১০. মালিকানা স্বত্ব

১০.

অকস্মাৎ সেরগেই ফেদোর লিয়ামি এবং তার মালিকানা স্বত্ব সম্বন্ধে সর্ব আলোচনা বন্ধ করে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে ফেদোরের চিন্তা কাতেরিনার সর্ব হৃদয়-মন যেন গ্রাস করে বসল। দুশ্চিন্তা আশঙ্কা তাকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করে তুলল যে, সে যেন তার জাল ছিন্ন করে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না। এমনকি সেরগেইকে আদর-সোহাগ করা পর্যন্ত তার আর রুচছিল না। ঘুমন্ত অবস্থায়ই হোক, কিংবা ঘর-সংসারের কাজ-কর্ম করার সময়েই হোক, অথবা তার ইষ্ট-দেবতাকে স্মরণ করার সময়ই হোক– উদয়াস্ত তার মনে মাত্র একটি চিন্তা : এ যে এক্কেবারে ডাহা অবিচার। বাস্তবিকই এ আবার কী? কোত্থেকে পুঁচকে একটা ছোঁড়া এসে জুটল, আর আমি আমার সর্বস্ব থেকে বঞ্চিত হব? আমি এতখানি যন্ত্রণা সইলুম, পর্বতপ্রমাণ পাপের বোঝা আমার আত্মসত্তার ওপর চাপালুম, আর কোনও হাঙ্গামা-হুজ্জৎ না পুইয়ে, খড়ের কুটোটি পর্যন্ত কুড়িয়ে না তুলে হঠাৎ এই ছোঁড়াটা এসে আমার তাবৎ-সর্বস্ব কেড়ে নেবে?… তা-ও না হয় বুঝতুম, দাবিদার ভারিক্কি বয়েসের কেউ যদি হত– তা নয়, একটা নাবালক কোথাকার,- পুঁচকে ছোঁড়া।

***

বাইরে প্রথম শীতের আমেজ লেগেছে। জিনোভিই বরিসিচের কোনও খবরই কোনওদিক থেকে এল না– আর আসবেই-বা কী করে? কাতেরিনা ক্রমেই মোটা হয়ে উঠেছিল আর সমস্তক্ষণ ভাবনা-ভরা মন নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। ওদিকে শহরের লম্বা রসনা তাকে নিয়ে, তার কী করে এটা হল, তার কী করে সেটা হল তাই নিয়ে সুবোসাম জল্পনা-কল্পনা গুজব-গুল নিয়ে মেতে উঠেছিল : যেমন– এই যে হুঁড়ি কাতেরিনাটা অ্যাদ্দিন ধরে ছিল বাজা পাঠীটা আর দিনকে দিন শুকোতে শুকোতে হয়ে যাচ্ছিল পুঁই ডাটাটির মতন, এখন হঠাৎ তার সামনের দিকটা ওরকমধারা কেঁপে উঠতে লাগল কেন? এবং এদিকে সম্পত্তির ছোকরা মালিক ফেদিয়া লিয়ামিন খরগোশের চামড়ার হালকা কোটটি পরে বাড়ির আঙিনায় খেলাধুলো করে আর ছোট ছোট গর্তে জমে-যাওয়া বরফ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভেঙে ভেঙে দিন কাটাচ্ছিল।

রাঁধুনী আকসিনিয়া আঙিনার উপর দিয়ে তার পিছনে ছুটে যেতে যেতে চিৎকার করে করে ডাকছে, এ কী হচ্ছে ফেদোর ইগনাতিচ? খানদানি সদাগরের ছেলে তুমি, এ কী হচ্ছে সব? গর্তের জলে-কাদায় মাখামাখি করা কি শেঠজির ছেলের সাজে?

কাতেরিনা আর তার বল্লভের সবকিছু ওলোট-পালোট করে সম্পত্তির হিস্যেদারটি নিরীহ ছাগলছানার মতো বাড়িময় তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে, তার চেয়েও নিরীহ অকাতর নিদ্রায় ঘুমোয় মাত্রাধিক স্নেহময়ী দিদিমার পাশে। জাগরণে বা স্বপ্নে কখনও তার মনে এক মুহূর্তের তরেও উদয় হয়নি, সে কারও পাকা ধানে মই দিয়েছে কিংবা কারও সুখে এতটুকু ব্যাঘাত-ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে।

বড় বেশি ছুটোছুটির ফলে অবশেষে ফেদিয়ার জল-বসন্ত হল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুকের ব্যথা। বেচারিকে তখন বাধ্য হয়ে শয্যাগ্রহণ করতে হল। গোড়ার দিকে জড়িমড়ি দিয়ে তার চিকিৎসা করা হল, শেষটায় ডাক্তার ডাকতে হল।

ডাক্তার ভিজিট দিতে শুরু করলেন। তাঁর প্রেসক্রিপশনমতো ওষুধ ফেদিয়াকে প্রতি ঘণ্টায় খাওয়ানো হল– কখনও দিদিমা খাওয়াতেন, কখনও বা তার অনুরোধে কাতেরিনা।

দিদিমা কাতেরিনাকে বলতেন, মা লক্ষ্মী সোনামণি কাতেরিনা আমার! বাচ্চাটিকে একটু দেখ-ভাল্ কর মা আমার। আমি জানি, শরীরের ভারে তোমার নিজেরই বড় বেশি চলাফেরা করতে কষ্ট হচ্ছে, আর মা ষষ্ঠীর কৃপার জন্য তুমিও অপেক্ষা করছ– তবু বাচ্চাটির দিকে একটু নজর রেখ, লক্ষ্মীটি।

কাতেরিনা অসম্মত হয়নি। বুড়ি যখনই গির্জার সন্ধ্যারতিতে যেত, কিংবা অহোরাত্র উপাসনায় রোগশয্যায় যন্ত্রণায় কাতর বাছা ফেদিয়ার জন্য প্রার্থনা করতে অথবা ভোরবেলাকার প্রথম পূজার প্রসাদ ফেদিয়ার জন্য আনতে যেতে হত, কাতেরিনা তখন অসুস্থ বাচ্চাটির পাশে বসত, জল খাওয়াত, সময়মতো ওষুধ খাইয়ে দিত।

এই করে করে তাই যখন শীতের উপবাস আরম্ভের পরব উপলক্ষে বুড়ি সন্ধ্যারতি আর অহোরাত্র উপাসনা করার জন্য গির্জেয় গেল তার যাবার পূর্বে আদরের কাতেরিনাকে অনুরোধ করে গেল সে যেন ফেদিয়ার যত্নআত্তি করে। ততদিনে ছেলেটি অবশ্য আরোগ্যলাভ করে উঠছিল।

কাতেরিনা ফেদিয়ার ঘরে ঢুকে দেখে সে কাঠবিড়ালির চামড়ার তৈরি কোট পরে বিছানায় বসে সন্তদের জীবনকাহিনী পড়ছে।

গদিওলা কুর্সিতে আরাম করে বসে কাতেরিনা শুধলো, কী পড়ছ, ফেদিয়া? আমি সন্তদের জীবনকাহিনী পড়ছি, কাকিমা।*[* আসলে বউদি, কিন্তু রাশানরা আমাদের মতো যৌথ পরিবারে বাস করে না বলে একে অন্যকে সম্বোধনের সময় আমাদের মতো বাছবিচার করে না।]

ভালো লাগছে?

 ভারি চমৎকার, কাকিমা।

ফেদিয়া যখন কথা বলছিল তখন কনুইয়ের উপর ভর করে কাতেরিনা তার দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে দেখছিল। অকস্মাৎ তার অন্তস্তলে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাক্ষসের পাল যেন মুক্ত হয়ে আবার তার সেই পুরনো চিন্তাগুলো সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে ফেলল : এই ছোকরাটা তার কী সর্বনাশই না করেছে, এবং সে অন্তর্ধান করলে তার জীবন কত না আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

কাতেরিনা চিন্তা-সাগরে ডুব দিয়ে ভাবতে লাগল, এখন আর কীই-বা হতে পারে? ছেলেটা এমনিতেই অসুস্থ, তাকে ওষুধ খেতে হচ্ছে .. আর অসুখের সময় কত অঘটনই না ঘটতে পারে। লোকে আর কী বলবে? ডাক্তার ভুল ওষুধ দিয়েছিল!

তোমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে, ফেদিয়া?

হ্যাঁ কাকিমা। তোমার যদি কোনও অসুবিধা না হয়। তার পর চামচে ভরা ওষুধ গিলে বলল, সন্তদের এই জীবনকাহিনী কী অদ্ভুত সুন্দর, কাকিমা।

কাতেরিনা বলল, আরও পড়, বেশ করে পড়। কাতেরিনা তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরটার চতুর্দিকে তাকাতে গিয়ে তার দৃষ্টি নকশা-কাটা ঘষা কাঁচের জানালাগুলোর ওপর গিয়ে পড়ল। তখন বলল, এগুলোর খড়খড়ি বন্ধ করিয়ে নিতে হবে। দাঁড়িয়ে উঠে কাতেরিনা পাশের ঘরে গেল, সেখান থেকে বসবার ঘর হয়ে উপরের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে বসল।

পাঁচ মিনিটের ভিতর সরূগেই তার কাছে এল। পরনে ফুলবাবুটির মতো সিলের চামড়ার অস্তরদার পুস্তিনের পোশাক।

কাতেরিনা শুধাল, জানালার খড়খড়িগুলো বন্ধ করা হয়েছে?

কাটখোট্টা সংক্ষেপে সেরগেই হ্যাঁ, বলে, কাঁচি দিয়ে মোমবাতির পোড়া পলতেটুকু কেটে ফেলে স্টোভটার কাছে এসে দাঁড়াল।

সবকিছু চুপচাপ।

কাতেরিনা জিগ্যেস করল, আজ রাত্রে গির্জার উপাসনা অনেকক্ষণ অবধি চলবে না?

সেরগেই উত্তর দিল, কালকের পরবটা বড় রকমের; উপাসনা দীর্ঘ হবে। আবার সবকিছু চুপচাপ।

কাতেরিনা দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আমাকে নিচে ফেদিয়ার কাছে যেতে হবে; সে সেখানে একেবারে একলা।

ভুরু নিচু করে কাতেরিনার দিকে সোজা তাকিয়ে সেরগেই শুধাল, একেবারে একলা?

একেবারে একলা। কাতেরিনা ফিসফিস করে উত্তর দিয়ে শুধাল, কেন? তাতে কী হয়েছে?

দুজনের চোখে চোখে যেন বিদ্যুতে বিদ্যুতে ধারাবহ্নি জ্বলে উঠল; কিন্তু দুজনার ভিতর শব্দমাত্র বিনিময় হল না।

কাতেরিনা নিচের তলায় গিয়ে এ-ঘর ও-ঘর প্রত্যেকটি খালি ঘর ভালো করে তদারক করে নিল। সর্বত্র শান্ত– নিঃশব্দ নৈস্তব্ধ্য। ইকনগুলোর নিচে মঙ্গলপ্রদীপ নিষ্কম্প জ্যোতি বিচ্ছুরিত করছে। কাতেরিনার ছায়া তার সমুখ দিকে যেন দ্রুততর গতিতে এগিয়ে গিয়ে প্রাচীর-গাত্রে প্রসারিত হচ্ছে। খড়খড়ি তুলে দেওয়ার ফলে জানলার উপর জমে-যাওয়া বরফ গলে গিয়ে চোখের জলের মতো ঝরে পড়ছে। বিছানার উপর বালিশে ভর করে বসে ফেদিয়া তখনও পড়ছিল। কাতেরিনাকে দেখে সে শুধু বলল, কাকিমা, এ বইখানা নাও, লক্ষ্মীটি, আর ইকনের তাক থেকে ওই বইখানা দাও তো।

কাতেরিনা তার অনুরোধ পালন করে বইখানা তাকে দিল।

ফেদিয়া, এখন তুমি ঘুমিয়ে পড়লে ভালো হয় না?

না, কাকিমা, আমি দিদিমণির জন্য অপেক্ষা করব।

দিদিমণির জন্য অপেক্ষা করবে কেন?

আমার জন্য অহোরাত্র-উপাসনার নৈবেদ্য আনার কথা দিয়েছে দিদিমণি।

কাতেরিনার মুখ হঠাৎ একদম পাংশু হয়ে গেল। হৃৎপিণ্ডের নিচে সে এই প্রথম তার সন্তানের স্পন্দন অনুভব করল। সমস্ত বুক তার হিম হয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে আপন ঠাণ্ডা হাত দু-খানা গরম করবার জন্য ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেল।

শোবার ঘরে নিঃশব্দে ঢুকে দেখল সেরগেই স্টোভের কছে দাঁড়িয়ে। ফিসফিস করে তাকে বলল, ওইখানে।

প্রায় অস্ফুট কণ্ঠে সেরগেই শুধল, কী? তার গলাতে কী যেন আটকে গেল।

 সে একেবারে একলা।

 সেরগেই ভুরু কোঁচকাল। তার শাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে।

 কাতেরিনা হঠাৎ দোরের দিকে রওনা দিয়ে বলল, চল।

সেরগেই তাড়াতাড়ি জুতো খুলে ফেলে শুধাল, সঙ্গে কী নেব?

কাতেরিনা অতি অস্ফুট কণ্ঠে বলল, কিছু না। তার পর নীরবে সেরগেইয়ের হাত ধরে তাকে পিছনে পিছনে নিয়ে চলল।

.

১১.

এই নিয়ে তিন বারের বার কাতেরিনা যখন অসুস্থ বালকের ঘরে ঢুকল তখন সে হঠাৎ ভয়ে কেঁপে ওঠাতে বইখানা তার কোলে পড়ে গেল।

কী হল, ফেদিয়া?

বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে ফেদিয়া ভীত স্মিত হাস্যে বলল, ও, হঠাৎ যেন কিসের ভয় পেলুম কাকিমা।

কিসের ভয় পেলে?

তোমার সঙ্গে কে ছিল, কাকিমা?

কোথায়? আমার সঙ্গে তো কেউ ছিল না। লক্ষ্মীটি।

কেউ ছিল না?

ফেদিয়া খাটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা হয়ে, তার কাকিমা যে দোর দিয়ে ঢুকেছিল সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন খানিকটা আশ্বস্ত হল!

বলল, বোধহয় আমার নিছক কল্পনাই হবে।

কাতেরিনা খাটের খাড়া তক্তায় কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। ফেদিয়া তার কাকির দিকে তাকিয়ে বলল, তার মনে হচ্ছে, কেন জানিনে, তাকে বড় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।

উত্তরে কাতেরিনা ইচ্ছে করে কেশে দরজার দিকে তাকিয়ে কী যেন প্রতীক্ষা করল। সেখান থেকে এল– কাঠের মেঝে থেকে সামান্যতম মচমচ শব্দ।

আমার নামে যে কুলগুরুর নাম– তাঁর জীবনকথা আমি পড়ছি, কাকিমা! বীরযোদ্ধা শহিদ হয়ে কীরকম পরমেশ্বরের কাছে প্রিয়রূপে গণ্য হলেন।

কাতেরিনা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ভাইপো সোহাগ করে বলল, তুমি বসবে, কাকিমা? আমি তা হলে তোমাকে কাহিনীটা পড়ে শোনাই।

কাতেরিনা উত্তর দিল, একটু দাঁড়াও, আমি এখখুনি আসছি। বসবার ঘরের মঙ্গলপ্রদীপটি ঠিক জ্বলছে কি না দেখে আসি। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল।

পাশের ঘরে যে ফিসফিস করে কথা আরম্ভ হল সেটা অতিশয় নীরবের চেয়েও ক্ষীণ, কিন্তু চতুর্দিকে যে গভীর নৈস্তব্ধ্য বিরাজ করছিল তার ভিতর সেটা ফেদিয়ার তীক্ষ্ণ কর্ণে এসে পৌঁছল।

কান্নার জলভরা কণ্ঠে ছেলেটি চেঁচিয়ে উঠল, কাকিমা, ওখানে কী হচ্ছে? কার সঙ্গে তুমি কথা বলছ? এক মুহূর্ত পরে আরও অশ্রু-ভরা কণ্ঠে আবার চেঁচিয়ে বলল, কাকিমা! এদিকে এসো আমার বড় ভয় করছে। এবার সে যেন কাতেরিনার কণ্ঠে ঠিক আছে শুনতে পেল এবং ভাবল সেটা তারই উদ্দেশে বলা হয়েছে।

দৃঢ় পদক্ষেপে কাতেরিনা এসে এমনভাবে দাঁড়াল যে, তার শরীর ফেদিয়া আর বাইরে যাবার দরজার মাঝখানে। বেশ কড়া গলায় বলল, তুমি খালি খালি কিসের ভয় পাচ্ছ? ঠিক তার পরই বলল, এইবারে তুমি শুয়ে পড়।

আমার যে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না, কাকিমা।

না, না। তুমি এবারে ঘুমোও, ফেদিয়া আমার কথা শোন, শুয়ে পড়… সত্যি, রাত হয়েছে।

কিন্তু কেন এসব, কাকিমা। আমার যে মোটেই শুতে ইচ্ছে করছে না।

না, তুমি শুয়ে পড়, শুয়ে পড়। কাতেরিনার স্বর আবার বদলে গিয়েছে, অল্প অল্প কাঁপছে। তার পর বাহু দু-খানা তুলে ছেলেটাকে দুই কান দিয়ে চেপে ধরে খাটের শিয়রের দিকে শুইয়ে দিল।

ঠিক সেই মুহূর্তেই ফেদিয়া আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল; সে দেখতে পেয়েছে সেরগেইকে– ফ্যাকাসে মুখ, আর খালি পায়ে সে ঘরে ঢুকছে।

ত্রাসে, ভয়ের বিভীষিকায় ছেলেটা তালু পর্যন্ত মুখ খুলে ফেলেছে। কাতেরিনা সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরল। কড়া গলায় বলল, শিগগির কর, তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসো– চেপে ধরো ছেলেটাকে, ধস্তাধস্তি না করে।

সেরগেই ছেলেটার দু হাত-পা চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা এক ঝটকায় বড় একটা পালকের বালিশ নিয়ে বলির পাঠা সেই ছোট্ট বালকের কচি মুখটি ঢেকে দিয়ে, বালিশের উপর ঝাঁপটে পড়ে তার শক্ত নরম স্তনের উপর চাপ দিতে লাগল।

কবরের ভিতর যে স্তব্ধতা– প্রায় চার মিনিট ধরে সেটা সে ঘরে বিরাজ করল।

অতি মৃদুকণ্ঠে কাতেরিনা বলল, ওর হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু– কিন্তু দাঁড়িয়ে উঠে সবকিছু গোছগাছ করাতে লাগতে না লাগতে, বহু লুকনো পাপের রঙ্গভূমি, নিস্তব্ধ বাড়িটার দেওয়ালগুলো সশব্দ তীব্র মুষ্ট্যাঘাতের পর মুষ্ট্যাঘাতে টলমল করে উঠল; জানালাগুলো খড়খড়িয়ে উঠল, ঘরের মেঝে দুলতে লাগল, মঙ্গলপ্রদীপ ঝোলানোর সরু শিকল দুলে দুলে দেওয়ালের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের উপর অদ্ভুত ছায়াছবির দৌড়াদৌড়ি লাগিয়ে দিল।

সেরগেই আতঙ্কে শিউরে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে লাগাল ছুট। কাতেরিনাও ছুটল তাকে ধরবার জন্য। ওদিকে হট্টগোল তোলপাড় যেন তাদের পিছনে আসছে। যেন কোনও অপার্থিব শক্তি এই পাপালয়কে তার ভিত্তিতল পর্যন্ত ঝাঁকুনি দিয়ে ওলট-পালট করে দিচ্ছে।

কাতেরিনার ভয় হচ্ছিল, পাছে সেরগেই ত্রাসের তাড়নায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে তার আর্ত চেহারা দিয়ে সবকিছু ফাঁস করে দেয়; সে কিন্তু ছুটল সিঁড়ির দিকে উপরের তলায় যাবে বলে।

সেরগেই মাত্র কয়েকটি ধাপ উঠতেই অন্ধকারে একটা আধখোলা দরজার সঙ্গে খেল সরাসরি প্রচণ্ড এক ধাক্কা। আর্তনাদ করে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচের দিকে– কুসংস্কার-ভরা আতঙ্কে সে তখন সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে গিয়েছে।

গড়গড় করে তার গলা দিয়ে শুধু বেরুচ্ছে, জিনোভিই বরিসিছ! জিনোভিই বরিসিছ! আর সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচের দিকে পা উপরের দিকে করে হুড়মুড়িয়ে পড়ার সময় কাতেরিনাকেও ফেলে দিয়ে নিয়ে চলেছে তার সঙ্গে।

কাতেরিনা শুধাল, কোথায়?

সেরগেই আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ওই যে, ওই তো ওইখানে সে একটা লোহার পর্দার উপর বসে বসে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। ওই তো ওই– আবার আসছে সে। শোন, সে গর্জন করছে- গর্জন করছে সে আবার।

এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, অসংখ্য হস্ত রাস্তার দিকে মুখ-করা জানালাগুলোর উপর প্রচণ্ড ঘা দিচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে কে একজন বাড়ির দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।

কাতেরিনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ওরে হাবা। ওঠ, উঠে পড়, হাবা কোথাকার! কথা ক-টি বলা শেষ করতে না করতে সে তীরের মতো ছুটে গেল ফেদিয়ার কাছে। মরা ছেলেটার মাথা সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বালিশের উপর এমনিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখল যে মনে হয় সে ঘুমুচ্ছে। তার পর শত শত মুষ্টি যে দরজাটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছিল সেইটে দৃঢ়হস্তে খুলে দিল।

সম্মুখে ভীষণ দৃশ্য। দলে দলে লোক রোয়াকের উপর উঠবার চেষ্টা করছে। তাদের মাথার উপর দিয়ে কাতেরিনা দেখতে পেল সারি সারি অপরিচিত লোক উঁচু পাঁচিল টপকে বাড়ির আঙ্গিনায় নামছে– আর বাইরের রাস্তা উত্তেজিত কণ্ঠের কথা-বলাবলিতে গগম্ করছে।

কোনওকিছু ভালো করে বোঝবার পূর্বে রোয়াকের দল কাতেরিনাকে উল্টে ফেলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ঘরের ভিতরে।

.

১২.

এই প্রচণ্ড উত্তেজনা, তুলকালাম কাণ্ড এল কী করে?

বছরের বারোটা প্রধান পর্বের যে কোনওটির আগের রাতে কাতেরিনা ভদের শহরের হাজার হাজার লোক শহরের সবকটা গির্জা ভরে দিত। শহরটা যদিও মফস্বলের, তবু তার ব্যবসাবাণিজ্য শিল্পোৎপাদন নগণ্য নয়। ফলে যেসব গির্জায় ভোরবেলাকার ঈশ্বরের-সংযোগ উপাসনা করা হত সেখানে এমনই প্রচণ্ড ভিড় জমত যে, বলতে গেলে পোকামাকড়টিও সেখানে নড়াচড়া করার মতো জায়গা পেত না। এসব গির্জের সমবেত ধর্মসঙ্গীত গাইত শহরের বণিক সম্প্রদায়ের তরুণের দল। তাদের মূল-গায়েন, আপন ওস্তাদও সেখানে নিযুক্ত থাকত।

আমাদের শহরবাসীরা প্রভুর গির্জার প্রতি অনুরক্ত উৎসাহী ভক্ত– তাই তাদের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তারা সঙ্গীত ও অন্যান্য কলার সমঝদার। গির্জায় বৈভব-উজ্জ্বল চাকচিক্য এবং অর্গেনসহ বহু কণ্ঠে গীত সঙ্গীত তাদের জীবনের একটি উচ্চতম পবিত্রতম বিমলানন্দ। যে গির্জায় যেদিন ঐক্যসঙ্গীত হত সেখানে আধখানা শহরের ভিড় লেগে যেত, বিশেষ করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের তরুণ দলের, কেরানি-কুল, ছোকরার দল, ফুলবাবুর পাল, কল-কারখানার ছোট বড় হুনুরি-কারিগর, এমনকি মিল কারখানার মালিকরাও তাঁদের ভামিনীগণ সমভিব্যাহারে উপস্থিত হতেন। সবাই ভিড় লাগাত একই গির্জায় : সবাই চাইত যে করেই হোক অৰ্গেনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অষ্ট কণ্ঠ-সঙ্গীত, কিংবা কোনও ওস্তাদ যখন সপ্তমে উঠে কঠিন কারুকার্য করেন সেগুলো শুনতে– তা সে নরকের অগ্নিকুণ্ডের গরম দিনেই হোক, আর পাথর-ফাটা কনকনে শীতেই হোক; গির্জার ঢাকা আঙিনাতেই হোক, আর জানালার নিচে দাঁড়িয়েই থোক।

ইসমাইলফদের পাড়ার গির্জেয় হবে সর্বমঙ্গলময়ী কুমারী মা-মেরির স্মরণে পরব। তাই তার আগের রাত্রে যখন ইসমাইল পরিবারে ফেদিয়াকে নিয়ে পূর্ববর্ণিত নাটক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তখন তাবৎ শহরের তরুণদল ওই গির্জেয় জড় হয়েছিল। গির্জে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বেশ শোরগোল তুলে তারা সে সন্ধ্যার বিখ্যাত তার-সপ্তক-গায়কের গুণ নিয়ে, এবং ওঁরই মতো সমান বিখ্যাত খাদ-গায়কের দৈব পদস্খলন নিয়ে আলোচনা করছিল।

কিন্তু সবাই যে কণ্ঠসঙ্গীত-আলোচনায় মেতে উঠেছিল তা নয়; দলের মধ্যে আর পাঁচজন আর পাঁচটা বিষয়ে অনুরাগী।

এদের মধ্যে ছিল একটি ছোকরা কলকজার হুনুরি। তাকে সম্প্রতি এখানকার একটি স্টিম-মিলের মালিক পেতের্সবুর্গ থেকে আমদানি করেছেন। ইসমাইলদের বাড়ির কাছে আসতে সে বলে উঠল, সবাই বলছে, মেয়েটা তাদের কেরানি সেরগেইকে নিয়ে রসকেলিতে অষ্টপ্রহর মেতে আছে।

ভেড়ার চামড়ার অস্তরদার নীল সুতি কোটপরা একজন বলল, যাহ! সে তো সব্বাই জানে। আর সেই কথাই যখন উঠল– আজ রাত্রে সে গির্জেয় পর্যন্ত আসেনি।

গির্জেয়? কী যে বলছ? বদমাইশ মাগীটা পাপের কাদামাটি এমনই সর্বাঙ্গে মেখেছে যে, সে এখন না ডরায় ভগবানকে, না ডরায় আপনি বিবেককে, না ডরায় দ্রজনের দৃষ্টিকে।

কলকজার ছোকরাটি বলল, ওই হোথা দেখ, ওদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। আঙুল তুলে সে দেখাল, খড়খড়ির ভিতর দিয়ে আসছে আলোর রেখা।

একাধিক গলা তাকে টুইয়ে দিয়ে বলল, ফাঁক দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখ না, এবারে তারা কোন তালে আছে।

দুই বন্ধুর কাঁধের উপর ভর করে কলকজার ছোকরাটি ফাঁকের ভিতর দিয়ে ভালো করে তাকাতে না তাকাতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ভাইরা সব, ওরা কার যেন দম বন্ধ করে তাকে মারছে– বন্ধুরা সব, দম বন্ধ করে কাউকে মারছে!

সঙ্গে সঙ্গে মরিয়া হয়ে দু হাত দিয়ে খড়খড়ির উপর থাবড়াতে লাগল। তার দেখাদেখি আরও জনা দশেক লাফ দিয়ে জানালার উপর উঠে হাতের মুঠো দিয়ে খড়খড়ির উপর হাতুড়ি পেটা করতে আরম্ভ করে দিল।

প্রতি মুহূর্তে ভিড় বাড়তে লাগল, এবং এই করেই ইসমাইলফুদের বাড়ি পূর্বোল্লিখিতভাবে আক্রান্ত হল।

***

 ফেদিয়ার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে কলকজার লোকটি সাক্ষ্য দিল, আমি নিজে দেখেছি; আমি স্বচক্ষে দেখেছি; বাচ্চাটাকে চিত করে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে দুজনাতে মিলে তার দম বন্ধ করে মারছিল।

সেরগেইকে সেই রাত্রেই পুলিশ-থানায় নিয়ে যাওয়া হল; দুজন প্রহরী কাতেরিনাকে তার শোবার-ঘরে নজরবন্দি করে রাখল।

***

ইসমাইলদের বাড়িতে অসহ্য শীত ছেয়ে পড়েছে। ঘর গরম করার স্টোভগুলো জ্বালানো হয়নি, সদর দরজা সর্বক্ষণ খোলা, কারণ দঙ্গলের পর দঙ্গল কৌতূহলীর দল একটার পর আরেকটা বাড়ির ভিতরে এসে ঢুকছে। সবাই গিয়ে দেখছে কফিনের ভিতর শুয়ে ফেদিয়া– আরেকটা ডালা-বন্ধ পুরো মখমলের পর্দা দিয়ে ঢাকা বড় কফিন।*[* পরে বলা হয়েছে, এটাতে ছিল কাতেরিনার স্বামীর মৃতদেহ। এটা পচে গিয়েছিল বলে কফিনের ডালা বন্ধ করে তার উপর ভারী পর্দা ফেলে দেওয়া হয়েছিল– যাতে করে দুর্গন্ধ না বেরোয়।] ফেদিয়ার কপালের যেখানটায় ডাক্তার ময়নাতদন্তের জন্য কেটেছিলেন সেখানকার লাল দাগটি ঢাকার জন্য তার উপর রাখা হয়েছিল সাটিনের ফুল-পাতা দিয়ে তৈরি একটি মালা। তদন্তে প্রকাশ পায় যে, ফেদিয়া দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মারা যায়। সেরগেইকে ফেদিয়ার মৃতদেহের পাশে নিয়ে যাওয়ার পর, পাদ্রি ভয়াবহ শেষ বিচারের দিন এবং যারা কৃত পাপের জন্য অনুশোচনা করে না তাদের কী হবে সে সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলতে না বলতেই সে হাউ হাউ করে চোখের জলে ভেঙে পড়ল। সমস্ত প্রাণ খুলে দিয়ে সে যে ফেদিয়ার খুনি একথাই যে স্বীকার করল তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষা জানাল জিনোভিই বরিসিচের মরা লাশও যেন খুঁড়ে তোলা হয়– স্বীকার করল যে, পাদ্রি-কৃত শেষ-অন্ত্যেষ্টির পুণ্যফল থেকে জিনোভিইকে বঞ্চিত করে সে তাকে মাটিতে পুঁতেছিল।

তখনও তার লাশ সম্পূর্ণ পচে যায়নি; সেটা খুঁড়ে তুলে একটা বিরাট সাইজের কফিনে রাখা হল। সর্বসাধারণকে ত্রাসে আতঙ্কিত করে সে তার দুটি পাপের সহকর্মিণীরূপে যুবতী গৃহকত্রীর নাম উল্লেখ করল।

সর্ব প্রশ্নের উত্তরে কাতেরিনা লভভূনার মাত্র একটি উত্তর : আমি কিছু জানিনে; আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানিনে।

সেরগেইকে কাতেরিনার সামনে মুখোমুখি করে তাকে দিয়ে কাতেরিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানো হল। তার সব স্বীকৃতি শুনে কাতেরিনা নীরব বিস্ময়ে তার দিকে তাকাল– সে দৃষ্টিতে কিন্তু কোনও রোষের চিহ্ন ছিল না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, সে যখন সবকিছু বলার জন্য এতই উৎসুক তখন আমার কোনও কিছু অস্বীকার করে আর কী হবে? আমি তাদের খুন করেছি।

সবাই শুধল, কিন্তু কেন, কিসের জন্য?

কাতেরিনা সেরগেইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওর জন্য।

সেরগেই মাথা হেঁট করল।

আসামি দুজনাকে জেলে পোরা হল। এই বীভৎস কাণ্ডটা জনসাধারণের ভিতর এমনই কৌতূহল, ঘৃণা আর ক্রোধের সঞ্চার করেছিল যে, ঝটপটু তার ফয়সালা হয়ে গেল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে সেরগেই এবং তৃতীয় বণিক সঙ্রে জনৈক বণিকের বিধবা কাতেরিনা লুভভনাকে ফৌজদারি আদালতের রায় শোনানো হল : তাদের আপন শহরের খোলা হাটে প্রথম তাদের চাবুক মারা হবে এবং তার পর সাইবেরিয়াতে কঠিন সশ্রম কারাদণ্ডে উভয়ের নির্বাসন। মার্চ মাসের এক ভোরবেলাকার নিদারুণ হিমের শীতে চাবুকদার কাতেরিনার অনাচ্ছাদিত দুগ্ধধবল পৃষ্ঠে আদালতের স্থির করা সংখ্যা গুনে গুনে চাবুকের ঘা মেরে মেরে নীল-লাল রঙের উঁচু ফুলে-ওঠা দাগড়ার দাগ তুলল। তার পর সেরগেই পিঠে-কাঁধে তার হিস্যে পেল। সর্বশেষে তার সুন্দর মুখের উপর জ্বলন্ত লোহা দিয়ে তিনটি রেখা কেটে ভ্রাতৃহন্তা ‘কেন’-এর লাঞ্ছনা অঙ্কন করে দিল।*[* বাইবেলের প্রথম অধ্যায় সৃষ্টি পর্বে বর্ণিত আছে, আদমের পুত্র কে তার ভ্রাতা আবেলকে হত্যা করে; যেহেতু মানুষ মাত্রই একে অন্যের ভ্রাতা তাই খুনির কপালে ছ্যাকা দিয়ে তিনটি চিরস্থায়ী লাঞ্ছন অঙ্কনের বর্বর প্রথা ইউরোপের প্রায় সর্বদেশেই উনবিংশ শতাব্দী অবধি প্রচলিত ছিল।]

এসব ঘটনা ঘটার সময় আগা-গোড়া দেখা গেল, যে কোনও কারণেই হোক, সেরগেই কিন্তু কাতেরিনার চেয়ে জনসাধারণের বেশি সহানুভূতি পেল। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত অবস্থায় কৃষ্ণবর্ণ দণ্ডমঞ্চ থেকে নামবার সময় সে বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, পক্ষান্তরে কাতেরিনা নেমে এল দৃঢ় পদক্ষেপে তার একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল যাতে করে তার খসখসে শেমিজ আর কয়েদিদের কর্কশ কোটটা তার পিঠে সেঁটে না যায়।** [** অনুবাদকের মনে হয়, তার ভয় ছিল, কর্কশ উলের সুতো পিঠের ঘায়ে ঢুকে গেলে শুকোবার সময় সমস্ত পিঠের চামড়া অসমান হয়ে গিয়ে তার পিঠের মসৃণ সৌন্দর্য নষ্ট করবে। কিন্তু অতি অবশ্য মনে রাখা উচিত, সে শুধু তার বল্লভের ভোগের জন্য। আপন সৌন্দর্য নিয়ে কাতেরিনার নিজস্ব কোনও দম্ভ ছিল না– কাহিনীতে তার কোনও চিহ্ন নেই।]

এমনকি জেল-হাসপাতালে যখন তাকে তার সদ্যোজাত শিশুকে দেখানো হল সে মাত্র এইটুকু বলল, আহ, কে ওটাকে চায়? কস্মিনকালেও গোঙরানো কাতরানোর একটি মাত্র শব্দ না করে, কস্মিনকালেও কারও বিরুদ্ধে কণামাত্র অভিযোগ না জানিয়ে সে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শক্ত তক্তার উপর বুকের ভার রেখে কুঁকড়ে পড়ে রইল।

.

১৩.

সেরগেই ও কাতেরিনা অন্যান্য কয়েদির সঙ্গে দল বেঁধে সাইবেরিয়ার উদ্দেশ্যে বেরোল বসন্ত ঋতুতে। পঞ্জিকায় সেটা বসন্ত ঋতু বলে লেখা আছে বটে, কিন্তু আসলে তখন সেই প্রবাদটাই সত্য যে, সূর্য আলোক দেন যথেষ্ট, কিন্তু গরমি দেন অতি অল্পই।

কাতেরিনার বাচ্চাটাকে বরিস তিমোতেইয়েভিচের সেই বুড়ি মামাত বোনের হাতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেওয়া হল। কারণ সে দণ্ডিতা রমণীর নিহত স্বামীর আইনসম্মত সন্তানরূপে স্বীকৃত হল বলে এখন সে ইসমাইল এবং ফেদিয়ার তাবৎ সম্পত্তির একমাত্র স্বত্বাধিকারী। এ ব্যবস্থাতে কাতেরিনা যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিল এবং বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিল পরিপূর্ণ তাচ্ছিল্যভরে। বহু অবাধ প্রণয়াবেগবিহ্বল রমণীর মতো তার প্রেমও আপন দয়িতে অবিচল হয়ে রইল– দয়িতের সন্তানে সঞ্চারিত হল না।

আর শুধু বাচ্চাটার ব্যাপারেই নয়, সত্য বলতে কী, কাতেরিনার জীবনে এখন আর কোনওকিছুর অস্তিত্ব নেই, আলো নেই, অন্ধকারও নেই; না আছে অমঙ্গল, না আছে মঙ্গল, দুঃখ নেই সুখও নেই, সে কিছুই বুঝতে পারে না, কাউকে ভালোবাসে না– নিজেকে পর্যন্ত না। অস্থির হয়ে সে শুধু প্রতীক্ষা করছিল একটি জিনিসের : কয়েদির দল রওনা হবে কবে, কারণ তার হৃদয়ে তখন একমাত্র আশা, দলের ভিতর সে সেরগেইকে আবার দেখতে পাবে। আপন শিশুটির কথা ততদিনে সে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছে।

তার আশা তাকে ফাঁকি দিল না। মুখে কে-এর লাঞ্ছনা আঁকা, সর্বাঙ্গে ভারী শিকল বয়ে সেরগেইও রওনা দিল তারই সঙ্গে একই ছোট দলটাতে।

যতই ঘৃণ্য হোক না কেন, মানুষ সর্ব অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় এবং সর্ব অবস্থাতেই নিজ নিজ ক্ষুদ্র আনন্দের সন্ধান সাধ্যমতো করে থাকে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার প্রয়োজন, কণামাত্র প্রয়োজন, কাতেরিনার ছিল না। সে সেরগেইকে আবার দেখতে পাচ্ছে এবং তার সঙ্গ পাওয়ার ফলে এই যে রাস্তা তাকে কঠিন কারাগারের নির্বাসনে নিয়ে যাচ্ছে সে-রাস্তাও তার কাছে আনন্দ-কুসুমে পুষ্পচ্ছাদিত বলে মনে হতে লাগল।

কাতেরিনা তার ছিটের তৈরি ব্যাগে করে মূল্যবান জিনিস সঙ্গে নিয়েছিল অল্পই, এবং রোক টাকাকড়ি নিয়েছিল তার চেয়েও কম। এবং সেসবও খর্চা হয়ে গেল নিনি নগরদ*[* বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মাসি গর্কির নামে বর্তমান গর্কি।] পৌঁছবার বহু পূর্বেই পাহারাওলাদের ঘুষ দিতে দিতে– যাতে করে সে রাস্তায় সেরগেইয়ের পাশে পাশে যেতে পারে, যাতে করে পথিমধ্যে রাত্রিযাপন আশ্রয়ের হিমশীতল এক কোণে, গভীর অন্ধকারে সে তার সেরগেইকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেক আলিঙ্গন করতে পারে।

ওদিকে কিন্তু কাতেরিনার কে-মার্কা মারা বল্লভের হৃদয়ে কী জানি কী করে তার প্রতি স্নেহ-প্রেম শুকিয়ে গিয়েছে। কথা সে বলত কমই, আর বললে মনে হত যেন আঁকশি দিয়ে কথাগুলো অতি কষ্টে টেনে বের করছে, আর এসব গোপন মিলনের মূল্য দিত সে অত্যল্পই– যার জন্য কাতেরিনাকে তার খাদ্য-পানীয়, আর তার আপন অত্যাবশ্যক প্রয়োজনের জন্য যে-কটি সামান্য দু-চার পয়সা তার তখনও ছিল, সবকিছু বিলিয়ে দিতে হত। এমনকি সেরগেই একাধিকবার বলতেও কসুর করল না, ওই যে অন্ধকার কোণে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিচের ধুলো সরাবার জন্য তুমি পাহারাওলাদের পয়সা দিচ্ছ সেগুলো আমাকে দিলেই পার।

মিনতিভরা কণ্ঠে কাতেরিনা বলল, আমি তো কুল্লে পঁচিশটি কপে দিয়েছি, সেরেজেঙ্কা।

আর পঁচিশটি কপেক কি পয়সা নয়? পঁচিশটি কপেক্‌ কি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া যায়? অতগুলো কপে কবার পেয়েছ তুমি? ওদিকে কবার অতগুলো তুমি দিয়ে দিয়েছ, কে জানে।

কিন্তু ওই করেই তো আমরা একে অন্যকে দেখতে পাই।

বটে? সেটা কি সহজ? ওতে করে আমরা কী আনন্দ পাই– এতসব নরক-যন্ত্রণার পর? আমার তো ইচ্ছে করে আমার জীবনটাকে পর্যন্ত অভিসম্পাত করি, আর এ ধরনের মিলনের ওপর তো কথাই নেই।

কিন্তু সেরেজা, তোমাকে দেখতে পেলে আমার তো অন্য কোনও কিছুতেই এসে-যায় না।

 এসব ঘোর আহাম্মকি।– এই হল সেরগেইয়ের উত্তর।

এসব উত্তরে কাতেরিনা কখনও আপন ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে রক্ত বের করত, আর কখনও-বা নিশাকালীন মিলনের অন্ধকার অশ্রুবর্ষণে অনভ্যস্ত তার সে দুটি চোখও তিক্ততার তীব্র বেদনায় ভরে যেত, কিন্তু সে সবকিছু বরদাস্ত করে গেল, নীরবে যা ঘটার ঘটতে দিল এবং নিজেকে নিজে ফাঁকি দিতে কসুর করল না।

উভয়ের মধ্যে এই নতুন এক সম্পর্ক নিয়ে তারা নিজনি নগর পৌঁছল। এখানে পৌঁছে তারা আরেক দল কয়েদির সঙ্গে যোগ দিল– তারা এসেছে মস্কো অঞ্চল থেকে, যাবে ওই একই সাইবেরিয়ায়।

নবাগত এই বিরাট বাহিনীর হরেক রকম চিড়িয়ার মাঝখানে, মেয়েদের দলে ছিল দুটি মেয়ে যারা সত্যই মনোযোগ আকর্ষণ করে। একটির নাম তিয়োনা, ইয়ারোস্লাভূলের এক সিপাইয়ের স্ত্রী। এরকম চমৎকার কামবিলাসিনী মোহিনী আর হয় না। সে লম্বা, আর আছে একমাথা চুলের ঘন কুন্তল বেণি, মদিরালস্ হরিদ্রাভ নয়ন, তার উপর নেমে এসে ছায়া দিচ্ছে নিবিড় আঁখিপল্লবের রহস্যময় অবগুণ্ঠন। অন্যটি সতেরো বছরের নিখুঁত খোদাই করা তরুণী। গাঁয়ের বর্ণটি মোলায়েম গোলাপি, মুখটি ছোট্ট, কচি তাজা দুটি গালের উপর দুটি টোল, আর কয়েদিদের মাথা-বাঁধবার ছিটের রুমালের নিচে থেকে কপালে নেমে এসে এখানে-ওখানে নাচছে ঢেউখেলানো সোনালি চুল। দলের সবাই তাকে সোনেৎকা নামে ডাকত।

সুন্দরী রমণী তিয়োনার স্বভাবটি ছিল শান্ত, মদিরালস। দলের সবাই তাকে ভালো করেই চিনত, এবং তাকে জয় করতে সক্ষম হয়ে কোনও পুরুষই অত্যধিক উল্লাসভরে নৃত্য করত না, কিংবা সে যখন তার তাবৎ কৃপাভিলাষীদের মস্তকে সমমূল্যের বিজয়-মুকুট পরিয়ে দিত তখন অত্যধিক শোকেও কেউ মুহ্যমান হত না।

পুরুষ-কয়েদির দল মশকরার সুরে সমস্বরে বলত, মেয়েদের ভিতর আমাদের তিয়োনা পিসি সবচেয়ে দরদি দিল ধরেন; কারও বুকে তিনি কস্মিনকালেও আঘাত দিতে পারেন না!

সোনেৎকা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ঝোপের চিড়িয়া।

তার সম্বন্ধে তারা বলত, যেন বান্ মাছ পাক দেবে, মোচড় খাবে, কিন্তু কখনও শক্ত মুঠোয় ধরতে পারবে না।

সোনেৎকার রুচি ছিল; চট করে যা-তা সে তো নিতই না, বরঞ্চ বলা যেতে পারে, বাড়াবাড়িই করত। সে চাইত কাম যেন তার সামনে ধরা হয় সাজসজ্জায় যেন সাদামাটা তরি-তরকারি তার সামনে না ধরে সেটা যেন তৈরি হয় তীক্ষ্ণ স্বাদের ঝাল-টকের সস্ দিয়ে কামে যেন থাকে হৃদয়দহন, আত্মত্যাগ। আর তিয়োনা ছিল খাঁটি, নির্ভেজাল রুশ সরলতার নির্যাস। আর সে সরলতায় ভরা থাকত এমনই অলসের আবেশ যে, কোনও পুরুষকে, কেন জ্বালাচ্ছ, ছেড়ে দাও আমাকে বলবার মতো উৎসাহ তার ছিল না। সে শুধু জানত, সে স্ত্রীলিঙ্গের রমণী। এ জাতীয় রমণীকে বড়ই আদর করে ডাকাত-ডাকু, কয়েদির দল আর পেতেসবুর্গের সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক গুষ্ঠী।

এই দুই রমণীসহ মস্কো থেকে আগত কয়েদির দল যখন সেরগেই-কাতেরিনার দলের সঙ্গে মিলিত হল তখন এ দুটি রমণী নিয়ে এল কাতেরিনার জীবনে ট্র্যাজেডি।

.

১৪.

দুই দলে সম্মিলিত হয়ে নিজনি থেকে কাজান রওনা হওয়ার প্রথমদিন থেকেই সেরগেই কোনওপ্রকারের ঢাক-ঢাক গুড়গুড় না করে উঠে-পড়ে লেগে গেল সৈনিক বধূ তিয়োনার প্রণয়লাভের জন্য এবং স্পষ্টই বোঝা গেল কোনওপ্রকারের অলঙ্ঘ্য প্রতিবন্ধক তার সামনে। উপস্থিত হয়নি। অলসাবেশা তিয়োনা সেরগেইকে অযথা হতাশায় মনমরা হতে দিল না– সে তার হৃদয়বশত কদাচ কোনও পুরুষকেই হতাশায় মনমরা হতে দিত না। তৃতীয় কিংবা চতুর্থ রাত্রির আশ্রয়স্থলে সন্ধ্যার সময় কাতেরিনা ঘুষ দিয়ে তার সেরেজেকার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিল; এখন সে ন্দ্রিাহীন চোখে প্রতীক্ষা করছিল, যে কোনও মুহূর্তে প্রহরী এসে আস্তে আস্তে তাকে নাড়া দিয়ে কানে কানে বলবে, ছুটে যাও! ঝটপট সেরে নিয়ো। দরজা খুলে গেল, আর কে যেন, কোন এক রমণী তীরবেগে করিডর পানে ধাওয়া করল; দরজা আবার খুলে গেল, আবার আরেক রমণী তিলার্ধ নষ্ট না করে তার শোবার তক্তা থেকে লাফ দিয়ে উঠে প্রহরীর পিছনে অন্তর্ধান করল; অবশেষে কে যেন এসে তার সর্বাঙ্গ ঢাকা কর্কশ কোটে আস্তে আস্তে টান দিল। তৎক্ষণাৎ সে তার শোবার তক্তা থেকে লাফ দিয়ে উঠল– তক্তাখানা কত না কয়েদির গাত্ৰ-ঘর্ষণে চিকুণ-মসৃণ হয়ে গিয়েছে– কোটটা কাঁধের উপর ফেলে আস্তে আস্তে প্রহরীর গায়ে ধাক্কা দিল তাকে গন্তব্যস্থল দেখিয়ে দেবার জন্য নিয়ে যেতে।

করিডরের মাত্র একটি জায়গায় অগভীর পিরিচের উপর ঢালাই মোমে প্রদীপের নিষ্প্রভ পলতেটি ক্ষীণ আলো দিচ্ছে। কাতেরিনা চলতে চলতে দু-তিনটি যুগল-মিলনের সঙ্গে ঠোক্কর খেল– গা মিলিয়ে দিয়ে তারা যতদূর সম্ভব অদৃশ্য হবার চেষ্টা করছিল। পুরুষদের ওয়ার্ড পেরিয়ে যাবার সময় কাতেরিনা শুনতে পেল তাদের দরজায় কাটা ছোট জানালার ভিতর দিয়ে চাপা হাসির শব্দ আসছিল।

পাহারাওলা বিড়বিড় করে কাতেরিনাকে বলল, হাসাহাসির রকমটা দেখছ? তার পর তার কাঁধে ধরে একটা কোণের দিকে ঠেলে দিয়ে চলে গেল।

হাতড়াতে গিয়ে কাতেরিনার একটা হাত পড়ল কর্কশ কোট আর দাড়ির উপর, দ্বিতীয় হাতটা স্পর্শ করল কোন এক রমণীর গরম মুখের উপর।

সেরগেই নিচু গলায় শুধল, কে?

কী, কী করছ তুমি এখানে? তোমার সঙ্গে এ কে?

অন্ধকারে কাতেরিনা সজোরে তার সপত্নীর মাথা বাঁধার রুমালখানা ছিনিয়ে নিল। সে-ও সঙ্গে সঙ্গে তাকে এড়িয়ে দিল ছুট। করিডরে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে সে বায়ুবেগে অন্তর্ধান করল।

সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের ওয়ার্ড থেকে উচ্চকণ্ঠে ফেটে উঠল একশো অট্টহাস্য!

কাতেরিনা ফিসফিসিয়ে বলল, বদমাইশ, আর সেরগেইয়ের নবীন নাগরীর মাথা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রুমালের কোণ দিয়ে মারল তার মুখে ঝাঁপটা। সেরগেই তার দিকে হাত তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে-ও ইতোমধ্যে ছায়ার মতো লঘুপদে করিডর দিয়ে ছুটে গিয়ে ধরেছে তার কুঠুরির হাতল। পুরুষদের ওয়ার্ড থেকে যে অট্টহাস্য তার পিছনে পিছনে ধাওয়া করেছিল সেটা আবার এমনি কলরবে ধ্বনিত হল যে, যে-পাহারাওয়ালাটা পিরিচের গালামোমের কাঁপা কাঁপা বাতিটার সামনে বসে সময় কাটাবার জন্য আপন বুটজুতোর ডগাটাকে লক্ষ করে মুখ থেকে থুথুর তীর ছুড়ছিল সে পর্যন্ত মাথা তুলে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠল, চোপ্ ব্যাটারা!

কাতেরিনা চুপচাপ শুয়ে পড়ে অবধি সামান্যতম নড়াচড়া না করে সেইরকমই পড়ে রইল। সে চাইছিল নিজেকে বলে, আমি তাকে আর ভালোবাসিনে– আর অনুভব করছিল তাকে সে ভালোবাসে আরও গভীরভাবে, আরও বেশি আবেগভরা উচ্ছ্বাসে। বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই একই ছবি: তার ডান হাত অন্যটার মাথার নিচে থেকে থেকে কাঁপছে, তার বাঁ হাত চেপে ধরেছে অন্যটার কামাগ্নিতে জ্বলন্ত স্বন্ধদ্বয়।

হতভাগিনী কাঁদতে আরম্ভ করল। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে সর্ব দেহ-মন দিয়ে কামনা করতে লাগল, ওই সেই হাতটি যেন থাকে তার মাথার নিচে, সেই হাতটি যেন চেপে ধরে তার কাঁধ- হায়, সে কাঁধ এখন মৃগী রোগীর মতো থেকে থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে।

সেপাইয়ের বউ তিয়োনা তাকে ভোরবেলা জাগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি অন্তত আমার রুমালখানা ফেরত দিতে পার!

ও! তুমিই ছিলে তবে?

লক্ষ্মীটি, দাও না ফেরত!

কিন্তু তুমি আমাদের মাঝখানে আসছ কেন?

কেন, আমি কী করছি? তুমি কি ভেবেছ আমাদের ভিতর গভীর প্রণয়, নাকি? না এমন কিছু সত্যি একটা মারাত্মক ব্যাপার যে যার জন্য তুমি রেগে টং হবে!

কাতেরিনা একটুখানি চিন্তা করে বালিশের তলা থেকে আগের রাত্রের ছিনিয়ে নেওয়া রুমালখানা বের করে তিয়োনার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ ফেরাল।

তার হৃদয় হালকা হয়ে গেল।

আপন মনে বললে, ছিঃ! আমি কি এই রঙ-করা পিপেটাকে হিংসে করব? চুলোয় যাক গে ওটা। তার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতেই আমার ঘেন্না ধরে।

পরের দিন পথে যেতে যেতে সেরগেই তাকে বলতে লাগল, শোন, কাতেরিনা ভভূনা, তোমাকে আমি কী বলতে চাই। দয়া করে তুমি তোমার মাথার ভিতর এই তত্ত্ব-কথাটি ভালো করে ঢুকিয়ে নাও তো যে, প্রথমত আমি তোমার জিনোভিই বরিসি নই, দ্বিতীয়ত তুমি এখন আর কোনও গেরেম্ভারি সদাগরের বউ নও; সুতরাং মেহেরবানি করে এখন আর বড়মানষির চাল মারবে না। আমার ব্যাপারে আস্ত একটা পাঁঠীর মতো যত্রতত্র ছুঁ মারলে সেটা আমি বরদাস্ত করব না।

এর উত্তরে কাতেরিনা কিছু বলল না এবং তার পর এক সপ্তাহ ধরে সে সেরগেইয়ের পাশে পাশে হাঁটল বটে, কিন্তু উভয়ের মধ্যে একটিমাত্র দৃষ্টি বা বাক্য-বিনিময় হল না। তাকেই করা হয়েছে আঘাত, তাই সে নিজের মর্যাদা বাঁচিয়ে তার এই সেরগেইয়ের সঙ্গে তার এই সর্বপ্রথম কলহ মিটিয়ে সমঝাওতা আনার জন্য তার দিকে এগিয়ে যেতে চাইল না।

এদিকে যখন সেরগেইয়ের প্রতি কাতেরিনার রাগ, ততদিনে সেরগেই কুলধবলা তন্বী সোনেৎকার দিকে হরিণের মতো কাতর নয়নে তাকাতে আরম্ভ করেছে এবং নর্মভরে তার হৃদয়-দুয়ারে প্রথম করাঘাত আরম্ভ করে দিয়েছে। কখনও সে তার সামনে নম্রতাভরে মাথা নিচু করে বলে, আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিবাদন আর কখনও-বা তার দিকে তাকিয়ে মধুর স্মিত হাস্য করে, আর পাশাপাশি এলে ছল করে তাকে হাত দিয়ে ঘিরে দেয় সোহাগের চাপ। কাতেরিনা সবকিছুই লক্ষ করল, আর তার বুকের ভিতরটা যেন আরও সিদ্ধ হতে লাগল।

মাটির দিকে না তাকিয়ে যেন ধাক্কা খেতে খেতে এগুতে এগুতে কাতেরিনা তোলপাড় করতে লাগল, কী জানি, তবে কি ওর সঙ্গে মিটিয়ে ফেলব? কিন্তু এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বাধা দিতে লাগল তার আত্মসম্মান– এগিয়ে গিয়ে মিটমাট করে ফেলতে। ইতোমধ্যে সেরগেই আরও নাছোড়বান্দা হয়ে সেঁটে রইল সোনেৎকার পিছনে; এবং সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, নাগালের বাইরের যে-সেনোক্তা এতদিন পাক দিতেন মোচড় খেতেন কিন্তু ধরা দিতেন না, এইবারে তিনি, যে কোনও কারণেই হোক, হঠাৎ যেন পোষ মেনে নিচ্ছেন।

কথায় কথায় তিয়োনা একদিন কাতেরিনাকে বলল, তুমি আমাকে নিয়ে নালিশ করছিলে না? কিন্তু আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। আমারটা ছিল আজ-আছে-কাল-নেই ধরনের দৈবাৎ ঘটে যাওয়ার একটা ব্যাপার; এসেছিল, চলে গেল, মিলিয়ে গেল; কিন্তু সাবধান, এই সোনেৎকাটার ওপর নজর রেখ।

কাতেরিনা মনস্থির করে আপন মনে বলল, জাহান্নমে যা আমার এই আত্মসম্মান; আজই আমি তার সঙ্গে মিটমাট করে ফেলব। এবং তার পর ওই একটিমাত্র চিন্তা নিয়ে পড়ে রইল, মিটমাট করে ফেলার জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশলটা কী হবে?

কিন্তু কিছু করতে হল না; সেরগেই নিজেই তাকে এই ধাঁধা থেকে বেরোবার পথ তৈরি করে দিল।

পরের আশ্রয়ে পৌঁছতেই সেরগেই কাতেরিনাকে ডেকে বলল, ভা, আজ রাত্রে এক মিনিটের তরে আমার কাছে এসো তো; তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কাতেরিনা চুপ করে রইল।

কী হল? আমার ওপর এখনও রেগে আছ নাকি? কথা বলবে না?

কাতেরিনা এবারেও কোনও সাড়া দিল না।

কিন্তু পরের ঘাঁটির কাছে আসার সময় শুধু সেরগেই না, সবাই লক্ষ করল যে, কাতেরিনা সরদার পাহারাওলার চতুর্দিকে ঘুর ঘুর করছে, শেষটায় ভিক্ষায় পাওয়া তার সতেরোটি কপেক সে সরদারের হাতে গুঁজে দিল। মিনতিভরা কণ্ঠে তাকে বলল, আরও দশটা জমাতে পারলেই তোমাকে দেব।

সরদার পয়সা কটি আস্তিনের ভঁজে লুকল। বলল, ঠিক আছে।

লেনদেন শেষ হয়ে গেলে সেরগেই ঘোঁৎ করে খুশি প্রকাশ করে সোনেৎকার দিকে। চোখের ইশারা মারল।

ঘাঁটির সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে কাতেরিনাকে জড়িয়ে ধরে আর সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ওগো, কাতেরিনা, লক্ষ্মীটি, শুনছিস ছোঁড়ারা, এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন মেয়ে তো সারা সংসারেও পাওয়া যায় না।

কাতেরিনার মুখ লাল হয়ে উঠল– আনন্দে সে তখন হাঁফাচ্ছে।

সন্ধ্যা হতে না হতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল; একলফে সে বেরিয়ে এল বললে কমই বলা হয়; তার সর্বাঙ্গ তখন ঘন ঘন শিহরিত হচ্ছে আর অন্ধকারে তার হাত সেরগেইয়ের সন্ধানে এখানে-ওখানে খুঁজছে।

তাকে আলিঙ্গন করে আপন বুকে চেপে যেন দম বের করে সেগেই বলল, আমার কেট।

চোখের জলের ভিতর দিয়ে কাতেরিনা উত্তর দিল, ওগো, আমার সর্বনাশের নিধি। তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সে যেন ঝুলে রইল।

পাহারাওলা করিডরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি পাইচারি করতে করতে মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছিল; বুটজুতোর ডগায় থুথুর তীর ছোঁড়া অভ্যাস করে ফের পাইকারি আরম্ভ করছিল; ক্লান্তিতে জীর্ণ কয়েদিরা দরজার ভিতরে নাক ডাকিয়ে যাচ্ছে; ঘর গরম করার স্টোভের নিচে কোথায় যেন একটা ইঁদুর কুট কুট করে কম্বল কাটছে; ঝিঁঝির দল একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রাণপণ চিৎকার করে যাচ্ছে–কাতেরিনা তখনও সপ্তম স্বর্গে।

কিন্তু হৃদয়াবেগ ভাবোচ্ছ্বাস স্তিমিত হল এবং রসকষহীন অনিবার্য বাক্যালাপ আরম্ভ হল।

করিডরের এক কোণে মেঝের উপর বসে সেরগেই নালিশ জানাল, আমি কী মারাত্মক যন্ত্রণায়ই না কষ্ট পাচ্ছি; পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু অবধি হাড়গুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমায় পাগল করে তুলেছে।

সেরগেইয়ের লম্বা কোটের ভিতর সোহাগভরে মাথা গুঁজে কাতেরিনা শুধাল, তা হলে কী করা যায়, সেরেজেশ্বকা?

যদি না… কী জানি, হয়তো-বা ওদের বলতে হবে, কাজানে পৌঁছলে আমাকে সেখানকার হাসপাতালে জায়গা করে দিতে। তাই করব নাকি?

সে কী? কী যে বলছ, সেরেজা!

এছাড়া অন্য কী গতি আছে বল; যন্ত্রণায় আমার যে প্রাণ যায়।

 কিন্তু তা হলে তারা তো আমাকে আগে আগে খেদিয়ে নিয়ে যাবে, আর তুমি পড়ে রইবে পিছনে!

ঠিক কথা, কিন্তু আমি কী করি? আমি তোমাকে বললুম তো, পায়ের শিলি ঘষে ঘষে আমাকে যে মেরে ফেলল। শিকলিগুলো যেন ঘষতে ঘষতে আমার হাড়গুলোর ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। হয়তো-বা কয়েকদিনের জন্য মেয়েদের লম্বা পশমের মোজা পরলে কিছু-একটা হয়।

লম্বা মোজা? আমার কাছে এখনও আনকোরা একজোড়া তো রয়েছে, সেরেজা!

তা হলে তো আর কথাই নেই।

একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে কাতেরিনা ছুট দিয়ে ঢুকল তার কুঠুরিতে। শোবার তক্তার নিচের থেকে হাতড়ে হাতড়ে বের করল তার ব্যাগটা। ফের ছুট দিল সেরগেইয়ের কাছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নীল রঙের পুরু পশমের একজোড়া লম্বা মোজা; দু পাশে রঙিন সিল্কের মিহিন নক্শা জ্বলজ্বল করছে–বক শহরের তৈরি মোজা, এ মোজা তৈরি করেই সে শহর তার ন্যায্য খ্যাতি পেয়েছে।

কাতেরিনার শেষ মোজাজোড়াটি নিয়ে যেতে যেতে সেরগেই জোর দিয়ে বলল, এগুলো পরলে আর ভাবনা কী!

কাতেরিনার কী আনন্দ! ফিরে এসে কঠিন তক্তায় অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। শুনতেই পেল না, সে ফিরে আসার পর সোনেৎকা করিডরে বেরিয়ে গেল আর সেখানে সমস্ত রাত কাটিয়ে চুপে চুপে ভোরের ঠিক অল্প একটু আগে কখন ফিরে এল।

এ সমস্ত ঘটল কাজান পৌঁছবার দু ঘাঁটি পূর্বে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *