অধ্যায় ২ – মিডনাইট ব্লু

অধ্যায় ২ – মিডনাইট ব্লু

চেক ইন ডেস্কের ওপাশে ষাটোর্ধ্ব বয়সের এক লোক বসে আছেন। তিনি গত বছর ছিলেন না। দেখে মনে হচ্ছে যেন আজীবন প্রশাসনিক কাজ করে অবসর নেওয়ার পর এখানে কাজ করা শুরু করেছেন।

নিজের নাম লোকটাকে বলার সময় কাতসুরো খুব অস্বস্তি বোধ করল। ‘পুরো নাম কী?’ লোকটা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘কাতসুরো মাটসুকা। আমি চ্যারিটি কনসার্টের জন্য গান গাইতে এসেছি।’

‘চ্যারিটি?’

‘ক্রিসমাস শোয়ের জন্য—’

‘ওহ হ্যাঁ।’ লোকটা অবশেষে বুঝতে পারলেন। ‘শুনেছি গানের পারফর্ম্যান্স হবে। ভেবেছিলাম ব্যান্ড আসবে। কেবল আপনিই এসেছেন?’

‘হ্যাঁ, দুঃখিত।’

‘এক মিনিট।’

লোকটা ফোন উঠিয়ে কোথাও কল করলেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর কাতসুরোকে বললেন, ‘কেউ এখনই এসে আপনাকে নিয়ে যাবে।’

চশমা পরা এক মহিলা এলো। কাতসুরো চিনতে পারল তাকে। গত বছর পার্টির দায়িত্বে ছিল সে। মহিলাও কাতসুরোকে চিনতে পেরেছে। মৃদু হেসে এগিয়ে এলো।

‘আবারও স্বাগতম। আসার জন্য ধন্যবাদ।’

‘আমাকে আবারও ডাকার জন্য ধন্যবাদ।’

মহিলা তাকে একটা ওয়েটিং রুমে নিয়ে এলো।

‘স্টেজে পাবেন চল্লিশ মিনিট। সেট লিস্টটা গতবারের মতো বাছাই করে নেবেন?’

‘সমস্যা নেই। আমি বেশিরভাগ ক্রিসমাস মিউজিক বাজাবো। আর দুই-একটা অরিজিনাল।’

‘চমৎকার।’

স্টেজে যাবার আগে কিছু সময় বাকি আছে এখনও। তাই কাতসুরো ওয়েটিংরুমে বসে এক কাপ চা খেল।

মারুমিতসুয়েন নামের এই অনাথাশ্রমে এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এলো সে। এটা পাহাড়ের পাশে চারতলা একটা দালান। লিভিং কোয়ার্টার, ক্যাফেটেরিয়া, স্নানঘর এবং আরও নানা ফ্যাসিলিটি আছে এখানে। বাচ্চা থেকে শুরু করে আঠারো বছর বয়সি ছেলেমেয়ে থাকে এখানে। কাতসুরো এরকম অনেক জায়গায় গিয়েছে। তাদের মধ্যে মারুমিতসুয়েন সবচেয়ে বড়ো।

গিটারটা নিয়ে চেক করল সবকিছু ঠিক আছে কিনা। ঠিক আছে।

মহিলা ফিরে তাকে এসে বলল স্টেজে যাবার সময় হয়েছে। যাবার আগে আরেক কাপ চা শেষ করে নিলো কাতসুরো।

অনুষ্ঠানটা জিমনেশিয়ামে চলছে। বেশিরভাগ বাচ্চাই খুব ছোটো, প্রাথমিক স্কুলে পড়ার বয়েসি। কাতসুরো মঞ্চে উঠতেই তারা হাততালি দিলো, যেভাবে বড়োরা বলে দিয়েছিল তাদের।

মঞ্চে একটা চেয়ার, একটা মাইক্রোফোন আর একটা মিউজিক স্ট্যান্ড আছে। কাতসুরো চেয়ারে বসে বাচ্চাদের দিকে তাকালো, ‘হ্যালো মারুমিতসুয়েন!’

‘হ্যালো,’ বাচ্চারা একসাথে বলে উঠল।

‘আমি দ্বিতীয়বারের মতো এলাম এখানে। গত বছরের ক্রিসমাসেও আসার সুযোগ হয়েছিল। নিজেকে এখন সান্টা ক্লজ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু উপহার ছাড়া।’ বাচ্চারা হেসে উঠল। ‘কিন্তু চিন্তার কিছু নেই। আমি মিউজিক উপহার দিবো তোমাদের।’

কাতসুরো ‘রুডলফ দ্য রেড-নোসড রেইনডিয়ার’ গাইতে শুরু করল। সবাই এটার ছন্দ জানে, তাই একত্রে গাওয়া শুরু করল।

কাতসুরো ক্ল্যাসিকাল ক্রিসমাস গানের মাঝেমধ্যে কিছু কৌতুকও বলল। বাচ্চারা বেশ মজা পাচ্ছে। হাততালি দিচ্ছে, গাইছে, দুলছে।

এসবের মাঝে কাতসুরোর দৃষ্টি একটা মেয়ের দিকে আটকে গেল। দ্বিতীয় সারিতে বাম দিকে বসে আছে সে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বড়ো কোনো ক্লাসে পড়ে হয়তো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। যেন কাতসুরোর গানে তার কোনো আগ্রহ নেই। বাকিদের মতো সে গান গাইছে না।

কাতসুরো বাচ্চা মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। এমন শূন্য দৃষ্টি বাচ্চাটাকে মানাচ্ছে না।

হয়তো গানগুলো মেয়েটার পছন্দ হচ্ছে না। কাতসুরো এবার গত বছরের ব্লকবাস্টার গান, ইউমি মাটসুটোয়ার টেক মি আউট টু দ্য স্লোল্যান্ড থেকে ‘মাই বেবি স্যান্টা ক্লজ’ গাইতে শুরু করল। সত্যি বলতে সে কপিরাইট আইন ভঙ্গ করছে, কিন্তু তাকে রিপোর্ট করবেই বা কে?

বাকি বাচ্চারা আনন্দ করছে কিন্তু সেই মেয়েটার অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো না।

কাতসুরো এই মেয়েটার বয়েসি বাচ্চা পছন্দ করবে এমন সব গান গাইলো, কিন্তু কিছুই হলো না।

‘আচ্ছা, এটা আমার শেষ গান। সবাইকে সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।’

কাতসুরো গিটার রেখে হারমোনিকা তুলে নিলো। চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিশ্বাস নিলো সে। হাজারবার গাওয়া এই গানটার জন্য তার কোনো শিটের প্রয়োজন হবে না।

চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ হারমোনিকা বাজালো সে। গানটা স্থায়ী হলো কেবল সাড়ে তিন মিনিটের মতো। পুরো জিমনেশিয়াম তখন স্তব্ধ। গান শেষে চোখ খুলতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল কাতসুরোর।

মেয়েটা এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তীব্র দৃষ্টি। এক মুহূর্তের জন্য কাতসুরো যেন ভুলে গেল তাকে কেমন আচরণ করতে হবে।

পারফরমেন্স শেষে সবাই হাততালি দিলো। চশমা পরা মহিলা তাকে ধন্যবাদ জানাতে এলে কাতসুরো ভাবল ওই বাচ্চা মেয়েটার কথা জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু করল না। কোন উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করবে?

অনুষ্ঠানের পর বাচ্চারা ক্যাফেটেরিয়াতে খেতে গেল। কাতসুরোও আমন্ত্রিত সেখানে। যখন সে খাবার খাচ্ছিল তখন মেয়েটা এগিয়ে এলো।

‘গানটার নাম কী?’ সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

‘কোনটা?’

‘শেষেরটা। হারমোনিকা দিয়ে বাজিয়েছেন যে। আমি আগে কখনও শুনিনি।’

হাসলো কাতসুরো, ‘শোনার কথাও না, ওটা অরিজিনাল।’

‘অরিজিনাল মানে?’

‘আমি নিজে বানিয়েছি। তোমার ভালো লেগেছে?’

মেয়েটা ওপর-নিচে মাথা নেড়ে বলল, ‘চমৎকার হয়েছে। আমি আবার শুনতে চাই।’

‘আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করো।’

কাতসুরো নিজের ঘর, যেটা আশ্রমের তরফ থেকে আজকের জন্য দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে হারমোনিকাটা নিয়ে এলো। এরপর ক্যাফেতে বসে মেয়েটাকে আবার গান গেয়ে শোনালো। মেয়েটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল।

‘এটার নাম কী?’

‘রিবন।’

‘রিবর্ন—’ মেয়েটা গুনগুন করতে লাগল। চমৎকারভাবে তার গানের সুরটা গেয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটা।

‘ইতোমধ্যেই শিখে গেছো?’

অবশেষে বাচ্চাটা হাসল, ‘আমি গান খুব ভালো মনে রাখতে পারি।’

‘চমৎকার,’ কাতসুরোর মনে একটা শব্দই এলো—জিনিয়াস।

‘মিস্টার মাটসুকা, আপনি এখনও পেশাদার হননি কেন?’

‘কী জানি!’ কাতসুরো মনের তীব্র কষ্টটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল।

‘আমি নিশ্চিত এই গানটা হিট হবে।’

‘তাই?’

‘আমার খুব ভালো লেগেছে।’

কাতসুরো হাসল, ‘ধন্যবাদ, আমারও ভালো লাগে।’

‘সেরি, তুমি ওখানে?’ একজন স্টাফ সেদিকে এলো, ‘টাটসুকে খাইয়ে দেবে?’

‘আচ্ছা,’ সেরি কাতসুরোকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

কাতসুরো পিছুপিছু গিয়ে দেখল সেরি একটা ছোটো বাচ্চা ছেলের পাশে বসে তাকে চামচ দিয়ে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। বাচ্চাটার চেহারা ভাবলেশহীন।

চশমা পরা মহিলাটা কাছেই ছিল। কাতসুরো তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, ‘ওরা ভাই-বোন। গত বসন্তে একটা অত্যাচারী সংসার থেকে পালিয়ে এসেছে। টাটসু তার বোন ছাড়া কারও সাথে কথা বলে না।’

কাতসুরো সেরিকে দেখে বুঝতে পারল কেন সে বাকি বাচ্চাদের মতো ক্রিসমাসের গান উপভোগ করেনি।

ডিনার শেষে কাতসুরো নিজের ঘরে বসে বাইরে বাচ্চাদের দেখছিল। সবাই মজা করে খেলছে। কেবল সেরি আর টাটসু দূরে এক কোনায় বসে বসে দেখছে।

আপনি এখনও পেশাদার হননি কেন?

লম্বা সময় ধরে এটা তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি। হয়তো দশ বছর ধরে। ‘বাবা, আমি আপনার মান রাখতে পারিনি।’ সে রাতের আকাশের দিকে তাকালো, ‘হেরে যাওয়া যুদ্ধটা লড়বারও সুযোগ পেলাম না।’

আট বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল তার।

জুলাইয়ের প্রথম দিকে একদিন তার দাদির মৃত্যুর খবর পেল কাতসুরো। দোকান খোলার সময় তার ছোটো বোন এমিকোর ফোন আসে। তখন সব জানতে পারে সে।

সে জানত দাদির শরীর ভালো না। লিভার আর কিডনির সমস্যা বেড়েই চলেছিল। সবাই জানত তার দিন ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু কাতসুরো বাসায় গিয়ে তার সাথে দেখা করার সাহস যোগাতে পারছিল না। দাদির জন্য চিন্তা করেনি এমন না। কিন্তু বাসায় না যাবার অনেক কারণ ছিল তার।

‘সুয়া অনুষ্ঠান কাল হবে। আর ফিউনারেল তার পরদিন। তুমি কত দ্রুত আসতে পারবে?’

কাতসুরো মাথা চুলকালো, ‘আমার তো কাজ করতে হবে, তাই বলতে পারছি না। বসকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।’

এমিকোর তীব্র নিশ্বাসের শব্দ পেল সে।

‘কাজ? তুমি না কেবল কাজে সাহায্য করছো? দুই-এক দিনের জন্য ছুটি নিলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না তার। আমি ভেবেছিলাম তুমি এই কাজটা এ কারণে নিয়েছো যেন যখন-তখন ছুটি নিয়ে নিতে পারো।’

এমিকো কখনও কিছু ভোলে না। সে ঠিকই বলছে। কাতসুরো এমিকোকে বোকা বানাতে পারবে না। তাই চুপ করে রইল।

‘তুমি না এলে খুব ভেজালে পড়ব আমরা। বাবার শরীর ভালো নেই। মা-ও দাদির সেবা করতে করতে খুব পরিশ্রান্ত। দাদি তোমার জন্য অনেক কিছু করেছে, সেটা তুমি জানো। অন্ততপক্ষে তার ফিউনারেলে আসাটা তোমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’

কাতসুরো নিশ্বাস ফেলল, ‘আচ্ছা, দেখা যাক কী করতে পারি।

‘যত দ্রুত পারো এসে পড়ো। পারলে আজ রাতেই।’

‘সেটা সম্ভব না।’

‘তবে কাল সকালে। খুব বেশি হলে দুপুরে।’

‘ভেবে দেখবো।’

‘দেখো। যা চাও তা তো করোই সবসময়।’

মানে কী তা জিজ্ঞাসা করার আগেই এমিকো ফোন কেটে দিলো।

কাতসুরো ফোন রেখে টুলে বসল। অন্যমনস্ক হয়ে দেওয়ালের দিকে তাকালো, সেখানে ওকিনাওয়া বিচের অনেক ছবি। তার বস এই বিচটা খুব পছন্দ করে। পুরো বার জুড়েই ওকিনাওয়ার কিছু না কিছু আছে।

বারের এক প্রান্তে কাতসুরোর জন্য বরাদ্দ গিটার আর চেয়ার আছে। রিকোয়েস্ট এলে কাতসুরো গান করে। কাস্টমাররা তার গানে মুগ্ধ হয়। কেউ কেউ গানের সাথে তাল মিলায়। ‘বিশ্বাস হয় না আপনি নিজে নিজেই গান শিখেছেন!’ কেউ না কেউ সবসময় তাকে পেশাদার গায়ক হবার পরামর্শ দেয়।

‘আহা, কী বলছেন,’ মুখে এটা বললেও ভেতরের কণ্ঠ চিৎকার করতে থাকে, ‘আমি তো সেটাই চাই।’ একারণেই কলেজ মাঝ পথে ছেড়ে দিয়েছিল সে।

মিডেল স্কুলে থাকতে সংগীতের প্রেমে পড়েছিল সে। ক্লাস সিক্সে এক বন্ধুর বাসায় তার ভাইয়ের গিটার দিয়ে শুরু। ভাই তাকে গিটার ধরা শিখাচ্ছিল। সেই প্রথম গিটার হাতে ধরা। প্রথম প্রথম ধরতে পারছিল না। অনেক চেষ্টার পর যখন একটা সুর বাজিয়ে ফেলল, তখন যেই তৃপ্তি বোধ হয়েছিল, তার তুলনা নেই। অব্যক্ত এক শিহরণ বয়ে গিয়েছিল তার শরীর জুড়ে।

কিছুদিন পর সাহস করে বাবা-মাকে বলে ফেলল যে তার নিজের একটা গিটার চাই। তার বাবা-মাছের দোকান চালায়। তার জীবনে সংগীতের কোনো মূল্য নেই। সে রেগেমেগে তার পুত্রকে বলল ওই-সব বন্ধুদের সঙ্গ বাদ দিতে, গিটার বাজানো মানে পাড়ার কুকর্মকারী হয়ে যাওয়া।

কিন্তু কাতসুরো কাকুতি-মিনতি করল: ‘আমি ভালোমতো পড়াশোনা করব, ভালো স্কুলে ঢুকার চেষ্টা করব। যদি ঢুকতে না পারি তবে নিজেই গিটার ভেঙে ফেলে দেবো। আর কখনও বাজাবো না।’

তার বাবা-মা দ্বিধায় পড়ে গেল। কাতসুরো কখনও তাদের কাছে এমনভাবে কোনো কিছু চায়নি। প্রথমে তার মা রাজি হয়, এরপর বাবা। কিন্তু তারা তাকে মিউজিক স্টোরে না নিয়ে একটা পন শপে নিয়ে যায়। আপাতত তাকে একটা ব্যবহৃত গিটারই দেওয়া হবে।

‘একে তো ফেলেই দিবে, তাহলে শুধু শুধু দামিটা কিনে টাকা নষ্ট করার দরকার নেই।’ তার বাবা গজগজ করে বলেছিল।

ব্যবহৃত হোক বা নতুন, একটা গিটার পেয়েই কাতসুরো খুশি হয়ে যায়। এত খুশি হয় যে রাতে ঘুমাবার সময়ও গিটার নিয়ে ঘুমাতো সে। সারাদিন অনুশীলন করত। বাবা-মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য প্রচুর পড়াশোনাও শুরু করে দেয়। তার গ্রেড খুব ভালো আসতে শুরু করে। কেবল ছুটির দিনে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে গিটার অনুশীলন করত। তাই তার বাবা-মাও কোনো আপত্তি করতে পারত না। প্রতিশ্রুতি মতো, ভালো একটা স্কুলে চান্স পেয়ে যায় কাতসুরো।

স্কুলে ঢুকেই সবার আগে মিউজিক ক্লাবে যোগ দেয় সে। ক্লাবের কিছু সদস্যের সাথে মিলে একটা থ্রি-পিস ব্যান্ড গঠন করে। সুযোগ পেলেই তারা পারফর্ম করত। শুরুর দিকে কেবল কভার করত, কিন্তু আস্তে আস্তে অরিজিনাল গাওয়াও শুরু করে তারা, যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল কাতসুরোর লেখা। ব্যান্ডের সদস্যরা কাতসুরোর প্রতিভার বেশ প্রশংসা করত।

কিন্তু স্কুলের তৃতীয় বছরে ব্যান্ডটা ভেঙে যায়। পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। যদিও তারা কথা দিয়েছিল যে কলেজে উঠে আবারও ব্যান্ড তৈরি করবে কিন্তু তেমনটা আর হয়নি। একজন সদস্য কোথাও চান্স পায়নি। এক বছর পরে দূরে কোথাও চান্স পেলেও আবার ব্যান্ড তৈরি করার ইচ্ছাটা কারও মাঝে আর জাগেনি।

কাতসুরো টোকিওর এক স্কুলে ইকন মেজরে পড়া শুরু করে। প্রথমে মিউজিক নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও পরে তা দমিয়ে ফেলে, কারণ তার মা-বাবা এর তীব্র বিরোধিতা করবে, যেহেতু তাকে কিছুকাল পরই পারিবারিক স্টোর সামলাতে হবে। কাতসুরো খুব ছোটো থাকতে এই স্টোর কেনা হয়েছিল। তার বাবা-মা এখন পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কাতসুরো এই স্টোর সামলানো ছাড়া জীবনে অন্য কিছু করতে চাইবে না। এমনকি কাতসুরো নিজেও তা ধারণা করেনি কখনও।

কলেজে মিউজিকের অনেক ক্লাব ছিল। কাতসুরো একটাতে যোগ দেয়। কিন্তু শীঘ্রই একটা ভুল করে বসে। এই ক্লাবের সদস্যরা সংগীত করার চেয়ে বেশি ঘুরে বেড়ানোতে আগ্রহ রাখত। কাতসুরো কয়েকবারই এই প্রসঙ্গটা তুলতে চেয়েছে কিন্তু বাকিরা তার সাথে এমন আচরণ করত যেন সে একটা পাগল।

‘কী যে বলো না, সংগীতের মানে হচ্ছে কিছু ভালো সময় কাটানো।’

‘হ্যাঁ, তুমি এত কাঠখোট্টা কেন? এমন তো না যে সিরিয়াসলি সংগীত করে খুব বড়ো গায়ক হয়ে যাবে।’

বিরক্ত হয়ে কাতসুরো ক্লাব ছেড়ে দেয়। এদের সাথে যুক্তিতে পারা যাবে না। এরা জীবনকে অন্য ভঙ্গিতে দেখে।

এরপর কাতসুরো অন্য ক্লাবগুলোতেও যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেনি। উচ্চাশাহীন মানুষের সাথে সংগীত করে হতাশ হবার চেয়ে একা একা চেষ্টা করাই ভালো।

এই সময়ে সে শখের গায়কদের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শুরু করে। হাইস্কুলের অনুষ্ঠানগুলোতে মঞ্চে উঠে গাইতে শুরু করে। প্রথম প্রথম সমস্যা হলেও আস্তে আস্তে সামলে নেয়। ফাইনাল পর্যন্ত উঠে যেতে শুরু করে।

এই গ্রুপের মানসিকতা খুব সংক্রামক ছিল। তাদের কাছে সংগীতই সব। এর জন্য তারা যে কোনো বলিদান দিতে প্রস্তুত।

তাদের সংগীত শুনে কাতসুরো মনে মনে ভাবত, আমাকে আরও ভালো করতে হবে।

তার প্রায় সমস্ত সময় সংগীত অনুশীলনে চলে যেতে লাগল। এমনকি গোসলের বা খাবার সময়েও সংগীতের চিন্তা তার মাথা থেকে সরতো না। তখন সে আস্তে আস্তে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। কোনো কারণই পাচ্ছিল না ক্লাসে যাবার। তার গ্রেড খারাপ আসতে শুরু করে, এমনকি সব বিষয়ে ফেইল করে বসে।

তার মা-বাবা এসবের কিছুই জানত না। ছেলেকে টোকিও পাঠাবার পর তারা ভেবেছিল চার বছর পর সে স্নাতক শেষ করে ফিরবে। কাতসুরো যখন তাদেরকে ফোন করে কলেজ ছেড়ে দেওয়ার কথা জানালো তখন তার মা রিসিভার হাতেই কান্না করে ফেলে। সেই গ্রীষ্মে কাতসুরোর বয়স একুশ। তার বাবা ফোন করে রাগের স্বরে এসবের কারণ জানতে চাইল।

কাতসুরো সংগীতকে পেশা বানাতে চায়। তাই কলেজে যাবার আর কোনো কারণ নেই।

তার কথা শুনে তার বাবা রাগে ফেটে পড়ে। চিৎকার করতে শুরু করলে কাতসুরো ফোন রেখে দেয়।

সে রাতেই তার বাবা-মা টোকিওতে তার অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসে। রাগান্বিত বাবা, ফ্যাকাসে মা। ছয়টা তাতামি মাদুর বিছানো সেই স্টুডিয়োতে বসে তারা তাদের পুত্রের সাথে সারারাত কথা বলে। কাতসুরোর বাবা-মায়ের কথা, কলেজ যদি সে ছেড়েই দেয় তবে তাকে এখন বাড়ি ফিরে স্টোরের দেখাশোনা করতে হবে। কাতসুরো রাজি হয় না। সে জানায় এই সিদ্ধান্ত নিলে তাকে আজীবন আফসোস করতে হবে। সফল না হওয়া পর্যন্ত সে টোকিওতেই থাকবে।

সেদিন সকালের প্রথম ট্রেনেই তার বাবা-মা ফিরে যায়। জানালা থেকে কাতসুরো তাদেরকে চলে যেতে দেখছিল। অজান্তেই প্রার্থনায় হাত জোড় করে ফেলে সে।

তিন বছর চলে গেল। এতদিনে কাতসুরো কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে বেরিয়ে যেত। তার বদলে সে এখনও সংগীত নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখনও সারাদিন কেবল অনুশীলন করে যায়। নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, এই আশায় যে কোনো ট্যালেন্ট স্কাউট হুট করে কোনো একদিন তার প্রতিভা আবিষ্কার করে ফেলবে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। এমনকি রেকর্ডিং কোম্পানিদের কাছে ডেমো টেপ পাঠিয়েও কোনো উত্তর পায়নি সে।

সম্প্রতি বারের এক পেট্রন তাকে এক মিউজিক ক্রিটিকের সাথে পরিচয় করায়। সাদা চুলের লোকটাকে কাতসুরো তার দুটো অরিজিনাল গেয়ে শুনিয়েছিল।

এতদিনে কাতসুরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। ভাবছিল এতদিনের অনুশীলনে গায়ক বা সং রাইটার হিসেবে পেশাদার দক্ষতা এসে গেছে তার।

‘এই,’ ক্রিটিক বলেছিল, ‘খারাপ না। মেলোডিটা চমৎকার আর আপনার কণ্ঠ বেশ শক্তিশালী। ভালো করেছেন।’

কাতসুরোর বুক ধক ধক করতে শুরু করে। হয়তো অবশেষে তার আত্মপ্রকাশের সময় এসেছে।

কাতসুরোর হয়ে পেট্রন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনার মনে হয় সে বাজিমাত করতে পারবে?’

কাতসুরো তটস্থ হয়ে যায়। ক্রিটিকের চোখের দিকে তাকাবার সাহস হচ্ছিল না তার।

‘দেখুন, এ শহরে আপনার মতো ভালো গান করে এমন লোকের অভাব নেই। আপনার কণ্ঠে যদি অন্যরকম কিছু থাকতো, অনন্য কিছু, তাহলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু তেমনটা নেই।’

সোজাসাপটা কথার কোনো উত্তর দিলো না কাতসুরো। এসব তার জন্য নতুন কিছু না।

‘গানগুলো?’ পেট্রন জিজ্ঞাসা করে, ‘সেগুলো তো আমার কাছে খুব ভালো লাগল।’

‘শখের গায়ক হিসেবে ভালো। কিন্তু যথেষ্ট নয়।’ ক্রিটিক বিনম্রতার ধার ধারছে না। ‘এমন গান অনেক আছে। এগুলো টাটকা না।’

কাতসুরো প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়ে।

তার মানে আমার কোনো প্রতিভা নেই। আমি কখনও সংগীতকে আমার পেশা বানাতে পারব না। সেই দিন থেকে এই ভয় কাতসুরোর মনে তীব্রভাবে গেঁথে গেল।

সেদিন বিকেলে অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে কাঁধে একটা ডাফেল ও একটা কাপড়ের ব্যাগ চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে কাতসুরো। ব্যাগের ভেতরে একটা স্যুট ছিল যা সে তার বসের কাছ থেকে ধার নিয়েছে। টোকিওতে কবে ফেরা হবে তা সে জানে না। ইচ্ছা করছিল গিটারটা নিয়ে যেতে কিন্তু তার বাবা-মা কী বলবে তা ভেবে আর নিলো না। কেবল ডাফেল ব্যাগে হারমোনিকাটা নিয়ে নিলো।

টোকিও স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠল সে। দিনের এই সময়ে ট্রেনে ভিড় থাকে না, তাই একটা ফোর সিটার একা নিজের জন্য পেয়ে গেল কাতসুরো। আরাম করে পা উঠিয়ে বসে পড়ল। দু’ঘণ্টা লাগবে বাড়ি যেতে। কাতসুরো শুনেছে, অনেকে নাকি প্রতিদিন সেখান থেকে টোকিও কাজের উদ্দেশ্যে আসা-যাওয়া করে। নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয় তাদের। কাতসুরো হলে হয়তো পারত না।

কাতসুরো তার বসের কথা ভাবল। দাদি গত হয়ে যাবার কথা শোনার সাথে সাথেই কাতসুরোকে তৎক্ষণাৎ ছুটি দিয়ে দিয়েছে।

‘এই সুযোগে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে আসতে পারো। সামনে কী করবে সে বিষয়ে।’ তিরস্কারের মতো মনে হয়েছে কথাটা। সংগীত ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে একটা ইঙ্গিত।

জানালা দিয়ে বাইরের চলন্ত দৃশ্য দেখে কাতসুরো ভাবল, আসলেই কী তাই করা উচিত? তারা সবাই কি ঠিকই বলছে? বাসায় গেলে কেউ না কেউ এই প্রসঙ্গ তুলবেই। কাতসুরোর কানে এখনই বাজছে: ‘স্বপ্ন দেখা বাদ দাও। বাড়ি ফিরে এসো; দোকানটা দেখাশুনা করো; কোনো কোম্পানি তোমাকে ভাড়া করবে না।’

কাতসুরো মাথা থেকে এসব হতাশাপূর্ণ চিন্তাভাবনা বের করতে চাইল। ডাফেল খুলে ওয়াকম্যান আর হেডফোন বের করল। এই দুটো জিনিস তার দুনিয়া বদলে দিয়েছে। এখন কাতসুরো যখন যেখানে খুশি গান শুনতে পারে।

চোখ বন্ধ করে গান শুনতে লাগল। ইয়েলো ম্যাজিক অর্কেস্ট্রার গান বাজছে। এই দলের সবাই জাপানিজ। প্রথমবার লস অ্যাঞ্জেলসে যখন এরা টিউবস বাজিয়েছিল তখন নাকি দর্শকরা এত মুগ্ধ হয়েছিল যে হাততালি থামাতে পারেনি।

প্রতিভা থাকা কি একেই বলে? প্রশ্নটার উত্থান হলো তার মস্তিষ্ক থেকে, কিন্তু সেটা অন্তরে কাঁটার মতো বিঁধল।

ট্রেনটা অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছালো। টিকেট লবি থেকে বেরিয়ে সেই চিরচেনা দৃশ্য চোখে পড়ল কাতসুরোর। মেইন স্ট্রিটের দুপাশে ছোটো ছোটো দোকান। এখানে নতুন কাস্টমার খুব একটা পাওয়া যায় না। সবাই রেগুলার। কাতসুরো কলেজে যাবার পর থেকে এখানে আর আসেনি, কিন্তু শহর ঠিক আগের মতোই আছে।

একটা ছোটো স্টোরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। সাইনে লেখা, ‘উমাটসু’। এর পাশেই ছোটো ছোটো করে লেখা ‘ফ্রেশ সি ফুড অ্যান্ড ইভেন্ট কেটারিং’।

দোকানটা তার দাদা কিনেছিল। শুরুর দিকে এটা খুব খোলামেলা জায়গায় ছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় বিল্ডিং আগুনে পুড়ে মাটিতে মিশে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে দাদা আবার দোকানটা চালু করে।

কাতসুরো অর্ধেক বন্ধ শাটারের নিচে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। অন্ধকার। রেফ্রিজারেটেড ডিসপ্লেতে কোনো মাছ নেই। বছরের এই সময়টাতে সি ফুড ফ্রিজে একদিনের বেশি ভালো থাকে না। দেওয়ালে একটা হাতে লেখা ম্যাসেজ: ‘এখন গ্রিল্ড ইল সার্ভ করা হয়’।

মাছের পরিচিত দুর্গন্ধে কাতসুরো একটা ধাক্কা খেল। দোকানের পেছনের দিকে গেল সে। একটা স্টোন স্ল্যাব পার হয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। দরজাটা প্রায় বন্ধ কিন্তু অল্প একটু ফাঁকা দিয়ে ভেতরের আলো দেখা যাচ্ছে। কাতসুরো কাউকে নড়তেও দেখল।

একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে জোরে বলে উঠল, ‘আমি এসে গেছি।’

এটা না বলে হয়তো কেবল ‘হ্যালো’ বললেই ভালো হতো।

দরজা খুলল কালো পোশাক পরিহিতা এমিকো। বেশ বড়ো হয়ে গেছে সে। অনেক আগে তাকে দেখেছিল কাতসুরো।

‘এসে পড়েছো তাহলে। আমি তো ভেবেছি আসবে না।’

‘কেন? আমি বলেছিলাম তো, দেখি কী করতে পারি।’

কাতসুরো জুতা খুলে ছোটো লিভিং রুমটাতে ঢুকে গেল।

‘মা-বাবা কোথায়?

‘তারা সারা বিকেল ফিউরানেল হোমেই ছিল। আমিও গিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতাম কিন্তু থেকে গেছি। ভাবলাম তুমি এসে বাসা খালি পাবে।’

‘ওহ।’

‘সুয়াতে এসব পরে যাবে নাকি?’

কাতসুরো একটা জিন্স আর টিশার্ট পরে এসেছে। ‘অবশ্যই না। এক মিনিট দাঁড়াও। আমি কাপড় বদলে আসছি।’

‘তাড়াতাড়ি, ঠিক আছে?’

‘আচ্ছা,’ কাতসুরো ব্যাগ নিয়ে ওপরে উঠে গেল।

দোতলায় দুটো তাতামি রুম আছে। অপেক্ষাকৃত বড়োটা কাতসুরোর ছিল।

দরজা খুলে কাতসুরো অবাক হয়।

বাতি জ্বেলে দেখে সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। তার পেন্সিল শার্পনারটা এখনও ডেস্কে আর তার পছন্দের পোস্টারগুলো এখনও দেওয়ালে লাগানো। বুকশেলফে গিটারটা বইয়ের সাথে রাখা।

টোকিওতে আসার পর তার মা ফোন করে বলেছিল যে এমিকো এই ঘরটা চাইছে। কাতসুরো বলেছিল তার কিছু আসে যায় না। তখন তার মনে সংগীতের

ভূত চেপে ছিল, ভেবেছিল এখানে আর কখনও ফিরবে না। কিন্তু এই ঘরটা ঠিক আগের মতোই সাজানো। তার মা-বাবা কি তবে তার ফেরার অপেক্ষায় ছিল? মনটা কুঁকড়ে গেল। তাড়াতাড়ি স্যুট পরে নিলো সে।

জুলাই হিসেবে খুব শীত পড়েছে। এমিকো আর কাতসুরো বেরিয়ে পড়ল। সুয়া অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে হচ্ছে। বাসা থেকে সেখানে যেতে মাত্র দশ মিনিট লাগে। পাড়াটা একটু অন্যরকম লাগল। এমিকো বলল অনেক নতুন লোকজন আসছে এখানে।

এই ছোটো শহরটাও তাহলে বদলাচ্ছে, ভাবল কাতসুরো।

‘তো কাতসুরো, কেমন যাচ্ছে সব?’ এমিকো হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল। কাতসুরো জানে এমিকো কীসের কথা বলছে। এড়িয়ে যেতে চাইল প্রশ্নটা, ‘কী কেমন যাচ্ছে?’

‘তুমি বলেছিলে তোমার অনেক বড়ো প্ল্যান আছে। মিউজিকের পেশা খুব চমৎকার হবে। কিন্তু তুমি কি সেটা করতে পারবে?’

‘অবশ্যই। না পারলে তো এতে নামতাম না। তাই না?’ মনে মনে কষ্ট হলো তার। সত্যিটা বলছে না সে।

‘আমি তোমার গান শুনেছি। পারফর্ম করতে দেখেছি। তুমি চমৎকার গান করো। কিন্তু সেটাকে পেশা বানানো, সেটা অন্য মাত্রার জিনিস।’

‘তুমি এসবের কীই বা জানো? কিচ্ছুই না।’

‘ঠিক বলেছো, আমি কিছু জানি না। কিন্তু আমি ব্যাবসা জানি। একারণেই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি। মানে, প্ল্যান কী তোমার? এতটা আত্মবিশ্বাস যেহেতু আছে, তার মানে নিশ্চয়ই কোনো পরিকল্পনা আছে তোমার। ভবিষ্যতের স্পষ্ট কোনো ধারণা। সময়ের কোনো আন্দাজ। কতদিন লাগতে পারে তোমার? আমার তো মনে প্রশ্ন জাগছে তুমি আসলেই কিছু জানো কিনা।’

তার বোনের যুক্তিতে জোর আছে। কিন্তু কাতসুরো হেসে উড়িয়ে দিলো তা।

‘সব যদি পরিকল্পনামতো হতো তবে কাউকে কখনও সংগ্রাম করতে হতো না। যে মহিলা কলেজ পার করেই লোকাল ব্যাংকের চাকরিতে ঢোকার চিন্তাভাবনা করছে তার পক্ষে এসব বোঝা কঠিন।’

এমিকো আগামী বসন্তে স্নাতক শেষ করবে, কিন্তু ইতোমধ্যেই সে একটা চাকরির লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছে। কাতসুরো ভেবেছিল এবার এমিকো রেগে যাবে কিন্তু তার বদলে এমিকো কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘আমাদের বাবা-মায়ের কথা কখনও ভাবো তুমি? তাদের বয়স হয়েছে কাতসুরো।’

চুপ করে রইল কাতসুরো। বাবা-মায়ের বয়স হয়ে গেছে এটা সে ভাবতে চায় না।

‘বাবার গত মাসে আরও একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।’

কাতসুরো থেমে গেল। ‘কী বলছ?’

এমিকো সোজা তার চোখের দিকে তাকালো, ‘তেমন গুরুতর ছিল না। কিন্তু সময়টা খুব খারাপ ছিল। তখন দাদির শরীর প্রচণ্ড খারাপ। আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’

‘আমি জানতাম না এসব।’

‘বাবা চায়নি মা তোমাকে এসব জানাক।‘

বাবা হয়তো ভেবেছে অকৃতজ্ঞ ছেলেকে জানিয়ে কী লাভ। কাতসুরো এই যুক্তির সাথে তর্ক লড়বে না। বাকি পথ এমিকো আর কাতসুরো নিঃশব্দে হেঁটে গেল।

কমিউনিটি সেন্টারটি একটা বিশাল ঐতিহ্যবাহী জাপানিজ বাড়ির আদলে তৈরি। শেষকৃত্যের পোশাকে সজ্জিত নারী-পুরুষ ঢোকার রাস্তায় ভিড় করছে।

কাতসুরো এবং এমিকোর মা, কানাকো, লবিতে দাঁড়িয়ে একটা হালকাপাতলা গড়নের লোকের সাথে কথা বলছিল। কাতসুরো একটু সময় নিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।

মা যখন তাকে দেখল তখন কাতসুরো বলতে চাইছিল, ‘আমি এসে গেছি।’ কিন্তু সাথের লোকটাকে দেখে সে যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল।

লোকটা কাতসুরোর বাবা, তাকিও। সে এতটা শুকিয়ে গেছে যে কাতসুরো প্ৰথম দেখায় চিনতেও পারেনি।

তাকিও কাতসুরোর দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালো। ‘তুমি এখানে? কে বলেছে তোমাকে?’

‘এমিকো।’

‘তাই নাকি?’ তাকিও একবার এমিকোর দিকে তাকিয়ে আবার কাতসুরোর দিকে তাকালো। ‘ভাবিনি এসবের জন্য সময় হবে তোমার।’

কাতসুরো অন্তর্নিহিত কথাটা শুনতে পেল: ‘ভাবিনি বড়ো সাফল্য পাবার আগ পর্যন্ত তোমার চেহারা দেখাবে।’

‘আপনি চাইলে পরের ট্রেনেই টোকিও ফিরে যেতে পারি।’

‘কাতসুরো,’ তার মা একটা সাবধানী কণ্ঠে বলল।

তাকিও হাত নেড়ে বলল, ‘আমি সেটা বলিনি। ঝামেলা করবে না, ঠিক আছে? আজ এসবের সময় নেই।’ হন্তদন্ত হয়ে সেখান থেকে চলে গেল সে।

কানাকো বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না।’

মনে হচ্ছে এমিকোকে কানাকোই ফোন করতে বলেছিল।

‘এমিকো সুযোগ দিলো কোথায়? যাই হোক, বাবা খুব শুকিয়ে গেছে। আবার নাকি হার্ট অ্যাটাক করেছিল? সে ঠিক আছে এখন?’

‘বুঝতে দিতে চায় না। কিন্তু আমি জানি, ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে ফেলছে সে। ষাট পেরিয়ে গেছে।’

তাকিও ছত্রিশ বছর বয়সে কানাকোকে বিয়ে করেছিল। উমাটসু (একধরনের খাবার) বানাতে বানাতে স্ত্রী খোঁজার সময়ই নাকি ছিল না তার হাতে।

ছ’টা বেজে গেল। সুয়ার সময় ঘনিয়ে আসতেই আরও পরিবার-পরিজন দেখা যাচ্ছে। তাকিওর অনেকগুলো ভাই-বোন। তার নিজের বউ-বাচ্চা ছাড়াও পরিবারের আরও বিশজন দেখতে পেল কাতসুরো। প্রায় দশ বছর ধরে কারও সাথে দেখা হয়নি তার।

তাকিওর চেয়ে বয়সে তিন বছরের ছোটো এক চাচা কাতসুরোর দিকে এগিয়ে এসে করমর্দন করল।

‘এই কাতসুরো, কেমন আছো? শুনলাম তুমি নাকি টোকিওতে থাকো। কী করছো আজকাল?’

‘তেমন কিছু না।’

‘তেমন কিছু না। এটা বোলো না যে কেবল মজা করার জন্যেই টোকিও থেকে গেছ তুমি।’

কাতসুরো হুট করে বুঝতে পারল তার বাবা-মা পরিবারের আর কাউকে বলেনি যে সে কলেজ ছেড়ে দিয়েছে। কানাকো কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, শুনছে, কিন্তু কিছু বলছে না।

কাতসুরো অপমান বোধ করল। ছেলে মিউজিশিয়ান হতে চায় এটা কি এতটাই অপমানজনক তাদের কাছে? অথচ এখন সে তার বাবা-মায়ের মতই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। না এটা হতে দেওয়া যায় না।

‘আমি কলেজ ছেড়ে দিয়েছি।’

‘কী?’

‘কলেজ, আমি কলেজ ছেড়ে দিয়েছি।’ কাতসুরো আড়চোখে দেখতে পেল কানাকো নড়ে উঠছে কিন্তু সে বলে গেল, ‘আমি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার চেষ্টা করছি।’

‘মিউজিক?’ চাচা পুরোপুরি ভড়কে গেল। যেন সে শব্দটাই চিনতে পারছে না।

কিন্তু সৌভাগ্যবশত তাদের কথোপকথন সেখানেই শেষ। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। চাচা চলে গিয়ে অন্য কয়েকজন আত্মীয়ের সাথে কথা বলল, হয়তো যা শুনেছে তা ঠিক কিনা যাচাই করছে।

মন্ত্র পড়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। কাতসুরো বাকিদের সাথে ধূপ জ্বালালো। বেদিতে দাদির একটা হাসিমাখা ছবি টানানো হয়েছে। কাতসুরোর স্মৃতিতে দাদি খুব উষ্ণ একটা চরিত্র। ছোটোবেলা দাদি সবসময় তাকে দেখে রাখতেন। এখন বেঁচে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই কাতসুরোর পাশে দাঁড়াতেন।

অনুষ্ঠান শেষে সবাই অন্য রুমে চলে গেল। সুশি আর বিয়ার পরিবেশন করা হলো। দাদির বয়স প্রায় নব্বই বছর হয়ে গিয়েছিল আর সবাই এখন কিছুটা বিমর্ষ অনেক বছর পর সবাই একত্রে। রিসেপশনটা অনেকটা পুনর্মিলনীর মতো হয়ে গেছে।

হুট করে সবার মাঝে একটা কণ্ঠ গর্জে উঠল, ‘যথেষ্ট হয়েছে। আমার বাসায় কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা তোমার দেখার বিষয় না।’ কাতসুরো না দেখেই বুঝে গেল এটা তাকিও।

‘তোমার বাসা? তুমি ওখানে দোকান ওঠাবার আগে ওটা আমাদের বাবার বাড়ি ছিল। হয়তো ভুলে গেছ, আমিও সেখানে থাকতাম।’ সেই চাচা তাকিওর সাথে কথা বলছে। দুজনেই হয়তো বেশি অ্যালকোহল খেয়ে ফেলেছে।

‘বাবার বাসা যুদ্ধের সময়েই পুড়ে গিয়েছিল। এখন যেটা আছে সেটা আমি বানিয়েছি। তোমার আপত্তি করার কোনো কারণ নেই সেখানে।’

‘শোনো কথা। খালি উমাটসু নামের সুখ্যাতির কারণেই তুমি দোকানটা খুলতে পেরেছো। বাবা তোমাকে দোকানটা দিয়ে গেছে বলেই তুমি সেটা যখন তখন বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখো না।’

‘কে বলেছে আমি সেটা বন্ধ করে দেবো? আমি কোথাও যাচ্ছি না।’

‘তুমি চালাতেই বা পারবে কতদিন? নিজেকে দেখো একবার। দোকানে একটা টুনা বয়ে নিয়ে আসবার ক্ষমতাও নেই তোমার। ভাবছিলে-টা কী? একমাত্র ছেলেকে টোকিওতে কলেজে পাঠিয়ে দিয়েছো। মাছের ব্যাবসা করতে কি শিক্ষা লাগে নাকি?’

‘পারিবারিক ব্যাবসার এই মূল্য তোমার কাছে?’

তাকিও উঠে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে হাতাহাতি হয়ে যাবে। কিন্তু বাকিরা থামালো। অবশেষে তাকিও বসল।

‘—গর্দভ বুড়ো।’ চাচা বিড়বিড় করেই যাচ্ছে, ‘ছেলেকে স্কুল ছাড়তে দিলে কেন? গায়ক হতে? যত্তসব!’

‘চুপ থাকো। তোমার পরামর্শের দরকার নেই আমার।’

অবস্থা বেগতিক দেখে কাতসুরোর ফুপুরা চাচাকে অন্য ঘরে নিয়ে গেল।

লোক দুজনের ঝগড়া হয়তো কমে গেছে কিন্তু ঘরের পরিবেশটা আর আন্তরিক নেই। একজন উঠে বলল তার যাবার সময় হয়েছে। এরপর একে একে সবাই প্রস্থান করতে শুরু করল।

‘তোমাদেরকে থাকতে হবে না।’ তাকিও কানাকো আর কাতসুরোকে বলল, ‘ধূপ শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি আছি।’

‘পারবে?’ কানাকো বলল।

‘আমি অসুস্থ না।’

কাতসুরো এমিকো আর কানাকোকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই বলল, ‘তোমরা এগুতে থাকো, আমি আসছি।’

‘কী হয়েছে?’ কানাকো জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু রেখে এসেছো?’

‘না–’

‘বাবার সাথে কথা বলবে?’ এমিকো আন্দাজ করল।

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল কাতসুরো। ‘হ্যাঁ, বলা উচিত।’

‘ওহ, আচ্ছা। আমি আর মা যাচ্ছি তাহলে।’

কানাকো যাবার লক্ষণ দেখালো না, ‘তোমার বাবা তোমার ওপর রেগে নেই কাতসুরো। সে কেবল তোমার ভালো চায়।’

‘তোমার তাই ধারণা?’

‘সে তোমার জন্য নিজের ভাইয়ের সাথেও ঝগড়া করছিল।‘

‘হ্যাঁ —’

চুপ থাকো। তোমার পরামর্শের দরকার নেই আমার। কথাটার মানে এখন বুঝতে পারল কাতসুরো। ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে তাকিও বুঝাতে চেয়েছে তার ছেলে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবার ক্ষমতা রাখে। একারণেই কাতসুরো তার সাথে এখন কথা বলতে চাইছে।

‘তোমার বাবা চায় তুমি তোমার স্বপ্নের দিকে ছোটো। সে তোমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চায় না। কথা বলতে চাও, বলো। কিন্তু যা যা বললাম সেগুলো মাথায় রেখো।’

‘আচ্ছা।’

কাতসুরো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার মা আর বোনকে চলে যেতে দেখল। এরপর উলটো পথে হাঁটতে শুরু করে।

এমনটা আশা করেনি সে। ভেবেছিলো বাবা-মা আর আত্মীয়দের কথা শুনতে হবে। কিন্তু তার বাবা-মা এখন উলটো তার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছর আগে যখন তারা টোকিওতে এসে কাতসুরোকে বুঝিয়ে ফিরে গিয়েছিল তখনকার সাথে এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের চিন্তাভাবনা এতটা কীভাবে বদলে গেল?

কমিউনিটি সেন্টারের কেবল একটা বাতি বাদে বাকি সব বন্ধ। কাতসুরো সেদিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে উঁকি দিলো।

বেদিতে ধূপ জ্বলছে। সামনের একটা চেয়ারে বসে আছে তাকিও।

তার বাবা কী করছে? তাকিও উঠে দেওয়ালের পাশে রাখা একটা ব্যাগের দিকে এগিয়ে গেল। সেখান থেকে সাদা কাপড়ে মোড়া কিছু বের করছে। কাপড় খুললে ভেতরের জিনিসটা আবছা আলোয় চকচক করে উঠল।

একটা চাকু। একটা ঐতিহ্যবাহী চাকু। এই চাকুর গল্প কাতসুরো অসংখ্যবার শুনেছে। উমাটসু শুরু করার প্রথম দিন থেকে তার দাদা এই চাকু ব্যবহার করতেন। তাকিও যখন ব্যাবসাটা সামলে নিতে শুরু করে তখন এই চাকু তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাকিও এই চাকু দিয়েই মাছ কাটা শিখেছিল।

তাকিও ক্যাসকেটে চাদর বিছিয়ে সেখানে চাকুটা রেখে দিলো। তার মায়ের ছবির সামনে হাত জোড় করে প্রার্থনা করতে লাগল। এই দৃশ্য দেখতে কাতসুরোর মন ভেঙে যাচ্ছে। সে জানে তার বাবা দাদিকে কী বলছে।

মাফ চাইছে। বাবার দেওয়া ব্যাবসাটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। পারিবারিক চাকুটা বংশধরের হাতে তুলে দিতে ব্যর্থ হবার জন্য।

কাতসুরো সরে এলো সেখান থেকে। একবারও পেছন দিকে না তাকিয়ে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে গেল সে।

বাবার পরিস্থিতি ভাবতে খুব খারাপ লাগছে কাতসুরোর। নিজেকে প্রচণ্ড দোষী বলে মনে হচ্ছে। তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বাবাকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানানো উচিত।

তার চাচা ঠিক বলেছে। বাবা খুবই অসুস্থ। কে জানে কতদিন সে দোকানটা চালাতে পারবে। কানাকো যদি দায়িত্ব নিয়েও নেয়, তখন তো পাশাপাশি তাকে অসুস্থ স্বামীর দেখভালও করতে হবে। একদিন না একদিন এই দোকান ঠিকই বন্ধ করতে হবে।

তখন?

এমিকো আগামী বসন্ত থেকে ব্যাংকে টেলারের চাকরি করবে, যার মানে সে বাড়িতে থাকতে পারবে। কিন্তু এই বেতনে সে বাবা-মা দুজনকেই চালাতে পারবে না।

কাতসুরোর এখন কী করা উচিত? মিউজিক ছেড়ে দিয়ে উমাটসু সামলানো উচিত?

এটা সবচেয়ে বাস্তবিক সমাধান। কিন্তু এত বছরের সাধনা, সেটার কী হবে? কানাকো বা তাকিও তার স্বপ্নের রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে চায় না।

কাতসুরো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাঁটা থামিয়ে চারপাশে তাকালো সে। সে কোথায় আছে বুঝতে পারছে না। নতুন বাসাগুলোর মাঝে পথ হারিয়ে ফেলেছে।

আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে করতে একটা ঢালু রাস্তা পেল। এবার চিনতে পারছে। ছোটোবেলা অনেক খেলত এখানে। কিছু দূর হাঁটতেই একটা পরিচিত বিল্ডিং চোখে পড়ল তার। ছোট্ট স্টোরে পেন্সিল-কলম এসব বিক্রি হতো। হ্যাঁ এটাই সেই স্টোর। নামিয়া জেনারেল স্টোর।

একজন বয়স্ক লোক চালাতো দোকানটা। পাশাপাশি নানা পরামর্শ দিয়ে বেড়াতো। কাতসুরো তখন খুব সামান্য সামান্য সমস্যা নিয়ে যেত তার কাছে। আজ দৌড়ে প্রথম হবো কী করে? নতুন বছরের সময় আরও টাকা কীভাবে পাবো? যাই হোক, বয়স্ক নামিয়া সবই গুরুত্বের সাথে সমাধান করার চেষ্টা করত। নতুন বছরের কার্ডের খামগুলো স্বচ্ছ রাখবে। তাহলে আত্মীয়রা কম টাকা দিবে না। লোক দেখানোর জন্য হলেও বেশি টাকা দেবে তারা।

সেই বয়স্ক লোকটা কেমন আছে? ময়লা শাটারটা বন্ধ। ভেতরে কোনো আলো নেই। কাতসুরো গ্যারেজের পাশে দিয়ে উঁকি দিলো। এখানে আগে গ্রাফিতি আঁকত তারা। কিন্তু বয়স্ক লোকটা কখনও বকা দিতো না। বলত, ‘দেওয়ালে যদি আঁকতেই হয় তবে সুন্দর কিছু আঁকবে।’

কী এঁকেছিল তার কোনো চিহ্ন আর নেই এখন। দশ বছর হয়ে গেছে। আঁকিঝুকি এতদিনে ধুয়ে মুছে নষ্ট হয়ে গেছে।

হুট করে একটা বাইসাইকেল থামল সেখানে। কাতসুরো পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখল একটা মেয়ে বাইক থেকে নামছে। ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে মেইল স্লটে ঢুকিয়ে দিলো। অজান্তেই কাতসুরো বলে উঠল, ‘কী করলেন?’

যদিও খুব জোরে বলেনি, কিন্তু মেয়েটা ভয় পেয়ে বাইকে উঠে বসল। হয়তো কাতসুরোকে কোনো বদমাশ ভেবেছে।

‘এই, এক মিনিট। আপনি ভুল ভাবছেন। আমি কিছু করছিলাম না।’ কাতসুরো রাস্তায় বেরিয়ে এলো। ‘আমি লুকাচ্ছিলাম না। কেবল দেওয়ালটা দেখছিলাম। ছোটোবেলা এখানে খেলতাম।’

মেয়েটাকে আশ্বস্ত দেখাচ্ছে না। এক পা এখনও প্যাডেলে দেওয়া। চোখে সন্দেহ। লম্বা চুলগুলো উঁচু করে বাঁধা। অল্প মেকাপ করেছে। হয়তো কাতসুরোর বয়েসি, বা ছোটো। শক্তসামর্থ্য গড়নের শরীর। হয়তো কোনো ক্রীড়াবিদ হবে।

‘আপনি আমাকে দেখেছেন, তাই না?’ মেয়েটার কণ্ঠ ভারী।

কাতসুরো বুঝতে পারল না মেয়েটা কী বলতে চাচ্ছে।

‘আমি কী করছিলাম তা আপনি দেখেছেন, তাই না?’

‘মনে হয় আপনি মেইল স্লটে কিছু রেখেছেন—’

মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে অন্য দিকে তাকালো। দয়া করে যা দেখেছেন তা ভুলে যান। আমাকেও।

‘কিন্তু–’

মেয়েটা তাকে বিদায় জানিয়ে প্যাডেলে চাপ দিলো।

‘দাঁড়ান এক মিনিট,’ কাতসুরো তাকে থামালো, ‘খামে ভরে চিঠি দিচ্ছিলেন— আপনি পরামর্শ চাইছিলেন?’

মেয়েটা সাবধানী চোখে দেখল তাকে, ‘কে আপনি?’

‘আমি ছোটোবেলা এই স্টোরে আসতাম। বয়স্ক লোকটার কাছে পরামর্শ চাইতে—’

‘আপনার নাম কী?’

‘অন্য কাউকে নাম জিজ্ঞাসা করার আগে নিজের নাম দেওয়া উচিত না?’

‘দুঃখিত। সেটা সম্ভব না। চিঠিটা পরামর্শ চেয়ে দেইনি, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দিয়েছি।’

‘কৃতজ্ঞতা?’

‘ছয় মাস আগে আমি পরামর্শ চেয়েছিলাম আর উনি খুব ভালো সমাধান দিয়েছেন। তাই তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেছি।’

‘উনি? মানে স্টোরের কাউকে? বয়স্ক লোকটা এখনও থাকে এখানে?’ কাতসুরো বাসাটার দিকে তাকালো।

‘আমি ঠিক জানি না কিন্তু আমি গত বছর একটা চিঠি ফেলেছিলাম। পরদিন এসে দেখি মিল্ক ক্রেটে আমার জন্য একটা চিঠি রাখা।’

উত্তর। হ্যাঁ, সে রকমই তো ছিল। মেইল স্লটে রাতের বেলা চিঠি ফেলে যাও, পরদিন সকালে মিল্ক ক্রেটে সেটার উত্তর দেওয়া থাকবে।

‘কে জানে সে এখনও চিঠি নেয় কিনা।’

‘হ্যাঁ, কে জানে। আমি অনেকদিন আগে পরামর্শ পেয়েছিলাম। জানি না এই চিঠিটা তিনি পাবেন কিনা। কিন্তু আশা করতে দোষ কী।’

মনে হচ্ছে মিস্টার নামিয়া এই মেয়েটাকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা খুব কাজে দিয়েছে।

‘আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন?’ মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি তাড়াতাড়ি বাসায় না ফিরলে আমার পরিবার খুব চিন্তায় পড়ে যাবে।

‘ওহ, হ্যাঁ, স্যরি।’

কাতসুরো সরে দাঁড়ালে মেয়েটা প্যাডেল চেপে দ্রুত চলে গেল। কাতসুরো মনে মনে দশ পর্যন্ত গোনার আগেই দৃষ্টির বাইরে চলে গেল সে।

স্টোরটা একদমই খালি। পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে। চিঠির উত্তর কি ভূতে দিচ্ছে নাকি?

কাতসুরো জোরে শ্বাস ফেলল। কীসব হাবিজাবি! এমনটা হতেই পারে না। নিজের পথে হাঁটতে শুরু করল।

বাসায় ফিরে দেখল এমিকো একা লিভিং রুমে বসে আছে। সে বলেছিল ঘুমোতে সমস্যা হয়, এ কারণেই হয়তো স্নায়ুকে শান্ত করতে সামনের টেবিলে হুইস্কির বোতল আর গ্লাস নিয়ে বসে আছে। মেয়েটা রাতারাতি বড়ো হয়ে গেছে। মা মনে হয় ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।

‘বাবার সাথে কথা বলেছো?’

‘না, যাইনি। হাঁটাহাঁটি করছিলাম একটু।’

‘রাতের এ সময়ে কোথায় গেলে?’

‘আশেপাশেই। ওহ, পুরোনো স্টোরটার কথা মনে আছে? নামিয়া জেনারেল স্টোর?’

‘নামিয়া? হ্যাঁ মনে আছে। ভূতুড়ে জায়গা।’

‘কেউ কি ওখানে থাকে এখনও?’

‘কী?’ এমিকোর কণ্ঠে সন্দেহ। মনে হয় না। তারা তো স্টোর বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি নিশ্চিত ওই জায়গায় কেউ থাকে না।’

‘জানতাম।’

‘কী জানতে? কী হয়েছে?’

‘কিছু না।’

‘এই কাতসুরো, তোমার প্ল্যান কী? পারিবারিক ব্যাবসা ত্যাগ করে দেবে?’

‘ত্যাগ? আমি সেটা করতে চাই না।’

‘তাহলে কী করতে চাও? তুমি দায়িত্ব না নিলে দোকানটা বন্ধ করে দিতে হবে আমাদের। মালিক কে হবে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই কিন্তু বাবা-মায়ের কী হবে? দয়া করে এটা বোলো না যে তুমি তাদেরকেও ত্যাগ করবে।

‘চুপ করো। আমার নিজের প্ল্যান আছে।’

‘কেমন প্ল্যান? আমি শুনতে চাই।’

‘বলছি তো চুপ করো।’

কাতসুরো নিজের ঘরে এসে স্যুট পরেই বিছানায় ঢলে পড়ল। তার মাথায় হাজারো চিন্তা। কিন্তু অ্যালকোহলের কারণে কোনোটাই বোধগম্য হচ্ছে না।

একটু পর সে বিছানা থেকে উঠে ডেস্কে বসল। এখানে নোটবুক আর কলম আছে।

নোটবুকটা খুলে লিখতে শুরু করল,

নামিয়া জেনারেল স্টোরকে…

ফিউনারেলটা নির্বিঘ্নে শেষ হলো। কাল রাতের পর থেকে সবার হাবভাব কিছুটা বদলে গেছে। কাতসুরোর আশেপাশে সবাই একটু অদ্ভুত আচরণ করতে লাগল। তার চাচা আর কাতসুরোর গা ঘেঁষল না।

আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও পাড়ার লোকজন আর উমাটসুর আশেপাশের দোকানগুলোর লোকজনও এসেছে। এসব চেহারা কাতসুরোর চিরপরিচিত। ভীড়ের মাঝে ছোটোবেলার এক ক্লাসমেটকে পেয়ে গেল সে। প্রথমে স্যুটের কারণে চিনতে পারেনি। কিন্তু হুট করেই মনে পড়ে গেল। মিডেল স্কুলে এক ক্লাসে ছিল তারা। ছেলেটার বাবা-মা উমাটসুর পাশেই একটা দোকান চালাতো, সেখানে বাসায় তৈরি খাবার বিক্রি করত।

কাতসুরো ছেলেটার কাহিনি মনে করল। অনেক ছোটোবেলায় ওর বাবা-মারা যায়। এরপর দাদা তাকে খোদাই করতে শেখায়। হাইস্কুলের পর সে সোজা পারিবারিক ব্যাবসায় লেগে যায়। আজ ফিউনারেলে তার উপস্থিতি তার পারিবারিক ব্যাবসার প্রতিনিধিত্ব প্রকাশ করছে।

ছেলেটা মৃতের জন্য একটা ধূপ জ্বালিয়ে কাতসুরো এবং তার পরিবারের দিকে এগিয়ে এলো। নতজানু হয়ে সম্মান প্রদর্শন করল তাদের। এই অঙ্গভঙ্গির কারণে যেন তাকে কাতসুরোর চেয়ে বয়সে অনেক বেশি বড়ো মনে হচ্ছে।

অনুষ্ঠান শেষে দেহটা শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সপ্তম দিনের স্মৃতিচারণের জন্য সবাই কমিউনিটি সেন্টারে যায়। সব শেষে তাকিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই শেষকৃত্যের প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘোষণা করে।

কাতসুরো এবং তার পরিবার বাকি সবাইকে বিদায় জানিয়ে গোছগাছ শুরু করে। অনেক কিছু বয়ে নিয়ে যেতে হবে। শপের ডেলিভারি ভ্যানের পেছনে বেদি আর ফুলগুলো তুলে নিলো। পেছনের সিটে রাখল লাগেজ।

তাকিও ড্রাইভার সিটে উঠে বসল।

‘কাতসুরো, তুমি সামনে বসো।’ কানাকো প্রস্তাব দিলো।

মাথা নাড়লো কাতসুরো, ‘না মা, তোমরা যাও। আমি হেঁটে যাবো।’

কানাকো হতাশ হলো। হয়তো ভাবছে কাতসুরো তার বাবার সাথে যেতে চায় না।

‘রাস্তায় কিছু কাজ আছে আমার। দেরি হবে না।’

‘ওহ্—’

কাতসুরো দেরি না করে বেরিয়ে গেল। এখন কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় না সে।

ঘড়িতে দেখল প্রায় ছ’টা বাজে।

কাল মধ্যরাতে সে একটা বাদামি খাম হাতে নামিয়া জেনারেল স্টোরে গিয়েছিল। চিঠিটায় তার পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে লেখা। নিজেই লিখেছে।

নিজের আসল নাম ছাড়া কোনোকিছুই লুকায়নি। কী করা উচিত তার পরামর্শ চেয়ে এই চিঠি লেখা। সোজা কথায়, তার কী এখন নিজের স্বপ্নের পেছনে ছোটা উচিত নাকি পারিবারিক ব্যাবসায় লেগে যাওয়া উচিত সেটার একটা সঠিক উত্তর চাইছে।

সত্যি বলতে পরদিন সকালে উঠে এসব ভেবে লজ্জা পেয়েছিল। ওই স্টোরে এখনও কেউ থাকা অসম্ভব। মেয়েটা নিশ্চয়ই পাগল ছিল। আর সত্যিই পাগল হয়ে থাকলে কাতসুরো একটা ভুল করে ফেলেছে। সে এখন চায় না এই চিঠি কেউ পড়ুক।

আবার এমনও হতে পারে, মেয়েটা ঠিক বলছে। এসবই সত্যি। হয়তো সে নিজের প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবে। যাতে করে জীবনটা সঠিক দিকে পরিচালিত হবে তার।

অনিশ্চয়তা ও প্রত্যাশা নিয়ে কাতসুরো পাহাড় বেয়ে পুরোনো স্টোরটার দিকে এগিয়ে চলল। আগে স্টোরের দেওয়ালের রং ক্রিমি ছিল। এখন সেটা ময়লা ধূসরে রূপ নিয়েছে, এই ব্যাপারটা গত রাতে অন্ধকার থাকায় সে খেয়াল করেনি।

স্টোর ও গ্যারেজের মাঝে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে, এটাই পেছনে যাবার একমাত্র রাস্তা মনে হলো।

দেওয়ালের ময়লা সাবধানে এড়িয়ে কাতসুরো পেছন দিকে চলে গেল। পেছনের দরজার পাশেই একটা কাঠের মিল্ক ক্রেট। কাতসুরো অস্বস্তি নিয়ে বাক্সটা খোলার জন্য হাত বাড়ালো। খুব শক্ত এটা। কিন্তু একটু জোর দিতেই খুলে গেল।

ভেতরে একটা বাদামি খাম। সেটায় কালো কালিতে লেখা, প্রিয় সংগ্রামী শিল্পী। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল কাতসুরোর। এখানে কেউ আছে তাহলে। কাতসুরো বাসাটার দিকে তাকিয়ে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছু শোনা গেল না।

হয়তো এখানে কেউ থাকে না, কিন্তু রাতে এসে মেইল স্লট চেক করে যায়। কিন্তু এত ঝামেলা কেন পোহাচ্ছে?

প্রশ্নগুলো উপেক্ষা করে খামটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে চলে এলো কাতসুরো নামিয়া জেনারেল স্টোরের মালিকের হয়তো ব্যক্তিগত কোনো কারণ আছে এসব করার। আপাতত এই চিঠিটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো নির্ভেজাল জায়গায় খুলতে হবে এটা।

একটা ছোটো পার্ক খুঁজে পেল সে। কেউ নেই ওখানে। একটা বেঞ্চে বসে বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে খামটা খুলল। ভেতরে একটাই কাগজ। বুক ধক-ধক করছে তার। পড়তে শুরু করল চিঠিটা।

প্রিয় সংগ্রামী শিল্পী,

এই নির্লজ্জ অভিযোগটি আমাকে জানাবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। নির্লজ্জই তো, তাই না? পারিবারিক ব্যাবসার উত্তরাধিকারী হতে নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে। আগে থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত একটা দোকানের ভারটা নিয়ে নিতে পারবেন, কোনোরূপ সংগ্রাম করা ছাড়াই।

কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি। আপনি কি জানেন এ জগতে কত মানুষ একটা চাকরির জন্য মরিয়া হয়ে ছুটছে?

উত্তরটা যদি না হয়ে থাকে তার মানে আপনি খুব চমৎকার একটা পৃথিবীতে থাকেন।

কিন্তু ত্রিশ বছর পর পৃথিবীটা এমন থাকবে না। খুব কঠিন হয়ে যাবে। একটা চাকরি তখন আশীর্বাদের মতো মনে হবে। এমন দিন আসবে যখন কলেজ গ্র্যাজুয়েটরাও চাকরি পাবে না। বাজি ধরে বলতে পারি এমন দিন আসছে।

আর নিজেকে দেখুন। কলেজ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি ভাগ্যবান যে আপনার বাবা-মা আপনার কলেজের সব খরচ নিয়ে আপনাকে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু আপনি সেসবে জল ঢেলে দিলেন।

সব সংগীতের জন্য। আপনি বলছেন সংগীতের জন্য আপনি আপনার পারিবারিক ব্যাবসাও ছেড়ে দিতে পারেন। একা চলার সাহস রাখেন, সঙ্গে গিটার বাদে আর কিছু দরকার নেই। দেখুন পরামর্শ দিয়ে কোনো লাভ হবে না জানি। আপনি যা করতে চান আপনি তাই করবেন। আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখা লোকগুলোকে মাঝেমধ্যে বাস্তবতায় মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। কিন্তু আমি যেহেতু বিনামূল্যে পরামর্শ দিয়ে থাকি সুতরাং আপনাকেও একটা পরামর্শ দিতে হবে।

আমার আসল পরামর্শ কী জানেন? গিটার ফেলে মাছ কাটতে নামুন। আপনার বাবা খুব অসুস্থ। এখন এমন খাপছাড়া স্বপ্ন দেখার সময় না। সংগীতকে আপনি কখনই পেশা বানাতে পারবেন না। একমাত্র মিউজিক জিনিয়াসরাই সেটা পারে। যাদের মাঝে অনন্য কিছু আছে। যেটা আপনার ক্ষেত্রে নেই। আকাশকুসুম স্বপ্ন থেকে জেগে উঠুন।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

রাগে কাতসুরোর হাত কাঁপছে।

সংগীত ছেড়ে ব্যাবসায় নামা—এটাই তো বাস্তবিক সমাধান। কিন্তু তাই বলে এমন দুর্ব্যবহার করবে? সত্যি বলতে কাতসুরো এখন অপমানিত বোধ করছে।

পরামর্শ চাওয়াটাই ঠিক হয়নি তার। চিঠিটা দুমড়েমুচড়ে পকেটে রেখে দিলো। সামনে কোনো ডাস্টবিন পেলে ফেলে দিবে।

কিন্তু যাবার পথে কোনো ডাস্টবিন পেল না। বাসায় ফিরে দেখল তারা বাবা-মা আর ছোটো বোন পারিবারিক বড়ো বেদির সামনে আনুষ্ঠানিক বেদিটা স্থাপন করছে।

‘কোথায় ছিলে?’ কানাকো জিজ্ঞাসা করল, ‘কত সময় পেরিয়ে গেল।’

‘হ্যাঁ—’ কাতসুরো আর কিছু না বলে ওপরে চলে এলো।

জামাকাপড় বদলে চিঠিটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। ফেলে দিয়েই তৎক্ষণাৎ তুলে আরও একবার পড়ল। আরও একবার হতাশ হলো।

সে জানে এসব নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই কিন্তু ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারল না। চিঠির প্রেরক তাকে ভুল বুঝেছে। ভাবছে দোকানটা কোনো বিশাল ব্যাবসা আর কাতসুরো কোনো ধনীর ঘরের দুলাল।

চিঠিতে লিখেছে জেগে উঠুন, কিন্তু কাতসুরো তো বাস্তবিকতার মুখোমুখিই দাঁড়িয়ে আছে। একারণেই সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাকে। চিঠির প্রেরক সেই জিনিসটা বুঝতে পারছে না।

কাতসুরো লিখতে বসে গেল।

নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,

চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আমি খুব অবাক হয়েছি। ভেবেছিলাম কোনো উত্তর পাবো না। যাই হোক, আপনার উত্তরে আমি বেশ আশাক্ষুণ্ণ হয়েছি। সত্যি বলতে আপনি আমার সমস্যাটা বিন্দুমাত্রও বুঝতে পারেননি। পারিবারিক ব্যাবসায় নেমে যাওয়াই যে সবচেয়ে সহজ সমাধান সেটা আমি জানি।

কিন্তু এর মানে এই না যে ভবিষ্যতের জন্যও এই সমাধানটা ভালো হবে।

আপনার ধারণা ভুল, আমাদের দোকানটা আহামরি কিছু না। একঘেয়ে এক গলির একটা পুরোনো দোকান। এটা আমাদের জন্য খুব সৌভাগ্য বয়ে আনছে এমন কিছু না। কোনোমতে দিন চলে যায়। একারণেই এই সমাধানটা বিতর্কিত। আমি অন্য ভালো কোনো পথেও তো যেতে পারি। আমার বাবা-মা এখন আমার পক্ষে আছেন। এখন যদি আমি আমার স্বপ্ন ছুঁড়ে ফেলে দেই তাহলে তারা মনঃক্ষুণ্ণ হবেন।

আরও একটা জিনিস আপনি ভুল বুঝছেন। আমি সংগীতকে আমার পেশা হিসেবে বেছে নিতে চাই, শখ হিসেবে না। আমি নিজে গান লিখছি ও গাইছি। আপনার মনে হচ্ছে আমি মজা করে বেড়াই। শখের বশে গিটার নিয়ে ঘুরি। একারণে আমাকে ‘সংগ্রামী শিল্পী’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন। আমি আপনার ভুলটা ভাঙাতে চাই: সংগীতকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চাই আমি, কেবল স্বপ্ন হিসেবে নয়।

আমি জানি সংগীতে সফল হতে গেলে অনন্য প্রতিভা লাগে। কিন্তু আপনি কীভাবে বলতে পারেন যে আমার মাঝে কোনো প্রতিভা নেই? দয়া করে এমন কোনো ধারণা পোষণ করবেন না।

আপনার উত্তরের আশায় রইলাম।

—সংগ্রামী শিল্পী

‘টোকিওতে কবে ফিরছো?’

ফিউনারেলের পরদিন কাতসুরো দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। মাথায় ব্যান্ডান্না (রুমাল আকৃতির পট্টিবিশেষ) পেঁচানো তার বাবা এইমাত্র দোকান থেকে বেরিয়ে তাকে প্রশ্নটা করল।

উমাটসু এইদিন খোলা ছিল। নিজের রুমের জানালা থেকে কাতসুরো দেখছিল সকালবেলা, যখন তাকিও মার্কেটের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল।

‘এখনও জানি না,’ কাতসুরো বিড়বিড় করে উত্তর দিলো।

‘এখানে থাকতে আর আপত্তি নেই তোমার? তারকা গৌরব কি এতই সহজ যে কাজ-টাজ ফেলে বাড়িতে বসে থাকা যায়?’

‘কে বলেছে ছেড়ে দিয়েছি? আমি সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি।’

‘কীসের চিন্তাভাবনা?’

‘তা জেনে আপনি কী করবেন?’

‘তিন বছর আগে এই আগুন জ্বালিয়েছো তুমি। এখন থামতে পারবে না। এমনভাবে এগিয়ে যেতে হবে যেন জীবন-মরণ নির্ভর করছে এর ওপর।’

‘হ্যাঁ, আমি জানি। মনে করাতে হবে না আমাকে।’ কাতসুরো চপস্টিক রেখে উঠে দাঁড়ালো। রান্নাঘর থেকে এসব দেখে কানাকো খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছে।

সেই রাতে কাতসুরো হাঁটতে বের হয়। নিঃসন্দেহে, সে জেনারেল স্টোরের দিকে যাচ্ছে। কাল রাতে মেইল স্লটে চিঠিটা রেখে গিয়েছিল সে।

মিল্ক ক্রেট খুলতেই বাদামি খাম পেল সে। কে; নিশ্চয়ই প্রতি রাতে আসে এখানে।

সেই পার্কে গিয়ে খামটা খুলে পড়তে শুরু করল কাতসুরো…

প্রিয় সংগ্রামী শিল্পী,

ছোটো হোক বা বড়ো, ব্যাবসা ব্যাবসাই। এই মাছের দোকানের কারণেই আপনার বাবা-মা আপনাকে কলেজে পড়তে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্যাবসায় যদি মন্দা হয়ে থাকে তাহলে সেটাকে টেনে তোলা কি উত্তরাধিকারী হিসেবে আপনার দায়িত্ব নয়?

আপনি বলেছেন আপনার বাবা-মা আপনার পক্ষে। যে-কোনো বাবা-মা-ই তাদের সন্তানের পক্ষে থাকে, যতক্ষণ তারা আইনবিরোধী কিছু না করতে চায়। তাদের উদারতার সুযোগ নেওয়া উচিত না।

আমি আপনাকে সংগীত ছেড়ে দিতে বলব না। এটা চমৎকার, কিন্তু কেবল শখ হিসেবে।

সত্যি বলতে এর বেশি প্রতিভা নেই আপনার। আমি আপনার গান না শুনেই এটা বলতে পারি। আপনি তিন বছর ধরে বিফলে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাই না? এটাই প্রমাণ

যারা বড়ো কিছু করতে পেরেছে তাদের দেখুন। খুব বেশি সময় লাগেনি আবিষ্কৃত হতে। অনন্য লোকেরা মানুষের নজরে পড়ে যায়-ই। আপনি কারও নজরে পড়েননি। এটা মেনে নিন।

শিল্পী সম্বোধনটা আপনার পছন্দ হচ্ছে না। হয়তো আপনার চিন্তা-ভাবনা সেকেলে। যাই হোক, মাছের দোকানটাই বেছে নিন। এতে আপনারই ভালো।

–নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

কাতসুরো ঠোঁট কামড়ে ধরল। এই উত্তরটাও বিদ্বেষপূর্ণ। বিষণ্ণ লাগছে তার।

কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এবার কাতসুরোর রাগ লাগল না। সোজাসাপটা কথা শুনতে বরং হালকাই লাগছে।

আরও একবার চিঠি পড়ল সে।

কিছু অংশের সাথে একমত না হয়ে পারল না সে। খুব রূঢ় কথা, কিন্তু বাস্তব অনন্য যে-কোনো কিছু মানুষের নজর এড়ায় না। কাতসুরো জানত এসব, কিন্তু মানতে চাইত না। ভেবেছিল ভাগ্য একসময় না একসময় তার সহায় হবে। কিন্তু প্রতিভা না থাকলে ভাগ্যও সাথে থাকবে না।

এত সোজাভাবে এই কথাগুলো কেউ তাকে এর আগে বলেনি। তোমার রাস্তাটা খুব কঠিন—এ পর্যন্তই বলেছে। আসলে কেউ তাদের কথার দায়ভার নিতে চায়নি। এই চিঠি যে লিখেছে সে এমন না। সে মোটেও ভণিতার ধার ধারেনি।

কিন্তু—এটা কে?

যেই হোক আসল কথা বলতে জানে। মানুষ অন্যভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কোমলভাবে বলে। এই চিঠি সেসবের সম্পূর্ণ বিপরীত।

কাতসুরো নিশ্চিত এই চিঠি বুড়ো নামিয়া লিখতে পারে না। সে খুব কোমল লোক।

কাতসুরো এই প্রেরকের সাথে দেখা করতে চায়। অনেক কিছুই চিঠিতে বলা সম্ভব হয় না, সামনাসামনি দেখা হলে বলা যেতে পারে।

সে রাতে কাতসুরো তার তৃতীয় চিঠি পোস্ট করল। অনেক ভেবে চিন্তে সে নিচের সার-সংক্ষেপে পৌঁছালো।

.

নামিয়া জেনারেল স্টোরকে,

দ্বিতীয় চিঠির জন্য ধন্যবাদ।

সত্যি বলতে আমি এতটা কঠোর সমালোচনা আশা করিনি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কিছুটা হলেও প্রতিভা রাখি। ভেবেছিলাম সেটাই যথেষ্ট হবে এবং একদিন আমি সফল হবো।

কিন্তু আপনার সোজাসাপটা উত্তর আমার চোখ খুলে দিয়েছে।

আমি স্বপ্নের পেছনে দৌঁড়াতে গিয়ে এতটাই মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম যে বুঝতেই পারিনি, কখন এক কদম পিছিয়ে আসতে হয়। কখন থামতে হয়।

আমি বলতে লজ্জিত কিন্তু আমি এখনও সব কিছু ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নই। আমি যদি পারি তো আর একটু এগিয়ে দেখতে চাই।

আমি অবশেষে আমার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছি।

আমি লম্বা সময় ধরে জেনে এসেছি আমার কী করা উচিত। কিন্তু স্বপ্ন ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে খুব কষ্ট হয় আমার। এটা যেন প্রতিদান-হীন ভালোবাসা। জানি, প্রতিদানে কিছুই পাবো না কিন্তু হৃদয়হরণকারীকে ছেড়েও দিতে পারি না।

চিঠিতে সব কিছু সঠিকভাবে বুঝানো যায় না। কোনোদিন সামনাসামনি দেখা হলে খুব ভালো হতো। বুঝিয়ে বলতে পারতাম। এবং আপনার সাথে দেখাও হতো।

কীভাবে দেখা করা যায় আমাকে জানাবেন দয়া করে।

—সংগ্রামী শিল্পী

.

নামিয়া জেনারেল স্টোরটা সন্ধ্যার আবছা আলোয় নিস্তব্ধ। কাতসুরো শাটারের কাছে গিয়ে একটু ইতস্তত করল। তবুও মেইল স্লটে চিঠিটা অর্ধেক ঢুকালো।

হয়তো এই শাটারের পেছনে কেউ আছে।

এমনটা হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই সে কাতসুরো চলে যাবার পর শাটার খুলে মেইল স্লট থেকে চিঠি নেবে। অপেক্ষা করে দেখা যাক।

ঘড়িতে দেখল এগারোটার বেশি বাজে।

কাতসুরো পকেট থেকে হারমোনিকা বের করল। মেইল স্লটের সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো নিশ্বাস নিয়ে বাজাতে শুরু করল। সে চাইছে ভেতরে যেই থেকে থাকুক না কেন, সে যেন তার সংগীত শুনতে পায়।

তার লেখা গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর গান ‘রিবর্ন’ বাজাতে শুরু করল সে। এখনও গানের কথা যুক্ত করেনি। মঞ্চে উঠলে কেবল হারমোনিকা দিয়েই এর সুর বাজায় সে। খুব চমৎকার এক মেলোডি।

কিছুক্ষণ বাজানোর পর কাতসুরো থেমে গেল। কেউ বেরিয়ে মেইল স্লট থেকে চিঠি নেয়নি। তার মানে এখানে কেউ নেই। হয়তো সকালে এসে নিয়ে যাবে।

কাতসুরো এগিয়ে এসে খামটা মেইল স্লটে পুরোপুরি ঢুকিয়ে দিলো। এটি টুপ করে স্লটের ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।

‘কা-ট-সু-রো, ঘুম থেকে ওঠো!’

কেউ তাকে ঝাঁকাচ্ছে। চোখ মেলে কানাকোর ফ্যাকাসে চেহারা দেখতে পেল কাতসুরো।

‘কী হয়েছে?’ ঘড়িতে দেখল সাতটা বাজে।

‘খুব খারাপ কিছু হয়েছে। তোমার বাবা মাছের বাজারে অজ্ঞান হয়ে গেছেন।’

‘কী,’ লাফিয়ে উঠলো কাতসুরো, ‘কখন?’

‘এখনই। সেখানকার লোকজন ফোন করেছে। হাসপাতালে নিয়ে গেছে তাকে।’

কাতসুরো ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে জিন্স পরতে শুরু করল।

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এমিকো আর কানাকোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। যাবার আগে দোকানের শাটারে লিখে গেল: অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাবশত আমরা আজ দোকান বন্ধ রাখছি।

একটা ট্যাক্সি করে হাসপাতালে চলে গেল তারা। সেখানে একজন মধ্যবয়স্ক লোক অপেক্ষা করছিল। কানাকোর সাথে লোকটার পরিচয় আছে।

‘সে কিছু বাক্স উঠাচ্ছিল আর হুট করেই তার ব্যথা উঠল,’ লোকটা বলল, ‘আমরা সাথে সাথেই অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছি— ‘

‘আচ্ছা, আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটাবার জন্য আমরা দুঃখিত এবং আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। এখান থেকে আমরা সামলে নিতে পারব,’ কানাকো লোকটাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় করল।

তাকিওর চিকিৎসা হয়ে গেছে। ডাক্তার পরিবারের সাথে কথা বলতে চাইল।

‘তার ওপর কাজের খুব চাপ পড়ে গেছে। একারণে তার হৃৎপিণ্ডে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সে কি ইদানিং খুব দুশ্চিন্তা করে?’ ডাক্তার সাদা চুলের এবং সুদর্শন চেহারার একজন ভদ্রলোক। তার কণ্ঠ বেশ নরম।

কানাকো তাকে জানালো কিছুদিন আগেই তাকিওর মা মারা গেছেন।

‘তার খুব কঠিন সময় যাচ্ছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সে বিপর্যস্ত। তাকে আরও সাবধান হতে হবে। আমি উপদেশ দেবো তাকে নিয়মিত স্ক্রিনিং করার।’

‘আমরা সেদিকে খেয়াল রাখব,’ কানাকো বলল।

তাকিওর সাথে দেখা করতে গেল তারা। ইমার্জেন্সি রুমে রোগীদের বিছানায় শুয়ে আছে তাকিও। বাকিদেরকে দেখে একটু তেতোভাবে তাকালো।

‘একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’ সাহসী ভাব ধরছে ঠিকই কিন্তু তেজটা আর আগের মতো নেই।

‘আমি তোমাকে বলেছিলাম এত দ্রুত দোকানটা খুলবার দরকার নেই। আর কিছুদিন বিশ্রাম করে নিতে পারতে।’

তাকিও কানাকোর দিকে বিরক্ত হয়ে তাকালো, ‘তোমার মনে হয় আমাদের সেই সামর্থ্য আছে? আমি ঠিক আছি। একদিনের জন্যও যদি দোকান বন্ধ রাখি তাহলে সেদিনের কাস্টমাররা যাবে কোথায়? ভালো মাছের জন্য অনেক লোকই আমার ওপর নির্ভর করে।’

‘কিন্তু অতিরিক্ত কাজ তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।’

‘আমি অতিরিক্ত কাজ করিনি। আমি ঠিক আছি।’

‘বোকার মতো কথা বলবেন না তো বাবা,’ কাতসুরো বলল, ‘আরও একদিন যদি দোকান বন্ধ না রাখা যায় তাহলে সেদিন আমি দোকানের দেখাশোনা করব।’

বাকি তিনজন অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।

‘কী বলছো তুমি?’ নিস্তব্ধতা ভাঙল তাকিও। ‘তুমি মাছ পরিষ্কারও করতে জানো না।’

‘এটা সত্যি না। মনে আছে স্কুলে থাকতে আপনাকে সাহায্য করতাম?’

‘সেটা ব্যাবসা চালানোর জন্য যথেষ্ট না।’

‘হ্যাঁ কিন্তু—’ তাকিও হাত তুলে কাতসুরোকে থামিয়ে দিলো।

‘তোমার মিউজিকের কী হবে?’

‘আমি ভাবছিলাম সেটা ছেড়ে দিবো–’

‘কী বললে? আমার ছেলে তার সমস্যা থেকে পালিয়ে বেড়াবে না। তাহলে সে আমার ছেলেই না।’

‘ব্যাপারটা তেমন না। আমি ভাবছিলাম দোকান সামলানোটা সেসবের চেয়ে বেশি ভালো হবে।’

তাকিও রেগে উঠল, ‘তিন বছর আগে তুমি খুব বড়ো বড়ো কথা বলেছ। আর আজ এই পর্যায়ে নেমে আসতে পারবে না। শুনে রাখো, আমি তোমাকে দোকানের ভার দেবো না।’

কাতসুরো তার বাবার কথা বিশ্বাস করতে পারল না।

‘তাকিও,’ কানাকো সাবধান করতে চাইল তাকে।

‘তুমি মন থেকে এই ব্যাবসায় জড়াতে চাইলে সেটা অন্য ব্যাপার ছিল। কিন্তু আমি জানি ব্যাপারটা তেমন নয়। করুণাবশত দোকানের ভার নিতে এলে তুমি সেটা ঠিকভাবে করতে পারবে না। আমার কথা মিলিয়ে নিও। কয়েক বছর পর মিউজিক

কেন ছাড়লে তার জন্য আফসোস করতে হবে।’

‘এটা সত্যি না।’

‘এটাই সত্যি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তখন তুমি বাহানা দেবে, আমার বুড়ো বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, আমার আর কোনো উপায় ছিল না, পরিবারের জন্য শিল্প বিসর্জন দিতে হয়েছিল। আমাকে তুমি কোনো দায়ভার দেবে না। তখন এটা অন্য কারও দোষ বলে মনে করবে।’

‘তাকিও এভাবে কেন

‘তুমি এর মাঝে কিছু বলতে আসবে না। এই ছেলে, তুমি বলো। আমার কথা ভুল প্রমাণিত করতে পারবে?’

কাতসুরো জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিওর দিকে তাকাল, ‘নিজের পরিবারের জন্য চিন্তা করা কি খুব খারাপ কিছু?

‘যখন নিজে বড়ো কিছু অর্জন করতে পারবে তখন এসব বলতে পারবে। কিন্তু তুমি করেছো-টা কী? মিউজিক দিয়ে এমন কী অর্জন করতে পেরেছো? কিছুই না। যে স্বপ্নের কারণে তুমি নিজের বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো তা থেকে বড়ো কোনো অর্জন প্রত্যাশা করি আমরা। শূন্য হাতে আসবে আর আমি তোমাকে আমার ব্যাবসা সঁপে দেবো ভেবেছো? ভাবছ এটা কেবল একটা মাছের দোকান? এটা ভেবে আমাকে অপমানিত করবে না।’

চিৎকার করার পর তাকিওর চেহারা ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। বুক চেপে ধরল সে।

‘তাকিও,’ চেঁচিয়ে উঠলো কানাকো, ‘এমিকো ডাক্তার ডাকো।’

‘থামো, কিছু হয়নি। কাতসুরো, আমার কথা শুনো।’ শুয়ে শুয়ে তাকিও কাতসুরোকে বলল, ‘আমি বা আমার দোকান কোনোটাই এতটা অসহায় অবস্থায় নেই যে তোমাকে সাহায্যের জন্য ছুটে আসতে হবে। নায়ক না সেজে টোকিওতে ফিরে যাও। যোদ্ধা হও। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করো। হেরে যাওয়া যুদ্ধেও লড়াই করতে হয়। নিজের অস্তিত্ব তৈরি করো। সেটা না করা পর্যন্ত ফিরবে না। বুঝতে পেরেছো?’

কাতসুরো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

তাকিও আবার জিজ্ঞাসা করল তাকে, ‘বুঝতে পারছ?’

‘হ্যাঁ,’ খুব আস্তে বলল কাতসুরো।

‘আমাকে কথা দাও।’

কাতসুরো মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

হাসপাতাল থেকে ফিরে কাতসুরো দ্রুত তার জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলল। শুধু টোকিও থেকে নিয়ে আসা জিনিসপত্র না, একই সাথে পুরো ঘরটাই পরিষ্কার করতে লাগল। বসন্তের সময় যেমন সব কিছু গোছগাছ করা হয় তেমন।

‘ডেস্ক আর বিছানাটা সরিয়ে ফেলো।’ কানাকোকে দুপুরের খাবারের সময় বলল সে, ‘বুককেসটা আর লাগবে না। সেটাও ফেলে দিতে পারো। আমি এই ঘরটা আর ব্যবহার করছি না।’

‘আমি করি?’ তৎক্ষণাৎ বলল এমিকো।

‘করো। আমার কিছু যায় আসে না।’

‘বাহ,’ এমিকো খুশি হয়ে হাততালি দিলো।

‘কাতসুরো, তোমার বাবার কথা মনে ধরে রেখো না। তুমি যখন খুশি তখন বাসায় ফিরতে পারবে।’

কিন্তু কাতসুরো তার মায়ের ভালোবাসা অনুভব করে হেসে ফেলল, ‘তুমি তার কথা শুনেছো। আমি কথা দিয়েছি তাকে।’

‘আমি জানি, কিন্তু—’ কানাকো আর কিছু বলতে পারল না।

ঘর পরিষ্কার করতে করতে সারাদিন লেগে গেল। সন্ধ্যায় কানাকো হাসপাতালে গিয়ে তাকিওকে বাসায় নিয়ে এলো। সকালের তুলনায় এখন তাকে খুব ভালো দেখাচ্ছে।

সুকিয়াকি পট দিয়ে রাতের ভোজ সারল তারা। এমিকো বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে গিয়েছিল আর তাকিও বিয়ার খাবার জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগল। কয়েকদিনের জন্য ধূমপান এবং মদ পান করা বারণ তার। ফিউনারেলের পর থেকে এই প্ৰথম নিজের পরিবারের সাথে একটু ভালো সময় কাটালো কাতসুরো।

খাবার শেষে কাতসুরো টোকিও ফেরার জন্য তৈরি হলো। কানাকো তাকে আরও একদিন থাকার প্রস্তাব দিলো কিন্তু তাকিও তাকে বাধা দিলো। বলল কাতসুরো যা করতে চায় তাকে তা-ই করতে দিতে।

‘আচ্ছা, আসছি আমি।’ হাতে ব্যাগ নিয়ে বাবা-মা আর বোনকে বিদায় জানালো কাতসুরো।

‘ভালো থেকো,’ কানাকো বলল। তাকিও চুপ।

স্টেশনে যাবার সময় একবার শেষবারের মতো নামিয়া জেনারেল স্টোরে গেল কাতসুরো। হয়তো শেষবারের মতো কোনো উত্তর থাকবে মিল্ক ক্রেটে।

এবং একটা বাদামি খাম তার জন্যই সেখানে অপেক্ষা করছিল। সে খামটা পকেটে নিয়ে নিলো। পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে তাকাল সে। গম্ভীর এক অবস্থা যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে।

ট্রেনে উঠে চিঠিটা পড়তে লাগল সে।

.

প্রিয় সংগ্রামী সংগীতশিল্পী,

আপনার তৃতীয় চিঠি পড়েছি।

বিস্তারিত বলতে পারব না, কিন্তু সামনাসামনি দেখা করা সম্ভব না। সম্ভব হলেও, সেটা উচিত না। আমাকে দেখে আপনি খুব আশাহত হবেন। তাই এটা এই পর্যন্তই থাকুক।

তো, আপনি অবশেষে সংগীত ছেড়ে দিতে চাইছেন।

কিন্তু আমার মনে হয় আপনি আবারও এর কাছেই ফিরে আসবেন। হয়তো এই চিঠি যতক্ষণে আপনার কাছে পৌঁছাবে ততক্ষণে আপনার মন আবারও বদলে গেছে। আপনাকে হতাশ করতে চাই না কিন্তু আমি আসলে জানি না যে আপনার মত পরিবর্তনটা কী আসলে ভালো সিদ্ধান্ত নাকি খারাপ। কিন্তু একটা জিনিস বলতে পারি।

সংগীতে আপনার প্রচেষ্টা বৃথা যাবে না।

আপনার সংগীত কারও জীবন বাঁচাবে। আপনার লেখা গানগুলো আজীবন বেঁচে থাকবে।

জিজ্ঞাসা করবেন না আমি এসব কীভাবে জানি। আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি সত্যি বলছি।

শেষ পর্যন্ত একে আঁকড়ে ধরে রাখবেন। একদম শেষ পর্যন্ত। এটুকুই বলার ছিল।

কাতসুরো ঘাড় চুলকালো।

—নামিয়া জেনারেল স্টোর

.

এইসব কী? নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল সে। এই চিঠি খুবই বিনয়ী ভাষায় লেখা। বাকি চিঠিগুলোর মতো রুক্ষ না।

অবাক করার বিষয় এই চিঠিতে কাতসুরোকে আরও একবার চেষ্টা করার পরামর্শ দিচ্ছে। হয়তো মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলার তার এই অন্তর্দৃষ্টির কারণেই তার এমন নাম হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত একে আঁকড়ে ধরে রাখবেন। একদম শেষ পর্যন্ত।

এর মানে কী?

হয়তো কোনো একদিন তার স্বপ্ন সত্যি হবে। কিন্তু এতটা নিশ্চিতভাবে কীভাবে

বলতে পারছে?

কাতসুরো চিঠিটা ব্যাগে রেখে দিলো। হার-জিত যাই হোক না কেন, কাতসুরো এখন লড়াই করতে প্রস্তুত।

কাতসুরো একটা নীল জ্যাকেটেড সিডি দোকানের সামনে থামল। সিডির ওপরে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘রিবর্ন’, পাশে সংগীতশিল্পীর নাম: কাতসুরো মাটসুকা।

অবশেষে সে পেরেছে। পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। বিশাল এক রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।

নতুন পাওয়া সাহস আর উদ্যম নিয়ে টোকিওতে ফিরে, কাতসুরো মনে প্রাণে সংগীতের আরাধনা শুরু করে। সে সমস্ত কনটেস্টে অংশগ্রহণ করতে লাগল, অডিশন দিতে লাগল এবং মিউজিক কোম্পানিতে আবার রেকর্ডিং পাঠাতে লাগল। এর মাঝে যখনই সম্ভব রাস্তায় অসংখ্যবার সংগীত বাজালো সে।

কিন্তু সেই মহান সাফল্য কখনও এলোই না।

সময় খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল। আর কাতসুরো খুব শীঘ্রই আবারও পথভ্রষ্ট

হয়ে যেতে লাগল।

তখনই একজন তাকে একটা অনাথাশ্রমে চ্যারিটি কনসার্টে গাইবার অনুরোধ জানালো। নির্লিপ্তভাবেই রাজি হয়েছিল সে।

যখন গাইতে মঞ্চে উঠল তখন বুঝতে পারলো তার দর্শক হচ্ছে কেবল বিশটা বাচ্চা। কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেও সংগীত করল সে। দর্শকরাও তার মতই বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

এরপর একটা বাচ্চা হাততালি দিয়ে সুরের তালে তালে দুলতে ও তাল মেলাতে শুরু করে। এরপর বাকিরাও একই পথ অনুসরণ করে। দ্রুতই কাতসুরো সহজ হয়ে এলো। মজাই লাগছিল। সংগীত করে এমন নির্মল আনন্দ সে অনেকদিন পায়নি।

এরপর থেকে সে পুরো জাপান ঘুরে ঘুরে নানা অনাথাশ্রমে গান গাইতে শুরু করে। সে এক হাজারের বেশি বাচ্চাদের গান সংগ্রহ করে এবং এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড়ো সাফল্য।

কিন্তু তাই কী? তাহলে তার হাতের সিডিটা কীসের? এটা অবশ্যই কোনো বড়ো সাফল্যের ফলাফল। এর এটা তার সবচেয়ে প্রিয় গান।

‘রিবর্ন’-এর প্রারম্ভের সুরটা গুনগুন করতে শুরু করল কিন্তু অদ্ভুত কোনো কারণে গানের কথাগুলো মনে করতে পারল না। নিজের লেখা গানের কথা মনে করতে পারল না! এটা কীভাবে হলো? কাতসুরো সিডি কেস খুলে ভেতরে গানের কথা খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আঙুল দিয়ে বুকলেটটা ওল্টাতে পারছে না সে। শপের ভেতর থেকে ধুম ধুম শব্দ আসছে। এটা কেমন ধরনের মিউজিক?

কাতসুরো চোখ মেলল। সে বুঝতে পারছে না যে সে কোথায় আছে। অপরিচিত ছাদ, দেওয়াল এবং জানালার পর্দা। শেষমেশ মনে হলো তার: সে মারুমিতসুয়েনের একটা ঘরে আছে।

একটা বেলের কর্কশ শব্দ বাজছে। চিৎকার করছে কেউ, ‘আগুন! শান্ত থাকুন সবাই!’

কাতসুরো লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠল। ব্যাগটা নিয়ে জ্যাকেট ও জুতো পরল। ভাগ্য ভালো জামাকাপড় ছেড়ে ঘুমায়নি। গিটারটা কোথায়? থাকুক। এখন সময় নেই।

দরজা খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। পুরো হলভরতি ধোঁয়া।

রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরা এক স্টাফ তাকে ইশারায় বলল, ‘এদিক দিয়ে বের হতে হবে। এদিকে আসুন।’

কাতসুরো তার পিছু পিছু দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামল।

কিন্তু নিচতলার সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে হুট করে থেমে গেল সে। সেরি হলওয়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।

‘চলো, এখান থেকে বের হতে হবে,’ কাতসুরো তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করল।

সেরির চোখ রক্তবর্ণ। গালগুলো চোখের জলে ভেজা। ‘আমার ভাই- তাতসুয়ুকিকে খুঁজে পাচ্ছি না আমি।’

‘কী? কোথায় সে?’

‘আমি জানি না। হয়তো ছাদে। ঘুমুতে না পারলে ওখানে চলে যায় ও।’

‘ছাদে–’ একমুহূর্ত ভেবেই বিদ্যুৎগতিতে ছুটল সে, ‘এগুলো নিয়ে বের হয়ে যাও।’

‘কী?’

দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল কাতসুরো।

কয়েক মিনিটেই ভারী ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তার। চোখে পানি চলে আসছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না এবং শ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এমনকি আগুনের শিখাও চোখে পড়ছে না। কী পুড়ছে? কোথায় পুড়ছে?

এগিয়ে যাওয়াটা বিপজ্জনক। চলে যাওয়া উচিত? ভাবতেই একটা বাচ্চার কান্নার শুনতে পেল কাতসুরো।

‘এই! কোথায় তুমি?’

চিৎকার করতেই তার মুখ দিয়ে ধোঁয়া ঢুকে গেল। কাশতে কাশতে এগিয়ে গেল কাতসুরো। ধোঁয়াটা একটু কাটতেই নড়াচড়ার শব্দ এলো। সিঁড়ির গোড়ায় একটা ছোটো বাচ্চা গুটিসুটি মেরে বসে কাঁদছে। নিশ্চয়ই সেরির ভাই।

কাতসুরো কোনোমতে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে তাকে কাঁধে তুলে নিলো। সিঁড়ি দিয়ে যেই না নামতে শুরু করল অমনি ছাদের একটা অংশ বিকট শব্দ করে ধ্বসে পড়ল তাদের ওপর। এরপর কেবল আগুন। অগ্নিশিখার সাগর।

বাচ্চাটা কেঁদে উঠল। কাতসুরো এখন ভয় পাচ্ছে।

কিন্তু থেমে থাকা যাবে না। নিচে নামাই এখন বাঁচার একমাত্র পথ।

বাচ্চাটাকে জাপটে ধরে আগুনের মাঝে দিয়েই দৌড়ে চলল কাতসুরো। পায়ের নিচে কী আছে তা বুঝতে পারল না, কোথায় যাচ্ছে তাও বুঝতে পারল না। তার আশেপাশে কেবল আগুনের লেলিহান শিখা। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সারা শরীর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

অবশেষে একটা লাল বাতির সামনে এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু উত্তর দেওয়ার শক্তি নেই তার। নড়তেও পারছে না। চেতনা হারাতে শুরু করল। গভীর ঘুমে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে।

একটা চিঠির কিছু বাক্য দেখতে পেল চোখের সামনে।

সংগীতে আপনার প্রচেষ্টা বৃথা যাবে না।

আপনার সংগীত কারও জীবন বাঁচাবে। আপনার লেখা গানগুলো আজীবন বেঁচে থাকবে।

জিজ্ঞাসা করবেন না আমি এসব কীভাবে জানি। আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি সত্যি বলছি।

শেষ পর্যন্ত একে আঁকড়ে ধরে রাখবেন। একদম শেষ পর্যন্ত।

এটুকুই বলার ছিল।

এখন দেখো, সে শেষের খুব কাছে। সমাপ্তির সন্নিকটে। শেষ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে, একদম শেষ পর্যন্ত।

হয়তো এখানেই আমি আমার ছাপ ফেলে যাবো, বাবা। হেরে যাওয়া যুদ্ধটা মূল্যবান ছিল।

১০

এখন পর্যন্ত অঙ্গনটা উল্লাসে মুখরিত। পরিকল্পনামতো, তিনটা গানই এতক্ষণ দর্শকদেরকে মাতিয়ে রেখেছিল।

কিন্তু এখন শেষ গানটার ব্যাপারটা অন্যরকম। মেয়েটার আন্তরিক ভক্তরা জানে এখন কোন গান হতে যাচ্ছে এবং এই গানটির উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে। মেয়েটা মাইক্রোফোনের সামনে যখন দাঁড়ালো, তখন দশ হাজার দর্শকের তীব্র উল্লাস ধ্বনিতে কেঁপে উঠল কনসার্টের অঙ্গন।

‘এটা আমার শেষ গান। যে গান দিয়েই আমি সবসময় সমাপ্তি টানি।’

মেয়েটা একটা জিনিয়াস। এই প্রজন্মের অনন্য এক রত্ন।

‘এই গানের কারণেই আমি শিল্পী হতে পেরেছি কিন্তু এর তাৎপর্য আরও গভীর। এই গানের লেখক আমার একমাত্র আপনজন, আমার ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজে আত্মহুতি দিয়েছিল। তার সাথে কখনও দেখা না হলে আজ আমি এখানে থাকতে পারতাম না। একারণে আমি আজীবন এই গান গেয়ে যাবো। এর এভাবেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাবো। সবাইকে ধন্যবাদ।’

‘রিবর্ন’-এর সুর বেজে উঠল প্রাঙ্গণ জুড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *