হৃদয়ের শব্দ – ইন্দ্রনীল সান্যাল
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০২০
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ – কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল
.
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের সমস্ত
অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ
ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষককে।
.
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
লেখক ও চিকিৎসক দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত, যে আমার ছোটবেলার বন্ধু। মেডিক্যালের ছাত্রী ত্বিষা চট্টোপাধ্যায় ওরফে গুঞ্জা, যে আমার আর এক বন্ধুর কন্যা। এই দুজন আমার এই উপন্যাসের পান্ডুলিপি পড়ে নানা পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলো আমি গ্রহণও করেছি। তারপরেও যদি তথ্যগত ত্রুটি থেকে যায়, তার দায় সম্পূর্ণ ভাবে আমার। পত্রভারতী গ্রুপের সকল সদস্যকেও কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁদের
সমবেত প্রচেষ্টায় এই উপন্যাস গ্রন্থায়িত হল।
এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, শঙ্খ ঘোষ, অমিতাভ দাশগুপ্ত, বীরেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং জন লেননের কবিতার পংক্তি, কবিতার নাম অথবা গানের লাইন ব্যবহার করা হয়েছে।
তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই।
অভিজ্ঞানের লেখা কবিতাগুলির রচয়িতা আমি।
.
‘‘Two souls with but a single thought—
Two hearts that beat as one!’’
–John Keats
.
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ
এটা উপন্যাসে বর্ণিত চরিত্রদের নাম, পেশা, বাসস্থান; কাহিনিতে বর্ণিত রাজনৈতিক দলের নাম; চিকিৎসা সংক্রান্ত, পুলিশি এবং আইনি কার্যকলাপ লেখকের কল্পনাপ্রসূত। জীবিত বা মৃত ব্যক্তি, সংগঠন বা বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কোনওরকমের সাদৃশ্য একান্তই কাকতালীয়।
.
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ঢুকি ১৯৮৫ সালে। ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে ছিল এমনটা নয়। আমি প্রেসিডেন্সিতে ইংরিজিতে অনার্সের ফর্ম তুলেছিলাম। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কমপ্যারেটিভ লিটারেচার নিয়ে পড়ার ইচ্ছেও ছিল। কারণ আমি লেখালিখির জগতে আসতে চেয়েছিলাম।
আমার থেকে দশ বছরের বড় দাদা এবং মা মিলে ঘাড় ধরে ঢুকিয়ে দিল ডাক্তারি পড়তে। সেই যে সাহিত্য জগত থেকে নির্বাসন ঘটল, সেটা চলল ২০০৪ সাল পর্যন্ত।
কী ভাবে? ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ডাক্তারি পড়াশুনো। পরের দু’বছর ইনটার্নশিপ ও হাউসস্টাফশিপ। কলেজ জীবনের সাত বছর আমি ছিলাম, আক্ষরিক অর্থে আউটসাইডার। পড়াশুনো করতাম, রাজনীতি করতাম, টুকটাক প্রেমও করেছি। কিন্তু জীবন সম্পর্কে আশ্চর্য এক উদাসীনতা কাজ করত। কাজ করত অন্তর্লীন বিষাদ। কলেজকে, শিক্ষকদের, সহপাঠীদের, সিনিয়র দাদা আর জুনিয়র ভাইদের দেখতাম কৌতূহল ভরে।
১৯৯৫ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান করলাম এবং পোস্টিং হল সন্দেশখালি ব্লকের জেলিয়াখালি নামের এক হেলথ সেন্টারে। সেটি একটি দ্বীপ। দাঁড় বওয়া নৌকো পেরিয়ে সেখানে পৌঁছতে হত। ইলেকট্রিসিটি পৌঁছয়নি। সেখানে ছিলাম পাঁচ বছর।
ওই পাঁচটা বছর কী করে যে কাটিয়েছি সে আমিই জানি! হেলথ সেন্টারে থাকতাম। চিকিৎসা করার পাশাপাশি দিনে দশ থেকে বারো ঘণ্টা পড়তাম। প্র্যাকটিস করতাম না। বাড়ি আসতাম মাসে একবার। কাদায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া, তুমুল ঝড়ের সময় নদীতে নৌকা পারাপার, পালস পোলিও নিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে মিটিং—এই সব মনে পড়ে। কলকাতা শহরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
২০০০ সালে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এনট্রান্স পরীক্ষায় সফল হয়ে চলে এলাম কলকাতায়। পরের তিন বছর আবার অমানুষিক পড়াশুনো করতে হল। ২০০৩ সাল থেকে জীবন ছন্দে ফিরতে শুরু করল। ২০০৪ সালে তমলুক জেলা হাসপাতালে পোস্টিং হল। এবং আমার মনে পড়ে গেল, প্রায় কুড়ি বছর আগে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম—লিখব।
তো, সেই ছিল লেখালিখির শুরু। ছোটগল্প থেকে বড় গল্প থেকে নভেলা থেকে উপন্যাস—সবই টুকটাক লিখে ফেলেছি। ২০১০ সাল নাগাদ মনে পড়ে গেল কলেজ জীবনের কথা। এবং দেখলাম, সব মনে আছে। আউটসাইডার হয়ে যে জীবন কাটিয়েছিলাম—সেটি মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কাটছে, ফুলের মতো ফুটে উঠছে, পাখির ছানার মতো ডানা মেলতে চাইছে। মাথা ভর্তি অজস্র চেনা, অচেনা, আধোচেনা চরিত্র ঘুরপাক খাচ্ছে, স্লাইড শোয়ের মতো মনের পর্দায় আছড়ে পড়ছে একের পর এক ঘটনা।
সত্যি কথা বলতে কি, এই উপন্যাস লেখার জন্যে আমাকে মাথা খেলাতে হয়নি। কম্পিউটারের কি বোর্ড টেপার কায়িক শ্রম ছাড়া কিছুই করতে হয়নি। লেখা নিজের আনন্দে আসত। এবং এই উপন্যাসটি লেখার সময় যে পরিমাণ আনন্দ পেয়েছি, তা আগে কখনও পাইনি। কখনও হাসতাম, কখনও ভয় পেতাম, কখনও বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকতাম, দু’একবার কেঁদেও ফেলেছি। তাড়াতাড়ি কি বোর্ড থেকে মুছে ফেলেছি অশ্রু।
তিন বছর ধরে উপন্যাসটি লেখার পরে পাঁচ বছর ফেলে রেখেছিলাম। মাঝেমধ্যে টুকটাক এডিট করতাম।
পত্রভারতীর কর্ণধার শ্রী ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধায় জানতেন উপন্যাসটির কথা। তিনিই একদিন দাবি জানালেন, এটি বই করতে চান। আমি রাজিও হয়ে গেলাম। কিন্তু এই উপন্যাস শুরু হচ্ছে ২০১০ সালে। আর আমার ডাক্তারি ছাত্রজীবন ১৯৮৫ সালে শুরু। পঁচিশ বছরে ডাক্তারি পাঠক্রম আমূল বদলে গেছে।
ইতিমধ্যে আমার বন্ধুর কন্যা ত্বিষা চ্যাটার্জি ওরফে গুঞ্জা ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছে। এবং সে আমার বন্ধুও বটে। তাকেই নিয়মিত এই উপন্যাস পর্বে পর্বে মেল করতাম। সে সংশোধন করে দিত। মেল চালাচালি চলেছিল ছমাস ধরে। অবশেষে উপন্যাসটি রেডি হল। পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিলাম পত্রভারতীর দপ্তরে। বুকের মধ্যে যে পাথর জমা হয়েছিল ১৯৮৫ সাল থেকে, তা সরে গেল ২০১৯ সালে।
আজ নিজেকে ভারমুক্ত লাগছে। আমার কাজ শেষ। প্রিয় পাঠক, এবার আপনার দায়িত্ব!
ইন্দ্রনীল সান্যাল
১লা জানুয়ারি ২০২০
Leave a Reply