৫ম হিজরী সন

হিজরী ৫ম সন

দূমাতুল জানদাল যুদ্ধ ও রবীউল আওয়াল মাস

ইবন ইসহাক বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) দূমাতুল জানল [১. অভিধানবিদগণ দূমা এবং হাদীছবিদগণ দাওমা বলে থাকেন । দ্র. আল-বিদায়া (পাদটীকা)] যুদ্ধ পরিচালনা করেন । ইবন হিশাম বলেন, এই যুদ্ধ পরিচালনা করেন ৫ম হিজরীর রবীউল আওয়াল মাসে। তখন মদীনার শাসনভার দিয়েছিলেন সিবা ইবন উরফুতা গিফারীর হাতে।

ইবন ইসহাক বলেন, দূমাতুল জানদাল পর্যন্ত পৌঁছার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় ফিরে আসেন। পথে কোন প্রকারের সংঘর্ষ কিংবা কোন ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হননি। তারপর বছরের অবশিষ্ট সময়টুকু তিনি মদীনাতেই অতিবাহিত করেন। ইব্‌ন ইসহাক এরূপই বলেছেন।

ওয়াকিদী আপন সনদে তাঁর শায়খদের থেকে তাঁরা একদল প্রাচীন ও জ্ঞানীজন থেকে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সিরিয়ার উপকণ্ঠে যাবার ইচ্ছা করেছিলেন। তাঁকে জানানো হয়েছিল যে, এরূপ করতে পারলে রোমান সম্রাট কায়সার ভয় পেয়ে যাবে। তাকে আরো জানানো হয় যে, দূমাতুল জানদাল এলাকায় বড় একটি দল রয়েছে যারা ওই পথে যাতায়াতকারী পথিকদেরকে খুবই নির্যাতন করে থাকে।

সেখানে একটি বড় বাজারও ছিল। দুমাবাসীরা মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনাও করেছিল । ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) লোকজনকে আহ্বান জানালেন । প্রায় ১০০০ সাহাবী নিয়ে তিনি যাত্রা করলেন। তাঁরা দিনের বেলা লুকিয়ে থাকতেন আর রাতের বেলা সম্মুখে অগ্রসর হতেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ছিল মাযক্র নামক খুবই চৌকস একজন পথ প্রদর্শক। দূমাতুল জানদালের কাছাকাছি পৌঁছে সে বনূ তামীম গোত্রের পশু পালগুলো মুসলমানদের দেখিয়ে দিল । রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাথীগণ সম্মুখে অগ্রসর হয়ে ওই পশু পাল ও রাখালদের উপর হামলা করেন। কতক রাখাল পালিয়ে যায়, আর কতক মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। দূমাতুল জানদালের অধিবাসীদের নিকট এই সংবাদ পৌঁছলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওই এলাকায় গিয়ে পৌঁছে ওদের কাউকেই ওখানে পাননি। সেখানে তিনি কয়েকদিন অবস্থান করেন। সেখান থেকে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল আশে পাশে প্রেরণ করেন। তারপর তাঁরা মদীনার দিকে ফেরত যাত্রা করেন। মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা (রা) ওদের এক ব্যক্তিকে ধরে ফেলেন । তিনি তাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত করেন! রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে তার সাথীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। সে বলে যে, ওরা সবাই পূর্বের দিন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব দিলেন, সে ইসলাম গ্রহণ করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনায় ফিরে এলেন।

ওয়াকিদী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) দুমাতুল জানাল অভিযানে বেরিয়েছিলেন ৫ম হিজরীর রবীউল আখের মাসে। ওয়াকিদী এও বলেন যে, ওই মাসেই সা’দ ইবন উবাদা (রা)-এর মা ইনতিকাল করেন। তখন সা’দ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথেই ছিলেন।

ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী তাঁর জামি’ গ্রন্থে বলেছেন, মুহাম্মাদ ইবন বাশশার– সাঈদ ইবন মুসায়্যিব (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, সা’দ (রা)-এর মা যখন মারা যান তখন রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় ছিলেন না। মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর তিনি মরহুমার জন্য নামায আদায় করেন । মৃত্যুর একমাস পর তিনি এই নামায আদায় করেন। এটি একটি উত্তম মুরসাল পদ্ধতির হাদীছ । এতে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এই যুদ্ধ উপলক্ষে প্রায় একমাস বা ততোধিক সময় মদীনায় অনুপস্থিত ছিলেন। যেমনটি ওয়াকিদী বলেছেন ।

খন্দক বা আহযাবের যুদ্ধ

এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা সূরা আহযাবের প্রথম দিকের আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন । আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :

অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যখন শত্রুবাহিনী তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল এবং আমি ওদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম ঝঞ্ঝা বায়ু এবং এক বাহিনী যা তোমরা দেখনি। তোমরা যা কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। যখন ওরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল উচ্চ অঞ্চল ও নিম্ন অঞ্চল হতে তোমাদের চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল কণ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানাবিধ ধারণা পোষণ করছিলে। তখন মু’মিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল এবং মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ছিল ব্যধি তারা বলছিল, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয় । এবং ওদের একদল বলেছিল “হে ইয়াছরিববাসী। এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোমরা ফিরে চল এবং ওদের মধ্যে একদল নবীর নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলছিল, আমাদের বাড়ী ঘর অরক্ষিত। অথচ ওগুলো অরক্ষিত ছিল না, আসলে পলায়ন করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য! যদি শত্রুরা নগরীর বিভিন্ন দিক হতে প্রবেশ করে ওদেরকে বিদ্রোহের জন্যে প্ররোচিত করত তারা অবশ্য তা-ই করে বসত, তারা তাতে কাল বিলম্ব করত না। এরাতো পূর্বেই আল্লাহর সাথে অংগীকার করেছিল যে, এরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, পালাবে না । আল্লাহর সাথে কৃত অংগীকার সম্বন্ধে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে। বলুন, তোমাদের কোন লাভ হবে না যদি তোমরা মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে পলায়ন কর এবং সেক্ষেত্রে তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে । বলে দিন, কে তোমাদেরকে আল্লাহ্ হতে রক্ষা করবে। যদি তিনি তোমাদের অমংগল ইচ্ছা করেন এবং তিনি যদি তোমাদেরকে অনুগ্রহ করতে ইচ্ছা করেন কে তোমাদের ক্ষতি করবে? ওরা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। আল্লাহ অবশ্যই জানেন তোমাদের মধ্যে কারা তোমাদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে বাধা দেয় এবং তাদের ভ্রাতৃবর্গকে বলে “আমাদের সংগে এস।” ওরা অল্পই যুদ্ধে অংশ নেয়- তোমাদের ব্যাপারে কৃপণতাবশত যখন বিপদ আসে তখন আপনি দেখবেন মৃত্যু ভয়ে মূচ্ছাতুর ব্যক্তির ন্যায় চক্ষু উল্টিয়ে ওরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যখন বিপদ চলে যায় তখন ওরা ধনের লালসায় তোমাদেরকে তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। ওরা ঈমান আনে নাই, এজন্যে আল্লাহ্ ওদের কার্যাবলী নিষ্ফল করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষে তা সহজ। ওরা মনে করে, সম্মিলিত বাহিনী চলে যায়নি। যদি সম্মিলিত বাহিনী আবার এসে পড়ে, তখন ওরা কামনা করবে যে, ভাল হত যদি ওরা যাযাবর মরুবাসীদের সাথে থেকে তোমাদের সংবাদ নিত। ওরা তোমাদের সাথে অবস্থান করলেও ওরা যুদ্ধ অল্পই করত; তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। মু’মিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল ওরা বলে উঠল, এটি তো তাই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন। আর এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেল। মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অংগীকার পূর্ণ করেছে, ওদের কেউ কেউ শাহাদত বরণ করেছে। ওদের কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে, তারা তাদের অংগীকারে কোন পরিবর্তন করেনি। কারণ, আল্লাহ্ সত্যবাদীদেরকে পুরস্কৃত করেন। সত্যবাদিতার জন্যে এবং তার ইচ্ছা হলে মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন অথবা ওদেরকে ক্ষমা করেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। আল্লাহ্ কাফিরদেরকে ক্রুদ্ধাবস্থায় বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করলেন। যুদ্ধে মুমিনদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ সর্বশক্তিমান পরাক্রমশালী । কিতাবীদের মধ্যে যারা ওদেরকে সাহায্য করেছিল তাদেরকে তিনি তাদের দুর্গ থেকে অবতরণে বাধ্য করলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করলেন; এখন তোমরা ওদের কতককে হত্যা করছ এবং কতককে করছ বন্দী, এবং তিনি তোমাদেরকে অধিকারী করলেন ওদের ভূমি, ঘরবাড়ী ও ধন-সম্পদের এবং এমন ভূমির যা তোমরা এখনও পদানত করনি, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। (৩৩-আহযাব : ৯-২৭)।

উপরোক্ত আয়াতগুলোর প্রত্যেকটি সম্পর্কে আমরা তাফসীর গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর । এখানে আমরা সংশ্লিষ্ট যুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়গুলো আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে। ইবন ইসহাক, উরওয়া ইবন যুবায়র, কাতাদা, বায়হাকী এবং প্রাচীন ও আধুনিক যুগের বহু উলামা-ই-কিরাম এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ পেশ করেছেন। মূসা ইব্‌ন উব্বা যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ৪র্থ হিজরীর শাওয়াল মাসে। আহমদ ইবন হাম্বল (র) মূসা ইবন দাউদের বরাতে ইমাম মালিক থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন যে, বায়হাকী (র) বলেন, মূলত এখানে কোন বৈপরীত্য নেই। কারণ, তারা ৪র্থ হিজরী বলে এ কথা বুঝিয়েছেন যে, যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে হিজরী ৪র্থ বছর পূর্ণ হবার পর এবং ৫ম বছর পূর্ণ হবার পূর্বে ।

এটা নিশ্চিত যে, উহুদ যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় মুশরিকরা পরবর্তী বছর পুনরায় বদর প্রান্তরে যুদ্ধের আগাম ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিল। সেই মুতাবিক রাসূলুঃ “হ্ (সা) তাঁর সাহাবীগণকে নিয়ে ৪র্থ হিজরীর শাবান মাসে বদর প্রান্তরে উপস্থিত হন। আর দুর্ভিক্ষের বাহানা দিয়ে আবু সুফিয়ান তার কুরায়শী বাহিনী নিয়ে মক্কায় ফিরে যায়। এ পরিস্থিতিতে মাত্র দু’ মাস পর তাদের মদীনা আক্রমণ করা সম্ভব ছিলনা। ফলে এটি নিশ্চিতভাবে জানা গেল যে, পরবর্তী বছরের অর্থাৎ ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে তারা মদীনা আক্রমণের জন্যে এসেছিল।– যুহরী স্পষ্ট বলেছেন যে, উহুদ যুদ্ধের দু’ বছর পর খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে কারো দ্বিমত নেই যে, উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৩য় হিজরী সনের শাওয়াল মাসে। অবশ্য কেউ কেউ বলে থাকেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হিজরতের পরবর্তী মুহাররম মাস থেকে হিজরী সন গণনা শুরু হয়। তাঁরা হিজরতের বছরের রবীউল আওয়াল হতে যিলহজ্জ মাস পর্যন্ত এই মাসগুলোকে গণনায় আনয়ন করেন না। বায়হাকী এটি উদ্ধৃত করেছেন। ইয়াকূব ইবন সুফিয়ান ফাসাবী এই মতের সমর্থক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে ১ম হিজরীতে, উহুদ ২য় হিজরীতে, বদর-ই ছানী তৃতীয় হিজরীর শাবান মাসে এবং খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৪র্থ হিজরী সনে! ১ম হিজরীর মাস গুলো বাদ দিয়ে হিজরী সন গণনা করাটা জমহুর তথা অধিকাংশ ইমামের ঐক্যবদ্ধ অভিমতের বিরোধী। কারণ, এটা সুপ্রসিদ্ধ যে, হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা) হিজরতের ১লা মুহাররম কে হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। অন্যদিকে ইমাম মালিক (র) হিজরতের বছরের রবীউল আওয়াল মাস থেকে হিজরী সনের সূচনা বলে মত প্রকাশ করেছেন। ফলে হিজরী সনের সূচনা সম্পর্কে তিনটি অভিমত বিদ্যমান । আল্লাহই ভাল জানেন।

বিশুদ্ধ মত হলো- জমহুরের অভিমত যে, উহুদ যুদ্ধ তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে এবং খন্দকের যুদ্ধ ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়। তবে সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে উবায়দুল্লাহ্ সূত্রে নাফি থেকে বর্ণিত যে, ইবন উমর (রা) বলেছেন, উহুদ যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৪ বছর । যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্যে আমি নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট পেশ করলে তিনি আমাকে অনুমতি দেননি। খন্দকের যুদ্ধের সময় আমি নিজেকে তার নিকট পেশ করি। তখন আমার বয়স ১৫ বছর। তিনি এবার আমাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন। ইবন উমর (রা)-এর এ বক্তব্য সম্পর্কে উলামা-ই-কিরাম বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ প্রসংগে বায়হাকী বলেছেন যে, উহুদ যুদ্ধের দিবসে তিনি যখন নিজেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পেশ করেছেন তখন তার চৌদ্দতম বছর মাত্র শুরু হয়েছিল। আর খন্দকের যুদ্ধের দিবসে যখন তিনি নিজেকে পেশ করেছিলেন তখন তার বয়স ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার শেষ পর্যায়ে ছিল ।

আমি বলি, এমন ব্যাখ্যাও দেয়া যায় যে, খন্দকের যুদ্ধের দিনে তিনি যখন নিজেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পেশ করেছিলেন তখন তার বয়স ১৫ বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সাধারণতঃ ১৫ বছর পূর্ণ হলে বালকদেরকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেয়া হত । ১৫ বছরের অধিক হবার জন্যে অনুমতি আটকে থাকত না। এ জন্যে নাফি যখন এই হাদীছ উমর ইবন আবদুল আযীযের নিকট পাঠান তখন এই মন্তব্য করেছিলেন যে, নাবালক ও সাবালকের মধ্যে সীমা নির্ধারণকারী মানদণ্ড হল এটি। তারপর তিনি এই হাদীছ ও এই মন্তব্য সব জায়গায় পৌঁছিয়ে দেন। জমহুর তথা

অধিকাংশ আলিম এটাকেই নির্ভরযোগ্য অভিমত বলে গ্রহণ করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইবন ইসহাক ও প্রমুখ খন্দকের যুদ্ধের ঘটনা এভাবেই উল্লেখ করেছেন। ইবন ইসহাক বলেছেন, তারপর কথা হল ৫ম হিজরী সনের শাওয়াল মাসেই খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ প্রসংগে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন উবায়দুল্লাহ্ ইব্‌ন কা’ব ইবন মালিক থেকে। আরো বর্ণনা করেছেন, মুহাম্মাদ ইবন কা’ব কুরাযী, যুহরী, আসিম ইবন উমার ইবন কাতাদা এবং আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবু বকর প্রমুখ। তাঁদের কেউ এমন তথ্য বর্ণনা করেছেন য অন্যের বর্ণনায় নেই। তবে তাঁরা সকলে বলেছেন, খন্দক যুদ্ধের পটভূমি এই যে, ইয়াহূদী নেতা সালাম ইবন আবুল হুঁকায়ক ন্যরী, হুয়াই ইবন আখতাব, কিনানা ইব্‌ন রাবী ইব্‌ন আবুল হুায়ক, হাওযা ইবন কায়স ওয়াইলী এবং আবু আম্মার ওয়াইলীর নেতৃত্বে বনূ নযীর ও বনূ ওয়াইল গোত্রের কতিপয় লোক মিলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে একটি জোট বাধে। তারা একসময় মক্কায় কুরায়শদের নিকট উপস্থিত হয় । তারা কুরায়শীদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের আহ্বান জানায়। তারা আশ্বাস দিয়ে বলে যে, মুহাম্মাদ (সা)-কে সমূলে উৎখাত না করা পর্যন্ত আমরা তোমাদের সাথে থাকবই। কুরায়শী লোকেরা তাদেরকে বলল, হে ইয়াহূদী সম্প্রদায়! আমরা এবং মুহাম্মাদ (সা) যে বিষয়ে মতভেদ করছি তা সৃষ্টি হওয়ার পূর্বেকার কিতাবের তোমরা অনুসারী এবং তোমরা তখনও জ্ঞানবান ছিলে, আচ্ছা তোমরাই বল, আমাদের ধর্ম ভাল, না কি মুহাম্মাদের (সা) ধর্ম? ইয়াহূদী জোটের লোকেরা বলল, তোমাদের ধর্মই বরং তার ধর্মের চাইতে উত্তম । তোমরাই সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী, এ সকল ইয়াহূদীদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :

আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল? তারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্যে বিশ্বাস করে। তারা কাফিরদের সম্বন্ধে বলে, এদেরই পথ মু’মিনদের চেয়ে প্রকৃষ্টতর। এরাই তারা যাদেরকে আল্লাহ্ লা’নত করেছেন। এবং আল্লাহ্ যাকে লানত করেন আপনি তার জন্যে কখনো কোন সাহায্যকারী পাবেন না। (৪- নিসা ৫১-৫২)।

তাদের উত্তর শুনে কুরায়শরা মহা খুশী। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তাবে সানন্দে রাযী হয়ে গেল। তারা সকলে একমত হল এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগল। এরপর ইয়াহূদী দল গাতফান গোত্রের নিকট যায় । তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে প্ররোচিত করে। নিজেরা এই যুদ্ধে অংশ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি তারা গাতফানীদেরকে দেয়। কুরায়শরা যে যুদ্ধে শরীক হবে সে সংবাদও তারা জানাল। গাতফানীরা তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করল ।

যথা সময়ে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরায়শরা উয়ায়না ইবন হিসান ইবন হুযায়ফা ইব্‌ন বদর–এর নেতৃত্বে গাতফানীরা ও ফাযারীরা, হারিছ ইবন আওফ ইবন আবু হারিছা মুররী-এর নেতৃত্বে বনূ মুররা গোত্রের লোকজন এবং মিসআর ইবন রুখায়লা ইবন নুওয়ায়রা-এর নেতৃত্বে আশজাঈ গোত্রের লোকেরা যুদ্ধের জন্যে বের হয়। ওদের আগমন ও পরিকল্পিত যুদ্ধ প্রস্তুতির সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনার সীমানায় পরিখা (খন্দক) খননের নির্দেশ দিলেন। ইবন হিশাম বলেন, পরিখা খননের পরামর্শ দিয়েছিলেন হযরত সালমান ফারেসী (রা)।

তাবারী ও সুহায়লী বলেন, যুদ্ধে সর্ব প্রথম পরিখা খনন করেছিল, মনুচেহ্র ইবন ঈরাজ ইবন আফরীদূন। সে ছিল মূসা (আ)-এর যুগের লোক। ইবন ইসহাক বলেন, মুসলমানদেরকে এ ছাওয়াবের কাজে উৎসাহিত করে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজেও পরিখা খননে অংশ নেন। মুসলিম সৈন্যগণ তার সাথে পরিখা খনন করেন। মুনাফিকদের একটি দল শারিরীক দুর্বলতার অজুহাতে এ কাজ থেকে বিরত থাকে। তাদের কতক আবার রাসূলুল্লাহ্ (=)-এর অনুমতি ও অবগতি ব্যতিরেকে চুপিসারে পালিয়ে যায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা আয়াত নাযিল করে বলেন ও

তারাই মু’মিন যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে এবং রাসূলের সাথে সামষ্টিক ব্যাপারে একত্র হলে তার অনুমতি ব্যতীত সরে পড়েনা। যারা আপনার অনুমতি প্রার্থনা করে তারাই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলে বিশ্বাসী। অতএব, তারা তাদের কোন কাজে বাইরে যাবার জন্যে আপনার অনুমতি চাইলে তাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা আপনি অনুমতি দেবেন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু । রাসূলের আহ্বানকে তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি আহ্বানের ন্যায় গণ্য করো না, তোমাদের মধ্যে যারা চুপি চুপি সরে পড়ে আল্লাহ্ তাদেরকে জানেন। সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরোধিতা করে তারা সতর্ক থাকুক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর কঠিন শাস্তি। জেনে রেখো, আকাশরাজি ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহরই । তোমরা যাতে ব্যাপৃত তিনি তা জানেন, যেদিন তারা তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে সেদিন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেবেন, তারা যা করত। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ। (২৪- নূর : ৬২-৬৪)।

ইবন ইসহাক বলেন, মুসলিম সৈন্যগণ পরিখা খনন করতে লেগে গেলেন এবং উত্তমভাবে তা সম্পন্ন করলেন। জনৈক মুসলমানকে উপলক্ষ করে তারা কবিতা ও আবৃত্তি করেছিলেন। লোকটির নাম ছিল জুআঈল । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার নামকরণ করেন আমর । তখন মুসলমানগণ নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করলেন :

রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার নাম রাখলেন আমর। প্রথমে তার নাম ছিল জুআঈল। এক সময় সে ফকীর মিসকীন ও অভাবীদের সাহায্যকারী ছিল।

কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে তারা যখন আমরান উচ্চারণ করতেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-ও তাদের সাথে আমরান উচ্চারণ করতেন। তারা যখন যাহরান” উচ্চারণ করতেন তখন তিনিও “যাহরান” উচ্চারণ করতেন।

বুখারী (র) বলেছেন, আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মাদ– আনাস (রা) সূত্রে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) পরিখা এলাকায় গমন করলেন। তিনি সেখানে দেখতে পেলেন যে, শীতকালের ভোর বেলায় আনসার ও মুহাজিরগণ পরিখা খনন করছেন। তাঁদের পক্ষ হয়ে কাজ করে দেয়ার মত কোন দাস তাঁদের ছিল না। তাদের দুঃখ কষ্ট ও ক্ষুধা দেখে তিনি দু’আ করে বললেন,

হে আল্লাহ্! আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। আপনি আনসার ও মুহাজিরদেরকে ক্ষমা করে দিন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দু’আর জবাবে তারা বললেন :

মুহাম্মাদ (সা)-এর হাতে বায়আত করেছি এবং অঙ্গীকার করেছি যে, যতদিন বেঁচে থাকব জিহাদ করেই যাব ।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে শুবা– আনাস (রা) সূত্রে অনুরূপ হাদীছ বর্ণিত আছে। ইমাম মুসলিম (র) হাম্মাদ– আনাস (রা) সূত্রে অনুরূপ উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম বুখারী (র) বলেছেন, আবূ মামার–… আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, মদীনার সীমানায় আনসার ও মুহাজিরগণ পরিখা খনন করছিলেন, নিজেদের পিঠে করে তারা মাটি বহন করছিলেন, এবং এ কবিতা আবৃত্তি করছিলেন :

আমরা মুহাম্মাদ (সা)-এর হাতে বায়আত করেছি এ বিষয়ে যে, যতদিন বেঁচে থাকি ইসলামের পথে অবিচল ও অটল থাকব।

তাদের কবিতার জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন :

বর্ণনাকারী বলেন, পরিখা খননের এই কষ্টময় সময়ে তাদের খাদ্য হিসেবে আজলা ভরে যব আনা হতো আর দুর্গন্ধযুক্ত চর্বি মিশিয়ে তা দিয়ে তাদের জন্যে খাদ্য তৈরী করা হত। সেই স্বল্প পরিমাণ খাদ্য তাঁদের সম্মুখে রাখা হত । অথচ তারা সকলে তখন অভুক্ত তদুপরি ওই খাদ্য গলায় আটকে যেত এবং তা দুর্গন্ধময়ও ছিল।

বুখারী বলেন, কুতায়বা ইবন সাঈদ– সাহল ইবন সা’দ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে খন্দকের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলাম । মুসলিম মুজাহিদগণ পরিখা খনন করছিল। আমরা কাঁধে বয়ে মাটি সরাচ্ছিলাম। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন :

ইমাম মুসলিম (রা) কা’নবী সূত্রে আবদুল আযীয থেকে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।

বুখারী বলেছেন, মুসলিম ইবন ইব্রাহীম– বারা ইবন আযিব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজে খন্দক যুদ্ধে মাটি সরিয়েছেন। তাতে তার পবিত্র পেটও ধূলায়িত হয়ে পড়ে। তিনি তখন নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করছিলেন :

আল্লাহর কসম, আল্লাহর দয়া না থাকলে আমরা হিদায়াত পেতাম না। আমরা সাদকাও করতাম না। নামাযও পড়তাম না ।

হে আল্লাহ্! আপনি আমাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করুন এবং আমরা যখন শত্রুর মুখোমুখি হব, তখন আমাদেরকে সুদৃঢ় ও অবিচল রাখুন :

হে আল্লাহ্! শত্রুরা আমাদের প্রতি সীমালংঘন করেছে । ওরা যখনই কোন ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে তখনই আমরা তা প্রতিরোধ করি। প্রত্যাখ্যান করি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) । শব্দ উচ্চারণ করার সময় উচ্চস্বরে । বলছিলেন। মুসলিম (র) ও শুবা সূত্রে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

এরপর ইমাম বুখারী (র) বলেছেন, আহমদ ইবন উছমান প্রমুখ এবং বারা (রা) থেকে, বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, খন্দকের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) পরিখা খনন করেছিলেন । আমি তাঁকে দেখেছি যে, তিনি পরিখার মাটিগুলো অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে এমন হল যে, মাটির আবরণে তাঁর পবিত্র পেটের চামড়া ঢেকে গেল। তার শরীরে প্রচুর লোম ছিল । আমি শুনেছি, তিনি মাটি বহন করেছিলেন আর আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা বিরচিত এই কবিতা পাঠ করছিলেন :

বায়হাকী (র) তাঁর দালাইল গ্রন্থে বলেছেন, আলী ইবন আহমদ— সালমান (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) পরিখা খননে অংশ গ্রহণ করেন এবং তখন তিনি এ কবিতা আবৃত্তি করেছেন :

আরম্ভ করছি আল্লাহর নামে । তাঁর দয়ায় আমরা হিদায়াত পেয়েছি। আমরা যদি তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করতাম তবে নিঃসন্দেহে আমরা হতভাগ্য হয়ে যেতাম।

আহ! কতই না ভাল প্রভু! আহ! কতই না ভাল দীন। এই সনদে এটি একক বর্ণনা। ইমাম আহমদ বলেন, সুলায়মান— হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন । মুজাহিদগণ পরিখা খনন করছিল তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন :

হে আল্লাহ! পরকালের কল্যাণ ব্যতীত প্রকৃত কোন কল্যাণ নেই। আপনি আনসার ও মুহাজিরদেরকে পরিশুদ্ধ করে দিন। বুখারী ও মুসলিম তাঁদের সহীহ গ্রন্থদ্বয়ে এ হাদীছটি গুনদার সূত্রে শুবা থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইবন ইসহাক বলেন, পরিখা খননকালে এমন কতক ঘটনা ঘটেছে বলে আমার নিকট হাদীছ পৌঁছেছে যে ঘটনাগুলোর মধ্যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। সে ঘটনা গুলোতে প্রমাণ রয়েছে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সত্যায়নের এবং তাঁর নুবুওয়াতের যথার্থতার । উপস্থিত মুসলমানগণ ওহী সব ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন। তার একটি এই- হযরত জাবির (রা) বর্ণনা করেছেন যে, একটি পরিখা খনন করার সময় তাঁরা একটি কঠিন শিলা খন্ডের মুখোমুখি হন। কোন কুঠার ও শাবল দ্বারা তা ভাঙ্গা যাচ্ছিল না। তাঁরা বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জানালেন । তিনি এক পাত্র পানি আনতে বললেন। তিনি ওই পানিতে তাঁর পবিত্র মুখের থু থু মিশিয়ে তারপর দু’আ করলেন। তারপর ওই পাথরে পানিটুকু ছিটিয়ে দিলেন। সেখানে যারা উপস্থিত ছিল তারা বলল যে, যে মহান সত্তা তাঁকে সত্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন তাঁর কসম, ওইপাথর একেবারেই নরম হয়ে গেল। এমনকি তা বালুর ঢিবিতে পরিণত হল। তারপর আর কোন কুঠার কিংবা বেলচার আঘাত ব্যর্থ হয়নি। ইবন ইসহাক এভাবে হযরত জাবির (রা) থেকে সনদ ছাড়া এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

বুখারী (র) বলেছেন, খাল্লাদ ইবন ইয়াহয়া আয়মান সূত্রে বলেছেন যে, তিনি বলেন, আমি হযরত জাবির (রা)-এর নিকট এসেছিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন যে, খন্দক যুদ্ধের দিনে আমরা পরিখা খনন করছিলাম। আমাদের সামনে পড়ল একটি কঠিন শিলাখণ্ড। লোকজন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে তাঁকে ঘটনা জানাল। তিনি বললেন, আমি নিজে ওই পরিখাতে নামব। তিনি উঠলেন। তাঁর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। তিনদিন আমরা কোন খাবার খেতে পাইনি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) শাবল হাতে নিলেন। তারপর ওই শিলাখণ্ডে আঘাত করলেন। সেটি বালির ঢিবি বালির স্তূপের ন্যায় হয়ে গেলে। হযরত জাবির (রা) বলেন, আমি তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আরয করলাম যে, আমাকে একটু বাড়ী যাবার অনুমতি দিন। তিনি অনুমতি দিলেন। বাড়ী গিয়ে আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে এতই ক্ষুধার্ত ও করুণ অবস্থায় দেখে এসেছি যে, আমি আর ধৈর্য ধারণ করতে পারছিলাম না। তোমার নিকট কি কোন খাদ্য দ্রব্য আছে? সে বলল, আমার নিকট সামান্য যব ও একটি বকরীর বাচ্চা আছে। আমি ওটি যবাই করলাম । সে যবগুলো পিষে নিল । আমরা পাতিলে গোশত ঢেলে রান্না চড়িয়ে দিলাম। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এলাম। তখন আটাগুলো পৃথক করার আমীরের পর্যায়ে ছিল এবং চুলার উপর পাতিলের গোশত রান্না হয়ে আসছিল। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাড়ীতে সামান্য খাবার আছে। আপনি চলুন। সাথে এক দু’জন লোক নেয়া যায়। তিনি বললেন, খাদ্যের পরিমাণ কতটুক? আমি পরিমাণ বললাম, তিনি বললেন, ভাল, ভাল, তাতো অনেক বেশী। তুমি তোমার স্ত্রীকে গিয়ে বল, আমি না আসা পর্যন্ত যেন চুলা থেকে পাতিল না নামায় আর তন্দুর থেকে রুটি বের না করে। এদিকে তিনি সবাইকে বললেন, চল, সকলে আস। তাতে মুহাজির এবং আনসার উপস্থিত সবাই যাত্রা করলেন। হযরত জাবির (রা) তাঁর স্ত্রীর নিকট গিয়ে বললেন, হায় কপাল! রাসূলুল্লাহ্ (সা) আনসার, মুহাজির এবং তাদের সাথে যারা আছে সবাইকে নিয়ে যাত্রা করেছেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন? আমি বললাম, হাঁ জিজ্ঞেস করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সকলে সুশৃংখলভাবে ভেতরে প্রবেশ কর। কোন প্রকারের হুড়োহুড়ি না হয়। এবার রাসূলুল্লাহ্ (সা) স্বহস্তে রুটি ভেঙ্গে তাতে গোশত দিয়ে এক একজন করে দিতে লাগলেন। একেক বার নেয়ার পর তিনি পাতিল ও চুলো ঢেকে রাখছিলেন। এভাবে দিচ্ছিলেন আর ঢেকে রাখছিলেন। রুটি ভেঙ্গে দিতে দিতে এবং গোশতের পাতিল থেকে গোশত তুলে দিতে দিতে একে একে সকলের তৃপ্তি সহকারে খাওয়া হয়ে গেল। তবু কিছু খাবার অবশিষ্ট রয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জাবির (রা)-এর স্ত্রীকে বললেন, এটা তুমি খাও এবং অন্যকে উপহার হিসেবে দাও। কারণ, আশে পাশের লোকজন অভুক্ত আছে। এই বর্ণনা ইমাম বুখারী (র) একাই উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আহমদ (র) উকী– জাবির (রা) সূত্রে কঠিন শিলাখণ্ড এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পবিত্র পেটে পাথর বাঁধার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী (র) দালাইল গ্রন্থে হাকিম– জাবির (রা) সূত্রে কঠিন শিলাখণ্ড এবং খাদ্য তৈরীরও পরিবেশনের ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর বর্ণনাটি ইমাম বুখারী (র)-এর বর্ণনা অপেক্ষা দীর্ঘ ও পূর্ণাঙ্গ। ওই বর্ণনায় আছে যে, খাবারের পরিমাণ সম্পর্কে অবগত হবার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) উপস্থিত সকল মুসলমানকে বললেন, সবাই জাবির (রা)-এর বাড়ী চল। সবাই যাত্রা করলেন। জাবির (রা) বলেন, আমি তাতে এত বেশী লজ্জিত হয়ে পড়েছিলাম যা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। আমি মনে মনে বললাম, হায়! আমার এক সা (৩,৫ সের প্রায়) যব ও একটি ছোট্ট বকরীর বাচ্চার তৈরী খাবারের জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিরাট জামাত নিয়ে আসছেন । আমি আমার স্ত্রীর নিকট গিয়ে বললাম, এবার তোমার লজ্জা পাওয়ার পালা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) খন্দক যুদ্ধে উপস্থিত সবাইকে নিয়ে তোমার বাড়ীতে আসছেন। স্ত্রী বলল, রাসূলুল্লাহ্ (সা) কি আপনাকে খাদ্যের পরিমাণ জিজ্ঞেস করেছেন : আমি বললাম, হাঁ, জিজ্ঞেস করেছেন। সে বলল, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। আমরা তো আমাদের নিকট যা আছে তা জানিয়ে দিয়েছি । তার কথায় আমার প্রচন্ড দুশ্চিন্তার অবসান হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বাড়ী এলেন। আমার স্ত্রীকে বললেন, তুমি রুটি গোশতের ব্যাপারটি আমার হাতে ছেড়ে দাও। রাসূলুল্লাহ্ (সা) রুটি ভেঙ্গে ভেঙ্গে আর পাতিল থেকে গোশত তুলে তুলে দিচ্ছিলেন। রুটি নেয়ার পর চুলা এবং গোশত নেয়ার পর পাতিল ঢেকে রাখছিলেন। তিনি এভাবে সবাইকে খাদ্য পরিবেশন করছিলেন। এক পর্যায়ে সবারই তৃপ্তির সাথে খাওয়া শেষ হল। চুলা ও পাতিলে শুরুতে যা খাবার ছিল এখন তার চাইতে আরো বেশী অবশিষ্ট থাকল । রাসূলুল্লাহ্ (সা) জাবির (রা)-এর স্ত্রীকে বললেন, এবার তুমি নিজে খাও এবং প্রতিবেশীদেরকে হাদিয়া স্বরূপ দাও। সে দিন পূর্ণ দিবস সে নিজে খেয়েছে এবং প্রতিবেশীদেরকে দান করেছে।

আবু বকর ইবন আবূ শায়বা— হযরত জাবির সূত্রে তনুরূপ বর্ণনা করেছেন। সেটি আরো দীর্ঘ ওই হাদীছের শেষ দিকে আছে যে, তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, তাঁর বাড়ীতে উপস্থিত মুজাহিদদের সংখ্যা ৮০০; অথচ তিনি বলেছেন ৩০০। ইউনুস ইবন বুকায়র— জাবির (রা) সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি খাবার সম্পর্কিত হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। তিনি উদ্ধৃত করেছেন যে, উপস্থিত লোকজনের সংখ্যা ছিল ৩০০।

এরপর ইমাম বুখারী (র) বলেছেন, আমর ইবন আলী– . জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) সূত্রে বলেছেন, পরিখা যখন খনন করা হচ্ছিল তখন আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষুধার আলামত দেখতে পাই। আমি আমার স্ত্রীর নিকট ফিরে আসি। আমি তাকে বলি “তোমার নিকট কি কোন খাবার আছে? আমি তো রাসূলুল্লাহ (সা)-কে প্রচও ক্ষুধার্ত অবস্থায় রেখে এসেছি। সে আমাকে একটি থলে বের করে দিল। তার মধ্যে ছিল এক সা (৩.৫ সের প্রায়) যব । আর আমাদের একটি ছোট্ট বকরী ছিল। আমি বকরীটি যবাই করে দিলাম। সে যবগুলো পিষে আটা বানিয়ে নিল। সে তার কাজ শেষ করল, আমি আমার কাজ শেষ করলাম। বকরীর গোশত কেটে আমি পাতিলে রাখলাম । তারপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম । স্ত্রী বলল, দেখুন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাথে যারা আছেন সবাইকে এনে আমাকে লজ্জা দিবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এলাম। তাঁর কানে কানে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমাদের এক সা পরিমাণ যব ছিল। সেগুলো আমরা পিষেছি। ছোট্ট একটা বকরী ছিল। সেটি যবাই করেছি। আপনি অল্প কয়েকজন লোক নিয়ে মেহেরবানী করে আসুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উচ্চস্বরে সবাইকে ডেকে বললেন, হে খন্দকে উপস্থিত লোকজন! জাবির (রা) তোমাদের জন্যে খাবার তৈরী করেছে। সুতরাং তোমরা সকলে চল । তিনি আমাকে বললেন যে, আমি না আসা পর্যন্ত তোমরা চুলার উপর থেকে পাতিল নামাবে না এবং খামার দিয়ে রুটি বানাবে না।

আমি আমার বাড়ীতে এলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) লোকজন নিয়ে এসে পৌঁছলেন। আমি আমার স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হলাম। সে আমাকে দোষারূপ করে বলল, আপনি কী করলেন :আমি বললাম, তুমি যেভাবে বলতে বলেছিলে আমি সেভাবেই বলেছি। সে আটাগুলো বের করে দিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার মধ্যে পবিত্র মুখের লালা মিশিয়ে দিলেন এবং বরকতের দুআ করলেন। তারপর গোশতের পাতিলে লালা মিশিয়ে বরকতের দু’আ করলেন। তারপর বললেন, রুটি বানাতে পারদর্শী একজন লোক ডেকে আন। সে তোমার সাথে রুটি বানাবে। আর তুমি পাতিল থেকে পেয়ালা ভর্তি করে গোশত পরিবেশন করবে । পাতিল কিন্তু চুলা থেকে নামাবে না । তাঁরা ছিলেন ১০০০ জন, জাবির (রা) বলেন, আমি কসম করে বলছি তাঁরা সকলেই খেয়েছিলেন। সবাই চলে যাওয়ার পরও ওই পাতিলে পূর্বের মতই গোশত টগবগ করছিল। আর আমাদের আটাও তেমনি থাকল, যেমনটি পূর্বে ছিল।

ইমাম মুসলিম (রা) এই হাদীছ হাজ্জাজ ইব্‌ন শাইর সূত্রে আবু আসিম থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক এই হাদীছটি উদ্ধৃত করেছেন। তবে কোন কোন বিষয়ে তিনি একক বর্ণনাকারী হয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সাঈদ ইবন মীনা হাদীছ বর্ণনা করেছেন জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে। তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে খন্দকের যুদ্ধে অংশ নিয়ে পরিখা খনন করছিলাম । আমার একটি ছোট্ট ক্ষীণকায় বকরী ছিল। আমি মনে মনে বললাম, যদি এটি দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্যে একটু খাবার তৈরী করতে পারতাম তবে ভালই হত। আমি আমার স্ত্রীকে নির্দেশ দিলাম । সে আমাদের জন্যে কিছু যব পিষে নিল। তা দিয়ে আমাদের জন্যে রুটি তৈরী করল । আমি বকরীটি যবাই করলাম । সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্য ভাজা করে নিল। সন্ধ্যা হয়ে এল এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) বাড়ী ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা করলেন । জাবির (রা) বলেন, তখন আমরা দিনভর পরিখা খনন করতাম । আর সন্ধ্যা হলে বাড়ী ফিরে যেতাম। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমদের ছোট্ট একটি বকরী ছিল, আমরা সেটি দিয়ে আপনার জন্যে একটু খাবারের ব্যবস্থা করেছি। সাথে যবের অল্প কয়টা রুটিরও ব্যবস্থা রয়েছে। আমি আশা করছি যে, আপনি আমার সাথে আমাদের বাড়ী যাবেন । জাবির (রা) বলেন, আমি মনে করেছিলাম রাসূলুল্লাহ্ (সা) একাই আমার সঙ্গে আসবেন। কিন্তু আমি যখন তাঁকে একথা বললাম, তখন তিনি বললেন, হাঁ, যাব এবং তিনি জনৈক ঘোষককে ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সে চীৎকার করে ঘোষণা দিচ্ছিল যে, আপনারা সকলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা)-এর বাড়ী চলুন। জাবির (রা) বলেন, আমি তখন “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পাঠ করলাম । রাসূলুল্লাহ (সা) এলেন। তাঁর সাথে সকলেই এলেন। তিনি বসলেন । আমরা খাবারগুলো তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করলাম। তিনি বরকতের দুআ করলেন । বিস্মিল্লাহ্ পাঠ করলেন। তারপর নিজে খেলেন এবং লোকজনকে খাবার দিতে লাগলেন। একদলের খাওয়া শেষ হলে তারা চলে যাচ্ছিল । অপর দল আসছিল। অবশেষে খন্দক যুদ্ধে যারাই উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সকলেই খাওয়া দাওয়া করে বিদায় নিলেন।

এটি অবাক ব্যাপার যে, ইমাম আহমদ (র) এটি সাঈদ ইবন মীনা– জাবির (রা) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, সাঈদ ইবন মীনা বলেছেন যে, তিনি হাদীছ শুনেছেন যে, বাশীর ইবন সাদের কন্যা যিনি নুমান ইবন বাশীরের বোন ছিলেন। তিনি বলেছেন, আমার মা আমরাহ্ বিন্ত রাওয়াহা । আমাকে ডেকে আমার কাপড়ে দুমুঠো খেজুর দিয়ে বললেন, প্রিয় কন্যা! তুমি এগুলো নিয়ে তোমার বাবা ও মামা আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন রাওয়াহার নিকট যাও! এগুলো দিয়ে তাঁরা খাবারের কাজ সেরে নিবেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ওগুলো নিই এবং তাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। পথে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে আমার দেখা হয়। আমি আমার বাবা ও মামাকে খুঁজছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এই যে, ছোট্ট মেয়ে, এদিকে আস, তোমার সাথে কী? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এটি খেজুর, আমার মা এগুলো পাঠিয়েছেন আমার পিতা বাশীর ইবন সা’দ এবং আমার মামা আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহার জন্যে। তাঁরা এগুলো দিয়ে নাশতা সেরে নিবেন। তিনি বললেন, এগুলো আমাকে দাও। আমি তাঁর পবিত্র হাতের দু তালুতে তা ঢেলে দিলাম। তাতে তাঁর আজলা ভরেনি। তিনি একটি কাপড় আনতে নির্দেশ দিলেন। কাপড়টি বিছানো হল। তারপর তিনি কাপড়ের উপর খেজুরগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেন। সেগুলো কাপড়ের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। তারপর জনৈক ব্যক্তিকে বললেন, খন্দকের যুদ্ধে উপস্থিত সকলকে ডেকে বল যেন সবাই নাশতা খেতে আসে। সবাই তাঁর নিকট সমবেত হলেন। সকলে ওই কাপড়ের উপর থেকে খেতে শুরু করেন। আর ওই খেজুর গুড়ার পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সবাই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলে যায়। আর তখনও কাপড় থেকে খেজুরের টুকরো ঝরে ঝরে পড়ছিল। ইবন ইসহাক এরূপই বর্ণনা করেছেন। তবে এটির সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। হাফিয বায়হাকী আপন সনদে এরূপ বর্ণনা করেছেন। অতিরিক্ত কিছু বলেননি।

ইবন ইসহাক বলেন, সালমান ফারসী (রা)-এর বরাতে আমার নিকট হাদীছ বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, পরিখা এলাকার এক পাশে আমি একটি পরিখা খনন করছিলাম । আমার সামনে পড়ল একটি সুকঠিন পাথর। রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাছেই ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন যে, আমি শাবল মারছি আর ওই পাথরটি আমার জন্যে অত্যন্ত শক্ত ঠেকছে, তখন তিনি নেমে এলেন এবং আমার হাত থেকে শাবল নিয়ে ওই পাথরে প্রচণ্ড এক আঘাত হানলেন । তাতে শাবলের নীচে থেকে বিজলীয় ন্যায় আলো বিচ্ছুরিত হয়। তিনি পুনরায় শাবল মারলেন! পুনরায় আলো চমকাল । তিনি তৃতীয়বার আঘাত করলেন। তৃতীয়বার আলো চমকাল । আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমার বাপ-মা আপনার জন্যে কুরবান হোন, আপনি শাবল মারছিলেন আর আপনার শাবলের নীচে আলো চমকাচ্ছিল, ওই আলো কিসের? তিনি বললেন, হে সালমান! তুমি কি ওই আলো দেখতে পেয়েছ? আমি বললাম, জী হাঁ, দেখেছি। তিনি বললেন, প্রথমবারে আল্লাহ্ তা’আলা ইয়ামান রাজ্যের দরজা আমার জন্যে খুলে দিয়েছেন । ২য় বারে সিরিয়া রাজ্যের ও পশ্চিমা রাজ্যের দরজা আমার জন্যে খুলে দিয়েছেন। তৃতীয় বারে আল্লাহ্ তা’আলা আমার জন্যে পূর্বদেশীয় রাজ্যসমূহের দরজা খুলে দিয়েছেন ।

বায়হাকী (র) বলেছেন যে, ইবন ইসহাক যা বলেছেন মূসা ইবন উকবা তার মাগাযী গ্রন্থে তা-ই উল্লেখ করেছেন । আবু আসওয়াদ এটি বর্ণনা করেছেন উরওয়া থেকে। এরপর বায়হাকী ও (র) মুহাম্মাদ ইব্‌ন ইউনুস কুদায়মী থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। তবে এই হাদীছের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে। ইবন জারীর এই হাদীছ তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন মুহাম্মাদ ইবন বাশশার ও গুনদার–।

আমর ইবন আওফ মুযানী সূত্রে। ওই হাদীছে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রতি দশজনের জন্যে ৪০ হাত করে পরিখা খননের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। হযরত সালমান ফারসীর পরামর্শে পরিখা খননের সিদ্ধান্ত হওয়ায় তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় । মুহাজিরগণ ও আনসারগণ হযরত সালমান (রা)-কে তাঁদের নিজ নিজ দলভুক্ত বলে দাবী করেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ফায়সালা দিয়ে বলেন, সালমান আমাদের আহলে বায়তভুক্ত। আমর ইবন আওফ (রা) বলেন, আমি সালমান, হুযায়ফা, নুমান ইব্‌ন মুকাররিন এবং ছয়জন আনসারী মিলে ৪০ হাত খননের দায়িত্ব পাই। আমরা পরিখা খনন করছিলাম। প্রথম স্তরের পর আমরা যখন দ্বিতীয় স্তরে খনন করতে শুরু করি তখন একটি সাদা চকচকে পাথর আমাদের সামনে পড়ে। সেটিতে আঘাত করাতে আমাদের শাবল ভেঙ্গে যায়। ওটি ভেদ করে যাওয়া আমাদের জন্যে দুষ্কর হয়ে পড়ে। হযরত সালমান (রা) তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট যান। তিনি তখন একটি তুকী তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন । তিনি তাঁকে ঘটনা জানালেন। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে এসে সালমান (রা)-এর হাত থেকে শাবলটি নিয়ে ঐ পাথর খণ্ডে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করলেন । পাথরটি ভেঙ্গে গেল এবং আঘাতের সাথে পাথর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে মদীনার দু’ পাহাড়ের মধ্যবর্তী অঞ্চল আলোকিত করে ফেলল । ওই আলো যেন অন্ধকার রাতের প্রদীপ্ত প্রদীপ। এটা দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিজয়ের তাকবীর ধ্বনি দিলেন। মুসলমানগণও তাকবীর দিয়ে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) দ্বিতীয় বার আঘাত হানলেন। তারপর তৃতীয়বার। প্রত্যেকবারই অনুরূপ ঘটলো। সালমান ও মুসলিমগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ওই আলোর রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, প্রথম আলোতে আমার নিকট স্পষ্ট দেখা দিয়েছিল হীরা রাজ্যের প্রাসাদ গুলো এবং পারস্যের শহরগুলো। ওগুলো কুকুরের দাঁতের মত দেখাচ্ছিল । জিবরাঈল (আ) আমাকে জানিয়েছেন যে, আমার উম্মত ওই অঞ্চল জয় করবে। দ্বিতীয়বার আমার নিকট রোম সাম্রাজ্যের লাল লাল প্রাসাদগুলো উদ্ভাসিত হয়েছিল। সেগুলো মনে হচ্ছিল কুেরের দাঁতের ন্যায় । জিবরাঈল (আ) আমাকে জানিয়েছেন যে, আমার উম্মত ওই এলাকা ও জয় করবে । তৃতীয়বারের আলোতে আমি দেখেছিলাম, সানআ রাজ্যের প্রাসাদগুলো। সেগুলোও কুকুরের দাঁতের মত মনে হচ্ছিল। জিবরাঈল (আ) আমাকে জানিয়েছেন যে, আমার উম্মত ওই অঞ্চলও জয় করবে । সুতরাং সুসংবাদ গ্রহণ কর, খুশী হও। এতে মুসলমানগণ পরম খুশী হন এবং তাঁরা বলে উঠেন, “আলহামদু লিল্লাহ” এটি সত্য প্রতিশ্রুতি। 

বর্ণনাকারী বলেন, সম্মিলিত শক্তিপক্ষ যখন কাছাকাছি এসে পৌঁছল তখন ঈমানদারগণ বলল : 

এটিতো তা-ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছিলেন। আর এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেয়েছিল। 

তখন মুনাফিকগণ বলেছিল “তার কাণ্ড দেখ, ইয়াছরিবে অবস্থান করে তিনি বলছেন যে, তিনি হীরা রাজ্যের রাজপ্রাসাদ ও পারস্য সাম্রাজ্যের শহরগুলো দেখছেন আর ওইগুলো তোমরা জয় করবে । অথচ তোমরা এখন আত্মরক্ষার জন্যে খন্দক খুঁড়ছ। বাইরে বের হয়ে মুকাবিলার সাহস পাচ্ছ না।” ওদের এই বিরূপ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন । 

মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল তারা বলছিল” আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয়। (৩৩- আহযাব : ১২)। 

এটি একটি গরীব পর্যায়ের বর্ণনা। 

হাফিয আবুল কাসিম তাবারানী বলেন, হারূন ইবন মাল– আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) পরিখা খননের নির্দেশ দিলেন । মদীনার সীমানায় পরিখা খনন করা হচ্ছিল, সংশ্লিষ্ট খননকারিগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা একটি পাথর পেয়েছি যে, আমরা তা ভাঙ্গতে পারছি না ওই জায়গায় খনন করতে পারছি না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) পঁড়ালেন, আমরাও তাঁর সাথে দাঁড়ালাম, সেখানে এসে তিনি শাবল হাতে নিলেন। তিনি শাবল দ্বারা পাথরে সজোরে আঘাত করলেন এবং তাকবীর বলে উঠলেন। আমি তখন এমন একটি ভাঙ্গার শব্দ শুনলাম যা অতীতে কখনো শুনিনি । তিনি বললেন, পারস্য সাম্রাজ্য বিজিত হল । তিনি দ্বিতীয় বার আঘাত করলেন এবং তাকবীর বললেন। আমি এমন এক ভাঙ্গার শব্দ শুনলাম যা অতীতে কখনো শুনিনি। তিনি বললেন, রোমক সাম্রাজ্য বিজিত হল । তিনি তৃতীয়বার আঘাত হানলেন এবং তাকবীর বললেন। আমি এমন একটি ভাঙ্গার শব্দ শুনলাম যা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা হিময়ার গোত্রকে তামাদের সাহায্যকারী হিসেবে মঞ্জুর করেছেন। অবশ্য এই সনদের বিবেচনায় এটিও একটি গরীব বা একক বর্ণনা। এ সনদের একজন রাবী আবদুর রহমান ইবন যিয়াদ ইবন আনউম আফ্রিীর মধ্যে দুর্বলতা আছে। আল্লাহই ভাল জানেন। 

তাবারানী আরো বলেছেন, আবদুল্লাহ্ ইবন আহমদ ইবন হাম্বল– ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সশরীরে পরিখা খননে অংশ নিয়েছিলেন। সাহাবীগণ তখন ক্ষুধায় পেটে পাথর বেঁধেছিলেন। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমরা কি আমাকে এমন একজন লোকের কথা বলে দিতে পার যে আমাদের জন্যে সামান্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে? এক ব্যক্তি বলল, জ্বী হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! পারব । তিনি বললেন, তবে তুমি আগে আগে যাও আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও। যেতে যেতে তারা এক লোকের বাড়ী উঠলেন। লোকটি তখনও তার জন্যে নির্ধারিত অংশের পরিখা খননে নিয়োজিত ছিল। তার স্ত্রী সংবাদ পাঠালেন যে, বাড়ীতে রাসূলুল্লাহ (সা) তাশরীফ এনেছেন, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। তিনি দ্রুত বেগে হেঁটে বাড়ী পৌঁছলেন। তিনি বললেন, তার একটি ছাগী আছে, ওই ছাগীর সাথে একটি বাচ্চা আছে। তিনি ছাগীটি যবাই করতে গেলেন । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন। ছাগী নয় বরং তার বাচ্চাটিই যবাই কর । বাচ্চাটি যবাই করা হল। মহিলাটি তার আটা খুঁজে বের করে খামীর বানিয়ে রুটি তৈরী করলেন এদিকে গোশতও রান্না হয়ে এসেছিল। তিনি পেয়ালা ভরে গোশত ও রুটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে হাযির করলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বাটিতে আঙ্গুল রেখে বললেন, আল্লাহর নামে শুরু করছি, হে আল্লাহ্! আপনি এর মধ্যে বরকত দান করুন। তিনি বললেন, এবার সকলে খেতে শুরু কর, সবাই তৃপ্তি সহকারে খেলেন, এবং নিজ নিজ জায়গায় ফিরে গেলেন । দেখা গেল যে, সবাই মিলে খাবারের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ খেতে পেরেছেন। দুই-তৃতীয়াংশ খাবার অবশিষ্ট রয়ে গেছে। ওই বাড়ীওয়ালার সাথে যে দশজন খনন কাজ করছিল তিনি তাদেরকে দ্রুত পাঠিয়ে বললেন এবার তোমরা যাও এবং আরো দশজন এখানে পাঠিয়ে দাও। তারা গেলেন এবং নতুন দশজনকে পাঠিয়ে দিলেন । তাঁরাও এসে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) উঠলেন এবং বাড়ীওয়ালার ও তার পরিবার-পরিজনের জন্যে দু’আ করলেন। তারপর তিনি পরিখার নিকট ফিরে গেলেন । 

এবার তিনি বললেন চল, আমরা সালমানের (রা) নিকট যাই। সালমানের (রা) সম্মুখে একটি বিরাট পাথর পড়েছিল যা তিনি ভাঙ্গতে পারছিলেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমাকে সুযোগ দাও, আমি প্রথম আঘাত করি। তিনি “বিসৃমিল্লাহ” বলে সেটিতে আঘাত করলেন। সেটির এক তৃতীয়াংশ ফেটে গেল। তিনি বললেন “আল্লাহু আকবার”, কাবা গৃহের মালিকের কসম, এ যে সিরিয়া সাম্রাজ্যের প্রাসাদগুলো । তিনি আবার আঘাত করলেন। এবার আরো একটু অংশ খসে গেল, তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার, কা’বা গৃহের মালিকের কসম! এ যে পারস্য সাম্রাজ্যের প্রাসাদগুলো। তখন মুনাফিকগণ ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল, আমরা জান বাঁচানোর জন্যে পরিখা খনন করছি আর উনি আমাদেরকে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

হাফিয বায়হাকী বলেছেন, আলী ইবন আহমদ ইবন আবদান ..– বারা ইব্‌ন আযিব আনসারী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে পরিখা খননের নির্দেশ দিলেন। তখন একটি পরিখার মধ্যে আমাদের সম্মুখে একটি বড় ও কঠিন পাথর এসে পড়ল, শাবল তার মধ্যে কোন কাজ করতে পারছিল না। সংশ্লিষ্ট লোকজন সংবাদটি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জানান। তিনি পাথরটির দিকে তাকালেন এবং কোদাল হাতে নিয়ে বিসমিল্লাহ্ বলে তাতে আঘাত করলেন। সে আঘাতে এক তৃতীয়াংশ ভেঙ্গে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহু আবার সিরিয়ার চাবিগুচ্ছ আমাকে দেয়া হল। আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই সেখানকার লাল লাল প্রাসাদগুলো আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। তিনি পাথরে দ্বিতীয়বার আঘাত করলেন। এবার অপর তৃতীয়াংশ ভেঙ্গে পড়ল। তিনি বললেন, “আল্লাহু আকবার পারস্য সাম্রাজ্যের চাবিগুলো আমাকে দেওয়া হল। আল্লাহর কসম, আমি মাদায়েনের সাদা সাদা প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি । তিনি তৃতীয় আঘাত হানলেন পাথরের উপর এবং বিস্মিল্লাহ বললেন । তাতে পাথরের অবশিষ্ট অংশ ভেঙ্গে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার ইয়ামান রাজ্যের চাবিগুলো আমাকে দেওয়া হল । আল্লাহর কসম, আমি এখন এই স্থান থেকে সানআ নগরীর ফটকগুলো দেখতে পাচ্ছি। এই হাদীছ ও গারীব তথা একক বর্ণনাকারীর বর্ণনা। মায়মূন ইবন উসতা এটি একা বর্ণনা করেছেন। তিনি বসরা নগরীর লোক। বারা এবং আবদুল্লাহ্ ইবন আমর (রা) থেকে তিনি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। 

ইমাম নাসাঈ (র) বলেছেন, ঈসা ইবন ইউনুস জনৈক সাহাবী (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন পরিখা খননের নির্দেশ দিলেন তখন পরিখা খননকারীদের সম্মুখে একটি পাথর এসে পড়ল । তাতে খনন কার্য বন্ধ হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সা) উঠে শাবল হাতে নিলেন। তাঁর চাদরটি পরিখার এক পার্শ্বে রাখলেন। তারপর বললেন : — সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ এবং তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ)। তিনি স্বহস্তে পাথরে আঘাত করলেন। পাথরের এক-তৃতীয়াংশ ভেঙ্গে গেল । হযরত সালমান ফারসী (রা) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আঘাতের সাথে– বিদ্যুচ্ছটার মত চমকাচ্ছিল । তিনি দ্বিতীয় বার আঘাত করলেন এবং বললেন :– , এবার পাথরটির আরেক তৃতীয়াংশ ভেঙ্গে গেল। আঘাতের সাথে আলো জ্বলে উঠেছিল। হযরত সালমান (রা) তা দেখছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তৃতীয়বার আঘাত করলেন এবং বললেন : —  এবার অবশিষ্ট তৃতীয়াংশও ভেঙ্গে গেল । রাসূলুল্লাহ (সা) পরিখা থেকে উঠে এলেন। তিনি তাঁর চাদর তুলে নিলেন এবং বসলেন। হযরত সালমান (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমি দেখেছি, আপনি যতবারই আঘাত করেছেন ততবারই বিদ্যুতের মত আলো জ্বলে উঠেছে । রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সালমান! তুমি কি তা দেখেছ? তিনি বললেন জ্বী হাঁ, যে মহান সত্তা আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, আমি তা দেখেছি। 

রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমি যখন প্রথমবার আঘাত করি তখন পারস্যের কিসরার মাদায়েন ও আশেপাশে বহু শহর আমার নিকট তুলে ধরা হয়েছিল। ‘আমি স্বচক্ষে সেগুলো দেখেছি। উপস্থিত সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! দু’আ করুন, আল্লাহ যেন ওইগুলোর উপর আমাদেরকে বিজয়ী করে দেন। আমরা যেন ধন-সম্পদ গনীমতের মাল রূপে পেতে পারি এবং নিজ হাতে ওদের শহর নগর পদদলিত করতে পারি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সে দু’আ করলেন। তিনি বললেন, আমি যখন দ্বিতীয়বার আঘাত করি তখন রোমক সম্রাট কায়সারের রাজধানী এবং তার আশেপাশে অবস্থিত শহরগুলো আমার নিকট তুলে ধরা হয়। আমি স্বচক্ষে ওহীগুলো দেখেছি। তাঁরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আল্লাহর নিকট দু’আ করুন। তিনি যেন ওইগুলো আমাদের করায়ত্ত করে দেন। আমরা যেন ওদের ধন-সম্পদ ও ছেলে মেয়েদেরকে গনীমতের মালরূপে পেতে পারি এবং ওদের নগর শহরগুলি পদানত করতে পারি। রাসূলুল্লাহ (সা) দু’আ করলেন। তিনি বললেন, আমি যখন তৃতীয় আঘাত করলাম, তখন আবিসিনিয়া ও তার আশে পাশের জনপদগুলো আমার নিকট তুলে ধরা হয়। আমি স্বচক্ষে সেগুলো দেখতে পাই। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, যত দিন আবিসিনিয়ার লোকেরা তোমাদেরকে উত্যক্ত না করে তোমরাও ততদিন তাদেরকে উত্যক্ত করবে না। আর তুর্কীরা যতদিন তোমাদেরকে আক্রমণ না করে তোমরাও ততদিন তাদেরকে আক্রমণ করবে না। নাসাঈ (র) এভাবে দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করেছেন ।–আবু দাউদ । 

নাসাঈকে উদ্ধৃত করে শেষের অংশটুকু বর্ণনা করেছেন । 

এরপর ইবন ইসহাক বলেছেন, বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি আমার নিকট আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর (রা), উছমান (রা) ও তাঁদের পরে যখনই এসব শহর বিজিত হত তখন আবু হুরায়রা বলতেন, তোমরা যত সুযোগ পাও জয় করে নাও, আবু হুরায়রা-এর প্রাণ যার হাতে তাঁর কসম, তোমরা যত শহর জয় করেছ এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত শহর জয় করবে তার সবগুলোর চাবি পূর্বেই আল্লাহ্ তা’আলা মুহাম্মাদ (সা)-কে দিয়ে দিয়েছেন। এ সনদটি বিচ্ছিন্ন, তবে অন্যত্র তা পূর্ণ সনদসহ হয়ে বর্ণিত হয়েছে। সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার । 

ইমাম আহমদ (র) বলেছেন, হাজ্জাজ– হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলছিলেন আমি প্রেরিত হয়েছি  “স্বল্প ভাষায় অধিক মর্ম প্রকাশের ক্ষমতা দিয়ে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে এবং গাম্ভীর্য দ্বারা আমি সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছি, একদিন আমি ঘুমন্ত ছিলাম তখন পৃথিবীর সকল সম্পদের চাবি এনে আমার হাতে দেয়া হয়। বুখারী একা এই হাদীছটি ইয়াহয়া ইবন বুকায়র ও সা’দ ইবন উফায়র সূত্রে লায়ছ থেকে বর্ণনা করেছেন। ওই বর্ণনায় আছে যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় নিয়েছেন আর তোমরা ওই সম্পদটি সগ্রহ করছ। 

ইমাম আহমদ (র) বলেন, ইয়াযীদ– আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন “গাম্ভীর্য দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে, আমি “জাওয়ামিউল কালিম” তথা স্বল্প শব্দে অধিক মর্ম প্রকাশের শক্তি পেয়েছি, সমগ্র ভূজগত আমার জন্যে মসজিদ স্বরূপ ও পবিত্র করে দেওয়া হয়েছে। আমি একদিন ঘুমন্ত ছিলাম, তখন পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদের চাবি আমার নিকট উপস্থিত করা হয় এবং আমার হাতে তা তুলে দেওয়া হয়। ইমাম মুসলিমের শর্ত মুতাবিক এই হাদীছের সনদ খুব মযবুত হলেও অন্যান্যরা তা উদ্ধৃত করেননি। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন “বর্তমান (রোম কায়সার ম্রাটের) পতন হলে এরূপ কায়সার আর হবে না। বর্তমান কিসরার পতন হলে (এরূপ) কিসরা আর হবে না। যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম, ওই সাম্রাজ্যগুলোর ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে তোমরা ব্যয় করবে।” সহীহ্ হাদীছে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন ।–আল্লাহ্ তা’আলা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলসমূহ সংকুচিত করে আমার নিকট উপস্থিত করেছিলেন। যেই সীমা পর্যন্ত আমার নিকট উপস্থিত করা হয়েছে আমার উম্মতের রাজত্ব ওই সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ও প্রসারিত হবে। 

অধ্যায় : ইব্‌ন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) পরিখা খনন শেষ করলেন। মক্কার দিক থেকে কুরায়শরা এসে রূমা অঞ্চলে জুরুফ ও যুগাবাহ্ এর মাঝামাঝি মুজতামা আল আস্ইয়াল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। তাদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। তাদের সাথে ছিল অস্ত্র-শস্ত্র, বাহন ও অন্যান্য সনদপত্র। বানূ কিনানা ও তিহামাবাসী কতক লোকও সাথে ছিল । গাতফান ও নাজদের লোকজন এসে অবস্থান নেয় উহুদের দিকে যামরে নাকমায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা)ও মুসলিম সেনাবাহিনী বের হলেন। তাঁদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। সালা পাহাড়কে পেছনে রেখে তাঁরা অবস্থান নিলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সেখানে তাঁর সৈন্যদলকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে রাখলেন। শত্রু সৈন্য ও মুসলমানদের মাঝখানে রইল খন্দক। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশে শিশু ও মহিলাদেরকে একটি টিলার উপরে অবস্থিত দুর্গে নিয়ে রাখা হয়। ইবন হিশাম বলেন, মদীনার শাসনভার তখন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উম্মি মাকতুমের হাতে ন্যস্ত ছিল। আমি বলি, নিম্নের আয়াতে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন : –যখন ওরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল উচ্চ অঞ্চল ও নিম্ন অঞ্চল হতে তোমাদের চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল কষ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ্ সম্বন্ধে নানাবিধ ধারণা পোষণ করছিলে। (৩৩- আহযাব : ১০)।

ইমাম বুখারী (র) বলেন, উছমান ইবন আৰূ শায়বা– আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, — । আয়াত সম্পর্কে তিনি বলেন এ ঘটনা ঘটেছিল খন্দকের যুদ্ধের দিনে। 

মূসা ইবন উবা বলেন, সম্মিলিত শত্রু বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে অবতরণের পর বনূ কুরায় গোত্র নিজেদের দুর্গের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল । 

ইন ইসহাক বলেন, হুয়াই ইবন আখতাব নাযীরী এগিয়ে গেল । সে কুরায়যা গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কা’ব ইবন আসাদ কুরাযীর নিকট গিয়ে পৌঁছল । হুয়াই ইবন আখতাবের আগমন সংবাদ শুনে কা’ব ইবন আসাদ দুর্গের দরজা ভালভাবে বন্ধ করে দিল যাতে সে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে এবং তার সাথে সাক্ষাত না হয়। হুয়াই দরযায় গিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইল, কিন্তু কা’ব তাকে অনুমতি দিল না। হুয়াই ডেকে ডেকে বলল, দুর্ভোগ তোমার হে কা’ব! আমি এসেছি দরযা খুলে দাও। কাব বলল, হে হুয়াই! দুর্ভোগ তোমার তুমি একজন অপয়া লোক। আমি মুহাম্মদের (সা) সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। এখন আমি ওই চুক্তি ভঙ্গ করতে পারব না, আমি তার পক্ষ থেকে চুক্তি রক্ষা ও সততা ছাড়া অন্য কিছু পাইনি। হুয়াই বলে ধুত্তরী, তুমি দরজা খোল, আমি তোমার সাথে কথা বলব। কা’ব বলল, না আমি দরজা খুলব না। হুয়াই বলল, বুঝেছি, আমি ভেতরে ঢুকে তোমার খাবারে ভাগ বসাব এ ভয়ে তুমি আমার জন্যে দরজা বন্ধ করে রেখেছ। এতে কাবের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে এবং সে দরজা খুলে দেয়। হুয়াই বলল, হে কাব! আমি তোমার নিকট একটি বিরাট ও বিরল সম্মান ও অতল সাগরের সন্ধান নিয়ে এসেছি। সে বলল, তা আবার কী? হুয়াই বলল, কুরায়শের সকল নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে আমি সাথে নিয়ে এসেছি। ওদেরকে রূমা অঞ্চলের “মুজতামা আল আসয়াল” নামক স্থানে রেখেছি। আমি গাতফান গোত্রের লোকজনকে ওদের নেতাকর্মীসহ নিয়ে এসেছি। ওদেরকে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে নাকমা-তে রেখেছি। ওরা সকলে আমার সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছে যে, মুহাম্মাদ (সা) ও তার সাথীদেরকে নির্মূল না করে কেউ ফিরে যাবে না। কা’ব বলল, তুমি আমার নিকট খুশীর খবর আননি; বরং এনেছ অপমান ও লাঞ্ছনার খবর । তুমি আমার নিকট নিয়ে এসেছ এমন মেঘমালা যা পানি শূন্য। যা শুধু বজ্রপাত করে ও বিদ্যুৎ চমকায়; কিন্তু তার মধ্যে কোন পানি নেই । হে হুয়াই! তুমি আমাকে আমার অবস্থায় থাকতে দাও। কারণ, আমি মুহাম্মদের (সা) পক্ষ থেকে কোনদিন চুক্তি ভঙ্গের কোন উদ্যোগ দেখিনি, তিনি সতোর সাথে বরং চুক্তি ও অঙ্গীকার পালন করে চলেছেন। এ বিষয়ে আমর ইবন সা’দ কুরাযীও কথা বলেছিল। সে খুব উত্তম কথা বলেছিল বলে মূসা ইব্‌ন উকবা উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ওদের চুক্তি ও অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সে তখন বলেছিল, তোমরা যদি মুহাম্মাদ (সা)-কে সাহায্য করতে না চাও তবে তাঁকে ছেড়ে দাও। তিনি নিজে নিজেরটা বুঝবেন। কিন্তু তোমরা তাঁর শত্রুদেরকে সাহায্য করতে যেয়োনা। 

ইবন ইসহাক বলেন, হুয়াই ইবন আখতাব নাছোড়বান্দা। সে কাব কে ধরেছে তো ধরেছেই আর ছাড়ছে না। আকাশ পাতাল অনেক বুঝাতে বুঝতে শেষ পর্যন্ত কা’ব চুক্তিভঙ্গ করতে রাজয় এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত শত্রু বাহিনীর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করতে রাযী হয়ে গেল । তবে একটা শর্ত ছিল যে, এ ব্যাপারে হুয়াই ইবন আখতাব অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে যে, মুহাম্মাদ (সা)-কে পরাজিত করতে না পেরে যদি কুরায়শ ও গাতফান গোত্র ফিরে যায় তাহলে সে বনু কুরায়যা গোত্রের দূর্গে ঢুকে পড়বে এবং ওদের যে পরিণতি হবে সে-ও ওই পরিণতি ভোগ করবে। তখন কা’ব ইবন আসাদ তার ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মাঝে যে চুক্তি ছিল তা বাতিলের ঘোষণা দিল । 

মূসা ইবন উবা বলেন, কা’ব ইবন আসাদ ও বনূ কুরায়যার লোকজন হুয়াই ইবন আখতাবকে নির্দেশ দিল কুরায়শ ও গাতফান গোত্রের কতক লোককে বক রাখতে! ওরা বনূ কুরায়যার নিকট আবদ্ধ থাকবে যাতে মুহাম্মাদ (সা)-কে পরাজিত না করে ওর ফিরে গেলে বনূ কুরায়যার গোত্র অত্যাচারিত না হয়। তারা বলল যে, ওদের ৯০ জন ম্লান্ত লোক বন্ধক হিসেবে থাকবে। হুয়াই ইবুন আখতাব এ বিষয়ে কুরায়শী ও গাতফানীদেরকে রায। করাল। 

এ পর্যায়ে বনূ কুরায়যার লোকেরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করল এবং চুক্তিপত্র ছিঁড়ে ফেলল । তবে সানার পুত্রত্রয় আসাদ, উসায়দ ও ছা’লাবা ইয়াহুদীদের পক্ষ ত্যাগ করে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট চলে যায় । 

ইবন ইসহাক বলেন, ইয়াহূদীদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সা) এবং অন্যান্য মুসলমানদের নিকট পৌঁছে যায়। তিনি আওস প্রধান সা’দ ইবন মুআয এবং খাযরাজ গোত্র প্রধান সাদ ইবন উবাদা (রা)-কে সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে পাঠালেন। তাদের সাথে ছিলেন আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা ও খাওয়াত ইবন জুবায়র । রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমরা ওই সম্প্রদায়ের নিকট যাও। তারপর দেখ, আমরা যা শুনেছি তা সত্য কিনা। যদি ওই ঘটনা সত্য হয়, তবে সাংকেতিক শব্দ দ্বারা পরিস্থিতি আমাকে জানাবে। মুসলমানদের আম মজলিসে তা ঘোষণা করবে না। আর যদি ওরা চুক্তি বহাল রাখে তবে মুসলমানদের আম মজলিশে তা প্রকাশ করতে পার । তাঁরা গেলেন ওদের নিকট। তাঁরা ওদের দূর্গের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাদেরকে চুক্তি মুবায়ন ও পুনঃচুক্তি সম্পাদনের আহ্বান জানালেন। তারা বলল, হায় এখন? অথচ আমাদের একটি ডানা ভেঙ্গে গেছে। অর্থাৎ বানু নাযীর গোত্র বহিষ্কৃত হয়েছে। তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্পর্কে কটুক্তিও করে। সা’দ ইবন উবাদাহ (রা) ওদেরকে গাল মন্দ করতে লাগলেন। তারা তাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল । হযরত সা’দ হইল মুআয বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা ঝগড়া করতে আসিনি। এখন আমাদের যে পরিস্থিতি তা গাল-মন্দের চেয়েও গুরুতর । এবার সা’দ ইবন। মুআয (র) ওদেরকে ডেকে বললেন, হে বনু কুরায়যা গোত্র! তোমাদের মাঝে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মাঝে কী চুক্তি ছিল তা তোমাদের জানা আছে। ওই চুক্তি ভঙ্গ করলে বনু নাযীরের ন্যায় কিংবা তদপেক্ষা কঠিন পরিণতি তোমাদের হতে পারে বলে আমি আশংকা করছি। তারা তখন তার প্রতি অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করে। তিনি বললেন, শালীন ভাষা ব্যবহার করাটাই তোমাদের জন্যে উত্তম ছিল। 

ইবন ইসহাক বলেন, ওরা রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে কটুক্তি করেছিল। তারা বলেছিল,  রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবার কে? মুহাম্মাদ ও আমাদের মধ্যে কোন চুক্তি নেই। সা’দ ইবন মু’আয তাদেরকে ভর্ৎসনা করলেন। ওরাও তাকে পাল্টা ভর্ৎসনা করল। সা’দ ইব্‌ন মু’আয (রা) ছিলেন অত্যন্ত তেজস্বী প্রকৃতির লোক। সাদ ইবন উবাদা (রা) বললেন, থাক থাক গাল মন্দের দরকার নেই। এখন আমাদের আর ওদের মধ্যকার পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশী গুরুতর । হযরত সা’দ ইবন মু’আয, সা’দ ইবন উবাদাহ্ এবং তাদের সাথে যারা ছিলেন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ফিরে এলেন। তাঁরা তাঁকে সালাম জানিয়ে সাংকেতিক ভাষায় বললেন, “আযল ও কারাহ গোত্র” । অর্থাৎ আযল ও কারাহ গোত্রদ্বয় যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করে হযরত খুবায়ব (রা) ও তাঁর সাথীদেরকে হত্যা করেছিল এরাও তেমনি বিশ্বাসঘাতকতার পথ বেছে নিয়েছে। তাদের বক্তব্য শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বলে উঠলেন “আল্লাহু আকবার” হে মুসলিমগণ! সুসংবাদ গ্রহণ কর। 

মূসা ইবন উকবা বলেন, বনূ কুরায়যা গোত্রের সংবাদ শুনে বাসূলুল্লাহ (সা) কাপড়ে মাথা চেকে শুয়ে পড়লেন। দীর্ঘক্ষণ তিনি এ অবস্থায় ছিলেন। তাঁকে শায়িত দেখে লোকজন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও শংকিত হয়ে পড়ল । তারা বুঝতে পারল যে, বনূ করায়যার ব্যাপারে ভাল সংবাদ আসেনি । এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাথা তুললেন এবং বললেন, সকলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয়ের সুসংবাদ গ্রহণ কর। 

ভোরবেলা উভয় পক্ষ মুখোমুখি হল। তীর ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটল । রাবী সাঈদ ইবন মুসায়্যিব (রা) বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন বলেছিলেন : 

“হে আল্লাহ্! আমি আপনার দেয়া ওয়াদা ও অঙ্গীকার পূর্ণ করার প্রার্থনা জানাচ্ছি । হে আল্লাহ্! আপনি যদি চান যে, আপনার ইবাদত করা হবে না। তবে তাই হবে।” ইবন ইসহাক বলেন, এ সময়ে এক দারুণ পরীক্ষা উপস্থিত হয়। লোকজনের মনে প্রচন্ড ভীতির সঞ্চার হয়। শত্রু পক্ষ এগিয়ে আসে তাদের উধ্বাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল থেকে। ঈমানদারগণের মনে নানাবিধ ধারণা সৃষ্টি হয় । আর মুনাফিকরা প্রকাশ্যে মুনাফিকী কথাবার্তা শুরু করে দেয়। আমর ইবন আওফ গোত্রের মুআত্তাব ইবন কুশায়র বলে উঠে, মুহাম্মাদ তো আমাদেরকে রোমক ও পারস্য সম্রাটের ধন-সম্পদ ভোগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ আমাদের সঙ্গীরা এখন পায়খানায় যাওয়ার নিরাপত্তাও পাচ্ছেন না। আওস ইবন কায়সী বলেছিল “হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের বাড়ীঘর শত্রু পক্ষের সম্মুখে অরক্ষিত। ওদের অনেকেই এরূপ কথা বলে। সুতরাং হে রাসূল! আমাদেরকে আমাদের বাড়ী যাওয়ার অনুমতি দিন। আমাদের বাড়ী তো মদীনার বাইরে অবস্থিত। আমি বলি, আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নের আয়াতে ওদের কথাই বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন : 

মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে ছিল ব্যাধি তারা বলছিল। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয়। এবং ওদের একদল বলেছিল, হে ইয়াছরিববাসী। এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই! তোমরা ফিরে চল, এবং ওদের মধ্যে একদল নবীর নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলছিল আমাদের বাড়ীঘর অরক্ষিত। অথচ ওগুলো অরক্ষিত ছিল না। আসলে পলায়ন করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্যে । (৩৩- আহযাব : ১২, ১৩)। 

ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিলেন। আর মুশরিকরা তাকে ২৩ দিনের অধিক প্রায় এক মাস সময় অবরোধ করে রাখে। এতদনে উভয় পক্ষে তীর নিক্ষেপ ছাড়া অন্য কোন যুদ্ধ হয়নি। বিপদ খুব কঠিন দেখতে পেয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) গাতফান গোত্রের দুনেতা উয়ায়না ইবন হিসন এবং হারিছ ইবন আওফের নিকট প্রস্তাব পাঠালেন যে, ওরা যদি ওদের সাথীদেরকে নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে যায় তবে তাদেরকে মদীনায় উৎপাদিত মোট খেজুরের এক-তৃতীয়াংশ প্রদান করা হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) ও গাতফানী নেতাদের মাঝে চুক্তি বিষয়ক আলাপ আলোচনা চলছিল । চুক্তিপত্র লিখা হয়ে গিয়েছিল। তবে স্বাক্ষর ও সত্যায়ন তখনো হয়ে সারেনি । ইত্যবসরে বিষয়টি সম্পর্কে পরামর্শের জন্যে তিনি সা’দ ইবন মুআয ও সাদ ইবন উবাদা (রা)-কে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা এলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে ঘটনা জানালেন । এবং এ ব্যাপারে তাদের পরামর্শ চাইলেন। তাঁরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটি কি আপনার ব্যক্তিগত পসন্দের সিদ্ধান্ত? তাহলে আমরা অবশ্যই তা মেনে নিব । অথবা এটি কি আল্লাহর নির্দেশ? তাহলেও আমরা অবশ্যই এটি মেনে নেব। অথবা এটি কি আমাদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে আপনি করতে যাচ্ছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, এটি বরং তোমাদের স্বার্থেই আমি করতে চাচ্ছি। আমি এজন্যে এটি করতে চাচ্ছি যে, আমি দেখছি আরবদের সকলে একজোট হয়ে তোমাদের উপর আক্রমণ করছে, একই ধনুক থেকে তারা তীর ছুঁড়ছে তোমাদের প্রতি এবং চারিদিক থেকে ওরা ঘিরে ফেলেছে তোমাদেরকে। আমি চাচ্ছি যে, এ কৌশলের মাধ্যমে ওদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করে ওদেরকে দুর্বল করে দিই। সা’দ ইবন মু’আয (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! এমন এক সময় ছিল যখন আমরা এবং ওরা সকলে শিরকবাদী ছিলাম । মূর্তিপূজারী ছিলাম। আমরা তখন আল্লাহর ইবাদত করতাম না আল্লাহকে চিনতাম না। তখন তারা ক্রয় কিংবা আমাদের পক্ষ থেকে আতিথ্য ব্যতীত আমাদের একটা খেজুরের দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারেনি । আর এখন আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে ইসলাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন। আমাদেরকে ইসলামের দিকে পথ দেখিয়েছেন। আপনার উপস্থিতি ও তাঁর দয়ায় আমাদেরকে মহিমান্বিত করেছেন । ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! এখন কি আমরা আমাদের মাল-সম্পদ ওদের হাতে তুলে দেব? এমন চুক্তির আমাদের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর কসম! আমরা ওদেরকে কিছুই দেব না। শুধু উচিয়ে ধরব তরবারি যতক্ষণ না মহান আল্লাহ্ আমাদের আর ওদের মাঝে ফায়সালা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ঠিক আছে তুমি যা চাচ্ছো তাই হবে। হযরত সা’দ ইবন মু’আয চুক্তি পত্রটি হাতে নিয়ে সকল লিখা মুছে ফেললেন। তারপর বললেন, এবার ব্যাটারা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করুক। 

রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও সাহাবীগণ অবরুদ্ধ হয়ে রইলেন। বড় কোন সংঘর্ষ তখনও হয়নি। হঠাৎ কুরায়শের কতক অশ্বারোহী সাহসী যোদ্ধা বনূ আমির ইবন লুওয়াই গোত্রের আমর ইবন আবদে উদ, ইকরিমা ইবন আবু জাহল, হুরায়রা ইবন আবু ওয়াহব মাখযুমী, দিরার ইবন খাত্তাব ইবন মিরদাস প্রমুখ সম্মুখ যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। তারা তাদের অশ্ব দলে চেপে বসল এবং বনূ কিনানা গোত্রের অবস্থান ক্ষেত্রে গিয়ে বলল, হে বনূ কিনানা গোত্র! যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হও। আজই তোমরা বুঝতে পারবে অশ্বারোহী যোদ্ধা কাকে বলে। এরপর তারা বীরত্বের সাথে ঘোড়া হাকিয়ে পরিখার নিকট পৌঁছে। পরিখা দেখতে পেয়ে তারা বলল, হায় আল্লাহ! এ যে, এক নতুন ফন্দী দেখছি। আরবরা তো এমন কৌশল কোনদিন অবলম্বন করেনি। প্রশস্ত পরিখা অতিক্রমে অপারগ হয়ে তারা এমন স্থান খুঁজতে লাগল যেখানে পরিখার প্রশস্ততা কম । খন্দক ও সালা পাহাড়ের মধ্যবর্তী এরূপ একটি স্থানে তারা গিয়ে পৌঁছে। ঘোড়া হাকিয়ে তারা পরিখা পারও হয়ে যায় এবং তাদেরকে নিয়ে তাদের অশ্বগুলো পরিখা ও গিরিপথের মধ্যখানে লাফাতে থাকে। এদিকে কয়েকজন মুসলিম যোদ্ধা নিয়ে বেরিয়ে এলেন হযরত আলী (রা)। যে পথে শত্রু পক্ষ পরিখা পার হয়েছিল তাঁরা সেখানে এলেন। শত্রুপক্ষের অশ্বারোহিরা বীরত্বের সাথে তাদের দিকে এগিয়ে গেল । শত্রুপক্ষের আমর ইবন আব্‌দ উদ্দ বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। এই যখমের জন্যেই সে উহুদ যুদ্ধে সে অংশ নিতে পারেনি। তাই খন্দক যুদ্ধে বীরত্ব দেখানোর জন্যে পতাকা হাতে বের হয়। অশ্বারোহী সঙ্গিগণ সহ পরিখা পার হয়ে সে মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বলে, কে আছ যে, আমার সাথে লড়াই করতে আসবে? তার মুকাবিলায় বেরিয়ে আসলেন হযরত আলী (রা)। তিনি বললেন, হে আমর! তুমি তো আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিলে যে, কোন কুরায়শী লোক যদি তোমাকে দুটো প্রস্তাব দেয় তুমি দুটোর যে কোন একটি মেনে নিবে। সে বলল, হাঁ তাইতো। হযরত আলী বললেন, তবে আমি তোমাকে আল্লাহর পথে, তাঁর রাসূলের পথে এবং ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। আমর বলল, না ও সবের আমার কোন প্রয়োজন নেই । হযরত আলী (রা) বললেন, তবে আমি তোমাকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার আহ্বান জানাচ্ছি। সে বলল, ভাতিজা আল্লাহর কসম, তোমার মত যুবককে হত্যা করতে আমি পসন্দ করি না। হযরত আলী (রা) বললেন, আমি কিন্তু তোমাকে হত্যা করতে খুবই আগ্রহী। একথা শুনে আমর রেগে যায় এবং ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে। আপন তরবারিতে সে নিজের ঘোড়ার পা কেটে দিয়ে তার মুখে আঘাত করে। এরপর হযরত আলীর (রা) সম্মুখে উপস্থিত হয়। উভয়ে তরবারি পরিচালনা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত হযরত আলী (রা) ওকে হত্যা করেন। তার সাথী অশ্বারোহিগণ পরাজয় বরণ করে, পরিখা পার হয়ে পালিয়ে যায়। 

ইন ইসহাক বলেন, এ প্রসংগে হযরত আলী (রা) নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেন : 

সে সাহায্য করেছে পাথরের মূর্তির । এটি ছিল তার মূর্খতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত । আমি সাহায্য করেছি মুহাম্মাদ (সা)-এর প্রতিপালকের। আমি অনুসরণ করেছি সঠিক পথের । 

তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে আমি যখন ফিরে আসি তখন তাকে মনে হয়েছিল বালুস্তূপ ও পাহাড়ী টিলার মাঝখানে সে একটি কর্তিত বৃক্ষ-কাণ্ড। 

আমি তার কাপড়-চোপড় ও অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে এসেছি। আমি যদি কাতারী জামা পরিধান করতে চাইতাম তবে তা পারতাম। কিন্তু আমার কাপড়ই আমার জন্যে যথেষ্ট। 

হে সম্মিলিত শত্ৰু-বাহিনী। কখনো মনে করোনা যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর দীনকে এবং তাঁর নবীকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবেন। 

ইবন হিশাম বলেন, কবিতা বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে সন্দেহ করেন যে, এটি আলী (রা)-এর কবিতা কিনা। ইবন হিশাম বলেন, আমরের করুণ অবস্থা দেখে ইকরামা সেদিন বশা ফেলে পালিয়ে বেঁচেছিল। এ প্রসংগে হাসসান ইবন ছাবিত (রা) বলেন : 

আমাদের জন্যে বর্শা ফেলে রেখে সে পালিয়ে গিয়েছে। তুমি যদি বীর পুরুষ হতে তবে এরূপ করতে পারতে না। 

তুমি তো পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়েছ। যেমন উটপাখী তার স্থান থেকে পালায় । 

বন্ধুত্ব ও সহানুভূতি লাভের আশায় তুমি পিছনে ফিরে তাকাওনি তোমার ঘাড় যেন ছিল ভলুকের ঘাড়। 

ইব্‌ন হিশাম বলেন, — শব্দের অর্থ হচ্ছে ভলুক ছানা । 

হাফিয বায়হাকী তার দালাইল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইবন ইসহাক থেকে যে, আমর ইবন আবৃন্দ উদ্দ লৌহ বর্মে মুখ ঢেকে উপস্থিত হয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে। সে হাঁক ছেড়ে বলল, কে আছ যে, আমার সাথে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে? হযরত আলী (রা) দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অনুমতি চেয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমি আছি ওর বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সে যে আমর, তুমি বসে পড়! আমর আবার হাঁক ছেড়ে বলল, এমন কোন বীর পুরুষ কি নেই যে আমার সাথে লড়াই করতে পারবে? সে মুসলমানদেরকে বিদ্রূপ করতে লাগল এবং বলল, তোমাদের ওই জান্নাত কোথায় যা সম্পর্কে তোমরা বলে থাক যে, তোমাদের কেউ নিহত হলে ওই জান্নাতে প্রবেশ করবে? তোমরা কোন পুরুষকে আমার সাথে লড়তে পাঠাচ্ছনা কেন? হযরত আলী (রা) দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি বসে পড়। আমর তৃতীয়বার হাঁক ছেড়ে বলল : 

আমি তো ওদের সকলকে উদ্দেশ্য করে ডাক ছেড়ে বলেছি, তোমাদের মধ্যে লড়াই করার কেউ আছে কি? 

আমি তো আমার অবস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বীর পুরুষের মত যখন সাহসী বীর পুরুষ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । 

তা এজন্যে যে, তরবারি পরিচালনার পূর্বেই আমি শত্রুকে ঘায়েল করতে অভ্যস্ত। 

নিঃসন্দেহে যুবকের মধ্যে বীরত্ব-সাহসিকতা ও দানশীলতা থাকা তার জন্যে সর্বোত্তম সম্পদ। 

বর্ণনাকারী বলেন, এবারও হযরত আলী (রা) উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ওযে আমর! হযরত আলী (রা) বললেন, সে অমর হলেও আমি তার মুকাবিলার জন্য প্রস্তুত। এবার রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে অনুমতি দিলেন । তিনি এগিয়ে গেলেন আমরের দিকে এবং বললেন :

ওহে, তুমি অত তাড়াহুড়া করো না। তোমার হাঁক-ডাকের উপযুক্ত জবাব দানকারী তোমার সম্মুখে এসে পড়েছে। এই ব্যক্তি অক্ষম ও দুর্বল নয়। 

উদ্দেশ্য ও দূরদৃষ্টিতে মোটেই অক্ষম নয় । তদুপরি সত্য হল সকল সফলতার চাবিকাঠি। 

আমি আশা করছি যে, আমি তোমার সবদেহের উপর বিলাপকারিণীর ব্যবস্থা করব। 

এমন এক তরবারির আঘাতে আমি তোমার মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দিব যে আঘাত প্রচণ্ড কর্তন শক্তি সম্পন্ন । প্রত্যেক যুদ্ধের সময় ওই আঘাতের কথা মানুষ স্মরণ করবে। 

হযরত আলী (রা)-এর রণ-হুংকার শুনে আমর বলল, “তুমি কে?” তিনি বললেন, “আমি আলী” সে বলল, আব্‌দ মানাফের পুত্র আলী? তিনি বললেন, না, আমি আবু তালিবের পুত্র আলী। সে বলল, “ভাতিজা! তোমার তো অনেক চাচা আছে যারা তোমার চেয়ে বয়স্ক ওদের কাউকে পাঠাও, আমিতো তোমার মত বাচ্চা ছেলের রক্ত প্রবাহিত করতে চাই না।” হযরত আলী (রা) তার উদ্দেশ্যে বললেন, তবে আল্লাহর কসম! আমি তোমার রক্ত প্রবাহিত করাকে অপসন্দ করি না। এ কথায় আমর রেগে অগ্নিশর্মা হল । সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ল। তার তরবারি কোষমুক্ত করে উঁচিয়ে ধরল। সেটি যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। এরপর রাগে গরগর করতে করতে সে অগ্রসর হল হযরত আলী (রা)-এর দিকে। হযরত আলী (রা) আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে ঢাল প্রস্তুত রেখে এগিয়ে গেলেন। আমর আক্রমণ করল হযরত আলী (রা)-এর ঢালের উপর । ঢাল কেটে তরবারি বের হয়ে তা গিয়ে লাগল হযরত আলী (রা)-এর মাথায়। তাঁর মাথা যখম হয়ে গেল । হযরত আলী (রা) পাল্টা আক্রমণ করেন আমরের ঘাড়ের শিরায়। অমনি সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকবীরধ্বনি শুনলেন। তাতে আমরা বুঝে নিলাম যে, আলী (রা) তাকে হত্যা করেছেন। তখন হযরত আলী (রা) বললেন : 

ওহে আলী! এভাবে তুমি শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী যোদ্ধাদেরকে তাড়িয়ে দিবে আমার নিকট থেকে এবং মুসলমানদের নিকট থেকে। তুমি আমার সাথীদেরকে ওদের আক্রমণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। 

আমার আত্মমর্যাদাবোধ আজ আমাকে পিছু হটতে বারণ করছে, আমি তরবারির তীক্ষ্ণ আঘাত করি মাথায়। মুখে নয়। তিনি আরো বললেন :

সে তার বিবেক ও বিবেচনার ভ্রান্তি ও বোকামীর কারণে পাথর পূজা তথা মূর্তি পূজা করেছে। আর আমি সত্য ও সরল পথের অনুসরণে মুহাম্মদের (সা) প্রতিপালক মহান আল্লাহর ইবাদত করেছি।– শেষ পর্যন্ত । এবার আলী (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁর চোখে মুখে তখন আনন্দের দ্যুতি। উমর ইবন খাত্তাব (রা) বললেন, আরে, ওর যুদ্ধের লৌহবর্ম খুলে নিয়ে এলে না কেন? তার বর্মের চেয়ে উৎকৃষ্ট বর্ম তো সমগ্র আরবে আর নেই। আলী (রা) বললেন, আমি তাকে আঘাত করেছি। সে তার লজ্জাস্থান উন্মুক্ত করে আত্মরক্ষার প্রয়াস পেয়েছে। তার ভাতিজা সম্বোধনের কারণে যুদ্ধে বর্ম খুলে নিয়ে তাকে বিবস্ত্র করতে আমি লজ্জাবোধ করেছি। অবশেষে আমরের সাথী অশ্বারোহীরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়।

বায়হাকী ইবন ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, আলী (রা) শত্রুনেতা আমরের কণ্ঠনালীর গোড়াতে তরবারি দিয়ে এমন আঘাত করেন যে তা তার মূত্রনালী ভেদ করে যায় । ফলে সে পরিখার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে। মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট প্রস্তাব পাঠায় যে, তারা ১০,০০০ দিরহামের বিনিময়ে আমরের লাশ কিনে নিবে। তিনি জবাবে বলেন যে, ওর লাশ তোমরা এমনিতেই নিয়ে যাও। আমরা লাশ বিক্রি করে মূল্য খাই না।

ইমাম আহমদ বলেন, নাসর ইবন বাব ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন । তিনি বলেছেন, মুসলমানগণ খন্দকের যুদ্ধ দিবসে জনৈক মুশরিককে হত্যা করেন। ওরা লোকটির লাশের বিনিময়ে অর্থ-সম্পদ দিতে চায়। এ প্রসংগে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, ওর লাশ ওদেরকে এমনিতেই দিয়ে দাও। কারণ নাপাক লাশের বিনিময় ও মুক্তিপণও নাপাক। তিনি এজন্যে মুশরিকদের নিকট থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ করেননি। 

বায়হাকী এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন, হাম্মাদ ইবন সালামা ইবন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তবে তাতে তাদের বিনিময় মূল্য ১০,০০০ স্থলে ১২,০০০ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ প্রসঙ্গে বললেন, ওর লাশের মধ্যেও আমাদের কোন কল্যাণ নেই, ওর লাশের মূল্যের মধ্যেও আমাদের কোন কল্যাণ নেই। 

তিরমিযী এটি বর্ণনা করেছেন সুফিয়ান ছাওরী ইব্‌ন আব্বাস সূত্রে। তিনি মন্তব্য করেছেন যে, এটি গরীব পর্যায়ের বর্ণনা। মূসা ইবন উবা উল্লেখ করেছেন যে, মুশরিকরা নাওফল ইবন আবদুল্লাহ্ মাখযুমীর নিহত হওয়ার পর লাশ ফেরত চেয়েছিল। আর মুক্তিপণ দেয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন–সেতো খাবীছ নাপাক। তার মুক্তিপণও নাপাক। তার উপর আল্লাহর লানত। তার মুক্তিপণের উপরও আল্লাহর লা’নত । ওর মুক্তিপণে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। ওকে দাফন করতে আমরা তোমাদেরকে বাধা দেবনা। 

ইউনুস ইবন বুকায়র বর্ণনা করেছেন। ইবন ইসহাক থেকে, তিনি বলেছেন যে, নাওফল ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন মুগীরা মাখযুমী মাঠে এসে মুসলিম পক্ষকে মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানায় । তাকে মুকাবিলার জন্যে এগিয়ে আসেন যুবায়র ইব্‌ন আওয়াম (রা)। তিনি প্রচণ্ড আঘাত হানেন তার উপর। এক আঘাতে তিনি তাকে দু’টুকরো করে ফেলেন । তাতে তাঁর তরবারির ধার নষ্ট হয়ে যায়। তিনি নিম্নের পংক্তি উচ্চারণ করতে করতে তাঁবুতে ফিরে আসেন? 

আমি এমন এক লোক যে, আমি নিজেকে রক্ষা করি শত্রুর আক্রমণ থেকে এবং উম্মী নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা)-কে আক্রমণ থেকে রক্ষা করি । 

ইবন জারীর উল্লেখ করেছেন যে, নাওফল যখন পরিখার মধ্যে পড়ে ছুটোছুটি শুরু করে, তখন মুসলমানগণ তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করতে থাকেন। তখন সে বলতে থাকে যে, হে আরব সম্প্রদায়! আমাকে এভাবে লাঞ্ছনার সাথে মেরো না; বরং একটু সম্মানের মৃত্যু দাও। তখন হযরত আলী পরিখার মধ্যে নেমে তাকে তরবারির আঘাতে হত্যা করেন। মুশরিকরা মুক্তিপণের বিনিময়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট তার লাশ ফেরত চায়। ওদের নিকট থেকে কিছু নিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) অস্বীকার করেন এবং ওদেরকে ওই লাশ নিয়ে যাবার সুযোগ প্রদান করেন। এই বর্ণনাটিও গরীব । 

বায়হাকী (র) হাম্মাদ ইবন ইয়াযীদ– আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়র (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, খন্দকের যুদ্ধের দিবসে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল টিলার উপর অবস্থিত দুর্গে শিশু ও মহিলাদের দেখা শোনা করার। আমার সহযোগী ছিলেন উমার ইবন সালামা বাহিরে কী ঘটছে তা দেখার জন্যে আমি ও উমার ইবন আবু সালামা পালাক্রমে ঘাড় নীচু করে তাকে উপরের পিঠে উঠে বাহিরে তাকিয়ে দেখতাম। আমি সেদিন বাইরে আমার বাবাকে দেখেছি যে, তিনি একবার এদিকে এসে হামলা করছেন আবার ওদিকে গিয়ে হামলা করছেন। আর যখন কেউ কিছু উচিয়ে ধরতো তখনই তিনি সেখানে গিয়ে পৌঁছছেন। সন্ধ্যায় আমার বাবা দুর্গের মধ্যে আমাদের নিকট আসলে আমি বললাম, বাবা! আজ আপনি যা যা করেছেন আমি তা দেখেছি। তিনি বললেন, প্রিয়পুত্র। তুমি কি সত্যিই তা দেখেছ? আমি বললাম, জ্বী হাঁ” । তিনি বললেন, আমার পিতা-মাতা তোমার জন্যে কুরবান হোন। 

ইবন ইসহাক বলেন, আবু লায়লা আবদুল্লাহ্ ইবন সাহল আনসারী আমাকে জানিয়েছেন যে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আইশা (রা) খন্দক দিবসে বনূ হারিছার দুর্গে ছিলেন। ওই দুর্গটি ছিল মদীনার সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গ। সা’দ ইবন মুআযের (রা) মা ও তাঁর সাথে দুর্গে ছিলেন। হযরত আইশা (রা) বলেন, তখনও পর্দার বিধান নাযিল হয়নি। হযরত সা’দ সেখানে এসেছিলেন। তার পরিধানে ছিল একটি খাটো লৌহ বর্ম। তাঁর পুরোটা হাতই বর্মের বাহিরে ছিল। তাঁর হাতে ছিল বর্শা। তিনি বার বার জামা টানছিলেন আর বলছিলেন : 

হে জামাল! অপেক্ষা কর খুব অল্প সময়। তারপর যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হও। কারণ, মৃত্যুর নির্ধারিত সময়ে মৃত্যু বরণে কোন দোষ নেই। 

তখন তাঁর মা তাঁকে বললেন, বৎস! তুমি তাড়াতাড়ি যুদ্ধ ক্ষেত্রে চলে যাও। আল্লাহর কসম! তুমি তো দেরী করে ফেলেছ। হযরত আইশা বলেন, তখন আমি সাদের মা কে বললাম, আল্লাহর কসম, সাদের বর্মটি যদি আরেকটু বড় হত তবে আমি খুশী হতাম। সা’দের মা বললেন, আমি তো ভয় পাচ্ছি না জানি ওই খোলা অংশে এসে শক্রর তীর বিদ্ধ হয় নাকি । ঠিক তাই হল। হযরত সাদ (রা) তীর বিদ্ধ হলেন। তীরের আঘাতে তাঁর হাতের রগ কেটে গেল। 

ইবন ইসহাক বলেন, আসিম ইবন উমর ইবন কাতাদা আমাকে জানিয়েছেন যে, হায়্যান ইবন কায়স ইবন আরাকাহ্ তাঁর প্রতি তীর নিক্ষেপ করেছিল । সে ছিল বনূ আমির ইবন লুওয়াই গোত্রের লোক। হযরত সা’দ (রা) তীর বিদ্ধ হবার পর ইবন আরাকা বলেছিল, নাও এটি আমার পক্ষ থেকে তোমার উপহার । চিনে নাও আমি আরাকাহ-এর পুত্র। হযরত সা’দ (রা) বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা তোর চেহারাকে জাহান্নামের আগুনে ঘর্মাক্ত করুন । তিনি আরো বললেন, হে আল্লাহ! কুরায়শের সাথে মুসলমানদের যদি আরো যুদ্ধ আপনি অবশিষ্ট রেখে থাকেন তবে ওই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্যে আপনি আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। কারণ, অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে কুরায়শ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যদি আমার বেশী পসন্দনীয়। যেহেতু তারা আপনার রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে, তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে । হে আল্লাহ! আর যদি আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে যুদ্ধ শেষ করে দিয়ে থাকেন তবে এই যখম দ্বারা যেন আমাকে শহীদ হিসেবে মঞ্জুর করে নেন। অবশ্য বনু কুরায়যার উপযুক্ত শাস্তি দেখে আমার চোখ জুড়ানোর পূর্বে আমার মৃত্যু দিবেন না। 

ইবন ইসহাক বলেন, জনৈক বিশ্বস্ত ব্যক্তি আবদুল্লাহ্ ইবন কা’ব ইবন মালিক থেকে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, সেদিন হযরত সাদ (রা)-কে তীরে আক্রান্ত করেছে আবু উসামা 

জাশামী, সে ছিল বনু মাখযুম গোত্রের মিত্র। এ উপলক্ষে ইকরামা ইবন আবু জাহলকে উদ্দেশ্য করে আবু উসামা নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করে– 

অর্থাৎ হে ইকরামা, যখন তুমি আমাকে বলছিলে মদীনার টিলাসমূহ চিরকালের জন্য তোমার জন্যে উৎসর্গীকৃত হোক, তখন তুমি কি আমাকে ভর্ৎসনা করনি? 

আমিই কি সেই ব্যক্তি নই যে সাদকে কনুইয়ের মধ্যভাগে তীরবিদ্ধ করে প্রবহমান রক্ত ঝরিয়েছি। তাতে সা’দের জীবনাবসান হয় তারপর উঠতি বয়সের যুবতীরা ছিন্ন বসনে তার জন্যে বিলাপ করেছে। 

তুমিই সেই ব্যক্তি যে তার পক্ষ হয়ে প্রতিরোধ করেছিল। আর উবায়দা ঐ কষ্টের মুহূর্তে তার দলবলকে সাহায্যার্থে আহ্বান জানিয়েছিল । 

যখন লোকসব তার কাছ থেকে দূরে সরে পড়ে এবং অন্যরাও কাছে ঘেষতে সাহস পাচ্ছিল না। 

ইবন ইসহাক বলেন, মূলত কে তীর নিক্ষেপ করেছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন। 

ইবন হিশাম বলেন, কথিত আছে যে, হযরত সা’দ (রা)-কে তীর মেরে যখম করেছিল খাফাজা ইবন আসিম ইবন হিববান। আমি বলি, মহান আল্লাহ্ বনূ কুরায়যা গোত্র সম্পর্কে হযরত সাদ (রা) এর দু’আ কবুল করেছিলেন। ওদের ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর চোখ জুড়িয়েছিলেন। মহান আল্লাহ্ পরম দয়ায় ওদের জন্যে তাকেই ফায়সালা দানের ক্ষমতা দান করেন এবং এ দাবীটা তারাই উত্থাপন করেছিল। এ বিষয়ে বিবরণ পরবর্তীতে আসবে। হযরত সাদ (রা) রায় ঘোষণা করলেন যে, বনু কুরায়যা গোত্রের যুদ্ধক্ষম সকল পুরুষকে হত্যা করা হবে এবং তাদের শিশুদেরকে বন্দী করে রাখা হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে সা’দ! তুমি তো সাত আসমানের উপর থেকে আল্লাহর দেয়া ফায়সালার অনুরূপ ফায়সালা প্রদান করেছ। 

ইবন ইসহাক বলেন, ইয়াহয়া ইবন আব্বাদ ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়র তাঁর পিতা আব্বাদ থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, হযরত সাফিয়্যা বিন্‌ত আবদুল মুত্তালিব ফারিং দুর্গে অবস্থান করছিলেন। ওই দুর্গে হযরত হাসসান ইবন ছাবিত (রা) ও ছিলেন। সাফিয়্যা বলেন, ওই দুর্গে নারী ও শিশুসহ আমাদের সাথে হযরত হাসান (রা) ছিলেন। জনৈক ইয়াহূদী আমাদের দুর্গের নিকট এসে ঘোরাঘুরি শুরু করে। ওদিকে বনূ কুরায়যার ইয়াহুদী গোত্র রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ সময়ে ওই গোত্রের আক্রমণ থেকে আমাদের দুর্গস্থিত লোকদেরকে রক্ষা করার কেউ ছিল না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও মুসলিম সেনাবাহিনী মূল যুদ্ধ ক্ষেত্রে সম্মিলিত বাহিনীর মুখোমুখি প্রতিরোধ সৃষ্টিতে নিয়োজিত ছিলেন। ওখান থেকে এদিকে আসার কোন সুযোগ ছিল না তাদের। তখনই জনৈক ইয়াহূদী আগমন করে আমাদের দুর্গের নিকট। আমি হাস্সান (রা)-কে ডেকে বললাম, হাসসান। ওই যে, ইয়াহূদীকে দেখছ, সে আমাদের দুর্গের চারিদিকে ঘুরছে। আমি আশংকা করছি যে, আমাদের এখানে আশ্রয় নেয়া মহিলা ও শিশুদের কথা সে ইয়াহূদীদেরকে জানিয়ে দেবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তার সাহাবীগণতো যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যস্ত। আপনি নীচে নামুন এবং এই ইয়াহূদীকে হত্যা করুন। হাস্সান বললেন, হে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা! আল্লাহ্ আপনাকে ক্ষমা করুন! আপনি জানেন যে, আমি ওই কাজের যোগ্য নই। সাফিয়্যা (রা) বলেন, তিনি যখন এ কথা বললেন, তখন আমি দেখলাম যে, তাকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। তখন আমি কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে নিলাম। তারপর একটি লাঠি হাতে দুর্গ থেকে নেমে এসে ওই ইয়াহূদীকে লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করলাম। তাতেই তার মৃত্যু হয়। তাকে হত্যা করে আমি দুর্গে ফিরে আসি। হাস্সান (রা)-কে বলি, এবার যান ওর অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের পোশাক খুলে আনুন। ও পুরুষ হওয়াতে আমি তা খুলে আনিনি। হাসসান (রা) বললেন, হে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা, ওর অস্ত্রশস্ত্র ও পোষাকের আমার কোন প্রয়োজন নেই। [টীকা ও সুহায়লী এ বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যদি তা বিশুদ্ধ হয়েও থাকে তবে হয়তো সেদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। ইবন আবদুল বার এ বর্ণনাটির বিশুদ্ধতা অস্বীকার করেছেন। (দ্র. মূলগ্রন্থ পাদটীকা) ]

মূসা ইবন উবা বলেন, মুশরিকরা ঘিরে রেখেছিল মুসলমানদেরকে। ওদের সৈন্যরা সশস্ত্র পাহারায় রেখেছিল মুসলমানদেরকে। প্রায় বিশদিন অবরোধ করে রাখার পর মুশরিক সৈন্য একযোগে সকল দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। ওদের প্রতি সতর্ক মনোযোগ নিবদ্ধ রাখার কারণে নামাযীদের নামাযে সন্দেহ হয়ে যেত যে নামায পূর্ণভাবে আদায় হয়েছে কি না। শত্রুপক্ষ একযোগে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তাঁবুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেটি ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী বাহিনী, সেদিন পূর্ণ দিন মুসলমানগণ ওদেরকে প্রতিরোধের জন্যে যুদ্ধ করেন । ঠিক আসর নামাযের সময় শত্রুপক্ষ কাছাকাছি এসে পৌঁছে। ফলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সহ সাহাবীগণের কেউই যথা সময়ে আসরের নামায আদায় করতে পারেন নি। রাতের বেলা শত্রু সৈন্য ফিরে যায়। হাদীছ বিশারদগণ বলেন যে, এ সময়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন : “ওরা আমাদেরকে আসর নামায আদায়ে বাধা দিয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা ওদের পেট ও অন্তর আগুনে পূর্ণ করে দিন। এক বর্ণনায় আছে যে, আরো বলেছিলেন এবং ওদের কবরগুলো আগুনে পূর্ণ করে দিন। 

কষ্ট যখন বৃদ্ধি পেল তখন বহুলোক মুনাফিকী প্রদর্শন করতে লাগল এবং বিভিন্ন অশালীন কথাবার্তা বলতে লাগল। মুসলমানদের এই দুঃখ-কষ্ট দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে সুসংবাদ দিতে শুরু করলেন এবং বলতে লাগলেন : “যে মহান প্রভুর হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম! এই বালা-মুসীবত অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলা দূর করবেন। আমি অবশ্যই আশা রাখি যে, আমি নিরাপদে বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করব এবং এও আশা রাখি যে, আমার হাতে আল্লাহ্ তা’আলা কা’বা গৃহের চাবি প্রদান করবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলা রোমান ও পারস্য সম্রাটকে ধ্বংস করবেন। আর তাদের ধন-সম্পদ তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। 

বুখারী বলেন, ইসহাক হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) খন্দক যুদ্ধের দিবসে বলেছিলেন “আল্লাহ্ তা’আলা ওদের গৃহসমূহ ও কবরসমূহ আগুনে পূর্ণ করে দিন। যেমন  তারা আমাদেরকে আসরের নামায আদায় করা থেকে বিরত রেখেছে। এ অবস্থায়ই সূর্য ডুবে যায়। অন্যান্য ইমামগণও এরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে ইবন মাজাহ এটি বর্ণনা করেছেন হিশাম ইবন হাসান আলী (রা) সূত্রে। মুসলিম ও তিরমিযী সাঈদ ইবন আবু আরূবা আলী (রা) সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী (র) বলেন, এটি হাসান ও সহীহ্ হাদীছ। 

বুখারী (র) বলেছেন, মক্কী ইবন ইব্রাহীম জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, খন্দকের যুদ্ধের দিন সূর্যাস্তের পর হযরত উমর (রা) কুরায়শদেরকে গালমন্দ শুরু করেন এবং বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! সূর্য প্রায় ডুবছে আমি কিন্তু এখনও আসরের নামায আদায় করতে পারিনি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আল্লাহর কসম, আমিও ওই নামায আদায় করতে পারিনি। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-সহ আমরা বুতহান অঞ্চলে গেলাম। তিনি উযূ করলেন। আমরাও উযু করলাম। তারপর তিনি সূর্যাস্তের পর আসরের নামায পড়লেন এবং আসরের পর মাগরিব আদায় করলেন। ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ (র) ইয়াহইয়া ইবন আবু কাছীর সূত্রে আবু সালামা থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। 

ইমাম আহমদ (র) বলেন, আবদুস সামাদ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একটুও অবসর পাননি। এ অবস্থাতেই আসরের ওয়াক্ত চলে যায়। তখন তিনি বললেন : “হে আল্লাহ্! যারা আমাদেরকে মধ্যবর্তী নামায থেকে বাধা দিল আপনি ওদের ঘরগুলোকে আগুনে পূর্ণ করে দিন এবং ওদের কবরগুলোকে আগুনে পূর্ণ করে দিন। ইমাম আহমদ এরূপ একক বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এটি হিলাল ইবন খাব্বাব আবাদী কূফী এর বর্ণনা। তিনি একজন বিশ্বস্ত রাবী। তিরমিযী ও অন্যান্যগণ তার বর্ণনা বিশুদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন। 

এই সকল হাদীছ দ্বারা একদল আলিম প্রমাণ করেন যে, মধ্যবর্তী নামায হল আসরের নামায। এ সব হাদীছ দ্বারা তা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়। কাযী মাওয়ারদী বলেছেন যে, এটাই ইমাম শাফিঈ (র)-এর অভিমত। কারণ, এই হাদীছগুলো বিশুদ্ধ সহীহ্। এবিষয়টি আমরা — তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে। (২ বাকারা : ২৩৮)। আয়াতের ব্যাখ্যায় দলীল প্রমাণসহ উল্লেখ করেছি। 

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে একদল এ মত গ্রহণ করেছেন যে, যুদ্ধ বিগ্রহের উযরের কারণে আসরের নামায নির্দিষ্ট সময় থেকে বিলম্বিত করা বৈধ। এটি ইমাম মাকহুল ও আওযাঈ-এর অভিমত। ইমাম বুখারী এই শিরোনামে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। এ হাদীছ দ্বারা তিনি দলীল পেশ করেছেন। আরো একটি দলীল পেশ করেছেন যে, বনু কুরায় যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) সংশ্লিষ্ট সবাইকে বনূ কুরায়যা গোত্রের এলাকায় যাবার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন” — 

কেউ যেন বনূ কুরায়যা গোত্রের নিকট না পৌঁছে আসরের নামায আদায় না করে।” এ নির্দেশের পর সেদিন কতক লোক সময়মত পথেই আসরের নামায পড়ে নিয়েছিলেন আর কতক বনূ কুরায়যাদের এলাকায় গিয়ে সূর্যাস্তের পর আসরের নামায আদায় করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) উভয় দলের কাউকেই দোষারোপ করেননি। এ বিষয়ে দলীল স্বরূপ ইমাম বুখারী (র) সাহাবীগণের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন । তাহল হযরত উমরের যুগে ২০ হিজরীতে মুসলিম সৈন্যগণ শত্রুদের তুস্তার দুর্গ অবরোধ করেছিলেন। ওই সৈন্য দলে অনেক সাহাবা ও তাবিঈ ছিলেন। দুর্গ জয় নিকটবর্তী হওয়া এবং লড়াই বিদ্যমান থাকার কারণে তারা সেদিন ফজরের নামায সূর্যোদয়ের পরে আদায় করেছিলেন। 

অপর একদল আলিম বলেন, এ দলে ইমাম শাফিঈ (র) এবং জমহুর আলিমরাও বলেছেন যে, খন্দক দিবসের এই নিয়ম পরবর্তীকালে সালাত আল খাওফ ভয়কালীন নামাযের বিধান নাযিল হওয়ায় রহিত হয়ে গিয়েছে। খন্দক দিবসে ভয়কালীন নামাযের বিধান ছিল না বলে তাঁরা নামায বিলম্বিত করেছিলেন। অবশ্য, এ ব্যাপারটি জটিলতামুক্ত নয়। কারণ, ইবন ইসহাক বলেছেন যে, একদল উলামার মতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ভয়কালীন নামায আদায় করেছেন উছফান অভিযান কালে । আর মাগাযী ঘটনা শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ইবন ইসহাক বলেছেন যে, উছফান অভিযান পরিচালিত হয়েছিল খন্দক যুদ্ধের পূর্বে। দ্রুপ যাতুর-রিকা অভিযান পরিচালিত হয়েছিল খন্দক যুদ্ধের পূর্বে। আল্লাহই ভাল জানেন। 

কেউ কেউ বলেছেন যে, খন্দক যুদ্ধের দিনে নামায বিলম্বিত হয়েছিল ভুলবশত যেমন সহীহ্ মুসলিমের কোন কোন ভাষ্যকার তা বলেছেন এ ব্যাখ্যাও জটিলতা মুক্ত নয়। কারণ, নামাযের প্রতি সাহাবা-ই-কিরামের প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সেখানে উপস্থিত সকলেই নামাযের কথা ভুলে যাবেন তা কল্পনাই করা যায় না। তা ছাড়াও বর্ণিত আছে যে, সেদিন তাঁরা যোহর, আসর ও মাগরিব তিন ওয়াক্ত নামায বিলম্বিত করেছিলেন এবং ইশার সময়ে সবগুলো নামায আদায় করেছিলেন। আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ (রা) এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। 

ইমাম আহমদ (র) বলেন, ইয়াযীদ ও হাজ্জাজ আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, খন্দক দিবসে আমরা বাধা প্রাপ্ত হই। এভাবে রাতের কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আমরা ঝামেলামুক্ত হই। এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন : 

যুদ্ধে মুমিনদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী, (৩৩- আহযাব : ২৫)। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিলাল (রা)-কে ডেকে ইকামত দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি ইকামত দিলেন। সকলে যোহরের নামায আদায় করলেন যেমন আদায় করতেন ঠিক সময়ে, তারপর আসরের জন্যে ইকামত দিলেন। আসরের নামায অনুরূপ আদায় করলেন । তারপর মাগরিবের জন্যে ইকামত দিলেন। নিয়মমত মাগরিবের নামায আদায় করলেন। তারপর ইশার নামাযের ইকামত দিলেন এবং যথা নিয়মে ইশার নামায আদায় করলেন। এটি ছিল সংশ্লিষ্ট আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বের ঘটনা। বর্ণনাকারী হাজ্জাজ বলেন, এটি ভয়কালীন নামাযের বিধান সম্পর্কে — আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বের ঘটনা। 

ইমাম নাসাঈ (র) ফাল্লাস– ইবন আবু যিব থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, মুশরিকরা খন্দক যুদ্ধের দিনে আমাদেরকে যুহরের নামায থেকে বিরত রাখে । এভাবে সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। এভাবে তিনি পূর্ণ হাদীছ বর্ণনা করেন। ইমাম আহমদ বলেন, হুশায়ম– 

আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, মুশরিকরা খন্দক যুদ্ধের দিনে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে চার ওয়াক্ত নামায আদায় করা থেকে বিরত রাখে। এভাবে রাতের কিছু অংশ ও অতিবাহিত হয়ে যায়। এরপর তিনি বিলাল (রা)-কে নির্দেশ দেন। বিলাল (রা) আযান দিলেন। তারপর ইকামত দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যুহরের নামায আদায় করলেন। তারপর বিলাল (রা) ইকামত দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আসরের নামায আদায় করলেন। তারপর বিলাল (রা) ইকামত দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাগরিবের নামায আদায় করলেন। তারপর হযরত বিলাল (রা) ইকামত দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইশার নামায আদায় করলেন। 

হাফিয আবু বকর বাযযার বলেন, মুহাম্মাদ ইবন মামার– জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) খন্দক যুদ্ধের দিন যোহর আসর, মাগরিব ও ইশার নামায আদায়ে বাধা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এরপর তিনি বিলাল (রা) কে আযান দেয়ার নির্দেশ দেন। বিলাল (রা) আযান ও ইকামত দেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যুহরের নামায আদায় করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিলাল (রা)-কে নির্দেশ দেন। তিনি আযান ও ইকামত দেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আসরের নামায আদায় করেন। তিনি বিলাল (রা)-কে আবার নির্দেশ দেন। বিলাল (রা) আযান ও ইকামত দেন। রাসূলুল্লাহ (সা) মাগরিবের নামায আদায় করেন। তারপর তিনি বিলাল (রা)-কে নির্দেশ দেন। বিলাল (রা) আযান ও ইকামত দেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইশার নামায আদায় করেন। তারপর তিনি বললেন : “তোমরা ব্যতীত জমিনের বুকে অন্য কোন সম্প্রদায় নেই যারা এই সময়ে আল্লাহর যিকর করে, আল্লাহকে স্মরণ করে।” বাযার একাই এটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে,এ সূত্র ছাড়া অন্য কোন সূত্রে এটি আমি পাইনি। কেউ কেউ এই হাদীছ আবদুল করীম– আবদুল্লাহ্ সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

খন্দকের যুদ্ধে সম্মিলিত শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুআ 

ইমাম আহমদ (র) বলেন, আবু আমির আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করে, তিনি বলেন, আমরা খন্দকের দিবসে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমরা কি এক্ষণে কোন দু’আ পাঠ করব? আমাদের প্রাণ তো এখন কণ্ঠাগত। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হাঁ এই দুআ পাঠ কর । 

হে আল্লাহ! আমাদের দোষত্রুটি গোপন রাখুন আর আমাদের ভয়-ভীতি ও অশান্তি দূর করে শান্তি দান করুন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আল্লাহ্ তা’আলা প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা বায়ু প্রেরণ করে শত্রুদের মুখ মলিন করে দিলেন। ইবন আবী হাতিম তাঁর তাফসীর গ্রন্থে তাঁর পিতা– আবু সাঈদ খুদরী সূত্রে এই হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। এটাই সঠিক। 

ইমাম আহমদ (র) বলেন, হুসায়ন– জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্মিলিত বাহিনীর অবস্থান ক্ষেত্রের নিকটস্থ মসজিদে এলেন। তিনি তাঁর চাদর খুলে রাখলেন এবং দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে দু’আ করলেন। তখন তিনি ওখানে নামায পড়েননি। এরপর তিনি আবার সেখানে এলেন এবং ওদের জন্যে বদ দু’আ করলেন। তারপর সেখানে নামায পড়লেন। 

সহীহ বুখারীও সহীহ মুসলিমে ইসমাঈল ইবন আবু খালিদ সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আবু আওফা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সম্মিলিত শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে এই বলে দু’আ করলেন : “হে আল্লাহ্! কিতাব নাযিলকারী দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী, ওই সম্মিলিত বাহিনীকে পরাস্ত করে দিন। হে আল্লাহ! ওদেরকে পরাজিত করে দিন এবং ওদের অবস্থান নড়বড়ে করে দিন। অপর এক বর্ণনায় আছে- “হে আল্লাহ্! ওদেরকে পরাজিত করে দিন এবং ওদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।” 

ইমাম বুখারী (র) বর্ণনা করেছেন, কুতায়বা আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে। তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এই কালিমা পাঠ করতেন –আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি একক । তাঁর বাহিনীকে তিনি বিজয়ী করেছেন। তাঁর বান্দাকে তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি একাই সম্মিলিত শক্র বাহিনীকে পরাজিত করেছেন। তিনি ব্যতীত চিরস্থায়ী কিছুই নেই। 

ইবন ইসহাক বলেন, বস্তুত রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ সেই করুণ ও বিপদসংকুল অবস্থায় ছিলেন। যা আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন করীমে উল্লেখ করেছেন। কারণ, শত্রু পক্ষ তাদের কাছাকাছি এসে পড়েছিল। তদুপরি ওরা উধ্বাঞ্চল নিম্নাঞ্চল সকল দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছিল। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর নুয়াইম ইবন মাসঊদ আসেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট । নুয়াইম (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমার সম্প্রদায়ের লোকজন কিন্তু আমার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জানেনা। সুতরাং আপনার যা ইচ্ছা আমাকে নির্দেশ দিন । আমি তা করব। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমাদের পক্ষে তুমি একা। সুতরাং ওদেরকে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করতে আমাদের পক্ষে তুমি যা সম্ভব তা কর। কারণ, যুদ্ধ হল কৌশল। অনুমতি পেয়ে নুয়াইম যাত্রা করলেন। তিনি এলেন বনূ কুরায়যা গোত্রের নিকট। জাহিলী যুগে ওদের সাথে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। তিনি বললেন, হে বনূ কুরায়যা গোত্র! তোমাদের সাথে আমার বন্ধুত্বের ব্যাপার তো তোমরা জান। আমার মাঝে আর তোমাদের মাঝে যে বিশেষ সম্পর্ক তাও তো তোমরা অবগত আছ। তারা বলল, হাঁ,তাই আপনি সত্য বলেছেন। আপনি আমাদের নিকট কোন সন্দেহ ভাজন ব্যক্তি নন। তিনি ওদেরকে বললেন, কুরায়শ আর গাতফান গোত্র তো তোমাদের মত নয়। এই শহর তোমাদের শহর। এখানে তোমাদের ধন-সম্পদ রয়েছে স্ত্রীপুত্র রয়েছে। তোমরা এ শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারবে না। পক্ষান্তরে, কুরায়শ ও গাতফান গোত্রের লোকদের বিষয়টি তোমাদের চেয়ে আলাদা। ওরা মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। তোমরাও এই লক্ষ্যে ওদেরকে সহযোগিতা করছ। ওদের শহর, ওদের স্ত্রীপুত্র এবং ওদের ধন-সম্পদ কিন্তু অন্যত্র। এখানে নয়। সুতরাং ওদের অবস্থা আর তোমাদের অবস্থা সমান নয়। ওরা বিজয় দেখলে তা ভোগ করবে আর অন্যথা হলে তারা নিজেদের শহরে চলে যাবে এবং তোমাদেরকে এমন এক লোকের নিকট ছেড়ে যাবে যে তোমাদের শহর মদীনাতেই বসবাস করে। তোমরা তখন একাকী ও নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে। ওই ব্যক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ তোমাদের থাকবে না। সুতরাং ওই দুই গোত্রের সম্ভ্রান্ত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে যিম্মীরূপে না রেখে তোমরা ওদের সমর্থনে যুদ্ধে বের হবে না। ওই যিম্মায় থাকা সম্ভ্রান্ত লোকজন তোমাদের সাথে থাকবে জামানত হিসেবে। যতক্ষণ না তোমরা বিজয় লাভ কর। ওরা বলল, চমৎকার আপনি তো খুব ভাল কথা বলেছেন। এরপর তিনি বের হলেন। এসে উঠলেন কুরায়শ গোত্রের নিকট। আবু সুফিয়ান ও তার সাথীদেরকে তিনি বললেন, তোমাদের প্রতি আমার বন্ধুত্ব ও ভালবাসা এবং মুহাম্মাদের প্রতি আমার সম্পর্কহীনতার কথা তো তোমাদের অজানা নেই। আমার নিকট একটি গোপন সংবাদ এসেছে। সেটি তোমাদেরকে জানিয়ে দেয়া আমি দায়িত্ব মনে করেছি। তবে এই সংবাদ আমার তরফ থেকে জেনেছ তা গোপন রাখতে হবে। ওরা বলল, ঠিক আছে, তাই হবে। তিনি বললেন, তবে জেনে রেখো যে, মুহাম্মদের (সা) সাথে ইয়াহূদীদের যে চুক্তি ছিল তারা সে চুক্তি ভঙ্গ করে যে অপরাধ করেছে তার জন্যে তারা লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েছে। ওরা মুহাম্মাদ (সা)-এর নিকট প্রস্তাব পাঠিয়েছে যে, আমাদের কৃতকর্মের জন্যে আমরা অনুতপ্ত । এখন আমরা যদি কুরায়শ ও গাতফান গোত্রের নামকরা ও সম্ভ্রান্ত কতক লোক ধরে এনে আপনার হাতে তুলে দিই আর আপনি তাদেরকে হত্যা করেন এবং এরপর আমরা আপনার সাথে মিলিত হয়ে ওদের অবশিষ্ট সবাইকে সমূলে উৎখাত করে দেই, এই প্রস্তাবে হে মুহাম্মাদ (সা)! আপনি কি রাযী আছেন? উত্তরে মুহাম্মাদ (সা) সংবাদ পাঠিয়েছেন যে, হাঁ এই প্রস্তাবে আমি রাযী । নাঈম বললেন, হে কুরায়শী লোকজন! বনু কুরায়যার লোকজন যদি তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদেরকে যিম্মী রাখার জন্যে ওখানে নিয়ে যেতে চায় তবে সাবধান, তোমরা একজন লোককেও ওখানে পাঠাবে না। 

এরপর তিনি গেলেন গাতফান গোত্রের নিকট। ওদের নিকট গিয়ে তিনি বললেন, হে গাতফান গোত্র! তোমরা আমার স্ববংশীয় লোক এবং আমার আপন জন। তোমরা আমার সর্বাধিক প্রিয়জন। তোমরা আমাকে সন্দেহ করবে আমি তা মনে করি না। ওরা বলল, বটে, আপনি সত্য বলেছেন, আপনি আমাদের নিকট কোন সন্দেহ ভাজন ব্যক্তি নন। তিনি বললেন, তবে আমি তোমাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি এ খবরটি যে আমি দিয়েছি তা গোপন রাখতে হবে। এরপর তিনি কুরায়শদেরকে যা বলেছিলেন ওদেরকেও তা বললেন। কুরায়শদেরকে যেমন সতর্ক করেছিলেন এদেরকেও তেমনি সতর্ক করে দিলেন। 

৫ম হিজরী শাওয়াল মাসের শনিবার দিনে আল্লাহর সাহায্য মুহাম্মাদ (সা)-এর জন্যে নেমে এল। এভাবে যে আবু সুফিয়ান ও গাতফানী নেতারা ইকরামা ইব্‌ন আবু জাহলের নেতৃত্বে কুরায়শী ও গাতফানী লোকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় বনু কুরায়যা গোত্রের নিকট। ওরা গিয়ে বনু কুরায়যার লোকদেরকে বলেছিল যে, আমরা এখানে স্থায়ী থাকার মত অবস্থানে নেই। আমাদের গাধা-ঘোড়া ও গরু ছাগল সব শেষ হয়ে গিয়েছে। সুতরাং যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হও। যাতে আমরা মুহাম্মাদ (সা)-কে পরাস্ত করে, এই ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারি। উত্তরে বনু কুরায় বলল, আজ শনিবার। শনিবারে আমরা কোন কাজই করিনা, আমাদের কেউ কেউ শনিবারে কাজ করে বিপদগ্রস্ত হয়েছে তাও তোমাদের অজানা নেই। উপরন্তু তোমাদের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদেরকে আমাদের নিকট যিম্মী না রাখলে আমরা তোমাদের সাথী হয়ে মুহাম্মাদ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না। তোমাদের লোকগুলো আমাদের হাতে থাকবে জামানত স্বরূপ, যতক্ষণ না আমরা মুহাম্মাদ (সা)-এর বিরুদ্ধে বিজয়ী হই। কারণ, আমরা আশংকা করছি যে, যুদ্ধে যদি তোমরা পরাজিত হও। এবং প্রচণ্ড যুদ্ধের কারণে তোমরা নিজেদের পরিবার-পরিজন ও মালামাল নিয়ে তোমাদের শহরেই চলে যাও। আর আমাদের একা এমন এক লোকের কাছে রেখে যাও যে, ওর সাথে টিকে থাকার ক্ষমতা আমাদের ও নেই। তখন আমাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে। 

বনূ কুরায়যার উত্তর নিয়ে প্রতিনিধিদল ফিরে আসে। বিস্তারিত শুনে কুরায়শী ও গাতফানীরা বলল যে, আল্লাহর কসম, নুয়াইম ইবন মাসঊদ যা বলেছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। প্রতুত্তরে তারা বনু কুরায়যার নিকট সংবাদ পাঠাল যে, আল্লাহর কসম! আমরা আমাদের একজন লোকও তোমাদের নিকট পাঠাব না। তোমরা যদি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে যুদ্ধে অংশ নিতে চাও তবে এসে অংশ নাও। কুরায়শীদের বক্তব্য বনু কুরায়যার লোকজন অবগত হবার পর তারা লল যে, নুয়াইম ইবন মাসঊদ বলেছেন তা তো পুরোপুরি সত্য। ওদের ইচ্ছা হল, তোমাদেরকে সাথে নিয়ে ওরা যুদ্ধ করবে । যুদ্ধে বিজয়ের সম্ভাবনা দেখলে ওরা তা ভোগ করবে। অন্যথায় নিজেদের শহরের দিকে দৌড়ে পালাবে, আর তোমাদেরকে তোমাদের শহরে ওই লোকের হাতে ছেড়ে যাবে। সুতরাং কুরায়শ ও গাতফান গোত্রকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহর কসম! আমরা তোমাদের সাথী হয়ে যুদ্ধ করব না, যতক্ষণ না তোমাদের লোকজন আমাদের নিকট যিম্মী স্বরূপ রাখ। ওরাও এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল । মহান আল্লাহ্ উভয় দলের মধ্যে পরস্পর অবিশ্বাস সৃষ্টি করে তাদের লাঞ্ছনার ব্যবস্থা করে দিলেন। উপরন্তু শীতকালীন প্রচন্ড শীতের রাতে ঝঞ্ঝা বায়ু প্রেরণ করলেন। তাতে তাদের পাতিল ডেকচি উল্টে গেল এবং থালা-বাসন দূরে বহুদুরে উড়ে গেল। মূসা ইবুন উকবা নুয়াইম ইবন মাসউদ সম্পর্কে যা উল্লেখ করেছেন ইবন ইসহাকের এই বর্ণনা তার চাইতে উত্তম। বায়হাকী মূসা ইবন উক্রা সূত্রে তাঁর দালাইল গ্রন্থে এটি উদ্ধৃত করেছেন। ওই বর্ণনার মূল কথা হল- নুয়ায়ম ইবন মাসউদ যা শুনতেন তা প্রচার ও প্রকাশ করে দিতেন। ঘটনাক্রমে একদিন ইশার সময়ে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে ডেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ওহে! এদিকে এস! তিনি এলেন। তিনি বললেন, তুমি কি দেখে এসেছ। ওদিকের খবর কী? তিনি বললেন, কুরায়শ ও গাতফানের লোকেরা বনূ কুরায়যার নিকট প্রস্তাব পাঠিয়েছে যে, তারা যেন ওদের সাথে মিলে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়। বনূ কুরায়যার লোকেরা বন্ধক চেয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জামানত স্বরূপ সম্ভ্রান্ত লোকদেরকে বন্ধক রাখার শর্তে তারা হুয়াই ইবন আখতাবের প্ররোচনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে। 

রাসূলুল্লাহ (সা) নুয়াইমকে বললেন, আমি তোমাকে একটি গোপন কথা বলব তা তুমি কারো নিকট প্রকাশ করো না। তিনি বললেন, বনূ কুরায়যা গোত্র আমার নিকট প্রস্তাব পাঠিয়েছে যে, ওদের মিত্র বনূ নযীর গোত্রকে যদি মদীনায় এনে ওদের বাড়ী-ঘর ও ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দিই তাহলে তারা আমার সাথে মীমাংসায় পৌঁছবে একথা শুনে নুয়াইম ইবন মাসঊদ গেলেন। গাতফান গোত্রের নিকট। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ ও বলেছিলেন যে, –যুদ্ধ হল কৌশল মাত্র। নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের কল্যাণের কোন একটি ব্যবস্থা করে দেবেন। নুয়াইম এলেন গাতফান ও কুরায়শ গোত্রের লোকজনের নিকট এবং তাদেরকে বানূ কুরায়যার মীমাংসা প্রস্তাবের কথা জানালেন। তারা অবিলম্বে বনূ কুরায়যার নিকট ইকরামার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায় যুদ্ধে অংশ গ্রহণের আহবান জানিয়ে। ঘটনাক্রমে সেদিন ছিল শনিবার। তাই ইয়াহুদীগণ শনিবারের দোহাই দিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করে। তারপর তারা আবার মানুষ বন্ধক চায়। এভাবে আল্লাহ্ তা’আলা উভয় পক্ষের মধ্যে সন্দেহ ও বিরোধ সৃষ্টি করে দেন। আমি বলি যে, সম্ভবত বনূ কুরায়যা গোত্র চেষ্টা-সাধনার পর ও কুরায়শ ও গাতফান গোত্রের সাথে সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট মীমাংসার প্রস্তাব পাঠিয়েছিল যে, বনূ নযীর গোত্রকে মদীনায় ফিরিয়ে আনলে তারা তাঁর সাথে একটি মীমাংসায় পৌঁছবে। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইবন ইসহাক বলেন, শত্রুপক্ষের ঐক্যের ফাটল ধরার সংবাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পোঁছে। তখন শত্রুপক্ষ রাতের বেলা কী করছে তা দেখে আসার জন্যে তিনি হযরত হুযায়ফাঁকে পাঠালেন। ইবন ইসহাক বলেন, ইয়াযীদ ইবন যিয়াদ বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ ইবন কা’ব কুরাযী থেকে। তিনি বলেন, কূফার একজন লোক হুযায়ফা ইবন ইয়ামান (রা)-কে বললেন, হে আবু আবদুল্লাহ্! আপনি কি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখেছেন এবং ‘র সাহচর্য লাভ করেছেন : হুযায়ফা (রা) বললেন, হাঁ, হে ভাতিজা! সে লোকটি বলল, তবে আপনারা তখন কী করতেন তা আমাদেরকে জানান। হুযায়ফা (রা) বললেন, আল্লাহর কসম, তখন আমরা সাধ্যমত পরিশ্রম করতাম। লোকটি বলল, আল্লাহর কসম, আমরা যদি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে পেতাম তবে আমরা তাঁকে মাটিতে পা ফেলতে দিতাম না কাঁধে নিয়ে রাখতাম। হুযায়ফা (রা) বললেন, ভাতিজা, শোন, একটি ঘটনা তোমাকে বলি । আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে খন্দক যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলাম। রাতের কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) নামায আদায় করলেন। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন “কে আছ এই মুহূর্তে শত্রুপক্ষের নিকট গিয়ে ওদের অবস্থা দেখে ফিরে আসবে এবং বিনিময়ে আমি দুআ করি সে আমার জান্নাতের সাথী হবে। খবর জেনে ফিরে আসার শর্ত লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রচণ্ড ক্ষুধা, অসহ্য ঠাণ্ডা ও ভয়-ভীতির কারণে কেউই তাঁর ডাকে সাড়া দিল না। কেউ যখন প্রস্তুত হল না তখন তিনি আমাকে নাম ধরে ডাকলেন। সুনির্দিষ্টভাবে আমাকে ডাক দেয়ায় আমার না উঠে উপায় ছিল না। তিনি আমাকে বললেন, হে হুযায়ফা! তুমি যাও, শত্রুপক্ষের ভেতরে প্রবেশ কর, তারপর দেখে নাও ওরা কী করছে। আমার নিকট ফিরে আসার পূর্বে এ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলবে না। হুযায়ফা বলেন, আমি গেলাম । ওদের দলের মধ্যে ঢুকে গেলাম। ঝঞ্ঝা বায়ু ও আল্লাহর প্রেরিত প্রাকৃতিক শক্তি তখন সেখানে যা করার করছিল তাদের ডেকচি-পাতিল, আগুন ও তাঁবু কিছুই স্থির থাকছিল না। সব উপড়ে গিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। তখন আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে বলল, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! প্রত্যেকেই নিজের পাশের লোকের পরিচয় জেনে নাও এবং তার ব্যাপারে সতর্ক থেকো। হুযায়ফা (রা) বলেন, এ কথা শুনে আমি আমার পাশের লোকটিকে [টীকা : ঘটনাচক্রে তখন তার ডানে বায়ে মুআবিয়া ও আমর ইবনুল আস অবস্থান করছিলেন।– দ্র. পাদটীকা  পৃ ৩. (শেষাংশ) শারহে মাওয়াহিল লাদুন্নিয়া এর বরাতে] বললাম, তুমি কে হে? সে বলল, আমি অমুকের পুত্র অমুক ।

হুযায়ফা (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্যে ফিরে চলোম। তাঁর নিকট যখন এসে পৌঁছি তখন তিনি তাঁর এক সহধর্মিণীর নকশী চাদর গায়ে নামায পড়ছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে আমাকে তাঁর পদদ্বয়ের নিকট চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললেন এবং চাদরের এক মাথা আমার উপর ছড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি রুকূ করলেন, সিজদা করলেন। আমি তখনও তাঁর চাদরের মধ্যে, তাঁর সালাম ফিরানোর পর আমি তাঁকে শত্রুপক্ষের অবস্থান জানালাম। এদিকে কুরায়শদের মক্কা যাত্রার কথা গাতফান গোত্রের লোকেরা জানতে পায়। ফলে তারাও অবিলম্বে নিজেদের দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এ সনদটি বিচ্ছিন্ন। 

ইমাম মুসলিম (রা) এই হাদীছ তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন আমাশ– ইয়াযীদ তায়মী থেকে। তিনি বলেছিলেন, আমরা হুযায়ফা (রা)-এর পাশে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি বলল, আমরা যদি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে পেতাম তবে তাঁর সাথী হয়ে জিহাদ করতাম এবং যে কোন বিপদ হাসিমুখে বরণ করে নিতাম। তখন হুযায়ফা (রা) ওকে পূর্ব বর্ণিত ঘটনাটি আনুপূর্বিক বললেন । তুমি কি তাই করতে? তবে তাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এ কাজের জন্য তিন তিনবার আহ্বান করার পর তাকে নাম ধরে আহ্বান করেছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। 

হুযায়ফা (রা) ঐ প্রসঙ্গে তাতে বাড়তি বলেন, আমি রওয়ানা করলাম। আমি হাঁটছিলাম এমনভাবে যে, আমি যেন গোসল খানার উষ্ণতা অনুভব করছিলাম। অর্থাৎ প্রচণ্ড শীতের সামান্য ও আমি অনুভব করিনি। তিনি আরও বলেন : আমি ওদের নিকট পৌঁছে যাই। সেখানে দেখি আবু সুফিয়ান আগুনের দিকে পিঠ করে আগুন পোহাচ্ছে। আমি আমার ধনুকে তীর সাজিয়ে ফেলি এবং তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করতে উদ্যত হই। হঠাৎ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশ আমার স্মরণে আসে যে, “আমার তরফে ওদের কাউকে ভয় পাইয়ে দিয়োনা যেন। আমি থেমে যাই। কিন্তু যদি তখন তীর নিক্ষেপ করতাম তবে আমি নিশ্চিত যে, তা লক্ষ্য ভেদ করতো। আমি ওখান থেকে ফিরে এলাম যেন গোসল খানার উষ্ণতার মধ্যে হাঁটছি। আমি এসে পৌঁছি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে আসার পথে আমি আবার ঠাণ্ডা অনুভব করি। শত্রুপক্ষের অবস্থান সম্পর্কে আমি তাঁকে অবহিত করি। তিনি যে জুব্বা পরিধান করে নামায পড়ছিলেন তার অতিরিক্ত অংশ দ্বারা তিনি আমার শরীর ঢেকে দিলেন। সকাল পর্যন্ত আমি বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকি। ভোরবেলা রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে ডেকে বললেন, হে ঘুম কাতুরে ব্যক্তি উঠ! 

হাকিম এবং হাফিয বায়হাকী তার দালাইল গ্রন্থে এ হাদীছটি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন ইকরামা ইবন আম্মার— আব্দুল আযীয সূত্রে। আব্দুল আযীয হলেন হুযায়ফা (রা)-এর ভাতিজা। তিনি বলেন, একদিন হুযায়ফা (রা) তাঁর সহচরদের নিকট রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অভিযানসমূহে উপস্থিত থাকার কথা বর্ণনা করছিলেন। তাঁর সহচরগণ বললেন, 

[(দ্রঃ) এরপর আবু সুফিয়ান বলল, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম, এখন তোমরা সুস্থির। অবস্থানে নেই। রসদ পত্র, পশু-প্রাণী, খাদ্য দ্রব্য সব এখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ওই দিকে বানু। কুরায়যা গোত্র আমাদের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ওদের সম্পর্কে আমরা যে সংবাদ পেয়েছি তা দুঃখজনক। প্রচন্ড ঝঞ্ঝা বায়ুতে আমাদের এখন কী যে অবস্থা তাতো সকলেই দেখতে পাচ্ছ। ঝড়ের আঘাতে আমাদের হাড়ি পাতিল স্থির থাকে না আগুন নিভে যাচ্ছে এবং আমাদের বাসস্থান তাঁবু কিছুই টিকে থাকছে না। সুতরাং সবাই মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু কর। আমি চলোম। একথা বলে সে পাশেই বাঁধা উটের পিঠে সওয়ার হল। পিঠে উঠেই সে চাবুক মারল পিঠে তিন পায়ে লাফিয়ে । ছুটতে লাগল সেটি । পূর্ণ গতিতে উটটি যাত্রা করল । রাসুলুল্লাহ (সা)-এর সাথে আমার অঙ্গীকার ছিল। যে, তাঁর নিকট ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন ঘটনা ঘটাবনা। এই অঙ্গীকার না থাকলে আমি অনায়াসে তীর নিক্ষেপে আবু সুফিয়ানকে হত্যা করতে পারতাম। ]

“আল্লাহর কসম, আমরা যদি ওই সময় থাকতাম তবে এমন এমন উল্লেখযোগ্য কাজ করতাম। হুযায়ফা (রা) বললেন, ওই রকম অবস্থান কামনা করেনা। শোন আমরা খন্দকের যুদ্ধে রাত্রিবেলা ওখানে ছিলাম। আমরা সকলে সারিবদ্ধভাবে বসা আছি। আবু সুফয়ান ও তার বাহিনী অবস্থান করছে আমাদের উপরের দিকে। আর বনূ কুরায়যার ইয়াহূদীরা আমাদের নীচের দিকে। ওরা আমাদের নারী ও শিশুদের উপর আক্রমণ করে কিনা আমরা সেই আশংকায় ছিলাম। ওই রাতের চেয়ে অধিক ঠাণ্ডা, অন্ধকারও ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ রাত আমাদের জীবনে আর আসেনি। বাতাসের শব্দে বজ্রের নিনাদ। চারিদিকে অথৈ অন্ধকার। আমাদের কেউ নিজের আঙ্গুলটি পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিল না। মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চাচ্ছিল। তারা বলছিল, আমাদের বাড়ীঘর অরক্ষিত। প্রকৃতপক্ষে ওগুলো অরক্ষিত ছিল না। যে-ই অনুমতি চাচ্ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকেই অনুমতি দিয়ে দিচ্ছিলেন। আর মুনাফিকরা অনুমতি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কৌশলে সরে পড়ছিল। আমরা প্রায় তিনশ জনের মত ছিলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ব্যক্তিগতভাবে একে একে আমাদের সবার নিকট এলেন। এক পর্যায়ে তিনি আমার নিকট এলেন। আমার নিকট শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার কোন ঢাল ও ছিল না আর ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার কোন জামা কাপড়ও ছিল না। আমার স্ত্রীর একটি ছোট্ট চাদর আমার কাছে ছিল বটে। সেটি আমার হাঁটুর নীচে পৌঁছতো না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার নিকট এলেন। তখন আমি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসেছিলাম। তিনি বললেন, এ লোকটি কে? আমি বললাম, আমি হুযায়ফা। তিনি বললেন, হুযায়ফা! তুমি যে একেবার মাটির সাথে মিশে আছ? আমি বললাম, জ্বী হাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ! দাঁড়াতে চাইনা বলে তা করেছি। এরপর আমি দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, শত্রু শিবিরে একটি অবাক ঘটনা ঘটবে তুমি গিয়ে ওই সংবাদ নিয়ে আমার নিকট ফিরে আসবে। হুযায়ফা (রা) বলেন, আমি তখন ছিলাম সর্বাধিক ভীতি গ্রস্ত ও ঠাণ্ডায় আক্রান্ত মানুষ। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশ পালনের জন্যে আমি বের হলাম। তিনি আমার জন্যে দু’আ করে বললেন:

হে আল্লাহ্! ওকে হিফাযত করুন তার সামনের দিক থেকে, পেছনের দিক থেকে, ডান দিক থেকে, বাম দিক থেকে এবং তার উপরের দিক ও নীচের দিক থেকে। হুযায়ফা বলেন, আল্লাহর কসম, তখন থেকে আমার মধ্যে কোন ভীতি বা ঠাণ্ডাকাতর ভাব আসেনি। 

তিনি বলেন, আমি যখন যাত্রা করলাম তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে হুযায়ফা! আমার নিকট ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি শত্রু-শিবিরে কোন ঘটনা ঘটাবে না। হুয়ায়ফা বলেন, আমি বের হলাম। শত্রু সৈন্যদের কাছাকাছি এসে দেখলাম ওদের ওখানে আগুন জ্বলছে। আগুনের আলোতে আমি জনৈক হৃষ্টপুষ্ট এবং কালো বর্ণের একজন লোককে দেখতে পেলাম। সে আগুন পোহাচ্ছিল এবং কোমরে গরম হাত বুলাচ্ছিল। আর বলছিল, যাত্রা কর । যাত্রা কর । ইতিপূর্বে আমি আবু সুফয়ানকে চিনতাম না। আমি আমার তুনীর থেকে একটি তীর বের করে ধনুকে যোজন করি। আগুনের আলোতে ওকে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে আমি ওই লোকের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশ আমার স্মরণ হল । তিনি বলেছিলেন আমার নিকট ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন ঘটনা ঘটাবে না। আমি থেমে গেলাম। তীর পুনরায় তুনীতে ভরে নিলাম। এরপর আমি দুঃসাহসী হয়ে উঠলাম। যেতে যেতে শত্রু সেনাদের ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমার পাশের লোকটি ছিল বনূ আমির গোত্রের লোক। তারা ডাকাডাকি করে বলছিল, হে আমির গোত্রের লোকেরা! ফিরে চল। ফিরে চল । এখানে আর থাকা যাবে না । শত্রু সৈন্যের ওখানে শুরু হল প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা বায়ু। ঝড়ের দাপটে ওরা এক বিঘতও সম্মুখে অগ্রসর হতে পারছিল না। আল্লাহর কসম! ওদের তাঁবুতে ও বিছানায় আমি পাথরের শব্দ শুনছিলাম, ঝড়ের আঘাতে ওই পাথরগুলো উড়ে এসে ওদের তাঁবুতে পড়ছিল। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আসার জন্যে ফিরতি যাত্রা করি। অর্ধপথ অতিক্রম করার পর আমার সাথে সাক্ষাত হয় পাগড়ী পরিহিত প্রায় ২০ জন অশ্বারোহী ব্যক্তির । তারা আমাকে বলল, তোমার সাথী অর্থাৎ নবী করীম (সা)-কে জানিয়ে দিবে যে, তাঁর পক্ষে আল্লাহ্ তা’আলা সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন । 

হুযায়ফা (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে এলাম। তিনি তাঁর চাদর গায়ে নামায পড়ছিলেন। আমি ওখানে পৌঁছার সাথে সাথে আমার শীতের অনুভূতি ফিরে আসে এবং আমি অসুস্থ বোধ করতে থাকি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) নামাযে ছিলেন। তিনি আমাকে হাতে ইশারা করলেন। আমি তাঁর খুব কাছে গেলাম। তাঁর চাদরের এক অংশ তিনি আমার উপর ছেড়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিয়ম ছিল যে, কোন বড় সমস্যার সম্মুখীন হলে তিনি নামাযে মনোনিবেশ করতেন। আমি শত্রু পক্ষের খবর তাকে জানাই যে, আমি দেখে এসেছি ওরা সকলে চলে যাচ্ছে। বর্ণনাকারী বলেন, এ প্রসংগে নাযিল হয়েছে :– হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল এবং আমি ওদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম ঝঞ্ঝা বায়ু এবং এক বাহিনী যা তোমরা দেখ নাই । তোমরা যা কর আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা। যখন ওরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল উচ্চ অঞ্চল ও নিম্ন অঞ্চল হতে তোমাদের চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল কণ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ্ সম্বন্ধে নানাবিধ ধারণা পোষণ করছিলে । তখন মু’মিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল এবং মুনাফিকগণ এবং যাদের অন্তরে ছিল ব্যাধি, তারা বলছিল, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয় এবং ওদের একদল বলেছিল, হে ইয়াছরিববাসী! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোমরা ফিরে চল, এবং ওদের একদল নবীর নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলছিল, আমাদের বাড়ীঘর অরক্ষিত অথচ ওগুলো অরক্ষিত ছিল না। আসলে পলায়ন করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্যে। যদি শত্রুরা নগরীর বিভিন্ন দিক হতে প্রবেশ করে ওদেরকে বিদ্রোহের জন্যে প্ররোচিত করত তারা অবশ্যই তা-ই করত। ওরা তাতে কাল বিলম্ব করত না। এরা তো পূর্বেই আল্লাহর সাথে অংগীকার করেছিল যে, এরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। আল্লাহর সাথে কৃত অংগীকার সম্বন্ধে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে। বলুন, তোমাদের কোন লাভ হবে না যদি তোমরা মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে পলায়ন কর এবং সেক্ষেত্রে তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেওয়া হবে। বলুন,কে তোমাদেরকে আল্লাহ্ হতে রক্ষা করবে যদি তিনি তোমাদের অমংগল ইচ্ছা করেন এবং তিনি যদি তোমাদের অনুগ্রহ করতে ইচ্ছা করেন কে তোমাদের ক্ষতি করবে? ওরা আল্লাহ্ ব্যতীত নিজেদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। আল্লাহ অবশ্যই জানেন, তোমাদের মধ্যে কারা তোমাদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণে বাধা দেয় এবং তাদের ভ্রাতৃ বর্গকে বলে-”আমাদের সাথে আস” ওরা অল্পই যুদ্ধে অংশ নেয়। তোমাদের ব্যাপারে কৃপণতা বশত। যখন বিপদ আসে তখন আপনি দেখবেন মৃত্যুভয়ে মুচ্ছাতুর ব্যক্তির মত চক্ষু উল্টিয়ে ওরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যখন বিপদ চলে যায় তখন ওরা ধনের লালসায় তোমাদের–কে তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। ওরা ঈমান আনেনি।এজন্যে আল্লাহ্ ওদের কার্যাবলী নিষ্ফল করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষে তা সহজ। ওরা মনে করে সম্মিলিত বাহিনী চলে যায়নি। যদি সম্মিলিত বাহিনী আবার এসে পড়ে তখন ওরা কামনা করবে যে, ভাল হত যদি ওরা যাযাবর মরুবাসীদের সাথে থেকে তোমাদের সংবাদ নিত। ওরা তোমাদের সংগে অবস্থান করলেও ওরা যুদ্ধ অল্পই করত । তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। মু’মিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল ওরা বলে উঠল, এতো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে সত্যই বলেছিলেন, আর তাতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেল। মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অংগীকার পূর্ণ করেছে, ওদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। ওরা তাদের অংগীকারে কোন পরিবর্তন করেনি। কারণ, আল্লাহ্ সত্যবাদীদেরকে পুরস্কৃত করেন সত্যবাদিতার জন্যে এবং তাঁর ইচ্ছা হলে মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন অথবা ওদেরকে ক্ষমা করেন। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। আল্লাহ্ কাফিরদেরকে ক্রুদ্ধাবস্থায় বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করলেন। যুদ্ধে মু’মিনদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী। কিতাবীদের মধ্যে যারা ওদেরকে সাহায্য করেছিল তাদেরকে তিনি তাদের দুর্গ হতে অবতরণে বাধ্য করলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন। এখন তোমরা ওদের কতককে হত্যা করছ এবং কতককে করছ বন্দী। এবং তোমাদেরকে অধিকারী করলেন ওদের ভূমি, ঘর-বাড়ী ও ধন-সম্পদের এবং এমন ভূমির যা তোমরা এখনও পদানত করনি। আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (৩৩, আহযাব ও ৯-২৭)। “কাফিরদেরকে কুদ্ধ ও ব্যর্থ মনোরথ অবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলা ফিরিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ প্রচন্ড ঝঞ্ঝা বায়ু, ফিরিশতা এবং অন্যান্য উপায়ে আল্লাহ্ তা’আলা কাফিরদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। “মু’মিনদের জন্যে যুদ্ধে আল্লাহ্ই যথেষ্ট” অর্থাৎ মু’মিনদের যুদ্ধ করতে হয়নি, শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়নি; বরং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’আলা নিজ কুদরত ও শক্তিতে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এ বিষয়ে বর্ণিত আছে যে, আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ বাক্য পাঠ করতেন: 

আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি একক, তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, তাঁর সৈন্যবাহিনীকে বিজয় দান করেছেন। তিনি একাই সম্মিলিত শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেছেন। তিনি ব্যতীত কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আল্লাহ্ তা’আলার বাণী: 

(মু’মিনদের জন্যে যুদ্ধে আল্লাহই যথেষ্ট) আয়াতে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুসলমানদের মাঝে ও মক্কার মুশরিকদের মাঝে যুদ্ধাবস্থা শেষ হয়ে গিয়েছে। মুশরিকদের পক্ষ থেকে আক্রমণের দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। বাস্তবে তাই ঘটেছে। খন্দকের যুদ্ধ থেকে পালানোর পর কুরায়শ সম্প্রদায় আর কোন সময় মুসলমানদের উপর আক্রমণ করতে পারেনি। যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারেনি। এ প্রসংগে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) বলেছেন যে, খন্দকের যুদ্ধে উপস্থিত কুরায়শ বাহিনী খন্দক যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন : 

এই বছরের পর কুরায়শরা আর কখনও তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসবে না যুদ্ধ আক্রমণ করবে না; বরং তোমারই ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আক্রমণ করবে। বর্ণনাকারী বলেন, বস্তুতঃ এরপর কুরায়শরা আর কোনদিন মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে আসেনি। বরং রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ কুরায়শদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এমন হতে হতে এক পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা মক্কা বিজয় করিয়েছিলেন। এটি ইবন ইসহাকের বর্ণনা। 

ইমাম আহমদ (র) বলেছেন, ইয়াহইয়া– সুলায়মান ইবন সারদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : এখন আমরা ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, ওরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসবে না। ইমাম বুখারী (র) ইসমাঈল ও সুফিয়ান ছাওরী– সুলায়মান ইবন সারদ সূত্রে এরূপ বর্ণনা করেছেন। 

ইবন ইসহাক বলেন, খন্দকের যুদ্ধে বনূ আব্‌দ আশহাল গোত্রের তিনজন লোক শহীদ – হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন- সাদ ইব্‌ন মু’আয (রা) তাঁর শাহাদত বরণের বিস্তারিত আলোচনা পরে আসবে। আনাস ইব্‌ন আওফ ইবন আতীক ইবন আমর এবং আব্দুল্লাহ ইবন সাহল । এছাড়া আরো যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন- তুফায়ল ইবন নুমান, ছা’লাবা ইব্‌ন গানামা– তাঁরা দু’জন জুশম গোত্রের লোক এবং কা’ব ইব্‌ন যায়দ আল নাজ্জারী একটি অজ্ঞাতনামা তীরের আঘাতে তিনি শহীদ হন। 

ইবন ইসহাক বলেন, ওই যুদ্ধে মুশরিক পক্ষে নিহত হয় তিনজন। তারা হল মুনাবিহ ইবন উছমান ইবন উবায়দ ইব্‌ন সাববাক ইবন আবদুদ্দার। সে তীরের আঘাতে আহত হয়েছিল এবং মক্কায় পৌঁছে মারা যায়। নাওফল ইবন আব্দুল্লাহ্ ইবন মুগীরা। সে ঘোড়াসহ পরিখার মধ্যে নেমে পড়েছিল। তারপর সেখানে ছুটোছুটি করছিল। সেখানেই সে নিহত হয়। তার লাশের বিনিময়ে মোটা অংকের অর্থ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল মুশরিক পক্ষ। এ বিষয়টি ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। মুশরিকদের তৃতীয় নিহত ব্যক্তি হল আমর ইব্‌ন আবৃন্দ উদ্দ আমিরী । হযরত আলী ইবন আবু তালিব (রা) তাকে হত্যা করেন।

ইবন হিশাম বলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে আমি জেনেছি যে, যুহরী বলেছেন, ওই দিন হযরত আলী (রা) আমর ইবন আব্‌দ উদ্দ এবং তারপুত্র হাসূল ইব্‌ন আমর দু’জনকেই হত্যা করেছিলেন । ইব্‌ন হিশাম বলেন, কেউ বলেছেন, ওর নাম আমর ইব্‌ন আব্‌দ উদ্দ আর কেউ বলেছেন আমর ইবন আবদ। 

 গাযওয়া বনূ কুরায়যা 

ইসলামের দুশমনদের কুফরী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এবং খন্দকের যুদ্ধে কাফির দলের সঙ্গে সহযোগিতা সহমর্মিতার শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে পরকালের কঠোর শাস্তি ছাড়াও দুনিয়ার জীবনেই মর্মন্তুদ শাস্তিতে নিপতিত করেছেন। কাফির দলের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা কোন কাজেই আসেনি। বরং তারা আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর রোষানলে পতিত হয় এবং দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষয়-ক্ষতি ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন । 

আল্লাহ্ কাফিরদেরকে ক্রুদ্ধাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন, তারা কোন কল্যাণ লাভ করেনি। যুদ্ধে মুমিনদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ্ সর্ব শক্তিমান। পরাক্রমশালী । কিতাবীদের মধ্যে যারা ওদেরকে সাহায্য করছিল তাদেরকে তিনি তাদের দুর্গ থেকে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন; এখন তোমরা তাদের কতককে হত্যা করছ আর কতককে করছ বন্দী। আর তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে অধিকারী করেছেন তাদের ভূমি ঘর-বাড়ী, ধন-সম্পদ এবং এমন ভূমির, যাতে তোমরা এখনও পদার্পন করনি। আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (৩৩ আহ্যাব ও ২৫-২৭)। 

বুখারী (র) মুহাম্মাদ ইবন মুকাতিল– আবদুল্লাহ (ইবন উমর) সূত্রে বর্ণনা করে বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) যুদ্ধ-জিহাদ এবং হজ্জ ও উমরা থেকে প্রত্যাবর্তন করে এ দু’আ পাঠ করতেন : 

আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই, তিনিই প্রশংসার মালিক। তিনি সমস্ত কিছুর উপর সর্ব শক্তিমান। আমরা প্রত্যাবর্তনকারী তাওবাকারী, রবের ইবাদতকারী ও সিজদাকারী এবং তাঁরই প্রশংসাকারী । আল্লাহ্ তাঁর ওয়াদা সত্য করে দেখিয়েছেন তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সম্মিলিত বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছেন। 

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) প্রত্যুষে খন্দক যুদ্ধ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। আর মুসলমানরা অস্ত্রশস্ত্র খুলে ফেলেন। ইমাম যুহুরী (রা-এর বর্ণনামতে যুহরের সময় হযরত জিবরাঈল (আ) রেশমী বস্ত্রের পাগড়ি পড়ে খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এলেন। খচ্চরটির পিঠে একটি মোটা রেশমী চাদর বিছানো ছিল। তিনি বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি কি হাতিয়ার খুলে ফেলেছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইতিবাচক জবাব দিলে জিবরাঈল (আ) বললেন, ফেরেশতারাতো এখনো অস্ত্র খুলেননি। আর আমি ফিরে এসেছি কাফির সম্প্রদায়ের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য। হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ তাআলা তো আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন বনু কুরায়যার উদ্দেশ্যে অভিযানে বের হতে। আর আমিও তাদের দিকে ধাবিত হওয়ার মনস্থ করেছি। আমি তাদের অভ্যন্তরে ফাটল ধরাবো। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) একজন ঘোষককে লোকজনের মধ্যে ঘোষণা প্রচার করার নির্দেশ দান করেন । যে এ ঘোষণা শুনছে এবং অনুগত রয়েছে এমন ব্যক্তিরা যেন বনু কুরায়যার জনপদে না পৌঁছে আসরের সালাত আদায় না করে। ইবন হিশামের বর্ণনা মতে (এ সময়) রাসূলুল্লাহ (সা) আব্দুল্লাহ্ ইবন উম্মে মাকতূমকে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। আর ইমাম বুখারী (র) আব্দুল্লাহ্ ইবন আবূ শায়বা সূত্রে হযরত আইশা (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলছেন? 

রাসূলুল্লাহ্ (সা) খন্দক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে অস্ত্র খুলে গোসল করার সাথে সাথে জিব্রাঈল (আ) তাঁর নিকট আগমন করে বললেন- আপনি অস্ত্র খুলে ফেলেছেন? আল্লাহর কসম! আমরা এখনো অস্ত্র খুলিনি। আপনি ওদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ন! তিনি জানতে চাইলেন, কোন্ দিকে? জিব্রাইল (আ) বললেন, এদিকে। একথা বলে তিনি বনূ কুরায়যার প্রতি ইঙ্গিত করলেন। তখন নবী করীম (সা) বের হয়ে পড়লেন। ইমাম আহমদ (র) হাসান ও আইশা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আহযাব যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে গোসল করার জন্য গোসল খানায় প্রবেশ করলে তাঁর নিকট হযরত জিব্রাঈল (আ) আগমন করলেন । দরজার ফাঁক দিয়ে আমি জিব্রাঈল (আ)-কে দেখতে পাই যে, তাঁর মাথায় ধুলাবালি লেগে আছে। তখন তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনারা কি অস্ত্র খুলে রেখেছেন? আমরাতো এখনো অস্ত্র খুলিনি। আপনি দ্রুত বনূ কুরায়যা অভিমুখে রওয়ানা করুন। 

ইমাম বুখারী (র) মূসা, জারীর–আনাস ইবন মালিক সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন বনু কুরায়যা অভিমুখে রওয়ানা করেন তখন বনূ গনম এর গলিতে জিব্রাঈল (আ)-এর সওয়ারীর (চলাচলের ফলে উখিত) ধূলাবালি যেন আমি নিজ চক্ষে অবলোকন করছি । অতঃপর ইমাম বুখারী (র) আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ— ইবন উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আহযাব যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন : বনূ কুরায়যার এলাকায় না পৌঁছে কেউ যেন আসরের সালাত আদায় না করে। পথে কারো কারো আসরের সালাতের সময় হয়ে যায়। তখন কেউ কেউ বললেন, আমরা বনূ কুরায়যায় জনপদে না পৌঁছে আসরের সালাত আদায় করবো না। আবার কেউ কেউ বললো, বরং আমরা সালাত আদায় করে নেবো। আমরা সালাত আদায় না করি এটা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উদ্দেশ্য ছিল না, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে আলোচনা করা হলে তিনি কারো ক্ষেত্রেই অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করলেন না। মুসলিম (র) ও আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মাদ ইব্‌ন আসমা সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম বায়হাকী হাফিয আবু আবদুল্লাহ কাযী আবু বকর আহমদ ইবন হাসান-এর সূত্র উল্লেখ করেন ও আবুল আব্বাস মুহাম্মাদ ইবন কাব ইবন মালিক তাঁর চাচা উবায়দুল্লাহর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) আহযাব এর অনুসন্ধান শেষে ফিরে এসে লৌহ বর্ম খুলে ফেলে গোসল করলে হযরত জিব্রাঈল (আ) এসে বললেন : আপনি তো দেখছি যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়েছেন। আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আপনি লৌহ বর্ম খুলে ফেলেছেন। আমরা তো এখনো তা খুলিনি, বর্ণনাকারী বলেন যে, একথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ব্যস্ত হয়ে উঠেন এবং সকলকে এ মর্মে তাগিদ দেন যে, তারা যেন বনু কুরায়যার জনপদে পৌঁছেই আসরের সালাত আদায় করেন। রাবী বলেন যে, সকলেই অস্ত্র ধারণ করেন এবং বনু কুরায়যার জনপদে পৌঁছার পূর্বেই সূর্য অস্তমিত হয়। সূর্যাস্ত কালে লোকদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। তাদের একদল বললেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে তাকীদ করেছেন যে, আমরা যেন বনূ কুরায়যার জনপদে না পৌঁছে আসরের সালাত আদায় না করি। তাই আমরা তার তাকীদ অনুযায়ী কাজ করেছি। সুতরাং নামায আদায় না করায় আমাদের কোন গুনাহ হবে না। সাওয়াবের আশায় একদল সালাত আদায় করেন আর অপর দল সূর্যাস্ত পর্যন্ত নামায আদায়ে ক্ষান্ত থাকেন। সুতরাং তারা সাওয়াবের আশায় বনূ কুরায়যার জনপদে পৌঁছে সালাত আদায় করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এ দু’দলের কাউকেই ভৎর্সনা করেননি। বায়হাকী (র) আবদুল্লাহ আল-উমরী সূত্রে– আইশার বরাতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর কাছে ছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি আগমন করে তাঁকে সালাম দিলে তিনি ঘাবড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আমিও রাসূল (সা)-এর সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যাই । দেখতে পাই যে, তিনি (আগন্তুক ব্যক্তি) দিহইয়া আল-কালবী। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তখন বললেন, ইনি জিব্রাঈল (আ)। বনূ কুরায়যা অভিমুখে যাত্রা করার জন্যে তিনি আমাকে বলে গেলেন। জিব্রাঈল (আ) বললেন, আপনারা তো অস্ত্র খুলে ফেলেছেন। কিন্তু আমরা এখনো অস্ত্র খুলিনি। মুশরিকদের পশ্চাদ্ধাবন করে আমরা হাম্রাউল আসাদ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। আর এটা সে সময়ের কথা যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) খন্দক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাঁর সাহাবীগণকে বলেন যে, আমি তোমাদেরকে জোর নির্দেশ দিচ্ছি যে, তোমরা বনূ কুরায়যার জনপদে না পৌঁছে আসরের সালাত আদায় করবে না। তাঁরা সেখানে পৌঁছার পূর্বেই সূর্য অস্ত যায়। তখন একদল বললো যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এটা অভিপ্রেত ছিল না যে, তোমরা নামায ত্যাগ করবে; কাজেই তোমরা পথেই (সময়মত) নামায আদায় করে নাও। অপর দল বলে, আল্লাহর শপথ, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশের উপর কঠোরভাবে অটল রয়েছি। কাজেই আমাদের কোন গুনাহ হবে না। তাই ছাওয়াব লাভের আশায় একদল সালাত আদায় করেন আর সাওয়াবের প্রত্যাশায় অপর দল সালাত আদায়ে বিরত থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এ দুদলের কোন দলের প্রতিই কঠোরতা দেখাননি। আল্লাহর নবী বের হয়ে বনু কুরায়যার এক দল লোকের সমাবেশের নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে জিজ্ঞেস করলেন এর মধ্যে তোমাদের নিকট দিয়ে কেউ কি অতিক্রম করেছে? তারা বললো, একটা খচ্চরে চড়ে দিহইয়া কালবী এ দিক দিয়ে গিয়েছেন। খচ্চরটির পিঠে একটা রেশমী চাদর বিছানো ছিল। তিনি বললেন, ইনি ছিলেন জিব্রাঈল (আ)। বনু কুরায়যাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার জন্য তিনি প্রেরিত হয়েছেন। নবী করীম (সা) তাদেরকে অবরোধ করে ফেললেন এবং সাহাবীগণকে নির্দেশ দিলেন তারা যেন তাঁকে ঘিরে শক্র থেকে আড়াল করে রাখেন। যাতে তিনি নিজেই তাদের কথা শুনতে পান। নবী করীম (সা) তাদেরকে ডাক দিয়ে বললেন : হে শূকর আর বানরের সমগোত্রীয়রা! তারা বললো : হে আবুল কাসিম! তুমি তো কোন দিন অশ্লীল ভাষী ছিলে না। মুসলমানরা বনূ কুরায়যাকে অবরোধ করে রাখেন। অবশেষে তারা হযরত সা’দ ইবন মু’আযকে সালিশ মানতে রাযী হল। তিনি ছিলেন বনূ কুরায়যার মিত্র। সা’দ ইবন মু’আয (রা) তাদের ব্যাপারে রায় দেন যে, তাদের যুদ্ধক্ষম পুরুষদেরকে হত্যা করা হোক আর নারী এবং শিশুদেরকে বন্দী করা হোক। আইশা (রা) প্রমুখ থেকে বিভিন্ন উত্তম সনদে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। 

আসরের নামায আদায়ের ব্যাপারে কাদের মত সঠিক ছিল। এ ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে সর্বসম্মত অভিমত এইযে, উভয় পক্ষই ছাওয়াব এবং মাগফিরাত পাবেন। তাদের মধ্যে কোন পক্ষই ভর্ৎসনীয় নন। 

তবে একদল আলিম বলেন যে, সে দিন যারা নির্ধারিত সময়ের পর বনূ কুরায়যার জনপদে গিয়ে সালাত আদায় করেছিলেন তারাই সঠিক কাজটি করেছিলেন। কারণ, সে দিন নামায বিলম্বিত করার নির্দেশ ছিল একটা বিশেষ নির্দেশ। কাজেই শরীআত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করার সাধারণ নির্দেশের উপর এ বিশেষ নির্দেশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে । আবু মুহাম্মাদ ইবন হাযম যাহিরী কিতাবুল সীরাহ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন : মহান আল্লাহ্ জ্ঞাত আছেন যে, আমরা সেখানে উপস্থিত থাকলে বনূ কুরায়যার জনপদে উপস্থিত না হয়ে সালাত আদায় করতাম না। কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হলেও আমরা তাই করতাম। তাঁর এ উক্তি শরীঅতের বাহ্যিক নির্দেশের উপর আমল করার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে অপর একদল আলিম বলেন : যথা সময়ে যারা সালাত আদায় করেছিলেন তারাই সঠিক কাজটি করেছিলেন। কারণ, তারা বুঝেছেন যে, এ নির্দেশের তাৎপর্য হচ্ছে বনূ কুরায়যার জনপদে তাড়াতাড়ি পৌঁছা; সালাত বিলম্বিত করা এ নির্দেশের উদ্দেশ্য ছিল না। ওয়াক্তের শুরুতে সালাত আদায় করা উত্তম। বাহ্যিক এ প্রমাণের দাবী অনুযায়ী তাঁরা আমল করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন । এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের কাউকেই ভর্ৎসনা করেননি এবং পুনরায় সালাত আদায়ের নির্দেশও দেননি। যেন সেদিন সালাত আদায়ের ওয়াক্তই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল । অবশ্য যারা সালাত বিলম্বিত করেছিলেন তারা যা বুঝেছিলেন তদনুযায়ী আমল করেছেন। এ কারণে তাঁরা ক্ষমাহ বিবেচিত হয়েছেন । বিলম্বিত করার জন্যে বড় জোর তাদেরকে নামাযের কাযা আদায় করার নির্দেশ দেয়া যেতো। আর তাঁরা যথারীতি তা করেছেনও। অবশ্য যুদ্ধের ওযরে যিনি সালাত বিলম্বিত করাকে জাইয বলেন, যেমনটি ইমাম বুখারী (র) বুঝেছেন এবং ইতোপূর্বে উল্লিখিত হযরত ইবন উমরের হাদীছ দ্বারা তিনি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, নামায বিলম্বিত করা আর ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে কোন জটিলতা দেখা দেয় না, আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। 

ইবন ইসহাক (র) বলেন : রাসূল করীম (সা) আলী ইবন আবু তালিব (রা) কে পতাকাসহ অগ্রে প্রেরণ করেন এবং কিছু লোক তাঁর সাথে সাথে গমন করেন। আর মূসা ইবন উবা তাঁর মাগাজী গ্রন্থে ইমাম যুহরীর সূত্রে উল্লেখ করেন যে, ঐতিহাসিকদের ধারণা অনুযায়ী রাসূলে করীম (সা) গোসল খানায় সবেমাত্র মাথার একাংশের চুল আঁচড়িয়েছেন। এমন সময় জিব্রাঈল (আ) লৌহবর্ম সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার চড়ে মসজিদের দরজার কাছে জানাযার নামায আদায়ের স্থানে হাযির হলে রাসূল করীম (সা) তার দিকে এগিয়ে যান। এ সময় জিব্রাঈল (আ) তাঁকে বললেন, আল্লাহ্ আপনাকে ক্ষমা করুন, আপনি কি অস্ত্র খুলে ফেলেছেন? রাসূলে করীম (সা) বললেন, হাঁ। জিরাঈল (আ) বললেন, তবে আমরাতো আপনার নিকট শত্রু আগমন করার পর এখনও অস্ত্র খুলিনি । আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে পরাজিত করা পর্যন্ত আমি তো শত্রুর সন্ধানে রত ছিলাম । ঐতিহাসিকরা বলেন যে, হযরত জিবরাঈল (আ)-এর চেহারায় ধুলাবালির চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। এ সময় জিব্রাঈল (আ) নবী করীম (সা)-কে বলেন, আল্লাহতো আপনাকে বনূ কুরায়যার সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার সঙ্গী ফেরেশতাদেরকে নিয়ে আমি তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমরা তাদের দুর্গে কম্পন সৃষ্টি করবো । আপনি লোকজন নিয়ে রওয়ানা হয়ে পড়ন। জিব্রাঈল (আ)-এর পিছু পিছু রাসূলে করীম (সা) বের হয়ে পড়লেন। তিনি বনু গনমের একটা সমাবেশের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেন। সেখানে তাঁরা রাসূল করীম (সা)-এর অপেক্ষায় ছিলেন। রাসূল করীম (সা) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এই মাত্র কোন অশ্বারোহী এদিক দিয়ে অতিক্রম করেছে কি? তারা বলে, সাদা ঘোড়ায় চড়ে দিহইয়া কালবী আমাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছেন। তার নীচে ছিল নকশী করা রেশমী চাদর । ঐতিহাসিকগণ বলেন : রাসূল করীম (সা) এ সময় বলেছেন যে, ইনি ছিলেন জিবরাঈল (আ)। রাসূল করীম (সা) জিব্রাইল (আ)-কে দিহইয়া কালবীর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে অভিহিত করতেন। রাসূল করীম (সা) বললেন, তোমরা বনূ কুরায়যার জনপদে গিয়ে আমার সঙ্গে মিলিত হবে এবং সেখানে আসরের সালাত আদায় করবে । আল্লাহর ইচ্ছায় মুসলমানরা উঠে দাঁড়ালেন এবং বনু কুরায়যা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে পড়লেন। তখন তারা একে অপরকে বলেন, তোমরা কি জানো যে, রাসূল করীম (সা) তোমাদেরকে বনু কুরায়যার জনপদে পৌঁছে সালাত আদায় করতে বলেছেন : অন্যরা বললেন, সালাততো যথা সময় আদায় করতে হয় । একদল সালাত আদায় করলেন, অপর দল সালাত বিলম্বিত করলেন। এমন কি বনু কুরায়যার জনপদে পৌঁছে সূর্যাস্তের পর তারা আসরের সালাত আদায় করলেন। একদল তাড়াতাড়ি আর অপর দল বিলম্বিত করে সালাত আদায়ের কথা রাসূল করীম (সা)-কে জানালে তিনি এদের কোন দলকেই নিন্দা করেননি। 

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) বলেন, হযরত আলী ইবন আবু তালিব রাসূল করীম (সা)-কে এগিয়ে আসতে দেখে তাঁর দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ফিরে যান, ইয়াহূদীদের জন্য আপনার পক্ষে আল্লাহ্ যথেষ্ট। আলী (রা) রাসূল করীম (সা) এবং তাঁর সহধর্মিনিগণের সম্পর্কে তাদের মুখে কটুক্তি শুনেন। কিন্তু তা রাসূল করীম (সা) শুনুন এটা তিনি পসন্দ করলেন না। রাসূল করীম (সা) বললেন, তুমি আমাকে ফিরে যেতে বলছ কেন? ইয়াহূদী বনু কুরায়যার মুখ থেকে তিনি যা শুনেছিলেন তা তিনি তাঁর কাছ থেকে গোপন রাখলেন। তখন রাসূল করীম (সা) বললেন, আমার মনে হয়, তুমি আমার সম্পর্কে তাদের মুখে কষ্টদায়ক কোন কথা শুনেছ । তা যেতে দাও। কারণ, আল্লাহর দুশমনরা আমাকে দেখলে তুমি যা শুনেছ, তার কিছুই বলবেনা। 

রাসূল করীম (সা) ইয়াহূদীদের দুর্গে পৌঁছে তাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে তাদেরকে শুনিয়ে বললেন, আর এরা ছিল দুর্গের চূড়ায়, হে ইয়াহূদী সমাজ! হে বানরের গোষ্ঠী! এখন জবাব দাও। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের উপর লাঞ্ছনা নেমে এসেছে। একদল মুসলিম বাহিনী নিয়ে রাসূল করীম (সা) ইয়াহুদীদেরকে ১০ দিনের বেশী সময় অবরোধ করে রাখলেন। আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা হুয়াই ইবন আখতাব উপস্থিত হয়ে বনূ কুরায়যার দুর্গে আটকা পড়ে। মহান আল্লাহ্ তাদের অন্তরে ভয়-ভীতির সঞ্চার করলেন। এই অবরোধ তাদের কাছে দুর্বিষহ ঠেকে। এসময় তারা আনসারদের মিত্র আবু লবাবা ইব্‌ন আবদুল মুনযিরকে চিৎকার করে ডাক দেয়। তখন আবু লুবাবা বলেন, রাসূল (সা)-এর অনুমতি ছাড়া আমি তাদের কাছে যাব না। তখন রাসূল করীম (সা) তাকে বলেন, আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম। আবু লুবাবা তাদের নিকট উপস্থিত হলে তারা তাঁকে ঘিরে কাঁদতে কাঁদতে বলেঃ হে আবু লুবাবা । তুমি কী মনে কর আর আমাদেরকে কী করতে বল? কারণ, আমাদেরতো লড়াই করার মত ক্ষমতা নেই। তখন আবু লুবাবা হাতের আঙ্গুল দ্বারা গলার দিকে ইঙ্গিত করে বুঝান। যে, হত্যাই তাদের জন্যে অবধারিত। আবু লুবাবা ফিরে এসে লজ্জিত হন এবং মনে করেন যে, তিনি গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছেন। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, আমি অন্তর থেকে খালিস তাওবা না করা পর্যন্ত রাসূল করীম (সা)-এর চেহারা মুবারকের দিকে তাকাবো না। আর আল্লাহ্ তা’আলা আমার এই আন্তরিক তাওবা জানবেন। তিনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং মসজিদের একটা খাম্বার সাথে নিজেকে বেঁধে রাখেন। ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন যে, তিনি প্রায় ২০ দিন এভাবে খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন। আবু লুবাবাকে অনুপস্থিত দেখে রাসূল করীম (সা) বললেন, আবু লুবাবা কি মিত্রদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এখনো ফিরে আসেনি? আবু লুবাবা যা করেছেন তা তাকে জানান হলে তিনি বললেন : আমার এখান থেকে যাওয়ার পর সে ফ্যাসাদে পড়েছে। সে আমার নিকট উপস্থিত হলে আমি তার জন্য আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত চাইতাম। যখন এ কাজটা সে করেই এসেছে তখন তার ব্যাপারে আল্লাহর সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আমি তাকে তার স্থান থেকে সরাবো না। ইবন লাহিয়ার আবুল আসওয়াদ সূত্রে উরওয়ার বরাতে এরূপ বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) তাঁর মাগাযী গ্রন্থে যুহরী সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। 

ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বনু কুরায়যার একটা কুপের নিকট অবস্থান করেন। এ কুপটি ‘আন্না কূপ’ নামে পরিচিত ছিল। এখানে তিনি বনূ কুরায়যাকে ২৫ দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রাখেন। এ অবরোধে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয়। হুয়াই ইবন আখতাবও তাদের সঙ্গে দুর্গে প্রবেশ করেছিল যখন কুরায়শ ও গাতফান গোত্রের লোকেরা তাদের নিকট থেকে ফিরে গিয়েছিল। হুয়াই এসেছিল কা’ব ইব্‌ন আসাদকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যে। যখন বনূ কুরায়যার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, রাসূল করীম (সা) তাদের সঙ্গে লড়াই না করে ফিরে যাবেন না, তখন কা’ব ইবন আসাদ বলল, হে ইয়াহূদী সম্প্রদায়! তোমাদের যে দশা হয়েছে তাতে তোমরা দেখতেই পাচ্ছ। আমি তোমাদের সম্মুখে তিনটি প্রস্তাব রাখছি। এর মধ্য থেকে তোমরা যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করতে পার। তারা বললো : প্রস্তাবগুলো কী? সে বললো- (১) আমরা এ ব্যক্তির আনুগত্য করবো এবং তাঁকে সত্য বলে মেনে নেবো। আল্লাহর কসম! তোমাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি অবশ্যই প্রেরিত নবী। তোমরা তোমাদের গ্রন্থে যার পরিচয় দেখতে পাও, ইনি হলেন সে ব্যক্তি তাঁর প্রতি ঈমান আনার মাধ্যমে তোমরা নিজেদের জীবন, সম্পদ, সন্তান এবং নারীদের নিরাপত্তা লাভ করতে পার। একথা শুনে তারা বলে উঠলো । আমরা কখনো তাওরাতের বিধান ত্যাগ করবোনা, এবং তার পরিবর্তে অন্য কোন বিধান মেনেও নেবো না। 

(২) কা’ব বলল : তোমরা এটা মেনে নিতে অস্বীকার করলে এসো, আমরা আমাদের সন্তান আর নারীদেরকে হত্যা করি এবং উন্মুক্ত তরবারি হাতে মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। পেছনে কোন বোঝ রেখে যাবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের আর মুহাম্মাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন। ধ্বংসই যদি আমাদের ভাগ্যে থাকে তা হলে আমরা এমনভাবে ধ্বংস হব যে, আমাদের পেছনে কোন বংশধর ছেড়ে যাবো না, যাদের জন্য আমাদের আশংকা থাকবে। আর যদি আমরা জয়ী হই তাহলে জীবনের শপথ করে বলছি, তাহলে নিশ্চিত আমরা নতুনভাবে নারী এবং সন্তান লাভ করবো। একথা শুনে তারা বলে উঠলো– আমরা কি এ অসহায়দেরকে অকারণে হত্যা করবো? এরপর জীবনের স্বাদ বলে কী আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে? 

 (৩) কা’ব বলল : তোমরা যদি এটাও মেনে নিতে অস্বীকার কর তবে আজকের রাত তো শনিবার রাত। হয়তো মুহাম্মাদ আর তার সঙ্গীরা এ রাতে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকবেন। চলো, আমরা হামলা চালাই, মুহাম্মাদ এবং তাঁর সঙ্গীদের উপর হয়তো আমরা অতর্কিত হামলা চালাতে সক্ষম হবো। তারা বললো, আমরা কি শনিবার দিনের অবমাননা করবো? এদিনে আমরা কি এমন কাণ্ড করবো, যা ইতিপূর্বে যে ব্যক্তিই করেছে তার অবয়ব বিকৃতি ঘটেছে বলে তুমি নিজেও জানো। তখন সে বলল, তোমাদের কোন ব্যক্তির মায়ের পেট থেকে জন্মের পর সে এমন বোকার মতো কখনো রাত্রি যাপন করেনি। তারপর তারা রাসূল করীম (সা)-এর নিকট এ মর্মে বার্তা প্রেরণ করেন যে, বনু আমর ইবন আওফের আবু লুবাবা ইবন আবদুল মুনযিরকে আপনি আমাদের নিকট প্রেরণ করুন। বনূ কুরায়যা ছিল আওস গোত্রের মিত্র পক্ষ। তারা বললোঃ আমরা তার নিকট থেকে পরামর্শ গ্রহণ করবো। নবী করীম (সা) তাঁকে প্রেরণ করলেন। তাঁকে দেখে লোকেরা দণ্ডায়মান হলো। তাঁকে দেখেই নারী এবং শিশুরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এতে আবু বাবার অন্তর বিগলিত হয়। তারা বলে, হে আবু লুবাবা! তুমি কি মনে কর, আমরা কি মুহাম্মাদের নির্দেশ মতো দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসবো? আবু লুবাবা বললেন, হাঁ । তিনি তাঁর হাতের দ্বারা গলার দিকে ইঙ্গিত করে বুঝালেন, যে তাদের জবাই হতে হবে । আবু লুবাবা বলেন : যে আমার স্থান ত্যাগের পূর্বেই আমি বুঝতে পারি যে, আমি আল্লাহ্ তা’আলা এবং তার রাসূলের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি। তারপর আবু লুবাবা রাসূল করীম (সা)-এর নিকট আগমন না করে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে মসজিদের একটা খুঁটির সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলেন । তিনি বললেন, আমি যা করেছি সে জন্যে আল্লাহ্ আমাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমি এ স্থান ত্যাগ করবো না। তিনি অঙ্গীকার করেন যে, আমি কখনো বনূ কুরায়যার জনপদে পা রাখবো না এবং সে জনপদে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি তাতে কখনো বিচরণ করবো না। 

ইবন হিশাম, সুফিয়ান ইব্‌ন উয়ায়না, ইসমাঈল ইব্‌ন আবু খালিদ এবং আবদুল্লাহ্ ইবন আবু কাতাদা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন : 

হে ঈমানদারগণ! তোমরা জেনেশুনে আল্লাহ্ ও তার রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না এবং তোমরা পরস্পরের আমানত সম্পর্কেও বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না এবং তোমরা জেনে রাখবে যে, তোমাদের ধন-সম্পদ আর সন্তান-সন্ততিতে এক পরীক্ষা মাত্র এবং আল্লাহরই নিকট রয়েছে মহা পুরস্কার। (আনফাল : ২৭-২৮)। 

ইবন হিশাম বলেন : তিনি ৬ রাত পর্যন্ত খুঁটির সঙ্গে বাঁধা ছিলেন। এ সময় নামাযের ওয়াক্ত হলে তাঁর স্ত্রী উপস্থিত হয়ে বন্ধন খুলে দিতেন। তিনি উযু করে নামায আদায় করে পুনরায় নিজেকে বেঁধে ফেলতেন । শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ তাঁর তাওবা কবুল করে আয়াত নাযিল করলেন : 

আর অপর কতক লোক নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তারা এক সৎ কর্মের সাথে অসৎ কর্ম মিশ্রিত করেছে। আল্লাহ্ হয়তো তাদেরকে ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মহা ক্ষমাশীল পরম দয়ালু (৯- তাওবা : ১০২)। পক্ষান্তরে মূসা ইবন উবা বলেন যে, তিনি খুঁটির সঙ্গে ২০ দিন বাঁধা ছিলেন। আল্লাহই ভাল জানেন। ইবন ইসহাক উল্লেখ করেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা রাসূল করীম (সা)-এর উপর আবু লুবাবার তাওবা কবুলের আয়াত নাযিল করেন রাতের শেষ প্রহরে। এ সময় রাসূল করীম (সা) হযরত উম্মে সালামার ঘরে ছিলেন। আয়াতটি নাযিল হলে নবী করীম (সা) মুচকি হাসতে লাগলেন। উম্মে সালামা (রা)-এর কারণ জিজ্ঞেস করলে নবী করীম (সা) তাঁকে জানান যে, মহান আল্লাহ আবু লুবাবার তাওবা কবুল করেছেন। তিনি আবূ লুবাবাকে এ সুসংবাদ দানের জন্য রাসূল করীম (সা)-এর নিকট অনুমতি চাইলে রাসূল (সা) তাঁকে অনুমতি দান করেন। উম্মে সালামা বের হয়ে আবু লুবাবাকে এ সংবাদ দান করলে লোকেরাও ছুটে আসে সুসংবাদ দানের জন্য। লোকেরা তাকে বন্ধন মুক্ত করতে চাইলে তিনি বললেন : আল্লাহর কসম! রাসূল করীম (সা) ছাড়া আর কেউই আমাকে বন্ধন মুক্ত করবেন না। রাসূল করীম (সা) ফজরের সালাতের জন্য বের হয়ে তাঁকে বন্ধন মুক্ত করলেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রতি প্রসন্ন হোন এবং তাঁকে প্রসন্ন রাখুন। 

ইন ইসহাক বলেন : সা’লাবা ইবন সা’ইয়াহ ও উসায়দ ইবন সাইয়া এবং আসাদ ইবন উবায়দ এরা বনূ কুরায়যা বা বনূ নষীরের লোক ছিলেন না; বরং এরা ছিলেন বনূ ছুহালের অন্তর্ভুক্ত। এদের বংশধারা আরো উপরে পৌঁছেছে। এরা ছিলেন ওদের জ্ঞাতি ভাই। রাসূল করীম (সা)-এর নির্দেশক্রমে যে রাত্রে বনু কুরায়যাকে দুর্গ থেকে বের করা হয় সে রাত্রে এরা ইসলাম গ্রহণ করেন। একই রাত্রে আমর ইব্‌ন সু’দা আল কুরাযীও দুর্গ থেকে বের হন। ইনি রাসূল করীম (সা)-এর পাহারাদারদের নিকট দিয়ে গমনকালে তারা জিজ্ঞেস করলেন-কে? এ পাহারাদারদের নেতৃত্বে ছিলেন মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা। তিনি জবাবে বলেন, আমর ইব্‌ন সু’দা আর ইনি বনূ কুরায়যার সঙ্গে যোগ দিয়ে রাসূল করীম (সা)-এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাযী হননি। তিনি বলেছিলেন– আমি কখনো মুহাম্মাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবোনা। মুহাম্মাদ ইব্‌ন মাসলামা তাকে চিনতে পেরে বললেন : 

“হে আল্লাহ! সম্মানিত ব্যক্তিদের পদস্খলন ক্ষমা করা থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।” মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা তাকে চলে যেতে অনুমতি দিলেন। তিনি সোজা গিয়ে মসজিদে নব্বীতে উঠেন এবং সেখানে রাত্রিযাপন করেন। পর দিন তিনি সেখান থেকে বের হন; কিন্তু তারপর তিনি সেখান থেকে কোথায় যে গেলেন অদ্যাবধি তা জানা যায়নি। তার সম্পর্কে রাসূল করীম (সা)-কে অব্যাহতি করা হলে তিনি বলেন : 

এ এমন ব্যক্তি যার বিশ্বস্ততার কারণে আল্লাহ্ তাকে মুক্তি দিয়েছেন। 

ইবন ইসহাক বলেন : কোন কোন লোকের ধারণা, বনু কুরায়যার যে সব লোককে রশি দিয়ে বাঁধা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ইনিও ছিলেন। ভোরে তার রশি পড়ে থাকতে দেখা যায়; কিন্তু তিনি কোথায় গেলেন তা জানা যায়নি। তখন নবী করীম (সা) তার সম্পর্কে উপরোক্ত উক্তি করেন। ঘটনা কি ঘটেছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন। 

ইব্‌ন ইসহাক আরো বলেন : সকালে নবী করীম (সা)-এর নির্দেশে বনু কুরায় দুর্গের অভ্যন্তর থেকে বের হলে আওস গোত্রের লোকেরা এগিয়ে এসে বললো : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এরা আমাদের মিত্র পক্ষ; খারাজরা নয়। আমাদের খাযরাজী ভাইদের মিত্রদের সম্পর্কে আপনি পূর্বে যা করেছেন, করেছেন। অর্থাৎ আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। মানে, আবদুল্লাহ ইবন উবাই এর আবেদনক্রমে বনু কায়নুকাকে যেমন ক্ষমা করেছিলেন। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। 

ইবন ইসহাক আরো উল্লেখ করেন যে, আওস গোত্রের লোকেরা রাসূল করীম (সা)-এর সঙ্গে কথা বললে উনি বললেন : 

হে আওস সম্প্রদায়! তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের ব্যাপারে তোমাদের মধ্যকার একজনই ফায়সালা করবেন? তারা বললো, জ্বী হাঁ, নিশ্চয়ই। রাসূল করীম (সা) এ সিদ্ধান্তের ভার অর্পণ করেন সা’দ ইব্‌ন মুআয এর উপর। রাসূল করীম (সা) হযরত সা’দকে মসজিদে নববী সংলগ্ন একটা তাঁবুতে থাকতে দেন। এটি ছিল রুফায়দা নাম্নী আসলাম গোত্রের এক মহিলার তাঁবু। আর এ মহিলা আহত ব্যক্তিদের সেবা শুশ্রূষা করতেন। রাসূল করীম (সা) সা’দকে বনূ কুরায়যার বিচারক নিযুক্ত করলে আওস গোত্রের লোকেরা তাঁর নিকট এসে তাঁকে গাধায় সওয়ার করে রাসূল করীম (সা)-এর দরবারে নিয়ে যান। আর তিনি ছিলেন একজন হৃষ্টপুষ্ট সুদর্শন পুরুষ । গাধার পৃষ্ঠে তাঁরা তাঁর জন্য একটা চামড়ার গদি বিছিয়ে দেন। তাঁরা তাঁকে বলেন : হে 

আবু আমর! আপনার মিত্রদের সাথে সদয় ব্যবহার করবেন। কারণ, তাদের সঙ্গে সদাচার করার জন্যই রাসূল করীম (সা) আপনাকে তাদের বিচারক মনোনীত করেছেন। তারা হযরত সা’দকে পীড়াপীড়ি করলে তিনি বললেন :

সাদের জন্য সময় এসেছে যে, সে আল্লাহর ব্যাপারে কোন ভর্ৎসনাকারীর ভসনার পরওরা করবে না। একথা শুনে তাঁর গোত্রের কিছু লোক, যারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁরা বনূ আবদুল আশহাল গোত্রের নিকট এবং সেখানে সা’দের প্রবেশের পূর্বেই বনু কুরায়র মৃত্যুর শোকবার্তা পৌঁছিয়ে দেন। হযরত সা’দ (রা) রাসূল করীম (সা)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি বললেন : 

তোমরা তোমাদের নেতার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াও। কুরায়শী মুহাজিররা বলেন, একথা দ্বারা রাসূল করীম (সা) আনসারদেরকে সম্বোধন করেছিলেন। আর আনসারগণ বলেন যে, রাসূল করীম (সা) সকল মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তা বলেছিলেন। তাঁরা সকলেই হযরত সা’দের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ান। তখন তাঁরা বলেন : হে আবু আমর! রাসূল করীম (সা) আপনার মিত্রদের ব্যাপারে আপনাকে সালিশ মনোনীত করেছেন যাতে করে আপনি তাদের ব্যাপারে ফায়সালা করতে পারেন। তখন হযরত সাদ বলেন : আল্লাহ ও রাসূল (সা)-এর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার তোমাদেরকে মেনে চলতে হবে। তাদের ব্যাপারে আমি যে নির্দেশ দেবো, তাই কি হবে চূড়ান্ত ফায়সালা? তারা বললেন, হাঁ। হযরত সাদ বললেন, আর যিনি এ দিকে রয়েছেন? সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মানার্থে তিনি তার নাম নিলেন না। রাসূল করীম (সা) বললেন, হাঁ। তখন হযরত সা’দ বললাম, তাদের ব্যাপারে আমি ফায়সালা দিচ্ছি যে, তাদের পুরুষদেরকে হত্যা করা হবে, তাদের সম্পদ বন্টন করা হবে এবং শিশু আর নারীদেরকে বন্দী করা হবে। 

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক আসিম ইবন উমর– আলকামা ইবন ওয়াক্কাস লাইছী সূত্রে বলেন, রাসূল করীম (সা) হযরত সা’দকে বললেন :

“সপ্ত আসমান থেকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তুমি তাদের মধ্যে ফায়সালা করেছ। ইবন হিশাম বলেন, একজন আস্থাভাজন আলিম আমাকে বলেন যে, মুসলমানরা যখন বনু কুরায়যাকে অবরোধ করে রাখে তখন হযরত আলী ইবন আবু তালিব এবং যুবায়র ইবনুল আওয়াম সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বলেন : হে ঈমানের বলে বলীয়ান বাহিনী! আল্লাহর কসম, বীর হামযা যা আস্বাদন করেছেন, আমিও তা আস্বাদন করবো; অথবা আমি দুর্গ জয় করে তাতে প্রবেশ করবো। তখন অবরুদ্ধরা বলে উঠে সা’দ ইবন মু’আয এর ফায়সালা সাপেক্ষে আমরা (দুর্গের ভেতর থেকে) বেরিয়ে আসছি। 

ইমাম আহমদ (র) মুহাম্মাদ ইবন জাফর– আবু সাঈদ খুদরী সূত্রে বলেন। হযরত সা’দ ইবন মু’আয এর ফায়সালা সাপেক্ষে বনূ কুরায়যা পোত্র দুর্গ থেকে অবতরণ করলে রাসূল করীম  

(সা) হযরত সাদ-এর নিকট দূত প্রেরণ করেন। তিনি গাধায় আরোহণ করে আগমন করেন। তিনি মসজিদের নিকটবর্তী হলে নবী করীম (সা) বললেন : তোমাদের নেতা বা উত্তম ব্যক্তির উদ্দেশ্যে তোমরা উঠে দাঁড়াও। তারপর তিনি বললেন : এরা তোমার ফায়সালা সাপেক্ষে দুর্গ থেকে বের হয়ে এসেছে। হযরত সা’দ বললেন, তাদের মধ্যে যারা যোদ্ধা আমরা তাদেরকে হত্যা করবো আর তাদের সন্তানদেরকে আমরা বন্দী করবো। রাবী বলেন, তখন রাসূল করীম (সা) বললেন : au। ২, ৩,১৭ তুমি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ফায়সালা করেছ। কোন কোন বর্ণনায় lLauls অর্থাৎ বাদশাহের নির্দেশ অনুযায়ী উল্লেখ রয়েছে। আবার কোন কোন বর্ণনায় কেবল L বা বাদশাহ শব্দের উল্লেখ রয়েছে। ইমাম বুখারী (র) ও ইমাম মুসলিম (র) শু’বা সূত্রে বিভিন্ন সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। 

ইমাম আহমদ (র) হাজীন– জাবির ইবন আবদুল্লাহ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, খন্দকের যুদ্ধে হযরত সা’দ ইবন মু’আয তীর নিক্ষেপে আহত হলে লোকেরা তাঁর বাহুর রগ (4) কেটে ফেলে এবং রাসূল করীম (সা) তাতে আগুন দ্বারা দাগান। এতে তাঁর হাত ফুলে গিয়ে রক্ত প্রবাহিত হলে রাসূল (সা) পুনরায় দাগান। এবারও হাত ফুলে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে । হযরত সা’দ এ অবস্থা দেখে দু’আ করেন : 

“হে আল্লাহ্! বনূ কুরায়যার ব্যাপারে আমার চক্ষু শীতল হওয়ার পূর্বে তুমি আমাকে মৃত্যু দিয়ো না। তখন রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায় এবং হযরত সা’দের নির্দেশে বনূ কুরায়যা দুর্গ থেকে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আর এক ফোঁটা রক্তও নির্গত হয়নি। রাসূল করীম (সা) তাঁর নিকট দূত প্রেরণ করলে তিনি নির্দেশ দেন যে, বনূ কুরায়যার পুরুষদেরকে হত্যা করা হবে এবং নারী ও শিশুদেরকে বন্দী করা হবে আর মুসলমানরা তাদের সেবা গ্রহণ করবেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন 

 “তাদের ব্যাপারে তুমি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যথার্থ নির্দেশ দান করলে। যাদেরকে হত্যা করা হয়, সংখ্যায় তারা ছিল ৪শ’ তারপর আবার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে এবং এতেই তাঁর ইনতিকাল হয়। তিরমিযী ও নাসাঈ উভয়েই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন কুতায়বা সূত্রে লায়ছ থেকে এবং তিরমিযী (র) হাদীছটিকে হাসান সহীহ বলে অভিহিত করেছেন। 

ইমাম আহমদ (র) ইবন নুমাইর– হযরত আইশা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল করীম (সা) খন্দক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে অস্ত্র খুলে গোসল করলে তাঁর নিকট হযরত জিবরাঈল (আ) আগমন করেন। তাঁর মাথা তখনো ধূলাবালি ধূসরিত । তিনি বললেন, আপনি অস্ত্র খুলে রেখেছেন? আল্লাহর কসম! আমিতো এখনো অস্ত্র খুলিনি। আপনি তাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ন। রাসূল করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেন, কোন দিকে? জিব্রাঈল (আ) বললেন, এদিকে । একথা বলে তিনি বনূ কুরায়যার দিকে ইঙ্গিত করলেন। তখন রাসূল করীম (সা) তাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। হিশাম বলেন, আমার পিতা আমাকে জানান যে, বনু কুরায়র ইয়াহূদীরা রাসূল করীম (সা)-এর নির্দেশক্রমে দুর্গ থেকে বের হয়ে আসে। তিনি তাদের ব্যাপারে সা’দ (রা)-কে সালিশ মনোনীত করেন। তখন হযরত সা’দ বলেন যে, তাদের ব্যাপারে আমি নির্দেশ দিচ্ছি যে, তাদের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হবে, শিশুদেরকে বন্দী করা হবে এবং অর্থ-সম্পদ বণ্টন করা হবে। হিশাম বলেন যে, আমার পিতা আইশা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূল করীম (সা) তখন বলেছিলেন তাদের ব্যাপারে তুমি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ফায়সালা করেছ। 

ইমাম বুখারী (র) যাকারিয়া ইবন ইয়াহয়া– আইশা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, খন্দক যুদ্ধের দিন হযরত সা’দ তীরবিদ্ধ হন। কুরায়শের হিব্বান ইব্‌ন আরাকা নামক জনৈক ব্যক্তি তীর নিক্ষেপ করলে তা তাঁর বাহুর রগে বিদ্ধ হয়। নিকট থেকে তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য রাসূল করীম (সা) মসজিদে একটা তাবু স্থাপন করেন। রাসূল করীম (সা) খন্দক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে অস্ত্র খুলে গোসল করলে মাথা থেকে ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে হযরত জিব্রাঈল (আ) তাঁর নিকট আগমন করেন। তিনি বললেন, আপনি অস্ত্র খুলে ফেলেছেন; আল্লাহর কসম, আমি এখনো অস্ত্র খুলিনি। আপনি তাদের উদ্দেশ্যে বের হোন। নবী করীম (সা) জানতে চাইলেন, কোন্ দিকে? তিনি বনূ কুরায়যার দিকে ইঙ্গিত করলেন। রাসূল করীম (সা) বনু কুরায়যা অভিমুখে গমণ করলে তারা রাসূল করীম (সা)-এর নির্দেশক্রমে (দুর্গ থেকে বের হয়। অতঃপর তিনি হযরত সা’দের প্রতি ফায়সালার ভার অর্পণ করেন। তিনি বললেন, তাদের ব্যাপারে আমি এ নির্দেশ দিচ্ছি যে, তাদের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হবে, নারী আর শিশুদেরকে বন্দী করা হবে এবং তাদের ধন-সম্পদ বিলি বণ্টন করা হবে। 

হিশাম বলেন, হযরত আইশা সূত্রে আমার পিতা আমাকে জানান যে, হযরত সা’দ ইবন মু’আয আহত অবস্থায় দু’আ করেছিলেন : হে আল্লাহ্! যে জাতি তোমার রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং তাঁকে দেশান্তরিত করেছে, তাদের তুলনায় এমন কেউ নেই, তোমার নিমিত্ত যার বিরুদ্ধে জিহাদ করা আমার নিকট বেশী প্রিয়। হে আল্লাহ! আমি মনে করি যে, তুমি তাদের এবং আমাদের মধ্যে যুদ্ধকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছ। কুরায়শের যুদ্ধের কিছু অংশও যদি অবশিষ্ট থাকে তবে সে জন্য তুমি আমাকে জীবিত রাখবে, যাতে আমি কেবল তোমারই উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি । আর যদি তুমি যুদ্ধের পালা শেষ করে দিয়ে থাক তাহলে তুমি আমার আঘাত অব্যাহত রেখে তাতেই আমার শাহাদত নসীব কর । 

তাঁর ক্ষতস্থান থেকে রক্তের প্রবাহ অব্যাহত থাকে। তা আর থামলো না। মসজিদে বনূ গিফারের একটা তাঁবু ছিল, রক্ত সে পর্যন্ত গড়ায়। তারা বলে, হে তাঁবু বাসীরা! তোমাদের দিক থেকে আমাদের দিকে এটা কী আসছে? হঠাৎ দেখা গেল যে, সা’দের আঘাত থেকে রক্ত উথলে উঠছে। এতেই তাঁর ইনতিকাল হয়। ইমাম মুসলিম (র) আবদুল্লাহ্ ইবুন নুমায়র সূত্রে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। 

আমি বলি ও বনূ কুরায়যার ব্যাপারে প্রথম ফায়সালার পূর্বে হযরত সা’দ এ দু’আটি করেছিলেন। এ কারণেই এ দুআয় তিনি বলেছিলেন, বনু কুরায়যার ব্যাপারে আমার চক্ষু শীতল হওয়ার পূর্বে তুমি আমাকে মৃত্যু দিয়ো না। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর দু’আ কবুল করেন। হযরত সা’দ যখন বনূ কুরায়যার ব্যাপারে ফায়সালা জারী করেন এবং আল্লাহ্ তা’আলাও তার চক্ষু শীতল করেন। তখন তিনি পুনরায় এ দুআ করলে আল্লাহ্ তা’আলা এ আঘাতকেই তাঁর শাহাদাতের কারণ হিসাবে গ্রহণ করেন। মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট রাখুন। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে শীঘ্রই আলোচনা আসছে, ইনশাআল্লাহ। 

ইমাম আহমদ (র) অন্য সূত্রে হযরত আইশা থেকে হাদীছটি বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করেছেন। তাতে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় রয়েছে। তাতে তিনি য়াযীদ– হযরত আইশা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, খন্দক যুদ্ধের দিন লোকজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি বের হই। আমি পেছন থেকে মাটির ধপধপ আওয়ায শুনতে পাই। হঠাৎ দেখি, সা’দ ইবন মুআয় এবং তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর ভাতিজা হারিস ইবন আওস। তিনি ঢাল ধারণ করে চলছেন। হযরত আইশা (রা) বলেন, আমি মাটিতে বসে পড়ি। এ সময় হযরত সা’দ অতিক্রম করেন। তাঁর গায়ে ছিল লোহার বর্ম । লৌহ বর্ম থেকে তার দেহের পার্শ্বদেশ বেরিয়ে পড়েছিল। আমি তার দেহের খোলা অংশ দেখে ভয় পাই। হযরত আইশা (রা) বলেন, হযরত সা’দ ছিলেন দীর্ঘ দেহী সুপুরুষ । তিনি এ কবিতাটি আবৃত্তি করতে করতে অগ্রসর হলেন : 

একটু থামো, উট যুদ্ধের নাগাল পাবে। মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসে তখন তা কতইনা চমৎকার। 

হযরত আইশা (রা) বলেন : আমি দাঁড়ালাম এবং একটা বাগানে প্রবেশ করলাম। সেখানে ছিলেন একদল মুসলমান। তাদের মধ্যে উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-ও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শিরস্ত্রাণধারী এক ব্যক্তিও ছিল। উমর (রা) বললেন, আপনি কেন এখানে এসেছেন। আপনি তো দুর্দান্ত সাহসী দেখছি। বিপদ যে ঘটবে না এ ব্যাপারে আপনি কেমন করে নিশ্চিন্ত হলেন? অন্য কিছুওতো যুক্ত হতে পারতো? এভাবে তিনি আমাকে ভৎর্সনা করতে থাকেন। এতে শেষ পর্যন্ত আমার আকাক্ষা জাগে যদি সে মুহূর্তে মাটি ফেটে যেত এবং আমি তাতে প্রবেশ করতাম। শিরস্ত্রাণধারী লোকটি শিরস্ত্রাণ সরালে দেখতে পাই যে, তিনি হলেন তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ্। তিনি বললেন, হে উমর! আশ্চর্য, অদ্যাবধি আপনি অনেক বাড়াবাড়ি করেছেন। আশ্রয় আর পলায়নতো কেবল আল্লাহরই দিকে। 

হযরত আইশা (রা) আরও বলেন : ইবনুল আরাকা নামক কুরায়শের জনৈক ব্যক্তি হযরত সাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে। লোকটি বলেছিল এটা লও! আমি আরাকার পুত্র। তীর তার দেহের এক পাশের রগে বিদ্ধ হয় এবং এতে রগটি ছিঁড়ে যায়। তখন হযরত সাদ আল্লাহর নিকট দু’আ করে বলেন : 

হে আল্লাহ! বনূ কুরায়যার ব্যাপারে আমার চক্ষু শীতল না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমাকে মৃত্যু দিয়ো না। হযরত আইশা বলেন, জাহিলী যুগে বনু কুরায়যা ছিল হযরত সা’দের মিত্র । তিনি বলেন, তাঁর আঘাত শুকিয়ে যায় এবং আল্লাহ মুশরিকদের উপর ঝঞ্ঝা বায়ু প্রেরণ করেন। আর যুদ্ধে মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর আল্লাহ্ মহাশক্তিধর ও পরাক্রমশালী ।

আবু সুফিয়ান এবং সঙ্গীরা তিহামায় গিয়ে পৌঁছে। আর উয়ায়না ইবন বদর এবং তার সঙ্গীরা নাজদে গিয়ে পৌঁছে। বনূ কুরায়যা প্রত্যাবর্তন করে নিজেদের দুর্গে আশ্রয় নেয়। আর রাসূল করীম (সা) মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। হযরত সা’দের জন্য মসজিদে চামড়ার একটা তাঁবু প্রস্তুত করার জন্য রাসূল করীম (সা) নির্দেশ দান করেন। হযরত আইশা (রা) আরো বলেন : জিবরাঈল (আ) আগমন করেন। তখন তার সম্মুখে দাঁতে ধুলা লেগেছিল। তিনি বললেন : আপনি কি অস্ত্র খুলে ফেলেছেন? আল্লাহর কসম! ফেরেশতারা এখনো অস্ত্র খোলেননি। বনূ কুরায়যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন এবং তাদের সঙ্গে লড়াই করুন। এরপর রাসূল করীম (সা) বর্ম পরিধান করেন এবং লোকজনকে বনু কুরায়যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ দান করেন। তিনি বনূ গনমের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেন। আর এরা ছিল মসজিদের আশপাশের প্রতিবেশী। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছে। লোকেরা বললো, দিহইয়া কালবী। আর তাঁর দাড়ি দাঁত এবং চেহারা ছিল হযরত জিব্রাঈল (আ)-এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের নিকট আগমন করেন এবং ২৫ দিন পর্যন্ত তাদেরকে অবরোধ করে রাখেন। অবরোধ যখন তীব্র হয় এবং ওদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে, তখন তাদেরকে বলা হয় যে, তোমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ফায়সালা সাপেক্ষে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসো। তারা এ ব্যাপারে আবু লুবাবা ইবন আবদুল মুনযির এর পরামর্শ চাইলে তিনি ইঙ্গিতে বুঝান যে, জবাই হতে হবে। তারা বলে, সা’দ ইবন মু’আয-এর ফায়সালা সাপেক্ষে আমরা বের হবো। তখন রাসূল করীম (সা) বললেন, তোমরা সা’দ ইব্‌ন মু’আয-এর ফায়সালা সাপেক্ষে বের হও। সাদ ইবন মু’আযকে গাধায় সওয়ার করে আনা হয়। এর পালানোর গদি ছিল খেজুরের ছাল ভর্তি। এর উপরে তাকে আরোহণ করানো হয় এবং তাঁর চারপাশে লোকজনের ভিড় লেগে যায়। তারা বলে, হে আবূ আমর! এরা তোমার মিত্র ও বন্ধু । এখন তারা বিপদগ্রস্ত। তাদের যে দুর্গতি, তাতে তোমার অজানা নেই। তিনি তাদের কথার কোন উত্তর দিচ্ছিলেন না এবং তাদের প্রতি ক্ষেপও করছিলেন না। তাদের বাড়ী ঘরের নিকট এসে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন আমার জন্য সময় উপস্থিত হয়েছে যে, আমি আল্লাহর ব্যাপারে কোন ভসনাকারীর ভসনার পরওয়া করবো না। 

হযরত আইশা (রা) বলেন, আবু সাঈদ বলেছেন : হযরত সা’দ উপস্থিত হলে রাসূল করীম (সা) বললেন : 

তোমরা তোমাদের সাইয়েদের (নেতার) প্রতি দাঁড়াও এবং তাকে নামাও। এসময় হযরত উমর (রা) বলেন : আমাদের সাইয়েদ তথা মাওলাতো একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই। রাসূল করীম (সা) বললেন, তাকে গাধার পিঠ থেকে নামাও। তখন তারা তাকে নামালেন। রাসূল করীম (সা) বললেন, তুমি তাদের ব্যাপারে ফায়সালা দাও। তখন হযরত সা’দ (রা) বলেন, আমি তাদের ব্যাপারে ফায়সালা দিচ্ছি যে, তাদের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হবে, সন্তানদেরকে বন্দী করা হবে এবং তাদের ধন-সম্পদ বন্টন করা হবে। তখন রাসূল করীম (সা) বললেন : তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহ্ ও রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী ফায়সালা করেছ। এরপর হযরত সা’দ দু’আ করলেন। 

হে আল্লাহ্! কুরায়শের যুদ্ধের কোন অংশ যদি তুমি অবশিষ্ট রাখ তোমার নবীর জন্য তবে তুমি সেজন্য আমাকেও বাঁচিয়ে রেখো, আর যদি তুমি তাদের মধ্যে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে থাক তাহলে আমাকে তোমার সান্নিধ্যে তুলে নাও। 

হযরত আইশা (রা) বলেন : তাঁর যখমের ঘা শুকিয়ে গিয়েছিল। সামান্য পরিমাণ বাকী ছিল। তারপর আবার আঘাতের স্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে শুরু করে। এ অবস্থায় তিনি রাসূল করীম (সা) নির্মিত তাঁবুতে ফিরে আসেন। হযরত আইশা (রা) বলেন, মৃত্যুকালে তার কাছে উপস্থিত ছিলেন হযরত আবূ বকর এবং হযরত উমর (রা)। তিনি আরো বলেন, মুহাম্মাদ (সা)-এর জীবন যে পবিত্র সত্তার হাতে তাঁর শপথ! আমি আবু বকর ও উমর (রা)-এর ক্রন্দনের মধ্যে পার্থক্য করেছি। এ সময় আমি আমার হুজরায় ছিলাম। আর তারা ছিলেন যেমন আল্লাহ্ বলেছেন : পরস্পরে দয়ার্ড। 

আলকামা বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে উম্মুল মু’মিনীন। (এমন সময়) রাসূল করীম (সা)-কেমন করতেন : জবাবে তিনি বলেন ও তাঁর চক্ষু কারো জন্য অশ্রু ঝরাতো না; তবে এমন ক্ষেত্রে তিনি দাড়িতে হাত বুলাতেন। 

এ হাদীছটির সনদ উত্তম এবং এজন্য বিভিন্ন সূত্রের অনেক প্রমাণও রয়েছে। এতে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে হযরত সাদের দু’দফা দু’আ করার। একবার বনূ কুরায়যার ব্যাপারে তাঁর ফায়সালা করার পূর্বে এবং একবার এরপরে । আমরা ইতিপূর্বেও একথা উল্লেখ করেছি। সমস্ত প্রশংসা আলাহ্র জন্য। এ কাহিনীর আলোচনা শেষ করার পর তাঁর মৃত্যুর ঘটনা, দাফনের বৃত্তান্ত এবং তাঁর ফযীলত ও মর্যাদার বিষয় উল্লেখ করব। 

ইবন ইসহাক (র) বলেন : তারপর রাসূল করীম (সা) তাদেরকে দুর্গ থেকে বের করে মদীনায় বনূ নাজ্জারের জনৈকা মহিলার বাড়ীতে আটক রাখেন। আমি বলি : সে মহিলার বংশ পরিচয় হলো নাসীবা বিনতুল হারিস ইবন কুরয ইবন হাবীব ইবন আব্‌দ শামস। এ মহিলাটি ছিল মুসায়লামা কাযযাবের স্ত্রী । অতঃপর আবদুল্লাহ্ ইবন আমির ইব্‌ন কুরায় তাকে বিবাহ করেন। অতঃপর রাসূল করীম (সা) মদীনার বাজারের পথে বের হন এবং সেখানে কয়েকটি পরিখা খনন করান । এবং সেখানেই তাদের হত্যা করা হয়। এক এক করে তাদেরকে তাঁর নিকট হাযির করা হয়। এদের মধ্যে আল্লাহর দুশমন হুয়াই ইবন আখতাব এবং বনু কুরায়যার সদার কা’ব ইবন আসাদও ছিল। যাদেরকে হত্যা করা হয় তাদের সংখ্যা ছিল ৬ শ’ বা সাত শ’ । যারা অধিক সংখ্যা বলেন, তাদের মতে এ সংখ্যা ছিল ৮/৯ শ’র মাঝামাঝি। 

আমি বলি, ইতিপূর্বে আবুয যুবায়র সূত্রে জাবির বর্ণিত হাদীসে এদের সংখ্যা চারশ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন। 

ইবন ইসহাক বলেন, রাসূল করীম (সা)-এর দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, হে কা’ব! আমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে বলে তুমি মনে কর? সর্বত্রই কি তোমরা নিবোধ থাকবে? তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে, আহ্বানকারী আসছে না, আর তোমাদের মধ্যে যাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে আর ফিরে আসছেনা। আল্লাহর কসম, তাতো কেবল হত্যা। এ অবস্থা অব্যাহত ছিল তাদের হত্যা কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত । অবশেষে হুয়াই ইবন আখতাবকে হাযির করা হয়। তার গায়ে ছিল নকশী চাদর। চাদরটি সে চতুর্দিক থেকে কয়েক আঙ্গুল পরিমাণ করে ছিঁড়ে রেখেছিল, যাতে করে কেউ তা গনীমত রূপে ব্যবহার করতে না পারে। একটি রশি দিয়ে তার হাত দুটি গদান পর্যন্ত উঠিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। রাসূল করীম (সা)-এর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই সে বলে উঠে ও আল্লাহর কসম, আপনার প্রতি বৈরিতা পোষণের জন্যে আমি মোটেই অনুতপ্ত নই। অবশ্য আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন সেই লাঞ্ছিত হয়। তারপর লোকজনের দিকে মুখ করে সে বলে? হে লোকসকল! আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে কোন দুঃখ নেই। তাতো ভাগ্যলিপি আর মহা হত্যাকান্ড। যা আল্লাহ্ তা’আলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন বনী ইরাঈলদের জন্য। একথা বলার পর সে বসে পড়লে তার মস্তক দ্বিখন্ডিত করা হয়। এ প্রসঙ্গে কবি জাবাল ইবন জাওয়াল সালাবী বলেন : 

তোমার জীবনের শপথ, হুয়াই নিজেকে তিরস্কার করেনি। কিন্তু আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন সেই হয় লাঞ্ছিত। 

সে পুরোপুরি চেষ্টা চালিয়েছেন, এমন কি সে তাতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। আর মর্যাদার সন্ধানে চেষ্টা চালিয়েছে পুরোপুরি। 

ইবন ইসহাক যুবায়র ইবন বাতার ঘটনা উল্লেখ করেছেন । বয়োবৃদ্ধ এ লোকটি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বুয়াস যুদ্ধে এ ব্যক্তি ছাবিত ইবন কায়স ইবন শাম্মাম এর প্রতি অনুগ্রহ করেছিল। আর তার মাথার সম্মুখ ভাগের চুল কেটে দিয়েছিল। এ দিনটিতে তিনি তাকে প্রতিদান দিবার ইচ্ছা করেন এবং তিনি যুবায়রের নিকট আগমন করে বলেন : হে আবূ আবদুর রহমান । তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ? সে জবাবে বললো, আমার মতো মানুষ আপনার মতো মানুষকে ভুলতে পারে? তখন ছাবিত তাকে বললেন : আমি আজ তোমার অনুগ্রহের প্রতিদান দিতে চাই। তিনি বললেন : মহান ব্যক্তিই মহান ব্যক্তিকে প্রতিদান দিয়ে থাকেন। অতঃপর ছাবিত রাসূল করীম (সা)-এর নিকট গমন করে তার কাছে অব্যাহতি চাইলে তিনি তাকে মুক্ত করে দেন। এরপর ছাবিত তাঁর কাছে গিয়ে তাকে তার মুক্তির সংবাদ জানান। তিনি বললেন : বৃদ্ধ লোক, না আছে পরিবার, না আছে সন্তান, এমন জীবন নিয়ে সে কী করবে? তারপর ছাবিত রাসূল করীম (সা)-এর নিকট গিয়ে তার স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য মুক্তি চাইলে রাসূল করীম (সা) তাদেরকেও মুক্তি দান করলেন। এরপর তিনি যুবায়র-এর নিকট উপস্থিত হলে সে বললো, হিজাযে একটা পরিবার অর্থ-সম্পদ ছাড়া কিভাবে বেঁচে থাকবে? তখন ছাবিত রাসূল করীম (সা)-এর নিকট গিয়ে যুবায়র ইবন বাতার ধন-সম্পদ ফেরত দানের আবেদন জানালে রাসূল করীম (সা) তাও মঞ্জুর করেন। ছাবিত ফিরে গিয়ে তাকে এ সংবাদ দিলে সে বললোঃ হে ছাবিত! যে লোকটির চেহারা ছিল চীনা আয়নার ন্যায় স্বচ্ছ, যার মধ্য দিয়ে কা’ব ইব্‌ন আসাদের পরিবারের রমণীদের মুখ দেখা যেতো, তার খবর কি? তিনি বললেন : সেতো নিহত বৃদ্ধটি। তখন বললো ও গ্রাম আর শহর সব অঞ্চলের নেতা হুয়াই ইবন আখতাব, তিনি কী করলেন । বললাম, সে ও নিহত হয়েছে। সে বললো : আমরা যুদ্ধে শত্রুর মুখোমুখি হলে যিনি আমাদের অগ্রবর্তী থাকতেন, আর আমরা পলায়ন করলে যিনি আমাদের সহায়তা করতেন, সেই ইযাল ইবন শামওয়ালের খবর কি? তিনি বললেন, সেও নিহত হয়েছে। বৃদ্ধটি জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে বনূ কা’ব ইবন কুরায়যা এবং বনূ আমর ইবন কুরায়যার কী খবর? ছাবিত বললেন : তারা সকলেই বিদায় নিয়েছেন সকলেই নিহত হয়েছেন। বৃদ্ধটি তখন বলে উঠলো, হে ছাবিত! তোমার প্রতি আমার যে অনুগ্রহ, তার দোহাই দিয়ে বলছি। আমাকে আমার লোকজনের সঙ্গে মিলিত করে দাও। আল্লাহর কসম! এদের পরে বেঁচে থাকায় আর কোন মঙ্গল নেই। বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়া ছাড়া আমিতো আর একটুও ধৈর্য ধারণ করতে পারছি না। ছাবিত তাকে আগে ঠেলে দিলে তার গদান দ্বিখন্ডিত করা হয়। বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা হযরত আবু বকর (রা)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি বলেন : আল্লাহর কসম, জাহান্নামের আগুনেই তাদের মিলন হবে। সর্বদা সেখানে তারা বাস করবে। 

ইবন ইসহাক (র) বলেন : বনূ কুরায়যার মধ্যে যেসব যুবকের গোফ-দাঁড়ি গজিয়েছিল রাসূল করীম (সা) তাদের সকলকে হত্যা করার নির্দেশ দান করেছিলেন তিনি শুবা ইবন হাজ্জাজ– আতিয়া আল-কারযীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, বনূ কুরায়্যার মধ্যে যাদের গো-দাড়ি গজিয়েছে। তাদের সকলকে হত্যা করার নির্দেশ দান করেন। তখন আমি বালক ছিলাম। তারা দেখলো যে, আমার গোঁফ-দাঁড়ি গজায়নি, তাই তারা আমাকে অব্যাহতি দেয়। চারটি ‘সুনান’ গ্রন্থের ইমামগণও আবদুল মালিক ইবন উমায়র সূত্রে আতিয়া আল-কারযীর বরাতে অনুরূপ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যেসব আলিমরা বলেন যে, লজ্জাস্থানের চারিপার্শ্বের লোম গয়ানো বালিগ হওয়ার প্রমাণ, তারা এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেন। ইমাম শাফিঈ (র)-এর দুটি উক্তির মধ্যে বিশুদ্ধতম উক্তি অনুযায়ী এটাই হলো সাবালকত্বের প্রমাণ। কোন কোন আলিম যিম্মী শিশুদের মধ্যে পার্থক্য করেন। তাঁদের মতে, শিশুদের ক্ষেত্রে এটা বালিগ হওয়ার প্রমাণ হিসাবে গৃহীত হবে, অন্যদের ক্ষেত্রে নয়। কারণ, এ দ্বারা মুসলমানদের বিব্রত হওয়ার কারণ ঘটবে। 

ইবন ইসহাক আইউব ইবন আব্দুর রহমান সূত্রে বর্ণনা করেন যে, সালমা বিনত কায়স যাকে উম্মুল মুনযির বলে ডাকা হতো তিনি রাসূল করীম (সা)-এর নিকট রিফায়া ইবন শামওয়ালকে মুক্ত করার জন্য আবেদন জানালে তিনি তা মঞ্জুর করেন। এ সময় তিনি বালিগ ছিলেন। আর রিফায়া আগে থেকেই তাদেরকে জানতেন। সালমা বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রিফায়ার ধারণা যে, সে অচিরেই নামায আদায় করবে এবং উটের গোশত খাবে । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাতে সম্মতি দিয়ে রিফায়াকে মুক্ত করে দেন। ইব্‌ন ইসহাক মুহাম্মাদ ইব্‌ন জাফর– আইশা (রা) সূত্রে বলেন, বনূ কুরায়যার মধ্যে কেবল একজন নারীকে হত্যা করা হয়। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম, যে মহিলা আমার সাথে কথা বলছিল প্রাণ খুলে হাসছিল। আর এমন সময় রাসূল করীম (সা)-এর নির্দেশে তাদের পুরুষদেরকে বাজারে হত্যা করা হচ্ছিল। এ সময় হঠাৎ তার নাম ধরে ডাকা হয় হে অমুকের কন্যা । সে বললো, আল্লাহর কসম! আমি যে নারী। তিনি বলেন, আমি তাকে বললাম, তোমার কী হয়েছে : সে বললো, আমি একটি ঘটনা ঘটিয়েছি বলে আমাকে হত্যা করা হবে । হযরত আইশা (রা) বলেন, তাকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হল । আইশা (রা) প্রায়ই বলতেন, আল্লাহর কসম! তার এ আশ্চর্য ঘটনাটি আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না । সে ছিল হাসিখুশী রমণী; অথচ সে জানতো যে, তাকে হত্যা করা হবে। অনুরূপ ইমাম আহমদ (র) ও ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইবন ইসহাক বলেন, এ মহিলাটি খাল্লাদ ইবন সুওরায়দ-কে যাতায় নিক্ষেপে হত্যা করেছিল । একারণে রাসূল করীম (সা) তাকে হত্যা করেন। ইব্‌ন ইসহাক অন্যত্র এ মহিলার নাম উল্লেখ করেছেন নাবাতা বলে । সে ছিল হাকাম আল-কুরীর স্ত্রী। 

ইবন ইসহাক আরো বলেন : রাসূল করীম (সা) খুমুস তথা এক পঞ্চমাংশ বের করার পর বনূ কুরায়যার সম্পদ, নারী এবং সন্তানদেরকে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেন। তিনি অশ্বারোহীর জন্য তিন অংশ- দু’ অংশ অশ্বের আর একাংশ অশ্বারোহীর এবং একাংশ করে পদাতিকের দান করেন। তখন অশ্ব ছিল ৩৬ টি । ইবন ইসহাক বলেন, এই প্রথম বারের মতো গনীমতের মালে দুই অংশ দান ও খুমুস বা এক-পঞ্চমাংশ সংরক্ষণের রীতি প্রবর্তিত হয়। 

ইবন ইসহাক আরো বলেন, রাসূল করীম (সা) বনু কুরায়যার বন্দীদেরকে সায়া দিয়ে সাঈদ ইব্‌ন যায়দকে নাজুদে প্রেরণ করে তার বিনিময়ে অশ্ব ও অস্ত্র ক্রয় করেন। রাসূল করীম (সা) বনূ কুরায়যার নারীদের মধ্যে রায়হানা বিন্ত আমর ইব্‌ন খানাকাকে নিজের জন্য পসন্দ করেন। এ মহিলাটি ছিলেন বনূ আম্‌র ইবন কুরায়যা গোত্রের। তিনি আমৃত্যু রাসূল করীম (সা)-এর মালিকানাধীন ছিলেন। রাসূল করীম (সা) তার কাছে ইসলাম পেশ করলে তিনি প্রথমে বিরত থাকেন। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল করীম (সা) অত্যন্ত আনন্দিত হন। তাকে মুক্ত করে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলে তিনি রাসূলুল্লাহর সুবিধার কথা বিবেচনা করে একজন দাসীরূপে থাকাই পসন্দ করেন। রাসূল করীম (সা)-এর ইনতিকাল পর্যন্ত তিনি তাঁর কাছেই ছিলেন। তারপর ইবন ইসহাক খন্দক যুদ্ধের কাহিনী প্রসঙ্গে সূরা আহযাবের প্রথম দিকের আয়াত সম্পর্কে আলোচনা করেন। সূরা আহযাবের তাফসীরে এ বিষয়ে আমরা বিশদ আলোচনা করছি। সমস্ত প্রশংসা আর সন্তুষ্টি আল্লাহর জন্য । 

ইবন ইসহাক বলেন : বনু কুরায়যার যুদ্ধের দিন মুসলমানদের মধ্যে খাল্লাদ ইবন সুওয়ায় ইবন সা’লাবা ইবন আমর আল-খাযরাজী শাহাদত বরণ করেন। এক মহিলা তার প্রতি যাতা নিক্ষেপ করলে তিনি প্রচণ্ড আঘাত পান। মুসলমানরা মনে করেন যে, রাসূল করীম (সা) বলেছেন : হযরত খাল্লাদের জন্য রয়েছে দু’জন শহীদের পুরস্কার। আমি বলি : প্রস্তর নিক্ষেপকারী মহিলা ছাড়া বনু কুরায়যার মধ্যে অন্য কোন নারীকে হত্যা করা হয়নি। এ ঘটনা ইতিপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন। 

ইবন ইসহাক বলেন, বনূ কুরায়যার অবরোধকালে আবু সিনান ইবন মিহসান ইব্‌ন হুরসান ইনতিকাল করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। ইনি ছিলেন বনূ আসা’দ ইবন খুযায়মার লোক। আজও সেখানেই তাঁর কবর রয়েছে।

হযরত সাদ ইবন মুআয (রা)-এর ইনতিকাল 

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, অভিশপ্ত হিব্বান ইবন আরিকা সা’দ ইবন মুআয (রা)-এর প্রতি তীর নিক্ষেপ করলে তা তাঁর বাহুর প্রধান শিরায় বিদ্ধ হয়। পরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আগুন দাগালে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। এসময় সা’দ (রা) আল্লাহর দরবারে দু’আ করেন যা ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং বনূ কুরায়যার মধ্যেকার চুক্তিসমূহ তারা ভঙ্গ করে এবং রাসূলুল্লাহর বিরুদ্ধে মুশরিক দলের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। সম্মিলিত কাফির বাহিনী যখন দূরে চলে যায় এবং বনু কুরায়যা কালিমা লিপ্ত বদনে দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষয়ক্ষতিসহ নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে আসে। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বনু কুরায়যাকে অবরোধ করার জন্য রাসূল করীম (সা) তাদের অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন। রাসূল করীম (সা) ঘেরাও করে (তাদের জীবন) সংকীর্ণ করে তুললে রাসূল করীম (সা)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তারা দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসতে সম্মত হয়। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী রাসূল করীম (সা) তাদের ব্যাপারে যে নির্দেশ দান করবেন। তারা তা মেনে নিতে রাযী হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের ব্যাপারে ফায়সালা করার দায়িত্ব আওস গোত্রপতি হযরত সা’দের উপর ন্যস্ত করেন। কারণ, জাহিলী যুগে আওস গোত্র ছিল বনূ কুরায়যার মিত্র পক্ষ। এতে বনূ কুরায়যাও সম্মত হয়। আবার কারো কারো মতে হযরত সা’দকে সালিশ নিযুক্ত করার জন্যে তারাই প্রস্তাব দিয়েছিল। কারণ, তারা তাঁর পক্ষ থেকে দয়াও অনুগ্রহের আশা পোষণ করতো। কারণ, তাঁর ঈমানের দৃঢ়তা ও সত্যবাদীতার আলোকে তারা এমনটি মনে করতো না যে, তিনি তাদেরকে শুকর আর বানরের চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করবেন।

সাদ (রা) মসজিদে নববীতে একটা তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিকট পয়গাম প্রেরণ করলে অসুস্থতার কারণে তাকে গাধায় সওয়ার করে আনা হয়। আর গাধার পৃষ্ঠের পালান ছিল নরম গদি বিশিষ্ট। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তাঁবুর নিকটবর্তী হলে তিনি উপস্থিত লোকজনকে তাঁর উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হওয়ার নির্দেশ দেন। কারো কারো মতে, তাঁর এই দণ্ডায়মান হওয়া ছিল অসুস্থতার কারণে; আবার কারো কারো মতে এটা ছিল বিবাদীদের দৃষ্টিতে তাঁর মর্যাদা প্রকাশের উদ্দেশ্যে। যাতে তাঁর নির্দেশ তাদের কাছে অধিকতর কার্যকর হয়। আল্লাহই ভাল জানেন।

সাদ ইবন মু’আয (রা) যখন বনূ নষীরের ব্যাপারে হত্যা এবং বন্দী করার হুকুম জারী করেন এবং আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর চক্ষু শীতল এবং অন্তর প্রশান্ত করেন এবং তিনি মসজিদে নব্বীতে তাঁর খীমায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সান্নিধ্যে তিনি ফিরে আসেন, তখন তিনি শাহাদত কামনা করে আল্লাহর নিকট দু’আ করেন। আল্লাহ্ তাঁর মনোবাঞ্চা পূর্ণ করেন। এরপর তাঁর ক্ষতস্থান থেকে পুনরায় রক্ত ক্ষরণ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এর ফলেই তাঁর ইনতিকাল হয়। মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন। 

ঐতিহাসিক ইবন ইসহাক বলেন : বনু কুরায়যার বিষয়টি নিষ্পন্ন হলে সা’দ ইব্‌ন মু’আয এর আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং এর ফলে তিনি শাহাদতের মৃত্যু বরণ করেন। 

ইবন ইসহাক মু’আয ইবন রিফা’আ আ-যারকীর সূত্রে নির্ভরযোগ্য রাবীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, রাত্রিকালে হযরত সা’দ ইনতিকাল করলে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম মাথায় রেশমী পাগড়ি পড়ে আগমন করে বলেন : হে মুহাম্মাদ! এ মৃত ব্যক্তি কে? যার জন্য আসমানের দরজা উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং আরশ প্রকম্পিত হয়েছে : তিনি বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) চাদর টানতে টানতে হযরত সা’দের দিকে দ্রুত গমন করে তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। আল্লাহ্ তাঁর প্রতি তুষ্ট থাকুন। আর হাফিয বায়হাকী (র) তাঁর দালাইল গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, হাফিয আবু আবদুল্লাহ্ জাবির ইবন আব্দুল্লাহ্ থেকে বর্ণনা করেন ও জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আগমন করে বলেন ও মৃত্যুবরণকারী এ নেকার ব্যক্তিটি কে? যার জন্য আসমানের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং যার জন্য আরশ প্রকম্পিত হয়েছে : তিনি বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বের হয়ে হযরত সা’দ (রা)-এর লাশ দেখতে পান। রাবী বলেন, তাঁর দাফনের সময় রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর কবরের পাশে বসেন। সেখানে বসে তিনি দুবার সুবহানাল্লাহ্ বললে (উপস্থিত) লোকজনও সুবহানাল্লাহ্ বললেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার বললে উপস্থিত লোকজনও আল্লাহু আকবার বলেন । তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : 

এ নেকার ব্যক্তিটির জন্য আমি সত্যিই বিস্মিত । কবরে তার প্রতিও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। শেষ পর্যন্ত তার কবর প্রশস্ত করা হলে আমি তাকবীর ধ্বনি দেই । 

ইমাম আহমাদ এবং ইমাম নাসাঈ (র) ইয়াযীদ ইবন আবদুল্লাহ প্রমুখ সূত্রে জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, সা’দ (রা)-এর মৃত্যুর দিন তাঁর দাফনকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন । 

এ নেককার লোকটির জন্য অবাক হতে হয়; যার জন্য দয়াময় আল্লাহ্ তা’আলার আরশ প্রকম্পিত হয় এবং আসমানের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত হয় । তার জন্যে কবর সংকীর্ণ করার পর আল্লাহ তাকে প্রশস্ত করেছেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক মু’আয ইব্ন রিফাআ— জাবির ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ সূত্রে বর্ণনা করেন। 

সা’দ (রা)-কে যখন দাফন করা হয়, তখন আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে ছিলাম। তখন তিনি সুবহানাল্লাহ বলে লোকেরাও তাঁর সঙ্গে সুবহানাল্লাহ্ বলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহু আকবার বললে লোকেরাও তাঁর সাথে আল্লাহু আকবার বলেন। তখন উপস্থিত সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কী কারণে সুবহানাল্লাহ্ বললেন :জবাবে তিনি বললেন, এ নেকার লোকটির জন্য কবর সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তাঁর জন্য কবরকে প্রশস্ত করে দেন । ইমাম আহমদ (র) হযরত সা’দের পুত্র ইব্রাহীম সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেন। ইবন হিশাম বলেন, এ হাদীছের বক্তব্য হযরত আইশা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীছের অনুরূপ। যাতে তিনি বলেন । 

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : অর্থাৎ কবর একবার চাপ দিবে, যদি কোন ব্যক্তি এ থেকে নিষ্কৃতি পেতো তা হলে সা’দ ইব্‌ন মুআয তা অবশ্যই পেতেন। ইমাম আহমদ (র) ইয়াহয়া সূত্রে— হযরত আইশা (রা) থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেন। হযরত আইশা (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : 

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন : কবরের চাপ আছে; তা থেকে কেউ রক্ষা পেলে সা’দ ইবন মু’আয রক্ষা পেতেন। এ হাদীছটি বিশুদ্ধ হাদীছ গ্রন্থদ্বয় বুখারী মুসলিমের শর্তানুযায়ী বিশুদ্ধ। তবে ইমাম আহমদ (র) হাদীছটি গুন্দার–… আইশা (রা) সূত্রেও বর্ণনা করেছেন। হাফিয বাযার নাফি সূত্রে ইবন উমর (রা)-এর বরাতেও হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। হাফিয বাযযার আবদুল আলা সূত্রে– ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : 

সা’দ ইবন মু’আয যে দিন ইনতিকাল করেন সেদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা পৃথিবীতের অবতরণ করেছিলেন যারা ইতিপূর্বে কোনদিন যমীনে অবতরণ করেননি। কবর তাঁকে এক দফা চাপ দেয়। এ হাদীছটি বর্ণনা করে রাবী নাফি কাঁদতে শুরু করেন। এটি একটি উত্তম সনদ; তবে বাযযার বলেন যে, উবায়দুল্লাহর মাধ্যমে নাফি সূত্রে অন্যরাও মুরসালরূপে হাদীছটি বর্ণনা করেন। তারপর বায়ূর সুলায়মান ইবন সাইফ— ইবন উমর সূত্রে বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন :

সা’দ ইবন মু’আয-এর মৃত্যুতের ৭০ হাজার ফেরেশতা অবতরণ করেন; যারা ইতিপূর্বে পৃথিবীতে কোনদিন পদার্পণ করেননি। দাফনকালে তিনি বলেন, সুবহানাল্লাহ! কবরের আযাব আর চাপ থেকে কেউ মুক্তি পেলে তা পেতেন সা’দ ইবন মু’আয । হাফিয বাযযার ইসমাঈল ইবন হাফ— ইবন উমর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, সাদের সঙ্গে আল্লাহর সাক্ষাতের আগ্রহে (আল্লাহর) আরশ স্পন্দিত হয়। বলা হয় যে, এখানে আরশ অর্থ আসন । কুরআন মজীদে (হযরত ইউসুফ আ. সম্পর্কে) বলা হয়েছে যে, (তিনি তার পিতামাতাকে আরশে তোলেন (১২-ইউসুফ : আয়াত ১০০) এখানেও আরশ অর্থ আসন, রাবী বলেন যে, এতে আসনের স্তম্ভগুলো আলগা হয়ে যায়। রাবী ইবন উমর (রা) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাদের কবরে প্রবেশ করে কিছু সময় সেখানে কাটান। তিনি কবর থেকে রেরিয়ে আসলে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! বিলম্বের হেতু কি? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন : 

কবরে সা’দকে প্রচণ্ড চাপ দেয়া হয়। আমি আল্লাহর নিকট দু’আ করলে তার কবর প্রশস্ত করা হয়। হাফিয বাযযার বলেন, এ হাদীছের সনদে আতা ইবনুস সাইব একক রাবী। আমি বলি, তার সম্পর্কে অনেক সমালোচনা রয়েছে। ইমাম বায়হাকী (র) কবরে হযরত সাদের উপর চাপের বর্ণনা উল্লেখ করার পর এটিকে গরীব তথা অপ্রসিদ্ধ বর্ণনা বলে মন্তব্য করেছেন। এতে তিনি হাফিয আবু আবদুল্লাহর বরাতে আবুল আব্বাস– উমাইয়া ইবন আবদুল্লাহ্ হযরত সা’দের পরিবারের কোন সদস্যকে জিজ্ঞেস করেন। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কোন উক্তি আপনাদের নিকট পৌঁছেছে কি? তাঁরা বলেন, আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন :–

