একটু-একটু দেখা যায়

একটু-একটু দেখা যায়

নীল শাড়ি পরা মেয়েটি রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই মলিন রেস্তোরাঁয় পরিবেশটাই যেন বদলে গেল। কোনও সুন্দরীর বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল যদি না থাকে তা হলে ওর দিকে আমি একবারের বেশি তাকাব না এটা ঠিক নয়। তাই চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া থামিয়ে আমি রূপসি মেয়েটির দিকে অপলকে চেয়ে রইলাম।

মেয়েটি হঠাৎই একচিলতে হাসল–তারপর আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল আমারই টেবিলের দিকে।

রেস্তোরাঁর নাম বিভূতি কেবিন–হাতিবাগান অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলের রেস্তোরাঁ। চা, টোস্ট, মাংসের সিঙাড়া, চপ-কাটলেট, মোগলাই ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় দুশো ছত্রিশবার হাতবদল হওয়া রোজকার খবরের কাগজ, নানান মাপ ও রঙের আরশোলা এবং হাফডজন টিকটিকি।

এখানে আমি প্রায়ই আসি, তবে এই সুন্দরীকে কখনও দেখিনি। এই মুহূর্তে ওকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল।

মেয়েটির বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল নেই কিন্তু সেটা ও লুকিয়ে রাখার কোনওরকম চেষ্টাই করছে না। ডানহাতে ভ্যানিটি ব্যাগ আর বাঁ-হাতে হালকা নীল সিনথেটিক শাড়ির মনোরম ভাজগুলো ধরে রেখেছে।

আজ আমি এখানে আচমকা ঢুকে পড়েছি একটু দম নেওয়ার জন্যে। সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ মাথায় নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে কাদা প্যাঁচপেচে রাস্তায় প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। তারই মধ্যে হঠাৎ খেয়াল করেছি, কালো জামা-প্যান্ট পরা একটা লোক আমাকে বিচ্ছিরিভাবে ফলো করছে।

লোকটাকে আমি দিনচারেক ধরে লক্ষ করছি। ভাবলেশহীন মুখ যেন পাথর কেটে তৈরি। ছিপছিপে লম্বা চেহারা। আর পরনে আধুনিক ঢঙের কালো ফুলশার্ট আর কালো জিম্স।

আমি একা মানুষ, নিজেকে নিয়েই সময় কাটিয়ে দিই। আমার কোনও শত্রু আছে বলে মনে হয় না। অথচ আমাকে ওই লোকটা কদিন ধরে ফলো করছে।

শ্যামবাজারে ভিড়ের মধ্যে লোকটাকে আমি কঁকি দিতে পেরেছিলাম। তারপর বৃষ্টির মধ্যেই ঢুকে পড়েছি হকার্স কর্নারের সরু একচিলতে গলির মধ্যে। সেখান থেকে এ-গলি ও-গলি করে অবশেষে এই বিভূতি কেবিন। এবং বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় ধোঁয়া ওঠা স্পেশাল চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক।

মেয়েটি সোজা এসে আমার মুখোমুখি বসে পড়ল। হাসল। অর্থপূর্ণ চোখে দেখল আমার দিকে।

মেয়েটিকে যা ভাবা উচিত, বুঝতে পারছিলাম মেয়েটি তা নয়। ওর ফরসা মুখে, নিপুণ সাজগোজে, কোথায় যেন একটা আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে।

আমাদের মাঝে শুধু একটা শ্বেতপাথরের টেবিলের ফাঁক। সেই ফাঁক কিছুটা কমিয়ে দিতে মেয়েটি ঝুঁকে পড়ল টেবিলের ওপর। দুটো সুন্দর হাতের পাখনা মেলে ধরল সাদা পাথরের বুকে। তারপর আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বলল, আপনি তো ইন্দ্রজিৎ ইন্দ্রজিৎ সেন…।

আমি চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেলাম।

সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে একবার আলাপ হলে আমি কখনও ভুলি না। এই মেয়েটিকে আমি আগে কখনও দেখিনি–কিন্তু ও আমার নাম জানল কী করে!

আপনি–আপনি আমার কথা বারবার আটকে যেতে লাগল।

আবার হাসল রূপসি। বলল, আমার নাম অনামিকা…আপনাকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি।

কোথায়? আমি হঠাৎই ভয় পেয়ে গেলাম। ডানহাতটা ধীরে-ধীরে টেবিল থেকে নামিয়ে পাশের চেয়ারে রাখা ব্রিফকেসের ওপর নিয়ে গেলাম। তারপর কাকড়াবিছের মতো হামাগুড়ি দিয়ে আমার ডানহাত পৌঁছে গেল ব্রিফকেসের হাতলে।

যে-কোনও অবস্থার জন্যে আমি এখন তৈরি। দরকার হলে বিফ্রকেন্স আমাকে খুলতে হবে।

অনামিকা আমাকে খুঁটিয়ে দেখল। বোধহয় বুঝতে পারল, আমি ভয় পেয়েছি। আমার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামও হয়তো ওর নজর এড়াল না।

ও হেসে বলল, ইন্দ্রজিৎ, শুধু-শুধু সিন ক্রিয়েট করে কোনও লাভ নেই। চলুন, সময় হয়ে গেছে–আপনাকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি।

আমি বাচ্চাদের মতো জেদ করে বললাম, না, আমি কোথাও যাব না। এখানেই চুপচাপ বসে থাকব।

অনামিকা হাসল–অবুঝ শিশুর জেদি কথায় সুন্দরী মা যেমন হাসে।

কিন্তু আমি পাগলের মতো ভাবছিলাম। অনামিকা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? কীসের সময় হয়ে গেছে?

স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় আমি আবার চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। চা জুড়িয়ে জল, কিন্তু তা-ই সই। যেভাবেই হোক আমাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। আমি যে ভয় পেয়েছি সেটা ওকে বুঝতে দেব না।

আমি ওকে বললাম, চা খাবেন? সঙ্গে টোস্ট?

 অনামিকা হেসে মাথা নাড়ল। যার মানে, চা-টোস্ট কিছু চাই না–শুধু তোমাকে চাই।

এবার একটু রূঢ় স্বরে বললাম, মাপ করবেন, ম্যাডাম–আপনাকে আমি চিনি না। একজন অচেনা মহিলার সঙ্গে কোথাও যেতে আমি রাজি নই।

আবার হাসল অনামিকা। ওর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে গোল বলের মতো কী একটা বের করে আমার মুখের সামনে ধরল।

বলটা চকচকে ধাতুর তৈরি। তার ওপরে কয়েকটা রঙের রহস্যময় ছায়া।

এবার কি কিছু মনে পড়ছে? প্রশ্ন করল অনামিকা।

 আমি পাগলের মতো মাথা আঁকালাম। বললাম, না, না কিছু মনে পড়ছে না।

অনামিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলটা আবার ঢুকিয়ে রাখল ওর ব্যাগের ভেতরে। তারপর চোয়ালের রেখা শক্ত করে বলল, থ্রি এক্স ওয়ান বি ওয়ান। কিছুক্ষণ আমাকে ভাবার সময় দিয়ে তারপরঃ এবার কিছু মনে পড়ছে?

আমি আবার মাথা নাড়লাম পাগলা ঘোড়ার মতো।

একটা হতাশ ভাব ফুটে উঠল অনামিকার মুখে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, ইন্দ্রজিৎ, সত্যি, তোমার মাথার ভেতরে বোধহয় কোনও গণ্ডগোল হয়েছে।

ওর আপনি থেকে তুমি-তে যাওয়া ওর শরীরের বাঁকগুলোর মতোই কী স্বাভাবিক!

আমি পালটা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমাকে চমকে দিল।

বিভূতি কেবিন-এর জীর্ণ মলিন রান্নাঘরে একটিমাত্র দরজা ও একটি বড় মাপের গরাদহীন জানলা। কিচেন থেকে চপ-কাটলেট ইত্যাদি জানলা দিয়েই বেয়ারাদের হাতে আসে। সেই জানলা এবং দরজার মাথায় বড় বড় দুটো কাচের সাইনবোর্ড। তাতে প্রকাণ্ড মাপের লাল হরফে লেখা বিভূতি কেবিন এবং মোগলাই পরোটা। আমি যখনই এখানে আসি তখন এই লেখাগুলোর দিকে মুখ করে বসি। আজও তাই।

হঠাৎই দেখি বিভূতি কেবিন লেখাটার কিছু কিছু জায়গা অদৃশ্য হয়ে গিয়ে শুধু পড়া যাচ্ছে ভূত কেবিন। আর দ্বিতীয় সাইনবোর্ডের মোগলাই পরোটা হয়ে গেছে গলা রাটা।

আমার অবাক ভাবটা অনামিকার নজরে পড়েছিল। ও পেছন ফিরে তাকাল একবার। তারপর জিগ্যেস করল, কী হল! কী দেখে অমন চমকে উঠলে?

আমি ওকে ব্যাপারটা বললাম।

তাতে ও ঝরনার জলে ভাসিয়ে দেওয়া একরাশ রঙিন কাচের চুড়ির মতো রিনরিন করে হেসে উঠল। সে-হাসি আর থামতেই চায় না।

রেস্তোরাঁয় অন্যান্য আড্ডাবাজ পরচর্চা-ভক্ত লোকগুলো ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখতে লাগল।

 আমি চাপা গলায় বললাম, কী হচ্ছে! সবাই দেখছে!

অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে অনামিকা বলল, এবার তো মানবে যে, সময় হয়ে গেছে। কোনও লেখারই সঠিক মানে তোমার চোখে আর ধরা পড়বে না। আচ্ছা, আমার এই কড়ে আঙুলটা ধরো তো! বলে ও টেবিলের ওপরে রাখা বাঁ-হাতটা এগিয়ে দিল আমার কাছে।

অন্য সময় হলে ওর হাতের ছোঁয়া পাওয়ার আশায় আমার মন আবেগে উথালপাতাল হয়ে যেত, রক্তকণিকা-রক্তকণিকায় বেধে যেত মরণপণ লড়াই।

কিন্তু এখন ওর কড়ে আঙুলহীন বাঁ-হাতটার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করে উঠল। একটা পরদেশি ভয় ঠান্ডা শিরদাঁড়া বেয়ে কুলকুল করে নামতে লাগল।

আমি অনামিকার কথা অমান্য করতে পারলাম না।

চায়ের কাপটা আলতো করে সরিয়ে দিলাম একপাশে। তারপর আমার বাঁ-হাত গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে লাগল ওর বাঁ-হাতের দিকে কড়ে আঙুলের শূন্যস্থান লক্ষ্য করে।

শূন্যস্থানে পৌঁছেই আমি অবাক!

আমার ছোঁয়ায় ওর কড়ে আঙুল আমি দিব্যি টের পেলাম। অথচ সেই কড়ে আঙুলটা আমি একফেঁটাও দেখতে পাচ্ছি না!

আমি হতবাক হয়ে অনামিকার সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ও ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, ইন্দ্রজিৎ সেন, এবার বুঝতে পারছ, তোমার গল্প শেষ!

আমি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সে কথাই জানালাম ওকে। তারপর বললাম, এসব কাণ্ডকারখানা আমার কাছে ভূতুড়ে ঠেকছে। বরং চলো, আমরা অন্য কোথাও গিয়ে একটু নিরালায় বসে গল্প করি। তোমাকে ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।

 অনামিকা ওর বাঁ-হাতটা টেনে সরিয়ে নিল। তারপর শক্ত গলায় বলল, তুমি দেখছি ভালো কথার মানুষ নও! তা হলে খারাপভাবেই কিছু করা যাক।

কথাটা বলেই ও ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আবার সেই ধাতব বলটা বের করল। ওটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী একটা করতে লাগল।

সঙ্গে-সঙ্গে দেখি রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো ফুলশার্ট কালো জিন্স পরা ছিপছিপে লম্বা চেহারার লোকটা। মুখে অভিব্যক্তির কোনও লেশমাত্র নেই।

একটা নাম-না-জানা আতঙ্ক আমাকে পাগল করে দিল।

আমার ডানহাতটা ব্রিফকেসের ওপরেই ঘোরাফেরা করছিল। এক ঝটকায় ব্রিফকেসটা খুলে ফেললাম। চোখের পলকে জেনারেটার গান বের করে অনামিকাকে লক্ষ্য করে ফায়ার করলাম।

ও হাতের বলটা নিয়ে কী একটা করল। দেখলাম, জেনারেটার গানের তীব্রশক্তির কণার স্রোত ওকে মোটেই কাবু করতে পারল না। ও অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় উঠে দাঁড়িয়ে শ্বেতপাথরের টেবিলটাকে উলটে দিল আমার ঘাড়ের ওপর। আর একইসঙ্গে দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করে কী যেন বলল।

রেস্তোরাঁয় হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। চেয়ার উলটে টেবিল কাত করে যে যেদিকে পারে ছুটছে। সেইসঙ্গে কানে আসছে আতঙ্কের চিৎকার।

কালো পোশাক পরা লোকটা এসবে ভ্রূক্ষেপও করল না। হরিণের মতো সাবলীল তিনটে লাফ দিয়ে ও চলে এল আমার কাছে।

আমি তখন মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি। একইসঙ্গে জেনারেটার গানটাকে নিয়ে আসতে চাইছি শত্রুর মুখোমুখি।

কালো পোশাক পরা লোকটা ঝুঁকে পড়ে ডানহাতে আমার টুটি টিপে ধরল। আর বাঁ-হাতে জেনারেটার গানসমেত আমার ডানহাত চেপে ধরল।

আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম, এই লোকটার শক্তির সঙ্গে লড়াই করে কোনও লাভ নেই। লোকটার হাতগুলো কি ইস্পাতের তৈরি?

এক হ্যাঁচকায় সে আমাকে খাড়া করে দাঁড় করিয়ে দিল। তার পর এক ভয়ংকর মোচড় দিল আমার ডানহাতে। আমার কবজির জোড় যেন খুলে গেল। ব্যথার বিদ্যুৎ হাত বেয়ে ছিটকে গেল মাথায়। জেনারেটার গানটা খসে পড়ল হাত থেকে। মেঝেতে পড়ে রইল অনাথের মতো।

রেস্তোরাঁর লোকজন সব ফাঁকা হয়ে গেছে। শুধু মালিক চোখ ছানাবড়া করে জরাজীর্ণ ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছে। আর তিনজন বেয়ারা আতঙ্কে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে রাঁধুনিদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে।

অনামিকা ওদের সবাইকে উদ্দেশ করে গলা তুলে বলল, আপনাদের কোনও ভয় নেই। আমরা শুধু একে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি। আমরা সিক্রেট পুলিশের লোক।

কথাটা বলে সুন্দর করে হাসল ও।

তারপর এগিয়ে এল আমার কাছে।

আমি তখন কালো পোশাক পরা লোকটার হাতে বন্দি হয়ে যোবা চোখে ওদের দেখছি।

অনামিকা এবার হেসে জিগ্যেস করল, ইন্দ্রজিৎ, তুমি কি এখন সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছ?

আমি চারপাশে তাকালাম।

ভূত কেবিনটা এখন ভূত কেন হয়ে গেছে। আর গলা রাটা হয়ে গেছে গলা টা। এ ছাড়া সবকিছুই আমি অসম্পূর্ণভাবে একটু-একটু দেখতে পাচ্ছি।

আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। এ আবার কোনদেশি চোখের অসুখ!

আমি যে কিছু বলতে চাই সেটা বুঝতে পেরে অনামিকা লোকটাকে ইশারা করল। লোকটা আমাকে ছেড়ে দিল।

আমি গলায় হাত বুলিয়ে কয়েকবার কাশলাম। তারপর কোনওরকমে বললাম, আমার চোখে কোনও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। আমি সবকিছুই কেমন খাপছাড়া দেখছি। তোমার ডানহাতের খানিকটা আমি দেখতে পাচ্ছি না। ওই চেয়ারটার মাত্র দুটো পায়া দেখতে পাচ্ছি। আর তার দিয়ে ঝোলানো ওই ল্যাম্পটার তারের মাঝখানটুকুই নেই।

আমার কেমন অসহায় লাগছিল। চারপাশটা কেন এমন খাপছাড়াভাবে মুছে যাচ্ছে?

অনামিকা আমার থুতনি ধরে আদর করে নেড়ে দিল, বলল, ইন্দ্রজিৎ, সেই তখন থেকেই তো তোমাকে বলছি যে, সময় হয়ে গেছে। তোমার মাথার ভেতরে গোলমাল হতে শুরু করেছে।

আমার বয়েস আটাশ, স্বাস্থ্য ভালো, শরীরে কোনও অসুখ নেই। তা হলে হঠাৎই আমার এসব কী শুরু হল!

অনামিকা এবার গলা নামিয়ে সমবেদনার সুরে বলল, আসলে পৃথিবীতে তোমার থাকার পালা শেষ। তাই তোমার ভেতরকার সফটওয়্যার ধীরে-ধীরে মুছে যাচ্ছে। কোনও প্রোগ্রামই আর ঠিকঠাক কাজ করছে না…তাই তুমি একটু-একটু দেখতে পাচ্ছ…।

আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। ওর কোনও কথাই আমি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না। নাকি বুঝতে চাইছিলাম না?

আমার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসল অনামিকা, বলল, তুমি আসলে একটা রোবট, ইন্দ্রজিৎ। রোবট নাম্বার থ্রি এক্স ওয়ান বি ওয়ান। হুবহু মানুষের মতো দেখতে রোবট যাকে অ্যানড্রয়েড বলে। অ্যানড্রয়েডদের শরীরে ছুরি বসালে রক্ত পড়ে–মানুষের মতো। ওদের সবকিছুই মানুষের মতো–শুধু ভেতরে ব্যাটারি থাকে, মাইক্রোচিপ থাকে, মোটর থাকে। তোমাকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল নিম্নমধ্যবিত্তদের জীবনযাপন সম্পর্কে ডেটা কালেক্ট করতে। দু-বছর ধরে তুমি সেসব জোগাড় করেছ। তোমার শরীরের ভেতরে সেগুলো অটোমেটিকভাবে স্টোন্ড হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনামিকা? কিন্তু গোলমাল হল, তুমি এখানকার লোয়ার মিডল ক্লাস লাইফটাকে ভালোবেসে ফেললে। ভুলে যেতে চাইলে যে, তুমি অন্য গ্রহ থেকে আসা একটা রোবট। তাই তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমাদের আসতে হয়েছে।

অনামিকার মুখটা আমার চোখের সামনে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছিল। কালো পোশাক পরা লোকটার বাঁ-হাত আর মাথার অর্ধেকটা নেই। চারপাশের মানুষজন, চেয়ার-টেবিল, সাইনবোর্ডের লেখা, সবই ধীরে-ধীরে অসম্পূর্ণ থেকে আরও অসম্পূর্ণ হচ্ছে। আমার চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে আমার নিম্নমধ্যবিত্ত নিঃসঙ্গ জীবন–যে-জীবনকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম, এই নিম্নমধ্যবিত্ত জীবন, এই নিম্নমধ্যবিত্ত রেস্তোরাঁ ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হচ্ছে।

অনামিকা ওর সঙ্গীকে বলল, ওকে ওই আয়নাটার কাছে নিয়ে চলো।

লোকটা আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেল বেসিনের কাছে। সেখানে বড় মাপের একটা আয়না লাগানো আছে বয়েসের ভারে মলিন অথচ অভিজাত আয়না।

আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলাম। আমার শরীরের অনেকটাই অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন ছায়া দেখে আমার কান্না পেয়ে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি অসহায়ভাবে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলাম।

আমি তা হলে শুধুই হার্ডওয়্যার আর সফ্টওয়্যার! নিছকই একটা রোবট!

কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গে আমার কোনও যোগ নেই! যাকে আমি ভালোবাসি তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই!

আমার কান্নার মাঝেই অনামিকার গলা পেলাম। কালো পোশাক পরা লোকটাকে ও বলল, ইন্দ্রজিতের ব্যাটারিটা শর্ট সার্কিট করে দাও। নইলে ফেরার সময় ঝামেলা হবে।

আয়নায় আমার ছায়া তখন অসম্পূর্ণ থেকে আরও অসম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *