প্রেম – সৈয়দ মুজতবা আলী
নিকোলাস লেসকফ
রচিত
মৎসেনস্ক জেলার
লেডি ম্যাকবেৎ
শ্রীমান অবধূতের করকমলে
.
অনুবাদকের নিবেদন
নিকোলাই সেমোনোভিচ লেস্কফের প্রেম (আসলে নাম মৃৎসেনস্ক জেলার লেডি ম্যাকবেৎ) গল্পটি আমার কাছে অনবদ্য এবং বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয় বলে মনে হয়। লেস্কফের জন্ম ১৮৩১-এ এবং মৃত্যু ১৮৯৫-এ। প্রেম প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে। ওই সময় তলস্তয় ও তুর্গেনিয়ে তাঁদের খ্যাতির মধ্যগগনে। সে সময় লেখক হিসেবে নাম করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। আরেকটি কথা বললেই যথেষ্ট হবে। এর কয়েক বৎসর পরে যখন ফ্রান্সে মপাসার ছোটগল্প মাসিকপত্রে বেরোতে আরম্ভ করে তখন সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই সেগুলোর অনুবাদ অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় হতে থাকে, এক রুশ ভাষা ছাড়া যদিও রুশদেশই সে যুগে ফ্রান্সের সবচেয়ে বেশি নকল করত। তার কারণ রুশাকাশে তখন একাধিক অত্যুজ্জ্বল গ্রহ উপগ্রহের সংযোগ।
এই উপন্যাসটি প্রায় যেন গ্রিক ট্র্যাজেডি। নিয়তির অলঙ্ নির্দেশ, কিংবা বলতে পারেন প্রকৃতিদত্ত রজোগুণের কাম-তাড়নায় (কাতেরিনা) কিংবা নীচাশয়তায় (সেরগেই) এরা যেন কোন এক অজানিত করাল অস্তাচলের পানে এগিয়ে চলেছে। নিদারুণ কঠিন অবস্থায় পড়ে এরা তখন কীসব অমানুষিক কাজ করে তারই উল্লেখ করতে গিয়ে স্বয়ং লেকই বলেছেন, যারা এই উপদেশবাণীতে কর্ণপাত করে না, এ রকম বীভৎস অবস্থায় যাদের হৃদয়ে মৃত্যু-চিন্তা প্রলোভনের চেয়ে ভয়ের সৃষ্টি করে বেশি তাদের করতে হয় বীভৎসতর এমন কিছু যেটা এই আর্ত ক্রন্দন-ধ্বনির টুটি চেপে ধরে তাকে নীরব করে দেবে। এই তত্ত্বটি আমাদের নিত্যদিনের সাধারণ সাদামাটা সরল মানুষ উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করতে জানে; এ অবস্থায় সে লাগাম ছেড়ে তার নির্ভেজাল নীচ পাশবিক প্রবৃত্তিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেয়; সে তখন সাজে সঙ, নিজেকে নিয়ে আরম্ভ করে নিষ্ঠুর খেলা, আর-পাঁচজন মানুষকে নিয়েও তাদের কোমলতম হৃদয়ানুভূতি নিয়ে। এরা (এস্থলে সাইবেরিয়াগামী যাবজ্জীবন কঠোর কারাদণ্ডে কয়েদির পাল) এমনিতেই অত্যধিক কোমল স্বভাব ধরে না– এরকম অবস্থায় পড়ে তারা হয়ে যায় দ্বিগুণ পিশাচ।
এবং বীভৎস রসের সঙ্গে সঙ্গে এতে আছে অতি মধুর গীতিরস, রুশ নিদাঘ দিনান্তের অপূর্ব বর্ণনা, প্রেমের আকুতি-মিনতি, অভিমান, ক্ষণকলহ, মিলন-বিচ্ছেদ- এবং সর্বশেষে দয়িতের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ।
এস্থলে আমি ব্যক্তিগতভাবে সভয়ে সবিনয় নিবেদন করি, এবং যুক্তি না দেখিয়ে সংক্ষেপেই করি, কাতেরিনা যত পাপাচারই করে থাকুক, তার একনিষ্ঠ প্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। তথাকথিত ভদ্র মানবসমাজেও এ জাতীয় প্রেম বিরল। চেখফের দুলালি পড়ে তলস্তয় পরবর্তী যুগে যা বলেছেন, হয়তো এস্থলেও তা-ই বলতেন।
মপাসাঁর বেল আমি-র সঙ্গে পাঠক এ নভেলিকার মিল দেখতে পাবেন। কিন্তু বে আমি প্রকাশিত হয় লেস্কফের বইয়ের কুড়ি বৎসর পরে। মপাসার যৌবনে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত তুর্গেনিয়েফের ফ্লোবেরের বাড়িতে। হয়তো-বা সে সময় তুর্গেনিয়ে গল্পটি মুখে মুখে মপাসাঁকে বলে থাকতে পারেন– কারণ মপাসা যখন প্লটের জন্য মাকে চিঠি লিখতে পারেন তখন তাঁর প্রতি সদাস্নেহশীল গুরুসম তুর্গেনিয়েফকে যে তিনি এ বিষয়ে অনুরোধ করবেন তাতে আর বিচিত্র কী? মপাসার চিঠিতেই রয়েছে, তিনি একবার তুর্গেনিয়েকে জিগ্যেস করেন, মাতাল ইংরেজ খালাসি যদি হঠাৎ গান ধরে তবে তারা কি গান গাইবে– গড় সেভ দি কুইন? তুর্গেনিয়ে বললেন, বরঞ্চ গাইবে রুল ব্রিটানিয়া এবং সেইটি অনুবাদ করে তাঁকে সাহায্য করেন।
এ পুস্তকে আদিরসের প্রাধান্য হয়তো বাঙালি পাঠকের কিঞ্চিৎ পীড়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু রুশ-সাহিত্যের মহারথীরাও এই ধরনেই লিখেছেন (তলস্তয়ের নেখলুদ-মাসলভা, এবং গোর্কির তো কথাই নেই)। বস্তুত এ বই যদি লিখতেই হয় তবে এছাড়া গতি নেই। কুমারসম্ভব লিখতে হলে কালিদাসের মতোই লিখতে হয়, চৌরপঞ্চাশিকা লিখতে হলে চূড়ের মতো লিখতে হয়।
অনুবাদ করতে হলে যে-কটি গুণের প্রয়োজন হয়, তার একটিও আমার নেই। তাই আমি আমার একাধিক মিত্র তথা শিষ্যকে এই নভেলিকাটি অনুবাদ করার জন্য অনুরোধ করেছি। তাঁরা করেননি বলেই (মাঝখান থেকে বইখানি আমাকে তিন-তিনবার কিনতে হয়েছে!) আমি এটাতে হাত দিয়েছিলুম। করতে গিয়ে বুঝতে পারলুম, অনুবাদ-কর্ম কী কঠিন গর্ভযন্ত্রণা। নিজের আপন লেখা আপন পাঁঠা, কিন্তু পরেরটা বলি দিতে হয় শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে। তদুপরি যে সমস্যা আমাকে সবচেয়ে চিন্তায় ফেলছে সেটি এই : যদি সেটাকে মধুর বাঙলায় হুবহু আপন মাতৃভাষায় যেরকম বলি, শুনি, সেরকম অনুবাদ করি তবে বাঙালি পাঠক সেটি হোঁচট না খেয়ে খেয়ে আরামে পড়ে যাবেন কিন্তু তাতে রুশ-বৈশিষ্ট্য মারা যাবে। পক্ষান্তরে সে বৈশিষ্ট্য রাখতে গেলে অনুবাদ হয়ে যায় আড়ষ্ট, পাঠক রস পায় না– তা হলে আর বৃথা পরিশ্রম করলুম কেন? তবে মাঝে মাঝে ইক, সামোভার, আপেলগাছ, ভগা, নিজনি নভগরদ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে প্রয়োজনীয় রুশ আবহাওয়া তৈরি করে। তবু বলি, অনুবাদটি যোগ্য ব্যক্তির করা উচিত ছিল।
সর্বশেষে নিবেদন, কয়েক মাস ধরে নিদ্রাকৃতায় ভুগি। তখন চিকিৎসক উপদেশ দেন, কোনও মৌলিক রচনায় হাত না দিয়ে যেন অনুবাদ-কর্ম আরম্ভ করি– তাতে করে রোগশয্যার একঘেয়েমি থেকে খানিকটে মুক্তি পাব। রোগশয্যার অজুহাত শুনে আমার অনুরাগী পাঠক (এ নিবেদনটি একমাত্র তাদেরই উদ্দেশে) যে অনুবাদ পছন্দ করে বসবেন, এ আশা আমার করা অনুচিত, কিন্তু কটু-কাটব্য করার সময় হয়তো সেকথা ভেবে খানিকটে ক্ষমার চোখে দেখবেন। এবং অতি সর্বশেষ নিবেদন, অনিদ্রারোগে অনুবাদকর্ম অতিশয় উপকারী। এটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বললুম। আমার মতো যারা অন্দ্রিায় ভুগছেন তারা উপকৃত হবেন। কিমধিকমিতি ॥
—সৈয়দ মুজতবা আলী
.
পাত্রপাত্রী
রুশ উপন্যাসে একই পাত্রকে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রপাত্রী ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে বলে নিম্নে তাদের নির্ঘণ্ট দেওয়া হল :
পরিবারের নাম –ইসমাইলফ
বাড়ির কর্তা — বরিস তিমোতেইয়েভিচ ইসমাইলফ, বরিস তিমোতেইয়েভিচ
পুত্র –জিনোভিই বরিসিচ
বরিসের পুত্রবধূ, জিনোভিইয়ের স্ত্রী –কাতেরিনা লভভনা ইসমাইলভা, কেট, কেতারিনা লভভনা, লভভনা
পুত্রবধূর প্রণয়ী –গেই ফিলিপচ, সেরেজকা, জেশকা, সেরেজেঙ্কা, সেরেজা
পাচিকা –সনিয়া
সম্পত্তির অংশীদার বালক –দর জাখাফর লিয়ামিন, ফেদিয়া
কয়েদি –য়োনা, সোনেৎকা ও অন্যান্য
Leave a Reply