এক অনশন-শিল্পী – চারটি গল্প
প্রথম দুঃখ
এক ট্র্যাপিজ-শিল্পী– এ শিল্পের (বিখ্যাত বিচিত্রানুষ্ঠান-মঞ্চগুলোর উঁচু গম্বুজের মতো অংশটিতে যার চর্চা হয়) পরিচিতি আছে মানুষের আয়ত্তের মধ্যেকার সবচেয়ে কঠিন কাজের একটি হিসেবে– প্রথম দিকে স্রেফ আরো চূড়ান্ত উত্তর্ষে পৌঁছানোর ইচ্ছে থেকে, কিন্তু পরের দিকে নির্মম হয়ে ওঠা এক অভ্যাসেরও তাড়নায়, তার জীবনকে এমনভাবে সাজাল যে সে কোনো একটা দলের সঙ্গে যত দিন করে থাকত তার পুরোটা সময়ই, রাতদিনের পুরোটাই, কাটাত ট্র্যাপিজের উপর। তার যা কিছু দরকার, সত্যি বলতে চাহিদা ছিল তার অতি সামান্য, তা নিচে পাহারায় থাকা সারি-বেঁধে-দাঁড়ানো পিয়নের দল তার কাছে পৌঁছে দিত বিশেষভাবে বানানো ঝুড়িতে করে, উপরে ওখানে তার যা যা লাগবে তা ঝুড়িতে ভরে তারা সেটা ওঠাত আর নামাত। তার এই এমনতরো জীবনধারার কারণে সাধারণ পাবলিকের যে বিশেষ কোনো অসুবিধা হতো তা বলা যাবে না; স্রেফ অন্য খেলার সময়ে তার এই উঁচুতে বসে থাকার ব্যাপারটা মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটাত একটু, তাকে তো লুকিয়ে রাখার কোনো উপায় ছিল না; যদিও ওসব সময়ে সে স্থির হয়ে থাকত, তবু দর্শকের চোখ তো মাঝেসাঝে তার দিকে একটু পড়তই। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই বিষয়টুকু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন, কারণ সে ছিল একজন ব্যতিক্রমী আর ভূ-ভারতে মাত্র একজনই আছে এমন এক শিল্পী। তা ছাড়া কর্তৃপক্ষ ভালোমতোই বুঝতেন যে কোনো বাঁদরামি করার জন্য সে এমনভাবে জীবন কাটাচ্ছে না, তারা বুঝতেন নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এ ছাড়া তার আসলে কোনো বিকল্পও নেই।
আর উপরে ওখানে থাকাটা স্বাস্থ্যকরও বটে; গরমের দিনে যখন গম্বুজের চারপাশের জানালার ফোকরগুলো খুলে দেওয়া হতো, বাইরের তাজা হাওয়ার সঙ্গে যখন ভেতরের আধো-অন্ধকারে বানের মতো রোদ ঢুকত, তখন একই সঙ্গে দেখতে সুন্দর লাগত বেশ। সত্য যে তার সামাজিক মেলামেশা ছিল সীমিত; স্রেফ কখনো সখনো দেখা যেত কোনো সহসঙ্গী অ্যাক্রোব্যাট দড়ির মই বেয়ে কষ্ট করে উপরে তার ওখানে উঠেছে, তারপর তারা দুজনে একসঙ্গে বসত ট্র্যাপিজের উপর, ডানে ও বায়ে নিরাপত্তা-দড়ির উপর ঝুঁকে পড়ত আর খোশগল্প করত; কিংবা হয়তো ছাদ সারাতে ওঠা মেরামত শ্রমিকেরা তার সঙ্গে টুকটাক দু-একটা কথা বলত কোনো খোলা জানালার ফোকর দিয়ে; কিংবা অগ্নিনির্বাপন বিভাগের কোনো অফিসার, উপরের ব্যালকনির জরুরি আলোক ব্যবস্থা পরীক্ষা করতে গিয়ে হয়তো তাকে ডাক দিত শ্রদ্ধাভরে কিছু বলে, কথাটা অবশ্য নিচে থেকে ঠিকমতো বোঝা যেত না। এগুলো ছাড়া তার চারপাশে সব সময়েই সুনসান নীরব; স্রেফ মাঝেসাঝে মঞ্চের কোনো কর্মচারী হয়তো দুপুরবেলার ফাঁকা মঞ্চে খানিক ঘোরাঘুরি করার পর ভাবুক দৃষ্টি নিয়ে উপরে, প্রায় অভেদ্য ওই উচ্চতায় তাকাত একটুখানিক, ওখানে ট্রাপিজ-শিল্পী, তার বোঝার কোনো উপায় নেই যে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, দেখা যেত অনুশীলন করে যাচ্ছে অথবা বিশ্রাম নিচ্ছে।
স্রেফ যদি দলটার এভাবে এক শহর থেকে আরেক শহরে চলে যাওয়ার ওই অপরিহার্য সফরগুলো করতে না হতো, তাহলে ট্রাপিজ-শিল্পী হয়তো তার জীবন নিরুপদ্রব কাটিয়ে যেতে পারত’ এভাবেই; ওই সফরগুলো তার কাছে লাগত মারাত্মক যন্ত্রণার। কোনো সন্দেহ নেই তার ম্যানেজার এটা নিশ্চিত করতেন যেন ট্রাপিজ-শিল্পীকে যত পারা যায়। কম ভোগান্তি দেওয়া হয়: যেমন একই শহরের মধ্যে এ-জায়গা থেকে ও-জায়গায় যাওয়ার সময়ে রেসিংয়ের গাড়ি ব্যবহার করা হতো; সেই গাড়ি মূলত রাতে কিংবা খুব ভোরে জনমনুষ্যহীন রাস্তাগুলো ধরে ফেড়ে কুঁড়ে চলতে ভয়ংকর বিপজ্জনক গতিতে, যদিও অস্থিরতার মধ্যে ডুবে থাকা ট্র্যাপিজ-শিল্পীর তখনো মনে হতো গাড়ি আরো জোরে ছুটছে না কেন; আর যদি যাত্রাটা হতো রেলে চড়ে, তাহলে পুরো একটা কামরা ভাড়া করা হতো, সেখানে ট্রাপিজ-শিল্পী পুরোটা সময় উপরে লাগেজ রাখার তাকে বসে কাটিয়ে তার স্বাভাবিক জীবনের একধরনের বিকল্প, হয়তো খুবই শোচনীয় বিকল্প, খুঁজে নিত; তাদের সফরসূচিতে পরের যে শহরটা থাকত, সেখানে থিয়েটারে জায়গামতো ট্রাপিজটি ঝুলিয়ে ফেলা হতো ট্রাপিজ-শিল্পী পৌঁছাবার অনেক আগে থেকেই, এর সঙ্গে অডিটোরিয়ামের দিকে গেছে এমন সব কটা দরজা হাট করে খুলে রাখা হতো, সব করিডর ফাঁকা করে রাখা হতো –তার পরও ম্যানেজার সাহেবের জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত বোধ হয় সব সময়ে ওটাই হতো যখন ট্র্যাপিজ-শিল্পী শেষমেশ পা রাখত দড়ির-মইয়ে আর চোখের নিমেষে, অবশেষে, দেখা যেত সে উপরে ওখানে আবার ঝুলছে তার ট্র্যাপিজে।
এখন পর্যন্ত এরকম অনেক সফর ম্যানেজার সফলভাবে শেষ করতে পারলেও, প্রতিটা নতুন সফরই তার জন্য মনে হতো কঠিন পরীক্ষা, কারণ তিনি বুঝলেন– অন্য সবকিছু বাদ দিলেও, এই সফরগুলো পরিষ্কার ট্র্যাপিজ-শিল্পীর স্নায়ুতে অনেক চাপ ফেলছে।
তো একদিন কী হলো –তারা দুজনে আবার একসঙ্গে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাচ্ছে, ট্রাপিজ-শিল্পী শুয়ে আছে উপরে লাগেজ রাখার তাকে, স্বপ্ন দেখছে, ম্যানেজার উল্টোদিকে জানালার পাশের একটা সিটে হেলান দিয়ে বসে একটা বই পড়ছেন, হঠাৎ নিচু স্বরে ট্রাপিজ-শিল্পী ম্যানেজারকে ডেকে উঠল। ম্যানেজার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হলেন তার সেবায়। ট্র্যাপিজ-শিল্পী তার ঠোঁট কামড়িয়ে বলল, এখন থেকে তার সো’র জন্য সব সময়, এত দিনকার স্রেফ ওই একটা ট্র্যাপিজের বদলে, দুটো করে ট্র্যাপিজ লাগবে, দুটো ট্রাপিজ– একটা আরেকটার সামনাসামনি। ম্যানেজার তৎক্ষণাৎ তার সম্মতি দিলেন। কিন্তু ট্রাপিজ-শিল্পী তার পরও ঘোষণা করল –যেন সে দেখাতে চাচ্ছে যে এ-বিষয়টাতে ম্যানেজারের রাজি হওয়া কিংবা না-হওয়া, দুটোই তার কাছে সমান গুরুত্বহীন– যে এখন থেকে সে আর কখনোই, কোনো দিনও আর কোনো পরিস্থিতিতেই, শুধু এক ট্র্যাপিজে খেলা দেখাবে না। আবার যে কোনো দিন তাকে এক ট্র্যাপিজে খেলা দেখানো লাগতে পারে স্রেফ এটুকু ভাবতেই ভয়ে-বিরাগে তার গা মনে হয় কেঁপে উঠল। যানেজার, দ্বিধাদীর্ণ ও সতর্ক, আরো একবার জোর দিয়ে জানালেন তার হা-সূচক পূর্ণ সম্মতি, একটা ট্র্যাপিজের চেয়ে দুটো কত ভালো, আর তা ছাড়া এই নতুন ব্যবস্থায় বাড়তি লাভ হচ্ছে এটা খেলায় বৈচিত্র্য যযাগ করবে। এ সময় ট্রাপিজ-শিল্পী হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল। খুব শঙ্কিত হয়ে ম্যানেজার লাফিয়ে উঠলেন, জিগ্যেস করলেন কী হয়েছে, আর কোনো উত্তর না পেয়ে ট্রাপিজ-শিল্পীর আসনে উঠে গেলেন, তার গায়ে হাত বোলালেন আর তার গালে গাল রাখলেন যাতে করে ট্র্যাপিজ-শিল্পীর চোখের পানিতে তার নিজের গাল ভেসে যায়। কিন্তু অনেক জিজ্ঞাসা আর অনেক মন-গলানো কথার পরেই কেবল ট্রাপিজ-শিল্পী মুখ খুলল ফোঁপাতে ফোঁপাতে: ‘আমার হাতে শুধু এই একটা.ট্র্যাপিজের বার –এভাবে কী করে আমি বাঁচব!’ এবার তাকে সান্তনা দেওয়া ম্যানেজারের জন্য খানিকটা সহজ হলো; তিনি কথা দিলেন পরের স্টেশনেই তিনি নিচে নেমে তাদের সফরসূচিতে এরপরের যে শহর আছে সেখানে দ্বিতীয় একটা ট্র্যাপিজের কথা বলে টেলিগ্রাম করে দেবেন; তিনি নিজেকে গালমন্দ করলেন এত দিন ধরে ট্রাপিজ-শিল্পী কেবল একটা ট্র্যাপিজে খেলা দেখিয়ে এসেছে বলে, আর শেষমেশ এই ভুলটা তার নজরে আনার জন্য তিনি ট্রাপিজ-শিল্পীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাদরে তার প্রশংসা করলেন। এভাবেই ম্যানেজার সফল হলেন ট্রাপিজ-শিল্পীকে ধীরে ধীরে শান্ত করার কাজে, তারপর তিনি ফিরে গেলেন জানালার পাশে তার নিজের সিটে। কিন্তু তার নিজের মন তখন অনেক অশান্ত, গভীর উদ্বেগ নিয়ে তিনি চোরা চোখে, বইয়ের মাথার উপর দিয়ে, দেখতে লাগলেন ট্রাপিজ-শিল্পীকে। একবার যখন এ ধরনের চিন্তা তাকে পীড়া দিতে শুরু করেছে, তখন কি আর কোনো দিন পুরো থামবে তা? বরং এগুলো কি নিয়মিত আরো বাড়তেই থাকবে না? তার রুটিরুজির জন্য এটা কি একটা হুমকি নয়? আর আসলেই ম্যানেজার যখন দেখলেন, সে একসময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আপাতশান্তির এক ঘুমে এলিয়ে পড়েছে, তার মনে হলো ট্র্যাপিজ-শিল্পীর বাচ্চাদের মতো পেলব কপালে যেন প্রথম বলিরেখাগুলোর দাগ কেটে বসা দেখতে পেলেন তিনি।
এক ছোটখাটো মহিলা
আমি এখন যাকে নিয়ে কথা বলছি সে এক ছোট মহিলা; পাতলা গড়ন তবু আঁটসাঁট কাপড় পরে আছে; সব সময় আমি তাকে একই কাপড়ে দেখি, ধূসর-হলদে রঙের ওটা, দেখতে লাগে কাঠের মতো রং, ওটার থেকে ঝোলে একই রঙের সুতো কিংবা বোতামের মতো কিছু জিনিস; তার মাথায় কখনোই হ্যাট দেখি না, তার দীপ্তিহীন ব্লন্ড চুল সে একদম ছেড়ে দিয়ে রাখলেও ওগুলো মসৃণ আর ওদের অগোছালো বলা যাবে না। আঁটসাঁট কাপড় পরা বটে সে, কিন্তু তার চলাফেরার মধ্যে নমনীয়তা আছে; সত্যি বলতে, তার এই সচলতার ভাবটা সে একটু বাড়িয়েই দেখায়– কোমরের পেছনে হাত রেখে, হঠাৎ অবাক করা দ্রুততায় ঝটকা মেরে শরীরের উপরের অংশ পাশের দিকে মোচড় দেওয়া কী যে পছন্দ তার! তার হাত দেখে আমার যে ধারণা হয়েছে তাতে বলতে গেলে শুধু এটুকুই বলতে পারি যে আমি কখনোই আর ওরকম কোনো হাত দেখিনি, যার প্রতিটা আঙুল একটা থেকে আরেকটা ওরকম স্পষ্ট আলাদা; তা হলেও তার হাতের গঠনে কোনো ত্রুটি কিন্তু নেই, একদম স্বাভাবিক একটা হাত।
এই ছোটখাটো মহিলা আমার ওপর খুব অসন্তুষ্ট, সব সময় আমার কোনো ভুল ধরা পড়বে তার চোখে, সব সময় আমি যেন তার ওপর অবিচার করে যাচ্ছি, প্রতিটা পদক্ষেপে আমি যেন তার বিরক্তি ঘটাচ্ছি; যদি কোনো মানুষের জীবনকে সবচেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে আলাদা করা যেত, আর প্রত্যেক অংশ আলাদা করে বিচার করা যেত, কোনো সন্দেহ নেই সে আমার জীবনের প্রতিটা ক্ষুদ্রতম অংশকেও অশোভন বলত। আমি প্রায়ই ভাবি, আমার সবকিছু তার কাছে এত বিরক্তির কেন; হতে পারে আমার প্রতিটা জিনিসই তার পছন্দের উল্টো –তার নান্দনিক বোধ, ন্যায়-অন্যায়ের বোধ, তার অভ্যাস, তার রীতিনীতি, তার আশা-আকাঙ্ক্ষা– সবকিছু; দুজনের এরকম বেমিল স্বভাব বাস্তবে অনেক দেখা যায়; কিন্তু ব্যাপারটা তাকে এত পীড়া দেয় কেন? আমাদের মধ্যে মোটেই এমন কোনো সম্পর্ক নেই যে আমার কারণে তার এতখানি কষ্ট পাওয়া উচিত। তার শুধু মনস্থির করা উচিত যে আমাকে সে অপরিচিত কোনো লোক হিসেবেই দেখবে, তার কাছে তো আমি আসলেও তা-ই– সে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আমার তাতে কোনো আপত্তি থাকবে না, বরং আমি তার সিদ্ধান্তকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাব; তার শুধু। এটাই ধরে নেওয়া উচিত যে আমি আসলে নেই, আমার থাকাটা আমি তো কখনোই তার ওপরে চাপিয়ে দিইনি কিংবা কোনো দিন চাপিয়ে দেবও না– এটুকু হলেই আমাকে নিয়ে তার সব ভোগান্তি নিশ্চিত শেষ হয়ে যাবে। এখানে আমি আমার নিজের কথা পুরো বাদই দিচ্ছি, এটাও বাদ দিচ্ছি যে তার আচরণে আমিও অনেক বিব্রত হই; আমার এই নিজেরটুকু বাদ দিয়ে দেখার পেছনে কারণ হলো আমি ভালোভাবেই এটা জানি যে আমার এই বিব্রত হওয়াটা আমার জন্য তার ভোগান্তির তুলনায় কিছুই না। একই সঙ্গে আমি এটুকুও জানি যে তার এই ভোগান্তির মধ্যে আমার জন্য তার কোনো স্নেহ-ভালোবাসার টুকরোটাও নেই; আমাকে ঠিক করা বা শোধরানো নিয়ে সামান্য মাথাব্যথাও নেই তার, তবে এটাও ঠিক যে আমার যেসব জিনিসে তার আপত্তি সেগুলোর কারণে আমার জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে এমনও নয়। কিন্তু আমার সামনে এগিয়ে যাওয়া নিয়েও সে থোড়াই কেয়ার করে, তার কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ তার নিজের স্বার্থ, সেটা হচ্ছে: আমি তাকে যে যন্ত্রণাটুকু দিই, তার শোধ নেওয়া, আর ভবিষ্যতে আরো যেসব যন্ত্রণা তাকে দিতে পারি বলে তার ভয়, সেগুলো ঠেকানো। আমি একবার তাকে দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম যে কী করলে সে তার এই বিরামহীন বিরক্তি থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে রেহাই পেতে পারে, কিন্তু তাতে করে সে এমনই রাগে ফেটে পড়েছিল যে আমি কখনোই ওই চেষ্টা দ্বিতীয়বার আর করব না।
আপনি বলতে পারেন, পুরো ব্যাপারটার জন্য আমিও কোনো-না-কোনোভাবে দায়ী, কারণ এই ছোটখাটো মহিলা আমার যতই অপরিচিত হোক –আর যতই এটা সত্যি হোক না কেন যে আমাদের মধ্যে একমাত্র সম্পর্কই হচ্ছে আমার তাকে বিরক্ত করাটুকু, কিংবা আমাকে সে যেটুকু বিরক্তি করতে দেয় সেটুকু –তার ওপরে ওই বিরক্তির স্পষ্ট শারীরিক প্রভাব পড়ছে; সেটা তো আমি পুরো অবজ্ঞা করতে পারি না। থেকে থেকেই আমি অন্যের কাছ থেকে শুনতে পাই, ইদানীং আরো বেশি বেশি করে শুনি, যে সে আবার কীভাবে রাতে ঘুম ভালো না হওয়ার কারণে মলিন চেহারা নিয়ে, মাথা-ফেটে-যাচ্ছে এমন ব্যথা নিয়ে, আর কাজ করার জন্য প্রায় পুরোপুরি অসমর্থ অবস্থায় কীভাবে সকালে কাজে আসে; তার অবস্থা দেখে তার আত্মীয়স্বজন অনেক উদ্বিগ্ন, তারা এর কারণ খুঁজে বেড়ান, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর তারা খুঁজে পাননি। কেবল আমিই জানি কারণটা কী: তার সেই একই পুরোনো আর সব সময় নতুন-করে-শুরু-হওয়া বিরক্তি, আমাকে নিয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার আত্মীয়স্বজনের মতো করে তাকে নিয়ে আমার উদ্বেগ হবে না; সে বেশ সবল ও শক্ত; ওই রকম প্রবল বিরক্ত হওয়ার ক্ষমতা যে রাখে তার তো সেটার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়; আমার এমনকি সন্দেহ হয় যে –অন্তত একটু হলেও– সে কষ্টে থাকার ভান করে যাতে করে মানুষের আমাকে নিয়ে সন্দেহ হয়। তাকে আমি কীভাবে জ্বালাতন করি সেটা সবার সামনে খোলাখুলি বলতে তার অহংকারে লাগে; আমার কারণে তার অন্য লোকের সাহায্য চাইতে হবে –ব্যাপারটা তার কাছে নিজের মর্যাদাহানির সমান; তাকে হরদম তাড়িত করে আমার জন্য এক ঘৃণার বোধ, নিরন্তর ঘৃণার বোধ; এরকম ঘৃণা-বিদ্বেষের বিষয়টা লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করবে ভাবতেও সে অনেক লজ্জা পায়। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে সে একদম চুপ করে থাকবে তা-ও সে মেনে নিতে পারে না, মেনে না নেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত নিজের মধ্যে চাপ বোধ করে। সুতরাং তার মেয়েমানুষি ধূর্ততা নিয়ে সে বেছে নিয়েছে একটা মধ্যপন্থা: জনতার আদালতে বিষয়টা সে নীরবে, তার গোপন দুঃখের সামান্য একটু বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে, তুলে ধরার চেষ্টা করছে। বোধ হয় সে এটাও আশা করছে যে লোকজন আমার ব্যাপারে একবার একটু পরিষ্কার ধারণা পেয়ে গেলে, আমাকে নিয়ে সবার মধ্যে একটা ক্ষোভ জাগবে, সেই ক্ষোভের বিশাল শক্তি আছে আমাকে চিরদিনের জন্য দোষী করার, অন্যদিকে তার ব্যক্তিগত একক ক্ষোভ সে তুলনায় দুর্বল এবং তা কোনো দিনও আমাকে ওরকম শক্তভাবে ও চটজলদি দোষী বানাতে পারবে না; তখন সে স্বস্তির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অবসর নেবে পর্দার আড়ালে, আমাকে পিঠ দেখাবে। হু, সে যদি আশা করে যে সত্যিই ও রকম কিছু হবে, তাহলে বলব, বোকার স্বর্গে বাস করছে। সে। লোকজনের বয়েই গেছে তার ভূমিকায় মঞ্চে নামতে; লোকজন যদি আমাকে কঠিন কোনো নিক্তিতেও তোলে, তবু আমার মধ্যে কোনো দিন ওই অজস্র ত্রুটি খুঁজে পাবে না। সে যেমন ভাবে, আমি তেমন কোনো মহা ফালতু লোক নই; বড়াই করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, বিশেষ করে এ বিষয় নিয়ে তো নয়ই; কিন্তু তবু বলব, আমি যদি কোনো ব্যতিক্রমী ধরনের সুনাগরিক না-ও হই, তার একদম উল্টোটাও আমি নিশ্চিত নই; শুধু তারই মনে হয় যে আমি সে রকম, শুধু তার ঐ দুচোখ, ওদের ওই প্রায় বিবর্ণ দীপ্তি, শুধু ওদেরই মনে হয় যে আমি সে রকম; অন্য কাউকে সে এ ব্যাপারে কোনো দিনই রাজি করাতে পারবে না। তো, তাহলে আমি কি নিশ্চিন্ত যে খারাপ কিছু ঘটবে না? না, আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না; কারণ সত্যিই যদি এটা জানাজানি হয়ে যায় যে আমি আমার আচরণের মাধ্যমে তাকে বাস্তবিকই অসুস্থ বানিয়ে তুলছি– আর কিছু গুজব ছড়ানো মানুষ তো থাকেই, একদম হাল-না-ছাড়া কিছু নিরীক্ষক যারা তার কথা প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছে কিংবা অন্তত সে রকমই ভাব দেখাচ্ছে– যদি তারপর সারা দুনিয়া একসঙ্গে হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করে: আমার শোধরানোর অযোগ্য খাসলত দিয়ে আমি কেন এরকম একটা নিরীহ ছোট মহিলাকে জ্বালাতন করছি, আমি কি আসলে তাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছি নাকি, আর কবে আমার একটু দয়ামায়া হবে, সামান্য বোধ হবে যে এবার ক্ষান্ত দিই –যদি পৃথিবী আমাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বসে, তার উত্তর দেওয়া তো কঠিন হবে। তখন কি আমি এটাই বলব যে আমি ওর ওসব অসুখের ন্যাকামিতে খুব একটা বিশ্বাস করি না, তা বললে কি আমার সম্বন্ধে মানুষের সেই বাজে ধারণাই হবে না যে আমি অন্যকে দোষ দিয়ে আসলে নিজের দোষ এড়াতে চাচ্ছি, আর কাজটা করছি সবচেয়ে অভদ্রলোকের মতো করে? আমি কি, ধরা যাক, সবার সামনে খোলাখুলি বলতে পারি যে, সে যদি সত্যিকারের অসুস্থ হয়েও থাকে, মানলাম, কিন্তু তবু তার জন্য আমার আসলে কোনো মায়া হচ্ছে না, কারণ এই মহিলা আমার একদমই অপরিচিত, আর আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক পুরোপুরি তারই বানানো, কেবল তার দৃষ্টিকোণ থেকেই এর অস্তিত্ব আছে, তা ছাড়া নেই? আমি বলছি না মানুষ আমাকে বিশ্বাস করবে না; এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি যে তারা বিশ্বাসও করবে না, অবিশ্বাসও করবে না; তারা ওরকম জায়গায় আসবেই না যেখানে এসব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠতে পারে; তারা স্রেফ আমি একজন দুর্বল, রোগা মহিলাকে নিয়ে কী উত্তর দিলাম সেটা শুনবে, আর তা কোনোভাবেই আমার জন্য ভালো হবে না। কারণ এখানে, এরকম একটা ঘটনায়, আমি যে-উত্তরই দিই না কেন, আমার ওই ঝামেলা থাকছেই যে পৃথিবী সন্দেহ করবে নিশ্চিত আমাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার আছে, যদিও এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে আমাদের দুজনের মধ্যে ও রকম কোনো ব্যাপার নেই, আর যদি থেকেও থাকত, সেটা খুব সম্ভব তার দিক থেকে যতটা না তার চেয়ে বেশি থাকত আমার দিক থেকেই, যেহেতু সত্যি যে আমি এই ছোটখাটো মহিলার বিচারবুদ্ধির তীক্ষ্ণতা ও তার নিজের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করার অক্লান্ত শ্রমের প্রশংসাই করি, কিন্তু হায়, ঠিক তার এই গুণগুলো কিনা হরহামেশা আমার বিরুদ্ধেই সে ব্যবহার করে চলেছে অস্ত্র হিসেবে। তার মধ্যে আমার প্রতি বন্ধুত্বের সামান্য নিশানাও নেই; সে এ ব্যাপারে একদম সাফ-সাফ এবং আন্তরিক; এখানেই আমার শেষ আশা; আমার বিরুদ্ধে যে প্রচারাভিযান সে চালাচ্ছে, আমাদের মধ্যে প্রেমপ্রীতি-বিষয়ক গুজব উঠলে তাতে তার আরো হয়তো সাহায্য হবে, কিন্তু তবু তার মাথা এত বিগড়ে যায়নি যে ওই গুজবে ইন্ধন দেবে সে। কিন্তু আমজনতা এসব একদমই বুঝবে না, তারা যা ধারণা করেছে তাতেই স্থির থাকবে আর তাদের রায় নিশ্চিত আমার বিপক্ষেই যাবে।
সুতরাং আমার হাতে এখন একটা উপায়ই আছে– সময় থাকতেই নিজেকে বদলানো, বাইরের পৃথিবী নাক গলানোর আগেই অন্তত এটুকু নিজেকে বদলে ফেলা যাতে করে এই ছোট মহিলার আমার প্রতি ঘৃণার পুরোপুরি অবসান না ঘটলেও– সেটা অচিন্তনীয় ব্যাপার– তা মাত্রায় যেন কিছুটা হলেও কমে আসে। আর আসলেই আমি অনেকবার বিভিন্ন সময়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছি– আমার বর্তমান অবস্থা নিয়ে সত্যিই আমি কি এত খুশি যে নিজেকে বদলানোর আমার কোনো ইচ্ছা নেই, সত্যিই কি আমার অন্তত কিছু কিছু বিষয় বদলানো যায় না (ধরলাম যে সেগুলো বদলাবার প্রয়োজন নিয়ে আমার নিজের ভেতরই কোনো প্রত্যয় নেই) স্রেফ ঐ মহিলাকে শান্ত করবার স্বার্থে? কথা হচ্ছে আমি ঐকান্তিকভাবেই সে চেষ্টা করেছি, যত্ন দিয়ে এবং কষ্ট করে সে চেষ্টা করেছি; আমার ভালোই লেগেছে ব্যাপারটা, এমনকি মজাও পেয়েছি; তাতে করে কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, সবাই পরিষ্কার দেখবে এমন কিছু পরিবর্তন, ঐ মহিলাকে আমার কষ্ট করে সেগুলো দেখাতে হয়নি, ও ধরনের যেকোনো কিছু আমার অনেক আগে তার নিজেরই চোখে পড়ে, আমার আচরণে এর কোনো ছায়া পড়লেই সে তা ধরে ফেলতে পারে; কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ হলো না এসব করে। হবেই বা কী করে? আমার প্রতি তার অসন্তুষ্টি একেবারেই মূলগত, সেটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি এখন; কোনোকিছুই তার অবলুপ্তি ঘটাতে পারবে না, এমনকি আমার নিজের বিলুপ্তি হয়ে গেলেও না; ধরুন, সে শুনল আমি আত্মহত্যা করেছি, তাতে সে যে কী রকম সীমাহীন ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ হয়ে যাবে তা আমি আন্দাজ করতে পারি। আমি ভাবতে পারি না তার মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধির কোনো মানুষ ব্যাপারটা পরিষ্কার দেখতে পারছে না যেভাবে আমি পারছি, মানে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, তার চেষ্টাগুলো যে কত অর্থহীন তা কি সে দেখে না? সেই সঙ্গে আমার নিজের নিষ্পপতা, সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার চাহিদা মেটাতে আমার অক্ষমতা– এসব কি সে দেখে না? অবশ্যই সে দেখে, কিন্তু তার স্বভাব যেহেতু লড়াই করা, তাই যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে সে এটা ভুলে যায়, অন্যদিকে আমার নিজের অসুখী স্বভাব– আমার ওটা নিয়ে করার কিছুই নেই, আমি জন্মেছিই ওই স্বভাব নিয়ে– হচ্ছে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ক্রোধের চিৎকার করছে এমন কারো কানে খুব বেশি হলে মৃদু দু-একটা সাবধানের কথা ফিসফিস করে বলা। নিঃসন্দেহে, এভাবে আমাদের দুজনের মধ্যে কখনোই বোঝাপড়া হবে না। আমি আমার বাসা থেকে, ধরুন যে, ভোরবেলার দারুণ আনন্দের মধ্যে বাইরে পা দিতেই থাকব, আর আমার দেখা হতেই থাকবে ঐ অসন্তুষ্ট চেহারার মানুষটার সঙ্গে, আমার কারণেই সে অসন্তুষ্ট, আর সেই গোমড়া মুখের কোঁচকানো ঠোঁট, সেই সন্ধানী দৃষ্টি যা আগে থেকেই জানে যে কী দেখতে পাবে, আমার ওপর দিয়ে সোজা চলে যাবে ঐ দৃষ্টি, যতই ঝটতি দৃষ্টি হোক কিছুই তার চোখ এড়াবে, সেই বাচ্চা মেয়ের মতো গালে দাগ কেটে বসে যাওয়া ত্যক্তবিরক্ত একটু হাসি, সেই আকাশের দিকে শোকার্তভাবে তাকিয়ে থাকা, সেই কোমরের ওখানে শক্তভাবে হাত রেখে শরীর সোজা করা আর তারপর সেই ফ্যাকাশে মুখে কাঁপতে কাঁপতে রোষে ফেটে পড়া।
কিছুদিন আগে এই প্রথমবারের মতো– আমি আসলে অবাকই হলাম যে এত দিনে এই প্রথমবার –আমি আমাদের ব্যাপারটা আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে একটু ইঙ্গিতে জানালাম, স্রেফ কথার কথা হিসেবে আর কি, স্রেফ হঠাৎ করে দু-একটা কথা বলে ফেললাম এমনভাবে –চেষ্টা করলাম পুরো বিষয়টার গুরুত্ব বাস্তবে যতটুকু তার চেয়ে অল্প একটু কমিয়ে দেখানোর, অবশ্য বাইরের মানুষের হিসেবে দেখলে এটার গুরুত্ব তো এমনিতেও আসলে খুব বেশি না। অদ্ভুত ঘটনা যে, তার পরেও আমার বন্ধু ঠিকই ধরতে পারল; শুধু তা-ই না, আমার চোখে ধরা পড়েনি এমন কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় সে সামনে তুলে ধরল, কথা ঘুরিয়ে তার মন আমি অন্যদিকে নিতে ব্যর্থ হলাম, সে এই বিষয় নিয়েই কথা চালিয়ে যাওয়ার জেদ ধরে থাকল। আরো অদ্ভুত যে, ওদিকে পুরো বিষয়টার একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক কিনা সে ছোট করে দেখল, আন্তরিকভাবে আমাকে উপদেশ দিয়ে বসল যে কিছুদিনের জন্য আমি যেন দূরে কোথাও চলে যাই। এত বোকার মতো আর কোনো উপদেশ হতে পারে না; ব্যাপারটা খুব সহজ-সাধারণ, যে-কেউ একটু ভালো করে দেখলেই বুঝবে যে কত সহজ, কিন্তু তাই বলে এত সহজ না যে আমি দূরে চলে যাব আর এর সবকিছুর –কিংবা এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোর –সমাধান হয়ে যাবে। বরং উল্টোটাই, দূরে চলে যাওয়াই হবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় ভুল; আমাকে যদি কোনো পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হয় তা বরং এ রকম: ব্যাপারটা এখনকার সীমাবদ্ধ পরিসরেই রাখতে হবে, এখন যেমন বাইরের পৃথিবী এতে এখনো ঢুকে যায়নি, সেভাবেই রাখতে হবে; অন্য কথায় আমি যেখানে আছি সেখানেই থাকতে হবে চুপচাপ, দেখতে হবে এটা যেন কোনো বড় মাপের, চোখে-পড়ার-মতো-আকার না নিয়ে নেয়; তার মানে হচ্ছে আমাকে অন্য আরো কিছু বিষয়ের সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে আমি যেন এটা নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলি; এই সবকিছুই দরকারি এজন্য না যে এটা কোনো বিপজ্জনক গোপন বিষয়, বরং এজন্য যে এটা একটা গৌণ, পুরোদস্তুর ব্যক্তিগত বিষয়, সবকিছুর পরেও এটা হালকা একটা বোঝা, আর এটা তেমনই রাখা সংগত। এদিক দিয়ে দেখলে আমার বন্ধুর উপদেশ আমার জন্য মূল্যহীন নয়; আমি তার উপদেশ থেকে নতুন কিছু হয়তো শিখিনি, কিন্তু ওগুলো আমার মৌলিক ভাবনাচিন্তাকে অন্তত কিছুটা আরো শক্তিশালী রূপ দিয়েছে।
আরো ভালো করে ভাবলে দেখা যায় আসলে পরিস্থিতির এই ইদানীংকালের পরিবর্তনগুলো মোটেই সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন নয়, সাধারণ অর্থে এটাই সত্যি; বরং যা ঘটেছে তা হলো এই পরিবর্তনগুলো আমি উপলব্ধি করা শুরু করেছি, ওগুলোর প্রতি আমার আচরণে বিবর্তন ঘটেছে– একদিকে আমি হয়ে উঠেছি আরো শান্ত, আরো পুরুষোচিত, ঘটনার মূল বিন্দুর আরো কাছাকাছি পৌঁছানো এক মানুষ; অন্য দিকে –আমাকে মানতেই হচ্ছে– আবেগের নিয়মিত ওঠানামার প্রভাবে, যতই তুচ্ছ আবেগ হোক না কেন, আমি কী ধরনের যেন একরকম নার্ভাস বোধ করছি, ওটা থেকে বেরোতে পারছি না।
পুরো বিষয়টা নিয়ে আমি আরো শান্ত হয়ে উঠছি এ-অর্থে যে আমার বিশ্বাস জন্মেছে, কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, কখনো-সখনো তা যতই আসন্ন মনে হোক না কেন, আসতে সম্ভবত এখনো অনেক দেরি; সাধারণত বয়স যখন কম থাকে দেখা যায় সবাই ভাবে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কোনো কঠিন ব্যাপার না; যখনই আমার এই ছোটখাটো বিচারক আমাকে দেখে নিস্তেজ হয়ে তার চেয়ারের এক পাশে ঢলে-নুয়ে পড়ত, এক হাতে চেয়ারের পেছন ধরে আর অন্য হাতে অস্থিরভাবে তার কাপড় হাতড়াতে-হাতড়াতে, দেখা যেত তার গাল বেয়ে পড়ছে ক্রোধ ও হতাশার অশ্রু, আমি সব সময় তখন ভাবতাম সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহূর্তটা এসে গেছে, শিগগিরই আমাকে জবাবদিহি করতে বলা হবে। কিন্তু দেখা গেল কিছুই না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ব্যাপার নেই, জবাবদিহি করার কোনো ডাক এল না।– মেয়েরা বহু কিছুতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে প্রায় প্রায়, পৃথিবীর সময় নেই ওদের ওই প্রতিটা ব্যাপারের বিচার করতে বসার । তো, তাহলে, এই এতগুলো বছরে আসলে সত্যিকার অর্থে ঘটলটা কী? এটুকুই যে ওরকম ঘটনা বারবার ঘটল, মাত্রায় হয়তো কোনো বার বেশি, কোনো বার কম, কিন্তু সবটা মিলে মোদ্দা কথা যোগফল এখন আগের চেয়ে বড়। আর এটাও ঘটল যে, লোকজন ইতিউতি দিতে লাগল আশপাশে, পথ পেলেই নাক গলাবে সেই আশায়, কিন্তু কোনো পথ তারা পেল না; এখন পর্যন্ত তারা ভরসা করেছে স্রেফ তাদের নাকের ওপর, যেন গন্ধ শুঁকে বের করবে কী চলছে আমাদের দুজনের মধ্যে, তবে ওসব শোকাকির যাদের স্বভাব তারা হয়তো মহা ব্যস্ত থাকে, তবে তাতে কোনো দিন কোনো কাজের কাজ হয় না। কিন্তু সব সময়ে মূলত এমনটাই হয়ে এসেছে; সব। সময়েই এই ফালতু টো-টো কোম্পানির দল আশপাশে ঘুরেছে, বাতাসে গন্ধ শুঁকেছে জোরে জোরে, চালাকের মতো –আত্মীয়তার অজুহাত দিয়ে –জায়েজ করেছে তাদের আশপাশে থাকা; সব সময় সতর্ক পাহারা দিয়ে রেখেছে তারা, সব সময় শুঁকতে শুঁকতে নাক ভরিয়ে রেখেছে কোনো-না-কোনো গন্ধে, কিন্তু কী লাভ? এতকিছু করে তাদের এটুকুই লাভ যে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে তারা, এখনো । আগের থেকে একমাত্র পার্থক্য, আমি ধীরে ধীরে এদের সবাইকে চিনতে শিখেছি, একজনের থেকে আরেকজনের চেহারা আলাদা করা শিখেছি; একসময় আমি বিশ্বাস করতাম এরা ধাপে ধাপে জড়ো হচ্ছে সব জায়গা থেকে, তার ফলে আমাদের ব্যাপারটা যত দিন যাচ্ছে তাতে আরো বড় আকার নিয়ে নিচ্ছে এবং শুধু এ কারণেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময়টা আসতে আর বোধ হয় বাকি নেই; আজ আমার বিশ্বাস, সবকিছু সেই গোড়া থেকে এরকমই ছিল, সব সময়; এর সঙ্গে সিদ্ধান্তে আসার যোগ অতি সামান্য কিংবা একেবারেই নেই। আর সিদ্ধান্তের বিষয়টা– আমিই বা ওটাকে এরকম ওজনদার নাম দিচ্ছি কেন? সিদ্ধান্ত! যদি অমনটা আসলেই কোনো দিন ঘটে– নিশ্চিত যে কাল ঘটবে না, কিংবা পরশুও না, সম্ভবত কোনো দিনও না – যদি লোকজন আমাদের এই বিষয়টা নিয়ে সত্যি ব্যস্ত হয়ে পড়ে (তাদের যে এ বিষয়ের বিচার করার কোনো যোগ্যতাই নেই, সে কথা আমি বারবার, বারবার বলব) সেই বিচার-আচারে আমার নিশ্চিত সামান্য কিছু ক্ষতি তো হবেই, কিন্তু তা হলেও কোনো সন্দেহ নেই লোকজন এটাও বিবেচনায় নেবে যে আমি একেবারে ভেসে আসিনি, আমাকে মানুষজন চেনে, সব সময় সবার চোখের সামনেই জীবন কাটিয়েছি আমি, মানুষকে বিশ্বাস করেছি আর মানুষও এর প্রতিদানে আমাকে বিশ্বস্ত হিসেবেই নিয়েছে, অতএব ঐ ছোটখাটো দুঃখী মহিলা, এই সেদিন উদয় হওয়া ঐ মহিলা –যাকে, কথার কথা বলছি, অন্য যেকোনো লোক চিনে ফেলত ক্লান্তিহীন এক গায়ে লতিয়ে পড়া, জড়িয়ে থাকা মেয়ে হিসেবে আর জনতার কানের আড়ালে জুতোর তলায় পিষে গুঁড়িয়ে মারত বহু আগেই–
খুব বেশি হলে কী করতে পারে? খুব বেশি হলে পারে সমাজের সম্মানিত একজন ভদ্রলোক। হিসেবে বহু আগে আমি যে সনদপত্র পেয়ে গেছি তাতে শুধু একটু ছোট, কুৎসিত একটা দাগ ফেলতে, স্রেফ ওটুকুই। এখনকার অবস্থা ঠিক এরকম; অন্য কথায়, আমার আসলে চিন্তার খুব বেশি কিছু নেই।
তবে আমি যে গত কয়েক বছর ধরে সামান্য হলেও দুশ্চিন্তা করেছি, তার সঙ্গে ব্যাপারটার সত্যিকারের গুরুত্ব থাকা-না-থাকার কোনো সম্পর্ক নেই; আপনি অন্যের জন্য লাগাতার বিরক্তির কারণ– এটা আপনি কাহাতক সহ্য করবেন? যদি দেখেন যে ওই লোকের বিরক্তির আসলে কোনো কারণই নেই, তবুও তো সহ্যের একটা সীমা থাকবে; একসময় একটু দুশ্চিন্তা তো আপনার হবেই; আপনি বাস করতে শুরু করবেন সব সময় সিদ্ধান্ত আসার এক অপেক্ষার মধ্যে, যদি সেটা স্রেফ শারীরিক অর্থে হয় কিংবা ওসব সিদ্ধান্ত আসার বিষয় নিয়ে খুব বেশি বিশ্বাস আপনার যদি না-ও থাকে তো তবু । অংশত, আমার বিশ্বাস, এ সবকিছুর জন্য দায়ী বয়স বাড়ার ব্যাপারটা; কম বয়স থাকতে সবকিছু মানিয়ে যায় সুন্দরমতো; তারুণ্যের অবিরাম কল্লোলিত শক্তির সামনে যে-কারোরই খারাপ দিকগুলো হারিয়ে যায়; তরুণ বয়সে কারো দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকুন, কেউ আপনার ওপর খেপে যাবে না, কেউ আসলে তা ধরতে গেলে খেয়ালই করবে না, যার কথা বলা হচ্ছে সেই তরুণ নিজেও না; কিন্তু বয়স বাড়লে, বুড়ো হলে কী হয়? পেছনে ফেলে আসা ঐ সবকিছু তখন ছিটকাপড়ের মতো অবশেষ, এর প্রতিটা টুকরোই দরকারি, কোনোটাই নতুন করে শুরু করা যাবে না, প্রতিটাই সবাই খেয়াল করছে; আর অন্যদিকে বয়স বেড়ে যাওয়া কোনো লোকের তীক্ষ্ণ চোখে তাকানো নিয়ে কোনো এটা-ওটা নেই, তা সোজা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকারই ব্যাপার, সবারই চোখে পড়বে সেটা। তবে এখানেও, আগের মতোই, সত্যি বিরাট যে কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে তা কিন্তু না।
অতএব, যেদিক থেকেই দেখি না কেন, আমার সব সময়েই মনে হয় –আর আমার এ বিশ্বাস থেকে আমি নড়ছি না– আমি যদি শুধু আমার হাত দিয়ে এই ছোট ব্যাপারটা একটু হালকা মতন ঢেকে বা লুকিয়ে রাখি, তাহলে এই মহিলা যতই দুর্বার ক্রোধে ফেটে পড়ুক না কেন, আমি এত দিন যেভাবে জীবন কাটিয়ে এসেছি সে রকমই আরো অনেক বছর, পৃথিবীর যন্ত্রণা থেকে নির্বিঘ্নে, আমার জীবন কাটিয়ে দিতে পারব।
এক অনশন-শিল্পী
অনশন-শিল্পীদের ওপরে মানুষের আগ্রহ বিগত কয়েক দশকে বেশ কমে গেছে। আগে যেখানে যে-কেউ নিজের উদ্যোগে ওরকম প্রদর্শনীর বড় মাপের আয়োজন করলে অনেক টাকা কামাতে পারত, আজ তা অনেকটাই অসম্ভব । দিনকাল বদলে গেছে। তখনকার দিনে অনশন-শিল্পীকে নিয়ে সারা শহর কীরকম মেতে থাকত; তার না-খেয়ে থাকার দিন যত পার হতো, মানুষের উদ্দীপনা আরো বাড়ত; সবাই রোজ অন্তত একবার করে হলেও চাইত অনশন-শিল্পীকে দেখতে যাবে; তার অনশনের শেষের দিকে শিক-দেওয়া ছোট খাঁচাটার সামনে বিশেষ সংরক্ষিত আসনগুলোয় লোকজন বসে থাকত সারা দিন ধরে; এমনকি রাতের বেলায়ও শো চলত, টর্চের আলো জ্বালিয়ে শো’র চটক বাড়িয়ে তোলা হতো; যেদিন আবহাওয়া ভালো থাকত, খাঁচাটা বাইরে বয়ে আনা হতো, ওভাবে বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য অনশন-শিল্পীকে দেখানোর ব্যবস্থা হতো; বড়দের কাছে যেখানে অনশন-শিল্পী একধরনের তামাশা-মশকরার বিষয়, তারা সেই তামাশায় অংশ নেয় কারণ অমনটাই হাল ফ্যাশনের নিয়ম, সেখানে বাচ্চারা দাঁড়িয়ে থাকত মুখ হাঁ করে, বিপদমুক্ত থাকার জন্য তারা একজন আরেকজনের হাত ধরে থাকত আর তাকে দেখত খাঁচার ভেতরে তার জন্য বিছানো খড়ের উপর বসে আছে, চেয়ারে বসতেও মহা অরুচি তার, কালো সাঁতারের পোশাক পরা একটা দুর্বল শরীর, পাজরের হাড়গুলো বেরিয়ে আছে কিম্ভুতকিমাকারভাবে, এই মাথা নড়াচ্ছে বিনয়ের সঙ্গে, এই একটা কষ্টের হাসি দিয়ে জবাব দিচ্ছে কোনো প্রশ্নের, মাঝে মাঝে শিকের ভেতর থেকে একটা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বাইরে যেন বাচ্চারা ছুঁয়ে দেখতে পারে কী লোলচর্ম হাল তার, কিন্তু তারপরই নিজেকে ফের সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিচ্ছে নিজের ভেতরে, কারোর দিকেই কোনো মনোযোগ দিচ্ছে না, এমনকি খাঁচার ভেতরে যে দেয়ালঘড়ি –তার কাছে যেটা অনেক প্রিয় একটা জিনিস আর তার খাঁচার একমাত্র আসবাব– সেটা বেজে উঠলেও তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, সে শুধু আধবোজা চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে আর তার শুকনো ঠোঁট একটু ভেজানোর জন্য একটা ছোট গ্লাস থেকে কখনো-সখনো চুমুক দিচ্ছে একটু।
তাকে দেখতে আসা ও ভেতরে ঢোকা এইসব দর্শকের পাশাপাশি আরো থাকত স্থায়ী পাহারাদারেরা, জনগণই ঠিক করত কারা পাহারাদার হবে –যথেষ্ট অবাক ব্যাপার যে সব সময় দেখা যেত এরা সবাই পেশায় কসাই– এদের কাজ ছিল প্রতি শিফটে তিনজন করে সারা দিন সারা রাত অনশন-শিল্পীর দিকে নজর রাখা, এটুকু নিশ্চিত করা যে অনশন শিল্পী কোনো গোপন যন্ত্রের সাহায্যে তার শরীরে পুষ্টি জোগাচ্ছে না। তবে এটা ছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা, জনসাধারণকে অনশন বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়ার ভাবনা থেকেই এর শুরু হয়েছিল, উদ্যোক্তারা ভালোভাবেই জানত যে অনশন-শিল্পী তার অনশনের দিনগুলোতে কখনোই কোনো অবস্থাতেই, এমনকি তাকে জবরদস্তি করা হলেও, এক টুকরো খাবারও মুখে তুলবে না; তার শিল্পের মর্যাদা তাকে অমন কিছু করতে দেবে না। তবে অবশ্য সব পাহারাদারই যে এই সত্যটা বুঝত এমন না, প্রায়ই এমন পাহারাদারের দল দেখা যেত যারা রাতের শিফটে পাহারা দিতে গিয়ে বিরাট উদাসীন আচরণ করত, ইচ্ছে করে এক কোনায় জড়ো হয়ে মগ্ন থাকত তাস খেলায়, তাদের পরিষ্কার উদ্দেশ্য অনশন-শিল্পী এই ফাঁকে কিছু খেয়ে নিক, তারা ভাবত গোপন কোনো ভান্ডার থেকে খাদ্য আহরণ করার কোনো একটা উপায় অনশন-শিল্পী জানে। এ ধরনের পাহারাদারেরাই ছিল অনশন-শিল্পীর জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণার বিষয়; ওরা তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলত; তার অনশনকে বীভৎস রকমের কঠিন বানিয়ে ছাড়ত; তাদের সন্দেহ যে কত ভুল তা দেখার জন্য মাঝে মাঝে সে শরীরের যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে তা জড়ো করে তাদের পাহারার সময় গান ধরত, যতক্ষণ শক্তিতে কুলায়– গেয়ে চলত। কিন্তু তাতে খুব কোনো কাজ হতো না; বরং ওরা এতে আরো অবাক হতো যে গান গাইতে গাইতে খাওয়ার ক্ষমতাও এই লোকের আছে। এদের চেয়ে অনেক বেশি সে পছন্দ করত সেই সব পাহারাদারদের যারা শিকের কাছ ঘেঁষে বসে থাকত, অডিটোরিয়ামের ক্ষীণ রাত্রিবেলার আলোতে সন্তুষ্ট হতে পারত না, তাই তার ওপরে ফেলে রাখত তাদেরকে ম্যানেজার সাহেবের দেওয়া বৈদ্যুতিক টর্চের আলো। ঐ চোখ-ধাঁধানো আলোতে তার একটুও অসুবিধা হতো না, ঘুম তো তার এমনিতেই হতো না, আর যতই আলো থাকুক, ঘড়িতে যে-কটাই বাজুক, সব সময়েই চট করে একটু তন্দ্রার মধ্যে চলে যাওয়া তার জন্য সম্ভব ছিল যেকোনো সময়, এমনকি যখন অডিটোরিয়াম গিজগিজ করত হই-হট্টগোল করা দর্শকে, তখনো। ঐসব পাহারাদারের সঙ্গে সারা রাত একটুও না-ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে খুবই রাজি থাকত সে; ওদের সঙ্গে তামাশা-কৌতুক করতেও রাজি থাকত; চাইত ওদের শোনাবে তার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ানো এই জীবনের গল্প আর ওদের থেকে শুনবে ওদেরটাও, অর্থাৎ যেকোনো কিছুতেই রাজি সে, উদ্দেশ্য স্রেফ ওদের জাগিয়ে রাখা যেন সে বারবার দেখাতে পারে যে তার খাঁচার মধ্যে কোনো খাদ্য নেই আর সে এমনভাবেই অনশন করছে যেটা করার ক্ষমতা ওদের কারো নেই। তবে সে সবচেয়ে খুশি হতো যখন সকালে তার নিজের খরচে ওদের সবার জন্য আসত বিরাট নাশতা; ক্লান্তিকর রাতভর পাহারার পরে কোনো সুস্থ মানুষের যে খিদে লাগে, সেরকম খিদে নিয়ে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ত নাশতার ওপর। তবে এমন লোকও আছে যারা ভাবত, এভাবে পাহারাদারদের নাশতা খাওয়ানোর পেছনে হীন উদ্দেশ্য আছে, অনশন-শিল্পী ওদের দলে টানতে চাইছে, কিন্তু এরকম সন্দেহকে বাড়াবাড়িই বলতে হবে, তাদের যদি তখন উল্টো জিজ্ঞাসা করা হতো সকালের নাশতা ছাড়া তারা রাতের পাহারা দিতে রাজি কি না, অর্থাৎ পাহারা শুধু পাহারা দেওয়ারই। স্বার্থে, সে বেলায় কিন্তু সব দৌড়ে পালাত, তবে সন্দেহ করা কিন্তু তার পরও ছাড়ত না।
অনশন-শিল্প নিয়ে মানুষের অসংখ্য সন্দেহের মাত্র একটা উদাহরণ এটা। কথা হচ্ছে, এমন কেউ নেই, যার পক্ষে সম্ভব অনশন-শিল্পীকে সারা দিন, সারা রাত ধরে দিনের পর দিন লাগাতার পাহারা দিয়ে যাওয়া, তাই কেউই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারবে না তার অনশন সত্যিকারের একটানা ও ত্রুটিহীন অনশন ছিল কি না; সেটা শুধু অনশন শিল্পীই জানে; অতএব তার নিজের অনশনের সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত দর্শক হওয়া একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু সে নিজেও, অন্য এক কারণে, কখনোই নিজের ওপর তৃপ্ত হতো না; তাকে যে দেখতে এরকম কঙ্কালের মতো রোগা লাগত– ওই দৃশ্য সহ্য করতে না-পারার কারণে অনেকেই আফসোসের সঙ্গে তার শো দেখতে যাওয়া পর্যন্ত বাদ দিয়ে দিত– তা সম্ভবত তার অনশন চালিয়ে যাওয়ার কারণে মোটেও না, সম্ভবত তাকে ওরকম কঙ্কাল বানানোর পেছনে স্রেফ তার নিজের ওপর অতৃপ্তিই দায়ী। কারণ একমাত্র সে-ই জানত, যা কিনা অনশন-শিল্পের বোদ্ধা কেউও জানত না, যে অনশন করা কত সহজ। পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ এটা। এ কথা গোপন করত না সে, কিন্তু মানুষ তার কথা বিশ্বাস করত না, খুব বেশি হলে তারা ভাবত এটা তার বিনয়, বেশিরভাগ লোকই ভাবত এটা তার প্রচারসর্বস্ব মানসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়, কিংবা কেউ কেউ এমনও ভাবত যে সে একটা বাটপার, তার জন্য তো অনশন করা সহজ হবেই, কারণ সে তো জানে কাজটা কী করে সহজ করতে হয়, আর দ্যাখো কী ঔদ্ধত্য তার যে কথাটা সে এভাবে অর্ধেক স্বীকারও করছে। এই সবকিছু সহ্য করে যেতে হতো তাকে, সত্যি বলতে, যত বছর পার হতে লাগল, এগুলো গা-সওয়া হয়ে গেল তার কাছে, যদিও ভেতরে ভেতরে তার এই অসন্তোষ তাকে খুঁচিয়ে মারত, তাই মনে হয় কোনো দিন, একবারের জন্যও কোনো অনশন পর্বের শেষে– এটুকু তাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে — সে নিজের থেকে খাঁচা ছেড়ে যেতে চায়নি। তার ম্যানেজার তাকে সর্বোচ্চ চল্লিশ দিন অনশন করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল, এর থেকে বেশি দিন অনশন চালানোর অনুমতি তার কখনোই মিলত না, এমনকি বড় নামকরা শহরগুলোতে গেলেও না, এর পেছনে অবশ্য যুক্তিসংগত একটা কারণও ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, যেকোনো শহরেই অনশন-প্রদর্শনীর ওপরে মানুষের আগ্রহ, প্রচার-প্রচারণা আস্তে আস্তে বাড়িয়ে, মোটামুটি দিন-চল্লিশেক পর্যন্ত জারি রাখা যায়, কিন্তু তারপর দর্শকসংখ্যা কমতে শুরু করে, দর্শক উপস্থিতি দেখা যায় ধুপ করে পড়ে যায়; স্বাভাবিক যে শহর ও অঞ্চলভেদে এই হিসাবের অল্পস্বল্প তারতম্য হতো, কিন্তু মোটের ওপর ওটাই নিয়ম ছিল যে চল্লিশ দিনই সর্বোচ্চ সীমা। অতএব তাই, চল্লিশতম দিনে, খোলা হতো ফুলে ফুলে ভরে থাকা খাঁচার দরজা, উৎসাহী দর্শকের ভিড়ে ভরে যেত প্রদর্শনীর পুরো এলাকা, সামরিক বাদ্যযন্ত্রীদের দল বাজনা বাজাত, দুজন ডাক্তার খাঁচার ভেতরে ঢুকত অনশন-শিল্পীর শরীরের প্রয়োজনীয় মাপজোক নিতে, মেগাফোনের সাহায্যে উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে ঘোষণা করা হতো ফলাফল, আর সবশেষে দুই তরুণী সামনে এগিয়ে আসত, ওরা খুশিতে আটখানা যে ওদের ওপর এই দায়িত্ব পড়েছে, ওদের কাজ অনশন-শিল্পীকে খাঁচা থেকে বার করে আনা, তারপর কয়েক কদম হেঁটে তাকে একটা ছোট টেবিলের কাছে নিয়ে যাওয়া –ওটাতে যত্ন করে সাজিয়ে রাখা থাকত অনেক দিন না-খাওয়া কোনো মানুষের জন্য উপযোগী কিছু খাবার। এই মুহূর্তটা এলেই অনশন-শিল্পী সব সময় বাধা দিয়ে বসত। এই দুই তরুণীর তার গায়ের উপর ব্যাকুল হয়ে ঝুঁকে পড়ে বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মধ্যে নিজের হাড় জিরজিরে হাত দুটো সঁপে দিতে অনশন-শিল্পীর কোনো আপত্তি না থাকতে পারে, কিন্তু উঠে দাঁড়াতে তার থাকত ঘোর আপত্তি। কেন, চল্লিশ দিন পর কেন সে তার অনশনে ক্ষান্ত দেবে? সে তো আরো অনেক দিন অনশন চালিয়ে যেতে সক্ষম ছিল, সীমাহীন আরো অনেক কাল চালাতে পারত সে এভাবেই; তাহলে কেন হঠাৎ এখনই থামতে হবে তাকে, যখন কিনা সে তার অনশনের সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে, সত্যিকার অর্থে যখন কিনা তার অনশনের সেরা বিন্দুতে পৌঁছানোর এখনো বাকি? কেন তারা তার কাছ থেকে তার অনন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার গৌরব কেড়ে নিতে চায়– শুধু যে সর্বকালের সেরা অনশন-শিল্পী হওয়ার গৌরব তা-ই নয় (সম্ভবত এরই মধ্যে সে ওটা হয়ে গেছে), সেই সঙ্গে তার নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, চিন্তার অগম্য এক জিনিস অর্জন করার গৌরবটুকুও? তার এরকম ভাবার কারণ সে বিশ্বাস করে তার অনশন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সীমাহীন। কেন ভিড়ের এই জনতা, যারা দাবি করে অনশন-শিল্পীকে এত ভালোবাসার, কেন তারা তার ব্যাপারে এত অধৈর্য হবে; সে যদি নিজে আরো বেশি দিন অনশন মেনে নিতে পারে, তাদের তাতে সমস্যা কিসের? আর তা ছাড়া সে তো ক্লান্ত, ভালোই তো আরাম করে সে বসে ছিল খড়ের উপর, সেই তাকে কিনা এখন উঠে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে আর এগিয়ে যেতে হবে খাবারের কাছে– খাবার, ওটা ভাবলেই তো তার গা গুলিয়ে আসে, এমন গা-গোলানো এক অনুভূতি হয় যা কিনা তাকে অনেক কষ্টে, ঐ মেয়ে দুটোর প্রতি সম্মানবশত, দমিয়ে রাখতে হয়। সে তখন তাকাত ঐ মেয়ে দুটোর চোখের দিকে, ওপরে ওপরে কত বন্ধুত্বের সেই দৃষ্টি, কিন্তু বাস্তবে আসলে কত নিষ্ঠুর; তারপর সে মাথা নেড়ে ‘না’ জানাত, তার ঐ নিস্তেজ ঘাড়ের উপরে কেমন ভার হয়ে বসে পড়ত তার মাথা। কিন্তু এরপর তা-ই ঘটত যা সব সময়ে ঘটে। ম্যানেজার সাহেব নিজে গিয়ে হাজির হতো ওখানে; নীরবে– যেহেতু ব্যান্ডের বাজনার কারণে কোনো কথা বলা যেত না– সে অনশন-শিল্পীর দেহটার উপরে নিজের দুই হাত তুলে ধরত যেন স্বর্গের দিকে কাউকে ডাকছে এইখানে এই খড়ের উপর বসে থাকা তার সৃষ্টিকর্মটি দেখতে, এই শোচনীয় শহীদ বেচারাকে দেখতে– অনশন-শিল্পী সত্যিকার অর্থে তো তা-ই, স্রেফ ভিন্ন এক অর্থে, এই যা। তারপর ম্যানেজার তাকে তার সরু কোমর বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরত, একটু বাড়াবাড়ি রকম সহৃদয়তা দেখিয়ে কাজটা করত সে যাতে করে দর্শকেরা বুঝতে পারে কত পলকা একটা জিনিস তাকে নাড়াচাড়া করতে হচ্ছে; এবার সে তাকে তুলে দিত– সবার চোখের আড়ালে দু-একটা ঝাঁকি দিয়ে তবেই, এর ফলে অনশন-শিল্পীর শরীরের উপরের অংশ ও নিচের অংশ অসহায়ের মতো। দুলত টলমলিয়ে –মরা মানুষের চেহারার মতো ফ্যাকাশে হয়ে আসা মেয়ে দুটোর হাতে। ততক্ষণে অনশন-শিল্পী নিজেকে পুরো সঁপে দিয়েছে পরিস্থিতির কাছে; তার মাথা ঢলে পড়েছে বুকের উপর; দেখে মনে হচ্ছে গড়িয়ে ওখানে গেছে যেন মাথাটা আর হঠাৎ যেন থমকে গেছে ওখানটায়; তার শরীর দেখতে লাগছে একদম কোনো কোটরের মতো; তার। পা দুটো হাঁটুর ওখানে একটার সঙ্গে অন্যটা জড়িয়ে আছে, কোনোভাবে নিজেদের বাঁচাতে চাইছে ওরা, তবে যেভাবে মাটির উপর টলটলিয়ে ঘসটে আছে ওরা, দেখে মনে হচ্ছে ওটা যেন সত্যিকারের মাটি নয়, সত্যিকারের মাটি কোথায় তা যেন খুঁজছে ওরা; তার পুরো । শরীর, নিশ্চিত ওজনে অতি সামান্য, মেয়ে দুটোর একটার উপরে হেলে আছে, মেয়েটা তখন সাহায্যের জন্য তাকাচ্ছে চারপাশে, নিশ্বাস ফেলছে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে– সে ভাবেনি তার এত সম্মানের কাজ আসলে এ জায়গায় এসে ঠেকবে– প্রথমে ঘাড়টা যত দূর পেছনে পারা যায় সরিয়ে নিচ্ছে সে, তার লক্ষ্য কোনোভাবেই যেন অনশন-শিল্পীর গালে তার গাল লেগে না যায়, কিন্তু এরপর সে দেখল যে তা অসম্ভব আর তার ভাগ্যবান সঙ্গীটি তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল না –সেই মেয়ে খুশি যে তাকে শুধু তার কাঁপা হাতে অনশন শিল্পীর একগাদা হাড়গোড়, মানে তার দুই হাত ও হাতের আঙুলগুলো, ধরে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে, এবার মেয়েটি ভেঙে পড়ল কান্নায়, দর্শকেরা তখন আমাদের হাসিতে ফেটে পড়েছে– মেয়েটার এই হাল দেখে একজন কর্মচারী এসে তার জায়গা নিল, তাকে বিকল্প হিসেবে আগে থেকেই এ কাজের জন্য পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর এল খাবার, ম্যানেজার চামচ দিয়ে সামান্য একটু তুলে দিল প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, প্রায় কোমায় চলে যাওয়া অনশন-শিল্পীর মুখে, ম্যানেজার সে সময় সমানে উৎসাহসূচক বকবকানি করে চলেছে যেন দর্শকের মনোযোগ অনশন-শিল্পীর এই চরম দুর্দশার অবস্থা থেকে অন্যদিকে ঘুরে যায়; এরপর আমজনতার সুখ-স্বাস্থ্য কামনা করে পানীয়ের প্রস্তাব রাখা হলো, বলা হয় যে অনশন-শিল্পী নিজে ম্যানেজারকে কানে কানে এ প্রস্তাব দিয়েছে; ব্যান্ডদল এবার সবকিছু ঢেকে দিল তাদের বিউগল-ট্রাম্পেটের ফেটে পড়া আওয়াজে, সবাই শুরু করল বিদায় নেওয়া, কারোরই মনে এখন আর এই শো নিয়ে কোনো অসন্তোষ নেই, কারোরই নেই– কেবল অনশন-শিল্পী ছাড়া, সব সময়ই কেবল সে ছাড়া।
এভাবেই অনশন-শিল্পী কাটিয়ে দিল অনেকগুলো বছর, বিশ্রামের জন্য নিয়মিত ছোট কিছুদিনের বিরতি দিয়ে দিয়ে, দৃশ্যত একধরনের গৌরবের মধ্যে, পৃথিবীর কাছ থেকে সম্মানিত হয়ে –কিন্তু এসব কিছুর পরেও মূলত দুঃখের মধ্যে, সেই দুঃখ তার বরং আরো বেড়েই চলল কারণ কেউ তা গুরুত্ব দিয়ে দেখল না। আর আসলেও, মানুষ তাকে। সান্ত্বনাই বা দিত কীভাবে? এর বেশি সে চায়ই বা কী? আর যদি কোনো এক দিন কোনো দয়ালু কেউ কাছে এসে তার জন্য দুঃখ প্রকাশও করত, তাকে বোঝাতে চেষ্টা করত যে সম্ভবত অনশন চালিয়ে যাওয়ার পরিণতি হিসেবেই সে এরকম দুঃখী হয়ে পড়ছে, তাহলে মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে সে যদি তখন অনশনের শেষ পর্যায়ে থাকত, এমন ঘটত যে অনশন-শিল্পী ফেটে পড়ত রাগে, সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে কোনো বুনো পশুর মতো খাঁচার শিক ধরে বাড়ি-টাড়ি মেরে একাকার করত। কিন্তু অনশন-শিল্পীর এই উন্মত্ত আচরণের জন্য ম্যানেজারের কাছে কৈফিয়ত তৈরি থাকত, সে খুব মজা পেত এই কৈফিয়তটা দিয়ে। দর্শকের ভিড়ের উদ্দেশে সে অনশন-শিল্পীর পক্ষ থেকে মাফ চাইত, বলত যে অনশন-শিল্পীর এই আচরণ না-খেয়ে থাকার কারণে মেজাজ খিটমিটে হয়ে যাওয়ার জন্যই ঘটছে, সেটা কীভাবে ঘটে তা পেটপুরে খাওয়া লোকজনের জন্য আসলেও বোঝা কঠিন; আর এ-প্রসঙ্গে সে অনশন-শিল্পীর দাবির কথাটাও সবাইকে জানিয়ে রাখছে, ওই দাবিটারও একটু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন, তার দাবি –চল্লিশ দিনের অনেক অনেক বেশি অনশন করে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব; ম্যানেজার এ পর্যায়ে তার এই বিরাট উচ্চাকাঙ্ক্ষার, তার এই প্রশংসনীয় ইচ্ছার তারিফ করত, তার এরকম চাওয়ার মধ্যে নিঃসন্দেহে আত্মবলিদানের যে বিশাল প্রকাশ লুকিয়ে আছে তাকে সাধুবাদ জানাত; কিন্তু এরপরই সে নেমে যেত অনশন-শিল্পীর এই দাবি খণ্ডন করার কাজে –সেজন্য বেশি কিছু লাগত না, দর্শককে সামান্য কিছু ফটো দেখালেই কাজ হয়ে যেত, একই সঙ্গে ফটোগুলো বিক্রির জন্য দেওয়া হতো দর্শকদের কাছে– এই ফটোগুলোতে দেখা যেত অনশন-শিল্পী তার কোনো এক অনশনের চল্লিশতম দিনে বিছানায় পড়ে আছে চরম ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে, তার অবস্থা প্রায় মরো-মরো। সত্যের এই বিকৃতি দেখাটা অনশন-শিল্পীর জন্য নতুন কিছু নয়, তার পরও প্রতিবারই এটা তার শক্তি ফের একবার শুষে নিত, সে সহ্য করতে পারত না এত বড় মিথ্যাচার । সময়ের আগেই তার অনশন শেষ করার পরিণতিকে কিনা এখানে দেখানো হচ্ছে কারণ হিসেবে! এই নির্বুদ্ধিতার বিরুদ্ধে, বিরাট-বিশাল এই মূর্খামির বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব। এর আগ পর্যন্ত সে সব সময় খাঁচার শিক জড়িয়ে ধরে থাকত, কান খাড়া করে সরল বিশ্বাসে শুনত ম্যানেজার কী বলছে, কিন্তু প্রতিবারই যেই ফটোগুলো দেখানো শুরু হতো, সে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে শিক ছেড়ে দিয়ে ধপাস করে পড়ে যেত তার খড়ের বিছানার উপর– এ সময়ে দর্শকেরা দুশ্চিন্তামুক্ত, তারা আবার খাঁচার কাছে এগিয়ে যেত তাকে খুঁটিয়ে দেখতে।
মাত্র দু-এক বছর পরেই, এসব দৃশ্যের যারা সাক্ষী, তারা যখন তাদের এই আচরণের কথা মনে করল, নিজেরাই অবাক হয়ে গেল নিজেদের ওপর। কারণ তত দিনে সেই আগের বলা পরিবর্তন ঘটে গেছে। প্রায় রাতারাতিই ঘটেছে এই পরিবর্তন; হয়তো এর পেছনে আরো গূঢ় কোনো কারণ রয়েছে, কিন্তু কে ভাবতে যাচ্ছে ওসব নিয়ে? যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, একদিন এই এত প্রীতি-প্রশ্রয় পাওয়া অনশন-শিল্পী দেখল বিনোদন সন্ধানী দর্শকেরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে, তার বদলে তারা সব দলে দলে গিয়ে হাজির হয়েছে নতুন কোনো প্রদর্শনীতে। তার ম্যানেজার, একবার, শেষবারের মতো তাকে নিয়ে ইউরোপের অর্ধেকটা চষে ফেলল –দেখতে যে পুরোনো আগ্রহের কোনো ছিটেফোঁটার দেখা কোথাও মেলে কি না; না পুরো চেষ্টা ব্যর্থ হলো, যেন গোপন কোনো সন্ধির বলে সব মানুষ অনশন-প্রদর্শনীর ওপর পুরোপুরি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সবখানে। অবশ্য রাতারাতি, এত হঠাৎ করে, এমন তো হওয়া সম্ভব নয়; পেছন দিকে তাকিয়ে মানুষের মনে পড়ল বেশ কয়েকটা পূর্বাভাস আসলে আগে ঠিকই পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু কেউ ওগুলো– তখনকার সাফল্যের তোড়ে– ঠিকভাবে খেয়াল করেনি কিংবা ওগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, আর এত দিন পরে এসে ব্যবস্থা নেওয়ার সেই সময়ও আর নেই। এটা নিশ্চিত, অনশন-শিল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ আবার একদিন, অন্য অনেক কিছুর মতো, ঠিকই ফিরে আসবে; কিন্তু এখনকার অনশন-শিল্পীদের জন্য সে কথার মধ্যে কোনো সান্ত্বনা আছে কী? অনশন-শিল্পী এখন করবেটা কী? হাজার মানুষের হাততালি পাওয়া কোনো শিল্পী তো আর গ্রামের কোনো মেলায় গিয়ে ছোট দু’পয়সার শো-তে হাজির হতে পারে না; আর যদি তার অন্য কোনো পেশা বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়, অনশন-শিল্পীর সে হিসেবে অনেক বেশি বয়স হয়ে গেছে, আর আরো বড় কথা হচ্ছে অনশনের শিল্পের প্রতি তার অনুরাগটা খুব বেশি মারাত্মক। অতএব সে বিদায় নিল তার ম্যানেজারের কাছ থেকে, তার এই অদ্বিতীয় কর্মজীবনের নিত্যসঙ্গী ছিল এই লোক; আর তারপরে যোগ দিল, বিরাট এক সার্কাসের দলে; নিজেকে খুঁচিয়ে আর আহত না-করার জন্য সে চুক্তিপত্রটা একবার তাকিয়েও দেখল না।
কোনো বড় সার্কাসের দলে যা হয়, এদের পাল পাল মানুষ, জীবজন্তু আর যন্ত্র সরঞ্জাম নিয়ে সব সময় সুন্দর ব্যবস্থা নেওয়া থাকে বাড়তি কিছু খেলা দেখানোর, তাই ওসব দলে যে কোনো সময়, যে-কারোরই –এমনকি কোনো অনশন-শিল্পীরও –জায়গা পাওয়া কোনো বড় সমস্যা না, ব্যাপার শুধু এটুকুই যে তার চাওয়া-পাওয়া হতে হবে সীমিত; আর তা ছাড়া এই অনশন-শিল্পীকে দলে টানার বেলায় তারা যে স্রেফ কোনো একজন অনশন-শিল্পীকে বেছে নিয়েছে তা তো নয়, তারা নিয়েছে অনেক দিনের বিখ্যাত এক শিল্পীকে; সত্যি বলতে, এই শিল্পে দক্ষতার জন্য যে বিশেষ ক্ষমতা থাকা লাগে, সময়ের সঙ্গে তার কমে আসার কোনো যোগ নেই, তাই এই অনশন-শিল্পীকে কেউ বলতে পারবে না সে কোনো অবসর-নেওয়া বুড়ো শিল্পী যে তার সেরা সময় পার করে এসেছে আর এখন তাই আশ্রয় চাচ্ছে ঝামেলাহীন কোনো সাকার্সের চাকরিতে; বরং উল্টো অনশন-শিল্পী দাবি করতে লাগল –তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ তো নেই– সে আগের মতোই এখনো পুরোদমে অনশন চালিয়ে যেতে পারে; এমনকি সে বলে বসল যে তাকে যদি তার মতো করে অনশন করতে দেওয়া হয়, তাহলে– কোনো দ্বিধা ছাড়াই সার্কাসের উদ্যোক্তারা রাজি হয়ে গেল তার এই প্রস্তাবে– সে আসলে প্রথমবারের মতো এই পৃথিবীতে বিরাট কোনো তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য সত্যিকারের তৈরি, যদিও তার এই দাবি, বর্তমানের সময়ের মেজাজের বিবেচনায়– যা কিনা অনশন-শিল্পী তার প্রবল উৎসাহের তোড়ে শুধু ভুলে যায়– অভিজ্ঞ লোকজনের মধ্যে সামান্য হাসি ছাড়া আর কোনো জোশ জাগাল না ।
তবে বাস্তবে কিন্তু অনশন-শিল্পী চারপাশের সত্যিকারের পরিস্থিতি কী তা ভুলে যায়নি; যেমন, সে একদম স্বাভাবিকভাবে মেনে নিল যে মঞ্চের মাঝখানে তারকা-আকর্ষণ হিসেবে আর তাকে ও তার খাঁচাকে রাখা হবে না, তাকে জায়গা দেওয়া হবে বাইরে, জীবজন্তু থাকার জায়গার কাছে, সহজে যাওয়া যায় এমন এক স্থানে। বড় বড়, রংচঙে ব্যানার টানানো হলো তার খাঁচার চারপাশ ঘিরে, ওতে লেখা ব্যানারের পেছনে কী দর্শনীয় বস্তু রয়েছে। সার্কাসের বিরতির সময়ে মানুষজন যখন দল বেঁধে ভিড় করে জীবজন্তু দেখে, তখন অনশন-শিল্পীর খাঁচা পার হয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকে না, তারা ওখানে থামে একটুখানিকের জন্য; সম্ভবত তারা আরো বেশিক্ষণ থাকত তার ওখানে, কিন্তু সরু এই গলিপথে তাদের পেছনে ধাক্কা দিতে থাকে আরো অনেক মানুষ, পেছনের ওরা বুঝে উঠতে পারে না কোন জিনিসটা তাদের এত কাক্ষিত জীবজন্তুর খামার কাছে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর ফলে কেউ যে অনশন-শিল্পীকে আর একটু সময় নিয়ে, আরাম করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে সেই উপায় নেই। এটাও একটা কারণ যে কেন অনশন শিল্পী বিরতির সময়ের কথা ভেবে কাঁপত, যদিও অন্য হিসেবে দেখলে তাকে দেখতে মানুষ আসবে এজন্যই তো সে বেঁচে আছে। প্রথমদিকে সার্কাসের বিরতি হওয়ার জন্য তার আর তর সইত না; সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখত কীভাবে স্রোতের মতো মানুষ এদিকে আসছে, কিন্তু খুব শিগগিরই তার বোধোদয় হয়ে গেল যে –এমনকি সবচেয়ে গোয়ার্তুমি করে, সুচিন্তিতভাবে নিজেকে ঠকানোর পরিকল্পনা করার মাধ্যমেও তো এই সত্য ঢাকা যাবে না– পুরো ভিড়টাই, প্রতিবারই, কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই, অন্তত তাদের যা মন চাইছে সেই বিচারে, ছুটছে আসলে জীবজন্তুর খাঁচার দিকে। দূর থেকে সে যে তাদের দেখত, সেটাই তার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগত। কারণ যেই-না তারা কাছে আসত, তার কান বধির হয়ে যেত সংখ্যায় ভারী হতে থাকা দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের চিৎকার ও গালিগালাজে: একদল চাচ্ছে –অল্পদিনের মধ্যেই অনশন-শিল্পী এই দলকেই বেশি অপছন্দ করা শুরু করল –তাকে চুপচাপ একটু দেখতে, কোনো সত্যিকার আগ্রহ থেকে না, স্রেফ তাদের খেয়ালের কারণে, স্রেফ তাদের বোকার মতো একগুঁয়েমি থেকে; আর অন্যদল চাচ্ছে সোজা, ধাক্কা মেরে, জীবজন্তুর খাঁচার ওখানে পৌঁছাতে। প্রথম ভিড়টা একবার চলে যেতেই এবার আসত বিচ্ছিন্ন, একা-একা ঘুরতে থাকা লোকজন, অনশন-শিল্পীকে থেমে যতক্ষণ খুশি দেখতে বাধা দেওয়ার তাদের কেউ নেই, কিন্তু এরা কিনা ঝটপট চলে যেত লম্বা পা ফেলে, পাশের দিকে বলতে গেলে একবার তাকাতও না; তাদের একটাই পণ– সময়মতো পৌঁছাতে হবে পশুদের খাঁচার কাছে। আর খুবই দুর্লভ সৌভাগ্য বলতে হবে যখন, কখনো সখনো, দেখা যেত বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোনো পরিবারের পিতা হাজির হয়েছে, আঙুল দিয়ে বাচ্চাদের দেখাচ্ছে অনশন-শিল্পীকে, বিস্তারিত বলছে অনশন-শিল্প কী জিনিস সে বিষয়ে, তাদের শোনাচ্ছে সেই অতীতকালের গল্প যখন সে নিজে দেখেছে একই রকম কিন্তু এখনকার চেয়ে হাজার গুণ বেশি চমৎকার অনশন-শিল্পের প্রদর্শনী, আর বাচ্চারা তখন, তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা কম এবং স্কুলে তাদের ঠিকভাবে শেখানো হয়নি বলে, তখনো বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা কী –তাদের কাছে অনশন মানে কী আসলে?– কিন্তু তার পরও তাদের কৌতূহলী চোখের উজ্জ্বলতার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠত এক নতুন ও আরেকটু দয়ালু কোনো ভবিষ্যতের ঝলকানি। কখনো কখনো অনশন-শিল্পী মনে মনে বলত, খুব সম্ভব পুরো ব্যাপারটা আরেকটু ভালো হতো যদি তার খাঁচা জীবজন্তুদের। খাঁচাগুলোর অত কাছে রাখা না হতো। এর ফলে মানুষজন কী দেখতে হবে তা খুব সহজে বাছাই করে নিতে পারছে –অন্য ব্যাপারগুলো না-হয় বাদই দেওয়া গেল: যেমন পশুর খাঁচার থেকে আসা ঐ বিকট দুর্গন্ধ, রাতের বেলায় পশুগুলোর ঐ ছটফটানি, শিকারি পশুদের জন্য তার খাঁচার সামনে দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া কাঁচা কাঁচা মাংসের পিণ্ড, খাওয়ার সময় হলে ওদের ঐ তর্জন-গর্জন; এ সবকিছুই তার মন অনেক খারাপ করে দিত, সব সময় তার মন ভার করে রাখত। কিন্তু সার্কাসের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানানোর সাহস হতো না তার; সবকিছুর পরেও ঐ পশুগুলোকে তার তো ধন্যবাদই দেওয়া উচিত, ওদের কারণেই তো এদিকে দর্শকের দল আসে, আর দলের মধ্যে সব সময় কেউ-না-কেউ তো থাকে তার শিল্পকে একটু মন দিয়ে দেখবে; তা ছাড়া সে যে এখানে আছে সেটা মনে করিয়ে দিলে কে জানে তাকে নিয়ে তারা কোথায় লুকিয়ে রেখে দেবে, তখন তো তাদের মনে পড়ে যাবে যে এই অনশন-শিল্পী, নিখুঁত বিচারে বললে, জীবজন্তুর খাঁচার কাছে যাওয়ার পথে বাধা ছাড়া আর কিছুই না।
খুব ছোট একটা বাধা, মানতেই হবে, এমন একটা বাধা যা সময়ের সঙ্গে আরো আরো ছোট হয়ে আসতে লাগল । আজকাল কেউ যদি বলে সে অনশন-শিল্পীকে দেখতে চায়, এমন কথা বলাটাও অদ্ভুত কিছু কথাটা সে হিসেবেই দেখার অভ্যাস দাঁড়িয়ে যাচ্ছে; আর সেই অভ্যাসের সঙ্গেই মোহর পড়ে গেল তার নিয়তিতে। যেমন খুশি সে অনশন করে যেতে পারে, কীভাবে করছে তা শুধু তার নিজের জানলেই চলবে –আর সে করলও তাই, কিন্তু তাতেও তার রক্ষা হলো না কোনো, মানুষজন চলে গেল তার খাঁচা পাশ কাটিয়ে। আপনি স্রেফ চেষ্টা করে দেখুন না অনশন-শিল্প কী তা কাউকে একটু ব্যাখ্যা করে বোঝানোর । কেউ যদি ব্যাপারটা ভেতর থেকে অনুভব করতে না পারে, তাহলে কি কোনো দিনই বুঝবে এটা কী জিনিস? সুন্দর ব্যানারগুলো হয়ে পড়ল নোংরা ও পড়ার অযোগ্য, ওদের ছিঁড়ে নামানো হলো, কেউ নতুন ব্যানার টানানোর কথা ভাবল না; ছোট বোর্ডের উপরে যেখানে কত দিন অনশন হয়েছে তার হিসাব লেখা থাকে, যেটা প্রথমদিকে খুব যত্ন করে বদলানো হতো প্রতিদিন, সেই বোর্ড এখন দীর্ঘদিন পড়ে থাকল একই হিসাব নিয়ে, কর্মচারীরা প্রথম কটা দিন যেতে-না-যেতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এই সামান্য কাজটুকু করতেও; অতএব অনশন-শিল্পী তাই আসলে অনশন করেই যেতে লাগল, একদিন তো এটারই স্বপ্ন দেখত সে, কিন্তু কেউ হিসাব রাখল না কত দিন হলো; কেউ, এমনকি অনশন-শিল্পী নিজেও, জানল না যে কত বিশাল এক সাফল্য অর্জন করল সে; আর তার বুক ভার হয়ে উঠল একসময় । আর কখনো যদি কোনো দিন কোনো গা-ছাড়া দর্শক একটু এখানে থামল তো বোর্ডের মধ্যে লেখা ওই পুরোনো সংখ্যা দেখে অনশন শিল্পীকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা শুরু করে দিত, বলত বাটপারি হচ্ছে –এর চেয়ে অপমানকর মিথ্যা কথা আর হয় না, মানুষের উদাসীনতা ও স্বভাবগত বিদ্বেষপরায়ণতা থেকে এর। চেয়ে বড় মিথ্যা আর জন্ম নিতে পারে না, কারণ বাটপারি করে অনশন-শিল্পী কাউকে ঠকাচ্ছে না, সে তার শিল্পচর্চা করে যাচ্ছে সততা নিয়েই, বরং পৃথিবীই তাকে ঠকাচ্ছে তার প্রাপ্য পুরস্কার থেকে।
তারপর আবার অনেকদিন চলে গেল, তারপর সেটারও শেষ হলো একদিন। একদিন এক শ্রমিকসর্দারের হঠাৎ নজরে পড়ল খাঁচা, সে তার সঙ্গের শ্রমিকদের কাছে জানতে চাইল যে কেন এই সুন্দর খাঁচা ভেতরে পচা খড় নিয়ে পড়ে আছে বিনা কারণে, কেন ওটার কোনো ব্যবহার করা হচ্ছে না; কেউ উত্তর দিতে পারল না, শেষে একজন, অনশনের হিসাব রাখার বোর্ডটা দেখে, মনে করতে পারল অনশন-শিল্পীর কথা। তারা খড়ের মধ্যে তোটুতো দিল, অনশন-শিল্পীকে শেষমেশ পেল ওই খড়ের নিচে। কি, তুমি কি এখনো–খেয়ে আছ?’ শ্রমিকসর্দার জিগ্যেস করল, “কবে থামবে তুমি বল তো?’ ‘আমাকে সবাই ক্ষমা করে দিয়ো, ফিসফিস করে বলল অনশন-শিল্পী; শুধু শ্রমিক-সর্দারই, তার কান খাঁচার শিকে লাগানো, বুঝতে পারল সে কী বলছে। অবশ্যই দেব, শ্ৰমিকসর্দার বলল, সে হাত দিয়ে তার কপাল চাপড়াচ্ছে, বাকি সবাইকে বোঝাতে চাইছে অনশন-শিল্পীর কী করুণ অবস্থা, আমরা তোমাকে ক্ষমা করছি। আমি সব সময় চেয়েছি আমার অনশনকে তোমরা সম্মানের চোখে দেখো’, বলল অনশন-শিল্পী। তাই তো দেখি আমরা’, অমায়িক বিনয় নিয়ে বলল শ্রমিকসর্দার। কিন্তু তোমাদের উচিত না এটা শ্রদ্ধা-সম্মানের সঙ্গে দেখা, অনশন-শিল্পী বলল। “ঠিক আছে, তাহলে দেখি না ওভাবে’, বলল শ্রমিকসর্দার, ‘কিন্তু কেন আমরা তোমার অনশন শ্রদ্ধা-সম্মান নিয়ে দেখব না, কেন? কারণ আমাকে অনশন করতেই হবে, আমার অন্য কোনো উপায় নেই,’ বলল অনশন-শিল্পী। “উফ্, আর কী বলবে বলো তো,’ বলল শ্রমিকসর্দার, কেন তোমার অন্য কোনো উপায় নেই? ‘কারণ,’ বলল অনশন-শিল্পী, অল্প একটু মাথা তুলে, ঠোঁট দুটো দিয়ে যেন চুমু খেতে চাইছে এমনভাবে কুঁচকে, সোজা শ্ৰমিকসর্দারের কানের মধ্যে বলল যেন তার একটা শব্দও সর্দারের শোনা বাদ না পড়ে যায়, কারণ আমি খেতে পছন্দ করি এমন কোনো খাবার কখনোই খুঁজে পাইনি। যদি খুঁজে পেতাম, বিশ্বাস করো, তাহলে কোনো শোরগোল পাকাতাম না, আমার খাবারটুকু পেটপুরে খেতাম ঠিক তোমার ও অন্য আর সবার মতোই। এই ছিল তার শেষ কথা, কিন্তু তার ক্ষীণ ও দুর্বল চোখের মধ্যে তখনো দেখা যাচ্ছে গর্বটুকু বাদ দিয়ে শুধু দৃঢ় এক প্রত্যয় যে, সে তখনো অনশনেই আছে ।
‘এই, তাহলে এবার সব সাফ করো!’ বলল শ্রমিকসর্দার, এরপর তারা কবর দিল অনশন-শিল্পী, খড়বিচালি, সবকিছু। খাঁচার মধ্যে তারপর তারা পুরল একটা জোয়ান চিতা। এত দিনের এই শূন্য পড়ে থাকা খাঁচায় বনের এই জন্তু লাফিয়ে চলেছে এটা দেখাও তো কোনো সবচেয়ে ভোঁতা-বুদ্ধির লোকের জন্যও স্পষ্ট স্বস্তির । চিতাটার কোনোকিছুরই অভাব নেই। তাকে যারা পালে, তারা তার পছন্দের খাবার এনে এনে দেয়, কোনো বেশি ভাবাভাবি করার থাকে না এ বিষয়ে; তাকে দেখে মনে হয় স্বাধীনতা হারানোর ব্যাপারটা নিয়েও তার কোনো আফসোস নেই; তার ঐ রাজকীয় শরীর– যেখানে যা যা দরকার সব নিয়ে শরীরটা ফেটে পড়ার উপক্রম –তার ঐ রাজার শরীর যেন একেবারে নিজের মধ্যে স্বাধীনতা সঙ্গে করে নিয়ে চলেছে; তার চোয়ালের মধ্যে কোথাও যেন লুকানো আছে ঐ স্বাধীনতা; আর তার কণ্ঠের অগ্নিকুণ্ড থেকে জীবনের জয়োল্লাস এমন প্রচণ্ডভাবে জ্বলে বেরোচ্ছে যে দর্শকদের পক্ষে এর ধাক্কা সহ্য করা সহজ নয়। কিন্তু নিজেদের শক্ত করে নিয়েছে তারা, দাঁড়িয়ে গেছে খাঁচাটা ঘিরে, আর একবার দাঁড়িয়েছে তো ওখান থেকে নড়ানোই যাচ্ছে না তাদের।
গায়িকা জোসেফিন অথবা ইঁদুর-জাতি
আমাদের গায়িকার নাম জোসেফিন। যে তার গান শোনেনি, সে জানে না গানের শক্তি কী জিনিস। আমাদের মধ্যে কেউ নেই যে তার গান শুনে আত্মহারা হয়; আর আমরা যেহেতু সার্বিক বিচারে কোনো গানপ্রিয় জাতি না, এটা তাই আরো বড় ব্যাপার বলতে হবে। আমাদের জন্য সেরা গান হচ্ছে শান্তি, আর নিরুদ্বেগ থাকা; জীবন আমাদের কঠিন, আর আমরা যদি কোনো দিন ধরুন একবারের জন্যও আমাদের রোজকার উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলতে পারলাম, তবু গানের মতো আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে এত দূরের এক জিনিস নিয়ে পড়ে থাকার মতো অবস্থা আমাদের নেই। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের বেশি আক্ষেপও নেই; অদুর পর্যন্ত ব্যাপারটা যায়-ই না কখনো; আমরা মনে করি, আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে আমাদের বিশেষ একধরনের বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ধূর্ততা– আমাদের জন্য সত্যি বলতে ওটারই সবচেয়ে বেশি দরকার –আর সেই ধূর্তামির একটু হাসি দিয়েই আমরা একজন আরেকজনকে প্রবোধ দিই সব ব্যাপারেই, এমনকি ধরুন যখন আমাদের মন কেমন করে ওঠে –আসলে এমনটা হয় না– বিশেষ ওই ধরনের সুখের জন্য যা কিনা সম্ভবত সংগীত থেকে পাওয়া যায়। আমাদের মধ্যে জোসেফিনই একমাত্র ব্যতিক্রম; সে গান ভালোবাসে, আর জানে গান দিয়ে কীভাবে অন্যের মনে নাড়া দিতে হয়; একমাত্র সে-ই; তার বিদায়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের জীবন থেকে– কে জানে কতকালের জন্য –গানও বিদায় নেবে।
গান আসলে কী জিনিস তা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি। সবকিছুর পরেও এটা সত্যি যে আমরা অসাংগীতিক এক জাতি; তাহলে কী করে আমরা জোসেফিনের গান বুঝি, কিংবা– যেহেতু জোসেফিন মানতে চায় না যে আমরা গান বুঝি– ভাবি যে আমরা ওর গান বুঝছি, তা আমার মাথায় আসে না। এ প্রশ্নের সবচেয়ে সোজা উত্তর বোধ হয় এই যে, জোসেফিনের গানের মাধুর্যের কারণে কারো পক্ষেই, সবচেয়ে ভোতা কানের যে তার। পক্ষেও, তার গান উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না; তবে এটা কোনো ভালো উত্তর হলো না। যদি সত্যিই তা-ই হতো, তাহলে তার গান তো যে-কারো মধ্যেই সাধারণের বাইরের কিছু হিসেবে তাৎক্ষণিক ও চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যেত; আমাদের মনে হতো, আমরা এর আগে কোনো দিন শুনিনি আর শোনার ক্ষমতাও আমাদের নেই এমন একটা কিছু বোধ হয় বের হচ্ছে তার গলা থেকে; এমন কিছু যা কেবল এই অদ্বিতীয় জোসেফিনই, আর কেউ নয় শুধু জোসেফিনই, আমাদের পারে শোনার জন্য যোগ্য করে তুলতে। কিন্তু এমনটা ঘটছে বলে আমি অন্তত মনে করি না; এমন কিছু আমি অনুভব করি না, এমন কিছু অন্য কেউ অনুভব করছে বলেও আমি দেখিনি। আমাদের নিজেদের মধ্যে আমরা খোলাখুলিভাবেই বলি যে জোসেফিনের গান, গান হিসেবে, সাধারণের বাইরের কোনো কিছু নয়।
সত্যিই কি একে গান বলা চলে? গানের মর্ম সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণা না থাকলেও এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে সামান্য হলেও গানের ঐতিহ্য আমাদের জাতির আছে; প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে গানের প্রচলন ছিল; এসব নিয়ে কিংবদন্তিও আছে, কিছু কিছু গান সংরক্ষণ করাও হয়েছে, যদিও মানছি যে এখন আর কেউ ওগুলো গাইতে পারে না। তার মানে, গান কী, সে বিষয়ে আমাদের মধ্যে কিছু আবছা ধারণা অবশ্যই রয়েছে; আর সত্যি কথা হচ্ছে জোসেফিন যা গায় তাকে কি আদৌ গান বলা চলে? তা কি আসলে স্রেফ শিস বাজানোই নয়? আর কিচমিচ করে শিস বাজানোর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত, ওরকম শিস দেওয়াই আমাদের জাতির সহজাত প্রবণতা, কিংবা আসলে ওটাকে প্রবণতা বলাও হয়তো ঠিক হচ্ছে না –আমাদের জীবনের বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্নই তো ওটা। আমরা সবাই কিচমিচ করি, কিন্তু খুব স্বাভাবিক যে সেটাকে শিল্প বলার স্বপ্নও কেউ দেখে না, আমরা কিচমিচ করি নিজেদের অজান্তেই; সত্যি বলতে খেয়ালও করি না যে কিচমিচ করছি; আর আমাদের মধ্যে এমনকি অনেকেই আছে, যারা জানেও না যে কিচমিচ করা আমাদের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অতএব এ কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে যে জোসেফিন গান গায় না বরং শুধু একটু কিচমিচ করে, আর তা-ও এমনকি আমাদের– অন্তত আমার কাছে সেটাই মনে হয়– সাধারণ কিচমিচের চেয়ে উঁচু কোনো কিচমিচও নয় –সত্যি হচ্ছে, তার শরীরের যা শক্তি তাতে সাধারণ কিচমিচ করাই তো তার সাধ্যে কুলায় না, এমনকি মাটি খোঁড়ার সাধারণ কোনো শ্রমিকও তো সারা দিন কাজ করে যাওয়ার মধ্যেই কত সাবলীলভাবে কিচমিচ চালিয়ে যেতে পারে– এই সব যদি সত্যি হয় তো জোসেফিনের এই তথাকথিত শিল্পীর পরিচয় আসলেই খারিজ হয়ে যায়, কিন্তু তাহলে আবার আমাদের মধ্যে তার যে বিশাল প্রভাব রয়েছে তা ভাবতে সত্যিই ধাঁধার মতো লাগে।
কথা হচ্ছে, জোসেফিনের গলা থেকে যা বেরোয় তা স্রেফ কিচমিচ করা শিসধ্বনিই নয়। আপনি যদি ওর কাছ থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ান ও শোনেন, কিংবা আরো ভালো যদি এই পরীক্ষাটা করেন, অর্থাৎ, যখন কিনা জোসেফিন অন্য কয়েকজনের সঙ্গে মিলে গাইছে, তখন যদি আপনি ওর কণ্ঠ অন্যদের থেকে আলাদা করতে চেষ্টা করেন, তাহলে সব সময়ই আপনি দেখবেন যে ওটা খুব সাধারণ একটা কিচমিচ শিস ছাড়া আর কিছুই নয়, অন্যগুলোর থেকে যা শুধু এই অর্থেই আলাদা যে তারটা আরো বেশি নাজুক ও নিস্তেজ এক শিস। কিন্তু এবার ধরুন, আপনি দাঁড়ালেন জোসেফিনের সামনে গিয়ে, তখন দেখবেন যে স্রেফ শিস না ওটা; তার শিল্প বোঝার জন্য আপনার শুধু তাকে শুনলেই চলবে না, তাকে দেখতেও হবে। যদি তারটা এমনকি স্রেফ আমাদের নিত্যদিনের কিচমিচ শিস দেওয়াও হয়ে থাকে, তার পরও আমাদের প্রথমে এই অদ্ভুত সত্যের মুখোমুখি হতে হবে যে, আমরা সবাই রোজ রোজ যা করে থাকি সে কাজটা করার জন্যই এখানে আমাদের একজন আনুষ্ঠানিক গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে –স্রেফ এটাই তো বিশেষ একটা ব্যাপার। যতই যেভাবে দেখুন না কেন আপনি তো আর বাদাম ভাঙতে পারাকে শিল্প বলতে পারেন না, আর তাই এমন কি হওয়া সম্ভব যে কেউ সবাইকে কখনো একসঙ্গে জড়ো করবে, তারপর সামনে এগিয়ে এসে সবাইকে বাদাম ভেঙে বিনোদন দিতে চাইবে? কিন্তু ধরুন, কেউ সেটাই করল; ধরুন সেটা করে তার লক্ষ্যে সফলও হলো, তখন তো আপনি আর ব্যাপারটাকে স্রেফ বাদাম-ভাঙা বলতে পারবেন না। অথবা অন্যভাবে দেখলে, ওটা হয়তো স্রেফ বাদাম-ভাঙাই, কিন্তু দেখা গেল আমরা, আগে অনেক বাদাম ভেঙেছি বলেই হয়তো কখনো খেয়ালই করিনি যে এটা একটা শিল্প, আর এই নতুন বাদাম-ভেদকই কিনা আমাদের প্রথমবারের মতো দেখিয়ে দিল বাদাম ভাঙার সত্যিকারের অর্থ কী –আর সেই ক্ষেত্রে সে যদি আমাদের অধিকাংশের চেয়ে বাদাম-ভাঙার কাজে একটু কম দক্ষ হয়, তাহলে তো তার বাদাম-ভাঙার সৌন্দর্য বরং আমাদের চোখে আরেকটু বেড়েই যাবে।
সম্ভবত জোসেফিনের গানের বেলায় ব্যাপারটা এমনই; তার ক্ষেত্রে আমরা ঠিক সে জিনিসটারই প্রশস্তি গাই, আমাদের নিজেদের বেলায় যেটার প্রশস্তি গাওয়ার কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না; এই পরের কথাটাতে, প্রসঙ্গক্রমে বলছি, জোসেফিন আমাদের সঙ্গে পুরো একমত। একবার আমি উপস্থিত আছি এরকম একটা জটলায় আমাদের মধ্যে কেউ একজন– মাঝেমধ্যেই এমন হয়– কথা তুলল জাতি হিসেবে আমাদের কিচমিচ শব্দ করার অভ্যাস নিয়ে; কথাটা বেশ সাবধানেই বলল সে, কিন্তু জোসেফিন সেটুকুও সহ্য করতে পারল না। কী এক শ্লেষাত্মক, কী এক ঔদ্ধত্যভরা হাসি হাসল সে, যেমনটা আমি আগে আর কখনোই দেখিনি; সে, যাকে দেখতে মনে হয় কমনীয়তার বিরাট বড় উদাহরণ (এ ধরনের নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যে ভরা কোনো জাতির সদস্য হিসেবেও তার কমনীয়তা চোখে পড়ার মতো), সেই তাকেই কিনা সে সময়ে মনে হলো কত রুক্ষ; তবে সঙ্গে সঙ্গেই সে বোধ হয় বুঝতে পারল ব্যাপারটা, তার সংবেদনশীলতা সব সময়েই বলার মতো, তাই সামলে নিল নিজেকে । অতএব, কথা হচ্ছে, জোসেফিন তার শিল্প ও কিচমিচ করার মধ্যে সামান্য সম্পর্কও আছে বলে বিশ্বাস করে না। যারাই এর উল্টো ভাবে, সে তাদের ঘৃণা করে, সম্ভবত লুকানো এক ঘৃণা । এটা অসার দম্ভের কোনো ব্যাপার না, কারণ বিরোধীপক্ষও, আমি নিজে অর্ধেকটা ওই দলেরই একজন, কোনো সন্দেহ নেই তার ততটুকুই প্রশংসা করে যতটা তাকে করে আমাদের জাতির বেশিরভাগ সদস্য; তবে জোসেফিন শুধু ওই প্রশংসাতেই খুশি নয়, সে চায় তাকে প্রশংসা করা হোক একদম তার ঠিক করে দেওয়া নিয়ম মেনে, শুধু প্রশংসার জন্য প্রশংসাতে তার কোনো আগ্রহ নেই। আর তার সামনে বসলেই না আপনি বুঝবেন সে কী জিনিস; তার বিরোধিতা শুধু তার থেকে দূরে বসেই করা সম্ভব; তার সামনে বসলে আপনি জেনে যাবেন যে: তার এই কিচমিচ শিস বাজানো কোনো কিচমিচ শিসই নয়।
কিচমিচ করাটা যেহেতু আমাদের ভেবেচিন্তে করতে হয় না, আমরা স্বভাবগতভাবেই ওটা করি, তাই আপনি ঠিকই ভাববেন যদি ভাবেন যে জোসেফিনের শ্রোতাদের মধ্যেও তো যে-কেউ কিচমিচ করে বসতে পারে; তার শিল্পকর্ম শুনে আমরা ভালো বোধ করি, আর আমরা যখনই ভালো বোধ করি, তখনই কিচমিচ করি । তবে শ্রোতারা কিচমিচ করে না; ইঁদুরদের চেয়ে চুপচাপ আর কোনো শ্রোতা নেই; আমরা যেন আমাদের বহু-আকাক্ষিত শান্তির সন্ধান পেয়ে গেছি, যে শান্তি থেকে আমাদের নিজস্ব কিচমিচ আমাদের কিছুটা হলেও দূরে সরিয়ে রাখে, তেমনভাবে আমরা চুপ করে থাকি। তার গানই কি আমাদের জাদু করে রাখে নাকি তার ক্ষীণ, সামান্য কণ্ঠ ঘিরে রেখেছে যে ভাবগম্ভীর নীরবতা, তাতে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই? একবার কী হলো, জোসেফিন যখন গান গাইছে, কমবয়সী বোকা একটা কেউ খুব সরলমনেই কিচমিচ করে শিস বাজানো শুরু করল। আর দেখা গেল, তার ও জোসেফিনেরটার মধ্যে সামান্য কোনো পার্থক্যও নেই; আমাদের সামনের দিক থেকে আসছে জোসেফিনের কিচমিচ শিস, তার অত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও কেমন লাজুক একটা গলা; আর শ্রোতাদের মধ্যে থেকে আসছে বাচ্চাদের মতো কণ্ঠের নিজেকে-ভুলে-যাওয়া এক কিচমিচ শিসধ্বনি; এদের কেউই আলাদা করতে পারবে না; তার পরও আমরা তক্ষুনি এই অনাহূতকে শিস দিয়ে ও স্ স্ স্ আওয়াজ তুলে থামিয়ে দিলাম, যদিও সত্যি বলতে ওটা করার দরকার ছিল না, কারণ আমরা অমনটা না করলেও সে নিজের থেকে লজ্জা আর ভয়ে। এমনিতেই কুঁকড়ে গিয়ে হামা দিত; ইতোমধ্যে জোসেফিন, খুশিতে আত্মহারা হয়ে, শুরু করে দিয়েছে তার বিজয়ীর কিচমিচ, তার হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে আর তার গলা যত দূর পারা যায় তত দূর উপরের দিকে তুলে ধরে।
কিন্তু সে সব সময় অমনই; যেকোনো তুচ্ছ জিনিস, যেকোনো দৈবাৎ ঘটনা, যেকোনো উৎপাত, মেঝের কাঠের সামান্য কাঁচকাঁচ, দাঁতের সামান্য কিচমিচ, আলোতে কোনো সমস্যা –সবকিছুকে সে ভাবে তার গানের জাদু বাড়ানোর মোক্ষম উপায়; তার হিসেবে তার গান তো এমনিতেই কেউ বোঝে না; উৎসাহ আর হাততালির হয়তো কোনো কমতি নেই, কিন্তু অন্যরা তাকে সত্যিকারের বুঝবে, সে যেভাবে চায় সেরকম করে বুঝবে, এই আশা সে ছেড়ে দিয়েছে বহুদিন আগেই। এ কারণেই যেকোনো উৎপাতকে সে দেখে সুবিধা হিসেবে; বাইরের যেকোনো কিছু যা তার গানের বিশুদ্ধতার সঙ্গে যায় না, আর যাকে হারানো যায় সহজেই, কোনো কষ্ট না করেই হারানো যায়, এমন যেকোনো কিছু শ্রোতাদের জাগিয়ে তুলতে পারে, তাদেরকে কোনো উপলব্ধি দিতে না পারলেও অন্তত তাদের মধ্যে কিছুটা ভয় ও শ্রদ্ধা মেশানো ভাবের জন্ম দিতে পারে।
কিন্তু এসব ছোট বিষয় যদি তার এতটা কাজে আসে, তাহলে ভেবে দেখুন, বড়গুলোতে কী হতে পারে! আমাদের জীবন অনেক উদ্বেগের, প্রতিটা দিন আসে নতুন সব বিস্ময় নিয়ে, সেই সঙ্গে নতুন বিপদসংকেত, আশা, আতঙ্ক; এর ফলে কারো একার পক্ষে এতটা চাপ নেওয়া সম্ভব হয় না –তাকে দিনে-রাতে সব সময়, তার সঙ্গীদের সহযোগিতা নিয়ে চলতে হয়; কিন্তু তার পরও প্রায়ই সবকিছু অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যেই হাজার জনের কাঁধ কাঁপতে থাকে এমন এক বোঝার ভারে, যা আসলে কেবলমাত্র একজনের বোঝা। জোসেফিন কিন্তু অপেক্ষা করে থাকে এই সময়টার জন্যই। ঐ যে সে দাঁড়িয়ে ওখানে, দুর্বল এক চিড়িয়া, বিপজ্জনকভাবে কাঁপছে বিশেষ করে তার বুকের নিচের দিকটায়; দেখে মনে হচ্ছে তার সব শক্তি যেন সে ঢেলে দিয়েছে তার গানের মধ্যে; যেন যেকোনো কিছু যা তার গানের কোনো কাজে আসছে না, তার শরীরের সামান্য একটু শক্তিও, তার বেঁচে থাকার সামান্য কোনো উপায়ও –সব যেন কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার থেকে; যেন তাকে উলঙ্গ করে ফেলা হয়েছে, উন্মুক্ত, পুরোপুরি সে টিকে আছে স্রেফ সহৃদয় অতিলৌকিক শক্তিদের দয়ার ওপর; যেন এই এভাবে যখন সে বাস করছে তার গানের মধ্যে, এরকম সবকিছুর সামনে পুরো উন্মুক্ত হয়ে, যেন তখন স্রেফ ঠান্ডা হাওয়ার সামান্য একটা ফুয়েই সে শেষ হয়ে যাবে। তবে ঠিক এরকম দৃশ্য দেখেই আমরা –তার তথাকথিত বিরোধীপক্ষ যারা– নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি: ‘সে তো সামান্য কিচমিচ করতেও জানে না; দেখো তাকে কী ভয়ংকর কষ্ট করতে হচ্ছে একটুখানি গান গাওয়ার– আরে গানের কথা তো বাদই দাও– একটুখানি আমাদের রোজকার কিচমিচ করার মতো কিছু করতে গিয়েও।’ আমাদের এমনটাই মনে হয়; তবে তার পরও, যা আগেই বলেছি, আমাদের এই অবশ্যম্ভাবী অনুভূতি স্রেফ ক্ষণিকের জন্যই, দ্রুতই তা মিলিয়ে যায়। একটু পরেই আমরাও ডুবে যাই ভিড়ের বাকিদের অনুভূতির মধ্যে, ওরা –একজন আরেকজনের গরম শরীরের সঙ্গে ঠাসাঠাসি হয়ে –তার গান শুনে যায় শ্রদ্ধা-মাখানো রুদ্ধনিশ্বাসে।
আর আমাদের জাতির এই এতগুলোকে একসঙ্গে তার চারপাশে জড়ো করার জন্য– মনে রাখতে হবে, আমাদের জাতির সবাই সব সময়ে আছে চলার মধ্যে, সব সময় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটছে এদিক-ওদিক, কেন তা প্রায়ই স্পষ্ট নয়– সাধারণত জোসেফিনের ওরকম একটা অবস্থান নিলেই কাজ হয়ে যায়: মাথা পেছনে ঝুলিয়ে, মুখ অর্ধেক খুলে, চোখ আকাশের দিকে তুললেই চলে, সবাই বুঝে যায় সে গান গাইতে চাচ্ছে। এই কাজটা সে যেকোনো জায়গায় করলেই হবে, জায়গাটা দূর থেকে দেখা না গেলেও চলবে; ঠিক ঐ মুহূর্তে, কোনোকিছু না-ভেবেই, যেকোনো একটু নিরালা কোনার মধ্যে হলেও অসুবিধা নেই। সে গান গাইতে যাচ্ছে এই খবর সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, তক্ষুনি মিছিল করে আসতে থাকে সবাই। তবে কখনো-সখনো কাজটা কঠিনও হয়ে পড়ে; জোসেফিনের বেশি পছন্দ ঝামেলার সময়ে গান ধরা, তাই দেখা যায় একগাদা উদ্বেগ ও সমস্যার মধ্যে পড়ে আমাদের আসতে হয় নানা ঘোরানো পথ। ধরে; সাদা দুনিয়ার সব সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেখা যায় জোসেফিন যত তাড়াতাড়ি চায়, তত তাড়াতাড়ি আমরা জড়ো হতে পারি না; দেখা যায়, তাকে তার ওই অনবদ্য ভঙ্গিমায় হয়তো যথেষ্ট দর্শকসমাগম না-হওয়ার কারণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।– তারপর স্বাভাবিক সে রাগে ফেটে পড়ে, পা দিয়ে মাটিতে বাড়ি মারতে থাকে, জঘন্য অ-নারীসুলভ ভঙ্গিতে গালিগালাজ করতে থাকে, সত্যি বলতে সে এমনকি কামড় দেওয়াও শুরু করে। কিন্তু দেখা যায় এ ধরনের আচরণেও তার সুনামের কোনো ক্ষতি হয় না; তার এসব বাড়াবাড়ি চাহিদা কিছুটা খর্ব করার পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে, সবাই বরং যদুর সম্ভব চেষ্টা করে সেগুলো মেটাতে; শ্রোতাদের ধরে নিয়ে আসার জন্য পিয়ন পাঠানো হয়; এই কৌশলের কথা তাকে জানানো হয় না; চারদিকের সব রাস্তায় তখন দেখা যায় প্রহরী বসানো হয়েছে, তারা আসতে থাকা শ্রোতাদের হাত নেড়ে নেড়ে তাড়া দিতে থাকে আরেকটু জোরে ছোটার জন্য; এ রকম চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষমেশ একটা মানানসই শ্রোতার সংখ্যা তৈরি হচ্ছে।
জোসেফিনের জন্য আমাদের জাতির সবাই এ রকম কষ্ট করতে রাজি হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জোসেফিনের গানবিষয়ক প্রশ্নটার মতোই কঠিন, আর আসলে একটার সঙ্গে অন্যটার যোগও আছে। এই প্রশ্নটা আপনি বাতিল করেও দিতে পারেন, এটাকে দ্বিতীয় প্রশ্নের সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে দিয়ে; সে ক্ষেত্রে আপনাকে ধরে নিতে হবে যে। আমাদের জাতির সবাই জোসেফিনের প্রতি নিঃশর্তভাবে অনুরক্ত তার গানের কারণেই। কিন্তু তা তো সত্যি নয়; নিঃশর্ত অনুরক্তি বলে বাস্তবিক কোনোকিছু আমাদের জানা নেই; আমাদের জাতির যারা আছি তারা সবকিছুর ওপরে ভালোবাসি একধরনের ধূর্তামি, নির্দোষ ধরনের ধূর্তামি, বাচ্চাদের মতো ফিসফিসিয়ে কথা বলা, আর আমরা কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য না নিয়েই, মন থেকে নয়, স্রেফ ঠোঁটের থেকে, চর্চা করে যাই গুজব ও গালগল্পের– এরকম এক জাতির পক্ষে শর্তহীন অনুরক্তি অসম্ভব একটা বিষয়; আর সম্ভবত জোসেফিনও তা অনুমান করতে পারে; ঠিক এটার বিরুদ্ধেই সে লড়াই করে যায় তার দুর্বল স্বরযন্ত্রের সব শক্তি দিয়ে।
তবে নিশ্চিত এরকম আলগা রায় দেওয়া ও সেটা বেশি দূর নেওয়া ঠিক নয়; জাতি হিসেবে আমরা আসলেই জোসেফিনের প্রতি অনুরক্ত, নিশ্চিত আমরা তার ভক্ত, শুধু শর্তহীনভাবে কথাটা ঠিক না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা জোসেফিনকে নিয়ে কখনোই হাসাহাসি করতে পারি না। সত্য স্বীকার করে নেওয়া ভালো: জোসেফিনের মধ্যে অনেক কিছুই আছে যা হাসির উদ্রেক করে; আর হাসিতে ফেটে পড়া আমাদের জাতির চিরকালীন বৈশিষ্ট্য; আমাদের বেঁচে থাকার এত এত দুর্গতি সত্ত্বেও একটুখানিকের জন্য চুপচাপ হাসি, সত্যি বলছি, আমাদের খুব পছন্দের বিষয়; কিন্তু জোসেফিনকে নিয়ে আমরা হাসি না। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় আমাদের জাতি জোসেফিনের সঙ্গে তার সম্পর্ককে বরং এভাবে দেখে: এই নাজুক, অরক্ষিত, যেভাবেই হোক বিশিষ্ট আসনে বসা প্রাণীটির– তার হিসাবমতে, তার বিশিষ্টতার কারণ তার গান– ভার আমাদের হাতে সঁপে দেওয়া হচ্ছে এবং আমাদের অবশ্যই তার দেখভাল করে যেতে হবে; এর কারণ কী তা কারো কাছেই পরিষ্কার নয়, কিন্তু মনে হচ্ছে এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর আপনার হাতে কোনোকিছু বিশ্বাস করে যত্ন নেওয়ার জন্য সঁপে দেওয়া হলে আপনি তো তা নিয়ে হাসেন না; ঐ হাসি তো দায়িত্বভঙ্গের সমতুল্য হয়ে যাবে; আমাদের মধ্যে জোসেফিনের ওপর যাদের বিদ্বেষ সবচেয়ে বেশি, তারাও ওর প্রতি সবচেয়ে বড় বিদ্বেষ ঝাড়ে খুব বেশি হলে, মাঝেমধ্যে, এ কথা বলে: ‘জোসেফিনকে যখন দেখি তখন তো হাসি আসে না।’
তার মানে আমাদের জনগণ জোসেফিনের যত্ন নেয় ঠিক যেভাবে কোনো বাবা যত্ন নেয় তার দিকে ছোট ছোট হাত সামনে বাড়িয়ে দেওয়া শিশুসন্তানের– ওই বাড়ানো হাত দেখে বলার উপায় নেই শিশুটি কি কাকুতি-মিনতি করছে, নাকি তার চাহিদার কথা জানাচ্ছে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে ওরকম পিতৃসুলভ দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের জনগণ উপযুক্ত নয়, কিন্তু সত্যি হচ্ছে আমরা সেটা, অন্তত শুধু এই জোসেফিনের বেলায়, ঠিকই খুব ভালোভাবে পালন করি; এই ক্ষেত্রে কারো একার পক্ষে দায়িত্বটা সেভাবে পালন করা সম্ভব নয়, যা একটা জাতি হিসেবে সবাই মিলে সম্ভব। বলা বাহুল্য, জাতির শক্তি কোনো একজনের শক্তির চেয়ে অনেক অনেক বেশি, এতই বেশি যে জাতিকে স্রেফ তার কাছে রক্ষার্থী ওই একজনকে নিজের কোলের উষ্ণতার মধ্যে একটু টেনে নিলেই হয়, তাতেই সবকিছু থেকে তার যথেষ্ট রক্ষা মিলতে বাধ্য। মানছি, কারো অবশ্য সাহস নেই এসব কথা জোসেফিনকে বলার। আমাকে রক্ষা করার কথা ভুলেও বলবে না, সে তখন বলবে, না হলে তোমার কিচমিচের শিগগির আমি বারোটা বাজিয়ে দেব। ওহ্ হা, কিচমিচ করা তো তুমি ভালোই জানো, আমরা ভাবি। তবে যা-ই বলুন, তার ওরকম বিদ্রোহী আচরণ মানে এটা না যে সে আমাদের কথা সত্যিই মানতে চাইছে না। তার এই আচরণ বরং এক শিশুসুলভ বিদ্রোহের, এটার মধ্যে দিয়ে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শিশুতোষ ভঙ্গিটাই ফুটে ওঠে; এ ক্ষেত্রে কোনো পিতার কাজ হলো এসব খেয়াল না-করা।
তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়, আরো অন্য ব্যাপারও আছে; আমাদের জনগণ ও জোসেফিনের মধ্যেকার সম্পর্কের হিসাবটা ব্যাখ্যা করা এবার কিছুটা কঠিনই বটে। ঘটনা হচ্ছে, জোসেফিনের হিসাব পুরো উল্টো: তার বিশ্বাস, সে-ই বরং আমাদের জনগণকে রক্ষা করছে। যখনই আমরা গভীর কোনো সমস্যায় পড়ি, তা রাজনৈতিক হোক বা অর্থনৈতিক, বলা হয়ে থাকে যে তার গান তখন আমাদের রক্ষা করে; ঐ গানের অবদান এর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়; আর তাতে যদি আমাদের দুর্দশার অবসান নাও হয়, অন্তত সেটার ভার বহনের শক্তি আমরা পাই তার গান থেকেই। এমন না যে সে নিজে থেকে এটা বলে, কিংবা এভাবে না-বললেও অন্যভাবে বলে, বস্তুত সে খুব একটা কিছু বলে না কখনোই; আমাদের এই বকবক করা জনগণের তুলনায় সে অনেক চুপচাপ, কথাটা তার চোখের মধ্যে ঝিলিক মারে; তার বন্ধ করে রাখা ঠোঁটে –আমাদের মধ্যে খুব সামান্য কজনই হয়তো আছে যারা ঠোঁট বন্ধ রাখতে পারে; জোসেফিন তাদেরই একজন– কথাটা স্পষ্ট পড়া যায়। যখনই আমাদের কাছে কোনো খারাপ খবর আসে –অনেক দিনই দেখা যায় খারাপ খবর আসে বানের মতো, মিথ্যা খবর, অর্ধসত্য খবর সব মিলিয়ে অনেক — তখন জোসেফিন তার ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে –অন্য সময় হলে এই একই ক্লান্তিতে ঢুলতে থাকে সে –উঠে দাঁড়ায় একটুও দেরি না করেই, দাঁড়িয়ে গলা সারসের মতো বাড়িয়ে সে এদিক-ওদিক তার জাতিভাইদের দেখতে থাকে, যেভাবে ঝড় আসার আগে রাখাল-বালক দেখে নেয় তার মেষগুলো। সত্যি যে বাচ্চারাও এ ধরনের দাবি করে থাকে, তাদের যুক্তিহীন, বিশৃঙ্খল পদ্ধতিতে তারা এসব দাবি জানায়; কিন্তু জোসেফিনের দাবিগুলো বাচ্চাদের মতো অতটা ভিত্তিহীন নয়। এটা কি বলা লাগে যে, জোসেফিন আমাদের কোনো রক্ষাকর্তা নয়, আমরা তার কাছ থেকে কোনো ভার-বহনের শক্তিটক্তিও পাই না? একটা জাতির রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেকে দাবি করা সোজা, বিশেষ করে সেই
জাতি যদি আমাদের মতো হয়: ভোগান্তিতে অভ্যস্ত, নিজেদের ব্যাপারে মুক্তহস্ত, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পারদর্শী, মৃত্যুর সঙ্গে অতিপরিচিত, কেবল বেপরোয়া যে পরিবেশের মধ্যে নিয়ত বাস করছে তাতে মনে হয় একটু উদ্বিগ্ন, আর এরই সঙ্গে বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে যতটা অতিপ্রজ ততটাই স্বভাবে সাহসী– আমি বলতে চাচ্ছি, এরকম এক জাতির রক্ষাকর্তা হিসেবে, যে জাতি সব সময়েই কোনো-না-কোনোভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে, সেজন্য হয়তো তাদের এতটা মূল্য দিতে হয়েছে যা ভেবেই কিনা ইতিহাসবিদেরা– অবশ্য, সাধারণত, ঐতিহাসিক গবেষণায় আমরা কোনো পাত্তা দিই না –আতঙ্কে হিম হয়ে যান; সে রকম জাতির রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেকে জাহির করা খুব সহজ। তা সত্ত্বেও ঠিক এ রকম সময়গুলোতেই, যখন আমরা সবচেয়ে বিপদে থাকি সে রকম সময়েই আমরা জোসেফিনের গান অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর মনোযোগে শুনি। আমাদের ওপরে ঝুলতে থাকা আসন্ন বিপদের হুমকি আমাদের করে তোলে আরো শান্ত, আরো বিনয়ী, জোসেফিনের একনায়কসুলভ আচরণের প্রতি আরো আজ্ঞাবহ; আমরা আনন্দের সঙ্গেই সবাই একসঙ্গে হই, আনন্দের সঙ্গেই দল বেঁধে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়াই; আনন্দ কারণ আমাদের এই এখনকার গানের আসর ঐ বিরাট ও নিদারুণ যন্ত্রণার মূল বিষয় থেকে কত দূরের; ব্যাপারটা এমন যেন আমরা সবাই তড়িঘড়ি –ওহ্ হ্যাঁ, তড়িঘড়ি করার প্রয়োজন আছে, জোসেফিন প্রায়ই ভুলে যায় সে কথা– যুদ্ধের আগে আমাদের শান্তির যৌথ পানপাত্র থেকে একটু পান করে নিচ্ছি। আসরটা যতটুকু না গানের, তার চেয়ে বেশি জনসমাবেশের; আরো বড় কথা, এটা এমন এক জনসমাগম যেখানে, স্রেফ সামনের দিকের দুর্বল গলায় কিচমিচ করতে থাকা ঐ একজন ছাড়া, সবাই একদম চুপ; বকবকানি করার হিসেবে অনেক অনুপযুক্ত ও অনেক গাম্ভীর্যপূর্ণ এক সময় তখন।
অবশ্য এ ধরনের এক সম্পর্ক জোসেফিনকে কখনোই তৃপ্ত করতে পারে না। আমাদের জাতিতে তার অবস্থান কোথায়, তা কখনোই পরিষ্কার নয়, আর সেজন্য জোসেফিনের বুক ভরে থাকে অভিমান ও অসন্তোষে, তার নিজের প্রতি বিশ্বাসে সে আসলে এত অন্ধ যে অনেককিছুই সে দেখতে পায় না, আরো অনেক কিছুতে তার যেন চোখ না পড়ে সে-বিষয়ে তাকে রাজি করানোও কঠিন কোনো ব্যাপার নয়,– এ উদ্দেশ্যেই তাকে সব সময় ঘিরে রাখে চাটুকারের দল, তবে, অন্যদিক থেকে দেখলে, সবার জন্য ভালো কাজই তো করে তারা;– কিন্তু স্রেফ কোনো একটা জায়গায়, জনসমাবেশের কোনো এক কোনার মধ্যে, কেউ ঠিকমতো খেয়ালও করছে না এমন এক অবস্থায়, স্রেফ কোনো আনুষঙ্গিক আকর্ষণ হিসেবে গান গাওয়ার জন্য, যদিও সেটাও একেবারে কম কথা নয়, জোসেফিন নিশ্চিত তার সংগীতশিল্প বিসর্জন দেবে না।
তাকে দিতেই বা কে বলছে? তার শিল্পের দিকে কারো খেয়াল নেই কথাটা তো সত্যি না। যদিও এটা সত্যি যে আমরা তখন মানসিকভাবে একদম অন্য কিছুতে আচ্ছন্ন, সত্যি যে আমাদের তখনকার ঐ নীরবতার কারণ শুধু সে গান গাইছে বলেই না, সত্যি যে অনেক শ্রোতাই এমনকি উপরের দিকে একটু তাকায়ও না, বরং তার বদলে পাশের জনের লোমের মধ্যে মুখ গুঁজে রাখে, আর তাই জোসেফিনকে দেখতে মনে হয় যে ঐ সামনে ওখানে একদম বিনা কারণে সে নিজেকে ক্লান্ত করে চলেছে, এসব সত্ত্বেও তার ঐ কিচমিচ শিসের মধ্যে– এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই –ঠিকই দুর্নিবার কিছু আছে যা আমাদের মনকে মাতায়। এই জেগে উঠতে থাকা কিচমিচ শিস –যখন অন্য সবাইকে, অন্য সবকিছুকে যেন বলা হয়েছে একদম নীরব থাকতে– প্রত্যেক সদস্যের কানে পৌঁছায় জাতির থেকে আসা কোনো বার্তার মতো গুরুতর সব সিদ্ধান্তের মাঝখানে জোসেফিনের এই ক্ষীণ কিচমিচ অনেকটা যেন বৈরী পৃথিবীর মাঝখানে আমাদের জনগণের সকরুণ অস্তিত্বের মতোই কিছু। জোসেফিন নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে, তার এই তুচ্ছ গলা, এই তুচ্ছ অর্জন নিজেদের জাহির করে আর ঠেলে পথ কেটে পৌঁছায় আমাদের মনের জগতে; এ কথা মনে রাখা দরকার। যদি কোনো দিন সংগীতশিল্পের কোনো সত্যিকারের প্রতিনিধি আমাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে, তাকে কিন্তু আমরা জাতির এরকম একটা সময়ে নিশ্চিত সহ্য করতে পারব না, সবাই আমরা একজোট হয়ে তার গানকে হাস্যকর হিসেবে প্রত্যাখ্যান করব। হায়, জোসেফিন যেন কখনো এটা জানতে না পারে যে আমরা তার গান যে শুনি তার মানেই হচ্ছে, সে সত্যিকারের কোনো গায়িকা নয়। তার মনের মধ্যে এটা নিয়ে সম্ভবত ঠিকই কিছুটা সন্দেহ আছে, নতুবা কেন সে ওরকম জোর দিয়ে বলে যে আমরা তার গান শুনি না?– তার পরও সে নিজের মতো গেয়েই যায়, এসব সন্দেহ পাশ কাটিয়ে কিচমিচ করে যায়।
তবে, এটা ছাড়াও, তার জন্য অন্য আরো সান্ত্বনাও আছে: কিছুটা হলেও এটা সত্যি যে আমরা সত্যিই তার গান শুনি, সব সত্ত্বেও শুনি, যেভাবে কেউ সম্ভবত কোনো সত্যিকারের গায়কের গান শোনে, অনেকটা সেভাবে; আমাদের মন সে এমনভাবে আচ্ছন্ন করতে পারে যা কিনা কোনো সত্যিকারের শিল্পী আমাদের বেলায় পারত না, কোনো সন্দেহ নেই তার গানের ক্ষমতা কম বলেই সে এমনটা পারে। এটার মূল কারণ, নিঃসন্দেহে, আমাদের জীবনযাপনের ধারা।
আমাদের জীবনে তরুণ বয়স বলে কিছু নেই, আর সামান্য একটু শৈশবেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। সব সময় আমরা উপদেশ শুনি যে বাচ্চাদের একটু স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া উচিত; তাদের যে একটু শাসনের বাইরে যাওয়ার অধিকার আছে –এসব অধিকার মেনে নেওয়া উচিত, এসব অধিকার যেন তারা পায় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা উচিত; এ ধরনের উপদেশ আমাদের দেওয়া হয়, আর বলতে গেলে সবাই তাতে সম্মতিও জানায়, এর চেয়ে বেশি সম্মতি জানানোর মতো আর কিছু আমরা পাই না, কিন্তু একই সঙ্গে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার নিরিখে, মেনে নেওয়ার জন্য এর চেয়ে কঠিন কিছুও নেই; আমরা বাচ্চাদের এসব দাবি মেনে নিই, তারা যেন ওভাবে চলতে পারে তার জন্য কিছু প্রচেষ্টাও নেওয়া হয়, কিন্তু দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যেই সব আবার যেখানে ছিল সেখানে ফিরে এসেছে। সত্যি কথা হচ্ছে, আমাদের জীবনটাই এমন যে, যে-ই না একটা বাচ্চা একটু দৌড়াদৌড়ি করা শিখল, তার চারপাশ একটু চেনা শুরু করল, তাকে তখনই ঠিক বড়দের মতো করেই নিজেই নিজের দেখাশোনা করতে হয়; অর্থনৈতিক কারণে আমরা যতখানি এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে বাস করতে বাধ্য হই তা আকারে খুব বিশাল, আমাদের শত্রুর সংখ্যাও অগুনতি, আমাদের জন্য সবখানে ওঁত পেতে থাকা বিপদের সংখ্যাও অগণন– বেঁচে থাকার সংগ্রাম থেকে আমাদের বাচ্চাদের আগলে রাখা তাই আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না; যদি তা আমরা করার চেষ্টা করতাম, তার সোজা মানেই হতো এই বাচ্চাদের অকালমৃত্যু। তবে এরকম মন-খারাপ করা কারণের পাশাপাশি একটা মন চাঙা করা কারণও আছে: বংশবৃদ্ধির ব্যাপারে আমাদের জাতির অতিপ্রজতা। এক প্রজন্মের– প্রতিটা প্রজন্মই সংখ্যায় অগণন– পেছন পেছনেই রয়েছে তার আগেরটা; বাচ্চাদের সময় নেই বাচ্চা থাকার। অন্য জাতির ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা তাদের শিশুদের বিরাট যত্ন নিয়ে লালন-পালন করে, ওদের জন্য তারা হয়তো স্কুল বানায়, আর এসব স্কুল থেকে শিশুরা, জাতির ভবিষ্যৎ তারা, ঢলের মতো বেরিয়ে আসতে থাকে; কিন্তু অন্য এসব জাতির ক্ষেত্রে রোজ রোজ, দীর্ঘকাল ধরে, এই যে শিশুরা এভাবে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে, তারা কিন্তু একই শিশুদের দল। আমাদের কোনো স্কুল নেই, আমাদের অগুনতি বাচ্চাদের ঋক বেরিয়ে আসে আমাদের জাতির ভিড়ের মধ্যে থেকেই, সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বিরতি দিয়ে বেরিয়ে আসে তারা– ফুর্তিতে কিচিরমিচির করছে কিংবা চিকচিক শব্দ করছে যত দিন পর্যন্ত না কিচমিচ করে শিস দেওয়া না শিখছে, মাটিতে গড়াচ্ছে কিংবা ভিড়ের হাতে লাথিতো খাচ্ছে, যত দিন পর্যন্ত না দৌড়াতে শিখছে, তাদের বিশাল এক পাল হয়ে চলার কারণে সামনের সবকিছু ঝেটিয়ে নিয়ে চলেছে, যত দিন না ঠিকভাবে দেখতে শিখছে –আহ্, আমাদের বাচ্চারা! আর তারা, অন্য জাতির স্কুলের বাচ্চাদের মতে, সব সময়ে একই বাচ্চা না; না, সব সময়েই নতুন মুখ, চিরদিন, ফের নতুন নতুন মুখ; এর কোনো শেষ নেই, এর কোনো বিরাম নেই; এই এখন দেখলেন একটা বাচ্চা, তারপরই সে আর বাচ্চা নেই, এর পেছনে আরো অনেক বাচ্চার মুখ ভিড় করে আসতে শুরু করেছে, সংখ্যায় এত বেশি আর গতিতে এত দ্রুত যে এদের একটা থেকে আরেকটা আলাদা করার কোনো উপায় নেই, সবগুলো খুশিতে গোলাপি চেহারা। কিন্তু যতই আনন্দের শোনাক এ কথাগুলো, আর অন্য জাতির ওরা আমাদের এ কারণে যতই ঈর্ষা করুক– ঈর্ষাটা অযৌক্তিক নয়– সত্য এটাই থাকে যে আমরা আমাদের সন্তানদের একটা সঠিক শৈশব উপহার দিতে অসক্ষম। আর এর পরিণতি অবশ্যই আছে। আমাদের জাতির সবার ওপরে সব সময়ের জন্য বিরাজ করছে এক অমোচনীয় শিশুসুলভ ব্যাপার; আমাদের যেটা সবচেয়ে বড় গুণ, অর্থাৎ আমাদের অব্যর্থ বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান, তার একেবারে বিপরীতেই আমরা কিনা প্রায় প্রায়ই আচরণ করি চরম বোকার মতো, আমাদের এই বোকামি ঠিক বাচ্চারা যেরকম বোকামি করে সে রকম: একটা বাতিকগ্রস্ত, সীমা ছাড়ানো, প্রবল, দায়িত্বজ্ঞানহীন রকমের বোকামি, আর দেখা যায়, প্রায়ই তা স্রেফ একটু মজা করার জন্যই করছি আমরা। আর ও রকম করে আমরা যে আনন্দ পাই, তাকে অবশ্য বাচ্চাদের আনন্দের মতো মণপ্রাণঢালা আনন্দ বলা যাবে না, তবে কোনো সন্দেহ নেই, তার মধ্যে বাচ্চাদের সেই আনন্দের কিছুটা ছাপ তো থাকেই। আর আমাদের এই শিশুত্ব থেকে সবচেয়ে বেশি যে লাভ তুলে নিয়েছে, একদম শুরু থেকেই নিয়েছে, সে হলো জোসেফিন।
কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা যে শুধু শিশুসুলভ তা-ই না, এক অর্থে আমরা আসলে বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া এক জাতিও বটে; শৈশব ও বয়স হওয়ার ব্যাপারটা আমাদের ক্ষেত্রে অন্য জাতির থেকে ভিন্নভাবে ঘটে। আমাদের কোনো তরুণ বয়স বলে কিছু নেই, আমরা ধুম করে হঠাৎ বড় হয়ে যাই, তারপর একটু লম্বা সময় ধরে ওরকম বড়ই হয়ে থাকি; যার ফলে বিশেষ ধরনের এক ক্লান্তি ও নৈরাশ্যের বোধ কাজ করে আমাদের জাতির স্বভাবের মধ্যে –যদিও মূলে দেখলে আমরা স্বভাবে শক্ত ও আত্মবিশ্বাসী–, আর এর ছাপ রেখে যায়। আর আমরা যে অসাংগীতিক এক জাতি, তার সঙ্গে এ ব্যাপারগুলোরই সম্ভবত যোগ রয়েছে; আমরা সংগীতের জন্য একটু বেশি বুড়ো, সংগীতের উত্তেজনা, এর কল্লোল, এর উচ্ছ্বাস– এসব আমাদের বুড়োটে ভারিত্বের সঙ্গে যায় না, ক্লান্ত-শ্রান্তভাবে আমরা সংগীতকে দূর-দূর করে দিই; তারপর আমরা পিছু হটে আশ্রয় নিই কিচমিচ শিসের মধ্যে, এই এখন বা তখন একটুখানিক কিচমিচ শিস দেওয়া– ওটাই আমাদের জন্য ঠিক জিনিস। তবে আমাদের মধ্যে যে গানের মেধা নিয়ে কেউ আসেনি তা কে বলতে পারে; কিন্তু যদি এসেও থাকে, সেই মেধা বিকশিত হওয়ার আগেই তার সঙ্গীদের স্বভাব তার মেধাকে টিপে মারবে। অন্যদিকে জোসেফিন কিচমিচ করুক, কি গান গাক, কি ওটা তার মনে যা চায় সেই নামে সে ডাকুক, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, আমরা তাতে বিরক্ত হই না, আমাদের জন্য তা বরং ঠিকই আছে, আমাদের তা সহ্য করা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই; তার গলা থেকে যা বেরোয় তার মধ্যে গানের কিছু যদি থেকেও থাকে, সেটা একেবারে ন্যূনতম কিছুতে নামিয়ে আনা হয়; আমরা এক বিশেষ ধরনের গানের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখি, তবে সেই ঐতিহ্যকে আমাদের ওপরে সামান্যতম বোঝা হয়ে উঠতে দিই না কখনো।
কিন্তু আমাদের জনগণ, ওপরে বলা তাদের স্বভাবের কারণেই, জোসেফিনের কাছ থেকে এর চেয়েও বেশি কিছু পায়। তার গানের অনুষ্ঠানগুলোতে, বিশেষ করে বাতাসে যখন বিপদের গন্ধ, দেখা যায় যাদের বয়স একদম কম কেবল তাদেরই আগ্রহ আছে গায়িকার প্রতি; কেবল তারাই অবাক চোখে দেখে কীভাবে সে তার ঠোঁট কোঁচকায়, তার বেসামনের সুন্দর দাঁতগুলোর ফাঁক দিয়ে কীভাবে বাতাস বেরোয়, নিজের গলা থেকে বেরোনো শব্দ শুনে সে নিজেই কীভাবে ঘোরের মধ্যে চলে যায় আর এই ঘোরের ঘাড়ে চড়েই কীভাবে সে পৌঁছে যায় সাফল্যের আরো উঁচু শিখরে, তার নিজের কাছেই বিশ্বাস হতে চায় না এমন উঁচুতে; কিন্তু ততক্ষণে– পরিষ্কার দেখা যায় যে– শ্রোতাদের মূল অংশ সব যার যার মতো আছে। যুদ্ধের মধ্যেকার এসব ছোট বিরতির সময়ে একটা পুরো জাতি স্বপ্ন দেখা শুরু করে; ব্যাপারটা এমন যেন জাতির প্রতিটা একক সদস্যের হাত-পা একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, যেন যার যার ভেতরকার অস্থিরতা সবাই সরিয়ে রাখছে, যেন যে-কেউ শেষমেশ এত দিনে পারছে জাতির মহান উষ্ণ বিছানায় একটু হাত-পা ছড়িয়ে তার মনের খুশি মিটিয়ে শুতে। আর এসব স্বপ্নের মধ্যে থেকে থেকে ঢুকে পড়ে জোসেফিনের কিচমিচের শব্দ; সে এটাকে বলে মৃদু জলতরঙ্গ, আমরা বলি ধাক্কার শব্দ; কিন্তু যেটাই হহোক, এখানে এসেই গান তার আসল ঠিকানা খুঁজে পায়– অন্য কোথাও না, শুধু এখানেই– গানের প্রতীক্ষায় থাকা আসল মুহূর্তকে খুঁজে পায়; এটা তো সত্যি যে গানের মুহূর্ত সব সময় সহজে এমনি এমনি আসে না। এই গানের মধ্যে থাকে আমাদের অল্প দিনের শৈশবের একটু ছোঁয়া, যে আনন্দ আমরা হারিয়ে ফেলেছি আর যা আর কখনো ফিরে আসবে না তার একটু ছোঁয়া, কিন্তু আমাদের বর্তমানের ব্যস্ত জীবনের কিছুটা ছাপও, এই জীবনের দুজ্ঞেয় আনন্দ-ফুর্তির– যা অনড়-অটল বয়ে চলে এবং যার কোনো দিন অবসান ঘটে না –একটুখানি মিশ্রণও। আর এই সবকিছু গানের মধ্যে কোনো জোর ও জমকাল গলায় বলা হয় না, বলা হয় নরম, ফিসফিসে সুরে, সংগোপনে, কখনো কখনো একটু হেঁড়ে গলায়। মানছি যে তার এই গান একধরনের কিচমিচ মাত্র। হবেই বা না কেন? কিচমিচই তো আমাদের জাতির ভাষা; ব্যাপার হচ্ছে, কেউ কেউ সারা জীবন না-জেনেই, না-বুঝেই কিচমিচ করে যায়, আর এখানে এই কিচমিচ কিনা রোজকার জীবনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত, আর তা আমাদেরকেও পারে, সামান্য সময়ের জন্য হলেও, ওসব থেকে মুক্ত করতে। ওহ্ না, যেকোনো মূল্যেই হোক, এই গান আমাদের শোনা লাগবেই।
এখান থেকে নিয়ে জোসেফিনের জোর দাবি পর্যন্ত– অর্থাৎ এরকম সময়ে সে আমাদের দেয় নতুন শক্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি –কিন্তু অনেক লম্বা পথ। মানে, সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য; জোসেফিনের তোষামোদকারীদের জন্য নয়। অন্যকিছু হবেই বা কীভাবে?’- এমনটাই তারা বলে কেমন নির্লজ্জ ধৃষ্টতার সঙ্গে– ‘তার গানের অনুষ্ঠানের জন্য জড়ো হওয়া এই বিশাল ভিড়ের আর অন্য কী ব্যাখ্যা করা যায়, বিশেষ করে এমন আসন্ন বিপদের সময়েও এত জনসমাগম, আর যখন প্রায়ই দেখা যায় জোসেফিনের আসরে সবাই এভাবে জড়ো হয়েছে বলেই সময়মতো বিপদ এড়ানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা পর্যন্ত নেওয়া যাচ্ছে না? এই শেষ কথাটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, যদিও এর মধ্য দিয়ে জোসেফিনের খ্যাতির ব্যাখ্যা হয় না; বিশেষ করে, এর সঙ্গে আপনি যখন এটাও দেখবেন যে জোসেফিন– মানে যখন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে শক্ররা ঢুকে পড়েছে দর্শকদের মধ্যে, ভেঙে দিয়েছে ঐ জনসমাগম আর এর ফলে আমাদের অনেকেই মারা পড়েছে শত্রুর হাতে –এমন সময় আপনি যখন দেখবেন যে জোসেফিন, যে কিনা দায়ী এ সবকিছুর জন্য আর যার কিচমিচ শিসের কারণেই আসলে শত্রুরা হাজির হয়েছে, নিজে কিন্তু সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটা দখল করে নিল, সব সময়েই সে থাকল নিরাপদে আর পরে সে-ই প্রথম তার নিরাপত্তাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে পালিয়ে গেল খুব নীরবে আর প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সবাই এসবই জানে, তবু তারা পরেরবার আবার যখন জোসেফিন ঠিক করে যে সে উঠে দাঁড়াবে ও গান গাইবে, তখন আবার তারা দৌড়ে আসে, যেখানেই বা যে-সময়েই সে গান গাইতে মনস্থির করুক না কেন। এসব দেখে আপনার এমনটাই মনে হবে যে জোসেফিন যেন আইনের ঊর্ধ্বে, যেন যা খুশি তা ই সে করতে সক্ষম, কোনো ব্যাপারই না যদি তাতে করে আমাদের জাতি বিপদের মধ্যেও গিয়ে পড়ে; তার পরও সবকিছুর জন্য সে ঠিকই মাফ পেয়ে যাবে। যদি সত্যি সত্যিই এমন হয়ে থাকে, তাহলে জোসেফিনের দাবিগুলো তো ঠিকই আছে; প্রকৃত অর্থেই, জনগণ তাকে যে স্বাধীনতা দিয়েছে, এত বেশি স্বাধীনতা যা আর কাউকেই দেওয়া হয়নি আর যা আমাদের জাতির আইনকানুনের সঙ্গে কোনোভাবেই খাপ খায় না, স্বাধীনতার এ রকম লাগামছাড়া গতি দেখে আপনি বুঝে যাবেন যে আসলেই আমাদের জনগণ –ঠিক যেমন জোসেফিন দাবি করে– জোসেফিনকে বোঝে না, বরং তারা স্রেফ অসহায়ের মতো তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে, নিজেদের মনে করে তারা তার গানের যোগ্য নয়, আর আশা করে তাদের এই অযোগ্যতায় জোসেফিন যে কষ্টটা পাচ্ছে তা তারা পুষিয়ে দেবে নিজেদের নিশ্চিত মরিয়া আত্মত্যাগের মাধ্যমে– মানে, জোসেফিনের শিল্পীমন যেমনটা তাদের বোধগম্যতার বাইরে, ঠিক তেমন জোসেফিনকে ও তার ইচ্ছেগুলোকে তাদের আইনকানুনের অনেক বাইরে যেতে দিয়ে। যা-ই বলুন, কথাটা একটুও সত্যি না, হতে পারে খুঁটিনাটি বিষয়ে তারা জোসেফিনের কাছে আসলেই সহজে আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ তারা কারো কাছেই করে না, সুতরাং জোসেফিনের কাছেও না।
দীর্ঘদিন হয়ে গেছে, সম্ভবত তার শিল্পীজীবনের সেই শুরু থেকেই, যে জোসেফিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এই বলে– সে যেহেতু গান গায়, তাই সে অন্য কোনো কাজ করতে পারবে না; আমাদের বেঁচে থাকার যাবতীয় সংগ্রাম ও তার প্রতিদিনকার রুটিরুজির যাবতীয় উদ্বেগ থেকে তাকে রেহাই দিতে হবে আর– তার হিসেব মতে– তার ঐসব ঝামেলার ভার ঘাড়ে নিতে হবে আমাদের পুরো জাতিকে। যাদের কিনা অতি উৎসাহী হওয়ার রোগ আছে –এরকম অতি উৎসাহী চিড়িয়া আমাদের মধ্যে আসলেই রয়েছে –এমন যে-কেউ স্রেফ জোসেফিনের এই দাবির অস্বাভাবিকতা দেখে, এমন দাবি করার মতো মানসিক শক্তি কারো আছে এটা দেখে, ধরে নেবে তার দাবির যেন সহজাত ন্যায্যতা রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ এটা ধরলেও, জাতি হিসেবে আমরা কিন্তু তা ধরে নিইনি; আমরা শান্তভাবে জোসেফিনের অনুরোধে ‘না’ বলে দিয়েছি। আমরা যে এর পেছনের যুক্তিতর্ক খণ্ডনোর জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছি তা-ও নয়। জোসেফিন দাবি করে, উদাহরণস্বরূপ বলছি, যে কাজের চাপে তার গলার ক্ষতি হয়, সে আরো বলে কাজের চাপ যদিও গান গাওয়ার চাপের তুলনায় কিছুই না, তবু গান গাওয়ার পরে যে বিশ্রামটুকু তার দরকার হয়, নতুন করে গান গাওয়ার জন্য যে শক্তিটুকু তার দরকার হয়, তাকে গানের পাশাপাশি কাজও করতে হলে সেই বিশ্রাম সে আর পায় না, এর ফলে গান গেয়ে সে নিজেকে ক্লান্তিতে নিঃশেষ করে ফেলে ঠিকই, কিন্তু তবু, যেহেতু পরিস্থিতিটা এমন, গানের সর্বোচ্চ শিখরে ওঠা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। জনগণ তার এসব যুক্তি শোনে কিন্তু এসবে কোনো গা করে না। আমাদের এই জনগণ, আহ্ তাদের কত সহজে অভিভূত করা যায়, সেই তারাই আবার মাঝে মাঝে কিনা আদৌ কিছুতেই অভিভূত হয় না। তাদের প্রত্যাখ্যান মাঝেমধ্যে এত রূঢ় প্রত্যাখ্যান হয় যে এমনকি জোসেফিনও অবাক হয়ে যায়, তাকে জনগণের রায় মেনে নিতে হয়, নিজের কাজের ভাগটুকু নিজেকেই করতে হয়, যেটুকু ভালোভাবে সম্ভব গান গাইতে হয়– কিন্তু এ সবই অল্পখানিকের জন্য; কারণ তারপর আবার নতুন উদ্যম নিয়ে –এ কাজে তার উদ্যমের মনে হয় কোনো শেষ নেই– সে ফের ঝাঁপিয়ে পড়ে তার লড়াইতে।
তবে এখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে জোসেফিন যা বলছে, আক্ষরিক অর্থে সে আসলে তা চায় না। তার বুদ্ধি আছে; সে কাজ ভয় পায় না, অবশ্য কাজ ভয় পাওয়া ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে এমনিতেই থাকা অসম্ভব; তাকে কাজ করতে হবে না, তার এই আরজি যদি মানাও হতো, তার জীবন কিন্তু ঐ আগের মতোই থাকত, তার কাজ তার গানের জন্য একটুও কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াত না, তার গানও যে এর ফলে আরো বেশি সুন্দর কিছু হতো, তা-ও না –না, তার সত্যিকারের চাওয়া আসলে তার শিল্পের গণস্বীকৃতি, এমন এক স্বীকৃতি যা কিনা দ্ব্যর্থহীন, কাল বা যুগহীন, আজ পর্যন্ত দেওয়া যেকোনো স্বীকৃতির চেয়ে বড়। কিন্তু অন্য প্রায় সবকিছু তার মুঠোর মধ্যে থাকলেও দেখা যায় তার কাছে শুধু এই স্বীকৃতির ব্যাপারটা কখনো ধরা দেয় না। মনে হয় প্রথম থেকেই তার লড়াইয়ের জন্য ভিন্ন কোনো কৌশল নেওয়া উচিত ছিল, মনে হয় সে এত দিনে তার ভুল বুঝে গেছে, কিন্তু এখন আর তার পেছনে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই, যেকোনো ধরনের পিছু হটাই তার জন্য হয়ে যাবে নিজের প্রতি অসৎ হওয়া; এখন তার এই কাজ করতে না চাওয়ার দাবি নিয়েই হয় তাকে লড়তে হবে, নয়তো মরতে হবে।
সে যেমনটা বলে, তার যদি আসলেই ওরকম শত্রু থাকত, তারা তাহলে তার এই লড়াই দেখে মজাই পেত শুধু, কখনো তার বিরুদ্ধে একটা আঙুল তোলারও দরকার পড়ত না তাদের। কিন্তু তার তো কোনো শত্রু আসলে নেই; আর যদি ধরলাম মাঝে মধ্যে তাকে ছোটখাটো বিরোধিতার মুখে পড়তেও হয়, তবু আসলে তার এই লড়াইতে কেউ মজা পায় না কোনো। কীভাবে তারা মজা পাবে, যখন কিনা তারা আসলে এ ব্যাপারে বেছে নিয়েছে এক শীতল, নিরপেক্ষ মনোভঙ্গি– এমন এক ভঙ্গি যা অন্য কোনোকিছুর বেলায় দুর্লভ? আর কেউ একজন যদি নিজে ধরলাম জোসেফিনের দাবি ব্যক্তিগত পর্যায়ে মেনেও নিল, কিন্তু জাতি হিসেবে একদিন এভাবেই এ ধরনের দাবি তার বা অন্যদের ক্ষেত্রেও মানা লাগতে পারে, স্রেফ এই চিন্তা থেকেই তো আনন্দের সঙ্গে জোসেফিনের দাবি মেনে নেওয়া থেকে সে পিছিয়ে যাবে। কারণ এখানে, সত্যিকার অর্থে, জোসেফিনের দাবি প্রত্যাখ্যান করা বা তার দাবিটা আসলে কী, সেটা কোনো ব্যাপার নয়; ব্যাপার হচ্ছে জাতি হিসেবে আমরা যে আমাদেরই এক কমরেডের সামনে এরকম পাথুরে, দুর্ভেদ্য এক দেয়াল তুলে দিতে পারলাম– সেটা; আর এ ক্ষেত্রে দেয়ালটা আরো বেশি দুর্ভেদ্য কারণ এ সেই আমাদের একই কমরেড যাকে কিনা অন্য সবকিছুর বেলায় আমরা পিতৃসুলভ –আসলে পিতৃসুলভ বললেও কম বলা হবে –এক বিনয়ন যত্নের সঙ্গে দেখেছি।
আসুন, এখানে আমরা জাতির জায়গায় কোনো একক ব্যক্তির কথা চিন্তা করি: আপনি ধরে নিতে পারেন যে এই লোকটি সব সময় জোসেফিনের বশ্যতা স্বীকার করে নিচ্ছে শুধু তার বুকের ভেতরে এক বিরামহীন, জ্বলন্ত বিশ্বাস থেকে যে এভাবেই একদিন এই সব বশ্যতা স্বীকারের শেষমেশ ইতি ঘটবে; সে অতিমানবিক পরিমাণে জোসেফিনকে ছাড় দিচ্ছে এই দৃঢ় বিশ্বাস থেকেই যে অবশেষে এই সমস্ত ছাড়ের একটা বিহিব্যবস্থা হবে একদিন; প্রকৃত অর্থে, দরকারের চেয়েও বেশি ছাড় সে দিয়ে চলেছে স্রেফ যাতে করে সেই দিনটা একটু তাড়াতাড়িই আসে, স্রেফ জোসেফিন যেন আরো আত্নাদ পায় এবং আরো আরো বেশি চাইতে উদ্বুদ্ধ হয়, আর যেন শেষমেশ একদিন জোসেফিন তার এই শেষ দাবিটা করে বসে, আর তখন যেন সে, আগে থেকেই ভালো রকম তৈরি হয়ে আছে। বলেই, সোজা, সংক্ষেপে তার চূড়ান্ত ‘না’-টা জোসেফিনকে বলে দিতে পারে। হুঁ, কিন্তু সত্য আসলে এমন নয়, একেবারেই না; আমাদের জনগণের এত কূটকৌশলের দরকার পড়ে না, আর তা ছাড়া জোসেফিনের ওপর তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা যথেষ্ট আন্তরিক এবং প্রমাণিত, আর এমনিতেই জোসেফিনের দাবি এতই বাড়াবাড়ি রকমের যে, কোনো সাধারণ বাচ্চার পক্ষেও তাকে বলা সম্ভব এর পরিণতি কী হবে; তা সত্ত্বেও, জনগণের ওপরে-বলা ধারণাগুলো যে পরিস্থিতি বিষয়ে জোসেফিনের নিজের ধারণাকে কিছুটা প্রভাবিত করে তা বোঝাই যায়– ফলে, শেষমেশ, তার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কষ্টের সঙ্গে আরো যোগ হয় নতুন তিক্ততা।
কিন্তু সে জনগণের এসব ধারণা বা অনুমান ঠিকই বিবেচনায় রাখলেও, এসবকে সে তার লড়াইয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেয় না। ইদানীং তার এই অবস্থান আগের চেয়ে আরো তীব্র হয়েছে; আগে সে যেখানে কিনা কথা দিয়ে লড়াই চালাত, আজকাল সেখানে সে অন্য অস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করেছে, এমন সব অস্ত্র যা তার ধারণায় অনেক বেশি কার্যকরী, কিন্তু আমাদের হিসেবে তার জন্য আরো বেশি বিপজ্জনক।
আমাদের মধ্য কেউ কেউ আছে যাদের বিশ্বাস, জোসেফিন যে আজকাল এরকম নাছোড়বান্দা হয়ে উঠেছে তার কারণ, সে বুঝতে পারছে তার বয়স পড়ে আসছে, তার কণ্ঠের জোর কমে আসা শুরু হয়েছে, অতএব স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে শেষ লড়াইটা চালানোর তার এখনই সময়। আমি এটা বিশ্বাস করি না। যদি এটা সত্য হয় তাহলে জোসেফিন আর জোসেফিন থাকে না। তার জন্য বুড়ি হয়ে যাওয়া কিংবা গলার জোর কমে যাওয়া, এসব কথা প্রযোজ্যই না। সে যখন কোনোকিছু চায়, তাতে বাইরের পরিস্থিতির কোনো ভূমিকা থাকে না, তার ভেতরকার যুক্তি থেকেই সে তা চায়। সবচেয়ে উঁচু রাজমুকুটের পেছনে সে এ কারণে ছোটে না যে মুকুটটা এখন একটু নিচে ঝুলে আছে, বরং এ কারণে যে ওটা সবচেয়ে উঁচুতে; তার যদি ক্ষমতা থাকত, সে মুকুটটা বরং আরো বেশি উপরেই ঝোলাত।
বাহ্যিক বাধাগুলোর প্রতি তার এই ঘৃণা কিন্তু তাকে লড়াইয়ের সবচেয়ে জঘন্য পথগুলো বেছে নেওয়া থেকে নিরস্ত করেনি। তার অধিকারগুলো তার কাছে সব রকম প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, তাই কীভাবে সে সেই অধিকারগুলো আদায় করে নিচ্ছে, তাতে কী যায় আসে; বিশেষ করে সে যখন বিশ্বাস করে যে এই পৃথিবীতে ভালো পথগুলো বেছে নিলে ব্যর্থতা অনিবার্য। মনে হয়, আসলে এ কারণেই সে তার গানসংক্রান্ত ন্যায়বিচার পাওয়ার লড়াই থেকে সরে গেল অন্য এক বিষয়ের লড়াইতে, যেটার গুরুত্ব তার কাছে অতি সামান্য। তার অনুসারীরা কথা ছড়িয়ে দিল যে জোসেফিন বলেছে সে এমনভাবে গান গাইতে পুরোপুরি সক্ষম যাতে আমাদের জাতির সব স্তরের সবাই, এমনকি শত্রুপক্ষের শেষ সীমানা পর্যন্ত সবাই, সত্যিকারের আনন্দ পেতে পারে– আরো বড় কথা, এই সত্যিকারের আনন্দ জনগণের মানদণ্ডে সত্যিকারের আনন্দ না, কারণ জনগণ তো বলেই যে তারা সব সময়েই জোসেফিনের গান শুনে আনন্দ পায়, বরং তা জোসেফিনের নিজস্ব মানদণ্ডে সত্যিকারের আনন্দ। কিন্তু– সে আরো যোগ করে –যেহেতু তার পক্ষে যা মহান তা নিয়ে মিথ্যা বলা সম্ভব নয়, আবার যা অশ্লীল তার তোষণও সম্ভব নয়, তাই তার গান বরং যা আছে তা-ই থাকবে। তবে যেই-না বিষয়টা তার কাজকর্ম করা থেকে রেহাই পাওয়ার লড়াইসংক্রান্ত হয়ে দাঁড়ায়, দেখা যায় সেটা আলাদা ব্যাপার; স্বাভাবিক যে এ সময়েও সে আসলে তার গান নিয়েই কথা বলছে, কিন্তু এখানে সে তার গানসংক্রান্ত দামি অস্ত্রের সরাসরি ব্যবহার করছে না, তার মানে লড়াইয়ের যে পন্থাই সে নিক না কেন, সবই তার হিসেবে হালাল পন্থা।
উদাহরণস্বরূপ, গুজব ছড়ানো হলো যে যদি জোসেফিনের অনুরোধ রাখা না হয়, তাহলে সে তার গানের আলংকারিক অংশগুলো ছোট করে ফেলবে। গানের আলংকারিক অংশ কী সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই, আমি তার গানে কোনো আলংকারিক কিছু কখনো দেখিওনি । কিন্তু জোসেফিন নাকি তার আলংকারিক অংশগুলো কমিয়ে আনবে; আপাতত ওগুলো সে পুরো বাদ দেবে না, স্রেফ কমিয়ে আনবে। লোকে বলে সে তার হুমকি বাস্তবে রূপ দিয়েছে, যদিও আমার কথা যদি বলেন, আমি কিন্তু তার আগের গানের থেকে কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাইনি। সবাই মিলে যে জনসাধারণ তারা আগের মতোই তার গান শুনছে, আলংকারিক অংশ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি কেউ, তার দাবির বিষয়ে অন্যদের মনোভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঘটনাক্রমে এটাও অস্বীকার করা যাবে না জোসেফিন, যার ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিশেষ একধরনের মাধুর্য সত্যিই আছে, কখনো সখননা সে তার চিন্তার মধ্যেও কিছুটা একই মাধুর্যের পরিচয় দেয়। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, সে-ই ওই গানের অনুষ্ঠানের পরে ঘোষণা করল– যেন তার আলংকারিক অংশসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত একটু বেশি কঠোর বা বেশি আচমকা হয়ে গেছে –যে, আগামীবার সে আরো একবার আলংকারিক অংশগুলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গাইবে। কিন্তু পরেরবার সংগীতানুষ্ঠানের পরে সে আবার তার মন বদলে ফেলল, বলল, আলংকারিক অংশের পুরোটা গাওয়ার আর কোনো দিন প্রশ্নই আসে না, আর যদ্দিন না সবাই জোসেফিনের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ওই আলংকারিক অংশগুলো এখন থেকে পুরো বাদ। হাহ্, তার এইসব ঘোষণা, এইসব সিদ্ধান্ত, এইসব উল্টো-সিদ্ধান্ত জনগণ একদম কানেই তুলল না, ঠিক যেভাবে কোনো বাচ্চার বকবকানি কানে নেয় না বয়স্ক কেউ, যেভাবে সেই বয়স্ক লোকটা বাচ্চার ভালো চায় ঠিকই, তবে স্রেফ দূরের থেকে।
যা-ই হোক, জোসেফিন ক্ষান্ত দেয় না। এই যেমন সেদিন, উদাহরণস্বরূপ, সে। দাবি করল কাজ করতে গিয়ে সে তার পায়ে ব্যথা পেয়েছে, তাই এখন গান গাওয়ার সময় দাঁড়ানোটা তার পক্ষে কঠিন; কিন্তু সে যেহেতু কেবল দাঁড়িয়েই গান গাইতে পারে, তাই সত্যিকার অর্থে তার গানগুলো ছোট করে আনা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। যদিও সে এরপরে খুঁড়িয়ে চলা শুরু করল, তার সমর্থকেরা তাকে হাঁটতে সাহায্য করে যাচ্ছে, কেউই বিশ্বাস করল না সে সত্যিকারের আহত। আপনি যদি এমনকি বিশ্বাসও করেন যে জোসেফিনের খুদে শরীরটা সত্যি অস্বাভাবিক রকমের স্পর্শকাতর, তার পরও এটা তো সত্যি যে আমরা পরিশ্রমী জাতি আর জোসেফিন আমাদেরই একজন; সেই আমরা যদি প্রতিবার একটু আঁচড় খেয়েই খোঁড়াতে শুরু করে দিই, তাহলে তো আমাদের সবাই সারা জীবন খোঁড়াতেই থাকবে। তার পরও সে যদি পঙ্গুদের মতো অন্যের সাহায্য নিয়ে চলাফেরার সিদ্ধান্ত নেয়, সে যদি এমনকি বরাবরের চেয়ে বেশি ঘন ঘন আমাদের সামনে হাজির হয় তার এই শোচনীয় হালে, আমাদের জনগণ তবু আগের মতোই কৃতজ্ঞচিত্তে এবং মুগ্ধতা নিয়ে এখনো তার গান শুনে যায়; শুধু তার ওই গান ছোট করে আনা-টানা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিরাট হই-হট্টগোল থাকে না।
কিন্তু তার পক্ষে তো আর সারা জীবন খুঁড়িয়ে চলা সম্ভব নয়, তাই সে আবিষ্কার করল নতুন এক জিনিস– সে ভান করল পরিশ্রান্ত হওয়ার, খুব মনমরা হওয়ার, মূৰ্ছা যাবে যাবে এমন অবস্থার। অতএব এবার আমরা সংগীতানুষ্ঠানের পাশাপাশি তার নাট্যাভিনয়ও দেখা শুরু করলাম। জোসেফিনের পেছন পেছন আমরা দেখছি তার দলের সমর্থকদের, তাকে কাকুতি-মিনতি জানাচ্ছে গান গাওয়ার জন্য। গাইতে পারলে সে খুশিই হতো, কিন্তু তার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা তাকে সান্তনা দিচ্ছে, তোষামোদের আদর-সোহাগ জানাচ্ছে, তাকে পারলে প্রায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে গান গাওয়ার সেই বাছাই করা জায়গাটায়। শেষমেশ, ব্যাখ্যার অযোগ্য এক চোখের পানি ফেলে, সে হার মানল; কিন্তু তারপর সে যখন গাওয়ার চেষ্টা করল, স্পষ্ট দেখা গেল তার গান গাওয়ার ক্ষমতার একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে সে, একদম দুর্বল, বরাবরের মতো তার হাতগুলো দুপাশে ছড়িয়ে গেল না, বরং তার শরীরের দুদিকে ঝুলতে লাগল লকলক করে, দেখে মনে হলো হাতগুলো যেন আকারে একটু ছোট– এবার যখন সে গাওয়া শুরু করতে মনস্থির করল, না, পারল না, আদৌ পারল না, তার মাথার একটা অনীহাভরা আঁকি দেখেই আমরা সব বুঝে ফেললাম, আর তারপর আমাদের চোখের সামনেই সে পড়ে গেল ধপ করে। কিন্তু দেখা গেল আবার সে উঠে দাঁড়িয়েছে, গাইতে শুরু করেছে, আমার হিসাবে আগের থেকে সেই গানে তেমন কোনো পার্থক্য নেই; সম্ভবত সূক্ষ্ম পার্থক্য সবচেয়ে ভালোভাবে ধরতে পারে এমন কোনো কান হলে এটা ধরতে পারত যে, তার গানে আবেগ বরং সামান্য কিছুটা বেড়েছে, যার ফলে তার গানের আবেদনও যেন। বেড়েছে সামান্য। আর অনুষ্ঠান শেষে দেখা গেল, আগের চেয়ে সে বরং আরো কম ক্লান্ত; একটা দৃঢ় পদক্ষেপে– তার দ্রুত, হন্তদন্ত হয়ে ছোটাকে যদি আদৌ পদক্ষেপ বলা যায়– সে বেরিয়ে চলে গেল, তার কোনো সমর্থকেরই কোনো সাহায্য না নিয়ে, আর শীতল চোখে ভিড়ের সবাইকে মাপতে মাপতে– ভয় ও শ্রদ্ধা মেশানো এক ভঙ্গিতে ভিড়ের সবাই সরে তাকে পথ করে দিল।
অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্ত এই ছিল অবস্থা, কিন্তু সর্বশেষ সংবাদ হচ্ছে: একবার, সবাই যখন অনুষ্ঠানের ওখানে তার গানের অপেক্ষায়, তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। শুধু যে তার সমর্থকেরা তাকে খুঁজতে লাগল তা-ই নয়, অন্য অনেকেও খোঁজায় যোগ দিল, কিন্তু সবই বৃথা; জোসেফিন অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে গান গাইতে রাজি নয়, গান গাওয়ার কোনো আমন্ত্রণও সে আর গ্রহণ করবে না, এই দফা সে আমাদের পুরোপুরি ছেড়ে চলে গেছে।
এটা ভাবতেও অদ্ভুত লাগে যে জোসেফিন কীভাবে হিসাবে মহা ভুল করে, চালাক এই চিড়িয়া এতটাই কিনা হিসাবে গোলমাল করে ফেলে যে মনে হয় সে আদৌ কোনো হিসাবই করেনি, আর নিয়তি কেবল তাকে সামনের দিকে ধেয়ে নিয়ে গেছে, আর আমাদের পৃথিবীতে নিয়তি তো কখনোই দুঃখের বাদে অন্য কিছু হয় না। নিজের থেকেই সে গান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে, নিজের থেকেই সে ধ্বংস করেছে আমাদের হৃদয়-মন জয় করে নেওয়া তার সেই ক্ষমতা। সে যদি আমাদের মনকে এত কমই চেনে, তাহলে সে আসলে সত্যি ঐ ক্ষমতা অর্জন করেছিল কীভাবে? সে নিজেকে লুকিয়ে রাখল এবং গান গাইতে অসম্মতি জানিয়ে দিল; তবে ইতোমধ্যে আমাদের জাতি কিন্তু শান্তভাবেই, কোনো চোখে পড়ার মতো হতাশা না দেখিয়ে, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও কর্তৃত্বপরায়ণ এক জাতি হিসেবে –যারা সত্যি বলতে, দেখতে অন্য রকম লাগলেও, বাস্তবে শুধু কাউকে দিতেই শিখেছে, নিতে শেখেনি, এমনকি জোসেফিনের কাছ থেকেও না– বরাবরের মতো, নিজের পথে, সামনে চলতে লাগল।
তবে জোসেফিনের পথ শুধু নিচের দিকেই নামতে পারে। শিগগিরই ঐ দিন আসবে যেদিন তার শেষ কিচমিচ শোনা যাবে আর তা মিলিয়েও যাবে। আমাদের জাতির অন্তবিহীন ইতিহাসের সে এক ছোট অধ্যায় মাত্র, আর জনগণ তার ক্ষতি কাটিয়েও উঠবে। এমন না যে সেটা আমাদের জন্য সহজ হবে; চূড়ান্ত নীরবতার মধ্যে আমাদের জনসমাগম নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে না। কিন্তু যখন জোসেফিন আমাদের মধ্যে ছিল তখনো কি জনসমাগমগুলো নীরবই ছিল না? তার সত্যিকারের কিচমিচ কি তার কিচমিচের স্মৃতি যা থাকবে তার চেয়ে বেশি উঁচু লয়ের আর বেশি প্রাণবন্ত কিছু ছিল কখনো? তার জীবদ্দশায়ও কি আসলে তা স্রেফ কোনো স্মৃতির চেয়ে বেশি কিছু ছিল? ব্যাপারটা কি বরং এমন না যে আমাদের জনগণ তাদের প্রজ্ঞা থেকেই, জোসেফিনের গানের অমন উঁচু মূল্যায়ন করেছিল এজন্যই যে তারা জানত সেফ তেমনটা করলেই তার গানের কোনো দিন বিলীন হওয়ার ব্যাপার বলে কিছু থাকবে না?
সুতরাং, মনে হয়, সব সত্ত্বেও আমরা তার অভাব খুব বেশি একটা বোধ করব না, অন্যদিকে যখন কিনা জোসেফিন পার্থিব যন্ত্রণাগুলো থেকে –যেগুলো অবশ্য তার হিসেবে শুধু কিছু বাছাই-করা লোকেরই ভাগ্যে জোটে– মুক্ত হয়ে খুশিমনে হারিয়ে যাবে আমাদের জাতির বীরদের অগণন ভিড়ের মধ্যে, আর শিগগিরই, যেহেতু আমরা ইতিহাসে বিশ্বাস করি না, তার ভাগ্যে জুটবে তার সমস্ত ভাই-বেরাদারের সঙ্গে মিলে বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার এক আরো উঁচু কোনো মুক্তি।
শেষ গল্পটা অসাধারণ অন্যরকম