শীলা-সোমেশ
গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামক সর্ববিদিত পথটি সাঁওতাল পরগণার ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে যে ক্ষুদ্র শহরটিকে দ্বিধা ভিন্ন করিয়া দিয়া ঊর্ধ্বমুখে চলিয়া গিয়াছে সেই শহর হইতে প্রায় দশ-এগারো মাইল উত্তরে পথের ধারেই একটা বাংলো বাড়ি দেখা যায়। ঘন সন্নিবিষ্ট শালবনের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়া প্রায় বিঘা দুই জমি ঘেরা, তাহারই মধ্যস্থলে উচ্চ ভিত্তির উপর বাড়িখানি প্রতিষ্ঠিত। আশেপাশে দু-দশ মাইলের মধ্যে কোথাও জনমানবের বাস নাই।
সন্ধ্যার পর নিবিড় জঙ্গলের ছায়ায় যখন পথের শুভ্র রেখাটি মুছিয়া মিলাইয়া যায় এবং বাংলোটির ঘরে ঘরে আলো জ্বলিয়া উঠে তখন দিগ্ব্যাপী স্তব্ধতার মধ্যে জঙ্গলের নানাপ্রকার শব্দ পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে। শালের পাতায় পাতায় ঘষিয়া যে মর্মর ধ্বনি উত্থিত হয় তাহার সহিত সহসা খট্টাসের অট্টহাসি মিশিয়া বিশ্রব্ধ মনকে চমকিত সন্ত্রস্ত করিয়া দেয়। কখনও বা গভীর রাত্রে অতি সন্নিকটে ব্যাঘ্রের আকস্মিক গর্জন নিদ্রিত গৃহবাসীকে শয্যার উপর উঠিয়া বসাইয়া দেয়। তখন বাড়ির রক্ষক কুকুরগুলার ঘেউ ঘেউ শব্দের সদম্ভ আস্ফালন যেন মার খাইয়া থামিয়া যায়।
চন্দ্রনাথ রায়, ফরেস্ট অফিসার, এই বাংলোতে বাস করেন। বাড়ির পশ্চাতে তারের বেড়ার ধারে যে একসারি ছোট ছোট কুঠুরী আছে তাহার একপ্রান্তের কয়েকটি ঘরে তাঁহার অফিস বসে ও গুটি তিন-চার কর্মচারী বাস করে। অপর দিকে আস্তাবল ও সহিসের ঘর। চন্দ্রনাথবাবুর একটি ঘোড়া ও টম্টম্ আছে, ঘোড়াটি সোয়ারী ও টম্টম্ দুই কার্যেই ব্যবহৃত হয়। সাঁওতাল সহিস সপরিবারে এইখানেই থাকে। বাড়ির যৎসামান্য কাজের জন্য একটি দাই ও একজন বেয়ারা আছে। বেয়ারা একাধারে ভৃত্য এবং পাচক।
এ সকল ছাড়াও চন্দ্রনাথবাবুর একটি কন্যা আছে—তাহার নাম শীলা। সে-ই সংসারের কর্ত্রী, কারণ চন্দ্রনাথবাবু বিপত্নীক। শীলার বয়স আঠারো বৎসর। মেয়েটি দেখিতে সুন্দর, ছোটখাটো, ক্ষীণাঙ্গী, সহসা দেখিলে নেহাৎ বালিকা বলিয়া ভ্রম হয়। কিন্তু ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলে মুখের কোমল সৌকুমার্যের ভিতর দিয়া বয়সোচিত দৃঢ় চিত্তবল ও স্বনির্ভরতা ধরা পড়ে।
কন্যাটিকে লইয়া চন্দ্রনাথবাবু নিশ্চিতমনে অরণ্যবাস করিতেছেন। চিরজীবন এইভাবেই কাটিয়াছে; তাই মানুষের সঙ্গের প্রতি বড় একটা লিপ্সা নাই। শীলাও তাঁহার মতো—একলা থাকিতে ভালবাসে। কদাচ দু’মাস ছ’মাসে পিতাপুত্রী টম্টম্ আরোহণে শহরে গিয়া বন্ধু-বান্ধবের সহিত দেখা-সাক্ষাৎ করিয়া আসেন। তারপর আবার নিরবচ্ছিন্ন বনপর্ব চলিতে থাকে।
ভাদ্র মাস কাটিয়া গিয়াছে, আশ্বিনের আরম্ভ। সন্ধ্যার পর হিম পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, শেষরাত্রিতে একটু গা শীত-শীত করে। দিনের বেলাটি শীত-গ্রীষ্ম বিবর্জিত একটি মনোরম সন্ধিকাল। নির্মল আকাশ ও ঝরঝরে বাতাস যেন প্রকৃতির সমস্ত আসবাব ঝাড়িয়া মুছিয়া একেবারে ক্লেদমুক্ত করিয়া দিয়াছে—গাছের পাতায় কি আকাশের লঘু মেঘে কোথাও এতটুকু মলিনতার চিহ্ন পর্যন্ত নাই।
বাংলোর সম্মুখে খানিকটা স্থান লইয়া গোলাপের বাগান। বৈকালী সূর্যের সঙ্কুচিত রশ্মি বাগানটিকে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে। হাতে একটা খুরপী লইয়া শাড়ির আঁচলটা গাছ-কোমর করিয়া বাঁধিয়া শীলা গোলাপ গাছের তত্ত্বাবধান করিতেছিল। যে গাছে তখনও ফুল ধরে নাই তাহার গোড়া খুঁড়িয়া দিতেছিল, আবার যে গাছটি ফুলে মুকুলে ভরিয়া উঠিয়াছে, একটি ক্ষুদ্র জল ঢালিবার ঝাঁঝরিদার পাত্র হইতে তাহার পাতায় ও মূলে জল দিতেছিল। মালী নাই, এ বাগানটি শীলার নিজের হাতে তৈয়ারি—নিজস্ব। তাই ইহার প্রতি তাহার যত্ন ও মমতার অন্ত ছিল না। একটি ফুলও সে প্রাণ ধরিয়া কাহাকেও ছিঁড়িতে দিতে পারিত না।
শীলা মন দিয়া বাগানের সেবা করিতেছিল বটে কিন্তু তাহার একটি চোখ ও একটি কান পথের পানে পড়িয়াছিল। মাঝে মাঝে যেন পরিশ্রমের পর বিশ্রাম করিবার উদ্দেশ্যেই গেটের কাছে গিয়া দাঁড়াইতেছিল এবং কাঠের ফটকের উপর ভর দিয়া পথের যে প্রান্তটা শহরের দিকে গিয়াছে, সেইদিকে উৎসুক চোখে চাহিয়া দেখিতেছিল।
চন্দ্রনাথবাবু বেলা দ্বিপ্রহরে ঘোড়ায় চড়িয়া বন্দুক ঘাড়ে করিয়া বাহির হইয়াছিলেন, এখনও ফিরিয়া আসেন নাই। কিন্তু ইহা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, রোজই চন্দ্রনাথবাবুর ফিরিতে সন্ধ্যা হয় সুতরাং সেজন্য উৎকণ্ঠার কোনও হেতু নাই। শীলার চিত্তচাঞ্চল্যের অন্য কারণ ছিল। আসল কথা আজ শনিবার।
আষাঢ় মাসে আকাশে নবীন মেঘোদয় দেখিয়া তরুণীদের মন উন্মনা হয়, এ দেশের প্রাচীন কবিরা এরূপ একটা কথা লিখিয়া গিয়াছেন বটে, তাহাও পথিক-বধূ জাতীয় বিশেষ এক শ্রেণীর তরুণীদের সম্বন্ধে! কিন্তু শনিবারে, আকাশ একান্ত নির্মেঘ থাকা সত্ত্বেও এরূপ ব্যাপার ঘটিতে পারে তাহা কোন কাব্যে দেখিয়াছি বলিয়া স্মরণ হয় না। কবিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিন্দক ভর্তৃহরি কবিও শনিবারের নামে এমন একটা অভিযোগ আনিতে সাহস করেন নাই। তবে আজ কেবলমাত্র শনিবার বলিয়া একটি অনূঢ়া তরুণী গোলাপ গাছের পরিচর্যা করিতে করিতে তৃষিত নয়নে বনপথের পানে চাহিয়া থাকিবে কেন?
গত কয়েকটি শনিবার হইতেই এই ব্যাপার ঘটিতেছিল। মাস দুয়েক পূর্বে চন্দ্রনাথবাবু সকন্যা শহরে গিয়াছিলেন, সেখানে এক পুরাতন বন্ধুর গৃহে একটি নূতন লোকের সহিত তাঁহাদের পরিচয় হয়। লোকটি শহরে নবাগত, বিধবা জ্যেষ্ঠা ভগিনীর স্বাস্থ্যের জন্য হাওয়া বদলাইতে আসিয়া মস্ত একখানা কম্পাউন্ডযুক্ত বাড়ি ভাড়া লইয়া বাস করিতেছিল। পুরাতন বন্ধুটি পরিচয় করাইয়া দিলেন, ইনি সোমেশ বসু, ধনীর সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী এবং অতিশয় সজ্জন। অধিকন্তু লোকটি যে বিশেষ সুপুরুষ তাহা চন্দ্রনাথবাবু ও তাঁহার কন্যা স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিলেন। শীলা মনে মনে বয়স আন্দাজ করিল—ছাব্বিশ—সাতাশ।
সোমেশ বসুর সহিত আলাপে আরও একটা জিনিস প্রকাশ পাইল, সে অতি শীঘ্র আবালবৃদ্ধবনিতার সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিতে পারে। ঘণ্টা দুয়ের মধ্যে সে এতই ভাব জমাইয়া তুলিল, এবং এমনভাবে আচরণ করিতে লাগিল যেন চন্দ্রনাথবাবু তাহার খুড়া-জ্যাঠা জাতীয় একজন নিকট আত্মীয় এবং শীলা তাহার শৈশবের সহচরী—কেন যে তাহাকে এখনও ‘সোমেশদা’ বলিয়া বিগলিত কণ্ঠে ডাকিতেছে না ইহাই যেন ভারী আশ্চর্যের বিষয়!
সেইদিন সায়াহ্নে ‘সোমেশ বসুর বাড়িতে চা পান করিয়া তাহার বড় দিদির নির্মিত অপূর্ব জিভে-গজার স্বাদ মুখে লইয়া শীলা ও তাহার পিতা বাড়ি ফিরিলেন। বিদায়কালে সোমেশ আশ্বাস দিয়া বলিল, ‘কিছু ভাববেন না, শনিবারে শনিবারে গিয়ে আমি আপনাদের নির্জন বাসের ক্লেশ লাঘব করে দিয়ে আসব।’
এই আত্মপ্রত্যয়শীল যুবকের কথা বলিবার গম্ভীর ভঙ্গি দেখিয়া শীলার বড় হাসি পাইয়াছিল।
তাহার পর হইতে প্রতি শনিবারে সোমেশ বাইসিক্ল আরোহণে চন্দ্রনাথবাবুর বাংলোতে আসিয়াছে এবং ঘণ্টা দুই থাকিয়া চা সেবন ও শীলার স্বহস্ত প্রস্তুত কেক ভক্ষণ করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে ফিরিয়া গিয়াছে।
সম্প্রতি শীলার মনে একটা গোলমাল উপস্থিত হইয়াছে। সোমেশের স্বাস্থ্যপূর্ণ দৃঢ় শরীর, তাহার সুশিক্ষা-মার্জিত তীক্ষ্ণবুদ্ধি, তাহার কথা বলিবার হাল্কা অথচ গম্ভীর ভঙ্গি সবই শীলার ভাল লাগে এবং লোকটি যে খুব ভাল এ বিষয়েও তাহার মনে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহার সকল কথাবার্তা আচরণের অন্তরালে যে একটি দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় অজ্ঞাতসারে পরিস্ফুট হইয়া উঠে তাহা শীলার ভাল লাগে না। ইহা যদি অহমিকা বা আত্মম্ভরিতা হইত তাহা হইলে দু’চারিটি তীক্ষ্ণ কথার বাণে শীলা তাহাকে ধূলিসাৎ করিয়া দিতে পারিত। কিন্তু ইহা সে বস্তু নহে, প্রকৃতপক্ষে ইহার কতখানি ঠাট্টা এবং কতখানি সত্য মনোভাব তাহাই শীলা অনেক সময় বুঝিয়া উঠিতে পারে না। সে নিজে শৈশব হইতে আত্মনির্ভরশীলা, সর্ববিষয়ে নিজেকে রক্ষা করিতে সমর্থা, কাহারও মুরুব্বিয়ানা বা পৃষ্ঠপোষকতা সে আদৌ সহ্য করিতে পারে না। কিন্তু সোমেশের ভাবে-ইঙ্গিতে যেন ঐ বস্তুটারই সে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পায়। এবং এই আত্মপরিতোষ যতই তাহার মর্যাদায় আঘাত করিয়া যায়, আঘাত ফিরাইয়া দিতে না পারিয়া ততই সে উৎপীড়িত হইয়া উঠে।
তাছাড়া, বাড়িতে চন্দ্রনাথবাবু হইতে আরম্ভ করিয়া চাকরানীটা পর্যন্ত সোমেশের গুণগানে এমনি মুক্তকণ্ঠ হইয়া উঠিয়াছেন যে, একজন কেহ প্রতিবাদ না করিলে সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বৈচিত্র্যহীন বন্দনা-গীতি হইয়া দাঁড়ায়। তাই সুযোগ পাইলেই সে পিতার সহিত তর্ক করে যে, সোমেশবাবু লোকটি অতিশয় অহঙ্কারী! এবং উচ্চনীচ সকলকেই পিঠ ঠুকিয়া পেট্রনাইজ করা তাঁহার স্বভাব।
প্রত্যুত্তরে চন্দ্রনাথবাবু বলেন যে, যুবকদের নিরীহ অতিবিনয়ী ভাব তিনি সহ্য করিতে পারেন না এবং আজকালকার ছেলেরা অতিশয় শিষ্ট ও মিষ্টভাষী হইয়া একবারে উৎসন্নে যাইতে বসিয়াছে।
শীলা তর্ক করে যে, সোমেশবাবু সকলকেই মনে মনে তাচ্ছিল্য করিয়া ক্ষুদ্র করিয়া দেখেন। চন্দ্রনাথবাবু বলেন, না, সে নিজেকে সকলের সমান করিয়া দেখে।
সুতরাং তর্কের নিষ্পত্তি হয় না। নিজের যুক্তির প্রভাবে শীলা সোমেশের প্রতি বিমুখ হইয়া বসিতে চাহে, তাহাকে অবহেলা করিয়া মন হইতে ঝাড়িয়া ফেলিতে চায়। কিন্তু পারে না, অদৃশ্য আকর্ষণ দৃঢ়তর হইতে থাকে। এইরূপ দোটানার মধ্যে তাহার রাত ও দিনগুলা কাটিতেছে।
নিস্তব্ধ বাতাসে বহুদূর হইতে সুমিষ্ট কিড়িং কিড়িং শব্দ ভাসিয়া আসিল। শীলা সচকিত হইয়া দাঁড়াইয়া দেখিল তখনও পথের উপর সাইক্ল বা তাহার আরোহীকে দেখা যাইতেছে না। সে বাগানে ফিরিয়া গিয়া পীতপুষ্পভারনম্র একটি গোলাপলতার মঞ্চমূলে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া গভীর মনসংযোগে তাহার পরিচর্যা করিতে লাগিল।
কিছুক্ষণ পরে সোমেশ আসিয়া ফটকের সম্মুখে অবতরণ করিল; ফটকের গায়ে বাইসিক্ল হেলাইয়া রাখিয়া হাতার ভিতর প্রবেশ করিল। শীলা একমনে এতই কাজ করিতেছিল যে, তাহার অভ্যাগম জানিতে পারিল না।
সোমেশের পায়ে রবার-সোল্ জুতা ছিল, তাই সে যখন নিঃশব্দে শীলার পিছনে গিয়া দাঁড়াইল, তখনও শীলা মুখ তুলিয়া চাহিল না। কিন্তু হেঁট হইয়া কাজ করিতেছিল বলিয়াই বোধ হয় তাহার ঘাড় ও কর্ণমূল ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিল।
মিনিট দুই চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া সোমেশ মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। শীলা যেন চমকিয়া মুখ তুলিয়া তাহাকে দেখিতে পাইল; সেও একটুখানি স্বাগত হাসি হাসিয়া বলিল, ‘এই যে! কতক্ষণ এসেছেন?
সোমেশের অধরোষ্ঠ একবার প্রসারিত ও সঙ্কুচিত হইল। সে বলিল, ‘প্রশ্নের উত্তর নিষ্প্রয়োজন। কতক্ষণ এসেছি তা তুমি বিলক্ষণ জান।’
শীলা আবার ঘাড় গুঁজিয়া গোলাপ গাছে মন দিল, যেন সোমেশের কথা শুনিতেই পায় নাই। কিন্তু তাহার মুখ পূর্বাপেক্ষা আরও লাল ও উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। এই লোকটি কথায় কথায় মানুষকে এমন অপ্রস্তুত করিয়া দিতে পারে যে সহসা মুখে কথাই যোগায় না। তাছাড়া, এতদিন সে শীলাকে ‘আপনি’ বলিয়া সম্বোধন করিতেছিল, আজ হঠাৎ কোন প্রকার ভূমিকা না করিয়াই ‘তুমি’ বলিতে আরম্ভ করিয়া দিল দেখিয়া শীলার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করিয়া উঠিল।
শীলার মুখ সোমেশ দেখিতে পাইতেছিল না শুধু তাহার মাথার ঘন চুলের মধ্যে সিঁথির ঋজু রেখাটি সোমেশের চোখের নীচে একটি কাননমধ্যবর্তী সুন্দর বীথিপথের মতো জাগিয়া ছিল। সেই দিকে চাহিয়া চাহিয়া সোমেশ মুখ টিপিয়া একটু হাসিল, তারপর গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘এলো খোঁপা বাঁধলে তোমাকে বেশ দেখায়।’
এবার শীলা মনে মনে ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল, কিন্তু কোনও কথা না বলিয়া গাছ হইতে শুষ্ক পাতাগুলা ছিঁড়িয়া ফেলিতে লাগিল।
সোমেশ হাত বাড়াইয়া একটি আধ-ফুটন্ত ফুল বোঁটাসুদ্ধ ছিঁড়িয়া লইল। শীলা এতক্ষণে একটা সত্যকার সুযোগ পাইয়া ঘাড় বাঁকাইয়া তাহার দিকে ভ্রুকুটিপূর্ণ দৃষ্টি হানিয়া বলিল, ‘আমার গাছ থেকে ফুল ছিঁড়লেন যে?’
সে কথার উত্তর না দিয়া, ফুলের দীর্ঘ আঘ্রাণ গ্রহণ করিয়া সোমেশ বলিল, ‘আঃ! চমৎকার গন্ধ! মার্শালনীল বুঝি?—একবার উঠে দাঁড়াও তো, তোমার খোঁপায় গুঁজে দি।
বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া শীলা বলিল, ‘সোমেশবাবু!’
মৃদু বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সোমেশ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কি হল?’
ক্রুদ্ধস্বরে শীলা বলিল, ‘আজ এ সব আপনি কি বলছেন? জানেন বাবা বাড়ি নেই?’
সোমেশ সহজভাবে বলিল, ‘জানি। তিনি ডন্কুইস্কোটের মতো সাজ করে বেরিয়েছেন, পথে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মাইলখানেক পথ তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে এলুম—তারপর তিনি আবার অশ্বপৃষ্ঠে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তোমাকে খবর দিতে বললেন, আজ তাঁর ফিরতে দেরি হবে। কোথায় নাকি একটি বাঘের সন্ধান পেয়েছেন।’
রাগে শীলা একেবারে নির্বাক হইয়া গেল। ডন্কুইস্কোটের মতো!
সোমেশ পূর্ববৎ বলিতে লাগিল, ‘তোমার বাবার সঙ্গে গল্প করতে করতে একটা মজার ইতিহাস বেরিয়ে পড়ল; আমার বাবা এবং তিনি ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে একসঙ্গে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে ছিলেন,—দু’জনের মধ্যে ঘোর বন্ধুত্ব ছিল। ঠিক করেছি, তোমার বাবাকে এবার থেকে ‘কাকাবাবু’ বলে ডাকব। ইতিমধ্যে একবার ডেকেও নিয়েছি।’
কথা কহিবার ধরন যাহার এইরূপ তাহার প্রতি কতক্ষণ রাগ করিয়া থাকা যায়? কিন্তু শীলা তাহার পুরাতন অভিযোগ উপস্থিত করিয়া বলিল, ‘আপনি কেন আমার গাছের ফুল তুললেন? জানেন, আমার গাছে কেউ হাত দেয় আমি ভালবাসি না?’
সোমেশ কহিল, ‘তুললুম, কারণ গাছের চেয়ে তোমার চুলে এ ফুল ঢের বেশী মানাবে!’
শীলা বলিল, ‘আবার ঐ কথা! দিন্ আমার ফুল আমাকে।’
‘তাইতো দিতে চাইছি। পেছন ফিরে দাঁড়াও।’
‘না, হাতে দিন্। ওটাকে আমি দূর করে ফেলে দেব।’
সোমেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘কখনই হতে পারে না। হয় তোমার চুলে, নয় আমার বুকে। ফেলে দেওয়া অসম্ভব।’
‘বেশ, দরকার নেই আমার।’ বলিয়া শীলা হাতের খুরপী ফেলিয়া দিয়া বাড়ির দিকে যাইতে লাগিল। এত বিরক্ত সে আর কখনও হয় নাই। তাহার বোধ হইল, সোমেশ তাহাকে ইচ্ছা করিয়া রাগাইবার চেষ্টা করিতেছে। একবার তাহার মনে এরূপ সন্দেহও হইল যে, চন্দ্রনাথবাবু বাড়ি নাই জানিয়াই সোমেশ এমন স্পর্দ্ধা প্রকাশ করিতে সাহস করিতেছে। ইহাতে তাহার রাগ আরও বাড়িয়া গেল।
‘দাঁড়াও, একটা কথা আছে।’
শীলা থমকিয়া দাঁড়াইয়া অন্ধকার মুখ ফিরাইয়া বলিল, ‘কি কথা?’
সযত্নে গোলাপ ফুলটি নিজের এণ্ডির কোটের বট্ন্হোলে আটকাইয়া সোমেশ বলিল, ‘তুমি না নাও, আমিই পরলুম। কিন্তু কি সুন্দর ফুলটি দেখ, কেবলি নুয়ে পড়ছে, নরম বোঁটা তার মুখখানি তুলে ধরে রাখছে পারছে না। ঠিক যেন স্নেহভারনত সুকোমল নারী-প্রকৃতি! পুরুষের বুকেই এর যথার্থ স্থান।’ এই কবিত্বপূর্ণ পুষ্পবাণটি নিক্ষেপ করিয়া সোমেশ শীলার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, সহজভাবে বলিল, ‘এগারো মাইল পথ সাইক্ল চালিয়ে এবং তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে তৃষিত হয়ে পড়েছি। সুতরাং কেক এবং চা দিয়ে অতিথির সংবর্ধনা যদি করতে চাও তো এই সুযোগ! অয়মহং ভোঃ!’
অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া শুষ্কস্বরে একটা ‘আসুন’ বলিয়া শীলা বাড়ির দিকে অগ্রসর হইল। সোমেশ তাহার সঙ্গে যাইতে যাইতে বলিল, ‘পুরাকালে দুষ্মন্ত বলে এক পরাক্রান্ত নৃপতি ছিলেন বোধ হয় শুনেছ। মৃগয়া করতে বেরিয়ে তিনি একদিন এমনি একটি তপোবনে এসে উপস্থিত হন। শকুন্তলা তখন তরু আলবালে জলসেচন করছিলেন। অবশ্য, তাঁর সঙ্গে দু’জন সখী ছিলেন—’
উত্ত্যক্ত হইয়া শীলা কহিল, ‘আমি আপনার উপকথা শুনতে চাই না।’
উদারভাবে হাত নাড়িয়া সোমেশ বলিল, ‘আচ্ছা বেশ, তাই হোক্! উপকথা শোনবার এটা সময় নয় বটে’। তারপর এদিক-ওদিক চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কিন্তু তোমার সেই পোষা মৃগশিশুটিকে দেখছি না।’
অধর দংশন করিয়া শীলা চুপ করিয়া রহিল, উত্তর দিল না।
পশ্চিম দিকের ঘন শালবনের অন্তরালে সূর্য ঢাকা পড়িল। শালবন হইতে একটি সুমিষ্ট নির্যাসগন্ধ উত্থিত হইয়া বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইতে লাগিল।
বাংলোর খোলা বারান্দার উপর বেতের চেয়ারে বসিয়া দুই জনে চা-পান সমাপ্ত করিল। শীলা মুখ গম্ভীর করিয়া রহিল। সোমেশ রুমালে মুখ মুছিয়া পকেট হইতে সিগার বাহির করিয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিতেই শীলা বলিয়া উঠিল, ‘ঐ পোড়া গন্ধটা আমি সইতে পারি না।’
সোমেশ তৎক্ষণাৎ মুখের সিগারটা বারান্দার নীচে ফেলিয়া দিল। তারপর পকেট হইতে কুমিরের চামড়ার সিগার-কেসটা লইয়া একে একে সিগারগুলা বাহির করিতে লাগিল। প্রত্যেকটা সিগার ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল। শেষে যখন সবগুলা নিঃশেষ হইয়া গেল, তখন কেস-টা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া সেটাও ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া চেয়ারে হেলান দিয়া বসিল।
শীলা বিস্মিত চোখে তাহার কার্যকলাপ দেখিতেছিল, বলিল, ‘সব ফেলে দিলেন যে!’
অন্যমনস্কভাবে ঊর্দ্ধদিকে চোখ তুলিয়া সোমেশ বলিল, ‘আর খাব না।—ভাল কথা, তোমার বাবার সঙ্গে আর একটা কথা হয়েছিল সেটা বলতে ভুলে গেছি—’
শীলা উঠিয়া গিয়া বারান্দার রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইল। তখন সন্ধ্যার ছায়া ঘনীভূত হইয়া আসিতেছিল, শীলা উদ্বিগ্নস্বরে কহিল, ‘সোমেশবাবু, আজ কি আপনি বাড়ি ফিরবেন না? সন্ধ্যা হয়ে গেল যে।’
সোমেশ সেকথা কানে না তুলিয়া বলিল, ‘তোমার বাবার কাছে আমি আজ প্রস্তাব একটা করেছিলুম; তার উত্তরে তিনি বললেন—’
অধীর হইয়া শীলা বলিল, ‘কিন্তু এদিকে যে রাত্রি হয়ে যাচ্ছে, এতটা পথ অন্ধকারে যাবেন কি করে? দু’দিকে জঙ্গল, রাস্তাও নিরাপদ নয়।’
সোমেশ উঠিয়া শীলার পাশে গিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘আজ রাত্রে আমি এইখানেই থাকব স্থির করেছি। চন্দ্রনাথবাবু নিমন্ত্রণ করেছেন, বাড়িতে দিদিকেও বলা আছে। সে যাক্। তোমার বাবার কাছে আমি আজ যে প্রস্তাব করেছিলুম তার উত্তরে তিনি বললেন, শীলার যদি অমত না থাকে তাঁরও অমত নেই।’
সোমেশের কথার ভঙ্গিতে প্রস্তাবটা যে কি তাহা বুঝিতে শীলার দেরি হইল না। এক ঝলক রক্ত আসিয়া তাহার মুখখানা আরক্ত করিয়া দিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনও বিরূপ হইয়া বসিল।
জোর করিয়া যথাসাধ্য সহজ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি প্রস্তাব আপনি করেছিলেন শুনি?’
তাহার একখানা হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া সোমেশ বলিল, ‘এই পাণি গ্রহণ করবার আবেদন জানিয়েছিলুম।’
তাচ্ছিল্যভরে হাসিয়া শীলা হাত ছাড়াইয়া লইল, বলিল, ‘ওঃ এই প্রস্তাব। তা বাবা ঠিকই জবাব দিয়েছেন; আমার মত তো তিনি জানেন না।’
অবিচলিতভাবে সোমেশ বলিল, ‘আমি তাঁকে জানিয়ে দিয়েছি যে তোমার অমত নেই।’
‘কি! আপনি বাবাকে বলেছেন—’ ক্রোধে, বিরক্তিতে শীলার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। সে অধর দংশন করিয়া বলিল, ‘আপনি অনধিকার চর্চা করেছেন। কোন্ সাহসে আমার সম্বন্ধে এ ধৃষ্টতা প্রকাশ করলেন?’
সোমেশ গম্ভীরভাবে বলিল, ‘এই সাহসে যে আমি তোমায় ভালবাসি আর তুমিও আমায় ভালবাস!’
তীব্র অবজ্ঞার স্বরে শীলা বলিয়া উঠিল, ‘আপনি ভুল করেছেন। নিজের সম্বন্ধে আপনার ধারণা খুব উচ্চ হতে পারে, কিন্তু আমি আপনাকে সাধারণ পাঁচজনের সঙ্গে সমান করেই দেখি।’
সোমেশ বলিল, ‘মিথ্যে কথা। আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাস।’
শীলা উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। বিদ্রূপভরা সুরে বলিল, ‘আচ্ছা সোমেশবাবু, আপনার কি বিশ্বাস আপনার মতো যোগ্য ব্যক্তি পৃথিবীতে আর নেই?’
সোমেশ বলিল, ‘তুমি যদি অমন করে হাস তাহলে আমি লোভ সামলাতে পারব না।’
ভ্রূভঙ্গি করিয়া শীলা বলিল, ‘তার মানে?’
‘তার মানে—এই।’ বলিয়া হঠাৎ শীলার দুই হাত ধরিয়া টানিয়া আনিয়া সোমেশ তাহার অধরে চুম্বন করিয়া ছাড়িয়া দিল।
ক্ষণকালের জন্য শীলা একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেল। তারপর বাঁ হাতের পিঠ দিয়া ঠোঁট দুটা মুছিতে মুছিতে, ডান হাতে সজোরে সোমেশের গালে এক চড় বসাইয়া দিয়া পিছু সরিয়া দাঁড়াইল। তাহার দুই চোখ দিয়া যেন আগুন ছুটিয়া বাহির হইতে লাগিল।
চড় খাইয়া সোমেশের গালে চারি আঙ্গুলের দাগ লাল হইয়া ফুটিয়া উঠিল। কিন্তু সে হাসিমুখেই বলিল, ‘আমি অহিংসা ব্রতধারী—গান্ধীজীর শিষ্য। বাঁ গালে চড় মার্লে ডান গাল ফিরিয়ে দিতে—’
চাপা গর্জনে শীলা বলিয়া উঠিল, ‘আপনি যান্—যান্ এখান থেকে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা কইবার যোগ্য নন্ আপনি। এই দণ্ডে এই বাড়ি থেকে বিদায় হোন।’
এবার সোমেশের কণ্ঠস্বরে একটু পরিবর্তন হইল। সে যেন ভিতরের আঘাত গোপন করিতে করিতে বলিল, ‘কিন্তু বলেছি তো, আজ রাত্রে আমি এখানেই থাকব, চন্দ্রনাথবাবু নিমন্ত্রণ করেছেন—’
শীলা ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, ‘তিনি না জেনে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, নইলে আপনার মতো লোককে কেউ জেনেশুনে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে না।’
সোমেশ চুপ করিয়া অনেকক্ষণ বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর আস্তে আস্তে বলিল, ‘কিন্তু এদিকেও রাত হয়ে গেছে। পথও বলছিলে নিরাপদ নয়—’
কণ্ঠস্বরে তীব্র গরল ভরিয়া শীলা বলিল, ‘আপনি খাঁটি বাঙালী বটে। অসহায় স্ত্রীলোককে অপমান করতে পারেন কিন্তু শেয়ালের ভয়ে পথে বার হতে পারেন না।’
কথাগুলা সাঁওতালী তীরের মতো সোমেশের বুকে গিয়া বিঁধিল। অন্ধকারে তাহার মুখ ভাল দেখা গেল না, কিন্তু তাহার গলার পরিবর্তন এবার শীলার কানেও ধরা পড়িল। তথাপি সোমেশ হাল্কা ভাবেই কথা বলিতে চেষ্টা করিল, ‘আমি খাঁটি বাঙালী তা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু শেয়ালের অপবাদটা ভিত্তিহীন, কোনও খাঁটি বাঙালীই শেয়ালকে ভয় করে না। সে যাক্। এখন তাহলে বেরিয়ে পড়ি, এগারোটার মধ্যেই বোধ হয় বাড়ি পৌঁছতে পারব। তোমার বাবাকে বলে দিও আজ থাকতে পারলুম না।’ একটু থামিয়া বলিল, ‘আর,—যদি ভুল বুঝে অপমান করে থাকি মাপ করো।’ বলিয়া সোমেশ ধীরে ধীরে নামিয়া গেল।
অন্ধকারে একাকী দাঁড়াইয়া শীলা শুনিতে পাইল, ফটক খুলিয়া সোমেশ বাহিরে গেল, বাহির হইতে ফটক বন্ধ করিয়া দিল, তারপর সাইক্লখানা হাতে করিয়া লইয়া একবার ঘন্টি বাজাইয়া তাহাতে আরোহণ করিয়া চলিয়া গেল। সাইক্লের সঙ্গে বাতি ছিল না।
শীলা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে গিয়া একখানা চেয়ারে বসিয়া পড়িল। ঘড়িতে ঠং ঠং করিয়া আটটা বাজিল।
গালে হাত দিয়া বসিয়া বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া তাকাইয়া শীলা একবার শিহরিয়া উঠিল। এগারো মাইল পথ! সঙ্গে একটা দেশলাই পর্যন্ত নাই।
ঘরের ভিতর চাকর আলো দিয়া গিয়াছিল, দাসীটা আসিয়া একবার জিজ্ঞাসা করিয়া গেল, শীলা কাপড় ছাড়িবে কিনা। কিন্তু শীলা কিছুই শুনিতে পাইল না। দৃষ্টিহীন চক্ষু বাহিরের দিকে মেলিয়া পাষাণ মূর্তির মতো বসিয়া রহিল।
বাহিরে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনা গেল এবং পরক্ষণেই হাঁকডাক করিয়া চন্দ্রনাথবাবু বাড়ি ফিরিলেন। সহিস আসিয়া ঘোড়া লইয়া গেল। হ্যাট কোট ইত্যাদি খুলিয়া চাকরের হাতে দিয়া চন্দ্রনাথবাবু বারান্দায় আসিয়া বসিলেন। চায়ের গরম জল তৈয়ার ছিল, শীলা নীরবে চা প্রস্তুত করিতে লাগিল।
মুখ হাত ধুইয়া চা পান করিতে করিতে চন্দ্রনাথবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সোমেশ এসেছিল—চলে গেছে?’
শীলা নতনেত্রে বলিল, ‘হ্যাঁ।’
চন্দ্রনাথবাবু কন্যার মুখের দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিলেন কিন্তু ও-বিষয়ে আর কোনও প্রশ্ন করিলেন না। একথা-সেকথা আলোচনা করিতে করিতে বলিলেন, ‘একটা ম্যান্ইটার বেরিয়েছে। মাইল বারো চৌদ্দ দূরে সাঁওতালদের গাঁয়ে উৎপাত করছিল, কয়েকটা লোককে নিয়েও গিয়েছিল। এখন সাঁওতালদের তাড়া খেয়ে এদিকে পালিয়ে এসেছে। রাস্তার ধারে ধারে অনেকদূর পর্যন্ত তার থাবার দাগও দেখলুম, কিন্তু বাঘটার সন্ধান পাওয়া গেল না। কাল জঙ্গল বীট্ করিয়ে তাকে বার করতে হবে।’
ঠিক এই সময়ে বহুদূর দক্ষিণ হইতে ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট শব্দ আসিল—‘ফেউ! ফেউ!’
ফেউয়ের ডাক যে পূর্বে শুনে নাই সে কল্পনাও করিতে পারে না যে একটা দুর্দান্ত বাঘের পশ্চাতে একপাল শৃগাল ল্যাজ উঁচু করিয়া যাইতে যাইতে এমন মানুষের মতো গলা বাহির করিয়া চিৎকার করে। শীলা এ ডাক বহুবার শুনিয়াছে, তাই তাহার সর্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া কাঁপিয়া উঠিল! সোমেশ যে ঐ পথেই গিয়াছে! সে ভয়-ব্যাকুল স্বরে বলিয়া উঠিল, ‘বাবা, ঐ শোন!’
চন্দ্রনাথবাবু তাহার বিবর্ণ মুখ লক্ষ্য না করিয়া সহজভাবে বলিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলুম, বাঘটা ঐ দিকেই আছে।’ তিনি সহিসকে ডাকিয়া পালিত পশুগুলাকে সাবধানে রাখিতে হুকুম করিয়া দিলেন।
সমস্ত দিন অশ্বপৃষ্ঠে ঘুরিয়া চন্দ্রনাথবাবু ক্লান্ত হইয়াছিলেন, সকাল সকাল আহারাদি শেষ করিয়া শুইয়া পড়িলেন। শীলাও শুইতে গেল।
ঘরের ঘড়িতে যখন রাত্রি এগারোটা বাজিয়া গেল, তখন শীলা নিঃশব্দে নিজের বিছানা হইতে উঠিল। পিতার ঘরের দ্বারের কাছে গিয়া শুনিল, তিনি গভীর নিদ্রায় নাসিকাধ্বনি করিতেছেন। সাবধানে দরজা খুলিয়া শীলা বাহিরে আসিল। ঊর্ধ্বে তখন এক আকাশ নক্ষত্র দপ্দপ্ করিতেছে, তাহারই অস্পষ্ট আলোতে সে বাংলো হইতে নামিয়া সহিসের ঘরের দিকে গেল। সহিসের ঘরে তখনও আলো জ্বলিতেছিল এবং ভিতর হইতে একটা অস্ফুট কাতরোক্তির শব্দ আসিতেছিল। শীলা আস্তে আস্তে কবাটে টোকা মারিয়া ডাকিল, ‘ঝিমন!’
ঝিমন জাগিয়াছিল, বাহিরে আসিয়া শীলাকে দেখিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেল, ‘দিদি, তুমি এত রাত্রে এখানে!’
শীলা চুপিচুপি বলিল, ‘ঝিমন, তোমাকে একটি কাজ করতে হবে। এখনি টম্টম্ জুতে আমাকে নিয়ে শহরে যেতে হবে।’
ঝিমন ফ্যালফ্যাল করিয়া তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া শেষে বলিল, ‘কি বলছ, দিদি! এই রাত্তিরে—’
শীলা বলিল, ‘হ্যাঁ, এই রাত্রে, এখনি। তোমাকে দশ টাকা বখশিশ্ দেব। আর দেরি করো না, এখনি যেতে হবে।’
ঝিমন ব্যাকুল হইয়া বলিল, ‘কিন্তু কেন, দিদি, কেন? এত রাত্রে শহরে কি এমন দরকার?’
শীলা কম্পিতস্বরে কহিল, ‘সে কথায় কাজ নেই, ঝিমন; কিন্তু আজ আমাকে যেতেই হবে। জানি না শহর পর্যন্ত যাবার দরকার হবে কিনা।’
ঝিমন চিন্তা করিয়া কহিল, ‘ঘোড়া যে ভারী থকে আছে, দিদি, সে কি যেতে পারবে?’
‘পারবে। তাকে এক বোতল মদ খাইয়ে দাও।’
ঝিমন তখন বলিল, ‘কিন্তু আমি যে কিছুতেই যেতে পারব না, দিদি। নুনুয়ার মা’র ব্যথা উঠেছে, আজ রাত্রেই ছেলে হবে। তাকে একলা ফেলে কি করে যাব?’ ঝিমন কাতর দৃষ্টিতে শীলার মুখের পানে তাকাইয়া রহিল।
পাঁচ মিনিট স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া অবশেষে শীলা বলিল, ‘বেশ, তোমাকে যেতে হবে না। তুমি কেবল টম্টম্ জুতে রাস্তায় এনে দাও—আমি একাই যাব। কিন্তু দেখো শব্দ করো না। বাবা জেগে উঠ্লে আর যাওয়া হবে না।’
ভোর হইতে আর বিলম্ব নাই;—পূর্বদিকে একটা পাংশু শ্বেতাভা ক্রমশ পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে, গাছপালার অস্ফুট মূর্তি পারিপার্শ্বিক স্বচ্ছতার মধ্যে জমাট অন্ধকারের মতো দেখাইতেছে। সোমেশ নিজের বাড়ির গাড়ি-বারান্দার নীচে ক্যাম্প খাট পাতিয়া ঘুমাইতেছিল, পায়ের দিকে একপ্রকার অস্বস্তি অনুভব করিয়া জাগিয়া উঠিল। তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া চক্ষু মুছিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার হৃৎস্পন্দন প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেল।
সে দেখিল, মাটির উপর নতজানু হইয়া বসিয়া, তাহার পায়ের উপর উপুড় হইয়া মাথা রাখিয়া, পায়ের একটি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া শীলা ঘুমাইতেছে।
অতি সন্তর্পণে পা ছাড়াইয়া লইয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ শীলার ঘুমন্ত মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বিপুল স্নেহে তাহাকে বুকের কাছে তুলিয়া আনিয়া কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া মৃদুস্বরে ডাকিল, ‘শীলা! শীলা!’
ঘুমন্ত শীলা চোখ না খুলিয়াই উত্তর দিল, ‘উঁ।’
বাড়ির দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল না, ভেজানো ছিল মাত্র। সোমেশ শীলাকে লইয়া নিজের ঘরে বিছানার উপর শোয়াইয়া দিল। তারপর দিদির ঘরে গিয়া দিদির গা ঠেলিয়া চুপিচুপি বলিল, ‘দিদি, ওঠ। শীলা এসেছে—আমার ঘরে ঘুমুচ্ছে। তুমি তাকে দেখো। আমি চন্দ্রনাথবাবুকে খবর দিতে চললুম।’ বলিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া বাহির হইয়া গেল।
১৪ ভাদ্র ১৩৩৮