০৯. সেলাইয়ের কল

উৎপলার সেলাইয়ের কলটা অনেক দিন ধরে পড়ে ছিল-অবিশ্যি অযত্নে নয়—জিনিসের যত্ন করে সে কিন্তু অব্যবহারে। কলটার ঢাকনি সাফ করা, ঢাকনি খুলে ঝেড়েপুছে ঝকঝক করে রাখা—হাতে কাজ না থাকলে এটা তার খুবই সোহাগের কাজ।

এক দিন সকালবেলা পাশের ভাড়াটেদের একটি ছোট্ট মেয়ে এসে বললে, পলা মাসিমা, আপনার সেলায়ের কল আছে?

আমি যে তোমার মাসিমা, তা তোমাকে কে বললে?

মেয়েটি উৎপলার দিকে টলটল করে তাকিয়ে রইল–কোনো কথা বললে না।

মাল্যবান বললে, আঃ, ওকে আর ও-রকম শুখোচ্ছ কেন?

কোনো দিন এদের গাজও দ্যাখ্যা যায় না, উৎপলা বললে, আজ কল নেবার সময় পলা মাসিমা! আচ্ছা।

মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ফ্রকের কাপড় তুলে চিবোতে লাগল।

তুমি কার মেয়ে গা?

মেয়েটি তার বাবার নাম বললে।

ও, সেজোগিন্নির মেয়ে তুমি বুঝি? মেয়েটি চিবোনো কাপড়ের এক কিনার থেকে দাঁত বের করে বললে, হ্যাঁ।

উৎপলা মাল্যবানের দিকে তাকিয়ে বললে, সব জল ভরে গড়ায় কি-না। ওপরওয়ালার কল এমিই নড়ে। এই সেজো গিন্নিই তো এক দিন বলেছিলেন, কলকাতার জল সোনার দরে বিকোয় না-কি। খুব মনে আছে আমার। সে-কথা আমি ভুলব কোনো দিন।

কী লাভ ও-সব মনে রেখে!

না, না, তুমি কেন মনে রাখতে যাবে। তোমার দরদে তো মলম ঘষা হচ্ছিল সেজো বৌয়েয় সেদিন আমাকে তাবায় চড়িয়ে–

তাঁবায় চড়ালেই কি ফোস্কা পড়ে?

তা আমাদের পড়ে! এই রকম কথা শুনলে গায়ে জলবিছুটির জ্বালা হয়। ইশ!

মেয়েটির দিকে তাকিয়ে উৎপলা বললে, তোমরা কে হে বাপু, পাশের ভাড়াটে ঘরে থাকো; তোমাদের আমরা খাই না পরি, তোমাদের তেউড়ি খেসারির খেত মাড়াই, না, বকের বিষ্ঠা দিয়ে বড়ি-খেসারি মেখে দিয়ে ভোগা দিই—তোমার মা যে–

মাল্যবান উৎপলাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ছোট্ট মেয়েটির পিঠে-ঘাড়ে গোটা দুই চাপড় মেরে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললে, তুমিও পারো বাপু! ও কী জানে। ওকে নিয়ে ঘাঁটানো কী হবে।

কিন্তু কল আমি দেব না।

সে হল আলাদা কথা।

আর ঐ সেজো গিন্নি বড্ড অপয়া। পর-পর চারটি মেয়ে বিয়োল। পর-পর চারটি মেয়ে বিয়োল—

ছোট্ট মেয়েটি ফ্রক কামড়াচ্ছিল; আরো জড়োসড়ো হয়ে কামড়াতে লাগল।

সে-দিন তোমার একটি বোন হয়েছে, না খুকি?

হ্যাঁ।

তা আমি জানি। সাধে আমাদের বললে না। অথচ দশ মাইল দূর থেকে লোক ডেকে খাইয়েছে। মানুষ যে কী রকম বোকা শয়তান হতে পারে।

উৎপলা কথা শেষ করতে-না করতেই মাল্যবান বললে, খুকি তো দাঁড়িয়ে রইল, ওকে যা দেবার দাও। নাহলে বলে দাও—

অথচ এক ফালি বাড়ির ভেতর পাশাপাশি দুপরিবার থাকি—তবুও এটুকু গোয়ালার আক্কেল নেই।

তুমিও কি ওদের ডাকো-টাকো না-কি কোনো কাজ-কম্মে?

কেন ডাকব? ওরা ঝিনুক ভরে মধু নিয়ে সুর করে ডাকছে দিনরাত—

এক পক্ষকে প্রথমে শুরু করতে হবে তো–

আমি একা মানুষ, গুষ্টি ডেকে খাওয়াব? ওদেরই তো বরং উচিত আমাদের তিনটিকে ডেকে একটু মিষ্টিমুখ করানো অন্তত। এই মনুকেও তো একদিন ডেকে জিবেগজা শোনপাপড়ি যা-হোক একটা-কিছু হাতে তুলে দিতে পারত। আমরা তো দিই ওদের ছেলেমেয়েদের, ওরা একটা পিপারমিন্ট লজেনচুসও দিতে পারে না?

যাক গে, মরুক গে, তুমি এখন–

অথচ কতো বড় পরিবার; জমজম করছে; কাকে খাচ্ছে, ঘুনে খাচ্চে, ফোঁপড়ায় খাচ্ছে; চোট্টা শয়তান ওপর পড়া হয়ে খাট মেরে উজোড় করে দিচ্ছে সব।

কলটা দেবে না-কি দিয়ে দাও।

কিন্তু মনটা ওদের লাউয়ের মাচায় কেলে হাঁড়ির মতো। সে হাঁড়িতে তো ভাত ফোটে না, বালি তাতে; জনপ্রাণী পাখপাখালী পালিয়ে যায় সে-হাঁড়ি দেখলে। ভালো কেলে হাঁড়ি পেতে বসেছে বটে সেজো বৌরা—

এই মেয়েটির সামনে তুমি অনেক কথাই তো বললে—

শুনিয়েই বললাম, যাতে ওদের আঁতে লাগে!

মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।

মাল্যবান বললে, খুকি, তুমি ফ্রক চিবিয়ো না আর।

ফ্রকটা সে মুখের থেকে ফেলে দিল। দেখা গেল, দাঁত দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে।

মনু বললে, পানসে দাঁত।

তোমার পানসে দাঁত, উৎপলা বললে, তোমার বাপ-মা ডাক্তার দেখিয়েছেন?

না। মেয়েটি (উৎপলার কেন যেন মনে হল) শামকলের বাচ্চার মতো মাথা নেড়ে বললে।

না? উৎপলা মাল্যবানের দিকে তাকিয়ে বললে, কেমন ফ্রক চিবুচ্ছে দেখছ, সোথ হয়েছে এই মেয়েটার শরীরের চুণখড়ি নেই; অথছ বছর-বছর না বিয়োলেও চলবে না। ওদের বারো মাসই কার্ত্তিক মাস, বাবা!

মেয়েটি নিজের অজান্তেই আবার ফ্রক চিবুকে শুরু করেছিল; উৎপলা ফ্রকে একটা হাঁচকা টান মেরে বললে, দূ ধূমসি, খাসির রক্তে মাখিয়েছিস—মেড়েছিস—দূ—দূ–

মেয়েটি আস্তে-আস্তে হেঁটে চলে যাচ্ছিল।

শোন খুকি, ডাক দিল উৎপলা।

এসে দাঁড়াল মেয়েটি।

সর্ষের তেল আর নুন দিয়ে দাঁত ভালো করে ঘষে-ঘষে মেজো দিকিন রোজ। মাজবে?

শামকলের বাচ্চার মতন তুড়বুড় মাথা নেড়ে মেয়েটি বললে, হ্যাঁ।

তোমাদের তিনটি বোনকেই তো দেখি আমি, একেবারে লিকপিক করছে; বাঁশপাতা মাছের মতন; চেহারাও তেম্নি বিচ্ছিরি। তোমাদের ছোট বোন কেমন হল দেখতে?

বেশ সুন্দর।

রং কেমন?

খুব ফর্সা।

কালো ফর্সা তো কথা নয়, বড় শামকলটার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দিয়ে লাল লঙ্কা কেটে খেতে খেতে বললে যেন চন্দনা, মগরাহাটার কুচো চিংড়ির মতো হল তো দেখতে। মনে হয় যেন গলার নলি শুকিয়ে থোড়ের আঁশের মতো হয়ে রয়েছে। বড্ড দুঃখ করে। বাস্তবিক মানুষের পেটে এ কী টোনা টেংড়ি বলো তো দিকি—

মনু একটু ফিক করে হেসে উঠল।

যে-ফর্সা রং বলছ খুকি, ও তোমার বোনের গায়ে রক্ত নেই বলে। দুধে-আলতায় রং—সে আরেক রকম।

আবার শামকলের ছা মাথা নাড়ল, না, আমার বোনের রক্ত আছে।

আছে? তবুও শাদা?

খুব শাদা।

তাহলে ন্যাবা হয়েছে।

না, ন্যাবা হয় নি; ফর্সা রং! কেমন সুন্দর দেখতে! ইশ, ন্যাবা হবে আমার বোনের।

উৎপলা বললে, কই, দ্যাখালেও না তো তোমার বোনকে।

আসুন-না, দেখে যান।

এখন দেখতে যাব কেন। খাইয়েছিল? সাধে? যে-দিন হয়েছিল সে-দিন খবর পাঠিয়েছিল?

মাল্যবান একটু জ্বলে উঠে বললে, আ মল যা! ভালো বিপদেই পড়া গেছে দেখছি। সোমত্ত গাইগোরুর মতো একটা বাছুরের ঘাড় মটকাবার জন্যে চাট মারছ সেই থেকে! কী হল তোমার!

মেয়েটির চোখের ভেতরে যেন তলিয়ে গিয়ে তাকিয়ে থেকে উৎপলা বললে, কিন্তু, সেলয়ের কল নেবার সময়ে ঠিক মতন হাজির হয়েছ তো—শামকলের বাছা।

শুনে সচকিত হয়ে কেমন চমকে উঠে তাকাল মেয়েটির দিকে উৎপলার দিকে মাল্যবান।

তোমার বোন যে-দিন হল, সেদিন চারটে উলু দিলে কেন?

আমি তো দিইনি উলু।

উলুর যা ঘটা! ভাবলাম, এবার বুঝি রাজপুত্তর এসেছেন।

মেয়েটি শুকনো রৌদ্র ডাঙায় পাখির বাচ্চার মতো এক-আধ ফোঁটা মেঘের জল পেয়ে তিড়বিড় করে উঠল উৎপলার কথা শুনে।

তোমার মা কল চেয়েছেন কার কাছে?

আপনার কাছে।

কী বলে দিয়েছেন?

বলেছেন, তোর পলা মাসির কাছ থেকে সেলায়ের কলটা চেয়ে নিয়ে আয় তো—

উৎপলার খানিকটা ভালো লাগল, জ্যৈষ্ঠের মাটিতে কিছু আষাঢ়ের মেঘের রস এসেছে যেন, এম্নি ভাবে মেয়েটির কোঁকড়া চুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললে, মাসি হলাম কোন সুবাদে?

মা বলে দিলেন তো।

তোমার চুলের ভেতর ঢের উকুন, খুকি।

হ্যাঁ, দিদির মাথার থেকে এসেছে।

কেউ বাছে না তোমার মাথার উকুন?

না।

উৎপলা বুড়ো আঙুলের নখে একটার পর একটা উকুন টিপে মারতে মারতে বললে, এই যে মাথা বেছে দিচ্ছি তোমার, বেশ আরাম পাচ্ছ, না?

মেয়েটি উৎপলার কোলে মাথা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজে রইল।

তোমার মা কল দিয়ে কী করবেন?

জামা সেলাই।

কার জন্যে?

ছোড়দি, আমি, বোন—তিন জনের জামা।

তা, তোমার মা এখনও তো আঁতুর ঘরে।

না, বেরিয়েছেন।

কবে? এই তিন চার দিন হল—

নাড় তো এখনও বড্ড ফাঁচা, সেলাই করবেন কী করে? নাড়ি টনটন করে উঠবে যে।

চাইলেন তো।

লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে ক্ষীর এসেছে—খাবে খুকি?

মেয়েটি মাথা নেড়ে বললে, খাব। শামকল শাবকের মাথা কেমন তুড়বুড় করছে, চাদির ওপর জলের ফোঁটা রোদে শুকিয়ে গেছে যেন।

উৎপলা হাত ধুয়ে এসে মেয়েটিকে খানিকটা ক্ষীর দিল। তারপর কলটা ভালো করে দেখে মুছে মনুকে বললে, যা মনু, কলটা সেজো মাসিকে দিয়ে আয়। তোমার ক্ষীর খাওয়া হয়েছে, খুকি?

হ্যাঁ।

কেমন লাগল?

বেশ—

তোমার নাম কী?

নোরা। নোড়া, ভেঙে দেব দাঁতের গোড়া।

কী পড়?

আমি এখনও—ক অক্ষর—

বলে এঁটো হাত জামায় মুছতে মুছতে মেয়েটি দৌড় দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *