প্রেমে উপলব্ধি
এবার আমরা অসীম ও সসীমের, পরমাত্মা ও আমাদের আত্মার একত্র অবস্থানের চিরন্তন সমস্যায় আসছি। অস্তিত্বের মূলে রয়েছে এক বিশ্বব্যাপী বৈপরীত্য। আমরা কখনো তাকে এড়িয়ে যেতে পারি না, কারণ আমরা কখনোই এই সমস্যার বাইরে থাকতে পারি না আর অন্য কোনো সম্ভাব্য বিকল্প দিয়ে এর পরিমাপ করতে পারি না। কিন্তু এই সমস্যা শুধু যুক্তির মধ্যে রয়েছে; বাস্তবে সে আমাদের কাছে একেবারে কোনো বাধা নিয়েই আসে না। যুক্তি দিয়ে বললে, দুইটি বিন্দুর মাঝখানের দূরত্ব যত কমই হোক, তাকে অপরিসীম বলা যেতে পারে, কারণ তা চির বিভাজ্য। কিন্তু আমরা প্রতি পদক্ষেপে অসীমের সম্মুখীন হয়ে থাকি, এবং প্রতি মুহূর্তে চিরন্তনের সাক্ষাৎ পাই। সেইজন্য আমাদের কোনো কোনো দার্শনিক বলেন, সসীম বলে কিছু নেই, যা আছে তা মায়া, এক বিভ্রান্তি। যা সত্য তা অসীম, আর অসত্য মায়াই কেবল সসীমের বিবর্ত কারণ। তবে মায়া শব্দটি একটি নাম মাত্র, এ কোনো ব্যাখ্যা নয়। এ শুধুমাত্র বলে সত্যের সঙ্গে এই বিবর্ত রয়েছে যা সত্যের বিপরীত; কিন্তু কি ভাবে যে তারা এক সময়ে এক সঙ্গে থাকে তা ধারণার বাইরে।
সংস্কৃতে যাকে বলা হয় “দ্বন্দ্ব” আমাদের মধ্যে তা রয়েছে, সৃষ্টিতে এ বৈপরীত্যের ধারাবাহিক ক্রম; যেমন, ইতিবাচক মেরু ও নেতিবাচক মেরু, কেন্দ্রাভিমুখী শক্তি ও কেন্দ্রাতিগ শক্তি, আকর্ষণ ও বিকর্ষণ। এ সকলই শুধু নাম মাত্র, তারা কোনো ব্যাখ্যা নয়। তারা শুধুমাত্র নানা উপায়ে প্রকাশ করে যে জগৎ স্বরূপতঃ দুই বিপরীত শক্তির সমন্বয়। এইসব শক্তি, সৃষ্টিকর্তার বাম ও দক্ষিণ হস্তের মতো পূর্ণ সমন্বয়ে কাজ করে, যদিও করে বিপরীত দিক থেকে।
আমাদের দুইটি চোখের মধ্যে এক সমন্বয়ের বন্ধন রয়েছে, যা তাদের একত্রে কাজ করায়। অনুরূপ ভাবে ভৌত জগতে উষ্ণতা ও শৈত্য, আলো ও অন্ধকার, গতি ও স্থিতির মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য ধারাবাহিক সম্বন্ধ রয়েছে, যেমন রয়েছে পিয়ানোর সুরের খাদ ও নিখাদের মধ্যে। সেই কারণে এই সব বৈপরীত্য বিশ্বে কোনো বিভ্রান্তি আনে না, বরং সামঞ্জস্য আনে। সৃষ্টি যদি বিশৃঙ্খলা মাত্র হোতো, তা হলে আমাদের কল্পনা করতে হোতো যে দুইটি পরস্পরবিরোধী নীতি যেন একে অন্যকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিশ্বজগৎ সার্বভৌম ও শর্তপূর্ণ সামরিক আইনের অন্তর্ভুক্ত নয়। আমরা এখানে এমন কোনো শক্তির সন্ধান পাই না যা কাউকে হত্যা করার জন্য উন্মাদের মতো ছোটাছুটি করতে পারে, অথবা উচ্ছৃঙ্খল পথে অনির্দিষ্ট কাল ধরে যেতে পারে, যেমন ক’রে একজন নির্বাসিত অপরাধী পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সমস্ত রকম সমন্বয় ছিন্ন ক’রে যায়; সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবে প্রত্যেক শক্তিকে এক বক্র রেখায় তার ভারসাম্যে ফিরে আসতে হয়। ঢেউ ওঠে, মনে হয় যেন প্রতিটি ঢেউ অনমনীয় প্রতিযোগিতার ভাব নিয়ে তার নিজস্ব উচ্চতায় পৌঁছে যায়, কিন্তু শুধু এক নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত; আর এই ভাবে আমরা সমুদ্রের পরম স্থিরতার কথা জানতে পারি যার সঙ্গে সমস্ত ঢেউ সম্বন্ধযুক্ত আর সেখানে তাদের সবাইকে অবশ্যই এক আশ্চর্য সুন্দর ছন্দে ফিরে আসতে হয়।
বস্তুতঃ এইসব তরঙ্গ ও আলোড়ন, এইসব উত্থান ও পতন, কোনো অসম পদার্থের প্রবল কুঞ্চনের জন্য ঘটে না, তারা এক ছন্দোময় নৃত্য। ছন্দ কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার এলোমেলো ধাক্কাধাক্কির মধ্যে জন্মাতে পারে না। তার অন্তর্নিহিত সত্য অবশ্যই বিরোধ নয়, ঐক্য।
ঐক্যের এই মূল সত্য সকল রহস্যের বড় রহস্য। দ্বৈতের অস্তিত্ব নিমেষের মধ্যে আমাদের মনে একটি প্রশ্ন জাগায়, আর আমরা সেই একের মধ্যে তার সমাধান খুঁজি। অবশেষে যখন আমরা এই দুইয়ের মধ্যে এক সম্বন্ধ আবিষ্কার করি, আর তার ফলে দেখি স্বরূপতঃ তারা এক, তখন আমরা অনুভব করি যে আমরা সত্যে উপনীত হয়েছি। আর তখন আমরা সকল বৈপরীত্যের মধ্যে সব থেকে চমকপ্রদ বৈপরীত্য উচ্চারণ ক’রে বলি, এক বহুরূপে প্রকাশিত, এই প্রকাশ সত্যের বিপরীত এবং তৎসত্ত্বেও অবিচ্ছিন্ন ভাবে সত্যের সঙ্গে সম্বন্ধিত।
বিস্ময়ের ব্যাপার, অনেক মানুষ আছেন যাঁরা প্রকৃতির বৈচিত্র্যের মধ্যে নিয়মের সঙ্গতি যখন আবিষ্কার করেন, তখন আমাদের সমস্ত আনন্দের মূল রহস্যের সেই অনুভূতি হারিয়ে ফেলেন। কোনো আপেল গাছ থেকে পড়ার তুলনায় মাধ্যাকর্ষণ যেন বেশী কিছু রহস্যের নয়, অস্তিত্বের একটি পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ের বিবর্তন যেন এমন কিছু নয় যে সৃষ্টি পরম্পরার থেকে বিশ্লেষণে বেশী কুণ্ঠিত। সমস্যা হলো আমরা প্রায়ই এমন নিয়মে এসে থামি, যেন সেই নিয়ম আমাদের অনুসন্ধানের চরম পরিণতি, আর তারপর দেখি সে আমাদের আত্মাকে মুক্ত করতে শুরুই করেনি। সে শুধু মাত্র আমাদের বুদ্ধিকে পরিতৃপ্ত করে, আর যেহেতু সে আমাদের সমগ্র সত্তাকে স্পর্শ করে না তাই আমাদের অসীমের অনুভূতিকে অসাড় ক’রে দেয় মাত্র।
একটি মহৎ কবিতাকে যখন বিশ্লেষণ করা হয়, তখন সে বিচ্ছিন্ন শব্দগুচ্ছ হয়ে থাকে। যে পাঠক সেই বাইরের শব্দগুচ্ছকে সমন্বিত করার আভ্যন্তরীণ মাধ্যম রূপে তার অর্থ খুঁজে পান, তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক যথাযথ নিয়ম আবিষ্কার করেন, সেই নিয়ম কখনো কিছুমাত্র লঙ্ঘিত হয় না; সেই নিয়ম ভাবের বিবর্তনের নিয়ম, সুরের ও গঠনের নিয়ম।
কিন্তু নিয়ম নিজেই এক সীমা। সে শুধু দেখায় যে যা রয়েছে তা কখনো অন্যরকম হতে পারে না। যখন কোনো ব্যক্তি কার্য-কারণের যোগসূত্র অনুসন্ধানে আলাদা ক’রে ব্যস্ত থাকেন তখন তাঁর মন তথ্যের যথেচ্ছ শাসনের থেকে নিষ্কৃতি পেতে গিয়ে নিয়মের যথেচ্ছ শাসনের অধীন হয়। কোনো ভাষা শেখার সময়, যখন আমরা শুধুমাত্র শব্দ থেকে শব্দের নিয়মাবলীতে পৌঁছে যাই তখন অনেক কিছু পাই। কিন্তু আমরা যদি সেই জায়গায় থেমে থাকি, আর ভাষার গঠনের বিস্ময়ে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করি, তার আপাতঃ প্রতীয়মান খেয়ালের গোপন কারণ খুঁজতে থাকি, তা হলে শেষে পৌঁছাতে পারি না— এর কারণ ব্যাকরণ সাহিত্য নয়, ছন্দ কবিতা নয়।
সাহিত্যে এসে আমরা দেখি যে যদিও সে ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী চলে, তবুও সে একটি আনন্দের বিষয়, নিজেই সে নিজের মুক্তি। একটি কবিতার সৌন্দর্য কঠিন নিয়মে বাঁধা থাকে, তবুও সে তা উত্তীর্ণ হয়ে যায়। নিয়ম সমূহ তার ডানা, তারা ভার চাপিয়ে তাকে নীচু ক’রে দেয় না, তারা তাকে মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। নিয়মের মধ্যে তার গঠন, কিন্তু সৌন্দর্যের মধ্যে তার ভাব। নিয়ম মুক্তির প্রথম সোপান, আর সৌন্দর্য হলো পূর্ণ মুক্তি নিয়মের বেদীর উপর সে দাঁড়িয়ে আছে। সৌন্দর্য নিজের মধ্যে সীমা ও অসীমের, নিয়ম ও মুক্তির সমন্বয় সাধন করে।
বিশ্ব-কবিতায় তার ছন্দের রীতি আবিষ্কার, তার বিস্তার ও সংকোচনের, গতি ও স্থিতির পরিমাপ, তার গঠন ও প্রকৃতির বিবর্তনের অনুসরণ, এ হলো যথার্থ প্রাপ্তি; কিন্তু আমরা সেখানে থেমে যেতে পারি না। এ যেন এক রেল স্টেশন; কিন্তু স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম আমাদের বাড়ি নয়। যিনি জানেন যে সমগ্র জগৎ আনন্দের থেকে সৃষ্ট, একমাত্র তিনি পরম সত্য লাভ করেন।
এ আমাকে ভাবতে শেখায় প্রকৃতির সঙ্গে মানব হৃদয়ের সম্বন্ধ কতটা রহস্যজনক। বহির্জগতের কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রকৃতির এক রূপ, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে, আমাদের অন্তর্জগতে সে একেবারে অন্য ছবি উপস্থিত করে।
একটি উদাহরণ নেওয়া যাক— একটি ছোট গাছের ফুল যত সুন্দর আর সূক্ষ্মই দেখতে হোক, তাকে জোর ক’রে একটি বড় কাজে নিযুক্ত করা হয়, আর তার রঙ ও আকার সবই সেই কাজের উপযোগী হয়। তাকে অবশ্যই ফল আনতে হয়, না হলে ছোট গাছের অবিচ্ছিন্ন জীবন বিচ্ছিন্ন হবে আর অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী এক মরুভূমিতে পরিণত হবে। অতএব ফুলের রঙ ও গন্ধ সমস্তই কোনো প্রয়োজনের জন্য আছে; যে ক্ষণে মৌমাছি তাকে ফলপ্রসূ ক’রে তোলে, আর তার ফল লাভের সময় এসে যায়, তখন সে তার চমৎকার পাপড়িগুলি ঝরিয়ে দেয় আর এক নিষ্ঠুর ব্যয় সংকোচ তাকে তার সুগন্ধ বিসর্জন দিতে বাধ্য করে। নিজের চমৎকারিত্ব জাহির করার তার আর সময় থাকে না, কারণ সে তখন যৎপরোনাস্তি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, প্রকৃতিতে প্রয়োজনই একমাত্র কারণ যার জন্য সব কিছু কাজ করে ও নড়ে চড়ে। সেখানে কুঁড়ি বড় হয়ে ফুল হয়, ফুল ফল হয়, ফল বীজ হয়, বীজ আবার নতুন চারা গাছ হয়, আর এই রকম ক’রে কর্মের ধারাবাহিকতা অবিচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে। কোনো বিশৃঙ্খলা বা বাধা উপস্থিত হলেও কোনো অজুহাত গৃহীত হয় না, আর এই রকম দুঃখজনক ভাবে যার গতি রুদ্ধ হয় সে তৎক্ষণাৎ বাতিল বলে চিহ্নিত হয়, আর মরে যেতে বাধ্য হয় ও অবিলম্বে অন্তর্হিত হয়। প্রকৃতির সুবিশাল কার্যালয়ে অসংখ্য বিভাগ রয়েছে যেখানে অবিরাম কাজ হয়ে চলেছে, আর সেখানে যে সুন্দর ফুলটি দেখছো, ঝলমলে পোশাক পরা, সুগন্ধিত সুবেশী ফুলবাবুর মতো, তাকে আপাতদৃষ্টিতে যা দেখাচ্ছে, সে তা নয়, বরং সে একজন মজুরের মতো রোদে জলে খেটে চলেছে, তাকে তার কাজের পরিষ্কার হিসাব দিতে হয়, আর আনন্দপূর্ণ কৌতুক উপভোগ করার জন্য তার নিশ্বাস ফেলার অবকাশ থাকে না।
কিন্তু একই ফুল যখন মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে তখন তার ব্যস্ত কর্মদক্ষতা চলে যায়, আর সে অবকাশ ও বিশ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে। একই বস্তু যা বাইরে অন্তহীন কর্মের বাস্তব রূপ অন্তরে সে সৌন্দর্য ও শান্তির পূর্ণ প্রকাশ।
বিজ্ঞান এখানে আমাদের সতর্ক ক’রে দেয় যে আমরা ভুল করেছি, বাইরে যা প্রকাশিত হয় তা ছাড়া ফুলের আর কোনো প্রয়োজন নেই, এবং সৌন্দর্য ও কোমলতার যে সম্পর্ক তার সঙ্গে আমাদের রয়েছে বলে আমরা মনে করি সে সবই আমাদের নিজেদের সৃষ্টি, ভিত্তিহীন ও অলীক কল্পনা মাত্র।
কিন্তু আমাদের হৃদয় উত্তর দেয় আমরা কিছুমাত্র ভুল করিনি। প্রকৃতির রাজ্যে ফুল নিজের এক প্রশংসাপত্র সঙ্গে নিয়ে চলে যা সুপারিশ করে যে যথাযোগ্য কাজ করার অসীম ক্ষমতা এর আছে, কিন্তু যখন সে আমাদের হৃদয় দুয়ারে নাড়া দেয় তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিচয়পত্র আনে। সৌন্দর্যই হয় তার একমাত্র যোগ্যতা। কোনো জায়গায় সে ক্রীতদাস হয়ে আসে আর অন্যত্র আসে স্বাধীন বস্তু রূপে। কী ভাবে তা’ হলে আমরা প্রথম সুপারিশটিকে কৃতিত্ব দেবো, আর দ্বিতীয়টিকে অবিশ্বাস করবো? ফুল যে কার্য-কারণের অটুট পরম্পরায় নিজের অস্তিত্ব লাভ করেছে তা নিঃসন্দেহে সত্য; কিন্তু তা বাহ্যিক সত্য। অন্তরের সত্য হলো: “চিরন্তন আনন্দের থেকে এই ভূত সকল জাত।”১
কাজেই, প্রকৃতিতে ফুলের একমাত্র কাজ রয়েছে এমন নয়, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে আরো একটি বড় কাজ তাকে করতে হয়। কী সেই কাজ? প্রকৃতিতে তার কাজ এক পরিচারকের নির্দিষ্ট সময়ে তাকে উপস্থিত হতে হয়, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে সে রাজদূতের মতো আসে। রামায়ণে সীতা যখন প্রবল শক্তির দ্বারা স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য রাবণের স্বর্ণপ্রাসাদে হাহাকার করছিলেন, তখন তাঁর কাছে প্রিয়তম রামচন্দ্রের নিজস্ব আঙটি নিয়ে একজন দূত এসেছিল। সেটি দেখা মাত্র তার নিয়ে আসা সংবাদের সত্যতা সীতা বিশ্বাস করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে সে তার প্রিয়তমের কাছ থেকেই এসেছে, তিনি তাকে ভুলে যাননি, এবং তাকে উদ্ধার করার জন্য কাছেই এসে গেছেন।
ফুল আমাদের মহান প্রেমিকের সেইরকম এক দূত। রাবণের স্বর্ণ নগরীর সঙ্গে তুলনা ক’রে বলা যেতে পারে, পার্থিব জাঁকজমক ও অন্তঃসারহীন শোভাযাত্রার পরিবেষ্টনের মধ্যে থেকেও আমরা নির্বাসনে থাকি, তখন জাগতিক সাফল্যের উদ্ধত মানসিকতা আমাদের মুগ্ধ করে, প্রলুব্ধ করে আর আমাদের তার বধূ বলে দাবী করে। ইতিমধ্যে ফুল হঠাৎ সামনে আসে অন্য পারের সংবাদ নিয়ে, আর আমাদের কানে কানে চুপি চুপি বলে, “আমি এসেছি। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি সেই সুন্দরের দূত, যাঁর আত্মা প্রেমানন্দময়। নির্বাসিত এই দ্বীপে তিনি সেতু বন্ধন করেছেন, আর তিনি তোমাকে ভোলেননি; এখনই তিনি তোমাকে উদ্ধার করবেন। তোমাকে কাছে টেনে নেবেন আর আপন ক’রে নেবেন। এই মায়া তোমাকে চিরকাল দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ ক’রে রাখবে না।”
তখন যদি আমরা জাগ্রত থাকি, তা হলে তাকে জিজ্ঞাসা করি: “আমরা কি ক’রে জানবো যে তুমি সত্যই তাঁর কাছ থেকে এসেছো?” দূত বলে, “দেখো! তাঁর এই আঙটি আমার কাছে রয়েছে। কি সুন্দর এর রং, ও রমনীয়তা!”
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে, এটি তাঁর— সত্যই এ আমাদের বিবাহের আঙটি। এখন তা ছাড়া সবকিছুই বিস্মরণ হয়ে যায়, শুধু অনন্ত প্রেমের স্পর্শের এই সুমধুর প্রতীকটি এক আকুল আকাঙ্ক্ষায় আমাদের পূর্ণ করে। আমরা উপলব্ধি করি যে সোনার প্রাসাদে আমরা রয়েছি আমাদের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই— এর বাইরে আমাদের মুক্তি— আর সেখানে আমাদের প্রেমের ফলপ্রাপ্তি ও আমাদের জীবনের পরিপূর্ণতা।
মৌমাছির কাছে প্রকৃতিতে যা শুধু রঙ ও গন্ধ, আর নিদর্শন বা চিহ্ন যা মধুতে পৌঁছানোর সঠিক পথ দেখায়, তা মানুষের হৃদয়ে সৌন্দর্য ও আনন্দ, প্রয়োজন তাদের প্রতিবন্ধক হয়ে বাধা দেয় না। হৃদয়ে তারা নানা রঙের কালিতে লেখা প্রেমপত্র নিয়ে আসে।
এই কারণে আমি আপনাদের বলছিলাম যে আমাদের কর্মময় প্রকৃতি বহির্ভাগে যতই ব্যস্ত হোক না কেন, হৃদয়ে তার এক গুপ্ত কক্ষ আছে, সেখানে সে কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই ইচ্ছামতো আসে ও যায়। সেখানে তার কর্মশালার আগুন এক উৎসবের প্রদীপে রূপান্তরিত হয়, তার কারখানার আওয়াজ সঙ্গীতের মতো শোনায়। বহিঃপ্রকৃতিতে কার্যকারণের লৌহশৃঙ্খল গুরুগম্ভীর শব্দ করে, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে তার অবিমিশ্র আনন্দ যেন বীণার সোনার তারের মতো ধ্বনিত হয়।
সত্যই আশ্চর্যজনক মনে হয় যে একই সঙ্গে ও একই সময়ে, প্রকৃতির এই দুইটি এত বিপরীতধর্মী রূপ রয়েছে— একটি দাসত্ব বন্ধন আরেকটি স্বাধীনতা। একই বিন্যাসে শব্দ, রঙ ও স্বাদে দুইটি বিরুদ্ধ সুর শোনা যায়, একটি প্রয়োজনের আরেকটি আনন্দের। বহির্বিভাগে প্রকৃতি ব্যস্ত ও অস্থির, অন্তরে সম্পূর্ণ নীরব ও শান্ত।
তার এক দিকে কঠোর শ্রম, আরেক দিকে বিশ্রাম। একমাত্র যখন তুমি তাকে বাইরে থেকে দেখো, তখন তার বন্ধন দশা দেখো, কিন্তু তার হৃদয়ের মধ্যে রয়েছে সীমাহীন সৌন্দর্য।
আমাদের ঋষি বলেন, “আনন্দের থেকে এই ভূতসকল জাত, আনন্দের মধ্যে জীবিত, আনন্দের দিকে তারা অগ্রসর হয় ও আনন্দের মধ্যে প্রবেশ করে।”
এমন নয় যে তিনি অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করেন, অথবা তাঁর এই অসীম আনন্দের অভিনিবেশ কোনো বিমূর্ত ভাবনার অসংযমের দ্বারা উদ্ভূত উত্তেজনা থেকে জাত। তিনি প্রকৃতির অপ্রতিহত অনুশাসন সম্পূর্ণ স্বীকার করেন ও বলেন, “তাঁর (অর্থাৎ তাঁর অনুশাসনের) ভয়ে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, সূর্য দীপ্তিমান হয়, এবং বায়ু, মেঘ ও মৃত্যু তাঁর ভয়ে নিজেদের কর্তব্য সম্পাদন করে।” এ হলো লৌহ কঠিন অনুশাসনের রাজত্ব, বিন্দু মাত্র লঙ্খনে শাস্তি দিতে প্রস্তুত। তা সত্ত্বেও কবি আনন্দের মন্ত্র উচ্চারণ করেন, “এই ভুতসকল আনন্দের থেকে জাত হয়, আনন্দের মধ্যে জীবিত থাকে, আনন্দের দিকে অগ্রসর হয় ও আনন্দের মধ্যে প্রবেশ করে।”
“তিনি অমৃতরূপে আনন্দরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন।”২ তাঁর প্রকাশ নিজের পরিপূর্ণ আনন্দের থেকে সৃষ্টিতে। এই উচ্ছ্বসিত আনন্দের স্বভাব হলো রূপের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করা, সেটিই নিয়ম। নিরূপ আনন্দ রূপের মধ্যে অবশ্যই নিজেকে সৃষ্টি করেন, রূপান্তরিত করেন। গায়কের আনন্দ গানের বিন্যাসের মধ্যে প্রকাশিত হয়, কবির আনন্দ প্রকাশিত হয় কবিতার গঠনের মধ্যে। সৃষ্টিকর্তার ভূমিকায় মানুষ সর্বদা রূপের সৃষ্টি করছে, আর তারা তাঁর উচ্ছ্বসিত আনন্দের থেকে উদ্ভূত হচ্ছে।
এই আনন্দের আরেক নাম প্রেম, এই প্রেমের উপলব্ধির জন্য তাঁর স্বরূপে দ্বৈতভাব অবশ্যই থাকে। যখন গায়কের প্রেরণা আসে, তখন তিনি নিজেকে দুই ভাগ করেন; তাঁর নিজের মধ্যেই আরো একটি সত্তা থাকে শ্রোতারূপে, এবং বাইরের শ্রোতা তাঁর এই অন্য সত্তার বিস্তার মাত্র। প্রেমিক তার প্রিয়তমের মধ্যে অন্য সত্তা খোঁজে। বাধার মধ্যে দিয়ে মিলনের উপলব্ধির জন্য, আনন্দ এই বিচ্ছেদের সৃষ্টি করে।
“অমৃতম্”, অবিনশ্বর আনন্দ, নিজেকে দুই ভাগ করেছেন। আমাদের আত্মা প্রেমাস্পদ; এ তাঁর অন্য সত্তা। আমরা বিচ্ছিন্ন; কিন্তু এই বিচ্ছেদ যদি পারমার্থিক হতো, তা হলে দুঃখ কষ্ট ও অসহনীয় অমঙ্গলও এই জগতে পারমার্থিক হতো। তা হলে অসত্য থেকে কখনোই আমরা সত্যে পৌঁছাতে পারতাম না আর পাপের থেকে কখনোই আমরা হৃদয়ের শুদ্ধতা লাভ করার আশা করতে পারতাম না; তা হলে সমস্ত বিপরীত চিরদিন বিপরীত হয়েই থাকতো, এবং আমরা কোনোদিনই এমন কোনো মাধ্যম পেতাম না যেখানে আমাদের সমস্ত পার্থক্য মিলন অভিমুখী হতে পারে। তা হলে আমাদের কোনো ভাষা থাকতো না, কোনো উপলব্ধি থাকতো না, হৃদয়ে হৃদয়ে কোনো মিলন হতো না, জীবনে কোনো সহযোগিতা থাকতো না। বিপরীতে, আমরা দেখি যে বিষয় সমূহের স্বাতন্ত্র্য অঘনীভূত অবস্থায় থাকে। তাদের স্বাতন্ত্র্য সর্বদা পরিবর্তিত হতে থাকে, তারা একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায় ও পরস্পরের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যায়, যতক্ষণ না বিজ্ঞান নিজেই অধিবিদ্যায় পরিবর্তিত হয়ে যায়, জড় পদার্থ তার সীমা হারিয়ে ফেলে ও জীবনের সংজ্ঞা ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ, আমাদের আত্মা পরমাত্মার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, কিন্তু তা পর হয়ে যাওয়া থেকে হয়নি বরং হয়েছে প্রেমের পরিপূর্ণতা থেকে। সেই কারণে অসত্য, দুঃখ ও অশুভ নিশ্চল হয়ে থাকে না, মানবাত্মা তাদের তুচ্ছ করতে পারে, তাদের অতিক্রম ক’রে যেতে পারে; শুধু তাই নয়, নতুন শক্তি ও সৌন্দর্যে তাদের সম্পূর্ণ রূপান্তরিত করতে পারে।
গায়ক তাঁর গানকে গাওয়ার মধ্যে রূপান্তরিত করেন, তাঁর আনন্দকে রূপের মধ্যে, আর শ্রোতা আবার সেই গাওয়াকে মূল আনন্দে রূপান্তরিত করতে বাধ্য থাকেন; তখনই গায়ক ও শ্রোতার মধ্যে যোগাযোগ সম্পূর্ণ হয়। নিয়মের বন্ধন নিজের উপর নিয়ে পরম আনন্দ নিজেকে নানা রূপে প্রকাশ করছেন, আর যখনই আমরা রূপ থেকে আনন্দে, নিয়ম থেকে প্রেমে ফিরে যাই, যখন সসীমের বন্ধন ছিন্ন করি ও অসীমের স্মৃতিতে ফিরে যাই, তখন আমরা আমাদের অভীষ্ট সাধন করি।
মানবাত্মার যাত্রা চলেছে নিয়ম থেকে প্রেমে, নিয়মানুবর্তিতা থেকে মুক্তিতে, নৈতিক স্তর থেকে আধ্যাত্মিকতায়। বুদ্ধদেব আত্মসংযম ও নৈতিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতার উপদেশ দিয়েছিলেন; এ হলো নিয়মকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করা। কিন্তু নিয়মের এই বন্ধন নিজেই নিজের পরিণাম হতে পারে না; তাকে সম্পূর্ণ আয়ত্তে এনে আমরা তাকে অতিক্রম করার উপায় রূপে সংগ্রহ করি। একে বলে ব্রহ্মে, অনন্ত প্রেমে প্রত্যাবর্তন, নিয়মের সীমিত বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে এ নিজেকে প্রকাশ করে। বুদ্ধদেব একে বলেন “ব্রহ্মবিহার”, ব্রহ্মের আনন্দে জীবিত থাকা। বুদ্ধদেবের মতে যিনি এই পর্যায়ে পৌঁছাতে ইচ্ছুক তিনি “কাউকে বঞ্চনা করবেন না, কারো সম্বন্ধে ঘৃণার ভাব পোষণ করবেন না, এবং ক্রোধের বশে কখনো আঘাত করতে চাইবেন না। সর্বজীবে তাঁর অপরিমেয় প্রেম থাকবে, যেমন ক’রে একজন মায়ের নিজের একমাত্র সন্তানের প্রতি থাকে, যাকে তিনি নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেন। কোনো বাধা বন্ধন না মেনে উঁচুতে, নীচুতে, চতুর্দিকে তিনি যে প্রেম বিস্তার করবেন, তা সমস্ত ক্রুরতা ও বিরুদ্ধতা মুক্ত। দাঁড়িয়ে, বসে, চলতে চলতে, শয়নে যতক্ষণ নিদ্রা না আসে, ততক্ষণ তাঁর মনকে তিনি বিশ্বের মঙ্গল কামনায় সক্রিয় রাখবেন।”
প্রেম না থাকা কাঠিন্যের একটি মাত্রা; কারণ প্রেম হলো পরিপূর্ণ সচেতনতা। আমরা ভালবাসি না কারণ আমরা বুঝতে পারি না, কিংবা অন্যভাবে আমরা বুঝতে পারি না কারণ আমরা ভালবাসি না। এইজন্য আমাদের চারিপাশের সমস্ত কিছুর পরম অর্থ প্রেম। এ কোনো ভাবপ্রবণতা মাত্র নয়; এ সত্য; এ সেই আনন্দ যা সমগ্র সৃষ্টির মূলে রয়েছে। এ ব্রহ্মের থেকে উদ্ভূত নির্মল চেতনার শুভ্র আলোক। কাজেই, যিনি সবকিছু অনুভব করেন সেই “সর্বানুভূঃ”, যেমন বহিরাকাশে বিরাজ করেন, সেইরকম আমাদের অন্তরাত্মাতেও বিরাজ করেন, তাঁর সঙ্গে এক হতে গেলে, আমাদের চেতনার সর্বোচ্চ শিখর প্রেমকে লাভ করতে হবে: “কে বা নিশ্বাস নিতে পারতো, কে বা সঞ্চরণ করতে পারতো যদি আকাশে এই আনন্দ না থাকতো বা প্রেম না থাকতো?”৩ আমাদের চেতনাকে প্রেমে উন্নত করার মধ্যে দিয়ে এবং সমগ্র বিশ্বে তাকে ছড়িয়ে দিয়ে আমরা “ব্রহ্ম বিহার” লাভ করতে পারি, সেই পরমানন্দের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারি।
প্রেম স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সুপ্রচুর উপহারে নিজেকে দিয়ে দেয়। কিন্তু এই উপহারগুলি তাদের সম্পূর্ণ তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে যদি আমরা তাদের মধ্যে দিয়ে সেই দাতা প্রেমে পৌঁছাতে না পারি। তা করতে হলে, আমাদের নিজেদের হৃদয়ে প্রেম থাকা আবশ্যক। যার নিজের মধ্যে প্রেম নেই সে তার প্রেমিকের দেওয়া উপহারের মূল্য কার্যকারিতা অনুসারে বিচার করে। কিন্তু কার্যকারিতা ক্ষণস্থায়ী ও আংশিক। এ কখনো আমাদের সমগ্র সত্তাকে অধিকার করতে পারে না; যেখানে আমাদের কোনো অভাব আছে শুধুমাত্র সেই পর্যন্ত যা উপযোগী তা আমাদের স্পর্শ করতে পারে। যখন আমাদের অভাব পূরণ হয়ে যায়, তখনো যদি কার্যকারিতা থাকে তা হলে তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকে, যখন আমাদের হৃদয়ে ভালবাসা থাকে তখন নিদর্শন মাত্রেরও আমাদের কাছে স্থায়ী মূল্য থাকে। কারণ এ কোনো বিশেষ ব্যবহারের জন্য নয়। এ নিজেই সম্পূর্ণ; এ আমাদের সমগ্র সত্তার জন্য আর সেই কারণে আমাদের কখনো ক্লান্ত করে না।
প্রশ্ন হলো, কিভাবে আমরা আনন্দের পূর্ণ উপহার রূপে এই জগৎকে গ্রহণ করতে পারি? আমরা কি একে আমাদের হৃদয়ে গ্রহণ করতে পেরেছি যেখানে আমরা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রাখার মতো আমাদের মূল্যবান বস্তু অবিনশ্বর ক’রে রাখি? আরো অনেক বেশী ক্ষমতা লাভের জন্য আমরা বিশ্বের শক্তিসমূহকে প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে কাজে লাগাচ্ছি; আমরা তার সঞ্চয় থেকে নিজেদের খাওয়াচ্ছি ও পোশাক পরাচ্ছি, তার ঐশ্বর্যের জন্য কাড়াকাড়ি করছি, আর আমাদের কাছে সে এক তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা কি এই জগতের উপর আমাদের মালিকানার অধিকার সম্প্রসারিত করার জন্য, ও তাকে এক বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করার জন্য জন্ম গ্রহণ করেছি? আমাদের সমস্ত মন যখন এই জগৎকে কেবল কাজে লাগানোর জন্যই ঝুঁকে পড়ে তখন তার প্রকৃত মূল্য আমাদের কাছে হারিয়ে যায়। আমাদের ঘৃণ্য বাসনায় আমরা তাকে সস্তা ক’রে ফেলি; আর এইভাবে আমাদের দিন শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা তার কাছ থেকে শুধু পুষ্টি লাভ করার চেষ্টা করি ও তার সত্য হারিয়ে ফেলি, ঠিক যেমন কোনো লোভী শিশু দামী বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নেয় আর তা গিলে ফেলার চেষ্টা করে।
যে সমস্ত দেশে নরমাংস ভোজনের প্রচলন আছে সেখানে মানুষ মানুষকে খাদ্য রূপে দেখে। সেই সকল দেশে সভ্যতা কখনো সমৃদ্ধ হতে পারে না, কারণ সেখানে মানুষ তার মহান মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে ও অতি সাধারণ হয়ে যায়। কিন্তু স্বগোত্র ভোজনের অন্য ধরনের ব্যবস্থাও আছে, যদিও ততটা স্থূল ভাবে নয়, কিন্তু জঘন্যতায় কোনো অংশে কম নয়, এর জন্য অনেক দূরে যেতে হবে না। সভ্যতার মানদণ্ডে যে সমস্ত দেশ অন্যের তুলনায় উন্নত, সেখানে অনেকসময় আমরা দেখি মানুষকে শুধুমাত্র দেহ হিসাবে দেখা হয়, এবং বিপণন কেন্দ্রে একমাত্র তার মাংসের দাম দিয়ে তার ক্রয় বিক্রয় হয়। আর কখনো বা সে কতটা কার্যকর তার থেকে সে তার একমাত্র মূল্য পায়; তাকে একটি যন্ত্র বানিয়ে ফেলা হয় ও আরো বেশী অর্থ উপার্জনের জন্য অর্থবান ব্যক্তি তাকে দিয়ে বাণিজ্য করেন। এইভাবে আমাদের লোভ, আমাদের লালসা, আমাদের আরামের প্রতি আসক্তি, পরিণামে মানুষকে সস্তা ক’রে তার মান নিম্নতম ক’রে দেয়। এ হলো ব্যাপক বিন্যাসে আত্মপ্রতারণা। আমাদের অন্তঃস্থিত সত্য সম্বন্ধে আমাদের বাসনা আমাদের অন্ধ ক’রে রাখে, আর আমাদের আত্মার প্রতি এই হলো আমাদের সব থেকে বড় অপরাধ। এ আমাদের চেতনার বিনাশ করে, এবং এ আধ্যাত্মিক আত্মহননের ক্রমিক উপায় ছাড়া আর কিছু নয়। সভ্যতার অঙ্গে এ কুশ্রী ক্ষত সৃষ্টি করে, জঘন্য বাসস্থান ও গণিকালয় স্ফীত করে, এর প্রতিহিংসামূলক দণ্ডবিধি, এর নিষ্ঠুর কারাগার ব্যবস্থা, এর বিদেশী জাতিগুলিকে শোষণ করার সুসম্বদ্ধ প্রণালী, স্থায়ী আঘাত লাগানো পর্যন্ত স্বশাসনের নিয়ন্ত্রণ ও আত্মরক্ষার উপায় থেকে তাদের বঞ্চিত করে।
অবশ্যই মানুষ মানুষের কাছে প্রয়োজনীয়, কারণ তার দেহ এক বিস্ময়কর যন্ত্র, আর তার মন এক চমৎকার সুদক্ষ ইন্দ্রিয়। তার উপর সে এক আত্মা, আর একমাত্র প্রেমের দ্বারাই এই আত্মাকে যথার্থ ভাবে জানা যায়। যখন আমাদের প্রত্যাশিত কর্মের বিপণন মূল্য দিয়ে আমরা কোনো মানুষের সংজ্ঞা নিরূপণ করি, তখন তাকে আমরা অসম্পূর্ণ ভাবে জানি। তার সম্বন্ধে এই সীমিত জ্ঞান থাকায় আমাদের পক্ষে তার উপরে অবিচার করা সহজ হয় আর আমাদের কিছু নির্দয় সুবিধা থাকার জন্য যখন বিজয়োল্লাসে আত্ম-অভিনন্দনের আবেগকে হৃদয়ে পোষণ করি তখন আমরা তাকে যা দিয়েছি তার থেকে অনেক বেশী তার কাছ থেকে পেতে পারি। কিন্তু আমরা যখন তাকে আত্মা রূপে জানি তখন আমাদের নিজের বলে জানি। তৎক্ষণাৎ আমরা অনুভব করি যে তার প্রতি নির্মমতা আমাদের নিজেদের প্রতি নির্মমতা, তাকে ছোট করা আমাদের নিজেদের মানবতা হরণ করা, আর শুধুমাত্র ব্যক্তিগত লাভের জন্য তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করলে আমরা যথার্থই যা দিয়েছি তার জন্য কেবল অর্থলাভ করি অথবা বিশ্রাম।
একদিন আমি গঙ্গার উপরে একটি নৌকায় বেরিয়েছিলাম। সেটি ছিল হেমন্তের এক সুন্দর সন্ধ্যা। সূর্য সবে অস্ত গিয়েছিল; আকাশের নীরবতা অনির্বচনীয় প্রশান্তি ও সৌন্দর্যে কানায় কানায় ভরে ছিল। সুবিস্তৃত জলরাশি নিস্তরঙ্গ ছিল, সূর্যাস্তের দীপ্তির সমস্ত পরিবর্তনশীল বর্ণবৈচিত্র্যের প্রতিফলন হচ্ছিল। মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ নির্জন বালুকাতট কোন্ পুরাকালের প্রকাণ্ড সরীসৃপের মতো শুয়ে ছিল, তার নানা রঙে উজ্জ্বল ত্বক চকচক করছিল। আমাদের নৌকা যখন খাড়া পাহাড়ের চূড়ার মতো নদীতীরের পাশ দিয়ে নিঃশব্দে ভেসে যাচ্ছিল যেখানে অসংখ্য পাখির বাসার কোটর প্রহেলিকার মতো ছিল, হঠাৎ সেখানে একটা বড় মাছ জলের উপর লাফিয়ে উঠলো আর তার পরেই হারিয়ে গেল, সন্ধ্যা আকাশের সমস্ত রঙ তার বিলীয়মান শরীরে ছড়িয়ে দিল। এক মুহূর্তের জন্য সে নানা রঙের পর্দা সরিয়ে দিল, তার পিছনে জীবনের আনন্দভরা এক নিস্তব্ধ জগৎ ছিল। কোন্ রহস্যময় বাসস্থানের গভীর থেকে এক সুন্দর নাচের ছন্দ নিয়ে সে উঠে এসেছিল আর দিনান্তের নিঃশব্দ ঐকতানের সঙ্গে তার নিজের সুর মিলিয়ে দিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন এক ভিনদেশী জগতের কাছ থেকে তার নিজস্ব ভাষায় এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্ভাষণ শুনেছিলাম, আর আমার মনকে সে এক ঝলক খুশীতে ভরিয়ে দিয়েছিল। তখন হঠাৎ হালের মাঝি পরিষ্কার আক্ষেপের সুরে চিৎকার ক’রে উঠলো, “আহারে কি বড় একটা মাছ!” তৎক্ষণাৎ তার চোখের সামনে মাছটিকে ধরা ও তার নৈশভোজের জন্য প্রস্তুত করার ছবি এসেছিল। সে মাছটিকে শুধু তার বাসনার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেরেছিল, আর সেইজন্য মাছের অস্তিত্বের সম্পূর্ণ সত্য বুঝতে পারেনি। কিন্তু মানুষ পুরোপুরি পশু নয়। সে আধ্যাত্মিক দর্শনের উচ্চাভিলাষী, এই দর্শন পূর্ণ সত্যের দর্শন। এ তাকে পরম আনন্দ দেয়, কারণ এই আনন্দ তার ও তার পারিপার্শ্বিকের মধ্যে গভীর সমন্বয় প্রকাশ করে। আমাদের বাসনাগুলি আমাদের আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্র সীমিত করে, আমাদের চেতনার বিস্তার প্রতিহত করে, আর পাপ বাড়িয়ে তোলে, অনৈক্য ও স্বতন্ত্রতার ঔদ্ধত্য প্রতিষ্ঠা ক’রে ঈশ্বরের কাছ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার এই হলো অন্তর্বর্তী প্রতিবন্ধক। তার কারণ পাপ একটি কর্ম মাত্র নয়, জীবন সম্বন্ধে এ এমন এক ধারণা, যে ধরেই নেয় যে আমাদের লক্ষ্য সীমাবদ্ধ, আমাদের সত্তাই চরম সত্য, ও আমরা স্বরূপতঃ সকলে এক নই, বরং প্রত্যেকে ব্যক্তিগত স্বতন্ত্র অস্তিত্বের জন্য জীবিত থাকি।
কাজেই আমি পুনরাবৃত্তি করছি যে যদি না আমরা মানুষকে ভালবাসি, আমরা কখনো তার সত্য রূপ দেখতে পাব না। ক্ষমতা বৃদ্ধি দিয়ে নয়, বরং কতটা উন্নতি হয়েছে, ও তার নিয়ম ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে কতটা মানবপ্রেম প্রকাশিত হয়েছে, তাই দিয়ে সভ্যতার বিচার ও তার মূল্য নিরূপণ করা উচিত। প্রথম ও শেষ যে প্রশ্নের উত্তর তাকে দিতে হয় তা হলো, মানুষকে সে যন্ত্রের থেকে বেশী আত্মা রূপে উপলব্ধি করে কিনা করলে কতটা করে? কিছু নির্মম মানসিকতা উৎপন্ন হওয়া ও মানুষের মর্যাদাহানি হওয়ার কারণে যখনই কোনো প্রাচীন সভ্যতার পতন ও বিনাশ হয়েছিল; যখন হয় রাষ্ট্র নয় কোনো শক্তিশালী মানবগোষ্ঠী জনসাধারণকে নিজেদের ক্ষমতার হাতিয়ার রূপে দেখতে শুরু করেছিল; যখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতিদের জোর ক’রে ক্রীতদাসে পরিণত ক’রে আর যে কোনো উপায়ে তাদের হীন ক’রে রাখার চেষ্টা হয়েছিল, তখন মানুষ নিজের মহত্ত্বের মূলে, নিজের স্বাধীনতাপ্রিয়তা ও ন্যায়বিচারের মূলে আঘাত করেছিল। কোনো রকমের স্বগোত্র ভোজন দিয়ে সভ্যতা কখনো নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। কারণ একমাত্র যা দিয়ে মানুষ সত্য হয়, তাকে শুধু প্রেম ও ন্যায়বিচারই পালন করতে পারে।
মানুষের সঙ্গে যেমন, এই বিশ্বের সঙ্গেও তেমন। যখন আমাদের বাসনার অবগুণ্ঠনের মধ্যে দিয়ে আমরা জগৎকে দেখি তখন তাকে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ ক’রে ফেলি, আর তার পরিপূর্ণ সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে থাকি। অবশ্যই এটা সুস্পষ্ট যে জগৎ আমাদের সেবা করে ও আমাদের প্রয়োজন মেটায়, কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ এখানেই শেষ হয়ে যায় না। প্রয়োজনের থেকে অনেক গভীর ও যথার্থ বন্ধনে আমরা তার সঙ্গে আবদ্ধ। আমাদের আত্মা তার মধ্যে অনুস্যূত থাকে; জীবনের প্রতি আমাদের প্রেম বস্তুতঃ এই মহান জগতের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ অবিচ্ছিন্ন রাখার ইচ্ছা। এই সম্বন্ধ প্রেমের সম্বন্ধ। আমরা আনন্দিত যে আমরা এর মধ্যে রয়েছি; এর সঙ্গে যে অসংখ্য সূত্রে আমরা যুক্ত, সেগুলি ভূতল থেকে নক্ষত্র পর্যন্ত প্রসারিত। ব্যবহারিক জগতের থেকে তার মৌলিক পার্থক্য কল্পনা ক’রে মানুষ মূর্খের মতো নিজের উচ্চতর পদমর্যাদা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, অন্ধ গোঁড়ামিতে অনেক সময় এই জগৎকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা পর্যন্ত যায়, তাকে নিজের সব থেকে ভয়ঙ্কর শত্রু বলে ধরে। তা সত্ত্বেও যত তার জ্ঞানের বৃদ্ধি হয়, তত মানুষের পক্ষে এই পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে যায়, আর নিজের চারপাশে যত কাল্পনিক সীমানা সে তৈরী করেছিল সেগুলি একের পর এক বিলুপ্ত হয়। প্রত্যেকবার আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্মানের কিছু কিছু নিদর্শন হারাই যা দিয়ে আমরা আমাদের মনুষ্যত্বকে তার পারিপার্শ্বিকের থেকে পৃথক করার অধিকার দিয়ে থাকি আর সে আমাদের অপমানের আকস্মিক আঘাত করে। কিন্তু এর কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়। যদি আমাদের আত্মোপলব্ধির পথে বিভাজন ও অনৈক্য সৃষ্টি করার জন্য আমরা আমাদের অহংকারকে স্থাপন করি, তা হলে আগেই হোক বা পরেই হোক, সত্যের চাকার তলায় তাকে পড়তে হবে, ও ধুলায় মিশে যেতে হবে। না, আমাদের উপরে এমন কোনো ভয়ঙ্কর শ্রেষ্ঠত্বের বোঝা চাপানো নেই, যা অদ্ভূত আকস্মিকতায় অর্থহীন। আত্মার গুণে আমাদের থেকে পরিমাপযোগ্য নয় এমন ক্ষুদ্র জগতে বাস করা আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ মর্যাদাহানিকর হতো, ঠিক যেমন ক’রে জন্ম থেকে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত দিনে ও রাতে, একদল ক্রীতদাস পরিবেষ্টিত হয়ে থাকা ও সেবা পাওয়া ঘৃণ্য ও অসম্মানজনক হতো। সম্পূর্ণ বিপরীতে, এই জগৎ আমাদের সহযোগী, বস্তুতঃ, আমরা তার সঙ্গে এক।
বিজ্ঞানে আমাদের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জগতের সমগ্রতা ও তার সঙ্গে আমাদের একাত্মতা ক্রমশই আমাদের মনে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। যখন এই পরিপূর্ণ একাত্মতার প্রত্যক্ষ শুধুমাত্র বুদ্ধিগত থাকে না, যখন সে আমাদের সমগ্র সত্তাকে এক সর্বানুভূ চেতনায় আরো বেশী প্রকাশ করে, তখন তা উজ্জ্বল এক আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, এক সুদূর প্রসারী প্রেম হয়ে ওঠে। বিশ্বজগতে আমাদের আত্মা তার বৃহত্তর সত্তা খুঁজে পায় এবং সে যে অমর এমন এক পরম নিশ্চয়তায় ভরে ওঠে। সত্তার নানা পরিবেষ্টনের মধ্যে সে শতবার মৃত্যু বরণ করে; কারণ বিচ্ছিন্নতার অমোঘ পরিণাম মৃত্যু, তাকে কখনো চিরস্থায়ী করা যায় না। কিন্তু যেখানে সে সকলের সঙ্গে এক, সেখানে সে কখনোই মৃত্যু বরণ করতে পারে না; কারণ সেখানে তার সত্য, তার আনন্দ। যখন কোনো ব্যক্তি সমগ্র বিশ্বের আত্মিক জীবনের ছন্দোময় স্পন্দন তাঁর নিজের আত্মায় অনুভব করেন, তখন তিনি মুক্ত হন। তখন তিনি নানা রঙের সসীমতার অবগুণ্ঠনে ঢাকা সুন্দরী ধরিত্রী-বধূ ও নিষ্কলঙ্ক শুভ্র পরমাত্মা-বরের নিভৃত প্রণয় প্রার্থনার মধ্যে প্রবেশ করেন। তখন তিনি জানেন যে এই সাড়ম্বর প্রেমোৎসবে তিনি একজন অংশগ্রহণকারী, ও অমরত্বের আনন্দোৎসবে তিনি একজন মাননীয় অতিথি। তখন তিনি ঋষি-কবির সঙ্গীতের অর্থ বুঝতে পারেন, “প্রেমের থেকে জগৎ উৎপন্ন হয়, প্রেমের দ্বারা পালিত হয়, প্রেমের দিকে গমন করে ও প্রেমের মধ্যে তার প্রবেশ।”
প্রেমের মধ্যে অস্তিত্বের সমস্ত বৈপরীত্য নিজেদের নিমগ্ন করে ও হারিয়ে যায়। একমাত্র প্রেমের মধ্যে অদ্বৈত ও দ্বৈত বিরুদ্ধ হয় না। প্রেমকে একই সময়ে এক ও দুই হতে হয়।
শুধুমাত্র প্রেমই একাধারে গতি ও স্থিতি। আমাদের হৃদয় সারাক্ষণ তার স্থান পরিবর্তন করে যতক্ষণ না প্রেম খুঁজে পায়, আর তখন সে তার স্থিতিলাভ করে। তার এই স্থিতি কর্মেরই এক প্রগাঢ় বিন্যাস যেখানে পরম শান্ত অবস্থা ও অবিরাম কর্মচাঞ্চল্য এক বিন্দুতে প্রেমে এসে মিলিত হয়।
প্রেমের মধ্যে ক্ষতি ও লাভ সমন্বিত হয়। তার হিসাব-নিকাশের পাতায় জমা ও খরচের হিসাব একই তালিকায় থাকে আর লাভের অঙ্কে উপহার যুক্ত হয়। সৃষ্টির এই বিস্ময়কর উৎসবে, ঈশ্বরের আত্মোৎসর্গের এই মহাসমারোহে, প্রেমিক প্রেমের মধ্যে নিজেকে পাওয়ার জন্য অবিরত নিজেকে বিসর্জন দেন। বস্তুতঃ, প্রেমই বিসর্জন ও গ্রহণ করাকে একত্রিত করে, এবং অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত রাখে।
প্রেমের এক মেরুতে দেখবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, অন্য দিকে নৈর্ব্যক্তিকতা। এক দিকে পাবে সদর্থক ঘোষণা— “আমি এখানে”; অন্যদিকে পাবে একই রকম জোরালো অস্বীকার— “আমি নেই।” এই অহংকার ছাড়া প্রেম কী? আবার, একমাত্র এই অহংকার দিয়ে কি ভাবে প্রেম সম্ভব?
বন্ধন ও মুক্তি প্রেমের ক্ষেত্রে বিরোধী নয়। তার কারণ প্রেম সর্বাধিক মুক্ত ও একই সঙ্গে সর্বাধিক বদ্ধ। ঈশ্বর যদি সম্পূর্ণ মুক্ত হতেন তা হলে সৃষ্টি হতো না। সেই অসীম সত্তা নিজের মধ্যে সীমার রহস্য গ্রহণ করেছেন। আর প্রেমস্বরূপ তাঁর মধ্যে সসীম ও অসীমকে এক করা হয়েছে।
সেই রকম, আমরা যখন স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-হীনতার আপেক্ষিক মূল্যায়ন করি, তখন তা শব্দ নিয়ে খেলা মাত্র হয়ে দাঁড়ায়। এমন নয় যে আমরা একমাত্র মুক্তি কামনা করি, আমরা দাসত্ব বন্ধনও চাই। প্রেমের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সসীম সব কিছুকে স্বাগত জানানো ও তাদের উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া। তার কারণ প্রেমের থেকে বেশী স্বাধীন আর কোনো কিছুই নয়, আবার এই রকম পরনির্ভরতাও আমরা আর কোথায় পাবো? প্রেমে দাসত্ব বন্ধনও যত স্বাধীনতাও তত মহিমান্বিত।
বৈষ্ণব ধর্ম স্পষ্ট ঘোষণা করেছে যে ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে নিজেকে আবদ্ধ করেছেন, আর সেখানেই মানব অস্তিত্বের শ্রেষ্ঠ মহিমা। সসীমের অপূর্ব ছন্দের সম্মোহনে প্রতি পদক্ষেপে তিনি নিজেকে বদ্ধ করেন, আর এই ভাবে তিনি তাঁর প্রেম বিতরণ করেন সঙ্গীতে তাঁর সুন্দরের পূর্ণাঙ্গ গীতিকাব্যে। সুন্দর হলো আমাদের হৃদয়ের ভালবাসা পাওয়ার জন্য তাঁর চেষ্টা; এ ছাড়া এর আর কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। সর্বত্র এ আমাদের বলে যে ক্ষমতা প্রদর্শন সৃষ্টির চরম অর্থ নয়; যেখানেই একটু রঙ আছে, গানের একটি সুর আছে, আকারের সৌষ্ঠব আছে, সেখানেই রয়েছে আমাদের প্রেমের জন্য আহ্বান। ক্ষুধা আমাদের বাধ্য করে তার নির্দেশ পালন করতে, কিন্তু মানুষের কাছে ক্ষুধা শেষ কথা নয়। এমন অনেক মানুষ ছিলেন যাঁরা সুচিন্তিত ভাবে এর নির্দেশ অমান্য করেছিলেন, এই দেখানোর জন্য যে মানবাত্মা অভাবের চাপ ও দুঃখের ভীতিপ্রদর্শনে পরিচালিত হয় না। বাস্তবিক, মনুষ্য জীবন যাপন করতে হলে, সব থেকে যে ক্ষুদ্র ও সব থেকে যে মহৎ সকলকেই প্রতিদিন এর দাবী প্রতিহত করতে হয়। কিন্তু অন্যদিকে, জগতে এক সৌন্দর্য রয়েছে যা কখনো আমাদের স্বাধীনতার অপমান করে না, আমাদের দিয়ে তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করিয়ে নিতে তার কনিষ্ঠ অঙ্গুলীও ওঠায় না। তাকে আমরা পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারি ও পরিণামে কোনো শাস্তি ভোগ না করতে পারি। আমাদের কাছে এ এক আহ্বান, কোনো আদেশ নয়। আমাদের মধ্যে এ প্রেমের সন্ধান করে, আর বাধ্যবাধকতা দিয়ে প্রেম পাওয়া যায় না। মানুষের কাছে শেষ আবেদন বাধ্যবাধকতা নয়, বরং আনন্দ। আর আনন্দ রয়েছে সর্বত্র; রয়েছে পৃথিবীর সবুজ ঘাসের আস্তরণে; আকাশের সুনীল প্রশান্তির মধ্যে; বসন্তের উদ্দাম উচ্ছ্বাসে; শীতের সুকঠোর সংযমে; আমাদের দেহ সৌষ্ঠবে প্রাণ সঞ্চারকারী প্রাণবন্ত জীব প্রকৃতিতে; মহিমান্বিত ও ন্যায়পরায়ণ মানবমূর্তির পরিপূর্ণ সাম্যে; জীবন যাপনে; আমাদের সমস্ত শক্তির ব্যবহারে; জ্ঞান অর্জনে; অশুভের বিরুদ্ধে সংগ্রামে; যে প্রাপ্তি আমরা কখনো ভাগ করতে পারবো না, তার জন্য জীবন বিসর্জনে। আনন্দ সর্বত্র; সে অপর্যাপ্ত; অনাবশ্যক; শুধু তাই নয় সে প্রায়ই প্রয়োজনের অলঙ্ঘ্য নির্দেশের বিরোধিতা করে। এক মাত্র প্রেমের দ্বারাই যে নিয়মের বন্ধন সমূহ বিশ্লেষণ করা যায় তা দেখানোর জন্যই সে রয়েছে; তারা দেহ ও আত্মার মতো। আনন্দ হলো ঐক্যের সত্য উপলব্ধি, জগতের সঙ্গে আমাদের আত্মার ঐক্য উপলব্ধি ও পরম প্রেমিকের সঙ্গে বিশ্বাত্মার ঐক্য উপলব্ধি।
তথ্যসূত্র
১. আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।
২. আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।
৩. কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ।