সাধনা জীবনের উপলব্ধি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাংলা অনুবাদ: নীলা দাস
প্রথম সংস্করণ: এপ্রিল ২০১৯
প্রকাশক: সিগনেট প্রেস
আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড-এর একটি ইমপ্রিন্ট
প্রচ্ছদ: কাকলি গুহ
.
আরনেস্ট রাইসকে
.
লেখকের ভূমিকা
আমাদের পক্ষে বোধহয় স্পষ্ট করা ভাল যে এই গ্রন্থে যে সমস্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তাদের বিষয়বস্তু দর্শনশাস্ত্র অনুযায়ী আলোচিত হয়নি, গবেষকের দৃষ্টিকোণ থেকেও উপস্থাপিত হয়নি। লেখক এমন এক পরিবারে বড় হয়েছেন যেখানে প্রতিদিনের উপাসনায় উপনিষদের মন্ত্রের ব্যবহার হয়; আর তাঁর সামনে রয়েছে তাঁর পিতার দৃষ্টান্ত, যিনি তাঁর সুদীর্ঘ জীবন ঈশ্বরের গভীর ধ্যানে অতিবাহিত করেছিলেন, অথচ জাগতিক দায়িত্বে কোনো অবহেলা করেননি বা মানবহিতকর সকল কাজেই তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ লেশমাত্র শিথিল করেননি। তাই আশা করা যায় সুপ্রাচীন ভারতাত্মা যেভাবে আমাদের পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থে ব্যক্ত ও আজকের জীবনে প্রকাশিত হয়ে আছেন পশ্চিমের পাঠক এই প্রবন্ধগুলিতে তার সংস্পর্শে আসবার সুযোগ পাবেন।
মানুষের সমস্ত মহাবাণীর বিচার আক্ষরিক ভাবে না ক’রে বরং মর্মার্থ দিয়ে করা প্রয়োজন। ইতিহাসে রয়েছে এই মর্ম জীবনের ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে প্রকাশ করে। আমরা খ্রীষ্টধর্মের প্রকৃত অর্থ জানতে পারি বর্তমান মুহূর্তে তার প্রাণবন্ত রূপ পর্যবেক্ষণ ক’রে— বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পূর্ববর্তী নানা পর্যায়ের খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে তার পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও।
ভারতের মহান ধর্মশাস্ত্রগুলি মনে হয় শুধুমাত্র অতীতকে ফিরে দেখার জন্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক আকর্ষণের জন্য পশ্চিমী গবেষকদের আবিষ্ট ক’রে রেখেছে; কিন্তু আমাদের কাছে তারা জীবন্ত রূপে গুরুত্বপূর্ণ, আর এই কথা আমরা না ভেবে পারি না যে মানুষের চিন্তা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার নিদর্শনরূপে, পাণ্ডিত্যের মোড়কে চিরকালের জন্য সংরক্ষিত রাখা “মমি”র মতো কোনো পরিচয়-সম্বলিত আধারের মধ্যে যখন তাদের প্রদর্শন করা হয়, তারা তাদের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
মহান হৃদয় ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতার থেকে উদ্ভূত জীবন্ত বাণীর অর্থ কোনো বিশেষ শাস্ত্রের যৌক্তিক ব্যাখ্যায় নিঃশেষে বলা যায় না। ব্যক্তিগত জীবনের ভাষ্য-টীকায় অবিরত তাদের ব্যাখ্যা করতে হয়, আর প্রত্যেক নতুন প্রত্যাদেশে তারা অতিরিক্ত কিছু রহস্য যুক্ত করে। আমার কাছে উপনিষদের মন্ত্র আর বুদ্ধদেবের উপদেশ চিরকাল মননের বিষয়, ও সেইজন্য অপরিসীম প্রাণশক্তির প্রসারে সমৃদ্ধ; এবং যেমন ভাবে নিজস্ব অর্থ নিয়ে তারা আমার কাছে, ও অন্যের কাছে প্রেরণাস্বরূপ হয়ে থাকে সেইভাবে আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে ও আমার উপদেশে তাদের ব্যবহার করেছি, আর আমার নিজের সাক্ষ্য প্রমাণ তাদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কারণে অবশ্যই তার মূল্য আছে।
আমার বোধহয় আরো বলা উচিত যে এই প্রকাশনার পক্ষে উপযুক্ত, এই প্রবন্ধগুলি সম্মিলিত আকারে যে সমস্ত ভাব প্রকাশ করছে, তা বাঙলা ভাষায় বাঙলার বোলপুরে আমার বিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে যে সকল বক্তৃতা করতে আমি অভ্যস্ত, তার থেকে চয়ন করেছি; এবং আমার বন্ধু বাবু সতীশচন্দ্র রায় ও বাবু অজিতকুমার চক্রবর্তী সেইসব বক্তৃতার কিছু অংশের যে অনুবাদ করেছিলেন আমি এখানে ওখানে তার থেকে ব্যবহার করেছি। আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকৃত আমার বাঙলা বক্তৃতা “কর্মযোগ” এর অনুবাদ এই ক্রমের শেষ প্রবন্ধ, Realisation in Action (কর্মে উপলব্ধি)।
এই সুযোগে আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেম্স এইচ উড্সকে (Professor James H Woods) আমার কৃতজ্ঞতা জানাই, কারণ তাঁর উদার প্রশংসা আমাকে এই প্রবন্ধমালা সম্পূর্ণ করতে এবং প্রায় সবগুলি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করতে উৎসাহিত করেছিল। আমি মিস্টার আর্নেস্ট রাইসকে (Mr. Ernest Rhys) তাঁর সহৃদয় অভিমত ও পুনরীক্ষণ দিয়ে আমাকে সাহায্য করার জন্য ও প্রতিলিপি দেখে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই।
“সাধনা” উচ্চারণ সম্বন্ধে একটি শব্দ সংযোজন করা যায়: প্রথম আকারের স্বরসংঘাতে জোর দিতে হবে, অক্ষরটির উদাত্ত ধ্বনি এতে আসবে।
Leave a Reply