পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (দ্বিতীয় খণ্ড) – বদরুদ্দীন উমর
প্রথম প্রকাশ – সেপ্টেম্বর ১৯৭৫
.
উৎসর্গ
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সত্যিকার নায়ক পূর্ব বাঙলার সংগ্রামী জনগণের উদ্দেশে।
.
প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির দ্বিতীয় খণ্ডে তৎকালীন রাজনীতির যে পটভূমিকায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো তারই একাংশ বিবৃত করা হলো। ইচ্ছে ছিলো ১৯৫১ সালের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের ঠিক পূর্ব পর্যন্ত সম্পূর্ণ পটভূমিকার আলোচনা এই খণ্ডেই সমাপ্ত করে তৃতীয় খণ্ডে কেবলমাত্র ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলীর বিবরণসহ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির বিস্তৃত পর্যালোচনা করবো। কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডের কলেবর বৃদ্ধি হতে দেখে সে পরিকল্পনা বাতিল করতে হলো। এর ফলে তৎকালীন শ্রমিক আন্দোলনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের এবং সাধারণভাবে সংগঠিত রাজনীতির বিবরণ দ্বিতীয় খণ্ডের পরিবর্তে তৃতীয় খণ্ডেই সংযোজিত হবে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন যে সীমিত এলাকায় ঘটেছিলো এবং আন্দোলন তখন ছাত্র শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে যেভাবে সীমাবদ্ধ ছিলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সেইভাবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ না থেকে তা শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্তের এক ব্যাপক গণপ্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে সমগ্র পূর্ব বাঙলায় এক অদৃষ্টপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ১৯৪৮ সালের আন্দোলনের সাথে ১৯৫২ সালের আন্দোলনের এই পার্থক্যকে বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে হলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে পূর্ব বাঙলার ব্যাপক জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যা কিছু ঘটেছিলো এবং তার ফলে যে পরিবর্তন সমগ্র পরিস্থিতির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিলো তা ভালোভাবে জানা দরকার। পরিস্থিতির বিবরণের সাথে পরিচিত হলে দেখা যাবে যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুষ্টিমেয় ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবীর আন্দোলন ছিলো না, তা শুধু শিক্ষাগত অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিলো না। বস্তুতঃপক্ষে তা ছিলো পূর্ব বাঙলার ওপর সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার পাকিস্তানী শাসক শোষক শ্রেণীর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক বিরাট ও ব্যাপক গণআন্দোলন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদে কৃষক আন্দোলনের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তাতে সানেশ্বর এবং নাচোলের কৃষক আন্দোলনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে এ বইয়ের প্রথম খণ্ডে এই দুই আন্দোলনের কিছুটা সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ছিলো। কিন্তু তৎকালীন কৃষক আন্দোলনের ঘটনাবলী একত্রে আলোচনার জন্য উপরোক্ত অংশ দুটি দ্বিতীয় খণ্ডে কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত পরিচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এজন্যে প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণে এই অংশের
কোনো বিবরণ আর থাকবে না এবং তার পরিবর্তে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত সাধারণ বিবরণ সেখানে সংযোজিত হবে।
এই খণ্ডে প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সর্বশেষ পর্যায়ে পূর্ব বাঙলার কৃষকদের অবস্থা প্রসঙ্গতঃ বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনার সাথে আমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক এর বিবরণ ও আলোচনার একটা ধারাবাহিকতা আছে। এজন্যে এই তিনটি পরিচ্ছেদকে উপরোক্ত বইটির দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আমার কাছে লিখিত নোট পাঠিয়ে যাঁরা এই বইটি রচনায় আমাকে সাহায্য করেছেন এবং যাঁদের সাথে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সাক্ষাৎ আলোচনার সুযোগ আমার হয়েছে তাঁদের নামের তালিকা বইয়ের শেষ দিকে সংযোজিত হলো। তাঁদের সকলের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। যে সমস্ত লিখিত তথ্য নোট ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উল্লিখিত হয়েছে সেগুলির পশ্চাদটিকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম নির্দেশ করা হয়েছে।
তথ্য নির্দেশের উদ্দেশ্যে অনেক ক্ষেত্রে প্যারার শেষে ক্রমিক নম্বর দেওয়া আছে। এসব ক্ষেত্রে পুরো প্যারার তথ্যই একই সূত্র থেকে প্রাপ্ত বলে ধরে নিতে হবে।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫
.
দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির দ্বিতীয় খণ্ড প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আহমেদ মাহফুজুল হক কর্তৃক ‘মাওলা ব্রাদার্স’ এর পক্ষে। বইটির প্রথম খণ্ডও প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালের নভেম্বরে। প্রকাশক ছিলেন আহমেদ আতিকুল মাওলা। ১৯৭৩ সালের ২০শে অক্টোবর খুব আকস্মিকভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। আতিকুল মাওলার মতো বড়ো মাপের একজন প্রকাশকের মৃত্যু শুধু যে এ দেশের প্রকাশনা ক্ষেত্রেই এক বড়ো ক্ষতি ছিলো তাই নয়, আমার জন্য সেটা ছিলো এক বিরাট ব্যক্তিগত ক্ষতি। এই ক্ষতি এখনো পর্যন্ত অনেকাংশেই অপূর্ণ আছে।
বইটির তৃতীয় খণ্ড প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রকাশক ছিলেন চট্টগ্রামের ‘বই ঘর’ এর পক্ষে সৈয়দ মহম্মদ শফি।
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির তিনটি খণ্ড একই প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত না হওয়ার ফলে বেশ কিছু অসুবিধে দেখা দেওয়ায় আমি অনেক দিন থেকে চিন্তা করেছি তিনখণ্ড একত্রে একই প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশের কথা। এখন তিনটি খণ্ডই একত্রে প্রকাশিত হচ্ছে ‘জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন’ কর্তৃক।
এ বইটির তিনখণ্ডের মধ্যে এই দ্বিতীয় খণ্ডটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এই খণ্ডেই আমি তৎকালীন পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতিসহ অন্য কয়েকটি বিষয়ে যে আলোচনা করেছি এবং যে সব ঘটনার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছি সেগুলির সাথে পরিচয় ব্যতীত ভাষা আন্দোলন কীভাবে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়ে এক বিশাল জাতীয় গণপ্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিলো সেটা বোঝা সম্ভব নয়।
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি শুধু ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনেরই ইতিহাস গ্রন্থ নয়। ঐ পর্যায়ে পূর্ব বাঙলার সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসেরও এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই বইটির তিন খণ্ডেরই নোতুন সংস্করণ এক সাথে বের করার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ‘জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন’ এর কমলকান্তি দাস ও মোরশেদ আলমকে ধন্যবাদ।
বদরুদ্দীন উমর
৩০.০৫. ১৯৯৫
ঢাকা
Leave a Reply