রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – কাজী নজরুল ইসলাম
মুখবন্ধ
আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। সে আজ ইংরিজি ১৯১৭ সালের কথা। সেইখানে প্রথম আমার হাফিজের সাথে পরিচয় হয়।
আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেব থাকতেন। একদিন তিনি দীওয়ান-ই-হাফিজ থেকে কতকগুলি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। শুনে আমি এমনই মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেইদিন থেকেই তাঁর কাছে ফারসি ভাষা শিখতে আরম্ভ করি।
তাঁরই কাছে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি।
তখন থেকেই আমার হাফিজের ‘দীওয়ান’ অনুবাদের ইচ্ছা হয়। কিন্তু তখনও কবিতা লিখবার মতো যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। এর বৎসর কয়েক পরে হাফিজের ‘দীওয়ান’ অনুবাদ করতে আরম্ভ করি। অবশ্য তাঁর রুবাইয়াত নয় – গজল। বিভিন্ন মাসিক পত্রিকায় তা প্রকাশিতও হয়েছিল। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি গজল অনুবাদের পর আর আমার ধৈর্যে কুলোল না, এবং ওইখানেই ওর ইতি হয়ে গেল।
তারপর এস. সি. চক্রবর্তী এন্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মহাশয়ের জোর তাগিদে ওর অনুবাদ শেষ করি।
যেদিন অনুবাদ শেষ হল, সেদিন আমার খোকা বুলবুল চলে গেছে!
আমার জীবনের যে ছিল প্রিয়তম, যা ছিল শ্রেয়তম তারই নজরানা দিয়ে শিরাজের বুলবুল কবিকে বাংলায় আমন্ত্রণ করে আনলাম।
বাংলার শাসনকর্তা গিয়াসুদ্দিনের আমন্ত্রণকে ইরানের কবি-সম্রাট হাফিজ উপেক্ষা করেছিলেন। আমার আহ্বান উপেক্ষিত হয়নি। যে পথ দিয়ে আমার পুত্রের ‘জানাজা’(শবযান) চলে গেল, সেই পথ দিয়ে আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তম ইরানি কবি আমার দ্বারে এলেন। আমার চোখের জলে তাঁর চরণ অভিষিক্ত হল।
অন্যত্র হাফিজের সংক্ষিপ্ত জীবনী দিলাম। যদি সময় পাই, এবং পরিপূর্ণ ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’ অনুবাদ করতে পারি, তখন হাফিজের এবং তাঁর কাব্যের পরিপূর্ণ পরিচয় দিবার চেষ্টা করব!
সত্যকার হাফিজকে চিনতে হলে তাঁর গজল-গান – প্রায় পঞ্চাশতাধিক –পড়তে হয়। তাঁর রুবাইয়াত বা চতুষ্পদী কবিতাগুলি পড়ে মনে হয়, এ যেন তাঁর অবসর সময় কাটানোর জন্যই লেখা। অবশ্য এতেও তাঁর সেই দর্শন, সেই প্রেম, সেই শরাব-সাকি তেমনিভাবেই জড়িযে আছে!
এ যেন তাঁর অতল সমুদ্রের বুদ্বুদ কণা। তবে এ ক্ষুদ্র বিম্ব হলেও এতে সারা আকাশের গ্রহ-তারার প্রতিবিম্ব পড়ে একে রামধনুর কণার মতো রাঙিয়ে তুলেছে। হয়তো ছোটো বলেই এ এত সুন্দর।
আমি অরিজিন্যাল (মূল) ফারসি হতেই এর অনুবাদ করেছি। আমার কাছে যে কয়টি ফারসি ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’ আছে, তার প্রায় সব কয়টিতেই পঁচাত্তরটি রুবাইয়াত দেখতে পাই। অথচ ফারসি সাহিত্যের বিশ্ববিখ্যাত সমালোচক ব্রাউন সাহেব তাঁর History of Persian Literature-এ এবং মৌলানা শিবলি নোমানি তাঁর ‘শেয়রুল-আজম’-এ মাত্র ঊনসত্তরটি রুবাইয়াতের উল্লেখ করেছেন; এবং এই দুইজনই ফারসি কবি ও কাব্য সম্বন্ধে authority – বিশেষজ্ঞ।
আমার নিজেরও মনে হয, ওঁদের ধারণাই ঠিক। আমি হাফিজের মাত্র দুটি রুবাইয়াত বাদ দিয়েছি – যদিও আরও তিন চারটি বাদ দেওয়া উচিত ছিল। যে দুটি রুবাইয়াত বাদ দিয়েছি তার অনুবাদ নিম্নে দেওয়া হল। সমস্ত রুবাইয়াতের আসল সুরের সঙ্গে অন্তত এই দুটি রুবাইয়াতের সুরের কোনো মিল নেই। বেসুরো ঠেকবে বলে আমি এ দুটির অনুবাদ মুখবন্ধেই দিলাম।
১
জমায় না ভিড় অসৎ এসে
যেন গো সৎলোকের দলে।
পশু এবং দানব যত
যায় যেন গো বনে চলে।
আপন উপার্জনের ঘটায়
হয় না যেন মুগ্ধ কেহ,
আপন জ্ঞানের গর্ব যেন
করে না কেউ কোনো ছলে
২
কালের মাতা দুনিয়া হতে,
পুত্র, হৃদয় ফিরিয়ে নে তোর!
যুক্ত করে দে রে উহার
স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ওর।
হৃদয় রে, তুই হাফিজ সম
হস যদি ওর গন্ধ-লোভী,
তুইও হবি কথায় কথায়
দোষগ্রাহী, অমনি কঠোর!
.
রুবাইয়াতের আগাগোড়া শরাব, সাকি, হাসি, আনন্দ, বিরহ ও অশ্রুর মধ্যে এই উপদেশের বদ-সুর কানে রীতিমতো বেখাপ্পা ঠেকে।
তাছাড়া কালের বা সময়ের মাতাই বা কে, পিতাই বা কে, কিছু বুঝতে পারা যায় না।
আমার অনুবাদের আটত্রিশ নম্বর রুবাই-ও প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয়। কেননা, প্রথম দুই লাইনের সাথে শেষের দুই লাইনের কোনো মিল নেই, এবং ওর কোনো মানেও হয় না। দিনের ঔরসে রাত্রি গর্ভবতী হবেন, এ আর যিনি লিখুন – হাফিজ লিখতে পারেন না।
এই জন্যই ব্রাউন সাহেব বলেছেন ফারসি কবিতার সবচেয়ে শুদ্ধ সংস্করণ হচ্ছে – তুরস্কে প্রকাশিত গ্রন্থগুলি। তাঁর মতে – তুর্কিরা নাকি হিন্দুস্থানি বা ইরানির মতো ভাবপ্রবণ নয়। কাজেই তারা নিজেদের দু-দশ লাইন রচনা অন্য বড়ো কবিদের রচনার সাথে জুড়ে দিতে সাহস করেনি বা পারেনি। অথচ, ভারতের ও ইরানের সংগ্রাহকেরা নাকি ওইরূপ দুঃসাহসের কাজ করতে পশ্চাৎপদ নন এবং কাজও তা করেছেন।
এ অনুযোগ হয়তো সত্যই। কেননা আমি দেখেছি, পারসি কাব্যের (ভারতবর্ষে প্রকাশিত) বিভিন্ন সংস্করণের কবিতার বিভিন্ন রূপ। লাইন, কবিতা উলটোপালটা তো আছেই, তার ওপর কোনোটাতে সংখ্যায় বেশি কোনোটায় কম কবিতা। অথচ তুরস্ক-সংস্করণ বই সংগ্রহ করাও আমাদের পক্ষে একরূপ অসাধ্য।…
হাফিজকে আমরা কাব্য-রস-পিপাসুর দল কবি বলেই সম্মান করি, কবিরূপেই দেখি। তিনি হয়তো বা সুফি-দরবেশও ছিলেন। তাঁর কবিতাতেও সে আভাস পাওয়া যায় সত্য। শুনেছি, আমাদের দেশেও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব সেন প্রভৃতি হাফিজের মতো কবিতা উপাসনা-মন্দিরে আবৃত্তি করতেন। তবু তাঁর কবিতা শুধু কবিতাই। তাঁর দর্শন আর ওমর খাইয়ামের দর্শন প্রায় এক।
এঁরা সকলেই আনন্দ-বিলাসী। ভোগের আনন্দকেই এঁরা জীবনের চরম আনন্দ বলে স্বীকার করেছেন। ইরানের অধিকাংশ কবিই যে শরাব-সাকি নিয়ে দিন কাটাতেন, এ তো মিথ্যা নয়।
তবে, এও মিথ্যা নয় যে, মদিরাকে এঁরা জীবনে না হোক, কাব্যে প্রেমের আনন্দের প্রতীকরূপেই গ্রহণ করেছিলেন।
হাফিজ এক জায়গায় বলেছেন – ‘কাল আমার গুরু মসজিদ ছেড়ে পানশালার দিকে যাচ্ছেন দেখলাম, ওগো তোমরা বলো – আমি এখন কোন্ পথ গ্রহণ করি। অর্থাৎ তিনি বলতে চান – পানশালা প্রেমোন্মত্তের মন্দির; সেইখানেই সত্যকে পাওয়া যায়।
মুসলমান-শাস্ত্রে শরাব বা মদিরাপান হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ। কাজেই এঁদেরে গোঁড়ার দল আজও কাফের বলে অভিহিত করে – সে-যুগের কথা না-ই বললাম।
ইরানি কবিদের অধিকাংশই তথাকথিত নাস্তিকরূপে আখ্যাত হলেও এঁরা ঠিক নাস্তিক ছিলেন না। এঁরা খোদাকে বিশ্বাস করতেন। শুধু স্বর্গ, নরক, রোজকিয়ামত (শেষ বিচারের দিন) প্রভৃতি বিশ্বাস করতেন না। কাজেই শাস্ত্রাচারীর দল এঁদের উপর এত খাপ্পা ছিলেন। এঁরা সর্বদা নিজেদের ‘রিনদান’ বা স্বাধীনচিন্তাকারী, ব্যভিচারী বলে সম্বোধন করতেন। এর জন্য এঁদের প্রত্যেককেই জীবনে বহু দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছিল।
হাফিজের সমস্ত কাব্যের একটি সুর –
‘কায় বেখবর, আজ ফস্লে গুল ও তরকে শরাব।’
‘ওরে মূঢ়! এমন ফুলের ফসলের দিন – আর তুই কিনা শরাব ত্যাগ করে বসে আছিস!’
***
আমাকে যাঁরা এই রুবাইয়াত অনুবাদে নানারূপে সাহায্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে আমার শ্রেয়তম আত্মীয়াধিক বন্ধু গীত-রসিক শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত সরকার অন্যতম। তাঁরই অনুরোধে ও উপদেশে এর বহু অসুন্দর লাইন সুন্দরতর হয়ে উঠেছে। যদি এ অনুবাদে কোনো ত্রুটি না থাকে, তবে তার সকল প্রশংসা তাঁরই।
বিনয়াবনত
নজরুল ইসলাম
কলিকাতা
১ আষাঢ়
১৩৩৭
Leave a Reply