রূপসী বাংলার মুখ

রূপসী বাংলার মুখ

মেয়েটাকে চোখের ওপর বড় হতে দেখেছি। ঢলঢলে মিষ্টি মুখ। না কালো না ফর্সা। চোখ দুটো ভারী সুন্দর। না হাসলেও মনে হয় চাউনিতে একটু হাসির মায়া ছুঁয়ে আছে। নামও হাসি। ছ মাস বয়েস হতে ওর মা মনোরমা একদিন মেয়ে কোলে আমার কাছে হাজির। মুখে চিন্তার ছায়া। বলল, আপনার ভাগ্নীর তো ছ মাস হয়ে এলো দাদা, এ-মাসের শেষেই মুখে একই মায়ের প্রসাদ দেব ভাবছি, কিন্তু এখনো পর্যন্ত একটা নামই ঠিক হল না–আজ আপনার কাছ থেকে ওর একটা নাম না নিয়ে নড়ছি না।

মেয়ের একটা নাম ঠিক করে দেবার তাগিদ এ পর্যন্ত ওর মা আমাকে অনেকবার দিয়েছে। তখন পর্যন্ত বাচ্চাটার বাবা ওকে আদর করে ডাকত বুচু। ওই ডাক শুনে পিত্তি জ্বলে যায় এ-ও মনোরমা নিজেই অনেকবার বলেছে। মেয়ে খাদা নয় বোঁচা নয় তবু বুচু বলে ডাকলে কোন মায়ের ভালো লাগে!…ভাবতে গেলে মনে হয় সেদিনের কথা, মেয়ে কোলে মায়ের আক্ষেপ, পাড়ার সকলেও এখন বুচু বুচু শুরু করেছে, শেষে ও-ই না ডাক-নাম হয়ে দাঁড়ায়। আপনি এমন একটা নাম দিন দাদা যাতে ভালো নাম ডাক-নাম দুই-ই হয়ে যায়। আমি ওকে বলে দিয়েছি, দাদা নাম ঠিক করে দিলে মেয়েকে আর কোনো নামে ডাকা চলবে না।

ওকে অর্থাৎ ওর স্বামী নয়নকে বলে দিয়েছে। ওরা বসু চৌধুরী। আমি এদের দাদা হলেও আত্মীয়তার কোনো যোগ নেই। লাগোয়া পুরনো দোতলা বাড়িটা ওদের। পৈতৃক ভিটে। দোতলার দুখানা ঘরে ওরা থাকে। জোরে কথা কইলে বা শব্দ করে হাসলে-কাদলে আমাদের বাড়ির ও-মুখো ঘর থেকে শোনা যায়। একতলার ঘর দুটো পুরনো ভাড়াটের দখলে। নামমাত্র ভাড়া পায় বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু এতকালে তারাও আত্মীয়ের মতো হয়ে গেছে, তাই মুখ ফুটে কিছু বলে না বা বলতে পারে না। ওপর-নিচের দুই পরিবারই নিজেদের সুখে-দুঃখে আমাদের আপনার জন ভাবে।

পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে গেল, নামের তাগিদে ছ মাসের মেয়ে কোলে মনোরমার। সেই ঘরে এসে চড়াও হওয়াটা স্পষ্ট মনে আছে। যার কোলেই হোক, ঘরে এলেই মেয়েটা আমার টেবিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। লেখার কাগজ কলম বই-পত্র রহস্যজনক খেলার কিছু ভাবে হয়তো। কিন্তু মায়ের কোলে চেপে সেদিন সামনে না ঝুঁকে মুখের দিকে চেয়ে ফিক-ফিক করে হাসছিল। ও-যেন আমার ফ্যাসাদ বুঝেই মজা পাচ্ছে।

মেয়েটার হাসি দেখেই মনে হয়েছিল এই নামটা আমার অনেক আগেই মনে আসা উচিত ছিল। একটুও না ভেবে বলেছিলাম, মেয়ের নাম রাখো হাসি।

অনেকদিনের প্রত্যাশার পরে লেখকের কাছ থেকে এমন সাদামাটা নাম আশা করেনি মুখ দেখেই বোঝা গেল। বলল, শুধু হাসি…

–হাসি আবার শুধু হাসি কি, চোখ বুজে নামটা রেখে ফেলো, ও-নামের কদর পরে বুঝবে।

মেয়েটাও ও-কথার পরেই জোরে হেসে উঠেছিল মনে আছে।

পছন্দ হোক না তোক মনোরমা মেয়ের নাম হাসিই রেখেছে। আর ওর আত্মীয় পরিজন বা চেনা-জানা কাউকেই বোধহয় জানাতে বাকি রাখেনি মেয়ের এই নাম ওমুক দাদা রেখেছে।

তারপর দিনে দিনে মাসে মাসে বছরে বছরে হাসি আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। বিকেলে আর ছুটির দিনের দুবেলাই ওদের বাড়ির সামনের কাঁচা উঠোনে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ছোটাছুটি করে, এক্কা-দোক্কা খেলে, লাফাঝাপি করে আর সমবয়সী সব মেয়ের ওপরেই সর্দারি করে। হঠাৎ হঠাৎ মুখ তুলে ওপর দিকে তাকায়। ও ঠিক বুঝতে পারে দোতলার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক সময়েই ওকে আমি লক্ষ্য করি। ঝগড়াঝাটি করা বা সর্দারি করাও লক্ষ্য করি। তখন লজ্জা পায় আর খুব হাসে। সকালে স্কুল-বাসের হর্ন শুনলেই বই-খাতার ব্যাগ বুকে চেপে পড়ি-মরি করে ছুটে আসে, আর তখনো একবার তাকিয়ে দেখে দোতলার রেলিং-এ আমি দাঁড়িয়ে কিনা। ওর দৌলতে বাসের মেয়েরাও ওর মামাবাবুকে অর্থাৎ আমাকে চিনে গেছে, সকৌতুকে তারাও চেয়ে চেয়ে দেখে। কোনো কারণে পর পর দু-তিনদিন আমাকে না দেখলে হঠাৎ এক সময় আমার ঘরে এসে চড়াও হয়। গিনি গিন্নি মুখ।-বা-ব্বাঃ! এত লেখায় ব্যস্ত যে কদিনের মধ্যে দেখাই নেই, আমি ভাবলাম জ্বর-জ্বালা হল নাকি আবার দেখে আসি

সময় সময় আমারও গম্ভীর থাকার চেষ্টা।-জ্বর জ্বরই লাগছে, দ্যাখ তো–

তক্ষুণি কাছে এসে কপালে হাত, বুকে হাত। তার পরেই ঠোঁট উল্টে হাসি। –ধেৎ, পাথরের মতো ঠাণ্ডা গা–তাছাড়া জ্বর জ্বর মনে হলে কেউ পাখার নিচে খালি গায়ে বসে লেখে? আমাকে ঠকাবার মতলব?

–আর তোর পাকামো করতে আসার মতলব?

তক্ষুণি হি-হি হাসি আর ছুট। ভিতরে ভিতরে আমার এই হাসি দেখারই লোভ।

 আরো একটু বড় হতে বইয়ের তাগিদ।আজ ওমুক দিদিমণি তোমার একখানা বই চেয়েছে মামাবাবু, সকালে তো মায়ের জ্বালায় আসার সময় পাই না, আজই দিয়ে রাখো।

সঙ্গে সঙ্গে আমিও গম্ভীর।-বই নেই।

–বা রে, কাল একটা বই না নিয়ে গেলে আমার যে মান-ইজ্জৎ থাকে না।

–কি থাকে না? আবার বলতো?

থতমত খেয়ে হেসে ফেলে। একদিন প্রস্তাব করেছিলাম, আমি ঘড়ি দেখছি, তুই যদি আমার সামনে দাঁড়িয়ে টানা দু মিনিট হাসতে পারিস, তাহলে একটার বদলে দুটো বই পাবি।

শোনামাত্র সে-কি হাসি। হাসির চোটে চোখ মুখ লাল।-তুমি কি যে বলো মামাবাবু, ঘড়ি ধরে কেউ হাসতে পারে, আমি কি পাগল…! আবার হাসি আর ছুট।

এই মেয়ের নাম হাসি ছাড়া আর কিছু হতে পারে! যত দিন যায় নিজেই নিজের বিবেচনার তারিফ করি।

স্কুলের পাট শেষ হবার আগে থেকেই হাসির শাড়ি পরার ঝোঁক। চোখের সামনে মেয়েটা এর ফলে যেন হুট করে এক লাফে বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেল। স্বাস্থ্য ভালো, লম্বা গড়ন, শাড়ি পরলে হাসি-খুশি মেয়েটাকে আরো সুন্দর দেখায় অবশ্য। তবু বলেছিলাম দশ ক্লাশ শেষ না হতেই শাড়ি কেন, আরো একটা দুটো বছর ফ্রক ট্রক চালিয়ে গেলেই পারতিস। কলেজের মেয়েরাও আজকাল শাড়ি পরতে চায় না–

হাসির সব কথাতেই হাসি।কত ঢ্যাঙা হয়ে গেছি তোমার চোখ নেই! স্কুলের ঢ্যাঙা মেয়েরা শাড়ি পরে দেখে আমিও ধরে ফেললাম। তুমি আবার মা-কে কিছু। বোলো না বাপু, এমনিতেই বলে আমার দিকে তাকালে তার চোখে এখন কাটা ফোঁটে।

মায়ের চোখের খবর ঠিক রাখি না, কিন্তু পাড়ার নতুন বয়সের ছেলেগুলোর চোখের ভাষার কিছু তারতম্য বুঝতে পারি। সময়ে অসময়ে তাদের অনেককেই ও বাড়ির কাছাকাছি ছোঁকছোঁক করে ঘুরে বেড়াতে দেখি। হাসিকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেখলে বা বাড়িতে ঢুকতে দেখলে কেউ চকিত হয়, কেউ মুখখানা গম্ভীর করতে চেষ্টা করে, দুঃসাহসী দুই একজন ওকে থামিয়ে কিছু কথাবার্তা কইতেও চেষ্টা করে। হাসির কাছে ছেলেগুলোর এই আচরণ ভারী কৌতুকের ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে তখন আমাকে দাঁড়ানো দেখলে খুব লজ্জা পায়। ওর মুখের এই লজ্জার হাসিটুকু ঠিক ঠিক বর্ণনা করার মতো কলমের জোর নেই। শুধু ভাবি মেয়েটার হাসি নাম সার্থক।

ওদের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার পরে হাসি দিন কতক বাড়িতেই সেঁধিয়ে থাকল। চার নম্বরের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন হয়নি। ওর মা এসে জানান দিল, বাড়িতে বলছে লজ্জায় মামাবাবুকে আর মুখই দেখাতে পারবে না। দিন তিনেক না যেতে আবার ওর মায়ের মুখেই এক তাজ্জব খবর। হাসির বিয়ে। গত পরশু বিকেল সাড়ে তিনটেয় ছেলের পক্ষ এসে মেয়ে দেখে গেছে। ছেলের বাবা-মা নেই। বড় দুই দাদা, তাদের দুই বউ আর এক ছোট বোনকে নিয়ে ছেলে নিজেই হাসিকে দেখে গেছে। পছন্দ হয়েছে সেদিনই বোঝা গেছে। আজ সকালে এসে পাকা কথা দিয়ে গেছে। এটা জ্যৈষ্ঠ মাস, এই আষাঢ়েই তাদের ছেলের বিয়ে দেবার ইচ্ছে। মেয়ের মায়ের অর্থাৎ মনোরমার মাথায় এখন ভাবনার আকাশ ভেঙে পড়েছে।

ভাবনার কথা বলল বটে, কিন্তু মুখখানা খুশিতে ডগমগ মনে হল। হঠাৎ এ খবর শুনে আমার মাথায় বরং দুশ্চিন্তা একটু।–সবে স্কুল ফাইনাল পাস করল, এরই মধ্যে বিয়ে…ছেলে কেমন ভালো করে খোঁজ-টোজ নিয়েছ?

-তা আর নিইনি, আমাদের কাছে সোনার টুকরো ছেলে, বি. এসসি পাস, সরকারী চাকরি, রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে কি একটা পোস্ট-এ আছে বলল, এরই মধ্যে ছশ টাকাব ওপর মাইনে পায়, আর প্রায়ই টুরফুরে যেতে হয়, তাতেও মাসে শ-দেড়শ থাকেই দাবি-দাওয়া বলতে গেলে কিছুই না–ছেলে এখানে বিয়ে করবে বলতেই তার দাদারা উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এসেছে–ওর এক জ্যাঠতুতো ভাইয়ের চেনা পরিবার–তারাই সম্বন্ধটা দিয়েছিল, খুব ভালো বলেছে।

জিগ্যেস করলাম ছেলের বয়স কত?

-পঁচিশ। তা হাসিও তো ষোল পেরিয়ে সতেরোয় পা দিতে চলল, এমন কিছু খারাপ হবে না। আপনি যেন ওকে ডেকে একটু উৎসাহ দেবেন দাদা, এমনিতেই সকাল থেকে আমাকে ঝাড়ছে, আপনি খুব খুশি হয়েছেন না বুঝলে ঠিক বিগড়ে যাবে।…এ-দিকের শরীরের অবস্থা তো জানেন, ভালোয় ভালোয় বিয়েটা দিয়ে ফেলতে পারলে একটা বড় দায় শেষ।

শেষেরটুকু যুক্তির কথাই বটে। এই বয়েসেই ওর স্বামী নয়নের ছোটখাট একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।

সেই বিকেলেই হাসি এলো। হয়তো বা লজ্জাতেই বেঁকে-চুরে সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি সঙ্গে সঙ্গে দারুণ গম্ভীর।–আয়, সেকেন্ড ডিভিশনে সেকেন্ডারি পাস করে আমাকে মুখ দেখাতে পারছিস না, আর তার মধ্যে দিব্যি আর একজনকে মুখ দেখিয়ে মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিলি!

হাসি বলে উঠল, আমার বয়ে গেছে মুৎ ঘোরাতে, একটা ভোদকা

শুনে ধাক্কা খেলাম একটু।–সে কি রে! আমি তো শুনলাম খুব ভালো ছেলে।–তোর পছন্দ হয়নি?

–আমার এখন বিয়েই পছন্দ নয়, হায়ার সেকেণ্ডারি পাস করলাম না, এরই মধ্যে বিয়ে! তারপরেই দস্তুরমতো মিনতি, তুমি মা-কে ডেকে একটু বলো মামাবাবু, তোমার কথা শুনতে পারে–

বিড়ম্বনায় পড়ে জবাব দিলাম, ভালো ছেলে পেলে সব বাবা-মা-ই মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলতে চায়, চোখ-কান বুজে আপাতত বিয়েটা করে ফ্যাল, আমি বরং তোর বরকে শাসিয়ে দেব, এরপর না পড়ালে বিয়ে নাকচ হয়ে যাবে।

ঠোঁট উল্টে হাসি বলল, আর ছাই পড়া হবে, দেখো–

আষাঢ়েই বিয়ে হয়ে গেল। বর দেখে আমারও যে খুব একটা পছন্দ হয়েছে। তা নয়। ফর্সা, বেঁটে, মোটাসোটা, নাকের নিচে এক ইঞ্চির মতো এক খাবলা গোঁফ। কিন্তু সাধারণ ঘরের বিয়ের বাজারে ছেলের বিদ্যে আর ভালো চাকরিরই কদর। মেয়ে সুখে থাকলে একেই সকলে সোনার ছেলে বলবে।

শ্বশুর বাড়ি যাবার আগে হাসি প্রণাম করতে এলো। সেই প্রথম বোধ করি ওর কাঁদ কাদ মুখ দেখলাম ছদ্ম বকুনির সুরে বললাম, হাসির মুখে কান্না দেখলে। আমার দেওয়া নামের অপবাদ হবে বলে দিলাম! ফিক করে একবার হাস দেখি?

এ-কথার পর হাসিমুখেই প্রণাম করে গেছে।

.

 হিসেব না রাখলে সময় পাখা মেলে ওড়ে। দশটা বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে হাসি কত শত বার বাপের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি করেছে তা খেয়াল করার মতো কখনো কিছু ঘটেনি। এই সাতাশ বছর বয়সে হাসি রীতিমতো গিন্নি-বান্নি গোছের হয়ে উঠেছে। এখন এক মেয়ে আর দুই ছেলের মা। মেয়ে বড়ো। ছেলে দুটো ছোট। পড়াশুনা আর হয়নি। বিয়ের এক বছর না ঘুরতে মেয়ের মা হয়ে বসেছে, পড়াশুনা হবে কি করে! এই দশ বছরে খানিকটা মুটিয়েছে, কিন্তু লম্বা বলে খারাপ দেখায় না, উল্টে আরো ফর্সা আর ঢলঢলে মনে হয়। পান খায় খুব, মুখে সেই হাসি লেগেই আছে। দেখা হলেই লাল দুই ঠোঁটের হাসি সমস্ত মুখে ছড়ায়। আমি বলি, পান খাস কেন, অত সুন্দর দাঁতগুলো বিচ্ছিরি হয়ে যাবে।

ও হেসেই বলে, গেলেই হল, কত বার করে দাঁত মাজি জানো!

দাঁতের যত্ন নেয় বোঝা যায়, হাসলে পানের লাল রসে ভেজা দাঁতে সাদার চেকনাই ঝিকঝিক করে। হাসির মুখের হাসি আগের মতোই সুন্দর।

এই দশ বছরের মাথায় একটা অঘটন ঘটে গেল! তৃতীয় বারের হার্ট অ্যাটাকে হাসির বাবা নয়ন মারা গেল। তার পর থেকেই হাসি মেয়ে আর ছেলে দুটোকে নিয়ে বাপের বাড়িতে মায়ের কাছেই থাকে। বড় মেয়ে আর বড় ছেলেটা এ-দিকের স্কুলেই ভর্তি হয়েছে। হাসির মুখেই শুনেছি ছেলে-মেয়ে নিয়ে মায়ের কাছেই থাকবে। ভাসুরদের সঙ্গে এই ব্যবস্থা করে এসেছে। ওর বরের নাম সুবিনয় দত্ত। দশ বছরে ওর চেহারা আরো পরিপুষ্ট আর ভারিক্কি গোছের হয়েছে। তাকে এখন সপ্তাহে দুতিন দিন অন্তত এই শ্বশুর বাড়ির রাস্তায় দেখা যায়। শুনেছি রিহ্যাবিলিটেশনের কাজে প্রায়ই এখন তাকে কলকাতার বাইরে থাকতে হয়। ছেলে-মেয়ে নিয়ে হাসির মায়ের কাছে এসে থাকার এ-ও একটা কারণ। তাছাড়া ও না থাকলে এখন আর মাকে কে দেখবে।

আরো তিন বছর বাদে দ্বিতীয় অঘটন। হাসির মা মনোরমা লিভার ক্যানসারে মারা গেল। বাবার চিকিৎসা বা সেবা হাসি করতে পারেনি। কিন্তু মায়ের জন্য যথাসাধ্য করেছে। বাপের বাড়ির বোল আনার মালিক হবার জন্য মাকে এতটুকু তুচ্ছ করেছে, এ ওর শত্রুও বলতে পারবে না। যদিও বর সুবিনয় এ বাড়ির পাকা বাসিন্দা হবার পর অনেকের চোখ টাটিয়েছে। আড়ালে কেউ কেউ বলেছে, লোকটার ভাগ্য বটে, বিয়ের দৌলতে কলকাতার মতো জায়গায় আস্ত একখানা বাড়ির মালিক হয়ে বসল।

কলকাতায় থাকলে সুবিনয় এখন এ-বাড়িতেই থাকে, এখান থেকে অফিস যাতায়াত করে। তবে দফায় দফায় মাসের প্রায় অর্ধেক দিন বাইরে কাটাতে হয়। হাসির মতো গিন্নি মেয়ের খুব বেশি দিন শোক আঁকড়ে বসে থাকার কথা নয়। সময়ে। আবারও তার পান-খাওয়া ঢলঢলে মুখে সেই পুরনো হাসির ছোঁয়া লাগল। ঘরের বা ছেলেমেয়ের ব্যাপারে কোনো পরামর্শের দরকার হলে সোজা আমার ঘরে চলে আসে। তেমনি হেসে বলে, এলাম আবার জ্বালাতে, রামর্শের দরকার হলে এখন আর তুমি ছাড়া কার কাছেই বা আসব

আমি বলি, কেন সুবিনয় টুরে নাকি?

হাসি ঠোঁট উল্টে দেয়, থাকলেই বা কি না থাকলেই বা কি, ভালো-মন্দ কোনো কিছুর মধ্যে আছে–বিয়ের সময় যা ছিল তার থেকে আরো ভোদকা হয়ে গেছে দেখো না!

সেই রকমই চোখ-জুড়ানো হাসি।

ওর এখন বছর বত্রিশ বয়েস। আর ছেলেপুলে হয়নি। সেজন্য মনে মনে ওরই বুদ্ধি আর বিবেচনার প্রশংসা করি। অনেক দিন আগে এই ছেলেপুলের প্রসঙ্গে ওর মামী অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে নাকি বলেছিল, তোমাদের জামাইয়ের স্বভাব চরিত্র যা –ছবছরের মধ্যে তিন-তিনটে চলে আসতে ওই ভালো-মুখো লোককে আর বিশ্বাস। করি! ছোটটা আসার পরেই অপারেশন করিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত।

হাসি হেসে-হেসেই এ-রকম কথা বলতে পারে বটে।

এই হাসির মুখ হঠাৎ থমথমে হয়ে ওঠা থেকেই এই কাহিনী। কিছুদিন ব্যস্ত ছিলাম, তাই লক্ষ্য করিনি। হাসি অনেক দিন আসেনি তা-ও খেয়াল করিনি। সেদিন স্ত্রীর কথায় টনক নড়ল। সে বলল, মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে বোধহয়, আসে না, হাসে না, কথা-বার্তাও বলে না–

আমি অবাক।–কার কথা বলছ?

–হাসির। সুবিনয়ের সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে, তিন সপ্তাহ হল ওকেও বাড়িতে বসা দেখছি, অফিস-টফিসেও যেতে দেখি না, মুখ চুন করে বাড়ির সামনের দাওয়ায় বসে থাকে–আর এক-একদিন দেখি মেয়েটা আগুনপানা মুখে ফটাফট করে আমাদের দিকের ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, তা-সত্ত্বেও ও-ঘর থেকে ওর গর্জন আর বকাবকি কানে আসে–ডেকে কিছু জিগ্যেস করতে পারি না–এরকম হাসি খুশি মেয়েটার হঠাৎ কি হলো বলো তো?

 হাসির মুখে হাসি নেই এ আমার কাছে শুধু বিস্ময় নয়, আঘাতের মতোও। এরপর কদিন লক্ষ্য করেও ওকে দেখতে পাইনি। ওদের এ-বাড়িমুখো দোতলার ঘরের জানালা দুটো এখন প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। সুবিনয়কেও সত্যি কদিন একতলার দাওয়ায় বসে থাকতে দেখেছি। বিষণ্ণ, বিমর্ষ মুখ। ফর্সা মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। দেখলেই মনে হয় সুখের শরীর-মনের ওপর দিয়ে কিছু একটা ঝড় গেছে।

রাস্তায় হঠাৎ সেদিন মুখোমুখি দেখা। মাথা নিচু করে সুবিনয়ের পাশ কাটানোর চেষ্টা। কিন্তু হাসির জন্যে আমার মনেও কম অশান্তি নয়। ওকে পাশ কাটাতে দিলাম না। জিগ্যেস করলাম, অনেকদিন হাসির দেখা নেই, ভালো আছো তো সব?

সুবিনয় মিনমিন করে জবাব দিল, আজ্ঞে হ্যাঁ..ভালোই।

–তুমি অফিসে যাচ্ছ না দেখছি..ছুটিতে আছ নাকি?

–হ্যা…অনেক ছুটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে…

আর কথার ফুরসত না দিয়ে যেন পালিয়ে বাঁচল। বড় রকমের কিছু গণ্ডগোল বেধেছে তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু সেটা পারিবারিক ব্যাপার না আর কিছু!

মাস দেড়েক বাদে আবার আমার স্ত্রীর মুখেই সমাচার শুনলাম। এর মধ্যে সে আরও অনেকবার জানলা-দরজা বন্ধ ওই মুখোমুখি ঘর থেকে হাসির তর্জন-গর্জন। শুনেছে। সদ্য বর্তমানে হাসিদের একতলার পুরনো ভাড়াটে-গিন্নি ওদের ওপর দারুণ। বিরূপ। হাসি নাকি এতকালের হৃদ্যতা ভূলে ভাড়া ডবল বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে গেছে। ভাড়াটে-গিন্নি আমার স্ত্রীর কাছে এসে নালিশ করেছে, মগের মুলুক ভেবেছে এটা–ভাড়া ডবল বাড়াতে চাইলেই হল–আর যা ব্যাপার এখন, ভাড়া ডবল বাড়ালেই অভাব মিটবে-চরিত্র-দোষে জামাই অমন চাকরিখানা খুইয়ে বসেছে, এখন ভাড়াটের ওপর চড়াও হলে কত আর সুরাহা হবে!

.

এরপর ওদের ভাড়াটে-গিন্নির কথা থেকে বোঝা গেল, পাড়ার মধ্যে আমরাই কেবল প্রতিবেশীর খবর রাখি না, নইলে কেলেঙ্কারির খবর কে আর না জানে! যে টুকু বোঝা গেল তার সারমর্ম, পুনর্বাসন দপ্তরের চাকরি সুবিনয় দত্তর, গরিব ঘরের কত উদ্বাস্তু পরিবারের হর্তাকর্তা বিধাতা ভাবত নিজেকে, কিন্তু ঘুঘু আর কতবার ধান খেয়ে যাবে–একবার ফাঁদে পড়বে না? এক বিধবা মেয়ের সর্বনাশ বলতে গেলে হাতে-নাতে প্রমাণ হয়ে গেছে, শুধু চাকরির ওপর দিয়ে সব নিষ্পত্তি, জেল হয়ে যায়নি এই রক্ষে। সোয়ামির সঙ্গে মেয়ের দিন-রাত কুরুক্ষেত্র চলেছে এখন, মেয়ের গলার চোটে এক-তলায় কান-পাতা দায়, দুবেলা হিসহিস করে স্বামীকে শাসাচ্ছে, অমন লম্পটের জেলে পচে মরাই উচিত ছিল, তাহলে তার হাড়ে বাতাস লাগত। মেয়েও বলিহারি! দুবেলা মাথা খোঁড়ে আর বিধবা হতে চায়! বাইরে এ-দিকে ঢাক ঢাক গুড়গুড়–কিন্তু সত্যি কথা কদিন আর জানতে বাকি থাকে!

বুঝলাম, পাড়ায় এই সত্যি-কথা রাষ্ট্র করার গুরু দায়িত্ব ওদের ভাড়াটে-গিন্নিই। নিয়েছে।

আমার হাড়-পাঁজরে একটা বোবা যন্না ছড়িয়ে পড়ছিল। মেয়েটাকে আমি কত ভালবাসি তা যেন এতদিন জানতাম না। কেবল আশা করছি, বিনা দোষেও তো। অনেকে অনেক সময় বিপাকে পড়ে–এ কি সেরকম কিছু হতে পারে না? রাগে দুঃখে মাথার ঠিক নেই বলেই হাসি হয়তো সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সুবিনয়ের সর্বদা অপরাধী মুখ দেখে এ আশাও ফিকে হয়ে আসছিল।

পরের একটা বছরে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। হাসির মুখে হাসি তো নেই-ই। ওদের সংসারে অনটনের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুনেছি, সুবিনয়ের চাকরিই শুধু যায়নি, হাতে শুধু নিজের-দেওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কটাই পেয়েছে। এ ছাড়া সতের বছরের চাকরির পেনশন গ্র্যাচুইটি সবই মার গেছে। মেয়ে আর ছেলে। দুটো নামকরা স্কুলে পড়ত, স্কুল বাসে যাতায়াত করত। ক্লাস-প্রমোশন হয়ে যেতে তারা কাছাকাছির এমন স্কুলে ভর্তি হয়েছে যেখানে স্বল্পবিত্তের মানুষও পারতে ছেলে মেয়ে দিতে চায় না। ওই ছেলে-মেয়ের মুখের হাসিতেও টান ধরেছে। হাসিকে থলে হাতে ইদানীং ক্বচিৎ কখনো কাছের বাজারে যেতে বা আসতে দেখি। কিন্তু এ-বাড়ির দোতলার দিকে ছেড়ে মুখ তুলে কোনদিকেই ওকে তাকাতে দেখি না। শুকনো টান ধরা মুখ। পুজো এলো গেল, কিন্তু এবারে ও বিজয়ার প্রণাম করতেও এলো না। ডাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সংকোচ হয়, ডাকতে পারি না। আমার স্ত্রীও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, অত হাসি-খুশি মেয়েটা কি হয়ে গেল!

এক বছর বাদে। সকালে অন্যদিনের মতোই কাজে বসেছিলাম। মুখ তুলে আমিই সচকিত হঠাৎ। হাসি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।

ভিতরে আসব মামাবাবু?

আমিও গম্ভীর একটু।–আয়। কবে আবার জিগ্যেস করে এ-ঘরে ঢুকেছিস? বোস–

হাসতে চেষ্টা করল। এ হাসি কান্নার মতোই। একটা মোড়া টেনে বসল। বলল, মুখ কেন দেখাতে পারি না জানোই তো…

আমি কিছুই জানি না, জানতে চেষ্টাও করি না। বিনা দোষেও অনেকের ওপরে অনেক অবিচার হয়। কিন্তু যত দুঃখের ব্যাপারই হোক, তুই আমাকে সুষ্ঠু হেঁটে দিলি?

চুপচাপ চেয়ে রইল একটু।–আমার সব গুমর ভেঙে গেছে মামাবাবু, দিন আর চলছেই না, তাই না এসে পারলাম না….যা হোক কিছু ব্যবস্থা করতে পারো?

হাসির মতো মেয়ের হার-না-মানা মুখের থেকে হার-মানা মুখ দেখলে বেশি কষ্ট হয়। আমি কি করতে পারি না বুঝে জিগ্যেস করলাম, কি ব্যবস্থার কথা। বলছিস?

দেখলাম, সহানুভূতি সত্ত্বেও আমার মাথায় যা আসেনি, বিপাকে পড়ে হাসি তা ভাবতে পেরেছে। মাথা নীচু করে সাদা কথায় বলল, আমার বেয়াই বা জামাইকে বলে যদি সুবিনয়ের কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারি। একবার মুখ তুলে আমার প্রতিক্রিয়া দেখে আবার মাথা নীচু করল-লোকটা যেমনই হোক, কাজে-কর্মে খুব সুনাম ছিল মামাবাবু…।

আমার বেয়াই আর জামাইয়ের মস্ত কন্ট্রাকটারি ফার্ম। কনস্ট্রাকশন আর ডেভেলপমেন্ট দুরকম কাজেই তাদের বহু লোক খাটছে। কিন্তু সেখানে কারো কাজের সুপারিশ এ-পর্যন্ত করিনি। তবু আমিও যেন একটা পথ দেখতে পেলাম। কারণ। বেয়াইয়ের সঙ্গে আত্মীয়তার থেকেও হৃদ্যতার দিকটা ঢের বড়। ভদ্রলোক বাইরে মেজাজী রাশভারী মানুষ, কিন্তু ভিতরে যেমন উদার তেমনি দিলদরিয়া।

পরে জানাবো বলে হাসিকে তখনকার মতো যেতে বললাম। বেয়াই বেশি শুনতে চাইলেন না। আমি অনুরোধ করছি সেটাই যথেষ্ট ধরে নিয়ে সুবিনয় দত্তকে তার কাছে। পাঠিয়ে দিতে বললেন।

চাকরি হল। রিহ্যাবিলিটেশনে কাজ করেছে জেনে ছেলের অর্থাৎ আমার জামাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে ডেভেলপমেন্টের কাজে দিলেন। মাইনে সর্বসাকুল্যে ছশ। দিন-কাল যা ছশ টাকা কিছুই না। কিন্তু হাসি তাতেই হাতে স্বর্গ পেল। আমি বললাম, মন দিয়ে কাজ করতে বল, এরা গুণের কদর করতে জানে।

হাসি হেসে জবাব দিল, সেটা আমি তাকে খুব ভালো করে সমঝে দিয়েছি–অনেক বার বলেছি, বেয়াইয়ের কাছে কক্ষনো তোমার জন্যে মামাবাবুর মুখ ছোট হলে রক্ষে থাকবে না।

এত দিন বাদে ওকে ওইটুকু হাসতে দেখেও মনে হল, সময়ে ও আবারও আগের। মতোই হাসতে পারবে। মুখেও বললাম, আমার মুখ নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না, আমি কেবল তোর মুখে হাসি দেখতে চাই।

ছলছল চোখে হাসি পায়ের ধুলো নিল। বলল, আশীর্বাদ করো মামাবাবু, তোমার দেওয়া নাম আর যেন কালো না হয়।

হয়নি। ছমাস না যেতে বেয়াইয়ের মুখে সুবিনয়ের প্রশংসা। খাসা লোক দিয়েছেন মশাই, চেহারা দেখলে বোঝা যায় না এত খাটতে পারে, তাছাড়া সারভের কাজে বেশ পাকা, ডেভেলপমেন্টের কাজেও ভালো মাথা–কেউ শত্রুতা না করলে এ-রকম লোকের চাকরি যায় কি করে।

চাকরি কি করে যায় সে-আলোচনায় আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। বেয়াই যে খবরটা নিজে আমাকে বলেননি, হাসিমুখে এসে সে-খবর আমাকে হাসি দিল। এই ছমাস যেতেই সুবিনয়ের মাইনে আরো একশ টাকা বেড়েছে–আর পাকা খাতায় তার নাম উঠেছে, অর্থাৎ এরপর চাকরির শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড গ্র্যাচুইটিও পাবে।

.

পরের তিন বছরের সমাচারে নিরানন্দের ছিটে ফোঁটাও নেই। হাসির বয়েস এখন ছত্তিরিশ, তার মেয়ে সুমিতার আঠারো। মেয়ের চেহারা মোটামুটি। এ-বয়সে তার মা যা ছিল তার ধারে কাছেও নয়। এবারে হায়ার সেকেনডারি দেবে। মেয়ের বিয়ের ভাবনা-টাবনা হাসির মাথায় নেই। অনেক দিনই বলেছে, লেখাপড়ায় ভালোই, যতটা পড়তে চায় পড়ুক, তারপর বিয়ে। আঠারো বছরের মেয়ের মুখের হাসির থেকে এখনো ছত্তিরিশ বছরের মায়ের হাসি আমার চোখে ঢের বেশি সুন্দর।

বছরখানেক হল সুবিনয়কে বাঁকুড়ায় থাকতে হচ্ছে। বাঁকুড়ার অনেকটা ভিতরে মেজিয়া। সেখানে থারমল পাওয়ার স্টেশন হবে। সেইজন্যে আশপাশের বিরাট এলাকা। জুড়ে মাটি কাটা আর জমি ভরাটের কাজ চলছে। এসব জায়গায় নতুন টাউনশিপ গড়ে উঠবে। এই মাটি কাটা আর জমি ভরাটের বিশাল কন্ট্রাক্ট আমার বেয়াই পেয়েছেন। এই তিন বছরের মধ্যেই নিজের যোগ্যতায় সুবিনয় আরো অনেক ওপরে উঠেছে। Tই গত বছর তাকেই ম্যানেজার অর্থাৎ এ-কাজের সর্বেসর্বা করে পাঠিয়েছেন। এখন তার মাইনে বারো শ টাকার ওপরে। দুশর মতো কুলি-মজুর কামিন খাটায়, তার অধীনে দুজন সহকারী ম্যানেজার, জনা দুই সারভেয়ার, জনাকতক সুপারভাইজার আর ট্রাক, ড্রাইভিং ইউনিট কাজ করছে। এরা সকলেই সাইট-এর টেন্ট-এ থাকে। সুবিনয় গ্রামের ধারে ছোট একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। তার এখন আলাদা মর্যাদা। তবে সক্কলেরই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা টেন্ট ক্যানটিনে। আমার বেয়াই ভদ্রলোক নিজে ভোজন-রসিক, কর্মচারীদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও তার ফার্মের উদার নীতি। বেশ বড় আকারের এক ক্যানটিন ইউনিটও সেখানে বহাল।

কলকাতা থেকে মেজিয়া মোটরে বা জীপে সাত ঘণ্টার মতো পথ। বেয়াই তার নিজস্ব জোঙ্গায় (জীপের মতোই, আকারে বড়) মাসে দুই একবার সেখানে ইনসপেকশনে যান। আর ছেলে অর্থাৎ আমার জামাই এখানে ফার্মের অন্য কাজে ব্যস্ত, তাই ফি সপ্তাহে দেখে শুনে আসার জন্য অন্য ইনসপেক্টর আর এঞ্জিনিয়ার পাঠাতে হয়। সুবিনয় দুতিন মাসে দুই একদিনের জন্য কলকাতায় আসে, কাজের চাপে তার বেশি আসা সম্ভবও নয়।

তকতকে নীল আকাশ থেকে বজ্রপাত কি সত্যি কখনো হয়? সেদিন বিকেলে বেয়াইয়ের টেলিফোন পেয়ে অন্তত আমার মনে কোনরকম আশংকার ছায়াও পড়েনি। চিরাচরিত হাসি-ছোঁয়া ভারী গলা। বললেন, অনেক দিন বসা হয়নি, সন্ধ্যার দিকে একবার আসুন না, একটা ভালো জিনিস খুলব…তাছাড়া একটু আলোচনাও আছে।

এ-রকম আমন্ত্রণ নতুন কিছু নয়। ভালো জিনিসের লোভ দেখানোর অর্থ বিলিতি বোতল। আনুষঙ্গিক খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও ভালোই থাকে। ভদ্রলোকের বড় কোনো কাজের ধকল শেষ হলে এই গোছের আমন্ত্রণ আসে। এ-বয়সেও ওই এক জিনিসে আমারও একটু-আধটু লোভ আছেই।

খুশি মনেই গেলাম। তখনও ভদ্রলোকের হাসিমুখে এতটুকু দুর্যোগের আভাস পাইনি। সকলে মিলে খানিক গল্পগুজব চলল। বৈবাহিকা আর মেয়ে খাবার আর অন্যান্য সরঞ্জাম সাজিয়ে দেবার পর ভদ্রলোক বললেন, এখন আমাদের একটু দরকারি আলোচনা, আছে

আমার মেয়েকে নিয়ে ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা দুটো টেনে। দিলেন। আমি উৎসুক একটু, কি ব্যাপার?

–এমন কিছু নয়, ভদ্রলোকের হাসি মুখ, আগে শুরু তো করুন–

প্রথম দফায় ওই ড্রিংক আর ফুড নিয়েই হালকা কথা-বার্তা। দ্বিতীয় দফার শুরুতে হাসিমুখেই ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে সবিনয় দত্তর চাকরিটা যে গেছল সে-কি কোনো মেয়ে-টেয়ের সঙ্গে কিছু অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে?

আমি এত চমকে উঠলাম যে হাতের গেলাস থেকে খানিকটা ড্রিংক চলকে জামায় পড়ল। ভদ্রলোক অপ্রস্তুত একটু, পাশ থেকে ছোট তোয়ালেটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, কি কাণ্ড, এ-রকম ধাক্কা খাবার মতো কিছু ব্যাপার নয়–

ভদ্রলোকের স্নায়ু আমার থেকে দশগুণ শক্ত এ অনেক দিন জানি। তাই আশ্বস্ত হওয়া গেল না। জামাটা মুছে সোজা তাকালাম, বললাম, চাকরি ওই রকম কিছু ব্যাপারেই গেছল শুনেছি…কি হয়েছে আমাকে খোলাখুলি বলুন।

-বলছি। খান…।

খাওয়া মাথায় উঠেছে। কিন্তু ভদ্রলোকের কাছে ব্যস্ততা দেখিয়ে লাভ নেই। এরপর খেতে খেতে ধীরে সুস্থে যে সমাচার শোনালেন, ভিতরে ভিতরে আমি নিস্পন্দ কাঠ।

….মেজিয়ার একটা নিচু শ্রেণীর মেয়েকে নিয়েই ব্যাপার এবারও। বছর উনিশ হবে বয়েস। যারা দেখেছে তারা বলে খুব কালো হলেও ওদের মধ্যে অন্তত চোখে পড়ার মতো মেয়ে। ওদের শ্রেণীর একটা ছেলের সঙ্গে বিয়েও নাকি ঠিক হয়ে আছে, কিন্তু মেয়ের মা মোটা রকম পণ হাঁকতে ছেলেটা দেড় বছর ধরে টাকা জমানোর চেষ্টায় আছে। এর মধ্যে ওই মেয়েটাকে সুবিনয় টাকা গয়নার টোপ ফেলে বশ করেছে। ব্যাপারটা এখন ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে। তিন-চার মাস যাবৎ বেয়াই এ নিয়ে কিছু কানা-ঘুষা শুনছেন। কিন্তু যে লোক অত ভাল কাজ করে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তিনি মাথা ঘামানো দরকার মনে করেন নি। এখন না ঘামিয়ে পারছেন না। ম্যানেজার সুবিনয় দত্তর নামে কয়েকটা বে-নামী চিঠি পেয়েছেন–তার ধারণা, ওর আন্ডারের যে-সব লোক সাহস করে মুখে কিছু বলতে পারছে না, হিংসেয় হোক বা রাগে হোক তাদেরই কেউ কেউ এ-সব চিঠি পাঠাচ্ছে। বেয়াই তাতেও গা করতেন না, কিন্তু এখন লেবারের মধ্যেও এ নিয়ে অশান্তি দেখা দিচ্ছে, যে-ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে হবার কথা সেই এখন লেবারদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টায় আছে। ভালো করে খোঁজ-খবর নেবার জন্য বেয়াই এ-সপ্তাহে একজন বয়স্ক ইনসপেক্টরকে পাঠিয়েছিলেন। সে-ও এসে দুশ্চিন্তার কথাই বলেছে। মেয়েটার নাম দুলালী। সুবিনয় এখন নিজের বাড়িতেই এনে রেখেছে। খাবার সময় সাইটের ক্যানটিনে সে এখন-খেতে পর্যন্ত আসে না। ক্যানটিন থেকে ওদের দুজনের খাবার তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়। এ-সব এখন অনেকেই বরদাস্ত করতে পারছে না। বক্তব্য শেষ করে ঈষৎ আশ্বাসের সুরে বেয়াই বললেন, সামনের শনিবারে কাউকে কিছু না জানিয়ে ওই ইনসপেক্টরকে নিয়ে আমি নিজে যাব, লেবার ক্লাসের মধ্যে গণ্ডগোলের সম্ভাবনা দেখলে আমাকে স্টেপ নিতেই হবে…তা না হলে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই-আমার ইচ্ছে শনিবার আপনিও আমার সঙ্গে চলুন।

মাথায় আগুন জ্বলছে। ব্লাড প্রেসারও চড়ে গেছে বোধহয়। বললাম, আমার যাবার দরকার নেই, আপনি সিভিয়ার স্টেপ নিন।

ওঠার আগে ভদ্রলোক বার বার বললেন, আপনার আজকের আনন্দটাই মাটি করে দিলাম দেখছি।

বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে একটি কথাও বললাম না। ভেতরে অশান্তির ঝড়। আবার মেয়ে আর ছেলে দুটোর শুকনো মুখ চোখে ভাসছে। হাসির কালো মুখ চোখে ভাসছে। এমন অশান্তিতে জীবনে কখনো পড়িনি। রাতে ঘুম হলই না। হাসি আর ওর মেয়ে আর ছেলে দুটোর কথা ভেবে আমার মনের জোর কমে গেছে। সকালে উঠে ফোনে বেয়াইকে জানালাম, শনিবারে আমি তার সঙ্গে মেজিয়ায় যাচ্ছি।

মনের তলায় ক্ষীণ আশা, ওই সুবিনয়কে শায়েস্তা করার জন্য পায়ের থেকে জুতো খুলে মেরেও যদি ওর চাকরিটা বজায় রাখার সুযোগ মেলে তো তাই করব –তবু চাই না এতবড় অশান্তির খবর হাসি বা তার সংসারের কেউ জানুক।

গরম কাল। সকাল ছটায় রওনা হয়ে সাড়ে বারোটায় বেয়াইয়ের সঙ্গে তার জোঙ্গায় চেপে মেজিয়ায় পৌঁছেছি। সঙ্গে সেই বয়স্ক ইনসপেক্টর আর আরো একজন। লোক। খুব সকালে বেরুনোর ফলে এরই মধ্যে দুর্গাপুরে সকলে দুপুরের খাওয়াও সেরে নিতে পেরেছি।

মেজিয়ায় পৌঁছে আর সাইটে এসে বেয়াইকেও হতভম্ব দেখলাম একটু। সেখানে সুবিনয় নেই। ভয়ে ভয়ে একজন কর্মচারী জানালো, সে তার বাড়িতেও নেই, সকাল। থেকেই বাড়ি তালা-বন্ধ। আরো খোঁজ নিতে জানা গেল গত রাতে পর্যন্ত সেই মেয়েটা অর্থাৎ দুলালও তার বাড়িতে ছিল। সকালের মধ্যে দুজনেই কোথায় উধাও হয়ে গেছে।

মেজিয়া থেকে হামেশাই কেউ না কেউ কলকাতার অফিসে যাতায়ত করে। গত কদিনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সাহেব আজ আসছে আর কি জন্যে আসছে সে খবর সুবিনয় কোনোভাবে জেনেছে সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল। তাই মেয়েটাকে সুষ্ঠু নিয়ে কোথাও গা-ঢাকা দিয়েছে।

ঘণ্টা তিনেক থেকেও সেখানকার লেবার ক্লাসকে ম্যানেজারের ওপর ক্ষুব্ধ মনে। হল না আমাদের। যার সঙ্গে দুলালীর বিয়ে হবার কথা সে এখানকার শ্রমিকদের কেউ নয়, কাজেই তার দেখা পাইনি। কিন্তু এখানকার শ্রমিকদের সে ক্ষেপিয়ে তুলছে এমন আভাসও পেলাম না। ম্যানেজারের ওপর ভদ্রলোক কর্মচারীরাই কেবল বিরূপ। ব্যাপারটা সম্ভবত তারাই বরদাস্ত করতে রাজি নয়। সাহস পেয়ে তারা অনেকেই বলেছে ম্যানেজার। সুবিনয় দত্তকে এখান থেকে না সরালে তাদের মান থাকে না।

ফেরার সময় দুটি ছেলে কলকাতায় ফিরবে বলে আমাদের জোঙ্গায় উঠেছে। সামনে ড্রাইভারের পাশে আমি আর বেয়াই। বেয়াইয়ের মুখ এখন থমথমে। চাপা রাগে বললেন, আমি আসছি জেনে এভাবে পালানোর জন্যেই তাকে স্যাক করব।

আমি নির্বাক। সামান্য মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তাই করা উচিত। নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে এই কুৎসিত ব্যাপার সহ্য করব কি করে? ভয়ে পালিয়েছে সে-অপরাধ আমি অত বড় করে দেখছি না।

হঠাৎ সচকিত আমরা। পিছনের ছেলে দুটোর একজন বলে উঠল, ওই দুলালীর মা দাঁড়িয়ে।

মালিকের ইশারায় ড্রাইভার গাড়ির ব্রেক কষল। জংলা রাস্তার ধারে পঁচিশ ত্রিশ গজের মধ্যে বিবর্ণ খাটো শাড়ি-পরা এক রমণী দাঁড়িয়ে। হাড়ের ওপর কালো চামড়া মোড়া। চোখ দুটো গর্তে। চোয়ালের দুদিকের হাড় উঁচিয়ে আছে। রুক্ষ চুলগুলো তেলজলের মুখ দেখে না।

 আমাদের দিকে, না ঠিক আমাদের দিকে নয়, সে মালিক চেনে মনে হল বেয়াইয়ের দিকে এমন চেয়ে আছে যেন চোখের আগুনেই তাকে ভস্ম করে ফেলবে। চোখ দুটো সত্যি জ্বলছে। এমন ক্রুদ্ধ হিংস্র ভয়ংকর মূর্তি জীবনে দেখেছি কিনা জানিনা। পারলে সে গাড়িটার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। …

তবু, যে লোকের জন্য তার মেয়ের এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে, সেই লোকের মনিবের ওপর এই রাগ অস্বাভাবিক মনে হল না।

সামনে এসে বেয়াই নামলেন। ভয়ে ভয়ে পিছনে আমিও। নিকষ কালো এই অগ্নিমূর্তির মেয়েলোকটা দিশেহারা রাগে ভদ্রলোকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

তার সামনে এসে ভারী অথচ সদয় গলায় বেয়াই জিগ্যেস করলেন, তুমি দুলালীর?

তক্ষুণি জবাব না দিয়ে মেয়েলোকটা জ্বলন্ত চোখে আমাদের দুজনকেই তার এক দফা ভস্ম করে নিল। তারপর হিসহিস গলায় তরল আগুনের ঝাঁপটা মাল। –ক্যানে, মোর পরিচয়ে তোমাদের কি দরকার বটটে?

ঠাণ্ডা গলায় বেয়াই বললেন, দরকার কিছু নেই।…আমরাও ওই ম্যানেজারের বির করতেই এসেছিলাম, কিন্তু দেখা পেলাম না, আপাতত পালিয়েছে। সঙ্গে তোমার মেয়েও। …ম্যানেজারের ব্যবস্থা হবে, কিন্তু তোমারও মেয়েকে একটু সামলে রাখা উচিত ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে শুকনো বারুদে আগুন ধরানো সম্পূর্ণ হল। হাত, মুখ নেড়ে চারব না হয়ে ফেটে পড়ল।–তোমরা ওই মানিজারের বিচার করবেক, তাকে শাস্তি দিকে? ক্যানে তোমাদের এত হিংসা বটটে? ক্যানে শিকারীর মতো তোমরা ওই ভালো মানুষ মানিজারকে খুঁজতে লেগেছ? আমার মেয়েটা এট্ট ভালো খেতে পেলেক, পরার ভালো কখানি শাড়ি পেলেক, কানে হাতে পায়ে রূপার গয়না পেলেক-মুইও এটু সুখের মুখ দেখতে পালাম-তোমাদের তা সহ্যি হল না ক্যানে? তোমরা এততো নিষ্ঠুর ক্যানে? ক্যানে ক্যানে ক্যানে?

আমরা দুজনেই স্তব্ধ, নির্বাক, বিমূঢ়!

জোঙ্গা ছুটেছে। আমরা আবার পাশাপাশি বসে। অনেকক্ষণ বাদে বেয়াই খ খুললেন। তার ঠোঁটে হাসির আঁচড়। ভারী গলা যতটা সম্ভব মৃদু করে বললেন, কে কাকে ফাঁদে ফেলেছে মশাই?…এরপর বিচারটা কি-রকম হবে?

বিড়বিড় করে জবাব দিলাম, জানি না।

জোঙ্গা ছুটেছে। আমার চোখের সামনে হাসির মুখ, তার মেয়ে সুমিতার মুখ, তার ভাই দুটোর মুখ ভাসছে। রাস্তার দুদিকে আর কাছে-দূরে শাল পিয়াশাল জিয়াল পলাশ মহুয়া বহেরার গাছ। সামনে তকতকে নীল আকাশ। সব কিছু ছাপিয়ে চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে নিকষ কালো এক রমণীর ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত জ্বলন্ত ক্ষুধার্ত মুখ।