অলকনন্দা – ১

অলকনন্দা (উপন্যাস)

উৎসর্গ

শ্রীমতী রানী লাহিড়ী চৌধুরী
অর্থাৎ, ছোড়দিকে

প্রথম প্রকাশ : ১৯৬৩
রচনাকাল : ১৯৬২

 

কৈফিয়ত

অলকনন্দা বইটি ষাটের-দশকে লেখা।

বস্তুত একই আঙ্গিকে পরপর দুটি গ্রন্থ রচনা করি। অলকনন্দা এবং মনামী। আত্মকথার ঢঙে। অর্থাৎ লেখক শ্রুতিধরমাত্ৰ-স্টেনোগ্রাফারের মতো ডিকটেশন নিয়ে গেছেন। যা বলবার তা চরিত্ররা নিজেরাই বলেছে। দুটি কাহিনী রচনা করার পরে এই স্টাইলটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাবার ইচ্ছাটা চলে যায়। স্বভাবগত পল্লবগ্রাহিতায় অন্য বিষয়ের, অন্য আঙ্গিকের দিকে ঝুঁকেছিলাম। অলকনন্দা কিছুদিন বাজারে ছিল না। পরিবর্তিত সংস্করণ প্রকাশ করলেন নিউ বেঙ্গল প্রেস (প্রাঃ) লিঃ। তাদের ধন্যবাদ।

ঘরে-বাইরে পড়তে বসে আমার মনে একটা খটকা জেগেছিল। নিখিলেশ, সন্দীপ আর বিমলা–তিনজনেই কোন অলৌকিক ক্ষমতাবলে আয়ত্ত করল তাদের সৃষ্টিকর্তার অননুকরণীয় রচনাশৈলী? মনে হয়েছিল, সৃষ্ট চরিত্রগুলি যদি রবিঠাকুরের ভাষার হুবহু নকল করতে অপারগ হত তাহলে প্রতি পরিচ্ছেদের মাথায় কোনটা কার আত্মকথা সেটা জানানোর প্রয়োজন থাকত না। চোখে-দেখার নাটক যেদিন থেকে কানে-শোনার বেতার-নাট্যের রূপ নিল, সেদিন থেকে শুধু বাচনভঙ্গি আর কণ্ঠস্বর শুনেই আমরা বক্তাকে চিনে নিতে শিখেছি। ছাপা-উপন্যাসে কণ্ঠস্বর অনুপস্থিত, হস্তাক্ষরও। কিন্তু বাচনভঙ্গি? ভাষার বিন্যাস? ম্যানারিজম? প্রত্যেকটি চরিত্র যদি নিজের নিজের ঢঙে কথা বলে তাহলেও আমরা চিনে নিতে পারব কোনটা কার আত্মকথা! সেই পরীক্ষাটাই করেছিলাম—ঐ দুটি বইতে।

এই যে বিশেষ রচনাশৈলী—অর্থাৎ লেখক তার সৃষ্ট-চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের ভাষায় পাঠকের সঙ্গে কথা বলবেন—সেটি বাংলা ভাষায় কে প্রথম আমদানি করেছিলেন তা বলার অধিকার আমার নেই। ভাষাবিদ ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকেরা সে কথা বলবেন। আমার তো মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঘরে-বাইরেতে এই আঙ্গিকটা গ্রহণ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্রের রজনী (প্রথম প্রকাশ ১৮৭৭) অনুসরণে। সেই উপন্যাসেই প্রথম দেখতে পাই বঙ্কিমকে থামিয়ে দিয়ে রজনী-শচীন্দ্র-লবঙ্গলতা অমরনাথের দল আসর জমিয়ে বসেছিল। ওদের কলকোলাহলে বঙ্কিম একবারও মুখ খুলতে পারেননি। উপন্যাস শুরু হবার আগে এবং টাইটেল-পেজ এর পরে অতি সামান্য পরিসরে লেখকের মুখবন্ধ! দুই অর্থেই।

সেই মুখবন্ধে বঙ্কিম বলছেন, উপন্যাসের অংশবিশেষ নায়ক বা নায়িকা-বিশেষের দ্বারা ব্যক্ত করা, প্রচলিত রচনা-প্রণালীর মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না, কিন্তু ইহা নূতন নহে। উইলকি কলিন্সকৃত The Woman in White নামক গ্রন্থ প্রণয়নে ইহা প্রথম ব্যবহৃত হয়। এ প্রথার গুণ এই যে, যে-কথা যাহার মুখে শুনিতে ভাল লাগে, সেই কথা তাহার মুখে ব্যক্ত করা যায়। এই প্রথা অবলম্বন করিয়াছি বলিয়াই, এই উপন্যাসে যে-সকল অনৈসর্গিক বা অপ্রাকৃত ব্যাপার আছে, আমাকে তাহার জন্য দায়ী হইতে হয় নাই।

যে-কথা যাহার মুখে শুনিতে ভাল লাগে-একশ দশ বছর আগে বঙ্কিমের সেটা খেয়াল ছিল। ঘরে-বাইরেতে সেটা কিন্তু আমরা পাই না। বিমলা, সন্দীপ আর নিখিলেশের চিন্তাধারা, জীবনবোধ, আদর্শের যতই পার্থক্য থাক–তারা তিনজনেই হুবহু-রবিঠাকুরের ভাষায় কথা বলে। বঙ্কিমের চরিত্র সে ভুল করেনি।

পরিচ্ছেদের মাথায় কোনটি কার আত্মকথা যদি লেখা না থাকতো তাহলেও বঙ্কিম-পাঠকের সেটা বুঝে নিতে কোনো অসুবিধা হত না। অশিক্ষিতা রজনী সমাসবদ্ধপদসমৃদ্ধ বঙ্কিমীভাষায় লিখতে যেমন অসমর্থ ঠিক তেমনি ভাবেই শচীন্দ্রনাথ চোখের মাথা খেতে পারে না। লবঙ্গলতা যে অলঙ্কারে অভ্যস্ত (আগুনে-সেঁকা-কলাপাতার মতো শুকাইয়া উঠিবে) অমরনাথ সে ভাষায় কথা বলতে পারে না।

তুলনায় সন্দীপ, বিমলা, নিখিলেশ একে অপরের ভাষা হুবহু নকল করে গেছে।

একটা কথা। রজনীর চেয়ে ইন্দিরা বয়সে চার বছরের বড়। বোধ করি সেই ইন্দিরাই প্রথম বিদ্রোহিণী, যে বঙ্কিমকে বকলমা দিতে অস্বীকার করে। ইন্দিরা বঙ্কিমের পঞ্চমা কন্যা। ইন্দিরার যে চারজন বড় বোন ছিল তারা অনেক গুণের অধিকারিণী; কিন্তু এ দিক থেকে ইন্দিরা অনন্যা! ফুলমণি ব্যতিরেকে বাংলা সাহিত্যে ইন্দিরাই প্রথমা! দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী এবং বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনী নিজেদের কথা নিজেরা বলতে সাহস পায়নি—বকলমা-র নীচে টিপছাপ দিয়ে সৃষ্টিকর্তা বঙ্কিমকে তারা বলেছিল—আমাদের কথা আপনিই বরং বলুন।

ইন্দিরা তা বলেনি। বলেছিল—আপনি থামুন দেখি! আমার কথা আমি নিজেই বলতে পারব।

ইন্দিরা বঙ্গদর্শনের প্রথম বর্ষের চৈত্র সংখ্যায় (১২৭৯, মার্চ, ১৮৭২) প্রকাশিত। বঙ্কিম-কথিত উইলকি কলিন্স-এর The Woman in White প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। অর্থাৎ ইংরাজ-তনয়া ঐ শ্বেতাম্বরা ছিলেন বঙ্কিমতনয়া ইন্দিরা-র চেয়ে মাত্র বারো বছরের বয়োজ্যেষ্ঠা! ফুলমণির আত্মকথা-র নায়িকা আরও ত্রিশ বছরের প্রাচীন।

একশো পনেরো বছর পরে আজকাল আর উপন্যাসের নায়িকাকে ওভাবে সাহস করে এগিয়ে আসতে দেখি না। তারা আর কথাসাহিত্যিককে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বলে না : থামুন। আমার কথা আমিই বলব!

নারায়ণ সান্যাল
চৈত্র শেষ, ১৩৯৩ (1987)

 

০১.

আই চোজ মাই ওয়াইফ, অ্যাজ শী ডিড হার ওয়েডিং গাউন, ফর কোয়ালিটিস্ দ্যাট উড উয়্যার ওয়েল।—কথাটা গোল্ডস্মিথের। মানে, স্ত্রী যে মন নিয়ে বিবাহের বেনারসিটি কিনেছিলেন, আমিও ঠিক সেই মন নিয়েই আমার জীবন-সঙ্গিনীকে বেছে নিয়েছি—উভয়েরই লক্ষ্য ছিল সেই গুণটি, অর্থাৎ–। দূর ছাই! সব ইংরেজি কথারই কি বাংলা করা যায়? অন্তত আমি তো পারি না। বাংলা ভাষাটার ওপর আমার তেমন দখল নেই। মনে হয়, সব কথা বাংলায় বোঝানো যায় না। মনের ভাবটা কাগজের বুকে কালির আঁচড়ে টানতে গেলেই তা এদেশের মৌসুমী ভিজে বাতাসে যেন স্যাৎসেতে হয়ে যায়। অথচ ঐ কথাই ইংরেজিতে বল, কোথাও বাধবে না।—গ্যালপে গ্যালপে এগিয়ে যাবে কলম। হয়তো ছেলেবেলা থেকে সাহেবদের স্কুলে পড়ে আমার এই হাল। সুনন্দা বেশ বাংলা বলে, সুন্দর চিঠি লেখে। বাংলা-অনার্সের ছাত্রী ছিল সে। যদিও শেষ পর্যন্ত অনার্স নিয়ে পাস করতে পারেনি, তবু ভাষাটা শিখেছে।

সে যা হোক–যে কথা বলছিলুম। সুনন্দাকে আধুনিক পদ্ধতিতেই বিবাহ করেছি। প্রথমে পরিচয়, পরে প্রেম ও পরিণামে পরিণয়! তবু মনে হয় নির্বাচনের সময় আমি তার বাহ্যিক দিকটার দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলুম। বিলাতফেরত বড়লোকের একমাত্র পুত্রের, কোম্পানির একচ্ছত্র মালিকের স্ত্রীর যে গুণগুলি নিতান্ত প্রয়োজনীয়, সুনন্দার তার কোনোটারই অভাব ছিল না। তাই তাকে নির্বাচন করেছিলাম। ঠকিনি। বন্ধুবান্ধবেরা এখনও ঠাট্টা করে বলে–লাকি ডগ! চ্যাটার্জি সেদিন মশকরা করে বললে–তোমার নামের পেছনে বিলাতী অ্যালফাবেটের সঙ্গে আরও দুটো অক্ষর এখন থেকে বসাতে পার-এইচ. পি.।

আমি বললুম-এইচ. পি-টা কী বস্তু?

বলে–মিস্টার হেন-পেকড!

জবাব দিইনি। চ্যাটার্জি ও কথা বলতে পারে। ও হতভাগা সিউডো-ব্যাচিলার। স্ত্রী ওর সঙ্গে থাকে না। বেচারা।

সত্যিই পছন্দসই লক্ষ্মী বউ একটা…একটা অ্যাসেট। আর উড়নচণ্ডী দ্বিচারিণী হচ্ছে যাকে বলে, ব্যাঙ্ক-ক্র্যাশ! ঠিকই বলেছেন স্যেন্ম্যারেজ উইথ এ গুড উয়োম্যান ইজ এ হারবার ইন দ্য টেমপেস্ট অফ লাইফ; উইথ এ ব্যাড উয়োম্যান, ইট ইজ এ টেমপেস্ট ইন দি হারবার। অর্থাৎ

অর্থাৎ থাক। মোট কথা সুনন্দা আমাকে কানায় কানায় ভরে রেখেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানার কাজে ডুবে থাকি, সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত কারখানার কাজের চিন্তা আমার মনের সবটুকু দখল করে রাখে। সুনন্দার মতো সতী-সাধ্বী স্ত্রী না হলে আমার জীবনটা মরুভূমি হয়ে যেত। কী নিরলস পরিশ্রমে সে আমার কাছে কাছে থাকে। আমার প্রতিটি মুহূর্তকে মধুর করে তোলে। সময়ে চায়ের পেয়ালাটি, কফির কাপ, হাতে-গড়া কেক পুডিং যোগান দিয়ে যায়। সপ্তাহান্তে দুজনে সিনেমা যাই। রাত্রে নীচে ডানলোপিলো আর পাশে সুনন্দার নরম আশ্রয়ে ওর আবোল-তাবোল বকুনি শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি। স্ত্রীর কর্তব্যে সুনন্দা যেমন ত্রুটিহীন আমিও স্বামীর কর্তব্য সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন। আমাদের দাম্পত্য-জীবন ছককাটা ঘরে নিয়মের তালে তালে পা ফেলে চলে। এতটুকু বিচ্যুতি সহ্য করি না আমরা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে আমার সাতটা বাজে। এই সাতটা পর্যন্ত সুনন্দার ছুটি। ইচ্ছামতো সে বেড়াতে যায়, বই পড়ে, অথবা–অথবা কী করে তা অবশ্য আমি জানি না! অর্থাৎ জানবার চেষ্টা করিনি। কেন করব? সেটা স্বামী হিসাবে আমার অনধিকার চর্চা হয়ে যেত। সন্ধ্যা সাতটার পূর্ব মুহূর্তটি পর্যন্ত সময়টা তার পকেটমানির সামিল। সে যেমন খুশি তা খরচ করতে পারে। কিন্তু ঠিক সাতটার সময় আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন সে আমাকে রিসিভ করবার জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করে। প্রসাধন সেরে মাথায় একটি লাল গোলাপ গুঁজে একেবারে রেডি।

মাথায় লাল গোলাপ দেবার কথায় একটা পুরানো কথা মনে পড়ল। আমিই তাকে একদিন বলেছিলুম-প্রসাধনের পর খোপায় একটা লাল গোলাপ ফুল দিলে তাকে আরও সুন্দর দেখায়। তারপর থেকে প্রতিদিন সে এ কাজটি নিয়মিত করে।একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখলুম ওর খোপায় ফুল নেই। সেদিন অফিসের কী একটা গণ্ডগোলে এমনিতেই আমার মেজাজ খাপ্পা হয়ে ছিল। রাগারাগিটা বোধহয় বেশি করে ফেলেছিলুম। ওর এক বান্ধবী, নমিতা দেবী, বেড়াতে এসেছিলেন। তার সামনে ধমক দেওয়ায় সুনন্দা বড় অপমানিত বোধ করেছিল। রাত্রে নন্দা বললে–তুমি নমিতার সামনে কেন অমন করে বলে আমায়?

আমি বলি–তোমাকে আমার বলা আছে, সন্ধ্যাবেলায় মাথায় একটা গোলাপ ফুল দেবে। তোমার খোঁপায় ফুল না থাকলে আমার ভাল লাগে না। তুমি ফুল দিতে ভুল গেলে কেন আজ?

নন্দা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে–কী করব? আমাদের বাগানে আজ কোনো গোলাপ ফোটেনি যে।

ভাবলুম বলি—এ বাড়িতে একটি গোলাপ নিত্য ফুটে আছে দেখে গাছের গোলাপগুলো ফুটতে লজ্জা পায়। কিন্তু না, তাতে ওকে আশকারা দেওয়া হবে। কর্তব্যে অবহেলা করলে কঠোর হতে হয়।

তা সে অফিসের লোকই হোক অথবা বাড়ির লোকই হোক। কড়া সুরে বলি-লিঙ্কন। বলেছেন—নেভার এক্সপ্লেন। য়োর এনিমিজ ডু নট বিলিভ ইট অ্যান্ড য়োর ফ্রেন্ডস্ ডু নট নীড় ইট, অর্থাৎ–কাচ কৈফিয়ত দিও না, কারণ তোমার শত্রুরা তাহা বিশ্বাস করে না এবং তোমার বন্ধুদের তাহাতে প্রয়োজন নাই–

বাধা দিয়ে নন্দা বলে-থাক, অনুবাদ না করলেও বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু বাগানে ফুল না ফুটলে কী করে মাথায় ফুল দেওয়া যায় সে সম্বন্ধে চশার থেকে ইলিয়টের মধ্যে কেউ কখনও কিছু বলেছেন কি?

আমি কোনো জবাব দিইনি। দিতে পারতুম, দিইনি। জবাবে আমি ওকে মনে করিয়ে দিতে পারতুম–বায়রনের সেই অনবদ্য উক্তিটি রেডি মানি ইজ আলাদীনস্ ল্যাম্প (নগদ টাকা আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ)। মুখে বলিনি, কারণ সেটা ব্যবহারে পরে বুঝিয়ে দেব বলে।

এর পর প্রত্যহ নিউমার্কেট থেকে আমার বাড়ি ফুল সরবরাহের ব্যবস্থা করে দিলুম।

একটা বিলাতি অর্কেস্ট্রা যেমন ঐকতানে বাজে—এ সংসারের সবকিছুই তেমনি একটা শৃঙ্খলা বজায় রেখে আমাদের দাম্পত্য-জীবনের মূল সুরটি ধরে রেখেছে। একচুল বিচ্যুতি ঘটবার উপায় নেই। যত কাজই থাক, আমাদের দাম্পত্য-জীবনের সুখ-সুবিধার ক্ষতি হতে পারে এমন কিছু ঘটতে দিতুম না। রবিবার সন্ধ্যায় আমার ডায়েরিতে কোনো অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঢুকতে পারেনি। সপ্তাহান্তিক অবসরটা আমি স্ত্রীর সঙ্গে কাটাই। শহরে কোনো একটি প্রেক্ষাগৃহের সবচেয়ে সামনের অথবা সবচেয়ে পিছনের দুটি আরামদায়ক আসন আমাদের প্রতীক্ষায় প্রহর গোণে। আমার আদালী রামলালকে পাঠিয়ে টিকিট কিনে রাখার দায়িত্বটা নন্দার। কী বই দেখবে তার নির্বাচনের ভার সম্পূর্ণ সুনন্দার উপর ছেড়ে দিয়েছি। প্রথম প্রথম নন্দা এ বিষয়ে আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইত। কোন্ কাগজে কী। সমালোচনা বের হয়েছে, কে কী বলেছে আমাকে শোনাতে আসত। আমি ডিভিশন অফ লেবারে বিশ্বাসী। এ বিষয়ে যখন তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া আছে তখন আমি অহেতুক নাক গলাই কেন? সে যেখানে আমায় নিয়ে যাবে আমি সেইখানেই যেতে রাজি। ইবসেনের নোরার মত সে যেন না কোনোদিন বলে বসতে পারে—তাকে নিয়ে আমি পুতুল খেলা করেছি মাত্র। প্রেক্ষাগৃহের সবগুলি আসনের সামনে বসলে বুঝি থিয়েটার দেখছি—সবার পিছনে যখন বসি তখন বুঝে নিই—এ রবিবারে নন্দা আমাকে সিনেমা দেখাচ্ছে।

শুধু এই একটি বিষয়েই নয়–অনেক গুরুতর বিষয়েও আমি তাকে মতামত প্রকাশ করবার সুযোগ দিই। তার নির্দেশের ওপর অন্ধ নির্ভর করি। এই তো সেদিন কোম্পানি আমার জন্য একজন অতিরিক্ত লেডি স্টেনো স্যাংশন করল। আপনারাই বলুন, এ বিষয়ে কেউ কখনও স্ত্রীর পরামর্শ নিতে যায়? নিজেই ইন্টারভু নেয়, নিজেই নির্বাচন করে-এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সংবাদটা ধর্মপত্নীর কাছে বেমালুম চেপে যায়। আমি এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম। এবং এসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমটাই আমার কাছে নিয়ম! আমি সবকটি দরখাস্ত সুনন্দাকে এনে দিলুম। অকপটে বললুম-তুমি যাকে নির্বাচন করে দেবে, আমি নির্বিচারে তাকেই গ্রহণ করব।

পাঠক! তুমি পার এতটা অনাসক্ত হতে?

আমি পারি। নন্দার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। তার অন্যায় আবদার পর্যন্ত আমি মুখ বুজে সহ্য করেছি। জানি না, দরখাস্তকারিণীরা এ নিয়ে আমার বিষয়ে কী ভেবেছিল! কেউ কি স্বপ্নেও ভাবতে পারে যে, শুধুমাত্র স্ত্রীর অনুরোধেই অলক মুখার্জি সকলের ফটো চেয়ে পাঠিয়েছিল? পাঠিকা! তুমি যদি দরখাস্তকারিণী হতে, তাহলে কি বিশ্বাস করতে পারতে যে, তোমার ফটোখানি না দেখেই আর পাঁচখানা ফটোর সঙ্গে তুলে দিয়েছিলুম আমার ধর্মপত্নীর হাতে? অন্য কেউ না জানুক আমি নিজে তা জানি। আর নন্দাও জানে যে, তার একটা খেয়াল চরিতার্থ করতেই আমাকে এই আপাত-অশোভন কাজটি করতে হয়েছিল।

ফটোর বান্ডিলটা তার হাতে দিয়ে ঠাট্টা করেছিলুম–এই নাও। এর থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে কুৎসিত মেয়েটিকে খুঁজে বার কর এবার।

সুনন্দা সাগ্রহে ফটোর বান্ডিলটা আমার হাত থেকে নেয়। ডানলোপিলো গদির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে বাছতে থাকে ছবির গোছা। হঠাৎ একখানি ফটোতে তার দৃষ্টি আটকে গেল। ফটোখানি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে—কেমন দেখতে মেয়েটিকে?

আমি বললুম-কী বললে তুমি খুশি হও?

–সত্যি কথা বললে। মেয়েটি কি খুব সুন্দরী?

—না।

—মেয়েটি কি কুৎসিত?

–তাও না? তবে কি মেয়েটি মোটামুটি সুন্দরী?

-তা বলা চলে। হঠাৎ ধমক দিয়ে ওঠে সুনন্দা–কোনখানটা ওর সুন্দর দেখলে তা জানতে পারি কি?

কী বিপদ! কী বললে সুনন্দার সঙ্গে মতে মিলবে তা বুঝে উঠতে পারি না। ছবি দেখে মেয়েটিকে সত্যিই কিছু আহামরি সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে না। ছিপছিপে একহারা চেহারা। রূপসী না হলেও মুখখানি উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত। সুনন্দা আবার বলে-কই, বললে না? ওর কোনখানটা সুন্দর লাগল তোমার?

বললুম–দি বেস্ট পার্ট অব বিউটি ইজ দ্যাট হুইচ নো পিকচার ক্যান এক্সপ্রেস (সৌন্দর্যের মর্মকথা সেটাই, যেটা ছবিতে ধরা দেয় না)–

—রাসকিন বলেছেন বুঝি?

–না। বেকন।

—তা আমি তো আর বেকন-সাহেবের মতামত শুনতে চাইনি। আমি শুনতে চাই তোমার কথা। বললুম—আমার মতামতটা না জিজ্ঞাসা করাই ভালো। সৌন্দর্যের তো কোনও মাপকাঠি নেই–সুতরাং কতটা সুন্দর তা বোঝাতে গেলে তুলনামুলক শব্দ ব্যবহার করতে হয়। অন্য ছবিগুলো তো আমি দেখিনি। তা কার সঙ্গে তুলনা করব বল?

–অন্য ছবিগুলো তুমি দেখনি? শুধু এই একখানি ছবি দেখেই এত মোহিত হয়ে গেলে? কিন্তু কেন? কী দেখলে তুমি!

আমি বলি—কী আশ্চর্য! তুমি আমার কথাটা বুঝতেই চাইছ না। মোহিত হয়ে যাবার কোনো কথাই উঠছে না। এখানাও তত আমি আগে দেখিনি। তুমি এখন দেখালে, তাই দেখছি। এখন কথা হচ্ছে তুলনা করতে হলে–

বাধা দিয়ে নন্দা বলে–বেশ দেখ, সবগুলো ছবিই দেখ।

ছবির বান্ডিলটা সে ছুঁড়ে দেয় আমার দিকে। অজানা অচেনা একগুচ্ছ মেয়ে লুটিয়ে পড়ল আমার পায়ের কাছে। আমি তাসের প্যাকেটের মতো সেগুলি তুলে রেখে দিলুম টিপয়ে। দেখলাম না চোখ তুলেও। বললুম–না। আমি দেখব না। তুমি যাকে পছন্দ করে দেবে তাকেই বহাল করব আমি।

—কিন্তু না দেখলে তুলনামূলক বিচার তো তুমি করতে পারবে না!

–না হয় নাই পারলুম।

–তাহলে বরং আমার সঙ্গে তুলনা করে বল। না কি, আমার দিকেও কখন চোখ তুলে দেখনি তুমি?

বললুম–মাপ কর নন্দা, সে আমি পারব না। তোমার সঙ্গে কোনো মেয়ের তুলনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার পাশাপাশি কোনো মেয়েকে বসিয়ে মনে মনে তুলনা করছি—এটা আমি ভাবতেই পারি না। করলেও বিচারটা ঠিক হবে না। সে ক্ষেত্রে হয়তো মিস্ য়ুনিভার্সও আমার কাছে পাস-মার্ক পাবেন না।

সুনন্দা লজ্জা পায়। বলে–যাও, যাও। অতটা ভালো নয়।

সুনন্দা জানে, আমি মিথ্যা কথা বলিনি। সে মর্মে মর্মে জানে যে, তার রূপের জ্যোতিতে আমি অন্ধ হয়েই আছি। গাল দুটি লাল হয়ে ওঠে, দৃষ্টি হয় নত। রূপের প্রশংসা করলেই নন্দার ভাবান্তর হয়। অথচ তার রূপের প্রশংসা আমাকে প্রায় প্রত্যহই করতে হয়।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এ জন্যে আমাকে মিথ্যাভাষণ করতে হয় না। বস্তুত সুনন্দা নিজেও জানে যে, সে অপূর্ব সুন্দরী। আমি না বললেও পথচারীরা বিস্ফারিত মুগ্ধ দৃষ্টির লেফাফায় এ বারতা তাকে নিত্য জানায়। আমি অবশ্য তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করি অন্য কারণে। আমি তার রূপের প্রসঙ্গ তুললেই সে লজ্জা পায়–লাল হয়ে ওঠে। যে কারণে বাড়িতে নিত্য ফুলের ব্যবস্থা করেছি ঠিক সেই কারণেই আমি মাঝে মাঝে ওর রূপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করি। তখনই মনে পড়ে কবি গ্রেগরীর সেই কথা—-হোয়েন এ গার্ল সিজেস টু ব্লাশ, শী হ্যাজ লস্ট দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল চার্ম অব হার বিউটি। অর্থাৎ, কোনও একটি মেয়ে তার সৌন্দর্যের প্রধান চার্মটি, মানে আকর্ষণটি তখনই হারিয়ে ফেলে যখন থেকে সে-কী আশ্চর্য! ব্লাশের বাংলা কী? লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা? নাঃ! বাংলায় ডায়েরি লেখা এরপর বন্ধ করে দেব। একটা ভালো কথা যদি বাংলায় লেখা যায়!

মোট কথা, সুনন্দা আমাকে জোর করে ধরে বসল, ঐ মেয়েটিকেই চাকরিটা দিতে হবে। কেন, তা বলল না। মেয়েটির দরখাস্তখানি বার করলুম। পর্ণা রায়, বি. এ.। ইতিপূর্বে কোথাও চাকরি করেনি। সম্প্রতি কমার্সিয়াল কলেজ থেকে স্টেনোগ্রাফি পাস করেছে, স্পীডের উল্লেখ করেনি। অপরপক্ষে অন্যান্য প্রার্থিনীদের সুপারিশ ছিল, প্রাক্তন অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর ছিল অভিজ্ঞানপত্রে (টেস্টিমোনিয়ালের বাংলা ঠিক হল তো?)। সে কথা নন্দাকে বললুম। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। এ রকম বিপাকে পড়লে আপনারা যা করতেন আমিও তাই করলুম-কথা দিই–মোটামুটি যদি ডিকটেশন নিতে পারে, তবে তাকেই রাখব। আমি আমার কথা রেখেছি। না, ভুল হল, আমি যা কথা দিয়েছিলুম তার বেশিই করেছি। মেয়েটি মোটামুটি ডিটেশনও নিতে পারেনি। তবু তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি। কেন? কারণ, আমি বুঝতে পেরেছি ভিতরে কোনও ব্যাপার আছে। সুনন্দা কি মেয়েটিকে চেনে? তাহলে স্বীকার করল না কেন? আমি যতই তাকে পীড়াপীড়ি করি, সে অন্য কথা বলে এড়িয়ে যায়। একবার বলল—অন্যান্য দরখাস্তকারিণীদের তুলনায় এ মেয়েটির রূপের সম্ভার অল্প। কথাটা, জানি, ডাহা মিথ্যে! না না, অন্যান্য ফটোর সঙ্গে তুলনা করে এ কথা বলছি না। বস্তুত অন্যান্য ছবিগুলি আমি আজও দেখিনি। (পাঠক! তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, না? না হতে পারে, তুমি তো আমার সুনন্দাকেও দেখনি!) সম্ভবত সুনন্দা নিজেও দেখেনি। কারণ আমি জানি, সে ভয় নন্দার কোনোদিন ছিল না, থাকতে পারে না। সে জানে, অলক মুখার্জি আর যাই করুক স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। আর একবার ও বললে—বেকার মেয়েটি যে ভাবে দূরখাস্তে করুণ ভাষায় আবেদন করেছে তাতেই সে বিচলিত হয়েছে। এটাও বাজে কথা। কারণ সকলের দরখাস্তের ভাষাই প্রায় একরকম। শেষে বলে-দেখ, অন্যান্য মেয়ের পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে, তারা সহজেই অন্যত্র চাকরি জুটিয়ে নেবে। এ করা শক্ত। এ কথাটাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে পারা যায় না। কিন্তু আমার বিশ্বাস এটাও আসল কথা নয়। আসল কথা, মেয়েটি সুনন্দার পূর্ব-পরিচিত। তবে সেকথা ও স্বীকার করল না কেন?

কারণটাও অনুমান করতে পারি। সুনন্দা জানে আমি আদর্শবাদী। স্ত্রীর পরিচিত কাউকে চাকরি দেওয়ার অর্থ নেপটিজম, অর্থাৎ আত্মীয়-পোষণ। পর্ণা অবশ্য আমার আত্মীয় নয়, কিন্তু নেপটিজমের বাংলা কি ঠিক আত্মীয়-পোষণ? পরিচিত-পোষণ বলব কি? দূর হোক, বাংলা না হয় নাই করলুম। জিনিসটা তো খারাপ? সুনন্দা জানে, অলক মুখার্জি কখনও নেপটিজমের কবলে পড়বে না স্ত্রীর অনুরোধেও নয়। সম্ভবত সেই জন্যেই সে আসল কারণটা গোপন করে গেল।

এ প্রায় দেড় মাস আগেকার ঘটনা। ছয় সপ্তাহ আগে কোম্পানির খাতায় একটি নতুন নাম উঠেছে। পর্ণা রায়, বি, এ. লম্বা একহারা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। শ্যামলা রঙ। সমস্ত অবয়বের মধ্যে আশ্চর্য আকর্ষণ ওর চোখ দুটিতে। যেন কোন অতলস্পর্শ গভীরতার স্বপ্নে বিভোর। দিনান্তের শেষ শ্যামলছায়া যেমন দিগন্তের চক্ৰবালে আপনাতেই আপনি লীন হয়ে থাকে–মেয়েটির অন্তরের সব কথাই যেন তেমনি দুটি চোখের তারায় মগ্ন হয়ে আছে। ওর সে চোখের দিকে চাইলে মনে হয় সেখানে কোনো নিগুঢ় স্বপ্ন নিঃসাড়ে সুপ্তিমগ্ন। তখন মনে হয় না যে, ঐ ছায়া-ঘন শান্ত দিচ্চক্ৰবালেই হঠাৎ ঘনিয়ে আসতে পারে কালবৈশাখীর কুটি। তখন সে চোখের দিকে তাকাতে ভয় হয়। আবার ঐ চোখেই ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ উঁকি দেয় অস্তসূর্যের শেষ স্বর্ণাভা! তখনও সে চোখের দিকে তাকানো যায় না—চোখ ঝলসে যায়। নন্দার চোখ দুটিও সুন্দর। অনিন্দ্য। সমস্ত মুখাবয়বের সঙ্গে অত্যন্ত মানানসই। কিন্তু সে চোখ জুলে। সে যেন হরিণের চোখ—শান্ত, করুণ, উদাস—সরল সারঙ্গ দৃষ্টি। টেনিসনের ভাষায়–হার আইজ আর হোমস অব সাইলেন্ট প্রেয়ার–সে চোখে যেন উপাসনা-মন্দিরের স্নিগ্ধ সৌম্যতা। আর এই মেয়েটির চোখের দৃষ্টিতে মনে পড়ে শেক্সপীয়ারকে–এ লাভার্স আইজ উইল গেজ আন ঈগল ব্লাইন্ড! ঈগল পাখিও সে চোখের দিকে চাইলে অন্ধ হয়ে যায়।

এ সব কথাই কিন্তু একেবারে প্রথম দিন মনে হয়নি। পরে হয়েছে। আমি যখন ডিটেশন দিই ও মাথা নিচু করে কাগজের ওপর দুর্বোধ্য আঁচড় টানতে থাকে। আমি ওর নতনেত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেখানেও যেন আমার অজানা ভাষায় কোন দুর্বোধ্য আঁচড় পড়ছে। আমি সে চোখের ভাষা পড়তে পারি না, ও পারে। আবার টাইপ-করা কাগজখানি সই করার আগে আমি যখন পড়তে থাকি ও সামনে বসে থাকে চুপ করে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখন বুঝতে পারে যে, সে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সে চাহনি ঈগল দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেবার ক্ষমতা রাখে! আমি অসোয়াস্তি বোধ করি। পড়তে পড়তে যখনই চোখ তুলি–তৎক্ষণাৎ সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

এ সব কথাই কিন্তু প্রথম দিন মনে হয়নি। ক্রমে হয়েছে।

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, সুনন্দার আগ্রহাতিশয্যে এই মেয়েটিকে চাকরি দিয়েছি। সে কথা মনে পড়ল একদিন সুনন্দার কথাতেই। হঠাৎ ও একদিন প্রশ্ন করে বসল–পর্ণা কেমন কাজ করছে?

—পর্ণা কে? আমি প্রতিপ্রশ্ন করি। আমার স্টেনোকে আমি মিস রয় বলেই ডাকি। তার নাম যে পর্ণা সে কথা সে সময়ে আমার খেয়াল ছিল না।

সুনন্দা ফোঁস করে ওঠে—অতটা ভালোমানুষী ভালো নয়; তোমার স্টেনোর নাম পর্ণা নয়?

-ও! মিস্ রয়? হ্যাঁ, তা ভালই কাজ করছে। কেন?

—না, তাই জিজ্ঞাসা করছি। আমার অনুরোধে ওকে চাকরি দিলে তো। তাই জানতে চাইছি, আমার নির্বাচন তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা।

এই পছন্দ-অপছন্দ কথাগুলি বড় মারাত্মক। তাই ও প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে বলি—একদিন বাড়িতে নিয়ে আসব? আলাপ করবে?

সুনন্দা অস্বাভাবিকভাবে চমকে ওঠে। আর্ত কণ্ঠে বলে–না না না! অমন কাজ তুমি কর না।

আমি অবাক হয়ে যাই। বলি–ব্যাপার কী? এতটা ভয় পাওয়ার কী আছে? সে তো আর কামড়ে দেবে না তোমাকে?

সুনন্দা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকের ছলে বলে–কী করে জানলে?

—জানলুম, কারণ এতদিনেও আমাকে একবারও কামড়ায়নি।

–তাই নাকি। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল!

আমি বলি—নন্দা, তুমি আমাকে সেদিন মিছে কথা বলেছিলে, মেয়েটিকে তুমি চিনতে। সুনন্দা এতদিনে স্বীকার করে।

—তাহলে সেদিন বলনি কেন?

এতদিনে সব কথা খুলে বলল সে। বললে—পর্ণা আমাদের কলেজে পড়ত। একই ইয়ারে। খুব গরিব ঘরের মেয়ে। তাই ভেবেছিলাম–যদি বান্ধবীর একটা উপকার করতে পারি। তোমাকে বলিনি, পাছে আমার বান্ধবী বলেই তোমার আপত্তি হয়।

—তাহলে ওকে এখানে আনতে তোমার এত আপত্তি কিসের?

—ও লজ্জা পাবে বলে। তোমার কাছে স্বীকার করতে সংকোচ নেই–ও ছিল আমার প্রতিদ্বন্দ্বিনী। ক্লাসে কোনোবার ও ফার্স্ট হয়েছে কোনোবার আমি। দুজনেরই বাংলায় অনার্স ছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মেয়েটি আমার সঙ্গে টেক্কা দিতে চাইত। অবশ্য প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সে হেরে গিয়েছে আমার কাছে। খেলাধুলা, ডিবেট ইত্যাদিতে আমার কাছে হার স্বীকার করেছিল। তাই আমাকে ভীষণ হিংসে করত। আজ যদি সে জানতে পারে–আমারই অনুগ্রহে ওর চাকরি হয়েছে—তখন ব্যথাই পাবে সে মনে মনে। ওদের বাড়ির যে অবস্থা তাতে চাকরি ও ছাড়তে পারবে না–অথচ প্রতিদিনের কাজ আত্মগ্লানিতে ভরে উঠবে ওর।

সুনন্দার উদারতায় মুগ্ধ হয়ে গেলুম। সে গোপনে উপকার করতে চায়। যার অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিল—পাছে সে লজ্জা পায়, ব্যথা পায়, তাই সে কথা জানাতেও চায় না। ওর সব কথা শুনে স্নেহে শ্রদ্ধায় মনটা ভরে ওঠে! ওর মনের যেন একটা নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। শুধু বহিরঙ্গই সুন্দর নয়, ওর অন্তরটাও সোনা দিয়ে মোড়া। ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলিখেলাধুলা, ডিবেট, পড়াশুনা সব ক্ষেত্রেই তো তাকে হারিয়ে দিয়েছিলে—কিন্তু কলেজ জীবনের আসল প্রতিযোগিতার কথাটা তো বললে না?

—আসল প্রতিযোগিতা মানে?

–মদন-মন্দিরের প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে হয়নি তোমাদের?

ও হেসে বলে—এ তো তোমাদের বিলেতের কলেজ নয়।

আমি বলি—তাহলে ফাইনাল-রাউন্ডের খেলাটা হয়নি। কিন্তু সেমি-ফাইনালের খেলাতে ও তোমাকে হারিয়ে দিয়েছে নন্দা।

আমার বুক থেকে মুখ তুলে ও বলে–তার মানে?

—মিস্ রয় অনার্স নিয়েই বি. এ. পাস করেছে। সুনন্দা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে-তুমি ওর অরিজিনাল সার্টিফিকেট দেখেছ?

–না, কেন?

–পর্ণা বি. এ. পরীক্ষা দেয়নি।

–কী বলছ যা তা, তাহলে দরখাস্তে ও কথা লিখতে সাহস পায়?

–আমি নিশ্চিতভাবে জানি। আমরা একই ইয়ারে পড়তাম। বেয়াল্লিশ সালে আমাদের পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। পরীক্ষার আগেই ওকে পুলিশে ধরে। তারপর আটচল্লিশ সাল পর্যন্ত ও ছাড়া পায়নি। ইতিমধ্যে ওর বাবা মারা যান। আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি ওর।

আমি বলি—এও কি সম্ভব? পাস না করেই মেয়েটি নামের পাশে বি. এ. লিখেছে?

সুনন্দা বলে—পর্ণার পক্ষে সবই সম্ভব।

—বেশ, খোঁজ নেব আমি।

—না থাক, দরকার কী? অত্যন্ত গরিব ঘরের মেয়ে পর্ণা। বাপও মারা গেছে। ওর সঙ্গে কলেজে, একটি ছেলের খুবই মাখামাখি হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, তার সঙ্গেই ওর বুঝি বিয়ে হয়েছে। দরখাস্ত পড়ে বুঝলাম তা হয়নি। কী দরকার এ নিয়ে খুঁচিয়ে ঘা করার। অহেতুক চাকরিটা খোয়াবে বেচারি। খাবে কী?

আমি বলি—কী যা তা বকছ নন্দা! এ তো জালিয়াতি রীতিমতো! জেল পর্যন্ত হতে পারে এ জন্য।

-বল কী, জেল পর্যন্ত হতে পারে? কিন্তু প্রমাণ করবে কী করে?

এ আলোচনা এখানেই বন্ধ করে দিই, বলি—এক কাপ কফি খাওয়াতে পার?

পরদিনই মিস রয়কে বলি–আপনার ক্রিডেনশিয়ালগুলোর অ্যাটেসটেড কপিই দেখা আছে আমার। কালকে অরিজিনাল সার্টিফিকেটগুলো সব একবার আনবেন তো।

ঈগলদৃষ্টি-দগ্ধী দৃষ্টি পড়ে আমার মুখের ওপর।

—হঠাৎ, এতদিন পরে?

—হ্যাঁ। তাই নিয়ম। অরিজিনাল সার্টিফিকেটগুলো দেখে আপনার সার্ভিস-বইতে সই করে দিতে হবে আমাকে। কাল সব নিয়ে আসবেন। ডিগ্রি সার্টিফিকেটখানাও।

–ডিগ্রি সার্টিফিকেটখানা তো কাল আনতে পারব না স্যার। সেটা দেশে আছে। অন্যান্য মূল কাগজ অবশ্য আনব।

কেমন যেন সন্দেহ বেড়ে যায়! সবই আছে কাছে, আর ডিগ্রি সার্টিফিকেটখানাই দেশের বাড়িতে আছে? কিন্তু যখন ধরেছি তখন শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে আমাকে। বাধ্য হয়ে বলি—বেশ, উইকেন্ডে আনিয়ে নেবেন। না হয় দুদিন ছুটিই নিন।

—দেশ মানে স্যার, পাকিস্তান। সে তো আনা যাবে না সার। একথার পর সন্দেহ আর বাড়ে না! এতক্ষণে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল। মেয়েটি বি. এ. পাস করেনি আদপে। কিন্তু কী দুঃসাহস! সুনন্দার বান্ধবী বলে ক্ষমা করতে পারব না আমি। এ অপরাধ অমার্জনীয়। পুলিশে অবশ্য ধরিয়ে দেব না, কিন্তু চাকরিতেও রাখতে পারব না ওকে। আমার স্টেনো হিসাবে অনেক গোপন খবর ও অনিবার্যভাবে পাবে। যে মেয়ে এত বড় জালিয়াতি করতে পারে, তার পক্ষে সবই সম্ভব। কে জানে, অফিসের গোপন খবর জেনে নিয়ে হয়তো শেষে আমাকেই ব্ল্যাকমেইলিং শুরু করবে। অগত্যা সুকৌশলে এগিয়ে যেতে হল আমাকে।

–আই সী! দেশ মানে পূর্ব-পাকিস্তান! তা কোন ইয়ারে বি. এ. পাস করেন আপনি?

-বেয়াল্লিশ সালে।

–কোন কলেজ থেকে?

–প্রাইভেটে।

–কোনো কলেজে পড়তেন না আপনি?

–পড়তাম। পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিই।

–অনার্স ছিল বলেছিলেন—না?

-হ্যাঁ, স্যার, বাংলায়—সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলাম। ফার্স্ট ক্লাস সেবার কেউ পায়নি।

–ও। তা কোন কলেজে পড়তেন আপনি?

পর্ণা যে মফস্বল কলেজটির নাম করে সেখান থেকেই সুনন্দা বি. এ. পরীক্ষা দিয়েছিল। এবার তাই প্রশ্ন করি–আচ্ছা, আপনাদের ঐ কলেজে সুনন্দা চ্যাটার্জি বলে একটি মেয়ে পড়ত?

ডিটেশনের পেনসিলটা দিয়ে কপালে মৃদু মৃদু টোকা দিয়ে পর্ণা একটু ভেবে নিয়ে বললে–সুনন্দা! না! মনে পড়ছে না তো? কেমন দেখতে বলুন তো?

–খুব সুন্দরী একটি মেয়ে?

—কই, মনে তো পড়ছে না! সুমিত্রা না সুপ্রিয়া নামে একটা মেয়ে আমাদের ক্লাসে ছিল মনে হচ্ছে-বড়লোকের মেয়ে, একটু পুরুষালিভাব, খেলাধুলা সাইকেল চড়ায় মাতামাতি করত—কিন্তু সুন্দরী তাকে কেউ বলবে না। রঙটা অবশ্য কটা ছিল মেয়েটির, কিন্তু মুখ ছিল গোলগাল, হুলো বেড়ালের মত।

আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে আমার! মেয়েটি শুধু জালিয়াতিই নয়, চালিয়াতও। কলেজ জীবনে যে ছাত্রীটির কাছে সব বিষয়ে হার স্বীকার করতে হয়েছে, আজ তার অস্তিত্বটাই স্বীকার করতে চায় না! মনে মনে বললুম-তুমি জানতেও পারলে না পর্ণা, তোমার যে সহপাঠিনীকে আজ তুমি চিনতে চাইছ

-যার সৌন্দর্যে আজও ঈর্ষান্বিত হয়ে তুমি ব্যঙ্গবিদ্রুপ করছ, সেই মেয়েটির উদারতাতেই আজ তোমার রান্নাঘরে দুবেলা উনুন জ্বলে!

–তা আপনি এই সুনন্দা চ্যাটার্জিকে চেনেন নাকি স্যার?

আমি এ প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে বলি—এই চিঠিগুলো টাইপ করে আনুন!

মেয়েটি বুদ্ধিমতী। তৎক্ষণাৎ চিঠির কাগজগুলো নিয়ে সরে পড়ে।

বুঝলুম, মেয়েটি নির্জলা মিথ্যা কথা বলেছে। মফস্বলের গভর্নমেন্ট কলেজ। কোয়েডুকেশন ছিল! সুতরাং ছাত্রী ছিল মুষ্টিমেয়। নন্দার কাছে গল্প শুনেছি-তার নাম ছিল কলেজ-কুইন। ফার্স্ট ইয়ার থেকে ফোর্থ-ইয়ার পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছেলে, মায় দপ্তরী-বেয়ারাগুলো পর্যন্ত চিনত তাদের কলেজ-কুইনকে। আর মিস্ রয় তার সহপাঠিনী হয়ে তাকে চিনবে না, এ হতে পারে না। পর্ণা নিশ্চয় জানে না যে, ঐ সুনন্দাই তার বসের ঘরণি; জানলে এ সুরে কথা বলত না সে। কিন্তু তা হলেও পর্ণার হিংসুটে মনের কী কদর্য রূপটাই দেখতে পেলুম মুহূর্তে। ওর প্রতি যেটুকু করুশা সঞ্চারিত হয়েছিল তা ভেসে গেল ওরই কথায়। প্রভু-ভৃত্য ছাড়া ওর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখা চলবে না। কিন্তু না! সে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। যে মেয়ে য়ুনিভার্সিটির ডিগ্রি জাল করতে পারে তাকে অফিসে রাখা চলে না।

রাত্রে সব কথা নন্দাকে খুলে বলি। নন্দা যেন জ্বলে ওঠে–কী বলল সে? হুলো বেড়ালের মত?

আমি বলি–আহাহা, সে তো আর তোমাকে বলেনি।

–আমাকে না তো আর কাকে?

–যাক, আমার কী মনে হয় জান? মেয়েটি সত্যিই পাস করতে পারেনি। তাই বললে, ডিগ্রি সার্টিফিকেটখানা পাকিস্তানে আছে।

—তাতে আর সন্দেহ কী?

—আমি খোঁজ নিয়ে বার করব!

—কোথায় খোঁজ নেবে?

–তাই তো ভাবছি।

–খোঁজ অবশ্য তুমি য়ুনিভার্সিটি লাইব্রেরীতেই পেতে পার। কিন্তু আমি কী বলি জান? থাক না। খুঁচিয়ে ঘা করে কী লাভ? দুটো পয়সা করে খাচ্ছে। তুমি বলছ, এতে জেল পর্যন্ত হতে পারে?

—হতে পারে মানে? হবেই।

–তবে থাক। আমরা বরং ধরে নিই পর্ণা সত্যি কথাই বলেছে!

আমি বলি—দেখ নন্দা, স্যার ফিলিপ সিড়নি বলেছেন,–দ্য ওনলি ডিসঅ্যাডভান্‌টেজ অফ অ্যান অনেস্ট হার্ট ইজ ক্রেডুলিটি। অর্থাৎ কিনা, মহৎ হৃদয়ের একমাত্র অসুবিধা হচ্ছে তার বিশ্বাসপ্রবণতা। তোমার অন্তঃকরণ মহৎ, তাই তুমি অন্ধ বিশ্বাস করতে চাইছ। কিন্তু বিজনেসে অন্ধ বিশ্বাসের স্থান নেই।

নন্দা মাথা নেড়ে বলে—তা নয় গো। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠছে না। সে আমার শত্রুতা করেছে আজীবন, আজও করছে। তা করুক। আমি ওকে ক্ষমা করতে চাই।

ওকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে বলি-দ্য ফাইন অ্যান্ড নোল ওয়ে টু ডেসট্রয় এ ফো ইজ টু কিল হিম; উইথ কাইন্ডনেস য়ু মে সো চেঞ্জ হিম দ্যাট হি শ্যাল সীজ টু বি সো; দেন হি ইজ স্লেইন! –বল তো কার কথা?

নন্দা নির্জীবের মতো বলে–জানি না।

আমি বলি—অ্যালেইনের। কিন্তু মিস রয় তো আমার ফো নয়, আমার স্টাফ। আমাকে খোঁজ নিতেই হবে। অন্যায় যদি সে করে থাকে তাহলে শাস্তিও পেতে হবে তাকে। বিশেষ, জেনে হোক না জেনে হোক, সে তোমাকে অপমান করেছে।

নন্দা কোনো কথা বলে না।

পরদিন মিস্ রয় সকল সংশয়ের ওপর যবনিকাপাত করল। ছাপানো গেজেট এনে প্রমাণ করল যে, সে প্রাইভেটে বি. এ. পাস করেছে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান ছিল তার। রাজবন্দি হিসাবে সে পরীক্ষা দিয়েছিল।

সংবাদটা সুনন্দাকে দিলুম। এবারও সে কোনো কথা বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *