২০
টেলিফোনে আর্মির এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললেন অপরাজিতা সোম। যা যা ঘটছে, সংক্ষেপে বলে গেলেন। আগাগোড়া বুঝলেন, ‘আদিম শত্রু’ শুনছে প্রতিটি কথা। টেলিফোনে শোনা যাচ্ছে খুব অল্প হিসহিস আওয়াজ। তাই কতকগুলো যন্ত্রের অর্ডার দিয়ে গেলেন। কোত্থেকে পাওয়া যাবে। তাও বলে গেলেন। কীভাবে পাঠাতে হবে সে বিষয়েও নির্দেশ দিলেন। গাড়ি করে অবশ্যই নয়—আদিম শত্রুর খপ্পরে পড়তে পারে। হেলিকপ্টারে করে নামিয়ে দিতে হবে শিবালয় শহরে হোটেলের সামনে।
সবশেষে বললেন, ‘ডক্টর চঞ্চল চক্রবর্তীর আবিষ্কারটা পাঠাবেন—তিন টিন।’
সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে এল আর্মি হেলিকপ্টার। তখন আকাশে সূর্য উঠে পড়েছে। অপরাজিত সোম টেলিফোনে কিছু খুলে না বললেও আর্মির অধিকর্তারা বুঝে নিয়েছিলেন, এত যন্ত্রপাতির আদৌ কোনও দরকার নেই তাঁর। সবই ধোঁকাবাজি। দরকার ওই তিনটে টিন, যার মধ্যে আছে ডক্টর চঞ্চল চক্রবর্তীর অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার।
দূরে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনেই পথে বেরিয়ে এল ছ’জনে। সুরেশ সাইকিয়া সবাইকে নিয়ে রাস্তার মাঝখানে হাত ধরাধরি করে গোল চক্র তৈরি করে ফেললেন। হেলিকপ্টার থেকে দড়ির ডগায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল একটা মস্ত পুলিন্দা। সেটা ভূমি স্পর্শ করতেই দৌড়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। পুলিন্দার আংটায় লাগানো আঁকশি খুলে দিলেন। সাঁ করে দড়ি উঠে গেল ওপরে। কাত হয়ে ঝড়ের বেগে শিবালয়ের মাথার ওপর দিয়ে চম্পট দিল হেলিকপ্টার। অপরাজিতা সোমের শরীর অপরিসীম ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে কিন্তু বাঁচার তাগিদে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নানান যন্ত্রপাতির মধ্যে থেকে তিনটে স্প্রেগান বের করলেন। মামুলি গান নয়। এরোসল ট্যাঙ্ক স্পেয়ার। হাতে পাম্প করতে হয় না। সিলিন্ডারে ঠেসে রাখা বাতাস স্প্রে করিয়ে দেয়। প্রত্যেকটা ট্যাঙ্ক পিঠে ঝুলিয়ে নেওয়া যায় বেল্ট দিয়ে। হাতে থাকে নমনীয় রবারের হোসপাইপ, যার শেষে রয়েছে চার ফুট লম্বা ধাতুর তৈরি স্প্রেগান। বারো থেকে চোদ্দো ফুট দূরেও স্প্রে করে দেওয়া যায়।
একটা তুলে নিলেন অপরাজিতা সোম। আর্মির লোক বুদ্ধিমান। ট্যাঙ্কের মধ্যে ডক্টর চঞ্চল চক্রবর্তীর আবিষ্কার ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই এত ভারী। তিনটে আলাদা টিনে রয়েছে সেই একই আবিষ্কার।
ভয়-ভয় চোখে চারপাশ দেখে নিলেন অপরাজিতা সোম। ‘আদিম আতঙ্ক’র ছায়াপাত ঘটেনি কোথাও। তবে অণু-পরমাণুতে যে-রকম শিহরণ জাগছে, মনে হচ্ছে তার আবির্ভাবের আর বেশি দেরি নেই।
ঝটিতি বললেন মাধবী, সুরেশ সাইকিয়া আর বিশু বোসকে, ‘বড্ড ভারী, আমি বইতে পারব না। আপনারা একটা করে নিন, কাঁধে ঝোলান। ডক্টর লাহা, প্লীজ, আপনি মেয়ে হলেও গায়ে জোর রাখেন। কুইক।’
আধ মিনিটও গেল না। তিনটে ট্যাঙ্ক ঝোলানো হয়ে গেল তিনজনের পিঠে। হাতে রইল স্প্রেগান, আঙুল রইল ট্রিগারে।
জিজ্ঞেস করলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কী করতে হবে?’
‘স্বরূপহীন যে শরীরেই অ্যাটাক করতে আসুক না কেন, গায়ে ছিটকে দেবেন।’
‘তাতে কী হবে?’
‘কাচের ডিশে যে দৃশ্য দেখেছিলেন, তাই দেখবেন। মৃত্যু।’
অপরাজিতা সোমের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশের ম্যানহোলের ঢাকনি ছিটকে গেল শূন্যে। অতিকায় অজগরের মতন সরীসৃপ দেহ বিদ্যুৎবেগে উঠে এসেই ধেয়ে এল অপরাজিতা সোমের দিকে। লকলকে একটা শুঁড় তার গলা পেঁচিয়ে ধরতেই স্প্রেগান তুলে সমানে পিচকারি চালিয়ে গেছিলেন সুরেশ সাইকিয়া। কিন্তু বিষম আক্রোশে ততক্ষণে অপরাজিতা সোমের কাটা মুণ্ড গড়িয়ে গেছে রাস্তায়।
অতিকায় সরীসৃপও অক্ষত নেই। ট্যাঙ্ক নিঃসৃত হলুদ তরল যেখানে যেখানে লেগেছে, সেখানে সেখানে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে চলেছে—সাদাটে তরল গড়িয়ে পড়ছে। আচমকা ম্যানহোলের বাইরে যেটুকু অংশ তাণ্ডব নৃত্য দেখিয়ে গেল সেইটুকু অংশ রইল বাইরেই, নিস্তেজ অবস্থায়। বাকি অংশ অন্তর্হিত হল ম্যানহোলের মধ্যে।
সুরেশ সাইকিয়া লাফিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন খোলা ম্যানহোলের সামনে। হেঁট হয়ে দেখলেন স্বরূপহীনের দানবিক জেলি। চকিতে স্প্রেগানের চোঙা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ট্রিগার, টিপে রইলেন।
স্প্রে করার ফলে ভেতরে কী হচ্ছে, তা আর দেখতে পেলেন না। তবে টের পেলেন পায়ের তলায়, রাস্তা দুলছে। গোটা রাস্তা উঠছে আর নামছে। প্রচণ্ড চাড় দেওয়া হচ্ছে ভেতর থেকে।
কানফাটানো শব্দে লম্বালম্বিভাবে ফেটে গেল রাস্তা। রাস্তার তলায় টানেল বরাবর ওপরকার রাস্তা আর আস্ত নেই। টানেলের বিভীষিকা গোটা শরীরটা ঢুকিয়ে বসেছিল তার মধ্যে। গোটা শরীরের কল্পনাতীত চাপে রাস্তা ফেটে গেল মাঝখান থেকে। পাথর আর কংক্রিটের চাঁই ঠিকরে ঠিকরে গেল শূন্যে।
টাল সামলাতে পারেননি উতঙ্ক চৌধুরী। গড়িয়ে গেছিলেন ভাঙা রাস্তার ভেতরে স্বরূপহীনের জেলির ওপরে। বিলীন হলেন নিমেষে।
ওদিকে বিশু বোস আর মাধবীও দৌড়ে গিয়ে তফাতে থেকে পিচকিরি চালিয়ে যাচ্ছেন ভাঙা রাস্তার নিচে ফাঁক-ফোকর দেখলেই।
উতঙ্ক চৌধুরীকে যেখানে গ্রাস করা হয়েছে সেখানে গভীর পাতালকূপ লক্ষ করেছেন সুরেশ সাইকিয়া। অতিকায় জেলিদেহ জখম অংশকে পরিত্যাগ করে দ্রুত নেমে যাচ্ছে সেই কূপের মধ্যে। নিশ্চয় কন্দরের গোপন গুহানিবাসে সংরক্ষিত রয়েছে তার ব্রেন। স্প্রেগান কাঁধ থেকে নিমেষে খুলে ফেললেন সুরেশ সাইকিয়া। তিনটে টিনের দুটো দু’হাতে তুলে নিয়ে লাফিয়ে নেমে গেলেন ভাঙা রাস্তার গহ্বরে। জেলিদেহ যেখানে দ্রুত সেঁধিয়ে যাচ্ছে সেইখানে একটা টিনের প্যাঁচানো ছিপি খুলে উপুর করে ধরলেন। হলুদ তরল হুড় হুড় করে গড়িয়ে গেল ভেতরে। শূন্য টিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যখন দ্বিতীয় টিনের ছিপি খুলছেন তখন কেঁপে উঠল পায়ের তলার চাঙড়। গোটা রাস্তা আর আশেপাশের বাড়ি দুলছে। ঠিক যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। পাতালের আদিম আতঙ্ক নিশ্চয় মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে শেষ আঘাত হানতে যাচ্ছে।
তিলমাত্র দেরি করলেন না তিনি। লাফ দিয়ে নেমে গেলেন আরও নিচে—কূপের ভেতরে। দ্বিতীয় টিনের হলুদ তরল পুরো ঢেলে দিলেন ভেতরে।
গুম গুম গুড় গুড় আওয়াজে আর কান পাতা যাচ্ছে না। ওপর থেকে বড় আর ছোট পাথর খসে নামছে কূপের ভেতরে। একটা পড়ল কাঁধে। হাড় বোধহয় ভেঙে গেল। কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করলেন না সুরেশ সাইকিয়া। হাঁচড়-পাঁচড় করে উঠতে লাগলেন ওপরে।
পাতালগহ্বর থেকে ভেসে এল সুগম্ভীর নিনাদ। একই সঙ্গে কাতরাচ্ছে অসংখ্য কণ্ঠস্বর মানুষ এবং পশুর। লক্ষ কোটি বছর ধরে যারা আহার্য হয়েছিল পাতালের আদিম আতঙ্কর, যাদের ক্ষুদ্র থেকে উন্নত ব্রেন জড়ো করে মহাবিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বরূপহীন অজানা বিভীষিকা, তারাও এখন মৃত্যুযন্ত্রণার সম্মিলিত আর্তরবে পাতাল বিদীর্ণ করে চলেছে।
রাস্তার ওপরে উঠে এলেন সুরেশ সাইকিয়া। উন্মাদের মতন দৃষ্টিচালনা করলেন সামনে-পেছনে-ডাইনে বাঁয়ে। ওই তো দূরে হেঁট হয়ে স্প্রেগান চালিয়ে যাচ্ছেন বিশু বোস আর মাধবী। পরি আঁকড়ে রয়েছে দিদিকে। তিনজনেই দাঁড়িয়ে একই জায়গায়। দুটো স্প্রেগানের লক্ষ্যই একই দিকে—রাস্তার ভেতরে।
ব্রেনের কিছু অংশ কি ওখানেও প্রসারিত হয়ে রয়েছে?
বাকি টিনটা এক হাতে তুলে নিয়ে দৌড়লেন সুরেশ সাইকিয়া। অন্য হাত তো নাড়তে পারছেন না। হাড় নিশ্চয় ভেঙেছে। মাধবী আর বিশু বোসের চাহনি নিবদ্ধ নিচের দিকে। দেখতেও পেলেন না সুরেশ সাইকিয়া এসে হাঁপাচ্ছেন পাশেই। চোখ নামিয়েই দেখলেন সুরেশ সাইকিয়া স্বরূপহীনের শরীর। ব্রেন কি না বোঝা যাচ্ছে না তবে একটা প্রায়-জমাট লাভাপিণ্ড যেন ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। পিচকিরি দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টা করছেন মাধবী আর বিশু কেস। বিকৃত স্বরে পরিকে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘টিনের ছিপি… খুলে দে।’
পরি সাঙ্গ করল সেই কাজ। এক হাতে ভারী টিন উপুড় করার ক্ষমতা নেই সুরেশ সাইকিয়ার। পরি তা দেখল এবং বুঝল। দু’হাতে টিনের পেছন দিক ধরে উপুড় করে দিল লাভাকুণ্ডর মতন স্বরূপহীনের শরীরের ওপর।
গোটা রাস্তা এবার চৌচির হয়ে গেল। প্রবল আক্ষেপে মহাকায় অবয়ব দিয়ে শিবালয় সড়ককে ভেতরের দিকে বিদীর্ণ করে দিল ‘আদিম আতঙ্ক’। তার কিছুক্ষণ পরেই গুড় গুড় গুম গুম শব্দ মিলিয়ে গেল। নৈঃশব্দ্য নেমে এল শিবালয় টাউনে।
পড়ে রইল শুধু ভাঙা, আধভাঙা আর হেলেপড়া বাড়ির পর বাড়ি।
বহুদূর থেকেও আর্মি হেলিকপ্টারে জওয়ানরা দেখেছিল প্রলয়কাণ্ডের ফলে উত্থিত ধুলো আর ঠিকরে যাওয়া পাথর। সব যখন চুপ, যখন ভাঙা রাস্তার ওপর ভাঙা কাঁধ নিয়ে বসে পড়েছেন সুরেশ সাইকিয়া, যখন চারটে রুমালে গিঁট দিয়ে ফেট্টি বানিয়ে জায়গাটায় আরাম দেওয়ার জন্যে সুরেশ সাইকিয়ার হাত গলায় বেঁধে ঝুলিয়ে দিচ্ছে মাধবী, তখন হেলিকপ্টার সগর্জনে উড়ে এল মাথার ওপর।
ডক্টর চঞ্চল চক্রবর্তীর অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারটা তাহলে কী?
বিরাট কিছু নয়। বিশেষ ধরনের অণুজীব—যার কাজ শুধু ব্যাধি সৃষ্টি করে যাওয়া। অত্যুন্নত গলনমিশ্র পন্থায় কোষে কোষে জোড়া লাগিয়ে আশ্চর্য এই ব্যাকটিরিয়া বানিয়েছিলেন ডক্টর চক্রবর্তী। দেখা গেল, এই অণুজীব আহার করে শুধু যৌগ হাইড্রোকার্বন—অশোধিত পেট্রলে যা থাকে। জাহাজ থেকে তেল বেরিয়ে সমুদ্রে ভেসে গেলে এই অণুজীব দিয়ে তেল পরিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া এই অণুজীবের আর কোনও কাজ ছিল না।
মোবাইল ল্যাবরেটরির কাচের ডিশে সামান্য লেগে ছিল এই অণুজীব। জানতেন শুধু অপরাজিতা সোম। তাই কাউকে না জানিয়ে আনিয়েছিলেন সেই অণুজীব হাইড্রোকার্বন দিয়ে গড়া ‘আদিম আতঙ্ক’র শরীর নাশ করার মতলবে। তার টিসু জীবন্ত, রকমারি হাইড্রোকার্বনে বোঝাই, যেন পেট্রলেটাম-এর ভায়রা ভাই।
অণুজীব পরমানন্দে আহার করেছে তাকে। হয়তো তার ব্রেনকেও। কেননা, শিবালয় টাউনে আর তার উৎপাত ঘটেনি।