গীতা : কালে কালান্তরে – বরুণকুমার চক্রবর্তী
.
নিবেদন
আমার সহপাঠী সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ বেদজ্ঞ অমরকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠ নিয়েছি সংস্কৃতের। এই সুবাদেই গীতার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। কিন্তু গীতা নিয়ে আগ্রহ বৃদ্ধিতে উদ্দীপকের কাজ করল চার্লস উইলকিনসের গীতার ইংরেজি অনুবাদ। চার্লস উইলকিনসের ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। হেস্টিংয়ের আগ্রহাতিশয্যেই উইলকিনসের সংস্কৃত শেখা এবং গীতার ইংরেজি অনুবাদে আত্মনিয়োগ। ভূমিকায় হেস্টিংস গীতা সম্পর্কে যা মন্তব্য করেছেন আমি তাতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হই। এভাবেই ক্রমে ক্রমে গীতা বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি ও তারই ফলশ্রুতিতে বর্তমান গ্রন্থ রচনা। প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গীতার কোনো তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কিংবা দার্শনিক ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য এ গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। কিংবা আধ্যাত্মিক প্রেরণাও কারণ স্বরূপ ছিল না। তবু কেন গীতা নিয়ে পড়লাম প্রশ্ন এখানেই। গীতা অত্যন্ত বিতর্কিত গ্রন্থ। কী রকম? সত্য সত্যই কি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ মুখ নি:সৃত এই গীতা, নাকি অন্য কারও রচনা শ্রীকৃষ্ণের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। গীতা কি মহাভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, নাকি পৃথক রচনা, যা পরবর্তীতে মহাভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে? সত্য সত্যই কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে সাতশতটি শ্লোক কথিত হল আর কৌরবপক্ষ নীরবতা অবলম্বন করল এও কি সম্ভব? গীতা কি যিশুখ্রিস্টের পূর্ববর্তীকালের রচনা না কি পরবর্তীতে রচিত? বাইবেলের সঙ্গে গীতার নানা বক্তব্যে যে সাযুজ্য দেখি তার কারণ কি নিছকই Great men think alike; গীতায় কোন পথের ওপর গুরুত্ব দান করা হয়েছে-কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ না ভক্তিযোগ, কিংবা শেষ পর্যন্ত সমন্বয়বাদকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাতশতটি শ্লোকের ব্যাখ্যায় তাবড় তাবড় পন্ডিত গুণীজনের ব্যাখ্যায় এত তারতম্য কেন? পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় গীতা অনূদিত হয়েছে এবং ব্যাখ্যাত হয়েছে— কোন প্রেরণায় সেটা সম্ভব হয়েছে?
শ্রীকৃষ্ণ কি যুদ্ধবাজ ছিলেন, নানা ছলে যুদ্ধবিমুখ অর্জুনকে কেন তিনি যুদ্ধে প্ররোচিত করলেন? কাজেই অধিকার, ফলে নয়-এই নাকি গীতার মর্মবাণী, কিন্তু ফললাভের আশা ব্যতিরেকে কি কোনো কাজ করা সম্ভব? শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সব ধর্মকে পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণ নাও— এ কি কৃষ্ণের প্রচার? ‘আমি’ বলতে কি শ্রীকৃষ্ণ না দেবতা-কাকে বোঝানো হয়েছে? ‘বিশ্বরূপ দর্শন’ কি ভোজবাজি? কেউ গীতার কবিত্বে মুগ্ধ, কেউ বা গীতার নাটকীয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আবার কেউ গীতাকেই প্রথম মনোবিকলন তত্ত্বের আধাররূপে দেখেছেন। কারোর কাছে গীতা অবাস্তবতার আতিশয্যমন্ডিত আধার, আবার কেউ বা গীতাকে ব্যাবহারিক জীবনের সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য পথ নির্দেশকের মর্যাদা দিয়েছেন। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ বিভিন্নভাবে গীতাকে দেখেছেন, গীতার ব্যাখ্যা করেছেন। বিদেশীয়রা যে ভাষায় গীতাকে বিশেষিত করেছেন ভারতীয় হিসাবে বাস্তবিকই গর্ববোধ করেছি। কয়েক সহস্র গ্রন্থ গীতাকে নিয়ে রচিত। কোনো বিতর্কেরই সমাধান খুঁজিনি, কেবল বিতর্কগুলিকে একত্রিত করে উপস্থাপিত করেছি। মূলত বিভিন্ন জনের দৃষ্টিতে কেমন করে গীতার কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ অথবা সমন্বয়বাদ ধরা পড়েছে, তার হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করেছি। সবচেয়ে বড়ো কথা গীতার প্রাসঙ্গিকতা। এখনও গীতা চর্চিত হচ্ছে দেশে অথবা বিদেশে। আমরা অনেকেই সেসব খবর রাখি না। বিন্দুতে সিন্ধুর মতো কয়েক সহস্র গীতার মধ্যে শ’দেড়েক গ্রন্থের পরিচিতি পাঠকবর্গের কাছে উপস্থিত করেছি। এতেই আশা করি বোঝা যাবে এই মহাগ্রন্থের গুরুত্ব কী অপরিসীম। গীতার স্বদেশীয় ও বিদেশীয় অনুবাদ প্রসঙ্গকে যুক্ত করা হয়েছে দ্বিবিধ কারণে-অনুবাদে অনুবাদকদের সার্থকতা কতখানি তার পরিচয় দিতে এবং সেই সঙ্গে অনেকেই গীতা সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহের কারণও ব্যাখ্যা করেছেন, সেই কারণের বিষয়টি পাঠকদের জানাতে। এই গ্রন্থ রচনায় আমাকে অনেকেই উৎসাহিত করেছেন। বিশেষ করে তিনজনের নাম উল্লেখ্য-অধ্যাপক বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য, অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তী এবং অধ্যাপক সত্যবতী গিরি। বেশ কিছু বিরল প্রয়োজনীয় গ্রন্থ সংগ্রহ করে দিয়েছে আমার স্নেহাস্পদ জামাতা ড. সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়। এ গ্রন্থ পাঠে যদি কারোর গীতা সম্পর্কে সামান্যতম অনুসন্ধিৎসা জাগে তবেই বর্তমান লেখকের প্রয়াস সার্থক হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
পারুল প্রকাশনীর কর্ণধার শ্রীযুক্ত গৌরদাস সাহা বিশেষ যত্ন সহকারে গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব নেওয়ায় তিনি সাধুবাদের পাত্র হয়েছেন।
লেখক
মহালয়া, ১৪২১ বঙ্গাব্দ
Leave a Reply