অধ্যায় ৫ – আকাশ থেকে প্রার্থনা

অধ্যায় ৫ – আকাশ থেকে প্রার্থনা

সোতা স্টোরের সামনের দিক থেকে ফিরে এলো।

‘এখনও কিছু নেই?’

সে মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘নাহ। মনে হয় বাতাসের শব্দ।’

‘যাক, ব্যাপার না,’ আতসুয়া বলল।

‘কে জানে আমাদের উত্তরটা সে পেয়েছে কিনা।’ কোহেই বলল।

‘কেন পাবে না! চিঠিটা তো ক্রেটে নেই। তাহলে সেটা কে নিয়েছে?’

‘ঠিক বলছো। কিন্তু আমরা উত্তর পেলাম না কেন?’

‘হুম,’ সোতা বলতে শুরু করলে আতসুয়া তাকে থামিয়ে দিলো।

‘তাতে কী আসে যায়? একে নিয়ে আমাদের আর কীই-বা করার আছে? উত্তর দেখে সে নিশ্চয়ই কিছুই বুঝতে পারেনি। আরেকটি চিঠি আসা মানে আরেকটা ঝামেলা। যদি বিস্তারিত জানতে চায় তখন কী করব?’

বাকি দুজন নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘বুঝলে? এসব আসলে উটকো ঝামেলা।’

‘কী অদ্ভুত, তাই না?’ সোতা বলল, ‘মানে, এটাই সেই প্রিয় সংগ্রামী সংগীতশিল্পী, কী অদ্ভুত না?’

মুন র‍্যাবিটের সাথে চিঠি আদান-প্রদানের পরই নতুন একজনের কাছ থেকে চিঠি পায় তারা। ছেলেটার তথাকথিত সমস্যা ছিল, সে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল যে তার এখন পারিবারিক ব্যাবসা সামলানো উচিত নাকি সংগীতকেই নিজের পেশা বানিয়ে ফেলা উচিত। পড়ে মনে হয়েছিল বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া নবাব যে-কিনা কিছুতেই তুষ্ট হয় না।

ফিরতি চিঠিতে তারা তিনজন ছেলেটাকে নানা কথা শুনিয়ে দেয়। সংগ্রামী সংগীতশিল্পী এটা মোটেও আশা করেনি। সেও রেগে-মেগে উত্তর দেয় তাদের। তিন বন্ধু তখন আরেকটা তীব্র চিঠি লেখার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটে।

তারা স্টোরে বসে চিঠির অপেক্ষা করছিল। নিজেদের চোখেই দেখছিল কীভাবে চিঠিটা মেইল স্লটে পড়ছে। অর্ধেক পড়ে আটকে যায়। কিন্তু অবাক হবার মূল কারণ সেটা না।

মেইল স্লটের ভেতর থেকে হারমোনিকার সুর ভেসে আসে। এই সুর তাদের সুপরিচিত, ‘রিবর্ন’।

এটা সেরি মিযুহারার যুগান্তকারী গান। যার একটা চমৎকার প্রেক্ষাপট আছে। আর সেই প্রেক্ষাপট এই তিন বন্ধুর কাছে ব্যক্তিগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

সেরি মিহারা তার ছোটো ভাইয়ের সাথে মারুমিতসুয়েনে বড়ো হয়েছে। সে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিল তখন সেখানে একবার মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড হয়। তার ভাই প্রায় মরতে বসেছিল। কিন্তু এক অনভিজ্ঞ সংগীতশিল্পী যে তখন মারুমিতসুয়েনে ক্রিসমাসের গান করতে এসেছিল, সে সেরির ভাইকে বাঁচায়। লোকটার সারা শরীরে থার্ড ডিগ্রি বার্নে ভরে গিয়েছিল। শীঘ্রই সে হাসপাতালে মারা যায়।

‘রিবর্ন’ তারই অরিজিনাল গান। সেরি তার অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এই গান গেয়ে গেছে। এই গান দিয়েই তার মিউজিক ক্যারিয়ার শুরু হয়।

তিন বন্ধু গানটা ছোটোবেলা থেকে অসংখ্যবার শুনেছে। তারাও মারুমিতসুয়েনের অধিবাসী ছিল। সেই অনাথাশ্রমের জন্য সেরি ছিল এক আশার আলো। তারা সবাই সেরির পদচিহ্ন অনুসরণ করে জীবনে সফল হবার স্বপ্ন দেখত।

একারণেই আতসুয়া, সোতা আর কোহেই হারমোনিকাতে ‘রিবর্নের’ সুর শুনে অবাক হয়। তারা ইতোমধ্যে জানে ১৯৮০-এর সময় থেকে চিঠি আসছে। সেরি মিযুহারা হয়তো তখন জন্মেছে কিন্তু তখন সে কেবল একটা বাচ্চা। সে আরও অনেক বছর পর ‘রিবর্ন’ রেকর্ড করবে।

এসব থেকে একটা উপসংহারেই আসা যায়: সংগ্রামী সংগীতশিল্পীই ‘রিবর্ন’- এর নির্মাতা। আর সেই সেরির ভাইকে বাঁচাবে।

তিন বন্ধু খুব দ্বিধায় পড়ে যায়। সামনে যা হতে চলেছে তা কি বলে দেবে? বলতে পারবে যে, ‘শুনুন, ১৯৮৮ সালে আপনি মারুমিতসুয়েনে ক্রিসমাস শোতে গান করতে যাবেন আর তখন সেখানে অগ্নিকাণ্ড ঘটবে আর আপনি মারা পড়বেন।’

‘চলো বলে দেই,’ কোহেই বলল, ‘তাহলে সে মারা পড়বে না।’

‘সে না মরলে তো সেরির ভাই মারা যাবে।’ সোতা বলল।

কোহেই এর কোনো উত্তর পেল না।

আতসুয়া সিদ্ধান্ত নিলো তারা সেই ঘটনার কথা বলবে না।

‘যদি বলিও তাহলে সে বিশ্বাস করবে না। ভাববে কোনো ভবঘুরে লোক তাকে ভবিষ্যৎবাণী দিচ্ছে। আর চিঠিই দেবে না। তাছাড়া কী হতে চলেছে তা আমরা জানি। অগ্নিকাণ্ড ঘটবে আর সেরি বিখ্যাত মিউজিশিয়ান হবে। আমরা যাই লিখি না কেন, বেদনাদায়ক কিছু ঘটবেই। আমরা কেবল তাকে তার ভাগ্য মেনে নিতে সাহায্য করতে পারি।’

সোতা আর কোহেই রাজি হলো। কিন্তু লিখবে-টা কী?

‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি’ কোহেই প্রস্তাব দিলো, ‘সে না থাকলে সেরি বিখ্যাত হতে পারত না। আর আমরা কখনও ‘রিবর্ন’ শুনতে পেতাম না।’

আতসুয়া আর সোতা রাজি হলো, ‘চলো এটাই লিখি।’

তারা একসাথেই চিঠি লিখল। তার মূলকথা গুলো ছিল:

সংগীতে আপনার প্রচেষ্টা বৃথা যাবে না।

আপনার সংগীত কারও জীবন বাঁচাবে। আপনার লেখা গানগুলো আজীবন বেঁচে থাকবে।

জিজ্ঞাসা করবেন না আমি এসব কীভাবে জানি। আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি সত্যি বলছি।

শেষ পর্যন্ত একে আঁকড়ে ধরে রাখবেন। একদম শেষ পর্যন্ত।

এটুকুই বলার ছিল।

.

মিল্ক ক্রেটে চিঠিটা রাখার কিছুক্ষণ পরেই তা উধাও হয়ে যায়। সংগ্রামী সংগীতশিল্পী সেটা নিয়ে গেছে।

খুব দ্রুতই একটা উত্তর আশা করেছিল তারা। একারণে দরজাটা বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল।

কিন্তু কোনো চিঠি আসেনি। সব চিঠির উত্তর পরক্ষণেই এসে পড়ত। হয়তো সংগ্রামী সংগীতশিল্পী যা খুঁজছিল তা পেয়ে গেছে।

‘আচ্ছা, এখন দরজা খুলে দেই।’

‘দাঁড়াও,’ কোহেই তার জিন্স ধরে আটকালো, ‘আর কয়েক মিনিট।

‘কেন?’

কোহেই নার্ভাসভাবে বলল, ‘পেছনের দরজাটা কিছুক্ষণ এভাবেই থাকুক।’

‘কেন? সংগ্ৰামী সংগীতশিল্পী আর চিঠি দেবে না।’

‘হ্যাঁ, আমি জানি।’

‘তাহলে কীসের অপেক্ষা করছো?’

‘ইয়ে, মানে অন্য কেউ যদি চিঠি দেয় সেজন্যে।

‘কী?’ আতসুয়া গর্জে উঠল, ‘পাগল হয়ে গেছ? দরজাটা এভাবেই রেখে দিলে আমরা কখনও এখান থেকে বের হতে পারব না। সময় এখানেই থেমে থাকবে। বুঝেছো?

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি।’

‘তাই নাকি? বুঝলে এমন বোকার মতো কথা বলতে না। যথেষ্ট করেছি। আর না। আমরা কোনো পরামর্শদাতা নই।’

আতসুয়া জিন্স থেকে কোহেইর হাত ছাড়িয়ে উঠে পেছনের দিকে চলে গেল।

ভোর চারটা বেজে গেছে। আর দুঘণ্টা পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ছ’টা থেকেই ট্রেন চলে।

আতসুয়া ভেতরে ফিরে এলো। কোহেইকে হতাশ দেখাচ্ছে। আর সোতা তার ফোন দিয়ে খেলছে।

আতসুয়া কিচেন টেবিলে বসল। মোমবাতির আলো নড়ছে। মনে হয় বাইরে থেকে বাতাস আসছে এখানে।

কী অদ্ভুত বাসা, ভাবল সে। নোংরা দেওয়ালে তাকাল। এসব অতিপ্রাকৃত ছাইপাশ এখানে হচ্ছে কী করে? আর আমরাই বা এখানে কেন ফাঁসলাম?

‘কেন যেন মনে হচ্ছে,’ কোহেই বিড়বিড় করল, ‘আজ রাতে, জীবনে এই প্রথম অন্য কারও জীবনে একটা প্রভাব ফেলতে পেরেছি। আমার মতো একটা গর্দভ কারও জীবনে প্রভাবও ফেলতে পারে।’

আতসুয়া খেঁকিয়ে উঠল, ‘একারণেই পরামর্শ দিয়ে যেতে চাইছিলে? তাতে কোনো অর্থোপার্জন নেই।’

‘আমি অর্থ লাভের কথা বলছি না। এই প্রথম অন্য কারও পরিস্থিতি বোঝার সুযোগ হয়েছে। হয়তো সাহায্যও করতে পেরেছি।’

‘আর তাতে আমাদের কী লাভ হলো? কেউ তো আমাদের কাছে সাহায্য চায়নি। মিস অলিম্পিক আমাদের চিঠিকে নিজের মতো করেই বুঝে নিয়েছে। সংগ্রামী সংগীতশিল্পী জানে না তার এখন কী করা উচিত। আমি তো কখন থেকে বলেই আসছি। আমরা হতভাগা। আমরা কাউকে পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা রাখি না।’

‘কিন্তু মুন র‍্যাবিটের শেষ চিঠি দেখে তুমি হেসেছিলে।’

‘আমার তখন রাগ ছিল না। কিন্তু এটাও আমার কথারই আরও একটা প্রমাণ। আমাদের মতামত দেওয়ার অধিকার নেই। আমরা—’ কোনায় পড়ে থাকা একটা ব্যাগের দিকে ইশারা করে আতসুয়া বলল, ‘আমরা কেবল হতচ্ছাড়া চোর।’

কোহেইকে দেখে মনে হলো সে কষ্ট পেয়েছে। আতসুয়া তাকে দেখে দমে গেল।

তখনই সোতা চেঁচিয়ে উঠল, ‘একি!’

চেয়ার থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল আতসুয়া, ‘আবার কী হলো?’

‘এক মিনিট,’ সোতা ফোন তুলে ধরল, ‘এখানে নামিয়া জেনারেল স্টোরের কথা লেখা।’

‘ইন্টারনেটে? কেউ নিশ্চয়ই স্মৃতি রোমান্থন করছে।’

‘ইন্টারনেটে যখন খুঁজছিলাম তখন আমিও এটাই ভেবেছি। কেউ না কেউ হয়তো কিছু লিখে থাকবে।’

‘পরে কী পেলে? স্মৃতি রোমান্থন?’

‘না, নিজেই দেখো।’ সোতা নিজের ফোনটা এগিয়ে দিলো। সেটার শিরোনাম ‘নামিয়া জেনারেল স্টোর ওয়ান নাইট স্পেশাল।’ পুরোটা পড়ে আতসুয়ার যেন রক্ত গরম হয়ে উঠল।

.

যারা কখনও নামিয়া জেনারেল স্টোর থেকে পরামর্শের আবেদন করেছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে,

সেপ্টেম্বর ১৩ তারিখে, মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নামিয়া জেনারেল স্টোরের পরামর্শ বাক্স কেবল এক রাতের জন্য খোলা থাকবে। আমরা চাই যারা কখনও এই স্টোর থেকে উপদেশ পেয়েছেন, তারা যেন সেই সময়ে তাদের অশোধিত মতামত আমাদেরকে জানান। পরামর্শটা আপনার জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? কাজে দিয়েছে কি দেয়নি? দয়া করে আপনাদের চিঠিগুলো আগের মতো মেইল স্লটে রেখে যাবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকব।

.

‘এটা কী?’

‘জানি না। কিন্তু এখানে বলছে সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে বুড়ো লোকটার তেত্রিশতম মেমোরিয়াল সার্ভিস। তার পরিবারের কোনো সদস্য এটা পরিচালনা করছে।’

কোহেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো, ‘দেখি তো?’

সোতা তাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘এই আতসুয়া, আজকে কত তারিখ, জানো?’

আতসুয়া এই মাত্র উপলব্ধি করতে পারল। সেপ্টেম্বর ১৩ তারিখে, মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত—তারা ঠিক সেই সময়টাতেই আছে।

‘তার মানে তারা আবার পরামর্শ দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে?’ কোহেই চোখ পিট পিট করে বলল।

‘একারণেই হয়তো এসব অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে। আজ সেই বিশেষ দিন। বর্তমান আর অতীতের মাঝে সংযোগ ঘটছে।’

আতসুয়া মাথা চুলকালো। এসব তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সোতার কথায় যুক্তি আছে।

পেছনের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল সেটা হাঁ করে খোলা।

‘দরজা খোলা থাকলে অতীতের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,’ সোতা বলল। ‘দিন শুরু হতে আর কিছু সময় আছে। আমরা এখন কী করব আতসুয়া?’

‘আমরা কী—?’

‘আমরা নিশ্চয়ই একটা ঝামেলা বাধাচ্ছি। দরজাটা হয়তো সারারাতই বন্ধ থাকার কথা।’ কোহেই উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

‘কী করছো? খুলে দাও ওটা।’

কোহেই মাথা নাড়ল, ‘এটা বন্ধই থাকবে।’

‘কেন? এটা বন্ধ থাকলে সময় থেমে যাবে। তুমি আজীবন এখানে আটকে থাকতে চাও?’ আতসুয়ার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। দরজাটা বন্ধ থাকবে। আমরা বের হয়ে বন্ধ করে দেবো। তাতে সব ঠিক থাকবে। তাই না?’

কিন্তু বাকি দুজন ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

‘আহা, কিছু তো বলো!’

অবশেষে সোতা বলল, ‘আমি থাকব। তুমি চলে যেতে পারো আতসুয়া। বাইরে গিয়ে নাহয় অপেক্ষা করো।’

‘আমি থাকছি,’ কোহেই তাল মেলালো।

‘থেকে করবে-টা কী?

‘সেটা ব্যাপার না।’ সোতা বলল, ‘কেবল দেখব এরপর কী হয়। পুরোটা দেখে যেতে চাই আমি।’

‘এখানে কী হচ্ছে বুঝতে পারছ? এক ঘণ্টা পরই সূর্য উঠবে। বাইরের এক ঘণ্টা মানে এখানে কয়েক দিন। না খেয়ে এত সময় কাটাতে পারবে? আমার মনে হয় না।’

সোতা চোখ সরিয়ে নিলো। হয়তো আতসুয়া ঠিকই বলছে।

‘বাদ দাও,’ বলল আতসুয়া। সোতা আতসুয়ার উত্তর দিলো না।

একটু পরেই শাটারের শব্দ এলো। সোতা আতসুয়া চমকে উঠে একে অপরের দিকে তাকায়।

কোহেই সেদিকে তড়িঘড়ি করে যেতে শুরু করে। ‘মনে হয় বাতাস,’ আতসুয়া পেছন থেকে চিৎকার করে।

একটু পরেই কোহেই খালি হাতে ফেরে।

‘দেখেছো, বলেছিলাম বাতাসের শব্দ।’

কোহেই কাছাকাছি এসে লাফিয়ে উঠল, ‘টা-ডা!’ তার হাতে একটা সাদা খাম। নিশ্চয়ই পেছনের পকেটে রেখেছিল।

আতসুয়া এখন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।

‘হয়তো এটাই শেষ চিঠি আতসুয়া,’ সোতা বলল। ‘এটার উত্তর দিয়েই আমরা বের হয়ে যাবো।’

আতসুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলে বসে পড়ল। ‘পড়ে দেখি।’

কোহেই সাবধানে সিল খুলতে লেগে যায়!

হাই, মিস্টার নামিয়া,

আমি আপনার কাছে একটা পরামর্শ চেয়ে চিঠিটা লিখছি।

আমি এই বছরে একটা ভোকেশনাল হাইস্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। এপ্রিলে টোকিওতে একটা কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছি। কিছু সমস্যার জন্য বাড়ি যেতে পারিনি। আসলে পারিবারিক কিছু সমস্যার জন্য আমি দ্রুত কর্মজীবন শুরু করতে চাই।

কিন্তু কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমার মনে সংশয়। এটা কি আসলেই ঠিক সিদ্ধান্ত? এই কোম্পানি হাইস্কুল থেকে পাশ করা মেয়েদেরকে কেবল টুকিটাকি কাজ করার জন্য চাকরিতে নেয়। এখানে আমি কেবল চা বানাই, কফি তৈরি করি আর পুরুষদের হাতে লেখা ড্রাফটগুলো সুন্দর করে রিরাইট করে দেই। এসব যে কেউই করতে পারে। মিডেল স্কুল বা এলিমেন্টারি স্কুলের বাচ্চারাও এসব করতে পারবে। আমি এই কাজ থেকে কোনো সন্তুষ্টি পাচ্ছি না। আমার কাছে একটা ক্লাস টু বুককিপিং লাইসেন্স আছে, কিন্তু আমি আমার দক্ষতা কাজে লাগাতে পারছি না।

এই কোম্পানির মনোভাব এমন, এখানে মেয়েরা কেবল উপযুক্ত স্বামীর খোঁজে আসে। একবার যোগ্য কাউকে পেয়ে গেলে বিয়ে করে চাকরি ছেড়ে দেয়। একারণে এরা মেয়েদের অ্যাকাডেমিক তথ্যের ওপরেও তেমন গুরুত্ব দেয় না। বলা যায় এখানে চাকরির মান খুবই খারাপ। কেবল মেয়ে প্রদর্শন, যেন পুরুষরা মনমতো স্ত্রী বেছে নিতে পারে। আর মেয়েদেরকে খুবই সামান্য বেতন দিতে হয়।

আমি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারী হতে চেয়েছিলাম। কারও ওপরে এভাবে বোঝা হয়ে থাকার ইচ্ছা আমার মোটেও নেই।

কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু একদিন একজন আমাকে তার বারে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। শিনজুকুর একটা ক্লাব। লোকটা রাতের কাস্টমারদের মনোরঞ্জনের জন্য লোক খুঁজছিল।

তার কথায় যা বুঝতে পারলাম, শর্তগুলো খুবই ভালো। আমার বর্তমান চাকরির চেয়ে বেজায় ভালো। এতটাই ভালো যে আমার সন্দেহ লাগে।

সে আমাকে আগে সেখানে গিয়ে দেখতে বলে। ভাবলাম গিয়ে দেখি কেমন জায়গা। তবে সেখানে গিয়ে হতবাক হতে হলো।

ভেবেছিলাম সেখানের পরিবেশ ভালো হবে না। কিন্তু দেখলাম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য চমৎকার একটা অভিজাত জায়গা। অনেক মেয়ে সেখানে কাজ করছিল। কেবল সেজেগুঁজে বসে থাকার কাজ না, কৌশল বুঝে, দল গঠন করে করা কাজ। তাদের দক্ষতা কাজে লাগাচ্ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম না আমি এসব পারব কিনা কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কী।

তখন থেকে আমি দিনে কোম্পানিতে আর রাতে ক্লাবে কাজ করা শুরু করি।

দিনের কাজ শেষ করেই রাতের কাজের জন্য বের হতে হতো। আমার বয়স তখন উনিশ কিন্তু আমি বলেছিলাম বিশ। দুটো কাজ সামলানো খুব ক্লান্তিকর আর ক্লাবের কাস্টমার সামলানোটা সহজ কাজ না। কিন্তু তাও আমি অর্থনৈতিকভাবে শক্ত হতে পেরেছিলাম বলে ভালো লাগছিল।

কিন্তু দুমাস পর দ্বিধায় পড়ে যাই। ক্লাবের কাজ নিয়ে না, কোম্পানির কাজ নিয়ে। সেখানে থাকার আর কোনো কারণ দেখতে পাই না। সেখানে ভালো কাজের কোনো সুযোগ নেই আর এত কষ্ট করে থাকার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া সেটা বাদ দিয়ে ক্লাবের কাজে পুরোপুরি লেগে গেলে আমি আরও বেশি টাকা কামাতে পারব।

আমি ক্লাবে কাজ করছি সেটা কাউকে এখনও বলিনি। আর কোম্পানির চাকরি হুট করে ছেড়ে দিতে গেলে সেখানে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি অবশেষে সন্তোষজনক কাজ পেয়ে গেছি। আপনি যদি আমার নিজের অবস্থানটা বুঝতে আর কোম্পানির চাকরিটা কীভাবে ভালো উপায়ে ছাড়া যায় তা নিয়ে আমাকে পরামর্শ দেন তাহলে আমি কৃতজ্ঞ হবো।

সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।

—ডুবিয়াস ডগি

.

আতসুয়া খেঁকিয়ে উঠল, ‘ধুর, শেষ চিঠিটা এমন হলো!’

‘সে বুঝে যাবে,’ সোতা বলল, ‘এরকম কাজকে খুব চমৎকার ভেবে অনেক মেয়েই সেদিকে পা বাড়ায়।’

‘মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী,’ কোহেই বলল, ‘রাস্তায় দেখেই তাকে কেউ কাজের প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছে। আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে কেবল দুমাস লেগেছে তার।’

‘মনে হচ্ছে তার একটা নতুন প্রেমিকের উদয় হচ্ছে। এই সোতা, এটার উত্তর লেখো তো।’

‘কী লিখব?’ সোতা কলম নিয়ে প্রস্তুত হলো।

‘এমন গর্দভের জন্য কড়া কথাই শ্রেয়। নাহলে বুঝবে না।’

‘কী বলছো তা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু একটু নরমভাবে বলি, ঠিক আছে। বেশি কড়াভাবে বললে রেগে যাবে। তুমিও তো এমনই করো।’

সোতা যা লিখলো তা হলো:

প্রিয় ডুবিয়াস ডগি,

চিঠির জন্য ধন্যবাদ।

সোজাসাপটাভাবে বলি। ক্লাব ছেড়ে দিন, সেটা জীবন গড়ার জায়গা না।

হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি ওখানের বেতন আপনি যেখানে কাজ করেন সেই কোম্পানির চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় আর সহজ। আপনি একটা আয়েশের জীবনে প্রবেশ করেছেন এবং স্বভাবতই সেখানে থাকতে চাইবেন।

কিন্তু সেটা সহজ হবে না। আপনি এখনও খুব কমবয়সি। দুমাস খুব ভালো কেটেছে কিন্তু সেটা আজীবনের কষ্টের তুলনায় কিছুই না। আপনার অনেক পুরুষ কাস্টমার আসবে আর তারা প্রায় সবাই আপনার দিকে এগুতে চাইবে। আপনি তাদের সবাইকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন? নাকি তারা যা চায় তা দিয়ে দিতে বাধ্য হবেন? নিজের শরীরকে এভাবে বিলিয়ে দেওয়া ঠিক না।

আপনি কতদিন পর্যন্ত সেখানে থাকতে চান? কত বছর বয়স পর্যন্ত? আপনি স্বাধীন নারী হতে চান, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট বয়স পরে কেউ আর আপনাকে সেখানে চাকরি দেবে না।

এরপর কী হবে? নিজের ক্লাব খোলার চিন্তা করছেন? তেমনটা হলে শুভকামনা। কিন্তু সেই ব্যাবসা খুব সহজ হবে বলে আশা করবেন না।

আপনি কি কখনও বিয়ে করে নিজের পরিবার শুরু করতে চান না? যদি চান তাহলে আমার কথা শুনুন এবং আগেভাগেই এই চাকরি ছেড়ে দিন।

এখানে চাকরি করতে থাকলে কাকে বিয়ে করবেন? কোনো কাস্টমারকে? তাদের মধ্যে কজন অবিবাহিত আছে?

বাবা-মায়ের কথা ভুলে যাবেন না। আমার মনে হয় না তারা এই লাইনের কাজের জন্য আপনাকে কষ্ট করে লালন-পালন করে স্কুলে পাঠিয়েছিল।

কর্মচারী হওয়া খারাপ কী? আপনি একটা কোম্পানির অংশ। তেমন কিছু না করেই বেতন পাচ্ছেন। রুমে ঢুকলেই কেউ আপনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে না। আর সেখানের কাউকে বিয়ে করে নিলে আপনাকে আর কখনও কাজই করতে হবে না।

এতে খারাপ কী?

মিস ডুবিয়াস ডগি, এমন অনেক ছেলে পড়ে আছে যারা হাজার খুঁজেও কোনো চাকরি পায় না। তারা সদ্য হাইস্কুল পাশ করা একটা মেয়ের বেতনের অর্ধেক বেতন পাবার জন্যেও হাসিমুখে চা বানাতে প্রস্তুত।

আমি এসব লিখে আপনার মনঃক্ষুণ্ণ করতে চাই না। আপনার ভালোর জন্যেই বলছি। আমার কথা শুনুন। আপনার ভালো হবে।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

‘ভালোভাবেই লিখেছো। এভাবেই বলা উচিত,’ আতসুয়া চিঠি দেখে সম্মতি দিলো। এই চিঠি সে লিখলে না যেন কত কথা শোনাতো মেয়েটাকে।

বাবা-মা মেয়েটাকে পড়াশোনা করিয়েছে যেন সে ভবিষ্যতে একটা ভদ্র চাকরি

করতে পারে। আর সে? ক্লাবে কাজ করছে। ভাবছে-টা কী?

সোতা মিল্ক ক্রেটে চিঠিটা রাখার একটু পরেই স্লটে উত্তর চলে এলো।

.

নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,

আপনার উত্তরের জন্য ধন্যবাদ। আমি চিন্তায় ছিলাম উত্তর আদৌ পাবো কিনা। আপনার চিঠি পড়ে মনে হলো আমি কিছু ভুল করেছি। হয়তো কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আপনাকে আমার পরিস্থিতির আরও পরিষ্কার বিবরণ দেওয়া উচিত ছিল।

আমি বিলাসিতার জীবন পাবার জন্য ক্লাবের কাজে যোগ দিতে চাইছি না। আমি কেবল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাই। যার মানে নিজের জীবিকা নিজে উপার্জন করতে চাই, অন্য কারও ওপর ভরসা করে না। কোম্পানিতে থাকলে মনে হয় না আমি কখনও সেটা করতে পারব।

দ্বিতীয়ত, আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা নেই। সংসার করা, বাচ্চা নেওয়া হয়তো খুব চমৎকার একটা ব্যাপার, কিন্তু সেই জীবন আমার জন্য না।

আর আমার ধারণা এই ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে যে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে তা জানি। আমি আমার সহকর্মীদের দেখে সেই ধারণা পেয়ে গেছি। আমি সেসবের জন্য প্রস্তুত। আর হ্যাঁ, আমি কোনো একদিন নিজের ক্লাব খোলারও আশা রাখি।

আমার নিজের ওপর ভরসা আছে। আমার ইতোমধ্যে কিছু আন্তরিক কাস্টমার আছে যারা আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু তাদেরকে আমি পুরো সময়টা দিতে পারি না। এটাও কোম্পানি ছাড়ার আরেকটি কারণ।

যাই হোক, আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার করি। এখানে আসা পুরুষদের সাথে আমি বিছানায় যাই, এই ভাবনাটা হয়তো আপনার ভালো লাগছে না। আমি কখনই যাইনি। এমন না যে প্রস্তাব পাইনি, কিন্তু আমি জানি এদেরকে কীভাবে সামলাতে হয়। আমি প্রাপ্তবয়স্ক।

আমার আইনত অভিভাবক হয়তো এসব শুনে চিন্তিত হবে। কিন্তু আমি এটা তাদের জন্যই করছি, যেন তাদের উপকার ফিরিয়ে দিতে পারি।

আমাকে কি এখনও খুব হাবাগোবা বলে মনে হচ্ছে?

— ডুবিয়াস ডগি

বি.দ্র. আমি পরামর্শ চাচ্ছিলাম যে কীভাবে আমার পরিবার এবং বন্ধুদের কাছে আমার কাজটা ব্যক্ত করব। এই ইন্ডাস্ট্রি ছাড়ার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। আপনার কাছে যদি আমার জীবনধারা ভালো না লাগে তবে আপনি চিঠি উপেক্ষা করে যেতে পারেন।

.

‘উপেক্ষাই করে যাই,’ আতসুয়া বলল, ‘যত্তসব। নিজের ওপর বিশ্বাস আছে। বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত হতে বলো একে।’

কোহেই ধীরে ধীরে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছো।’

‘দাঁড়াও,’ সোতা বলল, ‘মেয়েটা খুব একটা ভুল বলছে না। একটা মেয়ে যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে চায় তবে ক্লাবে কাজ করাই সবচেয়ে সহজ আর দ্রুত পদ্ধতি। টাকাই সব আসলে। টাকা ছাড়া জগৎ চলে না।’

‘সেটা আমাকে বলতে হবে না,’ আতসুয়া বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছো। কিন্তু মেয়েটা যেভাবে চায় সেভাবে সব হবে না।’

‘সেটা তুমি কীভাবে বলতে পারো?’

‘কারণ বেশিরভাগ সময়েই হয় না। হ্যাঁ মেয়েটা এখন খুব ভালো অবস্থানে আছে এবং নিজের ক্লাবও খুলে ফেলতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্লাবই খোলার ছয় মাসের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। একটা ব্যাবসা সহজ ব্যাপার না। গতি ধরতে বেগ পেতে হয়, টাকা লাগে। কিন্তু টাকাই সব না। চিঠিতে বলে ফেলা খুব সহজ কিন্তু বাস্তব খুব কঠিন। এখন কিছুই টের পাচ্ছে না। গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু যখন টনক নড়বে তখন খুব দেরি হয়ে যাবে। বিয়ের সময় পেরিয়ে যাবে আর বয়স হয়ে যাবে। তখন আফসোস করেও লাভ হবে না।’

‘হ্যাঁ কিন্তু সে মাত্র উনিশ বছর বয়সি। এখনই এসব ভাবার সময় না।’

‘এখনই সময়। কারণ সে যুবতী। চিঠি লিখে বলো এসব ছাইপাশ মাথা থেকে বের করতে। ক্লাবের চাকরি ছেড়ে ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলতে বলো।’

সোতা কিছুক্ষণ খাতা-কলমের দিকে তাকিয়ে রইল, ‘না, আমি তাকে উৎসাহ দিতে চাই। মেয়েটা পরামর্শ চেয়েছে, ভর্ৎসনা না।’

‘সে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখছে।’

‘আমার মনে হয় সে যথেষ্ট বাস্তববাদী।’

‘তাই নাকি? চলো তাহলে একটা বাজি ধরি। সে সফল উদ্যোক্তা হবে কিনা তা নিয়ে। আমি বাজি ধরে বলছি, ক্লাবে কাজ করে একসময় কোনো বাজে পুরুষের পাল্লায় পড়ে যাবে আর শেষমেশ একাকী মা হয়ে বেদনাদায়ক জীবনযাপন করবে।’

সোতা ঢোক গিলল। মাথাটা ভারী লাগছে তার।

ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। এমনকি আতসুয়াও মেঝের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে।

‘আচ্ছা,’ কোহেই বলল, ‘তাকে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়?’

‘কী জিজ্ঞাসা করব?’ আতসুয়া উত্তর দিলো।

‘সব কিছু বিস্তারিত বলতে বলব। আমার মনে হয় না তোমরা কেউই ভুল বলছো। চলো তাকে আগে জিজ্ঞাসা করে দেখি সে এসব কতটুকু গুরুত্বের সাথে দেখছে।’

‘সে নিশ্চয়ই বলবে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখছে।’

‘বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করি। যেমন সে কেন স্বাধীন হতে চাচ্ছে বা বিয়ে নিয়ে মনে এত বিদ্বেষ কেন—এসব। ওহ্, আর ব্যাবসা নিয়ে তার কোনো প্ল্যান নির্দিষ্ট আছে কিনা তাও জিজ্ঞাসা করব। আতসুয়া ঠিকই বলেছে, এসব সহজ না। সে যদি সঠিকভাবে উত্তর দিতে না পারে তাহলে আমি মেনে নেব যে সে আকাশ-কুসুম স্বপ্নই দেখছে। আর ক্লাবের চাকরি তার ছেড়ে দেওয়া উচিত। ঠিক আছে?’

আতসুয়া রাজি হয়ে গেল। ‘এতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না, কিন্তু তবুও চেষ্টা করে দেখা যায়।’

‘আচ্ছা, লিখছি তবে।’ সোতা কাগজ-কলম তুলে নিলো!

প্রতিটা বাক্য লেখার আগে চিন্তা করে চিঠিটা লিখতে লাগল। আতসুয়া এসব দেখতে দেখতে নিজের বলা কথাটাই মনে করতে লাগল: ক্লাবে কাজ করে একসময় কোনো বাজে পুরুষের পাল্লায় পড়ে যাবে আর শেষমেশ একাকী মা হয়ে বেদনাদায়ক জীবনযাপন করবে। ঠিক যেমন তার মায়ের সাথে হয়েছিল। সোতা আর কোহেই এবার একারণেই বেশিরভাগ সময়ে চুপ ছিল, ব্যাপারটা ব্যক্তিগত।

আতসুয়ার মা যখন বাইশ বছর তখন আতসুয়ার জন্ম হয়। তার বাবা ছিল একই ক্লাবের এক তরুণ বারটেন্ডার। আতসুয়ার জন্মের কিছুদিন আগেই সে কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যায়।

বাচ্চা নিয়েই বারে কাজ চালিয়ে যায় আতসুয়ার মা। তার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।

অনেক ছোটোবেলায় তাদের সাথে একটা লোক থাকত। কিন্তু আতসুয়া তাকে কখনও বাবা হিসেবে দেখেনি। একসময় সেও চলে যায়। এর কিছুদিন পরই আরও একটা লোক থাকতে আসে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে। মা তাকে টাকা দিতো। লোকটার নাকি কোনো চাকরি ছিল না। সেও থাকে না। এরপর আরও একজন। এভাবে চলতেই থাকে। একসময় সবচেয়ে বাজে লোকটার আগমন ঘটে।

এই লোক আতসুয়াকে বিনা কারণে মারধোর করত। একবার লোকটা আতসুয়ার চেহারায় ঘুসি মেরে বসে। তার কাছে নাকি আতসুয়ার চেহারা ভালো লাগত না। এসব ফার্স্ট গ্রেডের কথা। তার মা কখনও কিছু বলত না। তার ধারণা ছিল এসব আতসুয়ারই দোষ।

আতসুয়ার শরীরে সবসময়ে কোনো না কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকত। কিন্তু আতসুয়া চেষ্টা করত ঢেকে রাখার। স্কুলে কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে। তাতে

করে বাসায় তার ওপর অত্যাচার আরও বেড়ে যাবে।

সেই লোকটাকে জুয়ার কারণে গ্রেফতার করা হয়। আতসুয়া তখন দ্বিতীয় গ্রেডে। গোয়েন্দারা যখন বাসায় এলো তখন আতসুয়া একটা ট্যাংক টপ পরে ছিল। তারা সেসব দেখে ফেলে আর মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মায়ের বাহানাগুলো এতই দুর্বল ছিল যে তাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলে গোয়েন্দারা।

জুভেনাইল অ্যাফেয়ার্স থেকে একজন কেস এজেন্ট পাঠানো হয়।

এজেন্ট এসে আতসুয়াকে নানা প্রশ্ন করে। কিন্তু এসবের মাঝে তার মা বারবার চাপাচাপি করছিল যে সে নিজেই আতসুয়াকে মানুষ করতে পারবে। আতসুয়া এর কারণ বুঝতে পারেনি। সে তো মাকে ফোনে বলতে শুনেছে, তার বাচ্চা সামলাতে খুব বিরক্ত লাগে। এই বাচ্চা না জন্মালেই সে বেশি খুশি হতো।

এজেন্ট চলে যায়। এখন কেবল মা আর আতসুয়া। আর মার খেতে হবে না বাসায়, সে ভেবেছিল। কিন্তু, বাসায় সে প্রায় একাই হয়ে পড়ল। তার মা প্রায়ই রাতে বাসায় আসত না। কেবল তাই নয়, আতসুয়াকে খাবার বা টাকা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করত না। একসময় এলো যখন একমাত্র স্কুলের লাঞ্চই হলো তার একমাত্র খাদ্যের উৎস। আতসুয়া এসব কাউকে বলেনি। করুণা চায় না তার।

শীতের মৌসুম এসে পড়ল। ক্রিসমাসও একা কাটালো আতসুয়া। শীতের ছুটিতে স্কুলও বন্ধ। তার মা দুসপ্তাহ ধরে বাসায় আসেনি। ফ্রিজে কোনো খাবার নেই।

২৮ ডিসেম্বরে আতসুয়া একটা রাস্তার দোকান থেকে চিকেন স্কিউয়ার চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে যায়। সারা শীতে সে কী খেয়ে বেঁচেছে তা তার মনে ছিল না। স্কিউয়ার চুরি করার স্মৃতিও মনে নেই তার। হাতেনাতে ধরা পড়ে। পালিয়ে যাবার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অ্যানেমিক শক

তিন মাস পরে আতসুয়া মারুমিতসুয়েনে চলে আসে।

প্রিয় ডুবিয়াস ডগি,

দ্বিতীয় চিঠির জন্য ধন্যবাদ।

আমার কাছে এটা এখন পরিষ্কার যে আপনি কেবল বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য ক্লাবে কাজ করতে চান না।

নিজের ব্যাবসা শুরু করার উচ্চাকাঙ্ক্ষাও প্ৰশংসনীয়।

তবুও দুমাস খুব ভালো কাটিয়ে আপনি চাকচিক্য আর সহজ টাকার প্রতি প্রমত্ত হয়ে যাচ্ছেন না সেটা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না।

ব্যাবসা শুরু করার টাকা কীভাবে জোগাড় করবেন তা ভেবেছেন? সময়কাল নির্দিষ্ট করেছেন? আর সেখান থেকে কীভাবে এগুবেন? ক্লাব চালাবার জন্য অনেক লোকের দরকার পড়বে। এসব পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা কোথায় পাবেন? ক্লাবে কাজ করেই কি সেসব বুঝে যেতে পারবেন?

আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি ব্যাবসায় সফল হবেন? যদি হয়ে থাকেন তবে এই নিশ্চয়তা কোথা থেকে পাচ্ছেন?

অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে চান সেটা খুবই প্রশংসনীয়। তবে স্বচ্ছল কাউকে বিয়ে করে নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা অর্জন করাটাও কি প্রশংসনীয় নয়? একটা মেয়ের যদি চাকরি নাও থাকে তবুও তার স্বামীকে যথাযথ সহায়তা করলে সেটা মেয়েটাকে একটা স্বাধীন পদমর্যাদা দেয়।

আপনি বলেছেন আপনার অভিভাবককে উপকার ফিরিয়ে দিতে চান। কিন্তু কেবল টাকা দিয়ে তাদের উপকার ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। আপনি নিজে সুখী হলেই তারা খুশি হবে। খুঁটি গাড়ুন, পরিবার শুরু করুন। তাহলেই আপনার বাবা- মা সন্তুষ্ট হবে।

আপনি বলেছেন আপনার জীবনধারা আমার পছন্দ না হলে যেন আমি এই চিঠি এড়িয়ে যাই। কিন্তু আপনার পরিস্থিতিটা এড়িয়ে যেতে পারলাম না। উত্তর দিতেই হলো। আপনার সৎ উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

‘ভালো হয়েছে।’ আতসুয়া রাজি হলো। সোতাকে চিঠিটা ফিরিয়ে দিলো সে।

‘দেখা যাক এখন সে কী বলে। পোক্ত কোনো প্ল্যান আছে কিনা।’

‘মনে হয় না।’

‘কেন না? সম্ভাবনা এভাবে উড়িয়ে দিতে পারো না তুমি।’

‘প্ল্যান যদি থেকেও থাকে, ফালতু কিছুই হবে দেখো। যেমন কোনো খ্যাতিমান ব্যক্তিকে বা বেসবল প্লেয়ারকে সুগার ড্যাডি বানানো—এরকম।’

‘সেটা কাজে দিতে পারে,’ কোহেই পইপই করে বলে উঠল।

‘চুপ থাকো গর্দভ। এমন কিছুই হবে না।’

‘যাই হোক, আমি আসছি।’ সোতা চিঠিটা খামে ভরে বাইরে চলে গেল। আতসুয়া আর কোহেই শব্দ পাচ্ছে, মিল্ক বিন খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। আজ এই এক

রাতে এই শব্দটা কতবার শুনলো তারা?

সোতা ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিতেই শাটারে শব্দ হলো, ‘আমি নিয়ে আসছি।’ কোহেই উঠে সেদিকে চলে গেল।

আতসুয়া আর সোতা একে-অপরের দিকে তাকালো।

‘এখন কী হবে?’ আতসুয়া জিজ্ঞাসা করল।

সোতা কেবল বলল, ‘জানি না।’

কোহেই আরও একটা খাম এনেছে, ‘আমি আগে পড়ি?’

‘আচ্ছা।’

কোহেই চিঠি পড়তে শুরু করলে তাকে দেখে মনে হলো অবাক হচ্ছে। এরপর তার অভিব্যক্তি বদলে আশঙ্কায় রূপ নিলো। নখ কামড়তে শুরু করেছে। আতসুয়া আর সোতা জানে কোহেই ভয় পেয়ে গেলে প্রায়ই এমন করে।

এবার আগের চেয়ে বড়ো চিঠি এসেছে। কোহেইর পড়া শেষ হলে আতসুয়া চিঠিটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিলো তার কাছ থেকে।

নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,

আপনার দ্বিতীয় চিঠিটা পড়েও সেই একইরকম অসঙ্গতি বোধ হলো আমার।

সত্যি বলতে আপনার ‘চাকচিক্য আর সহজ টাকার প্রতি প্রমত্ত হয়ে যাওয়া’ কথাটা খুব অপমানজনক লেগেছে আমার। কেবল মজার জন্য কেউ এই চাকরি করে নাকি?

কিন্তু মাথা ঠান্ডা হলে আপনার কথার আসল মর্ম বুঝতে পারলাম। উনিশ বছর বয়সি এক মেয়ে নিজের ব্যাবসা শুরু করবে এটা নিয়ে আপনার মনে সংশয় জাগাটাই স্বাভাবিক।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোনোকিছু আর লুকাবো না।

শুরুতে যা বলেছিলাম, আমি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে চাই। আমি কেবল স্বচ্ছল জীবনের কথা বলছি না। অনেক বেশি টাকা অর্জনের কথা বলছিলাম। কিন্তু এসব নিজের জন্য না।

আসলে, আমি খুব ছোটোবেলায় আমার বাবা-মাকে হারাই আর এলিমেন্টারি স্কুলের ছয় বছর মারুমিতসুয়েন নামে এক অনাথাশ্রমে কাটাই।

কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো ছিল। এলিমেন্টারি স্কুল শেষ করার পরই আমাকে আমার এক আত্মীয় পালক নিয়ে নেয়। তাদের কারণেই আমি হাইস্কুল শেষ করতে পেরেছি। অনাথাশ্রমে এমন অনেক বাচ্চা ছিল যাদেরকে তাদের বাবা-মা অত্যাচার করত। অনেকে ছিল যাদের পালক বাবা-মা অনাহারে রাখত। এমন দুর্ভাগ্য দেখে আমি বুঝতে পারি আমি আসলে কতটা ভালো আছি।

একারণেই আমি আমার অভিভাবকের জন্য কিছু করতে চাই। সময় চলে যাচ্ছে। তারা বয়স্ক। এবং যেহেতু তাদের আর কাজ করার সামর্থ্য নেই, তাই তাদেরকে তাদের সামান্য সেভিং দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। আমি ছাড়া তাদের সাহায্য করার মতো আর কেউ নেই। কেবল চা বানিয়ে বা কফি তৈরি করে আমি তাদের সাহায্য করতে পারব না।

আর নিজের ক্লাব শুরু করার একটা ভালো বুদ্ধি আছে আমার কাছে। টাকা জমাবো এবং পাশাপাশি আমার একজন পরামর্শদাতা আছে যে আমাকে সাহায্য করবে। সে আমাদের একজন কাস্টমার কিন্তু তার ফুড ইন্ডাস্ট্রিও আছে। এবং সে নিজের অবস্থানে সফল। সে আমাকে গোড়া থেকে সাহায্য করবে।

আপনি হয়তো ভাবছেন আমি এই কাস্টমারের ওপর কীভাবে এতটা ভরসা করতে পারি।

আসলে, ছেলেটা আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি রাজি হলে সে আমাকে মাসিক খরচ দেবে, হাতখরচের কথা বলছি না। সে খারাপ লোক না। এবং আমি তাকে অপছন্দও করি না।

আশা করি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর এখানে আছে। সবকিছুই পরিষ্কার করে তুলে ধরলাম। আপনি হয়তো ভাববেন আমি কল্পনার রাজ্যে বাস করছি। যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে দয়া করে আমাকে আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন। আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব।

-ডুবিয়াস ডগি

‘আমি স্টেশনের পাশের দোকানগুলোর দিকে যাচ্ছি,’ হারুমি হিদেওকে বলল। হিদেও হারুমির বড়ো খালা। হারুমির দিকে পিঠ দিয়ে চুলায় কাজ করছিল সে। বাতাসে বনিটো ফ্লেকসের গন্ধ।

‘আচ্ছা,’ হিদেও না ঘুরেই বিদায় জানালো। একটা ডিশে ব্রথ দিতে ব্যস্ত সে।

হারুমি বেরিয়ে গেটের সামনে রাখা বাইসাইকেলে উঠে বসল। সহজভাবে প্যাডেল করতে লাগল। এই গ্রীষ্মে তৃতীয়বারের মতো এত সকালে বের হচ্ছে সে। হিদেও হয়তো ব্যাপারটা লক্ষ করেছে, কিন্তু সে হারুমিকে কিছু বলবে না। হারুমির ওপরে ভরসা আছে তার।

হারুমি পরিচিত রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে শীঘ্রই তার গন্তব্যে চলে এলো।

নামিয়া জেনারেল স্টোরের আশেপাশে হালকা কুয়াশা। আশেপাশে কেউ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে গলি দিয়ে হেঁটে পেছনের দরজার সামনে চলে এলো। শুরুতে তার নার্ভাস লাগত, কিন্তু এখন এই প্রক্রিয়ায় সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

দরজার পাশেই একটা কাঠের মিল্ক ক্রেট। বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে ঢাকনাটা খুলল। ভেতরে একটা খাম আছে।

শ্বাসটা ছাড়ল।

সেখান থেকে বেরিয়ে সাইকেলে করে সোজা বাসায় চলে এলো। তৃতীয় চিঠিতে কী লেখা থাকতে পারে? তর সইছে না ওর।

হারুমি মুতো আগস্টের দ্বিতীয় শনিবারে বাসায় ফিরেছে। কোম্পানি আর শিনজুকুতে বন ব্রেক চলছে। একসাথে দুটো ছুটি না পেলে আসতে পারত না।

বন ব্রেক ছাড়া কোম্পানি থেকে আর ছুটি পায় না সে। ছুটির আবেদন তারা খারিজ করে দেয়। ক্লাবে এসব নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। আগে থেকে বলে রাখলে যখন-তখন ছুটি পাওয়া যায়। কিন্তু হারুমি কখনই বন্ধ দিত না। যতদিন সম্ভব কাজ করতে যেত।

এটা আসলে তার বাসা না। এখানে তার জন্ম হয়নি। বাড়ির গেটে লেখা ‘তামুরা’।

পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা-মা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। একটা ট্রাক ছিটকে তাদের লেনে এসে পড়েছিল। হারুমি তখন প্রিস্কুলে ছিল। সে কীভাবে খবরটা পেয়েছিল তা মনে নেই তার। হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছিল কিন্তু স্মৃতি মুছে গেছে। এরপরের ছয় মাস চুপ থাকার কথাও মনে নেই ওর। অন্য কেউ না বলে দিলে হয়তো এসব জানতও না।

এমন না যে তার কোনো আত্মীয় ছিল না। কিন্তু তাদের সাথে খুব কমই দেখা হতো। কেউ খবর শুনেই তাকে এসে নিয়ে যাবে এমনটা হবার কথা না। কিন্তু তামুরারা তখন এগিয়ে এসেছিল।

হিদেও তামুরা হারুমির নানির বোন। তার মানে সে সম্পর্কে হারুমির বড়ো- খালা। হারুমির নানাভাই যুদ্ধে মারা যায় আর এরপর নানি অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিছুদিন পর সেও ইহলোক ত্যাগ করে। হিদেও তখন স্বর্গের ফেরেস্তার মতো হারুমির সাহায্যে এগিয়ে আসে। হারুমিকে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করে। হারুমির বড়ো খালুও ঠিক একইরকম সদয়।

ভালো দিনগুলো বেশিদিন টিকেনি। তাদের একমাত্র মেয়ে হুট করে একদিন স্বামী-সন্তান নিয়ে বাসায় চলে আসে। পরে জানা যায় লোকটা নাকি ব্যাবসায় তার সমস্ত সম্পদ হারিয়ে ফেলেছে আর তাদের মাথায় অনেক ঋণের বোঝা। এমনকি বাড়িটাও ছেড়ে দিতে হয়েছে।

এলিমেন্টারি স্কুলে ঢোকার ঠিক আগে হারুমিকে অনাথাশ্রমে দিয়ে দেওয়া হয়। হিদেও যাবার সময় তাকে বলে গিয়েছিল, ‘আমি শীঘ্রই তোমাকে নিতে আসব।’

ছয় বছর পর, সে তার কথা রাখতে ফিরে আসে। তার মেয়ের পরিবার চলে গিয়েছিল। প্রথম দিন ফিরে হারুমি তার বড়ো খালাকে বেদির সামনে বসে প্রার্থনা করতে দেখে।

‘যেন বিশাল এক বোঝা নেমেছে আমার কাঁধ থেকে।’ হিদেও তার বোনের ছবি দেখতে দেখতে বলছিল।

তাদের বাড়ির কাছেই কিটাযাওয়াজরা থাকত। তাদের মেয়ে শিযুকো হারুমির চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড়ো।

শিযুকো প্রায়ই হারুমির সাথে খেলা করত। হারুমি যখন বাসায় ফিরে মিডেল স্কুলে ভর্তি হয় তখন শিযুকো হাইস্কুলে পড়ে। এতদিন পর শিযুকোর সাথে দেখা হবার পর হারুমি বুঝতে পারে শিযুকো খুব পরিপক্ক হয়ে গেছে।

এরপর থেকে দুজন একে অপরের সঙ্গ কখনও ছাড়ত না। শিযুকো হারুমিকে নিজের ছোটো বোনের মতো স্নেহ করত আর হারুমি তাকে বড়ো বোনের মতো ভালোবাসত। বাসা এত কাছাকাছি হওয়ায় তারা যখন ইচ্ছা দেখা করতে পারত।

এখনও বাড়ি এলে হারুমি শিযুকোর সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।

শিযুকো কলেজের চতুর্থ বর্ষে। ফিজিক্যাল এডুকেশন নিয়ে পড়ে। হাইস্কুল থেকেই ফেন্সিং করত। অলিম্পিকে যাবার মতো যোগ্যতাও তৈরি করে ফেলেছে। বেশিরভাগ সময়ে বাড়ি থেকে কলেজে আসা-যাওয়া করত সে। কিন্তু অভিজাত অ্যাথলেট হয়ে যাবার পর থেকে বাসায় আসা কঠিন হয়ে যায়। প্রায়ই বিদেশে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে কয়েক সপ্তাহ দূরে থাকতে হয় তাকে।

কিন্তু এই গ্রীষ্মে শিযুকো বাড়িতেই আছে। জাপান সরকার মস্কো অলিম্পিককে বয়কট করেছে। হারুমি খবরটা শুনে ভেবেছিল শিযুকো হয়তো ভেঙে পড়বে। কিন্তু দেখা গেল সে ব্যাপারটাকে সহজেই নিয়েছে।

অলিম্পিকের ব্যাপারটা এড়িয়ে চলা যেত না আর শিযুকো এড়িয়ে যেতও না। সে হারুমিকে বলেছে, সে হয়তো অলিম্পিকে শেষ পর্যন্ত যেতে পারেনি। কিন্তু এ নিয়ে তার মনে কোনো বোঝা নেই, ‘যে ক্রীড়াবিদরা অলিম্পিকের জন্য খুব কষ্ট করেছে তাদের কথা ভাবলে খারাপ লাগে।’ শিযুকো সবসময়েই খুব নরম মনের মানুষ।

দুবছর আগে হারুমির সাথে শিযুকোর দেখা হয়েছিল। এরপর হয়নি। একসময় শিযুকো পাতলা আর দোহারা গড়নের ছিল। এখন তার কাঁধ চওড়া হয়েছে, পেশি বেড়েছে। অলিম্পিকের জন্য যোগ্য হতে হলে বিশেষ ধরনের গড়ন দরকার, ভাবত হারুমি।

‘আমার মা বলে আমি ঘরে ঢুকলে নাকি কামরা সংকীর্ণ হয়ে যায়,’ মজা করে বলে শিযুকো।

এক রাতে ইউকাটা রোব পরে শহরের বন নাচ থেকে ফেরার সময়ে হারুমি প্রথম নামিয়া জেনারেল স্টোরের কথা জানতে পারে। তারা দুজন তাদের ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন আর বিয়ে নিয়ে কথা বলছিল। হারুমি শিযুকোকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ধরো যদি ফেন্সিং বা রোমান্স থেকে যে-কোনো একটা বেছে নিতে হয় তবে তুমি কোনটা বেছে নেবে?’

শিযুকো থেমে সোজা হারুমির চোখের দিকে তাকায়। তার চোখের মণি যেন বিনয়ে জ্বলজ্বল করছে। কান্না করে উঠে সে।

‘এই, কী হয়েছে? কিছু ভুল বলে ফেলেছি? আমি দুঃখিত! আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি!’ হারুমি তাড়াতাড়ি ক্ষমা চায়।

শিযুকো মাথা নেড়ে ইউকাটার হাতা দিয়ে চোখ মুছল, ‘কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। ভয় পাইয়ে দিলাম তোমাকে।’ আবার হাঁটতে শুরু করল।

এরপর অনেক লম্বা সময় ধরে তারা চুপ করে রইল।

এরপর শিযুকো আবার থামল।

‘হারুমি, একটা লম্বা রাস্তা ধরবে?’

‘আচ্ছা। কিন্তু কোথায় যাবো?’

‘গেলেই দেখবে। চিন্তা কোরো না, বেশি দূর না।

শিযুকো হারুমিকে একটা পুরোনো দোকানের সামনে নিয়ে আসে। সাইনে লেখা নামিয়া জেনারেল স্টোর। দোকানটা কেবল রাতের জন্য বন্ধ নাকি আজীবনের জন্য, তা বুঝা যাচ্ছিল না।

‘এই জায়গাটার কথা জানো?’ শিযুকো জিজ্ঞাসা করল।

‘নামিয়া—মনে হয় কোথাও শুনেছি। ওহ, হ্যাঁ, স্কুলের বাচ্চারা গাইতো। এখান থেকে সেটা এসেছে তাহলে?’

মিডেল স্কুলে থাকতে এর গল্প শুনেছে সে।

‘স্টোরটার ব্যাবসা বন্ধ, কিন্তু পরামর্শ দেওয়া এখনও চলছে।’

‘বলো কী?’

শিযুকো মাথা নাড়ে, ‘মানে, কদিন আগে আমি নিজেই খুব ভালো পরামর্শ পেয়েছিলাম।’

হারুমির চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল, ‘সত্যি?’

‘কাউকে বলিনি। কিন্তু তোমাকে বলাই যায়। তুমি তো আমাকে আজ কাঁদতেও দেখে ফেলেছো।’

গল্প বলতে বলতে শিযুকোর চোখ আবারও ভিজে এলো।

শিযুকোর গল্প শুনে হারুমি হতবাক হয়ে যায়। তার বান্ধবী নিজের ফেন্সিং কোচের প্রেমে পড়ে যায় এবং বিয়ের চিন্তা-ভাবনা করে শুনে সে যতটা না অবাক হয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পায় এটা শুনে যে ছেলেটা আর বেঁচে নেই। আর সে মারা যাবে জেনেও শিযুকোকে অলিম্পিকের ট্রেনিং চালিয়ে যেতে হয়েছে।

‘আমি এমনটা কখনই করতে পারতাম না,’ হারুমি স্বীকার করল, ‘যখন ভালোবাসার পুরুষটা মারা যাচ্ছে তখন কীভাবে সমস্ত সময় ক্রীড়ায় ব্যয় করা যায়!’

‘কারণ তুমি আমাদের পরিস্থিতিটা জানতে না।’ শিযুকোর কণ্ঠ এখন স্বাভাবিক, ‘সে জানত তার জীবন প্রায় শেষ। কিন্তু যেটুকু বাকি ছিল সেটুকুই সে প্রার্থনায় ব্যয় করে। যেন আমার স্বপ্ন একদিন সত্যি হয়। যখন আমি সেটা বুঝতে পারি, তখন আর কিছু ভাবার দরকার পড়েনি।’

শিযুকো বলে তার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব নামিয়া জেনারেল স্টোরের কারণে দূর হয়েছে। ‘লোকটা চমৎকার। সোজাসাপটা কথা বলে। যখন তাকে আমার সমস্যার কথা জানাই, সে কোনো ভণিতা না করে আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে সবটা দেখায়। সব কিছু স্পষ্টভাবে দেখতে বাধ্য করে। তার কারণেই আমি মন থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ট্রেনিংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছি।’

‘সত্যি—’

হারুমি আগ্রহ বোধ করে। স্টোরের যা অবস্থা, তাতে মনে হয় না এখানে কেউ এখন বাস করে।

‘আমি জানি তুমি কী ভাবছো।’ শিযুকো বলল, ‘আমার মনে হয় না এখানে কেউ থাকে। হয়তো রাতের বেলা চিঠি দেখতে আসে। উত্তর লেখা হয়ে গেলে মিল্ক ক্রেটে রেখে দেয়। সকালবেলাই পাওয়া যায় সেগুলো।’

‘অবিশ্বাস্য,’ কেউ এত ঝামেলা কেন পোহাতে যাবে? কিন্তু এসব শিযুকো বলছে। সে মিথ্যা বলবে না।

সে রাতে নামিয়া জেনারেল স্টোরের কথা মাথা থেকে সরাতে পারল না সে। হারুমি খুব বড়ো এক দ্বিধায় ভুগছে। পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই।

এক কথায়, তার সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক।

হিদেও যদিও কখনও তাকে বলেনি, কিন্তু হারুমি জানে তামুরা পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ চলছে। বাসাটা যদি একটা নৌকা হয়ে থাকে, তবে সেই নৌকার তলায় এমন ফুটো হয়েছে যে গলগল করে পানি ভেতরে ঢুকছে। বালতিতে করে পানি ফেলে কোনোরকমে নৌকাটা এখনও ভাসিয়ে রেখেছে তারা। কিন্তু খুব বেশিদিন এটা টিকবে না।

একসময় তামুরারা খুব স্বচ্ছল পরিবার ছিল। জমিজমার অভাব ছিল না। কিন্তু তাদের মেয়ের দায়বদ্ধতায় সেগুলো সব বিক্রি করে ফেলতে হয়েছে। সব কিছু দিয়ে দেওয়ার পর তাদের মেয়ে এখান থেকে চলে যায়। এরপর হারুমিকে আবার ফিরিয়ে আনে তারা।

সেটাই তামুরাদের দুর্দশার শেষ গল্প নয়। গত বছর হারুমির বড়ো খালু স্ট্রোক করে। সে এখন শরীরের ডান অংশ প্রায় নাড়াতেই পারে না।

একারণে হারুমিকে টোকিও গিয়ে কাজে লাগতে হয়েছে। বৃদ্ধ অভিভাবকের সাহায্য করা তার কর্তব্য মনে করেছে। কিন্তু কোম্পানির বেতনের প্রায় পুরোটাই থাকা-খাওয়ার জন্য খরচ হয়ে যাচ্ছে। তামুরাদেরকে সাহায্য করা কোনোমতেই সম্ভব হয়ে উঠছে না।

সমস্যায় জর্জরিত এই সময়ের মাঝে নাইট ক্লাবের জীবনের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। অন্য কোনো সময়ে প্রস্তাবটা এলে সে সাথে সাথে ফিরিয়ে দিতো। সত্যি বলতে সে ভাবত হোস্টেস হওয়া নিচু দরের চাকরি, তাকে মানায় না।

কিন্তু পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়ায়। এখন সে বরং কোম্পানির চাকরি ছেড়ে ফুল টাইম হোস্টেসের চাকরি করতে চায়। এতে করে সে তামুরাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারবে।

এটা নিয়ে পরামর্শ চাইব? এটা একটা সামান্য সমস্যা বলে মনে করবে না তো? হারুমি ডেস্কে বসে অনেকবার ভেবে দেখল।

শিযুকোর সমস্যাও খুব জটিল ছিল। নামিয়া জেনারেল স্টোর তো সেই সমস্যাও চমৎকারভাবে সমাধান করে দিয়েছে। হয়তো তাকেও একটা ভালো পরামর্শ দিতে পারবে।

আর ভাবার কিছু নেই। লিখে ফেলো। এটা ভেবে হারুমি নামিয়া জেনারেল স্টোরের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে ফেলে। কিন্তু সেটা মেইল স্লটে ফেলতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। উত্তর দেবে তো? শিকো বলেছে সে এক বছর আগে এখানে যোগাযোগ করেছে। এতদিনে বাড়িটা যদি পরিত্যক্ত হয়ে গিয়ে থাকে?

ধুর, যাই হোক। চিঠিটা মেইল স্লটে ফেলে দিলো। এতে তার আসল নামও লেখা নেই। কেউ যদি পেয়ে পড়েও ফেলে তবে জানবেও না প্রেরক কে।

কিন্তু পরদিন সকালে মিল্ক ক্রেটে ফিরতি চিঠি পেয়ে যায়।

যখন সেটা পড়ল, তখন সে বুঝতে পারে শিযুকো ভুল বলেনি। নামিয়া জেনারেল স্টোর ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কোনো কথা বলে না। একদম সোজাসাপটা। যেন তাকে রাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এভাবে লিখেছে।

‘মিস্টার নামিয়া এভাবেই কাজ করেন।’ শিযুকো বলল তাকে, ‘নিজেকেই নিজের কথা বলতে আর নিজের রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য করেন।

তারপরও হারুমির মনে হলো উত্তরটা খুব রূঢ়। মিস্টার নামিয়া ভাবছে সে কল্পনার রাজ্যে বাস করে আর সেই তাড়নায় হোস্টেস হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আর কিছু না।

সেও সোজাসাপটা একটা উত্তর লিখে ফেলে। কেবল স্বচ্ছল জীবনধারার জন্য সে ক্লাবে কাজ করতে চায় না বরং একদিন নিজের ক্লাবও খোলার পরিকল্পনা আছে।

ফিরতি চিঠিটা পেয়ে সে আরও রেগে যায়। অবিশ্বাস্যভাবে, মিস্টার নামিয়া তার অঙ্গীকারের দিকে আঙুল তুলেছেন। হারুমি যদি তার বৃদ্ধ অভিভাবকের সেবা করতেই চায় তবে সে কেন বিয়ে করে সংসার করছে না? এই চিঠি এখন সীমা পার করে ফেলছে।

হারুমির মনে হলো এখানে বুঝার ভুল হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো লুকিয়ে আর লাভ নেই।

তৃতীয় চিঠিতে তাই সে সব কিছু খুলে বলল। তার অভিভাবকের অবস্থা, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—সব

মিস্টার নামিয়া এবার কেবল প্রতিক্রিয়া দেবেন? কিছুটা উৎকণ্ঠা আর কিছুটা ভয় নিয়ে সেই চিঠিটা পোস্ট করেছিল হারুমি।

বাড়ি ফিরে তাতামির টেবিলে বসে সকালের নাস্তা খেয়ে নিলো। পাশের ঘরে হিদেও বড়ো খালুকে চামচে করে পরিজ আর ঠান্ডা চা খাওয়াচ্ছে। তাদের দেখে আবারও একটা তাড়না অনুভব করল হারুমি, এদেরকে সাহায্য করার। কিছু একটা করতেই হবে।

নিজের ঘরে ফিরে চিঠি পড়তে শুরু করল।

এবারের চিঠিটা বাকি সবগুলোর চেয়ে আলাদা।

.

প্রিয় ডুবিয়াস ডগি,

আমি আপনার তৃতীয় চিঠি পেলাম। এটা এখন পরিষ্কার, যে আপনি খুব কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন এবং যারা আপনার উপকার করেছে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য আপনি বদ্ধপরিকর। আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন আছে আমার।

• যে লোক আপনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে তাকে আপনি পুরোপুরি ভরসা করতে পারেন তো? আপনি বলেছেন এই ছেলে অনেক ব্যাবসার সাথে জড়িত কিন্তু কীভাবে জড়িত তা কি কখনও জিজ্ঞাসা করেছেন তাকে? যদি সম্ভব হয় তাহলে আপনি তাকে বলুন আপনাকে একদিন তার ব্যাবসা ঘুরে দেখাতে। সেখানে গিয়ে কর্মচারীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে ছেলেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করুন।

• ক্লাব চালু করার সময়ে ছেলেটা আপনাকে সাহায্য করবে এর কোনো লিখিত গ্যারান্টি আছে? তার স্ত্রী যদি এই সম্পর্কের কথা জেনে যায় তবুও কি সে তার কথা রাখবে?

• আপনি কি এই ছেলের সাথেই থাকতে চান? যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেন তখন কী করবেন?

• আপনি বলেছেন আপনি হোস্টেসের চাকরি করে টাকা জমাতে চান যেন একসময় নিজের ক্লাব খোলার মতো পুঁজি থাকে। আপনি রোজগারের অন্য কোনো উপায় বিবেচনা করতে রাজি? নাকি হোস্টেস হবার অন্য কোনো কারণ আছে?

• যদি আমি আপনাকে রোজগারের অন্য কোনো উপায় বলে দেই তাহলে আপনি কি সেটা বিবেচনা করবেন? আমি যা বলব তা করতে রাজি হবেন? একটা প্রবল সম্ভাবনা আছে যে আমি আপনাকে হোস্টেসের চাকরি ছেড়ে দিতে আর বাজে লোকের সঙ্গ ছেড়ে দিতে বলব।

দয়া করে এগুলোর সৎ উত্তর দিয়ে আরেকটি চিঠি লিখুন। আপনার উত্তর দেখলে আশা করি আপনার স্বপ্ন পূরণের কোনো উপায় বাতলে দিতে পারব।

এসব হজম করা হয়তো আপনার জন্য শক্ত। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আমি আপনাকে কোনো ধোঁকা দিচ্ছি না। সেটা করে আমার কোনো লাভ নেই। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

কিন্তু একটা সাবধানতার বাণী।

সেপ্টেম্বর ১৩ পর্যন্তই আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। এরপর আর সম্ভব হবে না।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

হারুমি কাস্টমারের তৃতীয় গ্রুপটা বিদায় করে দেওয়ার পর মায়া তাকে স্টাফ রুমে টেনে নিয়ে গেল। মায়া তার চেয়ে চার বছরের বড়ো।

দরজা বন্ধ করে হারুমির চুল টেনে ধরল সে। ‘কী ভেবেছো? বয়স কম বলে ফ্রি পাস পেয়ে যাবে?’

হারুমির চেহারা ব্যথায় কুঁকড়ে গেল, ‘কী বলছ?’

‘কী বলছি? তুমি আমার পুরুষের দিকে নজর দিচ্ছিলে।’ মায়া হিসহিস করে উঠল। তার ঠোঁটগুলো লাল লিপস্টিকে চকচক করছে।

‘কী? আমি কিছু করিনি!’

‘ঢং দেখো। মিস্টার সাতোর সাথে এত লুতুপুতু কীসের। ঐ বুড়োটাকে আমি এনেছি।’

মিস্টার সাতো? হারুমির নিজেরই বিশ্বাস হলো না। ওই বুড়ো ভামের দিকে হারুমি নজর দেবে? ছিঃ!

‘সে আমাকে এসে হাই বলেছে। আমি ভদ্রতা করে ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম।’

‘মিথ্যাবাদী। তার সামনে কিউট সাজছিলে।’

‘আমরা হোস্টেস। কাস্টমারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করাই আমাদের কাজ।’

‘চুপ,’ মায়া হারুমির চুল ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা দিলো। দেওয়ালে বাড়ি খেল ও, ‘পরেরবার এত সহজে ছাড়ব না। বুঝেছ?’

মায়া হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।

হারুমি আয়নায় নিজেকে দেখল। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। আলুথালু চুল। তাড়াতাড়ি ঠিক করে নিলো। এসবে নিজেকে কষ্ট পেতে দেবে না সে।

রুম থেকে বেরিয়ে একটা টেবিলে বসল। সেখানে তিনজন পুরুষ বসেছিল। এদের সবাইকে দেখে ধনী মনে হচ্ছে।

‘হ্যালো, আরেকটা কমবয়সি মেয়ে,’ একটা লোক জঘন্যভাবে হাসতে হাসতে বলল। হারুমিকে আপাদমস্তক দেখে নিলো লোকটা।

‘গুড ইভিনিং,’ লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল হারুমি, ‘আমি মিহারু। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’ লোকটার পাশে বসল সে।

তার একজন সহকর্মী ইতোমধ্যে টেবিলে বসে ছিল। কৃত্রিম হাসি হেসে হারুমির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটাও এর আগে হারুমিকে হুমকি দিয়েছে। সবার নজর যেন হারুমির দিকে এতটা না যায়।

যত্তসব, এই চাকরিতে কাস্টমারের নজরে না পড়লে লাভ নেই।

কিছুদিন পর শিনজি তমিওকা ক্লাবে একা আসে। পরনে ছিল ধূসর স্যুট আর লাল টাই। চমৎকার গঠন, কোনো বাড়তি মেদ নেই শরীরে। দেখে মনেই হয় না তার বয়স ৪৬।

প্রতিবারের মতোই আজও সে হারুমিকে ডেকে তার সাথে বসতে বলল।

‘আকাসাকাতে একটা ক্লাসি বার আছে,’ তমিওকা ফিসফিস করে বলল। হুইস্কিতে একটা চুমুক দিয়ে গলার স্বর আরও নামিয়ে বলল, ‘পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকবে আর সেখানে সবরকম ওয়াইন পাওয়া যায়। তারা এইমাত্র কিছু চয়েজ কেভিয়ার যোগ করেছে আর আমাকে সেটা দেখার জন্য আমন্ত্রণ করেছে। যাবে আমার সাথে?’

হারুমি কৌতূহল বোধ করল। কিন্তু সে নতজানু হয়ে বলল, ‘আমি দুঃখিত। কাল দেরি করে কাজে আসা যাবে না।’

তমিওকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘এজন্যই তোমার ওই চাকরি ছেড়ে দেওয়া উচিত। তারা যেন কী করে?’

‘স্টেশনারি ম্যানুফাকচারার।’

‘তুমি কী করো? ডেস্ক কাজ?’

হারুমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। সত্যি বলতে আসলে সেটাও না। বেগার খাটা আর কী।

‘এত কম বেতনে এগোবে কী করে? জীবন-যৌবন একবারই আসে। এই সময়ে নিজের স্বপ্নের দিকে ছোটা উচিত তোমার। এখনই সময় কিছু করার।’

হারুমি মাথা নেড়ে সোজা তমিওকার দিকে তাকাল, ‘যাই হোক, আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি, আপনি বলেছিলেন আমাকে গিনযার ডিনার ক্লাবে নিয়ে যাবেন। যেই ক্লাব আপনার ব্যাবসা দাঁড় করাতে সাহায্য করেছিল।’

‘ওহ, সেটা? অবশ্যই। কখন যেতে পারবে?’

‘সম্ভব হলে যখন বিজনেস আওয়ার থাকে না, তখন।’

‘কেন?’

‘ভবিষ্যতের জন্য। স্টাফদেরকে তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাই, কীভাবে ভেতরের জিনিসটা কাজ করে।’

তমিওকার চেহারা গম্ভীর হয়ে এলো, ‘মনে হয় না তেমনটা সম্ভব।’

‘কেন?’

‘আমি কাজ আর মজার মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে চলি। আর সেখানকার মালিকের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো আছে বলে আমি রেস্টুরেন্টের সাথে অসংযুক্ত কাউকে যখন-তখন সেখানে নিয়ে যেতে পারি না। এতে স্টাফরা বিরক্ত হবে।’

‘ওহ, আচ্ছা। আমি সেটা চাইনি। দুঃখিত।’ হারুমি নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘কিন্তু এর মানে এই না যে কাস্টমার হিসেবে যেতে পারব না। চলো, শীঘ্রই কোনো একদিন যাই।’ তমিওকার চেহারায় যেন জীবন ফিরে এলো।

সে রাতে হারুমি রাত তিনটার পর তার কোয়েনজির অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল। তমিওকা একটা ট্যাক্সি করে তাকে বাসায় নিয়ে এলো।

‘আমি ওপরে আসব না,’ এটা তমিওকা প্রতিবারই বলে, ‘আমি যে প্রস্তাব দিয়েছি তা ভেবে দেখো।’

প্রেমের প্রস্তাব। হারুমি উত্তর না দিয়ে হাসল।

ওপরে উঠে সবার আগে এক গ্লাস পানি খেল। সপ্তাহে চার দিন বারে কাজ করে সে। সেই চার দিনই বাসায় ফিরতে ফিরতে এত দেরি হয়। বাকি তিন দিন বাসায় ফিরে বাথহাউজে যাবার সময় পায় সে।

মেকাপ তুলে মুখ ধুয়ে তার প্ল্যানার নিয়ে বসল। সকালে বড়ো একটা মিটিং আছে। যার জন্য আধাঘণ্টা আগেই উপস্থিত হতে হবে তাকে। তার মানে আর চার ঘণ্টা আছে ঘুমানোর।

হারুমি প্ল্যানার রেখে একটা খাম তুলে নিলো। চিঠিটা সে এখন পর্যন্ত এতবার পড়েছে যে এটা এখন তার মুখস্ত। কিন্তু তাও দিনে কমপক্ষে একবার পড়েই। নামিয়া জেনারেল স্টোর থেকে পাওয়া তৃতীয় চিঠি এটা।

আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি এই লোকের ওপর ভরসা করতে পারেন?

হারুমির আগে থেকেই এই সন্দেহটা হচ্ছিল কিন্তু সে এড়িয়ে যেত। এটার মুখোমুখি হতে পারবে না সে। তমিওকা যদি ভণ্ড হয়ে থাকে তবে তার থেকে তার স্বপ্ন অনেক দূরে চলে যাবে।

নামিয়া জেনারেল স্টোরের সন্দেহ-প্রবণ হওয়া ভুল কিছু না। হারুমি যদি তমিওকার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায় আর সেটা তমিওকার স্ত্রী জেনে যায় তবে তমিওকা কি আর তাকে সাহায্য করবে? মনে হয় না।

তমিওকার আচরণও সন্দেহজনক। কাজ আর মজার মাঝে দূরত্ব বজায় রেখে চলা, কিন্তু তমিওকা নিজের অর্জনগুলো হারুমিকে দেখাবার জন্য নিজেই সেই রেস্টুরেন্টে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিল।

হয়তো তার ওপর আসলেই ভরসা করা যায় না। আর এমনটা হলে ভবিষ্যতে সে কী করবে?

চিঠিটা আবার পড়ল হারুমি। এক জায়গায় লেখা: যদি আমি আপনাকে রোজগারের অন্য কোনো উপায় বলে দেই তাহলে আপনি কি সেটা বিবেচনা করবেন? আমি যা বলব তা করতে রাজি হবেন? আর লেখা: আপনার উত্তর দেখলে আশা করি আপনার স্বপ্ন পূরণের কোনো উপায় বাতলে দিতে পারব।

এখানে হচ্ছে-টা কী? এমন কথায় কীভাবে বিশ্বাস করা যায়? শুনে মনে হয় যেন লোকটা প্রতারক, যার কাছে দ্রুত ধনী হবার কোনো অভিনব পদ্ধতি আছে। অন্য কোনো সময় হলে হারুমি চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিত।

কিন্তু এটা নামিয়া জেনারেল স্টোরের চিঠি। মিস্টার নামিয়া শিযুকোর এতটা স্পর্শকাতর সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। নাহলে শিযুকোর এতটা ভরসা অর্জন করতে পারতেন না। সে সোজাসাপটা কথা বলে। ধারালো কথা, কিন্তু বাস্তবিক।

এই চিঠিতে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেছে: হারুমিকে ফাঁদে ফেলে তার কোনো লাভ নেই। তবুও সবটা বিশ্বাস করা হারুমির পক্ষে কষ্টকর। অর্থ উপার্জন করা যদি এতই সহজ হতো তবে তো কাউকে কখনও সংগ্রামই করতে হতো না। আর তাছাড়া মিস্টার নামিয়া নিজেও কোটিপতি লোক নন।

চিঠির উত্তর দেওয়ার আগেই হারুমির ছুটি শেষ হয়ে যায়। টোকিওতে ফিরে এসে আবার একই সাথে কোম্পানিতে আর ক্লাবে কাজ করতে হচ্ছে। একই সাথে দুটো ভিন্ন জীবনধারা। আর সেটা তার শরীরের ওপর প্রভাব ফেলছে। মাঝেমধ্যেই তার ইচ্ছা করে চাকরিটা এখনই ছেড়ে দিতে।

হারুমি ক্যালেন্ডার দেখল। আজ বুধবার, সেপ্টেম্বর ১০।

চিঠিতে বলা ছিল কেবল সেপ্টেম্বর ১৩ পর্যন্ত যোগাযোগ করা যাবে। এরপর আর তাকে পাওয়া যাবে না। ১৩ তারিখ শনিবার। সেদিন এমন বিশেষ কী আছে? পরামর্শ দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে নাকি?

প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতেই হবে। হারুমি জানতে চায় উত্তর শুনে মিস্টার নামিয়া কী বলবে। তার কথা শুনবে বলে কথা দিলেও সেটা যে পরে রাখতেই হবে, এমন কিছু তো না। সে যদি মিস্টার নামিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও ক্লাবে কাজ করতে থাকে, তবে সেটা মিস্টার নামিয়া কখনও জানবেও না।

ঘুমুতে যাবার আগে হারুমি আয়নায় দেখল তার ঠোঁটে একটা ব্ৰন উঠেছে। ঠিকমতো রাতে ঘুমাবার সুযোগ হয় না তার। কোম্পানির চাকরিটা ছেড়ে দিলে অন্ততপক্ষে দুপুর পর্যন্ত ঘুমুতে পারত।

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ১২-তে সে কাজ শেষে তামুরা হাউজের দিকে রওনা হলো। ক্লাব থেকে ছুটি নিয়েছে।

বন্ধ শেষে এক মাস পরেই হারুমির বাড়ি ফেরাটা তামুরাদের জন্য একটা আশ্চর্যজনক বিষয়, কিন্তু তারা খুব খুশি হলো। গত বন্ধে বড়ো খালু তার সাথে খুব একটা কথা বলতে পারেনি। সে রাতে খাবারের সময়ে তারা অনেক কথা বলল। কিন্তু সে কাউকে ক্লাবের চাকরির কথা জানাল না।

‘বাসা ভাড়া দিতে পারছ তো? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? সমস্যা হলে অকপটে জানাবে, ঠিক আছে?’ খালুর কথা বলতেও কষ্ট হয়। হিদেও এখন বাড়ির টাকা-পয়সার দিক পুরোটা সামলায়। তাই অর্থনৈতিক মন্দার কথা বড়ো খালু জানেনও না।

‘সমস্যা হয় না। ভালো ব্যাপারটা হচ্ছে আমি এতটাই ব্যস্ত থাকি যে আরাম করার সময়ই পাই না। তাই কিছু খরচও হয় না।’

আরাম করার সময় নেই—এটাই কঠিন সত্যি।

খাবারের পর সে গোসল করল। বাথরুমের জানালা দিয়ে রাতের আকাশের পূর্ণিমা দেখা যাচ্ছে। কাল নিশ্চয়ই একটা রৌদ্রজ্জ্বল দিন হবে।

পরবর্তী চিঠিতে কী লেখা থাকবে?

আজ আসার সময় মেইল স্লটে চিঠি দিয়ে এসেছে হারুমি। তাতে বলেছে অর্থোপার্জনের অন্য ভালো উপায় পেলে সে ক্লাবের চাকরি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। প্রেমের প্রস্তাবটাও ফিরিয়ে দেবে।

পর দিন সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ। মিস্টার নামিয়া যে উত্তরই দিক না কেন, সেটাকে প্রতিহত করে উত্তর দেওয়ার আর সুযোগ নেই। এটাই তাদের শেষ যোগাযোগ। এই চিঠিতে কী লেখা থাকবে তার ওপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে হারুমিকে।

পর দিন সকালে সাতটার আগেই উঠে যায় সে। ঠিকমতো ঘুম হয়নি। তার বড়ো খালা ইতোমধ্যেই সকালের নাস্তা বানাতে শুরু করেছে। তাতামি ঘর থেকে একটা দুর্গন্ধ ভেসে এলো। হিদেও নিশ্চয়ই সেখানে বড়ো খালুকে সাহায্য করতে গেছে। বড়ো খালু নিজে নিজে বাথরুমে যেতে পারে না।

হিদেওকে বলে হারুমি বেরিয়ে পড়ল। সাইকেলে চড়ে পরিচিত জায়গাটায় এসে পড়ল।

নামিয়া জেনারেল স্টোর যেন তারই অপেক্ষা করছিল। পাশের গলিটা দিয়ে চলে এলো মিল্ক ক্রেটের কাছে। ভেতরে একটা খাম। সেটা দেখে বুক ধক-পক করছে হারুমির। কৌতূহল, সন্দেহ আর শঙ্কা।

বাসায় ফেরার সময়ে একটা নির্জন পার্কে বসে চিঠিটা পড়ল সে।

.

প্রিয় ডুবিয়াস ডগি,

চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আমার ওপর আস্থা রেখেছেন জেনে খুশি হলাম।

অবশ্যই, আমি যা বলছি তার হাতেনাতে প্রমাণ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। হয়তো আমার পরামর্শকে আপনি রহস্যজনক ভাবছেন। কিন্তু আপাতত সেটা নিয়ে আমার কিছু করার নেই। আমি আপনার কথার প্রেক্ষিতেই উত্তর দিচ্ছি।

যাই হোক, আপনি কীভাবে আপনার স্বপ্ন পূরণ করবেন?

দুটো জিনিস করতে হবে: পড়াশোনা করে এবং টাকা জমিয়ে।

পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করুন, বিশেষত নিরাপত্তা এবং রিয়েল এস্টেট নিয়ে। এটা করার জন্য আপনাকে কোম্পানির চাকরি ছাড়তে হবে। তবে হোস্টেস হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন।

প্রপার্টি কেনার জন্য টাকা জমাবেন। সেগুলো টোকিওর যত কাছাকাছি হবে, ততই ভালো। জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি—যাই লাভজনক মনে হবে তাই কিনবেন। পুরোনো হোক বা যাই হোক, খেয়াল রাখবেন যেন ১৯৮৫ সালের আগেই সব কেনা হয়ে যায়। এগুলো আপনার থাকার জন্য না।

১৯৮৬ সালে জাপানে একটি অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটবে। রিয়েল এস্টেটের দাম তখন হবে আকাশচুম্বী। যা যা কিনেছিলেন তা তখন লাভে বিক্রি করতে শুরু করবেন। এরপর আরও দামি কিছু কিনে সেটা আরও বেশি লাভে বিক্রি করবেন। বারবার এটাই করতে থাকবেন আর স্টকে টাকা লাগাবেন। এখানে আপনার পড়াশোনা কাজে দেবে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত যে-কোনো বড়ো ব্র্যান্ডেই লাভ আসবে।

গলফ কোর্সে ইকুইটি মেম্বারশিপ রাখাটা আরেকটা লাভজনক পথ। যত দ্রুত কেনা যায় ততই ভালো।

একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে: এসব বিনিয়োগ থেকে আপনি কেবল ১৯৮৯ পর্যন্তই লাভ পাবেন। ১৯৯০ থেকে সব কিছু অদ্ভুতভাবে বদলে যাবে। যদি মনেও হয় যে দাম এখনও বাড়ছে, তবুও সব কিছু লিকুইড করে নেবেন। এটা কার্ড গেমের মতো। কাল নির্ণয়ের ওপর সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে। কেবল আমার ওপর আস্থা রাখুন এবং যা বলছি তাই করুন।

এরপর থেকে জাপানিজ অর্থনীতিতে মন্দা হতে শুরু করবে। তখন আর কোনো বিনিয়োগ করবেন না। এতে কোনো লাভ হবে না। টাকা দিয়ে তখন ব্যাবসা শুরু করবেন।

আপনি হয়তো এখন সন্দেহ করছেন। ভবিষ্যতে কী হবে তা আমি কীভাবে এতটা নিশ্চিতভাবে বলছি? এই লোকটা কীভাবে জাপানের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎবাণী দিচ্ছে?

দুর্ভাগ্যবশত, আমি এর কারণ আপনাকে বলতে পারব না। বললেও হয়তো বিশ্বাস করবেন না। ধরে নিন আমি একজন গণক।

যাই হোক, আমি আরও কিছু ভবিষ্যৎবাণী করে দিচ্ছি।

আমি বলেছি জাপানিজ অর্থনীতি ডুবে যাবে কিন্তু এর মানে এই না যে তখন আর স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগ থাকবে না। তখন ব্যাবসার নতুন দুয়ার খুলে যেতে পারে।

কম্পিউটার একসময় সারা বিশ্বে দৈনন্দিন কাজে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। খুব শীঘ্রই, প্রতিটি বাসায়, প্রতিটি মানুষের কাছেই একটা করে কম্পিউটার থাকতে হবে। এইসব কম্পিউটার একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়ে বিশাল এক নেটওয়ার্ক গঠন করবে আর সারা বিশ্বের মানুষ সেই নেটওয়ার্ক দিয়ে যোগাযোগ করতে পারবে। সবার কাছে বহনযোগ্য ফোন থাকবে আর এই ফোন দিয়েও নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হওয়া যাবে।

এমন নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করছে এমন কোনো ইন্ডাস্ট্রির সাথে দ্রুত সংযুক্ত হয়ে যেতে হবে আপনাকে। এটা আপনার সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। সেই নেটওয়ার্ক আপনি ব্যাবসার কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। অসীম সুযোগ আসবে আপনার সামনে।

আমার কথা বিশ্বাস করা বা না করা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার। কিন্তু প্রথমে যা বলেছি তা মাথায় রাখবেন। আপনাকে ফাঁদে ফেলে আমার কোনো লাভ নেই। আমি কেবল বসে আপনার সমস্যা সমাধানের একটা উপায় ভেবেছি। আর এটাই আমার

মতে সবচেয়ে ভালো সমাধান।

আপনার জন্য আরও কিছু করতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু সময় শেষ। এটাই আমাদের সর্বশেষ যোগাযোগ। আমি আর কোনো চিঠি পাবো না।

আমাকে বিশ্বাস করা বা না করা আপনার সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমি চাই আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন। মন থেকে সেটাই প্রার্থনা করছি।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

হারুমি হতবাক হলো। এমন চিঠি তার প্রত্যাশার বাইরে।

এটা একটা ভবিষ্যৎবাণী। নিশ্চিত ভবিষ্যৎবাণী।

সে এখন যে সময়ে আছে, ১৯৮০-তে, এই সময়ে জাপানের অর্থনীতি মাথা তুলে দাঁড়াবার অবস্থায় নেই। অয়েল শক (তেলের দাম বৃদ্ধি) থেকে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা এখনও পুষিয়ে উঠেনি। আর এখন কলেজ গ্রাজুয়েটরাও সহজে চাকরি খুঁজে পায় না।

কিন্তু এই চিঠি অনুযায়ী, আর কয়েক বছরের মাঝেই এসব বদলে যাবে। উন্নয়ন শুরু হবে।

হারুমি বিশ্বাস করতে পারছে না। লোকটা নিশ্চয়ই মজা করছে।

কিন্তু আসলেই তো, তার সাথে মজা করে মিস্টার নামিয়ার কোনো লাভ নেই।

চিঠিটা কেবল অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎবাণীই দেয়নি, বরং ভবিষ্যতের টেকনোলজিরও আভাস দিয়েছে। এখানে কোনো অনুমান বা তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয়নি। কেবল শক্ত পোক্ত তথ্য।

কম্পিউটার নেটওয়ার্ক আর বহনযোগ্য টেলিফোন–এসব তার জগতে নেই। সত্যি বলতে একবিংশ শতাব্দী আসতে আর কেবল কুড়ি বছর বাকি। তখন এসব সত্যি হবে ভাবাটা অসম্ভব কিছু বলে মনে হচ্ছে না। দৈনন্দিন কাজেও হয়তো সেসবের দরকার পড়বে।

হারুমি সারাদিন ছটফট করল। রাতের বেলা ডেস্কে বসে একটা চিঠি লিখেই ফেলল সে। অবশ্যই, তা নামিয়া জেনারেল স্টোরকে উদ্দেশ্য করে লেখা। সে জানে সেপ্টেম্বর ১৩-এর পর থেকে তার সাথে আর যোগাযোগ করা যাবে না। কিন্তু মধ্যরাত এখনও হয়নি। এর আগে পর্যন্ত চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?

এই চিঠিতে সে এই ভবিষ্যৎবাণীর উৎস জানতে চাইল। যদিও বিশ্বাস করা শক্ত হবে, কিন্তু তাও সে জানতে চায়। সেটা জানার পর সে কোনো একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারবে।

রাত এগারোটায়, বাড়ি থেকে চুপিচুপি বের হলো সে। যখন স্টোরে পৌঁছালো তখন ঘড়িতে দেখল ১১ টা বেজে ৫ মিনিট। সময় আছে এখনও।

কিন্তু সাইকেল থেকে নেমে দু’কদম এগুতেই থমকে গেল।

হারুমি বুঝে গেল, সব শেষ। এখন আর কোনো উপায় নেই।

স্টোরের সেই অলৌকিক বাতাবরণটা আর নেই। এখন কেবল একটা পরিত্যক্ত জেনারেল স্টোর পড়ে রয়েছে। হারুমি জানে না কেন তার এমনটা মনে হলো। কিন্তু সে নিশ্চিত, যোগাযোগের সময় ফুরিয়ে গেছে।

চিঠিটা আর মেইল স্লটে গেল না। সাইকেলে চড়ে বাড়ি ফিরে এলো হারুমি।

.

চার মাস পর হারুমি বুঝতে পারল সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন বছরের ছুটিতে বাড়ি এসে শিযুকোর সাথে পাশের মন্দিরে গেল। শিযুকো একটা চাকরি পেয়েছে। একটা বড়োসড়ো সুপারমার্কেটে কর্পোরেট হেডকোয়ার্টারে। তার মানে এখন সে আর ফেন্সিং করবে না। শিযুকো বলল সে আর ক্রীড়ার সাথে জড়িত থাকবে না।

‘কিন্তু তুমি কত কষ্ট করেছো,’ হারুমি বলল।

শিযুকো হেসে মাথা নাড়ল, ‘আমার জন্য ফেন্সিং যতটুকু গুরুত্ব রাখে, আমি সে পর্যন্তই গিয়েছি। মস্কোর জন্য যখন ট্রেনিং নিয়েছি তখন আমি আমার সবটা তাতে দিয়ে দিয়েছিলাম। স্বর্গে বসে থাকা সেও এটা জানে।’ শিযুকো আকাশের দিকে তাকাল, ‘এখন ভবিষ্যতের কথা ভাবার সময় হয়েছে। আমি কোম্পানিতে ভালো করতে চাই। একবার সবকিছু ঠিকঠাকভাবে হয়ে গেলে এরপর ভালো একজন সঙ্গী খুঁজে নেবো।’

‘সঙ্গী?’

‘হ্যাঁ, আমি বিয়ে করে নিজের পরিবার শুরু করতে প্রস্তুত।’ শিযুকো জোরে হেসে উঠল। সেই হাসিতে গত বছরে প্রিয়তমকে হারানোর বেদনা নেই।

কী সাহসী মেয়ে। হারুমি মুগ্ধ হয়।

বাসায় ফেরার সময় শিযুকো বলে, ‘ওহ আচ্ছা, মনে আছে গত বছর তোমাকে একটা স্টোরের কথা বলেছিলাম? পরামর্শ দেয় যে?’

‘হ্যাঁ, নামিয়া নাম সেটার, তাই না?’ হারুমি সেখানে চিঠি দেওয়ার কথা কাউকে বলেনি। শিযুকোকেও না।

‘সেটা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। লোকটা নাকি মারা গেছে, আমি একটা লোককে সেখানে ছবি তুলতে দেখেছিলাম। সেই লোকটা এই খবর বলল। সে নাকি মিস্টার নামিয়ার পুত্র।

‘তাই নাকি? কবে?’

‘অক্টোবরে। লোকটা বলল মিস্টার নামিয়া গত মাসে মারা গেছে।’

হারুমি ঢোক গিলল, ‘তার মানে সেপ্টেম্বরে?’

‘মনে হয়।’

‘কত তারিখে?’

‘সেটা বলেনি। কেন?

‘এমনি।’

‘যখন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন দোকান বন্ধ ছিল। কিন্তু পরামর্শ দেওয়া বন্ধ হয়নি। অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো, আমার চিঠিই মনে হয় লোকটার শেষ চিঠি ছিল। এটা ভাবলে আমার খুব খারাপ লাগে।’

না, আমার চিঠি ছিল শেষ চিঠি। কিন্তু হারুমি সেটা মুখে বলতে পারল না। মনে হয় লোকটা ১৩ সেপ্টেম্বরে মারা গেছে। এ কারণেই হারুমিকে বলেছিল এরপর আর যোগাযোগ সম্ভব না। নিশ্চয়ই সে নিজের মৃত্যুর দিনটা বুঝতে পেরেছিল।

এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, লোকটা যদি আসলেই তার মৃত্যুর তারিখ আগে থেকে জেনে যেতে পারে, তার মানে তার অলোকদৃষ্টি সামান্য কিছু নয়।

কিন্তু তার মানে—

হারুমির চিন্তাভাবনা বিদ্যুতের গতিতে ছুটল।

চিঠিতে যা যা লেখা ছিল, সেগুলো কি আসলেই সত্যি?

ডিসেম্বর ১৯৮৮

হারুমি একটা ঘরে বসে আছে। ঘরটা তৈলচিত্রে সাজানো। সে একটা প্রপার্টি বিক্রি করার বিলে সাইন করবে। গত কয়েক বছরে অসংখ্যবার এসব করেছে সে। লাখ টাকার লেনদেন এখন আর তাকে চিন্তিত করে না। এই প্রপার্টিটা অতটা দামিও না। কিন্তু সে অপ্রত্যাশিতভাবে নার্ভাস বোধ করছে। কোনো রিয়েল এস্টেট কেনার ব্যাপারে সে কখনও এতটা আবেগী হয়ে উঠেনি।

দুই লক্ষ ইয়েন মূল্যের ডানহিল স্যুট পরা এজেন্টটা হারুমির মুখোমুখি হলো। তার চামড়া বাদামি। হারুমি অনুমান করল লোকটা হয়তো মাঝেমধ্যেই ট্যানিং সেলুনে যায়।

‘যদি আর কোনো আপত্তি না থেকে থাকে তবে দয়া করে এখানে সাইন করে আপনার সিলটা দিয়ে দিন।’

তারা একটা বড়ো ব্যাংকের শিনিজুকুর শাখার অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়েছে, এই শাখা থেকে লোন নিত। স্যুট পরা এজেন্ট, যে মাঝেমধ্যে হারুমির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে, সে ছাড়াও এখানে হিদেও তামুরা এবং কিমিকো ককা আছে। কিমিকো আর তার স্বামী শিগেকাযু এই প্রপার্টির মালিক। কিমিকোর বয়স প্রায় পঞ্চাশ। চুলে ধূসর রং ধরা শুরু হয়ে গেছে।

হারুমি বিক্রেতাদের দিকে তাকাল। হিদেও আর কিমিকো সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। শিগেকাযু কারও দিকে তাকাতে চাইছে না। কী কাপুরুষ। ভাবল হারুমি। কোনো সমস্যা থাকলে অন্ততপক্ষে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সেটা বলার সাহস করো।

ব্যাগ থেকে একটা কলম বের করল সে, ‘কোনো আপত্তি নেই।’ সে সাইন করে স্ট্যাম্প বসিয়ে দিলো।

‘ধন্যবাদ।’ এজেন্ট বলল, ‘আমাদের কাজ সম্পন্ন হলো। অভিনন্দন।’ সে কাগজপত্র গুছিয়ে নিলো। নিজের কাজে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে মনে হয়। হবেই না কেন? বেশ কষ্টের কাজ, কিন্তু তাতে চমৎকার বেতনও পায় সে।

দুপক্ষ তাদের কাগজপত্রের কপি নিলে শিগেকায়ু উঠে দাঁড়াল। কিমিকো টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। হারুমি একটা হাত বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। অবাক হলো কিমিকো।

‘কাজ শেষ। হ্যান্ডশেক করা যাক।’

‘ওহ, আচ্ছা,’ কিমিকো হ্যান্ডশেক করল, ‘উম, দুঃখিত।’

‘কেন?’ হাসল হারুমি, ‘দুঃখিত হবার কিছু নেই। এতে সবারই লাভ হলো।’

‘হ্যাঁ, তা সত্যি কিন্তু কিমিকো হারুমির দিকে তাকাচ্ছিল না।

‘এই,’ শিগেকায়ু খেঁকিয়ে উঠল, ‘চলো। বের হবো এখান থেকে।’

‘আচ্ছা।’ কিমিকো তার মায়ের দিকে ঘুরল। যার চোখে শূন্য দৃষ্টি।

‘আন্টির কথা ভাবতে হবে না,’ হিদেও হারুমির বড়ো খালা হলেও হারুমি সবসময়ে তাকে আন্টি বলেই ডাকে, ‘আমি তাকে বাড়ি নিয়ে যাবো।’

‘তাই? আমি নাহয় নিয়ে যেতাম। তোমার সমস্যা হবে নাতো?’

‘আমার কোনো কিছুতেই সমস্যা নেই।’ হিদেও বলল।

‘আচ্ছা তাহলে, ভালো থেকো হারুমি।’

‘তুমিও,’ বলার আগেই শিগেকায়ু বেরিয়ে গেল। আর তার পিছু পিছু কিমিকো।

ব্যাংকের বাইরে এসে, হারুমি হিদেওকে নিয়ে তার বিএমডাব্লিউতে উঠে গেল। বাড়ি ফিরছে। সত্যি বলতে সেটা আর হিদেওর নেই। তামুরা হাউজ এখন হারুমির প্রপার্টি। আজকের কন্ট্রাক্টে তা লিখিত হয়ে গেল।

সেই বসন্তে তার বড়ো খালু বৃদ্ধ বয়সে মারা যান।

বাড়িটার কী হবে? খালু অসুস্থ হবার পর থেকেই হারুমির মাথায় প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল।

একসময় তামুরাদের অনেক জমিজমা ছিল। কিন্তু এখন কেবল এই বাড়িটাই আছে।

তিন বছর ধরে জাপানে রিয়েল এস্টেটের দাম আকাশচুম্বী। টোকিও থেকে মাত্র দুঘণ্টার দূরত্বে থাকা তামুরা হাউজটা যদিও একটু পুরোনো, কিন্তু যথেষ্ট দামি। অর্থাৎ কিমিকো আর বিশেষত শিগেকার নজর পড়বে এর ওপরে। এই দুজন কিছু বেআইনি চুক্তিতে জড়িয়ে গিয়েছিল কিন্তু মনে হয় না সেসব লাভজনক হচ্ছে।

বড়ো খালুর বুদ্ধিস্ট সার্ভিসের (মৃত্যুর পরের একধরনের অনুষ্ঠান) পর দিন, খালু মারা যাবার উনপঞ্চাশ দিন পরে, কিমিকো তার মাকে ফোন করে। বলে যে বাড়ির মালিকানা নিয়ে জরুরি কথা আছে।

কিমিকো প্রস্তাব দিলো যে এই বাড়িটাই যেহেতু তার বাবার একমাত্র সম্পত্তি, তাহলে এটা তার ভাগাভাগি করে নেবে। বাড়িটা যেহেতু দুভাগে ভাগ করা যাচ্ছে না, তাই পুরো মালিকানাটা কিমিকোর নামে দিয়ে দেওয়া হবে। এরপর সে হিদেওকে অর্ধেক টাকা দিয়ে দেবে। যদিও এরপর থেকে এ বাসায় থাকতে হলে হিদেওকে ভাড়া দিতে হবে। সেটা সহজ করে দেওয়ার জন্য কিমিকো হিদেওর অংশ থেকে টাকা কেটে রাখবে। সহজ হিসাব।

প্রথমে শুনলে মনে হয় ন্যায়সঙ্গত একটা সমাধান কিন্তু হিদেও যখন হারুমিকে সবটা জানালো, তখন হিদেও বুঝতে পারল এখানে সমস্যা আছে। শেষমেশ দেখা যাবে কিমিকো হিদেওকে একটা পয়সাও না দিয়েই বাড়ি দখল করে নেবে। তাছাড়া কিমিকো বাড়িটা যখন-তখন বিক্রি করে দিতে পারে। হিদেও কোনো ভাড়াটে না, তার নিজের মা। তাকে ঐ বাড়ি থেকে কিমিকো সহজেই বের করতে পারবে। এমনটা হলে তখন হিদেওকে তার অংশের পুরো টাকা দিতে হবে। কিন্তু কিমিকো জানে তার মা তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কোর্টে যাবে না।

হারুমি এটা ভাবতে চাইল না যে, হিদেওর নিজের কন্যাই তার বিরুদ্ধে এমন কুচক্রী পরিকল্পনা করছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে শিগেকার হাত আছে।

হারুমি হিদেও আর কিমিকোকে প্রস্তাব দেয় দুজনকেই বাড়ির মালিক হয়ে বাড়িটা হারুমির কাছে বিক্রি করে দিতে। তারা টাকা ভাগ করে নেবে আর হিদেও আগের মতো সেই বাড়িতে বসবাস করতে থাকবে।

হারুমি যখন কিমিকোকে এটা জানালো তখন শিগেকাযু বলে উঠে, ‘কেন? আমাদের পরিকল্পনাটা খারাপ কী?’

কিন্তু হিদেও এটা বলে, ‘আমার মনে হয় হারুমি বাড়িটা কিনে নেওয়াই সবার জন্য মঙ্গলজনক।’

শিগেকাযু আর কিছু বলেনি। তার তো এখানে শুরুতেই কিছু বলার কথা না।

.

হারুমি হিদেওকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে রাতটা সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। সকাল সকালই আবার বেরিয়ে পড়তে হবে। শনিবারে তার কোম্পানি বন্ধ থাকে কিন্তু সামনের বড়ো প্রজেক্টটার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে। টোকিওতে একটা বড়ো পার্টিতে সভাপতিত্ব করতে হবে। ক্রিসমাসের হুল্লোড় আরকি। দু’শ টিকেট প্ৰায় সাথে সাথেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।

ফুটনে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে হারুমি। বিশ্বাস হচ্ছে না এই বাড়িটা এখন তার। অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সময়ে যেমন লাগছিল, এখনকার অনুভূতিটা তার চেয়ে আলাদা।

এটা কোনো রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগ না। হিদেও মারা গেলেও সে এই বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরে রাখবে।

সবকিছু চমৎকার চলছে। এতটা চমৎকার যে ভয় হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয় যেন কেউ তাকে সুরক্ষা দিচ্ছে।

সবকিছুর শুরু সেই চিঠি থেকে।

সে চোখ বন্ধ করল। চোখের সামনে শেষ চিঠির শব্দগুলো ভেসে উঠল। নামিয়া জেনারেল স্টোরের শেষ চিঠি।

প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছে, কিন্তু আস্তে আস্তে হারুমি চিঠির পরামর্শ মেনে চলার জন্য নিজেকে মানিয়ে ফেলে। আর কোনো প্ল্যান মাথায় আনেনি। সে বুঝতে পারে তমিওকার মতো কারও ওপর ভরসা করে চলা যাবে না আর অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলে তার কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না।

কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা টেকনিক্যাল কলেজে ক্লাস করা শুরু করে। বাড়তি সময়ে সে স্টক আর রিয়েল এস্টেট নিয়ে পড়াশোনা করত আর বেশ কিছু সার্টিফিকেট জমিয়ে ফেলে।

রাতে সে ক্লাবে কাজ করত। কিন্তু ঠিক করে নিলো সাত বছরের মাঝেই এখান থেকে বের হতে হবে। নিজেকে সময় দেওয়ার পর সে আরও বেশি প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। ক্লাবে বাকি মেয়েদের চেয়ে তার কাস্টমারের সংখ্যা বেড়ে যায়। এমনকি সেলও বাড়ে। তমিওকাকে প্রত্যাখ্যান করার পর সে আর ক্লাবে আসত না। কিন্তু হারুমি এই ক্ষতি সহজেই পুষিয়ে নেয়। পরে জানা যায়, অনেক ব্যাবসা দাঁড় করানোয় তার হাত থাকার দাবিটা খুব সামান্যই সত্যি। মানুষ কেবল তার কাছে মতামত চাইতো। এটুকুই তার অবদান।

১৯৮৫ সালে হারুমি আসল যুদ্ধে নেমে পড়ে। গত কয়েক বছরে সে যথেষ্ট টাকা জমিয়েছে, প্রায় ত্রিশ মিলিয়ন ইয়েন। আর এখন অবশেষে রিয়েল এস্টেট কেনার জন্য সে প্রস্তুত। ইয়োটসুয়ার পুরোনো একটা বিল্ডিং কিনল। এটা সস্তায় বিক্রি হবে না আর হারুমি জানত এর থেকে তার কোনো বড়ো লোকসানের আশঙ্কা নেই।

কয়েক মাস পরে, অর্থনীতির মোড় ঘুরতে শুরু করে। প্লাজা অ্যাকর্ডের (১৯৮৫ সালে জি-৫ ন্যাশনের মধ্যে করা ব্যাবসায়িক চুক্তি) কারণে ডলারের দাম পড়ে যায় আর ইয়েনের দাম বাড়তে থাকে। হারুমির গায়ে কাটা দেয়। জাপানিজ অর্থনীতি রপ্তানি ব্যাবসার ওপরে অনেক নির্ভর করে। যদি ইয়েন আকাশচুম্বী হতে থাকে তবে পুরো দেশই হতাশায় ডুববে।

এতদিনে হারুমি স্টকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। সে জানে বাজার কমে গেলে তার স্টকের দাম পড়ে যাবে। এমনটা কীভাবে হতে পারে? নামিয়া জেনারেল স্টোর যা ভবিষ্যৎবাণী করেছিল ঠিক তার উলটো হচ্ছে কেন?

কিন্তু সব কিছু খারাপের দিকে মোড় নেয়নি। বাজার খারাপ হয়ে যাওয়ায় জাপানিজ সরকার একটি সহজ অর্থনীতি জারি করে এবং সরকারি উদ্যোগে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।

১৯৮৬ সালের গ্রীষ্মে সে একটি ফোন পায়। ফোনটি করেছিল সেই রিয়েল এস্টেটের অফিস থেকে যেটা তার প্রথম অ্যাপার্টমেন্টের দালালি করেছিল, ‘দেখা যাচ্ছে, আপনি এখনও অ্যাপার্টমেন্টে উঠেননি।’ তারা বলে, ‘কিন্তু আমরা কেবল জানতে চাচ্ছি যে আপনি শীঘ্রই ওঠার পরিকল্পনা করছেন কিনা।’

হারুমি সোজা উত্তর দেয়নি। এজেন্ট তাকে জিজ্ঞাসা করল সে ওটা বিক্রি করতে চায় কিনা। এমন হলে তারা সেটা আবার কিনে নেবে।

অবশেষে, রিয়েল এস্টেট মার্কেট মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে।

হারুমি তাদের মানা করে দিয়ে ফোন রেখে দিলো। এরপর সোজা ব্যাংকে গিয়ে চেক করল এই অ্যাপার্টমেন্ট জামানত রেখে কত টাকা ঋণ নিতে পারবে। আর টাকার পরিমাণ দেখে খুব অবাক হয় সে। সেটা ক্রয়মূল্যের চেয়েও ৫০ শতাংশ বেশি।

লোন নিয়ে আরও প্রপার্টি কেনা শুরু করল হারুমি। ওয়াসেডার কাছাকাছি একটা ভালো বিল্ডিং পেয়ে কিনে ফেলল। খুব অল্প সময়ের মাঝেই দাম বেড়ে গেল সেটার। রিয়েল এস্টেটের দাম এতটাই বাড়া শুরু হলো যে ইন্টারেস্ট রেট এখন আর কোনো চিন্তার বিষয়ও না।

দ্বিতীয় প্রপার্টিটা জামানত রেখে আবারও লোন নিলো। এবার লোন অফিসার তাকে একটা অফিস খোলার পরামর্শ দেয়। এতে করে তার অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা সোজা হয়ে যাবে। এরপরই সূত্রপাত হয় ‘অফিস লিটল ডগ’ এর।

হারুমির এখন নামিয়া জেনারেল স্টোরের ভবিষ্যৎবাণীর ওপরে পুরো আস্থা এসে গেছে।

১৯৮৭ সালের ফল আসতে আসতে হারুমির কিছু কিছু প্রপার্টির দাম প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়। স্টকের দামও বেড়েছে। ক্লাবের কাজ তখন সে ছেড়ে দেয় কিন্তু কিছু লোকের সাথে যোগাযোগ ছাড়েনি। ইভেন্ট প্ল্যানিংয়ের বুদ্ধি আসে তার মাথায়। তার সব কাজেই সুফল আসছিল। কাজের কোনো অভাব ছিল না।

১৯৮৮ সালে সে তার সমস্ত সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ করল। তার কাছে এখন বিল্ডিং, স্টক, ইকুইটি মেম্বারশিপ আছে। এসবের দামই এখন আকাশচুম্বী। বাজার এখনও খুব ভালো, কিন্তু তাও সাবধানে চলতে হবে। মিস্টার নামিয়ার কথা সে বিশ্বাস করে। বিনিয়োগ আর ক্লাব হোস্টেসের মাঝে তুলনা করে সেই সঠিক পথ দেখিয়েছে তাকে।

১৯৮৮ এর আর মাত্র কয়েক মাসই বাকি আছে। নতুন বছর কী নিয়ে আসবে? ভাবতে ভাবতে ঘুমে ঢলে পড়ল হারুমি।

ক্রিসমাস ক্রুজটা চমৎকারভাবে সফল হলো। হারুমি সকাল পর্যন্ত স্টাফদের সাথে টোস্ট করেছে। কতগুলো ডম পেরিগন রোজের বোতল খুলেছে তার হিসাব নেই। পর দিন সকালে আয়োয়ামাতে নিজের বাসায় যখন তার ঘুম ভাঙল তখন তার প্রচণ্ড মাথাব্যথা।

বিছানা থেকে উঠে টিভি ছাড়ল। খবর চলছে। একটা বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। উদাসভাবে টিভি দেখছিল সে কিন্তু স্ক্রিনের নিচের নামটা দেখে আঁতকে উঠে, ‘মারুমিতসুয়েন অনাথাশ্রমে মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড।’

খবরটা শেষ হয়ে গেল। চ্যানেল বদলে দেখল হারুমি, কিন্তু আর কোথাও এই খবর নেই।

দ্রুত জামা-কাপড় বদলে নিলো নিচে নেমে পত্রিকা খোঁজার জন্য। তার বাড়ির অটোমেটিক লকগুলো বাড়তি সুরক্ষা দেয়। কিন্তু এ কারণে নিজেকেই নিচে নেমে পত্রিকা আনতে হয়

রবিবারে পত্রিকা ভারী থাকে। ফ্লায়ারে ভরা। প্রায় সবই রিয়েল এস্টেটের। পুরো পত্রিকা খুঁজেও কোথাও মারুমিতসুয়েনের খবরটা পেল না। হয়তো শহরের বাইরে বলে সেটা এই পত্রিকায় আসেনি।

হিদেওকে ফোন করল। সে হয়তো স্থানীয় পত্রিকায় খবরটা দেখে থাকবে। তার ধারণা সঠিক। হিদেও লোকাল নিউজ স্টেশনে খবরটা দেখেছে।

২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মারুমিতসুয়েনে আগুন লাগে। একজন নিহত এবং দশ জন আহত। যে মারা গেছে সে অনাথাশ্রমের কেউ না। সে নাকি ক্রিসমাস পার্টিতে গান গাইবার জন্য এসেছিল।

হারুমির ইচ্ছে করছিল সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে সেখানে ছুটে যেতে। কিন্তু নিজেকে কোনো মতে থামাল। কে জানে ওখানের এখন কেমন অবস্থা। সে হুট করে ওখানে উপস্থিত হলে যদি বাড়তি কোনো সমস্যা হয়?

হারুমি এলিমেন্টারি স্কুলের পর মারুমিতসুয়েন থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু এরপর মাঝেমধ্যেই সেখানে যেত। চাকরি পাবার পরও সেখানে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। কিন্তু ক্লাবে ঢোকার পর থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখেছে।

পর দিন অফিসে বসে হিদেওর ফোন পায় হারুমি। স্থানীয় পত্রিকায় অগ্নিকাণ্ডের আরও বিস্তারিত খবর লিখেছে। অনাথাশ্রমের বাচ্চারা নাকি এখন আপাতত নিকটবর্তী এলিমেন্টারি স্কুলের জিমনেশিয়ামে ঠাঁই নিয়েছে।

এই শীতের ডিসেম্বরে একটা জিমনেশিয়ামে থাকা—ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিলো হারুমির

দ্রুত কাজ সেরে নিজের বিএমডাব্লিউয়ে করে ঘটনাস্থলের দিকে ছুটল। যাবার পথে ফার্মেসি থেকে ডিসপোজেবল হ্যান্ড ওয়ার্নারের বাক্স এবং ঠান্ডার ওষুধ কিনে নিলো। বাচ্চাগুলো নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সুপারমার্কেট থেকে তৈরিকৃত খাবার নিয়ে নিলো অনেকগুলো। স্টাফরা রান্না ঘর ছাড়া বাচ্চাগুলোর খাবার কীভাবে তৈরি করছে কে জানে।

ব্যাগগুলো ট্র্যাংকে ভরে গাড়ি ছোটালো। রেডিয়োতে ‘এভরি ওয়ানস সং (মিনা নো উটা)’ চলছে। প্রাণোচ্ছল একটা গানও মন ভালো করতে পারছে না হারুমির। এই বছরটা খুব ভালো কেটেছে। কেবল শেষমেশ এসে এমন এক দুর্ঘটনা।

আসতে আসতে প্রায় দুঘণ্টা লাগল। ছোটোবেলার পরিচিত সাদা দেওয়ালগুলো পুড়ে কালো হয়ে গেছে। পুলিশ আর ফায়ার ডিপার্টমেন্ট এখনও তদন্ত চালাচ্ছে। তারা হারুমিকে ভেতরে যেতে দিলো না। কিন্তু দূর থেকেই ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ পাচ্ছে সে।

জিমটা প্রায় আধমাইল দূরে। হারুমি আসার জন্য ডিরেক্টর ইয়োশিকাযু মিনাজুকি তাকে ধন্যবাদ জানায়।

‘আমাদেরকে দেখতে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আজ তোমার দেখা পাবো এটা আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল। চমৎকারভাবে বড়ো হয়েছো তুমি।’ মিস্টার মিনাজুকি হারুমির বিজনেস কার্ডটা দেখল, ‘আত্মনির্ভরশীল এক মেয়েতে পরিণত হয়েছো।’

মিস্টার মিনাজুকি খুব শুকিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই খুব ধকল গেছে তার ওপর দিয়ে। এখন হয়তো তার বয়স সত্তরের কাছাকাছি।

হারুমির দেওয়া জিনিসগুলো সে সানন্দে গ্রহণ করল।

‘আমি যদি আর কিছু করতে পারি, তাহলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন। আমি যথাসম্ভব সাহায্য করতে চাই।’

‘ধন্যবাদ। এতটা ভরসার বাণী শুনে খুব আশ্বস্ত হলাম।’ চোখ ভিজে এলো মিস্টার মিনাজুকির।

‘দয়া করে ইতস্তত করবেন না। এটাই তো আপনাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ।’

‘ধন্যবাদ।’

বের হবার সময়ে ছোটোবেলার এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো হারুমির : হিরোশি ফুজিকাওয়া। সে হারুমির সাথেই অনাথাশ্রমে থাকত। কিন্তু বয়সে হারুমির চেয়ে চার বছরের বড়ো আর মিডেল স্কুল পাশ করার পরেই বেরিয়ে যায়। এই ছেলেটাই হারুমিকে একটা কাঠের খোদাই করা কুকুর ছানা দিয়েছিল। সেটাকে হারুমি সৌভাগ্যের কবজ মনে করে নিজের সাথে সবসময় রাখে। এখান থেকেই তার অফিসের নামকরণ করেছিল: অফিস লিটল ডগ।

হিরোসি এখন পেশাদার কাঠের কর্মী। সেও হারুমির মতো অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে ছুটে এসেছে। সে এখনও আগের মতো স্বল্পভাষী।

বিদায় জানাবার সময়ে হারুমির মনে হলো হয়তো তাদের মতো অনাথাশ্রমের অনেক প্রাক্তনই ছুটে আসবে।

নতুন বছরের প্রথম দিনে, সম্রাট নতুন যুগের সূচনা করেন—হেইসেই যুগ। এর পরের দিনগুলো অন্যরকম হয়। টিভিতে প্রাত্যহিক প্রোগ্রামগুলো সরিয়ে দেওয়া হয় এবং বছরের প্রথম সুমো ম্যাচ পুরো একদিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়।

সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে হারুমি আরেকবার মারুমিতসুয়েনে যায়। জিমের বাইরে একটা অফিস বসানো হয়েছে, যেখানে মিস্টার মিনাজুকির দেখা পায় হারুমি। বাচ্চাগুলো এখনও জিমেই থাকে, তবে ধ্বংসাবশেষের ওপরে নতুন ভবন তোলার কাজ শুরু হয়ে গেছে। সেটা শেষ হওয়া পর্যন্ত বাচ্চারা আপাতত একটা ডরমিটরিতে থাকবে, যেটার কাজ প্রায় শেষের দিকে।

পুলিশ আর ফায়ার ডিপার্টমেন্ট তদন্ত করে জানতে পারে ক্যাফেটেরিয়ার একটা অ্যান্টিক গ্যাস পাইপের লিক থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তারা বলে বাতাস এতটাই শুষ্ক ছিল যে স্টাটিক ইলেক্ট্রিসিটির জন্য আগুন ধরে যায়।

‘আমাদের আগেই এসব মেরামত করা উচিত ছিল,’ মিস্টার মিনাজুকি বিষণ্ণভাবে বলে।

গায়কটার মৃত্যুতে সে বিশেষভাবে কষ্ট পেয়েছে। ছেলেটা নাকি একটা বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারায়।

‘খুব দুঃখজনক মৃত্যু,’ হারুমি মিস্টার মিনাজুকিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, ‘কিন্তু অন্ততপক্ষে বাচ্চাদের তো কোনো ক্ষতি হয়নি।’

‘হ্যাঁ। এটা রাতের ঘটনা। তখন সব বাচ্চা ঘুমিয়ে ছিল। খুব খারাপ অবস্থা হতে পারত। এ কারণেই আমি স্টাফদেরকে বলছিলাম, পুরোনো ডিরেক্টর স্বর্গ থেকে আমাদের দেখে রাখছেন।’

‘আমার মনে আছে তার কথা। একজন মহিলা ছিলেন, তাই না?’

ঘোলাটেভাবে মনে আছে হারুমির। হালকাপাতলা গড়নের হাসিখুশি এক মহিলা। একসময় সে চলে গেলে নিস্টার মিনাজুকি দায়িত্ব নেয় অনাথ আশ্রমের।

‘সে আমার বড়ো বোন। মারুমিতসুয়েনের প্রতিষ্ঠাতা সেই-ই।’

‘আমি সেটা জানতাম না।’

‘তাই? অবশ্য তুমি যখন এখানে এসেছো তখন খুব ছোটো ছিলে। মনে না-ই থাকতে পারে।’

‘এটা আমি এই প্রথম শুনলাম। উনি অনাথাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কেন?’

‘অনেক লম্বা কাহিনি। আমাদের পরিবারের অনেক সহায় সম্পত্তি ছিল। আমার বাবা-মা মারা যাবার পর আমি আর আমার বোন সেসবের মালিক হই। আমি আমার অংশ নিয়ে একটা কোম্পানি দেই এবং আমার বোন তার অংশ দিয়ে অভাগা বাচ্চাগুলোর জন্য একটা অনাথাশ্রম বানায়। সে যুদ্ধের সময়ে শিক্ষকতা করেছিল। বাপ-মা ছাড়া বাচ্চাগুলো দেখতে তার খুব কষ্ট হতো।

‘আপনার বোনকে কখন হারিয়েছিলেন?’

‘উনিশ… না না, প্রায় বিশ বছর আগে। জন্ম থেকেই হার্ট দুর্বল ছিল তার। সবাই শেষ পর্যন্ত তার পাশে ছিল। যখন মারা যায় তখন মনে হচ্ছিল সে যেন কেবল ঘুমাচ্ছে।’

‘আমি দুঃখিত। এসব জানতাম না।’

‘না জানারই কথা। সে উইলে বলে গিয়েছিল যেন বাচ্চাদেরকে তার মৃত্যুর কথা না জানানো হয়। আমরা তাই সবাইকে বলেছিলাম সে অসুস্থ, চিকিৎসা নিতে গেছে। আমার পুত্র আমার কোম্পানির দেখাশোনা শুরু করে। আর আমি এই অনাথাশ্রমের।’

‘পুরোনো ডিরেক্টর স্বর্গ থেকে আমাদের দেখে রাখছেন—এটা বললেন কেন?’

‘মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছিল, ভয় পেয়ো না, আমি স্বর্গ থেকেও তোমাকে চোখে চোখে রাখব। অগ্নিকাণ্ডের সময়ে এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছিল আমার।’ মিস্টার মিনাজুকি দুর্বলভাবে হাসল, ‘হয়তো আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন কথাবার্তা বলছি।’

‘না, আপনি চমৎকার গল্প বলছেন।’

‘ধন্যবাদ।’

‘আপনার বোনের সংসার ছিল?’

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘সে কখনও বিয়ে করেনি। আজীবন একাই ছিল। বলতে পারো জীবন বিলিয়ে দিয়েছে।’

‘বাহ, খুব দারুণ মহিলা।’

‘স্বর্গ থেকে তোমার কথা শুনলে আমি নিশ্চিত সে একমত হতো না। সে কেবল নিজের জীবন নিজের মতো করে বেঁচেছে। তোমার কথা বলো। বিয়ে-শাদির কথা ভেবেছো? পছন্দ আছে কোনো?’

‘না, নেই,’ হাত নেড়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলো হারুমি।

‘তাই নাকি? একটা মেয়ে কাজের দিকে এত বেশি ঝুঁকে পড়লে কিন্তু বিয়ের সুযোগ হারিয়ে ফেলে। ব্যাবসা চালাচ্ছো ভালো কথা, কিন্তু একটা ভালো সঙ্গীও তো খোঁজা দরকার।’

‘আমি হয়তো আপনার বোনের মতোই নিজের জীবন নিজের মতো করে বাঁচব।’

মিস্টার মিনাজুকি হাসল, ‘তুমি খুব শক্ত মেয়ে। কিন্তু আমার বোন কাজের কারণে বিয়ে থা করেনি, এমন না। সে একটা ছেলের প্রেমে পড়েছিল। প্রায় পালিয়েই যেতে বসেছিল তারা।’

‘তাই নাকি?’

হারুমি কৌতূহল বোধ করে।

‘ছেলেটা তার চেয়েও দশ বছরে বড়ো ছিল। শহরের একটা ছোটো ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। একবার আমার বোনের সাইকেল ঠিক করে দেয়। সেখান থেকেই শুরু। লাঞ্চ ব্রেকের সময় হয়তো দুজনে চুপিচুপি দেখা করত। কিন্তু সেই সময়ে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে একসাথে দেখা মানে প্রায় হট্টগোল লেগে যাওয়া।’

‘আপনার বাবা-মা রাজি হয়নি বলে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল তারা?’

মিনাজুকি মাথা নাড়ল, ‘দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, আমার বোন তখন সবে মাত্র হাইস্কুলে। যেটা কোনো মারাত্মক সমস্যা না। তবে অন্য কারণটা মারাত্মক। আমরা বেশ স্বচ্ছল পরিবার ছিলাম। টাকার পরে মানুষ সম্মানের পেছনে ছোটে। আমার বাবা আমার বোনকে কোনো অভিজাত পরিবারে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কোনো সামান্য মেকানিকের কাছে না।’

হারুমির ভ্রু কুঁচকে গেল। ষাট বছর আগে এসব ঘটা অবাক করার মতো কিছু না।

‘তারপর, পালিয়ে যাবার সময়ে কী হলো?’

‘ভালো কিছু হয়নি। সে প্ল্যান করেছিল স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সময়ে মন্দিরে গিয়ে বেশভূষা বদলে নেবে।

‘কেমন বেশভূষা নেবে?’

‘আমাদের বাসায় অনেক পরিচারিকা ছিল। একজন আমার বোনের বয়সি। আমার বোন তাকে কাপড় নিয়ে মন্দিরে যেতে বলেছিল। সেই পরিচারিকার কাপড় পরে নিলে সে কারও নজরে পড়ত না। ছেলেটাও ছদ্মবেশে স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। আমার বোন তার কাছে কোনোমতে পৌঁছাতে পারলেই তারা পালিয়ে যেতে পারত। প্ল্যান খুব ভালো ছিল তাদের।’

‘এরপর কী হয়?’

‘খুব খারাপ কিছু। আমার বোন মন্দিরে যায় ঠিকই। কিন্তু সেখানে পরিচারিকা ছিল না। বরং আমার বাবার পাঠানো দুজন লোক ছিল। সেই পরিচারিকা আমার বোনকে সাহায্য করার কথা দিয়েছিল। কিন্তু পরে ভয় পেয়ে অন্য এক বয়স্ক পরিচারিকাকে বলে দেয়। এরপর কী হয়েছে তা বুঝতেই পারো।’

হারুমি বুঝতে পারল। পরিচারিকাকে দোষ দেওয়া যায় না। সময়টাই ছিল অন্যরকম।

‘প্রেমিকটার কী হলো?’

‘বাবা একজন লোককে একটা চিঠি দিয়ে স্টেশনে তার কাছে পাঠায়। সেখানে লেখা ছিলো: আমার অস্তিত্ব ভুলে যাও। চিঠিটায় আমার বোনের সাইন ছিল।’

‘তার হাতের লেখা নকল করেছিল কেউ?’

‘নাহ, আমার বোনকেই লিখতে হয়েছিল। আর কোনো উপায় ছিল না। বাবা ছেলেটাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছিল। পুলিশের সাথে বাবার ভালো হাত ছিল। সে চাইলেই ছেলেটাকে জেলে পুরে ফেলতে পারত।’

‘ছেলেটা চিঠি পড়ে কী করে?’

‘আমি যেটুকু জানি, সে শহর ছেড়ে চলে যায়। সে স্থানীয় লোক না। যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই নাকি ফিরে গিয়েছিল। কে জানে। কিন্তু তার সাথে আরও একবার দেখা হয় আমার।’

‘তাই নাকি? কীভাবে?’

‘তিন বছর পর। আমি তখন স্কুলে যাচ্ছিলাম। কেউ আমার নাম ধরে ডাকে। তাকিয়ে দেখি ত্রিশ বছর বয়েসি এক লোক। আমি আগে কখনও মেকানিককে দেখিনি। তাই চিনলাম না। সে আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলে, এটা আকিকোকে দিও। আকিকো আমার বোনের নাম।’

‘লোকটা জানত আপনি তার ছোটো ভাই?’

‘মনে হয় না। সে হয়তো কেবল আমার পিছু করছিল। আমি ইতস্তত করলে সে বলে, কোনো সন্দেহ থাকলে চিঠি খুলে দেখতে পারো, বা তোমার বাবা-মাকেও দেখাতে পারো। কিন্তু আকিকো পর্যন্ত পৌঁছে দিও দয়া করে, তাই আমি সেটা নিলাম। আসলে দেখতে চাইছিলাম সে কী লিখেছিল।’

‘পড়েছিলেন?’

‘অবশ্যই। ওটা সিল করাও ছিল না।’

‘কী লেখা ছিল?’

‘হুম—’ মিনাযুকো যেন কিছু একটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল, ‘তোমাকে দেখাচ্ছি দাঁড়াও।’

‘এখনও আছে?’

‘এক মিনিট। এখানেই কোথাও আছে।’ মিস্টার মিনাযুকো তার অফিসের বাক্সগুলো হাতড়াতে লাগল। সবগুলো বাক্সে ডিরেক্টরের অফিস লেখা।

‘আমার বাক্সগুলো কিচেন থেকে অনেক দূরে ছিল। তাই এগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি। এর মধ্যে অনেক কিছুই আমার বোনের। এই তো, পেয়ে গেছি।’

মিস্টার মিনযুকি একটা টিনের বাক্স বের করল। সেটা খুললে হারুমি দেখতে পেল অনেক নোটবুক আর ছবি। সেখান থেকে একটা খাম নিয়ে হারুমিকে দিলো মিনাজুকি। এতে ‘মিস আকিকো মিনাজুকি’ লেখা

‘আমি দেখলে সত্যি কোনো সমস্যা নেই?’

‘অবশ্যই না। সে এটা এমনভাবে লেখেনি যে আকিকো ছাড়া আর কেউ দেখলে সমস্যা হবে।’

‘দেখা যাক তাহলে।’

চিঠিটা কয়েকবার ভাঁজ করা। হাতের লেখাটা চমৎকার। হয়তো ফাউন্টেন পেনের লেখা। কোনো মেকানিকের হাতের লেখা বলে মনে হয় না।

.

অভিবাদন রইল,

এভাবে অনুপ্রবেশমূলক পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য শুরুতেই ক্ষমা চাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম মেইলে পাঠালে এই চিঠি পড়ার আগেই ফেলে দেওয়া হবে।

আকিকো, তুমি কেমন আছো? আমি ইউজি। সেই ইউজি যে কুসুনোকি মিশনারিতে কাজ করত। হয়তো আমাকে ভুলে গেছ, কিন্তু তুমি এই চিঠির শেষ পর্যন্ত পড়লে আমি কৃতজ্ঞ হবো।

কেবল একটা কারণেই এই চিঠি লেখা: ক্ষমা প্রার্থনা। আমি কয়েকবারই চেষ্টা করেছি সেটা করার কিন্তু তা পারিনি। যা হয়েছে তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আমি জানি অনেক দেরি হয়ে গেছে কিন্তু তাও আমার বোকামির জন্য আমি এখন ক্ষমা চাইছি।

তুমি তখন কেবল হাইস্কুলে পড়তে আর আমি তোমাকে আমার দিকে এগোতে উৎসাহ দিয়েছি। এখন ভাবলে মনে হয় এসব খুব খারাপ হয়েছে। তোমার মতো একটা মেয়েকে আমি তার পরিবার ফেলে আমার কাছে চলে আসতে উৎসাহ কীভাবে দিলাম? এর কোনো মাফ নেই।

সব কিছু শেষ করে দিয়ে ভালোই করেছ তুমি। মাঝেমধ্যে ভাবি, তোমার বাবা- মা তোমাকে চাপ দিয়ে এসব করায়নি তো? করিয়েও যদি থাকে, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তুমি আমাকে খুব বড়ো একটা পাপ করা থেকে বাঁচিয়েছো।

আমি আমার নিজের শহরে ফিরে এসেছি। এখানে মাঠে কাজ করি। তোমার কথা মনে হয় না এমন একটা দিনও কাটে না আমার। আমাদের একসাথে কাটানো সময়গুলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় ছিল। এমন কোনো দিন নেই যখন আমি আফসোস করি না। যখন মনে হয় এসব তোমার তরুণ হৃদয়ে কতটা আঘাত করেছে, তখন ঘুমুতেও পারি না।

আকিকো, আমি প্রার্থনা করি তুমি যেন চমৎকার একটা জীবন পাও। এটুকুই বলার ছিল। আশা করি তোমার যোগ্য কাউকে জীবনে খুঁজে পাবে তুমি।

—ইউজি নামিয়া

.

হারুমি মিস্টার মিনাজুকির দিকে তাকাল।

‘পড়ে কী মনে হয়?’ মিনাজুকি জিজ্ঞাসা করল।

‘লোকটা ভালোমানুষ বলে মনে হয়।’

মিনাজুকি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে, ‘আমারও তাই মনে হয়। হয়তো সেসময়ে সে আমার বাবা-মাকে ঘৃণা করত বা আমার বোনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তিন বছর পর সব কিছু ঠিকভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু এটাও জানত যে কেবল বুঝতে পারাই সব না। সে মাফ না চাইলে আমার বোন কখনই শান্তি পাবে না। লোকটা বুঝে গিয়েছিল, আমার বোন তার প্রেমিককে ধোঁকা দেওয়ার অপরাধবোধ মন থেকে সরাতে পারবে না। তাই সে অবশেষে চিঠি লিখে। আমি সেটা বুঝতে পেরে চিঠিটা সোজা আমার বোনকে দেই। বাবা-মাকে জানাবার কোনো প্রয়োজন বোধ করিনি।’

হারুমি চিঠিটা খামে ভরে দেয়, ‘আপনার বোন এই চিঠিটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল।’

‘তেমনই মনে হয়। সে মারা যাবার পর যখন তার ডেস্কে চিঠিটা পাই তখন একটা ধাক্কা খাই। বুঝতে পেরেছিলাম, সেই ছেলেটার সাথে তার মনের বন্ধনটা কখনই ভাঙেনি। একারণে আজীবন একাকী কাটিয়েছে। অন্য কোনো পুরুষকে আর ভালোবাসেনি। মারুমিতসুয়েনে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়। কিন্তু বলো তো, সে এখানে কেন অনাথাশ্রমটা বানালো? এই জায়গায় আমাদের পরিবারের কোনো সম্পত্তি ছিল না। কিন্তু সে এখানেই কেন এটা বানালো? আমার ধারণা ছেলেটার শহর এখানে ধারেকাছেই কোথাও, তাই।’

হারুমি খুব মুগ্ধ হলো। তারা কখনও এক হতে পারেনি ভেবে কষ্ট হলো তার। কিন্তু আকিকো যেভাবে একজন পুরুষকে আজীবন অন্তহীনভাবে ভালোবাসতে পেরেছে, সেটা শুনে ঈর্ষা হলো।

‘সে যেভাবে আমাকে বলেছিল, স্বর্গ থেকে আমাকে দেখে শুনে রাখবে, হয়তো সেই লোকটাকেও দেখেশুনে রাখছে। যদি সে বেঁচে থেকে থাকে আর কী।’ গম্ভীরভাবে বলল মিনাজুকি।

‘হয়তো।’

একটা জিনিস হারুমির খটকা লাগছে। লোকটার নাম। ইউজি নামিয়া। এখানে কয়জন নামিয়া থাকতে পারে?

মিস্টার নামিয়ার প্রথম নাম কখনও জানা হয়নি। তবে শিযুকো যা যা বলেছে তাতে মনে হয়েছে ১৯৮০ সালে লোকটার বেশ বয়স হয়ে গিয়েছিল। খুব সম্ভবত মিস্টার মিনাজুকির গল্পের লোকটার বয়সিই।

‘কিছু ভাবছ?’

‘না না, তেমন কিছু না।’

‘যাই হোক, আমার বোন যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানের জন্য মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়েছে, তাই আমি একে আবার তৈরি করছি।’

‘এটা খুবই মহান উদ্যোগ। আমি যথাসম্ভব সহায়তা করব।’ হারুমি চিঠিটা ফিরিয়ে দিলো।

খামে লেখা আকিকো মিনাজুকি নামটা আবার দেখল সে। হাতের লেখাটা নামিয়া জেনারেল স্টোর থেকে পাওয়া চিঠির হাতের লেখার সাথে অনেক তফাৎ।

এটা নিশ্চয়ই কোনো কাকতালীয় ব্যাপার।

হারুমি এ নিয়ে আর মাথা ঘামালো না।

ঘুম থেকে উঠেই জোরে হাঁচি দিলো হারুমি। সারা গায়ে কম্বল পেঁচিয়েও কাঁপছে সে। আগের রাতে এত গরম ছিল যে এয়ার কন্ডিশনে কয়েক ডিগ্রি নামিয়ে দিয়েছিল। ঘুমাবার আগে তা বাড়াতে ভুলে যায়। বালিশের ওপর বইটা পড়ে আছে। টেবিল ল্যাম্প এখনও জ্বালানো।

ঘড়িতে দেখাচ্ছে এখনও সাতটা বাজেনি। অ্যালার্মটা তখনই বাজবে। কিন্তু বাজার প্রয়োজনও পড়ে না। হারুমি আগেই উঠে যায়।

আজও ব্যতিক্রম হয়নি। সেটাকে বন্ধ করে বিছানা ছেড়ে উঠল। পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। আজ মনে হয় গরম পড়বে অনেক।

বাথরুমে গিয়ে প্রাতরাশ সেরে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হলো। শরীরটা কেমন অদ্ভুতরকম হালকা লাগছে, যেন তার বয়স সেই কুড়িতে আছে এখনও। কিন্তু আয়নার প্রতিবিম্বটা একান্ন বছর বয়সির।

হয়তো স্বপ্নটার কারণে এমন লাগছে। স্বপ্নে দেখেছে সে আবারও যুবতী হয়ে গেছে। মারুমিতসুয়েনের ডিরেক্টর মিস্টার মিনাজুকিও ছিল সেই স্বপ্নে।

নিজের চেহারার দিকে আবার তাকাল। বয়সের ছাপ স্পষ্ট। সেটা জীবনের লাগাম দখল করেছে তার প্রমাণ। লজ্জার কিছু নেই।

চেহারা ধুয়ে মেকাপ করল। এরপর ট্যাবলেটে কিছু জিনিস চেক করে সকালের নাস্তা সারল। কাল রাতে স্যান্ডউইচ আর ভেজিটেবল জুস কিনেছিল। রান্না শেষবার কবে করেছে তা মনে নেই। বেশিরভাগ সময় বাইরেই খায়।

তৈরি হয়ে বের হয়ে গেল। তার গাড়িটা ডমেস্টিক হাইব্রিড। সহজে পরিচালনাযোগ্য। ওসব বিদেশি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতে করতে এখন বিরক্ত। গাড়ি চালিয়ে সকাল সাড়ে আটটার আগেই রোপঙ্গিতে নিজের অফিসে চলে এলো।

গাড়ি পার্ক করে এলিভেটরে উঠবে এমন সময় কেউ ডেকে উঠল, ‘মিস মুতো, মিস মুতো!’

হারুমি ঘুরে দেখল পোলো শার্ট পরা এক লোক এগিয়ে আসছে। চেনা চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে তা মনে নেই।

‘মিস মুতো, প্লিজ, আমাদেরকে সুইটস প্যাভিলিয়নে আরেকটা সুযোগ দিন।’

‘সুইটস?—ওহ!’ এই লোক এক কনফেকশনারি কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। তারা বিশেষ মাঞ্জু বানায়, যেটা বিন পেস্টে ঠাসা এক ধরনের জাপানিজ বান।

‘একটা মাস সময় দিন। সেটা কি সম্ভব? আমরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করব।’

‘আমাদের চুক্তির কথা ভুলে গেছেন? দোকানটা যদি পরপর দুমাস সবচেয়ে খারাপ আয় করে তবে আমরা সেটা খালি করে দেওয়ার অধিকার রাখি। এটা কন্ট্রাক্টেই বলা ছিল।’

‘এজন্যই আমি আপনার সাহায্য চাচ্ছি। কেবল আর একটা মাস সময় দিন।’

‘সেটা সম্ভব না। আমরা ইতোমধ্যে অন্য ভেন্ডর দেখে ফেলেছি।’

হারুমি চলে যাচ্ছিল।

‘কিন্তু আপনি—’ লোকটা বলতে পারছিল না, ‘আমরা প্রমাণ করতে পারব। প্লিজ একটা সুযোগ দিন। এই মুহূর্তে যদি আমরা বেরিয়ে যাই তবে এই ব্যাবসাটা আর কখনও দাঁড়াবে না। প্লিজ কেবল একটা সুযোগ দিন।’

একটা গার্ড এসব দেখে এগিয়ে এলো, ‘কোনো সমস্যা?’

‘এই লোকের এখানে কোনো কাজ নেই। একে বিদায় করুন।’

গার্ডের চেহারার রং বদলে গেল, ‘বুঝতে পেরেছি।’

‘না দাঁড়ান, আমার কাজ আছে এখানে। আমরা বিজনেস পার্টনার। মিস মুতো, মিস মুতো!’

এলিভেটরে ঢোকার সময়েও লোকটার চিৎকার শুনতে পেল সে।

অফিস লিটল ডগ বিল্ডিংটার পাঁচ ও ছয়তলা জুড়ে। শিনজুকুর পুরোনো অফিস থেকে নয় বছর আগে এখানে অফিসটা সরিয়ে আনা হয়। হারুমির অফিস ছয় তলায়।

কম্পিউটারে কিছু জিনিস চেক করে দিনের কাজের জন্য প্রস্তুত হলো সে। তার ইনবক্স ভরতি অপ্রয়োজনীয় মেসেজ। স্পাম ফিল্টার নিজে নিজেই এগুলো ট্র্যাশে ফেলে দিতে পারে, কিন্তু তারপরেও অনেক অপ্রয়োজনীয় মেসেজ এখনও রয়ে গেছে।

ন’টা নাগাদ কিছু মেসেজের উত্তর দিয়ে হারুমি একটা এক্সটেনশনে ফোন করে।

‘গুড মর্নিং,’ এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মিস্টার সতোজিমা ফোন ধরল।

‘আসতে পারবেন?’

‘অবশ্যই।’

এক মিনিট পরেই সতোজিমা চলে এলো। হারুমি তাকে পার্কিং লটের ঘটনাটার কথা বলল।

‘ওই বুড়ো লোকটা? সে নাকি রিসিপশনেও অনেক কথা বলেছে। ভাবিনি সে সোজা আপনার সাথেই কথা বলতে চলে আসবে।’

‘মানে কী? আপনি বলেছিলেন তারা জায়গাটা ছাড়তে রাজি হয়ে গেছে।’

‘আমি সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু মনে হয় লোকটা ছাড়তে চাইছে না। তাদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ।’

‘শুনে খারাপ লাগল কিন্তু আমরাও একটা ব্যাবসা চালাই।’

‘ঠিক বলছেন। এসব আমাদের দেখার বিষয় না।’ সতোজিমা শীতল কণ্ঠে বলল। দু’বছর আগে এক ডেভেলপার একটা শপিং মল রেনোভেশন নিয়ে হারুমির কোম্পানির সাথে চুক্তি করে। সেটাকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে চায়।

তারা বুদ্ধি দেয় মলটা কনফেকশনারি কোম্পানিদের ভাড়া দিতে। সেখানে নানা ধরনের শপ আর ক্যাফে থাকবে। বাকি জায়গায় সমগ্র জাপানের নানা ভেন্ডরের স্যাটেলাইট শপ দেওয়া হবে। এ থেকেই সুইটস প্যাভিলিয়নের উত্থান। এখন সেখানে প্রায় ত্রিশটা শপ আছে। এবং আরও বাড়ছে।

মহিলাদের ম্যাগাজিনে এবং টিভিতে আগ্রাসী বিজ্ঞাপনের ফলে এই প্রজেক্টটা চরম এক সাফল্য বয়ে এনেছে। এখানে যে যে শপ আছে তারা তাদের আসল লোকেশনে চমৎকার লাভের আশা করতে পারে।

কিন্তু একটা জিনিস বানিয়েই ছেড়ে দেওয়া যায় না। রদবদল না করলে লোকজন একঘেয়ে বোধ করবে। একারণে তারা প্রায়ই শপগুলোর অবস্থান অদল বদল করে। কাস্টমারদের মতামত নেয়। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো ব্যাবসাকে এখান থেকে উঠিয়েও দেওয়া হয়। এতে সবাই সাবধানে থাকে। প্রতিটা দোকানই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।

মাঞ্জুর দোকানের মালিক হারুমির নিজস্ব শহরের লোক। হারুমি তাই তাকেই প্রথমে আমন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু তাদের বেস্ট-সেলিং প্রোডাক্ট মাঞ্জুও ইদানীং ভালো বিক্রি হচ্ছে না। দোকানটা সার্ভেতেও শেষ অবস্থানে আছে। তারা জায়গার মান কমিয়ে দিচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় করুণা কাজে আসে না। একারণে ব্যাবসা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

‘থ্রিডি এনিমে করলে কেমন হয়?’ হারুমি জিজ্ঞাসা করল, ‘সেটা ব্যবহার করা যায়?’

‘ডেমো রিল দেখেছি। টেকনিক্যালি সেই পর্যায়ে নেই। ছোটো স্মার্টফোনে ভালো দেখাবে না। তারা নাকি বেটা ভার্সন বানাচ্ছে। সেটা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখি।’

‘ধন্যবাদ। আজকের জন্য এটুকুই চলবে। আর কোনো আপডেট আছে?’

‘না, বাকি সব দেখে দিয়েছি। তবে একটা জিনিস আছে।’ সতোজিমা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, ‘অনাথাশ্রমের ব্যাপারে।’

‘সেটা একটা স্বাধীন উদ্যোগ। কোম্পানির সাথে যুক্ত না।’

‘আমি জানি। কিন্তু আমি আপনার অধীনে কাজ করি বলে জানি। বাইরের লোক তেমনটা নাও ভাবতে পারে।’

‘কী হয়েছে?’

‘কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমাদের কোম্পানি বিল্ডিংটাকে কী

করতে চায় তা জানার জন্য।’

হারুমি ভ্রু কুঁচকালো, ‘ধুর! এমনটা হলো কী করে?’

‘প্রেসিডেন্ট বলে আপনার দিকে মানুষের নজর বেশি। সাধারণ কিছু করলেও

সেটা সাধারণ মনে হয় না। এটা মাথায় রাখবেন দয়া করে।’

‘এটা কী কোনো কটাক্ষপূর্ণ উক্তি?’

‘একদমই না। আমি কেবল বাস্তবিক কথা বললাম।’

‘ঠিক আছে।’

‘আমি আসছি।’ বলে সতোজিমা বেরিয়ে গেল।

হারুমি উঠে জানালার সামনে দাঁড়ালো। কেবল ছয়তলায় দাঁড়িয়ে আছে সে। এটা খুব উঁচুতে না। আরও উঁচুতে উঠে যাওয়া উচিত তাদের। কিন্তু হারুমি যেতে চায় না। সে অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয়ী হতে চায় না। তবুও ওপর থেকে শহরটা দেখলে নিজের অবস্থানটা মনে হয়ে যায় তার।

গত বিশ বছরের সব কিছু মনে পড়ল। সে জানে সময়ের সাথে ব্যাবসা ধরে রাখাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

১৯৯০ এর মার্চে রিয়েল এস্টেটের অতিরিক্ত মূল্য হ্রাস করার জন্য অর্থমন্ত্রী সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের ওপর বিধিনিষেধ জারি করে। এটি অনিবার্য ছিল। জমির দাম তখন এতটাই আকাশচুম্বী হয়ে গিয়েছিল যে কোনো মধ্যবিত্ত পরিবার নিজের বাড়ি বানাবার আশা করতে পারত না।

এই নিষেধাজ্ঞায় জমির দাম আদৌ নামবে কিনা তা নিয়ে কেবল হারুমির একাই সন্দেহ ছিল না। মিডিয়াও সমান তালে প্রচার করছিল যে ‘এই এক ফোঁটা পদক্ষেপে’ মোটেও রাতারাতি দাম নেমে যাবে না।

কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা অর্থনীতিকে এক জোরালো ধাক্কা দেয়।

জাপানিজ মার্কেটে স্টকের মূল্য হ্রাস পায়। তারপরে আগস্টে ইরাকের কুয়েতে আক্রমণ তেলের দাম বাড়ায় এবং মন্দা জোরদার করে।

এবং অবশেষে, সম্পত্তির দাম কমতে শুরু করে।

কিন্তু তখনও কিছু সুবর্ণ সুযোগ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। একমুখী রিয়েল এস্টেট। অনেকে ভেবেছিল অবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে। এই বিশ্বাস ভাঙতে ভাঙতে ১৯৯২ সাল চলে আসে এবং সবাই মেনে নেয় যে কার্নিভাল অবশেষে শেষ হয়েছে।

হারুমি মিস্টার নামিয়ার চিঠি থেকে এসব আগে থেকেই জেনে গিয়েছিল এবং সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। সে সময়ের আগেই জানত রিয়েল এস্টেটের রাজত্ব শেষ হতে চলেছে আর ১৯৮৯ এর মধ্যেই সে স্টক, ইকুইটি মেম্বারশিপ এবং বাকি সব থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নেয়। জাপানি অর্থনীতির ওঠা-নামা সত্ত্বেও সে কয়েক শ’ মিলিয়ন মুনাফা অর্জন করে ফেলে।

বিশ্ব জেগে ওঠার আগেই হারুমি ইতোমধ্যে আগাম খেলায় নেমে গেছে। নামিয়া জেনারেল স্টোর এমন একটি নেটওয়ার্কের আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছিল যা ব্যক্তিগত কম্পিউটারগুলোকে পোর্টেবল টেলিফোনের সাথে সংযুক্ত করবে। প্রতিটি পকেটে একটি সেলুলার ফোন এবং প্রতিটি বাড়িতে একটি কম্পিউটার থাকবে। মিস্টার নামিয়া যদি সঠিক কথা বলে থাকেন, তবে এই সুযোগ হারুমির ছাড়া উচিত না।

হারুমি আশা করেছিল যে কম্পিউটার সংযোগ বাড়িয়ে অভাবনীয় এক যুগের সূচনা করবে। সে অবহিত এবং আপ টু ডেট থাকার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। ১৯৯৫ সালে, ইন্টারনেট যখন তাদের জীবনে অপরিহার্য হতে শুরু করছিল, হারুমি তার পক্ষে কাজ করার জন্য কয়েকজন প্রযুক্তিবিদকে নিয়োগ করে। সে তাদের প্রত্যেককে একটি কম্পিউটার এবং এর সাথে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। এই উদ্ভাবকরা তাদের কম্পিউটারগুলোর সামনে পুরো দিন কাটাত।

অফিস লিটল ডগ হোম পেজ ডিজাইন করার মাধ্যমে ওয়েব বিজনেসে পা দেয়। শুরুর দিকে, তারা তাদের সার্ভিসগুলোর বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য নিজের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছিল। সংবাদপত্র তাদের নিয়ে ফিচার করে এবং প্রতিক্রিয়াটি দুর্দান্ত ছিল: সংস্থা এবং ব্যক্তি—যারা নিজস্ব হোম পেজ পেতে চায় তাদের কাছ থেকে একের পর এক প্রশ্ন আসতে থাকে। এটি ইন্টারনেট সর্বজনীন এবং অবিচ্ছিন্নভাবে অ্যাক্সেসযোগ্য হওয়ার কয়েক বছর আগের কথা। কিন্তু বিজ্ঞাপনের এই নতুন পদ্ধতি তখন থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

পরবর্তী বছরগুলোতে, অফিস লিটল ডগ সুস্পষ্টভাবে সফল হয়েছিল। ওয়েব- ভিত্তিক বিজ্ঞাপন, বিক্রয়, গেম বিতরণ—সব কিছুতেই পারদর্শী হয়ে উঠে তারা। তার স্পর্শ করা সমস্ত কিছুই সোনায় পরিণত হয়েছিল।

নতুন শতাব্দীর প্রথম দিকে, হারুমি অন্যান্য অঞ্চলে শাখা প্রশস্ত করার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে এবং একটি পরামর্শ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল একজন পরিচিত ব্যক্তি, যে একটি রেস্তোরাঁ চালাতো যা কোনোমতে চলতো, লাভের মুখ দেখতে পেত না।

হারুমি ইতোমধ্যে রাষ্ট্র স্বীকৃত ছোটো ব্যাবসা পরিচালনার একজন পরামর্শদাতা। সে এই প্রকল্পের জন্য নিবেদিত কর্মী নিযুক্ত এবং একটি বিশদ বিশ্লেষণ করে। তাদের উপসংহার ছিল যে নিজের বিজ্ঞাপনই যথেষ্ট হবে না; ব্যাবসাটিকে আরও কার্যকর করা হবে এবং একটি শক্তিশালী ভিত্তিতে পুননির্মাণ করতে হবে। এর অর্থ একটি সম্পূর্ণ নতুন মেন্যু এবং ইন্টেরিয়র বানাতে হবে।

রেস্তোরাঁটা যখন তাদের পরামর্শগুলো বাস্তবায়িত করে এবং ব্যাবসার জন্য আবার খোলে, তখন এটি অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। খোলার তিন মাস পরে, সেখানে এমনকি কোনো টেবিল বুক করাও কঠিন ছিল।

হারুমি নিশ্চিত হয় যে পরামর্শে ভালো লাভ আছে, তবে তাকে এটি পুরোপুরি করা দরকার। দুর্বল পারফরমেন্সের মূল কারণটি আলাদা করা সহজ। তবে ব্যাবসা কার্যকর করার জন্য তাদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ফলস্বরূপ দক্ষতা প্রদর্শন করা প্রয়োজন। হারুমি প্রতিভা খুঁজে বেড়ালো। মাঝেমধ্যে তার দল ক্লায়েন্টদের জন্য পণ্য বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল এবং অনেক সময় তারা হৃদয়হীন পরামর্শও দিতে বাধ্য হয়।

তাদের আইটি এবং পরামর্শ বিভাগের দু’টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়ানো অফিস লিটল ডগ অনেক দ্রুত এগোতে থাকে। আর স্বভাবতই এতে হারুমির সাফল্য আসে। হারুমি ‘শিল্পের স্বপ্নদর্শী’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। এটি এক হিসেবে সত্য, তবে নামিয়া জেনারেল স্টোরের চিঠিটি ছাড়া সবকিছু এত ভালো হতো না। এ কারণেই যদি সে কখনও সুযোগ পায়, তবে এই উপকার ফিরিয়ে দেওয়ার মনোভাব রাখে।

এবং পাশাপাশি, মারুমিতসুয়েন তার জন্য যা কিছু করেছিল তা সে ভুলে যায়নি।

সে গুজব শুনেছিল যে মারুমিতসুয়েনের পরিচালনা সেই বছর বিড়ম্বনায় পড়েছিল। গুজবগুলো পরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। ২০০৩ সালে, মিস্টার মিনাজুকি মারা গেলে তার বড়ো ছেলে অনাথাশ্রমটির দায়িত্ব নেয়। কিন্তু যখন তার পরিবহন ব্যাবসায় লস হয়ে যায়, তখন মারুমিতসুয়েনকে চালু রাখার খুব একটা সুযোগ ছিল না।

খবরটি শুনেই হারুমি তাদের সাথে যোগাযোগ করে। দেখা গেল, মিনাজুকির বড়ো ছেলে কেবল নামেমাত্র পরিচালক; আশ্রমটি আসলে তার সহ-পরিচালক মিস্টার কারিয়া চালাচ্ছেন। হারুমি তাকে বলেছিল যে সে কিছু করতে পারে কিনা তা জানাতে এবং প্রয়োজনে বিনিয়োগেরও প্রস্তাব দেয়।

কিন্তু সে আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি সে হারুমিকে বলেও দিয়েছিল যে সে কারও ওপর নির্ভর করতে পছন্দ করে না।

হতাশ হয়ে হারুমি মিনাজুকি পরিবারকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছিল তারা তাকে মারুমিতসুয়েন পরিচালনার দায়িত্ব নিতে দেবে কি না। তবে তাকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করা হয় যে: ‘কারিয়া ইতোমধ্যে এর দেখাশোনা করছে।’

হারুমি মারুমিতসুয়েন সম্পর্কে গবেষণা করে আবিষ্কার করেছিলেন যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফুল টাইম স্টাফদের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে। পরিবর্তে, সন্দেহজনক পদবিসহ অস্থায়ী স্টাফদের সংখ্যা বেশি ছিল। আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে এদের মধ্যে কেউ যে আসলেই আশ্রমে কাজ করত এমন কোনো প্রমাণ হারুমি পায়নি।

সে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেয়। মিস্টার মিনাজুকির মৃত্যুর পরে, অনাথাশ্রমটি প্রতারণামূলক কার্যকলাপে জড়িত হয়ে পড়ে। সে সন্দেহ করেছিল যে কারিয়া মূল অপরাধী। সত্যটি যেন সামনে আসতে না পারে সেজন্য তার ভবন পরিচালনায় সহায়তা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।

এসব এড়িয়ে যাওয়া হারুমির পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাকে কিছু করতেই হয়। হারুমি নিজেকে মারুমিতসুয়েনকে বাঁচাতে পারার একমাত্র উপায় হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল।

হারুমি প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে তথ্যটা পায়। তার নতুন আপগ্রেড হওয়া স্মার্টফোনটিতে সার্চ করতে গিয়ে সে ‘নামিয়া জেনারেল স্টোর—ওয়ান-নাইট স্পেশাল’ আর্টিকেলটা দেখে।

নামিয়া জেনারেল স্টোর—এই নামটা হারুমি কখনই ভুলতে পারে না। আর্টিকেলে ক্লিক করলে একটি ওয়েবসাইটে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সাইটটিতে ঘোষণা করে ১৩ সেপ্টেম্বর নামিয়া জেনারেল স্টোরের মালিকের মৃত্যুর তেত্রিশ বছর পার হওয়া উপলক্ষ্যে তার জন্য একটি মেমোরিয়াল সার্ভিস হোস্ট করা হচ্ছে। এবং তার কাছে যারা পরামর্শের জন্য চিঠি লিখেছিলেন তারা যেন আবার লিখেন এবং সেই পরামর্শ তাদের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে তা জানান। সেখানে মধ্যরাত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়ে মেইল স্লটে চিঠিগুলো দিতে অনুরোধ করছিল।

এটা অবিশ্বাস্য। এত বছর পরে আজ নামটি দেখার আশা সে করেনি। এবং এটি ‘ওয়ান-নাইট স্পেশাল’ কেন? স্পষ্টতই তার পরিবারের কেউ এই সাইটটি পরিচালনা করেছে, তবে এই ঘটনাটি বৃদ্ধ ব্যক্তির মেমোরিয়াল সার্ভিস ছাড়া আর কোনো বৃত্তান্ত বলেনি।

প্রথমদিকে, সে সন্দেহ করেছিল যে এটি অবশ্যই একটি প্র্যাংক। কিন্তু কেউ এমন কেন করবে? মানুষকে বোকা বানিয়ে লাভটা কী? এমনকি কতজন লোক পোস্টটি পড়তে পারে?

হারুমিকে যে বিষয়টি সবচেয়ে গভীরভাবে নাড়া দেয় তা হলো: ১৩ সেপ্টেম্বর সেই বৃদ্ধের মৃত্যুর তারিখ। ঠিক বত্রিশ বছর আগের ১৩ সেপ্টেম্বরে নামিয়া জেনারেল স্টোরের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়।

এটি নিছক ঠাট্টা হতে পারে না। ঘটনাটি আসল। এবং যদি এমনটা হয়ে থাকে তবে সে বসে থাকতে পারে না। আর কেউ কিছু লিখুক বা না লিখুক, অন্ততপক্ষে তাকে একটা কৃতজ্ঞতার চিঠি লিখতেই হবে।

তবে তাকে প্রথমে পরীক্ষা করতে হবে নামিয়া জেনারেল স্টোরটি কি এখনও আছে কি না। হারুমি কয়েক বছরে কয়েকবার তামুরাদের পুরাতন বাড়িতে ফিরেছিল। তবে দোকানটা পর্যন্ত যাবার সাহস করেনি।

সেদিন এমনিতেও তাকে মারুমিতসুয়েনে কাজ ছিল। বিল্ডিং স্থানান্তর সম্পর্কে একটি মিটিং আছে। ফেরার পথে স্টোরটায় যেতে পারবে।

প্রত্যেকবারের মতো, এই মিটিংও সহ-পরিচালক মিস্টার কারিয়ার সাথে হবে। ‘মিনাজুকিরা আমাকে এ বিষয়ে পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়েছে। আপনি জানেন যে, আশ্ৰম পরিচালনার বাইরে থাকাটাই তাদের নীতি।’ কথা বলার সাথে সাথে তার পাতলা ভ্রু কুঁচকে গেল।

‘সেক্ষেত্রে আপনি তাদের সম্পত্তির আর্থিক অবস্থার বিষয়ে তাদের জানাতে পারেন। এটি তাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন করতে পারে।’

‘ধন্যবাদ, তাদের নিয়মিত জানানো হয়। আমি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন এটি ছিল আমাদের চুক্তির অংশ।’

‘ওহ আচ্ছা। আমাকে তথ্যগুলো জানাতে আপনার আপত্তি আছে?’

‘আমি আশঙ্কা করছি যে এটি সম্ভব হবে না। এটি আপনার উদ্বেগের বিষয় নয়।‘

‘মিস্টার কারিয়া, আমার কথা শুনুন। যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে এই বিল্ডিংটি ডুবতে বসেছে।’

‘এটি আপনার চিন্তার বিষয় নয়। আমরা কোনো না কোনো উপায় বের করে নেব। সাবধানে বাসায় যাবেন।’ কারিয়া বাউ করল।

হারুমি সিদ্ধান্ত নিলো আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। তবে তার হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তাকে কেবল মিনাজুকিদের বোঝানোর একটা উপায় বের করতে হবে।

পার্কিংয়ে সে দেখতে পেল তার গাড়িতে কাদা ছোঁড়া হয়েছে। সে ঘুরে দেখল কয়েকটা বাচ্চা বেড়ার পেছনে লুকিয়ে আছে।

ওহ, সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওরা নিশ্চয়ই ভাবছে আমি খারাপ লোক। কারিয়া তাদের কিছু লম্বা গল্প বলেছিল তাতে সন্দেহ নেই।

গাড়ি পরিষ্কার না করেই সে উঠে বসল। রিয়ারভিউ আয়নায় সে দেখেছিল বাচ্চারা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে ‘ফিরে আসবে না’ বলে চিৎকার করছে।

এই অপ্রীতিকর বিড়ম্বনা সত্ত্বেও, সে নামিয়া জেনারেল স্টোরে যাবার কথা ভোলেনি।

শীঘ্রই সে পরিচিত জায়গাটিতে ফিরে আসে। এই তিরিশটি অদ্ভুত বছরে, এটি মোটেও পরিবর্তিত হয়নি।

স্টোরটি ঠিক যেমন ছিল তেমনই আছে। সাইনটা এখন বুঝা যায় না এবং তার শাটারে মরিচা পড়ে গেছে। যেন কোনো বৃদ্ধ দাদা তার নাতনির অপেক্ষায় বসে থাকার উষ্ণতায় জড়িয়ে আছে।

১২ সেপ্টেম্বর কাজ শেষ করার পরে হারুমি বাড়ি ফিরে চিঠি লেখার জন্য ল্যাপটপ খুলে বসে। সে আরও আগেই লিখতে চেয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে এবং সময় পাচ্ছিল না। সেই রাতেই, তার এক ক্লায়েন্টের সাথে ডিনার করার কথা ছিল। কিন্তু ক্লায়েন্টকে বলে তার খুব জরুরি একটা কাজ পড়ে

গেছে এবং তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মীকে তার জায়গায় পাঠিয়ে দেয়।

বারবার লিখতে লিখতে অবশেষে রাত ন’টার পরে চিঠি লেখা শেষ হয়। তার পরে, সে চিঠিটা হাতে লিখে ফেলে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাতে লেখা তার একটা ব্যক্তিগত নিয়ম।

চূড়ান্ত চিঠির ভুলগুলো পরীক্ষা করে সেটা একটি খামে ভাঁজ করে নিলো হারুমি। বিশেষত এই উপলক্ষ্যেই সে স্টেশনারি এবং খামটি কিনেছিল। প্যাকিং করতে কিছুটা সময় যায়। যখন সে বাসা থেকে বেরোচ্ছিল তখন দশটা বাজে।

দোকানের আশেপাশে পৌঁছতে মাত্র দু’ঘণ্টা সময় লেগেছিল তার। তার পরিকল্পনা ছিল সোজা সেখানেই যাওয়ার। কিন্তু মধ্যরাতের আগে তার কিছুটা সময় বাকি ছিল এবং নিজের ব্যাগগুলো তমুরা হাউজে রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে সে আজকে রাত কাটাবে।

বাড়িটি কেনার পরে, হারুমি হিদেওকে সেখানে বাস করতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত হিদেও বাঁচেননি। তার খালা মারা যাবার পর হারুমি বাসাটার কিছু কাজ করায় এবং একে দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। শৈশব এই বাড়িতেই কেটেছে তার। এখানকার সবুজ শ্যামল ভাবটা সে খুব পছন্দ করে।

গত কয়েক বছরে, এক বা দুমাসে একবার এখানে আসত। রেফ্রিজারেটর খালি ছিল। খাবার-দাবার সব ফ্রিজারে সংরক্ষণ করা থাকত।

বাড়ির আশেপাশের অঞ্চলে স্ট্রিটলাইট খুব একটা ছিল না। এই গভীর রাতে তার গাড়ির হেডলাইটগুলোর আলোয় অন্ধকার দূর করা সম্ভব ছিল না। তবে চাঁদের আলোতে, সে তার পুরোনো বাড়িটি দূর থেকে দেখতে পায়।

কেউ ছিল না সেখানে। তাদের একটি গ্যারেজ আছে, তবে সে রাস্তায় পার্ক করেছে। জামাকাপড় এবং মেকাপের একটি টোটো ব্যাগ কাঁধে করে গাড়ি থেকে বের হলো। বড়ো গোল চাঁদ আকাশে ঝলমল করছে।

গেট পেরিয়ে দরজা খুলল। এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ আসছে। গতবার এয়ার ফ্রেশনারটা রেখে গিয়েছিল সে। সেটার পাশে চাবিগুলো রাখল।

দেওয়াল ধরে ধরে লাইট সুইচ খুঁজে বের করল সে। এরপর জুতো খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। স্লিপার ছিল, তবে সেগুলো খুব একটা পরে না সে। হল পেরিয়ে শোবার ঘরে ঢুকল।

শোবারঘরের বাতি জ্বালাবার আগেই ব্যাপারটা টের পেল সে। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। যেন অদ্ভুত কিছু একটার গন্ধ পাচ্ছে। এমন এক ভিন্ন গন্ধ যা তার শোবার ঘরে থাকে না।

বিপদ অনুভব করে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু লাইট জ্বালানোর আগে কিছু তার হাত ধরে ফেলে। তার হাত মুচড়ে তার মুখের উপরে কিছু চেপে ধরে। এমনকি তার চিৎকার করার সুযোগও ছিল না।

‘চুপ করে থাকুন, আমরা আপনার কোনো ক্ষতি করব না।’ লোকটি তার পেছনে ছিল। হারুমি তার চেহারা দেখতে পেল না।

চিন্তাভাবনা শূন্য হয়ে এলো হারুমির। এই লোকটি তার বাড়িতে কী করছে? কেন এসেছে? কেন তার সাথে এই ঘটনা ঘটেছে? হুট করে একসাথে অনেক প্রশ্ন লাফিয়ে উঠে তার মনে

সে লড়াই করতে চাইছে কিন্তু তার শরীর নড়ছে না। যেন স্নায়ু পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়েছে।

‘এই, আমি বাথরুমে কিছু তোয়ালে দেখেছি। কয়েকটা নিয়ে এসো তো।’ লোকটি চিৎকার করছে, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। বিরক্ত হয়ে আবার বলল, ‘আমার তোয়ালে দরকার! স্ট্যাট!’

অন্ধকারের মধ্যে লোকটার ছায়া কাটিয়ে অন্য একটি ছায়া অনুভব করল হারুমি। অন্য কেউও আছে এখানে।

হারুমি নাক দিয়ে প্রচণ্ড নিশ্বাস ফেলল। তার হার্টবিট এখনও বেড়ে আছে, তবে ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ফিরে আসছে। সে বুঝতে পারল যে তার মুখের ওপরে কী চেপে আছে—ল্যাটেক্স-গ্লাভ পরিহিত একটি হাত।

‘ইশ,’ তার পেছনে পাশ থেকে আরেকজনকে ফিসফিস করে বলল।

‘খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে,’ হারুমিকে ধরে রাখা লোকটা বলল, ‘এসো, ব্যাগটাতে খোঁজো। ওখানে সম্ভবত কোনো মানিব্যাগ বা কিছু আছে।’

ব্যাগটি হারুমির কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। কেউ তার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছে। ‘পেয়েছি,’ একটি কণ্ঠ অবশেষে বলল।

‘কত?’

‘কেবল বিশ, তিরিশ হাজার এবং একগুচ্ছ র‍্যান্ডম পয়েন্ট কার্ড।’

লোকটি হারুমির কানের কাছে শ্বাস ফেলল। ‘এটাই? যাই হোক। শুধু নগদ নিয়ে নাও। এই কার্ডগুলো কোনো কাজে দেবে না।’

‘মানিব্যাগের কী হবে? এটি ভালো ব্র্যান্ডের।’

‘এটি ভেঙে গেলে আর ভালো থাকবে না। ব্যাগটি বেশ নতুন; এটা আমরা নিয়ে নেবো।’

কারও পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। ‘এইটা ঠিক আছে?’ নতুন কণ্ঠস্বরটি অন্যদের চেয়ে তরুণ।

‘ঠিক আছে। চোখ বাঁধা যাবে। এটিকে তার মাথার পেছনে এমনভাবে বাঁধো যাতে আলগা না হয়।’

লোকটা যেন তাৎক্ষণিকভাবে দ্বিধা বোধ করল। কিন্তু তারপর এক সেকেন্ড পরেই একটি তোয়ালে দিয়ে তার চোখ বেঁধে দিলো। লন্ড্রি ডিটারজেন্টের মতো কিছুটা গন্ধ লাগল। এটি হারুমি সবসময় ব্যবহার করে।

গলায় তোয়ালেটা শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছিল।

এরপরে, তারা হারুমিকে ডাইনিং রুমের টেবিলে বসিয়ে তার উভয় কব্জি তার পেছনে ব্যাকরেস্টে বেঁধে রাখে এবং তার পায়ের গোড়ালিকে চেয়ারের পায়ে বাঁধে। পুরোটা সময়, গ্লাভস পরা হাতটি তার মুখে চেপে রইল।

‘আমরা আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই,’ হারুমির মুখ চেপে ধরে রাখা লোকটা, যে খুব সম্ভবত এদের লিডার, সে বলল, ‘আমি আমার হাত সরিয়ে নিচ্ছি, তবে এরপর আপনি কোনো ঝামেলা তৈরি না করাই ভালো। বিশ্বাস করুন, আপনি আমাদের অস্ত্র দেখতে চাইবেন না। যদি আপনি চিৎকার শুরু করেন, আমরা আপনাকে হত্যা করব। তবে আমরা সেটা করতে চাই না। শান্ত কণ্ঠে কথা বলুন এবং আপনার ক্ষতি হবে না। আপনি যদি শান্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন তবে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলুন।’

অমান্য করার কোনো কারণ নেই বলে হারুমি মাথা নাড়ল। হাত ওর মুখটা ছেড়ে দিলো।

‘সুতরাং, আপনি সম্ভবত ইতোমধ্যে অনুমান করে ফেলেছেন যে আমরা ডাকাত। আমরা ভেবেছিলাম বাড়ি খালি। আশা করিনি আপনি আসবেন এবং আপনাকে এইভাবে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। কিছু মনে করবেন না।’

নির্বাক, হারুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কিছু মনে করবেন না’ বলার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। এটা এখন অর্থহীন।

এবং তবুও, কেন যেন মনে হলো এই ছেলেগুলো সত্যিকারের গুন্ডা নয়।

‘আমরা যা নেবার জন্য এসেছি তা পেয়ে গেলেই আমরা চলে যাবো। তবে আমরা এখনও যেতে প্রস্তুত নই, কারণ আমরা নেবার মতো কোনো কিছুই এখনও পাইনি। আমাদের আপনার মূল্যবান জিনিস দরকার। সেগুলা কোথায় রাখেন? আমরা বাছাই করি না। যে-কোনো কিছু হলেই হবে। সত্যি করে বলুন কোথায় আছে।’

হারুমি তার দম ধরল, ‘এখানে কিছু নেই—’

‘আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না।’

‘আমি সত্যি বলছি।’ হারুমি মাথা নাড়লো, ‘খুঁজে দেখতে পারেন। আমি প্রায়শই এখানে থাকি না। এ কারণেই এখানে কোনো টাকা বা মূল্যবান কিছু নেই।’

‘আপনি এটি বলতে পারেন, তবে কিছু না কিছু তো আছে।’ কণ্ঠস্বরটি কাতরাচ্ছিল। ‘আরও চিন্তা করুন। কিছু না কিছু খুঁজে পাবেন। আপনি মনে না করা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি। আপনি তা পছন্দ করবেন না, তাই না?’

কিন্তু হারুমির কাছে তাকে বলার মতো কিছুই ছিল না। পুরো বাড়িতে মূল্যবান কিছুই নেই। হিদেওর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা যা পেয়েছিল তার সব শহরের অ্যাপার্টমেন্টে।

‘পাশের ঘরে একটি আলকোভ আছে, তাতামি ঘরের পাশের ঘরে। সেখানের বোল সেটটা একটি বিখ্যাত স্টুডিয়োর।’

‘আমরা সেটি পেয়েছি। এবং এর পেছনে দেওয়ালে ক্যালিগ্রাফি স্ক্রোলও। আর কী কী আছে?’

হিদেও তাকে বলেছিল যে বোলটি আসল, তবে স্ক্রোল স্ক্রিনটি আসল না। হারুমি ভাবল সেটা তাদের না বলাই শ্রেয়।

‘আপনি কি শোবার ঘরটি দেখেছেন? ছোটোটি।’

‘হ্যাঁ, ভালো কিছু দেখতে পাইনি।’

‘ড্রয়ারগুলো? দ্বিতীয়টির নিচে একটি ফলস বাটন আছে এবং নিচের অর্ধেকটি গহনাতে পূর্ণ। সেটা দেখেছেন?’

লোকটি তার জবাব দেয়নি। সে তার বন্ধুদের কাছে ইঙ্গিত করছে বলে মনে হয়।

‘যাও দেখে এসো।’ আদেশ দিলে কেউ একজন উঠে পড়ল।

ড্রেসারটি হিদেওর। সত্যিই একটা সিক্রেট ড্রয়ারে গহনা ছিল, তবে এটি হারুমির না। হিদেওর মেয়ে কিমিকো যখন অবিবাহিত ছিল তখন সে ওগুলো কিনেছিল। হারুমি কখনও সেগুলো খুলে দেখেনি কিন্তু মনে হয় সেখানে তেমন মূল্যবান কিছু নেই। যদি সেখানে থাকত, কিমিকো তার বিয়ে করার সময় সেগুলো নিয়ে যেত।

‘আপনি কেন আমাকে-আমার বাড়িতে ছিনতাই করতে এলেন?’ হারুমি তাদের জিজ্ঞাসা করল।

‘এমনিতেই।’

‘আপনার অবশ্যই কোনো না কোনো কারণ আছে।’

‘চুপ করুন! তাতে কিছু যায় আসে না।’

‘এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’

‘মুখ বন্ধ করুন।’

হারুমি তার কথা শুনল। শত্রুদের উৎসাহিত করা ঠিক না।

অবাস্তব নীরবতার শেষে কেউ বলে উঠল, ‘আমি যদি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি তবে কি আপনি উত্তর দেবেন?’ এটি লিডারের কণ্ঠ না। হারুমি এত ভদ্ৰ কিছু আশা করেনি।

‘এই,’ লিডার খেঁকিয়ে উঠল, ‘তুমি কী বলছো?’

‘আহা। আমি দেখতে চাই সে কী বলে।’

‘ভুলে যাও।’

হারুমি বলল, ‘আমাকে যে-কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’

‘আপনি কি সত্যিই এটি একটি হোটেল বানাবেন?

‘কী করব?’

‘আমি শুনেছি আপনি মারুমিতসুয়েনকে ভেঙে লাভ হোটেল (স্বল্প সময় অবস্থানের জন্য জাপানে শুরু হওয়া এক ধরনের হোটেল। এগুলোতে অতিথিদের প্রাইভেসির ক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষ রাখা হয়) বানাতে যাচ্ছেন।’

এমন কিছু শোনার আশা করেনি হারুমি। নিশ্চয়ই কারিয়া এদের পাঠিয়েছে। ‘আমি এমন কিছুই করব না। আমি এই বিল্ডিংটি সংস্কার করে অনাথাশ্রমের দায়িত্ব নেবার আশা করছি।’

‘সবাই জানে এটা কেবল একটা ছদ্মবেশ,’ লিডার বাধা দিলো। ‘আপনার সংস্থা মৃত-প্রায় ব্যাবসাগুলোকে নিজের মতো করে পরিবর্তন করে টাকা কামাই করে। যেমন করে বিজনেস হোটেলকে লাভ হোটেল বানিয়ে ফেলেছেন।’

‘আমরা সেই কাজটি নিয়েছিলাম। তবে এর সাথে সেটার কোনো যোগসূত্র নেই। আমি নিজেই মারুমিতসুয়েন প্রকল্পে অর্থায়ন করছি।’

‘মিথ্যাবাদী।’

‘মিথ্যা বলছি না। আমি সেখানে কখনও কোনো লাভ হোটেল তৈরি করবও না। কেউ সেখানে আসবে না। আমি কোনো বোকা নই। আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি অসহায়দের বন্ধু।’

‘সত্যি?’

‘ড্যুড, সে অবশ্যই মিথ্যা বলছে। তার কথা শুনবে না। অসহায়দের বন্ধু? কী ফালতু কথা। লাভ হবে না এমন কোনো কাজে এই মহিলা জড়াবে না।’

সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামার শব্দ হলো।

‘এত দেরি করলে কেন?’

‘ফলস বাটনটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে আমি এটি পেয়েছি। দেখো এগুলো।’

কস্টিউম জুয়েলারির ঝংকার এলো। নিশ্চয়ই পুরো ড্রয়ারটি নামিয়ে এনেছে।

অন্য দুজন চুপচাপ ছিল। তারা সম্ভবত গণনা করে যাচ্ছিল যে ট্রাইফলসের জঞ্জাল সম্ভবত কতটা মূল্যবান হতে পারে।

‘ঠিক আছে, এটি নিয়ে নাও,’ কেউ আদেশ দিয়েছে, ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ব্যাগে রাখো।’

হারুমি জিপার খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ পায়। তারা তাদের লুটপাটের ব্যাগে জিনিসপত্র রাখছে।

‘একে আমাদের কী করা উচিত?’ যে লোক মারুমিতসুয়েন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিল সে জিজ্ঞাসা করল।

লিডার বলল, ‘ডাক্ট টেপ আনো। আমরা কোনো ঝামেলা চাই না।’

টেপ ছিঁড়তে শুনল হারুমি। তারপর অনুভব করল যে এটি তার মুখে আটকে দেওয়া হয়েছে।

‘আমরা তাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারি না। যদি কেউ এসে তাকে খুঁজে না পায় তাহলে সে অনাহারে মারা যাবে।’

‘একবার আমরা নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলে, আমরা তার কোম্পানিকে কল করব এবং বলব যে তাদের প্রেসিডেন্ট আটকে আছে। ব্যস, হয়ে গেল।’

‘যদি তাকে বাথরুমে যেতে হয়?’

‘ধরে রাখতে পারবে সে।’

‘আপনি কি চাপ ধরে রাখতে পারবেন?’ তারা হারুমিকে জিজ্ঞাসা করছিল।

সে মাথা নেড়ে বলল। প্রকৃতপক্ষে, তাকে এখন বাথরুমে যেতে হবে না। এমনকি তারা যদি তাকে বাথরুমে আনার প্রস্তাব দেয় তবে সে তা অস্বীকার করত। এরা যত দ্রুত চলে যাবে ততই মঙ্গল।

‘ঠিক আছে, চলো যাই তবে।’ লিডার আদেশ দিলো। ‘কিছু ভুলে যেও না।’ হারুমি বুঝতে পারল তিনজনই ঘর ছেড়ে চলে গেছে। তাদের পায়ের শব্দ হলো এবং সামনের দরজার বাইরে গিয়ে পড়েছে।

একটু পরে, সে আবার তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। তাদের কেউ ‘গাড়ির চাবি’ বলছে।

হারুমির মনে পড়ল সে চাবি শু ক্যাবিনেটে রেখেছিল।

‘শিট,’ ঠোঁট কামড়ালো। তার হ্যান্ডব্যাগটি রাস্তায় পার্ক করা গাড়ির সামনের সিটে রাখা। গাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সে ওটাকে টোট ব্যাগ থেকে বের করেছিল। তার টোট ব্যাগের ভেতরে মানিব্যাগটি ছিল তার ব্যাকআপ। আসল মানিব্যাগটি ছিল হ্যান্ডব্যাগে। এতে অন্তত দুই লক্ষ নগদ ইয়েন আছে। তার সমস্ত ক্রেডিট কার্ড এবং ডেবিট কার্ডও।

কথা হলো মানিব্যাগটি নিয়ে সে চিন্তিত না। যদি তারা এই সমস্ত কিছু নেয় তবে সে খুশিই হবে। তারা হয়তো তাড়াহুড়োয় ব্যাগের ভেতরটা লক্ষ না করেই ব্যাগটা ফেলে দেবে।

আর ভেতরে দেখলে নামিয়া জেনারেল স্টোরের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিটা পাবে। সেটা তাদেরকে নিয়ে যেতে দিতে পারে না।

তবে তাতে কী আসে যায়? এমনকি তারা চিঠিটি রেখে গেলেও, খুব সম্ভবত সকাল পর্যন্ত সে আটকে থাকবে। এবং দোকানের ‘ওয়ান-নাইট স্পেশাল’ ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাবে।

হারুমি কেবল ধন্যবাদ বলতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল যে আজ নামিয়া স্টোরের কারণেই সে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে আর তার এই উচ্চ পদমর্যাদা দিয়ে মানুষের উপকার করতে যাচ্ছে। এটাই ছিল ধন্যবাদ বলার সুযোগ।

কিন্তু তারপরেও এটি ঘটতে যাচ্ছে। কেন? সে কি কখনও ভুল করেছে? লিডারের কথাগুলো মনে হলো তার।

অসহায়দের বন্ধু? কী ফালতু কথা। লাভ হবে না এমন কোনো কাজে এই মহিলা জড়াবে না।

এটা একটা ধাক্কা ছিল। সে কখনও কি এমন কিছু করেছিল?

এর পরেই মাঞ্জু কোম্পানির সভাপতির কথা কথা মনে পড়ে গেল।

হারুমি তাকে উড়িয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে হাসল সে।

এতদূর চেষ্টা করেছে এবং এই পর্যন্ত অর্জন করেছে। তবে সম্ভবত সে একটু বেশিই বাস্তববাদী হয়ে গিয়েছিল। এটি একটি সতর্কতা ছিল যে তার হৃদয়কে আরও একটু শিথিল করতে হবে।

হয়তো অবশেষে মাঞ্জুকে সে বাঁচাবে।

১০

বলার উপায় ছিল না, তবে ভোর মনে হচ্ছে কাছাকাছি এসে পড়েছে। আতসুয়া স্টেশনারির ফাঁকা শিটের দিকে তাকালো।

‘তোমার কী মনে হয় এটি সত্যিই সম্ভব?’

‘কী সম্ভব?’ সোতাকে জিজ্ঞাসা করল।

‘এই বাড়িটি অতীতের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে এবং এই চিঠিগুলো এখানে কোনোভাবে চলে আসতে পারে। এবং আমরা যদি মিল্ক ক্রেটটিতে একটি চিঠি রাখি তবে এটি সময়কালে ভ্রমণ শুরু করে।’

‘তুমি এতক্ষণে বুঝলে সেটা?’ সোতার বিস্মিত লাগছিল, ‘হ্যাঁ, এটা সত্যিই ঘটছে। এছাড়া আমরা এসব মানুষের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করলাম?’

‘এটি খুব অদ্ভুত,’ কোহেই একমত পোষণ করেছেন, ‘আজ রাতে ওয়ান-নাইট স্পেশাল হওয়ার সাথে এর কোনো না কোনো সংযোগ আছে।’

‘আসছি আমি।’ হাতে কাগজটা নিয়ে উঠে পড়ল আতসুয়া।

‘কোথায় যাচ্ছো?’ সোতা ডাকল।

‘যাচাই করার জন্য। আমি একটা চেষ্টা করব।

আতসুয়া পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে দরজা শক্ত করে বন্ধ করে দেয়। স্টোরের সামনে চলে গিয়ে স্লটে কাগজটা ফেলে দিলো। গলি দিয়ে পেছনে ফিরে এসে আবারো স্লটের কাছে চলে গেল। বাক্সটা খুলে দেখল ভেতরে কিছু নেই।

‘আমি যেমন ভেবেছিলাম,’ সোতা বিজয়ীভাবে বলল, ‘যদি এখন এই মেইল স্লটে কিছু রাখো, এটি বত্রিশ বছর আগে দোকানে চলে যায়। এটিই ওয়ান-নাইট স্পেশাল-এর প্রভাব। আমরা এই সংযোগের অপর প্রান্তে আছি।’

‘এবং একবার এখানে সকালে হয়ে গেলে, বত্রিশ বছর আগে—?’ আতসুয়াকে জিজ্ঞাসা করল।

‘বুড়ো লোকটা মারা যাবে। যে লোকটি স্টোরের মালিক ছিল।’

‘এটাই হবে।’ আতসুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এটি সত্যিই উদ্ভট একটা ব্যাপার, তবে এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।

‘ওই মেয়েটার কী হলো?’ কোহেই জোরে জোরে বলে উঠে। আতসুয়া ও সোতা দু’জনই তার দিকে তাকিয়ে রইল, ‘ওই যে ডুবিস ডগি। কে জানে তাকে সাহায্য করতে পেরেছি কিনা।

‘কে জানে?’ আতসুয়া বলল, ‘সে সম্ভবত আমাদের বিশ্বাস করেনি।’

তৃতীয় চিঠিটি পড়ার পরে তাদের দ্রুত ভাবতে হয়েছিল। কিছু ছদ্মবেশী লোক মেয়েটার সাথে প্রতারণা করছিল, তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছিল। এবং তারপর তারা জানতে পারল যে মেয়েটাও মারুমিতসুয়েনে বাস করত! তাকে বাঁচানোর জন্য তাদের কিছু করতেই হয়—না, কেবল তাকে বাঁচাতে নয়; তাদের এমন কিছু করতে হয়েছিল যা মেয়েটাকে সফল করে তুলবে।

তাদের তিনজন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা মেয়েটাকে ভবিষ্যৎ জানাবে। আশির দশকে জাপানের অর্থনীতি, তখন কী কী ঘটেছিল, কোথায় বিনিয়োগে লাভ হবে- সে বিষয়ে তারা তাকে পরামর্শ দিতে পারে।

তাদের স্মার্টফোনে সার্চ করে এবং ডুবিয়াস ডগিকে দেওয়ার জন্য তাদের চিঠিটি তৈরি করেছিল। এটি একটি পূর্বাভাসের মতো। ইন্টারনেট শব্দটি ব্যবহার না করা খুব শক্ত ছিল।

দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় সম্পর্কে তাকে সতর্ক করতে হবে কি না তা সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও কঠিন ছিল। কিছু বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটবে—১৯৯৫ সালে কোবে ভূমিকম্প এবং ২০১১ সালে তোহোকু ভূমিকম্প।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত, তারা তাদের সেসব উল্লেখ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঠিক যেভাবে তারা সংগ্রামী সংগীতশিল্পীকে আগুনের কথা জানায়নি। তারা জানত জীবন ও মৃত্যুর বিষয়ে ঝামেলা না করাই শ্রেয়।

‘মারুমিতসুয়েনের সাথে এসবের সংযোগ রয়েছে, অদ্ভুত না?’ সোতা মন্তব্য করল। ‘এটা কি কেবল কাকতালীয় ঘটনা?’

আতসুয়াও সে সম্পর্কে ভাবছিল। এটি একটি কাকতালীয় ব্যাপারই হবে। মারুমিতসুয়েনের কারণেই তো তারা তিনজন আজ এখানে আছে।

সোতাই তাদের এই খবরটা দিয়েছিল যে গত মাসের শুরু থেকে তাদের অনাথাশ্রমটা অত্যন্ত সঙ্কটে রয়েছে। সোতা, আতসুয়া আর কোহেই পানীয় খাচ্ছিল, তবে পাবে না। তারা অ্যালকোহলের দোকান থেকে ছাড়ে কেনা বিয়ার এবং চুহাইয়ের ক্যান, শোচু এবং কার্বনেটেড জল একসাথে মিশিয়ে পার্কে বসে খাচ্ছিল।

‘আমি শুনেছি যে কোনো লেডি সিইও নাকি পেছনে পড়েছে। সে এটি সংস্কার করবে। আমি বাজি ধরছি যে সে একজন ভণ্ড।’

সোতা মারুমিতসুয়েনের কাছেই একটা কনভেনিয়েন্স স্টোরে কাজ করত। কোম্পানির অবাধে লোক ছাটাইয়ের সময়ে সে চাকরি হারায়।

‘ছিঃ, আমি আশা করছিলাম আমি যদি ঘর ছাড়া হয়ে যাই তবে সেখানে থাকতে পারব।’ কোহেই বলল।

সে বেকার। অটোমেকানিক সংস্থাটি যখন দেউলিয়া হয়ে যায় তখনই সে চাকরি হারায়। কোম্পানির ছাত্রাবাসে থাকে সে, তবে তাকে যে-কোনো দিনই বের করে দিতে পারে।

আতসুয়াও চাকরি করত। কয়েক মাস আগে পর্যন্ত সে একটি পার্টস কারখানায় কাজ করত। সেখানে তার সময়কালে, তারা একটি নতুন সংস্থার কাছ থেকে একটি নতুন পার্টের জন্য অর্ডার পেয়েছিল। মাত্রাগুলো অতীতে অন্য যে-কোনো অর্ডারের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আতসুয়া ডাবল-চেক করেছে, তবে অর্ডারে যা বলা হয় সে তেমন ডিজাইনই করে। পরে জানা যায় এটি ভুল ছিল। তারা নতুন সংস্থার সাথে তার ইউনিটগুলো মিশ্রিত করেছিল। ফলাফল একটি অকেজো ব্যাচ। তারা আতসুয়াকে দায়ী করে। বলে যে সে যথেষ্ট পরিমাণে পরীক্ষা করেনি।

এমন কিছু তাদের সাথে সবসময় ঘটে: তাদের সংস্থাগুলো মূল কোম্পানির সাথে কথা বলতে পারে না। তাদের বস তাদের ধরে রাখে না। যখনই কোনো সমস্যা হয়, তখন দোষটি আতসুয়ার মতো লোকের ওপরে চলে আসে।

রেগেমেগে চাকরি ছেড়ে দেয় সে।

তার প্রায় কোনো সঞ্চয় ছিল না। ব্যালেন্স প্রত্যাশার চেয়েও খারাপ ছিল। দুমাসের ভাড়া জমে গেছে।

এই তিনজন ছেলে মারুমিতসুয়েনকে নিয়ে যতই ভাবুক না কেন, তারা সাহায্য করার মতো অবস্থানে নেই। ভবনটি কেনার চেষ্টা করা মহিলাকে গালাগাল ও অভিশাপ দেওয়া পর্যন্তই করতে পারে তারা।

এটা কার বুদ্ধি ছিল তা আতসুয়ার মনে নেই। তার নিজেরই হবে।

হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলেছিল, ‘চলো তাকে ধরা যাক। তার কাছ থেকে টাকা চুরি করলে মা মেরিও আমাদেরকে মাফ করে দেবে।’

সোতা আর কোহেইও উত্তেজিত হয়।

তারা সবাই একই বয়সি। মিডেল স্কুল আর হাইস্কুল একসাথে পেরিয়েছে। ছাত্রজীবনে কিছু খারাপ কাজ করেছিল। ছোটোখাটো চুরি-চামারি করত। তারা চুরির মতো অহিংস কাজকে সমর্থন করত। তারা এখনও ভাবে যে তারা যে কখনও ধরা পড়েনি এটি একটি অলৌকিক ঘটনা। তাদের কৌশল ছিল: কখনও একই জায়গায় দ্বিতীয়বার আঘাত না করা, সর্বদা কৌশল পরিবর্তন করা—এবং তারা নিষিদ্ধ, এমন কিছু করত না।

মাত্র একবার, একটা খালি বাড়িতে ছিনতাই করতে ঢুকেছিল। মালিক শহরে ছিল না। এটি ছিল তাদের হাইস্কুলের তৃতীয় বর্ষ। তারা চাকরির খোঁজ থামিয়ে দিয়েছিল, তবে তারা সত্যিই নতুন পোশাক চায়। তাদের টার্গেট ছিল তাদের স্কুলের সবচেয়ে ধনী বাচ্চা। ছুটির দিনে তার পরিবার চলে যায়। তিন বন্ধু কখনই ভাবেনি তারা ব্যর্থ হলে কী হবে। তারা প্রায় ত্রিশ হাজার ইয়েন নিয়ে এসেছিল। খুব খুশি হয় তারা। সবচেয়ে ভালো কথা, কেউ তাদের সন্দেহ করেনি। খেলাটি বেশ মজাদার লেগেছিল তাদের।

হাইস্কুল শেষে গোলযোগ বাধে। আইনের দৃষ্টিতে তারা এখন প্রাপ্তবয়স্ক। যদি তারা গ্রেপ্তার হয়, তবে তাদের নাম পত্রিকায় আসবে।

তবে এবার ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। কেউ এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কথা বলেনি। তারা তিনজনই পরিস্থিতিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং কারও ওপর ঝাল মেটাতে চেয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কী, মারুমিতসুয়েনে কী হচ্ছে তা শুনে আতসুয়া খুব একটা ধাক্কা খায়নি। পুরাতন ডিরেক্টর ভালো মানুষ ছিলেন, তবে এই কারিয়া লোকটি ছিল একটি আস্ত শয়তান। সে দায়িত্ব নেওয়ার পরে পুরো প্রকল্পটি বিগড়ে যায়।

সোতা বাড়িটা খুঁজে বের করে।

প্রথম আলোচনার কয়েক দিন পরে যখন তারা দেখা করেছিল, তখন সোতা ‘সুসংবাদ’ দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিল, ‘সিইওর দ্বিতীয় বাড়ি পেয়েছি। শুনেছি যে সে মারুমিতসুয়েনে আসছে। তার পেছনে পেছনে গিয়ে তার বাড়ির ঠিকানা বের করেছিলাম। এটি অনাথাশ্রম থেকে বিশ মিনিটের দূরত্বে। সামান্য কটেজ। ঢোকা সহজই হওয়া উচিত। তার প্রতিবেশীদের মতে, সে কেবল সেখানে মাসে একবার যায়। ওহ, চিন্তা করো না। আমি পাড়ার কাউকে সামনাসামনি জিজ্ঞাসা করিনি।’

সোতা ঠিক বলে থাকলে, এটি একটি দুর্দান্ত খবর। একমাত্র সমস্যা ছিল চুরি করার মতো কিছু সেখানে আদৌ আছে কিনা।

‘থাকতে হবে,’ সোতা যুক্তি দিয়েছিল। ‘এই মহিলা মাথা থেকে পা পর্যন্ত ডিজাইনার পণ্য পরে। সেই দ্বিতীয় বাড়িটিতেও সম্ভবত দামি কিছু রাখে। আমি বাজি ধরছি এটি ব্যয়বহুল ফুলদানি এবং পেইন্টিংয়ে পূর্ণ।’

‘ঠিক,’ আতসুয়া আর কোহেই বলে।

বাস্তবে, ধনী লোকদের বাড়িতে কী আছে তা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। তারা এনিমে এবং নাটকগুলোতে দেখা অসম্ভব কোটিপতিদের আস্তানা দেখে অনুমান করেছিল।

তারা ১২ সেপ্টেম্বর কাজ করার পরিকল্পনা করে। তারিখটির কোনো তাৎপর্য ছিল না। সোতার সেদিন ছুটি ছিল, এমনিতেই সে প্রচুর বন্ধ পায়। আর এটি কাকতালীয় ঘটনা ছিল।

কোহেই একটা গেটওয়ে গাড়ি কিনেছিল।

এগারোটার একটু আগে তিন বন্ধু বাসায় প্রবেশ করল। তারা বাগানের পাশের কাচের দরজাটি ফাঁক করে এবং ল্যাচটি খোলে। এটি একটি ভালো উপায়। যদিও তারা প্রথমে ডাক্ট টেপ দিয়ে কাচের ওপর একটি বড়ো তারকা তৈরি করেছিল যাতে ভাঙা কাঁচটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে না পড়ে।

প্রত্যাশামতো কেউ বাড়িতে ছিল না। তারা সমস্ত কিছু দখল করার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাদের হাতে কিছুই লাগেনি।

ঘরের প্রতিটি কোণে খুঁজেছিল। একজন সিইওর দ্বিতীয় বাড়ির তুলনায় এই বাড়িতে তেমন কিছুই নেই। কিছু তো থাকার কথা।

কিন্তু ছিল না।

তখনই বাড়ির ঠিক বাইরে একটি গাড়ি থামতে শুনল। সাথে সাথে তারা তাদের ফ্ল্যাশলাইটগুলো বন্ধ করে দেয়। তারপরে সামনের দরজায় চাবি ঘুরাতে শুনল। পেট মুচড়ে উঠল আতসুয়ার। সেই মহিলা সিইও, আর সময় পেল না আসার। সোতাকে ধমকাতে যাচ্ছিল, কিন্তু আর সময় নেই।

পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। আতসুয়া নিজেকে প্রস্তুত করল।

১১

‘আরে, সোতা,’ আতসুয়া বলল। ‘এই ফালতু জিনিসটা কীভাবে খুঁজে পেয়েছো? তুমি বলেছিলে হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেয়েছো এটার। ত

‘হ্যাঁ, এটি আসলে নিছক কোনো দুর্ঘটনা ছিল না।’

‘তাই না? তাহলে কী ছিল?’

‘মনে আছে আমি কীভাবে বললাম আমি স্কুটারে করে মহিলাকে অনুসরণ করেছি? পথে, সে এই স্টোরের সামনে থেমেছিল।’

‘কী জন্য?’

‘আমি কীভাবে জানব? কোনো কারণে, সাইনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকে বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করার পর আমি এখানে আবার ফিরে আসি। ভেবেছিলাম কখনও যদি পরিত্যক্ত জায়গাটা লুকাবার কাজে লেগে যায়।’

‘কিন্তু তোমার পরিত্যক্ত জায়গাটা একটা মারাত্মক টাইম মেশিনে পরিণত হলো।’

‘বলতে পারো।’

‘সেই মহিলা সিইওর কী হবে? তার নাম যেন কী?’

‘কী মুতো যেন। হারুকো? হারুকো মুতো?’ সোতা মনে রাখতে পারল না। আতসুয়া ব্যাগটা টেনে এনে হ্যান্ডব্যাগটা বের করে। গাড়ির সামনের সিটে রাখা হ্যান্ডব্যাগটা কিছু না ভেবেই ডাফেলে ভরে নিয়েছিল সে।

খুলে দেখল ঠিক তালির নিচে ছিল একটি সরু ওয়ালেট। নগদ কমপক্ষে দুই লক্ষ ইয়েন। সে একাই চুরিটি খালাস করেছে। ক্রেডিট আর ডেবিট কার্ডে তেমন কিছু আসে যায় না।

ড্রাইভিং লাইসেন্সে হারুমি মুতো লেখা। ছবি দেখে মনে হয় সে বেশ সুন্দরী ছিল। সোতা বলেছিল যে তার বয়স পঞ্চাশেরও বেশি। কিন্তু মহিলাকে মোটেও সেরকম লাগে না।

সোতা আতসুয়ার দিকে তাকাচ্ছিল। তার চোখ কিছুটা লাল, সম্ভবত ঘুমের অভাব থেকেই।

‘কোনো সমস্যা?’ আতসুয়াকে জিজ্ঞাসা করল সে।

‘এটি—এটি হ্যান্ডব্যাগে ছিল।’

সোতা একটা খাম ধরে ছিল।

‘ওটা কী? কী হয়েছে?’

সোতা খামটা আতসুয়াকে দেখাল। নাম দেখে আঁতকে উঠল আতসুয়া।

চিঠিটা নামিয়া জেনারেল স্টোরের উদ্দেশ্যে লেখা।

নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,

আমি যখন ইন্টারনেটে আপনার ‘ওয়ান-নাইট স্পেশাল’ সম্পর্কে শুনেছি, তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এটা সত্যি হচ্ছে কি না। তবে আমি আপনাকে এই চিঠিটি লিখছি কারণ আমি বিশ্বাস করি যে এটি আসলেই সত্য।

আপনি যদি আমাকে মনে না রাখেন তবে অবাক হবো না। আমি আপনাকে ১৯৮০ এর গ্রীষ্মে ‘ডুবিয়াস ডগি’ হিসাবে চিঠি লিখেছিলাম। তখন আমি সবেমাত্র হাইস্কুল পাশ করেছি। আপনাকে লেখা আমার চিঠিতে, বলেছিলাম যে আমি হোস্টেস জীবিকা নির্বাহ করতে যাচ্ছি, তবে কীভাবে আমার বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারকে বলব তা জানতাম না। আপনি আমাকে আমার জায়গা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

আমি তরুণ ছিলাম এবং আপনার পরামর্শের সাথে একমত হইনি। আমি আমার লালন-পালনের পরিস্থিতি এবং আমার বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করেছি এবং জোর দিয়েছিলাম যে আমাকে উপকার ফিরিয়ে দিতে হবে, এটাই ছিল একমাত্র উপায়। এইরকম একগুঁয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে বোঝানো নিশ্চয়ই খুব ক্লান্তিকর মনে হয়েছে আপনার।

আপনি সহজেই আমাকে এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আপনি আমাকে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং আমাকে সঠিক দিকে চালিত করেছিলেন; কেবল কোনো সাধারণ দিকে নয়, একটা নির্দিষ্ট দিকে। আপনি আমাকে সময়মতো টস করতে বলেছিলেন। এটি কোনো স্বাভাবিক পরামর্শ ছিল না। এটি একটি ভবিষ্যদ্বাণী ছিল।

আপনি আমাকে যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আমি তা করেছি। সত্যি কথা বলতে কী, প্রথমে আমার সন্দেহ ছিল, কিন্তু একবার যখন দেখেছিলাম যে আপনার ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে পৃথিবী পরিবর্তন হতে শুরু করে, আমি সন্দেহ ছেড়ে দেই।

এতটা দূরদৃষ্টি কীভাবে পেলেন তা ভেবে পাই না। আপনি কীভাবে জাপানি সম্পদের মূল্য ওঠা-নামা এবং আপনার নিজের মৃত্যুর পূর্বাভাস করেছিলেন? কীভাবে আপনি ইন্টারনেটের আগমনের পূর্বাভাস করেছিলেন?

তবে সম্ভবত এখনই এটি জিজ্ঞাসা করার কোনো মানে নাই। উত্তর পেলেই কোনোকিছু বদলে যাবে না।

আমার ধারণা আপনার জন্য আমার বার্তাটি খুব সহজ।

ধন্যবাদ মিস্টার নামিয়া।

আমি আপনাকে অন্তরের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানাই। আমি যদি কখনও আপনার পরামর্শ না পেতাম, তবে আমি আজ যেখানে আছি আসতে পারতাম না। আমি আজীবন আপনার কাছে ঋণী থাকব। আপনার দয়া ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও উপায় না পেয়ে আমি হতাশ। তবে আমি আশা করি আপনি বিকল্প হিসাবে এই বিনয়ী চিঠিটি গ্রহণ করতে পারেন।

ওয়েবসাইট অনুসারে, এটি আপনার তেত্রিশতম মেমোরিয়াল সার্ভিস। আমি আপনার কাছ থেকে পরামর্শ নেবার পর বত্রিশ বছর কেটে গেছে। আমার চিঠিই হয়তো আপনার শেষ চিঠি ছিল তা ভাবতে খুব খারাপ লাগে। আমি বিশ্বাস করি এটিই ভাগ্য ছিল।

মিস্টার নামিয়া, আপনি শান্তিতে বিশ্রাম নিন।

— ডুবিয়াস ডগি

.

আতসুয়া মাথাটা নিজের হাতে চেপে ধরল। মনে যেন তার মস্তিস্ক কুঁচকে যাচ্ছে। তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না।

অন্য দুজনও হাঁটু জড়িয়ে ধরে সমানভাবে বিহ্বল হয়ে পড়ে। সোতা শূন্যে তাকিয়েছিল।

এটা কীভাবে সম্ভব? কিছুক্ষণ আগেই তারা এক উচ্চাভিলাষী হোস্টেসকে ভবিষ্যতে সফল বানাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এই ঘটনাটির তেত্রিশ বছর পরে আতসুয়া এবং তার বন্ধুরা তার বাড়িতেই ডাকাতি করতে ঢোকে —

আতসুয়া বিড়বিড় করে বলল, ‘কিছু একটা হয়েছে।’

সোতা ওপরের দিকে তাকালো, ‘কী?’

‘মানে—দেখো, অবশ্যই মারুমিতসুয়েন নামিয়া জেনারেল স্টোরের সাথে সংযুক্ত। একটি অদৃশ্য বাঁধন বা অন্য কিছু।’

সোতা সিলিংয়ের দিকে তাকাল, ‘হতে পারে, হ্যাঁ।’

‘আক!’ কোহেই পেছনের দরজার দিকে তাকাচ্ছিল।

দরজা হাঁ করে খোলা। সকালের আলো ফুটছে। রাত শেষ।

‘দেখে মনে হচ্ছে যে এই চিঠিটি আর নামিয়া জেনারেল স্টোরে পৌঁছাবে না।’

‘ঠিক আছে। মানে, এটি তো আমাদের জন্য। তাই না আতসুয়া?’ সোতা বলল। ‘সে আমাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। সে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমাদের, এই কলঙ্কিত চোরদের কাছে সে কৃতজ্ঞ।’

আতসুয়া তার দিকে তাকালো। চোখ ভিজে রক্ত লাল হয়ে গেছে।

‘আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। তুমি জানো? যখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি বিল্ডিংটিকে ভেঙে লাভ হোটেল বানাবেন? সে না করেছিল। সে মিথ্যা বলেনি। ডুবিয়াস ডগি কখনই আমাদের কাছে মিথ্যা বলবে না।’

আতসুয়াও তাই অনুভব করল। মাথা নাড়ল সে।

‘তাহলে আমরা এখন কী করব?’ কোহেই জিজ্ঞাসা করল।

‘আমরা ফিরে যাচ্ছি।’ আতসুয়া উঠে দাঁড়ালো। ‘তার বাসায়। আমরা যা চুরি করেছি তা ফিরিয়ে দেবো।’

‘আমরা তার বাঁধন খুলে ফেলব,’ সোতা এগিয়ে গেল।

‘হ্যাঁ।’

‘তারপর? পালিয়ে যাবো?’ কোহেই জিজ্ঞাসা করল।

আতসুয়া মাথা নাড়ল, ‘না। পুলিশের জন্য অপেক্ষা করব।’

সোতা ও কোহেই প্রতিবাদের কোনো লক্ষণ দেখায়নি।

কোহেই কেবল বিড়বিড় করে বলল, ‘আমরা কারাগারে যাচ্ছি।’

সোতা বলল, ‘তারা হয়তো আমাদেরকে প্যারোল দেবে। তবে এটি কেবল শুরু। তোমার কী মনে হয়, এরপর আমরা কাজ পাবো? কী করব তখন?’

আতসুয়া আবার মাথা নাড়ল, ‘আমি জানি না। তবে আমি একটি জিনিস জানি। অন্য লোকের জিনিসপত্র চুরি করার দিন আমাদের শেষ।’

সোতা আর কোহেই চুপ করে রইল।

তারা তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে পেছনের দরজার বাইরে চলে গেল। রোদ ছিল উজ্জ্বল। চড়ুই কিচিরমিচির করছে।

মিল্ক ক্রেটটি আতসুয়ার চোখে পড়ে। সেই রাতে তারা কতবার এই জিনিসটি খুলেছে এবং বন্ধ করেছে? আর কখনও এটা করতে পারবে না ভেবে খারাপ লাগছিল।

সে আরও একবার ঢাকনাটি খোলে। ভেতরে একটা চিঠি।

সোতা আর কোহেই গলির অর্ধেকটা চলে গেছে।

‘আরে! দেখো কী পেয়েছি!’

চিঠির সামনের অংশটি ফাউন্টেন পেনে লেখা। প্রাপক জন/জেন ডো। হাতের লেখাটা খুব সুন্দর।

ভেতরের চিঠিটা বের করল সে।

.

নিম্নলিখিত চিঠিটি যিনি আমাকে ফাঁকা চিঠিটি প্রেরণ করেছেন তার উত্তর। যদি এটি আপনার না হয়ে থাকে তবে দয়া করে এটি যেখানে পেয়েছেন সেখানে রেখে দিন।

.

আতসুয়া ঢোক গিলল। খালি চিঠি সেই ফেলেছিল। এই চিঠিটি তার জন্য। উত্তর! প্রকৃত মিস্টার নামিয়ার চিঠি।

প্রিয় জন/জেন ডো,

আপনি কেন আমাকে খালি কাগজের কাগজ পাঠালেন তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো। আমি কেবল একজন বৃদ্ধ। তবে আমি জানতাম এটি অসাধারণ কিছু একটা হবে। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি একটা ভালো উত্তর দিতে।

আমি অনেক ভেবে এই উপসংহারে এলাম যে, এই ফাঁকা পত্ৰক আসলে মানচিত্রের অনুপস্থিতির প্রতীক।

যে লোকেরা আমার কাছে লিখেছে তারা ছিল বিভ্রান্ত। তাদের কাছে একটি মানচিত্র রয়েছে তবে তারা এটির দিকে নজর দেয় না বা কীভাবে তাদের নিজস্ব

অবস্থান সন্ধান করতে হবে তা জানে না।

তবে আমার অনুমানটি আপনার জন্যও প্রযোজ্য নয়। আপনার মানচিত্রটি আঁকা এখনও বাকি আছে। যা আপনি কোথায় যাচ্ছেন তা স্থির করা অসম্ভব করে তোলে। সেখানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ করে তোলে।

খালি মানচিত্র পেলে কেউ বিভ্রান্ত না হয়ে পারে? এটি যে কারও জন্য একটি ধাঁধা।

ভালো দিক চিন্তা করুন। ফাঁকা মানচিত্রের অর্থ আপনি নিজের পছন্দমতো একে পূরণ করতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ আপনার ওপর নির্ভর করে। সবকিছু খোলা; সম্ভাবনাগুলো সীমাহীন। এটি একটি সুন্দর জিনিস। আমি কেবল আশা করতে পারি এটি আপনাকে নিজেকে বিশ্বাস করা শুরু করার ও কোনো অনুশোচনা না নিয়ে জীবনযাপন করার উপায় খুঁজে পেতে সহায়তা করে।

ভেবেছিলাম আমি আর কোনো চিঠির উত্তর দিতে পারব না। এইরকম কন্টকাকীর্ণ ধাঁধা শেষ করতে পেরে আমি খুব প্রসন্ন বোধ করছি।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

আতসুয়া কাগজের পাতা থেকে চোখ তুলল। বাকিদের চোখের দিকে তাকালো। তাদের চোখ চকচক করছে।

হয়তো চকচক করছে তার নিজের চোখও।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *