অলকনন্দা – ২

কাজটা বোধ হয় ভালো করিনি। অবশ্য এখন আর ভেবে কী হবে? কেন এ কাজ করলাম। কিন্তু করব নাই বা কেন? এইতো স্বাভাবিক। ভাগ্য বিড়ম্বনায় আজ ও বেচারি নেমে গিয়েছে অনেক নিচে। দু-মুঠো অন্নের জন্য বেচারিকে কত দরখাস্ত করতে হয়েছে। আর আমি আজ উঠে এসেছি ওর চেয়ে অনেক অনেক উঁচুতে। অথচ একদিন আমরা একই ক্লাসে বসতাম। একই বেঞ্চিতে। আমি ওকে দয়া না করলে কে করবে?

যেদিন অলক দরখাস্তের বান্ডিলটা আমাকে এনে দিল সেদিন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলাম, ওর মধ্যে আছে একটি দীন আবেদন-মিস্ পর্ণা রায় করুণ ভাবে ভিক্ষা করছে একটি চাকরি— মিসেস সুনন্দা মুখার্জির স্বামীর কাছে? জানলে ও নিশ্চয়ই এখানে দরখাস্ত করত না। করত না? নিশ্চয়ই করত! যে রকম নির্লজ্জ আর হ্যাংলা প্রকৃতির মেয়ে ও—ঠিক এসে ধরনা দিত আমার কাছে। সোজাসুজি এসে ধরত আমাকে। কী বলতাম? বলতাম–আমি দুঃখিত। চাকুরিপ্রার্থিনীদের যোগ্যতা বিচারের ভার যার উপর তিনিই দেখে নেবেন। এ বিষয়ে কোনো অনুরোধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ম্লান হয়ে যেত ওর মুখটা। কিন্তু না, ও যদি জানতে পারত যে, যে ছিল কলেজ-জীবনে তার চরমতম শত্রু-সেই সুনন্দা চ্যাটার্জির স্বামীই হচ্ছেন এই অলক মুখার্জি-তাহলে হয়তো ও এই চাকরির জন্য দরখাস্তই করত না। আমার তো বিশ্বাস আজও যদি সে ওকথা জানতে পারে তাহলে চাকরিতে ইস্তফা দেবে। তাই জানতে ওকে আমি দেব না। অর্থাৎ ভালো করে একদিন ওকে জানিয়ে দেব সেকথা।

সেদিন দরখাস্ত দেখেই ওকে চিনতে পেরেছিলাম। নিঃসন্দেহ হলাম ছবি দেখে। কিন্তু পর্ণা রায় এখনও মিস্ কেন? তাহলে গৌতম ব্যানার্জি কোথায় গেল? তা ছাড়া পর্ণা পাস করল কেমন করে? বছর পনেরো আগেকার কথা মনে পড়ছে। কী মধুর ছিল দিনগুলো! বোমার হিড়িকে আমরা সপরিবারে কলকাতা ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছি মফস্বলের একটা শহরে। সে বছরই আমি আই. এ. পাস করলাম। বাবা কিছুতেই আর আমাকে কলকাতায় রাখবেন না। তার বিশ্বাস জাপানিরা নাকি আমারই মাথায় ফেলবে বলে বোমা জমিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া কলকাতার বাড়িও তখন তালাবন্ধ। বাধ্য হয়ে নাম লেখালাম মফস্বলের সেই কলেজে।

শহরের একান্তে একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ। তার উল্টো দিকে ক্রিশ্চান মিশনারী স্কুল। মাঝখান দিয়ে কালো পীচমোড়া রাস্তাটা চলে গেছে কলেজের দিকে। না, ভুল বললাম! আমরা যখন পড়তাম তখনও রাস্তাটা ছিল লাল-খোয়াবাঁধানো ধুলোর রাস্তা। প্রথম যেদিন ক্লাস করতে গেলাম, সেদিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে। ক্লাস নিচ্ছিলেন বি. আর. ডি. জি.। পুরো নামটা আজ আর মনে নেই। কলেজের সব অধ্যাপককেই আমরা নামের আদ্যক্ষর দিয়ে উল্লেখ করতাম। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরে ঢুকবার অনুমতি চাইলাম। দেখলাম, সারা ক্লাসটা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আজ না হয় আমার বয়স হয়েছে তখন আমি ছিলাম—যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী। ক্লাস ছুটি হতে মেয়েরা সব যেচে ভাব করতে এল আমার সঙ্গে। কদিনেই লক্ষ্য করলাম ছেলেগুলো আমাকে কেন্দ্র করেই ঘুরঘুর করছে। হাত থেকে রুমালটা পড়ে গেলে পাঁচটা ছেলের মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যায়–কে আগে কুড়িয়ে দিতে পারে। অল্পদিনেই শুনতে পেলাম, আমার নতুন নামকরণ হয়েছে–কলেজ-কুইন!

কলকাতা কলেজের অভিজ্ঞতা ছিলই, বরং মফস্বলের ছেলেরা একটু মুখচোরা। তা হোক, তবু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রচারিত হয়ে গেল আমার কথা—শুধু সুন্দরী বলে নয়, ভালো ছাত্রী বটে, বেস্ট ডিবেটার বলে, টেবিল-টেনিস চ্যাম্পিয়ান বলে। আমার অপ্রতিহত গতির সামনে কেউ কোনো দিন এসে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। আমি কলেজে আসতাম একটি লেডিজ-সাইকেলে চেপে। প্রথম দিন ক্লাস ছুটি হবার পর দেখি চাকায় হাওয়া নেই। বুঝলাম কেউ দুষ্টুমি করেছে। কয়েকটি ছেলে গায়ে পড়ে সহানুভূতি জানাতে এল। পাম্প করে দেবার প্রস্তাব করল কেউ কেউ। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে অস্বীকার করলাম। কলেজ থেকে অদূরে ক্রিশ্চানপাড়ার মোড়ে ছিল একটা সাইকেল-সারানোর দোকান। সেখানে পাম্প করিয়ে নিলাম। দোকানির সঙ্গে বন্দোবস্ত করলাম সেটা মাসিক এক টাকায় জমা রাখার। দু-একবার ক্লাসের বোর্ডে কলেজ-কুইনের নামে অহেতুক উচ্ছ্বাস-মাখানো দু-এক লাইন কবিতা পড়েছি। গ্রাহ্য করিনি। বুঝতাম, এগুলো আমার প্রাপ্য। কই, আর কারও নামে তো কবিতা লেখা হয় না!

এই প্রসঙ্গে আলাপ হয়ে গেল একদিন গৌতম ব্যানার্জির সঙ্গে। সে এক অদ্ভুত ঘটনা। সেদিন একটু দেরি করে এসেছি। শুনলাম, আমি আসার আগে নাকি ক্লাসে একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। গিরীন ঘোষ বলে একজন গুণ্ডাপ্রকৃতির ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে। সে নাকি বোর্ডে আমার নামে কী সব লিখছিল। করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বুঝি নজরে পড়ে গৌতমের। সে ক্লাসে ঢুকে গিরীনকে বারণ করে। তখনও ছাত্রীবাহিনীর চালচিত্র পেছনে নিয়ে অধ্যাপকের মূর্তির আগমন ঘটেনি ক্লাসে। গিরীন রুখে ওঠে—আমাদের থার্ড-ইয়ার ক্লাসে তো কেউ আপনাকে মাতব্বরি করতে ডাকেনি।

গৌতম ফোর্থ-ইয়ারের ছাত্র! সে বলে-ওসব থার্ড-ইয়ারও বুঝি না–এসব থার্ড-গ্রেড ইয়ার্কিও বুঝি না। ফোর্থ ইয়ারে ওঠেননি বলেই কিছু অভদ্রতা করবার মতো নাবালক নন আপনি।

অল্প কথা-কাটাকাটির পরেই হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। গিরীনরা ছিল দলে ভারী। গৌতমই মার খেয়েছে বেশি।

গৌতম ছেলেটিকে চিনতাম—ফোর্থ-ইয়ারের সেরা ছেলে। সব দিকেই বেশ চৌকস। যেমন দেখতে, তেমনি পড়াশুনায়। আলাপ ছিল না ওর সঙ্গে না থাক, ঠিক করলাম ছুটির পরে ছেলেটির সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ জানাব। ছুটির পর খোঁজ নিতে গিয়ে শুনলাম, গৌতম ফার্স্ট-এইড নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে।

দেখা হল পরের দিন। সে দিনটার কথাও ভুলব না। থার্ড পিরিয়ড অফ ছিল। বসেছিলাম মেয়েদের কমনরুমে। ঘরটা প্রফেসরদের ঘরের সংলগ্ন। কলেজপ্রাসাদের একান্তে। জানলা থেকে দেখা যায় বিস্তীর্ণ খেলার মাঠটা। মাঠের ওপাশে মিশনারী স্কুলের গির্জা। ক্রিশ্চানপাড়ার ঘরগুলি দেখা যায়। জানলার পাশেই একটা অশোকগাছ। বসন্ত চলে গেছে, তবু আজও ওর বসন্তবিদায় পর্ব শেষ হয়নি–ডালে ডালে লেগে আছে আবীরের ছোঁওয়া। গরম পড়তে শুরু করেছে। খেলার মাঠের ওপর তাপদগ্ধ প্রান্তরের দীর্ঘশ্বাস কেঁপে কেঁপে উঠছে আকাশের দিকে। কোথায় একটা হতভাগ্য কোকিল স্থান-কাল-পাত্র ভুলে একটানা ডেকে চলেছে এই তপোবনে! একপাল মোষ চলে গেল ধুলো উড়িয়ে—গলায় বাঁধা ঘন্টার ঠ ঠনঠন্ স্তব্ধ মধ্যাহ্নের অলসতার সঙ্গে সুন্দর ঐকতান রচনা করল। মনটা কেমন উদাস হয়ে ওঠে। কমনরুমটা খালি। মেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় বাগানে ঘুরছে। কোনো কোনো ভাগ্যবতীর আবার বান্ধবীর বদলে বন্ধুও জুটে গিয়েছে। অশোকতলায় একটু দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে ওদের। হঠাৎ নজরে পড়ল ফোর্থ-ইয়ারের গৌতম কয়েকটি ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে। ল্যাবরেটারি থেকে। উত্তেজিতভাবে কী একটা আলোচনা করতে করতে ওরা চলে যাচ্ছে লাইব্রেরীর দিকে। এতদিন ভালো করে লক্ষ্য করিনি ভদ্রলোককে। আজ দেখলাম! ফর্সা রঙ-চুলগুলো পেছনে ফেরানো, চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা। গায়ে একটা সাদা চুড়িদার পাঞ্জাবি, হাতাটা গোটানো। হাতে ল্যাবরেটারির খাতা, কঁাধে অ্যাপ্রন। বেয়ারাটার হাতে একটা স্লিপ দিয়ে ডেকে পাঠালাম।

বেয়ারাটা চলে যেতেই কেমন যেন লজ্জা করে উঠল। কেন এ কাজ করলাম? ভদ্রলোককে আমি চিনি না, মানে আলাপ নেই। এভাবে ডেকে পাঠানোটা কি ঠিক হল? কমনরুমের ও প্রান্তে ইতিমধ্যে কয়েকটি মেয়ে এসে বসেছে। তাই বেরিয়ে এলাম করিডোরে। দেখি বেয়ারার হাত থেকে ও কাগজটা নিল; ঝুঁকে পড়ল ওর বন্ধুরা কাগজটা দেখতে। আলোচনাটা থেমে গেছে ওদের। একজন কী একটা কথা বললে, ওরা সমস্বরে হেসে ওঠে। আর একজন গৌতমের পিঠে একটা চাপড় মারে। গৌতমকে খুব গম্ভীর মনে হচ্ছে। ও চশমাটা খুলল, রুমাল দিয়ে কাচটা মুছে ফের চোখে দিল। কী যেন জিজ্ঞাসা করল বেয়ারাটাকে, সে হাত দিয়ে আমাকে দেখাল।

গৌতম ধীরে ধীরে এগিয়ে এল আমার দিকে।

—আপনি আমাকে ডাকলেন?

–হ্যাঁ, মানে, কিছু মনে করবেন না। আপনার সঙ্গে আমার আলাপ নেই, তবু মনে হল আপনাকে ডেকে আমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।

—ধন্যবাদ! হঠাৎ খামকা আমায় ধন্যবাদ দেবেন কেন?

–কাল নাকি আপনি আমারই জন্যে আহত হয়েছিলেন?

—আপনার জন্য? কই জানি না তো!

চমকে উঠলাম। ও অস্বীকার করতে চায় কেন ঘটনাটাকে? খবরটা আমি অনেকের কাছেই শুনেছি—কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই জোর দিয়ে বললাম–কাল গিরীনবাবুর সঙ্গে আপনার–

—ও হ্যাঁ, তা তার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?

–আমার নামেই গিরীনবাবু বোর্ডে লিখছিলেন—

–তাই নাকি, তা আপনার নামটা কী?

—সুনন্দা চ্যাটার্জি।

–কই ও নাম তো লেখেনি গিরীন!

–না, নামটা না লিখলেও আমাকেই মীন করেছিল।

–কী করে জানলেন? আমার যতদূর মনে আছে কোনো মেয়ের নামই সে লেখেনি। লিখেছিল কলেজ-কুইনের নামে দু-লাইন কবিতা। তা আপনি কেন ভাবছেন যে, আপনাকেই মীন করেছিল?

আপাদমস্তক জ্বালা করে ওঠে ওর ন্যাকামি দেখে। যেন কিছুই জানে না। বললাম—আমি কী ভাবছি সেটা কথা নয়—ক্লাসসুদ্ধ মেয়ে ভেবেছিল যে আমাকেই মীন করা হয়েছে।

ক্লাসসুদ্ধ মেয়ে মোটেই তা ভাবেনি। সবাই ভেবেছিল–ঠিক আপনি যা ভেবেছেন। কারণ প্রত্যেক মেয়েই ভাবে সেই বুঝি কলেজ-কুইন। আর মেয়েদের এই রকম ভ্রান্ত ধারণা আছে বলেই ছেলেরা ঐ রকম অসভ্যতা করে। ছেলেদের অসভ্যতাটা প্রকাশ্যে, কিন্তু তাতে ইন্ধন যোগায় মেয়েরাই। সিল্কের শাড়ি পরে আর একগাদা রঙ মেখে সঙ সেজে কলেজে আসতে তাদের সংকোচ হয় না বলেই ছেলেরাও বাড়াবাড়ি করে।

এর চেয়ে স্পষ্টভাবে আর কী করে অপমান করা যায়? আমার পরিধানে সেদিন ছিল সিল্কের শাড়ি। প্রসাধনটা নিখুঁত না হলে আমি বাড়ির বার হই না-কলেজেও আসতে পারি না।

রাগে অপমানে আমার কান দুটো ঝা-ঝা করতে থাকে। একটা কথাও বলতে পারি না। ঘন্টা পড়ে গিয়েছিল। দলে দলে সবাই বেরিয়ে আসছে ক্লাস থেকে। গৌতম হয়তো আরও কিছু বলত, হঠাৎ আমার ওপাশ থেকে একটি মেয়ে এগিয়ে এসে বলে-কী হচ্ছে গৌতম! তুমিও কাণ্ডজ্ঞান হারালে নাকি? মেয়েদের কমনরুমের সামনে দাঁড়িয়ে

বাধা দিয়ে গৌতম বলে—আমি এখানে স্বেচ্ছায় আসিনি পর্ণা। আমাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে।

স্লিপ কাগজটা পর্ণার দিকে বাড়িয়ে দেয় সে। পর্ণা হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিতেই গটগট করে গৌতম চলে যায়। পর্ণা আমার দিকে ফিরে বলে—কিছু মনে করবেন না। গৌতম একটু অন্য জাতের ছেলে। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি।

আমি বুলি–মাপ চাইবার কী আছে? আর তা ছাড়া গৌতমবাবুর হয়ে আপনিই বা মাপ চাইবেন কেন?

পাশ থেকে মীরা সেন বলে—তাতে কোনো দোষ হয় না। গৌতমবাবুর হয়ে মাপ চাইবার অধিকার আছে পর্ণার; ওরা দুজনে বুস-ফ্রেন্ড।

পর্ণা ওর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকায়; বলে—হ্যাঁ, ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমরা, সে কথা অস্বীকার করি না; এবং সে কথা তোমরা বললেও আমি আপত্তি করব না, তবে আমি আশা করব ভদ্রতর বিশেষণ ব্যবহার করবে তোমরা আমাদের বন্ধুত্বটা বোঝাতে!

পর্ণা মেয়েটিকে ইতিপূর্বে ক্লাসে দেখেছি–লক্ষ্য করিনি। লক্ষ্য করে দেখবার মতো কিছু ছিল না বলেই সম্ভবত দেখিনি ওকে। ও আমারই মতো এসেছে কলকাতার কলেজ থেকে ট্রান্সফার নিয়ে। পাতলা একহারা চেহারা। শামলা সাধারণ বাঙালিঘরের মেয়ে। আশ্চর্য, ঐ মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে গৌতম ব্যানার্জি।

মেয়েটিকে দ্বিতীয়বার স্বীকার করতে হল ফার্স্ট টার্মিনালের রেজাল্ট বের হবার পর। ওরও ছিল বাংলায় অনার্স। ও না থাকলে আমিই প্রথম হতাম ক্লাসে। সেই দিন থেকে শুরু হল আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিজ্ঞা করলাম, যেমন করে হোক ওর চেয়ে বেশি নম্বর পেতেই হবে। ক্রমশ পড়াশুনা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও ওর সঙ্গে ঠোকাঠুকি বাধতে শুরু হল। ক্লাসের মধ্যে দেখা দিল দুটি শিবির। সুনন্দা চ্যাটার্জি আর ক্লাসে একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী থাকল না। শাড়ি-গহনা, রুজ-লিপস্টিক, লেডিজ-সাইকেল এবং সর্বোপরি আমার রূপের সম্ভার সত্ত্বেও ক্লাসের সব মেয়েকেই আমার দলে রাখতে পারলাম না। কারণটা সহজেই অনুমেয়। ওদের দলে টানবার জন্য যেগুলো ছিল আমার অস্ত্র, সেইগুলোকেই আবার ঈর্ষা করত অনেকে। তারা যোগ দিল বিপক্ষ শিবিরে। সেদিন থেকে আমার ব্রত হল পদে পদে ওকে জব্দ করা, অপদস্থ করা, পরাস্ত করা।

আজ জনান্তিকে এই ডায়েরির পাতায় স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার সে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে পারিনি। কোনো ক্ষেত্রেই তাকে হারাতে পারিনি–অথচ সব বিষয়েই আমি ছিলাম শ্রেষ্ঠতর! আশ্চর্য মেয়েটা। পাতলা ছিপছিপে শ্যামলা সাধারণ মেয়ে। রঙিন শাড়ি কেউ তাকে কোনোদিন পরতে–দেখেনি। এক হাতে একগাছি চুড়ি, অপর হাতে রিস্টওয়াচ। চুপ করে বসে থাকে ক্লাসে,–নোট নেয় না –কমনরুমে আসে না। লাইব্রেরীতে দেখা যায় ওকে প্রায়ই–একা বসে বই পড়ছে। আমি মনে মনে তাল ঠুকি–কিন্তু ওকে হারাব কী করে? ও টেবিল-টেনিস খেলতে আসে না। স্যোসালে গান গাইবে না—শাড়ি সজ্জা-সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় পর্ণা আমাকে ওয়াক-ওভার দেয়। সম্মুখসমরে কিছুতেই নামবে না সে। অপরিসীম ক্ষমতা সত্ত্বেও ভারত সম্রাট আলমগীর যেমন পার্বত্য-মূষিকের কাছে বারে বারে ঘা খেয়েছিলেন—আমারও হল সেই হাল! আজ তাই তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছি আমার দরবারের মাঝখানে! এখানে ছোট দরজার মধ্যে দিয়ে আমার রাজসভায় তাকে প্রবেশ করতে হবে—মাথা আপনিই নত করতে হবে ওকে।

কিন্তু প্রতিশোধের কথা পরে। প্রথমে পরাজয়ের কথাগুলি অকপটে স্বীকার করতে হবে ডায়েরির পাতায়। প্রথম খণ্ডযুদ্ধের কথা বলেছি,টার্মিনাল পরীক্ষার খাতা। দ্বিতীয় পরাজয়ের কাহিনীটা আরও মর্মন্তুদ। হঠাৎ কী করে খবর রটে গেল পর্ণা রাজনীতি করে। সে যুগে রাজনীতি করতে হত গোপনে। কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তখনও রুদ্ধকারার অন্তরালে। শুনলাম, ছাত্র-য়ুনিয়নের নির্দেশ এসেছে একদিন হরতাল হবে; কারণটা আজ আর মনে নেই। কলকাতায় বুঝি গুলি চলেছে; তারই প্রতিবাদে হরতাল হচ্ছে। আমাদের কলেজেও ছাত্র য়ুনিয়ান ছিল। তারা ধর্মঘট ঘোষণা করল একদিনের জন্য। পর্ণা নাকি ছিল এই ধর্মঘটের একজন গোপন পাণ্ডা। কলেজ থেকে আমরা দলে দলে বেরিয়ে এলাম। অশোকগাছতলায় বিরাট ছাত্র সমাবেশ হল। গৌতম ছিল ছাত্রনেতা; সেই সভাপতিত্ব করল। আমি ভালো বক্তৃতা করতে পারতাম। ডিবেটিং-এ প্রাইজ চিরকাল বাঁধা ছিল আমার। ঠিক করলাম আজ পর্ণাকে হারাতে হবে। দেখি, কার বক্তৃতায় লোকে অভিভূত হয়। ও বসেছিল সভাপতির পাশেই—প্রায় গা-ঘেঁষে! সভা শুরু হতেই গৌতম আজকের ধমর্ঘটের কারণটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিল। তারপর সমবেত ছাত্র-ছাত্রীদের কিছু বলতে বলল। যেমন সাধারণত হয়ে থাকে—কেউই প্রথমটা এগিয়ে আসে না। এই সুযোগ। আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম-আমি কিছু বলতে চাই।

গৌতম চোখ থেকে চশমাটা খোলে। স্বভাবসিদ্ধভাবে কাচটা মোছে। পর্ণার সঙ্গে ওর দৃষ্টি বিনিময় হয়। তারপর ও বলে—বেশ তো, বলুন।

মনে আছে, ঝাড়া তিন কোয়ার্টার বক্তৃতা করেছিলাম। ব্রিটিশ ইম্পিরিয়ালিজম, নাজিজ, ফ্যাসিজম, কংগ্রেস, গান্ধী, সুভাষ বোস, জনযুদ্ধ–কাউকেই বাদ দিইনি। ঘন ঘন হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠল সভাস্থল। সে কী উদ্দীপনা ছাত্রদের মধ্যে! আমার পরনে ছিল লালরঙের একটা শান্তিপুরী শাড়ি, লাল ব্লাউজ, কপালে একটা লাল টিপ। বাতাসে আমার আঁচল উড়ছে, অবাধ্য কোঁকড়া চুলগুলো কপালের ওপর থেকে বারে বারে ঝুঁকে পড়ে। হাত নেড়ে বক্তৃতা করেছিলাম-মনে রাখবেন–এ যুদ্ধে এক পাই নয়, এক ভাই নয়।

দীর্ঘ বক্তৃতার পর যখন আসন গ্রহণ করি, তখন মুহুর্মুহু করতালিতে সকলে আমাকে অভিনন্দিত করল। আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে বসে পড়ি। পাশ থেকে কে একজন বলল—এর পর আর কেউ কিছু বলতে সাহস পাবে না বোধহয়।

সত্যিই কেউ এল না। গৌতম বলল—সুনন্দা দেবী যে সব কথা বললেন, যদিও আদর্শগত ভাবে আমি তার সঙ্গে সব বিষয়ে একমত নই, কিন্তু রাজনৈতিক তর্ক আমরা এখানে করতে আসিনি। যেখানে আমরা একমত শুধু সেখানেই হাত মেলাব আজ আমরা। এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ কি না সে প্রশ্ন আজ নাই তুললাম। আজকে আমাদের প্রতিবাদ ব্রিটিশ বুরোক্রাসীর বিরুদ্ধে। যাই হোক, সুনন্দা দেবীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভা শেষ করছি আমি।

পর্ণা সাহস করে বক্তৃতা দিতেই ওঠেনি!

ভেবেছিলাম সর্বসমক্ষে এতবড় পরাজয় আর হতে পারে না পর্ণার। জীবনের সব ক্ষেত্রে তাকে হটিয়ে দিয়েছি—সে মেতে ছিল রাজনীতি নিয়ে। আজ সেখান থেকেও গদিচ্যুত করলাম তাকে।

ভুল ভাঙল পরদিন। গৌতম আর পর্ণাকে পুলিসে অ্যারেস্ট করেছে। আর আমার দীর্ঘ তিন কোয়ার্টারব্যাপী বক্তৃতাটা গোয়েন্দা পুলিস গ্রাহ্যই করেনি!

ওরা অবশ্য ছাড়া পেয়েছিল কয়েকদিন পরেই। পুলিস কেস চালায়নি। তা চালায়নি–কিন্তু আমাকে পুলিস অহেতুক অপদস্থের চূড়ান্ত করে গেল!

আমি নতুন উৎসাহে জ্বলে উঠলাম। সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলাম। অন্তত একবারও যদি আমাকে ধরে নিয়ে যেত পুলিসে! কিন্তু হতভাগা গোয়েন্দা পুলিসগুলোর যদি এতটুকু ভদ্রতাজ্ঞান থাকে।

তবুও ফল ফলল আমার পরিশ্রমের। গৌতম আমাকে একদিন ডেকে বলল—শুনুন, সেদিন বক্তৃতায় আপনি জনযুদ্ধ সম্বন্ধে কয়েকটা মন্তব্য করেছিলেন। সে নিয়ে সেদিন আমি কোনো কথা বলিনি। আপনার আপত্তি না থাকলে বিষয়টা আমি বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই।

আমি বললাম-আপত্তি কী? বেশ তো, আসবেন আজ বিকালে আমাদের বাড়িতে, আলোচনা করব।

এই সূত্রে ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা হল গৌতমের সঙ্গে। অতি ধীরে বিস্তার করলাম জাল। সে জালে ধরা না দিয়ে উপায় নেই। আঠারোটি বসন্তের আশীর্বাদে আমার সে জাল তখন ইন্দ্রজাল রচনা করতে পারত। গৌতমেরও তখন সেই বয়স—যে বয়সে ছেলেরা পালতোলা নৌকা দেখলেই পা বাড়িয়ে দেয়। তারপর কোথায় কোন কূলে তরী ভিড়বে সে খেয়াল রাখে না—নিরুদ্দেশ যাত্রা হলেও পরোয়া করে না। তিল তিল করে জয় করেছিলাম ওকে-আমার উদ্দেশ্য ছিল পর্ণার কবল থেকে ওকে মুক্ত করা। সাধ্য কী সেই পাতলা ছিপছিপে মেয়েটির ওকে আটকে রাখে। তারপর কখন নিজের অজান্তেই হঠাৎ লক্ষ্য করলাম এ তো আর অভিনয় নয়—সত্যিই ওকে ভালবেসে ফেলেছি! একদিন যদি বিকেলে ও না আসত, মনে হত সন্ধ্যাটা বুঝি বৃথা গেল! পর্ণাকে হারানোই ছিল প্রধান লক্ষ্য-লক্ষ্য করলাম, গৌতমকে হারানোর ভয়টাই হয়ে উঠল প্রধান। প্রসাধনটা আমি কমিয়ে দিয়েছিলাম। শাড়ি-গয়নার আড়ম্বর আর ছিল না আমার সাজপোশাকে। বুঝেছিলাম, গৌতম তাই ভালবাসে। আমার রূপের আগুনে ঝাঁপ দিল ও। আমার সঙ্গে ওর নাম জড়িয়ে নানা কথার রটনা হল কলেজে। ক্ষেপও করলাম না আমরা। এ নিয়ে পর্ণা কী একটা কথা বলতে এসেছিল গৌতমকে, শুনলাম এই প্রসঙ্গে ওদের মনোমালিন্য ঘটেছে–এবং ফলে দুজনের কথাবার্তাও বন্ধ হয়ে গেছে।

এই পর্যায়েই পর্ণার সঙ্গে বাধল আমার নতুন সংঘাত। কলেজ-য়ুনিয়ানে একটি আসন সংরক্ষিত ছিল ছাত্রীদের জন্য। কলেজ ম্যাগাজিনের সহ-সম্পাদকের আসন। নির্বাচন প্রতিযোগিতায় দেখা গেল

দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী—সুনন্দা চ্যাটার্জি আর পর্ণা রায়। ইলেকশনের ব্যাপারে পর্ণা আর গৌতমের মনোমালিন্যটা দেখা দিল প্রকাশ্য শত্রুতার রূপে। দু পক্ষ থেকেই প্রচারকার্য চালানো হচ্ছিল–যেমন হয়ে থাকে। গৌতম বেপরোয়া ছেলে, সে প্রকাশেই খরচ দিয়ে আমার নামে পোস্টার ছাপাল। মাইক ভাড়া করে এনে প্রচার চালাল-রেস্তোরাঁয় ভোটারদের করাল আকণ্ঠ ভোজন। বড়লোকের ছেলের খেয়াল! অপরপক্ষ, অর্থাৎ পর্ণার দল, খানকয়েক হাতেলেখা প্রাচীরপত্র টাঙিয়ে দিল এখানে ওখানে। হঠাৎ গৌতমের বুঝি নজরে পড়ে, কোথায় একটা পোস্টারে আমার সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে অশ্লীল কিছু ইঙ্গিত করা হয়েছে। গৌতম গিয়ে পর্ণাকে সোজা এ নিয়ে অভিযুক্ত করে। উত্তরে পর্ণাও কয়েকটি গরম গরম কথা বলে জানিয়ে দেয় যে, তার রুচি অত নীচ নয়–সে এসব ব্যাপারের কিছুই জানে না। গৌতম বিশ্বাস করে না। ফলে ওদের ঝগড়াটা আরও দৃঢ়মূল হয়ে যায়।

গৌতম ছিল ছাত্রমহলের বড় দরের পাণ্ডা। সুতরাং জয় সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিন্ত হলাম। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, গৌতমের অ্যাকাউন্টে চর্ব-চূষ্য খেয়ে এসে ওর বন্ধুরা ভোট দিয়ে আসবে পর্ণাকে! কিন্তু তাই দিয়েছিল ওরা। ভোট-গণনার পর দেখা গেল অর্থব্যয় আর অপমান ছাড়া কিছুই। জমা পড়েনি আমার অঙ্কে!

অনেকেরই ঈর্ষার পাত্র ছিলাম আমরা দুজন। ছাত্র এবং ছাত্রীমহলে। ওরা পূর্ণার সপক্ষে ভোট দিয়েছিল–তার আসল কারণ–কোনো ক্ষেত্রে অপর প্রার্থীর রূপের দেমাক, কোনো ক্ষেত্রে অপর প্রার্থীর পক্ষে সুপারিশকারীর বড়লোকি চাল!

দিনতিনেক কলেজে যেতে পারিনি, লজ্জায় সংকোচে। চতুর্থ দিন গৌতম এসে বলল—কদিন বাড়ি থেকে বের হইনি। কলেজের কী খবর?

আমি বললাম–সেকি! আমিই তো ভাবছি তোমার কাছ থেকে খবরটা জেনে নেব। আমিও আজ তিন দিন কলেজে যাইনি যে।

ও হাসল। ভারি ম্লান, অপ্রতিভ দেখাচ্ছিল ওকে। বলল—আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, শেষ পর্যন্ত হেরে যাব আমরা। তোমার ভারি ইচ্ছে ছিল ম্যাগাজিনের সহ-সম্পাদিকা হবার, নয়?

আমি বললাম–সে কি তুমি বোঝ না? আমি বোধ হয় আমার একখানা হাত কেটে ফেলতে রাজি ছিলাম এ জন্যে।

ও চুপ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ উঠে পড়ে বলে–চললাম।

আমি বলি—সেকি! এরই মধ্যে?

–হ্যাঁ, কাল কলেজে দেখা হবে।

পরদিন কলেজে ঘটল একটা অদ্ভুত ব্যাপার। টিফিন-আওয়ার্সে আমাকে ডেকে পাঠালেন প্রিন্সিপ্যাল। বললেন–তোমাকে আমি ম্যাগাজিন-কমিটির সাব-এডিটর নমিনেট করেছি।

আমি চমকে উঠে বলি—সে কী স্যার, আমি তো ইলেকশনে হেরে গেছি। এখন আবার নমিনেশন কিসের?

প্রিন্সিপ্যাল গম্ভীর হয়ে বলেন—সব কথা তো বলা যাবে না, পর্ণা রিজাইন দেবে।

বুঝলাম সরকারি নির্দেশ এসেছে নিশ্চয়ই এই মর্মে। পর্ণার নাম লেখা আছে কালো খাতায়। কলেজ-ম্যাগাজিনে তাকে রাখা যাবে না। পেছনের দরজা দিয়ে এভাবে ঢুকতে আমার একটুও ইচ্ছে ছিল না—কিন্তু অধ্যক্ষের নির্দেশ এড়াতে পারলাম না। রাজি হতে হল আমাকে। য়ুনিয়ানের নব নির্বাচিত সভ্যদের মিলিত গ্রুপ ফটো ভোলা হল—আমাকে বসানো হল মধামণিরূপে প্রিন্সিপ্যালের পাশেই।

এর প্রায় দিনসাতেক পরে অপ্রত্যাশিতভাবে পর্ণা এসে দেখা করল আমার সঙ্গে। ওর দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

–আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল।

—আমার সঙ্গে বেশ বলুন!

ও কিছুমাত্র ইতস্তত না করে বলে–আপনি গৌতমকে ছেড়ে দিন!

হো-হো করে হেসে উঠি আমি। এতদিনে মনস্কামনা সিদ্ধ হয়েছে। ওর অপ্রস্তুত ভাবটা রসিয়ে  রসিয়ে উপভোগ করি, চিবিয়ে চিবিয়ে বলি-গৌতম কি আমার বাঁধা গরু যে, গেরো খুলে দিলেই আপনার খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকবে?

এক মুহূর্ত ও জবাব দিতে পারে না। তারপর সামলে নিয়ে বলে–আপনার কাছে এটা নিছক খেলা—কিন্তু আমার কাছে এটা কতটা মর্মন্তুদ তা আপনি আন্দাজ করতে পারেন না!

-কী করে পারব বলুন? আমার তো বুজ-ফ্রেন্ড নেই!

এবার বিশেষণের জ্বালাটা গলাধঃকরণ করতে হল ওকে বলল-আমি অযাচিতভাবে আপনার কাছে এসেছি—এভাবে অপমান করলেও অবশ্য আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু

মনে হল সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এটা। ভদ্রতায় বাধছে।

বললাম–কিন্তু আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন? অবশ্য আমার কাছে সাহায্য চাইতে আসার অধিকার আছে কিনা সেটা আপনারই বিচার্য।

ও বলল-এতদিন বলতে আসিনি। সম্প্রতি আমি আপনার একটা উপকার করেছি—এবং আমার দান আপনি অম্লানবদনে হাত পেতে গ্রহণ করেছেন, তাই বিনিময়ে আমার সাহায্য চাইবার অধিকার জন্মেছে বলেই বিশ্বাস করেছি আমি।

একটু অবাক হয়ে বলি—ঠিক বুঝলাম না তো, আপনি আমার কোন উপকারটা করেছেন?

—কলেজ-য়ুনিয়ানে সহ-সম্পাদিকার পদটা আপনাকে ছেড়ে দিয়েছি।

–ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলুন।

–হ্যাঁ, বাধ্য হয়েছি–কিন্তু সে তো আপনারই স্বার্থে।

–আমারই স্বার্থে। বলেন কী? প্রিন্সিপ্যাল কি আমারই স্বার্থে আপনাকে রিজাইন দিতে বাধ্য করেছিলেন?

-প্রিন্সিপ্যাল তো বলেননি।

-তবে?

—আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে গৌতম। কারণটা সে আমাকে বলেনি, শুধু বলেছিল আমি পদত্যাগ না করলে সে দুঃখিত হবে। কারণটা না বললেও সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম–আপনিও পেরেছেন আশা করি। তার অনুরোধই আমার কাছে আদেশ। তাই সরে দাঁড়িয়েছি আমি।

আমি বজ্রাহত হয়ে যাই। ছি ছি ছি! গৌতমের যদি এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান থাকে। এইভাবে সে আমাকে ঢুকিয়েছে কলেজ য়ুনিয়ানে! কোন লজ্জায় এরপরে কথা বলব পর্ণার সঙ্গে?

ও বলে—আপনি কি প্রতিদানে ছেড়ে দেবেন ওকে?

আমি বিরক্ত হয়ে উঠি–কী বকছেন ছেলেমানুষের মতো! আমি কি আঁচলে বেঁধে রেখেছি ওকে? এ কি কেউ ছেড়ে দিতে পারে? এ কেড়ে নিতে হয়।

ও এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর বলে-এ যুদ্ধ-ঘোষণায় আপনার কোনও বীরত্ব নেই কিন্তু। যুদ্ধেরও একটা আইন আছে, সমানে সমানেই সেটা হয়ে থাকে। আপনি কি অন্যায় যুদ্ধ। করছেন না?

—অন্যায় যুদ্ধ মানে?

–মানে আপনার হাতে আছে ঈশ্বরদত্ত ব্রহ্মাস্ত্র; তপস্যা করে তা পাননি আপনি আপনার সহজাত কবচ-কুণ্ডল! আর আমি নিরস্ত্র। দুর্ভাগ্য আমার, গৌতমের চোখ আজ চকমকির ফুলঝুরিতেই অন্ধ।

–ঘিয়ের প্রদীপটার দিকে ওর নজর পড়ছে না, কেমন? কিন্তু সেজন্য আমাকে দোষ দিয়ে কী হবে বলুন? প্রদীপের কালির দিকে যদি গৌতমের নজর না পড়ে তবে তাকে দোষ দেবেন; এবং ঈশ্বর যদি আপনাকে রূপ না দিয়ে থাকেন তবে তার সঙ্গেই বোঝাপড়া করবেন। আর অন্যায় যুদ্ধের কথা বলছেন আপনি জানেন না, জীবনের দুটি ক্ষেত্রে আইন বলে কোনো কিছু নেই–

–তাই নাকি?

–হ্যাঁ, তাই। দেয়ার্স নাথিং আনফেয়ার ইন ল্যভ অ্যান্ড ওয়র।

–ও আচ্ছা। মনে থাকবে উপদেশটা। নমস্কার!

–নমস্কার!

এর পর আর কোনোদিন কথা হয়নি পর্ণার সঙ্গে।

পর্ণা অবশ্য চেষ্টাই করেনি গৌতমকে ছিনিয়ে নিতে–আমার ইন্দ্রজালের মোহ ভেদ করে। সে জানত তা অসম্ভব। সর্বান্তঃকরণে সে নেমে পড়ল রাজনীতিতে। দিনরাত মেতে রইল ছাত্র আন্দোলনে। কাটল আরও মাসছয়েক। তারপর আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার মাসখানেক আগে একটি ছাত্ৰ-শোভাযাত্রা পরিচালনা করবার সময় গ্রেপ্তার হল সে। লাঠি চার্জ করেছিল পুলিস। গুরুতর আহত অবস্থায় ভ্যানে করে তুলে নিয়ে গেল পর্ণাকে রাজপথ থেকে। গৌতম ততদিনে পাস করে কলকাতায় পড়তে গেছে য়ুনিভার্সিটিতে। পর্ণা আহত হওয়ার কথা শুনে সে ফিরে আসে। পুলিস-হাসপাতালে দেখা করতে যায় গৌতম। সেখানে তাদের কী কথাবার্তা হয়েছিল জানি না। কিন্তু সেখান থেকে সে বেরিয়ে এল–যেন একেবারে অন্য মানুষ। পর্ণা ছাড়া পেল না। পরীক্ষাও দেওয়া হল না ওর। বিনা বিচারে আটক হয়ে রইল। ক্রমে ক্রমে বদলে গেল গৌতমও। মাসতিনেকের মধ্যে তাকেও ধরে নিয়ে গেল পুলিসে।

আর ওদের কোনও খবর পাইনি।

কালে থেমে গেছে কালযুদ্ধ। আশা করেছিলাম, রুদ্ধকারার এ পাশে এসে ওরা হাত মিলিয়েছে। আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করেছিলাম জীবনের ওই করুণ অধ্যায়টাকে।

অলকের কাছে তাই সেদিন মিস পর্ণা রায়ের দরখাস্তটা দেখে বুঝতে পারিনি প্রথমটা। ভাবতেই পারিনি ওদের বিয়ে হয়নি। নিঃসন্দেহ হলাম ফটোটা দেখে। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই চাপা হাসিটি লেগে আছে বিষাক্ত ঠোঁটের কোনায়। ফটোর মধ্যে থেকে ওর শ্বাপদ দৃষ্টি জ্বলজ্বল করছে!

কিন্তু কাজটা কি ভালো করলাম? সত্যিই কি ওর উপকার করবার জন্য আমার প্রাণটা আকুল হয়ে উঠেছিল? তা তো নয়। মনের অগোচরে পাপ নেই। ওর নামটা দেখেই কেমন যেন মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। ফটোটা দেখে আর আত্মসংবরণ করতে পারিনি। একদিন চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম—যুদ্ধ আর প্রেমের অভিধানে অন্যায় বলে শব্দটির স্থান নেই। ও বলেছিল—মনে থাকবে উপদেশটা। মনে রেখেছিল সে। কেড়ে নিয়েছিল শেষ পর্যন্ত গৌতমকে। নিজে অবশ্য পায়নি কিন্তু আমাকেও পেতে দেয়নি। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলাম সেদিন। তাই কি আজ ইচ্ছা জেগেছে পার্বত্য-মূষিককে আমার রাজ-দরবারে হাজির করতে?

আজ অবশ্য মনের সে মেঘ সরে গেছে। আজ আমি পুরোপুরি সুখী। কী পাইনি আমি? এর চেয়ে কী বেশি দিতে পারত আমাকে গৌতম? অলকের চরিত্র গৌতমের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়। ও আমাকে প্রাণ ঢেলে ভালবাসে। গৌতমের ভালবাসাও ছিল তীব্র; কিন্তু বোধ হয় নিখাদ ছিল না। তার প্রেম ছিল ঘড়ির দোলকের মতো। পর্ণা আর সুনন্দার মধ্যে প্রতিনিয়ত দুলত তার অস্থিরমতি ভালবাসা। আর আমার স্বামীর প্রেম যেন দিগদর্শন-যন্ত্র। জোর করে অন্য দিকে ফিরিয়ে দিলেও আমারই দিকে ফিরে আসবে তার একমুখী প্রেম।

তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, বুঝি মনের কোনো একটা কোণা খালি রয়ে গিয়েছে। কী-যেন পাওয়া হয়নি। কিসের যেন অভাব। বড় যেন ছককাটা জীবন আমাদের। গৌতমের সঙ্গে প্রায়ই আমার মতের মিল হত না। আমি যদি উত্তরে যেতে চাই–ও দক্ষিণমুখী রাস্তা ধরত। আমি যদি বলতাম এস গল্প করি, ও বলত–না, চল বরং সিনেমা যাই। আবার আমি যদি বলি–আজ সিনেমা যাব, ও সঙ্গে সঙ্গে বলে বসত—আজ বরং নদীর ধারে বেড়ানো যাক। মতের এই অমিলের মধ্য দিয়েই হত আমাদের মিল। ও ইংরেজি ছবি দেখতে পছন্দ করত—আমি ছিলাম বাংলা ছবির পোকা। এই নিয়ে আমাদের লেগে থাকত নিত্য খিটিমিটি। অলকের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার উপায় নেই—ওর কোনো ছবি ভালোও লাগে না, খারাপও নয়। অন্তত মতামত প্রকাশ করে না ভুলেও। জিজ্ঞাসা করলে বলে–তোমার কেমন লেগেছে? আমি ভালো-খারাপ যাই বলি, ও বলে–আমারও তাই। এক-একদিন কেমন যেন গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয়; কিন্তু ও সব তাতেই সায় দিয়ে যায়। দুঃখ করে একদিন বলেই ফেলেছিলাম–তুমি আমার সব কথায় সায় দিয়ে যাও কেন বল তো? তোমার নিজস্ব কোনও মত নেই?

ও বলল——কেন থাকবে না, নিজস্ব মতোটা এ ক্ষেত্রে তোমার অনুকূলে।

রাগ করে বলি–এ ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই।

ও হেসে বলে—সেকথা ঠিক।

–কিন্তু কেন?

–শুনবে? তবে শোন–ইফ মেন উড কন্সিড়ার নট সো মাচ হোয়্যারিন দে ডিফার আজ হোয়্যারিন দে এগ্রি, দেয়ার উড বি ফার লেস অব আনচ্যারিটেনেস অ্যান্ড অ্যাংরি ফিলিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।

এবার আমাকে বলতে হবে—-বেকন বলেছেন বুঝি?

আর ও বলবে—না এডিসন!

আচ্ছা, এইভাবে একটা মানুষ সারা জীবন কাটাতে পারে? জীবনে যা কিছু ভালবাসতাম সবই আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু ওগো নিষ্ঠুর ভগবান! এত সহজে, এত অপ্রতিবাদে, এত অনায়াসে আমাকে সব দিলে কেন? কিছু বাধা, কিছু ব্যতিক্রম, কিছুটা কঁকিও কেন রাখলে না তুমি? শাড়ি-গহনায় আমার লোভ ছিল এককালে–কিন্তু এমন বাক্সভরতি জিনিস তো আমি চাইনি। আমার দুঃখটা আমি বোঝাতে পারি না। নমিতাও অবাক হয়ে যায়–বলে, বুঝি না কী চাও তুমি সত্যি। কী করে বোঝাব?

এই তো সেদিন, আমি, নমিতা আর কুমুদবাবু মার্কেটে গিয়েছিলাম। নমিতার একটা মাইশোর জর্জেট পছন্দ হল, কিনতে চাইল। আপত্তি করলেন কুমুদবাবু। বললেন–এই তো সেদিন একটা ভাল শাড়ি কিনলে ওমাসে।নমিতা চুপ করে গেল। আমার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে ওঠে। ও কেন এমন করে আমার ইচ্ছায় বাধা দেয় না! ধমকও ও দেয়, কিন্তু সে আমার ইচ্ছাতে বাধা দিতে নয়—সে অন্য কারণে—কেন আমি রুটিন-বাঁধা পথে চলছি না, তাই। কেন মাসে মাসে নতুন শাড়ি কিনছি না, নতুন গহনা গড়াচ্ছি না, তাই! মার্কেট থেকে ফিরবার পথে নমিতা একটি কথাও বলল না–আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছিল ওকে। মনে হচ্ছিল–কী সৌভাগ্য নমিতার! এই শাড়ির ব্যাপার নিয়ে আজ রাত্রে ওদের মান-অভিমানের পালা চলবে—আর শেষ পর্যন্ত কুমুদবাবুকে হার স্বীকার করতে হবে। পরের দিন সেই শাড়িটিই কিনে এনে মান ভাঙাতে হবে নমিতার। অতটা না হলেও অন্তত ইংরেজি উদ্ধৃতি শুনতে হবে না নমিতাকে মধ্যরাত্রের নির্জনতায় এই অভিমানের জন্যে।

প্রসাধন জিনিসটা আমার চিরকাল ভাল লাগে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত আমার এককালে। আজকাল আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আমার মাথা ধরে। রোজ সন্ধ্যাবেলা সেই তাসের দেশের হরতনের বিবিটি সাজতে সর্বাঙ্গ জ্বালা করে আমার! গোলাপ ফুল জিনিসটা যে এত কদর্য, তা স্বপ্নেও ভেবেছিলাম কোনোদিন?

সিনেমা দেখাটাও! প্রতি রবিবারের সন্ধ্যাটি বন্দি থাকতে হয় রুদ্ধদ্বার কক্ষে! প্রাণান্তকর বিড়ম্বনা। কোনোদিন অসময়ে এসে বলেনি—দুখানা টিকিট কেটে এনেছি, চটপট তৈরি হয়ে নাও! অন্তত একথাও কোনোদিন বলেনি—এ রবিবার একটা জরুরি কাজ আছে আমার। এবার থাক লক্ষিটি, সোমবার নিয়ে যাব তোমাকে।

আমি যা চাই, তাই পাই। কিন্তু বড় হিসেবি সেই পাওয়াটা। বাঁধা পশুকে শিকার করায় আর যাই হোক শিকারের থ্রিল নেই! বাঁধা-মাইনেয় নেই সেই শিহরণ, যা পাওয়া যায় হঠাৎ-পাওয়া বোনাসে। আমি ভালবাসি মুখ বদলানো হিসাবে মাঝে মাঝে দাম্পত্য-কলহ হবে, ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধ ঘটবে, চলবে মান-অভিমানের পালা কয়েকটা দিন-তারপর হবে গভীরতর মিলন! কিন্তু যা চাই তা কি চেয়ে পাওয়া যায়? এ কথা কী বলে বোঝানো যায়? ভয় হয় বলতেও! ও যা মানুষ হয়তো বলে বসবে-বেশ তো, এবার থেকে প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় আমি সব বিষয়ে ডিসেগ্রি করব তোমার সঙ্গে!

আপনারা হয়তো ভাবছেন বাড়াবাড়ি করছি। অলকের মতো বিদ্বান, বুদ্ধিমান লোক এমন ছেলেমানুষি করতে পারে? পারে। বিশ্বাস না হয় শুনুন। একদিন আপত্তি করেছিলাম রবিবার সন্ধ্যায় সিনেমা যেতে, বললাম-আজ এসো দুজনে ছাদে গিয়ে গল্প করি।

ও বলল, সপ্তাহে একদিন আমোদ করা উচিত। আমাদের প্রোগ্রাম আছে রবিবারে সিনেমা যাওয়ার।

বললাম-বেশ তো নটার শোতে যাব।

-ওরে বাবা, রাত বারোটা পর্যন্ত আমি সিনেমা দেখতে পারব না। আর তা ছাড়া তুমি আমার সঙ্গে ঠিক ছটায় যাবে বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছ?

এত রুটিন-বাঁধা দাম্পত্য-জীবন ভালো লাগে তোমার?

এর উত্তরে কী বলল জানেন? ও বলল নাথিং ইন্সপায়ার্স কনফিডেন্স ইন এ বিজনেসম্যান সুনার দ্যান পাংচুয়ালিটি!—কথাটা ম্যাথুসের!

আপনারা বলতে পারেন এর উত্তরে আমার প্রশ্ন করা উচিত ছিল–তোমার-আমার সম্পর্কটা কি বিজনেসের?

স্বীকার করছি, সে প্রশ্ন আমি করিনি। কারণ ওর সঙ্গে এতদিন ঘর করে বুঝেছি, এ কথা বললেই শুনতে হবে আর একটা জ্ঞানগর্ভ বাণী–বিবাহও যে একটা বিজনেস–একটা কন্ট্রাক্টমাত্র, সে সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত মুহূর্তে। শেক্সপীয়র, শ অথবা জেমস জয়েস–কে যে ওর পক্ষ থেকে সওয়াল করতেন তা জানি না, তবে এটুকু জানি যে, আমার যুক্তি যেত ভেসে!

তাই তো সেদিন যখন ওর জামা-কাপড় কাচতে দেওয়ার সময় পকেট থেকে দুটো সিনেমা টিকিটের কাউন্টারপার্ট বের হল তখন অবাক হয়ে গেলাম আমি। আরও অবাক হলাম এই জন্যে যে, টিকিট দুটি রাত্রের শোর! গত বৃহস্পতিবার রাত্রের। মনে মনে হিসাব করে দেখি, গত বৃহস্পতিবার রাত্রে নমিতার ননদের বিয়েতে গিয়েছিলাম। রাতে বাড়ি ফিরিনি। ও যায়নি, অফিসের কী জরুরি কাজের জন্যে। টিকিট দুখানা হাতে করে আমি কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেলাম। অলক মুখার্জি রাতের শোতে সিনেমা দেখেছে? বৃহস্পতিবার রাত্রে? যে বৃহস্পতিবার কাজের চাপে সে সামাজিক নিমন্ত্রণ রাখতে যেতে পারেনি সস্ত্রীক! সমস্ত দিন ছটফট করতে থাকি। কখন ও বাড়ি ফিরবে, কখন, ওকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিন্ত হব। হঠাৎ মনে হল দ্বিতীয় টিকিটটা কার? ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা সম্ভাবনার কথা মনে হতেই শিউরে উঠলাম। এমন প্রকাশ্যে চমকে উঠলাম যে, মলিনা ঘর মুছতে মুছতে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে—দিদিমণি যে জেগে জেগে দেয়ালা দেখছ গো!

মলিনা আমার বাপের বাড়ি থেকে এসেছে। অনেকদিনের লোক।

পুরানো খবরের কাগজটা খুলে দেখলাম, সেদিন ঐ হলে ফল অব বার্লিন বইটার শেষ শো হয়েছে। ওটা আর এখন কলকাতায় দেখানো হচ্ছে না। আমরা ওটা দেখিনি।

সন্ধ্যাবেলায় ও ফিরতেই প্রশ্নটা করলাম। সোজাসুজি না করে বললাম—এ রবিবার চল ফল অব বার্লিন দেখে আসি।

–বেশ।

–বইটা তোমার জানাশোনা কেউ দেখেছে নাকি? কী বলছে লোকে?

ও নির্বিকারভাবে বলল—তুমি জানো, সিনেমার খোঁজ আমি রাখি না।

-ও হ্যাঁ, তাই তো! কিন্তু বইটা তো তুমি নিজেই দেখেছ?

—আমি? কী বই? আমি টিকিটের ভগ্নাংশ দুটি ওর সামনে মেলে ধরে বলি, এই বই।

–ও সেই সিনেমাটা? সেই হিটলারের মতো দেখতে একটা জোকার আছে যেটাতে? হ্যাঁ ভালোই লেগেছে বইটা। চল না রবিবারে যাওয়া যাবে–

—কিন্তু তুমি তো দেখেছ সিনেমাটা!

–তাতে কী হয়েছে—না হয় আবার দেখব।

—তা তো বুঝলাম–কিন্তু এই জরুরি কাজেই বুঝি সেদিন রত্নার বিয়েতে যেতে পারলে না? হো হো করে হেসে ওঠে অলক। বলে—কথাটা তোমায় বলতে ভুলেই গেছি। সত্যিই জরুরি কাজ ছিল সেদিন। রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত কাজের মধ্যে ডুবে ছিলাম। তারপর আর কাজ ছিল না। এক বন্ধু জোর করে ধরে নিয়ে গেল সিনেমায়। ঐটাই নাকি লাস্ট শো ছিল। তেমন করে ধরলে কী করি বল?

-ও! তেমন করে ধরলে বুঝি নাইট শোতেও সিনেমা দেখা যায়? তা এমন করে কোন বন্ধুটি তোমায় ধরল শুনি?

–সে তুমি চিনবে না। আমার একজন পোলিশ বন্ধু। আমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়ত গ্লাসগোতে। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পথে। ভারতবর্ষ দেখতে এসেছে। বলল—মুখার্জি, যুদ্ধটা আমরা কেমন উপভোগ করেছি চল দেখিয়ে আনি তোমায়। নিকলস্-এর সঙ্গে আলাপ হলে বুঝতে ওর কথা ঠেলা যায় না। সাড়ে ছফুট লম্বা ইয়া জোয়ান, শিশুর মতো সরল এদিকে।

বুক থেকে পাষাণভার নেমে যায়। নিজেকেই ধমক দিই—ছি ছি, কী ছোট মন আমার কেমন করে আমি ভাবতে পারলাম ও কথা? অলকের মন স্লেটের তৈরি নয় যে অত সহজেই আঁচড় পড়বে।  সে মন শক্ত গ্রানাইটে তৈরি, সাধ্য কী পর্ণার যে সেই পাথরের ওপর দাগ কাটে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *