৯. ত্রিলোচনের সঙ্গে মধুর বেশ ভাব

৪৮.

ত্রিলোচনের সঙ্গে মধুর বেশ ভাব জমেছিল। মধু কারখানার কাজকর্ম জানে। জগদ্দলের পাগলা সাহেব নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছে অকে, গারুলিয়ার অলিক তাকে চায়, এ সব শুনে ত্রিলোচন খুব উৎসাহী। ত্রিলোচন তাকে চাপদানিতে যেতে বলেছিল। বলেছিল, বাড়িতে যদি না-ই ফিরবে, আমার সঙ্গে চাপদানিতে চলো, আমার সায়েব তোমাকে লুফে নেবে। মাথা গোঁজবার ভাবনা নেই, আমাদের কাছেই থাকবে।

কাঠুরে বউ খুশি হয়ে বলেছিল, সেই ভাল। তবু গঙ্গার এপারের একটা লোক কাছে থাকবে। আজকাল তো আর এপারের মানুষের মুখ দেখতে পাই না।

ত্রিলোচন ঠাট্টা করে বলেছিল, এপারের ওপর যে এত টান, তা জানতাম না তো। যখন পালিয়েছিলে, তখন তো প্রাণের দায়ে দৌড় দিয়েছিলে।

কাঠুরে বউ আর সে কাঠুরে বউ ছিল না, শ্রীনাথের মার খেয়ে যে সবসময়েই ভয়ে জবুথুবু হয়ে থাকত। বলেছিল, তা যখন পালিয়েছিলাম, তখনকার কথা আলাদা। সেই কোন ছোটটি থাকতে মূলাজোড়ের জঙ্গলপীরের জঙ্গলে গিয়ে উঠেছিলাম। সাত-আটবছর বয়স হবে তখন। সেই থেকে বয়সকালটা তো পেরায় ওখেনেই কেটেছে, শ্যামনগর আতপুর সেনপাড়া, ভোলা কি যায়?

প্রৌঢ় ত্রিলোচন চোখ ঘুরিয়ে বলেছিল, আমাকে যে দয়ে ডোবালে গো। বয়সকাল কি আর তোমার নেই?

সকলের সামনেই কথা হয়েছিল, সবাই হেসেছিল। বয়সকাল বলতে কাঠুরে বউ যৌবনকালের কথাই বলেছিল। মাস চারেক আগে, ঘোষপাড়ার যখন কাঠুরে বউকে দেখেছিল মধু, তখন তার সেই বয়সকাল আর ছিল না সত্যি, তবে চুলে পাক ধরেনি, দাঁত পড়েনি, শরীরটিও মোটামুটি শক্ত ছিল, একেবারে কচি কাঁচা না হলেও, ঢলঢল ভাবটুকু ছিল। সেটা হয়তো ত্রিলোচনের ঘরে, ভাত কাপড় আশ্রয়ের নিশ্চিন্ত জীবনের ছাপ, ত্রিলোচনের সোহাগের দাগও হতে পারে। জঙ্গলপীর থেকে যখন পালিয়েছিল, তখন হয়তো চব্বিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স ছিল। সাত-আট বছর থেকে, চব্বিশ-ছাব্বিশ তাই কি কম? জীবনের বেশির ভাগটা সেখানেই কেটে গিয়েছে। সেখানকার কথা কি সহজে ভোলা যায়, না কি সে কথা মন খুলে না বলাতে কিছু সুখ আছে।

যাই হোক, ত্রিলোচন আর কাঠুরে বউ, মধুকে দুজনেই পীড়াপীড়ি করেছিল। চাপদানির দলের যারা ছিল, তারাও বলেছিল। বিমলা আপত্তি করেছিল, না, ছেলে বউ সে ছাড়তে চায় না, তারা গারুলিয়াতেই খুড়াখুড়ির কাছে থাকবে।

কথা ছিল, ঘোষপাড়া থেকে বুনবুন কাটাগঞ্জ দিয়ে, বাগের খালে পেরিয়ে, হালিশহর গরিফা নৈহাটির উপর দিয়ে হেঁটে ফিরবে সবাই। মধুর মন তাতে নারাজ ছিল। জগদ্দলের উপর দিয়ে, হেঁটে গারুলিয়ায় চলে যাওয়া, তার ইচ্ছে ছিল না। শেষ পর্যন্ত স্থির হয়েছিল, ত্রিলোচনের খুটনি নৌকোয় করে সবাই যাবে। চাপদানির পথে গারুলিয়ার ঘাটে তাদের নামিয়ে দিয়ে যাবে।

ঘোষপাড়া ছেড়ে আসবার আগের দিন, ত্রিলোচনের সঙ্গে মধু সাহেব বাগানে গিয়েছিল। ঘোষপাড়া থেকে আরও উত্তরে, কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির বাগান বাড়ি। ত্রিলোচনের কাছে সে বাগানও প্রায় তীর্থ, ফিরিঙ্গি কবিয়ালের সে ভারী ভক্ত। অনেকবার তার গান শুনেছে, গান তার মুখস্থ ছিল, মধুকে অনেক শুনিয়েছিল। কবিয়াল ছিল না বাগানে, শুধু বাগান দেখেই ফিরতে হয়েছিল। একবারটি কুলিয়া ঘুরে আসবার ইচ্ছে ছিল ত্রিলোচনের, কুলের পাট যাকে বলে, অপরাধ ভঞ্জনের পাট। ত্রিলোচন গল্প শুনিয়েছিল, কাচড়াপাড়ার কাছে থাকত এক ব্রাহ্মণ, নাম দেবানন্দ। তিনি ভক্তিতত্ত্ব মানতেন না। কুলিয়ায় চৈতন্য এসেছেন শুনে, তিনি ঠোঁট উলটে রইলেন। চৈতন্য এসেছেন তো এসেছেন, তাঁর কাছে ভক্তি শিখতে যাব না। যাবেন না তো, যাবেন না…কিন্তু নাম গানের ধ্বনি গিয়ে কানে যখন পৌঁছুল, তখন দেবানন্দর প্রাণ যেন চমকে উঠল। নিজের অচেনা প্রাণের ভিতর থেকে কী এক প্রস্রবণের ধারা যেন বয়ে এল। সে ধারা চোখের কোলে প্লাবিত হল। চোখের সামনে ভেসে উঠল নিমাইয়ের মূর্তি। থাকতে পারলেন না, ছুটলেন, কোথায় নিমাই, চরণ দাও, অপরাধ ক্ষমা কর। তখন দুহঁ দোহা জড়াজড়ি, কোলাকুলি। সেই থেকে কুলিয়ায় হল অপরাধ ভঞ্জনের পাট। শুনে, মধুর প্রাণে যে কোনওরকম ভক্তি এসেছিল, তা নয়। বরং সে অবাক হয়েছিল ত্রিলোচনের ছলছল চোখ দেখে। কী জানি, এদের প্রাণে কী হয় সে জানে না। নাম গান শুনে তার কখনও চোখে জল আসেনি, ও সব ভক্তিতত্ত্ব সে জানে না।

এই উপলক্ষে প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের একাদশী তিথিতে সবাই যায় সেখানে। তীর্থক্ষেত্রের আবার সময় অসময় কী। যখন খুশি গেলেই হল। ফাল্গুন মাস বলে কি যেতে নেই? তবে, মধুর অনিচ্ছা, তাই ত্রিলোচনের আর একলা যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

ঘোষপাড়ার পলিমাটির চড়া পেরিয়ে সবাই নৌকায় উঠেছিল। ভোর রাত্রে ভাটা পড়েছিল, তাই ভোররাত্রেই নৌকা ছাড়তে হয়েছিল, ভাটার টানে টানে যাতে চলে যাওয়া যায়। ভোরের আলো দেখা দিতে না দিতে, নৌকা তরতরিয়ে হুগলিঘাটের রেলপুলের তলায় এসে পড়েছিল। গরিফার চটকল তখন চলতে শুরু করেছিল। তার বয়লারের শব্দ হচ্ছিল ঘস-ঘস। তখন, গোলামের কথা মনে পড়েছিল মধুর। আর সেই মুহূর্তেই, নিতান্ত কাজকর্মহীন ঘুরে বেড়ানো জীবনটাকে বড় নিথর মন্থর মনে হয়েছিল তার। মনটা অস্থির হয়ে উঠেছিল। সহসা, গত কিছুকালের জীবন যেন তার কাছে বড় নিস্তরঙ্গ বিস্বাদ বোধ হয়েছিল, একমাত্র মোহ ছাড়া। মনে মনে বলেছিল, না, এভাবে আর চলে না।

একটু বেলা হতে না হতেই, জার্ডিনদের গলায় দড়ের মিল দেখা গিয়েছিল। তখনও কারখানার চারদিকে বাঁশের ভারা, মই, বাঁশের ডগায় অশুভ দৃষ্টি নিবারক জুতো ঝাঁটা ভাঙা চুপড়ি। নৌকার সবাই বলাবলি করেছিল, বেশ বড় কল তৈরি হচ্ছে।

তারপরেই দেখা গিয়েছিল তেসুতিকলের চিমনি। পাগলা সাহেবের কুঠি। জগদ্দলের ঘাটে অনেকে স্নান করছিল। মধুর মাকে মনে পড়েছিল, ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত মুখ। বাবার ভাবলেশহীন অসুস্থ মুখ। হীরাটা হয়তো এখন তেসুতিকলে ঘুরছে। মনে পড়েছিল, মনের কোথাও টান লাগেনি। স্রোতে ভেসে যাওয়া পানার মতো। যতক্ষণ সে চোখের উপর থাকে, ততক্ষণ মাত্র মনের কোথাও সে প্রবেশ করে না। আবার অন্য চিন্তায় চলে গিয়েছিল।

ওঠার থেকে, নামার টানই বেশি, ভাটার তীব্র টানে, নৌকো দেখতে দেখতে চলে গিয়েছিল আতপুরে। রাজবাড়ি আর শিবমন্দির দেখা গিয়েছিল গাছের ফাঁকে ফাঁকে। চিটেরাও মহাজনি করতে করতে ইতিমধ্যে কাছারিবাড়ি করেছিল গঙ্গার ধার ঘেঁষেই। বহু লোকজন আসে, খাতাপত্র বেড়েছে, হিসাবরক্ষক ও গোমস্তা রাখতে হয়েছে। কারণ, কেবল তো মহাজনি নয়। মহাজনি করতে করতেই, খরিদ করা জমিও বাড়ছিল, অতএব প্রজার সংখ্যা বাড়ছিল। যদিও রাজবাড়ি ও মন্দিরের তুলনায় চিটেদের ঘর কিছুই নয়, তবু পাকা ঘর তো।

আতপুর পেরিয়ে যেতে না যেতেই জঙ্গলপীরের দহ, সংস্কৃত টোল, বাগান, ব্ৰহ্মময়ীর মন্দির, সংলগ্ন শিবমন্দিরের সারি, নাটমন্দির, নহবতখানা, ঠাকুরদের বাড়ি, সব এগিয়ে এসেছিল। তারপরেই গঙ্গা পুব দিকে বাঁক নিয়ে, হঠাৎ যেখানে তটভূমি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, সেই গারুলিয়া দেখা দিয়েছিল।

মধু শুনতে পাচ্ছিল, বিমলা নারাণ খুড়োকে তাড়া দিচ্ছে সব বাঁধা ছাঁদা করবার জন্যে।

 মোহকে তৈরি হতে বলছিল। ত্রিলোচনকে হাঁক দিয়েছিল, গারুলের ঘাটে একবারটি বাঁধতে বলল গো তেলোচন, আমরা নেমে যাই।

তারপরেই ডাক দিয়েছিল, কই গ ভাশুরপো, গা তোলো।

মধু বলে উঠেছিল, থাক খুড়ি, এখেনে আর নামব না।

কথাটা মধু যত সহজে বলেছিল, তত বেশি অবাক হয়েছিল নারাণ, বিমলা, ইস্তক মোহ। মোহ ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল, সন্দেহ ও সংশয়ে। মশকরা নাকি, ভাবছিল সে।

বিমলা বলেছিল, সে কী গ ঘাটে এসে তরী ডোবাচ্চ বাবা।

মধু হেসে বলেছিল, না খুড়ি, তরী ডোবাব না। তবে কিনা, ভাবলুম কী যে, গঙ্গার এপারে থাকব না। তার চেয়ে, তেলোচন খুড়োর সঙ্গে চাপদানিতেই চলে যাই।

বিমলা আর নারাণ, অবাক হয়ে চোখাচোখি করেছিল। মধুর মনোগত উদ্দেশ্যটা বুঝতে চাইছিল তারা। যে কারণে মোহর দিকেও তারা ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করছিল।

ত্রিলোচন হাঁক দিয়ে উঠেছিল, সাধু সাধু, সাধু সাধু!

নারাণ বলেছিল, সত্যি নাকি?

মধু বলেছিল, হ্যাঁ খুড়ো, কাছেপিঠে আর থাকব না, এবার একটু দূরে গিয়ে থাকব। তেলোচন খুড়োকে যখন পাওয়াই গেল, কাঠুরে খুড়িও আছে।

বলে সে মোহর দিকে তাকিয়েছিল। বিমলা বলেছিল, তেলোচন খুড়ো আর কাঠুরে খুড়িকে পেয়ে, এ খুড়ো খুড়িকে ভুলে গেলে বাবা? নয়া বলে?

ব্রিলোচন বলেছিল, তা নয়ার টান তো থাকেই। আমরা পুরনো হয়ে গেলে আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসবে।

মধু বলেছিল, তা নয়, অই যে বললুম, কাছেপিঠে আর থাকব না।

ইতিমধ্যে মাঝি হাঁক দিয়ে উঠেছিল, আর নোঙর করব না গো, নৌকো লগি দিয়ে ঠেলে রেখে দিয়েছি।

নামবার তাড়া দিয়েছিল মাঝি। নারাণ বিমলকে বলে উঠেছিল, ওকে যেতে দাও, মন যখন করছে, কাছেপিঠে থাকবে না, তখন যাক। এসো, তাড়াতাড়ি নামি।

বিমলা মোহর গাল দুটি টিপে দিয়ে বলেছিল, চলি বউ, মন করলে, ভাশুরলোকে নিয়ে খুড়িকে দেখতে এসো।

তারা নেমে গিয়েছিল। নৌকো আবার এগিয়ে চলেছিল। সেই থেকে, মোহকে নিয়ে মধু চাঁপদানিতেই আছে। আজ ফরাসডাঙায় ফ্যাস্তায়, সেখান থেকেই তারা এসেছে।

.

নতুন জায়গায় নতুন মানুষ গেলেই যে তার কদর হয়, তা নয়। বিশেষ কলকারখানার জায়গায় যেখানে মেলাই লোকজন, নিত্য নতুন মানুষের আনাগোনা, সেখানে কেউ কারু দিকে ফিরে তাকাতে চায় না। তবে মধুর সৌভাগ্য, সে ত্রিলোচনের অতিথি হিসেবে গিয়েছিল চাঁপদানি, অনেকেই তাকে ভাই বেরাদারের মতো খাতির করেছিল। শুধু ত্রিলোচনের লোক বলে নয়, তার মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য হল, মধুকে কেউ নেহাত একজন উটকো মানুষ ভাবেনি। সঙ্গে একটি ডাগর বউ ছিল। তুমি ভিন গাঁয়ে একলা মানুষ যাও, তোমাকে কেউ তেমন আমল দিতে চাইবে না। কে না কে এসেছে, চিনি না জানি, সন্দেহের চোখে দেখবে সবাই। সঙ্গে মেয়েমানুষ থাকলে একটু প্রত্যয় হয়। তোমাকে দেখলে যতটা চেনা যায়, তোমার সঙ্গে মেয়েমানুষ থাকলে, তার চালচলন কথাবার্তায়, তোমাকে আরও বেশি করে চেনা যায়। তা সে তোমার ঘরের বউ হোক আর বাইরের বউ হোক। দেবী দেখলে দেব চেনা যায় না? তা ছাড়া মেয়েমানুষ থাকলে, লোকে ভাবে, নেহাত চুরি ডাকাতি করতে আসেনি। হঠাৎ পালিয়ে যাবার মতলব নেই। তার মধ্যে কথা আছে। মেয়েছেলেটি ডাগর হলে মানুষের মন একটু বেশি নরম হয়। উপরি, যদি মোহর মতো একটু চোখ নাক ঘোরানো মেয়ে হয়, অর্থাৎ কেউ একটা কথা বললে, অনেকে যেমন সাত হাত ঘোমটা টেনে জবুথবু হয়ে থাকে, মুখ দেখায় না, রা কাড়ে না, সেরকম যদি না হয়, তা হলে, নিন্দে যত করুক, তার ঘরের পৈঠায় ভিড় বেশি। তা বলে কি আর বেলেল্লা করবে।

তবে সেটা কোনও কথা নয়, মধুর খাতির হয়েছিল ত্রিলোচনের জন্যেই। ত্রিলোচনের বেশ প্রতিপত্তি আছে। সতেরো-আঠারো বছর বয়সের সময়, ত্রিলোচন নাকি খুনে ডাকাত ছিল। লোকের কথা নয়, ত্রিলোচনের নিজের মুখেই শুনেছে মধু। ত্রিলোচন বলেছে, এমনি এমনি কি আর খুনে ডাকাত হয়েছিলুম? খুনে ডাকাতের রক্ত আছে যে আমার শরীরে। বাপ ঠাকুরদা, সবাই খুনে ছিল। জান তো, এককালে চাঁপদানির নামই ছিল ডাকাতদের গাঁ বলে।

কথাটা মিথ্যে বলেনি। এককালে চাঁপদানির খুনে ডাকাতদের কথা, কিংবদন্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কলকাতা হুগলি চব্বিশ পরগনার তাবৎ লোকেরা সে কথা জানে। যদিচ কোম্পানির আমল থেকে, খুনে ডাকাতদের দিনকাল খারাপ হয়ে গিয়েছে, তথাপি এখনও চাঁপদানির খুনেদের কথা শুনলে লোকে কেঁপে ওঠে। এখনও, সন্ধের পর চাঁপদানির জলে ডাঙায় লোকে চলাফেরা করতে ভয় পায়, দ্বিধা করে। কারখানা হওয়ার পরেও, ডাকাতি যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। তবে, তেমন ভয়ংকর কিছু নয়। ছোটখাটো ছিঁচকে ডাকাতি বলে তাকে। একসময়ে যেমন চাঁপদানির ঠ্যাঙাড়েদের কথা মনে হলে হৃৎকম্প উপস্থিত হত, কারখানা হবার পর আর তেমন হয় না। এখন চাঁপদানি ছোটখাটো শহর। বাইরের থেকে মেলাই নোক এসে জড়ো হয়েছে, প্রতি মাসেই আসছে, বিশেষ করে বেহার দেশের লোকেরা। কারখানার সর্দাররা তাদের গ্রাম গ্রামান্তর থেকে ডেকে নিয়ে এসেছে, সর্দারদের যেমন কাজ। গারুলিয়ার যেমন সর্দার আছে, সবথেকে বড় সর্দার, যার কথায় বিদেশি কুলি মজুরেরা ওঠাবসা করে, চাঁপদানিতেও সেইরকম আছে। গারুলিয়ার সর্দার মুসলমান, এখানকার সর্দার হিন্দু। বিদেশি মজুরেরা সাহেব চেনে না, মিস্তিরি চেনে না, বাবু চেনে না, কেবল সর্দার। সর্দার তাদের বেহারের দুর দূরান্তরের জেলা থেকে শুধু নিয়ে আসেনি, সে তাদের বাসস্থান দিয়েছে, যতদিন রুজি-রোজগার শুরু হয়নি, ততদিন খেতে দিয়েছে, তার জন্যে অবিশ্যি টিপছাপ খত দিতে হয়েছে, এবং ঋণ চিরদিনই থেকে যাচ্ছে, যে কারণে সর্দার হপ্তার বেতন নেবার সময়, সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে, আর বেতন হাতে নেওয়া মাত্রই সে তার পাওনা আগেই নিয়ে নেয়। তা তো নেবেই, সে-ই তো এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এদের মা বাপ আশ্রয়দাতা, কর্মদাতা। তা ছাড়া হপ্তার বেতন নেবার সময় সর্দারকে কাছে দাঁড়াতেই হবে। তার লোকজনকে সে-ই চেনে, খাজাঞ্চিবাবু প্রত্যেককে বেতন দেবার সময় একবার সর্দারের দিকে না তাকিয়ে টাকা দেন না। স্বয়ং ম্যানেজার আর ওভারসিয়ার সাহেবও দাঁড়িয়ে থাকে বেতন দেবার সময়ে, এবং তারাও সর্দারের নির্দেশ কখনও অমান্য করে না। এমনকী, মজুরের পাওয়ানা টাকা দিতেও যদি সর্দার বারণ করে তবে টিপ ছাপ নিয়ে সে টাকা হাতে দেয় না। কারণ, হয়তো লোকটা বেয়াদপি করেছে, কিংবা পালাবার মতলব করেছে, নয় তো আর কারুর কাছে ঋণ করেছে, যা সে শোধ দিতে পারে না, অথবা সর্দারের নিজের পাওনা কেটে নেবার দরকারেই হপ্তা বন্ধ করে দিয়েছে। সাহেবরা জানে, সর্দার তার ন্যায্য পাওনা নিয়েছে। তার লোকদের কাকে কী করতে হবে, সেই সব থেকে ভাল জানে। অতএব তারা কখনও সর্দারের সর্দারির উপরে কথা বলে না। সাহেব মানে সর্দারকে, সর্দার মানে সাহেবকে।

মধুর মনে হয়, সর্দার নয়, জমিদার। জমিদারের কাছারি সেরেস্তা দলিল দস্তাবেজ থাকে। কেরানি গোমস্তা থাকে। সর্দারের সব মুখে মুখে। খাতাপত্র দেখতে চাও, দেখিয়ে দেবে, কিন্তু খাতাপত্র দেখতে কেউ জানে না। তা ছাড়া এত বড় বেয়াদপি, খাতাপত্র দেখতে চায়। কার ঘাড়ে কটা মাথা! সর্দার মুখিয়া না? সর্দার সবকিছুর মালিক। তোমার, তোমার বউ সন্তান, সমস্ত কিছুর মালিক সে। সর্দারের মালিক সাহেব। সে শুধু সাহেবকেই সেলাম ঠোকে। আর ঠোকে বাবুদের (কেরানি)। জমিদার যেমন সাহেব মানে আর ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মানে।

তবে হ্যাঁ, মধু গারুলিয়াতেও দেখেছে, চাঁপদানিতেও দেখেছে, বিদেশি মজুরেরা সর্দারকে কখনও অমান্য করে না। অমন বশংবদ সে আর দেখেনি। জমিদারের প্রজারাও জমিদারকে সেরকম মানে না। এত ভয় এবং ভক্তি, মানুষের মধ্যে কখনও চোখে পড়েনি। ভেড়ার পালের মধ্যেও কখনও কখনও অবাধ্যতা চোখে পড়ে, বিদেশি মজুরদের মধ্যে সেটুকুও নেই। সর্দার বলেছে তো, আর কথা নেই। সর্দার যা বলবে, যা চাইবে, যা করবে, সব ঠিক আছে। সর্দার বিচারক, সর্দার শাস্তিদাতা। সর্দার হল ঈশ্বর।

মধু ভাবে বেশ মজা। পরের ধনে পোদ্দারি। কোম্পানি খোলে কারখানা, সেখানে বিদেশ থেকে মজুর এনে কাজ করায় সর্দার, সে তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আগে থেকে সর্দার সাহেবের সঙ্গে কথা বলে। কারখানার কাছেপিঠে পোড়ো বা ধান জমি, যা হোক ঠিকে নেয় জমির মালিকের কাছ থেকে। তারপরে লোক এনে বসায় সেই জমিতে। সর্দার বাঁশ বেড়া দড়ি খোলা কিনে দেয়, মজুরেরা নিজেরাই ঘর তৈরি করে নেয়। ঘরের মালিক সর্দার, ভাড়া দেয় মজুরেরা। তবে বাঁশ বেড়া বাখারির ঘর পশ্চিমা বেহারিরা ভাল করতে পারে না, দেশি ঘরামির দরকার হয় তখন। পশ্চিমারা মাটির দেওয়ালের উপরে খোলা সাজানো ঘর মন্দ করে না। যদিচ, ওরা নিজেরাই বলে, ছাজা বাজা কেশ, তিনো মিলকে বাংলা দেশ। চিনি চুঁচি দহি, বাংলা মে নহি ॥ ঘর ছাওয়া, ঢাকের বাজনা, মেয়েদের চুল বাঁধা, বাংলা দেশের সেরা। কিন্তু চিনি তৈরি হয় না বাংলাদেশে, মেয়েদের স্তনের গঠন শিথিল, বাংলাদেশের মিষ্টি হড়হড়ে দই-এর কোনও কিম্মতই নেই। স্বাদু, কিন্তু উপকার দেয় না। বক্তব্যটা এই রকম। হয়তো কথাগুলি সত্যি, মধু যাচাই করতে পারেনি, পশ্চিমাদের দেশে যায়নি। তবে লোকে বলে, কাশীর চিনি। কাশী তো পশ্চিমেই। পশ্চিমা মেয়ে দেখেছে গারুলিয়ায়। তার স্তনের জ্ঞান, মা, এবং গঙ্গায় স্নানরত প্রতিবেশিনী স্ত্রীলোকদের আর মোহর। মা ও প্রতিবেশিনীদের কথাটা তেমন মনে আসে না। যুবক মধু স্তন বলতে, মোহর বুক বোঝে, এবং তেমন বুক শুধু পশ্চিমে কেন, জগৎ-সংসারে আর কোথাও আছে বলে সে জানে না। কোনও পশ্চিমা মেয়েকে দেখে, একবারও তেমন করে মন মাতাল হয়ে ওঠেনি। অতএব, ওরকম তুলনা সে প্রাণ থেকে মেনে নিতে পারে না। আর দই টক হলে, সবাই ঠাট্টা করে বলে, খোট্টাই দই, অর্থাৎ পশ্চিমা দই। মধু মনে মনে ওটাও নাকচ করে।

যাই হোক, চাঁপদানিতেই এখন, মিলের আশেপাশে, বিদেশি পশ্চিমাদের অনেক ঘর। যাদের ঘর প্রাণ সবকিছুর মালিক সর্দার। এরা আছে বলেই, চাঁপদানি যেন আরও সরগরম, ভিড় ভারাক্রান্ত। অতএব, খুনে ডাকাত ঠ্যাঙাড়েদের চাঁপদানি আর নেই। তবে চাঁপদানির সেই বংশধরেরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। ত্রিলোচন নিজেই বলেছে, যেবারে কারখানা হল চাঁপদানিতে, তা ধরগে পেরায় আট-নবছর হয়ে গেল, সেই যে হে, যে বছরে তোমাদের শ্যামনগরের টমাসড়খের (গারুলিয়ার টমাস ডাফ) কল খুললে, চাঁপদানি আর শ্যামনগরের কল তো একসঙ্গেই খুলেছিল, তা অবিশ্যি, তুমি তখন আরও ছোট, তো জ্ঞানগম্যি নিচ্চয় হয়েছিল?

মধু বলেছে, হ্যাঁ আমরা দল করে সব কারখানা গড়া দেখতে যেতাম।

ত্রিলোচন বলেছে, অ! অই সেই বছরের গোড়াতেই, শেষ ডাকাতি করেছি, আর করিনি। তখন আমার বয়স দুকুড়ি পুরো হতে চলেছে। যেতাম না, আমার নিজের খুড়ো এসে বললে, একটা বড় দাঁও আছে। এক মস্ত বৈষ্ণব মহাজন এসেছিল বদ্যিবাটিতে, অই তোমার গে, নিমাই তীর্থের ঘাটে, যেখানে গৌরাঙ্গ এয়েছিলেন, পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে যাবার পথে, ওই ঘাটে নেমে বিশ্রাম করেছিলেন, আর নিমগাছ পুতিয়েছিলেন, সেই থেকে নিমাই তীর্থের ঘাট, বোষ্টমদের তীর্থক্ষেত্তর, যে-ই হোক, বোষ্টম হলে, ও ঘাটের ধুলো একবারটি মাথায় নেবে। খুড়ো এসে বললে, মহাজন মস্ত বড়লোক, সঙ্গে মেলাই নগদ মোহর টাকা। রাত্রের গোণে লৌকো ভাসাবে, নবদ্বীপ যাবে। ব্যবসা বাণিজ্য করতে বেরোয়নি, লোকজন তেমন সঙ্গে নেই, ঘোট নৌকো, তিনজন মাঝি, একটা চাকরানি আর মহাজনের ডাগর পরিবার। তখন আমার মনে কেমন ভাটা পড়েছিল, ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। লাল মালার নাম শুনেছ কখনও?

ত্রিলোচনের কাহিনী শুরু হতেই, পৌষের সেই কুয়াশাঘন গঙ্গার বুকে, ভয়ংকর রাত্রি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। ক মাস আগের কথা আর সে সব। তার উপরে লাল মালার নাম শুনে, অজস্র কথা তার ঠোঁটের ডগায় এসে থমকে ছিল। মনে করেছিল, ত্রিলোচনকে সব কথা বলবে। কিন্তু সাবধান করার কথা মনে পড়েছিল তার, খবরদার, কাকপক্ষীর কাছেও কোনওদিন এ রাত্রের কথা বোলো না। বলেনি মধু। ত্রিলোচনকে অবিশ্বাসের কিছু ছিল না, তবু সত্যরক্ষা বলে একটা কথা আছে। সে বলেছে, নাম শুনেছি, মস্ত বম্বেটে।

ত্রিলোচন চোখ বড় করে বলেছে, মস্ত বম্বেটে কী হে, জলের কুমির কামটের থেকেও ভয়ংকর। যে বছরে তোমার গে, কলকেতার ইস্টিমার উঠে গেল।

মধু বলে উঠেছিল, কলকেতার ইস্টিমার?

হ্যাঁ, কলকেতার ইস্টিমার ছিল না? চুঁচড়া থেকে, কলকেতা অবধি রোজ ইস্টিমার চলত যে আগে, জান না? তারপরে তো রেলগাড়ি হল, রোজের ইস্টিমার বন্ধ হয়ে গেল। বড়লোকেরা ইস্টিমার করে কলকেতায় যেত, আট টাকা করে ভাড়া ছিল। ছেলেবেলায় রোজ আমরা গঙ্গার ধারে গে দাঁড়াতাম, কখন ইস্টিমার যাবে। আর হাততালি দিয়ে সবাই ছড়া কাটতাম, ফারফেলাই, ফারফেলাই, চোঙায় ছাড়িস ধোঁয়া। কোমেটের তলায় বুড়বুড়ি কাটে, ভোলা আছে পোঙা ॥

তখন ওই দুটো ইস্টিমার চলত, ফারফেলাই আর কোমেট।

ছড়া শুনে মধু হেসে উঠেছিল। উপরে ধোঁয়া, তলায় বুড়বুড়ি, তাইতেই ছড়ার উৎপত্তি হয়েছিল। মধু বলেছিল, বাবার মুখে শুনেছি কি না মনে নেই, চোখে দেখিনি।

আমরা দেখেছি। পেথম পেথম, ইস্টিমার জলে থাকলে, জলে নামতাম না। সবাই বলত, মাঝ গঙ্গা দিয়ে ইস্টিমার চললেও, পাড়ের কাছে জলে নামলে, শোঁ করে টেনে নিয়ে যাবে। তা বললে কী,বরাবর মন মানে? এক পা দু পা করে জলে নেমে দেখতাম, টেনে নিয়ে যায় কিনা। তারপরে আস্তে আস্তে বুক জলে, ডুব জলে, এই করতে করতে সাহস বেড়ে গেছল, তখন সাঁতার কেটে ইস্টিমারের অনেকখানি কাছে চলে যেতাম। ঢেউ খেতে খুব মজা লাগত।…তা সে কথা যাকগে, ইস্টিমার হয়েছিল বলে, গোরাদের পাহারাও বেড়ে গেছল গঙ্গায়। যত বম্বেটে ছিল, সব ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছল। কিন্তু হুগলি চব্বিশ পরগনার আসল বম্বেটে লাল মালাকে কোনওদিন ধরতে পারেনি। যে বছর রোজের ইস্টিমার উঠে গেল, সে বছর থেকে লাল মালার কেরামতি আবার শুরু হল। পল্টনের গোরা যে কত জাল ফেলেছে লাল মালাকে ধরবার জন্যে, কী যেন সেই সায়েটার নাম, চুঁচড়োর বড় সায়েব গ, (ম্যাজিস্ট্রেট) হন্যে হয়ে উঠেছিল তাকে ধরবার জন্যে, কিন্তু পারেনি। এখনও কম চেষ্টা হয় না, কিন্তু লাল মালার টিকিটিও দেখা যায় না।….তো, ওই লাল মালাই আমার জলে ডাকাতির গুরু। এই চাঁপদানিতে, আমাদের বাড়িতে অনেকবার তাকে দেখেছি ছেলেবেলায়, আমার বাপের দোসর ছিল যে! বাপের চেয়ে বয়সে ছোট বটে, কিন্তু মাল তুখোড়।..

শুনতে শুনতে মধুর চোখের সামনে লাল মালার মুখ ভেসে উঠেছিল। কুয়াশাঘন ভূতের রাত্রির জ্যোৎস্নায়, সেই ভয়ংকর নিষ্ঠুর মুখ, অথচ ভালবাসায় যেন একেবারে ভ্যাবানন্দ। ত্রিলোচন বলেই চলেছিল, তা খুড়ো এসে যখন বললে, তখন লাল মালার মুখখানি চোখের সামনে দেখতে পেলাম। রক্তের মধ্যে নেশা তো একটা ছিলই। তবে না, নেশা বলব না, ওটা কেটেই গেছল। আমার মা চাইত না যে ডাকাতি খুনোখুনি করি, তাই চাষ-আবাদ নিয়েই থাকতে চাইতাম। আমার, কী বলে গে, বউ-হ্যাঁ, বেতো কখনও করিনি, তখন একটি চোরাই বউ ছিল, লুটের মাল যাকে বলে, সেও তোমার ওই নিমাই তীখের ঘাটের বরাবর, এক লৌকো লুট করেছিলাম, আজ থেকে পেরায় বারো-তেরো বছর আগের কথা। লৌকো লুট করেই চলে আসতাম, কিন্তু দুটো মাঝি বড় গোলমাল শুরু করলে। সে দুটোকে খুন না করে উপায় ছিল না। আর রক্ত দেখলে, মন বদলে যায়, তখন অন্য ঝোঁক আসে। একটা বউকে ধরে নিয়ে চলে এসেছিলাম। ছেলেমানুষ নয়, ডাগর বউ, অনেক কেঁদেছিল, হাতে পায়ে ধরে কেঁদেছিল, বলেছিল, যাই কর, আমার সাত বছরের মেয়েটা লৌকোয় রয়েছে, ওকে নিয়ে আসতে দাও। ধুত্তোরি তোর মেয়ে, তখন কাঁচা খাবার ক্ষুধা। ওকে বলে ঝোঁক, নেশা করলে যেমন হয়, চোখ পড়েছে তো আর রেহাই নেই। ওই সময়টায় কেউ সামাল দেবার থাকে না, ভগমান এলেও না, খুন চেপে যাওয়া যাকে বলে। গায়ে আগুন, শেতল হবার তখন সেই ডাগর বউ, ছোঁ দিয়ে যখন নিয়েছি, তাকে চাই। কাঁদাকাটির মুখে, কাপড় বেঁধে ডাঙায় নিয়ে চলে এলাম…।

বলতে বলতে ঘেমে গিয়েছিল ত্রিলোচন। যেন কিছু ভাবছিল, জেগে স্বপ্ন দেখছিল। আর মধু দেখছিল, গলায় কষ্ঠি জোড়া জড়ানো ত্রিলোচনকে, চাঁপদানির কারখানার মিস্তিরি, অতি নিরীহ, ভক্তিমান এক পঞ্চাশ বছরের পুরুষকে। যার সঙ্গে চাঁপদানির নাম করা খুনে ডাকাতদের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

ত্রিলোচন একটু থেমে, আচমকা একটা নিশ্বাস ফেলে, শেষ ডাকাতির প্রসঙ্গ তুলতে যাচ্ছিল। মধু বাধা দিয়েছিল, বলেছিল, ও কথা শুনব, তার আগে সেই লুঠ করা বউয়ের কথা বলল। তাকে তো দেখতে পাইনি এখেনে।

ত্রিলোচন বলেছিল, কথার পিঠে কথা আসে, বলতে ইচ্ছে করে না, না বলে পারিনি, মনের এক ধন্দ, বুঝলে মধু, সে বউয়ের কথা বলে কিছু বোঝাতে পারি না। সে কি পাপিষ্টি ছিল কি পুণ্যিমতী ছিল তা ঠাওর করতে পারিনি। অবিশ্যি, আমার ও সব ঠাওর পাবার কোনও জো ছিল না, কারণ আমি পেয়ে বত্তেছিলুম।

মধু বলেছিল, কেন, এ কথা বলছ কেন খুড়ো?

ত্রিলোচনের ভ্রূকুটি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি ছিল দূরে, আসলে আপনার মধ্যে। বলেছিল, কেন, না এই জন্যে বলছি কী যে, সে আমার বড় ন্যাওটা হয়ে পড়েছিল, তাই। একটু থেমে, অনেকটা যেন নিজেকেই যুক্তি তর্ক দিয়ে বোঝাবার মতো করে সে বলেছিল, আহা, কথাটা হচ্ছে, সে তো আমি হাজারবার করে চেয়েছিলুম হে, তুমি ন্যাওটা হবে। আর তুমি যে আমার ন্যাংটা হয়েছিলে, তাতে মনে বড় সুখ পেয়েছিলাম। লুটের বউয়ের মন পাওয়া, সে তো চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু মধু, মন এক বস্তু, লোকে যাই বলুক, তার হদিস পাওয়া জবর শক্ত। সে বউ যখন, উঠোন ঝাঁট দিত, ঘর নিকোত, বেঁধে বেড়ে আমাকে তুষ্টি করে খাওয়াত, আর বুকে পড়ে বক বক করত, তখন আমার মন বলত, কেন? কেন গো, তোমার সেই সাতবছরের মেয়েটার কথা কি মনে নাই? নৌকো ভরতি তোমার যে আপনজনেরা ছিল, তাদের জন্য কি আর প্রাণ পোড়ে না? বউটা সুখে টসটসে হয়েছিল। আমার ডাকাতের মন, ও সব ভাববার কথা নয়, কিন্তু কী করব, আমার মনে হত। কোনওদিন তাকে মনের সে কথা বলিনি।…অবিশ্যি, তবে কি না, তার অনেক বিত্তান্ত ছিল। সে ছিল বামুন কুলীনের বউ। কোনওদিন সোয়ামির মুখ দেখেনি–হ্যাঁ শোনো, সে কথাই বলছি, তবে মেয়ে হল কেমন করে। তা সে তো তোমার তেমন শক্ত কিছু নয়, যেমন করে কুলীনের স্বামীর মুখ না দেখা বউদের ছেলে হয়, তেমনি করেই হয়েছে, আনপুরুষের দ্বারা হয়েছে। সে আনপুরুষ আবার কে, না, নিজের মামা। সে আবার কী বলে তোমার কুলীনদের উলটো–ভঙ্গজ না কী বলে, তাদের আবার বেকরবার মেয়ে জোটে না। এক বামুনদের মধ্যেই কত কীত্তি দেখ, একজন শতাবধি বেকরবে, আর একজনের একটাও, ঝাঁটা মারো শালা নিয়মের মুখে। মেয়ে কিনে তবে তাদের বেকরতে হয়। ভরার মেয়ের কথা শুনেছ তো, গুচ্ছের মেয়ে লৌকোয় করে নিয়ে এসে, তোমাকে দেখিয়ে তোমার পছন্দ করিয়ে, বেচে দিয়ে যাবে। তা সে কোন জাতের মেয়ে, কে জানে, বাপের সাতপুরুষের নাম তোমাকে লিখে দিয়ে যাবে। তারপর একদিন দেখলে, শালা তোব তোবা, বামুনের মেয়ে তো দুরের কথা, হিদুর মেয়েও নয়। বেটি মোচলমানের মেয়ে। তখন ঘর করতে কোন না এক-আধটি বিয়েন হয়ে গেছে। আর কি প্রাচিত্তি চলে? তার চেয়ে, ঢোক গিলে থাক, লোকে তা আর জানছে না।

ত্রিলোচনের কথা শুনে মধু হেসে বাঁচেনি। বলেছিল, কী যন্ত্রণা!

তবে? ত্রিলোচন বলেছিল, ওইরকম সব বামনাই কেতা। তা সে যাক গে। বউয়ের মুখে যা শুনেছিলুম, তাই বলি। বলেছিল, ড্যাকরা জোয়ান মামা, গাঁয়ের টোলো পণ্ডিত ছিল। তা হলে কী হবে, পায়ে কাঁটা বেঁধা বাঘ যে! জঙ্গলে চরে খাবার জো নেই, গেরস্থের ঘর ভাঙে। ক্ষুধা তো আর পণ্ডিতি মানে না। ঘরে ডাগর ভাগ্নি, তারও ওই এক কথা। তা, সে তো হবেই। জীবের একটা ধমমো আছে। ভাগ্নিটিরও চোখে ইতিউতি নজর। জোয়ান দেখলে শরীর যেন কেমন করে উঠত। সম্পর্কের কথা মনে থাকত না। সোয়ামির ঘর করার কোনও আশা নেই, তা ছাড়া, কে জানে সেটা আবার কোন বুড়ো হাবড়া। তা সেই মামা, সমসকেতয় অং বং করে নাকি অনেক রসের কথা বলত। শুনতে নাকি লজ্জা করত, ভালও লাগত। কে জানে, সমসকেতয় আবার কী এমন রসের কথা হতে পারে যে, শুনলে লজ্জা করে। চিরদিন তো জানি, ওতে পুজোপাটের মন্তরতন্তর ছাড়া কিছু হয় না। হবে হয়তো, রসের মন্তরও আছে ওতে। তা সেই মন্তরের গুতোয় ভাগ্নির পেট বেধে গেল। তখন মামা দেখলে বেগতিক, তাড়াতাড়ি ছুটল ভাগ্নিজামাইকে আনতে। একবার তাকে আনতে পারলে, এক রাত্তির বাস করাতে পারলে, আর ভয় নাই। গাঁয়ের লোকে মনে যাই বুঝুক, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না। কুলীনের বউয়েদের অত যে কাটনি কাটা সুতো ব্যাচা পয়সা দিয়ে, সোয়ামিদের পেন্নামি দেবার জন্যে একবারটি ডেকে নিয়ে আসা, তা কি কেবল সোয়ামির পা ধোয়াবার জন্যে? কুলীনের পোয়েরাও তা জানত, সে ব্যাটাও একবার আসার জন্যে ভেঁড়েমুসে আদায় করে নিয়ে যেত। ওটা একটা লড়াই, বুঝলে না? কুলীন মাগ ভাতারের লড়াই। ঘাটের ডাকের মতন, খেয়া ঘাটের ডাক হয় না, নিলেমের ডাক? সেইরকম। একবার তোমার হাতে নিলেমের পরচা তুলে দিলে, তারপরে তুমি যত খুশি খেপ মার, বলবার নাই, তাই চড়া ডাকের তোল তো তুলে নিই!

ত্রিলোচনের বলার ভঙ্গিতে, মধুর হাসি আর থামেনি। বলেছিল, তুমি খুড়ো বেশ বলো। কুলীনদের ওপর তোমার খুব গোঁসা দেখছি।

ত্রিলোচন বলেছিল, হবে না? কাণ্ড দ্যাখ দিকিনি। আবার ইদিকে পটপটানির ঠ্যালায় অস্থির। তবে, আমি তো আর কুলীন বামুন নই, বউয়ের মুখে শুনেছিলুম, তাই। শুনে খুব রাগ হয়েছিল। মামা তো ওদিকে ভাগ্নিজামাইকে আনতে গেছে, গেছে তো গেছে, আর ফেরে না, এদিকে ভয়ে প্রাণ সারা। উঠতে বসতে বমি, চোখের কোলে কালি, কোন দিন কে কী বলে বসে। গলায় দড়ি দেবে, না কলকে ফুলের বীচি থেতলে খাবে, তাই কেবলি ভাবছে। তারপর নিজের মাকে বলতে হল। মামার তো ওদিকে অগোস্ত যাত্রা। তা একদিন রাত পোহরে, বউয়ের মা দিলে শাঁখ বাজিয়ে! বাড়ির ঝিটাকে আগেই টিপে রেখেছিল, তাকে ছুট করালে এ বাড়ি ও বাড়ি। কেন, না, একটু আদা লঙ্কা দাও, একটু গোলমরিচ পাঁচফোড়ন দাও, ঘরে কিছু নাই। রাত পোহরে এখন রান্না বসাতে হবে, জামাই এসেছে। জামাই এসেছে, জামাই এসেছে। বাড়িতে বাতি জ্বলছে, ধোঁয়া উঠছে, রান্না হচ্ছে, ঝি এপাড়া ওপাড়া দৌভুচ্ছে, ময়রার বাড়িতে গিয়ে হানা দিচ্ছে, ওগো যা আছে, তাই দাও, অমুক বাড়িতে জামাই এসেছে। মুদিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলছে, এক কাণ্ড বটে।…তারপর রাত পোয়াল। সবাই জিগ্যেস করে, জামাই কোথায় গো? আর বলল কেন, এল রাত দুকুরে, গেল ভোর রাতে, তার কি সময় আছে? তা বটে, কাকে সাক্ষী মানবে মানো। রাত করে তো আর কেউ দেখতে আসেনি। এখন দিনে দিনে পেট বড় হোক, গা টিসটিস বমি যা খুশি করুক। হিসেবে দু মাস আগে বিয়োবে, তা বিয়োক না, আগে আগে কি আর হয় না? অমন কত হচ্ছে।…।

বলতে বলতে ত্রিলোচনও গলা মিলিয়ে হেসেছিল মধুর সঙ্গে। হাসি থামিয়ে বলেছিল, আর বলল কেন। তা সে কথা যাক, আমার মনের বিত্তান্তটা কী, বুঝি না। এদিকে চাই ন্যাওটা হোক, ওদিকে মন বলে, কেন। বোঝো এবার ঠ্যালাখানি। বললে বিশ্বাস যাবে না, এমন অবধি ভাবতুম, বউটা তো গলায় দড়ি দিয়ে মরল না? অথচ সেই গলায় দড়ি দিয়েই তুমি মরলে, কয়েক বছর ঘর করে, আমাকে জজিয়ে মরলে।

মধু যেন কানে শুনতে ভুল করেছিল। চমকে উঠে বলেছিল, গলায় দড়ি দিয়ে মরল?

 ত্রিলোচনের মুখখানি তখন মাটির চাংড়ার মতো ভাবহীন দেখাচ্ছিল। বলেছিল, হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলছি। তুমি মেয়ে হারিয়ে, জাত হারিয়ে, বাপের ঘর হারিয়ে, ডাকাতের ঘর করলে। তাও কী, যেন তোমার বড় সুখের ঘর করছিলে। যেন জন্মকালের ঘর তোমার। সে জন্যেই বলছিলুম, পাপিষ্টি কি পুণ্যিমতী, বুঝতে পারিনি। তারপরে, শেষবারে যখন ডাকাতি করতে গেলুম, সে বারণ করেছিল। আমার মাও বারণ করেছিল। আমার মা-তে আর তা-তে বড় ভাব ছিল। আমি চাষ-আবাদ নিয়ে ছিলুম, দুজনেই তাতে খুশি ছিল। যখন শুনলে, তখন হাত ধরে বারণ করলে। কিন্তু খুড়ো বারবার বলতে লাগল। রক্তের দোষ, যাবে কোথায়। কথা না শুনে চলে গেলুম। তা দেখে মধু বাবা, আমার হাত দুখানা এমনি দেখলে কি আর রক্ত দেখা যায়? কিন্তু মেলা রক্ত লেগে আছে। আবার দেখ, এই হাতে পেট পুরে খাই, বাঁচবার কী সাধ! একটা মাঝি আমাকে বঁটি তুলে মারতে এসেছিল। সেই বঁটি যেই নিজের হাতে নিলুম, তখন মাথায় খুন। দুজনকে পর পর কুপিয়ে মেরেছিলুম। কিন্তু পরে মালের ভাগ আর নিতে পারিনি, ফিরে এসে দেখেছিলুম, বউ ঘরে নেই। মাকে জিগ্যেস করলুম। মাও জানত না, ভেবেছিল ঘরেই শুয়ে আছে। গোয়ালের গোরুগুলানের ফোঁসফোঁসানি শুনে গিয়ে দেখি, গোরুর দড়ি গলায় দিয়ে, বউ বাতায় ঝুলছে।…অই, অই জন্যেই আরও বলছিলুম, পাপিষ্টি কি পুণ্যিমতী, তা ধরতে পারিনি।…

ত্রিলোচনের চোখ ও মন সম্ভবত তখন তার গোরুর গোয়ালের বাতায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মধু কথা বলতে পারেনি। সে কণ্ঠি গলায় প্রৌঢ় লোকটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। সে চেষ্টা করেও কল্পনা করতে পারেনি, লোকটা কুপিয়ে মানুষ কাটছে, তার সর্বাঙ্গে রক্ত। দেখলে বিশ্বাস হয় না। আর সেই বউ, তারই বা কী মনে হয়েছিল। সে ডাকাতের লুট করা বউ, ডাকাতের সঙ্গে ঘর করেছে। ত্রিলোচন তখন ডাকাতি করত না বটে, কিন্তু সে ডাকাত, খুনি, বউ তা নিজের চোখে দেখেছিল। আবার ডাকাতি করতে গিয়েছিল বলে, বউ গলায় দড়ি দিয়েছিল কেন। বউ জানত, নৌকায় মহাজন আর তার ডাগর বউ আছে। সে কি ভেবেছিল, ত্রিলোচন যেমন তাকে লুট করে এনেছিল, তেমনি মহাজনের ডাগর বউটিকেও লুট করে নিয়ে আসবে, তখন তার কপাল পুড়বে। না কি বউয়ের মনে হয়েছিল, তাকে পেয়ে ডাকাত ডাকাতি ছেড়েছে, এই বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল, দাগা পেয়ে মরেছিল। ত্রিলোচনের প্রতি নিবদ্ধ দৃষ্টির উপর দিয়ে, মধুর চোখের সামনে, ডাকাতি খুন রক্ত চিৎকার বউ গলায় দড়ি, সব একে এসে ভেসে গিয়েছিল।

ত্রিলোচন বলেছিল, এখন তুমি ভাববে, আমি সেইজন্যে বুঝি ধমে কমে মন দিয়েছি। কিন্তু বললে বিশ্বাস যাবে না, ধম্মো কমো বলছি না, একটু খোল কত্তাল বাজিয়ে গান করতে আমার বরাবরই ভাল লাগে, তখনও লাগত। এই যেমন ধর না কেন, নিমাইয়ের সন্ন্যাস নেবার গান শুনলে, বুক টাটিয়ে মরে যাই, লোকজনের সামনে বসে থাকতে পারি না, চোখে জল আসে। বরাবরই এরকম। আবার মানুষ খুনও করি। তা এ তো তোমার বাল্মীকিও হল না। সে তো নামের গুণেই তরে গেছল। আর আমি কী? দুয়ের বার, বোঝ তালে অবস্থা। কে জানে, আবার কোনওদিন কিছু করে বসব কিনা। নিজেকে আর আমার বিশ্বাস নেই। কোনদিন দেখলে হয়তো কারখানার ওই পচ্চিমা সর্দারটাকে গলায় কাটারি দিয়ে বসে আছি।

বলে, ব্রিলোচন তার মাটির চাংড়ার মতো মুখে হেসেছিল। মধু যেন চমকে উঠেছিল। সে ত্রিলোচনের মুখের দিকে তাকিয়ে, মনের কথা বুঝতে চেয়েছিল। কথার ভাবটা তার ভাল লাগেনি।

ত্রিলোচন হাসি মুখেই বলেছিল, লোকটার সর্দারি আমার ভাল লাগে না। তারপরে হাসি থামিয়ে বলেছিল, তা সে থাকগে। সেই থেকে চাষ-আবাদ লাটে উঠে গেল। কারখানা হবার একেবারে গোড়া থেকেই কাজে লেগে গেছলুম। চাঁপদানির এই কলে, রাজমিস্তিরির কাজও করেছি। এখন কলের মিস্তিরি হয়েছি। নিজের বলতে আমার আর কে আছে। যখন যে আসে, থাকে। যেমন পেরেছি, ঘর তুলে দিয়েছি। জমিটা ফাঁকা পড়েছিল, একে একে ছটা ঘর তুলে দিয়েছি। দূর থেকে যারা এসেছে, কলে কাজ করে, তারা সবাই কাছেপিঠে থাকতে চায়। এমনি করে একদিন তোমাদের গঙ্গার ওপারের কাঠুরে বউটা এল। এখন তো আমার সঙ্গেই থাকা খাওয়া শোয়া, যা বলল। আই বউ বলল, আর যাই বলল, আছি একসঙ্গে। তবে কিনা, সেই লুটের বউয়েরও আমার সঙ্গে থেকে ছেলেপিলে হয়নি, কাঠুরে বউয়েরও না। তার মানে হল গিয়ে, আমিই বাঁজা, আঁটকুড়ো। কাঠুরে বউকে বলি, বাপু বিয়েন চাও তো, চরে এসোগে। রাগ করে, বলে কেন বিয়নো ছাড়া কি আমার আর কাজ নেই?

ত্রিলোচনের সঙ্গে মধুও হেসেছিল। ত্রিলোচন বলেছিল, তা কি মিথ্যে বলেছি, বলল। পেটে ধরবে বলে আঁটকুড়ো সোয়ামি ছেড়ে এলে। আবার সেই আঁটকুড়োর ঘরে। আমার মনটা একটু আকুপাকু করে। তা ডাকাতের আর বংশরক্ষা না হওয়াই ভাল।

মধুর মনে হয়েছিল, কথাটা যত আভাঙা গলায় ত্রিলোচন বলেছিল, ততটা আভাঙা নয়। হাসির মধ্যেও দুঃখের খবর মেলে। ত্রিলোচন যে ছেলেপিলে চায়, তবু হয় না, এই দুঃখটা তার হাসির ভাবে টের পাওয়া গিয়েছিল। বংশরক্ষা কেউ ভেবে করে না, ডাকাতেও না। আর ডাকাতের ছেলে ডাকাত হবে, এমন কথায় মধুর বিশ্বাস নেই। তবে, চিরদিন তার ধারণা ছিল, মেয়েলোকেই কেবল বাঁজা হয়, ব্যাটাছেলেদের ওপাট নেই। কিন্তু মূলাজোড়ের জঙ্গলপীরের কাঠুরে শ্রীনাথ আর ত্রিলোচনকে দেখে, বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। তখন মধু না ভেবে পারেনি, আঁটুকুড়ো পুরুষের ব্যাপারটা কেমন। শ্রীনাথ যথেষ্ট শক্ত সমর্থ পুরুষ, যত মোটা শক্ত কাঠ দাও, কুড়ুল দিয়ে ফালা ফালা করে দেবে। কাঠবেড়ালির মতো তরতরিয়ে গাছে উঠতে পারে। ব্রিলোচন তো খুনে। ধ্বজভঙ্গ যাদের বলে, এদের দেখলে সে কথা মনে হয় না। তা অবিশি বাঁজা মেয়েছেলেদের দেখলেও মনে হয় না! ডাকাতে বিমলিকে দেখলে কেউ রুগ্ন বলবে না। যাদের হিজড়ে বলে, এরা তাও নয়। মধুর প্রথম মনে পড়েছিল, তার আর মোহ-র কথা। মোহর সঙ্গে তার যা হয়, মেয়ে পুরুষের যা হয়, এদের কি তা হয় না। তার ধারণা, ও সব যাদের হয়, তাদেরই ছেলেপিলে হয়। তবু কেমন খটকা লেগে যায়, কোথায় একটা গোলমাল আছে।

তবে সে গোলমাল বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সেইদিনই রাত্রে, মোহকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে, সে বলেছিল, তোর ছেলেপিলে হবে তো?

মোহ হেসে উঠেছিল, মরণ! ও কথা কেন?

-অনেকের দেখি তো, বউ নিয়ে ঘর করে, তবু ছেলেপিলে হয় না।

–তোমার তাতে কী?

–আমারও যদি না হয়?

মোহর মনটাও যে একটা অজানা ভয়ে চমকে ওঠেনি, তা নয়। বলেছিল, কেন, আমরা কি কোনও পাপ করেছি যে, ছেলেপিলে হবে না?

মোহ সেটাই জানে, যারা কোনও পাপ করে, তাদের ছেলেপিলে হয় না। মধুর আবার ও সবে বিশ্বাস নেই। বলেছিল, পাপের কথা রাখ। কত নষ্ট পাজি নচ্ছারের কাঁড়ি কাঁড়ি ছেলেপিলে হতে দেখেছি।

মোহ বলেছিল, সে তো তুমি এ জমমে দেখছ, আর জমমের পুণ্যিতে হয়েছে তাদের।

মধুর সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ। তার এ-জন্মে ওজন্মে বিশ্বাস নেই। বলেছিল, তোকে বলেছে।

-না বলেনি। জগতের সবাই এই কথা বলে। তা ছাড়া।

কথাটা শেষ করেনি মোহ। মধুর বুকের তলায় শুয়ে শুয়ে, যেন আনমনে মধুর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। মধু বলেছিল, তা ছাড়া কী, বললি না?

মোহ দু হাত দিয়ে মধুকে জড়িয়ে ধরেছিল, না, সে কথা থাক।

 মধু জেদ করেছিল, না থাকবে কেন, বল।

মোহ বলেছিল, এ জমমের পাপও আছে। মেয়েমানুষে যদি আন চিন্তা করে।

–আন চিন্তা করে?

–হ্যাঁ, এ সময়ে।

মধু বুঝেছিল, অর্থাৎ স্বামী স্ত্রী যখন মেলে, তখন বউ অন্য পুরুষের কথা ভাবলে অন্য কিছু চিন্তা করলে, তাদের ছেলেপিলে হয় না। মোহ একটু থেমে, আবার ব্যাখ্যা করে বলেছিল, মেয়েমানুষে মন প্রাণ সঁপে না দিলে, তাদের পাপ লাগে।

মধু সে কথাও বিশ্বাস করে না। সে ভেংচে বলেছিল, তোকে বলেছে।

মোহ বলেছিল, বলবে আবার কী, এ কথা সবাই জানে।

–তুই রাখ, তা হলে অনেক ঘুসকি মেয়েমানুষের ছেলেপিলে হত না।

-আহা, কথা বোঝ না, খালি প্যাকোড় প্যাকোড় কর। আমি কি খালি সোয়ামির কথা বলেছি। আমি বলেছি, মেয়েমানুষ যাকে দেবে, তাকে সব সঁপে না দিলে ছেলেপিলে হয় না। যে জিনিসের যেমন ধমমো। ফল পেতে হলে, খালি কি গায়ে গতরে হয়, মন প্রাণ লাগে না? মধুর বিশ্বাস হয়নি, তবে মোহকে তার বিশ্বাস থেকে টলানো সম্ভব ছিল না। মধু সে চেষ্টাও করেনি। সুখে তখন তার প্রাণ গলছিল। হেসে বলেছিল, তা, তুই কোনও আন চিন্তা করিস না তো?

মোহর গলা ভারী হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, যদি করে থাকি, তবে হাতেনাতে ফল পাব। তা বলে কি একলা মেয়েমানুষের দায় ভেবেছ? তুমি আন চিন্তা করলে, তোমারও পাপ লাগবে। ছেলেপিলে তো আর একলার নয়।

মধু অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল, এবং আঁটকুড়ো বিষয়ে খটকা গোলমাল, তার মনে, ওই পর্যন্তই ছিল। সে ভেবেছিল, পাপ পুণ্য কিছু নয়, বাঁজা মেয়ে পুরুষদের ভিতরে অন্য কোনও গেরো আছে। মোটের উপর, ত্রিনোচনকে তার বেশ ভাল লেগেছিল। ত্রিলোচনেরও লেগেছিল। তাকে আর মোহকে থাকবার জন্যে একটা ঘর দিয়েছিল। চাঁপদানির কারখানায় নিয়ে গিয়েছিল সাহেবের কাছে। কারখানা ছোট নয়, গারুলিয়ার কলের এক বছর আগে, ফিলমুর কোম্পানি ( ফিনলে মুর অ্যান্ড কোং। দেশীয় লোকেরা ওই নামেই তার উচ্চারণ করে।) চাঁপদানিতে কারখানা করেছিল। ত্রিলোচনদের সাহেবটা বেঁটেখাটো টাটু ঘোড়ার মতো টগবগে। অনেক মিস্তিরি সে নিজের হাতে তৈরি করেছিল। আট-দশ বছর এই মুলুকে আছে, বাংলা কথা বলতে পারে বেশ। মধুর মনে হয়েছিল, কথার চেয়ে, শুয়োরের ঘোঁতঘোঁতানি বলা ভাল। নাকি সুরে হিক্কা মেরে এমনভাবে কথা বলে, কথা বোঝা গেলেও, মনে হয় যেন হাঁকোড় পাড়ছে। আর তাই যদি বলল, তবে কথার চেয়ে মিস্তিরিদের কাছ থেকে খিস্তি শিখেছে অপর্যাপ্ত। ও ব্যাপারে সাহেবের শ্রীমুখ একেবারে পালিশ দেওয়া। বাংলাতে হেন খারাপ কথা নেই, যা সে জানে না। কারখানায় মেয়েরা কানে আঙুল দেয়, পুরুষেরা হাসে। তবে, একটা কথা সবাই জানে, সাহেবদের লজ্জা শরম একটু কম। কিন্তু সাহেবটা ভাল, যদিও একটু রগচটাও আছে। কাজের সময় তার কাছে খাতির নেই।

মধুর প্রথম দিনের কাজ দেখেই সাহেব খুব খুশি হয়েছিল। কোনও জিনিসটা বুঝিয়ে দিতে হয়নি। সাহেব এ যন্ত্রে এক খামচা, ও যন্ত্রে এক খামচা করে কাজ করতে বলেছিল। মধু মনে মনে বলেছিল, পরখ করছ, বুঝেছি। ও সব আমার আগেই জানা।টাটু সাহেব পিঠ চাপড়ে চাপড়ে আর পিঠের কিছু রাখেনি, আর কেবলই চিৎকার করে উঠেছিল, সাঁল্লা থু হোঁস্তাদ মিস্থিরি হাঁছে। থুমাঁর ঘাঁড়ে বঁহুত খিম্মত হাঁছে।থ ঘ খ সবগুলিই ত গ ক। মানুষের নিম্নাঙ্গের ওই প্রত্যঙ্গেও যে কিম্মত থাকতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই টাটু দেশি মিস্তিরিদের কাছ থেকে শিখেছিল। প্রথম দিনেই, হাজিরাবাবুর খাতায়, মধুর নাম লিখিয়ে দিয়েছিল সাহেব, আর একেবারে চার টাকা দু আনা হপ্তা মাইনেও লিখিয়ে দিয়েছিল। প্রথম কাজে লেগেই, এক কথায় চার টাকা দু আনা হপ্তা, চাট্টিখানি কথা নয়। ত্রিলোচন পর্যন্ত বলেছিল, আজ এত বছর ঘষে সাড়ে চার টাকা হপ্তা পাই, মধুর আমার পেখম খেপেই চার টাকা দু আনা। তা টাট্ট আর ছ আনা দিলেই হত।

তবে ত্রিলোচনের কথায় হিংসা ছিল না, কেন না, মধু তার লোক। সে-ই মধুকে এনে সাহেবের হাতে দিয়েছে, মধু তার বাড়িতে থাকে। কিন্তু অন্যান্য অনেক মিস্তিরিরাই রাগ করেছিল। তার মধ্যে ইনুস মিস্তিরির রাগটাই বেশি হয়েছিল। চাঁপদানির ফিলমুরের সে সবথেকে সাবেকি মিস্তিরি। যে সব সাহেব ওভারসিয়াররা প্রথম এ কারখানায় মেশিন বসিয়েছিল, ইনুস তখন থেকে তাদের সঙ্গে আছে। তার হপ্তা সাড়ে পাঁচ টাকা। আর মধুর মতো কালকের যোগী, এক কথায় চার টাকা দু আনা!কেন, ওর ট্যাঁকে কি মামদোর কারসাজি আছে? ইনুস এ কথা বলেছিল। হাতের যন্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিল, দুত্তোরি তোর নিকুচি করেছে ফিলমুর কোম্পানির আর টাটু সায়েবের। কাজ দেখিয়ে পয়সা লোব, কোম্পানি কি আর নেই?

টাট্টু গিয়ে ধরেছিল ইনুসকে। ইনুসকে সে ভালবাসে, বন্ধুর মতো পেয়ার করে। তারা পুরনো দিনের লোক। টাট্ট অনেকবার মানকুণ্ডুতে ইনুসের বাড়ি গিয়েছে, ঘরে বসে খেয়েছে। সে বলেছে, তুমি যদি অন্য কোম্পানিতে চলে যাও, আমার মনে চোট লাগবে। তবে তুমি তো বলছ, কাজ দেখিয়ে পয়সা নেবে। যে ভাল কাজ জানে, সে বেশি পয়সা নেবে। যে ভাল কাজ জানে, সে বেশি পয়সা পাবে। মধু যা কাজ জানে, তাকে আমি কম পয়সা দেব কেমন করে। তুমি নিজে মধুকে বাজিয়ে নাও।

ইনুসের প্রাণে হিংসা ছিল, কিন্তু ন্যায্য কথার জবাব দিতে পারেনি। সে বাজিয়েই নিয়েছিল মধুকে। দুটো যন্ত্রের শাফটু, অর্থাৎ শ্যাফট লেদার এমন ঝুলিয়ে রেখে দিলে, সেগুলো পরিয়েও আর ঘোরানো যাচ্ছিল না। একটা চাকা ঘোরে তো আর একটা চাকা ঘুরছিল না। মাঝখান থেকে চামড়াটা এমন ঝাপটা খেয়ে পড়ছিল যেন উড়ন্ত কুমিরের মতো ল্যাজের বাড়ি মেরে ফেলে দিচ্ছিল। ইস্তক টাটুও ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল। কোথায় গোলমালটা ঘটেছে, তার চোখেও চট করে ধরা পড়েনি।

পড়বে কেমন করে। মধু বলেছিল ত্রিলোচনকে, পড়বে কেমন করে বলো। তোমার ব্যায়ো শ্যামো হয়, কবরেজে নাড়ি টিপলে বুঝতে পারে। বগলে রসুন পুরে গা গরম করলে, কবরেজে কী বলবে বলো। দুদুটো যন্ত্র ইনুস নিজের হাতে গোলমাল পাকিয়ে রেখেছিল। গোটা একটা বেলা মধু পাগল হয়ে গিয়েছিল। কোথায় গোলমাল হয়েছে, কিছুতেই ধরতে পারেনি। যতবারই চাকা থামিয়ে লেদ পরিয়েছে, আর চাকা চালু করেছে, ততবারই এক গোলমাল। ফটাস করে ভারী লেদ ছিটকে ঘাড়ের উপর এসে পড়ছিল। ভয়ে কেউ কাছেই আসতে চাইছিল না। বড় চাকাটা নীচে, ছোট চাকাটা উপরের রেলিঙে। বড় চাকাটায় কোনও গোলমাল ছিল না, অথচ উপরের ছোট চাকাটা এক পাক না ঘুরতেই, শুয়োরের মতো চেঁচিয়ে নেমে যাচ্ছিল। তখন মধু উপরের রেলিঙে উঠেছিল। ইনুস বলেছিল, দ্যাখ সায়েব, বিপদ-আপদ কিছু ঘটলে তখন ইনুসকে দুষো না।

মধু ত্রিলোচনকে মেশিন চালু করতে বলেছিল। চালু করলেই মাঝের ডাণ্ডা (রড) ঘুরতে থাকবে, অথচ তার উপরেই মধু রয়েছে। ত্রিলোচন ভয় পেয়েছিল। কিন্তু মধু এমন ধমক লাগিয়েছিল, চালু না করে উপায় ছিল না। মধু জানত, বগল গলিয়ে কেমন করে ঘোরানো ডাণ্ডায় ঝুলে থাকা যায়। তেসুতিকলের পাগল সায়েব শিখিয়েছিল তাকে। তবে আসল কাজ সেটা নয়। মধু দেখতে চেয়েছিল, ছোট চাকায় কোনও গোলমাল আছে কি না! ছিল, যে সে গোলমাল নয়, প্রায় চার ইঞ্চির এক ইসকুরু বোল (স্কু বোল্ট) চাকার আর রডের সঙ্গে এমনভাবে লাগানো ছিল, মেশিন থেমে থাকলে তা খোলবার উপায় পর্যন্ত ছিল না। অথচ চালু অবস্থায় খুলতে গেলে, চাকার সঙ্গে হাতটি ঘুরে পাকিয়ে মুচড়ে যাবে। তখন মধু চিৎকার করে বলেছিল, কোন শালা মামদোর বাচ্চা এখেনে একটা ইসকুরু বোল খুঁজে রেখেছে।

কে রেখেছে, তা বুঝতে কারুর বাকি ছিল না। ত্রিলোচন বলেছিল, তা গোঁজবার আর জায়গা না পেলে, কলের যন্তরে এসেই গুঁজতে হবে। বড্ড গরম যে।

কথাটার মধ্যে যে ইঙ্গিত ছিল, তা ইনুসকে লক্ষ্য করেই। অনেকে হেসে উঠেছিল। টাট্ট সাহেব কিন্তু হাসেনি। কাউকে বাজিয়ে নেওয়ার অর্থ এই নয় যে, তুমি নিজের হাতে ওরকম একটা বিপজ্জনক গোলমাল পাকিয়ে রাখবে। মধুর কথা সে বুঝতে পেরেছিল। স্কু বোল্ট যেখানে লাগানো ছিল, সেখানে এক পাক খেয়েই রডে লেগে, চাকা শব্দ করে থেমে যাচ্ছিল, আর নীচের চাকা বনবন করে ঘুরছিল। যে কারণে লেদ খুলে যাচ্ছিল। সেটা বিপজ্জনক তো বটেই, তার উপরে দু-দুটো চালু মেশিন বিগড়ে রেখে তুমি মাল পয়দায় হুজ্জোত বাধালে। তাই সে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেছিল, কোন শালা স, গুঞ্জেহেঁ, হাঁমি জানতে ছাঁই, হেঁই হির্নস।

ইনুস হাত উলটে, ঠোঁট উলটে জানিয়েছিল, তোবা তোবা সায়েব, সে কিছুই জানে না। ওদিকে ত্রিলোচন তখন মেশিন থামাতে যাচ্ছিল, আর টাট্ট হুকুম করছিল মই আর হাম্বর নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু তার আগেই মধু হাত চালিয়ে দিয়েছিল। চাকাটা হাতের ধাক্কায় ঘুরিয়ে দিয়েই, মাঝামাঝি অবস্থায় স্কুটা খুলে নিতে গিয়েছিল। সেটা অন্যায় হয়েছিল, গোঁয়ার্তুমি করেছিল মধু। কারণ চাকা ঘুরলেই স্কুটা আলগা হয় ঠিকই। খুলে নিয়ে চোখের পলকে সরিয়ে নিয়ে আসতে না পারলেই, চাকার সঙ্গে হাত ঘুরে যাবার ভয় ছিল, আর তাই গিয়েছিল। তবে পুরো পাকটা খেতে পায়নি। তা হলে ধনুকের মতো হাত বেঁকে যেত। কিন্তু জোর করে মুচড়ে দেবার মতো, একটা মোচড় খেতেই, মধু হাত সরিয়ে আনতে পেরেছিল। চোট লেগেছিল নির্ঘাত, হাতের জোর এত কমে গিয়েছিল, রেলিঙে আর ঝুলে থাকতে পারেনি, নীচে পড়ে গিয়েছিল, পড়ে গিয়ে কোনও চোট লাগেনি, নীচে তেল ছড়ানো মেঝে ছাড়া কিছু ছিল না। উঁচুও তেমন নয়। তবে টাট্ট থেকে সবাই যে ভাবে ছুটে এসেছিল, সে একটা দেখবার মতো কাণ্ড। যেন মধু মরে পড়ে গিয়েছিল। মধু জানিয়েছিল, তার কিছুই হয়নি, হাতটা সে ঠিক সামলে নেবে। ফলে হপ্তায় আরও দু আনা ইনাম মিলেছিল, চার টাকা চার আনা। টাট্ট ইনুসের উপর খুব চটেছিল। ত্রিলোচনের তো কথাই নেই। কিন্তু বিবাদ বজায় রাখা যায়নি। কারণ ইনুস নিজে মধুর হাত ডলে টিপে টিপে আরাম করে দিয়েছিল।

চাঁপদানিতে গিয়ে মধু সংসারী হয়েছে। মাস গেলে সতেরো টাকা হাতে। ত্রিলোচন খুড়ো হাত পেতে নিতে না চাইলেও, মধু জোর করেই মাসিক পাঁচসিকে ঘর ভাড়া দিয়েছে। আর ধর গিয়ে মন খানেক চাল, কিছু ডাল, তেল, মশলা, রোজকার কিছু কাঁচা, বাজারে মাসে দশ টাকা অপর্যাপ্ত। দুটো মানুষের তার বেশি লাগে না। রবিবারে রবিবারে পাঁটা কাটা হয়, সের হিসাবে চার আনার বেশি পড়ে না। রোজ কেউ মাছ খুঁজতে যায় না, পেঁয়াজ পোস্তবাটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে, মোহর হাতে খোলে ভাল। চৈত বোশেখ, জ্যৈষ্ঠে, মোহর জন্যে চারখানা শাড়ি কিনে দিতে পেরেছিল।

মোহর তখন অন্য রূপ। সে এরকমটিই চেয়েছিল। বেদের টোল নিয়ে ঘোরাঘুরি করে হাঁপিয়ে উঠেছিল। পাখি বাসা চেয়েছিল, বাসা পেয়েছে, আর বৈশাখ মাসেই পেটে ডিম। যেন এতকাল ঘরে এসে বসতে পায়নি বলেই, পেটে ডিম ধরতে পারছিল না। যেমনি ঘর পেয়েছে অমনি একদিন দেখা গিয়েছিল, মোহর মাথা ঘুরছে, খেতে সাধ নেই, বমি উঠে আসে। মধু বেশি আদর করতে গেলে, বুকে হাত দিয়ে বলে উঠত, উঃ লাগে। হ্যাঁ, রং বদলেছিল, ভারী হয়েছিল বুক জোড়া। কী অসুখ বলে একে। কাঠুরে বউ প্রথম হেসে হাততালি দিয়ে বলেছিল, ছুঁড়ির পেট বেধেছে।

একবার জানাজানির অপেক্ষামাত্র। তারপরে, বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা মোহকে নিয়ে কী নেত্যকেতই না শুরু করেছিল। পুরুষেরা সকলেই কারখানায় চলে গেলে, তাদের শুরু হত। মধু দু-একদিন সে সব নিজের চোখেও দেখেছে, কানে শুনেছে। লোকে বলে, খারাপ কথা ব্যাটাছেলেরাই বলে, খারাপ অঙ্গভঙ্গি তারাই করে। মেয়েমানুষেরা যে কী বলতে পারে, আর কী করতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ব্যাটাছেলেকেও কানে আঙুল দিতে হয়। চোখ বুজতে হয়। মোহ তো এক-একদিন কেঁদেই ফেলত। মধুর রাগ হত। কিন্তু রেগে সে কিছু বলতে চাইলে, মোহ তাকে ধমকে দিত, পাগল নাকি। মেয়েমানুষের ব্যাপারে, তুমি কথা বলতে যাবে কেন?

আসলে মোহ সকলের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারত না। তার প্রতি অন্যান্য মেয়েদের অত্যাচারের মাত্রা এক-এক দিন বেড়ে উঠত, তখন সে মধুকে বলে ফেলত। মেয়েরা কেউ তার বুক খামচে দিত, ঠোঁট কামড়ে দিত, এমনকী কাপড় খুলে নিয়ে ব্যাটাছেলের মতো কীর্তি করত, আর বলত, এমনি করে বউয়ের ছেলে করেছি। বাকিরা সবাই হাততালি দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ত।

সব মিলিয়ে আর দশটা সংসারের মতোই, মধুরও সংসার গড়ে উঠেছিল। কিন্তু মধুর নিজের একটা প্রকৃতি আছে, সে বেশিদিন স্থির থাকতে পারে না। এ কথা তার নিজের জানা ছিল না। মোহ যতই কুলুঙ্গি সাজাচ্ছিল, থালাবাটি বাড়াবার দিকে ঝোঁক করছিল, বাইরে মধুর ততই বন্ধু বাড়ছিল। মানকুণ্ডুর ইনুসের সঙ্গে আগেই দোস্তি হয়েছিল। ফরাসডাঙার টান বাড়ছিল। ফরাসডাঙার ওপারে থেকে যে জিনিসে টান ছিল না, চাঁপদানিতে এসে সেই টান ধরেছিল, মদ খেতে শিখেছিল। বাজি রেখে মদ খাওয়া আর হুল্লোড় করা! মাতলামি করে দুই রাত্রি হাজতবাস করতে হয়েছিল। মোহ রাগ করেছে, কেঁদেছে, ঝগড়া বাধিয়েছে। তখন মধু সামলে নিয়েছে। কিন্তু সামলে রাখবার উপায় কী। কানের কাছে ফিসফিস, দূর থেকে হাতছানি, রাতবিরেতে ডাকাডাকি। মধুকে ঘিরে, চাঁপদানিতে ছোকরা মিস্তিরিদের একটা দল তৈরি হয়েছে। ত্রিলোচনও মদ খায়, ঘরে বসে খায়। সে বলে, বাইরে যাবার কী দরকার, খেতে হয়, ঘরে বসে খাও।

মধু ভাবে, তবে আর মজা কী হল। হই-হুঁল্লোড় হল না, ছুটোছুটি হল না, দু-একটা মাতালের দলের সঙ্গে মারামারি হল না, ঘাটে বাঁধা নৌকা জলে ডোবানো হল না, কারুর পিছনে লাগা হল না। মাঝরাত্রেই নিজেদের মধ্যে চু কি কি শুরু হল না, তবে আর মদ খেয়ে লাভটা কী হল। ত্রিলোচন খুডোর মতো, ঘরে বসে মদ খেয়ে, এড়িয়ে গড়িয়ে হরে কেষ্ট হরে রাম করা আর কাঠুরে বউয়ের গায়ে হাত বোলানো, রক্ষা কর বাবা। লোকে নাকি আফিম খেলে ওরকম করে। ওতে অভক্তি। ফরাসডাঙায় চণ্ড চরস গুলিরও অভাব নেই, আড্ডা মেলাই। মধু যায়নি। মদটাই তার ভাল লাগে। তবে মোহ-র হাত ছাড়িয়ে আসা দুষ্কর। রীতিমতো পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সে যাওয়াও যে একটা ঘোরের মধ্যে ঘটত, তা নয়। ভিতরটা যেন কোথায় হাঁপিয়ে উঠত তার। সেই হাঁপিয়ে ওঠার কারণটা মধু জানত না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হত, যেন দুষ্টু ছেলেটার খেলা শেষ হয় না। বাইরে যে রাত ঘনিয়ে আসে, পাখিপাখালিরা বাসায় ফিরে যায়, ঝিঁঝিদের ডাক বাড়ে, শেয়ালেরা ডাক ছাড়ে, ডাকা ছেলেটার যেমন সে কথা মনে থাকে না, সেইরকম। ছেলেবেলায় মা রাগ করত, এখন মোহ করে। কেন, আর দশজনের মতো কি মধু থাকতে পারে না। সে এমন অস্থির কেন। একবার যে নিবিষ্ট হয়ে ভাববে, সে কী চায়, তাও তো ভাবে না।

ভাববার তার সময় কোথায়। যেন এক বস্তা টানে চলেছে, তো চলেছে। মোহ রাগ করে, কাঁদে, ঝগড়া করে, আবার মধুর বুকের কাছটিতে শুয়ে অঘোরে ঘুমোয়। মধু একটা নোঙর ছেঁড়া নৌকা, মোহ সেই নৌকার যাত্রী। হাতের চুড়ি ভাঙে মধুকে মারতে গিয়ে, নিজের হাত কাটে, মধুর গা কাটে। তবু রেশমি চুড়িতে সেই রক্ত মাখামাখি করে মধুর কালো বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। মধু কেবল তার জীবন নয়, মরণ তো বটে। মোহ তো মিথ্যা বলবে না, যখন মধু অতি সুখ দেয়, তখন তবে মনে হয় কেন, মরি, আমি মরি, বড় মরতে ইচ্ছা করে। সে তেসুতিকলে কাজ করেছে, চাঁপদানির কলেও কাজ করতে পারত। মায়ের ঘর তার ফরাসডাঙায়, সেখান গিয়ে রঙিণী হয়ে থাকতে পারত। কিন্তু সব কিছু যে মধুই ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। এখন যদি তাকে মাঝ দরিয়ায় ফেলে যায়, তবে মোহ ডুববে।

কিন্তু ঘরের জন্যই কি ঘর ছেড়েছে না মোহ। মনের মতো পুরুষের সঙ্গে আপন কুলায় উঠবে পক্ষিণী। সোহাগ কাড়বে, ডিম পাড়বে, বাচ্চা নিয়ে পক্ষিণী মা কিচিরমিচির করে বেড়াবে। তারপর একদিন সবাইকে কাঁদিয়ে সে মরবে। এই সম্পূর্ণ জীবনেরই জপতপ মোহর।

তবু ভয়ে তার কাঁপুনি লাগে। মধুর সঙ্গে ছুটতে পারছে না যেন। তার হাতের শক্তি ফুরায়। রক্তে শোনে মরণের ডাক। মধুর কাছে থাকতে, মধুর মতো দুর্জয় হওয়ার সাধ্যের সাধনা করে সে। মধুকে নিষ্ঠুর মনে হয়। মধুর চোখ কান সবই আছে। তবু সে যেন কেমন একরকমের নির্বিকার। এই জগৎসংসার যেমন চলছে, তেমনি অন্ধশক্তির মতো।

এমনি করে দিন চলছিল। আজ চাঁপদানি থেকে ফরাসডাঙায় এসেছে। শত হলেও ফ্যাস্তা বলে কথা। জন্ম থেকে দেখে এসেছে, না এসে থাকতে পারেনি। মোহও এসেছে সঙ্গে। পেটে চার মাসের ভার। তা হোক, সেও জন্ম থেকে দেখে এসেছে। খাস ফরাসডাঙার মেয়ে সে। তা ছাড়া, তাকে একলা ফেলে মধুই কি ফ্যাস্তায় আসতে পারে।

ত্রিলোচন কাঠুরে বউরা এসেছে। মধুর অন্যান্য সাঙ্গোপাঙ্গরাও সবাই এসেছে দল বেঁধে। তবে কিনা, পালের গোদা ইনুস।

এখানেই দেখা হয়ে গেল গারুলিয়ার দলের সঙ্গে। বিমলা, নিমি সবাই এসেছে। বিমলা মোহকে দেখে বলল, এই যে, সঙ্গেই আছে দেখছি। একে নিয়ে বাড়িতেই আছ তালে এখন? কালীদিদি আপত্য করে না?

মধু বলল, বাড়ি কোথা দেখলে? আমি তো এখন চাঁপদানি থেকে আসছি। সেই যে তোমাদের কাছ থেকে গেলুম, আর ঘরে যাইনি।

এবার সকলের নজর পড়ে ত্রিলোচনদের উপর। ত্রিলোচন বলল, তোমার ভাশুরপোকে গুণ করেছি গো বিমলাদিদি।

বিমলা বোধহয় তেমন খুশি হল না, বলল, ওমা, তাই তো দেখছি।

নিমি এতক্ষণ বারে বারে মধুকে দেখছিল। মাঝে মাঝে মোহকে। সে বলল, ও মা, তাই নিকি গো? সেই পৌষমাস থেকে এতদিন?

গায়ের সঙ্গে লেপটে না হলেও, প্রায় মধুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল মোহ।

মধু বলল, হ্যাঁ।

 বিমলি চিবুক ধরে আদর করল মোহকে। বলল, মনে আছে তো খুড়িকে?

মোহ বলল, সে কী গো খুড়ি, তোমাকে ভুললে আমার পাপ না?

–বটে বুঝি! আহা আমার নককি বউ গো।

বিমলা বুকের কাছে নিয়ে আদর করল মোহকে, তারপরে হঠাৎ যেন চমকে উঠে, ভুরু কুঁচকে তুলল। বলল, ওলো বউ, তোর পেটে কি?

বিমলার কথা শেষ হবার আগেই মোহ যেন কিছুটা লজ্জায় আর আবেশেই, বিমলাকেই জড়িয়ে ধরে। নিমি হেসে উঠে বলল, ওমা, ছুকরি বউয়ের এর মধ্যেই পেটে পেটে এত?

নিমি মধুর গা ঘেঁষে, নিচু গলায় বলল, তা সেই পোষ থেকে আষাঢ়ের শেষ অবধি লুটের মাল নিয়ে ঘুরছ।

মধু বলল, ঘুরছি কোথায়, চাঁপদানিতে ঘর বেঁধেছি।

 নিমি চোখ ঘুরিয়ে বলল, আহা, এমন মিস্তিরি টমাসডখ ছেড়ে ফিলমুরে গেল?

যেন টমাস ডাফ কোম্পানির ভাবনাতেই, মিস্তিরির জন্যে নিমির বড় দুঃখ। নিমি হেসে, কাছে গিয়ে মোহ-র কাঁধে হাত দিল। মোহ হাসল, কিন্তু নিমির চোরা পেখম খোলা তার চোখে পড়েছে। বুঝেছে, গারুলিয়ায় মধুর সঙ্গে আলাপ আগেরই। একটু আশনাইও হয়েছিল বোধহয়।

মধু জিজ্ঞেস করল নারাণের কথা, খুড়ো কোথায়? আসেনিকো?

বিমলি চমকে উঠে বলল, উ মা! তাও তো কথা। সেনপাড়ায় গেছে, বাড়িতে। তোমার বাবার শরীলটা নিকি ভাল নয়, এখন ত্যাখন অবস্থা।

একবার বুঝি মধুর মুখে ছায়া পড়ল। বলল, তাই নিকি? তা হলে কাল একবার গারুলিয়া গিয়ে খুড়োর কাছে খবরটা নিতে হবে তো।

মধু যেন অন্যমনস্কের মতো মেলার ভিড়ের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারে, মোহ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তবু কী আশ্চর্য, মধু বাবার মুখটা কিছুতেই মনে করতে পারছে না। কেবল মায়ের মুখটাই দেখতে পাচ্ছে, কালী বাগদিনির মুখ।

মধুকে চুপ করে থাকতে দেখে, সকলেই অন্যদিকে মন দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু মোহ তাকে ছাড়ল না। সে তার হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে গেল। বলল, তুমি ঘরে যাও বাপু একবারটি।

মধু গম্ভীর মুখে বলল, না।

–না কেন? বাপের শরীল খারাপ, বুড়ো হয়েছে। কখন কী হয়, বলা যায়? এক ছেলে তুমি, একবারটি যাও, নইলে বাপু আমাকে শাঁপ লাগবে।

মধু বলল, তোর যত বাজে কথা। শাঁপ লাগবে কেন শুধু শুধু?

বলে একটু চুপ করে থেকে বলল, আর বাড়ি যেতে আমার সাহসে কুলোয় না বউ। সোমসারে আমি একজনকে বড় ডরাই, জানিস। সে আমার মা। অ্যাদ্দিন বাদে আমি আর মার সামনে যেতে পারব না।

মোহর দু চোখে আলো ফুটে উঠল। অনেকদিন বাদে যেন মধুর নির্বিকার নিষ্ঠুরতার মধ্যে, তার সঙ্গে প্রেম করা ছাড়াও অন্য একটি মূর্তিকে দেখতে পাওয়া গেল। দেখতে পেল, মধু এক দুর্জয় মায়ের দুর্জয় ছেলে। যে মাকে মধু মনে মনে স্মরণ করে। সেই মায়ের বারণ না শুনে মধু মোহকে নিয়ে পালিয়েছে। সেই মায়ের কাছে মধুকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া মোহ রই কর্তব্য। শর্ত শুধু একটিই। মধুকে সে ছাড়বে না। তা হলে প্রাণ রাখা যায় কেমন করে?

মোহ বলল, তা হোক। মা-তো! মায়ের কাছে ব্যাটা যাবে, তার আবার ভয় কীসের? তুমি একবারটি চলো।

-তোকে নেবে না মা।

–না নেয়, তখন দেখা যাবে।

–মাকে তুই চিনিস না বউ।

—কেন?

–আমাকে মা কাটারি দিয়ে কেটে ফেলতেও পারে।

মোহ শিউরে উঠে বলল, ও মা! ছি! মায়ের নামে ওকী কথা।

মধু শুকনো হেসে বলল, আমার মা এমনি।

 মোহর যেন আর কথা বলবার সাহস হল না। তার মনে হল, এ মা আর ছেলে সমান।

ইতিমধ্যে ইনুস আর বন্ধুর দল অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তারা দৌড়ের বাজির জন্যে মধুকে ওসকাচ্ছে। বিমলা বাধা দিয়ে বলল, না বাবা, দৌড়-টৌড় দিতে যেয়ো নাকো, খ্যামতা থাকে, খুঁটিতে ওঠ, জিতলে লাভ আছে।

মধু জবাব না দিয়ে এসে দাঁড়াল তেল মাখানো খুঁটির সামনে। তখন ফরাসডাঙার নাম করা দাগি ডাকাত হরলাল চেষ্টা করছে। বোধহয় কয়েকদিন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু পারছে না। সবাই হাসাহাসি করছে, হাততালি দিচ্ছে। স্বয়ং বড় কোতোয়ালি সাহেব পাইপ টানতে টানতে দাঁড়িয়ে দেখছেন। হরলালের উপর সকলের ভরসা। সে কত উঁচুতে উঠতে পারে গাছ বেয়ে বেয়ে। দৌডুতে পারে রণপায় করে।

মধুর বন্ধুরা তাকে ঠেলতে লাগল, যা না মোথো, যা?

মধু হেসে বলল, উরে বাপরে, ও শালার খুঁটিতে আমি উঠতে পারব না। হরে ডোম উঠতে পারছে না, আমি পারব?

পারবি পারবি।

 সবাই ঠেলতে লাগল তাকে। বিরক্ত হয়ে মধু একজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। ধূর শালা মামদো কমনেকার। বলছি পারব না।

বিমলি বলল পাশ থেকে, থাক বাপু, যাসনে। লোক হাসাবার কী দরকার। আমাদের গায়ে লাগবে।

 নিমি বলল, হ্যাঁ, তার চে চলো পীরের ওখানে মুরগির নডুয়ে বাজি রাখি গে।

কথাটা মধুর উদ্দেশেই। ঠাট্টা করছে, চিপটেন কাটছে। কিন্তু মধুর দৃষ্টি খুঁটির দিকেই। সাপের মতো অপলক চোখে সে খুঁটি দেখছে, আর শরীরে পেশিতে পেশিতে যেন একটা লড়াই চলছে তার। মনে মনে ভাবছে, পারব? হরে ডোম যে ভাবে তোক হাসাচ্ছে, তাতেই যেন ভয় লাগছে বেশি। তবে গতবছর খুঁটির বাজি জিতেছিল। এবার একেবারে খালি হাতে ফিরবে? সে মোহর দিকে তাকাল। দ্যাখ, মোহর চোখ দুটোতেও কেমন উৎসাহ আর ইচ্ছা। যেন মধুর জন্যে ওরই হার হচ্ছে।

মধু এগিয়ে গেল। সবাই অমনি হেসে পথ ছেড়ে দিল। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলল, ওরে সর সর, নয়া খেলোয়াড় এয়েছেন।

কত হাতি গেল তল মশা বলে কত জল।

 –তাই না বটে। কত সখ যায় রে চিতে, মলের আগে চুটকি দিতে। খুঁটিতে উঠবেন।

এমন সময়ে গোলাম ছুটে এল মধুকে দেখতে পেয়ে। এসে একেবারে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।

 চারিদিকে বাজনা বাজছে। নানান গলার নানান চিৎকার। গঙ্গায় বুঝি আবার হাঁস ছাড়া হয়েছে। চিৎকার করে অনেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গোলামের চোখ একেবারে ছলছলিয়ে উঠল। প্রায় ভাঙা স্বরে বলল, আরে শালা মধু, তুই শালা আদমি না জিন রে?

মধুরও দুই চোখে হাসি ধরে না। গোলাম বলল, কোথায় ছিলি অ্যাদ্দিন?

 মধু বলল, সে সব পরে হবে। খুঁটিতে উঠব গোলাম?

গোলাম বলল, জরুর। আমি তো মনে মনে গাইছিলুম, থাকত এখন মোধধা, দেখিয়ে দিত সবাইকে।

মধুর সারা শরীরের পেশি যেন কেউটের মতো পাক দিয়ে উঠল। মোহ-র মনে মনে ইচ্ছা, গোলামও বলছে। শক্তি পাওয়ার আর বাকি কী? সে এগিয়ে গেল খুঁটির কাছে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রূপ ও শ্লেষ হাসির ঢেউ খেলে গেল।

কোতোয়ালির লোক এসে মধুর হাত মুছিয়ে দিল ন্যাকড়া দিয়ে। মধু বুঝল শরীরকে একেবারে হালকা করে, সোজাসুজি না উঠে, কয়েকটা পাক দিয়ে কাঠবেড়ালির মতো উঠতে হবে।

প্রথমবার উঠে, মাঝখান বরাবর গিয়ে হড়কে এল সে মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ও হাততালিতে কানে তালা লেগে গেল তার। লজ্জায় মুখ ভোলা দায়। কোনওরকমে মোহর দিকে তাকাল সে।

মোহও হাসছে, নির্ভয়ের হাসি। ঘোমটা খুলে গেছে খেয়াল নেই। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে আবার উৎসাহ দিচ্ছে।

মধু আবার দেখল খুঁটিটাকে। বারকয়েক পাক দিল খুঁটিটার চারপাশে। যেন বাঘটা ঝাঁপ দেবার আগে পাক দিয়ে নিচ্ছে। তারপরে আবার খুঁটিতে হাত দিল। সর্বাঙ্গে পেশি উঠল কিলবিলিয়ে। পরমুহূর্তেই ঘুরনচাকির মতো খুঁটিটার গায়ে পাক খেতে খেতে, প্রায় ডগার কাছে গিয়ে উঠল মধু।

এবারেও অনেকে হাততালি দিয়ে উঠল। গোলাম আর তার বন্ধুর দল চিৎকার করে উঠল, আর এটটু, মোধধা, আর এটটু।

মধুর চোয়াল শক্ত। সে থাকতে পারছেনা, আবার একটু একটু করে প্রায় এক ইঞ্চি করে যেন হড়কে আসছে নীচে। চেষ্টা করছে আঁকড়ে থাকবার। কিন্তু তেলের স্রোত বইছে যেন হাতের চেটোয়।

মোহ বোবা পাথর। গোলাম নিজের দুই হাতে পাঞ্জা লাগিয়ে দিয়েছে। নিমির গায়ে যে আনকা পুরুষ হাত দিয়েছে, সে খেয়ালও তার নেই। বিমলির মতো বাঘা মেয়েমানুষও উত্তেজনায় বিড়বিড় করছে, না বাপু, এ কী খেলা।

মধু আর একবার মরিয়া হয়ে পাক দিল, ঠেলা দিল উঁচু দিকে। পরমুহূর্তেই একেবারে পুরস্কারের ডালিসুদ্ধ ধপাস করে নীচে পড়ল।

মোহ ছুটে এল। গায়ে হাত দিয়ে বলল, লাগেনি তো?

 মধু বলল, কী হল, পারলুম না?

গোলাম ডালিটা তুলে দেখিয়ে চিৎকার করে উঠল, এই দ্যাখ, এই দ্যাখ শালা।

মধু দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আর একটা দেখতে হবে। যা গোলাম, মাল কিনে নিয়ে আয়। কী বলল ইনুস দাদা?

ইনুস চিৎকার করে বলল, হারগিজ।

অন্যান্য সাঙ্গোপাঙ্গরা নাচন-কোঁদন লাগিয়ে দিয়েছে। ভিড়ের মধ্য থেকে একজন একটা চাঁপা মদের বোতল বাড়িয়ে দিল, লাও হে বীরপুরুষ।

মধু গলায় মদ ঢেলে দিয়ে, তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখল।

 লাল মালা!

 মধু বলল, তুমি?

লাল মালা বলল, কীর্তি দেখতে। আমিও তোমার খুড়ো না? চললুম।

মুহূর্তে অদৃশ্য হল লাল মালা। ভিড়ের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল, আর দেখা গেল না। গোলাম ইনুস বিমলা মোহ সবাই জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে?

মধু কেবল বিড়বিড় করে বলল, বাদাবনের বাঘ।

.

মধু পর পর আরও দুটি খুঁটি জয় করল।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হল, রাত ঘনিয়ে এল। ফরাসডাঙার গঙ্গার ধারের পথে পথে মদের স্রোত বইছে। বাজনার থামবার নাম নেই। হল্লায় আকাশ ভরে গেছে। ফরাসডাঙার নটী আর বেশ্যারা কেউ আজ ঘরে নেই। আজ সবাই বাইরে এসে মেতেছে।

দুম করে শব্দ হল। আকাশে রংবেরং ফুল ছিটিয়ে পড়ল হাউই ফেটে। ফুল শেষ হয়ে যাবার পর, তিন রং পতাকা ফুটে উঠল আকাশে। নিশান হাউই উড়ছে। উড়তে থাকবে এখন।

ন্যাশনেল দ্য ফেত! ফিয়াস্তা! ভিভ লা বাস্তিল ডে। ভিভ লা ফ্রাঁস। কথাগুলি লাল নীল রং-এ ঝলকে উঠল আকাশে। তারপর গলে গলে পড়তে লাগল গঙ্গার বুকে। রূ দ্য আর্লেয়-এর বস্তিতে মুরগিগুলি ভয় পেয়ে চেঁচাতে লাগল খোঁয়াড়ে।

সবাই বাজি পোড়ানো দেখার জন্য গঙ্গার বাঁধানো স্টান্ডে ভিড় করেছে। মধু নেমে এসেছে গঙ্গার ধারে। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার সব যেন নদীর ওপারে, জগদ্দল আর সেনপাড়ায় ভারী হয়ে নেমেছে। নদীতে অনেক নৌকা, ভাউলে, বজরা। ফ্যাস্তা উপলক্ষ করে সবাই বেরিয়ে পড়েছে। মোহ গোলাম বিমলা নিমি ইনুস আর চাঁপদানির বন্ধুরা সবাই আছে সঙ্গে। আরও মদ এসেছে। মোহ ছাড়া সবাই খেয়েছে। তবু এখনও খুঁটির বাজি জেতার টাকা রয়েছে মোহর হাতে।

মোহ বলল, জলের ধারে আঁধারে যাচ্ছ কেন?

 মধু খালি শব্দ করল, উম?

মোহ-র ভয় হল, মধুর নেশা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মধু বলল, গোলাম, একটা লৌকো চাই।

গোলাম বলল, ওই তো গাছতলায় আমাদের লৌকো রয়েছে। বেড়াতে যাবি?

মধু বলল, না। একবার বাড়ি যাবার মন করছে।

মোহ ভয় পেল না খুশি হল, সে নিজেই যেন বুঝতে পারল না। মধুর পিঠে হাত রেখে বলল, সত্যি যাবে?

–হ্যাঁ। চ যাই একবারটি। মুখটা কেন মনে আসছে না।

কথা সে শেষ করতে পারে না। মোহ শোনে, মধুর স্বর যেন কেমন বদলে গিয়েছে। মোহর বুকে কেমন যেন একটা ভয়ের দুরুদুরু ভাব, অথচ ওপারের দিকে সেও যেন এক অবধারিত নিশির টানের মতো, টান বোধ করছে। বলল, চলো যাই।

বিমলি বলল, তাই যাও বাবা। আমরা ফিরি।

–হ্যাঁ খুড়ি এসো। পরে দেখা হবে।

নিমির মুখখানি অন্ধকার। অতিরিক্ত মাতালের মতো ঢলে পড়তে লাগল যার তার গায়ে। আর চিৎকার করে গান ধরেছে, ও মাসি, তোর বিদ্যারে না দিস, সুন্দর সুন্দর পুতুল এনে দে…।

চাঁপদানির বন্ধুরা অবাক। ইনুস অবাক হয়ে বলল, চলে যাচ্ছিস দোস্ত?

মধু বলল, হ্যাঁ, একবার বাড়ি যাব।

 ত্রিলোচন জিজ্ঞেস করল, আবার ফিরছ কখন? কলে কামাই দিয়ো না, টাট্ট সায়েব জিজ্ঞেস করবে। তা ছাড়া ঘরে জিনিসপত্তর রয়েছে।

মধু কেবল উচ্চারণ করল, আসব।

.

৪৯.

শ্যামের দৃষ্টি স্বচ্ছ। সম্পূর্ণ জ্ঞানে যেন চকিত। কত বছর এমন করে তাকায়নি শ্যাম। কত বছর ধরে তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন বিভ্রান্ত ছিল। যেন কুয়াশা ঢাকা অন্ধের মতো তাকাত।

আজ তাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে, স্বচ্ছ চোখে তাকাতে দেখে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল কালী। যে মানুষকে সকাল থেকে আগুনের সেঁক দিয়ে রাখতে হচ্ছে, সে এমন পরিষ্কার চোখে তাকায় কেন?

লখাই, নারায়ণ দুজনেই শ্যামের বিছানার দুই দিকে। সারদা সেঁক দিচ্ছে। কালী শুধু দু হাত দিয়ে আগলে বসে আছে শ্যামকে।

অল্প বাতাস! রেড়ির তেলের আলোটা অস্থির। সকলের ছায়াগুলি কাঁপছে মাটির বেড়ার গায়ে। বাইরে জোনাকি জ্বলছে। উঠোনে শুয়ে কুকুরটা তাকিয়ে আছে ঘরের দিকে। হীরা বসে আছে দাওয়ায়। তার মন খারাপ। জ্যাঠাকে সে ভালবাসে। কদিন ধরেই জ্যাঠার অবস্থা খারাপ।

কিন্তু ফরাসডাঙার হাউই কত উঁচুতে উঠেছে? বিদ্যুৎ চমকানোর মতো তাদের অন্ধকার উঠোনেও হাউইয়ের ঝিলিক হানছে। হানুক। হীরা কোথাও যাবে না। ঘরে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাইরে কোথাও তার যেতে ইচ্ছে করছে না। জ্যাঠার অবস্থা নাকি বড় খারাপ মধু দাদা বাড়ি ফিরল না। কথাটা মনে হতেই রাগে দুঃখে সে মনে মনে বলে ওঠে, হে ভগবান, মধু দাদা যেন মরে যায়। আর কোনওদিন যেন তাকে আমায় না দেখতে হয়। মোহ যেন পাগল হয়ে যায়, আর তাকে যেন কুকুরে তাড়া করে। বড়মার কষ্ট এ সংসারে কেউ বোঝে না।

তারপর যেন মন্ত্রপড়া বিস্ময়ের মতো, বহু বছর বাদে, শ্যামের কথা স্পষ্ট পরিষ্কার সঠিক শোনা গেল। বলল, কালীবউ, বাইরে একটা বাতি দে। কালীর গায়ের মধ্যে শিউরে উঠল। চমকে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ওগো, তুমি এমন করে কথা বলছ কী করে?

শ্যাম বলল, যেন দূর থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, কেন, যেমন করে বলি। বাইরে একটা বাতি দে।

কালী বলল, কেন বলছ?

–বাড়ি আঁধার রাখিস না। কালী ছুটে গিয়ে আলো জ্বালল। কিন্তু তার বুকের মধ্যে কাঁপছে। কান্না তার বাধা মানছে না। এ কীসের ইঙ্গিত শ্যামের। কার আশার পথ চেয়ে আলো জ্বালবে কালী? যে চোখের আড়াল দিয়ে, চুপি চুপি আসে, আর নিঃসাড়ে সব নিয়ে চলে যায়, সংসারের, মানুষের কোনও মাথা কোটাকুটি মানে না, তার জন্যে?

তবু আলো জ্বেলে দিয়ে ছুটে এল সে ঘরে। এসে ঝুঁকে পড়ল শ্যামের উপর। বলল, কিছু বলছ আর?

-হ্যাঁ।

–কী?

–তুই অত অধীর হোস নে। লারাণ!

 নারায়ণ ঝুঁকে এল। শ্যাম বলল, দাদা হয়ে তোকে দূরে রেখেছি, ওটা অল্যায্য কাজ।

 নারায়ণের শক্ত বুকে নিশ্বাস আটকে এল। বলল, চুপ দেও দিনি। ঘুমোও এটটু।

-না নারাণ, কথা কটা বলে নিই। লখাইকে আপন করে নিস। দূরে থাকলেও আপন বলে মনে করিস। লখাই!

লখাই বলল, বলো।

সে কাছেও এল না। সে যেন কেমন ভাব বিহ্বল হয়ে বসে আছে। শ্যাম বলল, তোমাকেও সেই কথা। ভগবান আমাদের পরীক্ষা করতে পাইঠেছেন সোমসারে, আর দেখে দেখে হাসছেন। মানুষ মানুষ। তার বড় কেউ না। ভাল করে মানুষ, মন্দও করে। কিন্তু চেরকাল বিবাদ থাকলে মানুষ হয় না। মনে মনে আতান্তর রেখ নাকো।

গলার স্বর নেমে যেতে লাগল অতলে। কিন্তু ভাঙা নয়, ঘড়ঘড়ে নয়, স্পষ্ট, নিচু। আরও নামতে নামতে তলিয়ে যাচ্ছে যেন।

কালী প্রস্তুত। সে জানে, সে ইশারা পেয়েছে। চিৎকার সে করবে না। ও শুনতে পাবে।

হঠাৎ শ্যামের নিচু গলা যেন উতলা শোনাল। ডাক দিল, কালীবউ!

–কী?

–তুই পুরুষ হলে যেমন পায়ের শব্দ হত, আমি তেমন শব্দ পাচ্ছি।

–কী বললে?

–আমি মধুর পায়ের শব্দ পাই।

দরজার শব্দ পেয়ে সবাই ফিরে দেখল মধু। মুহূর্তে কালীবউ কঠিন মুখ ফিরিয়ে নিল শ্যামের দিকে। মৃতপ্রায় স্বামীর কাছে বসে, চোখ তার নিষ্ঠুর আরক্ত হয়ে উঠল।

শ্যাম বলল, অমন করিসনে কালীবউ। ওকে আসতে দে।

-না।

 কঠিন নির্বিকার গলায় বলল কালী। বলল, আমি জানি, জানি, এই শমনের জন্য তুমি আমাকে আলো জ্বালাতে বলেছ।

–না কালীবউ। ওকে হুকুম দে আসবার।

 মধু ডাকল, মা!

কালী শক্ত হয়ে ফিরে রইল, কিন্তু তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল।

মধু মায়ের পাশ ঘেঁষে, বাবার বুকে হাত রেখে, বহুকাল আগের মতো ফিসফিস করে ডাকল, বাপ গো।

শ্যাম ফোগলা দাঁতে শিশুর মতো হাসল। কিন্তু গলার স্বর নিভে এল। যেন বড় খুশি গলায় বলল সে, হারামজাদা, মদ গিলে এয়েছিস?

মধু বলল, হ্যাঁ। আমি আর থাকতে পারলুম না, তাই এয়েছি।

শ্যাম প্রায় চুপিচুপি বলল, মাকে দেখিস মধু।

মধু মায়ের দিকে দেখল, তারপরে মায়ের পিঠে একটা হাত রাখল। মায়ের শরীরটা কাঁপছে, কিন্তু শক্ত। মধু মাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। এই মধুকে দেখে সেই যাযাবর ঘরছাড়া, গ্রামছাড়া, নোঙর-ঘেঁড়া নৌকা বলে চেনা যায় না। এখন সে যেন কেমন শিশুর মতোই বাবাকে দেখছে আর তার লাল চোখ দুটোতে জল এসে পড়েছে। সে বলল, জানিস মা, বাপের মুখটা মনে আসছিল না।

কালী সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে, হঠাৎ শ্যামের বুকের উপর হাত রাখল, তারপরে উপুড় হয়ে পড়ল। মধু ডাকল, বাপা!

শ্যাম আর সাড়া দিল না।

হীরা এতক্ষণ বাইরে ছিল। আর থাকতে পারল না। মধু দাদার জন্যে নয়, বাইরের দাওয়ায় একলা থাকতে ভয় করছিল তার। সে ভিতরে এসে, শ্যামের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জোরে কেঁদে উঠল। উঠোনের কুকুরটা চমকে উঠে ঘেউঘেউ করে উঠল।

সারদার গলায় স্বর ছিল না। সে কেবল দরজার কাছে ঘোমটা ঢাকা মোহকে হাত তুলে, মৃত শ্যামের কাছে আসতে বলল। মোহ কালীর পাশে এসে বসল। লখাই উঠে গিয়ে হীরাকে বুকের কাছে নিল। তার চোখে এখন অনেক মৃত বন্ধুদের মুখ ভাসছে, তার সহযোদ্ধাদের মুখ। কেন তা সে জানে না।

কালী যেন অনেকটা বোধবুদ্ধিহীন অচেতনের মতো চিৎকার করে ডাকতে লাগল, তুমি কি গেলে নাকি! শুনছ, ওগো মধুর বাপ, তুমি কি চলে গেলে।…

সারদা শ্যামের বুকের ওপর রাখা কালীর হাত তুলে আনতে গেলে। কালীর হাত শ্যামের ঠাণ্ডা হয়ে আসা বুকটা খামচে ধরেছিল। আশেপাশের বাড়ির লোকেরা কালীর কথা শুনে জানতে পারল, শ্যাম বাগদি মারা গেল। সারদা উঠে, কাছে গিয়ে নিচু স্বরে লখাইকে বলল, ব্যবস্থা দ্যাখো।

লখাই নারায়ণের দিকে তাকাল। নারায়ণ বলল, চল যাই।

 উঠতে উঠতে বলল, বাপ মরলে কিছু বুঝতে পারিনি, আজ মনে হয়, আমার বাপ গেল।

 লখাই নারায়ণকে জিজ্ঞেস করল, কোন ঘাটে যাবে?

নারায়ণ বলল, জঙ্গলপীরের কাছে যাই।

.

ফরাসডাঙার ফ্যাস্তার শেষ বাজি পোড়ানো হয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার ওপারেও নেমেছে। তবে, ফ্যাস্তার যাত্রীদের ফেরার পালা এখনও চলেছে। এখন যারা ফিরছে তাদের এখনও ফ্যাস্তার খোয়ারি কাটেনি।

সেনবাড়ির জঙ্গল গজানো বাগানে, মজলিশ ঘরের পিছনে, যেখান থেকে ফরাসডাঙা দেখা যায়, সেখানে দুই গোমস্তা এখনও বসে আছে। ঝি চপলা তাদের মাঝখানে। তারা নৌকা ভাড়া করতে পারেনি। খেয়া পেরিয়ে, ওপারের ভিড়ে তারা যেতে পারেনি, কারণ চপলাকে নিয়ে যাবার উপায় ছিল না। তারা তিনজন এপারে বসেই, তোপের শব্দ শুনেছে, বাজনা শুনেছে, বাজি পোড়ানো দেখেছে। তাদের খোয়ারি এখনও কাটেনি। তারা, একজন চপলার কোমর জড়িয়ে ধরে আছে, আর একজন গলা জড়িয়ে ধরে আছে। চপলা তাদের দুজনকে সমানভাবেই তার প্রেম দান করছিল। তাদের খোয়ারি এখন কাটবার নয়, কারণ তাদের নেশা ও নেশার কারণ, সবই নতুন। তারা তখনও বলাবলি করছিল: এল এ বি ও ইউ আর–লেবার মানে-মজুর, বি আর আই বি ই-বেরাই মানে–ঘুষ, জে ইউ টি ই–মানেচট।… চপলা হেসে বলছিল, আর অমন বললে না?দুজনেই তাড়াতাড়ি বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, অম্যান মানে ইস্তিরি লোক। সেই সময়ে, হঠাৎ হরিধ্বনি শুনে, তারা চুপ করে গেল, শক্ত হয়ে উঠল। চপলা দু হাতে দুজনকে জাপটে ধরে রইল। শুনতে পেল, কে যেন জিজ্ঞেস করছে, কে গেল?

লখাইয়ের গলা শোনা গেল, শ্যাম দিগর।

অন্ধকারের মধ্যে হরিধ্বনি দক্ষিণে এগিয়ে চলল। শ্মশানযাত্রীরা দেখল, গঙ্গার ধার থেকে একটি বউ পাড়ায় ঢুকছে। বউটি যেন টলছে। তার কিছু দূর পিছনে পিছনে একজন পুরুষ। শ্মশানযাত্রীরা চিনতে পারল, তেসুতি কলের গগন বোসকে। বউটি যে তার বউ, তারা বুঝতে পারল। তারা হরিধ্বনি দিয়ে এগিয়ে গেল।

শ্মশানযাত্রীরা এগিয়ে যাবার পর বউ থমকে দাঁড়াল। গগন কাছে এসে পড়ল। বউটি মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার পেছন পেছন আসছেন কেন? মজুমদার বাড়ি থেকে আমি রোজই একলা একলা বাড়ি ফিরি।

গগন একটু চুপ করে রইল, তারপরে বলল, বাড়ি চলো।

তার গলায় কোনও আদেশ নেই, অনুরোধও নেই। তার গলায় যেন কোনও সুর নেই। ফরাসি বিপ্লবের এই স্মৃতি দিবস তাকে নানানভাবে হতাশ করেছে। বন্ধুদের খানাপিনা, এই উৎসব, তারপরে এই অবসাদ, সব যেন বঙ্গসিন্ধুর প্রবন্ধকে ঠাট্টা করছে। জীবনঠাকুর পর্যন্ত উৎসবেই মেতেছিলেন। রামবাঁড়ুজ্জেও মদের পাত্র মুখে তুলেছেন আজ, আর অকারণ বকবক করেছেন, অর্থহীন প্রলাপ। প্রবন্ধের কথা তাঁর নিজেরও মনে ছিল না বোধহয়। তারপরে এপারে ফিরে গগন মজুমদারদের বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়েছিল, তার স্ত্রী ফিরেছে কি না। সেটা কেবলমাত্র কর্তব্যবোধ নয়, ঘরে তালা বন্ধ থাকলে সে ঢুকতে পারত না। শুনেছিল, তখনও গিন্নিদের নৌকা ফেরেনি, তাই সে গঙ্গার ঘাটেই অপেক্ষা করছিল।

গগনের স্ত্রী বলল, আপনি কি কেবল আমাকে উদ্ধার করেই যাবেন?

গগন বলল, বাড়ি চলো।

স্ত্রী মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ করল, যাব না। আপনি মনে করেছেন, বিয়ে করে আমাকে উদ্ধার করেছেন, নইলে আমার কলঙ্ক চাপা পড়ত না। এখনও আমাকে রক্ষা করে বেড়াচ্ছেন। আমাকে ও সব পুরুষগিরি দেখাবেন না…।

গগন দেখল, স্ত্রীর জিভ জড়িয়ে আসছে। সে তাকে ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে চলল। স্ত্রী জোর করতে লাগল, ছাড়ুন। বিয়ে করে আমাকে আপনি বেইজ্জত করেছেন। ছাড়ুন…।

.

হরিধ্বনি তখনও ভেসে আসছে। শ্মশানযাত্রীরা দক্ষিণে চলেছে। লখাই নারায়ণ মধু আর প্রতিবেশী গণেশ দিগর কাঁধ দিয়েছে। কালী মোহ পিছনে পিছনে। মোহর হাতে বাতি। আতপুর ঘুমিয়ে পড়েছে, কোথাও আলো নেই। কুকুরগুলো ডাকছে। রাজবাড়ির দেউড়িতে মাত্র একটা আলো দেখা যায়। টুং টাং ঘণ্টা বেজে ওঠে। পবনপেয়ারি আর লক্ষ্মীপেয়ারি দুই হস্তিনী হরিধ্বনিতে নড়েচড়ে উঠেছে, তাই ঘণ্টা বেজে ওঠে।

আর একটা ঘরে আলো জ্বলছিল, গোঁসাইদের কাছারি ঘরে। নায়েবমশাই একজন আমিন নিয়ে, প্রদীপের পলতে চড়িয়ে, তখনও এই অঞ্চলের নকশা দেখছিলেন। সেনপাড়ায় বেগডানলপ কোম্পানিকে যে জমি দেওয়া হয়েছে, তার উত্তরের ভূখণ্ড বিচার করছিলেন। কী কী গ্রাম আছে, প্রজাদের কাকে কী ধরনের বন্দোবস্ত দেওয়া আছে। এক আমেরিকান সাহেব কলকাতায় এসেছে, শীঘ্রই জগদ্দলে আসবে। তারা চটকল করতে চায়। একটা নয়, একাধিকতাদের কোম্পানির নাম, ডানকান ব্রাদার্স।

নায়েবমশাই হরিধ্বনি শুনে, মুখ তুলে আমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, কে মরল?

আমিন বাইরে এসে হাঁক দিলেন, কে গেল?

শ্মশানযাত্রীরা সবাই ভাবল, লখাই জবাব দেবে। কিন্তু লখাই কোনও জবাব দিল না। সে কাছারির দিকে ফিরে তাকাল না। আমিন আবার হাঁকলেন। হরিধ্বনিতে তার গলা ডুবে গেল। শ্মশানযাত্রীরা পশ্চিম দিকে বাঁক নিল। গঙ্গার ধার দিয়ে, জঙ্গলপীরের দিকে চলল।

.

পরদিন দুপুরে সবাই ঘরে গোয়ালে আর দাওয়ায় শুয়েছিল। মধু গোয়ালে গিয়ে শুয়েছিল। তার এখন কাছা গলায়, থান পরা। কালীও থান পরেছে, সে ঘরে শ্যামের যেখানে বিছানা ছিল, সেখানে শুয়ে আছে। লখাই দাওয়ায়। সারদা ভাতের হাঁড়ি চাপিয়েছিল উনানে। একজনকে কাজকর্ম না দেখলে চলে না। তার সঙ্গে রয়েছে মোহ।

দুপুরে পাগলা সাহেব এল। লখাই কথা বলবে না, সে জানত। মধুর সঙ্গেই কথা হল অলটারের। অলটার মধুকে বকল, শ্যাম দিগরের প্রশংসা করল। যাবার সময় বলে গেল, টাকা পয়সার দরকার হলে যেন মধু তাকে বলে। যাদের সঙ্গে ভাব আছে, তাদের বিপদ-আপদ হলেই সাহেব একবার দেখা দেয়।

নারায়ণ সকালবেলা জঙ্গলপীর থেকেই গারুলিয়ায় চলে গিয়েছে। সে আর সেনপাড়ায় ফেরেনি।

হীরা আর সবাইকে ছেড়ে, মোহর কাছে ঘেঁষবারই বেশি চেষ্টা করছিল। অথচ মোহকে সে মনে মনে কত গালাগালি দিয়েছে। এখন এ বাড়িতে মোহর কাছে কাছেই তার থাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু মোহ-র মনটা উতলা হচ্ছে। বারেবারেই চাঁপদানির সেই ঘরটার কথা তার মনে পড়েছে। ঘরদোর জিনিসপত্র, সব সেখানে পড়ে রইল। মধুর মনের কথা সে বুঝতে পারছে না। মানুষটার কিছুই বুঝতে পারছে না সে। সেই যে গতকাল রাত্রে বাড়ি আসতে চাইল, তারপর থেকে, মধুকে যেন সে ঠিক বুঝতে পারছে না। তখন থেকে আর একটি কথাও হয়নি। অথচ মধু ছাড়া তার কথা বলবার কে আছে, কে বা তাকে বুঝবে। তার শাশুড়ি, অধরার বাড়িটার দিকে সে তাকিয়ে দেখেছিল। সেখানে কেউ আছে বলে মনে হয় না। বুড়িটা মারা গিয়েছে কি না, তা সে জানে না। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও বাধছে। সে জানে না, কালী তাকে বউ করে নেবে কি না। লখাই আর সারদা তার কাছে, বলতে গেলে অচেনা।

এদিকে, একটা লোক মারা গেল। তবু তার চাঁপদানির সংসারের জন্যে ভাবনা, তাই বা কেমন কথা। এ কথা বুঝেও, মোহ-র মন ঘুরে ফিরে সেই কথাই ভাবে। সে যেন কোনও কিছুরই সঠিক কার্যকারণ বুঝতে পারছে না। কী নিয়মে কী ঘটছে, হদিস করতে পারছে না।

যে বাড়িতে যেদিন লোক মারা যায়, সে বাড়িতে তখন কোনও নিয়মকানুন থাকে না। সাঁজবেলায় সবাই ঘুমোচ্ছে। কালী লখাই সারদা, সবাই। আসলে, বেলা শেষে যাই হোক পেটে কিছু পড়েছে সকলের, তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। হীরাটাও কালীর খোলা বুকে একটা হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। মোহ গেল গোয়ালে। মধু চাটাই পেতে শুয়েছিল, ঘুমোয়নি। মোহকে দেখে বলল, বউ, একটু তামাক খাওয়াবি?

–খাওয়াব।

মোহ যেন স্বস্তি পেল মধুর কথা শুনে। তাড়াতাড়ি শ্যামের হুঁকো কলকে খুঁজে, কলকে সাজিয়ে আগুন দিয়ে, মধুকে এনে দিল। দিয়ে, মধুর পাশেই, চাটাইয়ে শুয়ে পড়ল। তারও তো শরীরটা ভাল নয়। মধু বসে হুঁকো টানতে লাগল। মোহ মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, না বলে পারল না, চাঁপদানির কী হবে?

মধু খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপরে বললে, আর যাব না। এখানেই থাকব।

–জিনিসপত্তর গুলোন? নতুন থালা বাটি, আমার কাপড়চোপড়।

–সে একসময়ে গিয়ে নিয়ে এলেই হবে।

এমনভাবে বলল, যেন চাঁপদানির সংসারের কথা মধুর মনেও নেই। মধু যে চাঁপদানিতে কাল দুপুর অবধি ছিল, সেখানে খেয়েছে, সে যে সেখানে কারখানায় কাজ করত, তাকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। সে বাঁ হাতটা দিয়ে মোহকে জড়িয়ে কাছে টেনে নিল, যেমন কাছে থাকলেই নেয়। ডান হাতে হুঁকো ধরে ভুড়ুক ভুড়ুক টানতে লাগল। তারপরে বলল, চোখের কোলগুলোন তোর বসে গেছে। একটু ঘুমা আমার কাছে শুয়ে।

তবে, এ লোককে তুমি কী বলবে। মোহর চোখে জল আসে। আবার ঘুমও আসে। চাঁপদানির সংসারের কথা ভেবে লাভ নেই! মধু যখন ঘুমোতে বলছে, তখন তার কাছে শুয়ে মোহ ঘুমোক।

মধু মোহর গায়ে হাত রেখে বাইরে তাকাল। আকাশে শ্রাবণের ঘটা দেখা যায়, বৃষ্টি আসবে। গোরুগুলোকে সে ঘরে আনবে। গাভিন গোরুটা তাঁতিদের পোড়োয়, অন্ধকার নামতে দেখে নিশ্চয় কারুর অপেক্ষা করছে। হয়তো মধুর মায়ের জন্যেই অপেক্ষা করছে। তবে মধুকেও সে চেনে।

মধু দেখল, মোহ ঘুমিয়ে পড়েছে। কলকেটা উপুড় করে দিয়ে হুঁকোটা বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে সে বাইরে গেল। তাঁতিদের পোড়োয় গিয়ে দেখল, গাভিন গোরুটা সেখানে নেই। পোডোর পাশ দিয়ে মজুমদারদের রাখাল যাচ্ছিল। মধুকে দেখে অবাক হল। অনেকদিন দেখেনি বলেই বোধহয়। মধু তাকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের গাভিন গাইটা দেখেছ?

রাখাল বলল, দেখেছি। দুপুরে তো হীরা তাকে গঙ্গার ধারে বেঁধে দিয়ে এসেছে।

মধু তাড়াতাড়ি গঙ্গার ধারের দিকে গেল। দেখল একটা কাঁঠাল গাছের গোড়ায় গোরু বাঁধা। গোরুটা এইদিকেই ভয় ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে রয়েছে। মধু গিয়ে হাত দিতেই, তার গায়ের চামড়া কেঁপে কেঁপে উঠল। ভেজা নাক দিয়ে মধুর গায়ে একবার ঘষে দিল। কিন্তু আগের মতো ফোঁসফোঁস করে উঠল না। যেমন আদরে আর খুশিতে করে।

গোরুর বাঁধন খুলতে খুলতেই মধু দেখল, সেনপাড়ায় ঘাটে একটা নৌকা এসে ভিড়েছে। কারা যেন নেমে, উপরের দিকেই উঠে আসছে। মুসলমানপাড়ায় শরাফত ছাড়া কাউকেই সে চিনতে পারল না। নজরটা একজনের দিকেই মধুর আটকে রইল। লুঙ্গির উপরে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে, টকটকে ফরসা একজন জোয়ান তার মাথায় লাল বাবরি চুল, ছাঁটা দাড়িগোঁফও লাল। বিদেশি বলে মনে হয়। সকলের শেষে যখন মাঝি উঠে এল, তাকে মধু জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে এল?

মাঝি বলল, ঈশা সারখিল। কলকেতার বন্দরে সদারি করত। সেনপাড়ায় যে নয়া কল হবে, এখন তার সর্দারি করবে।

বেগ ডানলপ কোম্পানির সর্দার এল। অথচ, এল যেন কোনও নবাবজাদা। শরাফতের খাতির দেখে সেইরকমই মনে হয়। শরাফতের মতো খানদানি লোকও কোম্পানির সর্দারকে এত মর্যাদা দেয়, এ বড় আশ্চর্য কথা।

মধু ফিরতে গিয়ে দেখল, সাঁজবেলার ছায়ায় তখনও কাকে যেন ঘাটে দেখা যায়। একটা পুঁটলির মতো গুটিসুটি হয়ে সিঁড়ির ধাপে বসে আছে। একটু ঠাহর করে দেখে চিনতে পারে। কালো দুলের বুড়িটা বসে আছে। দুলে বুড়িটা এখনও মরেনি। অথচ ঘাটে এসে বসে আছে। কাছে গেলে শোনা যাবে, বুড়ি জলের দিকে চেয়ে বকবক করছে।

মধু ঘরে ফিরে যায়। গোয়ালে গিয়ে তাড়াতাড়ি একটা বাতি জ্বালতে হবে। ধোঁয়া দিতে হবে। নইলে গোরু মোহ, সবাইকে ডাঁসে আর মশায় ছিঁড়ে খাবে। সহসা মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মা তার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। কাল রাত্রে চিতায় আগুন দেবার পর, মা সারাক্ষণ চিতার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বাবার প্রতিটি অঙ্গ কেমন করে পুড়েছে, মা সবই দেখেছে। ভোরবেলা ফেরার সময়, মধু মায়ের পাশে পাশেই ছিল। মা কোনও কথা বলেনি। আর কোনওদিন বলবে কি না কে জানে। মধু বলতে পারবে না, তার মনের মধ্যে ঠিক কেমন করছে। তার কোনও কষ্ট হচ্ছে কি না, সে বোঝে না। অথচ বুকের কাছে যেন একটা শক্তমতো কিছু ঠেকে আছে।

এ কী রকম আশ্চর্য, এ মধু যেন ফ্যাস্তার সেই মধু নয়। ঘর বিবাগী, বেদে মধু নয়, যে এ রাজ্য সে রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছে মোহকে নিয়ে। তার মনটা চিরে দেখ, তার আচার আচরণ দেখ, সবই যেন অন্য রকম। সে যেন কতকাল বাড়িতেই রয়েছে, নিবিষ্ট মনে সংসার করছে, সকলের সবকিছু দেখাশোনা করছে, এবং এখন শোকে আচ্ছন্ন।

মধু যদি নিজেকে দেখত, তা হলে বুঝত, মানুষ কত বিচিত্র

.

এক মাস অশৌচ শেষ হবার আগেই লখাই সারদাকে নিয়ে চলে গেল উচ্ছেগড়। কয়েকদিনের মধ্যেই একটা মানুষ যে এতটা ভেঙে পড়তে পারে, লখাইকে না দেখলে বোঝা যায় না। হীরা যখন বলল, সে এখানেই থাকতে চায়, তাতেও লখাই আপত্তি করল না। সে খালি বলল, আমার সঙ্গে আর কোথায় যাবি। চিরকাল তো এখানেই থাকবি।

কালীকে যখন যাবার কথা বলল, সে বলল, যা ভাল বুঝবে তাই করবে। কামানোর দিনে একবার এসো।

লখাই সারদা চলে গেল। কালী মোহ-র সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে। মোহ কিছু জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেয়। যেটা করা দরকার, নিজের থেকেই বলে। কথা নেই কেবল মধুর সঙ্গে।

মোহ বলে, মার কাছে কাছে থাকতে পার না? কথা বলতে পার না?

মধু বলে, তুই তো মা নোস, আমি তোর ছেলে নই। তুই কেমন করে বুঝবি?

মোহ বলে, আচ্ছা, কথার ছিরি দ্যাখ। তা এখন তো ঘরে ফিরে এসেছ। এখন আর কী আছে।

কী আছে, তা মনও জানে না। তবে একটা কিছু আছে। একটা কঠিন বেড়ার মতো। ইচ্ছা করলেই তা পার হওয়া যায় না। কোনও একদিন আপনা থেকেই হয়তো সরে যাবে।

.

দুপুরে, গারুলিয়ার কারখানার পিছনে, একটা গাছের নীচে, হাঁটু গেড়ে বসেছিল তিনজন। টমাস ডাফের গারুলিয়ার ম্যানেজার উইলসন, ওয়ালিক আর গোঁসাইদের নায়েব। উইলসনের চোখে, একটা লম্বা একচোখো দূরবীন। তাদের সামনে একটা বড় নকশা। সকলেরই লক্ষ্য ওপারের দিকে। উইলসনও গঙ্গার ওপারের দিকেই দূরবীন দিয়ে দেখছে।

দূরবীন নামিয়ে বলল, আমার মনে হয়, জেন্টল ম্যাকস ওখানে আসেনি।

ওয়ালিক বলল, কিন্তু আমার কাছে খবর ছিল, মি. জেমস লক-ই ওখানে আজ আসবেন।

উইলসন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ডান্ডি জুট বোর্ড থেকে ঝুককে বেছে পাঠানো হয়েছে। ডান্ডিতে সবাই তাকে জেন্টল ম্যাকস বলে। আমি চিনি তাকে। কিন্তু ওপারে যারা জমি মেপে দেখছে, তাদের মধ্যে জেমসকে আমি দেখছি না। তবে ভিক্টোরিয়া কোম্পানির কোনও রিপ্রেজেন্টেটিভ রয়েছে।

ওয়ালিক দূরবীনটা তুলে নিয়ে একবার দেখল। তারপরে বলল, এনি হাউ, আমাদের মুখোমুখি ওপারে আমরা আর কাউকেই কারখানা তুলতে দিতে পারি না। লেবার আর মেকানিক্যাল হ্যান্ডস এমনিতেই ভীষণ কম। এখন যদি সামনাসামনি আর একটা মিল হয়, সেটা সাংঘাতিক ক্রাইসিস হবে। ওপারের লোকগুলো সব বেহাত হবে।

উইলসন বলল, কিন্তু সাম প্যাঁচেজ অব ল্যান্ড তো আমাদের ওপারে রয়েছে, তার কী হবে?

সঙ্গে সঙ্গে গোঁসাই নায়েব বলে উঠল, এই যে স্যার, দাগিয়ে রেখেছি সে সব জায়গা। এ সব জমি আমার মালিকেরই ছিল, আপনারা নিয়েছেন।

ওয়ালিক বলল, কিন্তু আমাদের তো আরও ল্যান্ড চাই, যাতে ওরা কোনও কারখানা করতে না পারে।

নায়েব বলল, তাও স্যার দাগিয়ে রেখেছি। ওপারের ওই তল্লাটের মধ্যে গোঁসাইদের বাকি যত জায়গা আছে, সবই লাল কালিতে দাগিয়ে রেখেছি, এই যে দেখুন।

উইলসনের থেকেও, ওয়ালিকের মেজাজ বেশি তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। সে বলল, তা তো রেখেছ। বাকি জমিগুলো কাদের?

নায়েব বলল, তেলিনিপাড়ার বাঁড়ুজ্জেদের।

–সে ল্যান্ড আমাদের চাই।

–তা কী করে হবে স্যার! সব তো ভিক্টোরিয়া কোম্পানি নিয়ে বসে আছে।

 উইলসন তাকায় ওয়ালিকের দিকে। ওয়ালিক উইলসনের দিকে। টমাস ডাফের কারখানার দুই সৃষ্টিকর্তা। ওয়ালিক সকলের আগে। সে যেন অনেকটা অসহায় আর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কারণ, সে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, ওপারে ভিন্ন কোম্পানির মিল উঠেছে তাদের বুকের উপর। ওপারের লোকেরা কাজে আসছে না এপারে। গারুলিয়া মিল আধা বন্ধ। অসম্ভব, একেবারেই অসম্ভব।

নায়েব হঠাৎ বলল, সায়েব, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলি।

ওয়ালিক কখনও এদের বুদ্ধি পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে না। বলল, বলো।

ভিক্টোরিয়া কোম্পানিকে আপনারা ভালভাবে বারণ করুন, ওখানে মিল না তুলতে।

–নায়েব, তোমার দিমাক খারাপ আছে। ওরা জেনেশুনেই ল্যান্ড কিনেছে, কোনও কথা চলবে না।

–তবে ধর্মাবতারের কাছে যান, হুগলির কোর্টে যান।

–কোর্টে?

–হ্যাঁ, আপনার অসুবিধার কথা বলুন। খালি কারখানা করলেই হবে না, চালাতে হবে তো। আর জমিজমার প্যাঁচ পয়জার সব আমি দেখছি।

ওয়ালিক তাকাল উইলসনের দিকে। ম্যানেজার ব্যাপারটা যেন সঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু ওয়ালিকের চোখে আলো ফুটে উঠল। সে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলল, ইয়েস, লিটিগেশন, লিটিগেশন! যদি ওরা বিল্ডিং তুলতে যায়, তা হলে ডিফামেশন স্যুট করব, ইনজাংশন জারি করব।

উইলসন অবাক হয়ে বলল, তাতেই ক্রাইসিস কেটে যাবে?

যাবে। আপনি গোপনে আমাদের হেড অফিসের সঙ্গে এ বিষয়ে একটু আলোচনা করুন। আর ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের খালি একটা কথাই বলতে হবে। টমাস ডাফের আর একটা মিল হবে ওপারেই।

উইলশন ভ্রূ তুলে বলল, বাট দ্যাট ইজ নট টু।

ওয়ালিক বলল, কিন্তু হেড অফিসকে এখন এই মিথ্যা কথাটাই বলতে হবে।

নায়েবের গোঁফের ফাঁকে একটু চোরা ধূর্ত হাসি দেখা গেল। সে তখন মনে মনে বলছিল, একে বলে ব্যবসা। পয়সা! কাকের মাংস কাকেও খায়।

ওয়ালিকের মুখে একটা আচ্ছন্ন ভাব। তার মুখে হাসির ছটা। চোখে স্বপ্নের আবেশ। সে বলল, আর মিথ্যাই বা কেন। আমাদের মিলের যা পজিশন, আমাদের ম্যানুফ্যাকচার আর এক্সপোর্ট ক্যাপাসিটি, তাতে টমাস ডাফের ডিভিডেন্ড, এই মিলই ম্যাক্সিমাম দেয়। ওপারে আর একটা মিল আমরা করতে পারি। মিস্টার টমাস ডাকে আমি নিজেই সেই প্রস্তাব করব।

উইলসন বলল, নিউ মিল!

ওয়ালিক হেসে বলল, নিশ্চয়ই, নিউ মিল। আপনি জানেন, গোঁদলপাড়ায় অলরেডি গিলান্ডারস আরবুথনটেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ম্যাকলিস্টারের কথা মিথ্যা নয়, জুট ইজ গোল্ড, নট অনলি গোল্ডেন ফাইবার। নতুন মিল চাই–নতুন মিল!

নায়েব মনে মনে বলল, ওদিকে ডানকান ব্রাদার্স আসছে। নতুন মিল হবে। বেগ ডানলপ কাজ শুরু করছে।

নতুন মিল। নতুন মিল, অনেক মিল আর কোম্পানি মিছিল করে আসছে। আর মিছিলের সঙ্গে মিছিলের সংঘর্ষ, তাদের বিবাদের পালাও শুরু হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *