারা ভণ্ডামি মনে করে। আমি তার পিতা হিসেবে বলতে যাব না যে কারা বা কোনটা ঠিক, কিন্তু আমাকে মানতেই হবে, পরের যারা তাদেরকে আগের লোকদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখাটাই সমীচীন।
আমার এগারোতম ছেলে নাজুক প্রকৃতির, সম্ভবত সবগুলো ছেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্বল; কিন্তু তার দুর্বলতাকে ভুল বোঝা খুব সহজ; সময়ে সময়ে সে দেখা যায় বেশ শক্তিশালী ও দৃঢ়সংকল্প, তবে তা সত্ত্বেও দুর্বলতাই তার চরিত্রের মৌলিক বিষয়, এ কথা মানতেই হবে। কিন্তু এই দুর্বলতা নিয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, এটা শুধু আমাদের এই পৃথিবীর দৃষ্টিকোণ থেকেই দুর্বলতা। সে অর্থে কি আকাশে ওড়ার ক্ষমতাও, উদাহরণস্বরূপ বলছি, একধরনের দুর্বলতা নয়? ওড়ার মধ্যেও তো আছে কেমন টলমলে, অস্থির পাখা ঝাঁপটানি আর দ্বিধাগ্রস্ত একটা ব্যাপার! আমার এই ছেলের আচরণও সেরকম কিছু। এগুলো কোনো পিতার জন্যই নিঃসন্দেহে সুখকর কোনো আবিষ্কার নয়; কারণ স্পষ্টতই এ ধরনের আচরণ একটা পরিবারে ভাঙন ধরাতে পারে। কখনো-কখনো সে আমার দিকে তাকায়, যেন বলতে চায়: “তোমাকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব, বাবা।’ তখন আমি মনে মনে বলি: ‘ভরসা করার ব্যাপারে তুমি হচ্ছো আমার কাছে সবচেয়ে শেষের জন। তখন তার চেহারা দেখে মনে হবে সে বলছে: “ঠিক আছে, আমাকে অন্তত শেষের জনই হতে দাও।
এই আমার এগারো ছেলে।
ভাইয়ের হত্যা
প্রমাণিত হয়ে গেছে যে খুনটা হয়েছিল এইভাবে:
এক পরিষ্কার জ্যোস্না রাতে, নয়টার দিকে, শমার, খুনি, অপেক্ষা করতে লাগল রাস্তার সেই কোনাটাতে যেখানে ভেজে, তার শিকার, অফিস থেকে বাড়ি আসার পথে মোড় নেবে।
রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া যে-কারো হাড় পর্যন্ত জমিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু শমার পরে আছে শুধু পাতলা নীল একটা জামা; এমনকি তার জ্যাকেটের বোতামও লাগানো নেই। তার কোনো ঠান্ডা লাগছে না; তা ছাড়া, অনবরত হাঁটাহাঁটি করছে সে। খুন করার জন্য রাখা অস্ত্রটা, অর্ধেক বেয়নেট, অর্ধেক রান্নাঘরের ছুরি, তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা আর খাপ খোলা, যে-কারো চোখে পড়বে। চাঁদের আলোয় সে এটা পরীক্ষা করল; ছুরির ফলা ঝিকমিকিয়ে উঠল; মারের তাতে মন ভরল না; সে ফুটপাতের ইটের গায়ে ওটা ঘসতে লাগল– ফুলকি উড়িয়ে; সম্ভবত তাতে খেদ হলো তার; সেই অনুশোচনা থেকে সে ছুরিটা তার জুতোর তলিতে ঘষতে লাগল বেহালার ছড়ের মতো করে; এ সময় সে দাঁড়িয়ে এক পায়ে, শরীর ঝুঁকে আছে সামনে, শুনছে নিজের জুতোয় ছুরি ঘষার শব্দ, আর একই সঙ্গে কান খাড়া করে আছে দুর্ভাগা পাশের রাস্তা থেকে। কোনো শব্দ আসে কি না শুনতে।
কেন প্যাল্লাস নামের শৌখিন গোয়েন্দা ভদ্রলোক এ সবকিছু ঘটতে দিল, তাকিয়ে তাকিয়ে সব শুধু কাছে থেকে দেখল তার দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে? সে মানবপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করছিল! কলার তুলে, তার প্রশস্ত শরীরটাতে ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে, সে তাকিয়ে থাকল নিচে– রাস্তায়, খুনের ঘটনাস্থলে, মাথা নাড়তে নাড়তে।
আর ওটা থেকে পাঁচ বাড়ি পরে, রাস্তার কোনাকুনি ওপাশে, রাতে পরার টিলা পোশাকের উপর শেয়ালের লোমের কোট চাপিয়ে, মিসেস ভেজে বাইরে তাকিয়ে আছে। স্বামীর পথের দিকে, ভাবছে সে তো কখনো বাড়ি ফিরতে এত দেরি করে না।
অবশেষে ভেজে-এর অফিসের দরজার ঘণ্টি বাজল, দরজার ঘণ্টি হিসাবে আওয়াজটা অনেক বেশি; সারা শহর জুড়ে, একদম উপরে আসমান অবাধ প্রতিধ্বনিত হলো তা; আর এই পরিশ্রমী, রাতের-কর্মী ভেজে –তখনো তাকে দেখা যাচ্ছে না রাস্তা থেকে, তখনো শুধু ঘণ্টির শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে সে এদিকে আসছে– রওনা দিল তার অফিস বিল্ডিং থেকে; ফুটপাতে গোনা যাচ্ছে তার শান্ত-চুপচাপ পায়ের শব্দ।
কোনোকিছু যেন দেখার বাকি না থাকে, প্যাল্লাস তাই তার জানালা থেকে অনেক বাইরে ঝুঁকে এল। ঘণ্টির শব্দ শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে মিসেস ভেজে তার জানালা বন্ধ করলেন খটাং করে। শমার বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে; তখন তার শরীরের বাকি সব অংশ ঢাকা, শুধু মুখ ও হাত দুটো বেরিয়ে আছে, সে ওগুলো চেপে ধরে থাকল রাস্তার পাথরে; সবকিছু শীতে জমে যাচ্ছে, কিন্তু শমার উত্তেজনায় পুড়ছে।
দুটো রাস্তা যে-দাগে এসে ভাগ হয়েছে, ভেজে থামল সেখানটায়, তার হাতের ছড়ি বাড়িয়ে দিল বাড়ি যাওয়ার রাস্তার দিকে। একটা খেয়াল। রাতের আকাশ, ঘন নীল আর সোনালি, তাকে মুগ্ধ ও খেয়ালি করে দিয়েছে। একদম সন্দেহমুক্ত মনে সে আকাশের ধেয়ানে আছে, একদম সন্দেহমুক্ত মনে সে মাথার হ্যাট উপরে উঠিয়ে, চুলে আঙুল চালাচ্ছে পেছনদিকে; উপরে আকাশে এমন কোনোই নকশা নেই যা দেখে সে নিজের একটু পরের ভবিষ্যণ্টা জানতে পারবে; সবকিছু যার যার অর্থহীন, রহস্যময় জায়গায়। আপাতদৃষ্টিতে এটা খুবই যুক্তিযুক্ত যে ভেজে হাঁটতে থাকবে, কিন্তু সে হেঁটে গেল শমারের ছুরির দিকে।
‘ভেজে!’ পায়ের আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে চিৎকার করে উঠল শমার, তার হাত উপরের দিকে বাড়ানো, ছোরা তীক্ষ্ণভাবে নিচুমুখো করা, ‘ভেজে! জুলিয়া খামাখা অপেক্ষা করছে! আর ডানদিক থেকে গলার মধ্যে, বামদিক থেকে গলার মধ্যে, এরপর তৃতীয়বার পেটের গভীরে ছুরি চালাল শমার। নর্দমার ইঁদুরের পেট ফেড়ে ফেললে যে শব্দ হয়, ভেজে ঠিক সেরকম শব্দ করল।
‘শেষ,’ বলল শমার, আর সবচেয়ে কাছের বাড়িটার সামনে ছুঁড়ে মারল তার অনর্থক রক্তমাখা বোঝা। ওহ্ খুন করার স্বর্গসুখ! মুক্তি, অন্য মানুষের রক্ত ঝরানোর উত্তুঙ্গ জোশ! ভেজে, বুড়ো রাতের পাখি, বন্ধু আমার, মদ খাওয়ার সাথি আমার, রাস্তার নিচে অন্ধকারে পড়ে থেকে তুই কেমন চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরছিস। কেন তুই স্রেফ একটা রক্তমাখা থলি হলি না, তাহলে কেমন দাপাতাম তোর ওপরে আর পুরো হাওয়া হয়ে যেতিস তুই। সব ইচ্ছা পূরণ হয় না, সব ফুল-ধরা স্বপ্ন বাস্তব হয় না, তোর ভারী মড়াটা এখানে শুয়ে আছে, আমার কোনো লাথিতেই ওটার কোনো খবর নেই। আমাকে তুই যে নিঃশব্দ প্রশ্ন করে যাচ্ছিস, তার আর কী মানে হয় রে?
প্যাল্লাসের বাড়ির দুই পাল্লার দরজা ধড়াম করে খুলে গেল; সে দাঁড়িয়ে চৌকাঠে, তার শরীরে খুবলাতে থাকা দুর্বার ক্রোধ কোনোমতে দমন করছে। ‘শমার! শমার! সব দেখেছি, কিছুই বাদ পড়েনি।‘ প্যাল্লাস ও শমার একজন আরেকজনকে দেখতে লাগল। প্যাল্লাস সন্তুষ্ট; শমার কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না।
মিসেস ভেজে ছুটে আসছে, তার দু-পাশে মানুষের ভিড়, তার মুখ ভয়ানক আতঙ্কে বেশ বুড়িয়ে গেছে। তার পশুর চামড়ায় বানানো কোট খুলে পড়েছে, সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ভেজের শরীরে; রাতের ঢিলে পোশাক পরা তার শরীরটা ভেজের, আর পশুর লোমের কোট– ওটা কবরের উপরের ঘাসের মতো ঢেকে আছে এই জুটিকে –ভিড়ের মানুষগুলোর।
শমার তার বিবমিষার শেষ দমকটুকু অনেক কষ্টে ভেতরে চেপে মুখটা রাখল পুলিশ কনস্টেবলের কাঁধে, যে কিনা দ্রুত পায়ে তাকে নিয়ে চলে গেল।
একটি স্বপ্ন
জোসেফ কে স্বপ্ন দেখছে:
সুন্দর একটা দিন আর কে.-র মন চাইছে হাঁটতে বেরোতে। কিন্তু কয় কদমও যেতে পারেনি, এই মধ্যে সে পৌঁছে গেল কবরখানায়। ওখানের পথগুলো খুবই পঁাচানো নকশার, অবাস্তব রকমের বাক খাওয়া, কিন্তু ওরই একটা ধরে সে নেমে যাচ্ছে সরসর করে, যেন খরস্রোতা কোনো পানিতে ভেসে যাচ্ছে টানা, অবিচল এক গতিতে। কিছুটা দূর থেকে তার চোখ আটকে গেল কবরের একটা ঢিবির উপর, নতুন বানানো ঢিবি, ওখানে সে থামতে চাইছে। এই ঢিবির মধ্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো কী যেন একটা আছে, তার মনে হচ্ছে ওখানে পৌঁছুতে তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আবার মাঝেমধ্যেই ঢিবিটা সে দেখতে পাচ্ছে না; অনেকগুলো পতাকা– একবার খুলছে, একবার বন্ধ হচ্ছে, প্রচণ্ড জোরে বাড়ি খাচ্ছে একটা আরেকটার গায়ে– তার দেখার পথে বাধা হয়ে আছে; এই পতাকাগুলো যারা বয়ে নিচ্ছে তাদের দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে বিরাট কোনো উৎসব-অনুষ্ঠান চলছে যেন।
তখনো সে তাকিয়ে আছে দূরে, কিন্তু হঠাৎই তার চোখে পড়ল সেই একই কবরের ঢিবিটা, তার পথের পাশে; সে আসলে ওটা অনেকখানি পেরিয়েও এসেছে। সে তাড়াতাড়ি লাফিয়ে ঘাসে নেমে গেল। যেহেতু লাফ দেওয়ার সময়ে তার পায়ের নিচের মাটি দ্রুত ছুটে সরে গেল, সে ভারসাম্য হারাল, এক হাঁটুর উপরে গিয়ে পড়ল ঠিক ঐ কবরের ঢিবির সামনে। দুজন লোক ওটার পেছনে দাঁড়ানো, তাদের মাঝখানে শূন্যে তারা ধরে আছে। একটা কবর-ফলক; কে, ওখানে হাজির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফলকটা আচমকা ঠেলে ঢুকিয়ে দিল মাটিতে, ওটা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকল যেন মাটিতে গাঁথা। তক্ষুনি তৃতীয় এক লোক বের হলো একটা ঝোঁপের মধ্য থেকে; কে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারল– একজন শিল্পী। তার পরনে শুধু ট্রাউজার আর যেনতেন করে বোতাম লাগানো একটা জামা; তার মাথায় একটা মখমলের টুপি; তার হাতে একটা সাধারণ পেনসিল, ওটা দিয়ে সে –এমনকি হেঁটে আসতে আসতেও– শূন্যে কোনো একটা কিছু লিখছে বা আঁকছে।
এবার সে কবর-ফলকের উপরের দিকে পেনসিলটা চালাতে এগিয়ে গেল; অনেক উঁচু এক পাথরের ফলক এটা, তাকে একটুও শরীর নোয়াতে হলো না; তবে তাকে সামনের দিকে গলা অনেক বাড়াতে হলো– কারণ কবরের ঢিবিটা তার ও পাথরটার মাঝখানে, আর ঢিবিতে পা ফেলতে চাচ্ছে না সে কোনোভাবেই। অতএব সে দাঁড়িয়ে আছে পায়ের আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে, পাথরের সমতল গায়ে বাঁ হাতে ঠেস দিয়ে নিজেকে খাড়া রেখেছে। কী রকম এক দক্ষ চাতুরীর মাধ্যমে সে এই সাধারণ পেনসিল দিয়েই সক্ষম হলো সোনার অক্ষরে লেখা বানাতে; সে লিখল: ‘এখানে শায়িত–’। প্রতিটা অক্ষরই দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার ও সুন্দর, গভীরভাবে খোদাই করা আর সবচেয়ে নির্ভেজাল সোনায় বানানো। এই শব্দ দুটো লেখা শেষে সে কে.-র দিকে পেছন ফিরে তাকাল; কে, খুব চাচ্ছে দেখবে যে অক্ষর খোদাইয়ের কাজটা কীভাবে এগোয়, তাই লোকটার দিকে তেমন নজরই দিচ্ছে না সে, স্থির তাকিয়ে দেখছে পাথরটা। নিশ্চিত, লোকটা আবার লেখা শুরু করার জন্য তৈরি হয়েছে, কিন্তু লিখতে পারল না সে, কী একটা যেন তাকে থামিয়ে দিয়েছে, তার হাত থেকে পেনসিল পড়ে গেল টুপ করে, সে আরো একবার কে.-কে দেখবে বলে ঘুরে গেল। এই দফা কে. তাকাল শিল্পীর দিকে, দেখল সে মহা বিব্রত, কিন্তু কেন তা কে, বুঝতে পারল না। শিল্পীর এর আগের সব উচ্ছলতা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এতে কে.-ও বিব্রত বোধ করতে লাগল; তারা দুজনে অসহায়ের দৃষ্টি বিনিময় করল; দুজনের মধ্যে কোনো মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে, যা তাদের কারো পক্ষেই মীমাংসা করা সম্ভব না। ঠিক এই সময়ে কবরস্থানের গির্জায় একটা ছোট ঘণ্টা বাজতে শুরু করল, তবে শিল্পী তার ডান হাত উপরে তুলে ইশারা করতেই থেমে গেল ঘণ্টা। অল্প একটু পরে আবার বাজতে লাগল সেটা; এইবার খুব নিচু আওয়াজে; কিন্তু এইবার কাউকে কোনো বিশেষ অনুরোধ করতে হলো না, ঘণ্টা থেমে গেল নিজে নিজেই; ব্যাপারটা এমন যেন ঘণ্টা নিজের শব্দ নিজে পরীক্ষা করে দেখছিল। শিল্পীর দুর্দশা দেখে কে-র অবস্থা সান্ত্বনাতীত, সে কাঁদতে শুরু করল, মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদল অনেকক্ষণ। কে. শান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল শিল্পী, তারপর অন্য আর কোনো উপায় না খুঁজে পেয়ে ঠিক করল, যা-ই হোক, লেখাটা চালিয়ে যাবে। তার প্রথম ছোট টানটাতে হাঁফ ছেড়ে খুশি হলো কে.; যদিও পরিষ্কার, শিল্পীকে এই টানটুকু দিতে নিজের অনেক অনীহা কাটিয়ে উঠতে হয়েছে; আর তার লেখাও আগের মতো অত সুন্দর নেই, বিশেষ করে মনে হচ্ছে সোনালি ব্যাপারটা হারিয়ে গেছে, লেখা কেমন মলিন আর টলমলে, অক্ষরের আকার বেঢপ বড়। অক্ষরটা ‘জো’, এরই মধ্যে লেখা প্রায় শেষ যখন শিল্পী উন্মত্ত হয়ে এক পা জোরে ঠুকল কবরের ঢিবির উপর, এত জোরে যে কবরের মাটি চারপাশে, উপরদিকে, শূন্যে ছিটকে গেল। কে, অবশেষে শিল্পীর মনের ভাব বুঝতে পেরেছে; তার মন বদলাবার মিনতি জানানোর জন্য আর সময় হাতে নেই; হাতের সবগুলো আঙুল দিয়ে সে মাটি খুঁড়ে চলেছে, বাধাহীন, স্বচ্ছন্দে খুঁড়ছে; সবকিছু মনে হচ্ছে আগের থেকেই সাজানো; মাটির পাতলা একটা স্তর ঢিবি করে রাখা হয়েছে শুধু লোক দেখানোর কাজে ঠিক এর নিচেই একটা অত্যন্ত খাড়া দেয়ালের বড় গর্ত হাঁ করে আছে, আর ওটার মধ্যে– মৃদু একটা ঢেউয়ে তার পিঠের উপর চিৎ হয়ে যাওয়া শরীরে– ডুবে গেল কে। তবে গর্তের তলদেশে যখন এরই মধ্যে তাকে বরণ করে নেওয়া হয়েছে ঐ গহন অতলে, তার মাথা তখনো বাইরে বেরিয়ে আছে গলার উপর থেকে, সে দেখল বাইরে, উপরে, তার নামটা প্রচণ্ড শক্তিশালী হাতের টানে লেখা হয়ে যাচ্ছে, দৌড়ে যাচ্ছে পাথরের ফলকটায়।
এই দৃশ্যে বিমুগ্ধ-বিহ্বল হয়ে সে জেগে উঠল।
অ্যাকাডেমির জন্য একটি প্রতিবেদন
অ্যাকাডেমির সম্মানিত ভদ্র মহোদয়গণ!
আমার এর আগের শিম্পাঞ্জির জীবন নিয়ে আমাকে অ্যাকাডেমির কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করতে বলে আপনারা আপনাকে সম্মানিত করেছেন।
আমার আক্ষেপ, যেমন করে অনুরোধটা আমাকে সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে তা পূরণে আমি অসমর্থ। আমার শিম্পাঞ্জির জীবন সেই প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা, ক্যালেন্ডারের হিসেবে হয়তো খুব বেশি সময় না, কিন্তু আমাকে যেভাবে চার-পা তুলে লাফিয়ে আসতে হয়েছে সে হিসেবে অনন্তকাল– সেই আসার পথে পথে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে কিছু চমৎকার মানুষ, তাদের উপদেশ, হাততালি, অর্কেস্ট্রার বাজনা; তবে তার পরও আমি মূলত থেকে গেছি একা, যেহেতু আমার ঐ সব সঙ্গীই –রূপক অর্থে বলতে গেলে– সব সময়ে থেকে গেছে শিকগুলোর অনেক ওপাশে। এই অর্জন কখনোই সম্ভব হতো না যদি আমি একরোখার মতো আমার শেকড় ও আমার তরুণ বয়সের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইতাম। আমার প্রথম শাস্ত্রীয় নীতি হিসেবে আমি নিজের ওপর আরোপ করলাম নিজের সব ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিসর্জন; আমি, মুক্ত এক শিম্পাঞ্জি, নিজেকে সমর্পণ করলাম সেই জোয়ালে। এর ফলে কী হলো– আমার স্মৃতিগুলো আমার থেকে সরে যেতে লাগল দূরে, আরো দূরে। প্রথমদিকে –মানুষ যদি চাইত– আমার ফিরে যাওয়ার রাস্তা হয়তো ভোলা ছিল, পৃথিবী বেড় দেওয়া আসমানের ঐ বিরাট তোরণপথ দিয়ে আমি হয়তো ফিরে যেতে পারতাম, কিন্তু আমার বিবর্তনের ধাপে ধাপে আমাকে যতই চাবকে সামনে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল, ঐ তোরণপথ ততই আরো নিচু, আরো ছোট হয়ে এল; মানুষের পৃথিবীতে আরো বেশি স্বচ্ছন্দ হলাম আমি, আরো বেশি নিভৃতে জায়গা পেলাম; আমার অতীত থেকে আমার উদ্দেশে ধেয়ে আসা ঝড়টা কমে এল; আজ আর ওটা ঝড় না, স্রেফ আমার গোড়ালি ঠান্ডা করা একটুখানি হাওয়া; আর দূরের যে ফুটো থেকে ঐ হাওয়াটা আসছে, যে ফুটো দিয়ে একদিন আমি এসেছি, সেটা এতই ছোট হয়ে গেছে যে আমার যদি অত দূর পেছনে যাওয়ার শক্তি ও ইচ্ছা থেকেও থাকে, তবুও ঐ ফুটোর মধ্যে দিয়ে নিজেকে ঢোকাতে গেলে আমার শরীর থেকে সব লোম-পশমওয়ালা চামড়া আমাকে আগে খুলে নিতে হবে। সাফ সাফ বলতে গেলে– অলংকারবহুল কথাই পছন্দ আমার –সাফ সাফ বলতে গেলে: ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের নিজেদের বানর-শিম্পাঞ্জির জীবনও, নিশ্চয় জানেন যে আপনাদের পেছনেও ওরকম একটা জীবন থেকে থাকতে পারে, আপনাদের থেকে ততটাই দূরের যতটা আমার থেকে দূরে আমার নিজেরটা। এই পৃথিবীতে হেঁটে চলা সবারই গোড়ালিতে ঐ একই চুলকানিঃ ছোট শিম্পাঞ্জি থেকে শুরু করে মহান ঐ একিলিস পর্যন্ত, সবার।
যা হোক, খুব সীমিত অর্থে আমার পক্ষে হয়তো সম্ভব আপনাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া আর সেটাই আমি এখন করতে যাচ্ছি আনন্দের সঙ্গে। যে জিনিসটা আমি প্রথম শিখেছিলাম তা হলো হ্যান্ডশেক করা; হ্যান্ডশেক আন্তরিকতারই পরিচায়ক; আজ, আমার কর্মজীবনের এই চূড়ায় দাঁড়িয়ে, সেই প্রথম আন্তরিক হ্যান্ডশেকটা সম্পূর্ণ হোক আজকের আমার এই কথাগুলোর আন্তরিকতা যোগ হয়ে। অ্যাকাডেমির কাছে আমি যা বলতে যাচ্ছি তাতে প্রকৃত অর্থে নতুন কিছু হয়তো নেই, আমি জানি আপনাদের প্রত্যাশার অনেক পেছনে থাকব আমি, আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার এই বিবৃতি আপনাদের মনের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না –তারপরও আমার এই বিবৃতি থেকে আপনারা আগে শিম্পাঞ্জি ছিল কিন্তু এখন মানুষের পৃথিবীতে প্রবেশ করে সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, এমন একজনের জীবন চলার পথ নিয়ে একটা সাধারণ ধারণা পাবেন। তার পরও, নিজের সম্বন্ধে আমার যদি পুরো আত্মবিশ্বাস না থাকত আর এই সভ্য দুনিয়ার সব বড় বিচিত্রানুষ্ঠান মঞ্চে আমি যদি এরকম সুনিশ্চিত-সুরক্ষিত অবস্থান অর্জন করতে না পারতাম, তাহলে নিচে যে সামান্য কথা কটা বলা হলো, তা বলার অধিকার আমার নিশ্চিতই থাকত নাঃ
আমি এসেছি গোল্ড কোস্ট থেকে। আমার ধরা পড়ার গল্পটুকুর জন্য আমাকে ভরসা করতে হচ্ছে অন্যের কথার ওপর। হাগেনবে নামের এক শিকার অভিযান ফার্ম একদিন– কথার কথায় বলে রাখছি, এই ফার্মের নেতা মানুষটার সঙ্গে তারপর এত দিনে কত যে ভালো ভালো রেড ওয়াইনের বোতল শেষ করেছি আমি!– একদিন নদীর পাশের ঝোপে লুকিয়ে ছিল, সন্ধ্যায় আমাদের একটা দলের সঙ্গে আমি ওখানে পানি খেতে নিচে নেমে এলাম। ওরা আমাদের ওপর গুলি চালাল; কেবল আমিই গুলি খেলাম; দুই দফা।
প্রথমবার আমার গালে; সামান্য আঘাত; কিন্তু ওর থেকেই তৈরি হলো একটা বড়, লোমহীন, লাল দাগ, যে কারণেই আমার নাম দেওয়া হলো –খুবই জঘন্য আর পুরোপুরি বেঠিক এক নাম –রেড পিটার। ছি! কোনো শিম্পাঞ্জিরই মাথা থেকে বোধ হয় এসেছে। এই জঘন্য নাম –এতে মনে হচ্ছে এই সেদিন মারা যাওয়া, অল্প নামডাকওয়ালা সেই খেলা-দেখানো শিম্পাঞ্জি পিটারের সঙ্গে আমার ফারাক বুঝি স্রেফ আমার গালের ঐ লাল দাগটুকুই। কথার কথা বললাম আর কী!
দ্বিতীয় গুলি লাগল আমার কোমর ও পাছার নিচ দিকটায়; ওটা ছিল বেশ বড় আঘাত; আমি যে আজও একটু খুঁড়িয়ে হাঁটি তা আসলে ওই কারণেই। কিছুদিন আগে আমি একটা লেখা পড়লাম, কাগজে আমাকে নিয়ে লিখতে থাকা ঐ হাজার দশেক ফালতু-বকা লোকেরই একজন লিখেছে ওটা, ওই লেখায় সে বলতে চাচ্ছে, আমার শিম্পাঞ্জির স্বভাব আজও যায়নি; এর প্রমাণ হলো, দর্শকেরা আমাকে যখন দেখতে আসে, আমি নাকি ইচ্ছে করে তখন আমার প্যান্ট খুলে ফেলি, তাদের দেখাতে চাই যে কোথায় গুলিটা ঢুকেছিল। ওই ব্যাটার লেখার হাতের প্রতিটা আঙুল এক-এক করে গুলিতে উড়িয়ে দেওয়া উচিত। যার সামনে ইচ্ছে আমার প্যান্ট আমি খুলব, যার সামনে খুশি, সেটা আমার ইচ্ছা; ওখানে সুন্দর পরিপাটি একগোছা লোমের আস্তর ছাড়া, আর একটা ক্ষত ছাড়া– এই প্রসঙ্গে আমরা আসুন বিশেষ এক উদ্দেশ্যে বিশেষ এক শব্দই স্পষ্ট করে বরং ব্যবহার করি, তবে আশা করি আপনারা কেউ তা ভুল বুঝবেন না– দায়িত্বজ্ঞানহীন এক গুলি থেকে, দুবৃত্ত এক গুলি থেকে তৈরি হওয়া একটা ক্ষত ছাড়া ওখানে আর কিছুই কেউ খুঁজে পাবে না। সবকিছুই সবার চোখের সামনে খোলা, সাফ-সাফ; লুকানোর তো কিছু নেই। প্রশ্নটা যখন সত্যের, তখন তো উন্নতচেতা যে-কেউই ভাষা-রুচি ইত্যাদির বিশুদ্ধতা পাশে সরিয়ে রাখবে। তবে, দর্শকেরা আসার পর ঐ প্রতিবেদনের লেখক ধরুন তার নিজের প্যান্ট খুলল, সেটা নিশ্চিত একদমই আলাদা একটা ব্যাপার হবে, সে যে তা করে না তার জন্য আমি তার তারিফই করছি। তা-ই যদি হয়, তাহলে আমাকেও সে তার ওই সহৃদয় অনুভূতিগুলো থেকে রেহাই দিক!
গুলি খাওয়ার পরে আমি জেগে দেখি –এখান থেকেই ধীরে ধীরে শুরু আমার স্মৃতি ফিরে আসা– হাগেনবে কোম্পানির জাহাজে দুই ডেকের মাঝখানে একটা খাঁচায় আমি বন্দী। এটা কোনো চারপাশ ঘেরা সাধারণ শিক দেওয়া খাঁচা ছিল না; বদলে এর ছিল তিনটে পাশ, একটা বাক্সের সঙ্গে লাগানো; বাক্সটাই ছিল খাঁচার চার নম্বর পাশ। পুরো জিনিসটা এত নিচু ছিল যে দাঁড়ানো যায় না, আর আড়ে এত চাপা যে বসা যায় না। অতএব আমাকে বসতে হতো মেঝে ছুঁয়ে, উবু হয়ে, ভাঁজ হওয়া হাঁটু বিরামহীন কাঁপত, আর এর সঙ্গে আমার মুখ থাকত– যেহেতু আমি প্রথমদিকে কাউকে দেখতে চাইতাম না, চাইতাম সব সময় অন্ধকারে বসে থাকি –বাক্সের দিকে ফেরানো, আমার পিঠের দিকে খাঁচার শিকগুলো মাংস কেটে ঢুকে যেতে চাইত। বুনো জন্তুদের আটকে রাখার এই পদ্ধতি প্রথম কিছুদিনের জন্য সঠিক পদ্ধতি হিসেবে ধরা হয়, আর আজ, আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কথাটা আসলেই সত্যি।
কিন্তু সেই তখন আমি এভাবে ভাবতাম না। জীবনে প্রথমবারের মতো দেখলাম যে আমার বেরোবার কোনো পথ নেই; অন্তত সোজা সামনের দিকে কিছু নেই বাক্সটা ছাড়া, তার পরে তক্তা লাগানো শক্ত করে। তবে মানছি, তক্তাগুলোর মাঝখানে একটা ফাঁক ছিল, প্রথম যখন আমার এটা চোখে পড়ে আমি না-বুঝেই বোকার মতো খুশিতে চিৎকার দিয়ে ফাঁকটাকে স্বাগত জানাই, কিন্তু পরে দেখি, ওটা এমনকি লেজ ঢোকানোর মতোও বড় না, আর কোনো শিম্পাঞ্জির সেই শক্তি নেই যে ওটাকে আরো বড় বানায়।
আমার যারা দেখাশোনা করত তাদের কাছ থেকে পরে শুনেছি, আমি নাকি খুবই সামান্যই হইচই করতাম, অস্বাভাবিক রকমের কম; ওটা থেকেই তারা এই উপসংহারে এল যে হয় আমার মারা যাওয়ার আর বেশি বাকি নেই, না-হয় আমারই– প্রথম দিককার এই সংকটময় সময় একবার কাটিয়ে উঠতে পারলে– সম্ভাবনা আছে প্রশিক্ষণ পর্বে খুব বাধ্যগত থাকার। আমি সময়টা কাটিয়ে উঠতে পারলাম। চাপা কান্না, কষ্টকর মাছি তাড়ানো, ক্লান্তিকর কোনো নারকেল চেটে যাওয়া, বাক্সের দেয়ালে মাথা দিয়ে বাড়ি মারতে থাকা, যে-ই কাছে আসছে তার দিকে জিভ বের করে দেওয়া –নতুন জীবনে এগুলোই ছিল আমার প্রথম দিককার একমাত্র কাজ। কিন্তু এ সবকিছুর মধ্যেই কেবল একটা, একটাই মাত্র অনুভূতি: বেরোবার পথ নেই। শিম্পাঞ্জি হিসেবে তখন আমার এই যে অনুভূতি তা আজ আমার পক্ষে কেবল মানুষের ভাষাতেই প্রকাশ করা সম্ভব, তাতে করে ঘটনার বিবরণ ভুল হতে বাধ্য; আমার পক্ষে তো এখন আর সেই পুরোনো শিম্পাঞ্জি সত্যের নির্ভুলতায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, তার পরও আমি যা বলছি তা যে সেই সত্যেরই মোটামুটি কাছাকাছি কিছু, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যখনকার কথা বলছি তার আগে পর্যন্ত আমার সব সময়ই বেরোবার কত কত পথ ছিল, আর এখন একটাও নেই। আমার সব পথ রুদ্ধ। এরা যদি আমাকে পেরেক দিয়েও গেঁথে রাখত, আমার নড়াচড়া করার স্বাধীনতা কিন্তু এ-ই থাকত, এর চেয়ে কম আবার হবে কী করে? কিন্তু তা কেন? পায়ের আঙুলের ফাঁকে চুলকে চুলকে ক্ষত করে ফেল, কারণ খুঁজে পাবে না। শরীর পেছনে গরাদে ধাক্কা দিতে থাকো যতক্ষণ না প্রায় কেটে দু-টুকরো। হয়ে যাচ্ছ, কারণ খুঁজে পাবে না। আমার কোনো পথ খোলা ছিল না, কিন্তু আমাকে একটা পথ বের করতেই হতো, কারণ তা ছাড়া আমার পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব লাগছিল। সারা দিন পিঠ ঠেকিয়ে আছি ঐ বাক্সে– না, কোনো সন্দেহ নেই আমি তাতে নিশ্চিত শেষ হয়ে যেতাম। কিন্তু হাগেনবে কোম্পানিতে তো শিম্পাঞ্জিরা সারা দিন বাক্সে পিঠ ঠেকিয়েই থাকে– ভালো, তাহলে শিম্পাঞ্জি হয়ে থাকা বন্ধ করে দিলেই হয়। কেমন পরিষ্কার, সুন্দর-সংহত চিন্তা, আমি নিশ্চিত আমার পেট দিয়েই এত সুন্দর একটা চিন্তা করে উঠতে পারলাম, পেট দিয়ে, শিম্পাঞ্জিরা চিন্তা করে ওভাবেই।
আমার আশঙ্কা, পথ খোলা থাকা বা বেরোবার পথ বলতে আমি ঠিক কী বোঝাচ্ছি তা আপনারা হয়তো ধরতে পারছেন না। এই শব্দগুচ্ছ আমি ব্যবহার করছি এর সবচেয়ে সাধারণ ও সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ অর্থে। ইচ্ছে করেই আমি এড়িয়ে যাচ্ছি ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা। চারধারে উপলব্ধি হতে থাকা স্বাধীনতার ঐ প্রবল অনুভূতির কথা বলছি না আমি। ওরকম অনুভূতির সঙ্গে আমার হয়তো পরিচিতি ছিল আগে, শিম্পাঞ্জি জীবনে, আর অনেক মানুষ আমি দেখেছি যারা ঐ অনুভূতির জন্য হা-পিত্যেশ করে। তবে আমার ব্যাপারে বলতে গেলে, না তখন আমি স্বাধীনতার পেছনে ছুটেছি, না এখন। প্রসঙ্গক্রমে বলছিঃ মানুষের ঐ স্বাধীনতার অনুভূতি প্রায়ই দেখা যায় নিজেকে ঠকানো একটা বোধ মাত্র। আর আমাদের অনুভূতিগুলোর মধ্যে স্বাধীনতা যদি হয়ে থাকে সবচেয়ে মহীয়ান কোনো অনুভূতির নাম, তাহলে এর মধ্যেকার ধোঁকার যে-ব্যাপার তা-ও তো সবচেয়ে মহীয়ান ধোঁকাই হবে। অনেকবার আমি নানা বিচিত্রানুষ্ঠানের মঞ্চে আমার পালা আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেখেছি, ছাদের ঐ উঁচুতে কসরতবাজদের কোনো জোড়া কীভাবে তাদের ট্র্যাপিজে খেলা দেখাচ্ছে। তারা হাতে ঝুলছে, দোল খাইয়ে শরীর উপরে তুলছে, শাঁ করে উপরে লাফ দিচ্ছে, একজন আরেকজনের বাহুতে ভেসে আসছে, দাঁত দিয়ে চুলের মধ্যে ধরে একজন ঝুলিয়ে রেখেছে আরেকজনকে। এটার নামও মানুষের স্বাধীনতা, আমি ভাবলাম, ‘খেয়ালখুশিমতো শরীর একটু এদিক-ওদিক করতে পারা। প্রকৃতির নির্মলতা নিয়ে কী এক ফাজলামি! এই দৃশ্য দেখে তো শিম্পাঞ্জিদের দল অট্টহাসি দেবে যে তাতে কোনো বিল্ডিং ধসে পড়বে।
না, আমি যা চেয়েছিলাম তা স্বাধীনতা নয়। শুধু একটা বেরোবার পথ, এ-ই ছিল আমার চাওয়া; ডান দিকে, বাঁ দিকে, যেকোনো দিকেই হোক যায়-আসে না; আর কিছু তখন আমি চাইনি; যদি বেরোবার পথটা ছলনারও হয় তা-ই সই; চাওয়াটা ছিল ছোট, ছলনা সেখানে আর কতই বা বড় হবে! সামনে, সামনের দিকে! সব ঠিক আছে, শুধু আর না ঐ হাত উঁচু করে, বাক্সের এক পাশে চিড়ে-চ্যাপটা হয়ে থাকা।
আজ আমি সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি: মনের ভেতরের এক গভীরতম প্রশান্তি ছাড়া আমি কোনো দিনই পারতাম না ঐ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে। জাহাজে প্রথম কদিন থাকার পরে আমার মধ্যে যে-প্রশান্তি আসে, তা ছাড়া আসলেই আমি হয়তো জীবনে এ জায়গায় পৌঁছুতে পারতাম না। আর সেই প্রশান্তির জন্য, আমাকে বলতেই হচ্ছে, আমি জাহাজের কয়েকজন মানুষের কাছে ঋণী।
সবকিছুর পরেও, তারা সত্যি ভাল মানুষ। আমি আজও আনন্দের সঙ্গে মনে করতে পারি, যখন আধোঘুমে থাকতাম তখন কীভাবে তাদের ভারী পায়ের শব্দ আমার মাথার মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলত। যেকোনো কাজ খুব, খুবই ধীরে করা তাদের স্বভাবের মধ্যে ছিল। এদের কেউ যদি ধরুন একটু চোখ ডলবে, তো সে তার হাত এমনভাবে উপরে তুলত যেন ওতে কোনো ভার চাপানো হয়েছে। তাদের ঠাট্টা কৌতুকগুলো ছিল মোটা দাগের কিন্তু দিলখোলা। তাদের হাসির মধ্যে সব সময় কেমন একটা কর্কশ ভাব পাওয়া যেত, শুনতে মনে হতো বিপজ্জনক, তবে বাস্তবে অমন কিছু না। তাদের মুখে থু করে ফেলার জন্য সব সময় কিছু-না-কিছু থাকত, আর কোথায় তারা সেই থু-টা ফেলছে সে ব্যাপারে কোনোকিছুর তোয়াক্কা করত না। তারা সবসময় অভিযোগ করত যে আমার গায়ের মাছি লাফ দিয়ে তাদের কাছে গিয়ে পড়ছে; তার পরও এ নিয়ে আমার ওপরে তাদের কাউকেই আমি সত্যিকারের রাগতে দেখেনি; তারা মোট কথা জানত যে আমার বিশাল লোমের মধ্যে ওইসব রক্তপায়ী কীটপতঙ্গ বিস্তার লাভ করে, আর ওগুলো লাফাতে ওস্তাদ; সুতরাং তারা বিষয়টা মেনে নিল। মাঝেমধ্যে যখন বিশ্রামের সময় হতো, তাদের কয়েকজন এসে আমাকে ঘিরে বসত আধা বৃত্ত হয়ে; খুব একটা কথা বলত না তারা, শুধু একজন আরেকজনের দিকে কু-কু করে বোধ হয় বিরক্তি জানাত; পাইপ ধরাত, বাক্সের গায়ে হেলান দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসত; আমি সামান্য একটু নড়লেই হাঁটু চাপড়াতো, আর একটু পরপর তাদের কেউ একটা লাঠি নিয়ে আমার গায়ে, যেখানে যেখানে আমি সুড়সুড়ি পছন্দ করতাম, সেখানে সুড়সুড়ি দিত। আজ যদি আমাকে সেই জাহাজটায় চড়ে সমুদ্রযাত্রার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলে নিশ্চিত আমি সেটা গ্রহণ করব না; কিন্তু এটাও একই রকম নিশ্চিত যে দুই ডেকের মাঝখানে বসে আমি যেসব স্মৃতির মধ্যে হারিয়ে যাব তার সবগুলোই বাজে স্মৃতি হবে না।
সবচেয়ে বড় কথা, এই লোকগুলোর সঙ্গে থেকে মনের যে প্রশান্তি আমি অর্জন করেছিলাম, তা আমাকে পালানোর কোনো চেষ্টা নেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল। আজ পেছন ফিরে তাকালে আমার কাছে মনে হয়, আমি তত দিনে নিশ্চিতই বুঝে গিয়েছিলাম যদি বাঁচতে হয় তাহলে আমাকে বেরোবার একটা পথ বের করতেই হবে, কিন্তু এটাও বুঝেছিলাম সেই পথ মানে পালানোর পথ না। এখন আর বলতে পারব না, পালানো সত্যি আসলে সম্ভব ছিল কি না, যদিও আমার বিশ্বাস যে তা ছিল; কোনো শিম্পাঞ্জির জন্য পালিয়ে যাওয়া সব সময়ই সম্ভব। এখন আমার দাঁতের যে অবস্থা তাতে সাধারণ একটা বাদাম ভেঙে খেতে গেলেও খুব সাবধান হওয়া লাগে, কিন্তু তখন তো মনে হয় আমি ঠিকই পারতাম দরজার তালা সময়মতো কামড়ে ভেঙে পালিয়ে যেতে। আমি তা করিনি। তাতে আমার ভালোই বা কী হতো? খাঁচা থেকে আমার মাথা বের করা মাত্রই তো তারা আবার আমাকে ধরে ফেলত, একেবারে তালা দিয়ে কোথায় ফেলে রাখত– নিশ্চিত আরো জঘন্য কোনো খাঁচায়; কিংবা আমি হয়তো না দেখেই গিয়ে পড়তাম অন্য জন্তুদের মধ্যখানে, হতে পারে উল্টোদিকের অজগরজাতীয় সাপগুলোর মধ্যে, আর ওদের হাতেই শেষ নিশ্বাস ছাড়তে হতো আমাকে; কিংবা হয়তো আমি আসলেই চুপিসারে ডেকের উপর পৌঁছাতে পারতাম, তারপর পারতাম লাফিয়ে পড়তে, সে ক্ষেত্রে কী হতো? ওই গভীর জলে কিছুক্ষণ হয়তো দোল খেতাম, আর তারপরে সলিল সমাধি। বেপরোয়া সব প্রতিকারের পথ। এরকম, মানুষের মতো, হিসাবনিকাশ করে আমি অবশ্যই এগোইনি, কিন্তু আমার পারিপার্শ্বিকতার বিবেচনায় আমি যা করলাম তা মানুষের মতোই ছিল।
যা বললাম, অত হিসাব-নিকাশ আমি করিনি; কিন্তু সবকিছু আমি খেয়াল করতে লাগলাম খুব শান্তভাবে। আমি দেখতাম ঐ মানুষগুলোকে, তারা হাঁটছে এ মাথা থেকে ও মাথা, সব সময় একই মুখ, একই চলাচল, প্রায়ই আমার মনে হতো ওরা সবাই মিলে একটাই এবং একই লোক। তো, এই মানুষটা কিংবা এই মানুষগুলো হাঁটাচলা করত অবাধে। বিরাট এক স্বপ্ন ভর করতে শুরু করল আমার মাথায়। কেউ আমাকে এমন কোনো প্রতিজ্ঞা করেনি যে আমি যদি তাদের মতো হয়ে যাই, তাহলে তারা আমার খাঁচা খুলে দেবে। ওরকম প্রতিজ্ঞা– যখন তা কিনা এমন কিছু করার জন্য যা পূরণ করা অসম্ভব– কখনোই করা হয় না। তবে যা পূরণ করার তা আগে পূরণ করো, প্রতিজ্ঞা যথাসময়ে পরে আসবে, ঠিক সে-জায়গাতেই আসবে যেখানে আগে তুমি ব্যর্থ হয়ে খুঁজেছিলে ওসব প্রতিজ্ঞা। এখন কথা হচ্ছে, এই মানুষগুলোর মধ্যে এমন বিশেষ কিছু আমি কখনোই পাইনি, যা আমাকে তাদের মতো হয়ে যাওয়াতে প্রলুব্ধ করতে পারে। একটু আগের বলা ঐ স্বাধীনতার যদি আমি পূজারী হতাম, তাহলে এই মানুষগুলোর বিষণ্ণ দৃষ্টির মধ্যে বেরোবার পথের যে ছায়া আমি দেখতাম তার চেয়ে আমার নিশ্চিত অনেক বেশি ভালো লাগত সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তেই। যা-ই হোক, এসব ভাবনা মাথায় আসার বহুদিন আগে থেকেই তাদের আমি পর্যবেক্ষণ করছিলাম; সত্যি বলতে, আমার সেই বহুদিন ধরে করা একটু একটু পর্যবেক্ষণই আমাকে প্রথম ঠিক পথে ঠেলে দিল।
দেখলাম এসব লোককে নকল করা কত সোজা ব্যাপার। মাত্র অল্প কিছুদিনেই শিখে গেলাম কী করে থুতু ফেলতে হয়। তারপর আমরা একজন আরেকজনের মুখে থুতু মারতাম; একমাত্র ফারাক হলো, এরপর আমি আমার মুখ চেটে সাফ করতাম, যা তারা করত না। শিগগিরই আমি পাকা ধূমপায়ীর মতো পাইপ টানা শুরু করলাম, আর আমি যদি পাইপের ছোট বাটির মতো জায়গাটায় আমার বুড়ো আঙুল চেপে ধরতাম তো জাহাজের সব ক্রু খুশিতে বিরাট চিৎকার দিয়ে উঠত; শুধু কথা হচ্ছে, আমার এই পার্থক্য বুঝতে অনেক দিন লাগল যে কখন পাইপটা খালি আর কখন সেটা ভরা।
আমাকে সবচেয়ে ঝামেলা দিত মদের বোতল। রামের গন্ধ আমার জন্য ছিল একটা অত্যাচার; সমস্ত শক্তি দিয়ে জোর করে গিলতাম একটুখানি; কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজের সেই বাধা আমি উতরে গেলাম। অবাক ব্যাপার, লোকগুলো আমার এই নিজের সঙ্গে সংগ্রামের বিষয়টা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিল। আজ যখন ওই দিনগুলোর কথা ভাবি, আমি তাদের আলাদা আলাদা করে মনে করতে পারি না, তবু মনে আছে এদের মধ্যে একজন ছিল যে বারবার আসত আমার কাছে, একা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে, দিনে আসত, রাতে আসত, যেকোনো সময়ে আসত; আমার সামনে সে বসত বেশ কায়দা করে –হাতে তার মদের বোতল, আর মুখে আমার জন্য নানা নির্দেশ। আমাকে সে বুঝে উঠতে পারত না, আমরা শিম্পাজিরা কী করে বেঁচে থাকি সেই ধাঁধার সমাধান বের করতে চাইত সে। সে ধীরে ধীরে বোতলের ছিপি খুলত, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করত আমি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি কি না; আমি কবুল করছি, সব সময় আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম সবচেয়ে বুনো, সবচেয়ে অতি-ক্ষিপ্র মনোযোগ দিয়ে; সারা পৃথিবী খুঁজেও কোনো মানুষ শিক্ষক ও রকম মনোযোগী কোনো মানুষ-ছাত্র খুঁজে পাওয়ার আশা করতে পারবে না; ছিপি খোলা হয়ে যাওয়ার পরে সে ওটা মুখের সামনে তুলত; আমি তাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতাম, একদম যেন তার গলার ভেতর পর্যন্ত; সে মাথা নাড়ত, আমার ওপর খুশি, বোতলটা ছোঁয়াত তার ঠোঁটে; আমি, ধীরে ধীরে জ্ঞানের সন্ধান লাভ করার তুরীয় আনন্দে, তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করতে করতে আমার সারা গা চুলকাতাম, এখানে, সেখানে, সবখানে– যেমন খুশি; সে খুব মজা পেত, বোতল তুলে ধরত মুখে আর এক ঢোক খেত; আমি তাকে নকল করার জন্য তখন অধীর ও অস্থির, মলমূত্র বেরিয়ে যেত। আমার, নিজেকে নোংরা করে ফেলতাম, এটা দেখে সে আরো বিরাট মজা পেত; এরপর সে তার শরীরের এক হাতে সামনে বোতল ধরে আর ঝট করে তা ঠোঁটের কাছে নিয়ে। গিয়ে এক ঢোকে পুরো বোতল শেষ করত, কেমন স্কুলশিক্ষকদের মতো মহা পণ্ডিতির ঢঙে পেছনে ঝুঁকে যেত তার শরীর । আমি তখন মাত্রাতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষায় কাতর, আর তাকে দেখার মতো শক্তি শরীরে অবশিষ্ট নেই, হেলে পড়তাম শিকের গায়ে; এবার নিজের পেটে হাত বোলাতে বোলাতে আর একটা সেঁতো হাসি দিয়ে আমাকে শিক্ষাদানের তত্ত্বীয় পাঠ শেষ করে আনত সে।
কেবল এরপরই শুরু হতো ব্যবহারিক অংশ। এত এত তাত্ত্বিক অংশের পরে আমি তো ততক্ষণে মহা ক্লান্ত; নাকি? আসলেই বিরাট ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি। কিন্তু কী আর করা, আমার নিয়তি-ই তো তাই। যাক, এবার বোতল আমার দিকে ধরা হলে আমি সেদিকে যতটা পারা যায় শরীর বাড়াতাম; ছিপি খুলতাম, রীতিমতো কাঁপছি তখন; ছিপি খোলার কাজে সফল হলে পরে দেখতাম আমার শক্তি ধীরে ধীরে ফেরত আসছে; বোতল হাতে তুলতাম, মূল বোতল থেকে ওটা আলাদা করার প্রায় আর কোনো উপায়ই নেই; ঠোঁটে ছোঁয়াতাম ওটা আর– ওটাকে ছুঁড়ে মারতাম ঘৃণায়, ঘৃণায়, যদিও বোতল খালি এবং মদের গন্ধ ছাড়া কিছুই ওতে নেই, তবু নিচে মেঝের দিকে ছুঁড়ে মারতাম ঘৃণাভরে। আমার শিক্ষক তখন হতাশ, আমিও আরো বেশি হতাশ আমার নিজের ওপর; আমার এরপরের কাজেও দুজনের মনে কোনো শান্তি আসততা না– আমি বোতল ছুঁড়ে মেরেছি বটে, কিন্তু এর পরপর যে আমাকে খুব দর্শনীয় ভঙ্গিতে পেটে হাত বোলাতে হবে, সেই সঙ্গে দাঁত বের করে হাসতে হবে, সে-কথা আমি ভুলে যাইনি।
প্রায়ই দেখা যেত, তার এসব প্রশিক্ষণের এই হাল হচ্ছে। আমার শিক্ষকের প্রশংসা করতে হয়, সে আমার ওপর খেপে যেত না; মাঝে মাঝে আসলেই হয়তো সে তার জ্বলন্ত পাইপ ঠেসে ধরত আমার গায়ের লোমে, হাত যায় না এ রকম কোনো কোনো জায়গায়। এমনকি ধিকিধিকি জ্বলে উঠত আগুন, কিন্তু তারপর সে; সে সবসময় তার বিরাট, দয়ালু হাতে আবার তা নিভিয়ে দিত নিজেই, আমার ওপর রাগ হতো না সে বুঝতে পারল যে আমরা দুজনেই একই দলের হয়ে লড়াই করছি শিম্পাঞ্জির স্বভাবের বিরুদ্ধে, আর দুজনের মধ্যে আমার লড়াইটাই বেশি কঠিন।
সে হিসেবে তার ও আমার দুজনের জন্যই কত বড় বিজয় ছিল ওটা যখন একদিন সন্ধ্যায়, অনেক অনেক দর্শকের সামনে– মনে হয় ওটা ছিল বড় কোনো এক পার্টি, একটা গ্রামোফোন বাজছিল, একজন অফিসার ক্রুদের মধ্যে এদিক-ওদিক হাঁটছিল– সেই সন্ধ্যায়, ঠিক যখন দেখলাম যে আমাকে কেউ লক্ষ্য করছে না, আমি আমার খাঁচার সামনে বেখেয়ালে রেখে যাওয়া একটা মদের বোতল হাতে তুলে নিলাম, যেভাবে শেখানো হয়েছে তেমন করেই ওটার ছিপি খুললাম, উপস্থিত সবার ধাপে ধাপে বাড়তে থাকা মনোযোগের মধ্যে বোতলটা নিলাম ঠোঁটের কাছে, আর কোনো রকম দোনোমনা না করেই, কোনোরকম মুখ ভেংচি না কেটেই, পেশাদার মদখোরের মতো চোখ বড় বড় গোল করে আর গলায় গলগল শব্দ করে, সত্যি, সত্যিই একটানে খালি করে দিলাম ওটা; তারপর ছুঁড়ে মারলাম বোতল, এবার আর হতাশায় না বরং এক দক্ষ শিল্পীর মতো; আসলেই ভুলে গেলাম যে আমাকে পেটে হাত বোলাতে হবে; তার বদলে, যেহেতু নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না, যেহেতু মনে হলো যে এ ছাড়া আমার আর উপায় নেই, যেহেতু আমার সব ইন্দ্রিয়ে ঝড় উঠল, আমি ‘হ্যালো’ বলে একটা ছোট, তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে উঠলাম, মানুষের ভাষায় শব্দ করে উঠলাম, আর এই চিৎকারের মধ্য দিয়ে ভিড়ে গেলাম মানবসম্প্রদায়ের মধ্যে, আর অনুভব করলাম তাদের তরফে উত্তরটা– ‘শোনো, শিম্পাঞ্জিটা কথা বলছে!’– আমার পুরো ঘাম-জবজবে শরীরের ওপর ছড়িয়ে যাচ্ছে কোনো স্নেহস্পর্শের মতো।
আমি আবারও বলছিঃ মানুষের নকল করার কোনো অভিলাষ আমার ছিল না, আমি তাদের নকল করলাম শুধু এ কারণেই যে আমি একটা বেরোবার পথ খুঁজছিলাম, অন্য আর কোনো কারণ নেই। আর ঐ প্রথম বিজয় যে আমাকে অনেক দূর নিয়ে গেল তা না। এর ঠিক পরপরই আমার সেই কথা বলার ব্যাপারটা আবার হারিয়ে গেল; অনেক মাস লাগল ওটা ফিরে আসতে; মদের বোতলে আমার বিতৃষ্ণা এমনকি আগের চেয়েও অনেক শক্তভাবে ফিরে এল। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও, আমার পথ আমার জন্য ততদিনে নির্দিষ্ট হয়ে গেল, চিরদিনের মতো।
হামবুর্গে আমাকে যখন আমার প্রথম প্রশিক্ষকের হাতে তুলে দেওয়া হলো, আমি শিগগিরই বুঝে গেলাম যে আমার সামনে দুটো সম্ভাবনা খোলা আছে: চিড়িয়াখানা অথবা বিচিত্রানুষ্ঠানের মঞ্চ। আমি কোনো দ্বিধা করলাম না। নিজেকে বললাম: বিচিত্রানুষ্ঠানে ঢোকার জন্য তোমার ক্ষমতায় যেটুকু সম্ভব তা করো; ওখানেই আছে বেরোবার পথ; চিড়িয়াখানা তো স্রেফ আরেকটা শিক-দেওয়া খাঁচা; ওটাতে গিয়েছ কি মরেছ।
আমি শেখা শুরু করলাম, ভদ্রমহোদয়গণ। ওহ্, যখন শিখতেই হবে তখন আপনি ঠিকই শিখবেন; আপনি যদি বেরোবার পথ চান তো ঠিকই শিখবেন; শিখবেন নির্দয়ের মতো। নিজেকে তখন আপনি পাহারা দেবেন হাতে চাবুক নিয়ে নিজের ভেতর থেকে সামান্যতম বাধা অনুভব করলেই চাবকে নিজের ছাল তুলে ফেলবেন। আমার শিম্পাঞ্জির স্বভাব এমন দুড়মুড় করে আমার থেকে ছুটে দূরে পালাতে শুরু করল যে, এর ফলে আমার প্রথম শিক্ষক নিজেই শিম্পাঞ্জির মতো হয়ে উঠল, শিগগিরই আমাকে শিক্ষা দেওয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো সে; তাকে ভর্তি হতে হলো একটা মানসিক হাসপাতালে। সৌভাগ্যক্রমে, হাসপাতাল থেকে অল্পদিনেই ছাড়া পেল সে।
তবে আমি বেশ কয়েকজন শিক্ষক ব্যবহার করেছি, সত্যি বলতে একই সময়ে কয়েকজনকেও। আমি যখন আমার সামর্থ্যের ব্যাপারে আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম, বাইরের পাবলিক যখন আমার অগ্রগতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল আর আমার ভবিষ্যৎ যখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠা শুরু হলো, প্রশিক্ষকদের আমি নিজেই ব্যস্ত রাখলাম নিজের হিসাবমতে, তাদের বসালাম পর পর পাঁচটা ঘরে আর তাদের সবার কাছ থেকে, বিরামহীন এক ঘর থেকে আরেক ঘরে লাফ দিয়ে দিয়ে, শিখতে লাগলাম একই সঙ্গে।
কী যে ধাপে ধাপে অগ্রগতি হলো আমার! জ্ঞানের ওই শিখাগুলো চারদিক থেকে ঢুকতে লাগল আমার জেগে-উঠতে-থাকা মগজে! আমি অস্বীকার করব নাঃ আমার হৃদয় তাতে আনন্দ-আপ্লুত হলো। কিন্তু আমাকে এটাও অবশ্যই বলতে হবে: আমি ব্যাপারটার অতিমূল্যায়ন এমনকি তখনো করিনি, আর আজ তা করার তো কথাই ওঠে না। এ পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি এমন এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমি পৌঁছে গেলাম একজন গড়পড়তা ইউরোপিয়ান মানুষের সাংস্কৃতিক স্তরে। শুধু সেটুকুর বিচারে এটা হয়তো কিছুই না, তার পরও, প্রকৃত অর্থে, অবশ্যই এটা একেবারে ফেলনা ব্যাপারও না–এর সাহায্যেই তো আমি বেরোতে পারলাম খাঁচা ছেড়ে, এই ব্যাপারটাই তো আমাকে দিল এই বিশেষ ধরনের, মানুষের ধরনের, বেরোবার পথ। জার্মান ভাষায় একটা চমৎকার বাগ্ধারা আছে: বড় গাছের নিচের ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে যাওয়া; আমি ঠিক সে কাজটাই করেছি, গাছের নিচের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে গেছি। আমার যাওয়ার অন্য কোনো পথও ছিল না, সব সময়েই আমি ধরে নিয়েছি যে স্বাধীনতা আমার পথ না।
আমি যদি আমার বিকাশ আর তা আমাকে কতদূর নিয়ে এসেছে তার হিসাব করতে বসি, তাহলে দেখি আমার নালিশ জানানোরও কিছু নেই, পরিতৃপ্ত হওয়ারও কিছু নেই। আমার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে, টেবিলে আমার ওয়াইনের বোতল রেখে, আমি আমার দোলনা-চেয়ারে আধা শুয়ে, আধা বসে থাকি, তাকাই জানালা দিয়ে বাইরে। যদি কোনো দর্শনার্থী আসে, তাকে অভ্যর্থনা জানাই বিনয়ের সঙ্গে। আমার ম্যানেজার বসে থাকে লাগানো ঘরটাতে, আমি ঘণ্টা বাজালে সে আসে, শোনে আমি কী বলি। সন্ধ্যাবেলা প্রায় প্রতিদিনই শো থাকে, তাতে আমার যে সফলতা তা কারো পক্ষে ছাড়িয়ে যাওয়া বলতে গেলে অসম্ভব। অনেক রাতে আমি যখন ভূরিভোজন থেকে ঘরে ফিরি, কিংবা কোনো বৈজ্ঞানিক সোসাইটির পার্টি থেকে, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডা থেকে, তখন আমার জন্য অপেক্ষা করে একটা ছোট আধা-প্রশিক্ষণ পাওয়া মেয়ে-শিম্পাঞ্জি, শিম্পাঞ্জিদের মতো করেই তার সঙ্গসুখ ভোগ করি আমি। দিনের আলোতে তাকে দেখার আমার কখনোই ইচ্ছা হয় না; কারণ তার চোখের মধ্যে আছে পোষ-মানানো জন্তুদের সেই উদ্ভ্রান্ত, বিভ্রান্ত দৃষ্টি; আর কারো না, কেবল আমার চোখেই সেটা ধরা পড়ে যায়, আর ব্যাপারটা আমার একেবারেই সহ্য হয় না।
সার্বিক বিচারে, আমি যা অর্জন করতে চেয়েছিলাম অন্তত তা অর্জন করতে পেরেছি। কেউ যেন না বলে যে আমার এত চেষ্টা করার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া, অন্যের মতামতে আমার কোনো আগ্রহও নেই; আমার আগ্রহ শুধু আমাকে আপনারা বুঝুন –এই জ্ঞানটুকুর বিস্তারে; আমি শুধু প্রতিবেদন পেশে আগ্রহী; আপনাদের কাছে, অ্যাকাডেমির সম্মানিত ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের কাছেও আমি কেবল একটা প্রতিবেদনই পেশ করলাম।
অ্যাকাডেমির জন্য একটি প্রতিবেদন
দুটি খণ্ডাংশ ও একটি চিঠির শুরু
আমরা সবাই রটপিটারকে চিনি, যেমনটা তাকে চেনে অর্ধেক পৃথিবী। কিন্তু সে যখন আমাদের শহরে এল বাছাই-করা কিছু অতিথির জন্য শশা দেখাতে, আমি ঠিক করলাম তাকে একটু ব্যক্তিগতভাবে জানব। তার শো-তে ঢুকতে পারা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। বড় শহরগুলোতে হয়তো তারকাশিল্পীদের যত কাছ থেকে পারা যায় দেখার জন্য মানুষেরা, যারা খবর রাখে, মারামারি শুরু করে দেয়, অনেক বড় বড় বাধা হয়তো সেখানে পার হওয়া লাগে; কিন্তু আমাদের এই ছোট শহরে মানুষ ওসব বিস্ময়কর জিনিস দূরে গ্যালারি থেকে একটু অবাক চোখে দেখতে পেলেই খুশি। তাই এখন পর্যন্ত আমিই একমাত্র ব্যক্তি, হোটেলের বেলবয় যেমনটা বলল, যে কিনা রটুপিটারের সাক্ষাৎ লাভ করতে এসেছি। হের বুসেনাউ, শো-এর প্রযোজক, আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বিরাট সৌজন্য দেখিয়ে। তিনি যে এরকম বিনয়ী, আর বরং এমন লাজুক প্রকৃতির লোক হবেন তা আমি আশা করিনি। রটুপিটারের ঘরের লাগোয়া ঘরটাতে তিনি বসে আছেন, একটা অমলেট খাচ্ছেন। যদিও তখন সকাল, তবু সন্ধ্যাবেলার শো’র সময়ের পোশাক পরে বসে আছেন তিনি। তার চোখ পড়ল আমার দিকে –আমি, এক অচেনা লোক, এক সামান্য অতিথি, আর তিনি, অনেক বিশিষ্ট মেডেল পাওয়া এক মানুষ, প্রশিক্ষকদের রাজা, নামিদামি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেটধারী, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, করমর্দনের জন্য দুই হাত ধরে আমাকে ঝাঁকালেন, বসার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করলেন, টেবিলক্লথে তার চামচ মুছলেন আর সৌহার্দ্যপূর্ণ ভঙ্গিতে চামচটা আমাকে দিলেন যেন আমি তার অমলেটটা শেষ করি। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে অসম্মতি জানালাম, তিনি তা মানবেন না, চটপট ব্যস্ত হয়ে গেলেন আমাকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য। তাকে শান্ত করতে আর তাকে তার চামচ, প্লেট এসব দূরে সরাতে রাজি করানোর জন্য ভালো ঝাক্কি পোহাতে হলো আমার।
‘অনেক দয়া আপনার যে আপনি এসেছেন, কড়া ভিনদেশি বাচনভঙ্গিতে বললেন তিনি। অনেক দয়া! আর আপনি এসেছেন একদম ঠিক সময়ে, কী বলব– রটুপিটার সবসময় দর্শনার্থী সাক্ষাৎ দিতে রাজি না। মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতে তার প্রায়ই দেখা যায় বিরাট অনীহা; তখন কাউকেই, যেই হোক না কেন, কাউকেই। ঢুকতে দেওয়া নিষেধ; তখন আমিও, এমনকি আমারও তার সঙ্গে দেখা হয় শুধু কাজের সময়ে, মানে বলছি যে, শো-এর মঞ্চে। আর তখন তার শো শেষ হওয়া মাত্র আমাকে ভাগতে হয়, সে একাই গাড়ি চালিয়ে ঘরে ফেরে, এসেই ঘরে তালা লাগিয়ে দেয়, সাধারণত পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবেই চলে। তার শোয়ার ঘরে সব সময় একটা বড় ফলের ঝুড়ি থাকে, একা থাকার সময়গুলোতে ওই ফল খেয়েই সে কাটিয়ে দেয়। তবে আমি, আমার কি আর সাহস আছে তাকে চোখের আড়ালে রাখার, তাই সবসময় করি কী– তার ঘরের উল্টোদিকেরটা ভাড়া নিই, পর্দার আড়াল থেকে তার দিকে লক্ষ্য রাখি।’
.
আমি যখন তোমার সামনে এভাবে বসে আছি রটপিটার, তোমার কথা শুনছি, তোমার সুস্বাস্থ্য চেয়ে ড্রিংক করছি, তখন আমি সত্যি, বাস্তবিক ভুলে যাচ্ছি– তুমি এটা প্রশংসা হিসেবে নাও কিংবা না নাও, এটাই সত্যি– যে তুমি একটা শিম্পাঞ্জি। তখন খুব ধীরে ধীরেই কেবল –ভাবনাগুলো জোর করে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার পরেই কেবল –আবার বুঝছি আমি আসলে কার অতিথি।
হ্যাঁ।
হঠাৎ তুমি এত চুপ করে গেলে, আমি ভাবছি যে কেন? মাত্র একটুখানি আগেই তো তুমি আমাদের ছোট শহরটা নিয়ে কীরকম অবাক করা নির্ভুল মন্তব্য করছিলে, আর এখন তুমি এমন নীরব?
নীরব?
কোনো সমস্যা হয়েছে? আমি কি তোমার প্রশিক্ষককে ডাকব? তোমার কি দিনের এই সময়ে খাওয়াদাওয়া করার অভ্যাস আছে?
।না, না। সব ঠিক আছে। বলছি কী ঘটেছে। কখনো কখনো মানুষের প্রতি আমার এমন অনীহা জাগে যে বলতে গেলে প্রায় বমি চলে আসে। অবশ্য আমার এটা নির্দিষ্ট কোনো মানুষের জন্য হয় না, তোমার সঙ্গে আমার এই সুন্দর সাক্ষাতের জন্য তো হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ব্যাপারটা পুরো মানবজাতি নিয়ে। অবশ্য এটার মধ্যে বিশেষ বা অসাধারণ কিছু নেই। ধরো যে তুমি যদি শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গেও টানা এতগুলো দিন থাকতে, এই একই রকম অনুভূতি তোমার তখনো হতো, নিজের ওপর তোমার যতই নিয়ন্ত্রণ থাকুক না কেন। সত্যিকার অর্থে, আমার এত বিতৃষ্ণা মানুষের গায়ের গন্ধ নিয়ে না; মানুষের গন্ধ আমার মধ্যে চলে এসেছে আর আমার নিজের দেশের গন্ধের সঙ্গে মিশে গেছে। নিজেই শুঁকে দেখো! এই যে, আমার বুকে! লোমের মধ্যে, অনেক-ভেতরে নাক নিয়ে যাও! অনেক গভীরে বলছি!
দুঃখিত, আমি কোনো বিশেষ গন্ধ তো পাচ্ছি না। স্রেফ পরিপাটি করে রাখা কোনো শরীরের সাধারণ গন্ধ, ওটুকুই। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে শহরে থাকা লোকদের নাকের ব্যাপারে বেশি ভরসাও করা যায় না। কোনো সন্দেহ নেই, তুমি এমন হাজার জিনিসের। গন্ধ নাকে পাও, যা আমাদের নাক এড়িয়ে যায়।
সেটা একদিন সত্যি ছিল, জনাব, অনেক আগে একদিন। সেই দিন শেষ।
যেহেতু তুমি নিজে কথাটা তুললে, আমি সাহস করে জিজ্ঞাসা করছিঃ তুমি সত্যিকারের কত দিন হলো আমাদের সঙ্গে আছো?
পাঁচ বছর। এপ্রিলের পাঁচ তারিখে পাঁচ বছর পুরো হবে।
ভয়ংকর সাফল্য। পাঁচ বছরে শিম্পাঞ্জিত্ব ছুঁড়ে ফেলে মানুষের পুরো বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে আসা! নিশ্চিত তোমার আগে আর কেউই করতে পারেনি এটা! এই রেসের মাঠে তোমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
হ্যাঁ, এটা যথেষ্ট বড় ব্যাপার, আমি জানি, মাঝেমাঝে আমার নিজেরই চিন্তায় কুলায় না। তবে যখন শান্ত থাকি, তখন এই উচ্ছ্বাসটা অনেক কমে যায়। তুমি কি জানো, আমাকে কীভাবে ধরা হয়েছিল?
তোমাকে নিয়ে ছাপা হওয়া সবকিছুই আমার পড়া শেষ। তোমাকে গুলি করা হয়, তারপর ধরা হয়।
হ্যাঁ, দুটো গুলি করা হয় আমাকে, একবার এই এখানে গালে– যে দাগ তুমি দেখছ তার চেয়ে ক্ষতটা নিঃসন্দেহে অনেক বড় ছিল –আর দ্বিতীয়বার আমার কোমর ও পাছার নিচের এই দিকটায়। তোমাকে দাগটা দেখানোর জন্য আমি এই যে প্যান্ট খুলছি। এখান দিয়ে ঢুকেছিল গুলি, ওটাই ছিল মারাত্মক, চূড়ান্ত আঘাত। আমি গাছ থেকে পড়ে গেলাম আর যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি জাহাজের দুই ডেকের মাঝখানে খাঁচায় বন্দী।
খাঁচায়! দুই ডেকের মাঝখানে! তোমার গল্প কাগজে পড়া এক জিনিস, আর তুমি বলছ, তখন নিজের কানে শুনছি– সেটা পুরো আলাদা ব্যাপার!
আর, জনাব, ওই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়াটা তাহলে কত আলাদা ব্যাপার, বলো। ওই দিন পর্যন্ত আমি কখনোই বুঝিনি বেরোবার পথ না-থাকা বলতে কী বোঝায়। ওটা কোনো চারপাশ-ঘেরা সাধারণ শিক দেওয়া খাঁচা ছিল না, এর ছিল শুধু তিনটে পাশ, একটা বাক্সের সঙ্গে জোড়া লাগানো, বাক্সটাই চার নম্বর পাশ। অদ্ভুত এই পুরো জিনিসটা এত নিচু ছিল যে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না, আর আড়ে এত চাপা ছিল যে আমি এমনকি বসতেও পারতাম না। আমাকে বসতে হতো হাঁটু ভাঁজ করে, উবু হয়ে –তা ছাড়া অন্য উপায় নেই। রাগে ক্রোধে ফেটে পড়ে আমি ঠিক করলাম কাউকেই দেখা দেব না, তাই বাক্সের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকতাম; দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি ওই মেঝে ছুঁয়ে বসে থাকতাম, হাঁটু কাঁপতে থাকত আমার, আর পিঠের দিকে খাঁচার শিকগুলো মাংস কেটে ঢুকে যেত। বুনো জন্তু আটকে রাখার এই পদ্ধতিকে প্রথম কিছুদিনের জন্য সুবিধাজনক বলে ধরা হয়ে থাকে, আর আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কথাটা সত্যিই বটে। কিন্তু তখন মানুষের কী দৃষ্টিকোণ তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমার সামনে ছিল ওই বাক্স। কাঠের তক্তাগুলো ভেঙে ফ্যালো, কামড়ে কামড়ে ওগুলোতে একটা ফাঁক বানাও, কোনো একটা ফাঁক দিয়ে শরীর মুচড়িয়ে ঢুকিয়ে দাও, বাস্তবে কিনা যে ফাঁকটা বলতে গেলে বাইরে তাকানোর মতোও বড় নয়, আর, সেটা দেখেই কিনা তুমি, প্রথম যখন দেখলে, বোকার মতো না-বুঝেই কী মহা খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওটাকে স্বাগত জানালে! কোথায় যেতে চাও তুমি? তক্তাগুলোর ওপারে জঙ্গলের শুরু।
(একটি চিঠির শুরু)
প্রিয় হের রটপিটার:
আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির কাছে লেখা তোমার প্রতিবেদনটি পড়লাম, সত্যি বলতে, পড়ার সময়ে বুক ধুকপুক করছিল আমার। তাতে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই, যেহেতু আমিই ছিলাম তোমার প্রথম শিক্ষক; আর আমার স্মৃতি তুমি যে সদয় ভাষায় মনে করেছ, তাতেও অবাক হইনি আমি। তবে আমার মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার কথাটা হয়তো তুমি আরেকটু বিবেচনা করে এড়িয়ে যেতে পারতে; আমি অবশ্য বুঝতে পারি, তোমার এই পুরো প্রতিবেদন আর যেরকম অকপটে তুমি এটা লিখেছ, তাতে লেখার সময় এই আনুপুঙ্খিক তথ্যটি বাদ দেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি, যদিও এতে করে অল্প হলেও আমার সুনামের ক্ষতি হয়ে গেছে। অবশ্য আমি এখানে ঠিক এ কথা তোলার জন্য কলম ধরিনি, আমার মাথায় অন্য কিছু কথা আছে।