অধ্যায় ৪ – দ্য বিটলসের জন্য এক মুহূর্তের নীরবতা

অধ্যায় ৪ – দ্য বিটলসের জন্য এক মুহূর্তের নীরবতা

স্টেশন থেকে বেরিয়ে দোকান ঘেরা রাস্তায় নেমে এলো কসুকে ওয়াকু। তার বুকে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। যেটার ভয় পেয়েছিল, তাই সত্যি হলো। দুঃসময় এই শহরের পিছু ছাড়েনি। একটা সময় এখানে বসতি স্থাপন করার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসতো। তখন স্টেশন আর তার আশেপাশের জায়গাগুলোতে বেশ জমজমাট ব্যাবসা ছিল। কিন্তু সেসব ১৯৭০ সালের কথা। এখন চল্লিশ বছর পর সময় বদলে গেছে। এখন আর শহরতলির কোনো ব্যাবসা জমে না। এই পুরোনো শহরের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো কথা মনে করতে চেষ্টা করল। ভেবেছিল কিছুই মনে পড়বে না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সে অনেক জায়গাই চিনতে পারল।

এমন না যে শহরটা একদমই বদলায়নি। তার মা যে মাছের দোকানে প্রায়ই যেত সেটা এখন আর নেই। কী যেন নাম ছিল সেটার? উমাটসু। মালিক ভদ্রলোকটা সবসময় আগ্রহ নিয়ে কাস্টমার ডাকত ‘এই মিসেস, আমাদের আজকের ওয়েস্টার খুবই চমৎকার। এখন এক ডজন নিয়ে যান, আপনার স্বামী পরে এসে আমাকে ধন্যবাদ জানাবে।’

সেই লোকটার কী হয়েছিল? সে শুনেছিল লোকটার ছেলে ঐ দোকানের ভার নেবে কিন্তু এর বেশি আর কিছু মনে নেই তার।

রাস্তার শেষে একটা মোড় নিলো সে। রাস্তাটা ঠিক তার মনে নেই।

রাস্তায় আলো খুব কম। কিন্তু সে হাঁটতে থাকল। কিছু স্ট্রিট লাইট আছে কিন্তু সবগুলো জ্বালানো নেই। গত বছরের বড়ো ভূমিকম্পটার পর থেকে জাপান শক্তি অপচয় নিয়ে খুব সাবধান হয়ে গেছে। রাস্তা দেখার মতো বাতি জ্বালানো থাকাই এখন যথেষ্ট বলে মনে করা হয়।

যখন সে ছোটো ছিল তখন এই এলাকার উন্নয়নের বেশ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথা শোনা যেত। সেটা নিয়ে উত্তেজিত একটা ক্লাসমেটের কণ্ঠ তো সে এখনও শুনতে পায়, ‘আমরা নিজেদের মুভি থিয়েটার পেতে যাচ্ছি!’

সেসব পরিকল্পনা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের সাফল্য বলে ধরে নেওয়া যায়। একসময় শহরটা জাপানিজ এসেট প্রাইস বাবলে উঠে যায় এবং কিছু সময়ের জন্য টোকিওতে নিত্য যাতায়াতকারীদের শহর হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

রাস্তাটা এখানে ‘T’ আকৃতি ধারণ করেছে। এটা অপ্রত্যাশিত কিছু না। যেমন ভেবেছিল, জায়গাটা ঠিক তেমনই আছে। কসুকে আবারও ডানে ঘুরে গেল।

কিছু দূর যেতেই ঢাল পেয়ে গেল সে। এটাও মনে আছে তার। সে প্রায় এসে পড়েছে।

সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটলে কসুকে এতক্ষণে স্টোরটা দেখে ফেলত। কিন্তু সে মাথা নিচু করে হাঁটছে। ভয় লাগছে তার। যদিও সে যা পড়েছে তা যদি মিথ্যাও হয়ে থাকে, তবুও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে চায় না।

অবশেষে থামল সে। কাছাকাছি এসে পড়েছে। এই রাস্তা ধরে হাজারবার হাঁটাহাঁটি করেছে কসুকে।

মাথা তুলে তাকালো। বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ল।

নামিয়া জেনারেল স্টোর এখনও এখানে আছে। তার জীবন এখন যে পর্যায়ে আছে তাতে এই দোকানটার ভূমিকা খুব বড়ো।

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কসুকে। সাইনের লেখাগুলো খুব অস্পষ্ট এবং শাটারটায় জং ধরে গেছে। এখানে কেউ থাকাটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। ওই গল্পটা কীভাবে বিশ্বাস করবে সে? ইন্টারনেটে ছিল। কেউ কি মজা করে লিখেছে সেটা?

কিন্তু নামিয়া জেনারেল স্টোর নিয়ে মজা করে কারও কী লাভ? এর কথা খুব কম মানুষই জানে।

সে সিদ্ধান্ত নিলো কিছুক্ষণ এখানে থাকবে। চেক করবে। তাছাড়া সে এখনও নিজের চিঠিটা লিখেনি। চিঠি লেখা ছাড়া এই অদ্ভুত ঘটনায় শামিল হতে পারবে না।

কসুকে যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে যেতে লাগল। বেশিরভাগ দোকানগুলো এখন বন্ধ। ভেবেছিল এখানে কোনো রেস্টুরেন্ট পাওয়া যাবে যা চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে। কিন্তু দেখা গেল তার ধারণা ভুল।

একটা কনভেনিয়েন্ট স্টোর খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকল, স্টেশনারি সেকশনে তার কিছু কেনাকাটা ছিল। রেজিস্টারে একটা তরুণ ক্যাশিয়ার বসে আছে।

‘রাতে কোনো জায়গা খোলা থাকে এখানে?’ কসুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোনো পাব বা তেমন কিছু?’

‘রাস্তার শেষ মোড়ে কতগুলো পাব আছে। কিন্তু আমি নিজে কখনও সেখানে যাইনি।’ ক্যাশিয়ারটা জবাব দিলো।

‘আচ্ছা, ধন্যবাদ।’

পাবগুলো পেয়ে গেল কসুকে। এদের ব্যাবসায় নিশ্চিত ভাটা পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে বাকি ব্যবসায়ীরা যার যার দোকান বন্ধ করার পর এখানে ড্রিংক করতে আসে।

একটা সাইন দেখে কসুকে থামল: বার এফএবি৪। এমন একটা নাম দেখে থেমে যাওয়াই স্বাভাবিক।

কয়লা রঙের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে। সামনে দুটো টেবিল, পেছন দিকে স্টুলসহ একটা কাউন্টার। একটা স্টুলে একজন মহিলা বসে আছে। চুল ছোটো বব স্টাইলে কাটা, পরনে হাতাকাটা কালো জামা। এখানে আর কেউ নেই। হয়তো মহিলাই এখানের মালিক।

মহিলাটা তাকে দেখে একটু অবাক হলো, ‘ড্রিংক করতে এসেছেন?’

বয়স হয়তো চল্লিশোর্ধ। চেহারা দেখেই বুঝা যায় জাপানিজ।

‘হ্যাঁ, যদি বেশি দেরি না হয়ে থাকে।’

মহিলা মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো। ‘অবশ্যই না। আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখি।’

‘তাহলে আমি কেবল একটা ড্রিংক নেবো। ধন্যবাদ।’

কসুকে কাউন্টারের সামনে দূরবর্তী একটা টুলে বসল।

‘এত জায়গা ছেড়ে বসার দরকার নেই,’ মহিলাটা হেসে উঠল। হাত মোছার জন্য একটা গরম তোয়ালে এগিয়ে দিলো, ‘আমার মনে হয় না আজ আর কেউ আসবে।’

‘আমি ঠিক আছি। ধন্যবাদ। ড্রিংক খেতে খেতে আমাকে কাজ করতে হবে।’

‘কাজ? এত রাতে?’

‘হ্যাঁ,’ এর বেশি বোঝানো কষ্টসাধ্য হবে।

আর মহিলাটাও বেশি খোঁচালো না। ‘আরাম করে বসুন। কী এনে দেবো আপনাকে?’

‘বিয়ার। ডার্ক কিছু আছে?’

‘গিনেস চলবে?’

‘অবশ্যই।’

কাউন্টারের পেছনে গিয়ে নিচে ঝুঁকল মহিলাটা। মনে হয় ফ্রিজ আছে সেখানে। উঠে দাঁড়ালে দেখা গেল তার হাতে একটা গিনেসের বোতল। ক্যাপ খুলে কসুকেকে চমৎকারভাবে এক গ্লাস ঢেলে দিলো। প্রায় এক আঙুল সমান ফোম জমেছে।

এক ঢোকে বড়ো একটা অংশ খেয়ে নিলো কসুকে। পরিচিত তেতো একটা স্বাদ মুখে ছড়িয়ে পড়ল তার, ‘আপনি খাবেন একটা?’

‘কেন নয়। ধন্যবাদ।’ কসুকের সামনে একটা ছোটো থালাভরতি বাদাম রেখে মহিলাটা নিজের জন্য এক গ্লাস গিনেজ ঢেলে নিলো, ‘চিয়ার্স।’

‘চিয়ার্স।’

কনভেনিয়েন্স স্টোর থেকে আনা ব্যাগটা থেকে খাতা-কলম বের করল কসুকে।

‘আপনি কি কাউকে চিঠি লিখছেন?’

‘সেইরকমই।’

মহিলাটা মাথা নেড়ে বারের দূরের দিকে গিয়ে বসল। কিছুটা ব্যক্তিগত জায়গা দিলো কসুকেকে।

গিনেস খেতে খেতে কসুকে বারটা দেখতে লাগল। এমন লোকহীন শহরতলির কোনো বারের মতো লাগছে না একে। টেবিল চেয়ারগুলো চমৎকার আর দেওয়ালে পোস্টার আর ড্রইং দিয়ে সাজানো। পোস্টারগুলো চল্লিশ বছর আগের প্রচণ্ড জনপ্রিয় এক ব্যান্ডের চারজন সংগীতশিল্পীর। একটা পোস্টারে সাইকাডেলিক রঙে রাঙানো একটা হলুদ সাবমেরিন।

‘এফএবিফোর (Fab4)’ হচ্ছে ‘দ্য ফ্যাব ফোর’-এর রেফারেন্স, দ্য বিটলসের ডাকনাম।

‘এটা কি একটা বিটলস বার?’

মহিলাটা হ্যাঁ বলল। ‘সেটা মনোযোগ আকর্ষণের একটা কায়দা।’

‘ওহ,’ কসুকে দেওয়ালে একটা ফ্ল্যাট স্ক্রিন দেখতে পেল। সেখানে কি দ্য বিটলসের সংগীত প্রদর্শন করা হয়? আ হার্ড ডেজ নাইট? হেল্প!? কসুকে ভাবেনি এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অজানা সিনেম্যাটিক গুপ্তধন পাবে।

‘আমার ধারণা আপনি ছোটোবেলায়ও এদেরকে চিনতেন না।’

‘কী যে বলেন। যখন আমি মিডেল স্কুলে ভর্তি হলাম তখন তাদের ব্যান্ড ভাঙার মাত্র দুই বছর হয়েছে। তখন শীর্ষে ছিল তারা। সব ধরনের ইভেন্ট চলত।’

‘একজন মহিলাকে এভাবে জিজ্ঞাসা করা ঠিক না কিন্তু

মহিলাটা তার কথা আগেই আন্দাজ করে শব্দ করে হেসে উঠল, ‘এতে কিছু মনে করার মতো বয়স আর আমার নেই। কিন্তু যদি জানতেই চান তবে বলি, আমি ইয়ার অব দ্য পিগ-এ জন্মগ্রহণ করেছিলাম।’

‘তার মানে—’ কসুকে চোখ পিট পিট করল, ‘আপনি আমার চেয়ে মাত্র দুই বছরের ছোটো।’

পঞ্চাশোর্ধ বলে তো মোটেও মনে হচ্ছে না।

‘না–আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার চেয়ে ছোটো।’

‘অদ্ভুত তো।’

মহিলাটা তার কার্ড দিলো কসুকেকে। সেখানে লেখা এরিকো হারা গুচি।

‘আপনি নিশ্চয়ই স্থানীয় লোক না। এখানে এলেন যে? কাজের উদ্দেশ্যে?’

কসুকে কেশে উঠল। এত দ্রুত কোনো মিথ্যা কথা ভেবে বের করতে পারছে না।

‘কাজের উদ্দেশ্যে না। বলতে পারেন নিজের শহরে ঘুরতে। আমি ছোটোবেলা এখানেই থাকতাম, চল্লিশ বছর আগে।’

‘তাই?’ এরিকোর চোখ বড়োবড়ো হয়ে গেল, ‘আমাদের নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও দেখা হয়েছিল।’

‘হতে পারে। যাই হোক, মিউজিক কোথায়?

‘আহা, কী যে হয়েছে আমার। সাধারণটা ছাড়ব?

‘যেটা আপনার ইচ্ছা।’

এরিকো কাউন্টারে গিয়ে কিছু বোতাম চাপল। দেওয়ালের স্পিকার থেকে কয়েক দশক আগের নস্টালজিক গান ভেসে এলো— ‘লাভ মি ডু…’

কসুকে গ্লাসের পানীয় শেষ করে আরও একটা অর্ডার দিলো।

‘আপনার মনে আছে দ্য বিটলস কবে প্রথমবার জাপানে এসেছিল?’

এরিকো গুনগুন করতে করতে মনে করার চেষ্টা করল।

‘টিভিতে দেখেছিলাম। কিন্তু হতে পারে সেটা কেবল আমার কল্পনা। এই ব্যাপারে মনে হয় আমি আমার ভাইকে তার বন্ধুদের সাথে বলতে শুনেছিলাম।’

‘হয় এমন।’

‘আপনার মনে আছে?’

‘কিছুটা। আমিও খুব ছোটো ছিলাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত নিজের চোখেই দেখেছি। লাইভ না, ফুটেজ। তারা প্লেন থেকে নেমে ক্যাডিলাকে করে ইম্পেরিয়াল হাইওয়েতে যাচ্ছিল। কদিন পরে জানতে পেরেছিলাম যে গাড়িটা ক্যাডিলাক। তাদের গাড়িতে তখন মিস্টার মুনলাইট বাজছিল।’

‘মিস্টার মুনলাইট তো তাদের অরিজিনাল না।’

‘কিন্তু টোকিওতে তাদের গাওয়া এই গান খুব হিট হয়েছিল। সত্যি বলতে আসলে সে কারণেই এখানে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল তারা। অনেকেরই ধারণা যে এই গান তারাই রচনা করেছিল।’

নিজেকে আবেগী হয়ে যেতে দেখে কসুকে চুপ হয়ে যায়। অনেকদিন ধরে দ্য বিটলস নিয়ে লম্বা আলোচনা করেনি।

‘চমৎকার সময় ছিল সেগুলো,’ এরিকো বলল।

‘অবশ্যই,’ কসুকে গ্লাস শেষ করলে এরিকো তাকে আরও এক গ্লাস দিলো।

কসুকের চিন্তাভাবনা উড়ে গেল চল্লিশ বছর আগের সময়ে।

দ্য বিটলস যখন জাপানে এসেছিল তখন কসুকে জানত না এরা আসলে কারা। কেবল জানত বিদেশ থেকে চারজন সংগীতশিল্পীর একটা দল আসছে। একারণে যখন সে তার চাচাতো ভাইকে বিটলসের আসার স্পেশাল ব্রডকাস্ট দেখে কাঁদতে দেখেছিল, তখন সে খুব অবাক হয়। তার চাচাতো ভাই তখন হাইস্কুলে ছিল। কিন্তু নয় বছর বয়েসি কসুকের কাছে সে তখন প্রাপ্তবয়স্ক। কসুকে সেদিনই জানতে পারে, এই জগতে কত চমৎকার চমৎকার মানুষ আছে। এত চমৎকার যে তাদের আগমন একটা প্রাপ্তবয়স্ক লোকের চোখেও পানি এনে দেয়।

তিন বছর পরে সেই চাচাতো ভাই মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। চাচা- চাচি প্রায় ভেঙে পড়ে। ভাবে ছেলেটাকে লাইসেন্স করতে দেওয়াটা ভুল ছিল। ফিউনারেলের সময় কসুকে তাদেরকে বলতে শুনেছিল, ছেলেটা যদি ওসব হাবিজাবি না শুনত তবে বাজে বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ত না। হাবিজাবি বলতে তারা দ্য বিটলসের গান বুঝিয়েছিল, ‘ওই রেকর্ডগুলো আমি ডাস্টবিনে ফেলে দেবো। এদের জায়গা ওখানেই।’ চাচি রেগেমেগে বলেছিলেন।

‘ফেলেই যেহেতু দেবেন,’ কসুকে বলে, ‘আমি নিয়ে নেই তাহলে।’ কসুকে শুনতে চাইছিল এগুলো এমন কী ধরনের সংগীত, যার কারণে তিন বছর আগে তার ভাই এমন পাগল হয়ে উঠেছিল। যখন সেই সংগীত কসুকেকে আঁকড়ে ধরতে শুরু করল, তখন সে কেবল মিডেল স্কুলের বাচ্চা।

কোনো কোনো আত্মীয় কসুকের বাবা-মাকে বলেছিল বাসা থেকে তার হাতখরচ বন্ধ করে দিতে, ‘ওর ভাইয়ের মতোই বিগড়ে যাবে।’ কিন্তু তার বাবা-মা এসব কানে তুলেনি।

‘পপ মিউজিক শুনে কোনো ছেলে পাগল হয়ে যায় না,’ তার বাবা সাদায়ুকি বলেছিল, ‘তাছাড়া তেতসুয়ো খারাপ ছেলে ছিল না। আজকাল প্রায় সব হাইস্কুলের ছেলেই বাইক চালায়।’

‘ঠিক, আমাদের ছেলে ঠিক আছে।’ কিমিকো, কসুকের মা বলেছিল।

কসুকের বাবা-মা সেসব বাবা-মা থেকে খুব আলাদা, যারা ছেলের চুল একটু বড়ো দেখলেই তাকে ক্রিমিনাল আখ্যা দিয়ে দেয়।

তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে বিটলসের জাপানে রিলিজ হওয়া প্রায় সব রেকর্ড ছিল। সেই সংগ্রহ শুনে কসুকে নেশায় পড়ে যায়। এমন সংগীত সে কখনও শোনেনি। এমন মেলোডি আর তাল জগতে আছে, তা জানা ছিল না তার।

ফ্যাব ফোরের জাপানে আসার সময়ে নতুন একদল সংগীতশিল্পী ইলেক্ট্রিক গিটার নিয়ে দেশ মাতিয়ে ফেলেছিল। কসুকে জানত তারা বিটলসদের অনুকরণ করছে না, এরা ভণ্ড। কিছু সময়ের মাঝেই তাদের পতন ঘটে।

মিডেল স্কুলে থাকাকালীন সময়ে কসুকে বুঝতে পারে তার অনেক সহপাঠী বিটলসের ভক্ত। মাঝেমধ্যে সে তাদেরকে নিজের বাসায় আমন্ত্রণ করত। তারা যখন কসুকের ঘরে ঢুকত, তখন তার চমৎকার সব অডিয়ো সরঞ্জাম দেখে অবাক হতো। হবেই-বা না কেন? তাদের চোখে একটা সলিড স্টেট অ্যাম্প আর স্পিকারই ছিল ভবিষ্যতের বস্তু। তখন এমনকী স্বচ্ছল পরিবারেও একটা মাত্রই কেবিনেট স্টাইল স্টেরিয়ো ছিল যাতে পরিবারের সবাই মিলে গান শুনত।

‘আমার বাবা সবসময় বলে শিল্পের জন্য খরচে কোনো কমতি রাখবে না।’ কসুকে তার বন্ধুদেরকে বলত, ‘সে বলে ঠিকমতো শুনতে না পারলে সংগীত শোনারই কোনো দরকার নেই।’ কসুকের বন্ধুরা হিংসায় জ্বলে যেত।

বিটলসের সংগীতগুলো সে সর্বাধুনিক সরঞ্জামে শুনতো। গান যদি জাপানে রিলিজ পেত, তবে কসুকের কাছে তা থাকত। এতেই তার বন্ধুরা খুব অভিভূত হয়ে যেত।

‘তোমার বাবা করে-টা কী?’ বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করত।

‘আমি ঠিক জানি না। তবে বেচা-কেনার ব্যাবসা মনে হয়। কোনোকিছু কমদামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করলেই তো লাভ হয়, তাই না? তার সেই কাজের একটা পুরো কোম্পানি আছে।’

‘তার মানে সে প্রেসিডেন্ট?’

‘মনে হয়।’ কসুকে বলত। শুনে মনে হতো সে বুঝি গর্ব করছে, কিন্তু কসুকে জানে, আসলে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন।

তাদের বাসাটা পাহাড়ের ওপরে। দোতলা ওয়েস্টার্ন বাসাটার পেছনে একটা লন আছে, যেখানে ভালো আবহাওয়ার সময়ে তারা বারবিকিউ পার্টি করে। তার বাবা সবসময় কর্মচারীদের দাওয়াত দেয়।

‘জাপান দীর্ঘদিন ধরে পুরো বিশ্বের অফিস বয় হিসেবে পড়ে আছে, ‘ সাদায়ুকি তার কর্মচারীদের বলত, ‘আর এখন আমাদের কিছু করে দেখাবার সময়। নিজেদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে, সবাইকে দেখিয়ে দিতে হবে। আর সেটা করার জন্য আগে জগতকে জানতে হবে। অন্য দেশ আমাদের বন্ধু বা শত্রু দুটোই হতে পারে। এটা মনে রেখো।’

নিজের বাবার ক্ষমতাসম্পন্ন দৃঢ় কণ্ঠ শুনে কসুকে গর্ববোধ করত। বাবার সমস্ত কথা সে বিশ্বাস করত। এবং ভাবত তার চেয়ে নির্ভরযোগ্য লোক আর এই জগতে হয় না।

কসুকের পরিবার তাকে কোনোকিছু নিয়ে অভাব বোধ করতে দিত না। প্লাস্টিক মডেল কিট, বোর্ড গেম, রেকর্ড–সে যা চাইত, তাই হাত ভরে পেত। এমনকি যা চাইত না তাও তার বাবা-মা তার সামনে এনে হাজির করত, যেমন—দামি ঘড়ি বা কাপড়।

তার বাবা-মা জীবন উপভোগ করছিল। সাদায়ুকির হাতে সবসময় স্বর্ণের ঘড়ি থাকত আর সে সবসময় দামি সিগারেট খেত। নতুন নতুন গাড়ি তো ছিল অপরিহার্য। কিমিকো ডিপার্টমেন্ট থেকে সেলসম্যান ডেকে নিত সোজা বাড়িতে। আর প্রায় পুরো ক্যাটালগই অর্ডার করে ফেলত।

‘সস্তা জিনিস সস্তা মানুষের জন্য,’ এটাই ছিল তার মূল মন্ত্র। তাতে করে তোমাকে কেবল দেখতেই সস্তা দেখায় না, বরং তোমার আত্মাটাও সস্তা হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব শুষে নেয়। একারণেই সবসময় সবচেয়ে ভালো জিনিস কেনা উচিত।’

কিমিকো খুব সুন্দরী ছিল। মানুষজন মাঝেমধ্যে ধারণা করে বসত তার বয়স আসল বয়সের চেয়ে দশ বছর কম। কসুকের স্কুলের এক অনুষ্ঠানে সে এলে কসুকের বন্ধুরা অবাক হয়ে যায়। কত বন্ধু যে কসুকেকে ‘ইশ, আমার মা-ও যদি তোমার মায়ের মতো এত কমবয়েসি হতো’ বলেছে তার ইয়ত্তা নেই।

সীমাহীন স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে ভাগ্যও সুপ্রসন্ন ছিল তাদের। হয়তো বা সবার কাছে এমনই মনে হয়েছিল।

কিন্তু এমন একসময় এলো যখন কসুকে পরিবর্তনটা বুঝতে পারল। খুব ধীরে ধীরে। ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে, বিপদের ঘনঘটা দেখা দিলো।

১৯৭০ সালে ওসাকার ওয়ার্ল্ড এক্সপো নিয়ে জাপানে খুব তোলপাড় শুরু হয়। কসুকে সেই এপ্রিলে মিডেল স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে। তার লক্ষ্য ছিল বসন্তের ছুটিতে এক্সপোতে ট্রেকিংয়ে অংশ নেওয়া। আগে গেলেই সুবিধা। তার বাবা কথা দিয়েছিল যে তারা যাবে।

মার্চের ১৪ তারিখে এক্সপো’ ৭০ একটা ফ্যানফেয়ারের আয়োজন করে। কসুকে টিভিতে দেখেছিল। রংচঙে অনুষ্ঠানে আসল জিনিস খুবই কমই ছিল। সেখানে কেবল পুরো বিশ্বের কাছে এটা প্রচার করা হচ্ছিল যে জাপান তার অর্থনীতি পুননির্মাণ করেছে এবং বিশ্ব বাজারে এখন তারা সমাদৃত। ঠিক যেমন তার বাবা বলে- আমাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

কিন্তু সাদায়ুকি এক্সপোর ট্রিপের যাবার কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এক সন্ধ্যায় খাবারের পর কসুকে কথাটা তোলে। তখন বাবার উত্তর শুনে সে চমকে যায়।

‘এক্সপো? আমার মনে হয় না যাওয়া হচ্ছে। আমি খুব ব্যস্ত।’

‘মে’র গোল্ডেন সপ্তাহে গেলে কেমন হয়?’

তার বাবা উত্তর দিলো না। পত্রিকা পড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল।

‘এক্সপো নিয়ে কার এত মাথাব্যথা আছে?’ বাবার হয়ে মা উত্তর দেয়, ‘এটা কেবল কয়েকটা দেশ মিলে একটা খেলায় প্রতিযোগিতায় নামা। সেসবে তোমার এখনও আগ্রহ আছে? তুমি না মিডেল স্কুলে উঠে গেছ?’

এরপর আর বলার কী থাকে? যাবার তেমন জোরালো কারণও নেই কসুকের কিন্তু সে যাবার কথা তার বন্ধুদেরকে ইতোমধ্যে বলে ফেলেছে। এখন না গেলে তাকে কেমন বোকা বোকা দেখায়।

‘এখন পড়াশোনায় মন দেওয়ার সময়। শীঘ্রই হাইস্কুলের এন্ট্রান্স পরীক্ষা। যত তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি শুরু করবে ততই ভালো। এক বছর খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। এক্সপোতে গিয়ে এখন সময় নষ্ট করার মানে হয় না।’

এর সাথে তর্ক করা যায় না। কসুকে চুপ রইল।

কিন্তু এখানেই শেষ না। কসুক আস্তে আস্তে বুঝতে পারল তার জীবনের মোড় ঘুরছে।

যেমন, জিমের জামা-কাপড়। সেগুলো ছোটো হয়ে যাচ্ছিল। সবসময় বলার আগেই তার বাবা-মা তাকে নতুন জামা এনে দেয়। কিন্তু এবার কিমিকোর উত্তর ছিল অন্যরকম।

‘এত তাড়াতাড়ি ছোটো হয়ে গেছে? এই শরতেই তো কিনে দিলাম। আর কিছুদিন এটা চালিয়ে নাও। এখনই নতুনটা কিনে দিলে দুদিন পরেই আবার নতুন চাইবে।’

যেন দ্রুত বেড়ে উঠে তাদের কোনো ক্ষতি করে ফেলছে কসুকে।

বারবিকিউগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বাবার কর্মচারীরা বাসায় আসা বন্ধ করে দেয়। বাবা আর গলফ খেলতে যেত না। বাসায় সবসময় তর্ক-যুদ্ধ লেগেই থাকত। কসুকে ঠিক বুঝত না, কিন্তু তার ধারণা কিমিকো আর সাদায়ুকি যখনই তর্ক করত, তার মূল বিষয়বস্তু ছিল টাকা।

সাদায়ুকি মাঝেমধ্যে বলে উঠত, ‘তুমি যদি এসব আরও গুরুত্বের সাথে দেখতে তাহলে এমন হতো না।’ যার উত্তরে কিমিকো ছুড়ে দিত, ‘যদি তুমি নিজের কাজ ঠিকভাবে করতে তাহলে আমাকে এখন জড়াতে হতো না।’

বাবার সম্প্রতি পছন্দের গাড়িটা, ফোর্ড থান্ডারবার্ড, গ্যারেজ থেকে উধাও হয়ে গেল। সাদায়ুকি ট্রেনে যাতায়াত শুরু করে। কিমিকো শপিং বন্ধ করে দেয়। আর তারা দুজনেই সবসময় বিরক্ত হয়ে থাকত।

আর এমন খারাপ সময়ে সে খবরটা পেল: দ্য বিটলস ব্যান্ড ভেঙে গেছে। একটা ব্রিটিশ পত্রিকায় খবর এসেছে।

কসুকে তার বন্ধুদেরকে খবরটা জানালো। তখন ইন্টারনেট ছিল না বা মিক্সি— যা ভবিষ্যতে জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হবে। তখন ‘আমি কোথাও দেখেছিলাম’, ‘রেডিয়োতে শুনেছিলাম’, ‘বিদেশি পত্রিকায় পড়েছি’— এভাবেই আসল বা নকল খবর ছড়িয়ে পড়ত।

না না, ভাবল কসুকে, এটা এখনই কেন হতে হলো।

ব্যান্ডের ভাঙন নিয়ে জল ঘোলাটে হতে শুরু করে। কেউ কেউ বলে পল মিককার্টনের স্ত্রীর সাথে ইয়োকো ওনোর সদ্ভাব হচ্ছিল না। আর অন্যরা জর্জ হ্যারিসনকে শেষ প্রজেক্ট আটকে রাখার কারণে দোষ দেয়। কিন্তু কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা তা জানার উপায় ছিল না।

কসুকের এক বন্ধু বলেছিল, ‘জানো, বিটলস নাকি কখনও জাপান আসতেই চায়নি? তাদের লেবেল জানত এতে করে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে তাই তাদেরকে জোর করে পাঠিয়েছিল। পিছিয়ে যাবার কোনো উপায় ছিল না। এরপরই তারা কনসার্ট করা বন্ধ করে দেয়।’

কসুকে এটা আগেও শুনেছে কিন্তু বিশ্বাস করেনি। সত্যি বলতে বিশ্বাস করতে চায়নি।

‘হ্যাঁ, কিন্তু তারা খুব চমৎকার শো উপহার দিয়েছে। দেখে মনে হয়েছে তারা উপভোগ করেছে এখানে।’

‘করেনি। তারা তো কোনো আসল সেটও বাজায়নি। তারা ভেবেছে স্টেজে উঠলে দর্শক এমন উল্লাসধ্বনি করবে যে আসলে কিছু শোনা যাবে না। তারা স্টেজে উঠে কী গাইলো বা বাজালো তাতে কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু এখানে সবাই অত চেঁচামেচি করেনি। আর সবাই তাদের পারফর্ম্যান্স শুনতে পারছিল, তাই না পেরে তাদেরকে ঠিকঠাকভাবে গাইতে হয়েছে।’

‘আমি বিশ্বাস করি না।’

‘তাতে কিছুই বদলাবে না। শোনো, আমিও বিশ্বাস করতে চাইনি। কিন্তু বিটলসরাও তো মানুষ। তারা জাপানকে কেবল একটা ছোটো দ্বীপ বলে ধরে নিয়েছে। ভেবেছে এখানে স্টেজে উঠে একটু নাড়াচাড়া করবে আর পরের ফ্লাইটেই ইংল্যান্ড ফিরে যাবে।’

কসুকে বিশ্বাস করতে পারল না। তার চাচাতো ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। সে বিটলসকে জাপানে আসতে দেখে কান্না করেছিল। যদি এসব মিথ্যাই হয়ে থাকে তবে ওই কান্নার মূল্য কী রইল?

সেদিন বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে বসে বিটলসের সবগুলো গান আবার শুনল। বিশ্বাস হচ্ছে না তারা আর কোনো গান বানাবে না।

সময়টা বেদনাদায়ক ছিল। গ্রীষ্মের বন্ধেও তার মন ভালো হলো না। বিটলসেই পড়ে রইল তার মন। লেট ইট বি নামে তাদের একটা চলচ্চিত্র আসছে কিন্তু তার শহরে কোনো শো হবে না। অনেকে বলছে এই ছবি দেখলে তাদের ব্যান্ড ভেঙে ফেলার কারণ জানা যাবে। কসুকে ছবিটার কথা ভেবে রাতে ঘুমাতে পারত না।

যখন কসুকের প্রজন্ম এই সংবাদ নিয়ে স্তম্ভিত, তখন কসুকেকে জীবনের খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হয়।

একরাতে সে যখন অন্যান্য দিনের মতোই বিটলসের গান শুনছিল, তখন ধড়াম করে তার ঘরের দরজা খুলে যায়। কিমিকো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কসুকে বলতে চাইছিল একবার দরজায় টোকা দিয়ে নিলেই তো পারত। কিন্তু থেমে গেল। তার মায়ের চেহারায় এমন গম্ভীর ভাব সে আগে কখনও দেখেনি।

‘একটু লিভিং রুমে আসবে? দরকারি কথা আছে।’

কসুকে স্টেরিয়ো বন্ধ করে নেমে এলো। সে জানত না কী দরকারি কথা। কিন্তু বুঝতে পারছে খারাপ কিছু হতে চলেছে।

তার বাবা একটা দামি ব্র্যান্ডি হাতে নিয়ে একটা আর্মচেয়ারে বসে আছে। ট্যাক্স ফ্রি দেখে ব্র্যান্ডিটা একবার বিদেশ থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিল। কসুকে সামনে বসলে তার বাবা এমন কিছু বলল, যাতে কসুকের দুনিয়া দুলে উঠল।

‘আমরা মাসের শেষের দিকে এখান থেকে চলে যাচ্ছি। জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলো। আর কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বোলো না।’

‘কী হচ্ছে?’ কসুকে বুঝতে পারল না, ‘এত তাড়াহুড়ো কীসের?’

সাদায়ুকির কাছে সবসময় একটা জবাব তৈরি থাকে, ‘দেখো, আমি ব্যবসায়ী। আর ব্যাবসা যুদ্ধের মতো। প্রতিদ্বন্দ্বী তোমার কাছ থেকে যতটুকু পাচ্ছে সেটাই পার্থক্য গড়ে দেয়। বুঝতে পারছো?’

সে সবসময় এরকম কথাই বলে। কসুকে মাথা নাড়ল। সাদায়ুকি আবার বলতে থাকে, ‘যুদ্ধে কখনও কখনও পিছু হটতে হয়। মারা পড়লে তো এমনিতেই খেল খতম। বুঝেছো?’

এবার কসুকে মাথা নাড়ল না। তেমনটা তো আসল যুদ্ধে হয়। ব্যাবসার যুদ্ধে কেউ কেন মারা পড়বে?

সাদায়ুকি থামল না, ‘মাসের শেষে আমরা পিছু হটছি। এই বাসাটা শত্রুদের দিয়ে যাবো। কিন্তু সেটা ব্যাপার না। চিন্তার কিছু নেই। তোমাকে কেবল আমাদের কথামতো চলতে হবে। স্কুল বদলাতে হবে। সেটাও ব্যাপার না। গ্রীষ্মের বন্ধের পর সময়টা মিলে যাবে স্কুলের। প্রথম ট্রাইমেস্টার শেষ হলে পুরোপুরি সহজ হয়ে যাবে।’

কসুকে ভয় পেয়ে গেল। নতুন স্কুল?

‘এটা তেমন কিছু না,’ তার বাবা বলে গেল। ‘বাবাদের চাকরির কারণে বাচ্চাদের অনেক সময়েই স্কুল বদলাতে হয়। অস্বাভাবিক কিছু না এটা।’

জীবনে প্রথমবার কসুকে তার বাবার কথা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেল। জীবন নিয়ে অস্বস্তি।

পরদিন, কসুকে তার মায়ের কাছে গেল। তখন সে রান্না করছিল।

‘আমরা কী পালিয়ে যাচ্ছি?’

কিমিকো স্টিয়ার ফ্রাই বানাচ্ছিল। কসুকের কথা শুনে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল, ‘এসব কে বলল তোমাকে?’

‘কেউ না। কিন্তু বাবা যা বলেছে তার মানে তো এটাই দাঁড়ায়।’

কিমিকো দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘এটা আর কাউকে বলবে না।’

কসুকে আশা করেছিল কিমিকো বলবে এটা তার ভুল ধারণা। কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হলো না। পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।

‘আমাদের চলে যেতে হবে কেন? আমরা কি পথে বসে যাচ্ছি?’

‘আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে।’

‘কোথায় যাচ্ছি? কোথায় থাকব?’

‘যথেষ্ট হয়েছে কসুকে। অভিযোগ করতে হলে তোমার বাবার কাছে যাও। এটা তারই সিদ্ধান্ত।’

কসুকে বুঝতে পারল না সে কষ্ট পাবে নাকি রাগ করবে।

কয়েকদিন নিজের ঘর থেকে বের হলো না সে। কানে হেডফোন দিয়ে কেবল বিটলসের গান শুনল। যেন গান শুনে নিজের কষ্ট ভুলে যেতে চাইল।

কিন্তু শেষের এই প্রশান্তিটুকুও খুব দ্রুত ছিনিয়ে নেওয়া হলো তার কাছ থেকে।

‘স্টেরিয়োটা বিক্রি করে দিচ্ছি,’ তার বাবা একদিন বলে বসল।

কসুকে এত সহজে একে ছেড়ে দেবে না, ‘আমি বিক্রি করতে দিলে তো।’ কিন্তু সাদায়ুকি কোনো কথা বলল না।

‘এই ভারী জিনিসটা নিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমি তোমাকে পরে একটা কিনে দেবো।’

কসুকে রাগে ফেটে পড়ল, ‘আমরা বাসা বদলাচ্ছি—পালাচ্ছি না।

সাদায়ুকি রেগেমেগে তার দিকে তাকাল। যেন মেরে ফেলবে কসুকেকে।

‘আর একটা চিৎকার করবে তো ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।’

‘এভাবে কেন পালিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদেরকে?’

‘চুপ করো, যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলবে না।’

‘কিন্তু–’

‘ওরা মেরে ফেলবে আমাদেরকে।’ সাদায়ুকি চিৎকার করল, ‘তারা আমাদেরকে পালিয়ে যেতে দেখে ফেললে গুলি করে মেরে ফেলবে। তুমি চাও সেটা? একটা সুযোগই পাবো কেবল। সেটা কাজে লাগাতে না পারলে আমাদের তিনজনেরই মারা পড়তে হবে, কসুকে। একারণেই তোমার সহযোগিতা প্রয়োজন।’

তার বাবার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। কসুকে কিছু বলতে পারল না। তার জগৎ যেন গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল।

.

কিছুদিন পর কয়েকজন অজানা লোক এসে তার ঘরের সব অডিয়ো সরঞ্জাম নিয়ে গেল। একটা লোক কিমিকোকে কিছু টাকা দিয়ে গেল। সাদায়ুকি বাড়িতে ছিল না।

স্টেরিয়ো ছাড়া ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রাগে কসুকের গা জ্বালা করছে। মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

যেহেতু আর বিটলসের গান শুনতে পারবে না, সুতরাং বাসায় থাকার আর কোনো কারণ নেই। কসুকে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু পথে কোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয় না। সে বুঝতে পারে, যদি কেউ তাকে এভাবে দেখে ফেলে তাহলে সে তাদের পালানোর কথা বলে ফেলতে পারে। আর যদি কেউ বাসায় আসে, তাহলে স্টেরিয়ো বিক্রি হবার ব্যাপারটা সহজেই ধরে ফেলতে পারবে।

তার পকেটে বেশি টাকা ছিল না। বেশিরভাগ সময়ে লাইব্রেরিতে থাকতে শুরু করল। শহরের বড়ো লাইব্রেরিটাতে গেলে যেন ঘুম পায়। কিছু প্রাইভেট ঘর ছাড়া, যেখানে শিক্ষার্থীরা এয়ার কন্ডিশনিংয়ের জন্য ভিড় করে, তাদের বেশিরভাগই হাইস্কুলের ছেলেমেয়ে, কলেজের এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদেরকে পাগলের মতো পড়াশোনা করতে দেখে কসুকে ভাবত, সে কি আর কখনও কলেজে যাবার সুযোগ পাবে?

কসুকের বাবা-মা যা যা বলেছে তা গুরুত্বের সাথে নিতে হবে তাকে। এখন পর্যন্ত কসুকে সাদায়ুকির ওপর অনেক ভরসা করত। ভাবত তার বাবা যা বলে তাই সবসময় সঠিক। তার বিশ্বাস ছিল সে তার বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করলে একদিন তার মতোই সফল হতে পারবে।

কিন্তু বাস্তবতা এখন আর তেমন না। গত কদিনে সে তার বাবা-মায়ের অনেক কথোপকথন গোপনে শুনেছে। তাতে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলেছে কসুকে। তার বাবা কেবল একজন অসফল ব্যবসায়ীই নয়, বরং একজন ভীতু লোকও বটে। সবার অলক্ষ্যে সে পালিয়ে যাবে আর ঋণের বোঝা ফেলে যাবে অন্য কারও ঘাড়ে। কোম্পানির অনেক বড়োসড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে, যা তার বাবা আর সামাল দিতে পারবে না। পরের মাসে খবর সবার সামনে আসবে। তার বাবা কর্মচারীদেরকে এখনও কিছু জানায়নি। নিজের পরিবারকে বাঁচানোই এখন তার একমাত্র চিন্তা।

কসুকের কী করা উচিত? বাবা-মায়ের কথা শোনাই কী একমাত্র উপায়? আর কোনো উপায়ও তো নেই।

লাইব্রেরিতে বিটলসের ওপর লেখা একটা বইয়ে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল কসুকে। কিন্তু চিন্তাগুলো তার মাথা থেকে সরল না। কোনো বইয়েই তার কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই।

পালিয়ে যাবার দিনটা দ্রুত এগিয়ে আসছিল। কিন্তু কসুকের কিছু করার ছিল না। তার জিনিসপত্রগুলো গুছানো শুরু করা উচিত। কিন্তু সেসব করার ইচ্ছা মরে গেছে তার।

এরপর, এক রাতে লাইব্রেরিতে যাবার জন্য বেরিয়ে দেখল কনস্ট্রাকশন কাজের জন্য রাস্তা বন্ধ। অন্য একটা পথ দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। সেই রাস্তা ধরে যাবার সময়ে একটা স্টোর চোখে পড়ল তার। কয়েকটা বাচ্চা স্টোরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেওয়ালে কিছু দেখে হাসছে।

কসুকেও এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলো। দেওয়াল ভরতি চিঠি টানানো।

প্রশ্ন: গামেরা এত গোল গোল ঘুরেও পড়ে যায় না কেন?

—গামেরার বন্ধু

উত্তর: আমার মনে হয় গামেরা ব্যালে করত। ব্যালেরিনারা যত দ্রুতই ঘুরুক না কেন, তারা পড়ে যায় না।

-নামিয়া জেনারেল স্টোর

প্রশ্ন: আমি সাদাহারুর মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যাট করতে চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো হোম রান করতে পারি না।

—টপল অব দ্য এইটথ

উত্তর: এক পায়ে চেষ্টা করার আগে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে হোম রান করার চেষ্টা করুন। দুপায়ে সম্ভব না হলে তিন পায়ে চেষ্টা করুন। কিন্তু চেষ্টা কখনও অসম্ভব লক্ষ্য নিয়ে শুরু করবেন না।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

ওহ আচ্ছা, এটা সেই জায়গা? ভাবল কসুকে। তার বন্ধুরা এই স্টোরের কথা বলত। যত সামান্য সমস্যাই হোক না কেন এই লোকটা নাকি তা সমাধানের পরামর্শ দেয়। বেশিরভাগ সময়ে মানুষ অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নই করত। বয়স্ক লোকটার সাথে মজা করতে। দেখতে চাইত সে কীভাবে উত্তর দেয়। লোকটা সমসময়েই চমৎকার উত্তর দেয়।

ফালতু জিনিস। ভেবে কসুকে সেখান থেকে হেঁটে চলে গেল।

কিন্তু একটা বুদ্ধি এলো মাথায়।

তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল কসুকে। স্বভাবতই, তার বাবা এখন কাজে আছে আর মা বাড়িতে নেই।

নিজের ঘরে গিয়ে ডেস্কে কাগজ কলম নিয়ে বসল। সে ভালো লিখতে পারে না। এক ঘণ্টা ভেবে যা লিখল:

আমার বাবা-মা রাতের বেলা পালিয়ে যেতে চায়।

তাদের ওপর অনেক ঋণের বোঝা এবং আমরা সেটা শোধরাতে পারব না। একারণে আমার বাবা পালিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

.

আমাদের এই মাসের শেষের দিকে চলে যাবার কথা।

তারা বলছে আমাকে স্কুল বদলাতে হবে। আমি তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে চাই। তারা বলেছে আমরা যত দূরেই পালাই না কেন, সেই লোকগুলো আমাদেরকে খুঁজে বের করবে। আমার ভয় হচ্ছে আমাদের হয়তো আজীবন পালিয়েই বেড়াতে হবে।

কী করব আমি?

—পল লেনন

.

চিঠিটা কয়েকবার পড়ে ভাঁজ করে তার পকেটে রাখল। এরপর বাসা থেকে বেরিয়ে নামিয়া জেনারেল স্টোরে গিয়ে উপস্থিত হয়। রাস্তার ওপাশ থেকে দেখে মনে হচ্ছে সবাই চলে গেছে। বয়স্ক লোকটাও দোকানের পেছন দিকে বসে পত্রিকা পড়ছে। এটাই সুযোগ।

কসুকে বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেল। সে প্রক্রিয়াটা জানে। স্লটটা এমন জায়গায় রাখা যেটা ভেতর থেকে দেখা যায় না। ইচ্ছা করেই এমন করেছে লোকটা, কসুকে ভাবল।

কসুকে স্টোরের সামনে গিয়ে চিঠি দেখার ভান করল। স্লটটা ঠিক তার সামনেই। বুক ধক-পক করছে। ইতস্তত করছে কসুকে। এটা কী ঠিক হচ্ছে?

কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। বাচ্চারা আবার আসছে। হায় হায়, ওরা চলে এলে তো আমি আর সুযোগ পাবো না।

যা হয় হোক। চিঠিটা বাক্সে ফেলে দিলো কসুকে। একটু শব্দ করেই যেন ভেতরে পড়ে গেল সেটা।

চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে বাচ্চারা ভেতরে ঢুকল, ‘এই মিস্টার নামিয়া! আপনি কি কিটারো পেন্সিল কিটটা আনিয়েছিলেন?’ যে বাচ্চাটা চিৎকার করছে সে খুব বেশি হলে ক্লাস ফাইভে পড়ে।

‘অবশ্যই আমি কিছু সাপ্লাইয়ারের সাথে কথা বলেছিলাম। তারা আমাকে একটা দিয়ে যায়। এটাই সেটা?’

‘বাহ! এটা ম্যাগাজিনে যেমন দেখাচ্ছিল ঠিক সেরকম। দাঁড়ান, আমি এখনই বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসছি।’

‘আচ্ছা, সাবধানে যেও।’

এটুকু দেখে কসুকে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। মনে হচ্ছে বাচ্চাটা জিজিজি নো কিটারো, একটা জনপ্রিয় মাঙ্গা সিরিজের একটা চরিত্রের ফিচার করা কোনো স্পেশাল পেন্সিল কেসের অর্ডার দিয়েছিল।

চলে যাবার আগে একবার ঘুরে স্টোরটা না দেখে পারল না কসুকে। বয়স্ক লোকটা ঠিক তার দিকে তাকিয়ে আছে। কসুকের অস্বস্তি লাগল। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এখন আফসোস লাগছে, কেন এটা করতে গেল। চিঠিটা দেওয়া ঠিক হয়নি। স্লটে ফেলবার সময়ে যা শব্দ হয়েছে তাতে লোকটা নিশ্চয়ই বুঝে গেছে এটা কসুকে লিখেছে।

এটা নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে ঠিকই, তবে কেন যেন আবার মনে হচ্ছে এসব ব্যাপার না। বয়স্ক লোকটা পল লেননের নামেই চিঠিটা দেওয়ালে টানাক। সে কেমন পরামর্শ দেবে কে জানে। কিন্তু তাতেও কিছু আসে যায় না। আসে যায় বরং অন্য কেউ চিঠিটা দেখে ফেলবে তাতে।

লোকমুখে তখন কথা ছড়াবে কেউ রাতের বেলা শহর ছেড়ে পালাবার পরিকল্পনা করছে। যদি সেই লোকগুলো, যারা তার বাবার কাছে টাকা পায়, তাদের কানে পৌঁছে যায়? তারা বুঝে যাবে এই চিঠির প্রেরকের বাবা সাদায়ুকি ওয়াকু। আর তারা নিশ্চিত কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেবে।

তার বাবা-মা লোকের মুখে এসব কথা শুনে হয়তো পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা বাদ দেবে।

এটা যেন কসুকের একটা জুয়া। খুব ব্যয়বহুল জুয়া। মিডেল স্কুলে পড়া একটা বাচ্চা হিসেবে এর চেয়ে বেশি তার আর কিছু করার নেই তার।

পরদিন বিকেলে কসুকে সোজা নামিয়া জেনারেল স্টোরে গিয়ে উপস্থিত হয়। সৌভাগ্যবশত, বয়স্ক লোকটা তখন সেখানে ছিল না। হয়তো বাথরুমে গেছে। কসুকে দেওয়ালের চিঠি দেখতে লাগল। নতুন একটা পোস্ট আছে, কিন্তু সেটা চিঠির উত্তর নয়, বরং ঘোষণা।

.

মিস্টার পল লেনন,

আপনার চিঠি পেয়েছি আমি। আপনার উত্তর স্টোরের পেছনে মিল্ক ক্রেটে পাবেন।

বাকিদের উদ্দেশ্যে,

এই চিঠি কেবল পল লেননের জন্য। দয়া করে সেটা দেখবেন না। অন্য কারও মেইল খোলা বা চুরি করা একটা অপরাধ। সবাইকে ধন্যবাদ।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

কসুকে থতমত খেয়ে গেল। প্ল্যানটা উলটো তার ওপরেই চড়ে বসছে। তার চিঠি বাকিদের মতো পোস্ট করা হয়নি। সে ভেবেছিল ছক্কা মারবে। কিন্তু হোম রানের বদলে গেমটাই বাদ হয়ে গেল।

কিন্তু লোকটার চিঠির কী হবে? কসুকে স্বীকার করল সে কিছুটা কৌতূহল বোধ করছে। কেমন পরামর্শ দিয়েছে?

কসুকে বাইরে এসে চারপাশে দেখে নিলো। কেউ নেই। পাশের গলি দিয়ে পেছনে চলে এলো সে। দরজার পাশেই একটা মিল্ক ক্রেট।

ঢাকনা খুলে দেখল ভেতরে কোনো দুধের বোতল নেই। কেবল একটা খাম। সে বের করে দেখল তাতে ‘পল লেনন’ লেখা।

খামটা শক্ত করে ধরে রাস্তায় উঁকি দিলো কসুকে। কেউ নেই। একজন লোক পাহাড়ের দিক থেকে আসছে। কসুকে লোকটার চলে যাবার অপেক্ষা করল। যখন বুঝতে পারল রাস্তা এখন একদম ফাঁকা, তখন দিলো এক ছুট।

কোথায় যাবে? লাইব্রেরিতে। কিন্তু ভেতরে গেল না, বাইরে একটা পার্কের বেঞ্চে বসল। খামের দিকে তাকিয়ে দেখল সেটা এখনও আঠা দিয়ে সিল করা। সাবধানে খুলল যেন ভেতরের চিঠিটা ছিঁড়ে না যায়। ভেতরে কসুকের দেওয়া চিঠিসহ আরও একটা চিঠি আছে। পরিষ্কার চিঠিটা কালো ফাউন্টেনপেন দিয়ে লেখা হয়েছে।

.

প্রিয় পল লেনন,

চিঠি লেখার জন্য ধন্যবাদ। সত্যি বলতে এটা দেখে আমি থতমত খেয়েছি। আমি প্রতিবেশী বাচ্চাদের সাথে খেলার ছলে চিঠি আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াটা শুরু করেছিলাম। তাদেরকে বলেছিলাম তাদের জীবনের যে-কোনো সমস্যা আমাকে চিঠিতে জানাতে, আমি তার উত্তর দেবো। কিন্তু সেসব চিঠিতে খুব সামান্য সমস্যার কথাই লেখা থাকত। কিন্তু আপনার চিঠি খুবই গুরুতর। বাস্তব জীবনের এক কঠিন সমস্যা। আমার মনে হয় আপনি চিঠি আদান-প্রদানের ব্যাপারটাকে ভুল বুঝেছেন। হয়তো শুনেছেন আমার স্টোর থেকে চিঠির উত্তর দেওয়া হয়, কিন্তু জানতেন না এসব কেবলই মজার ছলে। এমন যদি হয়ে থাকে তবে আপনার চিঠি ফিরিয়ে দেওয়া এখন আমার কর্তব্য। অন্ততপক্ষে এটুকু বলার জন্য যে আপনি অন্য কারও কাছে আমার চাইতে ভালো পরামর্শ পেতে পারেন। একারণে আপনার চিঠিটা ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম।

কিন্তু ফেরত দিতে গিয়ে মনে হলো কেবল আপনার চিঠিই আপনাকে ফিরিয়ে দিলে সেটা আমার পক্ষে দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হবে। যদিও পুরোটাই একটা ভুল বুঝাবুঝি, তাও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাকে কোনো পরামর্শ দেওয়ার।

যাই হোক, আমি আপনার অবস্থান থেকে পরিস্থিতিটা দেখার চেষ্টা করছি। সবচেয়ে বেশি ভালো হবে যদি আপনার বাবা-মায়ের মত বদলানো যায়। আমি অনেককে পালিয়ে যেতে দেখেছি। তাদের প্রত্যেকের কী হয়েছিল তা আমি সরাসরি শুনিনি কিন্তু আমার ধারণা তারা কেউই কখনও শান্তিতে বাস করতে পারেননি। আজীবন পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে।

কিন্তু আপনার বাবা-মায়ের মত বদলানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। আমি নিশ্চিত তারা অনেক চিন্তাভাবনা করেই এই সিদ্ধান্তে এসেছে। তারা হয়তো পরিস্থিতিটা আপনার চেয়ে বেশি গভীরভাবে জানে। এত সহজে তাদের মত বদলানো গেলে আপনি আমার পরামর্শ চাইতেন না নিশ্চয়ই।

সেই সূত্রে একটা প্রশ্ন আসে আমার মনে। আপনার বাবা-মায়ের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন? তাদেরকে পছন্দ করেন? তাদেরকে বিশ্বাস করেন? নাকি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন তাদের প্রতি?

হয়তো আপনার মনে আছে, আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনার কী করা উচিত, আপনার পরিবারের কী করা উচিত, তাই না? তাই কোনো পরামর্শ দেওয়ার আগে আমাকে জানতে হবে তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন।

শুরুতেই বলেছিলাম, এই প্রথমবার আমি কোনো গুরুতর চিঠির উত্তর দিচ্ছি। আমি হয়তো আপনাকে যথাযথ কোনো উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নই। এই চিঠি পেয়ে যদি আপনি বিরক্ত হন তবে এটা এ পর্যন্তই থাকুক। কিন্তু আপনি যদি আরও কিছু বলতে চান, তবে আমার প্রশ্নগুলো বিবেচনা করে দেখবেন। সেগুলোর যথাযথ উত্তর দেবেন। আমি আশা করি তখন কোনো ভালো পরামর্শ দিতে পারব।

এবার আপনার চিঠি বাক্সে ফেলার দরকার নেই। আমি আটটায় শাটার বন্ধ করে দেবো। আপনি এরপর এলে আপনার চিঠিটা মেইল স্লটে রেখে যেতে পারেন। আমি আমার উত্তরটা পরদিন সকালে মিল্ক ক্রেটে রেখে দেবো। আপনার যখন খুশি তখন আসতে পারেন। আমাদের স্টোর সকাল সাড়ে আটটা থেকে খোলা থাকে।

আপনাকে নিরাশ করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু আপাতত এটুকুই করতে পারলাম আমি।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

কসুকে আবারও চিঠিটা পড়ে অনেক কিছু হজম করার চেষ্টা করল।

প্রথমত, লোকটা চিঠিটা পোস্ট করেনি। সে বুঝতে পারল কেন। বাকি চিঠিগুলো মজার ছলে লেখা। মানুষজন দেখে মজা পায়। কিন্তু এরকম একটা চিঠি পোস্ট করার মতো না।

আরেকটা ব্যাপার, লোকটা চাইলেই এমন গুরুতর চিঠির উত্তর দেওয়া এড়িয়ে যেতে পারত। কিন্তু সে উত্তর দিয়েছে, বা দেওয়া শুরু করেছে। এটা কসুকের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। তার পরিস্থিতিটা অন্য কাউকে বলতে পেরে তার ভালো লাগছে।

কিন্তু বয়স্ক লোকটা আসলেই উত্তর দেয়নি। কসুকেকে কিছু প্রশ্ন করেছে। সেসবের উত্তর দিলে সে পরামর্শ দিতে পারবে।

আপনার বাবা-মায়ের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?

একটা কঠিন প্রশ্ন। কেমন সম্পর্ক আসলে?

কসুকে জানে না। মিডেল স্কুলে ওঠার পর থেকে তাদের ওপর সে বিরক্ত হয়ে আছে তবে তাদেরকে ঘৃণা করতে পারে না। তাদের আচার-ব্যবহারে সে কেবল বিরক্ত।

কিন্তু পালিয়ে যাবার কথাটা শুনে তাদের ওপর থেকে আস্থা চলে গেছে কসুকের। ভালোবাসা বা ঘৃণা? হ্যাঁ, তাদের কাজ-কর্মকে সে ঘৃণা করছে। তাদের ওপর আর আস্থা নেই। যাদের ওপর আস্থাই নেই, তাদের কথামতো চলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে সেটা সে কীভাবে বিশ্বাস করবে?

কসুকে বারবার ভাবল। কিন্তু প্রশ্নগুলোর এই উত্তরই এলো তার মাথায়। সে চিঠি লিখে ফেলল। চিঠি নিয়ে বের হবার সময়ে তার মা তাকে জিজ্ঞাসা করছিল সে কোথায় যাচ্ছে। উত্তরে কসুকে বলল এক বন্ধুর বাসায়। তার বাবা বাসায় ছিল না।

আসতে আসতে আটটা বেজে গেল। তখন শাটার বন্ধ। মেইল স্লটে চিঠিটা ফেলে দিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে গেল কসুকে।

পরদিন সকাল সাতটায়ই উঠে গেল সে। সারারাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি।

বাবা-মা দুজনেই ঘুমিয়ে ছিল। সন্তর্পণে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো কসুকে।

নামিয়া জেনারেল স্টোরের শাটার এখনও বন্ধ। আশেপাশে কেউ নেই। সে মিল্ক ক্রেটের কাছে চলে এলো। গতদিনের মতোই সাবধানে খামটা নিয়ে লাইব্রেরির দিকে ছুটল। কিন্তু লাইব্রেরি পর্যন্ত গেল না। রাস্তার পাশে দাঁড় করানো একটা ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে খামটা খুলল।

.

প্রিয় পল লেনন,

আমার মনে হয় আমি এখন আপনার অবস্থাটা ঠিকমতো বুঝতে পারছি।

এই পরিস্থিতিতে বাবা-মায়ের ওপরে ভরসা হারিয়ে ফেলা অস্বাভাবিক কিছু না। স্বভাবতই এখন আপনি আপনার বাবা-মায়ের ওপর বিরক্ত হতে শুরু করবেন।

আমার মতে পরিবারের সবাইকে একসাথেই থাকা উচিত, যতই কঠিন পরিস্থিতি আসুক না কেন। রাগ বা অধৈর্যের বশে কেউ কোনো চিঠি লিখে পালিয়ে যাওয়াটা পরিবারের ঐক্যকে অর্থহীন করে তোলে।

আপনি বলেছেন আপনার বাবা এখন যা করছে তাতে আপনি ক্ষুব্ধ। আমি এই বাক্যে আপাতত আশা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। নিশ্চয়ই নিকট অতীতে আপনার বাবা-মা এবং তাদের সিদ্ধান্তকে আপনি খুব পছন্দ করতেন। হয়তো ভবিষ্যতে তাদের প্রতি আপনার অনুভূতিগুলো আবার আগের মতো হয়ে যেতে পারে।

এমন যদি হয়ে থাকে তাহলে আসলে আপনার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আপনার পরিস্থিতিতে, পালিয়ে যাওয়াটা খুব একটা ভালো উপায় না। সাধারণত, আমি পালিয়ে যাবার পরামর্শ কখনও দিবো না। কিন্তু যেহেতু আর কোনো উপায় নেই, তাই আমার ধারণা আপনার বাবা-মায়ের কথা মেনে চলাই এখন সর্বোত্তম উপায়।

আমি নিশ্চিত আপনার বাবা-মা সব জেনে-বুঝেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তারা জানে কেবল পালিয়ে গিয়েই বেঁচে যাবে না তারা। কিছুদিন গা ঢাকা দিয়েই থাকতে হবে। এরপর সময়-সুযোগ বুঝে সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে।

এতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। অনেক কষ্টও হবে। কিন্তু পরিবারের সবাই একত্রে থাকাই মঙ্গল। আপনার বাবা মুখে কিছু বলেন না কিন্তু আমি নিশ্চিত তিনি আপনার জন্য সবকিছু করতে পারেন। নিজের পরিবারকে বাঁচাবার জন্য তিনি যে-কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। তার এই যুদ্ধে তার সাথে থাকা আপনার এবং আপনার মায়ের কর্তব্য।

সবচেয়ে খারাপ পরিণতি হবে আপনার পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা। এর চেয়ে বড়ো ক্ষতি আর নেই। আমি এটা বলতে পারব না যে পালিয়ে যাওয়াই আপনাদের জন্য সবচেয়ে ভালো সমাধান, কিন্তু এতে করে আপনারা লড়াই করে যাবার একটা সুযোগ পাবেন। এবং আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার রাস্তা তৈরি করে নিতে পারবেন।

আমি জানি না আপনার বয়স কত কিন্তু চিঠির লেখার ধরণ দেখে ধারণা করছি মিডেল স্কুল বা হাইস্কুলে পড়েন। কোনো একদিন নিজের বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে হবে। সেদিনের জন্য তৈরি হতে আপনাকে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে এবং নিজের জীবন তৈরি করতে হবে। আশা করি যেন সেই রাস্তায় আপনাকে কোনো কঠিন প্রতিবন্ধকতার মুখে না পড়তে হয়।

বিশ্বাস করুন, বর্তমান যতই খারাপ হোক না কেন, ভবিষ্যৎ সবসময় ভালো সময় নিয়ে আসে।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

কসুকের এক বন্ধু, যে নিজেও দ্য বিটলসের ভক্ত, সে গ্রীষ্মের বন্ধের এক সপ্তাহ আগে কসুকেকে ফোন করল। এই বন্ধুটাই বিটলসের জাপানে আসা নিয়ে যত্রতত্র বলেছিল। এবার সে ফোন করে কসুকের বাসায় আসতে চাইছিল যেন তারা আগেরমতো একসাথে বিটলসের গান শুনতে পারে। খুব বড়ো ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তার কাছে বিটলসের কোনো রেকর্ড ছিল না। তার পরিবারের কোনো রেকর্ড প্লেয়ার ছিল না। বিটলসের গান শুনতে চাইলে সে সবসময় কসুকের বাড়িতে চলে আসত।

‘দুঃখিত, এবার পারব না। বাড়ির কাজ চলছে, তাই স্টেরিয়োটা ধরা নিষেধ।‘

যেদিন স্টেরিয়োটা নিয়ে যায় সেদিন থেকেই এই অজুহাতটা তৈরি ছিল কসুকের মনে।

‘কী বলছ?’ বন্ধুটা এটা আশা করেনি। কণ্ঠে হতাশা স্পষ্ট বুঝা গেল, ‘ইশ, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছিল।’

‘কিছু হয়েছে নাকি?

‘আমি আজকে চলচ্চিত্রটা দেখেছি।’

লেট ইট বি। সেই চলচ্চিত্রটা।

‘কেমন ছিল?’

‘এটা দেখে আমার চোখ খুলে গেছে।’

‘কেন?’

‘অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে গেছে আমার কাছে, যেমন তারা কেন ব্যান্ড ছেড়ে দিলো, ইত্যাদি।’

‘কেন ছেড়েছে তা বলেছে?’

‘না সেভাবে বলেনি। ফিল্মিংয়ের সময়ে কেউ ব্যান্ড ভাঙার কথা বলেনি কিন্তু এমন কিছু হতে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছিল। বলে বোঝানো যাবে না। তুমি দেখলে বুঝবে।

‘ওহ, আচ্ছা।’

কথা আর জমছিল না। কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে দিলো দুজনে। কসুকে নিজের ঘরে গিয়ে বিটলসের রেকর্ডগুলো দেখছিল। তার আর তার চাচাতো ভাইয়েরগুলো মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশটা আছে।

এসব কীভাবে ছেড়ে দেবে তা সে জানে না। তার পরিবার যেখানে যাচ্ছে সেখানে এগুলো নিয়ে যাবার উপায় বের করতে চেয়েছিল কসুকে। তার বাবা-মা দুজনেই তাকে হালকা জিনিসপত্র ব্যাগে নিতে বলেছে। কিন্তু এই রেকর্ডগুলো ফেলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।

সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সে আর মাথা ঘামাবে না। বাধা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। তাদের মত বদলাবে না। আর তারা কসুকেকে ফেলেও যাবে না। নামিয়া স্টোরের বুড়ো মালিকটা বলেছিল, তার বাবা- মা সব ভেবেচিন্তে করছে। আসলে তাই-ই। কেবল বিশ্বাস রাখতে হবে যে-কোনো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

যাই হোক, এতটা আত্মপ্রত্যয় তার বন্ধু কোথা থেকে পেল? লেট ইট বি দেখে এমন কী বুঝে যাবে সে?

সেদিন রাতের খাবারের পর সাদায়ুকি পালিয়ে যাবার পরিকল্পনাটা সবাইকে খোলাখুলিভাবে বুঝিয়ে দিলো। ৩১ আগস্টের মধ্যরাতে তারা সবকিছু গুছিয়ে নেমে পড়বে।

‘সেদিন সোমবার। আমি কাজে যাবো। সেপ্টেম্বরের শুরুতে আমার এক সপ্তাহের ছুটি নেওয়া আছে। সেই সপ্তাহে আমাকে না দেখলেও কেউ কিছু সন্দেহ করবে না। এরপরের সপ্তাহে বিলগুলোর নোটিশ আসতে শুরু করবে। তখন সবাই জেনে যাবে যে আমরা পালিয়ে গেছি। আমাদেরকে কিছু সময়ের জন্য গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু এক বা দুই বছর সংসার চালানোর মতো টাকা আমাদের হাতে আছে। এর মধ্যে আমরা কোনো না কোনো রাস্তা খুঁজে পেয়ে যাবো।’ সাদায়ুকির চেহারায় আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ স্পষ্ট।

‘স্কুলের কী হবে? আমি কোন স্কুলে যাবো?’

সাদায়ুকি প্রশ্নটা শুনে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো, ‘আমি সেটা ভেবে দেখেছি। আপাতত সেসবের সুযোগ নেই। তোমাকে নিজে নিজেই আপাতত পড়াশোনা করতে হবে।’

‘মানে আমি আর স্কুলে যাবো না?’

‘সেটা বলিনি। যাবে। তবে এখনই নয়। মিডেল স্কুল শেষ করার দরকার সবারই আছে। তোমাকে কোথাও ভর্তি করিয়ে দেবো। সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। পরের বছর থেকে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করবে।’ সাদায়ুকির মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে।

‘হাইস্কুলের কী হবে?’ কসুকে প্রশ্নটা করতে পারল না। সে জানে তারা বাবা বলবে: ‘ভেবো না, আমি সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি।’ হ্যাঁ, তাই তো করছো।

এদের সাথে পালানোটা কি আসলেই সঠিক সিদ্ধান্ত? সে জানে এই একটা রাস্তাই আছে তার সামনে, কিন্তু কেন যেন সেটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না।

খুব শীঘ্রই ৩১ আগস্ট চলে এলো। কসুকে তার ব্যাগ গোছাচ্ছিল। তখন সাদায়ুকি দরজা খুলে ভেতরে এলো।

‘এক মিনিট সময় হবে?’

‘হ্যাঁ।’

সাদায়ুকি কসুকের পাশে এসে বসল। ‘সব প্রস্তুতি শেষ?’

‘হ্যাঁ। ভাবলাম টেক্সটবইগুলো সাথে করে নিয়ে যাই।’

‘হ্যাঁ, সেগুলো লাগবে তোমার।’

‘আর এগুলোও,’ কসুকে বিছানার নিচে থেকে একটা ভারী কার্ডবোর্ডের বাক্স বের করল। এতে বিটলসের সব রেকর্ড আছে।

‘সবগুলো?’

‘আমি বাকি জিনিসপত্র কমিয়ে নিয়েছি,’ কসুকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমি এগুলো নিয়ে যাবো আমার সাথে।’

সাদায়ুকি তেমন কিছু বলল না। কসুকের দিকে তাকাল, ‘বুড়ো বাবাকে এখন কেমন লাগে তোমার?’

‘মানে?’

‘তুমি রেগে আছো মনে মনে, তাই না? ভাবছ আমি খুব জঘন্য বাবা।’

‘তুমি জঘন্য না—’ বিড়বিড় করল কসুকে, ‘কী হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না। ভয় লাগছে আসলে।’

সাদায়ুকি মাথা নাড়ল, ‘লাগারই কথা।’

‘বাবা, সব কিছু ঠিক থাকবে তো? আমরা কী আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব?’

সাদায়ুকি কয়েকবার চোখ পিট পিট করল, ‘জানি না কবে বা কখন কিন্তু একদিন সব ঠিক হবেই। কথা দিচ্ছি।’

‘কথা দিচ্ছো?’

‘কথা দিচ্ছি। আমার কাছে আমার পরিবারের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। তোমাকে আর তোমার মাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আমি যে-কোনো কিছু করতে পারি। দরকার পড়লে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেবো। একারণেই—’ সাদায়ুকি সোজা তার পুত্রের চোখের দিকে তাকাল, ‘একারণেই পালাতে হবে।’

‘আচ্ছা বাবা।’

‘ঠিক আছে,’ সাদায়ুকি উঠে দাঁড়াল, ‘কালকের প্ল্যান কী তোমার? এখনও গ্রীষ্মের ছুটি কিছুটা বাকি আছে তোমার। যাবার আগে বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা করবে না?’

কসুকে মাথা নাড়লো, ‘সব হয়ে গেছে।’ বলতে চাইছিল, লাভ কী? সে আর কখনও তাদের সাথে দেখা করতে পারবে না। কিন্তু এগুলো বলল না। ‘আমি টোকিও চলে গেলে কেমন হয়?’

‘টোকিও? কেন?’

‘একটা চলচ্চিত্র দেখতে চাচ্ছিলাম। ইয়ুরাকুচতে সুবারু—এটা থিয়েটারে চলছে।’

‘কালই যেতে হবে?

‘যেখানে যাচ্ছি সেখানে যদি আর সুযোগই না পাই?’

‘ওহ, এ জন্য।’

‘যেতে পারি?’

‘পারো, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।’

‘আমি জানি।’

সাদায়ুকি শুভ রাত্রি জানিয়ে চলে গেল।

কসুকে একটা রেকর্ড বের করল। গত বছরই কিনেছিল এটা। লেট ইট বি। ওপরে বিটলসের চারজনের ছবি আঁকা।

সে রাতে চলচ্চিত্রটার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমানোর চেষ্টা করল কসুকে।

পরদিন সকালের নাস্তা করে কসুকে বেরিয়ে গেল। কিমিকো রাজি হয়নি কিন্তু সাদায়ুকি তাকে মানিয়ে ফেলল।

কসুকে এর আগেও বন্ধুদের সাথে টোকিওতে এসেছিল, কিন্তু একা এই প্ৰথম।

টোকিও স্টেশনে নেমে ইয়ামানোটে লাইনে উঠে ইয়ুরাকুচুতে পৌঁছাল। ম্যাপ দেখে বুঝল তার গন্তব্য কাছেই রয়েছে।

বাইরে খুব ভিড়। কসুকে ভাবল গ্রীষ্মের বন্ধের শেষ দিন বলে এই ভিড়। লাইনে দাঁড়িয়ে একটা টিকেট কিনে নিলো। শো শুরু হবার আগে আরও আধাঘণ্টা আছে।

এই সুযোগে আশেপাশের এলাকাটা দেখে নেওয়া যায়। সে ইয়ুরাকুচু বা গিনযার দিকে কখনও আসেনি।

হাঁটতে শুরু করলে কয়েক মিনিটের মাঝেই কসুকে হতভম্ব হয়ে যায়।

শহরটা অতিকায়। ইয়ুরাকুচুর বিশাল বিশাল বিল্ডিং আর মানুষ দেখে সে আগেই অবাক হয়েছিল কিন্তু গিনযার ব্যাপার অন্যরকম। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে যেন উৎসবের আমেজ। রাস্তাগুলো যেন জীবন্ত। পথচারীরা সবাই দেখতে সফল ও পরিশীলিত। এ শহরের সবখানে যেন উৎসব চলছে।

কিছুক্ষণ পর কসুকে এক্সপোর লোগো দেখতে পেল। এত মাস পরেও ওসাকাতে এখনও এক্সপো চলছে। আর টোকিওর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পুরো দেশ সেই উৎসবেই মেতেছে।

কসুকের একটা ধাক্কা লাগল। পৃথিবীতে এরকম জায়গাও আছে যেখানে জীবনের উৎসব পালন করা হয়। কিন্তু এটা তার জগৎ না। তার জন্ম হয়েছিল একটা সরু, একঘেয়ে নদীর পাশে জীবন কাটাবার জন্য। আর পরদিনই সে সেই নদীর গহীনে হারিয়ে যাবে।

থিয়েটারে ফিরে এলো সে। টিকেট দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা সিটে বসল। মনে হচ্ছে অনেকেই একা এসেছে।

চলচ্চিত্র শুরু হলো। প্রথমেই দেখা গেল ব্যান্ডের একটা ক্লোজআপ ছবি। ‘দ্য বিটলস’।

কসুকের বুক ধকধক করছে। এটাই সেই মহেন্দ্রক্ষণ। উত্তেজনা বেড়ে চলেছে তার।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার উত্তেজনা মিলিয়ে গেল।

লেট ইট বি একটা প্রামাণ্যচিত্র হবার কথা ছিল। লাইভ পারফরমেন্স-এর ফুটেজ নিয়ে বানানো একটা প্রামাণ্যচিত্র। কিন্তু এমন একটা ছবি বানাবার জন্য ওসব ফুটেজ নেওয়া হয়নি। বিটলসের কোনো সদস্যই যেন চলচ্চিত্রটা বানাতে চাচ্ছিল না। মনে হচ্ছে যেন তারা আইনত মানা না করতে পারায় এই চলচ্চিত্র বানাতে বাধ্য হয়েছে।

তাদের আধো আধো ডায়লগ, রিহার্সাল বা ছবির সাবটাইটেল দেখে কসুকে বুঝতে পারছিল না এটা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বা কী বুঝাতে চাইছে।

কিন্তু একটা জিনিস সে স্পষ্ট বুঝতে পারল।

বিটলসের কেউই আর সেই জায়গায় নেই।

এমন না যে তাদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব বা তারা গান করতে চাইছে না। তারা চারজন সবই করছে। কিন্তু তারা বুঝে গেছে, তারা আর অর্থবহ কিছু বানাতে পারছে না।

অবশেষে তারা চারজন অ্যাপলের বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে গেল। তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলো ইতোমধ্যেই সেখানে ছিল। সব স্টাফ সেখানে উপস্থিত হয়। জন লেননের পরনে ছিল একটা পালকের কোট।

তারা ‘গেট ব্যাক’ দিয়ে শুরু করে।

দ্রুতই বুঝা গেল যে এই শো-এর ঘোষণা আগে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়নি। পথচারীরা যখন রাস্তা থেকে বিটলসের গান শুনতে পেল তখন বিল্ডিংয়ের আশেপাশের এলাকায় ভিড় লেগে যায়। পুলিশ আসে।

এরপর ‘ডোন্ট লেট মি ডাউন’ আর ‘আই হ্যাভ গট আ ফিলিং’ বাজায় তারা। কিন্তু তাদের পারফরমেন্সে সেই আবেগ ছিল না। এটা তাদের শেষ শো, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই কোনো আবেগ প্রদর্শন করেনি।

এভাবেই চলচ্চিত্র শেষ হয়।

কসুকে অনেকক্ষণ সিটে বসে রইল। সে হতভম্ব হয়ে গেছে। দাঁড়াবার শক্তি ও নেই। যেন কেউ তাকে এক গাদা গলিত লেড খাইয়ে দিয়েছে।

এসব কী? সে যা ভেবেছিল এটা সেরকম কিছুই না। তারা না কোনো তর্ক করল, না কোনো ঝগড়া। কিন্তু কথা বলার সময়ে যেন একে অপরকে এড়িয়ে চলছিল। কথা বললেও কেবল কৌতুক বা ম্লান হাসি হেসেছে।

গুজব ছিল যে যারা মুভিটা দেখেছে, তারা বিটলস ভেঙে যাবার কারণ খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু কসুকে পায়নি। কারণ মুভিটা করার সময়ই বিটলস ভেঙে গিয়েছিল। কসুকে জানতে চায় তারা এই পর্যায়ে এলো কী করে।

ট্রেনে করে বাড়ি ফেরার সময়ে কসুকে বুঝতে পারল—এটা হয়তো কোনো ব্রেকাপ না।

কেবল কোনো একটা কারণেই মানুষ একে অপরের থেকে দূরে সরে যায় না। একটা কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু সেই কারণকেও একের পর এক ইন্ধন দিয়ে শক্তিশালী করে তুলতে হয়। যদি নিজেদের মনে সেই ইচ্ছেটা থাকে আর বন্ধন শক্তিশালী থাকে তবে কেউ না কেউ নষ্ট হয়ে যাওয়া জিনিসটা আবার সারিয়ে তুলতে এগিয়ে আসে। যখন কেউ আসে না তখনই জিনিসটা ভেঙে যায়। একারণেই চোখের সামনে বিটলস ভেঙে যেতে দেখেও তাদের চারজনের কেউ এগিয়ে আসেনি।

কসুকের মনে হলো তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। যেন তার খুব মূল্যবান কিছু কেউ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তখন সে সিদ্ধান্তটা নিলো।

স্টেশনে এসে সে তার বন্ধুকে ফোন করল। সেই বন্ধু যে এক সপ্তাহ আগে তাকে লেট ইট বি দেখার কথা বলেছিল।

বন্ধুটা বাসায়ই ছিল। কসুকে জিজ্ঞাসা করল সে কসুকের রেকর্ডগুলো কিনবে কিনা।

‘কোন রেকর্ড?’

‘বিটলসের। তুমি বলেছিলে তুমি সেগুলো সংগ্রহ করবে।’

‘তা বলেছিলাম। কোনগুলোর কথা বলছো?’

‘সবগুলো।’

‘সবগুলো?’

‘দশ হাজার ইয়েন হলে কেমন হয়? সবগুলো নিজে একটা একটা করে কিনতে গেলে আরও বেশি খরচ পড়বে।’

‘আমি জানি কিন্তু হঠাৎ এই কথা বললে যে? মানে, আমাদের বাসায় তো স্টেরিয়োও নেই।’

‘আচ্ছা তাহলে দেখি অন্য কেউ নেবে কিনা।’ কসুকে ফোনটা রাখতেই যাচ্ছিল তখন বন্ধু চেঁচিয়ে উঠল।

‘দাঁড়াও। ভেবে দেখছি। আমি কাল ফোন করব। ঠিক আছে?’

‘না। কাল না।’

‘কেন?’

‘তাতে কিছু যায় আসে না। আমার কাছে সময় নেই। তুমি যদি এখনই না কেনো তাহলে আমি ফোন রাখলাম।’

‘দাঁড়াও এক সেকেন্ড। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো প্লিজ। পাঁচ মিনিট। ‘

‘ঠিক আছে, পাঁচ মিনিট।’

ফোন রেখে ফোন বুথের পাশে দাঁড়ালো কসুকে। সূর্য অস্ত যেতে শুরু করেছে। কসুকে জানে না সে রেকর্ডগুলো কেন বিক্রি করে দিচ্ছে। কিন্তু সে জানে সে আর কখনই বিটলসের গান শুনতে পারবে না। যেন এক যুগের শেষ হতে চলেছে।

ঠিক পাঁচ মিনিট পরই তার বন্ধুকে ফোন করল কসুকে।

‘আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলেছি।’ বন্ধু উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘তারা টাকা দেবে। কিন্তু স্টেরিয়ো আমার নিজের টাকায় কিনতে হবে। রেকর্ডগুলো আমি এখনই এসে নিয়ে যাবো?’

‘হ্যাঁ।’

তার সবগুলো রেকর্ড চলে যাচ্ছে। ভাবতে বুকে তীক্ষ্ণ ব্যথা লাগছে তার। কিন্তু সে পাত্তা দিলো না।

বাসায় ফিরে সবগুলো রেকর্ড একটা কাপড়ের ব্যাগে ঢুকালো। এদের সাথে কত স্মৃতি জড়িত তার। এসজিটি পেপারস লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড দেখে সে থেমে গেল। এই গানটা সংগীত নিয়ে বিটলের পরীক্ষা করার সময়ের ফসল। কভারে বিটলসের চারজন মিলিটারি রেগালিয়া পড়েছে। সাথে পপ কালচারের ঐতিহাসিক সব কিংবদন্তির কাটআউট।

ডানের দিকে একজন মহিলা যিনি দেখতে মেরিলিন মনরোর মতো, তার পাশের একটা জায়গা কালো মার্কারে দাগানো। তার চাচাতো ভাই সেখানে টেপ দিয়ে নিজের ছবি লাগিয়েছিল। একজন ভক্ত হিসেবে চেয়েছিল যেন এই কভারে বিটলসের সাথে তার ছবি থাকে। কসুকে যখন সেই ছবিটা রেকর্ড থেকে তুলে ফেলল তখন তার সাথে কভারের কাগজ কিছুটা ছিঁড়ে উঠে যায়। এজন্য সে সেখানে কালো মার্কারের দাগ দিয়ে জায়গাটা কালো করে দেয় যেন দেখতে খারাপ না দেখায়।

তোমার রেকর্ডগুলো বিক্রি করে দিচ্ছি বলে দুঃখিত। আর কোনো উপায় নেই। হয়তো তার চাচাতো ভাই স্বর্গ থেকে তার প্রার্থনা শুনতে পাবে।

কিমিকো তাকে কাপড়ের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে দেখে বলল, ‘এসব কী? ‘ কসুকে সব সত্যি বলে দিলো। কিন্তু কিমিকো ভ্রুক্ষেপ করল না।

শীঘ্রই কসুকের বন্ধু দশ হাজার ইয়েন একটা খামে ভরে তার বাসার সামনে উপস্থিত হলো।

‘বাহ!’ ব্যাগ দেখে বন্ধু বলল, ‘তুমি সত্যিই বিক্রি করে দিতে চাও? লম্বা সময় ধরে এগুলো সংগ্রহ করেছো তুমি।’

‘আসলে হুট করে বুঝতে পারলাম। আমি আর বিটলসের সাথে নিজেকে একাত্ম অনুভব করছি না। চলচ্চিত্রটা দেখেছি।’

‘লেট ইট বি?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওহ,’ বন্ধুটা যেন আধো মেনে নেওয়া আর আধো অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ল। ব্যাগটা তুলে নিয়ে চলে যাবার সময় বলল, ‘ধন্যবাদ, কাল দেখা হচ্ছে।’

‘কাল?’ ব্যাপারটা বুঝে উঠতে তার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। কসুকে তো ভুলেই গিয়েছিল কালকের কথা। কাল তাদের ফল টার্মের প্রথম ক্লাস।

‘হ্যাঁ, কাল স্কুলে দেখা হচ্ছে।’

অবশেষে দরজাটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ইচ্ছে করছে এখানেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়তে।

সাদায়ুকি রাত আটটায় বাড়ি ফিরল। এত দেরি করে সে কখনও ফেরে না।

‘অফিসে সব গুছিয়ে এসেছি। খোঁজাখুঁজি যত দেরিতে হবে ততই ভালো।’ টাইয়ের বাঁধন আলগা করতে করতে বলল সে। শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে।

দেরি করে রাতের খাবার খেল তারা। এই বাসায় তাদের শেষ ডিনার হলো আগের রাতের খাবার দিয়ে। ফ্রিজটা আগেই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

খেতে খেতে সাদায়ুকি আর কিমিকো তাদের পরিকল্পনা নিয়ে নিচু গলায় কথা বলল। তারা কী নেবে, কী রেখে যাবে। এসব তো আগেই ঠিক করে রেখেছিল।

এখন যেন কেবল শেষবারের মতো সাবধান হয়ে নেওয়ার জন্য বলা।

কিমিকো কসুকের রেকর্ডের কথা তুলল।

‘বিক্রি করে দিয়েছো? সব? কেন?’ সাদায়ুকি খুব অবাক হয়েছে।

‘জানি না। সেগুলো তো আর চালাতেও পারব না।’

‘বাহ, ভালোই হয়েছে। বোঝা কমল। কত পেয়েছো?’

উত্তর দিতে কসুকের একটু দেরি হতেই কিমিকো বলে উঠল, ‘দশ হাজার ইয়েন।’

‘মাত্র দশ হাজার?’ সাদায়ুকির মেজাজ যেন সাথে সাথেই বদলে গেল, ‘হতচ্ছাড়া কোথাকার। কতগুলো ছিল। বেশিরভাগই তো এলপি। জানো সেগুলোর এখন দাম কত? বিশ বা ত্রিশ হাজার সহজেই পাওয়া যেত। মাত্র দশ হাজারে দিয়ে দিলে? ভাবছিলে-টা কী?’

‘আমি সেগুলো বিক্রি করে টাকা কামাতে চাইনি।’ কসুকে মাথা নিচু করে রইল, ‘ওগুলো তেতসুর।’

তার বাবা শব্দ করে হেসে উঠল, ‘গর্দভের মতো কথা বলবে না। কোনো কিছু বিক্রি করতে হলে লাভে বিক্রি করবে। এতদিন যেভাবে আয়েশে চলেছো এখন থেকে আর সেসব চলবে না। বুঝতে পেরেছো?’

কসুকে মাথা তুলল। সে জিজ্ঞাসা করতে চাইছে এসবে তার দোষটা কোথায়? কিন্তু সাদায়ুকি তার ছেলের চেহারায় যেন অন্য কিছু দেখতে পেল, ‘বুঝতে পেরেছো?’

কসুকে চামচ তার থালায় ফেলে দিলো, ‘যথেষ্ট হয়েছে।

টেবিল ছেড়ে চলে যেতে লাগল।

‘উত্তর দাও!’

‘চুপ করো। আমি বুঝতে পেরেছি।’

‘কী বললে? নিজের বাবার সাথে এভাবে কথা বলবে তুমি?’

‘সাদায়ুকি,’ কিমিকো সাবধান করল, ‘অনেক হয়েছে।’

‘না হয়নি। এই, ওই দশ হাজার ইয়েন দিয়ে কী করেছো?’

রাগে কসুকের গা জ্বলছে।

‘কার টাকায় ওসব কিনেছিলে? ওই কষ্টে অর্জিত টাকাগুলো কার?

‘থামো সাদায়ুকি। তুমি তোমার নিজের ছেলের কাছ থেকে টাকা নিতে পারো না।’

‘টাকা কে নিচ্ছে। ওর জানা উচিত এসব টাকা আসলে কার।’

‘যথেষ্ট হয়েছে। কসুকে, নিজের ঘরে গিয়ে জিনিসপত্র গুছাও।’

কসুকে তার মায়ের কথামতো নিজের ঘরে চলে গেল। বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। পোস্টারের বিটলস যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। উঠে সেসব টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল।

দুঘণ্টা পর দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। কিমিকো উঁকি দিলো ভেতরে, ‘শেষ? ‘

‘প্রায়,’ কসুকে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স আর ডাফেল দেখালো, ‘এখন যাচ্ছি?’

‘শীঘ্রই,’ কিমিকো ভেতরে এলো, ‘দুঃখিত, তোমাকে এসব সহ্য করতে হচ্ছে।’

কসুকে কিছু বলল না। বলার কিছু নেই।

‘কিন্তু আমি নিশ্চিত, সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরো।’

‘আচ্ছা।’

‘তোমার বাবা আর আমি—বিশেষত তোমার বাবা–তোমার সুন্দর জীবনের জন্য যে-কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। প্রয়োজন হলে নিজের জীবনও দিয়ে দিতে রাজি।’

যত্তসব। নিজের ছেলেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে সুন্দর জীবন দিতে চাচ্ছে। ভাবল কসুকে।

‘আচ্ছা, তাহলে আধা ঘণ্টার মাঝে নিচে চলে এসো।’ কিমিকো চলে গেল।

রিঙ্গোর মতো, কসুকে ভাবল। লেট ইট বি-তে একমাত্র রিঙ্গোই বিটলসকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সব চেষ্টা বিফলে যায়।

ঠিক মধ্যরাতে কসুকের পরিবার পালিয়ে যায়। সাদায়ুকি একটা সাদা কার্গো ভ্যান জোগাড় করে রেখেছিল। সামনের বেঞ্চ সিটে বসেছিল তারা। সাদায়ুকি স্টিয়ারিং হুইলে ছিল। ভ্যানের পেছনটা কার্ডবোর্ড বাক্সে ভরতি।

ঢোকার আগে কসুকে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘যখন পৌঁছে যাব তখন বুঝে যাবে।’ ভ্রমণের পুরো সময় আর কেউ কোনো কথা বলেনি।

হাইওয়েতে উঠে যায় তারা। কসুকে বুঝতে পারছিল না তারা কোথায় যাচ্ছে। রাস্তার সাইনগুলো তার পরিচিত না। দুঘণ্টা পর কিমিকো বলল তাকে বাথরুমে যেতে হবে এবং সাদায়ুকি একটা রেস্ট এরিয়ার সামনে ভ্যান থামায়। কসুকে একটা সাইন দেখে বুঝল তারা ফুজিকাওয়াতে আছে।

রাতের বেলা পার্কিংলটটা একদমই খালি। কিন্তু তাও সাদায়ুকি ভ্যানটা একদম কোনায় পার্ক করেছে। সন্দেহ করার কোনো সুযোগ কাউকে দিতে চায় না সে। কসুকে তার বাবার সাথে বাথরুমে ঢুকে গেল। সিংকে হাত ধোবার সময় সাদায়ুকি তার পাশে এসে দাঁড়াল।

‘তুমি কিছুদিনের জন্য কোনো হাত খরচ পাবে না।

কসুকে আয়নায় তার বাবার প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়।

‘অবাক হবার কিছু নেই,’ সাদায়ুকি বলতে থাকে, ‘তাছাড়া, তোমার কাছে দশ হাজার ইয়েন তো আছেই।’

আবার সেই দশ হাজার ইয়েনের কথা। ঘেন্না লেগে যাচ্ছে কসুকের।

সাদায়ুকি হাত ধুয়ে বেরিয়ে গেল।

নিজের বাবাকে চলে যেতে দেখে কসুকের তার বাবা-মায়ের সাথে থাকার শেষ ইচ্ছাটুকুও মরে গেল। তাদের বন্ধন ভেঙে গেছে। নিশ্চিতভাবেই।

কসুকে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভ্যানের বিপরীত পাশে দৌড়ালো। তাকে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে হবে। দ্রুত দৌড়াতে শুরু করল, যেন জীবন বাঁচিয়ে পালাচ্ছে। অন্য একটা পার্কিংলটে চলে এলো। এখানে ট্রাক ভরতি।

একটা লোক একটা ট্রাকের ভেতরে ঢুকল। মনে হচ্ছে এখনই ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে যাবে। কসুকে দ্রুত সেদিকে ছুটে ট্রাকটার পেছনে চড়ে বসল। সেখানে অনেকগুলো কাঠের বাক্সের সারি। কোনো বাজে গন্ধ নেই, আর লুকিয়ে থাকার যথেষ্ট জায়গা আছে।

ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। কসুকে চরম সিদ্ধান্তের মুখোমুখি এখন। ডেকের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল সে।

ট্রাক চলতে শুরু করেছে। কসুকের বুক ধক-পক করছে। বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছে সে। হাঁটু জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। ঘুমাবার চেষ্টা করল। কিচ্ছু ভাবতে চাইল না। কিন্তু পরিস্থিতির জটিলতা আর অনিশ্চয়তা তাকে দুচোখের পাতা এক করতে দিলো না।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কসুকে জানত না এই ট্রাক কোথায় যাচ্ছে। অন্ধকারে কোনো কিছু বুঝতেও পারছিল না সে। কিন্তু আলো থাকলেও কেবল বাইরের দৃশ্য দেখে জায়গা চেনা তার জন্য দুষ্কর হতো।

সে ভেবেছিল আজ আর ঘুম আসবে না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ঘুম অবশেষে এসেই পড়ল। তবে ট্রাকটা থামতেই তন্দ্রা কেটে গেল। ট্রাকটা কোনো ট্রাফিক লাইটে থামেনি। নিশ্চয়ই গন্তব্যে এসে পড়েছে।

কসুকে বাইরে উঁকি দিলো। বিশাল এক পার্কিং লটে আছে ট্রাকটা। আশেপাশে আরও অনেক ট্রাক।

চারদিকে যখন কেউ ছিল না তখন কসুকে ট্রাক থেকে নেমে সোজা এক্সিটের দিকে চলে গেল। ভাগ্য ভালো সেখানে কোনো দারোয়ান নেই। কোনো এক শিপিং ফ্যাসিলিটি এটা। সে এদোগাওয়া, টোকিওতে আছে।

চারিদিকে গভীর অন্ধকার। কোনো দোকান খোলা নেই। বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করল সে। কোথায় যাচ্ছে তা জানে না কিন্তু তাও থামল না। হয়তো কোথাও না কোথাও পৌঁছে যাবে।

দিনের আলো ফুটতে শুরু করলে বাসের ওয়েটিং স্টেশনের সাইন দেখতে পেল কসুকে। গন্তব্য: টোকিও স্টেশন। চমৎকার। চলতে থাকলে সেখানে পৌঁছে যাবে সো

কিন্তু টোকিও গিয়ে সে করবে-টা কী? অন্য কোথাও যাবে? টোকিও স্টেশন থেকে ট্রেন অনেক জায়গায় যায়। কোনটা বেছে নেবে?

হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাবা-মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল তার। তারা যখন বুঝতে পেরেছে কসুকে তাদের সাথে নেই, তখন তারা কী করেছে? খোঁজার কোনো রাস্তা নেই। তারা রিপোর্টও করতে পারবে না আর বাড়িতেও ফিরে যেতে পারবে না।

হয়তো তারা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাবে। সব কিছু ঠান্ডা হলে কসুকেকে খুঁজবে। কিন্তু সরাসরি খুঁজতে পারবে না। কোনো আত্মীয়ের সাথেও যোগাযোগ করতে পারবে না। সেই ভয়ানক লোকগুলো সবখানে জাল বিছিয়ে রেখেছে।

কসুকেও তার বাবা-মাকে খুঁজতে পারবে না আর। তারা লুকিয়ে থাকার পরিকল্পনা করেছে। হয়তো নিজেদের আসল নামও ব্যবহার করবে না।

অর্থাৎ সে আর কখনও তার বাবা-মায়ের দেখা পাবে না। ভাবনাটা যেন তীরের মতো বিঁধল তার বুকে। কিন্তু কোনো আফসোস নেই। তাদের মনের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। একে আর জোড়া লাগাবার বা একসাথে থাক র চেষ্টা করেও লাভ নেই। বিটলস এটা শিখিয়ে দিয়েছে তাকে।

দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে ট্রাফিকও বাড়তে লাগল। পথচারীর সংখ্যাও বাড়ল। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। কসুকের মনে পড়ল আজ ফল টার্মের প্রথম ক্লাস।

সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন। কিন্তু গ্রীষ্মের তাপ কমেনি। তার টি শার্টটা ঘামে আর ধুলায় ভিজে গেছে।

দশটার দিকে টোকিও স্টেশনে পৌঁছে গেল সে। পায়ে হেঁটে এই প্রথম এলো। প্রথমে বিল্ডিংটা চিনতে পারেনি। হুট করে দেখে মধ্যযুগীয় ইউরোপের কোনো পুরোনো প্রসাদ বলে মনে হয়েছে।

বুলেট ট্রেনের একটা সাইন দেখল কসুকে। এটাতে চড়ার শখ তার অনেক দিনের। সে ভেবেছিল এই বছর অবশেষে সেই শখ পূরণ হবে। এটা টোকিও থেকে সোজা ওসাকাতে যায়, যেখানে এক্সপো চলছে।

সে ওখানেই যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। তার পকেটে এখন চৌদ্দ হাজার ইয়েন আছে: দশ হাজার রেকর্ডের আর বাকি চার হাজার নিউ ইয়ারের সময়ে জমিয়েছিল।

আচ্ছা। এক্সপোতে যাবে। এরপর? সেখানে গেলেই বোঝা যাবে। সেখানে জাপানের—সমস্ত পৃথিবীর—অনেক লোক এক্সপো পালনের জন্য জড়ো হয়েছে। নতুন নতুন উদ্ভাবনের, নতুন নতুন সুযোগের মেলা চলছে। সেও কিছু না কিছু খুঁজে পেয়ে যাবে সেখানে।

টিকেট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে শিন-ওসাকা স্টেশনের ভাড়া দেখে খুশি হলো। অত বেশি না। দুটো লাইন আছে: হিকারি ও কোডামা। কোডামা বেছে নিলো। টাকা যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে চলতে হবে।

কাউন্টারে পৌঁছে টিকেট এজেন্টকে বলল, ‘শিন-ওসাকার একটা টিকেট দিন।’

‘স্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট চাই? আইডি দেখাতে হবে তাহলে।’

‘ওহ, সেটা তো আনতে ভুলে গেছি।’

‘তাহলে সাধারণ ভাড়া দিতে হবে।’

‘আচ্ছা।’

লোকটা এরপর তাকে সময়, রিজার্ভ সিট নিয়ে প্রশ্ন করল। কসুকে উত্তর দিলো সবগুলোর।

‘এক সেকেন্ড অপেক্ষা করুন,’ লোকটা পেছন দিকে চলে গেল। কসুকে টাকা আবার গুনে নিলো। টিকেট নিয়ে সকালের নাস্তার জন্য একটা বেন্টো বক্স কিনতে হবে।

তখনই ঘটনাটা ঘটল। কেউ তার কাঁধে হাত রাখল।

‘শুনুন।’

কসুকে ঘুরে দেখল একটা স্যুট পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

‘জি?’

‘কিছু কথা জিজ্ঞাসা করতে হবে। দয়া করে এদিকে আসুন।’

‘কিন্তু—আমার টিকেট—’

‘সময় লাগবে না। কেবল কয়েকটা প্রশ্ন করব, এরপর নিজের রাস্তায় চলে যাবো। আসুন।’

লোকটা শক্ত করে কসুকের বাহু ধরে নিয়ে চলল। কসুকে বুঝে গেল সে খোশগল্প করার জন্য কসুকেকে নিয়ে চলছে না। লোকটা অফিসে নিয়ে এলো তাকে। সে বলেছিল সময় লাগবে না। কিন্তু ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। কারণ কসুকে কোনো উত্তর দিচ্ছিল না। এমনকি প্রথম প্রশ্নেরও না।

‘তোমার নাম ঠিকানা বলো।’

লোকটা মেট্রোপলিটনের জুভেনাইল ডিভিশনের এক গোয়েন্দা। অনেক ছেলেমেয়েই বাসা থেকে পালিয়ে টোকিও স্টেশনে চলে আসে। আর এসব গোয়েন্দা তাদেরকে স্টেশনে খুঁজে বেড়ায়। কসুকের ময়লা টি শার্ট আর নার্ভাস চেহারা দেখে লোকটা শুরুতেই বুঝে গিয়েছিল। লাইনে কসুকের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। সুযোগ বুঝেই টিকেট এজেন্টকে ইশারা দিলে সে পেছনে চলে যায় আর লোকটা কসুকেকে নিয়ে চলে আসে।

গোয়েন্দা অনেক চেষ্টা করেও কসুকের কাছ থেকে কিছু বের করতে পারল না। সে ভেবেছিল কসুকে সব কিছু বলে দেবে আর এরপর তার বাবা-মা বা স্কুলে ফোন করবে যেন তারা এসে ছেলেটাকে নিয়ে যায়। যেমনটা সে অন্যদের বেলায় করে।

কিন্তু কসুকে তার পরিচয় একদমই দিলো না। কিছু বলতে গেলে পুরো ব্যাপারটাই খুলে বলতে হবে।

তারা যখন কসুকেকে ট্রেন স্টেশনের অফিস রুম থেকে পুলিশ স্টেশনের কনফারেন্স রুমে নিয়ে গেল, তখনও সে চুপই রইল। তাকে খাবার জন্য রাইস বল আর ঠান্ডা চা দেওয়া হলো। কিন্তু সে ছুঁয়েও দেখল না। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে কিন্তু এগুলো খেলে এদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

‘আচ্ছা,’ গোয়েন্দাটা হেসে উঠল, ‘অনেক হয়েছে। এখন কিছু খেয়ে নাও।’

সে কসুকেকে একা রেখে ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেল।

সে যেতেই কসুকে গপগপ করে সব খেয়ে নিলো। কাল রাতের পর থেকে আর কিছু খায়নি সে। এখন একটা সামান্য রাইস বলকেও যেন তার কাছে অমৃত বলে মনে হচ্ছে।

একটু পরই গোয়েন্দা আবার এলো, ‘কথা বলতে প্রস্তুত?

কসুকে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘এই বাচ্চাটা একটা আপদ।’

একটা লোক এসে গোয়েন্দার সাথে কিছু কথা বলল। কসুকে তাদের কথা শুনে ধারণা করল তারা কসুকেকে সারা দেশের নিখোঁজ ব্যক্তির লিস্টের সাথে মিলিয়ে দেখছে।

এরা যদি কসুকের স্কুলে ফোন করে, তখন কী হবে? স্কুল থেকে বলবে সে ছুটিতে আছে। সাদায়ুকি স্কুলে ফোন করে বলেছিল তারা এক সপ্তাহের জন্য গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু সেটাও সন্দেহজনক ছিল না?

রাত হয়ে এলো। কসুকে সেখানেই রাতের খাবার খেল। রাইস বোল আর টেম্পুরা। চমৎকার খাবার।

‘অন্ততপক্ষে তোমার নাম তো বলবে?’ গোয়েন্দা আবার বলল। কসুকের লোকটার জন্য এখন খারাপ লাগছে।

‘হিরোসি।’

লোকটার চেহারা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘কী বললে?’

‘হিরোসি ফুজিকাওয়া।’

গোয়েন্দা তাড়াতাড়ি খাতা কলম বের করল। ‘লেখো তো নামটা।’

কসুকে লিখে দিলো।

ছদ্মনাম ব্যবহার করার বুদ্ধিটা তার মাথায় আগেই এসেছিল। ওয়ার্ল্ড এক্সপোর জাপানিজ প্রতিশব্দ ‘হিরোসি’ আর কাল রাতের রেস্ট শপের নাম ‘ফুজিকাওয়া’ মিলিয়ে এই ছদ্মনাম বের করেছে।

‘ঠিকানা?’

কসুকে আর কিছু বলল না। কনফারেন্স রুমেই রাত কাটাল সে। তারা শোবার ব্যবস্থা করে দিলো। কসুকে কম্বল পেঁচিয়ে সারারাত ঘুমালো।

পরদিন সকালে গোয়েন্দা আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে লেগে গেল।

‘এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সত্যি করে বলে ফেলো তুমি কে। নাহয় ওরা তোমাকে জুভেনাইল অ্যাফেয়ার্সের কাছে দিয়ে দিবে। আজীবন সেখানেই ফেঁসে থাকতে হবে।’

কসুকে উত্তর দিলো না। গোয়েন্দাটা এখন রেগে যাচ্ছে।

‘তোমার মা-বাবাই বা কোথায়? ছেলে হারিয়ে গেছে সেটা টের পায়নি এখনও?’

কসুকে কিছু বলল না।

‘মনে হয় চুপ থাকার পেছনে কোনো ভালো কারণই আছে তোমার। হিরোসি ফুজিকাওয়া, এটা তোমার আসল নাম না, তাই না?’

এরপর শীঘ্রই কসুকেকে জুভেনাইল অ্যাফেয়ার্সের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কসুকে ভেবেছিল সেটা কোনো স্কুল বিল্ডিংয়ের মতো কিছু হবে কিন্তু একটা পুরোনো ইউরোপিয়ান প্রাসাদ দেখে সে অবাক হয়ে যায়।

কসুকে সেখানে দুই মাস ছিল। এ সময়ের মাঝে তার সাথে অনেকের দেখা হয়। ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট। সবাই ‘হিরোসি ফুজিকাওয়ার’ আসল পরিচয় জানার চেষ্টা করেছে। কেউ সফল হয়নি। কসুকের সাথে মিলে যায় এমন কোনো নিখোঁজ ব্যক্তির রিপোর্ট না পেয়ে সবাই খুব অবাক হয়। তার বাবা-মা কোথায়? কেউ তাকে খুঁজছে না কেন? কেউ কোনো উত্তর খুঁজে পেল না।

এরপর সে মারিমিটসুয়েন নামে এক অনাথাশ্রমে চলে আসে। এটা টোকিও থেকে একটু দূরে। কিন্তু তার আসল বাসা থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার পথ

চারতলা বিল্ডিংটা গাছগাছালিতে ঘেরা। পেছনে পাহাড়। ছোটো বাচ্চা থেকে শুরু করে হাইস্কুলের ছেলেমেয়ে, সবাই আছে।

‘তোমার পরিচয় বলতে চাও না, ঠিক আছে। কিন্তু তোমার জন্ম সালটা বলতেই হবে। কোন গ্রেডে পড়ো তা না জেনে তোমাকে স্কুলে পাঠাতে পারব না।’ একটা বয়স্ক লোক কসুকেকে জিজ্ঞাসা করেছিল।

কসুকের আসল জন্মদিন ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৫৭। কিন্তু আসল বয়স দেওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এর চেয়ে বেশি বললে সে আর কখনও মিডেল স্কুলের তৃতীয় বর্ষের টেক্সট বই দেখতে পাবে না।

উত্তর ছিল জুন ২৯, ১৯৫৭।

জুন ২৯–যেদিন বিটলস জাপানে পা রেখেছিল।

দ্বিতীয় গিনেসটা শেষ করল সে।

‘আরেকটা লাগবে?’ এরিকো জিজ্ঞাসা করল। ‘নাকি স্ট্রং কিছু দেবো?’

‘হ্যাঁ,’ কসুকে বারের লিকার বোতলগুলোর ওপর চোখ বুলালো, ‘একটা বুনাহাভাইন নেবো।’

এরিকো মাথা নেড়ে গ্লাস বের করল।

আই ফিল ফাইন চলছিল স্পিকারে। কসুকে সেটার সাথে অজান্তেই গুনগুন করছিল। বুঝতে পেরে থেমে যায়।

এরিকো আইস পিক দিয়ে বরফ টুকরো করছিল। সেটা দেখে কসুকের মনে পড়ে গেল, সে কীভাবে কাঠে খোদাই করত।

অনাথাশ্রমের জীবন খারাপ ছিল না। তার টেবিলে খাবার থাকত আর স্কুলেও যেতে পারত সে।

তার নাম হিরোসি ফুজিকাওয়াই থাকে। কিন্তু সবাই তার নামের প্রথম অংশ ধরে ডাকত, যেটা জাপানে সচরাচর হয় না। প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হতো কিন্তু দ্রুতই সেই নামের সাথে মানিয়ে যায় সে।

বন্ধু-বান্ধব বেশি একটা ছিল না তার। আসলে সে নিজেই এড়িয়ে চলত। কারও কাছাকাছি যেতে ভয় হতো। পাছে তার আসল পরিচয় জেনে যায় কিনা। নিজেকে দূরে দূরে রাখত সবার কাছ থেকে। বাকি বাচ্চারাও তাকে একটু ভয় পেত। একা একাই থাকত কসুকে।

খেলার কোনো সাথী ছিল না তার কিন্তু সে বিশেষত একাকী বোধও করত না।

অনাথাশ্রমে ঢুকে এক নতুন শখ পেয়ে বসে তাকে। কাঠে খোদাই করা। সে বেঞ্চের ভাঙা কাঠগুলো তুলে নিয়ে তাতে নিজের ইচ্ছেমতো পশুপাখি, রোবট, সুপারহিরো, গাড়ি—যা মনে আসত তাই খোদাই করত। প্রথম প্রথম কেবল সময় কাটাবার জন্য এটা শুরু করেছিল। কিন্তু পরে এতে মন বসে যায়। উপভোগ করতে শুরু করে।

একটা কাজ হয়ে গেলে সেটা সবচেয়ে ছোটো বাচ্চাটাকে দিয়ে দিতো। তারা প্রথমে অবাক হতো। কিন্তু পরে খুশি হয়ে যেত। অনাথাশ্রমের বাচ্চারা সহজে খেলনা পেত না। শীঘ্রই একে একে অনুরোধ আসতে লাগল, ‘আমি মমিন চাই’, ‘আমাকে একটা কামেন রাইডার বানিয়ে দাও না’ বাচ্চাগুলোকে খুশি করতে পেরে কসুকেও খুব খুশি হতো।

স্টাফরাও কসুকের প্রতিভা দেখে খুব খুশি হয়। একদিন তার ডাক পড়ে ডিরেক্টরের অফিসে। খুবই অপ্রত্যাশিত একটা প্রশ্ন করা হয় তাকে পেশা হিসেবে কী বেছে নিতে চায় সে? ডিরেক্টরের এক পরিচিত লোক উড-কার্ভিং স্টুডিয়ো চালায় আর সে একজন দক্ষ লোক খুঁজছে। কসুকে যদি তার সাথে থেকে কাজ শিখতে রাজি হয় তবে তাকে নাইট স্কুলের অনুমতি দেওয়া হবে আর সেখান থেকেই সে হাইস্কুলের ডিপ্লোমা নিতে পারবে।

মিডেল স্কুল প্রায় শেষ কসুকের। হয়তো একারণেই স্টাফরা তাকে নিয়ে এখন চিন্তিত।

স্টাফরা এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে চাইছে: কসুকেকে একটা আইনত নাম দেওয়া। ফ্যামিলি কোর্টকে লম্বা সময় ধরে তারা অনুরোধ করে আসছে তার নামে একটা রেজিস্ট্রি দেওয়ার জন্য। অবশেষে সেই অনুরোধ গৃহীত হয়।

এই অনুরোধ সাধারণত খুব ছোটো বাচ্চাদের জন্য গৃহীত হয়। কসুকের মতো বড়ো বাচ্চার জন্য না। কিন্তু কসুকের কেস আলাদা। তার নামে কোনো নিখোঁজ রিপোর্টও নেই। এমনটা কখনও হয় না। তাই এটা একটা সম্পূর্ণ আলাদা অনুরোধ ছিল।

ফ্যামিলি কোর্টের লোকজন তার সাথে কয়েকবার দেখা করতে আসে। তার পরিবার বা পরিচয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। কিন্তু স্বভাবতই কসুকে এই ব্যাপারে একটা কথাও বলেনি।

‘হয়তো কোনো মানসিক আঘাতে তার সেসব স্মৃতি মুছে গেছে,’ অবশেষে এই সিদ্ধান্তে আসে তারা, ‘ও চাইলেও আমাদেরকে কিছু বলতে পারবে না।’ হয়তো বড়োরা এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবার জন্য উপসংহার হিসেবে এটা বেছে নেয়।

মিডেল স্কুল শেষ করার কিছুদিন আগেই কসুকের নাম আইনত ‘হিরোসি ফুজিকাওয়া’ রেজিস্টার হয়ে যায়। আর এরপর সে অনাথাশ্রম ছেড়ে সাইতামাতে পাড়ি জমায়, শিক্ষানবিশ হিসেবে কাঠের খোদাই শিখবার জন্য।

ওস্তাদের সাথে পড়াশোনা করা সহজ ছিল না। লোকটা সেকেলে: জেদি আর কঠোর। প্রথম বছর কসুকে কেবল যন্ত্রপাতিই পরিষ্কার করেছে। দ্বিতীয় বছর গিয়ে অবশেষে সে কাঠে খোদাই করার অনুমতি পায়। কিন্তু যেভাবে বলা হতো, ঠিক সেভাবেই খোদাই করতে হতো। একদিনে বিশবার বা ত্রিশবার। প্রতিটা খোদাই হুবহু না হওয়া পর্যন্ত তাকে অন্যটা করতে দেওয়া হতো না। একে গতিশীল কাজ বলা যায় না।

কিন্তু ওস্তাদ খুব ভালো লোক ছিলেন। কসুকের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেন। কসুকেকে পেশাদার বানিয়ে তোলা যেন তার ব্যক্তিগত লক্ষ্যে পরিণত হয়। কসুকে এসব জানত কারণ ওস্তাদের দোকানটা উত্তরাধিকার সূত্রে সেই পেতে চলেছিল। লোকটার স্ত্রীও সমান দয়ালু প্রকৃতির।

হাইস্কুল শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে স্টুডিয়োতে কাজ করতে শুরু করে কসুকে। শুরুতে কেবল সহজ কাজ নিতো। আস্তে আস্তে যখন সে অভ্যস্ত হয়ে উঠে আর লোকজন যখন তার কাজে আস্থা রাখতে শুরু করে তখন সে জটিল কাজ নেয়। সেগুলো করাটা যেমন সহজ না, সেসব কাজের দামও তেমন চড়া

দিনগুলো খুব চমৎকার ছিল। পরিবারের সাথে পালিয়ে যাবার স্মৃতি সে ভুলতে পারেনি কিন্তু সে এখন বলতে পারে, যে সে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরিবারের সাথে না থেকে তার মঙ্গল হয়েছে।

সেই বয়স্ক লোকের পরামর্শমতো কাজ করলে সে এখন কোথায় থাকত?

১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে শান্তিতে বিঘ্ন ঘটে। টিভিতে খবরটা শুনতে পায় কসুকে।

জন লেননকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।

বিটলসের সাথে জড়িত সব ভালো-খারাপ স্মৃতি মনে পড়ে গেল তার। বেশিরভাগই খারাপ কিন্তু তাদের সাথে স্মৃতিবেদনা জড়িয়ে আছে।

বিটলস ভেঙে ফেলার কারণে জন লেনন কি কখনও আফসোস করেছিল? প্রশ্নটা মাথায় ঢুকে গেল তার।

নাহ, হতে পারে না। বিটলস যখন ভেঙে যায় তখন চারজন গায়ক নিজেদের একক সফল ক্যারিয়ার গড়ে তুলে। এর একমাত্র কারণ তারা বিটলসের মোহ ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। ঠিক যেভাবে কসুকে তার বাবা-মায়ের প্রভাব থেকে বেরিয়ে ভালো জীবনের সন্ধান পেয়েছে।

তাদের হৃদয়ের বন্ধন ভেঙে গেছে। সেটা একবার ভেঙে গেলে আর ফেরানো যায় না।

আট বছর পরে এক ডিসেম্বরে পত্রিকায় খবরটা পায় সে। মারুমিতসুয়েনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে। সবাই বেঁচে ফিরতে পারেনি।

ওস্তাদ তাকে সেখানে যেতে বলল। কসুকে পরদিনই বেরিয়ে পড়ে।

বিল্ডিংয়ের অর্ধেকটা আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চারা আর স্টাফরা জিমনেশিয়ামে আশ্রয় নিয়েছিল। কেরোসিন হিটার দিয়ে জায়গাটা উষ্ণ রাখা হয়েছে কিন্তু তাও সবাই ঠান্ডায় কাঁপছিল।

ডিরেক্টরের অনেক বয়স হয়ে গেছে। কসুকেকে দেখে সে খুব খুশি হয়। অবাকও হয়। যে ছেলেটা নিজের নামও বলতে চায়নি কখনও, সে এখন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, অনাথাশ্রমের দুর্দিনে সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছে।

‘আমি কিছু সাহায্য করতে পারলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন।’ কসুকে ডিরেক্টরকে বলে।

‘তুমি এটা বলেছো সেটাই আমাদের কাছে অনেক।’

বের হবার সময়ে একটা কণ্ঠ শুনতে পেল, ‘হিরোসি?’

এক তরুণী এগিয়ে এলো তার দিকে। হয়তো চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে। সে একটা দামি পালকের কোট পরে আছে।

‘আমি জানতাম এটা তুমি। হিরোসি ফুজিকাওয়া, তাই না?’ তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, ‘আমি হারুমি, হারুমি মুতো। মনে আছে?’

কসুকের মনে নেই। মেয়েটা তার ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করল, ‘এটা দেখো। এখন মনে পড়ছে?’

‘ওহ।’

মেয়েটা একটা কাঠের কুকুরছানা দেখালো তাকে। এটা মনে আছে কসুকের। সেই বানিয়েছিল। মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো এই চেহারা সে কোথাও দেখেছে, ‘তুমিও মারুমিতসুয়েনে ছিলে?’

‘হ্যাঁ। তুমি আমাকে এটা ফিফথ গ্রেডে দিয়েছিলে।’

‘হ্যাঁ। মনে হয়।’

‘তাই নাকি? আমি তোমাকে কখনও ভুলিনি। এই ছোট্ট জিনিসটা আমার এখনও খুব পছন্দের।’

‘ওহ আচ্ছা, দুঃখিত।’

মেয়েটা হেসে কসুকেকে একটা বিজনেস কার্ড দিলো। সেখানে লেখা, অফিস লিটল ডগ, হারুমি মুতো, সিইও। কসুকে তাকে নিজের কার্ড দিলো। খুশি হয়ে উঠল মেয়েটা।

‘কাঠের খোদাইয়ের স্টুডিয়ো—আমি জানতাম তুমি পেশাদার হয়ে যাবে!’

কসুকে মাথা চুলকালো, ‘আমার ওস্তাদ বলে আমি মাত্র আধা পথ পাড়ি দিয়েছি।’

তারা জিমনেশিয়ামের বাইরে একটা বেঞ্চে বসল। হারুমি বলল সে অগ্নিকাণ্ডের খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছে। ডিরেক্টরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

‘তারা আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। আমিও এখন সেই উপকার ফিরিয়ে দিতে চাই।’

‘খুব ভালো কাজ করেছো।’

‘তুমিও সে কারণেই এসেছো না?’

‘আমার ওস্তাদ আমাকে আসতে বলেছে,’ কসুকে মেয়েটার কার্ডের দিকে আবার তাকালো, ‘তুমি নিজের কোম্পানি চালাচ্ছো? কেমন কোম্পানি এটা?’

‘এটা ছোটো একটা উদ্যোগ। তরুণ ছেলেমেয়েদের নিয়ে ইভেন্ট পরিচালনা করি, অ্যাড ক্যাম্পেইন করি। এসব।’

‘বাহ,’ কসুকে কিছুই বুঝল না, ‘এই বয়সেই খুব ভালো সফলতা পেয়েছো। ‘

‘ভাগ্য সহায় ছিল আর কী।’

‘কেবল ভাগ্য না। উচ্চাকাঙ্ক্ষাও লাগে। কোম্পানি চালানো চমৎকার একটা ব্যাপার। তারচেয়ে পে চেক নেওয়া খুব সহজ।’

‘আসলে এটা আমার ব্যক্তিত্ব। আমি কারও আদেশ মানতে পারি না। বেশিদিন কোনো পার্ট টাইম চাকরি করতে পারতাম না। মারুমিতসুয়েন থেকে বের হওয়ার পর খুব কষ্ট করতে হয়েছে। এরপর একজন এই বুদ্ধিটা দিলো। এতে আমার জীবন বদলে যায়।’

‘একজন?’

‘হ্যাঁ, আসলে এক জেনারেল স্টোরের মালিক।’

‘জেনারেল স্টোর?’ কসুকে অবাক হলো।

‘ছোটো একটা স্টোর। আমার এক বন্ধুর বাসার পাশেই। লোকটা নাকি বিনামূল্যে পরামর্শ দিয়ে থাকে, যে-কোনো সমস্যার। কেবল চিঠি লিখতে হয়। এক ম্যাগাজিন সেটা নিয়ে ফিচারও করেছিল। আমিও চেষ্টা করে দেখলাম। সে আমাকে চমৎকার পরামর্শ দিয়েছে। এখন আমি জীবনে সফল কেবলমাত্র তার কারণেই।’

কসুকে ধাক্কা খেল। মেয়েটা নিশ্চয়ই নামিয়া জেনারেল স্টোরের কথা বলছে। কেননা এমন আর কোনো স্টোর নেই।

‘তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করছ না—’

‘না না। করছি। নিশ্চয়ই খুব চমৎকার জায়গা।’

‘তাই না? কে জানে সেটা এখনও আছে কিনা।’

‘হুম। সবকিছু চমৎকার চলছে শুনে খুশি হলাম।’

‘ধন্যবাদ। সত্যি বলতে সম্প্রতি খুব লাভ করতে পারছি। স্টক, রিয়েল এস্টেট, ইকুইটি ক্লাবে টাকা ইনভেস্ট করছি।’

কসুকে মাথা নাড়ল। ইদানিং এসব শুনেছে সে। রিয়েল এস্টেট বিজনেস আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এসব কারণে লাভজনক হয়ে উঠেছে কাঠের কাজও।

‘তুমি স্টকে আগ্রহ রাখো?’

কসুকে হেসে উঠল, ‘মোটেও না।’

‘কেন?’ হারুমিকে একটু চিন্তিত দেখালো। ‘এতে বা রিয়েল এস্টেটে অল্প আগ্রহ থেকে থাকলেও ১৯৯০ এর আগে ইনভেস্ট করে ফেলো। ১৯৯০-এর পর জাপানিজ অর্থনীতি ধ্বসে পড়বে।’

কসুকে খুব অবাক হলো। মেয়েটা এতটা নিশ্চিত হয়ে কীভাবে বলতে পারে এটা?

‘দুঃখিত,’ হারুমি দুর্বলভাবে হাসল। ‘কী অদ্ভুত কথা বললাম, তাই না। ভুলে যাও।’ ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালো সে, ‘এতদিন পর তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগল। আশা করি, আবার দেখা হবে।’

‘অবশ্যই,’ কসুকেও তার সাথে উঠে দাঁড়ালো, ‘বিদায়।’

বিদায় নিয়ে ভ্যানে উঠে পড়ল কসুকে। ইঞ্জিন চালু করেও হুট করে ব্রেক করল।

নামিয়া জেনারেল স্টোর।

জায়গাটার কথা আবার মাথায় ঢুকে গেছে তার। কসুকে লোকটার পরামর্শ নেয়নি এবং তার ধারণা এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু হারুমির মতো অনেকেই তার পরামর্শ নিয়েছে। এবং তারা লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞ।

কসুকের ভ্যান চালু হলো ঠিকই, কিন্তু সেটা নিয়ে সোজা নামিয়া স্টোরের দিকে রওনা হলো। এতদিনে হয়তো সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু একবার স্টোরটা নিজের চোখে দেখতে ইচ্ছে করছে তার। হয়তো তাতে কোনো বোঝা হালকা হবে।

আঠারো বছর পর এই প্রথম নিজের শহরে ফিরল সে। কত শত শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরের সাথে। কেউ তাকে এখন আর চিনবে না। কিন্তু তাও সে মানুষের চোখ এড়িয়ে চলল।

শহরটা খুব বদলে গেছে। জনসংখ্যা বেড়েছে। নতুন বাড়িঘর আর রাস্তা তৈরি হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

কিন্তু নামিয়া জেনারেল স্টোর বদলায়নি। সেই আগের জায়গায় আগের মতই আছে। বিল্ডিংয়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে আর সাইনটা এখন আর পড়া যায় না। কিন্তু এটা তার চিরপরিচিত নামিয়া জেনারেল স্টোরই। যেন শাটার খুললে এখনও স্টেশনারির শেলফ দেখা যাবে।

কসুকে ভ্যান থেকে বেরিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। সেদিন রাতে যখন চিঠি মেইল স্লটে ফেলেছিল, সেটার কথা মনে পড়ল। নিজের অজান্তেই পাশের গলি পেরিয়ে মিল্ক ক্রেটের পাশে উপস্থিত হলো কসুকে। বিনের ঢাকনা তুলল। কিছু নেই।

একটা নিশ্বাস ফেলল সে। কী করছি আমি? যথেষ্ট হয়েছে।

ঠিক তখনই দরজা খুলে এক মধ্য বয়স্ক লোক বের হলো। সেও কসুকের মতো অবাক হয়েছে। নিশ্চয়ই এখানে কাউকে দেখবে বলে আশা করেনি।

‘দুঃখিত।’ কসুকে বিনের ঢাকনা লাগিয়ে দিলো, ‘আমি কেবল—’

‘আপনি কী পরামর্শ নিতে এসেছেন?’ কসুকেকে অবাক করে দিয়ে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার বাবাকে চিঠি লিখেছেন, তাই না?’

হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে, ‘হ্যাঁ, অনেক আগে লিখেছিলাম।’

লোকটা যেন আশ্বস্ত হলো, ‘অবশ্যই, তা না হলে ক্রেট দেখবেন কেন।’

‘দুঃখিত। অনেক বছর পর এসেছি। ভাবলাম জায়গাটা দেখে যাই।’

‘ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আমি তার পুত্র। সে আট বছর আগে মারা গেছে।’

‘শুনে খুব কষ্ট পেলাম। তো এই বাড়িটা—

‘এখানে কেউ থাকে না। আমি মাঝেমধ্যে চেক করতে আসি।’

‘ভেঙে ফেলবেন নাকি?’

‘আপাতত তেমন কিছু করব না। আপনি কি গুরুতর কোনো চিঠি লিখেছিলেন? যেভাবে উত্তর খুঁজছেন, মনে হয় না মজার ছলে চিঠি দিয়েছিলেন।’

কসুকে বুঝতে পারল লোকটা কী জিজ্ঞাসা করছে।

‘হ্যাঁ। গুরুতরই ছিল।’

লোকটা মাথা নেড়ে কাঠের বাক্স দেখল।

‘আমার বাবা খুব অদ্ভুত। আমি সবসময় ভাবতাম সে এসব চিঠি লিখে সময় কেন নষ্ট করে। এই সময়টা ব্যাবসায় লাগানো উচিত। কিন্তু এটাই তাকে শক্তি দিতো। মানুষের কৃতজ্ঞতাই তাকে শেষ পর্যন্ত প্রশান্তি দিয়েছে।’

‘মানুষ প্রায়ই আসে?’

‘হ্যাঁ। এত বছর চিঠি লেখার পর বাবার মনে হলো সে আসলেই কারও উপকার করতে পেরেছে কিনা তা জানা দরকার। কিন্তু আমার মনে হয় কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চিঠিগুলো তার মনকে শান্তি দিয়েছে।’

‘কৃতজ্ঞতার চিঠিও এসেছিল?’

‘হ্যাঁ। এক লোক ছোটোবেলায় পরামর্শ নিয়েছিল। আর পরে বড়ো হয়ে সেটা তার শিক্ষকতার পেশায় কাজে লাগে। আরেকটা এসেছিল এক মেয়ের কাছ থেকে, যার মা এখান থেকে পরামর্শ নিয়েছিল। তার মা দ্বিধায় ছিল, বাচ্চাটাকে জন্ম দেবে কিনা। বাচ্চার বাবা ছিল এক বিবাহিত লোক, যার ইতোমধ্যে স্ত্রী-সন্তান আছে।’

‘এ পৃথিবীতে হরেক রকমের আকুলতা আছে, তাই না?’

‘একদম সত্যি। সেই কৃতজ্ঞতার চিঠিগুলো পড়ে আমিও এটাই ভেবেছিলাম। একের পর এক চিঠি আসত। আমার বাবা বেশ তৎপর থাকত এসব নিয়ে। একদিন চিঠি আসতো একটা ছেলে তার বাবা-মায়ের সাথে শহর ছেড়ে পালাবে কিনা সেই সমস্যা নিয়ে, তো পরদিন আসতো এক বাচ্চা তার শিক্ষকের প্রেমে পড়েছে সেটা নিয়ে।’

‘এক সেকেন্ড,’ কসুকে ধাক্কা খেল, ‘বাবা-মায়ের সাথে শহর ছেড়ে পালাবে কিনা তা নিয়ে কেউ পরামর্শ চেয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। কেন?’

‘সেও ধন্যবাদ চিঠি লিখেছে?’

‘হ্যাঁ। বাবা তাকে বলেছিল তার বাবা-মায়ের সাথেই থাকতে। ছেলেটা সেই পরামর্শ মতোই কাজ করে। এরপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায় তার। বাবা- মায়ের সাথে একটা সুখী জীবন কাটাচ্ছে।’

কসুকে ভ্রু কুঁচকালো, ‘এটা কবের কথা?’

‘বাবা যেদিন মারা গেল তার আগের রাতে। আসলে ব্যাপারটা এমন না। সেই সময়ে ধন্যবাদ চিঠিগুলো লেখা হয়নি।’

‘মানে?’

‘সত্যি বলতে—’ লোকটা থেমে গেল। ‘ধুর! এটা বলা ঠিক হয়নি। এসবের

কোনো মানে হয় না।’

অদ্ভুত। লোকটা বেরিয়ে দরজা বন্ধ করল।

‘আমাকে যেতে হবে। আপনি চাইলে থাকতে পারেন। যদিও এখানে দেখার মতো কিছু নেই।’

লোকটা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। কসুকে আর একবার মিল্ক ক্রেটের ভেতরে দেখল।

এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন মিল্ক ক্রেটটা বদলে গেছে।

১০

সুকে খেয়াল করল স্পিকারে এখন ‘ইয়েস্টারডে’ চলছে। সে আরও একটা হুইস্কির অর্ডার দিয়ে নিজের লেখা চিঠিতে চোখ বুলালো।

.

নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,

চল্লিশ বছর আগে আমি আপনার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম, পল লেনন ছদ্মনামে। আপনার হয়তো মনে আছে।

আমার সমস্যা ছিল আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু আমি যেতে চাচ্ছিলাম না।

আপনি আমাকে বলেছিলেন পরিবারের লোকজনকে সবসময় একসাথে থাকা উচিত এবং আমি যেন আমার বাবা-মায়ের ওপরে আস্থা রাখি।

আমি চেষ্টা করেছিলাম। যখন বাড়ি ছাড়ি তখনও আমরা একসাথে ছিলাম। কিন্তু রাস্তায় একটা সময় আমার মনে হলো আমি এটা আর করতে পারব না। তাদের ওপর থেকে ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলাম—বিশেষত আমার বাবার ওপরে। পরিবারের বন্ধনটা ভেঙে গিয়েছিল।

সুযোগ পেয়ে পালিয়ে যাই। জানতাম না ভাগ্যে কী ছিল আমার জন্য। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার জীবনের নানা মোড় পেরিয়ে আমি এখন সুখ খুঁজে পেয়েছি। আমি এখন মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ

আসলে কথাটা এভাবে বলা উচিত, আপনার পরামর্শ না মানার কারণে আমি এখন ভালো আছি।

আমি আবেগের বশে এটা বলছি না। অনলাইনে দেখলাম আপনার পরামর্শ কীভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে তা আপনি জানতে চান। আমি সেটাই আপনাকে জানাচ্ছি। হয়তো আপনি জানতে চাইবেন, যে আপনার পরামর্শ মানেনি তার জীবনটা কেমন কেটেছে।

আমার বিশ্বাস হচ্ছে, যখন বোঝাটা অতিরিক্ত বেড়ে যায়, তখন সেটা নিজে বহন করাই শ্রেয়।

হয়তো এই চিঠি আপনার পরিবারের কারও কাছে পৌঁছাবে। কোনো অসম্মান করে থাকলে ক্ষমা চাইছি। চাইলে চিঠিটা নষ্ট করে দিতে পারেন।

—পল লেনন

.

১৯৮৮ সালের সেই দিনের কথা মনে পড়ল, যেদিন বৃদ্ধ নামিয়ার পুত্রের সাথে তার দেখা হয়েছিল। কেউ ঠিক একই সমস্যা নিয়ে চিঠি লিখেছিল। কিন্তু সে পরামর্শ মেনেও জীবনে সুখ খুঁজে পেয়েছে।

অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার। শহরে আরও একটা বাচ্চা ঠিক একই সমস্যায় ভুগছিল?

কিন্তু সে বাবা-মায়ের সাথেই কীভাবে সুখ খুঁজে পেল? নিজের অভিজ্ঞতা তো বলছে সেটা অসম্ভব।

‘চিঠি শেষ?’

‘বলা যায়।’

‘আজকাল হাতে লেখা চিঠি খুব একটা দেখা যায় না।’

‘আবেগতাড়িত কাজ বলতে পারেন।’

আজ বিকেলেই নামিয়া জেনারেল স্টোরের পোস্টটা একটা ব্লগে দেখেছে সে।

সেপ্টেম্বর ১৩ তারিখে, মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নামিয়া জেনারেল স্টোরের পরামর্শ বাক্স কেবল এক রাতের জন্য খোলা থাকবে। আমরা চাই যারা কখনও এই স্টোর থেকে উপদেশ পেয়েছেন, তারা যেন সেই সময়ে তাদের অশোধিত মতামত আমাদেরকে জানান। পরামর্শটা আপনার জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? কাজে দিয়েছে কি দেয়নি? দয়া করে আপনাদের চিঠিগুলো আগের মতো মেইল স্লটে রেখে যাবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকব।

পোস্টটার উৎস খুঁজে দেখল সাইটের নাম নামিয়া জেনারেল স্টোর-ওয়ান নাইট স্পেশাল। ‘দ্য নামিয়া ফ্যামেলি’র নামে সাইটটা রেজিস্টার করা। পোস্ট অনুসারে আজ নামিয়া স্টোরের মালিকের তেত্রিশতম মেমোরিয়াল সার্ভিস।

ব্যাপারটা মাথা থেকে সরাতে পারেনি কসুকে। কাজেও মন দিতে পারছিল না।

যেন নিজের অজান্তেই ট্রেনে চড়ে বসেছে।

কসুকে হাতের চিঠিটা দেখল। অবশেষে জীবনের কিছু গিট খুলতে পেরেছে।

স্পিকারে এখন ‘পেপারব্যাক রাইটার’ চলছে। সিডি প্লেয়ারের পাশে একটা রেকর্ড প্লেয়ার চোখে পড়ল তার।

‘ভিনাইলও চালান কখনও?’

‘মাঝেমধ্যে। কেউ যদি অনুরোধ করে।’

‘আপনার সংগ্রহ দেখতে পারি? চালাতে বলব না।’

‘অবশ্যই।’ এরিকো কিছু এলপি নিয়ে এলো। ‘আরও আছে। কিন্তু ওপরে।’

কসুকে এবি রোড তুলে নিলো। এটা লেট ইট বি-এর আগে রিলিজ হয়েছে কিন্তু আসলে এটাই ছিল বিটলসের শেষ রেকর্ড। অ্যালবাম কভারে চারজনের ছবি। পল মিককার্টেনির পায়ে জুতো নেই। এ থেকেই তখন কথা ছড়িয়েছিল ‘পল ইজ ডেড।’

‘এসব দেখে পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল।’ আরও একটা পেল; ম্যাজিকাল মিস্ট্রি ট্যুর। এই নামে একটা মুভি ছিল। কিন্তু সেটা নাকি ফ্লপ গেছে। আরেকটা কভার চোখে পড়ল। এসজিটি পেপারস লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড। কভারের ডানে একজন মহিলা, যাকে কসুকে মেরিলিন মনরো মনে করত। পরে বড়ো হয়ে সে জানতে পারে মহিলা একজন ব্রিটিশ অভিনেত্রী যার নাম ডায়ানা ডরস। তার পাশেই একটা জায়গা কালো মার্কারে দাগানো। যেন সেখানের কাগজ উঠে যাওয়ায় কেউ জায়গাটা ভরার জন্য কালো কালি দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছে।

রক্ত যেন গরম হয়ে উঠল কসুকের। হৃদস্পন্দন খুব বেড়ে গেছে।

‘এগুলো—কার-আপনার?’ কোনোমতে বলল সে।

মহিলাটা একটু অবাক হলো, ‘না, আমার ভাইয়ের। ত

‘আপনি কীভাবে পেলেন?’

‘সে দুবছর আগে মারা গেছে। ছোটোবেলা থেকেই বিটলসের খুব বড়ো ভক্ত ছিল। সে সবসময়ই একটা বিটলস থিমের বার খুলতে চেয়েছে। তাই ত্রিশ বছর বয়সে এই বার খুলেছিল।’

‘আপনার ভাই কি অসুস্থ ছিল?’

‘ক্যান্সার হয়েছিল। বুকে।

কসুকে মহিলার বিজনেস কার্ড দেখল। এরিকো হারাগুচি।

‘তার নামও হারাগুচি?’

‘না। এটা আমার বিবাহিত নাম। আমি এখন ডিভোর্সি। নাম বদলানো ঝামেলা লাগে তাই এটা আর বদলাইনি। আমার ভাইয়ের শেষ নাম মাইডা।’

মাইডা কসুকের সেই বন্ধুর নাম যার কাছে সে রেকর্ড বিক্রি করেছিল। তার মানে এগুলো কসুকেরই রেকর্ডগুলো। বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু অবাক করার মতোও কিছু না। শহরে বিটলসপ্রেমী অনেকেই ছিল। ফ্যাব ফোর নাম শুনেই তার বোঝা উচিত ছিল এই বারের মালিক তার পরিচিত কেউ-ই হবে।

‘এটা জিজ্ঞাসা করলেন কেন?’

‘কিছু না। তার মানে এগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু এগুলো আসলে অন্য কারও। তার কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়েছিল।’

‘মানে?’

‘মিডেল স্কুলে থাকতে এক বন্ধুর কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়েছিল। সে বিটলসের আরও বড়ো ভক্ত। হুট করেই বিক্রি করে দেয় রেকর্ডগুলো। আমার ভাই খুব খুশি হয়েছিল এসব পেয়ে—’ এরিকো থেমে গেল, ‘দুঃখিত। কী একঘেয়ে গল্প শোনাচ্ছি আপনাকে।’

‘না, শুনতে ভালোই লাগছে। বলে যান, সেই বন্ধুর কী হয়েছিল?’

‘গ্রীষ্মের বন্ধের পর সেই বন্ধু আর ফেরেনি। তার পুরো পরিবার শহর ছেড়ে চলে যায়। বিশাল ঋণের বোঝা ছিল তাদের মাথায়। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও বাঁচতে পারেনি তারা—’

‘কেন?’

এরিকো চোখ নামিয়ে ফেলে, শহর ছাড়ার দুদিন পর তারা আত্মহত্যা করে।’

‘কী? তারা সবাই?’

‘মানে পুরো পরিবার। তিনজনই। বাবা প্রথমে স্ত্রী-পুত্রকে মেরে ফেলে। এরপর নিজে আত্মহত্যা করে।

কসুকে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল, ‘কিন্তু কেন? এমন কী হয়েছিল?’

‘আমি ঠিক জানি না। কিন্তু লোকটা নাকি তাদের বিষ প্রয়োগ করে একটা নৌকায় সমুদ্রে নিয়ে মেরে ফেলে দেয়।

‘তারা নৌকায় ছিল?’

‘মাঝরাতে একটা নৌকা চুরি করে হারবারের দিকে চলে গিয়েছিল। লোকটা যথেষ্ট পরিমাণ বিষ নেয়নি। পরদিন তীরে ভেসে উঠে। এরপর গলায় দড়ি দেয়।’

‘কিন্তু স্ত্রী-পুত্রের লাশ পাওয়া যায়নি?’

‘আমি জানি না। কিন্তু লোকটা একটা চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছিল। সেটা দেখেই সবাই জানতে পারে যে স্ত্রী-পুত্রও মারা গেছে।’

‘হায়!’

কসুকে হুইস্কি শেষ করে আরেকটা অর্ডার করে। তার মাথা ঘুরছে। শরীরে অ্যালকোহল না থাকলে হয়তো এতক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারত না।

আর একটা লাশ পেলে হয়তো সেটা কিমিকোর হতো। তার বাবা যদি চিঠি লিখেই আত্মহত্যা করে থাকে তবে পুলিশ আর কোনো লাশ না পেলেও কোনো তদন্ত করত না।

কিন্তু তার বাবা এমন কেন করল?

কসুকে বিয়াল্লিশ বছর আগের সেই হতভাগ্য রাতের কথা মনে করল। কসুকে নিশ্চিত ছিল তাকে না পেলে সাদায়ুকি আর কিমিকো হয়তো পুত্রের কথা ভুলে যাবে, গন্তব্যের দিকে চলতে থাকবে, আর নয়তো তাকে খোঁজার চেষ্টা করবে। যদিও চেষ্টা করলেও খুঁজে বের করতে পারত না।

কিন্তু তারা কোনো রাস্তাই বেছে নেয়নি। তার বদলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

হয়তো তার বাবা আগে থেকেই আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে রেখেছিল, একদম শেষ উপায় হিসেবে। কিন্তু কসুকের পদক্ষেপ তাকে সেটার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

কিন্তু সে আর কিমিকো নৌকা চুরি করে এসব করার ঝামেলা করতে গেল কেন?

এর একটাই উত্তর হতে পারে। তারা বুঝাতে চেয়েছে যে তাদের সন্তানও মারা গেছে। বিশাল সমুদ্রে লাশ কেউ খুঁজে পেত না। সবাই এটাই মেনে নিত।

তারা কি ভাবেনি যে তারা মারা গেলে তাদের পুত্রের কী হবে?

হয়তো ভেবেছে। একারণে কসুকে ওয়াকুর নাম পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। যেন সে এক নতুন পরিচয়ে বাঁচতে পারে।

জুভেনাইলের সেই গোয়েন্দা আর ফ্যামিলি কোর্টের লোকজন হাজার চেষ্টা করেও তার পরিচয় খুঁজে বের করতে পারেনি। পারার কথাও না। তার পরিচয় মুছে গিয়েছিল। সেই কসুকে ওয়াকুর কোনো অস্তিত্বই নেই।

তার মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেল কসুকে: তোমার বাবা আর আমি—বিশেষত তোমার বাবা–তোমার ভালো জীবনের জন্য যে-কোনো কিছু করতে প্রস্তুত। প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে দেবো।

সে মিথ্যা বলেনি। আজ তাদের বলিদানের জন্যই কসুকে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে।

নাহ, এই বাবা-মায়ের সন্তান হয়ে না জন্মালে এসব যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না তাকে। নিজের নামটাও ত্যাগ করে দিতে হয়েছিল। সে নিজে নিজেই এই পর্যন্ত এসেছে।

কিন্তু তারপরেও মনের মাঝে আফসোস দানা বেঁধে উঠতে লাগল।

কসুকে যখন পালিয়ে যায় তখন তার বাবা-মায়ের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। সে কেন আরেকবার জিজ্ঞাসা করল না তাদেরকে? কেন বলল না যে, চলো ফিরে গিয়ে নতুনভাবে শুরু করার চেষ্টা করি।

‘আপনি ঠিক আছেন?

কসুকে দেখল এরিকো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

‘মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে চিন্তিত আছেন।’

‘কিছু না। ধন্যবাদ।’

কাউন্টারের ওপর রাখা চিঠিটা দেখে কষ্ট হলো কসুকের। এই চিঠির কোনো অর্থ নেই। কেবল মূল্যহীন গর্ব লেখা। বয়স্ক লোকের পরামর্শের কোনো কৃতজ্ঞতার প্রকাশ নেই। আমার বিশ্বাস হচ্ছে, যখন বোঝাটা অতিরিক্ত বেড়ে যায়, তখন সেটা নিজে বহন করাই শ্রেয়। এর কোনো অর্থ নেই এখন। বাবা-মা সেই বলিদানটা না দিলে কে জানে সে এখন কোথায় থাকত।

চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল সে। এরিকো অবাক হলো।

‘দুঃখিত। আমি আর কিছুক্ষণ থাকতে পারি?’

‘হ্যাঁ অবশ্যই,’ এরিকো হাসল।

বুড়ো লোকটা আসলে সঠিক পরামর্শই দিয়েছিল। একসাথে থাকলেই তারা কোনো না কোনো রাস্তা খুঁজে পেত। কিন্তু কসুকে সেটা মানেনি। একা একাই গন্তব্যহীনভাবে বেরিয়ে পড়েছে।

তাহলে এখন কী লিখবে?

সে পরামর্শ উপেক্ষা করে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে আর এরপর তার বাবা-মা আত্মহত্যা করে। এটা লিখবে?

এটা পারব না। এটা ঠিক হবে না।

ওয়াকু পরিবারের খবরটা কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে কে জানে। বুড়ো লোকটা যদি শুনে থাকে তাহলে সে কী ভাববে? সে নিশ্চয়ই বুঝে যাবে পল লেনন এই ছেলেটাই। সে হয়তো ছেলেটাকে বাবা-মায়ের সাথে যাবার পরামর্শ দেওয়ার কারণে আফসোস করবে।

আজ সন্ধ্যায় সেই লোকটার তেত্রিশতম মেমোরিয়াল সার্ভিস। কসুকে তার আত্মার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবার একটা তাড়না অনুভব করল। তারা অশোধিত মতামত চেয়েছে, নির্মম না। পরামর্শগুলো কাজে লেগেছে কিনা সেটাই মূলকথা।

ভেবেচিন্তে, কসুকে আরেকটা চিঠি লিখল।

.

নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,

চল্লিশ বছর আগে আমি পল লেনন নামে একটা চিঠি লিখেছিলাম।

আমার সমস্যা ছিল, আমার বাবা-মা ঋণের দায়ে পড়ে শহর ছেড়ে পালাতে চাইছিল। বুঝতে পারছিলাম না আমি তাদের সাথে যাবো কি না। সেই চিঠিটা দেওয়ালে পোস্ট করা হয়নি। আপনি বলেছিলেন তখনই এই প্রথম কেউ আপনাকে কোনো গুরুতর সমস্যা নিয়ে চিঠি দিয়েছে।

আপনি আমাকে বলেছিলেন পরিবার ভাঙা কোনো ভালো ব্যাপার না। বলেছিলেন আমরা যদি একসাথে থাকি, তবে কোনো না কোনোদিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারব।

আমি আপনার পরামর্শ মতে তাদের সাথেই থেকেছি। এটাই সঠিক সমাধান ছিল।

বিস্তারিত বলব না কিন্তু আমার বাবা-মা এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একটা উপায় পেয়ে যায়। কয়েক বছর আগে তারা ইহলোক ত্যাগ করে। কিন্তু আমার ধারণা তারা সুন্দর জীবন কাটিয়েছেন। আমিও স্বাচ্ছন্দ্যে আছি।

এসবই আপনার পরামর্শের কারণে। ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি না লিখে পারলাম না।

আমার ধারণা এই চিঠি আপনার পরিবারের কারও হাতে যাবে। আশা করি এটা আপনার মেমোরিয়াল সার্ভিসে একটি গ্রহণযোগ্য অবদান হবে।

—পল লেনন

.

চিঠিটা কয়েকবার পড়ে কসুকে একটু অবাক হলো। বৃদ্ধ লোকের ছেলেটা সেদিন ঠিক এরকম একটা চিঠি পাবার কথাই বলেছিল।

হয়তো কাকতালীয় ব্যাপার।

চিঠিটা খামে ভরে কসুকে লক্ষ করল মধ্যরাত হয়ে গেছে।

উঠে দাঁড়ালো কসুকে, ‘আমি চিঠিটা পোস্ট করে আসব। বেশি দেরি হবে না। এসে কী আরেক দফা ড্রিংক করতে পারব এখানে?’

এরিকো একটু ইতস্তত করল। কিন্তু একটু পরই হেসে বলল, ‘অবশ্যই।’

‘ধন্যবাদ,’ বলে কসুকে কাউন্টারে একটা দশ হাজার ইয়েনের বিল রাখল। বার থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে চলতে লাগল সে। অনেক দোকান ইতোমধ্যে বন্ধ করে ফেলেছে।

কসুকে রাস্তা চেনে। কয়েক মিনিটের মাঝেই নামিয়া জেনারেল স্টোরে এসে পড়ল। দোকানটার সামনে এক মহিলার ছায়া দেখে থেমে গেল সে।

মহিলাটাও কি একই কারণে এসেছে এখানে? চিঠি পোস্ট করতে? কসুকে শাটারের দিকে এগিয়ে গেল। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি এক মহিলা, পরনে স্যুট। তার পাশে রাস্তায় একটা বেঞ্জ দাঁড় করানো। প্যাসেঞ্জার সিটে অনেকগুলো সিডি। সবগুলোই কোনো এক সিডিরই কপি। হয়তো এই মহিলা এবং এই শিল্পীর কোনো সংযোগ আছে।

মহিলাটা স্লটে কিছু একটা ঢুকিয়ে গাড়ির দিকে চলে গেল। কসুকেকে দেখতে পেয়ে থতমত খেয়ে যায়। কসুকে হাতের চিঠিটা দিয়ে মেইল স্লটের দিকে ইশারা করে। মহিলা বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হয়। কসুকের সামনে নতজানু হয়ে বেঞ্জে উঠে চলে যায় সে।

আজ কত মানুষ এখানে আসছে? নামিয়া জেনারেল স্টোর নিশ্চয়ই অনেক মানুষের জীবনে বড়ো প্রভাব ফেলেছে।

বেঞ্জটা দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে কসুকে তার চিঠিটা স্লটে ফেলল। চিঠি পড়ার এই ফ্লাপ শব্দটা বিয়াল্লিশ বছরে আর শোনেনি সে।

যেন তার জীবনের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে। হয়তো এখন সবকিছু সঠিক জায়গায় স্থান নিয়েছে।

ফ্যাব ফোর-এ ফিরে কসুকে দেখল ফ্ল্যাট স্ক্রিনটা চালু। এরিকো কাউন্টারের সামনে রিমোটটা নিয়ে টিপছে।

‘কী হচ্ছে?’ কসুকে জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার ভাই এই ভিডিয়োটা খুব পছন্দ করত। ভাবলাম আপনাকে দেখাই। এটা কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে রিলিজ করা হয়নি।’

‘হুম।’

‘কী খাবেন?’

‘হুইস্কি।’

কসুকের সামনে এক গ্লাস বুনাহাভাইন দেওয়া হলো। গ্লাসটা তুলে সে যখনই খেতে যাবে তখন ফিল্মটা চালু হলো। শব্দ শুনে প্লাস্টা নামিয়ে রাখল কসুকে। সে জানে এটা কোন ফিল্ম।

‘এটা কী—’

স্ক্রিনে অ্যাপল বিল্ডিংয়ের ছাদ দেখাচ্ছে। শীতের বাতাসে বিটলস আবারও গান করছিল। এটা মুভিটার শেষ অংশ। লেট ইট বি

গ্লাসটা রেখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল কসুকে। এই মুভিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এটাই তাকে শিক্ষা দিয়েছিল, হৃদয়ের বন্ধন কতটা ভঙ্গুর হয়।

এবং তবুও—

ফ্ল্যাট স্ক্রিনে দেখতে অন্যরকম লাগছে। থিয়েটারে দেখে মনে হয়েছিল তাদের বন্ধন ভেঙে গেছে আর তাদের পারফরমেন্সে সেরকম জাদু আর নেই। কিন্তু এখন এইবারে বসে সেটা একেবারে অন্যরকম প্রভাব ফেলল কসুকের ওপর।

ফ্যাব ফোর চমৎকার বাজাচ্ছে। সেই জাদু আছে তাদের সংগীতে। হ্যাঁ তারা ব্যান্ড ভেঙে দিচ্ছে কিন্তু তাদের একসাথে এভাবে গান করতে দেখে কীভাবে এই ঐতিহাসিক ব্যান্ডের শুরু হয়েছিল তা মনে পড়ে যাচ্ছে।

কসুকে যখন এটা থিয়েটারে দেখেছিল, তখন সে নিজের জীবনের দুঃখ কষ্টগুলো এই মুভির সাথে জড়িয়ে ফেলেছিল। তাই এই মুভি দেখে তার ওপর তেমনই প্রভাব পড়ে। কেউ যে আজীবন একসাথে থাকতে পারে সে বিশ্বাস ভেঙে যায়।

একটানে গ্লাসের হুইস্কি শেষ করে চোখ বন্ধ করে কসুকে। নিজের বাবা-মায়ের জন্য প্রার্থনা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *