গ্রন্থকার

গ্রন্থকার

প্রকাশকের জরুরী তাগিদে সেদিন নটা পঁচিশের লোকালে কলিকাতা যাত্রা করিয়াছিলাম। আন্দাজ ছিল, সাড়ে দশটা বাজিতে বাজিতে হাওড়ায় পৌঁছিয়া কলিকাতার কাজকর্ম সারিয়া দেড়টার গাড়িতে আবার বাড়ি ফিরিব।

আমাদের স্টেশনে মাত্র আধ মিনিট গাড়ি দাঁড়ায়; তাই দেখিয়া-শুনিয়া একটা নির্জন কামরা খুঁজিয়া লওয়া সম্ভব হইল না, সম্মুখে যে ইন্টার-ক্লাস কামরাটা পাইলাম তাহাতেই উঠিয়া পড়িতে হইল। গাড়ি তখন আবার চলিতে আরম্ভ করিয়াছে।

দুইখানি করিয়া সমান্তরাল বেঞ্চি লোহার গরাদ দিয়া পৃথক করিয়া দেওয়া হইয়াছে—যাহাতে অনেকগুলা লোকাল প্যাসেঞ্জার একত্র হইয়া কাড়াকাড়ি না করে। আমি যে কুঠুরিতে ঢুকিয়াছিলাম তাহাতে গুটি চার-পাঁচ ভদ্রলোক বসিয়াছিলেন। দুই পাশের অন্য খাঁচাগুলিতেও দুচারজন করিয়া লোক ছিলেন। তাঁহাদের চেহারা দেখিয়া এমন কিছু বোধ হইল না যে, ছাড়া পাইলেই তাঁহারা পরস্পরকে আক্রমণ করিবেন। যা হোক, সাবধানে একটু কোণ ঘেঁষিয়া বসিলাম।

আমার পাশে বসিয়া একটি প্রৌঢ় গোছের ভদ্রলোক একাগ্রভাবে একখানা বই গিলিতেছিলেন। অন্য কোনও দিকে তাঁহার দৃষ্টি ছিল না। বোধ হয় আবেগের প্রাবল্যেই তাঁহার কাঁচা-পাকা দেড়-ইঞ্চি-চওড়া গোঁফ নড়িয়া উঠিতেছিল, কোটরগত চক্ষু জ্বলজ্বল করিতেছিল। ভারী চোয়াল চিবানোর ভঙ্গিতে নাড়িয়া তিনি মাঝে মাঝে গলা দিয়া একপ্রকার শব্দ বাহির করিতেছিলেন—গরর—র—

কি এমন বই যাহা ভদ্রলোককে এত উত্তেজিত করিয়া তুলিয়াছে? জিরাফের মতো গলা উঁচু করিয়া বইখানার নাম পড়িলাম—নীল রক্ত। বইখানা পরিচিত—লেখকের নাম প্রদ্যোত রায়। মাস কয়েক পূর্বে বইটি বাহির হইয়া সাহিত্য-ক্ষেত্রে বিশেষ আন্দোলনের সৃষ্টি করিয়াছিল।

পাশের খাঁচা হইতে এক ভদ্রলোক গলা চড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, প্যারীদা, অত মন দিয়ে কি পড়ছেন?

পুস্তকপাঠনিরত ব্যক্তিই প্যারীদা। তিনি মুখ তুলিয়া সক্রোধে খ্যাঁক খ্যাঁক করিয়া হাসিলেন, বলিলেন, পদা ছোঁড়ার কেলেঙ্কারি দেখছি! কি ল্যাখাই লিখেছেন! মরি মরি! এই বই নিয়ে আবার তুমুল কাণ্ড বেধে গেছে। বইখানা বিশে লাইব্রেরি থেকে এনেছিল। ভাবলুম, দেখি তো পদা কি লিখেছে। ছেলেবেলা থেকেই ছোঁড়াকে জানি—আমার শ্যালীর সম্পর্কে ভাসুরপো হয়।তা, যে। বিদ্যে ছরকুটেছেন সে আর কহতব্য নয়।

সকলে কৌতূহলী হইয়া উঠিলেন। একজন প্রশ্ন করিলেন, নাম কি বইখানার?

প্যারীদা তাচ্ছিল্যসূচক গলা খাঁকারি দিয়া বলিলেন, নীল রক্ত। যেমন নাম, তেমনি বই। আরে, তখনি আমার বোঝা উচিত ছিল, পদা আবার বই লিখবে! মেনিমুখো একটা ছোঁড়া, তিনবার ম্যাট্রিক ফেল করেছে—

আর একজন বলিলেন, নীল রক্ত! বইখানার নাম শুনেছি বটে—সেদিন বোসেদের গুপে বলছিল বইখানা ভাল হয়েছে। গুপে বাংলা বইয়ের খবরটবর রাখে। তা লেখককে আপনি চেনেন নাকি?

প্যারীদা বলিলেন, বললুম না, আমার শ্যালীর ভাসুরপো। বাঘ-আঁচড়ায় থাকে, চালচুলো কিছু নেই। রোগা সিড়িঙ্গে হাড়-বের করা ছোঁড়া, মুখে বুদ্ধির নামগন্ধ নেই, কথা কইতে গেলে তিনবার হোঁচট খায়–সে আবার বই লিখবে! হেসে আর বাঁচিনে!

গ্রন্থকার শব্দটার মধ্যে কি-একটা সম্মোহন আছে, বিশেষত কেহ যদি বলে আমি অমুক লেখককে চিনি, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই, দেখিতে দেখিতে সে সকলের ঈর্ষা ও শ্রদ্ধার পাত্র হইয়া উঠে। প্যারীদাও গাড়িসুদ্ধ লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া লইলেন।

আর একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক গালে এক গাল পানদোক্তা পুরিয়া মৃদুমন্দ রোমন্থন করিতেছিলেন, তিনি বলিলেন, প্যারী, তুমি তো দেখছি ছোকরার ওপর বেজায় চটে গেছ। গল্পটা কি লিখেছে বল দেখি—আমরাও শুনি।

প্যারীদা বলিলেন, লিখেছে আমার মুণ্ডু আর তার বাপের পিণ্ডি।

আহাহা, গল্পটা বলই না ছাই।

গল্প না ঘণ্টা—এক বুনিয়াদি জমিদার বংশের ছেলের কেচ্ছা। আম্বা দেখে হাসি পায়! তোর বাপ তো হল গিয়ে সবপোস্ট-অফিসের পোস্টমাস্টার—তুই জমিদারের ছেলে কখনো চোখে দেখেছিস যে তাদের কেচ্ছা লিখতে গেলি? একেই বলে, পেটে ভাত নেই কপালে সিঁদুর। আমি যদি ও গল্প লিখতুম তাহলেও বা কথা ছিল। নিজে ছাপোষা বটে কিন্তু ত্রিশবচ্ছর ধরে দুবেলা জমিদারের বৈঠকখানায় আড্ডা দিচ্ছি তাদের নাড়ি থেকে হাঁড়ি পর্যন্ত সব খবর রাখি। বলুন তো মশায়? বলিয়া প্যারীদা হঠাৎ আমার দিকে ফিরিলেন।

প্যারীদার কথা শুনিতে শুনিতে কেমন আচ্ছন্নের মতো হইয়া পড়িয়াছিলাম, জগৎটাই মায়াময় বোধ হইতেছিল, চমকিয়া উঠিয়া বলিলাম, সে তো ঠিক কথা, কিন্তু

কিন্তু টিন্তু নয়—খাঁটি কথা। লেখার অভ্যেস নেই এই যা, নইলে এমন গল্প লিখতে পারতুম যে, পদার বাবাও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেত।

পূর্বোক্ত পান-চর্বণ-রত ভদ্রলোক বলিলেন, কিন্তু গল্পটাই যে তুমি বলছ না হে!

প্যারীদা বলিলেন, গল্পর কি আর মাথা-মুণ্ডু আছে! যত সব উদ্ভট ব্যাপার। শুনতে চাও তো বলছি। বলিয়া একবার চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।

আমার একবার সন্দেহ হইল, প্যারীদা গল্পটা সকলকে শুনাইবার জন্যই এতটা তাল ঠুকিতেছিলেন। যাহারা গল্প বলিতে জানে, শ্রোতার মনকে তৈয়ার করিয়া লইতেও তাহারা পটু! দেখিলাম, চলন্ত গাড়ির শব্দের ভিতর হইতে প্যারীদার গল্প শুনিবার জন্য সকলেই উকৰ্ণ হইয়া আছে। প্যারীদার মুখের উপর একটা তৃপ্তির ভাব ক্ষণেকের জন্য খেলিয়া গেল। তিনি বলিতে আরম্ভ করিলেন।

শেক্সপীয়রের মতো এক একজন প্রতিভাবান লোক আছে, যাহারা পরের গল্প আত্মসাৎ করিয়া তাহার চেহারা বদলাইয়া দিতে পারে। দেখিলাম প্যারীদারও সেই শ্রেণীর প্রতিভা। বইখানা কেমন হইয়াছে তাহা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়—কিন্তু প্যারীদার বলার ভঙ্গিতে গল্প জমিয়া উঠিল। আমি তাঁহারই কথা যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে গল্পটাকে উদ্ধৃত করিলাম।

এক মস্ত জমিদার বংশ; তিনশ বছর ধরে চলে আসছে। তিন লক্ষ টাকা বছরে আয়, সাতমহল বাড়ি, এগারোটা হাতি, বাওয়ান্নটা ঘোড়া; লাঠি সড়কি বরকন্দাজ মশালচি হুঁকাবরদার—-চারদিকে গিশ গিশ করছে। মোটের উপর, একটা রাজপাট বললেই হয়।

সেকালে জমিদারেরা ভীষণ দুর্দান্ত ছিল। ডাকাতি, গুমখুন, গাঁ জ্বালিয়ে দেওয়া—এমন কাজ নেই যা তারা করত না। তাদের এক বিধবা মেয়ের নাকি চরিত্র খারাপ হয়েছিল—জমিদার জানতে পেরে নিজের মেয়ে আর তার উপপতিকে ধরে এনে নিজের বৈঠকখানা ঘরের মেঝেয় পুঁতে আবার রাতারাতি মেঝে শান বাঁধিয়ে ফেলেছিল। তাদের অত্যাচার আর দাপটের কত কাহিনী যে প্রচলিত ছিল তার শেষ নেই! আশেপাশের জমিদারেরা তাদের যমের মতো ভয় করত। শোনা যায়, সীমানার এক ঘাটোয়ালের সঙ্গে দখল নিয়ে করার হওয়াতে সেই ঘাটোয়ালকে তার বাড়ি থেকে  লোপাট করে এনে অমাবস্যার রাত্রে মা কালীর সামনে বলি দিয়েছিল।

আজকাল অবশ্য সে সব আর নেই। তবে রাজপাট ঠিক বজায় আছে। বর্তমান জমিদারের একমাত্র ছেলে, তার নাম অহীন্দ্র। সেই হল গিয়ে এই গল্পের নায়ক। সে রীতিমত ইংরেজী লেখাপড়া শিখেছে, কলকাতায় প্রকাণ্ড বাসা করে থাকে। সে বড় ভাল ছেলে। বড় শান্ত প্রকৃতি তার পূর্বপুরুষদের দুর্দান্ত স্বভাব একটুও পায়নি—সাত চড়ে মুখে রা নেই। চেহারাও চমৎকার—লেখাপড়াতেও ধারালো। এক কথায় যাকে বলে হীরের টুকরো ছেলে।

এই ছেলে লেখাপড়া করতে করতে হঠাৎ এক ব্যারিস্টারের মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল। সে ব্যারিস্টারের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করলে। ব্যারিস্টারটির বাইরের ঠাট ঠিক আছে; কিন্তু ভেতরে একেবারে ভুয়ো—আকণ্ঠ দেন। তাঁর মেয়ে মনীষা কিন্তু খুব ভাল মেয়ে; সুন্দরী শিক্ষিতা বটে কিন্তু ভেঁপো চালিয়াৎ নয়—শান্ত ধীর নম্র। সেও মনে মনে অহীন্দ্রকে ভালবেসে ফেললে।

কিন্তু প্রেমের পথ বড়ই কুটিল; এতবড় জমিদারের ছেলেও দেখলে তার প্রিয়তমাকে পাবার পথে দুস্তর বাধা। অর্থাৎ মনীষার আর একটি উমেদার আছে। উমেদারটি আর কেউ নয় ব্যারিস্টার সাহেবের পাওনাদার। লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, অবিবাহিত, বিলেত-ফেরত এবং টাকার আভিল। তার নামে মাঝে মাঝে কিছু কানাঘুষোও শোনা যেত কিন্তু যার অত টাকা তার নামে কুৎসা কে গ্রাহ্য করে?

ব্যারিস্টার সাহেবের চরিত্র অতি দুর্বল। তিনি মেয়েকে ভালবাসেন বটে, কিন্তু পাওনাদারের মুঠোর মধ্যে গিয়ে পড়েছেন। তাই, ইচ্ছা থাকলেও অহীন্দ্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্ভাবনাটা মনের মধ্যে গ্রহণ করতে পারছেন না। অহীন্দ্রও স্পষ্ট করে কোনও কথা বলে না, কেবল আসে-যায়, গল্প করে, চা খায়—এই পর্যন্ত। তার মনের ভাব হয়তো কেউ কেউ বুঝতে পারে, কিন্তু সে মুখ ফুটে কিছু প্রকাশ করে না। এমনি ভাবে ছমাস কেটে গেল।

ছমাস পরে একদিন কথায় কথায় অহীন্দ্র পাওনাদার বাবুর মনের ভাব জানতে পারলে। তিনি মনীষাকে বিয়ে করতে চান না—বিয়েতে তাঁর ভারি অরুচি—তাঁর মতলব অন্য রকম। কিন্তু মনীষা ভালমানুষ হলেও ভারি শক্ত মেয়ে, সে ও-সবে রাজী নয়। ব্যারিস্টার সাহেব সবই বোঝেন কিন্তু পাওনাদারকে চটাবার সাহস তাঁর নেই—তিনি কেবল চোখ বুজে থাকেন। কিন্তু তবু পাওনাদার বাবু সুবিধা করে উঠতে পারছেন না।

এই ব্যাপার জানতে পেরেও অহীন্দ্র কোনও কথা বললে না, চুপ করে রইল। সে এতই ভালমানুষ যে, পাওনাদার বাবু তার প্রতিদ্বন্দ্বী জেনেও সে কোনও দিন তাঁর প্রতি বিরাগ বা বিতৃষ্ণা দেখায়নি। দুজনের মধ্যে বেশ সদ্ভাবই ছিল। পাওনাদার বাবু অহীন্দ্রকে গোবেচারি ভ্যাড়াকান্ত মনে করে ভেতরে ভেতরে একটু কৃপার চক্ষেই দেখতেন।

একদিন সন্ধ্যার পর অহীন্দ্র ব্যারিস্টার সাহেবের বাড়িতে এসে দেখলে, মনীষা বাগানে ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। অহীন্দ্র নিঃশব্দে বাগান থেকে ফিরে চলে গেল।

পরদিন বিকেলবেলা অহীন্দ্র পাওনাদার বাবুর সঙ্গে নিরিবিলি দেখা করে বললে, আপনার সঙ্গে একটা ভারি গোপনীয় কথা আছে—কিছু টাকা ধার চাই। কাজটা কিন্তু খুব চুপিচুপি সারতে হবেবাবা না জানতে পারেন।

বড়লোকের ছেলেদের টাকা ধার দেওয়াই পাওনাদার বাবুর ব্যবসা, তিনি খুশি হয়ে বললেন, বেশ তো! আজ রাত্রি দশটার সময় আপনি আমার বাড়িতে যাবেন। কেউ থাকবে না—চাকরবাকরদেরও সরিয়ে দেব।

রাত্রি দশটার সময় অহীন্দ্র পাওনাদার বাবুর বাড়িতে পায়ে হেঁটে উপস্থিত হল; দেখলে, গৃহস্বামী ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। তখন দুজনে টাকার কথা আরম্ভ হল।

অহীন্দ্র বিশ হাজার টাকা ধার চায়। কিন্তু সুদের হার নিয়ে একটু কষাকষি চলতে লাগল। অহীন্দ্র বললে সে শতকরা দশ টাকার বেশী সুদ দিতে পারবে না। পাওনাদার বাবু বললেন, তিনি শতকরা পনের টাকার কম সুদ নেন না। তার কারণ, যারা তাঁর কাছে ধার নেয় তাদের নাম কখনও জানাজানি হয় না—গোপন থাকে। অহীন্দ্র তাঁর কথায় সন্দেহ প্রকাশ করলে। তখন তিনি লোহার আলমারি খুলে অন্যান্য তমসুক বার করে দেখালেন যে সকলেই শতকরা পনের টাকা হারে সুদ দিয়েছে।

এই সময় টেবিলের ওপর আলোটা হঠাৎ নিবে গেল। তারপর অন্ধকার ঘরের মধ্যে কি হল কেউ জানে না।

পরদিন সন্ধ্যেবেলা অহীন্দ্র যথারীতি ব্যারিস্টার সাহেবের বাড়ি গিয়ে শুনলে যে পাওনাদার বাবু হঠাৎ মারা গেছেন। কিসে মারা গেছেন কেউ বলতে পারলে না। তবে তাঁর চরিত্র ভাল ছিল না, তাই অনেকেই অনুমান করলে যে, এর মধ্যে স্ত্রীলোকঘটিত কোনও ব্যাপার আছে।

এই ঘটনার সাতদিন পরে ব্যারিস্টার সাহেব বুক-পোস্টে একটা কাগজের তাড়া পেলেন। খুলে দেখলেন, কোনও অজ্ঞাত লোক তাঁর তমসুকখানি পাঠিয়ে দিয়েছে।

অতঃপর জমিদারের সুবোধ শান্ত ছেলের সঙ্গে ঋণমুক্ত ব্যারিস্টারের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। প্রেমিক প্রেমিকার মিলন হল।

.

প্যারীদা বলিলেন, শুনলে তো গল্প?

সকলে চুপ করিয়া রহিল। ট্রেন এতক্ষণ প্রত্যেক স্টেশনে থামিতে থামিতে প্রায় গন্তব্য স্থানে। আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। বেলুড়ে গাড়ি ধরিতেই, একটি পুরাদস্তুর তরুণ আমাদের কামরায় প্রবেশ করিয়া রুমালে সন্তর্পণে গদি ঝাড়িয়া উপবেশন করিল এবং চওড়া কালো ফিতার প্রান্তে বাঁধা প্যাঁশ-নে চশমার ভিতর দিয়া আমাদের সকলের দিকে একবার অবজ্ঞাভরে দৃষ্টিপাত করিল।

গাড়ি আবার চলিতে আরম্ভ করিল।

নীল রক্ত বইখানা প্যারীদার হাতেই ছিল; তরুণ এতক্ষণে সেটার নাম দেখিতে পাইয়া মুরুব্বিয়ানা চালে ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কেমন পড়লেন বইখানা? ওটা আমার লেখা।

আমরা সকলে স্তম্ভিত হইয়া তরুণের মুখের পানে তাকাইয়া রহিলাম। প্যারীদা কিয়ৎকালের জন্য একেবারে নির্বাক হইয়া গেলেন, তারপর গর্জন করিয়া উঠিলেন, তোমার লেখা? কে হে তুমি ছোকরা? এ বই পদার লেখা—আমার শ্যালীর ভাসুরপো পদা।

তরুণ অবিচলিত ভাবে একটা সিগারেট ধরাইয়া বলিল, আপনার শ্যালীর ভাসুর থাকতে পারে এবং সেই ভাসুরের পদা নামক ছেলে থাকাও অসম্ভব নয়। কিন্তু বইখানা আমার লেখা। আমার নাম প্রদ্যোত রায়।

গাড়িসুদ্ধ লোক এই অভাবনীয় ব্যাপার দেখিয়া একেবারে চমকৃত হইয়া গেল। যাহারা দূরের খাঁচায় ছিল তাহারা দাঁড়াইয়া উঠিয়া একদৃষ্টে তরুণকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

তরুণ বলিল, পদা নামধারী কোনও ব্যক্তির বই লেখা সম্ভব নয়।-দেখি বইখানা। বলিয়া তরুণ হাত বাড়াইল।

প্যারীদার মুখ দেখিয়া বোধ হইল তিনি এখনি বইখানা জানালা গলাইয়া ফেলিয়া দিবেন, কিন্তু লাইব্রেরিকে দেড় টাকা গুনাগার দিতে হইবে এই ভয়েই বোধ হয় তাহা করিলেন না। তরুণ বইখানা লইয়া কয়েক পাতা উল্টাইয়া বলিল, শুনুন, মুখস্থ বলছি—১০৯ পৃষ্ঠায় আছে—সভ্যতা ও ধর্মভয় মানুষের গায়ে ক্ষীণতম পালিশ মাত্র; জীবনের অবিশ্রাম ঘর্ষণে তাহা উঠিয়া গিয়া ভিতরের প্রকৃত মনুষ্যমূর্তি কখনও কখনও বাহির হইয়া পড়ে। তখন সে আদিম সভ্যতালেশবর্জিত নখদন্তায়ুধ মনুষ্যমূর্তি দেখিয়া আমরা আতঙ্কে শিহরিয়া উঠি। বুঝিতে পারি না যে, আমাদের সকলের মধ্যেই এই ভয়ঙ্কর মূর্তি লুক্কায়িত আছে—প্রয়োজন হইলেই সে ছদ্মবেশ ফেলিয়া বাহির হইয়া আসিবে। অনেকের জীবনেই সেই প্রয়োজন আসে না কিন্তু যাহার আসে, তরুণ মুচকি হাসিয়া বলিল,—এখনও কি আপনি বলতে চান যে এ লেখা আপনার পদার হাত থেকে বেরিয়েছে?

প্যারীদা এবার একেবারে নিবিয়া গেলেন, অতি কষ্টে অসংলগ্নভাবে বলিলেন, পদা—মানে পদার নামও প্রদ্যোত রায়, তাই আমি

বিজয়ী তরুণ সহাস্যে আমার দিকে ফিরিল, আপনি বইটা পড়েছেন কি? আমার চেহারা দেখিয়া আমাকেই বোধ হয় সে এই দলের মধ্যে সব চেয়ে শিক্ষিত মনে করিয়াছিল।

আমি কি আর বলিব, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে কহিলাম, হ্যাঁ। প্রুফ সংশোধন করবার সময় একবার পড়েছিলুম, তারপর আর পড়া হয়নি।

তরুণ বলিল, ও! আপনি ছাপাখানায় কাজ করেন?

কথাটা একটু গায়ে লাগিল। ট্রেন হাওড়া স্টেশনে প্রবেশ করিতেছিল, আমি বাহিরের দিকে তাকাইয়া বলিলাম, না। বইখানা আমারই লেখা।

তরুণ উচ্চকিতভাবে আমার পানে তাকাইল, একটু অস্বস্তির ভাব তাহার মুখে দেখা দিল। সে একবার ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিয়া বলিল, আপনি বলতে চান–?

মনকে কঠিন করিলাম। পকেট হইতে একটা পোস্টকার্ড বাহির করিয়া বিনীতভাবে বলিলাম, আপনারা রাগ করবেন না, কিন্তু আমিই প্রদ্যোত রায়। খাঁটি এবং অকৃত্রিম—ভেজাল নেই। বিশ্বাস না হয়, এই পোস্টকার্ডখানা পড়ে দেখুন-নীল রক্তর দ্বিতীয় সংস্করণ বার হবে তাই প্রকাশক মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে চলেছি।

সঙ্কুচিতভাবে পোস্টকার্ডখানা প্যারীদার দিকে বাড়াইয়া দিলাম, তিনি কেবল হিংস্রভাবে আমার পানে তাকাইলেন।

গাড়ি প্ল্যাটফর্মে আসিয়া থামিল। আমি কার্ডখানা তরুণের দিকে বাড়াইবার উপক্রম করিতেই সে দ্রুত প্ল্যাটফর্মে নামিয়া ভিড়ের মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

২২ পৌষ ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *