অরণ্যে

অরণ্যে

স্থান বাংলা দেশ, কাল বর্তমান, বেলা আন্দাজ সাড়ে নয়টা। বনের মধ্যে একটি ভাঙা বাড়ি। বাড়িটি পাকা, কিন্তু বহুদিনের অব্যবহারে অত্যন্ত জীর্ণ ও শ্রীহীন হইয়া পড়িয়াছে। এই বাড়িতে একটিমাত্র বাসোপযোগী ঘর; দেওয়ালের চটা উঠিয়া গিয়াছে, মেঝে অসমতল, উপরে একটা বরগা এক দিক খুলিয়া বিপজ্জনকভাবে ঝুলিয়া আছে। ঘরের দুইটি জানালার কবাটের কব্জা ঢিলা হইয়া গিয়া আপনা-আপনি খুলিয়া আছে—তাহার ভিতর দিয়া রৌদ্রোজ্জ্বল বৃক্ষসমাকীর্ণ বহিঃপ্রকৃতি ফ্রেমে বাঁধানো সুন্দর নিসর্গচিত্রের মতো দেখা যাইতেছে। ঘরের মধ্যস্থলে একটি নড়বড়ে টেবিল ও চারি পাশে চারিখানি কাঠের জীর্ণ চেয়ার। ঘরের কোণে তিনটি মাঝারি আয়তনের স্টীল ট্রাঙ্ক উপরা-উপরি করিয়া রাখা আছে। একটা কাঠের কবাট-যুক্ত দেওয়াল-আলমারি ঈষৎ খোলা অবস্থায় ভিতরে রক্ষিত অনেকগুলি টেনিস বলের মতো জিনিস কিঞ্চিন্মাত্র প্রকাশ করিতেছে। একটা বিছানা দেওয়ালের কাছে গুটানো রহিয়াছে। টেবিলের উপর সিগারেটের টিন ও দেশলাইয়ের বাক্স।

দুইটি চেয়ারে দুইজন লোক বসিয়া আছে। প্রথম ব্যক্তি একটি প্রাচীন গলিতপ্রায় ইংরেজী সংবাদপত্র মুখের সম্মুখে ধরিয়া পাঠ করিতেছে। দ্বিতীয় ব্যক্তি চেয়ারে হেলান দিয়া টেবিলের উপর সন্তর্পণে পা তুলিয়া মৃদুমন্দ হাসিতেছে ও একটি গানের কলি গুঞ্জন করিতেছে। তাহার বয়স তেইশ-চব্বিশ, অল্প পাতলা গোঁফ আছে, মুখখানি চমৎকার ধারালো, বড় বড় স্বপ্নাতুর চোখ, মাথার চুল দীর্ঘ ও ঈষৎ কোঁকড়ানো। তাহাকে দেখিয়া কবিপ্রকৃতির বলিয়া মনে হয়।

যুবক অলসভাবে অর্ধনিমীলিত নেত্রে গুঞ্জন করিতেছিল,–
        পাগলা মনটারে তুই বাঁধ।

কিছুক্ষণ কাটিবার পর প্রথম ব্যক্তি সংবাদপত্র নামাইয়া টেবিলের উপর রাখিল, তখন তাহার মুখ দেখা গেল। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ; মুখখানা ভারী, কিন্তু মাংসল নয়, গোঁফদাড়ি কামানো। চিবুক অত্যন্ত চওড়া, ভ্রূর উপরের অস্থি উঁচু, ভ্রূ প্রায় কেশহীন। নাক মোটা, অথচ অস্থিময়। চোখ ছোট ও তীক্ষ্ণ—হাঁ বড়। রঙ লালচে গৌরবর্ণ। পিরানে ঢাকা দেহের ঊর্ধ্বভাগ যতটা দেখা যাইতেছে, চওড়া ও মজবুত।

সিগারেটের টিন হইতে একটি সিগারেট লইয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিয়া লোকটি ঊর্ধ্বদিকে ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল, সংস্কারের কৈঙ্কৰ্য্যই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বন্ধন।

দ্বিতীয় লোকটি গান থামাইয়া স্বপ্নভরা চোখ তুলিল, বলিল, নিশ্চয়। সংস্কারের কৈঙ্কৰ্য্য কাকে বলে?

প্রথম : এটা ভাল, ওটা মন্দ, এই সংস্কার। এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া চাই তবেই সত্যিকারের মুক্তি পাবে।

দ্বিতীয় : (একটু চিন্তা করিয়া) বুঝলুম। কিন্তু আমরা যে মুক্তির পথে চলেছি, সেটা হবে কি?

প্রথম : সেটা ছোট মুক্তি, কতকগুলো অনাবশ্যক দুঃখ আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেইগুলো ঘাড় থেকে নামাতে চাই।

দ্বিতীয় : কিন্তু তা নামাবার দরকার কি? একেবারে আসল খাঁটি মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেই তো হয়।

প্রথম : তা হয় না। পায়ে কাঁটা বিঁধে থাকলে দৌড়তে পারবে না। আগে কাঁটা টেনে বার কর, তারপর শরীর ধাতস্থ হলে খাঁটি মুক্তির পেছনে দৌড় দিও।

দ্বিতীয় : তাহলে, যতদিন কাঁটা না বেরুচ্ছে, ততদিন ভাল-মন্দর জ্ঞান অর্থাৎ সংস্কার-কৈঙ্কৰ্য্য রাখতে হবে?

প্রথম : সংস্কারের কিঙ্কর হবার দরকার নেই, লৌকিকভাবে তাকে মেনে চললেই যথেষ্ট। যেমন আমি নিকটিনের কিঙ্কর নই, তবু সিগারেট খাচ্ছি।

দ্বিতীয় : (সহাস্যে টেবিল হইতে পা নামাইল। সন্তর্পণে একটা সিগারেট ধরাইল) আমি কিন্তু ভাল লাগে বলেই সিগারেট খাই।

প্রথম : কাজেই সিগারেট না পেলে তোমার কষ্ট হবে।

দ্বিতীয় : তা তো হবেই, হয়ও। কিন্তু কষ্ট সহ্য করি। বিরহী যেমন প্রিয়ার বিরহ সহ্য করে, তেমনই ভাবে হাহুতাশ করতে করতে সহ্য করি।

প্রথম : এই বিরহের ক্লেশ তোমার থাকত না, যদি মিলনের আকাঙ্ক্ষাকে মনে পোষণ না করতে।

দ্বিতীয় : হায় হায় দাদা, মিলনের আশাটাই যদি ছেড়ে দিই, তাহলে বাঁচব কিসের জোরে? দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যদি না নামে, বক্ষের দরজায় তাহলে বন্ধুর রথ থামবে কেন? বিচ্ছেদ-বেদনার পূর্ণ পাত্রটি হাতে অর্পণ করা যে হবে না। 

প্রথম : করবার দরকার হবে না ভাই। বিচ্ছেদের বেদনাই যদি না থাকে; মিলনের আগ্রহও সেইসঙ্গে উবে যাবে।

দ্বিতীয় : [মাথা নাড়িয়া] আমি তা চাই না, বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নহে, অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ।

প্রথম : অর্থাৎ তুমি বৈষ্ণব হতে চাও, ন্যাড়ানেড়ীর দল।

দ্বিতীয় : না দাদা, বৈষ্ণব হতে চাই না, আমি মুসলমানই থাকতে চাই। কিন্তু তারও ওপরে আমি বাঙালী, বাঙালীর ধর্মই আমার ধর্ম। বাঙালী মুক্ত হতে চায় না দাদা, বাঙালী সুখী হতে চায়।

প্রথম : তাইতেই তো সর্বনাশ হয়েছে।

দ্বিতীয় : হোক সর্বনাশ। সুখী হবার একান্ত চেষ্টাতেই একদিন বাঙালী এ সর্বনাশকে কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু তোমার উপদেশ শুনে সে যদি কেবল উপনিষদের ভূমাকে কামড়ে পড়ে থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত তাকে ভূমার বদলে ভূমিকেই কামড়ে পড়ে থাকতে হবে।

প্রথম : তোমার কথা যে একেবারে মানি না, তা নয়। তবে ভয় হয়, পাছে অতি ছোট সুখ পেয়েই মন তৃপ্ত হয়ে থাকে, আরও বড় জিনিসের প্রতি আগ্রহ কমে যায়।

দ্বিতীয় : কমবে না, সে ভয় নেই দাদা। হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব-এ লোভ দিন দিন বেড়েই চলবে।

প্রথম : কিন্তু সেটাও তো ভাল নয়।

দ্বিতীয় : সে কথা তখন বল, যখন অপর্যাপ্ত সুখের নেশায় বুঁদ হয়ে আমরা প্রকৃত সুখ কি তা ভুলে যাব। এখনও তার সময় হয়নি। এখন–[সুরে] প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।

এই সময় ভেজানো দরজা ঠেলিয়া একটি মেয়ে ঘরে প্রবেশ করিল। পরিধানে আটপৌরে কালাপেড়ে শাড়ি ও সেমিজ, পা খালি। মেয়েটি কালো, দীর্ঘাঙ্গী, ঈষৎ কৃশ। বয়স উনিশ কিংবা। কুড়ি। চোখ দুইটি হরিণের মতো আকর্ণবিশ্রান্ত। মাথার ঘন চুল এত কোঁকড়া যে, করবীবদ্ধ অবস্থাতেও মাথার উপর আঁকাবাঁকাভাবে ঢেউ খেলাইয়া গিয়াছে। দেহ নিরাভরণ, কেবল গলায় একটি সরু সোনার হার আছে। মেয়েটি সুন্দরী নয়, কিন্তু তাহার চোখের দৃষ্টির মধ্যে এমন একটা শক্তি সমাহিত আছে যে, দেখিলেই তাহাকে অসামান্য বলিয়া বোধ হয়।

গান শেষ হইলে সে বলিল, দেবদা, চা খাবে? রান্না নামতে এখনও ঘণ্টা দুই দেরি আছে। জামালদা, তুমি খাবে?

জামাল : [চেয়ার হইতে লাফাইয়া উঠিল] দাদা, এমন অপূর্ব কথা কখনও শুনেছ? কণাদিদি, এ কি শোনালে? গায়ে যে আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে! [সুরে] কি কহব রে সখি আনন্দ ওর

দেবব্রত : জামাল, তুমি একটা আস্ত পাগল। শান্ত হয়ে বস, পাগলামি কর না।

জামাল : পাগলামি করব না? আলবৎ করব। এতেও যদি পাগলামি না করি, তাহলে করব। কিসে? আমার গন্ধর্ব-নৃত্য নাচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু একলা তো ঠিক হবে না, দাদাকেও অনুরোধ করা বৃথা। অতএব কণাদিদি, তুমি এস।

কণা : আমি এখন নাচতে পারব না, আমার অনেক কাজ।

জামাল : অ্যা! নাচের চেয়ে কাজ বড় হল? বেশ, তাই তোক, তাহলে নাচব না। কিন্তু দিদি, তোমার সংসারে চা আছে, এ খবর আগে দাওনি কেন?

কণা : আগে দিলে কি ফুর্তি হত?

জামাল : [মহা উল্লাসে ঠিক। দাদা! বেদান্ত-দাদা! তোমার বেদান্ত এবার রসাতলে গেল। কণাদিদি কি বললে, তা শুনতে পেলে? শুনতে পেলেও বুঝতে পারলে? যদি না বুঝে থাক, বুঝিয়ে দিচ্ছি।

দেবব্রত : জামাল, তুমি একটা

জামাল : পাগল। ও প্রসঙ্গ একবার হয়ে গেছে, সুতরাং পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। আমি জানতে চাই, তুমি কণাদিদির কথার গূঢ় মর্মবাণী বুঝতে পেরেছ কি না?

দেবব্রত : পেরেছি। তুমি এখন ক্ষান্ত হও, নয়তো এই দণ্ডে এ ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হও। কণা এতক্ষণ স্মিত মুখে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল। সে এবার জোরে হাসিয়া উঠিল।

কণা : জামালদার মনের ভাব তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, উচি চা খাবেন। আর তুমি দেবদা? খাবে নাকি?

দেবব্রত : খাব, দিও এক পেয়ালা। কিন্তু জামাল, তুমি ওকে কণা বলে ডেকো না, অগ্নি বলে ডেকো।

জামাল : [শান্ত হইয়া বসিল] ওকে আমার কণাদিদি বলতেই ভাল লাগে।

দেবব্রত : কিন্তু ওর নাম অগ্নি। ও আমাদের আগুন, সাক্ষাৎ অগ্নিদেবতা। ওকে কথা বললে ওর মহিমা খাটো করা হয়।

জামালঃ যে আগুন আমাদের বুকের মধ্যে আছে, ও তারই ফুলকি, তাই ওকে কণা বলি। তা ছাড়া ওর নাম শুধু অগ্নি নয়, অগ্নিকণা। অন্যকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু আমার কাছে ও অন্ধকার রাত্রে আগুনের ফুলকির মতো, শুধু আনন্দের দেবতা, দাহনের নয়।

দেবব্রত : দেখ জামাল, তোমার প্রাণটা বড় বেশি ভাবপ্রবণ। ওটা এ পথে ভাল নয়। ভাবপ্রবণতা কাজের ক্ষতি করে।

জামাল : কে বললে, ক্ষতি করে? আমার প্রাণে যদি ভাবের উন্মাদনা না থাকত, একটা idea যদি আমাকে পাগল করে না দিত, তাহলে আমি সংসারী হতুম দাদা, এ পথে আসতুম না। কিন্তু যাক ওসব বাজে কথা। এখন কথা হচ্ছে, শ্রীমতী অগ্নিকণা দেবী দিদিঠাকুরানীকে কণা বলা যেতে পারে কি না? দাদা বলছেন, বলা উচিত নয়। কণা, তুমি কি বল?

কণা : [ভাবিয়া] আচ্ছা, তুমি একবার আমাকে অগ্নি বলে ডাক তো জামালদা।

জামাল : [গাম্ভীর্য-বিকৃত কন্ঠে] অগ্নি!

অগ্নি : উঁহু, মোটেই ভাল শুনতে হল না। তোমার মুখে কণাই মিষ্টি শোনায়। দেবদার মুখে যেমন অগ্নি মানায়, তোমার মুখে তেমনই কণা।

জামাল; বাস্। শুনলে তো? রফা হয়ে গেল। এখন তুমি অগ্নি বলে ডাক, আমি কণা বলে ডাকি। দুজনে মিলে পুরো পিতৃদত্ত নামটি পাওয়া যাবে।

দেবব্রত : অগ্নিকণা কি ওর পিতৃদত্ত নাম?

জামাল : তবে?

দেবব্রত : ওর পিতৃদত্ত নাম জানি না; ও কখনও বলেনি। বোধ হয় আমাদের দলের কেউ জানে।

অগ্নি : একজন জানে।

                                                                                            প্রস্থান করিল

         দেবব্রত ও জামাল কিছুক্ষণ বিস্মিতভাবে দরজার দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর দুইজনেই নীরবে সিগারেট ধরাইল। প্রায় পাঁচ মিনিট কোন কথা হইল না।

         জামাল : [দগ্ধাবশেষ সিগারেট ফেলিয়া দিয়া] দাদা, এখানে তো তিন দিন হয়ে গেল। আর কতদিন?

         দেবব্রত : আজ রাত্রি বারোটার সময় পরেশ আর ভবতোষ আসবে। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রগুলি জিম্মা করে দিয়ে তারপর আমাদের ছুটি। থাকতে ইচ্ছে করলে থাকতে পার, কিন্তু না থাকলেও ক্ষতি নেই।

জামাল : পরেশ আর ভবতোষ আজ রাত্রে আসবে। কিন্তু তারা অতগুলো রিভলবার আর বোমা নিয়ে যেতে পারবে? ভারী তো কম নয়, প্রায় দুমণ।

দেবব্রত : পারবে। কারণ তারা চাষা সেজে বলদ সঙ্গে করে আসবে।

জামাল : ও। [কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া] তাহলে কাল সকালে আমি বেরিয়ে পড়ি। কুমিল্লার কাজটা তো আমারই ওপর পড়েছে। আগে থাকতে গিয়ে জায়গাটা দেখে শুনে রাখা যাক।

দেবব্রত : বেশ, যাও। অগ্নিও তোমার সঙ্গে যাক। তোমাদের এখনও কেউ চেনে না, সন্দেহও করে না, সুতরাং নিরাপদে যেতে পারবে। আমি আর অখিল আপাতত এইখানেই রইলুম : অন্তত যতদিন না আমার ভাল করে দাড়ি গজায়, ততদিন থাকতেই হবে। আমি একেবারে মার্কামারা, দেখলেই ধরবে।

জামাল : তা বেশ, তোমরা থাক। এ জায়গাটার ওরা বোধ হয় এখনও সন্ধান পায়নি।

দেবব্রত : তাই তো মনে হয়। [ঈষৎ উৎকণ্ঠিতভাবে জানালার বাহিরে তাকাইয়া] আজ অখিলের ফিরতে বড় দেরি হচ্ছে।

জামাল : হ্যাঁ। বোধ হয় বেচারা গাঁয়ে মাছ পায়নি, তাই একেবারে মাছ ধরিয়ে নিয়ে আসছে। আজ প্রতিজ্ঞা করে বেরিয়েছিল, যেমন করে হোক মাছ নিয়ে তবে ফিরবে। কণাও বোধ হয় মাছের অপেক্ষায় রান্না চড়াতে দেরি করছে।

দেবব্রত : তাই হবে বোধ হয়।

জামাল : আচ্ছা দাদা, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ?

দেবব্রত : কি?

জামাল : অখিল আর কণার মাঝখানে কেমন একটা দূরত্ব আছে, ওরা ভাল করে মেশে না। কণা আমাদের সকলকে দাদা বলে, কিন্তু অখিলকে অখিলবাবু বলে।

দেবব্রত : হু। অখিল বড় আত্মসমাহিত গম্ভীর, কারুর সঙ্গে ভাল করে মেশবার তার ইচ্ছেও নেই, ক্ষমতাও নেই; ও শুধু কাজে ড়ুবে থাকতে চায়। তা ছাড়া মেয়েমানুষ সম্বন্ধে ওর মনে একটা সঙ্কোচ আছে, তাদের ঠিক আপন করে নিতে পারে না।

জামাল : তা হতে পারে। কিন্তু কণা তাকে দূরে রাখে কেন?

দেবব্রত : অগ্নি কাউকে দূরে রাখে না, কাছেও টানে না। ও হচ্ছে আগুন, ওর প্রভা শুধু আমাদের পথ দেখাবার জন্যে।

জামাল : না দাদা, অগ্নি শুধু পথ দেখায় না, পথে চলবার প্রেরণাও আনে। আমার এক এক সময় মনে হয়, ও আমাদের এই মুক্তিসাধনার বীজমন্ত্র, স্নেহে তরল অথচ কর্তব্যে কঠিন, সেবায় নারী কিন্তু বুদ্ধিতে পুরুষ, সত্যের মতো নির্লিপ্ত আবার সৌন্দর্যের মতো মোহময়ী। যে আদর্শ এই আনন্দময় মৃত্যুর পথে আমাদের বার করেছে, অগ্নি হচ্ছে তার প্রতিমা।

দেবব্রত : তোমার কবিত্ব বাদ দিলে যা থাকে, অগ্নি তাই বটে।

জামাল : কিন্তু তবু অখিলের সম্পর্কে ওকে দেখলে কেমন খটকা লাগে। মনে হয়, যেন অগ্নির সহজক্রিয়া কাচের চিমনিতে ঢাকা পড়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল।

দেবব্রত : ও তোমার বোঝবার ভুল। আসলে অখিল সর্বদা নিজের প্রাণের মধ্যে স্বতন্ত্র হয়ে থাকে, তাই অমন মনে হয়। কিন্তু দরকারের সময় ওদের মধ্যে কোন ব্যবধানই থাকবে না জেনো।

 জামাল : সে আমি জানি। কিন্তু তবু অখিলের জন্যে দুঃখ হয়। এত একাগ্র, এত তন্ময় যে আশেপাশে তাকাবার ওর যেন সময় নেই—এমন আশ্চর্য জীবনটাকে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করতে পেলে না।

দেবব্রত : জীবন উপভোগ করবার প্রণালী সকলের এক নয় জামাল।

জামাল : তাই হবে বোধ হয়। নইলে আজ আমরা চারটি প্রাণী এই জঙ্গলের মধ্যে পড়ো বাড়িতে বসে লাল চালের ভাত আর আলুনি তরকারি খাচ্ছি কেন?

দুটি কলাই করা সাদা বাটিতে চা লইয়া অগ্নি প্রবেশ করিল। টেবিলে রাখিতেই জামাল একটা বাটি টানিয়া লইয়া এক চুমুক পান করিয়া মুখ চোখাইল।

জামালঃ আঃ। কণা, তুমি হচ্ছ স্বর্গের সাকী; আজ যা খাওয়ালে, এ চা নয়, খাঁটি নির্জলা অমৃত—যা সাগর মন্থন করে উঠেছিল। দাদার নিরাকার পরব্রহ্মের অবস্থা, চিনি ও চিটাতে সমজ্ঞান; কাজেই ওঁর কাছ থেকে প্রশংসা প্রত্যাশা কর না। উনি হয়তো বলবেন, চিনি কম হয়েছে, কিংবা একেবারেই বাদ পড়েছে। কিন্তু তাতে কি আসে যায়! অমৃতে চিনি মেশালে কি বেশি সুস্বাদু হয়?

অগ্নি : জামালদা, এইজন্যেই তোমাকে খাইয়ে এত সুখ হয়। চিনি ছিল না তাই দিতে পারি নি-দুধও টিনের। দেবদা, চা খারাপ হয়েছে? [দেবব্রত এমনভাবে ঘাড় নাড়িল, যাহার অর্থ হাঁ না—দুই হইতে পারে] দাঁড়াও, আমার চা-ও নিয়ে আসি। ভাত চড়িয়ে দিয়েছি, এখনও ফুটতে দেরি আছে।

                                                                                    প্রস্থান করিল।

দেবব্রত : অখিলের আজ বড় দেরি হচ্ছে।

জামাল : ও কিছু নয়—মাছ। যখন প্রতিজ্ঞা করে বেরিয়েছে, তখন না নিয়ে ফিরবে না।

অগ্নি চায়ের বাটি লইয়া প্রবেশ করিল ও একটা চেয়ারে বসিল।

অগ্নি : দেবদা, আজ রাত্রে তো ওরা এসে জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যাবে—তারপর?

দেবব্রত : তারপর তোমাকে নিয়ে জামাল বেরিয়ে পড়বে, আমি আর অখিল আপাতত এখানেই থাকবো।

অগ্নি : তোমাদের অন্য কোনও কাজ আছে নাকি?

দেবব্রত : না, দাড়ি গজানো ছাড়া আর কোনও কাজ নেই।

অগ্নি : জামালদা তো কুমিল্লায় যাবে। আর আমি?

দেবব্রত : তুমিও!

অগ্নি : আমার কাজ?

দেবব্রত : উপস্থিত চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। যথাসময়ে খবর পাবে।

অগ্নি : [চিন্তা করিল] আপাতত মেয়ে-ইস্কুলে মাস্টারি নিতে পারি?

দেবব্রত : তা পার। কিন্তু দরকার হলেই যাতে ছেড়ে আসতে পার, সে পথ খোলা রেখো।

অগ্নি : বেশ। আর কোনও হুকুম আছে?

দেবব্রত : না।

একটি লোক ঘরে প্রবেশ করিল। শ্যামবর্ণ, মুখে গোঁফ ও অযত্ন-বর্ধিত খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল রুক্ষ ও ঝাঁকড়া; ইতরশ্রেণীর লোক বলিয়া মনে হয়, চেহারা দেখিয়া বয়স অনুমান করা কঠিন, পঁচিশ হইতে ত্রিশের মধ্যে যেটা খুশি হইতে পারে। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত; হাঁটু পর্যন্ত কাপড়, নগ্ন পদ। মলিন গামছার এক প্রান্তে বাঁধা সওদা কাঁধ হইতে নামাইয়া মাটিতে রাখিল, তারপর চেয়ারে আসিয়া বসিল। জামালের বাটিতে তখনও আধ বাটি চা ছিল। নিঃশব্দে তুলিয়া লইয়া পান করিল। তারপর সিগারেট ধরাইল।

তিনজনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহার পানে চাহিয়া রহিল।

দেবব্রত : অখিল, পুলিস সন্ধান পেয়েছে?

অখিল সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল। জামাল শিস দিবার মত মুখভঙ্গি করিল। অগ্নি নিষ্পলক নেত্রে অখিলের পানে তাকাইয়া রহিল। দেবব্রতের চোয়ালের হাড় শক্ত হইয়া উঠিল।

দেবব্রত : কখন আসছে?

অখিল : তারা গাঁ থেকে বেরিয়েছে দেখে এসেছি। খুব সাবধানে আসছে, তাই এসে পৌঁছুতে ঘণ্টাখানেক দেরি হতে পারে।

দেবব্রত : দিশী পুলিস?

অখিল : জন কুড়ি আর্মড পুলিস, আর সঙ্গে গ্রিফিথ।

দেবব্রত : গ্রিফিথ?

অখিল : হ্যাঁ, গ্রিফিথ।

কিছুকাল সকলে নীরব।

জামাল : [উঠিয়া] এমন সুযোগ আর হবে না। দাদা, আজ দ্বিতীয় বালেশ্বরের যুদ্ধ দেখিয়ে দেওয়া যাক। কি বল অখিল? [দেওয়াল-আলমারি হইতে রিভলবার লইয়া টোটা ভরিতে লাগিল।]

অগ্নি : আমারও তাই মত, কিন্তু অখিলবাবুর কি মনে হয়?

অখিল উত্তর না দিয়া কেবল ঘাড় নাড়িল।

দেবব্রত : পালাবার এখনও অনেক সময় আছে, কিন্তু পালালে চলবে না, তাহলে সমস্ত বোমা রিভলবার পুলিসের হাতে পড়বে। এগুলো নিয়ে পালানোও সম্ভব নয়। তাছাড়া পরেশ আর ভবতোষ আজ রাত্রে আসবে। তারা তো খবর জানে না; আর খবর দেবার সময়ও নেই।

সকলে চিন্তিতমুখে ভাবিতে লাগিল। জামাল রিভলবারে টোটা ভরিতে লাগিল। কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল।

দেবব্রত : [সহসা মুখ তুলিয়া] এক উপায় আছে। জামাল, এদিকে এস, মন দিয়ে শোন।

জামাল আসিয়া বসিল।

দেবব্রত : জামাল, তুমি মুসলমান, অগ্নিকেও কেউ চেনে না। তোমরা দুজনে এখানে থাক, আমি আর অখিল আড়াল হই।

জামাল : ঠিক বুঝলুম না দাদা, আর একটু স্পষ্ট করে বল।

দেবব্রত সম্মুখে ঝুঁকিয়া দ্রুত অনুচ্চ কণ্ঠে বলিতে লাগিল। চারিটি মাথা কিছুক্ষণ একত্র হইয়া রহিল। শেষে দেবব্রত চেয়ারে ঠেস দিয়া বসিল।

দেবব্রত : কি বল? এ ছাড়া অস্ত্রগুলো বাঁচাবার আর কোনও উপায় নেই।

অগ্নি ও অখিলের মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হইল। তারপর দুইজনেই ঘাড় নাড়িয়া দেবব্রতের প্রস্তাবে সায় দিল।

জামাল : [বাঁকিয়া বসিয়া] আমি পারব না।

দেবব্রত : [বিস্ফারিত নেত্রে] পারবে না?

জামাল : না। আমি কণাকে দিদি বলেছি।

দেবব্রত : ছিঃ জামাল! ও সব কুসংস্কারের কি এই সময়?

জামাল : আমি পারব না।

দেবব্রত : জামাল, তুমি আমার হুকুম অমান্য করছ?

জামাল : (হস্তস্থিত রিভলবার দেবব্রতের সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া] তার শাস্তি নিতে আমি তৈরি আছি।

দেবব্রত : [রিভলবার তুলিয়া লইয়া] হুকুম মানবে না?

জামাল : না, পারব না। অগ্নি আমার দিদি, আমার বোন। ওর গায়ে আমি ওভাবে হাত দিতে পারব না।

দেবব্রত : বেশ, তবে তৈরি হও।

জামাল : [হাসিয়া] আমি তৈরি আছি।

দেবব্রত : [রিভলবার ফেলিয়া দিয়া] Fool! গাধা! আহাম্মক! অভিনয় করতে পারবে না?

জামাল : কেন? তুমি কিংবা অখিল অভিনয় কর না।

দেবব্রত : আমাদের যে মানাবে না। গ্রিফিথ পাকা ওস্তাদ, একবার দেখেই ধরে ফেলবে।

জামাল : তোমাকে ধরতে পারে কিন্তু অখিলকে পারবে না। আমাদের মধ্যে মুসলমানের মতো চেহারা যদি কারও থাকে তো সে অখিলের।

দেবব্রত অখিলের দিকে চাহিল। অখিল নিঃশব্দে দাড়িতে হাত বুলাইতে লাগিল।

জামাল : ঐ দাড়ি কামিয়ে যদি থুতনির কাছে একটু নূর রেখে দাও, কার সাধ্য বলে যে অখিলের নাম জামালুদ্দিন মিঞা নয়।

দেবব্রত : অখিল, আর সময় নেই। কি বল?

অখিল : [অগ্নির দিকে ফিরিয়া] কি বল?

অগ্নি : [হাসিয়া উঠিয়া] কপালের লেখা কেউ খণ্ডাতে পারে না। আমার ভয়ে ঘর ছাড়লে তবু নিস্তার নেই। কি আর করবে বল?

অখিল : [দাঁড়াইয়া সনিশ্বাসে] আমি রাজী।

জামাল : [উৎসুকভাবে] ব্যাপারটা কি বল তো? কেমন যেন হেঁয়ালির মতো ঠেকছে।

অখিল : [ঈষৎ হাসিয়া] এক কথায় বলা যাবে না। যদি বেঁচে থাকি, আজ রাত্তিরে বলব! এখন চটপট সরে পড়, তারা এতক্ষণ এসে পড়ল।

অগ্নি : তোমাদের আজ খাওয়া হল না জামালদা।

জামাল : তা না হোক। অখিল, আমার বাক্সে লুঙ্গি আছে, ক্ষুর আয়না চিরুনি সব পাবে। আচ্ছা, চললুম, রাত্রে আবার দেখা হবে। চল দাদা।

দেবব্রত : একটা কথা মনে রেখো অখিল, গ্রিফিথ ভয়ানক ধড়িবাজ, আর সে বাংলা জানে।

                                                                            উভয়ে প্রস্থান করিল

অখিল ক্ষুর ইত্যাদি বাহির করিয়া দাড়ি কামাইতে বসিল। অগ্নি দেওয়াল-আলমারি খুলিয়া অস্ত্রগুলা সাবধানে তাকের পিছনে সরাইয়া রাখিয়া, তারপর একটা মশারি তাহার উপর চাপা দিল। চেয়ারগুলা ও টেবিল একপাশে সরাইয়া দিয়া মেঝেয় বিছানা পাতিল। ঘরটাকে গুছাইয়া রান্নাঘর অভিমুখে প্রস্থান করিল। কিয়ৎকাল পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, অখিল ক্ষৌরকর্ম শেষ করিয়া লুঙ্গি ও গোলাপী রঙের গেঞ্জি পরিয়াছে, মাথা তৈলসিক্ত করিয়া চুল আঁচড়াইতেছে।

অখিল : কেমন দেখাচ্ছে?

অগ্নি : বেশ। [মুখ টিপিয়া হাসিয়া] আমাকে ফেলে পালিয়ে আসার ফল পেলে তো?

অখিল : পেলুম।

অগ্নি : কেন পালিয়েছিলে, বল তো? ভেবেছিলে, আমি তোমায় বাধা দোব?

অখিল : তখন তো তোমাকে এমন করে চিনিনি।

অগ্নি : এখন চিনেছ?

অখিল : চিনেছি।

অগ্নি : এখন কেমন মনে হচ্ছে?

অখিল : মনে হচ্ছে, পালিয়ে এসে ভালই করেছিলাম।

অগ্নি : [কাছে আসিয়া] কেন বল দেখি?

অখিল : [অগ্নিকে জড়াইয়া লইয়া] তা না হলে তোমাকে যে এমন করে পেতুম না রানী।

অগ্নি : [কণ্ঠলগ্না] আমিও যে তোমাকে এমন করে পাব, তা কে জানত? সব আশা ছেড়ে দিয়েই তো বেরিয়েছিলুম।

কিছুক্ষণ এইভাবে দুইজনে দাঁড়াইয়া রহিল।

অখিল : [সুখস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উৎকৰ্ণভাবে] ওরা এসে পড়েছে—এস। শয্যার উপর অগ্নি শয়ন করিল; অখিল তাহার পাশে কাত হইয়া কনুইয়ে ভয় দিয়া শুইয়া মৃদু স্বরে কথা কহিতে লাগিল ও মাঝে মাঝে তাহার অধর চক্ষু চুম্বন করিতে লাগিল। অগ্নিও থাকিয়া থাকিয়া তাহার গলা ধরিয়া টানিয়া তাহার ওষ্ঠে চুম্বন করিতে লাগিল।

অতি সন্তর্পণে দরজা ঠেলিয়া একজন মিলিটারী বেশধারী সাহেব প্রবেশ করিল, তাহার হাতে রিভলবার। ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে ঘরের চারিদিকে দেখিয়া লইয়া কড়া সুরে বলিয়া উঠিল, Hands upboth of you. Youre under: arrest.

অখিল ও অগ্নি ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। অগ্নি চিৎকার করিয়া উঠিল, ওমা, আমি কোথা যাব? এ যে সায়েব!

অখিল : [ভয়কম্পিত স্বরে] তাই তো দেখছি। Who—who are you?

গ্রিফিথ : You put your hands up first, or my gun might go off. [অখিল দুই হাত তুলিল] Ask your companion to do the same.

অখিল : হাত তোল–সায়েব বলছে। [অগ্নি হাত তুলিল]

গ্রিফিথ : Thats good. হুকুম সিং।

জনৈক জমাদার প্রবেশ করিল।

গ্রিফিথ : Handcuff লাগাও। [হুকুম সিং হাতকড়া লাগাইল] Now search the man. মরদকা অঙ্গা-ঝাড়ি করো। [হুকুম সিং তাহাই করিল] Nothing there? All right!

অগ্নি : ওগো, কি হবে? আমাদের কি বেঁধে নিয়ে যাবে?

অখিল : কি জানি, হয়তো তোমার বাবা পুলিসে খবর দিয়েছেন।

গ্রিফিথ : [চেয়ারে বসিয়া] Now come and sit down here in fornt of me. [দুইজনে ভয়ে ভয়ে চেয়ারে বসিল] Thats right. Now tell me who you are.

অগ্নি : ওগো, সায়েব কি বলছে? আমাদের মেরে ফেলবে না তো? আমার যে বড্ড ভয় করছে। [কাঁদিতে লাগিল]

গ্রিফিথ : Ask your friend to be quiet.

অখিল : কণা, চুপ কর, সায়েব রাগ করছে।

গ্রিফিথ : Whats your name?

অগ্নি : ওগো, নাম জিজ্ঞাসা করছে নাকি? দোহাই তোমার, নিজের নাম বল না।

অখিল : [অধর লেহন করিয়া] My name is—অনিলকুমার রায়।

গ্রিফিথ : [মাথা নাড়িয়া] Its no use, young man, come out with the real one. And let me tell you, I know Bengalee. আমি বাংলা জানি।

অগ্নি : ওমা, কি হবে—সায়েব বাংলা জানে! [মাথায় কাপড় টানিবার চেষ্টা করিল। অখিল মুঢ়বৎ বসিয়া রহিল।]

গ্রিফিথ : এবার আসল নামটি বল তো দেখি।

অখিল : সায়েব, আমার আসল নাম মহম্মদ জামালুদ্দিন।

গ্রিফিথ : জামালুদ্দিন! Who is this young lady then?

অখিল : [থতমত] উনি—উনি আমার স্ত্রী।

গ্রিফিথ : মিথ্যে বল না— She is a Hindu girl. [অগ্নিকে] তোমার সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ?

অগ্নি : [লজ্জারুদ্ধ কণ্ঠে] সায়েব, আমি ওর সঙ্গে—ওর সঙ্গে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।

গ্রিফিথ : [শিস দিয়া] I see! I see! কোথায় তোমার ঘর?

অগ্নি : সায়েব, আমায় মেরে ফেল, কেটে ফেল, কিন্তু ও কথা মুখ দিয়ে বার করতে পারব না। নিজে যা করবার করেছি, বাবার মুখে কালি লাগাতে পারব না।

গ্রিফিথ : [অখিলকে] তোমার বাড়ি কোথায়?

অখিল : চব্বিশ পরগনায়। এর বেশী বলতে পারব না।

গ্রিফিথ : এই জঙ্গলের মধ্যে তোমরা কি করছ?

অখিল : লুকিয়ে আছি-তোমাদের ভয়ে।

গ্রিফিথ : [হাসিতে লাগিল] Well you are a nice pair of lovers! হুকুম সিং, handcuff খোল দেও।

হুকুম সিং হাতকড়া খুলিয়া দিল।

অগ্নি; সায়েব, আমাদের ছেড়ে দিলে? আমাদের ধরে নিয়ে যাবে না?

গ্রিফিথ : I was after bigger game. তোমাদের মতো চুনোপুঁটির খোঁজে তো আমি আসিনি। আমি খবর পেয়েছিলাম, একদল বিপ্লবী–terorist এখানে লুকিয়ে আছে।

অখিল : [সভয়ে] বিপ্লবী! সায়েব, আমরা তার কিছু জানি না। আজ তিন দিন হল, আমরা এখানে আছি। আমি ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি, এই আমার অপরাধ। বিপ্লবীদের আমি জানি না।

গ্রিফিথ : It seems I was misinformed-ভুল খবর পেয়েছিলাম। But in any case, আমি তোমাদের জিনিসপত্র তল্লাস করে দেখতে চাই।

অগ্নি : দেখ সায়েব, দেখ, আমাদের বাক্স-প্যটিরা যেখানে যা আছে সব দেখ। আমরা নিরপরাধ। 

গ্রিফিথ : Very good. হুকুম সিং, তোম লোগ সবকোই মিলকে দুসরা দুসরা ঘর খানাতল্লাস করো। [হুকুম সিং প্রস্থান করিল] Now let us see what you have got here.

                                                                                     [উঠিল]

অখিল : [অগ্নির নিকট হইতে চাবি লইয়া] এই নাও সায়েব, চাবি।

গ্রিফিথ সতর্ক চক্ষে ঘরের চারিদিকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে একবার ঘরটা প্রদক্ষিণ করিল। দেওয়াল-আলমারির কবাট খুলিয়া দেখিল, একটি মশারি গুটানো রহিয়াছে।

গ্রিফিথ : Whats this? A mosquito net?

অখিল : Yes sir. This jungle is very full of mosquitoes.

অগ্নি : সায়েব, চা খাবেন?

গ্রিফিথ : চা–tea? No, thank you. this is not my time for tea. দরকার নেই।

অগ্নি : না সায়েব, এক পেয়ালা খেতেই হবে, তোমার নিশ্চয় তেষ্টা পেয়েছে। আমি এখুনি তৈরি করে এনে দিচ্ছি।

গ্রিফিথ : [ইতস্তত করিয়া] well, if it is no trouble to you, young lady. দাও এক পেয়ালা।

অগ্নি : [কৃতজ্ঞভাবে] আচ্ছা সায়েব, এখুনি আনছি। আপনি আমাদের ওপর এত দয়া করলেন, এটুকুও যদি আপনার জন্যে না করি, তাহলে মনে বড় দুঃখ হবে।

                                                                                 প্রস্থান করিল

গ্রিফিথ : [কতকটা নিজ মনে] A pretty siren! Just the sort that finds home dull and dreary. [বাক্স খুলিয়া দেখিতে লাগিল। সর্বশেষের বাক্স হইতে একটি বোতল তুলিয়া লইল] Bless me! Whats this?

অখিল : [সাগ্রহে] মদ সায়েব, খাবে?

গ্রিফিথ : By all thats but why didnt you tell me? This is real stuff—whisky!

অখিল : একদম ভুলে গিয়েছিলুম সাহেব, তোমার তাড়া খেয়ে কিচ্ছু মনে ছিল না। খাবে?

গ্রিফিথ : Sure we shall take a sip together, though its not the time. Tell the young lady she neednt make tea. This will do. Bring three glasses.

অখিল : Very well সায়েব। কাচের গেলাস তো নেই, বাটি আনছি।

                                                                                 প্রস্থান করিল

গ্রিফিথ : [চাবির গোছা-সংলগ্ন কর্কস্ত্রু দিয়া বোতল খুলিতে খুলিতে] They seem to be all right. Just an ordinary case of elopement. But still,—there is something wrong somewhere. What is it? (চিন্তা করিয়া) Well, I shall test the girl. is she takes the whisky and can stand it, I shall know what to think. A good Hindu girl will never stand whisky.

তিনটি বাটি লইয়া অগ্নি ও অখিলের প্রবেশ। গ্রিফিথ প্রত্যেক বাটিতে একটু করিয়া মদ ঢালিল।

গ্রিফিথ : [অগ্নিকে] I suppose you are used to it? অভ্যাস আছে তো?

অগ্নি মৃদু হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।

গ্রিফিথ : No soda I believe? Well, it doesnt matter. I prefer it raw. Heres to you! [পান করিল]

অখিল : To you! [অগ্নি ও অখিল পান করিল।

গ্রিফিথ : [অগ্নিকে] How do you like it? কেমন মনে হচ্ছে?

অগ্নি : চমৎকার সায়েব। আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।

গ্রিফিথ : Good Lord! নাচতে ইচ্ছে করছে! But theres no time for that, Iam afraid. [সহাস্যে মাথা নাড়িল]

হুকুম সিং প্রবেশ করিল।

হুকুম সিং : হুজুর, কঁহি কুছ নহি মিলা।

গ্রিফিথ : Oh well, never mind. I didnt expect you would find anything. হুকুম সিং, বিলকুল ঝুঁট খবর মিলা। অব লৌট চলো।

হুকুম সিং : হুজুর!

গ্রিফিথ : Well, so long. Wish you both a very good time.

অখিল : Thank you sir.

অগ্নি : সায়েব, যাচ্ছেন? [জোড়হাত করিয়া] সায়েব, আমাদের প্রাণের ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের ধরে নিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তবু দয়া করে ছেড়ে দিলেন। আপনাকে আর কি বলব—থ্যা–থ্যাঙ্ক ইউ।

গ্রিফিথ : Dont thank me, young lady, rather thank your own luck that I am after bigger game. [টুপি তুলিয়া] Goodbye! But look here. You must clear out of this place as quickly as you can. [আঙুল তুলিয়া] If ever I come back and find you here still, I shall surely send you up. Good day!

অখিল : Good day.

গ্রিফিথ দ্বার পর্যন্ত গিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

গ্রিফিথ : [অর্ধস্ফুট স্বরে] Lord! Four chairs! [ফিরিয়া] By the way, there is none else with you?

অখিল : না সায়েব, কেবল আমরা দুজন।

গ্রিফিথ : No servant or anything of the sort?

অখিল : না সায়েব।

গ্রিফিথ : All right! Ta ta.

                                                                                প্রস্থান করিল

অগ্নি ও অখিল শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বাহিরে হুকুম সিং-এর গলা শুনা গেল—ফর্ম ফোর্স, রাইট টার্ন, কুইক মার্চ, জুতার মশমশ শব্দ ক্রমে দূরে মিলাইয়া গেল।

অগ্নি : [কম্পিত কণ্ঠে হাসিয়া] ওগো, আমায় একবার ধর। মাথাটা ঘুরছে।

অখিল : মাথা ঘুরছে? [অগ্নিকে জড়াইয়া ধরিল]।

অগ্নি : [বুকে মাথা রাখিল] মদ গিলেছি, মনে নেই?

পটক্ষেপ

দ্বিতীয় দৃশ্য

সেই ঘর। গভীর রাত্রি। টেবিলের উপর একটি লণ্ঠন জ্বলিতেছে। দেবব্রত, জামাল ও অগ্নি তিনটি চেয়ারে গালে হাত দিয়া বসিয়া আছে। যেন কাহারও প্রতীক্ষা করিতেছে।

অখিল প্রবেশ করিয়া বসিল।

দেবব্রত : পরেশ ভবতোষ চলে গেল?

অখিল : হ্যাঁ, তাদের বনের ধার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলুম।

দেবব্রত : যাক, এখন নিশ্চিন্দি। [সিগারেট ধরাইল]

জামাল : যাক। কণাদিদি, এখন আসল কথাটা হোক। এতদিন ফাঁকি দিয়েছ, এখন গল্পটা বল।

অগ্নি : কোন গল্প?

জামাল : তোমার আর অখিলের গল্প।

অগ্নি : [অখিলের দিকে ফিরিয়া] তুমি বল।

অখিল : বলবার বিশেষ কিছু নেই। কণা আমার বউ। তবে পুরোপুরি নয়—আধখানা।

জামাল : হেঁয়ালি রাখ-সব কথা খুলে বল।

অখিল : এক শহরেই আমাদের বাড়ি। যখন ইস্কুলে পড়তুম তখন থেকেই ওর সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক ছিল।

জামাল : অর্থাৎ তখন থেকেই ভালবাসা জন্মেছিল।

অখিল : ভালবাসা! কি জানি! যে জন্যে লোকে ভালবাসে-রূপ—তা ওর কস্মিনকালেও ছিল। না।

অগ্নি : আর তুমি বুঝি নবকার্তিক ছিলে?

অখিল : না। চেহারায় দুজনেই পরস্পরকে টেক্কা দিতুম, এখনও দিচ্ছি; কিন্তু তা নয়। ওকে ভালবাসতুম কি না বলতে পারি না, তবে ওর একটা প্রবল আকর্ষণ ছিল। আর মনে মনে ওকে একটু ভয় করতুম।

জামাল : আর কণাদিদি, তুমি?

অগ্নি : অমন নীরস লোককে কেউ ভালবাসতে পারে? তুমিই বল।

জামাল : তা পারে না, তবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারে—যেমন তুমি বেরিয়েছ। তারপর?

অখিল : ক্রমে দুজনে বড় হলুম। আমার মন দুদিকে টানতে লাগল—এক দিকে কণা আর এক দিকে দেশ। ভাল কথা, ওর নাম অগ্নি নয়, ওর সত্যিকারের নাম কনক। যাক, তারপর—অর্থাৎ একদিন—ভাবার সময় পেলুম না—আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। যেন নেশার ঘোরে বিয়ে করে ফেললুম। যেদিন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলুম, সেদিন চোখ থেকে হঠাৎ ঠুলি খসে পড়ল। বুঝলুম, যে বাড়িতে কণা আছে, সে বাড়িতে থেকে আমি অন্য কিছু করতে পারব না, আমার মনের সে জোর নেই। ওর মনের পরিচয় তখনও পাইনি; শুধু ওর একটুখানি হাসি দেখে ওর ভালবাসার ইসারা পেয়েছিলুম—তাই ভয় আরও বেড়ে গেল। কণা, মনে আছে?

অগ্নি : হুঁ।

অখিল : তখনও কুশণ্ডিকা হয়নি। সেই অবস্থাতেই ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে চম্পট দিলুম। পিছু ফিরে তাকালুম না, পিছু ফিরলে আর যেতে পারতুম না। তারপর দু বছর কেটে গেল। শেষে একদিন হঠাৎ বরিশালের মিটিং-এ কণার দেখা পেলুম। ও তখন আমাদের মধুচক্রের মক্ষিরানী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর থেকে সবই তোমরা জান।

জামাল : হুঁ। কণাদিদি, এবার তোমার তরফটা শুনি।

অগ্নি : আমার তরফে শোনবার কিছুই নেই। বড় হয়ে অবধি ওঁর সঙ্গে দেখা বড় একটা হত না, যদিও এক পাড়াতেই বাড়ি, কখনও কদাচিৎ দেখা হলে উনিও কথা কইতেন না, আমিও না। কিন্তু তবু, ওঁর মনের গতি কোন্ দিকে, তা আমি বুঝতে পেরেছিলুম। কি করে বুঝেছিলুম জানি না, বোধ হয় ভালবাসার যিনি ভগবান তিনিই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তাই নিজেকে ওঁর উপযুক্ত করে তৈরি করতে লাগলুম, ভাবলুম দুজনে মিলে কাজ করব। তারপর বিয়ে হতে না হতেই উনি নিরুদ্দেশ হলেন।

পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর অন্ধকার যখন হালকা হল, তখন ভাবলুম, তাতেই বা ক্ষতি কি? উনি যে পথে গিয়েছেন, আমিও তো স্বাধীনভাবে সেই পথে যেতে পারি।

মন ঠিক করতে কিছুদিন গেল। তারপর আমিও একদিন কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লুম।

কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। জামালের চোখ আনন্দের স্বপ্নে আচ্ছন্ন, অগ্নি নিজের মনের অতলে তলাইয়া গিয়াছে, দেবব্রত পাহাড়ের মতো নিশ্চল, অখিল অন্যমনস্কভাবে বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া আছে।

জামাল : [উঠিয়া দাঁড়াইয়া] আজ আমাদের কণাদিদির ফুলশয্যা। দাদা, আমরা এখানে কেন? চল, বনে বনে ঘুরে বেড়াইগে।

দেবব্রত : [উঠিয়া দাঁড়াইয়া] ঠিক কথা। অখিল, অগ্নি, এতদিন আমি তোমাদের মোড়ল নেতা কর্তা গুরু, যা বল ছিলুম; মনে ভাবতুম, মোড়ল হওয়ার অধিকার আমার আছে। আজ সে পদবী আমি ত্যাগ করলুম। তোমরা দুজনে আজ থেকে আমাদের গুরু হলে। এখন কি করব হুকুম কর।

অখিল ও অগ্নি দেবব্রতকে প্রণাম করিল।

অখিল : দাদা, আপাতত আমাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ করে দাও।

দেবব্রত : সে কি?

অখিল : কুশণ্ডিকা হয়নি যে।

দেবব্রত : পাগল! কুশণ্ডিকায় তোমাদের দরকার নেই। তোমাদের বিয়ে-সত্যিকারের বিয়ে—অনেক আগে হয়ে গেছে।

অখিল : তা হোক দাদা, তবু তুমি বিয়ে দাও। তুমি পণ্ডিত মানুষ, তোমার মুখ থেকে দুটো সংস্কৃত শ্লোক শুনলেই প্রাণটা ঠাণ্ডা হবে। জানি, তুমি বলবে—অন্ধ সংস্কারের কৈঙ্কৰ্য্য। কিন্তু আজ দুপুর থেকে প্রাণে শান্তি পাচ্ছি না। কণার শরীরটাকে নিয়ে যে ভাবে– না দাদা, তুমি যা হোক দুটো মন্ত্র আউড়ে দাও—অগ্নিদেবতা তো সামনেই রয়েছেন।

                                                                 লণ্ঠনের দিকে ইঙ্গিত করিল।

দেবব্রত : বেশ, তোমাদের যখন ইচ্ছে, তখন তাই হোক। কিন্তু কুশণ্ডিকার মন্ত্র তো জানি না। শুধু আধখানা শ্লোক মনে আছে, তাও নবেল পড়ে শেখা। আচ্ছা, তাতেই হবে। অগ্নি, তুমি অখিলের হাত ধর, ওর মুখের দিকে চেয়ে বল—ওঁ মমব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু, মমচিত্তং অনুচিত্তং তেহস্তু।

অগ্নি : ওঁ মমব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু, মমচিত্তং অনুচিত্তং তেহস্তু।

দেবব্রত : অখিল, তুমি বল।

অখিল : ওঁ মমব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু, মমচিত্তং অনুচিত্তং তেহস্তু।

দেবব্রত : ব্যস, হয়ে গেল। আমার মন্তরের পুঁজি ফুরিয়েছে।

জামাল : এবার সিঁদুর। এই সময় কপালে সিঁদুর দিতে হয় না?

সকলে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিল।

দেবব্রত : সিঁদুর তো নেই।

জামাল : দাদা, শুনেছি সেকালে যবনের আঙুল কেটে রাজা রানীর কপালে রাজটীকা পরানো হত। সিঁদুর যখন নেই, তখন সেই ব্যবস্থাই হোক। যবন তত উপস্থিত আছে। [ছুরি দিয়া আঙুল কাটিয়া অগ্নির কপালে রক্তের ফোঁটা দিল। অগ্নি জামালের পদধূলি লইল।]

জামাল : [আঙুল চুষিতে চুষিতে] যাক, শুভকর্ম শেষ। অখিল, Congratulations! কণা, চিরায়ুষ্মতী হও। দাদা, চল এবার আমরা অন্তর্হিত হই।

অখিল : সত্যিই যাবে? অগ্নি জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল।

জামাল : আলবাৎ যাব। দাদা, আর দেরি নয়, বরকনে কি রকম অধীর হয়ে পড়েছে, দেখছ তো? বর যদি বা মুখ ফুটে বললেন, সত্যিই যাবে? কনের মুখের কথাটি নেই। [প্রস্থানোদ্যত] শুধু একটা জিনিসের অভাব বোধ হচ্ছে—এই সময় রোশনচৌকি থাকত!

বাহিরে বন্দুকের আওয়াজ হইল। জানালার বাহিরের অন্ধকার হইতে গ্রিফিথের কণ্ঠস্বর শুনা গেল।

গ্রিফিথ : Hands up, young lady. Dont move, I have you covered.

অগ্নি ধীরে ধীরে হাত তুলিল। ঘরের মধ্যে মিনিটখানেক অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করিতে লাগিল। তারপর অখিল মৃদুকণ্ঠে হাসিল।

অখিল : জামাল, রোশনচৌকি খুঁজছিলে না? বাজন্দাররেরা এসে পড়েছে। একেবারে গোরার ব্যান্ড।

দেবব্রত : যাক, এই ভাল। আমাদের কাজ হয়ে গেছে, এখন মরলেও ক্ষতি নেই। [আলমারির ভিতর হইতে রিভলবার লইয়া অখিল ও জামালকে দিল]

গ্রিফিথ : [বাহির হইতে] Do you surrender?

দেবব্রত : [গর্জন করিয়া] No, damn you!

অখিল : দাদা, আমাদের দোষ। গ্রিফিথ যে বুঝতে পেরেছে, তা আমরা ধরতে পারিনি।

দেবব্রত : কিছু আসে যায় না অখিল। একদিন তো মরতেই হবে, আজ হলেই বা ক্ষতি কি?

গ্রিফিথ : [বাহির হইতে] Listen you! We have surrounded you, you cant escape. If you dont surrender, we shall kill you all and I shall begin with the lady.

জামাল : No, you wont. তা কি হয় সায়েব? কণা, আমি তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি সরে যেও। [জামাল পাশ হইতে বিদ্যুদ্বেগে কণার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল; কণা সরিয়া গেল। বাহিরে বন্দুকের আওয়াজ হইল! বুকে গুলি খাইয়া জামাল জানালার সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া পড়িল।

জামাল : [উচ্চ হাস্য করিয়া পরিষ্কার কন্ঠে] A miss, Griffith! Now take that and that and that [গুলি ছুঁড়িতে চুড়িতে জামালের মৃতদেহ মাটিতে এলাইয়া পড়িল]

দেবব্রত : জামাল তো গেল। অখিল, এবার আমাদের পালা।

তখন দুই জানালা দিয়া ঘরে ধারার ন্যায় গুলি বর্ষিত হইতে লাগিল। দেবব্রত ও অখিল জানালার নীচে লুকাইয়া বাহিরে গুলি ছুঁড়িতে লাগিল। অগ্নি টোটা সরবরাহ করিতে লাগিল।

দেবব্রত প্রথম পড়িল।

দেবব্রত : অগ্নি, যাই—

অগ্নি : এস দাদা [দেবব্রতের মৃত্যু]

অখিল : কণা, আমিও [চিৎ হইয়া পড়িল]

অগ্নি : [তাহার মুখের উপর মুখ রাখিয়া] চললে? চললে? একটু অপেক্ষা করতে পারবে না? একসঙ্গে যেতুম।

অখিল : কণা—এস-[মৃত্যু]

কণা উঠিয়া দাঁড়াইল। অখিলের হাত হইতে রিভলবার লইয়া নিজের খোঁপার মধ্যে খুঁজিয়া দিল।

কণা : [উচ্চকণ্ঠে] I surrender. আমি ধরা দিচ্ছি।

গ্রিফিথ : [বাহির হইতে] What about the others?

কণা : তারা কেউ বেঁচে নেই।

গ্রিফিথ : Good! Throw down your gun. বন্দুক ফেলে দাও।

কণা : আমার বন্দুক নেই—টোটাও ফুরিয়ে গেছে।

গ্রিফিথ : Good! [বন্দুক হস্তে দ্বার দিয়া প্রবেশ করিয়া] All the same, you put your hands up. Thats right. So you were four after all. You played me a pretty trick this morning, young lady. But I saw through it all right. Now I suppose you are coming quiety with me.

কণা : On the contrary, Griffith, it is you who are coming quietly with me.

গ্রিফিথ : Eh! What do you mean coming quietly with you?

কণা : গ্রিফিথ! শুধু আমরা যাব—তুমিও যাবে না?

কণা চুলের ভিতর হইতে ক্ষিপ্রহস্তে রিভলবার বাহির করিল। দুইজনে একসঙ্গে বন্দুক হুঁড়িল। গ্রিফিথ পড়িল।

কণা টলিতে টলিতে অখিলের বুকের উপর গিয়া পড়িল। অখিলের গলা ভাল করিয়া জড়াইয়া লইয়া তাহার বুকের উপর মাথা রাখিতেই তাহার প্রাণ বাহির হইয়া গেল।

২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *