মিসির আলি অমনিবাস ৩ – হুমায়ূন আহমেদ
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০১৩
নিবেদন
এই পাতা কয়টি বরাদ্দ থাকে লেখকের জন্য। প্রিয় গ্রন্থটি নিয়ে লেখকের কিছু বয়ান যা পাঠকের সামনে খুলে দেয় দরজা, ভালো লাগার প্রিয় কিছু কথার বারতা।
মিসির আলি অমনিবাস প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে হুমায়ূন আহমেদ পাঠকদের কাছে তাঁর প্রিয় কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। তৃতীয় খণ্ডে এসে সব এলোমেলো হয়ে গেল। প্রথমত, মিসির আলি অমনিবাসের তৃতীয় খণ্ড এত দ্রুত বের করার পরিকল্পনা ছিল না—কেননা মিসির আলির দ্বিতীয় খণ্ড তো বের হল সেদিনই। মিসির আলি আরো কয়েকটি রহস্যময়তার সন্ধান ও সমাধান করবেন তারপর হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বের হবে মিসির আলির তিন নম্বর খণ্ড -এরকম পরিকল্পনাই ছিল।
হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে মিসির আলি আর হিমু ব্যতিক্রম। এই দুই চরিত্র বিপরীতমুখী কিন্তু মিলও আছে—দু’জনই ছন্নছাড়া প্রকৃতির। সংসারী নন, আবার সংসারবিরোধীও নন। মিসির আলি চলেন লজিকের সুতা গুটাতে গুটাতে আর হিমুর উড়ন্ত ঘুড়িটা ভোঁ-কাট্টা সব সময়।
কিন্তু সব এখন থেমে গেল—মিসির আলির লজিক কিংবা হিমুর বোহেমিয়ান জীবন। লেখকের কলম নিথর হয়ে গেল। লেখক চলে গেলেন আরেক জীবনে—যে জীবন দোয়েলের নয়, শালিকের নয়। শুধু এক বিপন্ন বিস্ময় আর রহস্যময়তার কুয়াশার চাদরে মোড়ানো।
বিজ্ঞানের এক সূত্র উল্লেখ করে হুমায়ূন প্রায়ই বলতেন, সবকিছু আগেই নির্ধারিত হয়ে আছে। আমরা সেই পূর্বনির্ধারিত ঘটনার মধ্য দিয়েই চলছি। এই সূত্র মানলে বলতে হয় মিসির আলি বলে একটি চরিত্র জন্ম নেবে—আমরা ভাবব কাকতালীয়ভাবে, অথচ কাকতালীয় নয়—এটাই হওয়ার কথা ছিল।
১৯৮৪ সালের শেষ দিকে সংবাদপত্রগুলোতে একটানা বাইশ দিন ধর্মঘট চলছিল। একটা জাতি টানা বাইশ দিন সংবাদপত্রের মুখ দেখে নি, গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস যাঁদের, তাঁরা কী চরম বিস্বাদের সঙ্গেই না সকালটা পার করেছেন। তখন ইন্টারনেট নেই, অনলাইন পত্রিকাও নেই, বিটিভিই ছিল ভরসা।
তখন আমি সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিভাগীয় সম্পাদক। তো সেই কৰ্মবিহীন চাঞ্চল্যে বিচিত্রা অফিস হয়ে উঠল আড্ডাবিচিত্রা। সাংবাদিক আসেন, লেখক, কবি আসেন—কখনো কখনো রাজনীতিবিদ আসেন। সময় কেটে যায় ধুন্ধুমার আড্ডায়। চা-বিস্কিট উড়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। এরই মধ্যে ঘটল এক ঘটনা।
সেদিনও আড্ডা জমেছিল। সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর ঘরে।
আড্ডার এক পর্যায়ে কথা উঠল দেশী-বিদেশী সাহিত্য আর বই নিয়ে। বই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেকের কণ্ঠে আফসোসের সুর—বিদেশে ভালো বই, সাহিত্যের বই, ক্ল্যাসিক সবই কম দামে পেপারব্যাক এডিশানে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে কেন পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গেও এরকম হচ্ছে না। আমরা সে সময়ে বিশ্বসাহিত্যের, সংস্কৃতির সব লেখাই পড়েছি পেপারব্যাক এডিশানে। দাম কম, বহন করাও কষ্টকর নয়। পশ্চিমা সাহিত্য ছাড়াও লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, চীনা বা জাপানি লেখার সঙ্গে পরিচিত হই পেপারব্যাগ এডিশান দিয়েই। তখন ঢাকায় অনেক ভালো ভালো বই পাওয়া যেত। বিদেশী বইয়ের দোকানও ছিল। এখন কেউ ভাবতে পারবেন যে স্টেডিয়ামে ছিল বইয়ের একাধিক দোকান। সবগুলোতে বিদেশী বইয়ে তাক ভর্তি। দূরদূরান্ত থেকে পাঠকরা আসতেন, বই কিনতেন।
যাক, সেদিন আড্ডায় পেপারব্যাক, সুলভে সাহিত্য পড়ার বাসনা নিয়ে হাপিত্যেশ করতে করতে একসময় শাহাদত চৌধুরী বলেই বসলেন— আলমগীর তোমাদের তো বইয়ের ব্যবসা রয়েছে, তা তুমিই এমন একটা উদ্যোগ নাও না কেন? হ্যাঁ, প্রকাশনা আমাদের পৈতৃক ব্যবসা। এই প্রতিষ্ঠানটি এখনো টিকে আছে—যার বয়স সত্তর পার হয়েছে।
সেদিন যাঁরা ওই ঘরে উপস্থিত ছিলেন—সবার নাম তো মনে নেই, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, রেজোয়ান সিদ্দিকী, সৈয়দ লুৎফুল হকসহ আরো কয়েকজন। তাঁরা বললেন, হ্যাঁ এটা তো করা যায়।
কিন্তু সমস্যা হল পেপারব্যাক বই লিখবেন কে? রাজি কে হবেন নিউজপ্রিন্টে বই লিখতে। পেপারব্যাক মানে তো খুলনার নিউজপ্রিন্টে ছাপানো বই—যে কাগজে সাধারণত নোটবই প্রকাশিত হয়। এখনকার মতো বিদেশী কাগজের ছড়াছড়ি ছিল না সে সময়। প্রকাশকদের অবলম্বন ছিল খুলনার নিউজপ্রিন্ট আর কর্ণফুলীর লালচে-সাদা কাগজ
সেদিন আড্ডায় ঠিক হয় বই যদি বেরই করতে হয় তবে তা হবে মৌলিক বই অর্থাৎ পেপারব্যাকে মৌলিক সাহিত্যগ্রন্থ
কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এ যেন ঈশপের গল্পের পুনরাবৃত্তি—মহা কঠিন কাজ—পেপারব্যাক বই লিখতে কাকে অনুরোধ করা যায়? বলা মাত্রই হয়তো শুনতে পাব, কী যে বলো নিউজপ্রিন্টে বই ছাপাতে যাব কোন দুঃখে? আমার কি প্রকাশকের অভাব রয়েছে? না, বলছিলাম কি—সুলভ মূল্যে সাহিত্যের বই প্রকাশ করলে অনেক বেশি পাঠক তা কিনতে পারবে— এই আর কি। তখন হয়তো গম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলবেন, বুঝলে সস্তার কাজ মোটেই ভালো হয় না। যাক সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমরা কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। আড্ডার মধ্যে হতাশ বাতাসের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছি, তখন একজনের কথা উঠতেই সবাই যেন বলে উঠল তাই তো!
হুমায়ূন আহমেদ। বিচিত্রা অফিসে তাকে দেখেছি অনেক বার। আমার টেবিলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেন শাহাদত চৌধুরীর ঘরে। ছিমছাম একটা মানুষ। হাতে কখনো বই বা ম্যাগাজিন কখনো সিগারেট। আমার সঙ্গে কথা হতো না। শাহাদত চৌধুরীর ঘরে বসে আড্ডা দেয়ার সময়ও আমার ডাক পড়ত না। শাহরিয়ার কিংবা মুনতাসীরের সঙ্গে সমস্বরে কিছু কথাবার্তা ভেসে আসত। আর কথার ফাঁকে শাহাদত চৌধুরীর কাগজ ছেঁড়ার শব্দ। কথা বলার সময়, আড্ডা দেয়ার সময় শাহাদত চৌধুরী আনন্দের সঙ্গে একটা কাজ করতেন- নিউজপ্রিন্টের রাইটিং প্যাডের পাতা এমাথা ওমাথা ছেঁড়া। এমন নয় যে ফড়াৎ করে টান দিয়ে কাগজটাকে দু’টুকরো করে ফেলতেন। তার স্টাইল ছিল প্যাডের পাতাটা এমাথা থেকে ওমাথা সরু ফিতার মতো করে ছিঁড়ে ফেলা। ছিঁড়তে গেলে একটা অদ্ভুত শব্দ হয়—সেই শব্দ বা অনুরণন মনে হয় তাঁকে আনন্দ দিত।
তা হলে এই হল ঘটনা। হুমায়ূনকে প্রস্তাব দেবেন কে আর হুমায়ূন আহমেদ এ কথায় রাজি হবেন যে তার গ্যারান্টি কী? হুমায়ূন তো তখনো জনপ্রিয়, তা তো তাঁর প্রথম উপন্যাস থেকেই। তবে বর্তমানের মতো পরিস্থিতি হয় নি যে বই বের হলেই পঞ্চাশ হাজার কপি নিঃশেষ। এর পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল মাত্র তখন। তবে কেন জানি সবাই তাঁকেই পছন্দ করল। রাজি হোন বা না হোন তাঁকেই বলা যায় সব কথা।
মুনতাসীর মামুন তখন বসবাস করেন মগবাজার ইস্পাহানী কলোনিতে। চারদিকে বাগানঘেরা একতলা বাসা। না ঢুকলে বোঝা যাবে না ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে এরকম খোলামেলা জায়গা আছে। মুনতাসীরের বাসায় আমরা বসব ঠিক হল। তর সইছিল না, মনে হয় সেদিন আমরা ক’জন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মুনতাসীর মামুনের বাসায় গিয়ে হাজির হই। একসময় হুমায়ূন এলেন—চা সিগারেট, না মামুনের বাসায় সিগারেট খাওয়া যেত কি না মনে নেই—তবে জমপেশ চা-নাস্তার আয়োজন থাকত। সেদিনও ছিল। সবার নাম মনে পড়ছে না। সেদিন মামুনের বাসায় হাজির ছিলেন শাহরিয়ার কবির, ইমদাদুল হক মিলন, রেজোয়ান সিদ্দিকী। কিছুক্ষণ টুকটাক একথা ওকথা বলার পর মূল বিষয়ে আসা গেল। সব বলা হল। চুপচাপ শুনলেন এবং রাজিও হলেন। আমরা হতবাক বা বিস্মিত নই। তার চেয়ে বেশি আমাদের দম বন্ধ হয়ে ছিল কী জবাব দেন—তা থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হুমায়ূন রাজি হওয়ার পরপরই ঘটনাটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটা টোকেন অগ্রিম সম্মানী দেয়া হল। আগে থেকে প্রস্তুতি ছিল না। পকেটে অর্থও খুব ছিল না। যা ছিল তাই—জানেন কী পরিমাণ অর্থ অগ্রিম সম্মানী দেয়া হয়েছিল? মাত্র এক হাজার টাকা।
পরবর্তী ঘটনা তো জানা। হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন, ‘দেবী’, জন্ম হল মিসির আলি নামক বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় চরিত্র। এদেশের ইতিহাসে প্রথম পেপারব্যাক মৌলিক সাহিত্যগ্রন্থ ‘দেবী’, অবসরের প্রথম বই। হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলির মতো ‘অবসর’কে নিয়ে এলেন সবার সামনে।
আলমগীর রহমান
ঢাকা : ১৫ জানুয়ারি ২০১৩
সূচি
Leave a Reply