• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রচনাবলী ৮ (অষ্টম খণ্ড)

লাইব্রেরি » আশুতোষ মুখোপাধ্যায় » আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রচনাবলী ৮ (অষ্টম খণ্ড)

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রচনাবলী ৮ (অষ্টম খণ্ড)

ভূমিকা

আশুতোষ কর্মজীবনে সাংবাদিক। হয়ত সাংবাদিকতা তাঁর পেশা এবং নেশা। ‘সংবাদপত্রের সেকালের কথা’ গ্রন্থে ব্রজেন্দ্রনাথ এমন কিছু সংবাদকশা প্রকাশ করেছেন যেগুলিকে আমরা গল্পই বলতে পারি। বাবুদের নষ্টামি আর বেলাল্লাপনা নিয়ে সচর দর্পণে যে লেখা বেরিয়েছিল তার নাম ছিল বাবু উপাখ্যান। উপাখ্যান শব্দটি হো গল্পের কথাই মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে কৌলীন্যথার কুৎসিত ঘটনার নাম দেও হয়েছিল কাহিনী। সংবাদ যে উপাখ্যানের মেজাজ নিয়ে আসতে পারে সংবাদপত্রে সেকালের কথায় তার দৃষ্টান্ত কম নেই।

আশুতোষ এই ঘরানার লেখক। সিনেমাতে যাই হোক ‘দীপ জ্বেলে যাই’ গল্পটি তো একটি সংবাদই। অথবা মধুরঙ্গের কাহিনীতে দুর্গা এবং মধুররে জীবনকথা প্রায় সংবাদপত্রের ভাষাতেই বর্ণিত হয়েছে। এমন কি কোনো কোনো গল্পে কিছু সংবর পরিবেশন করে লেখক সংবাদের বাহুল্যটুকু যে বর্জন করেছেন তা পাঠককে জানিয়ে দেন। আশুতোষ যখন গল্প রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তখন সংবাদপত্র জগতেও দিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। নিউজ-ভিউজ তো মিলেমিশে গিয়েছিল। সাদামাটা সংবাদে আর গ্রাহক-পাঠক টানা যাচ্ছিল না। আর আন্তর্জাতিক ঘটনাপবিবেশন অথবা গুরুতর সংবাদনিবেদনের ফাঁকে ফাঁকে এমন কিছু পারিবারিক বা সামাজিক ঘটনার ঝলক পাই যা স্পর্শকাতর লেখককে উদবেজিত করে। তখনই প্রবাদবাকটি সত্য মনে হয় টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। আশুতোষ হাতে যে সংবাদপত্রের সংবালে একটা গল্পের বাজ পেয়ে যেতেন, লেখকজীবনে যে সব মুহূর্ত আসে তার কোনোটিকেই তিনি নষ্ট হতে দিতে চান না। এরকম সাহসে কোনো গল্প যেমন জমে যায় এবার কোনো গল্প কিছুটা ফিকে আর তরলই থেকে যায়। সংবাদকণাকে অবশ্য লেখকের কল্পনার তাপে-উত্তাপে গলিয়ে নিতে হয়। এখানেই লেখকের শিল্পকর্ম এবং এখানেই সংবাদসাহিত্য শিল্পগুণ হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ। সেজন্য সংবাদের উপর আশুতোষকে নাটকীয়তার সঞ্চার করতে হয়। তার অনেক গল্পেই নায়ক-নায়িকার মিলন বা সাক্ষাৎ আকস্মিকভাবে ঘটে যায়। গল্পটিও যেন তখন মাটি পেয়ে যায় আর বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে।

বঙ্কিমচন্দ্র গল্প সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। দুর্গেশনন্দিনীতে তা স্পষ্ট। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই উপন্যাসে গল্পের উপর ঠাই দিলেন প্লটকে আর তার সঙ্গে বুনে দিলেন প্যাটার্ন যার ছন্দে পাঠকচিত্ত আন্দোলিত হতে থাকে। আর সেই ছন্দে দুলতে থাকে এই বাণী –এ জীবন লইয়া কি করিব?

শরৎ গল্পকে আশ্রয় করলেন আরও দৃঢ়ভাবে। দত্তা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শ্রীকান্ত উপন্যাসে গল্পের মালা। লেখক প্রায়শই কথক হয়ে ওঠেন। গৃহদাহের অচলাব ট্রেন বদল নাটকীয়। চরিত্রহীনে নাটকীয়তা আরও বেশি। তারকেশ্বরে রমা-রমেশের সাক্ষাৎ আরও রোমাঞ্চকর। আমরা বলতে পারি আশুতোষের ছোটগল্পে নদীজঙ্গল পেরিয়ে বাংলোয় হাসিরাণীকে আবিষ্কার, অথবা রামেশ্বরে মাতাজীর আবির্ভাব এরকমই ঘটনা।

আশুতোষ কেবল সাংবাদিক নয়, একটি সাংবাদিক সত্তাও যেন ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল। তাঁকে ঘিরে। যে সত্তা বিশ্বাস করে কৌশল, ইশারা, ইঙ্গিত-এর তেমন প্রয়োজন নেই। যা যা ঘটছে তা একটানা বলে যেতে হবে। বালিকা-কিশোরী-যুবতীর হাসির জীবনকে কয়েকপৃষ্ঠার মধ্যে তিনি বেঁধে ফেলেন। রেখা মিত্রের সেবিকা জীবনের কাহিনীটুকুর মধ্যে বৈচিত্র্য বিশেষ কিছু নেই কিন্তু তিনি মোচড় দিলেন গল্পের শেষে যেখানে দেখি রেখা ভালোবাসার অভিনয় করে যে সব মানসিকরোগীকে বাঁচিয়েছিল সে অকৃত্রিম ভালোবাসাই তাকে গ্রাস করল। এবারে সে-ই রোগিণী। আশুতোষ গল্প বলতে চান। শরৎচন্দ্রের পর আমরা গল্প বলার যাদুর পাই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। গল্প মানে তো কৌতূহলকে উসকে দেওয়া। কিন্তু উসকে দিলেই হবে না। বর্ণনা, ঘটনা, বিকৃতি বিশ্বাস্য হওয়া চাই। তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাসে এই কৌতূহলকে অতি সহজে জাগিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছেন। আবার ব্যোমকেশের কাহিনী তো কৌতূহলের তারা মুদারা। উদারা। ছোট গল্পেও তিনি গল্পের মর্যাদাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। তুলনা না করেও বলা চলে বিমল মিত্র এই পর্যায়েরই লেখক। গল্পের কৌতূহলকে টেনে নিয়ে যান শেষ পর্যন্ত। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই গোষ্ঠীরই লেখক। কীভাবে তারা এই সার্থকতা পেয়েছেন? শরদিন্দুর পথ বিচিত্র। কখনও ঐতিহাসিক, কখনও রোমান্টিক, কখনও ডিটেকটিভ রচনা লিখে তিনি বৈচিত্র্য বাড়িয়ে দেন কথাসাহিত্যের। মধ্যবিত্ত জীবনের রোজনামচায় কিছুটা ঢেউ তোলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। অ্যাভারেজ বাঙালী পাঠকের চাহিদা আজও বোঝা যায় টেলিভিশনের সিরিয়ালের দিকে লক্ষ করলে। সিরিয়ালের কাহিনীতে মধ্যবিত্তের সোনার সংসারের ওলোটপালট দর্শককে টেনে নিচ্ছে। এ কথা তো ঠিক, মধ্যবিত্ত জীবনের পড়ার মতো বই রবিনসন ক্রুসো। আজও যার আবেদন অম্লান। কেন? মধ্যবিত্ত দেখতে পায় তার জীবনযাপনে যে সংগ্রাম আছে, উদরপূর্তির জন্য যে দৈনন্দিন যুদ্ধ সে তো আমাদেরই প্রতিচ্ছবি। আশুতোষ এই সংগ্রামে, যুদ্ধে হাত রাখেন। এই গোষ্ঠীর লেখকবৃন্দের মধ্যে যাঁদের নাম করেছি তারা বেস্ট সেলারের পর্যায়ে পড়েন। বেস্ট সেলার মানেই সেসব লেখক নন–একথা মানি। আবার সাময়িক হুজুগকে আশ্রয় করে যে রচনা বেস্ট সেলারের পর্যায়ে পড়ে তার জাত কিঞ্চিৎ আলাদা। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় চমক সৃষ্টি করবার জন্য গল্প লেখেন না। তিনি একালের এক শ্রেণীর পক্ষে জনপ্রিয় লেখক এবং এই জনপ্রিয়তাতে তিনি অভিভূত।

এবারে কিছু গল্পের পরিচয় নিই।

মুখোমুখি আত্মজৈবনিক। নিজেকেই বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। সেটা সম্ভব কিনা জানি না, কিন্তু লেখকের প্রয়াসকে স্বাগত জানাতে হয়। একজন লেখক যখন স্মৃতিরোমন্থনে নিমজ্জিত হন তখন উতে আসতে থাকে তার লেখার নানা প্রকরণ কৌশলের ইঙ্গিত। চরিত্ররচনায় তার বিন্যাসগতভাবে কতটা খাঁটি ছিলেন, এ সংশয়ও তাকে উতলা করে। আর লেখা যদি জীবনেরই অভিজ্ঞতা হয় তবে জীবনে তার চাওয়া পাওয়ার টানাপোড়েনের সুখদুঃখের কথাও এসে পড়বে। একের পর এক প্লট উদ্ভাবন করে নিজেকেই যেন তিনি জানতে চেয়েছেন। আর জানার ধাপে ধাপে তৈরি হতে থাকে একের পর এক গল্প অথবা উপন্যাস। লেখক-জীবনের সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে। লেখক শেষ পর্যন্ত বলছেন মানুষের চরিত্র নিয়ে সমস্ত লেখকজীবন ধরে যে এ ভাবে ভাওতাবাজী করে গেলাম, নিজেই জানতাম না। যে লোক নিজের চরিত্রের কানা জানে না, হদিস জানে না, সেই লোক অনন্য চরিত্রস্রষ্টা–এর থেকে হাসির ব্যাপার আর কি হতে পারে! সত্যিই কি তাই? কেবল ভাঁওতাবাজী? প্রশান্ত যে স্ক্রিান্তে এসে পৌঁছলেন ছোটগল্পের পরিসরে তাকে বিশ্বাস্য করে তোলা কিঞ্চিৎ দুরূহ। কেননা প্রশান্ত সফল লেখক। পাঠকধন্য লেখক। পাঠক কি করে এই ফকিতে ভুলে যায়? নাকি লেখক প্রশান্ত এই কথাই বলতে চান শৌখিন মজদুরিতে ভুলিয়ে তিনি সাময়িকভাবে পাঠকচিত্ত জয় করেছেন? তাই শৌখিন মজদুরির প্রতিই তাঁর জ্ঞা? মুখোমুখি হলে এরকম নৈরাজ্য পীড়িত করে লেখককে? সহাবস্থান গল্পটিতে একলের সমস্যাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন লেখক। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার বিবাহ। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ভালোবাসা ছাই হয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে বিবাহপূর্বজবনে একজনের স্থলন অন্যজনের বিবাহপরজীবনে আনুগত্যের অভাব। বলা বাহুল্য স্বামী-স্ত্রর দাম্পত্য জীবনের অভিনয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অভিনয় দীর্ঘস্থায়ীও হয় না। দুজনেই পাবোধে জর্জরিত হয়। ডিভোর্স ছাড়া অন্য সকল পথ তখন বন্ধ। কিন্তু একদিন সাহস করে। স্ত্রী খুলে বলে তার পাপের কথা। স্বামী ও তার পাপবোধকে লুকিয়ে রাখেনি নিশ্চয়ই। এই পাপবোধই দুজনের চৈতন্যে ঘা দেয়। হয়ত বা মিলনের সেতুবন্ধও রচিত হয় এইখান থেকেই। উত্তরণের একটা দিশাও পেয়ে যায় দুজনে। বোঝা গেল না স্বামী দিলীপ তার গোঁয়ার জীবনকে কোথায় নিক্ষেপ করবে? বোধ করি যেমন করে বলাপ। শীলার বড় ছেলেকে (যে অন্যের সন্তান) টেনে নেবে, তেমনি শীলা ও গোঁয়ার দিলীপের সন্তান দুটিকে বুকে করবে। এর বেশি প্রশ্নের উত্তর লেখক দেননি, সম্ভবত পাঠককেও। তা বিশ্বাস করতে বলেছেন।

দাম্পত্য আমাদেরই ঘরোয়া জীবনের কাহিনী। উঁচু ঘরের মেয়ের প্রেমে পড়ে যে সাধারণ ঘরের ছেলেটি নিজের সুখের চাইতে বিপর্যয়কে ডেকে আনল, তার কাহিনী বলেছেন লেখক এখানে। ছেলেটির মধ্যে এসে যায় এক প্রতিযোগিতার উত্তেজনা। প্রাণপণে যে হয়ে উঠতে চায় সুমিত্রার অর্থকৌলীন্যের প্রতিস্পর্ধা। বলা বাহুল, এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। কেননা প্রতিস্পর্ধায় দাম্পত্যজীবনের ফাটলে জোড়া লাগে না। অর্থ সব সময় শাস্তি নাও দিতে পারে। এই গল্পেও দেয়নি। শুরু হল নানা বিষয় নিয়ে ঝামেলা। এই ঝামেলায় যোগ দেয় সুমিত্রার বাবা। তিনি মেয়েকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। সুমিত্রাও ঝগড়াঝাটি করে বাপের বাড়ি চলে যায়। এ কি বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইলের মতো ভ্রমর-চরিত্র? বাপের বাড়ি চলে গিয়েই তো ক্ষণস্থায়ী। অভিমানকে ভ্রমর দীর্ঘস্থায়ী তিক্ততায় পৌঁছে দিল। এক্ষেত্রে অবশ্য রমেন চেষ্টা করেছে। সুমিত্রাকে ফিরিয়ে আনবার। কিন্তু বাদ সেধেছে সুমিত্রার বাবা। যখন ডিভোর্স একরকম অনিবার্য হয়ে উঠল তখন দেখা গেল সুমিত্রার ছেলেকে নিয়ে নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন। কিভাবে এই অঘটন ঘটল? লেখক দেখালেন মাদ্রাজে এক শেঠজীর দোকানে কোল্ড ড্রিংস খেতে খেতে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হল। পরিচয়ের ফলে সহানুভূতি। সকালে স্কুল করে ছেলেটি দোকানে চলে আসে। সারাদিন খাটে, খদ্দের সামলায়। খদ্দের আপ্যায়ন করে। রাত্রে তার ছুটি। কথায় কথায় জানাল ছেলেটি যে শেঠজীই তার বাবা। শেঠজী নিজে দোকান করেছেন, এখন বয়সে ছেলেকে শেখাচ্ছেন তার দোকানবিদ্যা। সুমিত্রার সঙ্গে রমেনের এবারের ঝগড়ার উদ্দেশ্য ছিল অনেকটা অনুরূপ। সুমিত্রা চেয়েছিল ছেলে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট হবে, বাপ বলেছিল ছেলে তার কারখানায় কাজ শিখুক। সুমিত্রা ঠাণ্ডা পানীয় খেতে খেতে ছেলেটির জীবনের যে পরিচয় পেল তাতে তার সম্বিত ফিরে এল। সে বাপকে উপেক্ষা করেই নিজের গৃহে চলে এল। দাদু চেয়েছিল ছেলে ডাক্তার হবে, মামা চেয়েছিল এঞ্জিনিয়ার হবে। সবগুলিতেই ছেলে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। তারপর র্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। এখন শেঠজীর দোকানে। বসে বুঝে ফেলে রমেনের কথাই ঠিক। বাপের কারখানা জীবনেই ছেলের সাফল্য আসবে। বাইস বছর পরে স্বামী-স্ত্রী দুজনে দুজনকে নতুন করে দেখছেন। এইভাবেই সত্যপরিচয় উদঘাটিত হয়। গল্পটি মনস্তাত্ত্বিক গল্পের নমুনা হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু আশুতোষ বহিরঙ্গ একটি ঘটনা নিক্ষেপ করলেন রমেন-সুমিত্রা-সুমু (ছেলে)র জীবনে। তার ফলে কঠিন সমস্যার সমাধান। আশুতোষ গল্পের জন্য প্রটের কথা খুব কি ভাবেন? আমার মনে হয় তিনি ঘরের মধ্যেই যে ঘর আছে তারই আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ান। আর গল্পের টুকরো পেয়ে যান সেখানে। এটাই তার যথার্থ এলাকা।

তপ আশুতোষের একটি বিশিষ্ট গল্প। বিশিষ্ট এই অর্থে যে এই গল্পে যেমন একদিকে পারিবারিক জীবনের এদিক-সেদিক ঘুরে দেখার কৌতূহল আছে তেমনি একলাফে গল্পটি রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে নারীর রহস্যময় গতিপ্রকৃতিতে। আশুতোষের গল্পে নারীচরিত্র প্রায়শই শক্তিময়ী হয়ে ওঠে। সাধারণ নারীর মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন তাপ উত্তাপ সঞ্চিত থাকে আশুতোষের গল্পে তা দপ করে জ্বলে ওঠে। তপ গল্পে আসামের চা-বাগানের এলাকায় যে নারীর সন্ধান পাই আমরা তার দেখা সচরাচর শহরের কোলাহলে মেলে না। মনোরমা দ্বিজেন গাঙ্গুলির মেয়ে বলে সকলে জানে। কিন্তু দ্বিজেন গাঙ্গুলি মনোরমাকে লালনপালন করে বড়ো করেছেন। অসামান্য সুন্দরী মনোরমা। তাকে দেখে প্রেমানন্দ পাগল। বিবাহ হয়ে গেল। কিন্তু কলকাতায় মনোরমা বেমানান। সে শশুরের ঘর করতে পারল না। স্বামী বাপমায়ের বাধ্য সন্তান। মনোরমাকে সন্দেহও সে করে। ক্ষিপ্ত প্রেমানন্দ মনোরমাকে শাসায়। অন্তঃসত্ত্বা মনোরমা ফিরে আসে। মনোরমার জীবন শেষ হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। পঁচিশ বছর পরে মনোরমার ছেলে মহানন্দ ঘোষ এসে প্রেমানন্দের হাতে মায়ের গয়না ফেরত দেয়। সঙ্গে একটি কবচ। এখন প্রেমানন্দ স্ত্রী সুমিত্রাকে নিয়ে রীতিমত প্রৌঢ়। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মহানন্দের দিকে। সে জানত মনোরমা মৃত। গল্পটির পরিণতিতে এসে দেখি যার কাছ থেকে মনোরমার জীবনকাহিনী শুনতে পেলাম সে মনোরমা নয়–সুমিত্রা। নানা প্রশ্নে পাঠক অস্থির হয়ে ওঠে এই গল্প পড়ে। মনোরমা কেন প্রতিবাদী হয়ে উঠল, কেন গল্পে চলে এল সংক্ষিপ্ত শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের কাহিনী? মনোরমা-সুমিত্রার মেলবন্ধনই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? আসলে আশুতোষ লক্ষ রেখেছেন মনোরমা সুমিত্রার দিকে। কতকগুলি পরিস্থিতির বাতাবরণে নারীর রহস্যময়তাকে উদঘাটন করেছেন লেখক। অতিকথনের ত্রুটিও আছে এই গল্পে। লেখক কিছুটা আরোপও করেছেন নিজস্ব ভাবনা এই গল্পে একমই মনে হয়।

আশুতোষের একটি আত্মজৈবনিক গল্প বিবেচনা সাপেক্ষ। এ গল্পটিতেও বিভাবতী চরিত্র আশুতোষকে প্রেরণা দিয়েছে। বিভাবতীর দীপ্তি গল্পটিতে বিস্তৃত হয়েছে। এ বিস্তার আশুতোষ সরল রেখায় গড়িয়ে দিয়েছেন। কীভাবে বিভাবতী সংসার। চালনা করেছে তার কিছু দৃষ্টান্ত দিয়ে বিভাবতীর মধ্যবিত্ত জীবনের সহনশীলতা, ধৈর্য, বুদ্ধিবৃত্তির অসামন্যতাকে প্রকাশ করেছেন লেখক। কিছু নাটকীয়তাও এনেছেন গল্পে। এই গল্পটি কি আশুতোষ লিখেছেন নিজেরই লেখা বিশ্লেষণের জন্য? গল্পের শেষে কিছু কৈফিয়ৎ আছে। গল্পে কি কি উপাদান প্রত্যাশিত পাঠকের কাছে? গল্পের শৈলী কেমন হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন লেখক। গল্পে কি সত্যের ছায়া থাকে, গল্প কি আর্কাড়া বাস্তব হবে, প্রথম পাঠে যাকে অবাস্তব বলে মনে হয়, হয়ত সূক্ষ্ম বিচারে তা ভ্রান্ত বলেই প্রতিপন্ন হবে, গল্পে কি উদ্দেশ্যমূলকতা প্রধান হবে অথবা পাঠকের কৌতূহলকে জাগিয়ে রাখবার জন্য উদ্দেশ্যমূলক ভাবকে গোপন করতে হবে, পাঠকের ইচ্ছাপূরণের জন্যই গল্প তৈরি হবে? এসব প্রশ্ন লেখকের যেমন পাঠকেরও তেমনি। লেখকের জিজ্ঞাসা থেকে যা উঠে আসে তা হল গল্পে প্রত্যক্ষ বস্তুর ছায়া থাকে, উদ্দেশ্যমূলকতাকেও বিসর্জন দেওয়া যায় না, কৌতূহলকে জাগিয়ে রাখতে হবে শেষ পর্যন্ত, ইচ্ছাপূরণ গল্পে না থাকাই বাঞ্ছনীয়। শেষ জিজ্ঞাসাটি কিন্তু আশুতোষ সর্বদা মেনে চলেন না। অনেক সময়েই আশুতোষের গল্পের বৃত্ত তৈরি হয় ইচ্ছাপূরণে। আশুতোষ নারীর মধ্যে শক্তিময়ীকে দেখেছেন। আবার মঙ্গলময়ী নারীর ভূমিকাকে আশুতোষ স্বাগত জানান তার গল্পে : যে মেয়ের মঙ্গল আর কল্যাণের আকাঙ্ক্ষায় মহিলার উনিশ হাজার টাকা সম্বলের থেকে দশ হাজার খরচ করার প্রেরণা আর অনায়াসে আইন ভঙ্গ করার তাড়না-কল্পনায় সেই মেয়ের মাথায় হাত রেখে কেন। বলতে ইচ্ছে করছে, মঙ্গল হোক, সুখ হও! লেখক এখানে ধরা দেন পাঠকের কাছে।

আশুতোষ প্রেমের গল্প লেখেননি এমন নয়। কিন্তু আমরা যে গল্পগুলি আলোচনা। করেছি তাতে পূর্বরাগের রোমান্সের বিস্তৃতি নেই। রোমান্টিক নায়ক-নায়িকা গল্পে লুকোচুরি খেলে না। অথচ সুন্দরী, কুশলী, বুদ্ধিদীপ্ত, আবেগপ্রবণ নায়িকার সাক্ষাৎ তার গল্পে সব সময়েই উঠে আসে। আশুতোষ যেন রোমান্সের ঘন পরিবেশে স্বচ্ছন্দ হতে পারেন না। বুদ্ধির প্রৌঢ়ত্বে ছোটগল্পে সহজে তারা পাঠকচিত্তকে আশ্বস্ত করে ঠিকই, কিন্তু উর্বশরূপে পরুষের চিত্তকে উথালপাতাল করে না। অপর্ণা আর মেজর ঘোষ চৌধুরীর বিবাহ প্রেমজসূত্রে কিন্তু সেটুকু সংক্ষেপে বলে লেখক মৃত্যুশয্যায় শায়িত অপর্ণার জন্য সৈনিক মেজরের উৎকণ্ঠা, আবেগ উত্তেজনা এবং ভালোবাসাকে বিবৃত করেছেন। গল্পটিকে তিনি সৈনিকের জীবনযাপনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। একটি দুষ্প্রাপ্য ওষুধ খাওয়াতে পারলে অপর্ণা বেঁচে যাবে এই আশায় দ্রুত গাড়ি চালিয়ে দোকান থেকে সংগ্রহ করলেন ওষুধটি। নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে পারলে স্ত্রী বেঁচে যাবে। মেজর গাড়ি চল্লিশ পঞ্চাশ মাইল গতিতে চালাতে লাগলেন। কিন্তু ক্রসিং-এ এসে গাড়ি থামাতে হয়। অস্থির হয়ে ওঠেন মেজর। এক একটা ক্রসিং-এর লাল আলো মেজরের বুকে আগুন হয়ে জ্বলে কিন্তু তিনি নিয়ম ভেঙ্গে বেরোতে পারেন না। একদিকে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে শৃঙ্খলিত সৈনিকের জীবনের ক্রসিং-এর বিধিবিধান। মানার দায়িত্ব মেজরের জীবনকে অস্থির করে তোলে। যখন তিনি পৌঁছলেন, তখন সব শেষ। বিষয় হিসাবে তুচ্ছই বলতে হবে, কিন্তু আশুতোষকে বোধ করি ভাবিয়েছে মানুষের দুর্ভাগ্যের উৎস কোথায়। এরকম গল্প খুব বেশি পড়েছি বলে মনে করতে পারছি না।

আগেই বলেছি আশুতোষ নারীচরিত্রের বৈচিত্র্য লক্ষ করেছেন নানা দিক থেকে। দুজনার ঘর গ্রন্থনামের গল্পটিতে কাজললতা এইরকম একজন বৈচিত্র্যময়ী নারী। স্বাচ্ছন্দ্য আর অনটনে যে নারী নূতন মাত্রায় বদলে বদলে যায়। কাজলতার মধ্যে সৃষ্টিধর্মী এক সত্তার পরিচয় আমরা পেয়ে যাই। এ নারী স্বপ্ন দেখে, পরিশ্রম করে সে স্বপ্নকে বাস্তবে সৃষ্টি করে তোলে। স্বামীর সঙ্গে দুজনে মিলে নিজেদের ব্যবসায়কে উন্নতির পথে নিয়ে যায়। কিন্তু ব্যবসায়ে ওঠা-পড়া আছে। পড়ার দিনে আগন্তুক তৃতীয় ব্যক্তিটি দুজনার ছিমছাম জীবনে গণ্ডগোল পাকিয়ে দেয়। ধারদেনা করে কাজললতা ব্যবসায়কে বাঁচিয়ে রাখে, ধার নেয় বটুকের কাছ থেকে। বটুক সুযোগ নেয়। স্বামী রাধাকান্ত একদিন টের পায়। কাজললতাকে নিয়ে পালিয়ে যায় বটুক। বটুকের শয়তানির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে কাজল একদিন ফিরে আসে। বস্তিতে ঘর বাঁধলেও তার সৃষ্টিসতা মরে যায়নি। সে আবার খুঁজে পায় দুজনার ঘর। কপালে বড়ো করে সিঁদুরটিপ। এটা যেন তার রক্ষাকবচ। সে নন্দন দোকানে চাকরি জুটিয়ে নেয়। দিনে দিনে নন্দর দোকানের উন্নতি ঘটতে থাকে। কাজললতার শ্রম আর পরিকল্পনা দোকানের লক্ষ্মীশ্রী ফিরিয়ে আনে। নন্দ খুশি। যে মেয়েটি কাজ করত তাকে কাজললতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্য তাড়িয়ে দেয়। তারপর নন্দ একদিন কাজললতাকে টেনে নিতে চায় সঙ্গিনী হিসাবে। তাদের নিভৃত খেলায় এসে দাঁড়ায় তৃতীয় ব্যক্তি নন্দর স্ত্রী। কাজললতা সরে যায়। জীবন দিয়ে সে বুঝতে পারে দুজনার ঘরে তৃতীয় ব্যক্তির স্থান নেই। বাঁচার লড়াইয়েও তৃতীয় ব্যক্তি প্রতিবন্ধক। পারিবারিক জীবন এবং বহির্জীবনের দ্বন্দ্ব মেটানো সম্ভব নয়। আশুতোষ এখানে আবার নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটিকে তৈরি করলেন। লেখকের ইচ্ছাশক্তির কাছে রাধাকান্ত, বটুক, নন্দ তিনজনই কুচরিত্রের পর্যায়ে নেমে আসে। রাধাকান্তর ঈর্শা, ক্ষোভ এবং খুনের ইচ্ছা অবশ্য সঙ্গত। কিন্তু তার বদমেজাজের প্রসঙ্গ অনুল্লিখিত নয় এই গল্পে। এখানেও পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন কাজললতাকে লেখক। আমরা কি কাজললতাকে অপাপবিদ্ধ ধরে নিতে পারি? বোধ করি এ ভাবা সম্ভব নয়। বটুক কিংবা নন্দের তাপউত্তাপে কাজল। গলে যায় কেন এর উত্তর বোধ করি এই কাজললতা তার সাচ্ছন্দ্যের জন্য যে কোনো মূল্য দিতে রাজী। গল্পটি একালের, হয়ত মূল্যবোধ হারানোর দৃষ্টান্ত হিসাবে গল্পটিকে গণনা করা যায়।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গল্পের চরিত্রনির্মাণকলা কিছুটা সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাক কাহিনীগ্রন্থনের মতো। নায়কেরা তাদের গল্প যখন নিবেদন করেছে পাঠকের কাছে তখন তাদের মধ্যে অনেকেই প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছেন। শ্রোতাদের আসরে বসিয়ে বাতির আলো ধীরে ধীরে কমিয়ে আনেন। আর নায়ক তখন বর্তমানকে শ্রোতার চিত্ত থেকে সরিয়ে দিতে থাকেন। অতীতের পর্দা খুলতে থাকে, আমরা আর এক আলোর জগতে পৌঁছতে থাকি। ভূতের গল্পে এই পরিবেশটি গা-ছমছম-করা। আশুতোষ কিন্তু ভূতের গল্প লেখেন না। অতীতকেই বর্তমানের ঘটনা, দৃশ্যে, সংলাপে রূপান্তরিত করেন। বোধ করি গল্প শোনার কৌতূহল এতে বেড়ে যায়। আসলে আশুতোষ যেন নাটক কিংবা চরিত্রবিহীনবিহীন গল্প অথবা চরিত্রবিরোধী গল্পে বিশ্বাসী নন। গল্প বলার বঙ্কিমী পদ্ধতিতে তার পূর্ণ আস্থা।

স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠিত লেখক রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী রামেশ্বরমে বেড়াতে গিয়েছেন। নিছক ভ্রমণের নেশায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমের রহস্যময়ী মাতাজীকে দেখতে পান। বিকেলে সর্বজনশ্রদ্ধেয়া, সঙ্গীতজ্ঞ, পরম ধর্মাচারী মাতাজী রামকৃষ্ণকে ডেকে পাঠান। সকালের দেখায় (ঘোমটার আড়ালে) যে কৌতূহল জেগেছিল বিকেলে তাকে চিনতে পারলেন। আর গল্পের শুরুও এখানে। এক সময়ের প্রেমিক-প্রেমিকা। রামকৃষ্ণের যেন কেবল পালিয়ে-বেড়ানো প্রেমিকাকে ভালোবাসার সম্পুটে ধরে রাখবার চেষ্টা। প্রচণ্ড আবেগে প্রেমিকা শুভ গাঙ্গুলিকে কিন্তু তিনি পেলেন না। রামকৃষ্ণের প্রচণ্ড ভালোবাসাকে গ্রাহ্য না করে শুভ উধাও হল। এখন সে মাতাজী। ভক্তজনের ভক্তির পাত্র। রামকৃষ্ণবাবুর অনুমান করতেন শুভা অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে পালিয়েছে। কৌতূহলবশেই জিজ্ঞেস করলেন কেন শুভা পালিয়েছিল এবং সেই প্রেমিকা পুরুষটিই বা কে? শুভার উত্তর শুনলেন তিনি। রামকৃষ্ণের বড়ো হয়ে ওঠার জন্যই শুভা সেদিন নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়েছিল। রামকৃষ্ণের লেখকজীবনে এরকম বিচ্ছেদ্যন্ত্রণা থাকলেই তাঁর লেখায় ফুটে উঠবে নায়িকাদের জীবনের সাধ আহ্বাদ, প্রেম রোমান্স আর শুভার মতো সাধারণ কালো মেয়ে নয়, দেখা দেবে সুন্দরীরা। নারীর এই ত্যাগ আমাদের কাছে কিছুটা অবাস্তব মনে হলেও আশুতোষ মানবিকতার। দৃষ্টান্তরূপে গল্পটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আমাদের ইচ্ছাপ্রণের গল্প এটি। লোকনাথবাবুর গল্প বলার কাহিনীও ওই অতীতের দরজা খুলে দিয়ে তার অন্দরমহলের চিত্র প্রদর্শন। রামকৃষ্ণবাবুর অভিজ্ঞতা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের রাখা সুমিত্রার (রাজা ও রানী) মতো–তোমাকে যে ছেড়ে যাই সে তোমারি প্রেমে। আর লোকনাথবাবুও বহুদিন। বাদে তার গ্রামের বাড়িতে এসে গ্রাম-পরিক্রমায় এসে সন্ধ্যার আলোআঁধারে আবিষ্কার করেন বোবা হাসিরাণীকে। গল্পটির মধ্যে মানুষের স্বার্থচিন্তা, অর্থলোভ, ঠকানোর চিত্র। আছে। গল্পের স্বাদ ঘন করেছেন প্রায় ডিটেকটিভ উপন্যাসের শৈলীতে। কিন্তু নারীর পালয়িত্রী এবং রক্ষায়িত্রীর ভূমিকাকে তিনি মেলে দেন এই গল্পের শেষে। নারীর অন্তরশক্তির পরিচয় পাই আমরা এ গল্পে। বোবা হাসিরানী নিজের অধিকার রক্ষা করার জন্য এক ধরনের নৃশংসতার আশ্রয় নিয়েছিল। এটা কি পাপ? গল্পের শেষে এর উত্তর পাই আমরা। লোকনাথবাবু বললেন, কোনো পাপ করোনি, কোনো অন্যায় করোনি–তুমি যা করেছ তোমার ছেলেরা তা সোনার অক্ষরে লিখে রাখে যেন, বংশ বংশ ধরে সকলে জানতে পারে। গল্পটার শেষ ছত্র বাঘিনীর নিঃশব্দ গর্জন কেউ শোনেনি। অনেক গল্পেই আশুতোষ নিজেই চরিত্রের জবানিতে গল্পের মর্ম উদঘাটন করেন। এ প্যাটার্নও বঙ্কিমী। আর লেখক ধরা দেন পাঠকের কাছে এইভাবে। প্রয়োজনে। নারী যে বাঘিনী হয়ে উঠতে পারে গল্পের মর্ম তাই। আবার সেই শক্তিময়ীর ভূমিকার বিস্তার লক্ষ করি আমরা।

আমরা আগে বলেছি আশুতোষ রোমান্সের রহস্যঘটনা তার গল্পে বিস্তার করেন না। তবে কি তার গল্পে প্রণয়কলার ছলনা, আকাঙ্ক্ষা, আবেগবর্জিত? সেরকম নয়। অবশ্য। কিন্তু পূর্বরাগ থেকে মিলনে উত্তরণ খুব দ্রুত ঘটে যায় আশুতোষের গল্পে। পূর্বরাগ অনেক সময়েই নায়কের পক্ষে একতরফা। এবং প্রেমিক তখন দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। যতটা না মধুচন্দ্রিমার ভাষায় প্রেমিক অভ্যস্ত, তার চাইতে অনেক বেশি সে মরিয়া। কোনো বাধাই সে মানতে চায় না। প্রেমিকা-কে সে জোর করে ছিনিয়ে নেবে–এই তার পণ। কিন্তু মিলনের পর হঠাৎ যেন সংসারের চাপে এবং দাপে অথবা স্বভাবে সে হয়ে পড়ে দুর্বল। সেই জায়গায় এসে দাঁড়ায় প্রেমিকা। আশুতোষের নায়িকাদের গৃহিণীপনার বৈচিত্র্য কর্তব্যপালনে, সন্তানপালনে, সংসারবিন্যাসে, কখনও বা সংসারত্যাগে। তার নারীরা লক্ষ্মী ও প্রিয়া একথা বলেছি, কিন্তু সময়বিশেষে তারা। উগ্র। বাঙালির সংসারে ঘানি টেনে (আধুনিকাদের দেখতে পাই না বিশেষ। বঙ্কিমচন্দ্রের নবীনা ও প্রবীণার সাক্ষাৎ পাই নিশ্চয়ই। বঙ্কিমচন্দ্রের নবীনারাও কিন্তু একালের উপন্যাসে নিতান্তই প্রবীণা। আশুতোষ বঙ্কিমগোষ্ঠারই লেখক।) নারীরা। সেই সূত্র ধরেই উঠে আসে বিভাবতী, হাসিরানী চরিত্র। মধুরঙ্গ গম্ভার প্রকৃতির মানুষ। অভিনয়জীবনে সে মানুষকে হাসায়। চরিত্রটির মধ্যে আমরা এক অনাস্বাদিত জীবনরসের পরিচয় পাই। তার শিক্ষাদীক্ষা খুব বেশি নয়। কিন্তু অভিনয়জীবনে সফল। সে ভালোবাসে দুর্গাকে। দুর্গা ধনীঘরের মেয়ে। উচ্চ শিক্ষিত। সে মধুরঙ্গকে উপেক্ষা করে। ঘৃণাই করে বলতে হবে। মধুরঙ্গ দুর্গাকে পাবার জন্য দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে তার মধ্যে জেগে ওঠে খুন করবার প্রবৃত্তি। কিন্তু একদিন সে অভিনয়ের ছলচাতুরির দ্বারাই দুর্গার চিত্ত জয় করে। দুর্গা পরিবর্তিত হয়। মধুরঙ্গকে সে ভালোবাসতে আরম্ভ করে। কিন্তু প্রেমের ফঁদ সে জানে না। মধুরঙ্গের জীবনকে গড়ে তোলাই তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। মধুরঙ্গ মানতে চায় না। দুর্গা ক্ষেপে ওঠে। মধুরঙ্গের জীবনকে সে সুন্দর করে তুলতে চায় বলেই কখনও কখনও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে দুর্গা। এই দুর্গা মরে গেল একদিন। দুর্গার শোকে শ্মশানে যখন সকলে বিহ্বল তখন মধুরদের মনে পড়ে যায় দুর্গাকে যেদিন অভিনয়-ছলার দ্বারা জয় করেছিল। সে অভিনয়ই সে করতে লাগল এখানে এসে। সে অভিনেতা। জীবনের সঙ্গে অভিনয়ের জন্য মেলবন্ধন ঘটে যায়। আর দুর্গা? সে যেন সরস্বতী নদী! যার বুকে বালি আর খুঁড়লেই অন্তঃশীলা ফন্ন। যদিও দুর্গা অবাঙালী কিন্তু আশুতোষ তার মধ্যে খুঁজে পান বাংলার বধূর জীবনযাপনের আদর্শ। যাকে আমরা প্রায় ফেলে এসেছি, আসছি ইতিহাসেরই অমোঘ নিয়মে। আশুতোষের মূল্যবোধ সাবেকি, ঐতিহ্যনিয়ন্ত্রিত।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গল্পে বাঙালী-অবাঙালী মধ্যবিত্তের সুখদুঃখের মেলা। তিনি দাম্পত্যজীবনের বিশেষ একটি ঝোঁকের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছেন। তিনি যখন গল্প লিখতে শুরু করেন তখন বাংলা গল্পে নূতন কালের ইশারা। নূতন গল্পে রচনাশৈলী পালটে যাচ্ছিল। মননের বিস্তার গল্পে দীপ্ত হচ্ছিল। সূক্ষ্ম কারুকার্যের দিকে লেখকবৃন্দের ঝোঁক তখন। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর আশা ও আশাভঙ্গের উৎসাহ ও বিষাদ বাংলা গল্পে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব তখন বিপন্ন। অবক্ষয়ের এক গভীর খাদের মুখোমুখি মধ্যবিত্ত। সিসিফাসের নিথ টানছে লেখকবৃন্দকে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের কাঠামো পরিবর্তিত হলো। মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সে পরিবর্তন জড়িয়ে গেল। বাংলা গল্পে তারও পদাঙ্ক পড়ল।

কিন্তু আশুতোষ এই পরিবর্তনের আবর্তে উঠে আসতে চাননি। তিনি লক্ষ করেছেন মধ্যবিত্তের জীবনে এমন কতকগুলি প্রবণতা, টানটোন আছে যা প্রায় গত শতাব্দের মাঝামাঝি থেকে চলে আসছে। সেই ট্রাডিশন সমানে না চললেও, উচাবচ কিছু তরঙ্গ সৃষ্টি হলেও-বাঙালী মধ্যবিত্তের একটা সাবেকি প্যাটার্ন থেকেই গেছে। আমরা যে গল্পগুলি চুম্বকে দেখেছি সেখানে এই গড়পড়তা বাঙালিরই চেহারা। মধ্যবিত্তের এই চিত্ৰচরিত্র-কে আশুতোষ ভোলেননি। তিনি মননের ধার দিয়ে যাননি এমন কথা বলি না, তবে স্পষ্ট, প্রত্যক্ষের ভাষায় তিনি এ জীবন এঁকে গেছেন। আমাদের কেবলই বাংলা কবিতায় অক্ষয়কুমার বড়ালের এষা কাব্যের কথা মনে পড়ে যায় আশুতোষের গল্পমালায়। অক্ষয় বড়াল প্রীতিবিরহের কাব্য রচনা করেছিলেন। প্রিয়ার বিরহের স্পর্শ ঘরের আনাচে-কানাচে মধুর রূপ নিয়ে আনাগোনা করছে এমন কি গৃহস্থালির প্রতিটি খুঁটিনাটি জীবনে কবি প্রিয়ার স্পর্শ পেয়েছিলেন। দুর্দান্ত পুরুষকে স্নেহবন্ধনে বেঁধেছে নারী। আশুতোষ এই জীবনকেই খুঁজে পান বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীজাগরণের বিস্তার। এই জাগরণের একটা আত্যন্তিক দিকও তার গল্পে উঠে আসে। তাকে যেন তিনি ঠিক মেনে নিতে পারেন না। সমর ঘোষাল আর অতসীর কাহিনীতে প্রেম ভালোবাসা মিলনে এবং চিরবিচ্ছেদে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অতসী (কুল) যেন আতসী (এক জাতীয় কাঁচ যা সূর্যকিরণকে ঘনীভূত করে প্রচণ্ড তাপে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া যায়)। নারীর দীপ্তি দাহ যেমন আমরা এ গল্পে পাই তেমনি দেখি ব্যর্থতার কারুণ্য। একটি গল্পে হাসি নামে মেয়েটির অবহেলা আর উৎপীড়নের শিকার হতে দেখি, অন্যদিকে আর একটি গল্পে শোনা যায় হাসিনার গর্জন। আশুতোষ মধ্যবিত্ত জীবনের এই কান্নাহাসির রূপকার।

–ডঃ বিজিতকুমার দত্ত

*

সূচীপত্র

মুখোমুখি
দুজনার ঘর
ফেরারী অতীত
চলো জঙ্গলে যাই
মডেল
রূপসী বাংলার মুখ
সোনালী রেখা
ত্রিবর্ণা
একজন মিসেস নন্দী
কথামালা
মীনা রাখি সাধিকা

Book Content

মুখোমুখি 3 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/3 Steps
মুখোমুখি
দাম্পত্য
সহাবস্থান
দুজনার ঘর 8 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/8 Steps
তপ
সৈনিক
তৃষ্ণা
মেজর সেবকরাম
তিলে তিলে তিলোত্তমা
বিবেচনা সাপেক্ষ
আকাঙ্ক্ষা
দুজনার ঘর
ফেরারী অতীত 5 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/5 Steps
ফেরারী অতীত
বাঘিনীর নিঃশব্দ গর্জন
মধুরঙ্গ
ক্ষুধা
রূপ
চলো জঙ্গলে যাই 10 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/10 Steps
চলো জঙ্গলে যাই
রমা মিত্র এবং মালবী মিত্র
যৌবন
পরনে ঢাকাই শাড়ি
আহুতি
তমোঘ্ন
স্মৃতি যদি ফেরে
ঘৃণা
পরিতাপ
আশা আর বাসা
মডেল 6 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/6 Steps
আচরণ
মা
দিনবদল
পথচিত্র
বোরখা
আরোগ্য
রূপসী বাংলার মুখ 4 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/4 Steps
রূপসী বাংলার মুখ
আতসী
দীপ জ্বেলে যাই
বারমুডা লিলি
সোনালী রেখা 2 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/2 Steps
সোনালী রেখা
সুলক্ষণা
ত্রিবর্ণা 2 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/2 Steps
দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি
একাকী জোনাকী
একজন মিসেস নন্দী 9 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/9 Steps
মহাবিহার
অভিরতি
মান
সম্পাদক
নাগরী
ঝড়
মন পবনের নাও
বীতশোক
একজন মিসেস নন্দী
কথামালা 4 Topics
Lesson Content
0% Complete 0/4 Steps
রানীদিন
ফল
আপস
হিসেবের বাইরে
মীনা রাখি সাধিকা 1 Topic
Lesson Content
0% Complete 0/1 Steps
সাধিকা
লেখক: আশুতোষ মুখোপাধ্যায়বইয়ের ধরন: রচনাসমগ্র / রচনাবলী / রচনা সংকলন
সাত পাকে বাঁধা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

সাত পাকে বাঁধা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

রূপসী বাংলার মুখ – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

ত্রিবর্ণা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

সোনালী রেখা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.