অক্টোবর রেইন – ৫৫

৫৫

সকালের ঘর থেকে বের হয়ে ফাহাদ নিচে নেমে আসল। গ্যারেজে এসে গাড়ি স্টার্ট দিল সে। তার ভেতরে একটা ঘোর কাজ করছে। মনে হচ্ছে যে করেই হোক সত্যটা তাকে জানতেই হবে। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। যদিও আকাশ মেঘলা। বিকেলবেলাতেই নেমে এসেছে সন্ধ্যের অন্ধকার। রাস্তার লাইট জ্বলে গেছে। ছুটির দিন হওয়াতে ট্রাফিক কম রাস্তায়। কিছুক্ষণের মাঝেই পৌঁছে গেলো সে গন্তব্যে। 

নাবিলার ফ্ল্যাটে সে কদাচিৎ এসেছে। এতগুলো লোক একসাথে গাদাগাদি করে থাকে। দেখলেই কেমন অস্বস্তি লাগে তার। নাবিলার রুমমেট পূজার জন্মদিনের দাওয়াত পেয়েছিল গত সপ্তাহে। আসেনি। অফিসের কাজের বাহানা দিয়ে নাকচ করে দিয়েছিল। 

আজকেও দরজা খুললো পূজা। ফাহাদকে দেখামাত্র একটু কেমন মলিন হয়ে গেলো তার মুখ। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, 

—‘কেয়সা হো? সাব ঠিক হ্যা?’ 

ফাহাদ ইংরেজিতে বলল, 

—‘নাবিলা কোথায়?’ 

—‘রুম মে হ্যা। তুম আন্দার আ যাও।’ 

ফাহাদ ভেতরে ঢুকে সোজা চলে গেলো নাবিলার ঘরে। ওটা মেয়েদের ঘর। নাবিলা ছাড়াও আরো দুটি ভারতীয় মেয়ে সেই শোবার ঘর শেয়ার করে। অপরিচিত একজন পুরুষ সেই অন্দরমহলে না বলে কয়ে ঢুকে পড়াটা একেবারেই সমীচীন দেখায় না। ফাহাদের তখন বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে। তার মাথা কাজ করছে না। সে বুনো মোষের মতো চোখ কান বন্ধ করে ঢুকে পড়ল ঘরটায়। দরজা খুলেই দেখলো নাবিলা বসে আছে পড়ার টেবিলের চেয়ারে। ওর ঠিক সামনেই বসে আছে একটি ভারতীয় ছেলে। নাম জুবায়ের। এই অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। ফাহাদের সাথে চেনাজানা আছে। নাবিলা ফাহাদকে দেখে ভীষণ চমকে উঠল। একটা আতঙ্কের ছাপ ছড়িয়ে পড়ল তার চোখেমুখে। বসা থেকে উঠে পড়ে বলল, 

—‘তুমি এখানে কী করছো?’ 

ফাহাদ হিম শীতল গলায় বলল, ‘তোমার সাথে আমার কথা আছে। নিচে নেমে এসো।’ 

নাবিলা অপ্রস্তুত ভাবে একবার তাকালো জুবায়েরের দিকে। জুবায়ের শক্ত গলায় ইংরেজিতে বলল, ‘ও কোথাও যাবে না। যা বলার এখানেই বল।’ 

ফাহাদের মুখে একটা হিংস্রতা নেমে আসলো। সে চিৎকার করে উঠে বলল, ‘তুমি কে আমাদের মাঝখানে কথা বলার?’ 

উত্তরটা নাবিলা দিল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ও আমার বয়ফ্রেন্ড।’ 

ফাহাদ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। তার চেহারায় আক্রোশের রেখা মুছে গিয়ে ভেসে উঠল এক প্রবল বাঁধভাঙা বিস্ময়। কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো চোখ। 

মিনিট গড়ালো। ফাহাদ স্বগতোক্তির মতো শব্দটা আওড়ালো একবার ‘বয়ফ্রেন্ড!’ 

মাথা নেড়ে নিজের মনে কী যেন ভাবলো। রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘নিচে এসো একবার। দুই মিনিট কথা বলেই চলে যাচ্ছি।’ 

নাবিলা জুবায়েরকে বলল, ‘থাকো। আমি আসছি।’ 

 ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে চুপচাপ নিচে নামলো ওরা। কেউ কোনো কথা বলছিল না। ফাহাদ শুধু ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলে যাচ্ছিল। মুখে কোনো রা নেই। নাবিলা ভয়ে ভয়ে দেখছিল ফাহাদকে। তার মনের ভেতরকার ক্রুদ্ধ ভাবটা মুখচ্ছবিতে ভেসে উঠছে। 

নিচে নেমে ফাহাদ সোজা অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে চলে আসলো। নাবিলা পেছন থেকে একবার বলল, ‘কোথায় যাচ্ছো? যা বলার এখানেই বল!’ 

ফাহাদ নাবিলার কথায় ভ্রুক্ষেপ মাত্র করলো না। গাড়ির কাছাকাছি এসে দরজা খুলে দিয়ে হুকুমের স্বরে বলল, ‘গেট ইন দ্যা কার। 

নাবিলা গাঁইগুঁই করে উঠে বলল, ‘না, এমন তো কথা ছিল না!’

ফাহাদ কোনো কথা না বলে নাবিলার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে এক ধাক্কায় গাড়ির ভেতরে ফেলে দিলো। নাবিলা আতনাদ করে উঠল। ফাহাদ কিছুই না শোনার ভান করে গাড়ির দরজা দিলো আটকে। তারপর ড্রাইভিং সিটে এসে বসে এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে গাড়ি স্টার্ট দিলো। নাবিলা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘কোথায় যাচ্ছো তুমি? এটা তুমি করতে পারো না। জোর করে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারো না।’ 

ফাহাদ নাবিলার দিকে ঘুরে তাকিয়ে কুপিত গলায় বলল, ‘বয়ফ্রেন্ড, না?’ 

নাবিলা ঢোঁক গিললো। ফাহাদের ওই আগুন আগুন চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। সে কোনো রকমে বলল, 

—‘হোয়াটেভার।’ 

ফাহাদ মুখে কিছু বলল না। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো। একশতে উঠল গতি। 

নাবিলা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছো?’ 

—‘কিডন্যাপ করছি তোমাকে।’ 

কথাটা শুনে নাবিলা থমকে গেলো। 

—‘কিডন্যাপ?’ 

—‘হুম কিডন্যাপ। তোমার নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাধ মেটাচ্ছি। দাড়াও।’

—‘পাগলামো করো না ফাহাদ।’

—‘চুপ থাকো।’ 

—‘আমি নাইন ওয়ান ওয়ানে কল করছি।’ 

—‘যা ইচ্ছে কর।’ 

.

নাবিলার অ্যাপার্টমেন্টে এসে দেখা গেল নাবিলা নেই। পূজা বলল ফাহাদ এসেছিলো ঘণ্টা খানেক আগে। এসেই নাবিলাকে ডেকে নিয়ে গেছে এবং তারপর থেকে দুজনেই লাপাত্তা। 

ওরা আর নাবিলার অ্যাপার্টমেন্টে দাড়ালো না। নিচে নেমে পার্কিং লটে এসে আরশান ডায়াল করলো ফাহাদের নম্বরে। ফোন রিসিভ করতে খুব একটা দেরি করলো না ফাহাদ। 

—‘হেই ব্রো!’ 

—‘ফাহাদ তুমি কোথায়?’ 

—‘ড্রাইভ করছি।’ 

—‘নাবিলা তোমার সাথে আছে?’ 

—‘হ্যাঁ আছে। কেন? কিছু হয়েছে? 

—‘কিছু হয়নি। আমরা এসেছিলাম নাবিলার অ্যাপার্টমেন্টে। তো ওকে না পেয়ে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’ 

—‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমরা ঠিক আছি।’ 

—‘শিওর?’ 

—‘মোর দ্যান শিওর।’ 

আরশান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ফোন কেটে সকালকে বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই। ওরা একসাথেই আছে।’ 

সকালের কপাল থেকে চিন্তার রেখাটি তবুও সরল না। সে ভার ভার গলায় বলল, ‘ঝগড়া টগড়া করছেনা তো আবার?’ 

—‘মনে হয় না। ফাহাদকে তো কুল মনে হলো।’ 

—‘নাবিলা হঠাৎ এরকম আচরণ করা শুরু করলো কেন কিছু বুঝলাম না।’

—‘আপনার ফ্রেন্ড, আপনিই ভালো বলতে পারবেন।’ 

—‘ওর সাথে আমার এ ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি।’ 

আরশান একটু গম্ভীর গলায় বলল, ‘এ কারণেই আমি রিলেশনশিপ জিনিসটাকে হেইট করি। আমার কাছে কী মনে হয় জানেন? মনে হয় প্রতিটা সম্পর্কই গড়ে ওঠে একটা সময় ভেঙে যাবার জন্য। এ পৃথিবীতে প্রত্যেক প্রাণীর যেমন মৃত্যু আছে, তেমনি প্রতিটি সম্পর্কেরও মৃত্যু আছে।’ 

কথাটা শুনে সকালের মনটা একটু খারাপ হলো। মুখে কিছু বলল না। আরশান ওর চেহারার পরিবর্তনটা ধরতে পেরে বলল, 

—‘আপনার কী হলো?’ 

—‘কিছু না। চলুন ফিরে যাই।’ 

—‘অন্য কোথাও যাবেন?’ 

—‘কোথায়?’ 

—‘আপনিই বলুন।’ 

সকাল একটু চিন্তা করলো খানিকক্ষণ। বলল, ‘ঠিক আছে সেই জায়গাটায় নিয়ে চলুন। যেখানে আপনি শক্ত লোহার মতো মুখ বানিয়ে আমাকে বলেছিলেন আমি আপনাকে বিয়ে করবো!’ 

আরশান বাঁকা হাসলো, ‘ও শ্যানেনডোয়া?’ 

—‘হ্যাঁ শ্যানেনডোয়া।’ 

—‘আজ সকালেই তো গেলেন সেখানে। ঠিক আছে চলুন। এখন গেলে সানসেট দেখতে পাবেন।’ 

৫৬

—‘আবারো বলছি আমি নাইন ওয়ান ওয়ানে কল করব। পুল ওভার দ্যা কার। রাইট নাও।’ 

—‘তোমার সাথে ফোন আছে?’ 

নাবিলার সাথে ফোন নেই। বের হওয়ার সময় ফোন সাথে নিতে ভুলে গেছে। ফাহাদের প্রশ্নের পাশ কাটানো উত্তর দিলো সে, 

—‘তুমি গাড়ি না থামালে আমি এক্ষুনি চিৎকার চেঁচামেচি করে লোকজন জড়ো করবো। জেল হয়ে যাবে তোমার ফাহাদ!” 

ফাহাদ জ্বালা ধরা হাসি হাসলো, ‘চেষ্টা করে দেখো।’ 

—‘যাচ্ছো কোথায়?’ 

—‘বললাম তো তোমাকে কিডন্যাপ করেছি। বেশি কথা বললে হাত মুখ বেঁধে দেব। তখন উচিত শিক্ষা হবে।’

—‘ইউ ক্যান্ট ডু দিস টু মি। তোমার কোনো রাইট নাই।’

—‘আমাকে ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয় করেছিলে কেন?’ 

—‘আমার ইচ্ছে হয়েছিল তাই। 

—‘মানুষের মন নিয়ে খেলা করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?’ 

এ প্রশ্নটা নাবিলার মুখে জ্বলতে থাকা আগুনের ওপর জলের মতো গিয়ে পড়ল। আগুনটা দপ করে নিভল। 

মুখ ফিরিয়ে নিলো সে জানালার বাইরে। 

চলার পথ দেখে ঠাওর করতে পারছে গন্তব্য কোথায়। গাড়ি চলেছে ফিলাডেলফিয়ার সেই বাড়ির দিকে। একদিন যেখানে নাবিলা নিজের ইচ্ছেয় যেচে গিয়েছিল ফাহাদের সাথে। 

মাথার ভেতরটা কেমন যেন বোবা হয়ে আছে। আজ দুপুরে ফাহাদের মায়ের ফোন পাবার পর থেকে তার চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে। সে পরিষ্কারভাবে কিছুই ভাবতে পারছে না। বুকটা ভার। 

ফাহাদের মা যখন ফোন করলেন ওরা তখন গাড়িতে। শেনানডোয়া থেকে ফিরছে। সামনের সিটে ফাহাদ, আরশান। আর পেছনে ওরা দুই বান্ধবী। ফোনটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ করলো নাবিলা। ফাহাদের মা স্পষ্ট গলায় বললেন, 

—‘শোনো মেয়ে তোমাকে কয়েকটা কথা বলব। তুমি চুপচাপ শুনে যাবে। দয়া করে আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও। এরপর আর কখনো যদি তোমাকে ফাহাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখি তো তোমার বাবা মায়ের কাছে কমপ্লেইন করব।’ 

৫৭

পশ্চিম আকাশে আগুন লেগেছে। আর একটু বাদেই ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা টুপ করে ব্লুরিজ মাউন্টেইনের পেছনে লুকিয়ে পড়বে। পর্বত মালার মাথায় এখন সেই ডুবন্ত সূর্যের হরেক রঙের লীলাখেলা। বেগুনি, গোলাপি আর নীল মেঘের ডানায় ডানায় ধীরে ধীরে ভর করছে বাদামি রঙের এক মন কেমন করা সন্ধ্যা। আকাশটাকে এখন রূপকথার রাজ্য বলে ভ্রম হচ্ছে। 

ওরা বসে ছিল রাস্তার ধারের পাথুরে প্রাচীরের ওপর। পাশাপাশি। ওপাড়ের পাহাড় থেকে ধোঁয়াটে মেঘ উড়ে আসছিল এ পাড়ের পাহাড়ে। ছুঁয়ে দিচ্ছিল ওদের, নিরুদ্দেশ ভেসে বেড়াচ্ছিল প্রাচীর ঘেরা সড়কের ওপর। 

অবাধ্য হাওয়া সকালের চুল নিয়ে খেলছিল। সকাল হাত দিয়ে চুলের গোছা সামলাতে সামলাতে বলল, 

—‘আপনি যে বললেন সব সম্পর্কের মৃত্যু থাকে। এর মানে তো এই দাড়ায় যে আপনার আমার সম্পর্কও আজীবনের জন্য নয়। তাই না?’ 

—‘আপনার কী মনে হয়? আপনি আজীবন থাকতে পারবেন আমার সাথে?’ 

—‘আপনি পারবেন না?’ 

—‘আমি আগে প্রশ্ন করেছি।’ 

সকাল নিশ্বাস নিলো, সময় নিয়ে। বলল, ‘আমি যাকে ভালোবাসবো, তার সাথেই বুড়ো হব।’ 

—‘আপনি কাকে ভালোবাসবেন?’ 

—‘সেটা সময়ই বলে দেবে।’ 

—‘আমাকে ভালোবাসবেন?’ 

—‘নাহ, আপনাকে কেন?’ 

আরশান চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আপনি বিয়ে করবেন আমাকে আর ভালোবাসবেন অন্য লোককে?’ 

—‘হতে পারে!’ 

—‘দিস ইজ নট ফেয়ার।’ 

সকাল মুখ টিপে হাসে, বলে, ‘বলা যায় না হয়তো আপনাকেও ভালোবেসে ফেলতে পারি। হু নোজ!’ 

একটু থেমে সকাল হঠাৎ ভারি আহ্লাদের গলায় বলল, ‘এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। বিয়ের পরে আমরা ছুটির দিনের বিকেলগুলোতে এখানে এসে বসে থাকবো, কেমন?’ 

আরশান হাসলো, বলল, ‘বেশ তো। আর কী কী করা হবে বিয়ের পর?’ 

দেখা গেলো সকালের এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলার অপরিসীম আগ্রহ। সে খুশিতে ঝুমঝুম হয়ে আরশানের দিকে ঘুরে, দেয়ালের ওপর দুই পা তুলে আয়েশ করে বসলো, বলল, ‘আমি খুব মন দিয়ে সংসার করবো। প্রথম কিছুদিন চাকরি-বাকরি কিছুই করবো না। প্রতিদিন নিয়ম করে রান্না করবো।’

—‘কী কী রান্না করতে পারেন আপনি?’ 

—‘ভাত, ডাল, মাছ, মাংস সব!’ 

—‘ঝাল দিয়ে?’ 

—‘হ্যাঁ ঝাল দিয়ে।’ 

আরশান মুখ গোঁজ করে বলল, ‘ওসব তো আমি খাই না! আর ভাত খাওয়া বন্ধ করেন। এতো ভাত খেতে হয় না।’ 

সকাল ভারি অবাক গলায় বলল, ‘ভাত ছাড়া খাবো কী?’ 

—‘ভাত ছাড়া আরো অনেক পুষ্টিকর খাবার আছে দুনিয়ায়। রোজ রোজ ভাত খেলে মোটা হয়ে যাবেন।’ 

সকাল ঠোঁট উল্টে বলল, ‘মোটা হলে সমস্যা কী? মোটা বউ আপনার সহ্য হবে না?’ 

—‘না সহ্য হবে না।’ 

—‘আমি কিন্তু এখনো একটু মোটার দিকে।’

আরশান কথাটা শুনে সকালকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিল। বলল, 

—‘এখন যেমন আছেন তাতে চলবে।’ 

—‘চলবে?’ 

—‘হুম চলবে। তবে আপনি চাইলেই আরো ফিট হতে পারেন। এক্সারসাইজ করেন?’

—‘না।’ 

—‘বলেন কী? অসুখ করবে তো! 

—‘ইয়োগা করি মাঝে মাঝে।’ 

—‘এটা কোনো কথা হল? ওয়ার্কআউট করা শুরু করেন। আর এসব ভাত টাত খাওয়া ছাড়েন।’ 

—‘আপনি কি একেবারেই ভাত খান না? 

—‘খাই মাঝে মাঝে। বেশিরভাগ সময় সেদ্ধ সবজি, স্যালাড, সাথে মাছ, মুরগী কিংবা বিফ। এছাড়া পাস্তা, স্যান্ডউইচ…’ 

—‘ধ্যাৎ এসব কি মানুষ খায় নাকি? আচ্ছা শুনুন, বিয়ের পর কি আমরা আপনার ওই পাতালঘরেই থাকছি?’ 

আরশান শ্রাগ করে বলল, ‘অন্য কোনো উপায় তো নেই আপাতত! কেন আপনার কি আমার বাসাটা খুব বেশি অপছন্দ?’ 

—‘না অপছন্দ নয়, তবে বেজমেন্টে আমার একটু কেমন ভয় ভয় লাগে।’ 

—‘কিসের ভয়?’ 

—‘সব ভূতের সিনেমাগুলোতে ভূত থাকে বেজমেন্টে। জানেন না?’ 

আরশান হো হো করে ডাকাতের মতো হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘অতো চিন্তার কিছু নেই। রাতের বেলা ঘুমোনোর সময় আমি আপনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখবো আমার বুকের সাথে। আপনার আর ভয় লাগবে না।’ 

সকালের ফর্সা গালদুটো এই কথা শুনে লালচে হয়ে উঠল 1 

—‘কী সব কথা!’ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিন মিন করে কথাটা বলে সে প্রসঙ্গ পাল্টে আবার বলল, 

— ‘আমার কিছু শপিং বাকি আছে বুঝলেন। এই চকলেট টকলেট এসব হাবিজাবি।’ 

আরশান একটু কেমন নিভে গেল কথাটা শুনে। ততক্ষণে পাহাড়ের পেছনে লুকিয়ে পড়েছেন সূর্যদেব। বিস্তৃত আকাশে সদ্য ডোবা সূর্যের শেষ লালিমা টুকু ছড়িয়ে আছে আলতার মতো। 

—‘কী হলো?’ সকালের প্রশ্ন। 

—‘আপনি চলে যাবেন?’ 

সকাল নরম গলায় বলল, ‘যেতে তো হবেই।’ 

—‘কেন যাবেন? কোথাও যেতে না দেবার জন্যেই তো বিয়ের ব্যবস্থা করলাম।’ কেমন ছেলেমানুষের গলায় বলল আরশান কথাগুলো। সকাল হাসলো খুব। বলল, 

—‘আপনি একদম বাচ্চা আরশান। বিয়ে কি মুখের কথা? এখনো আমার বাবা মায়ের কাছে তো প্রস্তাব দেয়া হয়নি। আপনি আমার বাবার কাছে আমার হাত চাইবেন না?’ 

—‘আশ্চর্য! কতবার প্রস্তাব দিতে হবে? প্রথমে আপনাকে প্রস্তাব দিলাম। এরপর নিজের বাবাকে প্রস্তাব দিলাম এখন আবার বলছেন আপনার বাবার কাছে প্রস্তাব দিতে হবে? মানে কী এসবের? আপনি বোঝেন প্রপোজ করাটা কত কষ্টের কাজ?’ 

সকাল হাসে, ‘খুব কষ্টের বুঝি?’ 

—‘হ্যাঁ খুবই কষ্টের।’ 

—‘কিন্তু এই কষ্টের কাজটা যে আপনাকে করতেই হবে! আর আমাকেও দেশে যেতেই হবে। কারণ, বিয়েটা হবে দেশে।’ 

আরশান ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘দেশে কেন?’ 

—‘কারণ, বিয়ে হয় মেয়েদের বাড়িতে, আর আমার বাড়ি বাংলাদেশ।’

আরশান বসা থেকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল, ‘তাহলে প্ল্যানটা কী? আপনি এক সপ্তাহ পর দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তারপর?’ 

—‘আমি কি জানি। বাবা মা যা ডিসিশন নেবেন তাই হবে।’ 

—‘না না আপনি বলুন বিয়েটা কবে হলে ভালো হয়?’ 

—‘আমি জানি না।’ সকাল উঠে দাড়ালো। 

কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। যার যার নিজস্ব ভাবনায় ডুবে রইল। আরশান একটা সময় লালিমা ঢাকা দিন শেষের আশ্চর্য আকাশটার দিকে তাকিয়ে থেকে মন্থর ভাবে বলল, ‘আমাকে ফেলে যেতে আপনার কষ্ট হবে না?’ 

বুকের মধ্যে মেঘ ডেকে উঠল শব্দ করে। সকাল বাদামি আলোর ভেতর দিয়ে আরশানের চোখে চেয়ে বলল, ‘আপনার কষ্ট হবে?’ 

—‘না গেলে হয় না?’ 

—‘থেকে যাওয়ার কোনো কারণ আছে কি?’ 

—‘আপনি কোনো প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে পারেন না?’

—‘না।’ 

—‘কেন?’ 

—‘আপনার কাছ থেকেই শেখা।’ 

—‘এই মুহূর্তে আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? 

—‘কী মনে হচ্ছে?’ 

—‘মনে হচ্ছে আপনাকে ছাড়া এতদিন আমি ছিলাম কী করে?’ 

সকাল চোখ নামিয়ে নিলো নিচে। তার চোখ ভিজে আসছিল। বুকটা ভারি উথাল পাতাল! সে পোষা বেড়ালের মতো গুটি গুটি পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসলো আরশানের কাছে। ওর প্রশ্বস্ত বুকে মাথা রাখল পরম নির্ভরতায়। সন্ধ্যার হাওয়ায় তখন হিমের গন্ধ ভাসছে। পাতা উড়ছে এলোমেলো। ধোঁয়াটে মেঘের ঝাঁক জাপটে ধরেছে ওদের। ক্রমে একটা নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে ফেলছে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডকে। 

৫৮

ওরা যখন ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে পৌঁছুলো তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে। নাবিলা গাঁট হয়ে বসে ছিল। সে নড়বেনা, নামবেও না গাড়ি থেকে। ফাহাদ গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করলো তাকে। 

পিটার নেই। চাবি দিয়ে সদর দরজা খুললো ফাহাদ। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ওদের গৃহপ্রবেশ হলো। নাবিলা ফাহাদের হাতের মুঠোয় খাঁচা বন্দি পাখির মতো ছটফট করছিলো। বাড়ির ভেতরের বাতি জ্বালালো ফাহাদ। নাবিলাকে ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো ভেতরে। এরপর একটা কথাও না বলে আবার বেরিয়ে পড়ল বাসা থেকে। নাবিলার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কী করছে এই বেহেড ছেলেটা? তাকে এই ভুতুড়ে বাড়িতে একলা ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে? পাগল নাকি? 

নাবিলা দৌড়ে ছুটে আসলো ফাহাদের পেছন পেছন। ফাহাদ ততক্ষণে গাড়িতে উঠে গেছে। গাড়ির কাচের জানালায় ধাক্কা দিতে দিতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো নাবিলা, আকুতি করলো, মিনতি করলো। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই। গাড়িটা সাই করে নাবিলাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। নাবিলা দাঁড়িয়ে রইল একলা, হতবুদ্ধি হয়ে, বিমূঢ় হয়ে ওই ঘন জংলী পাহাড়ি উপত্যকায়, ভুতুড়ে বাড়িটায়। 

একটা মানুষ এতটা নির্দয়, নির্বোধ আর পাশবিক কী করে হয়? তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এই মানুষটাকে সে ভালোবাসে! 

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না নাবিলা। তার চোখ বেয়ে দর দর করে কান্নার নোনা জল গড়িয়ে পড়ছিল। মাথার ভেতরটা শূন্য। সে জানে না এখন তার কী ভাবা উচিত, কী করা উচিত। আকাশে তখন জোরে সোরে মেঘ ডাকছে। বাতাস দাপুটে। আবার বৃষ্টি নামবে। টলতে টলতে, ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো নাবিলা। 

সাথে মোবাইল নেই, এ বাড়িতে কোনো ল্যান্ডফোন নেই, কথা বলার মতো একটা মানুষ নেই। সঙ্গী হিসেবে আছে খাঁ খাঁ করা একাকিত্ব। নাবিলা ড্রয়িং রুমের কাউচের ওপর বসে পড়ল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ দেয়ালে টাঙানো বিশাল বড় মোনালিসার ছবির দিকে। তার মনে হতে লাগলো পাশের ঘরে কেউ একজন স্যান্ডেলে খস খস শব্দ তুলে হাঁটছে। জানালায় ঠক ঠক করে করাঘাত করছে কোনো অশরীরী অস্তি ত্ব। বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাতে শুরু করলো। হাত পা কেঁপে উঠল খিঁচুনি দিয়ে। মনে হলো বুঝি একটা প্রলয়ংকরী ভয়ংকর ঝড় এসে তাকে নিঃশেষ করে দিয়ে যাচ্ছে। সে হারিয়ে যাচ্ছে, পতিত হচ্ছে এক গাঢ় কালো কুচকুচে অন্ধকার গহবরে। 

৫৯

বাড়ি ফিরে মায়ের ফোন পেলো সকাল। দেশে এখন ভোর। এই অসময়ে মায়ের ফোনটা একটু দুশ্চিন্তায় ফেললো তাকে। কল ব্যাক করতেই মা বসা গলায় বলল, ‘কোথায় গিয়েছিলি?’

প্রশ্নটা শুনে থতমত খেয়ে গেলো সকাল। মায়ের ঠিক এইভাবে প্রশ্নটা করার কথা ছিল না। কারণ, সকাল বাইরে বেরিয়েছিল এই তথ্যটাই মায়ের কান পর্যন্ত পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। তার ওপর মায়ের প্রশ্নটা একটু ধারালো ছিল। রেগে না গেলে মা এই স্বরে কথা বলে না। 

সকাল একটু তটস্থ ভাবে বলল, ‘বাইরে গিয়েছিলাম। কেন? 

—‘কার সাথে গিয়েছিলি?’ 

রক্ত জলকরা একটা প্রশ্ন। বুক দুরুদুরু করে উঠল। বাতাসে একটা কেমন বিপদের আভাস পেলো সকাল। সে যতটা সম্ভব গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,’ নাবিলার বাসায় গিয়েছিলাম।’ 

—‘কার সাথে?’ 

সকাল থামলো একটু। দম নিলো। স্পষ্ট গলায় বলল, 

—‘আরশানের সাথে।’ 

মা বোধহয় সকালের অকপট স্বীকারোক্তিতে একটু থমকে গেল। এলোমেলো নিশ্বাস ফেললো কয়েকবার, তারপর বলল, 

—‘শোন তুই, রহমান সাহেবের ওয়াইফ মানে তোর চাচি ফোন করেছিল আমাকে গতরাতে। বেশ অনেক রাতে। আমার ওই ফোন পাবার পর থেকে আর ঘুমই হয়নি। ফোন দিয়ে তোর নামে যা তা কথা বলল। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমার মেয়ের নামে কেউ এতো খারাপ কথা বলতে পারে!’ 

সকালের পায়ের জোর কমে গেলো। টলমল পা নিয়ে সে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। মুখ সাদা। 

মা বলল, ‘তুই নাকি সারাদিন বাসায়ই থাকিস না। ওই ছেলের সাথে সারাদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াস। তোর চাচা চাচির মুখের দিকে তাকিয়ে দুটা কথা বলিস না। একসাথে খাবার খাস না। আচ্ছা তুই কী বল তো? মহিলাটা নিজের ছেলের জন্য এত পছন্দ করে, শখ করে তোকে নিয়ে গেলো দেশ থেকে। আর তুই কিনা তার মুখের ওপর বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তারই সতীনের ছেলেকে পছন্দ করে বসলি? লজ্জা করে না তোর? আর এতো কিছু কখন ঘটালি? তুই আমাকে কিছু জানাসনাই কেন?’ 

সকালের ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপছিল। কী জানাবে সে? কখন জানাবে? সে নিজেই তো জানলো আজকে। আজ সকালে আরশান তাকে বিয়ের কথা বলল, আজকেই চাচার কাছে প্রসঙ্গটা তোলা হলো, আবার আজকের দিনেই ফাহাদ আর নাবিলার ব্রেকআপ হয়ে গেলো। একটা দিনের মাঝে কত কিছু ঘটে গেলো। ঘটনাগুলো ট্রেনের গতিতে ছুটছে যেন। কোথাও কোনো বিরতি নেই। 

মা বলে চললো,’ তোর ওপর আমাদের অনেক বিশ্বাস ছিল রে। এমন একটা কাজ করার আগে আমাদের মান সম্মানের কথা একবারও ভাবলি না তুই? এই মহিলাটার কাছে এখন মুখ দেখাবো কী করে আমি? এমন জানলে আমি তোকে ওখানে পাঠাতামই না।’ 

—‘মা এই মহিলাকে নিয়ে অত ভাববার কিছু নেই। মহিলাটা ভালো না। তুমি মহিলার বলা কথাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।’ 

মা শক্ত গলায় বলল,’ মহিলার সমস্যা আছে সেটা আমি খুব ভালো মতোই টের পাচ্ছি। আগে তো বুঝতে পারিনি। ঢাকায় যখন এসেছিল তখন তো খুব ভালো মানুষটি সেজে ছিল।’ 

—‘তার পছন্দের মানুষের সাথে সে দেবতার চেয়েও ভালো মা। আঁতে ঘা লাগলেই আসল কদাকার রূপটা বেরিয়ে আসে।’ 

—‘বুঝতে পারছি। আর বুঝতে পারছি বলেই আমি চাই না এমন একটা বাজে মহিলার বাড়িতে তুমি বউ হয়ে যাও। 

সকাল স্তব্ধ হয়ে গেলো। থমকে গেলো। নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলো।

—‘ম মা! এটা তোমাদের আগে বোঝা উচিত ছিল!’ 

—‘মানছি ভুলটা আমাদেরই হয়েছে। তাই ভুলটা শোধরাতে হবে আমাদেরকেই।’ 

—‘আর সময় নেই মা! আমি আরশানকে অনেক পছন্দ করি। আর ওকেই বিয়ে করতে চাই।’ 

—‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোর আব্বা বলে দিয়েছে ফাহাদের সাথে হলেও হতে পারতো, কিন্তু আরশানের সাথে কোনো ভাবেই না। প্রশ্নই ওঠে না।’ 

সকাল আর্তনাদ করে উঠল, ‘কেন মা? কেন? 

—‘তোর বাবা এর মাঝেই ওদের পুরো পরিবার সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খোঁজ নিয়েছে। আরশানের মায়ের চরিত্র নাকি ভালো ছিল না আর সত্যি বলতে আমরা কোনোদিন ওই মহিলাকে সামনা সামনি দেখিইনি। শুনেছি ছেলের জন্মের পরেই ছেলেকে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল, এ কেমন মা?’ 

—‘তাতে কী এসে যায়?’ 

—‘কী এসে যায় মানে? রক্তের একটা ব্যাপার আছে না? ওর শরীরে তো ওর মায়ের রক্তই বইছে, নাকি?’ 

কথাটা শেলের মতো বিধঁল মনের মাঝে। 

—‘মা প্লিজ!’ 

—‘কিসের প্লিজ? এরকম করছিস কেন তুই?’ 

বুক ফেটে যাচ্ছিল কষ্টে। সকাল দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রাণপণে কান্না চেপে বলল, ‘মা তুমি প্লিজ বাবাকে রাজি করাও, প্লিজ কিছু একটা কর!’ 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *