কোথায় যেন গল্প শুনেছিলাম, একজনের মনের মধ্যে শনি প্রবেশ করেছিল। সে দেখলে, তার ঘরের সামনে দিয়ে একটি পরমাসুন্দরী মেয়ে যাচ্ছে। মেয়েটিকে সে বাড়িতে আনবার জন্যে আমন্ত্রণ করল। মেয়েটি বলে—তুমি আমাকে পথ থেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছ? কিন্তু শুনে রাখ বাপু, আমি হচ্ছি অলক্ষ্মী—যার সংসারে একবার আমি ঢুকি তাকে আমি ছারখার করে দিই।, লোকটি বলে—আমিও তাই চাই। জানো না, আমার শনির দশা চলেছে, আমার সুবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। এসো মা, আমার ঘরে এসো।
আমারও যেন সেই দশা!
দিব্যি সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কেটে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঘাড়ে যেন শনি চাপল। আমাকে বলল—ঐ দেখ, পথ দিয়ে অলক্ষ্মী যাচ্ছে, ওকে ডেকে নিয়ে এসো!
মনের মধ্যে সুবুদ্ধি বলে উঠল-ওরে, অমন কাজ করিস না। ও তোর সুখের সংসার ছারখার করে দেবে।
আমি তখন বধির হয়েছিলাম, সুবুদ্ধির উপদেশ আমি শুনিনি।
বড্ড বেশি বিশ্বাস করতাম অলককে। বড় গর্ব ছিল আমার। আমার ড্রেসিং-টেবিলের আয়নাটার ভেতর যে অপূর্বসুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে আমার নিত্য সাক্ষাৎ হয়, ওর ওপর বড় বেশি আস্থা রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, ঐ ড্রেসিং-টেবিলের আয়নার ও-প্রান্তে সন্ধ্যাবেলায় মাথায় গোলাপফুল গুঁজে যে মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে রোজ মিটিমিটি হাসে, তার প্রেমে বুঝি পাগল হয়ে আছে অলক। একটা কালো কুৎসিত স্লেট-পেনসিলের সাধ্যও হবে না সে গ্রানাইট-প্রেমের গায়ে আঁচড় কাটতে।কিন্তু কেন এ কথা ভাবলাম? অসম্ভবকে কি ইতিপূর্বেই সম্ভব করেনি পর্ণা? গৌতমকে কি ছিনিয়ে নেয়নি আমার আঁচলের গিঁট খুলে?
কিন্তু কেন এসব ভাবছি পাগলের মতো? সবই হয়তো আমার কপোলকল্পনা। অলক তো বলছে, বিশ্বকর্মা পূজার আগে ঐ নোংরা একয়ে মজুরগুলো নাকি ধর্মঘট করতে চায়। এই জন্যই তার কাজ বেড়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে রোজ রাত হচ্ছে। হোক রাত, ও তো অফিসেই থাকে। সেটা পরীক্ষা করে জেনেছি। রাত নটা বাজলেই অফিসে টেলিফোন করি। সাড়া পাই। ও বলে, আর একটু দেরি আছে। পর্ণাও কি থাকে ওখানে অত রাত পর্যন্ত? জিজ্ঞাসা করতে সংকোচ হয়। কিন্তু থাকলেই বা কী? অফিসে আরও লোক থাকে, দোবেজী থাকে। হাজার হোক সেটা অফিস। অত ভয় কি আমার?
ভয় কি সাধে! আমি যে জানি, ও হচ্ছে–বিষকন্যা!
ও এসেছে আমার সুখের সংসারে আগুন দিতে।
সেদিন অলকের মন বুঝবার জন্যে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলাম-তুমি বলেছিলে পর্ণাকে একদিন বাড়িতে আনবে, কই আনলে না তো?
ও বললে-না, ভেবে দেখলাম সেটা উচিত হবে না। হতে পারে এককালে সে তোমার সঙ্গে পড়ত-কিন্তু এখন তোমার সঙ্গে তার আসমান-জমিন ফারাক। এই তফাতটা বজায় রাখাই ভালো। আর তা ছাড়া মেয়েটি খুব সুবিধেরও নয়, তোমার মুখের ওপরই বলছি-লাই দিলেই হয়ত মাথায় উঠতে চাইবে।
শুনে আশ্বস্ত হলাম। পর্ণাকে তাহলে ঠিকই চিনেছে ও। হাজার হোক অলক মুখার্জি গৌতম নয়! অত সহজে গলে যাবার মতো মাখনের মানুষ নয় সে।
তবু আমার মন যেন কাঁটা হয়ে থাকে। কোথাও কোনো ছায়া দেখলেই আমার মনে হয় এ বুঝি গ্রহণের পূর্বাভাস। বিষকন্যার বিষের নিশ্বাসের শব্দ যেন শুনতে পাই মাঝে মাঝে। কন্তু সামান্য কারণে আঁতকে উঠি। সেদিন গাড়ির ভেতর একটা সেন্ট-সুরভিত লেডিস-রুমাল কুড়িয়ে পেয়ে ঐভাবে, আঁতকে উঠেছিলাম। অলক যখন বললে যে, সে আমারই জন্য রুমালটা কিনেছিল–তারপরে কখন পকেট থেকে পড়ে গেছে জানে না, তখন নিশ্চিন্ত হই।
কিন্তু মদের মাত্রাটা আজকাল আবার বাড়িয়েছে। লক্ষ্য করেছি, যখনই ওর মনে দ্বন্দ্ব আসে ও মাত্রা বাড়ায়। আমার অসুখের সময় যেমন হয়েছিল। কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়েছিল সেবার! এবার অবশ্য মাত্রা বাড়াবার সংগত কারণ আছে। শ্রমিক-ধমর্ঘট! কিন্তু অলক তো বারে বারে বলেছে, সে সব মিটমাট হয়ে যাবে। সেটুকু বিশ্বাস আমারও আছে। বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই সব মিটমাট হয়ে যাবে। পূজার পরেই এবার ছাঁটাই করতে বলব ওর স্টেনোকে। অলকই তো বলেছে অতি অপদার্থ মেয়েটা। কী দরকার ওকে রাখার? ওকে ডেকে এনেছিলাম একদিন সুযোগমতো অপদস্থ করব বলে—সেটা সেরে নেব এবার। বেশিদিন ওকে রাখা দুঃসাহসের কাজ হবে। সব কথা বরং অলককে খুলে বলি। দরকার হয় গৌতমের কথাও। বিয়ের আগে যদি গৌতমকে ভালবেসে থাকি–সে কি আমার অপরাধ? আজকালকার ছেলে-মেয়েদের প্রাকৃৰিবাহ জীবনের ইতিহাসে অমন এক-আধটা অধ্যায় থাকেই। শুনলে অলকের মূছা যাবার কোনো কারণ নেই। এত বছর ঘর করার পর এ নিয়ে নতুন করে মান-অভিমানের কোনো অর্থ হয় না। আর হলেও বাঁচি। অন্তত তাতেও এই একঘেয়ে জীবনে একটা বৈচিত্র্য আসবে। না হয় থাকলই দুদিন অভিমান করে। তবু সব কথা খুলে বলতে হবে–আর অনুরোধ করব, ঐ মেয়েটাকে ছাঁটাই করতে। অনুরোধ কেন? বাধ্য করব। আমার কথা ও কোনোদিন ঠেলতে পারে না, পারবেও না!
কিন্তু তার আগে বিশ্বকর্মা পুজো!
বছরে এই একটি দিন! শাড়ি-সজ্জার এক প্রদর্শনী। কারখানার মাঠে শামিয়ানা খাটিয়ে মঞ্চ করা হয়। সামনে গদি-আঁটা খানকয়েক চেয়ার খালি থাকে বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য। অভিনয় শুরু হওয়ার আগে হয় পুরস্কার বিতরণী। বাৎসরিক স্পাের্টসে যারা প্রথম-দ্বিতীয় হয়েছে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। মঞ্চের ওপর সাজানো থাকে নানান উপহার। গদি-আঁটা চেয়ারে আমাকে গিয়ে বসতে হয় মঞ্চের ওপর। পাদপীঠের জোরালো আলোয় ঝলমল করতে থাকে আমার সর্বাঙ্গ! একে একে নাম ডাকে কেউ। আমি হাতে তুলে দিই পুরস্কার। ওরা হাত পেতে নিয়ে যেন ধন্য হয়ে যায়। নত হয়ে নমস্কার জানায়। সে নতি, আমি জানি, শুধু কারখানার মালিকপত্নীকে নয়–সে নতি ওরা জানায় সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে। বার্ষিক স্পাের্টসে ওরা যে আপ্রাণ দৌড়ায়, লাফায়, সে কি শুধু ঐ পুরস্কারের লোভে? মোটেও নয়! দৌড়বার সময় ওদের মনে পড়ে এই মুহূর্তটির ছবি-যে মুহূর্তটিতে ওরা আসে আমার সেন্টসুরভিত সান্নিধ্যে, হাত পেতে প্রসাদ নিতে।
এবারও আমি গিয়ে বসব ডায়াসে। এবার পরে যাব সবুজ রঙের নাইলনটা। পান্নার জড়োয়া সেটটা পরব সেদিন। মাথায় দেব জুইয়ের একটা মালা। আগে থেকে অলককে বলে রাখব, যেন পর্ণাকে নেওয়া হয় অভ্যর্থনা-কমিটিতে। পাশেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ওকে। আমার পক্ষে তাকে চিনতে পারা শক্ত। কারখানায় কত কর্মী, আমি কী করে চিনব? পর্ণা নিশ্চয়ই স্তম্ভিত হয়ে যাবে! হঠাৎ বুঝতে পারবে–যে ধনকুবেরের অধীনে চাকরি পাওয়ার আশায় সে একদিন আবেদনে লিখেছিল—এই অসহায় দরিদ্র রমণীকে দয়া করে কাজটি দিলে প্রতিদানে কর্মক্ষেত্রে সে সকল শক্তি প্রয়োগ করবে—সেই অফিস-বস, সেই বড়সাহেবের সঙ্গে রীতিমতো লাভ-ম্যারেজ হয়েছে সুনন্দা মুখার্জির! মনিব-গিন্নি! কথাটা ভাবলেও হাসি পায়। পর্ণা নিশ্চয়ই গম্ভীর হয়ে যাবে। হঠাৎ মাথা ধরার অছিলায় সরে পড়তে চাইবে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার অজুহাত ছাড়া তার আর উপায় কী? কিন্তু ওগো পর্ণা দেবী! আলমগীর যে ভুল করেছিলেন আমি তা করব না! অসুস্থতার অজুহাতে তোমাকে আমার কারাগার থেকে পালাতে দেব না! সে না অভ্যর্থনা-কমিটির লোক! দায়িত্ববোধ নেই ওর? পর্ণাকে ডেকে বলব-আপনি বুঝি—; না–আপনি কেন? বলব–তুমিই বুঝি ওর স্টেনন? আই সী! এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়াও না ভাই।বলব–আমার ড্রাইভারকে একটু ডেকে দাও না লক্ষ্মীটি—না না ব্যিউইকটা নয়-ওটা তোমার সাহেবের–আমার ড্রাইভার আছে আমার গাড়িতে—হ্যাঁ, ঐ কালো পন্টিয়াকটায়–থ্যাঙ্ক য়ু!
পর্ণা নিশ্চয়ই আজও জানে না, তার বড়সাহেবের মেমসাহেবটি কেমন মানুষ। রূপের প্রশংসা শুনে থাকবে সহকর্মীদের কাছে। নিশ্চয়ই তার কৌতূহল আছে প্রচণ্ড হয়তো বেচারি উদগ্রীব হয়ে আছে এই সুযোগে মনিব-গিন্নিকে একটু লুব্রিকেট করতে। চাকরি জীবনে অসহায় দরিদ্র রমণীর তোষামোদই তো উন্নতির একমাত্র সোপান। বিশ্বকর্মা পুজোর আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। অলকের ব্যস্ততার আর সীমা নেই। শুনেছি, ব্যস্ততার কারণ পুজো নয়–শ্রমিক য়ুনিয়ানের গণ্ডগোলের জন্যই। কিছুদিন হল শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটা খুব তিক্ত হয়ে উঠেছে। এরা মাঝে মাঝে ছাঁটাই করছে অবাঞ্ছিত শ্রমিক নেতাকে, ও পক্ষ করছে টোকেন-ধর্মঘট অথবা অবস্থান ধর্মঘট। অবস্থাটা ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে। অলক অবশ্য বারে বারে বলছে, শ্রমিক উপস্থিতির লালকালির দাগটা এখনো সমান্তরালই আছে-কিন্তু ও নাকি গোপনে সংবাদ পেয়েছে, চার্টের দাগটা যে কোনোদিন অতল খাদের দিকে হুমড়ি খেয়ে সোজা নেমে যেতে পারে। কিন্তু ভয় তো আমার ধর্মঘটকে নয়!
সেদিন বলেছিলাম—সন্ধ্যার পর বাড়িতে বসেই কাজ করলে পার?
ও বলে–কেন, ভয়টা কিসের? তোমার বান্ধবীকে তো? যখন তোমাদের সঙ্গে কলেজে পড়তেন তখন তার কী মূর্তি ছিল জানি না, কিন্তু এখন তার চেহারাটা যদি একবার দেখতে বুঝতে পারতে যে, তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই।
আমি বলি—আ হা হা! আমি যেন তাই বলছি!
ও আমাকে আদর করে বলে–যার ঘরের কোণে এমন ভরা পাত্র-ঝরনাতলার উছল পাত্রটার দিকে তার নজর যায় কখনও?
কী কথার ছিরি! আজকাল আবার মাঝে মাঝে বাংলায় উদ্ধৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাকে খুশি করার জন্য। এর চেয়ে ইংরেজি বুকনিও ছিল ভালো। অন্তত যা বলতে চায়, তার মানে বোঝ যায়। উপমান-উপমেয়ের তফাত যে বোঝে না—সে কেন এমনভাবে চাল দিয়ে কথা বলতে যায়? রবিবাবুর উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলার ফ্যাশন যেন একটা মুদ্রাদোষ আজকালকার ছেলেমেয়েদের!
কিন্তু যে কারণেই হোক, অলক শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেল আমার কাছে। ও স্বীকার করল, পর্ণাকে সে ব্যবহার করতে চায় কাঁটা তোলার কাজে। একখণ্ড সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখিয়ে বললে— মেয়েটা কাজের আছে। এই কাগজের অফিস থেকে এক শিট গ্যালি-প্রুফ চুরি করে এনেছে। কাগজটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমি। চার পাতার একটা সাপ্তাহিক। বিজ্ঞাপন কিছুই নেই। ভাঙা টাইপ, খেলো কাগজ। প্রথম বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা। অর্থাৎ যে ধরনের কাগজ নিত্য বের হয়, নিত্য বন্ধ হয়। কিন্তু আমার দৃষ্টি আটকে গেল সম্পাদকের নামটায়। সম্পাদক—গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমি ডুবে গিয়েছিলাম অতীতের আমিতে। অলকের কথা আর কানে যায়নি আমার। কলেজ জীবনে আমরা এই নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছি-আমরা একটা কাগজ বার করব। আমি আর গৌতম। আমি তার প্রুফ-রীডার-কাম ম্যানেজার, গৌতম তার পাবলিসিটি অফিসার-কাম এডিটর। আমাদের পুঁজি অল্প, কিন্তু আদর্শ বিরাট। বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করব না আমরা। মেহনতি মানুষদের কথা থাকবে তাতে। কৃষককে, শ্রমিককে যারা শোষণ করছে তাদের মৃত্যুবীজ বপন করে যাব আমরা ঐ কাগজে। হয়তো সে চারাগাছের মহীরুহ-রূপ দেখতে পাব না আমরা; কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিল সে গাছ একদিন ফল দেবেই! আমাদের সেই কল্পলোকের পত্রিকার নামকরণ আমিই করেছিলাম-দেওয়ালের লিখন। আগামী দিনের হুঁসিয়ারি থাকবে আমাদের সেই কাগজে। যাদের চোখ আছে তারা পড়ে নাও–রাইটিং অন দ্য ওয়াল?
আশ্চর্য! সেই কাগজ এতদিনে বার করেছে গৌতম। আর তার চেয়েও বড় কথা, সে আমার দেওয়া নামটাই বজায় রেখেছে। তা রাখুক, তবু আমি বলতে বাধ্য-গৌতম আদর্শচ্যুত। লক্ষ্যভ্রষ্ট, ব্রাত্য সে। যারা সতিকারের সর্বনাশ ডেকে আনছে দেশের, কোটি কোটি টাকা ফরেন এক্সচেঞ্জ ফাঁকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে গৌতমের কলম রুদ্ধবাক। তার যত তর্জন-গর্জন এই অলক মুখুজ্জেদের মতো চুনোখুঁটির ওপর। অলক ইনকাম ট্যাক্স কঁকি দেয় না, কালোবাজারি করে না, শ্রমিকের স্বার্থ সব সময়েই দেখে–তবু তার ওপরেই ওর যত আক্রোশ। কেন? সে কি জানে যে, তার সুনন্দাকে ছিনিয়ে নিয়েছে ঐ অলক? না, তা তো সে জানে না। জানার কথা নয়। তাহলে?
আর পর্ণা? তার কথা তো জলের মত পরিষ্কার। গৌতম ব্যানার্জি শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে কালনাগিনীর স্বরূপ। পাত্তা দেয়নি পর্ণাকে, তাই আজও মিস্ পর্ণা রায় চাকরি করে জীবনধারণ করছে। পর্ণা তাই গৌতমের ওপর প্রতিশোধ নিতে বসেছে। তার খবর গোপনে বেচে আসছে অলকের কাছে। এ কথা গৌতমকে জানিয়ে দিলে কেমন হয়? কিন্তু না। তাতে অলকের ক্ষতি।
ঠিক করলুম, অলককে অবাক করে দিতে হবে। যে কাজ পর্ণা পারে তা যে আরও সুচারুরূপে সুনন্দা পারে, এটা অলকের কাছে প্রমাণ করা চাই। না হলে এখানেও হার হবে আমার।
যে কথা সেই কাজ। পত্রিকা অফিসের ঠিকানাটা লিখে নিলাম এক টুকরো কাগজে। মতলব ঠিক করাই আছে। সোজা চলে গেলাম নমিতাদের বাড়ি। মনগড়া এক আষাঢ়ে গল্প শোনাতে হল তাকে। আমার এক গরিব বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাব। তাই ভাল শাড়িটা তার কাছে রেখে, গহনাপত্র খুলে রেখে যাব সেখানে। নমিতা বুদ্ধিমতী। বলে—বান্ধবী না হয়ে যদি বন্ধুই হয়, আমার আপত্তি কী?
আমি বলি—তোর মন ভারি সন্দেহবাতিক।
নমিতা হেসে বলে কিন্তু মিস্টার মুখার্জি কোথায়?
—আজ আসানসোলে গিয়েছে। কাল ফিরবে।
–তাই বুঝি আজ বান্ধবীকে মনে পড়েছে?
আমি আর কথা বাড়াতে দিই না।
বেলেঘাটার বাসে চেপে মনে হল–কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? আমাকে যদি এ বেশে কেউ দেখে ফেলে? আমাদের সমাজে বড় একটা কেউ বাসে চাপে না। সেদিক থেকে ভয় নেই। কিন্তু ওর কারখানার কত লোক আমাকে চেনে, যাদের আমি চিনি না। বাসের ঐ কোনায় ঐ যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন, তখন থেকে দেখছি উনি আমাকে লক্ষ্য করছেন। সে কি শুধু আমার রূপের জন্য? না কি আমার পরিচয় জানেন উনি? অবাক হয়ে ভাবছেন—মাথা খারাপ হয়েছে নাকি মিসেস্ মুখার্জির। কিন্তু না। অত শত ভাবতে গেলে আমার চলে না। আমি তো আমার যমজ বোনও হতে পারি। ওরা কি জানে, অলক মুখার্জির শালীকে দেখতে ঠিক তার স্ত্রীর মতো কিনা?
বাস চলেছে টিকিয়ে টিকিয়ে। ক্রমে লোকজনে বাসটা বোঝাই হয়ে গেল। নামব কী করে রে বাবা? ফুটবোর্ডে বাদুড়-ঝােলা হয়ে মানুষ ঝুলছে যে! কী করে বাসে-ট্রামে মেয়েরা যায়? শালীনতা রক্ষা করাই দায়।
বাসের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। বাইরে জনতার স্রোত। আজ ওদের সঙ্গে একটা একাত্মতা অনুভব করছি। আজ আমি ওদেরই একজন। আজ আমার পরনে সাধারণ মিলের শাড়ি, হাতে কাচের চুড়ি—গলায় প্যাক কোম্পানির মেকি হার, কানে পুঁতির দুল! আজ আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। চাকরি করি, রেশনের দোকানে লাইন দিই, সন্ধ্যাবেলায় ছোট-ছোট মেয়েদের নিয়ে অন্ধকার স্যাৎসেতে ঘরে প্রাইভেট টুইশানি করি।
–বেগবাগান, বেগবাগান!
একদল মানুষ নামছে, একদল উঠতে চাইছে। কী অমানুষিক প্রচেষ্টা! কেউ কারো তোয়াক্কা রাখে না। ধাক্কা দিয়ে, ঠেলা দিয়ে মানুষ উঠছে অথবা নামছে। আমিও কি নামবার সময় ও রকম কনুইয়ের তত মারব নাকি? পারব?
–টিকিট?
কন্ডাকটার এসে দাঁড়িয়েছে ভিড়ের মধ্যেও।
ছোট্ট হাত ব্যাগ খুলে বার করে দিই নোটটা, বলি—বেলেঘাটার মোড়ে নামব।
–তা নামুন না, কিন্তু দশ টাকার নোটের ভাঙানি নেই। খুচরো দিন।
–কত?
–পঞ্চাশ।
ব্যাগ হাতড়ে দেখি খুচরো মিলিয়ে বিশ পয়সার বেশি নেই।
কন্ডাকটার ধমকে ওঠে-ভাঙানি না নিয়ে ওঠেন কেন? এই ভিড়ে দশ টাকার ভাঙানি কোথায় পাই আমি?
কৌতূহলী জনতার দৃষ্টি এসে পড়ে আমার ওপর। নানা রকম মন্তব্য।—আহা, নেই বলছেন ভদ্রমহিলা, বিশ পয়সারই টিকিট দাও না ভাই।
–দয়া-দাক্ষিণ্য করার আমি কে স্যার? স্টেটবাস তো আমার পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। ছাড়ব কোন আক্কেলে?
বৃদ্ধ ভদ্রলোক তবু আমার হয়ে সুপারিশ করেন—আহা মেয়েছেলে–
ও পাশ থেকে একজন অল্পবয়সি ছোকরা ফোড়ন কাটে—মেয়েছেলে বলে তো মাথা কেনেননি। বাসে-ট্রামে দশ টাকার নোট যে ভাঙানো যায় না তা জানা নেই ওঁর? আজই বাসে নতুন চড়েছেন নাকি?
আর একজন বলেন–এ এক চাল! টিকিট ফাঁকি দেওয়ার ফিকির!
বৃদ্ধ তবু আমতা আমতা করে বলেন—তবু, মেয়েমানুষ–
–আরে মশাই, আপনার অত দরদ কেন? বয়স তো অনেক হল দাদু!
শুধু আমার নয়, বৃদ্ধেরও কান লাল হয়ে ওঠে সে কথায়!
কন্ডাকটার তাগাদা দেয়–এক টাকার নোট নেই?
বাধ্য হয়ে বলতে হয়না! সবই দশ টাকার!
ছোকরা ফোড়ন কাটে–হায়! হায়! দেবী চৌধুরাণী রে! সবই মোহর।
ভেতরে ভেতরে জ্বলছি তখন আমি। কন্ডাকটরকে বলি—এই দশ টাকার নোটখানাই তুমি রাখ, ভাঙানি দিতে হবে না।
সবাই একটু হকচকিয়ে যায়।
বৃদ্ধ বলেন—সে কী! না হয় আমিই দিয়ে দিচ্ছি কটা পয়সা!
ছোকরা বলে–হ্যাঁ, ওঁর ঠিকানাও বরং জেনে নিন। একদিন পয়সাটা নিয়ে আসবেনএকটু চা-টাও খেয়ে আসবেন।
ও পাশের একজন ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বলেন–আঃ! কী হচ্ছে?
ছোকরা বলে-নভেল হচ্ছে দাদা! বাস টিকিটের ইতিকথা!
আমার স্টপেজ এসে গিয়েছিল। উঠে পড়লাম। ভিড় ঠেলে নেমে পড়ি বাস থেকে। জানলা গলিয়ে দশ টাকার নোটখানাই ছুঁড়ে দিই কন্ডাকটারকে। বলি—ভাঙানি হলে ঐ ছোকরাকে দিয়ে দিও। ওর অশ্লীল রসিকতার দাম।
বাস ছেড়ে দেয়।
মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তবু ঠিকানা খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছানো গেল সেই একতলার সৎসেতে ঘরখানায়।
দেওয়ালের লিখন পত্রিকার অফিস। ছোট্ট ঘর। দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছে। বিজলি বাতি। অসঙ্কোচে আরশোলা ঘুরছে টেবিলে, মেঝেতে। নড়বড়ে একটা টেবিল। হাতল-ভাঙা খানদুই চেয়ার। টেবিলের ওপর একরাশ কাগজ, ফ, মাটির ভাঁড়ে বিড়ির টুকরো। সামনের চেয়ারে বসে আছে যে। মানুষটি তাকে দেখলাম দীর্ঘদিন পর। চোখ তুলে সেও দেখল আমাকে। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল!
ঘরে আরও একজন লোক ছিল। বৃদ্ধ, চোখে চশমা। তাতে মোটা কাচ। সুতো দিয়ে বাঁধা কানের সঙ্গে। সেও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উপভোগ করলাম দৃষ্টিটা। হাতদুটি বুকের কাছে জড়ো করে বলি—এটাই কি দেওয়ালের লিখন কাগজের অফিস?
গৌতম কথা বলতে পারে না, প্রতি-নমস্কার করতেও ভুলে যায়। বৃদ্ধ ভদ্রলোকই আমার কথার জবাব দেন—হ্যাঁ মা। কাকে খুঁজছেন?
—সম্পাদককে।
—ইনিই।
আমিই বসে পড়ি সামনের চেয়ারটায়।
–নমস্কার! আপনিই গৌতমবাবু?
গৌতম সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ, কী চান?
–কাগজে আপনারা একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন দেখলাম–রীডার চাই। তাই—
বাধা দিয়ে গৌতম বলে—কাগজে বিজ্ঞাপন? কোন কাগজে?
এবার থতমত খেয়ে যেতে হয় আমাকে। একান্তভাবে আশা করেছিলাম, আমার মনগড়া কাহিনীটা গৌতম মেনে নেবে। অন্তত তৃতীয় ব্যক্তির সামনে এভাবে আমাকে জেরা করবে না। কী বলব ভেবে পাই না।
–কই, আমরা তো কোনো বিজ্ঞাপন দিইনি! কাটিংটা এনেছেন?
দাঁতে দাঁত চেপে বললাম—কিন্তু–
একটা বিড়ি ধরিয়ে গৌতম বলে–মাপ করবেন। ঠিকানা ভুল হয়েছে আপনার। আমরা কোনো বিজ্ঞাপন দিইনি।
আমি উঠে পড়ি। সপ্রতিভভাবে বলি—তা হবে! বিরক্ত করে গেলাম, মাপ করবেন আমাকে।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে গৌতম বলে–বিজ্ঞাপন দিইনি, কিন্তু প্রুফ-রীডারের সত্যিই প্রয়োজন আছে আমাদের। আপনি কি এর আগে প্রুফ-রীডিং করেছেন?
এবারে সত্যি কথাই বলি-কলেজ ম্যাগাজিনে এককালে করেছি। দুদিনেই শিখে নিতে পারব।
–অ। লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
আপাদমস্তক জ্বলে গেল আমার। সে কথার জবাব না দিয়ে বলি–এক গ্লাস জল পাব?
বৃদ্ধ শশবস্তে বলেন—নিশ্চয়ই। বসুন, দিচ্ছি।
যা ভেবেছিলাম তা হল না। বৃদ্ধকে স্থানত্যাগ করতে হল না। ঘরের ভেতরেই ছিল কুঁজো-গ্লাস। অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে জল এনে দিলেন তিনি।
গৌতম বলল–চা খাবেন?
–খেতে পারি।
–রতনবাবু, মোড়ের দোকান থেকে–
–এক্ষুনি আনছি স্যার—
বৃদ্ধ চলে যেতেই আমি ধমকে উঠি-সব জেনেশুনেও এভাবে আমাকে জেরা করার মানে?
গৌতম হেসে বলে—সব আর জানি কই? বড়লোকের মেয়ে; বি. এ. পাস করলে। বিয়ে করেছ–অথচ তোমার এই হাল!
বললাম–সব কথাই বলতে চাই। চাকরিটা হবে কিনা বল?
—সত্যিই চাকরির দরকার তোমার?
–এখনও সন্দেহ আছে?
–না। কিন্তু তোমার স্বামী–
–স্বামীর কথা থাক।
–তা না হয় থাক, কিন্তু আমার কাগজের যা আর্থিক অবস্থা—
কথাটা ওর শেষ হল না। বৃদ্ধ ফিরে এলেন দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে।
গৌতম বললেএর বেশি আমরা দিতে পারব না, আপনি রাজি?
বললাম–রাজি না হয়ে উপায় কী? তবে কাজ দেখে পরে না হয় কিছু বাড়িয়ে দেবেন।
–সে পরে দেখা যাবে। আপনি কি এখানে বসেই দেখবেন? প্রুফ দেব?
–আজ বরং নিয়ে যাই। কাল এনে দেব।
–বেশ রতনবাবু, তিন নম্বর পাতার গ্যালিটা এঁকে দিন।
রতনবাবু একগাদা কাগজ এনে দিলেন আমার হাতে।
চা খাবার পর গৌতম বৃদ্ধকে বলে—আমি একটু বের হব। যদি প্রকাশ আসে বসতে বলবে। আমি ঘন্টাখানেকের ভেতরেই ফিরে আসছি।
দুজনেই বেরিয়ে পড়ি অফিস থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি ফুটপাথ ধরে। একটু দূরে এসে বলি–মাত্র একঘন্টার সময় নিয়ে এলে?
গৌতম বলে—চল, ঐ পার্কটায় বসি।
—চল।
পার্ক ঠিক নয়। ফাঁকা মাঠ। এখনও বাড়ি ওঠেনি। বর্ষার জল জমে আছে এখানে ওখানে, তবু ওরই মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় দুজনে বসি। গৌতম বলে–তারপর? তোমার কী ব্যাপার? এ হাল হল কী করে?
বলি–সে তো দীর্ঘ ইতিহাস। বিয়ে করেছি সে তো দেখতেই পাচ্ছ। স্বামীর রোজগারটাও আন্দাজ করতে পার। আর কী জানতে চাও বল?
-বাবা বেঁচে আছেন?
–না।
–ভায়েরা দেখে না?
—দেখতে চাইলেও আমি দেখতে দেব কেন?
ল্যভ-ম্যারেজ? হেসে বলি–না, লোকসান-ম্যারেজ!–থাক কোথায়?
—ঐ প্রশ্নটার জবাব আমি দেব না।
–ভালো কথা, ফর্মা পিছু দু টাকা করে দেব তোমাকে। তাতে কুলোবে?
আমি আবার বলি-রাজি না হয়ে উপায় কী? তবে কাজ দেখে পরে না হয় কিছু বাড়িয়ে দেবেন। একটু ইতস্তুত করে গৌতম বলে—আজ কিছু আগাম নেবে?
মানিব্যাগ খুলে একটা দশ টাকার নোট বার করে। আমি বলি–না! একটা টাকাই দাও এখন! ফেরার ভাড়া। আর এ টাকাটাও আমি দান নিচ্ছি না। তোমার কাগজের নাম দিয়েছি আমি। এ তারই মজুরি।
গৌতম ম্লান হাসল।
বলি—তোমার খবর কী?
–কী খবর জানতে চাও?
–বিয়ে করেছ?
–করেছি।
হেসে বলি-বউ পছন্দ হয়েছে?
গৌতমও হেসে বলে–আমি যদি তোমার ভাষায় বলি—স্ত্রীর কথা থাক।
—আমি বলব, তা না হয় থাক।
গৌতম একটু ইতস্তত করে বলে—পর্ণার খবর জান?
হঠাৎ কেমন যেন রাগ হয়ে গেল আমার। বললাম—গৌতম, তুমি যদি চাও–তোমার স্ত্রী এবং আমার স্বামীর গল্পও করতে পার তুমি–কিন্তু ঐ মেয়েটির নাম আর আজকের সন্ধ্যাটায় নাই বা আলোচনা করলাম।
গৌতম হেসে বলে–তার মানে তুমি আজও তাকে হিংসে কর?
আমি বলি—না। তার মানে তুমি আজও তাকে ভুলতে পারনি।
গৌতম প্রতিবাদ করে না।
আর করে না বলেই আমার মনের সুর কেটে যায়।
বিরক্ত হয়ে বলি—কী যে তুমি দেখেছিলে ঐ মেয়েটার মধ্যে–
বাধা দিয়ে গৌতম বলে—কিন্তু এই মাত্র তুমি বললে আজ সন্ধ্যাটায় ওর কথা আমরা আলোচনা করব না।
আমি বিরক্ত হয়ে বলি-হ্যাঁ, তুমি চাও মুখে আমরা ওর কথা আলোচনা করব না। অথচ মনে মনে শুধু তুমি ওর কথাই ভাববে।
গৌতম আবার হেসে বলে–তুমি একটুও বদলাওনি। দি সেম ওল্ড জেলা ইয়াং লেডি!
আমি বলি—বরং কাজের কথা বল শুনি। পত্রিকা কত ছাপছ? ফিনান্স কী রকম? বিজ্ঞাপন নেই দেখলাম। পাচ্ছ না, না নিচ্ছ না? কোনও ফিচার দিতে চাও?
গৌতম বলে–কাগজের কথা আজ আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না।
বলি-তাহলে তো মুশকিল। আমার স্বামীর কথা নয়, তোমার স্ত্রীর কথা নয়, তোমার প্রাকৃবিবাহ জীবনের ধ্রুবতারার কথা নয়, এমন কি কাগজের কথাও নয়। তাহলে কী আলোচনা করব আমরা? আজকের ওয়েদার? সিনেমা? রাজনীতি? ক্রিকেট খেলা?
গৌতম সে কথার জবাব না দিয়ে বলে—তোমাকে দেখে আজ আমি একেবারে অবাক হয়ে গেছি। সত্যি করে বলত সু, কেন তুমি এসেছ আমার কাছে?
বললাম—কী আশ্চর্য! সে তো আগেই বলেছি, চাকরির চেষ্টায়।
একটু চুপ করে থেকে গৌতম বলে–আমার বিশ্বাস হয় না। কেমন করে তুমি নেমে এলে এত নীচে?
–নেমে এলাম না উঠে এলাম?
গৌতম ধমক দিয়ে ওঠে-সিনেমার ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা কর না সু! এ দুনিয়ায় বাঁচতে হলে অর্থের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পার না তুমি। তোমার বাপের যথেষ্ট পয়সা ছিল। ভালো ঘরে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা–শিক্ষায়, বিদ্যায়, রূপে–
বাধা দিয়ে আমি বলি–এ যুগের ছেলেরা অন্ধ হলে আমি কি করতে পারি গৌতম? রূপের জাল তো বিস্তার করেও ছিলাম। কিন্তু জাল কেটে রুই-কাতলাগুলো বেরিয়ে গিয়ে যদি কাগজের সম্পাদক হয়ে বসে, তাহলে আমি কী করতে পারি?
লক্ষ্য করে দেখি, গৌতম অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। একটা চোরকাঁটা দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে অন্যদিকে চেয়ে বসে আছে।
বলি—কী ভাবছ বল ত?
–একটা কথা সত্যি করে বলবে?
—বল না, কী কথা।
—কেন তুমি আজ এসেছ আমার কাছে? কী চাও তুমি সত্যি সত্যি?
ডায়েরি লিখতে বসে আমার মনে হচ্ছে—প্রশ্নটা কঠিন। অথচ কী তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে দিয়েছিলাম আমি। এখন নিজেকেই যদি ফের ঐ প্রশ্নটা করি, তাহলে নিজেকে কী কৈফিয়ত দেব? কেন গিয়েছিলাম আমি গৌতমের কাছে? দুঃসাহসিকার মতো! সে কি আমার অভিসার? ময়লা শাড়ি আর কাচের চুড়ি পরে একটি বেলা ওর সমতলে গিয়ে দাঁড়াবার সখ? যে জীবনকে পাইনি তাকে কয়েকটা খণ্ড-মুহূর্ত ধরে উপভোগ করবার ভাইকেরিয়াস তির্যক আস্বাদন? এ কি আমার প্রাচুর্যের হাত থেকে সাময়িকভাবে পালাবার জন্য এসকেপিজম? না কি সত্যিই গিয়েছিলাম গৌতমের কাগজের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করতে? আমি অলকের যেমন ক্ষতি করতে পারি না, তেমনি সজ্ঞানে গৌতমেরও কি ক্ষতি করতে পারি? এত কথা তখন আমি ভাবিনি। মুখে-মুখে তৈরি জবাব দিয়েছিলাম–সে তো আগেই বলেছি, টাকার জন্য।
হয়তো বিশ্বাস করল গৌতম, হয়তো করল না। বলল, বেশ, তাই মেনে নিলুম। কিন্তু আজ আর নয়, এবার উঠতে হবে আমায়।
–আর একটু বস না।
–না, কাজ আছে। একজন লোকের আসার কথা আছে।
–গৌতম, প্লীজ।
তবুও উঠে পড়ে। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে-তোমার এ কথাটা ঠিক আগের কথার সঙ্গে খাপ খেল না। তুমি এসেছিলে টাকার জন্য। টাকা তোমাকে দিয়েছি, আরও দেব। কিন্তু অহেতুক সময় নষ্ট করে কী হবে বল?
মনে মনে হাসি। এ তাহলে অভিমান। যাক, ওর অভিমান ভাঙাবার সুযোগ পরে পাব। আপাতত আমিও উঠে পড়ি।
গৌতম বলে–আবার কবে আসছ?–কালই।
—না, কাল এস না। আমি থাকব না। তুমি বরং প্রুফটা ডাকে পাঠিয়ে দিও।
ও চলে যাবার উপক্রম করতে বললুম-আমার ঠিকানাটা তোমায় দিতে পারছি না, তবে এই ঠিকানায় চিঠি লিখলে আমি পাব।
নমিতার ঠিকানা একটা কাগজে লিখে গুঁজে দিই ওর হাতে।
গৌতম চলে গেল। আশ্চর্য, একবারও পেছন ফিরে তাকাল না।