৫
শিবালয় শহরের কর্তাব্যক্তিদের হেডকোয়ার্টার টিকেন্দ্রনগরে। যাঁর নামে নগরের নামকরণ, তাঁকে ইংরেজরা ফাঁসিতে লটকে দিয়েছিল ১৮৯১ সালে। তাঁর অপরাধ, বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে তিনি হেরে যান। মণিপুরের রাজা কীর্তিচন্দ্রের ছেলে বলেও তাঁকে খাতির করেনি পাষণ্ড ইংরেজ শাসক। টিকেন্দ্রনগরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে তাঁর মর্মর-মূর্তি। বছরের একবার ফুলের পাহাড় জমে সেখানে। তাঁর মৃত্যুদিবসে।
পুলিশপ্রধান সুরেশ সাইকিয়ার ঘরে ঢুকলেন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর বিশু বোস, ‘মাধবী লাহা নামে কাউকে চেনেন?’
‘কেন বলুন তো?’
‘এইমাত্র ফোন করেছিলেন শিবালয় টাউন থেকে। ভদ্রমহিলা ডাক্তার?’
‘হ্যাঁ। খুব পপুলার।’
‘মাথা কি খারাপ?’
‘কেন?’
‘শিবালয় টাউনে নাকি কেউ বেঁচে নেই—উনি আর ওঁর বোন ছাড়া।’
জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল মাধবী আর পরি। বেরিয়ে গেল জানলা দিয়েই।
রাত আরও শীতল হয়েছে। বাতাসের গোঙানি আবার বেড়েছে।
মাধবী আগে গেল নিজের বাড়ি। দুটো কোট নিয়েই বেরিয়ে এল বাইরে। গায়ে দিয়ে চলে এল পুলিশ অফিসের সামনে। কাঠের বেঞ্চি রয়েছে রাস্তার পাশে। বসল সেখানে। এখন শুধু প্রতীক্ষা। টিকেন্দ্ৰনগর থেকে আসুক পুলিশবাহিনী।
‘কতক্ষণ লাগবে, দিদি?’ পরির প্রশ্ন।
‘পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো বটেই। বড় জোর এক ঘণ্টা। তিরিশ মাইল পথ—চড়াই-উৎরাই—নিজেদের রেডি করা… সময় তো লাগবেই।’
‘ব্যানার্জীবাড়িতে কে টেলিফোন করেছিল?’
‘কেউ না।’
‘তুমি তো কান পেতে শুনছিলে?’
‘শুনছিলাম না—কান খাড়া করেছিলাম।’
‘তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে?’
‘ভয় পেয়েছিলাম কোনও আওয়াজ না পেয়ে। নো সাউণ্ড।’
কী বলবে মাধবী? ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টের পেয়েছিল, একটা অপার্থিব সত্তা হাজির রয়েছে টেলিফোনের অপর প্রান্তে। পরিকে তা জানিয়ে লাভ কী?
খসখস করে একটা কাগজ উড়ে গেল রাস্তার ওপর দিয়ে। চাঁদের মুখ ঢেকে গেল কালো মেঘে।
ঝপ করে নিভে গেল শিবালয় টাউনের সমস্ত আলো।
লাল এমার্জেন্সি ফ্ল্যাশ দিয়ে যাচ্ছে তিনখানা পুলিশ গাড়ির মাথায়। ঝড়ের বেগে ধেয়ে যাচ্ছে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে—শিবালয় শহরের দিকে। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। মাথার ওপর চাঁদ।
প্রথম ধাবমান গাড়িটা চালাচ্ছেন বিশু বোস। তাঁর পাশেই বসে রয়েছেন সুরেশ সাইকিয়া।
দ্বিতীয় গাড়িটায় বসে আছেন টম ডিক্সন। পুলিশ সার্জেন্ট। নরাকৃতি দানব বললেই চলে। গুলি চালায় নির্ভুল। কিন্তু তার একটা দোষ আছে। ক্ষণিকের দুর্বলতা যখন তাকে পেয়ে বসে তখন সে খুন করতে চায় না, নিজে খুন হয়ে যাবে জেনেও।
একদল নরঘাতক শিবালয় শহরকে শ্মশান বানিয়েছে শুনে সুরেশ সাইকিয়া সঙ্গে নিয়েছেন টম ডিক্সনকে। এবং, এই শীতেও ভয়ে ঘামছে টম ডিক্সন।
গোটা শিবালয় শহরের সমস্ত আলো নিভে গেল। অকস্মাৎ কমে এসেছে হাওয়ার বেগ। কালো মেঘ সরে গেছে চাঁদের মুখ থেকে।
বুক ধড়াস ধড়াস করছে মাধবীর। তাকিয়েছিল পেছন দিকে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলেছিল পেছনে তাকাতে।
পুলিশ ফাঁড়ি আর তার পাশের কফি হাউসের মাঝখানের জায়গাটা বড় অন্ধকার। গাছপাতায় ছাওয়া যেন একটা সুড়ঙ্গ। ঠিক যেমনটি দেখে এসেছিল বেকারিতে। অন্ধকারের আতঙ্ক যেন গুঁড়ি মেরে বসে আছে ওইখানে।
বেঞ্চি থেকে ছিটকে গেছিল মাধবী। টেনে নিয়ে গেছিল পরিকে রাস্তার ঠিক মাঝখানে। এখানে চাঁদের আলো ফুটফুট করছে।
আচমকা জ্বলে উঠল রাস্তার সব আলো। বিদ্যুৎ-দ্যুতিতে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে না যেতেই ঝপ করে নিভে গেল আবার। সেই অন্ধকার। এখন আরও উৎকট।
একটা বিকট হাহাকার ভেসে গেল গোটা শহরটা ওপর দিয়ে—বুকচেরা এমন আর্তনাদ কোনও মানুষের গলা দিয়ে বেরতে পারে না। পরক্ষণেই সব নিস্তব্ধ। আবার সেই বিকট গোঙানি। নৈঃশব্দ্য।
এবার শব্দটাকে চিনেছে মাধবী। সাইরেন বাজছে। কখনও পুলিশ ফাঁড়িতে, কখনও দমকল-হাউসে। পরের মুহূর্তেই শোনা গেল ঢং… ঢং… ঢং… আওয়াজ! যেন, পাগলা-ঘণ্টি বাজছে। শিবমন্দিরে দড়ি ধরে টানা হচ্ছে… হচ্ছে… হচ্ছে…
বন্ধ দরজা আর জানলায় আছড়ে পড়ছে সেই শব্দ… মাথা কুটে ফিরে যাচ্ছে… শিবালয় অ্যাভিনিউ দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে…
আবার বেজে উঠল সাইরেন… থামতে না থামতেই ঘণ্টাধ্বনি… তারপরেই
আবার সাইরেন… আবার ঘণ্টার সঙ্কেত…
সঙ্কেত! আসন্ন নতুন বিপর্যয়ের ছন্দময় সঙ্কেত!
দ্বিতীয় গাড়িটা চালাচ্ছে উজাগর সিং। ছিল আর্মিতে—এখন পুলিশে। চোখ শীতল। শরীর যেন পাথর কুঁদে তৈরি। রক্তে ডিসিপ্লিন।
উজাগরের পাশে গা এলিয়ে বসে রমেশ থাপা। চোখ মুখ শরীর কণ্ঠস্বর—সবই স্থূল। মোটা দাগের মানুষ। কথাবার্তা রুক্ষ।
ঝলসে উঠল রাস্তার ধারের মাইল পোস্ট হেডলাইটের ঘুরে যাওয়া আলোয়। মোড় নিয়েছে সামনের গাড়িটাও। আর মাত্র দু’মাইল বাকি…
তৃতীয় গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল এইখানেই, রাস্তা জুড়ে, প্ল্যানমাফিক। শহর থেকে যেন কেউ বেরতে না পারে।
এগিয়ে গেল সামনের গাড়ি দুটো।
ঘণ্টাধ্বনি আর সাইরেনের আর্তনাদ… ঘণ্টাধ্বনি আর সাইরেনের হাহাকার। তালে তাল মিলিয়ে আচমকা জ্বলে উঠছে সমস্ত আলো… নিভে যাচ্ছে পরক্ষণেই… আবার জ্বলছে… আবার নিবছে…
মাথা ঘুরছে দুই বোনের… গোটা শহরটা বুঝি মাতাল হয়ে গেছে… উন্মাদ হয়ে গেছে… আওয়াজ… আলো… অন্ধকার… পায়ে পা মিলিয়ে রক্ত জমানো লাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাজিক রচনা করে চলেছে…
রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে দুই বোন। হঠাৎ সব স্তব্ধ হয়ে গেল। আওয়াজের স্রোত দূর হতে দূরে মিলিয়ে গেল। প্রতিধ্বনিও আর ফিরে আসছে না। শুধু জ্বলছে আলোর মালা রাস্তায়, ঘরে ঘরে—আর নিবছে না।
কবরখানার নৈঃশব্দ্যের মাঝে জাগ্রত হল একটা চাপা গজরানি… দূর থেকে এগিয়ে আসছে… আসছে…
দিদির হাত চেপে ধরেছে পরি। রিভলভার তুলে ধরেছে মাধবী শব্দ লক্ষ করে।
তারপরেই দেখা গেল শব্দের উৎস। রাস্তা বেয়ে উঠে আসছে দুটো গাড়ি। পুলিশের গাড়ি। মাথায় জ্বলছে আর নিবছে লাল আলো।
ওদের সামনেই ব্রেক কষল গাড়ি দুটো। টপাটপ নেমে দাঁড়াল ছ’জন পুরুষ। ঘিরে
ধরল দুই বোনকে। কেউ কথা বলছে না। শুধু চেয়ে রয়েছে। দেখছে।
দেখছে মাধবীও। ওর মন বলছে, এরা কেউ জ্যান্ত ফিরে যাবে না। কেউ না।
সুমন্ত সেনের ডেডবডির পাশে এক হাঁটু পেতে বসে পড়েছিলেন সুরেশ সাইকিয়া। আঙুল ছোঁয়ালেন নীলচে-কালচে মুখে। অবাক হলেন।
‘চামড়া তো এখনও গরম।’
‘খুব বেশি আগে মারা যাননি,’ মাধবীর মন্তব্য।
‘কিন্তু মাত্র ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে কোনও বডি এভাবে ফুলে উঠতে পারে না। ডিসকালার্ড হয়ে যেতে পারে না,’ বললেন বিশু বোস।
‘এই শহরের সমস্ত ডেডবডির অবস্থা ঠিক এইরকম,’ মাধবীর শক্ত জবাব।
ডেডবডি উলটে দিলেন সুরেশ সাইকিয়া। পিঠে নেই কোনও ক্ষত চিহ্ন।
মাথার খুলির পেছনে চোট লাগেনি তো? আছড়ে পড়ার সময়ে খুলি ফেটে যায়নি তো? চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে খুলি পরখ করলেন সুরেশ সাইকিয়া। চোটের চিহ্ন নেই। খুলি অক্ষত।
উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘বেকারিতে চলুন। দল বেঁধে। এখানে কারও থাকার দরকার নেই।’
আহার্য-নিবাসে ঢুকল সবাই সামনের দরজা দিয়ে—পৌঁছোল পেছনের রান্নাঘরে। একতাল ময়দার ওপর বেলুন ধরে রয়েছে শুধু দুটো হাত—কব্জি পর্যন্ত। উনুনের মধ্যে রয়েছে শুধু দুটো মুণ্ডু। রক্ত নেই কোত্থাও। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে সবাই। অস্ফুটকণ্ঠে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কশাই-ও এভাবে জবাই করতে পারে না। বডিগুলো গেল কোথায়?’
শুরু হল খোঁজা। কাবার্ডে, ড্রয়ারে, বাথরুমে, ফ্রিজে। কোথাও পাওয়া গেল না রজনী আর মনোরমা শিকদারের শরীরের বাদবাকি অংশ। বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ডক্টর লাহা, চলুন সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতন জায়গাটায়—যেখানে ভয় পেয়েছিলেন।’
পুরো দলটাই বেরিয়ে এল বাইরে। কেউ আর কাউকে ছেড়ে থাকতে চাইছে
না। উৎকট এই দৃশ্য শিহরিত করেছে প্রত্যেককেই।
বাড়ির বাইরে সেই কাঠের গেট, ওপাশে একটা দোকান। মাঝে আলোহীন গলিপথ।
গেট খুলে ফেললেন সুরেশ সাইকিয়া। এখন তাঁর এক হাতে টর্চলাইট, আর এক হাতে রিভলভার।
ফিসফিস করে মাধবী বললে পেছন থেকে, ‘পরি বলছিল, কে যেন ওঁত পেতে রয়েছে দেওয়াল ঘেঁষে। আমার মনে হয়েছিল, তারা রয়েছে মাথার ওপরে মাচায়।’
কাঠের গেট খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ নিস্তব্ধ গলিপথে প্রতিধ্বনি জাগিয়েছিল। তা মিলিয়ে যেতেই জাগ্রত হল সুরেশ সাইকিয়ার বুটজুতোর শব্দ। অকুতোভয় পদক্ষেপে প্রবেশ করছেন অন্ধকার বিবরে। টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে গলিপথের মাঝ পর্যন্ত। আলো ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে পাশের দেওয়াল আর মাথার মাচার ওপর দিয়ে। কংক্রিটের দেওয়ালে পোকামাকড় পর্যন্ত নেই।
রিভলভার তুলে ধরার দরকার ছিল না—গলিপথের মাঝবরাবর গিয়ে ভেবেছিলেন সুরেশ সাইকিয়া। আর ঠিক তখনই তাঁর শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। স্পষ্ট মনে হল, তিনি আর একা নন।
দাঁড়িয়ে গেলেন সেইখানেই। টর্চ ঘুরিয়ে ফের খুঁটিয়ে দেখলেন দেওয়াল আর সিলিং। পা টিপে টিপে হয়তো কেউ এসেছে পেছনে। কিন্তু কেউ নেই। গলিপথের সামনে আর পেছনে শুধু অন্ধকার চমকে চমকে উঠছে আলোর ঝলকানিতে। আর চমকে উঠছেন তিনি নিজে। কেউ নেই, অথচ মনে হচ্ছে, কে যেন তাঁকে দেখছে। বৈরীচোখে নজরে রেখেছে।
টর্চের আলোয় কী যেন চকচক করে উঠল মেঝেতে। পলকের জন্যে। মেঝের এই জায়গায় রয়েছে একটা ড্রেনের ঝাঁঝরি। লম্বায়-চওড়ায় ফুটখানেক। এগিয়ে গিয়ে টর্চ ফোকাস করলেন ভেতরে। দেড়ফুট ব্যাসের একটা ড্রেনপাইপ নেমে গেছে নিচে, জল নেই। শুকনো। চকচকে জিনিসটা তাহলে জল নয়।
ইঁদুর? শিবালয় শহরে পোকামাকড় ইঁদুর-ছুঁচো দমন করা হয় কঠোর হাতে। এ শহর বড়লোকদের শহর। দু-একটা ইঁদুর হয়তো থেকে গেছে।
নিশ্চিত হয়ে গলির শেষ পর্যন্ত হেঁটে গেলেন। ফিরেও এলেন।
‘কী দেখলেন?’ বিশু বোসের প্রশ্ন।
গেট টেনে বন্ধ করে দিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘চকচকে কী যেন দেখলাম ড্রেনের মধ্যে। আর মনে হল, কারা যেন দেখছে আমাকে—অথচ কেউ নেই।’
‘শিকদার-ফ্যামিলিকে যারা কেটেছে তারা নিশ্চয় ড্রেনের বাসিন্দা নয়।’
‘তা তো বটেই। এবার চলুন ব্যারিকেড দেওয়া ঘরে।’
জোড়া খুনের বাড়ি যে রাস্তায়, সেই রাস্তায় ঢোকবার আগে থমকে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া। বললেন, ‘ও বাড়িতে ঢোকার আগে আগের বাড়িগুলো দেখতে যাব। একসঙ্গে নয়—দুটো দল হয়ে। রাস্তার একপাশ ধরে এগোব। পাশাপাশি দুটো বাড়িতে ঢুকবে দুটো দল। কেউ কারও কাছ থেকে বেশি তফাতে যাবে না, চোখের আড়াল হবে না—কক্ষনো নয়। যদি কিছু ঘটে, যদি কিছু দেখা যায়, দু-তিনবার ফায়ার করলেই পাশের বাড়ি থেকে সেই আওয়াজ শোনা যাবে, তখন দৌড়ে যাওয়া যাবে। প্রথম দলে থাকব আমি, বিশু বোস, ডক্টর লাহা, আর তুমি—পরি। দ্বিতীয় দলে লিডার হবেন উজাগর সিং। মেক ইট এ পয়েন্ট—দলছাড়া হবেন না, কোনও অবস্থাতেই নয়।’
মাধবী বললে, ‘নতুন ডেডবডি যদি দেখা যায়, কাইন্ডলি লক্ষ করবেন—চোখ কান নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে কি না।’
বিশু বোস বললেন, ‘রোগে মরলে যা হয়? কিন্তু কোনও রোগেই মুণ্ড বা হাত কাটতে পারে না।’
‘রোগ যখন মানুষকে উন্মাদ করে দেয় তখন সেই উন্মাদ অনেক কিছুই করতে পারে। যেমন, সাইকোপ্যাথিক কিলার। যেমন, র্যাবিড-ম্যানিয়াক।’
‘কোথায় সেই উন্মাদরা?’
‘লুকিয়ে আছে,’ বললে রমেশ থাপা।
খুনে পাগলরা মুখ বুজে ঘাপটি মেরে থাকে কি? এতক্ষণ ধরে?’
মাধবী বললে, ‘আমিও তাই বলি। পাগল নয়—অন্য কিছু। যা ভাবা যায় না।’
শুরু হল অভিযান।
প্রথম বাড়িটা রোগাটে ধরনের। পেছনদিকে লম্বাটে। এ বাড়ির একতলায় রয়েছে ছবি আর গিফট-এর দোকান। সামনের দরজার কাচ ভেঙে ভেতরে হাত ঢোকালেন উজাগর সিং, লক খুলে দরজা ঠেলে ঢুকে গেলেন। সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। দলের সবাইকে বললেন, ‘গায়ে গা লাগিয়ে থেকো না, ছড়িয়ে পড়ো। জোট বেঁধে থাকলে শত্রুর সুবিধে—সোজা টার্গেট। এক মারেই খতম করে দেবে।’
‘উজাগর সিংকে একসময়ে টেররিস্ট এলাকায় অপারেশন করতে হয়েছিল, গেরিলা অ্যাকটিভিটির মোকাবিলা করতে তিনি জানেন। আর্মি ট্রেনিং ভোলা যায় না।
দু’পাশের গ্যালারিতে ছবি আর গিফট সাজানো। লোকজন কেউ নেই। গ্যালারির শেষে ছোট্ট অফিসঘর। সেখানেও কেউ নেই। এই ঘরের পেছনে একটা দরজা। দরজা খুললেই সামনে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। মিলিটারি কায়দায় সিঁড়ি ভাঙলেন উজাগর সিং, এক হাতে রিভলভার। ওপরের চাতালে উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। সামনেই মালিকের ফ্ল্যাটের বসবার ঘর। ঘর ফাঁকা। নিশ্চিন্ত হওয়ার পর ইঙ্গিতে দলবলকে বললেন উঠে আসতে। নিজে সন্তর্পণে ঢুকলেন ঘরে। দাঁড়ালেন দেওয়াল ঘেঁষে। চোখে বিদ্যুতের ঝলক, সতর্ক শরীরের প্রতিটি অণুপরমাণু।
তন্ন তন্ন করে দেখা হল ফ্ল্যাটের খাবার ঘর। কেউ নেই। রান্নাঘরে রয়েছে একটা মৃতদেহ। ফ্রিজ খুলে রেখে হেলে রয়েছে ফ্রিজের গায়ে। ফোলা শরীর। নীলচে-কালচে চামড়া। চোখে বিস্ময় বা আতঙ্ক নেই। মরেছে খুব তাড়াতাড়ি। ফ্রিজ খুলেছিল টম্যাটো চীজ আর সালামি দিয়ে স্যান্ডউইচ বানাবে বলে। তিনটে জিনিসই ছড়িয়ে পায়ের কাছে।
‘রোগ নয়। হলে, স্যান্ডউইচ খাওয়ার ইচ্ছে হত না,’ আস্তে বললেন উজাগর সিং।
‘মরেছেও আচমকা,’ রমেশ থাপার মন্তব্য, ‘হাতভরতি খাবারদাবার নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েই খতম।’
শোবার ঘরে পাওয়া গেল আরও একটা ডেডবডি। একটি ছেলে। শুয়ে রয়েছে খাটে। শরীর জুড়ে অত কালসিটে থাকলে সঠিক বয়স ঠাহর করা যায় না। মুখ জুড়ে আতঙ্ক—যেমনটা দেখা গেছিল সুমন্ত সেনের মুখে। ভয়ানক ভয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে গেছিল, মাঝপথেই প্রাণ বেরিয়ে গেছে।
দলাই-মলাই করা চাদরে পড়ে একটা পয়েন্ট টু-টু অটোমেটিক। পকেট থেকে কলম বের করলেন উজাগর সিং। ট্রিগার গার্ডে ঢুকিয়ে তুলে নিলেন। ক্লিপ খুললেন। গুলি নেই ভেতরে। বেডল্যাম্পের দিকে নল ঘুরিয়ে এক চোখে তাকালেন ভেতরে। চেম্বারে নেই গুলি। নাকে ঠেকিয়ে শুঁকলেন। বারুদ পোড়ার গন্ধ পেলেন।
বললেন, ‘গুলি ছোঁড়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ফায়ারিং যখন শুরু হয়েছিল, ধরে নেওয়া যাক, ক্লিপ তখন ভরতি ছিল। মোট দশ রাউন্ড গুলি চালানো হয়েছে। ওই তো একটা বুলেট হোল।’
গুলির গর্তটা রয়েছে খাটের মাথার দিকে দেওয়ালের গায়ে। মেঝে থেকে প্রায় সাত ফুট হাইটে।
পাওয়া গেল আরও একটা বুলেট হোল। দেওয়ালে বসানো কাঠের মূর্তি ফাটিয়ে চৌচির করে ঢুকে গেছে ভেতরে। দশটা ফাঁপা খোল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে। কিন্তু পাওয়া গেল না বাকি আটটা বুলেটের গর্ত। বোঝা গেল না, সে গুলি লেগেছে কোথায় আর গেলই বা কোথায়।
আটটা গুলিই কি তাহলে লেগেছে আততায়ীর গায়ে? আটবার গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মরে পড়ে নেই কেন? তা ছাড়া, একজনের গায়ে আটখানা বুলেট ঢুকিয়ে দেওয়া কি সম্ভব? শুয়ে শুয়ে?
অসম্ভব।
তা ছাড়া, রক্তই বা কোথায়? আটখানা বুলেট হজম করে কিছুটা রক্তপাত ঘটানো উচিত ছিল গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির। কিন্তু তা হয়নি।
খাটের পায়ের কাছে গিয়ে ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলেন উজাগর সিং। দুটো মাথার বালিশ পিঠে দিয়ে আধবসা অবস্থায় দু’পা ছড়িয়ে রয়েছে সামনে।
রান্নাঘরের নিহত মানুষটা বোধহয় এই ছেলের বাবা। ছেলের জন্যে খাবার আনতে গেছিল। তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে ঠিক সেই সময়ে। নিমেষে মারে পিতাকে। তাকে সময় দেননি। সময় দিয়েছে ছেলেটাকে—বুলেট বর্ষণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
আর্ট গ্যালারির পাশের দোকানটায় ম্যাগাজিন, টোব্যাকো আর বইয়ের দোকান। আলো জ্বলছে ভেতরে, দরজা রয়েছে খোলা। বইয়ের দোকানের দরজা রোববারেও খোলা থাকে।
সুরেশ সাইকিয়া আগে ঢুকলেন, তাঁর পেছনে মাধবী আর পরি, একদম পেছনে বিশু বোস।
জনপ্রাণী নেই দোকানঘরে, নেই অফিসঘরে, নেই ওপরতলায়। শুধু জল থইথই করছে মেঝেতে। অথচ পাইপ ফুটো হয়নি। কুলার থেকে জল উপচে বেরিয়ে আসেনি।
নির্নিমেষে এই জলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বেরিয়ে এলেন সুরেশ সাইকিয়া। জলটা তাঁর ভালো লাগেনি।
জল দেখা গেল পাশের বাড়িতেও। ও বাড়ির একতলায় ওষুধের দোকান। ওপরের তলায় মালিকের ফ্ল্যাটে। বসবার ঘরের কার্পেটে ফুলে উঠেছে জলে। অথচ জল এসেছে কোত্থেকে, তা ধরতে পারছেন না উজাগর সিং।
এর পাশেই ছোট্ট হোটেলে দেখা গেল অন্য দৃশ্য।
তিনতলা বাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। একতলায় বসবার ঘর, কাউন্টার ফাঁকা। দোতলায় মালিকের ফ্ল্যাট ফাঁকা। তিনতলায় ছ’টা ঘরই ফাঁকা। অথচ সেখানে অতিথি ছিল। তাদের থাকার চিহ্ন ছড়ানো রয়েছে ঘরময়। নেই কেবল মানুষগুলো।
ষষ্ঠ ঘরের বাথরুমের দরজা বন্ধ ছিল ভেতর থেকে। ল্যাচ লাগানো দরজা—লক টানতে হয় ভেতর থেকে। নিশ্চয় মানুষ, আছে ভেতরে।
হেঁকে বলেছিলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘পুলিশ। দরজা খুলুন।’
সাড়া নেই।
ধাক্কা দিলেন।
সাড়া নেই।
রিভলভারের এক গুলিতে লক উড়িয়ে দিলেন।
কলতলা ফাঁকা।
জানলা নেই। সুতরাং কলতলায় যে ঢুকেছিল, সে ঘরেই আছে। তবে উবে গেছে।
শুধু একটা নিশানা রেখে গেছে বেসিনের ওপকার আয়নায়। আঠালো কালি দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে: আদিম শত্রু। উতঙ্ক চৌধুরী।
বিশু বোস আর সুরেশ সাইকিয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে মাধবী আর পরি যখন লেখাটা পড়ছে, ঠিক তখন পাশের দোকানে আবার রহস্যময় জলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছেন উজাগর সিং…
শুধু জল। মেঝে ভরতি জল। পাইপ ছেঁদা নেই, অথচ জল জমে রয়েছে মেঝেতে।
মালিকের কিচেনে ঢুকে একটা প্লাস্টিকের খালি শিশি পেলেন উজাগর সিং। আর একটা চামচে। জল তুলে ভরলেন শিশিতে।
স্যাম্পেল সংগ্রহ করলেন। খটকা যখন লেগেছে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করাবেন।
এ জল সাধারণ জল নয়।
চোখের পাতা নামাতে পারছে না মাধবী। চক্ষুগোলক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে।
পরি বললে শুকনো গলায়, ‘দিদি, উতঙ্ক চৌধুরী কে?’
‘যে লিখেছে,’ বিশু বোস জবাব দিলেন।
‘এ ঘর যে ভাড়া নিয়েছিল?’ সুরেশ সাইকিয়ার প্রশ্ন।
‘রেজিস্টার দেখে এসেছি আসবার সময়ে,’ বললেন বিশু বোস, ‘এ নাম পাইনি। নেমে গিয়ে ফের দেখব।’
পরি বললে, ‘খুনীদের একজনের নামও তো হতে পারে? ঘরে যে ছিল, সে চিনতে পেরেছিল। তাই নামটা লিখে রেখেছে।’
মাথা নাড়লেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘খুনী কখনও নিজের নাম রেখে যায়? খুন করার পর নাম মুছে দিয়ে যেত।’
‘হয়তো জানত না এ নাম লেখা আছে আয়নায়। জানলে তো মুছবে,’ পরির গলায় আশ্চর্য জোর এসেছে।
‘অথবা হয়তো জানত, জেনেও মোছেনি। রোগ-জীবাণু যখন মানুষকে পাগল করে দেয়, তখন সূত্র পড়ে রইল কি রইল না এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না,’ আস্তে বললেন বিশু বোস। ‘তোমার দিদি কিন্তু বলেছেন, র্যাবিড ম্যানিয়াকদের হাত থাকতে পারে শহরজোড়া এই খুনখারাপিতে।’
‘উতঙ্ক চৌধুরী নামে কেউ আছে শিবালয় টাউনে?’ মাধবীকে সুরেশ সাইকিয়ার প্রশ্ন।
‘অদ্ভুত নাম। একবার শুনলে মনে থাকত।’
‘এ টাউনের সবাইকে আপনি চেনেন?’
‘নিশ্চয়।’
‘পাঁচশো জনকেই?’
‘প্রায়।’
‘তাহলে জনাকয়েককে এখনও চেনেন না। উতঙ্ক চৌধুরী এই জনাকয়েকের মধ্যে তো থাকতে পারে?’
‘চোখের দেখা না দেখলেও নাম নিশ্চয় শুনতাম। ছোট্ট শহর। পাড়াপড়শির গল্পগুজব আমার সামনেই হয় বিশেষ করে, এই নামের কেউ থাকলে তাকে নিয়ে জমিয়ে হাসিঠাট্টা হত নিশ্চয়। না, না, এ নামে এ টাউনে কেউ নেই।’
‘আশপাশের কোনও অঞ্চলের মানুষ কি? তারাও তো আসে আপনার কাছে?’
চুপ করে রইল মাধবী। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু ভাবতে চাইছে। লেখাটা নিয়ে ভাবনা এখানে আটকে যাচ্ছে, ফাঁকা কোথাও গেলে হত। এই ঘরের পরিবেশ সহ্য হচ্ছে না। গা শিরশির করছে। মন বলছে—পালাও! পালাও! মাধবী লাহা, এই বাড়িরই আর এক জায়গায় তোমাদের জন্য তৈরি হচ্ছে আর এক আতঙ্ক!
পরি চেয়েই ছিল আয়নার দিকে। এখন বললে, ‘আদিম শত্রু কে?’
‘উতঙ্ক চৌধুরী—আবার কে? লিখেই তা জানাতে চেয়েছে লেখক,’ বললেন বিশু বোস।
‘লিখেছে তো গোঁফ কালো করবার পেন্সিল দিয়ে। কোথায় সেই পেন্সিল?’ জিজ্ঞেস করলেন সুরেশ সাইকিয়া।
পাওয়া গেল না বাথরুমের কোত্থাও।
এখন ওরা নিচের তলায়। গেস্ট রেজিস্টারে নাম পাওয়া গেল ভদ্রলোকের—বিনয় চৌধুরী, কলকাতা।
কলতলায় ঢুকে যিনি ভ্যানিশ হয়ে গেছেন! সঙ্গে নিয়ে গেছেন শুধু গোঁফ কালো করার পেন্সিল।
রেজিস্টারের অন্য নামগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন বিশু বোস—‘উতঙ্ক চৌধুরী নামে কেউ এখানে থাকেননি।’
‘তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক,’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘দেখা যাক কী পেলেন উজাগর সিং।’
গলিপথ ধরে দরজার দিকে যাওয়ার পথে সামনে পড়ল একটা টেবিল। সিলিং থেকে আলো ঝুলছে তার ওপর। পরিকে টেনে নিয়ে সবার আগে ওইদিকেই পা চালিয়েছিল মাধবী—এ-বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতলবে। আচমকা চিৎকারটা বেরিয়ে এল ওরই গলা চিরে।
একই সঙ্গে প্রত্যেকে দেখল সেই দৃশ্য।
আলোর নিচে যেন একটা শিল্পসামগ্রী বসানো রয়েছে টেবিলের ওপর। কব্জি থেকে কাটা একটা হাত। বুড়ো আঙুল, তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ধরে রয়েছে একটা পেন্সিল—গোঁফ কালো করার পেন্সিল।
যে পেন্সিল পাওয়া যায়নি কলতলায়।
কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বিশু বোস বললেন, ‘এখান দিয়ে যাবার সময়ে টেবিলে কিছু ছিল কি?’
‘না,’ সুরেশ সাইকিয়ার প্রশান্ত জবাব, ‘নিচে নেমে আসছি যখন, তখন এনে রাখা হয়েছে আমাদের দেখানোর জন্যে।’
উনি স্তব্ধ হতেই ওপরতলা থেকে ভেসে এল একটা আওয়াজ—ক্যাঁচ… ক্যাঁচ।
পাল্লা ঘোরানো হচ্ছে, খোলা হচ্ছে, ফের বন্ধ হচ্ছে… আবার… আবার…
আপনা থেকে নিশ্চয় হচ্ছে না। কেননা, হাওয়া তো নেই।
মাধবীর দিকে ফিরলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘মন্দিরের ঘণ্টা আর সাইরেনের আওয়াজ যখন শুনেছিলেন, তখন কি আপনার মনে হয়েছিল ঘটনা আবার ঘটবে, আমরা এলে?’
‘হয়েছিল।’
‘ইওর প্রিমনিশন ইজ কারেক্ট, ডক্টর লাহা। ঘটনা আবার ঘটতে চলেছে।’
রমেশ থাপার মেজাজ খিঁচড়েছে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স-এর সামনে। তার একপাশে উজাগর সিং, আর একপাশে শচীন আর সুধাকর।
চারজনেই চেয়ে আছে রাস্তার উলটোদিকের ছোট্ট হোটেলটার দিকে। দরজা দিয়ে এইমাত্র বেরিয়ে এলেন সুরেশ সাইকিয়া আর বিশু বোস। মাধবী আর পরি তাঁদের পেছনে। চারজনেরই হাঁটতে যেন কষ্ট হচ্ছে।
উজাগর সিং অর্ডার দিয়েছেন একই সঙ্গে ঢোকা হবে এই দোকানটায়। গতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না। ভয়ানক কিছু ঘটেছে দোকানঘরে। নইলে সামনের শোকেসের পেল্লায় কাচ দু’খানা বাইরে ঠিকরে এসে ফুটপাতের ওপর ভেঙে পড়বে কেন?
উজাগর তাই প্ল্যান করেছেন, দল ভারী করে ঢুকতে হবে ভেতরে। অনেক অভিজ্ঞতাই তো হল, সৃষ্টিছাড়া অনেক কিছুই দেখা হল।
এসে গেছেন সুরেশ সাইকিয়া। প্লাস্টিক শিশিতে আনা অদ্ভুত জলের নমুনা তাঁকে দেখাচ্ছেন উজাগর সিং। সুরেশ সাইকিয়া বলছেন, এমনই জলের সাক্ষাৎ তিনিও পেয়েছেন। দু-জনেই চেয়ে আছেন শোকেসের ভাঙা কাচের দিকে। কী এমন ঘটল দোকানের ভেতরে যে দু-দু’খানা কাচ ভেঙে পড়ল বাইরের দিকে? ভেতরে ঢোকার ফন্দি আঁটছেন খাটো গলায়।
এই হ্যাপায় ঢোকবার কোনও ইচ্ছেই নেই রমেশ থাপার। পুলিশের চাকরি বড় ঝঞ্ঝাটের। দোকানের ভেতরে নিশ্চয় নারকীয় কিছু ঘটেছে। বড় দোকান। শোকেসে যা কিছু সাজানো ছিল, ভাঙা কাচের ওপর সেসবও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ফুটপাতে। কাচ যে অথবা যারা ভেঙেছে, তারা নিশ্চয় ওঁত পেতে বসে রয়েছে ভেতরেই। রমেশ ঠিক করল, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!
মতলব স্থির হয়ে গেছে সুরেশ সাইকিয়ার। লাইন দিয়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন দোকানের দরজার দিকে। রমেশ রইল সবার পেছনে।
তছনছ হয়ে রয়েছে মনোহারী দোকান। তাকভরতি সমস্ত জিনিস ঝটকান মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে মেঝেতে। বিষম আক্রোশে যেন তাথৈ তাথৈ নৃত্য চলেছে ঘর জুড়ে। ভারী জিনিস শূন্যে তুলে আছড়ে ফেলা রয়েছে—আস্ত কাচ কোত্থাও নেই।
দোকানের পেছনদিকে শুধু বস্তা আর বাক্স। প্রত্যেকটা বস্তা ছিঁড়ে ফালা ফালা করা, বাক্সগুলো ভেঙে ফুটিফাটা—ভেতরের সব জিনিস বাইরে ছড়ানো।
সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘এবার স্টোররুমটা দেখা যাক।’
আলো নিভে গেল ঠিক তখুনি।
রাস্তার আলোও নিভে গেছে—তাই সামনের জানলা দিয়ে আসছে না আলো। স্টোররুমের সামনে নিচ্ছিদ্র তমিস্রা ওদের গিলে ফেলেছে…
একই সঙ্গে শোনা গেল অনেকগুলো গলা।
‘টর্চ।’
‘দিদি!’
‘টর্চ কোথায়?’
তারপরেই খুব দ্রুত ঘটে গেল পর-পর কয়েকটা ঘটনা।
টর্চ জ্বলে উঠল বিশু বোসের হাতে। বর্শাফলকের মতন আলো ধেয়ে গেল মেঝের ওপর দিয়ে। কে যেন তাঁকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল পেছন থেকে। সেই মুহূর্তে তাঁর পেছনে কারও থাকার কথা নয়। থাকলেও সে ছিল অদৃশ্য অবস্থায়। তার গতিবেগও অবিশ্বাস্য। বিশু বোসকে আছড়ে ফেলল শচীনের ওপর, শচীন তাঁকে নিয়েই ঠিকরে পড়ল সুধাকরের ওপর। তিন জনেরই দেহ একই সঙ্গে গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর—সেই সঙ্গে বোতাম টিপে রাখা জ্বলন্ত টর্চবাতি। গড়াতে গড়াতে আলোর ঝলক ফেলে যাচ্ছে এলামেলোভাবে।
গড়ানে বিদ্যুৎ-মশালকে মেঝে থেকে তুলে নিতে গিয়েও পারলেন না সুরেশ সাইকিয়া।
ইতিমধ্যেই শূন্যে উঠে পড়েছে রমেশ থাপার শরীর। যে অদৃশ্য শক্তি তিন-তিনটে মনুষ্যদেহকে হেলায় ঠিকরে দিয়েছে মেঝের ওপর, সেই শক্তিই আচমকা রমেশের কাঁধ খামচে তাকে তুলে নিয়েছে শূন্যে।
রমেশের পা এখন মেঝেতে ঠেকছে না। তার কাঁধে অতি-শীতল বস্তুর ছোঁয়া, একটু ভিজে ভিজে। বস্তু বলে মনে হলেও তা সজীব…
শূন্যে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কোমরের টর্চের দিকে হাত বাড়িয়েছিল রমেশ।
পাইথনের পাক যেন চেপে বসল গলা ঘিরে। দম আটকে এল রমেশের। টর্চ টেনে আনার কথা আর মনে রইল না। দু’হাত তুলে অদৃশ্য নাগপাশকে খামচে ধরতে যেতেই…
দু’হাতকে জাপটে ধরে অবশ করে দিল আততায়ী। হিমশীতল আলিঙ্গন—বাহু, ধড় সবকিছুর ওপর দিয়ে।
শিশুর মতন কেউ তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শূন্যপথে। গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর চেষ্টা করেছিল রমেশ… মুখের ওপর চেপে বসেছিল থাবা। থাবা ছাড়া তাকে আর কিছু মনে করতে পারেনি রমেশ। মুখ ঠুসে ধরায় কোনও আওয়াজ আর বেরোয়নি।
নাকে ভেসে এসেছিল দুর্গন্ধ। খুব উৎকট নয়, কিন্তু অসহ্য। এরকম বদ গন্ধ রমেশকে জীবনে শুঁকতে হয়নি।
গোটা শরীরে পাক দিচ্ছে। বমি ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। অবিশ্বাস্য এক দুঃস্বপ্ন রমেশকে পেঁচিয়ে ধরে নিয়ে চলেছে কল্পনাতীত পরিণতির দিকে। রমেশ বুঝেও কিছু করতে পারছে না…
টর্চ লাইট গড়িয়ে গিয়ে ধাক্কা খেতেই কাচ আর বাল্ব ভেঙে গেল। এখন এখানে নরকের একাকার।
সঙ্গীদের হাঁকডাক শুনতে পাচ্ছে রমেশ কিন্তু যেন বহুদূর থেকে!
রমেশ থাপাকে আর পাওয়া গেল না।
নিভে যাওয়া টর্চলাইট কুড়িয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দপ দপ করে জ্বলে উঠেছিল মনোহারী দোকানের সমস্ত আলো। খুব জোর পনেরো থেকে বিশ সেকেন্ডের মতন অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছিল সবাইকে। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে রমেশ। আলো জ্বলবার পর দেখা গেল শুধু সে নেই—সবাই আছে।
খোঁজা হয়েছিল সব জায়গাতেই। পাওয়া যায়নি। রাস্তাতেও নেই রমেশ, নেই ফুটপাতে। শিবালয় শহর যেন নিঃশব্দে বিদ্রুপের হাসি হেসে চলেছে।
‘গেল কোথায়?’ প্রশ্নটা উজাগর সিং-এর।
‘নিজে যায়নি, নিয়ে গেছে,’ সুরেশ সাইকিয়ার জবাব।
চেঁচাল না কেন?’
‘চান্স পায়নি বলে।’
‘জ্যান্ত অবস্থায়, না, মরা অবস্থায়?’ পরি আর মুখ বুজে থাকতে পারল না।
‘মরে কাঠ না হলে রমেশকে নিয়ে যাওয়া যেত না,’ দাড়ির জঙ্গল চুলকোলেন উজাগর, ‘ডেডবডি দেখতে পাব শীগগিরই।’
এই কথার জবাবেই যেন সহসা জ্বলে উঠল রাস্তার সমস্ত আলো। হঠাৎ বেড়ে গেল হাওয়ার বেগ—ভেসে এল গাছের পাতাদের নড়াচড়ার আওয়াজ। নুয়ে পড়েছে ডালপালা, দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে রাস্তার ওপর দিয়ে হু হু করে…
উজাগর বললেন, ‘রমেশের ডেডবডি যদি দেখতে পেতাম—’
কথা শেষ হল না, বেজে উঠল মন্দিরের ঘণ্টা। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে শিবমন্দির। রাস্তার মোড়ে। চুড়োয় মস্ত পিতলের ঘণ্টা। ঘণ্টা দুলছে রাস্তার—আলো ঝিলিক তুলে ঠিকরে যাচ্ছে তার পেতলের বপু থেকে। ঘণ্টা নাড়ানো হচ্ছে নিচ থেকে। দড়ি ধরে কেউ টানছে… ঘণ্টা নড়ছে… বাজছে…
‘কে টানছে?’ পরি হাত চেপে ধরল দিদির।
‘উজগর সিং যার ডেডবডি দেখতে চেয়েছিলেন, হয়তো সে,’ ফিসফিস করে বললে মাধবী।
কথাটা শুনল সবাই। কিন্তু হাসতে পারল না কেউই। সবারই মনের চোখে যুগপৎ ভেসে উঠল একটা শবদেহের ছবি। ফুলে ঢোল হয়ে ওঠা, নীলচে-কালচে রঙের একটা শবদেহ মন্দিরের ঘণ্টা ঘরের তলায় দাঁড়িয়ে দু’হাতে দড়ি ধরে টানছে… টানছে… টানছে…। ঘণ্টাধ্বনির সম্মোহনী শক্তি একটু করে সবাইকে আচ্ছন্ন করে আনছে। যেন টানছে সব্বাইকে। পা চুলবুল করছে মন্দিরের দিকে যাওয়ার জন্যে… মনের শক্তি লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে।
দাঁতে দাঁত পিষে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ডাকছে, আমাদের ডাকছে।’ উনি নিজের মনোবল জাগ্রত করছেন—ইচ্ছাশক্তিকে লোপ পেতে দিচ্ছেন না।
আচ্ছন্নের সুরে বলে গেলেন উজাগর, ‘হ্যাঁ, আমাদের ডাকছে…।’
উসখুস করছে আর সকলেই। যেন মন্ত্র-অবশ অঙ্গ প্রত্যেকেরই।
‘যাবেন না,’ ক্ষীণ কণ্ঠে বললে মাধবী।
সুরেশ সাইকিয়া শক্ত করে নিয়েছেন নিজেকে, ‘রাইট। এখান থেকে গিয়ে রমেশ থাপা-ই যদি ঘণ্টা বাজায়—’
‘উদ্ভট চিন্তা,’ আধবোজা চোখে বিড় বিড় করে গেলেন উজাগর সিং।
কঠোর কণ্ঠ সুরেশ সাইকিয়ার, ‘যেই বাজাক, আর একটা লোককেও বলি দিতে রাজি নই। আসুক নতুন ফোর্স, তখন দেখব কে বাজাচ্ছে ঘণ্টা। তার আগে চলুন থানায়। মার্চ।’
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ঘণ্টাধ্বনি। উজাগরের কথায় সায় দিয়ে যে প্রবল উৎসাহে ঘণ্টা বাজাচ্ছিল, সুরেশ সাইকিয়ার সিদ্ধান্তে হতাশ হয়ে সে যেন ঘণ্টার দড়ি ছেড়ে দিল। শব্দের শেষ ঢেউটা কাঁপতে কাঁপতে দূর হতে দূরে মিলিয়ে গেল একসময়ে। আবার দম আটকানো নীরবতা।
জুতোর আওয়াজে নৈঃশব্দ্য ভাঙতে ভাঙতে ওরা এগিয়ে গেল থানার দিকে। বড় রাস্তা ছেড়ে নামল না গলিতে। শর্টকাটের আর দরকার নেই, দরকার শুধু জোরালো আলোর।
জুতোর শব্দ এসে থামল থানার সামনে। আগে ঢুকলেন সুরেশ সাইকিয়া। সবশেষে উজাগর সিং।
চেয়ে রইলেন সবাই মেঝের দিকে। সুমন্ত সেনের দেহ কিছুক্ষণ আগেও এখানে পড়েছিল। এখন নেই। জায়গাটা খালি।
৭
সুমন্ত সেনের টেবিলে বসে আছেন সুরেশ সাইকিয়া। যুদ্ধকালীন আয়োজন চলছে তাকে ঘিরে। ছোট্ট দলের প্রত্যেককে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সুমন্তর ম্যাগাজিন সরিয়ে সেখানে বড় কাগজ পেতেছেন তিনি। টুকটাক পয়েন্ট, কেস হিস্ট্রি আর অ্যাকশন প্রোগ্রাম লিখছেন।
এবার টেনে নিলেন টেলিফোন, তুললেন রিসিভার। এসে গেল ডায়াল টোন। মাধবী লাহার মতন বেগ পেতে হল না।
ডায়াল করলেন এমার্জেন্সি নাম্বার—টিকেন্দ্ৰনগর হেডকোয়ার্টারে। জবাব দিল ডিউটি সার্জেন্ট অ্যান্টনি, ‘ইয়েস, স্যার?’
সংক্ষেপে ঘটনাবলীর সারাংশ বলে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া।
‘রমেশ তাহলে খতম?’
‘সেটা বলা যাবে না যতক্ষণ না ডেডবডি দেখছি। এবার কাজের কথা। প্রথমেই একটা পাসওয়ার্ড তৈরি থাকা দরকার। শিবসুন্দর—এই পাসওয়ার্ড না শোনা পর্যন্ত মুখ খুলবে না কারও কাছে। শিবালয় টাউন থেকে কোনও খবর যেন বাইরে না যায়, বাইরের খবর যেন এখানে না আসে। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে শিবালয়কে।’
‘হয়ে যাবে। শিবালয় শহরে ফ্যাক্স মেশিন নেই, আমি জানি। টেলিফোন কাট-অফ করে দেব।’
‘তা সত্ত্বেও, খবরটা ছড়িয়ে যাওয়ার পর পাহাড় টপকে রিপোর্টার আসতে শুরু করবে। তাদের কাছে কোনও খবর যেন না যায়। রাইট?’
‘ইয়েস, স্যার।’
‘বারোজন লোক চাই। দু’জন থাকবে টাউনে ঢোকার মুখে। দশজন চলে আসবে আমার কাছে। এদের কারোরই যেন ঘরসংসার বলে কিছু না থাকে। প্রাণের মায়া অবশ্যই থাকবে না। শিবালয় শহরে যাদের আত্মীয়স্বজন আছে, সেরকম কাউকে নেবে না। দিন দুয়েকের মতন খাবার জল আর খাবার সঙ্গে আনবে প্রত্যেকেই। এই দু’দিন এখানকার জল বা খাবার তাদের দেওয়া যাবে না, ক্লিয়ার?’
‘ইয়েস, স্যার?’
‘বারোজনই নিজেদের সাইড আর্ম আনবে সঙ্গে, এ ছাড়াও একটা করে রায়ট গান আর টিয়ার গ্যাস।’
‘নেক্সট?’
‘শিবালয়ের ম্যাপ দেখলাম এখুনি। এ শহরের ঢোকবার পথ দুটো। একটা মেন রোড—সেখানে পাহারা বসিয়েছি। আর একটা রাস্তা পেছনের জঙ্গল দিয়ে নেমেছে। ডেসপারেট রিপোর্টাররা এদিক দিয়েও ঢুকতে পারে। দু’জনকে পাহারায় রাখব এখানে। ঠিক আছে? আমি জানি, তুমি এদিককার পাহাড়-পর্বতের খবর রাখো।’
‘রাখি।’
‘কর্নেল ডিসুজার নাম তুমি জানো। ঠিকানা ফাইলে পাবে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার দরকার হতে পারে—ভিড় সামলানোর জন্যে। তৈরি থেকো।’
‘এনিথিং মোর?’
‘উতঙ্ক চৌধুরী নামটা লিখে রাখো। উ-ত-ঙ্ক চৌধুরী। কী তাঁর পরিচয়? পেশা? ঠিকানা? পুলিশ ফাইলে রেকর্ড আছে কি না, খোঁজ নেবে। কলকাতায় খোঁজ নেবে সবার আগে। বাঙালি নাম। আরও একটা নাম লেখো—বিনয় চৌধুরী। হোটেলের রেজিস্টারে নাম পেয়েছি। ডিটেলস জানো। আর একটা কথা। যে বারোজন আসবে, তাদের সঙ্গে দুশো পলিথিন ব্যাগ দিয়ে দেবে ডেডবডি রাখবার জন্যে।’
‘দুশোটা?’
‘পাঁচশোটাও লাগতে পারে। শিবালয়ে লোক থাকত পাঁচশো।’
‘ও মাই গড!’
টেলিফোন নিয়ে সুরেশ সাইকিয়া যখন তন্ময়, তখন পুলিশ রেডিয়ো খুলে ফেলা হচ্ছে—রেডিয়ো বিগড়েছে কেন, তা জানার জন্যে। থানার সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র নামানো হচ্ছে আলমারি থেকে—গুলি ঠাসা হচ্ছে প্রত্যেকটাতে।
সুরেশ সাইকিয়া এবার ফোন করলেন গভর্নর হাউসে।
গভর্নর জ্যাক সাংঘুলানা আর পুলিশ প্রধান সুরেশ সাইকিয়া এক সময়ে একই ক্লাসে স্কুলে পড়েছিলেন। সেই বন্ধুত্ব আজও আছে। জ্যাক চলে গেছিলেন পলিটিক্সে। ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন গভর্নরের পোস্টে। দিল্লি তাঁকে খাতির করে। কারণ অত্যন্ত সেন্সিটিভ এই পাহাড়ি অঞ্চলে তাঁর হুকুমে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। পুরো জায়গাটা তাঁর নখদর্পণে।
জ্যাক সাংঘুলানাকে এত রাতে টেলিফোন করে পাওয়া যায় না। কিন্তু সুরেশ সাইকিয়া জানেন, কী করে তাঁর ঘুম ভাঙাতে হয়। এখানেও আছে ‘চিচিং ফাঁক’ পাসওয়ার্ড। নিতান্ত প্রয়োজন হলে সুরেশ ব্যবহার করেন এই গুপ্ত পরিচয়।
টেলিফোন ধরলেন গভর্নর। ঘুমজড়ানো গলায় বললেন, ‘কী ঝামেলায় পড়েছিস?’
সুরেশ গুছিয়ে বললেন ঝামেলার বৃত্তান্ত।
জ্যাক বললেন, ‘কী চাস?’
‘টেলিফোন সেন্টার কাট-অফ করে দিক শিবালয় টাউনকে। খবরটা কাল ছড়িয়ে পড়লেই ঘরে ঘরে টেলিফোন যেন না বাজে। বাজুক শুধু এইখানে—থানায়।’
‘তাই হবে। আর?’
‘হেলথ ডিপার্টমেন্ট যেন নাক না গলায়। জীবাণু সংক্রমণ না পরিবেশ দূষণ—এটা যখন জানা যায়নি তখন তাদের হল্লাবাজির দরকার নেই।’
‘কিন্তু সুরেশ, গোটা টাউনের সমস্ত মানুষ যদি মরে যায় হঠাৎ, হেলথ ডিপার্টমেন্টকে তো আটকানো যায় না। যাকগে, তুই যখন বলছিস, তাই হবে। জার্মস না পয়জন—এটা আগে ঠিক কর।’
‘দুটো জেনারেটর চাই। পাওয়ার কন্ট্রোল আমাদের হাতে নেই, যখন তখন লোডশেডিং হচ্ছে।’
‘জেনারেটর সমেত ভ্যান পাঠাচ্ছি। আর্থকোয়েক রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে খানকয়েক আছে বলে জানি। আর কী?’
‘কর্নেল ডিসুজাকে দরকার।’
‘কর্নেল ডিসুজা! কেন?’
‘চমকে উঠলি? যদিও ব্যাপারটা খুব সিক্রেট তবুও আমি জানি কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার সংক্রান্ত একটা প্রোজেক্টের উনি কর্ণধার। এই পাহাড়ি অঞ্চলে গোপনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আর্মির হয়ে। যেহেতু তিনি রিটায়ার্ড, তাই সন্দেহ তাঁকে ছুঁতে পারছে না। কিন্তু আমি জানি, আমাকে জানতে হয়। ওঁকে আমার চাই। একমাত্র উনিই ধরতে পারবেন কেন কাটাছেঁড়া আর ফুলে ঢোল বডি পাওয়া যাচ্ছে যেখানে-সেখানে, কী কারণেই বা অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে একটা মানুষ।’
ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন জ্যাক, ‘ওঁর এক্সপেরিমেন্টের নার্ভ গ্যাস অথবা পয়জন এই কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে কি তোর মনে হচ্ছে?’
‘কর্নেল ডিসুজাই তা বলতে পারবেন। যেহেতু উনি এই প্রোজেক্টের সিভিলিয়ান ডিফেন্স ইউনিটের কম্যান্ডিং অফিসারও বটে, তাই তাঁর গোচরে আনা দরকার এখানকার পুরো ব্যাপারটা। ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে উনি সায়ান্টিস্টদের এনে ফেলতে পারবেন শিবালয় টাউনে। বায়োলজিস্ট, ভাইরাস-এক্সপার্ট, ব্যাকটিরিয়োলজিস্ট, ফোরেনসিক মেডিসিনে এক্সপার্ট প্যাথোলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট, এমনকী নিউরো-সাইকোলজিস্টকেও আনতে পারবেন উনিই। ওঁর ডিপার্টমেন্টেই আছে মোবাইল ফিল্ড ল্যাবরেটরি। গাড়িগুলো রয়েছে নানা অঞ্চলের গ্যারেজে—শিবালয়ের কাছাকাছি গ্যারেজে নিশ্চয় আছে। আমি একটু পরেই
তাঁকে ফোন করছি। তার আগে তুই তাঁকে জানিয়ে রাখ—’
‘রাখছি। আর কী চাহিদা?’
‘একটা শর্টওয়েভ রেডিয়ো। এখানকার রেডিয়ো বিগড়েছে। টেলিফোনও যখন তখন বন্ধ হচ্ছে—’
‘যাচ্ছে—রেডিয়ো ভ্যানেই থাকবে। আর কী?’
‘টেলিফোনের কাছে হাজির থাকিস। শিবালয় ওয়ার্ল্ড নিউজ হয়ে যেতে পারে রাত ভোর হলেই। তোকে যেন পাই।’
‘নিউজ যাতে না হয়, সে চেষ্টা করছি। পেজার আর সেলুলার ফোনও পাঠিয়ে দিচ্ছি। বিনিময়ে তোকে শুধু একটা কথা দিতে হবে। এমন কিছু ঝুঁকি নিবি না যাতে সুরেশ সাইকিয়া হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে।’
‘কথা দেওয়া সম্ভব নয়। ছাড়ছি।’
রিসিভার রেখে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন পুলিশ প্রধান। দেখলেন রেডিয়োর সামনের প্লেট খোলা হয়ে গেছে। ফায়ার আর্মসগুলোয় কার্তুজ ঠাসা চলছে। পরি কফি বানাচ্ছে।
ফের টেলিফোন তুললেন। ডায়াল টোন এল না। অথচ কে যেন রয়েছে অপর প্রান্তে। সে কান পেতে শুনছে।
‘হ্যালো,’ বললেন সুরেশ। জবাব নেই।
মাধবী লাহাও ঠিক এই পরিস্থিতিতে পড়েছিল। উপলব্ধি করেছিল, কে যেন বোবা হয়ে রয়েছে ওদিককার রিসিভারে।
‘কে তুমি?’ আস্তে বললেন পুলিশ প্রধান।
জবাবের আশা করেননি—কিন্তু জবাব পেলেন।
কণ্ঠস্বর নয়। খুব চেনা একটা শব্দ। পাখি ডাকছে। খুব সম্ভব গাংচিল। হ্যাঁ, গাংচিলের ডাক। জোর হাওয়া বইছে সমুদ্রতীরে—সেই আওয়াজের ওপর গলা চড়িয়ে ডাকছে গাংচিল।
পালটে গেল আওয়াজ। খটখটাখট খটখটাখট শব্দ হচ্ছে। ফোঁপরা লাউয়ের খোলে কাঁইবিচি রেখে যেন নাড়া হচ্ছে। কোথায় যেন এ-আওয়াজ শুনেছেন সুরেশ।
র্যাটলস্নেক!
হ্যাঁ। বিষধর র্যাটলস্নেকের ওয়ার্নিং সিগন্যাল। না, ভুল হয়নি। ওই সাউন্ড ভোলা যায় না।
সে শব্দও পালটে গেল। ইলেকট্রনিক গুঞ্জন। না, ইলেকট্রনিক নয়। মৌমাছির গুঞ্জন। ঝাঁক বেঁধে গুনগুন করছে।
আবার শোনা গেল গাংচিলের চিৎকার। গান গেয়ে উঠল আর একটা পাখি—ভারী মিষ্টি ডাক। সেই সঙ্গে জিব বের করে হাঁপানির আওয়াজ। কুকুর নাকি?
চাপা গজরানি। না, কুকুর নয়। আরও বড় জানোয়ার। ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে আঁচড়াচ্ছে কামড়াচ্ছে লড়ছে একাধিক বেড়াল।
গা হিম হয়ে এল সুরেশ সাইকিয়ার।
থেমে গেল ইতর প্রাণীদের চেঁচানি।
কান পেতে রইলেন সুরেশ। বললেন খাটো গলায়, ‘কে তুমি?’
জবাব নেই।
‘কী চাও?’
যেন বরফ দিয়ে তৈরি ছুরির মতন অনেকগুলো তীক্ষ্ণ চিৎকার তারের মধ্যে দিয়ে ভেসে এসে বিঁধে গেল কানে। কলজে-ছেঁড়া চিৎকার করে যাচ্ছে পুরুষ, নারী, শিশু। বহুজনে। অ্যাকটিং নয়—রিয়্যাল। আতঙ্কে যন্ত্রণায় এইভাবে চেঁচায় মানুষ।
রক্ত উত্তাল হল সুরেশ সাইকিয়ার—উদ্দাম হল হৃৎপিণ্ড, মনে হল যেন নরকের দরজা খুলে গেছে কানের পর্দায়। চেঁচাচ্ছে কারা? শিবালয় শহরে যারা ছিল, যারা মরে গেছে—তারা?
টেপরেকর্ডে ধরা ছিল চিৎকারগুলো? কে ধরে রেখেছে? এই স্মৃতির দরকার কী?
চরম চিৎকারটা একক হয়ে বেজে উঠল সবশেষে। বাচ্চা গলায় আকুল সেই চিৎকার শুনে মনে হল যেন টেনে টেনে তার হাত-পা ছেঁড়া হচ্ছে। পাক খেয়ে খেয়ে চিৎকারটা চূড়ান্ত হয়ে যেতেই থেমে গেল হঠাৎ।
আবার সেই নৈঃশব্দ্য। এবার আরও ভয়াবহ। আরও স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছেন সুরেশ সাইকিয়া তারের অপর প্রান্তের সত্তাকে। অতিশয় অশুভ সত্তা। নীরব।
আস্তে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন পুলিশ প্রধান। লোম খাড়া হয়ে গেছে তাঁর। আঙুল কাঁপছে। ঘাম জমেছে কপালে—গড়াচ্ছে ঘাড়ের পেছনে।
ঘরের কেউ তাঁর এই অবস্থা লক্ষ করছে না। ব্যস্ত যে যার কাজ নিয়ে। এই মুহূর্তে মুখ খুলতেও চান না পুলিশ প্রধান। গলা কেঁপে যাবে। তিনি যে লীডার…
আবার হাত বাড়ালেন রিসিভারের দিকে। তুলে নিলেন।
ফিরে এসেছে ডায়াল টোন।
ডাক দিলেন কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রোজেক্টের সিভিলিয়ান ডিফেন্স ইউনিটকে।
পরি খেতে দিল সবাইকে। সুমন্তর টেবিলে। ঠিক তখনই আলো কেঁপে উঠল মাথার ওপর। একবার… দু’বার… তিনবার…
আলো কাঁপছে বাইরেও… রাস্তায়… একবার… দু’বার… তিনবার…
নিভে গেল সমস্ত আলো।
৮
সুরেশ সাইকিয়া আলো নেভার আগেই টেলিফোনের কাজ সেরে নিয়েছিলেন। কর্নেল ডিসুজার বাড়িতে ফোন করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, শিবালয় শহরের এই বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে কী ধরনের এজেন্ট, কেমিক্যাল না বায়োলজিক্যাল। ডিসুজা শুধু বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ।’ তার বেশি কিছু না। তবে সাবধান করেছিলেন সুরেশকে। টেলিফোনে সব কথা বলা যায় না। যা বলবার, সামনাসামনি বলবেন। ভোরের দিকে ফিল্ড ল্যাব আর তদন্তকারীদের নিয়ে হাজির হবেন।
আলো কেঁপে উঠে নিভে গেল তারপরেই।
আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, এই জাতীয় বিভ্রাট ঘটলে কী করতে হবে। ঠিক তাই করা হল এখন।
সাতজনে গোল হয়ে কাঁধে কাঁধ আর পিঠে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ঘরের ঠিক মাঝখানে। দেওয়াল থেকে দূরে, জানলা থেকে তফাতে। বাড়তি দুটো লম্বা
টর্চলাইট পাওয়া গেছিল ফাঁড়িতে। এখন সব ক’টা জ্বলছে আর ঘুরছে।
থপ শব্দটা পাওয়া গেল সেই সময়ে… আলো ঠিকরে গেল দেওয়ালে, কড়িকাঠে, মেঝেতে। কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
আবার শব্দ ভেসে এল—থপ… থপ… থপ…
শব্দ বাড়ছে…
টর্চ ঘুরে গেল জানলার দিকে। বন্ধ কাচের বাইরে পাখনা ঝাপটাচ্ছে একটা আতঙ্ক।
দুটো চোখ তার জ্বলছে টর্চের আলোয়। দেহ প্রকাণ্ড—দুটো ফুটবল পাশাপাশি জুড়লে যত বড় হয় তত বড়। তার দু’পাশের পাখনা আরও বড়—গোটা জানলা জুড়ে রয়েছে। সবেগে আছড়ে পড়ছে কাচের ওপর কিন্তু কাচ ভাঙবার মতন দেহভার তার নেই। অতীব সূক্ষ্ম কলেবর। তাকে ফুঁড়ে বাইরের আলো দেখা যাচ্ছে।
ঠিক যেন একটা অতিকায় মথ পোকা!
থপ থপ থপ থপ…
মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে… পড়ছে… পড়ছে… নারকীয় জিঘাংসা ঠিকরে যাচ্ছে বহুরঙা দুই চোখ থেকে!
আচমকা বিদায় নিল সে।
কিছুক্ষণ কেউ নড়ল না।
জ্বলে উঠল সমস্ত আলো। ঠিকরে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এল সকলেই। কেউ নেই রাস্তায়। পতঙ্গ ওঁত পেতে নেই। কোত্থাও।
অথবা হয়তো আলোয় সে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
বৈঠক বসল তারপরেই। নানা মুনির নানা মত শোনা গেল সেই বৈঠকে। উড়ুক্কু বিভীষিকাকে কেউ বলল অতিকায় মথ পোকা, কেউ বলল অজানা এক পাখি। কিন্তু রমেশকে নিশ্চয় তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই এই উড়ুক্কু বিভীষিকার। জানলার কাচ ভাঙবার ক্ষমতাও তো তার নেই। তবে সে এল কোত্থেকে? গেলই বা কোথায়?
সুরেশ সাইকিয়া তখন বললেন, টেলিফোনে যা-যা শুনেছিলেন।
গুম হয়ে রইল মাধবী। তারপর বললে, ‘পাহাড়ের কোনও গুহা থেকে এই আতঙ্কের আবির্ভাব ঘটেনি তো? সেখানেই হয়তো মাকড়সার মতন জাল পেতেছে… শিবালয়ের বাসিন্দাদের আটকে রেখেছে জ্যান্ত। খিদে পেলে খাবে। তাদেরই গলা শুনলেন টেলিফোনে।’
হাসতে পারলেন না সুরেশ সাইকিয়া। শুধু বললেন, ‘ও সব সায়েন্স ফিকশনে মানায়। এতগুলো মানুষকে জবাই করা বা বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ওই পোকার নেই।’
পরি বলে উঠল, ‘কুকুরদের ধরবার ক্ষমতাও নেই।’
মনে পড়ে গেল মাধবীর। শিবালয় শহরে বেশ কয়েকটা জার্মান শেফার্ড আছে, একটা ডোবারম্যান আর একটা গ্রেটডেন আছে। এরা এখনও হাঁকডাক করছে না কেন? শহর এক্কেবারে নিস্তব্ধ। এদেরকে কাবু করাও তো সহজ নয়।
সবচেয়ে কঠিন হল বেড়ালদের কব্জায় আনা। বৃহৎ শক্তিও পারে না। তবে এরা গেল কোথায়?
সুরেশ সাইকিয়া মাধবীকে বললেন, ‘বেশ কিছু লোক আসছে। তাদের থাকার জায়গা দরকার। এক ঘরে একসঙ্গে থাকতে চাই। হেডকোয়ার্টার করব সেখানেই। অপারেশন চলবে সেখান থেকেই। এরকম ঘরের সন্ধান দিতে পারবেন?’
ভেবে নিয়ে মাধবী বললে, ‘একটু দূরেই একটা বড় কাফেটেরিয়া আছে। নিচের তলায় বড় বড় দু’খানা ঘর। একটায় শোয়া যাবে আর একটায় খাওয়া যাবে।’
‘চলুন, দেখে আসি।’
‘এখন?’ মাধবীর চোখ ঘুরে গেল জানলার দিকে। যেখানে একটু আগেই রহস্যময় কালো পতঙ্গ ডানা ঝাপটে গেছে।
সুরেশ সাইকিয়া উঠে পড়ে বললেন, ‘চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, এখানে বসে থেকেও আপনি নিরাপদ নন।’
‘তা নই,’ উঠে পড়ল মাধবী, ‘নিরাপত্তা এই শহরের কোত্থাও নেই। শহরটাকে
চেনাই যাচ্ছে না।’
শচীন আর সুধাকরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সুরেশ সাইকিয়া। তিনজনের হাতেই শটগান। এদের গা ঘেঁষে চলেছে মাধবী। স্ট্রিট ল্যাম্পের অম্বর-প্রভার বাইরে চাঁদের আলোয় ধোওয়া পথ মাড়িয়ে চলেছে চারজনে।
শহর যেন দমবন্ধ করে রয়েছে। গাছগুলোও রুদ্ধশ্বাস। দু’পাশের বাড়িগুলো বাষ্প-স্বচ্ছ প্রতিকৃতির মতন যেন ঝুলছে দু’পাশে।
সুরেশ সাইকিয়া চলেছেন সবার আগে। কী যেন পায়ে মাড়িয়ে ফেললেন। চমকে উঠলেন। শুকনো ঝরাপাতা।
চারতলা বাড়িটা এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। মাধবী চিনিয়ে দিয়েছে ওই বাড়িতেই বসবে হেডকোয়ার্টার। গোটা বাড়িটা অন্ধকার। আলো নেই ভেতরে।
চারজনেই যখন রাস্তার ঠিক মাঝখানে, ঠিক তখন অন্ধকারের ভেতর থেকে কী যেন ছিটকে এল ওদের দিকে। সুরেশ সাইকিয়া চাঁদের আলোয় দেখলেন, যেন জলের ওপর ঢেউ খেলে গেল—ফুটপাতের চাঁদের আলোকে জল বলেই ভ্রম হচ্ছিল। হেঁট হয়ে টুপ করে বসে পড়েছিলেন তৎক্ষণাৎ। কানে শুনলেন, ডানার আওয়াজ। আলতোভাবে মাথা ঘষটে কী যেন বেরিয়ে গেল।
আর্ত চিৎকার ঠিকরে এল শচীনের গলা চিরে।
তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া।
মথ পোকা!
নিবিড়ভাবে বেষ্টন করে রয়েছে শচীনের মুণ্ড। কীভাবে, তা বুঝতে পারলেন না সুরেশ।
এখন চেঁচিয়ে উঠেছে সবাই, ছিটকে সরে গেছে শচীনের কাছ থেকে। কুঁই-কুঁই ডাক ছাড়ছে মথ পোকা—উচ্চনিনাদী। কানে যন্ত্রণা ধরানো ডাক।
চাঁদের রুপোলি আলোয় মখমল কোমল ডানা আরও ভালোভাবে লেপটে ধরল শচীনের গোটা মুণ্ড আর ঘাড়।
টলতে টলতে পেছিয়ে যাচ্ছে শচীন। অন্ধের মতন। দু’হাতে মুখমণ্ডলে লেপটে থাকা উৎপাতকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। আস্তে আস্তে কমে আসছে আতীক্ষ্ণ হাহাকার। সেকেন্ড দুয়েক পরে কুলুপ পড়ল গলায়।
যেন পক্ষাঘাতে পঙ্গু সুরেশ সাইকিয়া, মাধবী আর সুধাকর।
দৌড়তে গেল শচীন। কয়েক পা গিয়েই থমকে গেল। দু’হাতে মুখ আঁকড়ে ছিল এতক্ষণ, এবার ঝুলে পড়ল দু’পাশে। এখন ওর হাঁটু ভেঙে যাচ্ছে।
পক্ষাঘাত কাটিয়ে উঠেছেন সুরেশ সাইকিয়া। শটগান বাগিয়ে দৌড়েছেন শচীনের দিকে।
দু’হাঁটু ভেঙে গেলেও পড়ে গেল না শচীন। কম্পমান দুই হাঁটুকে গায়ে গায়ে ঠেকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝাঁকুনি দিয়ে দুই কাঁধ বেঁকিয়ে নিয়েছে। মুচড়োচ্ছে গোটা শরীর, ঠিক যেন ইলেকট্রিক কারেন্ট বয়ে যাচ্ছে শরীরের মধ্যে দিয়ে।
এক হাত বাড়িয়ে শচীনের মুখ থেকে মথ পোকাকে টেনে ছিঁড়ে আনতে গেছিলেন সুরেশ। তার আগেই নেচে উঠেছিল শচীন—যন্ত্রণা আর শ্বাসকষ্ট আর যেন সইতে পারছে না। দু’হাতে খামচে ধরছে বাতাস। নেচে নেচে রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, কাঁধ দুলছে ডাইনে-বাঁয়ে—যেন পুতুলনাচিয়ের সুতোর টানে নেচে চলেছে গোটা শরীর। দু’হাত শিথিল হয়ে ঝুলছে শরীরের দু’পাশে। হাতের মুঠি খুলছে, ফের বন্ধ হচ্ছে, কিন্তু কখনওই উঠে এসে খামচে ধরছে না মুখ-ঘিরে-থাকা কদাকার আতঙ্ককে। এই মুহূর্তে তার নাচ যেন পরম সুখের—যন্ত্রণার নয়। পেছন পেছন এগিয়েছিলেন সুরেশ তবে কাছে যাওয়ার আগেই…
রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল শচীন।
সেই মুহূর্তে শূন্যে উঠে পড়ল মথ। স্বল্পক্ষণের জন্যে ভেসে রইল বাতাসে দুই ডানায় ভর দিয়ে। দুই চোখ অমনিশাকালো অসীম ঘৃণায় পরিপূর্ণ। ছোঁ মারল সুরেশের দিকে।
পিছিয়ে এসেই দুই বাহু দিয়ে নিজের মুখ চাপা দিয়েছিলেন—পড়ে গেছিলেন রাস্তায়।
তাঁর মাথার ওপর দিয়ে পিছলে বেরিয়ে গেল মথ।
মোচড় মেরে শরীর ঘুরিয়ে সেদিকে তাকিয়েছিলেন সুরেশ। ঘুড়ির সাইজের মথ নিঃশব্দে পিছলে চলে যাচ্ছে শূন্যপথে রাস্তা বরাবর। ওদিকের বাড়ির সারির দিকে।
শটগান তুলে ধরেছে সুধাকর, নির্ঘোষ ধ্বনি কামান গর্জনের মতো কাঁপিয়ে
দিল শহরকে।
সোজা যেতে যেতে হেলে গিয়ে ঠিকরে গেল মথ। লটপটিয়ে রাস্তায় আছাড় খেতে খেতেও সিধে হয়ে উঠে গেল ওপরে—মিলিয়ে গেল বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে।
চিৎপাত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে শচীন। নড়ছে না।
তার মুখ নেই। মুখটা যেন ছিড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চুল আছে, কপাল ঘিরে চামড়ার ফিতে দেখা যাচ্ছে সাদা হাড়ের ওপর। কঙ্কাল মুখ চেয়ে আছে আকাশপানে।
সোফায় শোয়ানো রয়েছে শচীনের মৃতদেহ। চাদর দিয়ে ঢাকা ঘরের মাঝখানে ছ’জনে বসে মুখোমুখি। কেউ কারও চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। দম আটকানো অস্বস্তি সইতে পারল না মাধবী। টর্চ হাতে উঠে গেল মৃতদেহের কাছে। চাদর সরিয়ে টর্চ ফেলে দেখল। চাদর টেনে দিয়ে এসে বসল চেয়ারে।
বললেন সুরেশ সাইকিয়া ধরা গলায়, ‘কী দেখলেন?’
কেশে গলা সাফ করে নিয়ে মাধবী বললে, ‘এরকম মৃত্যু কী করে সম্ভব হয়, তাই ভাবছি। রাস্তায় রক্ত পড়ে থাকতে দেখেছিলেন? দেখেননি। চোখ নেই কোটরে—রক্ত পড়েছে কি জামায়? নেই। থই থই রক্তের মধ্যে পড়ে থাকা উচিত ছিল যার, তার শরীরের মধ্যে একফোঁটা রক্ত নেই। শিরাগুলো দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু রক্ত নয়—গোটা ব্রেন উধাও। চোখ, নাকের তরুণাস্থি, দাঁতের মাড়ি, জিব—গোড়া পর্যন্ত সমস্ত দশ থেকে বারো সেকেন্ডের মধ্যে নিমেষে পান করেছে ওই পোকা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, পান করেছে। সবই অ্যাসিড জাতীয় কিছু দিয়ে গালিয়ে পুড়িয়ে চোখের পলক ফেলবার আগেই গিলে ফেলেছে। আমি আর ভাবতে পারছি না।’
সুরেশ সাইকিয়া ম্লানস্বরে বললেন, ‘দোষটা আমারই। রাস্তায় না বেরলেই হত।’
মাধবী বললে, ‘রাস্তায় পরে বেরলেও একই ঘটনা ঘটত। অন্তত একজনের অবস্থা এই রকম হত। দেখিয়ে দিল ওদের ক্ষমতা কতখানি। ফোর্স নিয়ে এসে করবেন কী? শটগান নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। চোখে আঙুল দিয়ে ওরা দেখিয়ে দিয়ে গেল—ওদের খপ্পর থেকে পরিত্রাণ নেই। হয়তো ডাইনোসরদের আমলে ছিল এমন পতঙ্গ, কিন্তু হঠাৎ এখানে এল কীভাবে?’
ঘর নিস্তব্ধ। ক্ষণপরেই শোনা গেল দূরায়ত ক্ষীণ গুঞ্জন।
জানলায় দৌড়ে গেল ছ’জনেই। দূর রাস্তায় লাল আলোর ফ্ল্যাশ দেখিয়ে আসছে। তিনটে গাড়ি।
আলো কাঁপল এই সময়ে। নিভু নিভু হয়ে ফের জ্বলে উঠল।
রাত এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট। শুরু হল ডাকিনী মুহূর্তের প্রতীক্ষা…
৯
ভুজঙ্গ বোনাৰ্জী কলকাতায় এসেছেন দিল্লি থেকে বিজনেসের ব্যাপারে।
এখন সকাল আটটা। দিনটা বড় বিষন্ন ধূসর মেঘ ভেসে যাচ্ছে শহরের ওপর দিয়ে। ভোর থেকেই ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিও চলছে। ভিজে গাছগুলোর ডালপালা নেতিয়ে নিঝুম। ফুটপাত দিয়ে যারা হাঁটছে, তাদের সবার মাথায় ছাতা।
রকফেলার হোটেলের জানলার কাচে বৃষ্টি আছড়ে পড়ে গড়িয়ে নামছে। ডাইনিং রুম থেকে দেখা যাচ্ছে না বাইরের দৃশ্য।
জানলার কাছের টেবিলে বসে আছেন ভুজঙ্গ বোনার্জী। ব্রেকফাস্ট বিলের কৈফিয়ৎ দেবেন কীভাবে ম্যানেজমেন্টকে—তাই ভাবছেন। যে অতিথির আপ্যায়নের জন্যে এলাহি খাবার-দাবারের অর্ডার দিয়েছেন, তাঁর অর্ডার দেওয়া এখনও শেষ হয়নি।
ডক্টর উতঙ্ক চৌধুরী বসে আছেন টেবিলের ওদিকে। ভুজঙ্গ বোনার্জী তাজ্জব হয়েছেন ওঁর খিদের বহর দেখে। উতঙ্ক চৌধুরীর চশমার ব্রিজ ভেঙে গেছিল—ঝালাই করা হয়েছে। নিশ্চয় নিজেই করেছেন, পয়সা বাঁচানোর জন্যে। দক্ষ মিস্ত্রীর হাতে পড়লে ঝালাই দেখা যেত না। বয়স আটান্ন, কিন্তু বেশি বুড়িয়েছেন। সাদা চুল কানের ওপর লতিয়ে নেমেছে। ঘাড় সরু, চামড়ায় অজস্র ভাঁজ। শরীরে হাড় আর তরুণাস্থি বেশি—মাংস কম। এত যে অর্ডার দিলেন, সব খাবার খেতে পারবেন কি না সন্দেহ।
কিন্তু তিনি খেয়েই যাচ্ছেন। খেতে খেতেই শুধোলেন ভুজঙ্গ বোনার্জীকে, ‘দিল্লি থেকে উড়ে এলেন শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতে? প্লেন ফেয়ার তো সাড়ে চার হাজার, তাই না?’
‘শুধু আপনার সঙ্গে নয়, আরও কয়েকজন লেখকের সঙ্গে কথা বলব,’ অমায়িক গলায় বললেন ভুজঙ্গ। ‘বইয়ের বাজার মার খাচ্ছে। বৈচিত্র দরকার। লেখকের নাম নয়, চাই বিষয়।’
‘তার মানে, বিষয়ের কথা ভেবেই এসেছেন আমার কাছে?’
‘আপনার “আদিম শত্রু” বইটা আমি পড়েছি। প্রথম সংস্করণ। অসাধারণ।’
‘অসাধারণই বটে।’ বিষন্ন এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ডঃ চৌধুরীর ওষ্ঠে। ‘ওই বই প্রকাশ পাওয়ার আঠারো মাসের মধ্যে শেষ হয়ে গেলাম আমি। গণ্যমান্য পণ্ডিতরা রায় দিলেন আমার থিয়োরিগুলো নাকি অবাস্তব, বিজ্ঞানসম্মত নয়। জোর করে উত্তেজনা সৃষ্টি করে আমি নাকি সাধারণ মানুষের কাছে রাতারাতি বিখ্যাত হতে চাইছি। ঘরে-বাইরে জুটল কেবল বিদ্রুপ আর অবজ্ঞা। বাধ্য হয়ে ইউনিভার্সিটির চাকরিটা ছাড়তে হল। ভাবলাম কোপারনিকাসকেও তো একদিন উপহাস করেছিল লোকে। গ্রহ-তারা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন বলে চার্চের রোষের শিকার হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে জানা গেল তাঁর কথাই ঠিক।
কফিতে চুমুক দিলেন ভুজঙ্গ। বললেন, ‘আপনার থিয়োরি এখনও চালু আছে বলে কি মনে হয় আপনার?’
‘নিশ্চয়। ইতিহাস হাতড়ালেই দেখবেন, অজস্র রহস্যময় অন্তর্ধানের কোনও সমাধান যুগিয়ে উঠতে পারেনি ঐতিহাসিক আর প্রত্নতত্ববিদ পণ্ডিতরা।’
টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন উতঙ্ক চৌধুরী। ঝোপের মতন পুরু ভুরুর নিচে ছলছলে চক্ষুযুগলে যেন সম্মোহনী শক্তি জাগ্রত করলেন। বললেন, ‘১৯৩৯ সালে দশই ডিসেম্বর নানকিং পাহাড়ের বাইরে দশ হাজার চীনে সৈন্য অদৃশ্য হয়ে গেছিল। কোনও চিহ্ন রেখে যায়নি। যুদ্ধ করেও মরেনি। একটা দেহও দেখতে পাওয়া যায়নি। জাপানিজ মিলিটারি ঐতিহাসিকরা এই দশ হাজার সৈন্যের আর কোনও হদিস পায়নি। স্রেফ ভ্যানিশড। যেখান দিয়ে গেছিল এই দশ হাজার সৈন্য, সেখানকার চাষারাও তাদের যাওয়ার আওয়াজ শোনেনি। একটা বন্দুক ছোঁড়ার আওয়াজও পায়নি, স্রেফ বাতাসে মিশে গেল গোটা একটা আর্মি। আবার দেখুন, ১৭১১ সালে স্প্যানিশ যুদ্ধে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল চার হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী!’
জ্বলজ্বল করছে প্রফেসরের চোখ। বইতে লেখা প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন দেখতে পাচ্ছেন, ‘মায়া শহরে একই কাণ্ড ঘটেছে আরও ব্যাপকভাবে। শুধু একটা শহরে নয়—পরের পর শহরে। হাজারে হাজারে, লাখে লাখে শহর ছেড়ে চলে গেছে আন্দাজ ৬১০ খ্রিস্টাব্দে। খুব সম্ভব এক সপ্তাহের মধ্যে—একদিনেই, কেউ পালিয়েছে উত্তরে—নতুন শহরের পত্তন ঘটিয়েছে। তবে অসংখ্য মানুষ যে অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে প্রমাণও আছে। রান্নার বাসনপত্র পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। উর্বর জায়গা পেলে মানুষ সেদিকে চলে যায় ঠিকই, কিন্তু দরকারি জিনিসপত্র ফেলে যাবে কেন? ফেলে গেলে, পরে এসে নিয়ে যায়নি কেন? কয়েকটা শহর দেখা গেছে, খাবার সাজিয়ে বসেছিল কিন্তু না খেয়ে চলে গেছে। একমাত্র আমার থিয়োরি ছাড়া আর কোনও থিয়োরি দিয়ে অদ্ভুত এই ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা করা যায় না।’
‘শুনেও তো ভয় লাগছে,’ বলেলেন ভুজঙ্গ।
‘লাগবেই তো।’
আর কোনও কথা না বলে খাবার নিয়ে তন্ময় হয়ে রইলেন প্রফেসর। যেন, দীর্ঘদিন ভালো জায়গায় ভালো খাবার-দাবার জোটেনি।
তারপর শুরু করলেন, ‘পৃথিবীতে যত রকম রহস্যজনক অন্তর্ধান ঘটেছে, সব ক’টার ব্যাখ্যা আমার এই একটা থিয়োরি দিয়ে করার চেষ্টা করেছিলাম। সেটাই অন্যায় করেছিলাম। আর কিচ্ছু করিনি। লাখে লাখে মানুষ আর ইতর জীব রাতারাতি কেন শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে—তার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মরেছি।’
ভুজঙ্গ বললেন, ‘আপনার বই পাবলিশড হওয়ার পর সেরকম ঘটনা আর ঘটেছে?’
‘ঘটেছে, ঘটেছে, ভ্যানিশ হওয়ার ঘটনা আবার ঘটেছে।’
‘সে কী! তাহলে তো খবরের কাগজে তা ছাপা হত!’
‘হয়নি তো কী করব! তবে দুটো ঘটনার খবর আমি জানি। একটা খবর ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছিল নিউজ পেপারে—কেননা অদৃশ্য হয়েছিল মাছ—মানুষ নয়। আমি জেনেছিলাম সায়েন্টিফিক জার্নালে। বছর আষ্টেক আগে প্রশান্ত মহাসাগরের একটা অঞ্চলে বেশ কয়েক প্রজাতির মাছ নাটকীয়ভাবে কমে যায়। সংখ্যায় অর্ধেক হয়ে যায়।’
‘জলদূষণ,’ বললেন ভুজঙ্গ।
‘কয়েকশো বর্গমাইল জুড়ে জলদূষণ ঘটা সহজ নয়। সেরকম কোনও পদার্থও আবিষ্কার করা যায়নি। তা ছাড়া, মরা মাছগুলো তীরে ভেসে আসেনি, স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গেছিল। চিহ্ন না রেখে।’
উত্তেজিত হলেন ভুজঙ্গ বোনার্জী। টাকার গন্ধ পেলেন। ভদ্রলোকের নাকে বেস্টসেলারের গন্ধ ঠিক ধরা পড়ে—আজও ভুল হয়নি। উতঙ্ক চৌধুরীকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, “আদিম শত্রু” বইটার শুষ্কতা পরিহার করে সরসভাবে সাধারণ পাঠকের জন্যে লিখতে হবে, এবং অবশ্যই ইংরেজি ভাষায়। নাম দেবেন “দি অ্যানসিয়েন্ট এনিমি”। ওয়ার্ল্ড মার্কেট অবধারিত।
মুখে বললেন, ‘আর একটা কেস কী?’
‘১৯৮০-তে ঘটেছিল আফ্রিকায়। মধ্য আফ্রিকার একটা দুর্গম জায়গা থেকে বাতাসে মিলিয়ে গেছিল তিন-চার হাজার জংলি মানুষ। গ্রাম খালি, জিনিসপত্র যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে, খাবারদাবার পর্যন্ত। যেন, সব ফেলে দিয়ে হঠাৎ পালিয়েছে জঙ্গলে। খানকয়েক মাটির পাত্র শুধু ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেছিল। রাজনৈতিক কারণে গণহত্যা হয় ওই অঞ্চলে। সেক্ষেত্রে লাশ পড়ে থাকে। এ গ্রামে তা নেই। কয়েক সপ্তাহ পরে জানা গেল, ওই অঞ্চলে জন্তু জানোয়ারের সংখ্যাও অবিশ্বাস্যভাবে কমে গেছে। দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র আছে, কিন্তু কারুর মাথায় তা আসেনি।’
‘আপনি কিছু জানেন?’
‘আঁচ করেছি।’
‘অদৃশ্য হওয়ার ঘটনাগুলো কিন্তু ঘটছে বহু দূরের অঞ্চলে—যাচাই করা কঠিন।’
‘ঠিক। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে সমুদ্রে—কেননা, ভূগোলকের সবচেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে আছে সমুদ্র। চাঁদ যেমন নাগালের বাইরে, সমুদ্রও তাই। আর, সমুদ্রের তলায় কী ঘটছে, তা তো জানার বাইরে।’
‘আপনার কি মনে হয়, সভ্য দুনিয়ায়, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এমন ঘটনা আজও ঘটতে পারে?’
‘নিঃসন্দেহে।’
‘কলকাতায় বা দিল্লিতে?’
‘নিশ্চয়। আমার বইতে ভূত্বকের নিচে কোথায় এমন জায়গা রয়েছে, তার ম্যাপ এঁকে দেখিয়ে দিয়েছি।’
সার্সির গায়ে আরও জোরে আছড়ে পড়ল বৃষ্টি।
উতঙ্ক চৌধুরীর থিয়োরী বিশ্বাস করেননি ভুজঙ্গ বোনার্জী। তবে বুঝেছিলেন, এই বিষয়ের বইয়ের কাটতি আছে।