তিনি প্রস্রাব শেষে পবিত্রতা অর্জনের ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা করতেন। ইমাম বুখারী (র) মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না– জাবির সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি নবী করীম (সা)-কে বলতে শুনেছি: 

সা’দ ইবন মু’আযের মৃত্যুতে আরশ প্রকম্পিত হয়েছে। আমাশ সূত্রে জাবির (রা) থেকে অনুরূপ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তখন জনৈক ব্যক্তি জাবির (রা)-কে প্রশ্ন করে- তবে যে বারা ইবন আযিব বলেছেন : -J AJ আসন প্রকম্পিত হয়েছে। জবাবে জাবির (রা) বললেন, এ দুই সম্প্রদায় (অর্থাৎ আওস এবং খারাজ)-এর মধ্যে রেষারেষি ছিল। আমি নবী করীম (সা)-কে বলতে শুনেছি, সা’দ ইবন মু’আয এর মৃত্যুতে দয়াময় (আল্লাহ)-এর আরশ কেঁপে উঠেছে। ইমাম মুসলিম এবং ইবন মাজা ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেন। 

ইমাম আহমদ (র) আবদুর রাযযাক সূত্রে ইবন জুরায়জ থেকে বর্ণনা করেন যে, জাবির ইবন আবদুল্লাহকে বলেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি, এ সময় সা’দ ইব্‌ন মু’আযের লাশ তাদের সম্মুখে ছিল । সা’দ ইবন মু’আযের লাশের জন্য দয়াময় আল্লাহর আরশ প্রকম্পিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম (র) আব্‌দ ইবন হুমায়দ সূত্রে এবং ইমাম তিরমিযী (র) মাহমূদ ইবন গায়লান সূত্রে আর উভয়ে আবদুর রাযযাক সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেন । ইমাম আহমদ (র) ইয়াহয়া ইবন সাঈদ সূত্রে আবু নারার বরাতে বর্ণনা করেন যে, আমি আবু সাঈদকে নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি যে, সা’দ ইব্‌ন মু’আয-এর মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। ইমাম নাসাঈ (র) ইয়াকূব ইবন ইব্রাহীম সূত্রে ইয়াহয়ার বরাতে হাদীছটি বর্ণনা করেন। ইমাম আহমদ (র) আবদুল ওয়াহহাব সূত্রে— আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে এ মর্মে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (র) ও ভিন্ন সূত্রে আবদুল ওয়াহহাবের বরাতে হাদীছটি বর্ণনা করেন। বায়হাকী (রা মু’তামির ইব্‌ন সুলায়মান হাসান বসরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, সা’দ ইবন মু’আয এর রূহের আগমনের আনন্দে দয়াময় আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। হাফিয বা্যুর (র) যুহায়র ইব্‌ন মুহাম্মাদ– আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত সা’দের লাশ বহন করে আনা হলে বনু কুরায়যার তার ফয়সালার জন্যে অসন্তুষ্ট মুনাফিকরা বলে উঠে, কতইনা হালকা তার লাশ, এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, না, বরং ফেরেশতাগণ তার লাশ বহন করছেন। হাদীছটির সনদ উত্তম। 

বুখারী (র) মুহাম্মাদ ইবন বাযযার– আবু ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি বারা ইবন আযিবকে বলতে শুনেছি । 

বারা ইবন আযিব বলেন, নবী করীম (সা)-এর দরবারে একটা রেশমী এক জোড়া কাপড় উপহার স্বরূপ এলে লোকজন তা স্পর্শ করে এবং তার মসৃণতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, এটা কোমল দেখে তোমরা বিস্মিত বোধ করছ? সা’দ ইব্‌ন মু’আযের রুমাল এর চেয়েও উত্তম এবং কোমল । অতঃপর তিনি বলেন, কাতাদা এবং যুহরী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আমরা আনাস (রা)-কে নবী করীম (সা) থেকে হাদীছটি বর্ণনা করতে শুনেছি। ইমাম আহমদ (র) আবদুল ওয়াহ্হাব— আনাস ইবন মালিক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, দুমার উকায়দির নবী করীম (সা)-এর দরবারে একটা জুব্বা হাদিয়া স্বরূপ প্রেরণ করেন, আর এটা ছিল রেশম ব্যবহার হারাম হওয়ার পূর্বের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জুব্বাটি পরিধান করলে লোকেরা বিস্মিত হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : সে সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন, জান্নাতে সা’দের রুমাল এর চাইতে সুন্দর। 

হাদীছটির সনদ বুখারী মুসলিমের শর্তানুযায়ী হলেও মুহাদ্দিসগণ হাদীছটি বর্ণনা করেননি। তবে ইমাম বুখারী সাদবিহীনভাবে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন, ইমাম আহমদ (র) ইয়াযীদ– সা’দ ইবন মু’আয-এর পৌত্র ওয়াকিদ ইবন আমর আর তিনি ছিলেন অতিশয় সুদর্শন ও দীর্ঘকায় ব্যক্তি। বলেন : আমি আনাস ইবন মালিক (রা)-এর নিকট গমন করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? আমি বললাম, আমি ওয়াকিদ ইবন আমর ইবন সা’দ ইব্‌ন মু’আয । তিনি বললেন, তুমি তো সাদের সঙ্গে বেশ সামঞ্জস্যশীল, এরপর তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে কাঁদলেন এবং বললেন, সা’দের প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক! তিনি ছিলেন বিশালবপু এবং দীর্ঘকায় ব্যক্তি। তারপর তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) দূমার (শাসক) উকায়দির-এর নিকট একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা) সমীপে স্বর্ণ খচিত একটা রেশমী জুব্বা প্রেরণ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জুব্বাটি পরে মিম্বরে আরোহণ করে কোন কথা না বলে বসে পড়েন। এরপর তিনি মিম্বর থেকে নেমে আসেন। লোকেরা জুব্বাটি স্পর্শ করে এবং দেখতে থাকে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, এতে তোমরা অবাক হচ্ছ? জান্নাতে সা’দ ইব্‌ন মু’আযের রুমাল তোমরা যা দেখছ, তার চেয়ে অনেক সুন্দর। ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসাঈ (র) মুহাম্মাদ ইবন আমর-এর সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (র) হাদীছটিকে হাসান সহীহ্ বলেছেন। 

ইবন ইসহাক (র) সাআদ ইবন মু’আয এর মৃত্যুতে আরশ আন্দোলিত হওয়ার কথা উল্লেখ করার পর বলেন যে, এ সম্পর্কে জনৈক আনসারী ব্যক্তি নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন : 

কোন মৃত্যু পথযাত্রীর জন্য আল্লাহর আরশ কম্পন ধরেনি, যা আমরা শ্রবণ করেছি। একমাত্র ব্যতিক্রম আবু আমর সাদি। 

ইবন ইসহাক বলেন, হযরত সা’দের লাশ বহনকালে তাঁর মা অর্থাৎ কুবায়শা (মতান্তরে কাবশা) বিন্ত রাফি’ ইবন মু’আবিয়া ইবন উবায়দ ইবন ছা’লাবা আলমুদরিয়া আল-খাযয়াজিয়া বলেন : 

দুঃখ হয় সা’দের জন্য সা’দ জননীর 
কর্তন আর বাধার কারণে।
নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব আর শ্রেষ্ঠত্বের কারণে 
পরিপূর্ণ অশ্বারোহণের কারণে।
তার কারণে হয় সংযম আর সংবরণ, 
সে কর্তন আর চূর্ণ করে মস্তক।

ইবন ইসহাক বলেন, (সাদি জননীর মুখে এ শোকগাথা শ্রবণ করে) রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন : সাদ ইব্‌ন মু’আযের জন্য বিলাপকারিণী ছাড়া সকল বিলাপকারিণীই মিছামিছি প্রশংসা করে বিলাপ করে। 

আমি বলি, আহযাব যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রায় ২৫ দিন পর হযরত সা’দ (রা)-এর মৃত্যু হয়। কারণ, সম্মিলিত কাফির বাহিনীর আগমন ঘটে হিজরী পঞ্চম সালে, তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তারা প্রায় একমাস অবস্থান করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ বনু কুরায়যার অবরোধের উদ্দেশ্যে বের হন এবং ২৫ দিন তা অব্যাহত রাখেন। হযরত সা’দের ফায়সালা সাপেক্ষে তারা দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসে। এর স্বল্পকাল পর তিনি ইনতিকাল করেন। তাই তাঁর মৃত্যুর ঘটনা হিজরী ৫ম সালে যিলকদ মাসের শেষ দিকে বা যিলহজ্জ মাসের প্রথম দিকে ঘটে থাকবে । আল্লাহই ভাল জানেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক এরূপই বলেছেন। তাঁর মতে, বনূ কুরায়যার উপর বিজয় লাভের ঘটনা ঘটে যিলকদের শেষ এবং যিলহজ্জ মাসের শুরুতে। তিনি আরো বলেন যে; এ বছর মুশরিকরাই হজ্জের তত্বাবধানে ছিল। ইবন ইসহাক বলেন, হযরত সা’দের ইনতিকালে হাস্সান ইব্‌ন ছাবিত নিম্নোক্ত শোকগাথা রচনা করেন —

মর্মার্থ : আমার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়েছে, আর সাদের জন্য অশ্রু বর্ষণ করা তার জন্য সমীচীন হয়েছে। 

যুদ্ধের ময়দানে তিনি নিহত হয়েছেন তার জন্য চোখসমূহ অশ্রুসিক্ত সদা অশ্রুপাত করছে। 

তিনি জীবন দান করেছেন দয়াময়ের দীনের জন্যে। তিনি শহীদদের সঙ্গে জান্নাতের ওয়ারিছ হয়েছেন। আর জান্নাতী দলের প্রতিনিধিই তো সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিনিধি । 

যদিও তুমি আমাদেরকে ছেড়ে গিয়েছ, ত্যাগ করেছ এবং আশ্রয় নিয়েছ অন্ধকার কবর কুঠরীতে । 

হে সা’দ! তুমিতো আশ্রয় নিয়েছ উত্তম শাহাদত হয়েছে। উত্তম তুমি সত্যিই প্রশংসা। 

বনূ কুরায়যা গোত্র সম্পর্কে তোমার ফায়সালা অনুযায়ী। আর তোমার নির্দেশ ছিল আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে। আস্থার সঙ্গে তুমি ফায়সালা দান করেছ। 

তাদের ব্যাপারে তোমার ফায়সালা ছিল আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী। তোমাকে অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করালে তুমি তাদের ক্ষমা করনি। কালের প্রবাহ তোমাকে তাদের মাঝে নিয়ে গেছে বটে;  তারা ক্রয় করে নিয়েছে চিরন্তন জান্নাতের পরিবর্তে এই দুনিয়া জীবনকে । কতই না চমৎকার নেককারদের প্রত্যাবর্তন স্থল, যখন একদিন তাদেরকে ডাকা হবে আল্লাহর দিকে মর্যাদার সাথে।

খন্দক ও বনূ কুরায়যার যুদ্ধ সংক্রান্ত কবিতাগুচ্ছ 

ইমাম বুখারী (র) হাজ্জাজ ইবন মিনহাল—বারা ইবন আঙিব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলে করীমকে হযরত হাসানকে লক্ষ্য করে একথা বলতে শুনেছেন? 

তুমি তাদের নিন্দা কর, জিব্রাঈলও এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আছেন। বুখারী বলেন, ইব্রাহীম ইবন তাহমান–… বারা ইবন আযিব সূত্রে বর্ণনা করেন, বনূ কুরায়যার যুদ্ধের দিন নবী করীম (সা) হাসসান ইবন ছাবিতকে বলেন : তুমি মুশরিকদের নিন্দা কর । কারণ, জিব্রাঈল (আ) এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আছেন। বুখারী, মুসলিম এবং, নাসাঈ বিভিন্ন সূত্রে কোন রকম বৃদ্ধি করা ছাড়া হাদীছটি বর্ণনা করেছেন, ইবন ইসহাক (র) বলেন, বনূ মুহারিব ইবন ফিহর গোত্রীয় যিরার ইবনুল খাত্তাব ইবন মিরদাস খন্দক যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেন, আমার মতে তখনো তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি কবিতার ছন্দে বলেন : 

মর্মার্থ : অনেক দয়ালু আছেন, যারা আমাদের ব্যাপারে নানা ধারণা পোষণ করেন, আমরা নেতৃত্ব দিয়েছি দর্প চূর্ণকারী বাহিনীকে। 

দর্শকদের সম্মুখে তার সদস্যরা উপস্থিত হলে তাদেরকে উহুদ পাহাড়সম মনে হতো। 

তুমি তাদের দেহগুলোকে বর্ম আচ্ছাদিত দেখতে পাবে, মযবুত বর্ম আর উত্তম অশ্ব ও তীর ধনুকে সজ্জিত। আমরা তাদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করি যেন তারা বিভ্রান্ত অপরাধী। 

যখন তারা হামলা চালায় আর আমরাও হামলা চালাই, তখন তারা যেন পরিখার স্থানে আমাদের সঙ্গে মুকাবিলা করছিল। তারা এমন মানুষ যাদের মধ্যে আমরা একজন ও সদ্বুদ্ধি পরিচালিত ব্যক্তি দেখতে পাই না। অথচ তারা বলে থাকে, আমরা কি নেকার নই? আমরা এক মাস তাদেরকে অবরোধ করে রাখি, আর আমরা ছিলাম তাদের উপর প্রতাপশালী । 

প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা আমরা তাদের উপর হামলা চালাতাম অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবিরাম ধারায়। আমাদের হাতে থাকতো তীক্ষ্ণ ধারালো তরবারি। এ গুলো দ্বারা আমরা কর্তন করতাম তাদের সিথিস্থল আর মাথার খুলিসমূহ। নাঙ্গা তরবারি যখন রাত্রিকালে ঝলসে উঠে তা ছিল যেন কোষমুক্ত তলোওয়ারের চাকচিক্যসম। তাতে তুমি আকীক পাথরের উজ্জলতা দেখতে পাবে। 

পরিখা যদি না থাকতো এবং তারা সেখানে না থাকতো তবে আমরা তাদেরকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দিতাম। 

কিন্তু তাদের মধ্যস্থলে অন্তরায় হয় পরিখা এবং তারা আমাদের ভয়ে তার আশ্রয় নিত। 

আমরা বিদায় নিলে তাতে কি? আমরা তোমাদের গৃহের নিকট সা’দকে রেখে এসেছি। ‘বন্ধক’ হিসাবে । 

আঁধার ঘনীভূত হলে তুমি বিলালপকারিণীদেরকে সাদের জন্য বিলাপ করছে, শুনতে পাবে। 

অচিরেই আমরা আবার ফিরে আসবো যেমন আমরা তোমাদের কাছে এসেছিলাম পরস্পরের সহযোগিতা নিয়ে, আমরা আসবো বনূ কিনানার একদল সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে বনের সিংহের মতো যে নিজের বিচরণস্থল সংরক্ষণ করে থাকে। 

ইবন ইসহাক বলেন, বনূ সালিমা গোত্রীয় কাব ইবন মালিক (রা) তার জবাবে বলেন : 

অনেক নারী জানতে চায়, কী বিপদ পতিত হয়েছে আমাদের উপর। তুমি উপস্থিত হলে সেসব বিপদে আমাদেরকে ধৈর্যশীল দেখতে পেতে । আল্লাহর উপর নির্ভর করে আমরা সবর করেছি আমাদের উপর আপতিত বিপদে। কারণ, আমরা তো দেখি না আল্লাহর কোন বিকল্প। 

নবী ছিলেন আমাদের জন্য সত্যিকার সহায়ক। তাঁকে কেন্দ্র করেই তো আমরা হয়েছি সকল সৃষ্টির সেরা। 

আমরা লড়াই করি এমন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যারা যুলুম আর নাফরমানী করে। শত্রুতায় তারা আমাদেরকে লক্ষ্য বস্তু মনে করে। তারা আমাদের দিকে ছুটে এলে আমরা তাদের সমুচিত শিক্ষা দেই। আমরা এমন আঘাত হানি, যা ত্বরাচারী হানাদারদেরকে দ্রুত ঠেলে দেয় মৃত্যুর মুখে। 

তুমি আমাদেরকে দেখতে পাবে পরিপূর্ণ বর্মসমূহের অভ্যন্তরে যা বিস্তীর্ণ পুকুরের ন্যায় প্রশস্ত। 

আমাদের দক্ষিণ হস্তে রয়েছে হালকা শুভ্র তলোয়ার, যা দ্বারা আমরা প্রতিবিধান করি অনিষ্টকারীদের তৎপরতায়, পরিখার মুখে যেন সিংহ পঁড়িয়ে আছে। 

তাদের পানজা সিংহের বাসস্থল সংরক্ষণ করে।

আমাদের অশ্বারোহীদল সকাল-সন্ধ্যা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শক্রদলের উপর হামলা চালায়, 

যেন আমরা সাহায্য করি আল্লাহ এবং মুহাম্মাদ (সা)-এর যাতে আমরা পরিণত হই আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দায়। মক্কাবাসী এবং শত্রুদল, যারা ঐক্যবদ্ধ দল রূপে বেরিয়ে এসেছে, তারা যাতে জানতে পারে যে, আল্লাহর কোন শরীক নেই, এবং তিনিই মুমিনদের অভিভাবক। 

তোমরা যদি মূর্খতাবশতঃ সাদকে হত্যা করে থাকো। তবে মনে রাখবে যে, আল্লাহ্ সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী। (তিনি এর বদলা নেবেন)। 

অবিলম্বে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন উত্তম উদ্যানে যা হবে পুণ্যবানদের আবাসস্থল। 

যেমন তিনি তোমাদেরকে ফেরত পাঠিয়েছেন তোমাদের ক্রোধ ব্যর্থতাসহ অপদস্থ করে। এমনই অপদস্থ যে, সেখানে কল্যাণ থেকে তোমরা হবে বঞ্চিত। তখন তোমরা ধ্বংসের নিকটবর্তী হয়ে পড়েছিলে। ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা যা আপতিত হয় তোমাদের উপর। তোমরা তার নিচে হয়ে পড়েছিলে দৃষ্টিহীন। 

ইবন ইসহাক বলেন যে, খন্দকের দিন সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনুয যা’বরী আস সামী বলেন, (অবশ্য আমি বলি যে, এটা তার ইসলামগ্রহণের পূর্বের রচনা)। 

মর্মার্থ : অভিবাদন জ্ঞাপন কর তুমি সেসব নিবাসকে, কালের প্রবাহ আর ঘোর আপদ যার চিহ্ন মুছে ফেলেছে। 

যেন ইয়াহুদীরা এঁকেছে তার চিহ্ন আর নকলামালা উষ্ট্রের আবাসস্থল আর তাঁবুর খুঁটি বাদ দিয়ে।

পরিণত করেছে বিরান ময়দানে যেন কখনো তুমি, তাতে আনন্দ বিহার করনি সমবয়সী বন্ধুদেরকে নিয়ে। 

বাদ দাও অতীত দিনের স্মৃতির কথা, তাতো করেছে সে স্থানকে একেবারেই জনমানবশূন্য বিরান।

স্মরণ কর, তুমি সমকালীনদের নিবাসের কথা আর জ্ঞাপন কর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। কারণ, তারা সকলেই এসেছে তীর্থস্থান থেকে ।

মক্কাভূমি থেকে তারা ছুটে এসেছে ইয়াছরিব অভিমুখে, গভীর অন্ধকার রজনীতে বিপুল সংখ্যক সৈন্য সামন্ত নিয়ে। 

পরিচিত পথ বাদ দিয়ে তারা এসেছে চড়াই-উত্রাই অতিক্রম করে ও গিরিপথ ধরে।

তাতে রয়েছে উত্তম উৎকৃষ্ট অশ্ব যেগুলোকে চালিত করা হচ্ছিল একই সঙ্গে। 

এমন সব অশ্ব ক্ষীণ যেগুলোর উদর আর গতি যেগুলোর দ্রুত।—

এক বাহিনীতে ছুটে চলে উয়ায়না তার পতাকা নিয়ে, আর আবু সুফিয়ান ছিলেন বাহিনী নেতা রূপে।

এরা দুজন যেন দুই পূর্ণ চন্দ্র । এরা দুজনে পরিণত হয়েছে অভাবী আর পলাতকদের আশ্রয় 

তারা উপস্থিত হন মদীনায় এবং ব্যবহার করেন পরীক্ষিত তীক্ষ্ণধার তরবারি। 

এক মাস দশ দিন পর্যন্ত ওরা দাপট বিস্তার করে রেখেছিলেন মুহাম্মাদের উপরে, আর তার সাহাবীরা ছিলেন লড়াইয়ের উত্তম সাথী। 

তারা ঘোষণা দেয় প্রস্থানের ঐ ভোরে যখন তোমরা বলেছিলে, আমরা ব্যর্থ লোকদের কাছাকাছি পাঠিয়ে পৌঁছে গেছি। 

পারিখা না হলে তারা সবাই নিহত হতো, আর ক্ষুধার্ত পাখি নেকড়ের খোরাকে পরিণত হতো।  

ইবন ইসহাক বলেন যে, এর জবাবে হাস্সান ইবন ছাবিত বলেন– 

এটা কি বিরান প্রান্তরের বিলীয়মান চিহ্ন? যা দিয়ে যাচ্ছে প্রশ্নকারীর জবাব। 

এমনই বিরান সে প্রান্তর যে, মুষলধারার ক্রমাগত বৃষ্টি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তার সকল চিহ্ন। 

আমি সেখানে দেখতে পেয়েছি উজ্জ্বল চেহারার রমণীদেরকে যাদের বংশ উন্নত, যারা ছিল আসরের শোভা । 

ছেড়ে দাও তুমি সেসব ললনাদের আলোচনা, যাদের চেহারা সমুজ্জ্বল আর যাদের বচন মধুর । 

দুঃখ-কষ্টের অভিযোগ কর তুমি আল্লাহর নিকট, সেসব ক্রুদ্ধ ব্যক্তির, যারা যুলুম করেছে রাসূলের উপর। 

তারা ছুটে যায় তার দিকে সম্মিলিতভাবে এবং জড়ো করে শহরবাসী আর মরুচারী বেদুঈনদের। 

তাদের মধ্যে রয়েছে উয়ায়না আর আবু সুফিয়ান ইবন হারবের বাহিনী। ভীষণ ক্রুদ্ধ তারা সদল বলে। 

শেষ পর্যন্ত তারা উপস্থিত হয় মদীনায় এবং তারা প্রয়াস পায় রাসূলকে হত্যার এবং গনীমত লাভের। 

তারা প্রত্যুষে চড়াও হয় আমাদের উপর; কিন্তু তাদেরকে পেছন বাম হটিয়ে দেয়া হয় তাদের ক্ষোভসহ। বিতাড়িত করা হয় তাদেরকে ঝঞ্ঝা বায়ু দ্বারা এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাহিনী দ্বারা। 

এবং ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয় তাদের দলকে। মুমিনদের যুদ্ধের জন্য আল্লাহইতো যথেষ্ট, আর তিনি তাদেরকে দান করেন উত্তম প্রতিদান । 

তাদের নিরাশ হওয়ার পর, তিনি ছিন্ন করে দেন তাদের দলকে। 

এটা ছিল আমাদের মহান দাতা আল্লাহর সাহায। আর শীতল করেন তিনি মুহাম্মাদ ও তাঁর সাহাবীদের চোখ। 

আর লাঞ্ছিত করেন সকল সত্য প্রত্যাখ্যানকারী সংশয়বাদীকে। যাদের হৃদয়সমূহ চরম বিদ্বেষী ও কুফরীর সংশয়ে ডুবে রয়েছে। যাদের পরিধেয় নয় পরিচ্ছন্ন। দুর্ভাগ্য তাদের অন্তরে আসন গেড়ে বসেছে। কুফরী কালের শেষ প্রবাহ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

ইবনূ ইসহাক বলেন, কা’ব ইবন মালিকও তার জবাবে বলেন–

উক্ত কবিতায় তিনি যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা দেওয়ার পর বলেন– 

যুদ্ধের ঘটনা আমাদের জন্য অবশিষ্ট রেখেছে আমাদের পালনকর্তা মহান দাতার উত্তম দান। সুউচ্চ প্রাসাদ আর ফলদায়ক ফলের বাগানসমূহ। 

….. আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ আর হিদায়াত পূত-পবিত্র যবান পবিত্র বংশের ব্যক্তির মাধ্যমে। 

তা আমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করা হয়। আর আমরা পসন্দ করি তার চর্চা-আলোচনা আহযাবের ঘটনার পর, যা ঘটেছিল। 

কুরায়শ আর সম্মিলিত বহিনীর কাফিরদের প্রতি। এমন সব জ্ঞানের কথা, অপরাধীরা যাকে নিজেদের ধারণা মতে অকল্যাণকর মনে করে। 

কিন্তু বুদ্ধিমানরা অনুধাবন করেন তার সঠিক মর্ম। কুরায়শরা এসেছে,

আপন প্রভুর উপর বিজয়ী হওয়ার বাসনা নিয়ে; কিন্তু যে ব্যক্তি বিজয়ীর উপর জয়ী হতে চায়, তাকে তো বরণ করতে হয় চরম পরাজয়।

ইবন হিশাম বলেন, আস্থাভাজন এক ব্যক্তি– আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র সূত্রে বলেন যে, এ কবিতাটি শ্রবণ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন :

হে কাব! তোমার এ কবিতার জন্য আল্লাহ্ তোমার প্রশংসা করেছেন। আমি বলি, এ কবিতায় যে কুরায়শদেরকে ‘সাহীনা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে তার কারণ হচ্ছে- আরবরা তাদেরকে এ নামেই অভিহিত করতো। তাদের গরম খাবারের জন্য, যা সাধারণতঃ অন্যান্য মরুচারীরা আহার করতে পেতোনা। আল্লাহই ভাল জনেন।

ইবন ইসহাক বলেন, কাব ইবন মালিক আরো আবৃত্তি করেন :  

আনন্দ দান করে যে ব্যক্তিকে প্রচণ্ড যুদ্ধের নিনাদ, যেন তা পাত্রে আগুন লাগার শব্দ আরকি!

তারা যেন হাযির হয় আমাদের কর্মক্ষেত্রে, যে তার তলোয়ারে শান দেয় মামাম আর খন্দকের মধ্যবর্তী স্থানে।

যারা অভ্যস্ত নামকরা বীর হত্যায়, যারা নিজেদের জীবন সমর্পণ করেছে দিগন্তের প্রভুর উদ্দেশ্যে।

আল্লাহ্ সাহায্য করেছেন তাঁর নবীকে এ দল দ্বারা, আর তিনিতো তাঁর বান্দার প্রতি অত্যন্ত সদয়।

আমরা শত্রুর মুখোমুখি হই বিশাল বাহিনী নিয়ে, যা তাড়িয়ে দেয় বিশাল বাহিনীকে প্রাচ্যের পর্বত চূড়া জয় করার মতো!

দুশমনের তরে আমরা প্রস্তুত রাখি দীর্ঘ দেহী অশ্ব, যা গোলাবের মতো লাল; আর সাদা কাল মিশ্রিত বর্ণের।

তা ছুটে নিয়ে যায় অশ্বারোহীকে, তীব্র গতিতে, কারণ, বীর বাহাদুর যুদ্ধের দিন ভোর বেলা কুয়াশা জনিত কাদামাটিতে যেন সিংহ আর কি!

তারা সত্যিকার বিশ্বস্ত, ধুলোর তলে, বর্শা নিয়ে বীর-বাহাদুর ব্যক্তিদেরকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করায়।

যুদ্ধের জন্যে সে সব অশ্বকে আল্লাহ্ তৈয়ার রাখার হুকুম করেছেন, আর আল্লাহতো হলেন সর্বোত্তম তাওফীক দাতা।

যাতে তারা উত্তেজিত করে তোলে দুশমনকে, আর সুরক্ষিত করে নেয় নিজেদের আবাসস্থলকে, ফলে তেড়ে আসে শক্ত সমর্থ অশ্বরাজি। আর দুশমনের মুকাবিলা কালে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেন তার পক্ষ থেকে প্রদত্ত শক্তি আর ধৈর্য দ্বারা। কারণ, তিনিতো মহা শক্তিধর।

আমরা মান্য করি আমাদের নবীর নির্দেশ আর

সাড়া দেই তাঁর আহ্বানে, কষ্ট সাধ্য কাজের তরে । তিনি আহ্বান জানালে আমরা পশ্চাৎপদ হইনা ।

যুদ্ধকালে তিনি যখন ডাক দেন আমরা তাতে সাড়া দেই, আমরা তুমুল যুদ্ধের সময় ছুটে যাই সেখানে।

নবীর বাণী মেনে চলে যেজন ( সেতো পরম পুণ্যবান)। কারণ, তিনিতো আমাদের মধ্যে মান্যবর, তিনিই তো নেতা, আর তিনিই তো সত্য! এভাবে তিনি আমাদের সাহায্য করেন, প্রকাশ করেন আমাদের মান-মর্যাদা, আর তা অর্জন করায় তিনি দয়া করে আমাদেরকে সাহায্য করেন।

 যারা অস্বীকার করে (নবী) মুহাম্মাদ (সা)-কে; তারাতো কুফরী করেছে আর দূরে সরে গেছে মুত্তাকীদের পথ থেকে । ইবন ইসহাক কা’ব ইবন মালিকের আরো কবিতা উল্লেখ করেন :

মর্মার্থ : শত্ৰুদলের লোকেরা জানতে পেরেছে যখন তারা আমাদের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছে এবং আমাদের দীনকে লক্ষ্য স্থলে পরিণত করেছে।

যা আমরা বিসর্জন দেবো না। কায়েস ইবন গায়লান এর দল আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তালি বাজিয়েছে; কিন্তু খন্দক দেখতে পেয়ে কি ঘটতে যাচ্ছে তা তারা ঠাহর করে উঠতে পারেনি।

তারা আমাদেরকে বাধা দেয় আমাদের দীন থেকে, আর আমরা তাদেরকে বাধা দেই কুফ্রী থেকে; আর দয়াময় আল্লাহতো দ্রষ্টা এবং শ্রোতা।

তারা যখন কোন স্থানে আমাদের বিরুদ্ধে উন্মা প্রকাশ করে তখন আল্লাহ্ তাঁর পক্ষ থেকে আমাদেরকে সাহায্য করেন।

আমাদের জন্য এটা আল্লাহর হিফাযত ও দয়া আর আল্লাহ যাকে হিফাযত করেন না, তার ধ্বংসতো অনিবার্য।

আল্লাহ আমাদেরকে সত্য দীনের প্রতি হিদায়াত করেছেন, এবং তা আমাদের জন্যে মনোনীত করেছেন।

আর আল্লাহতো হলেন সকল কর্তার শ্রেষ্ঠ কর্তা।

ইবন হিশাম বলেন, এ পংক্তিগুলো তার একটি দীর্ঘ কাসীদার অন্তর্ভুক্ত। ইবন ইসহাক বলেন, বনূ কুরায়যার যুদ্ধ প্রসঙ্গে হাস্সান ইবন ছাবিত এ কবিতাগুলো আবৃত্তি করেন :

বনূ কুরায়যা তার শব্দ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে লাঞ্ছনাকালে তারা পায়নি কোন সাহায্যকারী । বনূ নযীরের আপদ ছাড়া আরো আপদ তাদের উপর আপতিত হয়েছে। প্রত্যুষে রাসূল (সা) তাদের নিকট আগমন করেন। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল চাঁদের মত। তাঁর সাথে অশ্বরাজি যারা অশ্বারোহীকে নিয়ে ছুটে যায় ঈগল পাখির মতো। আমরা তাদেরকে ছেড়ে এসেছি এমন অবস্থায় যে, তারা কোন ব্যাপারেই সফল হয়নি।

সেখানে তাদের প্রচুর রক্ত ঝরে যায়। তারা ছিল ধরাশায়ী পাখি উড়ছিল তাদের উপর, হঠকারী পাপিষ্ঠ ব্যক্তি এভাবেই পাপের শাস্তি পায়।

এমন উপদেশ দ্বারা কুরায়শকে তুমি সতর্ক কর, আল্লাহর পক্ষ থেকে, যদি সে গ্রহণ করে আমার উপদেশ ।

বনূ করায় প্রসঙ্গে ইবন ইসহাক হাসান ইবন ছাবিত আরো একটি কবিতা উল্লেখ করেন :

কুরায়শের সাহায্যার্থে তার চুক্তিবদ্ধ হয়। তাদের শহরে তাদের জন্য নেই কোন সাহায্যকারী ।

তাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা তা বিনাশ করেছে তাওরাতের ব্যাপারে তারাতো চরম অন্ধ।

তোমরা কুরআন অস্বীকার করছ, অথচ তোমরাতো স্বীকার করেছিল সতর্ককারী রাসূলের বাণী মেনে নেয়ার কথা।

তাইতো লাঞ্ছিত হয়েছে বনূ লুয়াইর নেতাদের বুয়াইরার খেজুর বাগানে অগ্নিশাস্তির মাধ্যমে।

আবূ সুফিয়ান ইবনুল হারিস ইকন আবদুল মুত্তালিব এর জবাবে বলেন :

এহেন কর্মকাণ্ড আল্লাহ্ স্থায়ী করুন এবং তাদের দলের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করুন।

অদূর ভবিষ্যতে জানতে পারবে আমাদের মধ্যে কে তা থেকে দূরে; আরো জানতে পারবে আমাদের মধ্যে কোন পথের ভূমি ক্ষত্তি হবে।

খেজুর বাগানে যদি থাকতো অশ্বারোহী তবে তারা বলতে তোমাদের জন্যে কোন স্থান নেই, সুতরাং তোমরা চলে যাও।

আমি বলি, আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিছ ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে এ কবিতা রচনা করেন। এ কবিতার কিছু অংশ সহীহ্ বুখারীতে উল্লিখিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইবন ইসহাক জাবাল ইবন জাওয়াল সালাবীর কবিতার সে জবাব হযরত হাসান ইবন ছাবিত দিয়েছিলেন তাও উল্লেখ করেছেন। আমরা এখানে ইচ্ছাকৃত ভাবেই তা বাদ দিয়েছি। হযরত সা’দ ইবন মুআ এবং বনূ কুরায়যার যুদ্ধের অন্য যারা শাহাদত বরণ করেছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্যে হসাগান ইবন ছাবিত রচিত নিম্নের কবিতাগুলো ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন :

হে মোর জাতির লোকেরা, শোন, কপালের লিখন কি কেউ খণ্ডন করতে পারে? পারে কি কেউ সুখের দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে।

অতীত দিনের কথা আমি স্মরণ করেছি ফলে ডুবে যায় মন আর চক্ষু থেকে গড়িয়ে পড়ে মালা।

দুঃখের ঘনঘটা আমাকে স্মরণ করায় বন্ধু আর শহীদদের স্মৃতি, যারা গত হয়েছে ।

তাদের মধ্যে তুফায়েল আর রাফেও ছিল। ছিল সাদও, তারাতো জান্নাত লাভ করেছে আর তাদের ভূমিতে বিরান পড়ে আছে ।

বদর যুদ্ধের দিন তারা বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করেছে রাসূল (সা)-এর সঙ্গে। আর তাদের মাথার উপরে ঝুলছিল মৃত্যুর ছায়া আর উজ্জ্বল তরবারী।

রাসূল তাদেরকে আদেশ করেন আর তারা সাড়া দেন, সত্যের ডাকে, প্রতিটি ব্যাপারে তাঁরা সকলেই ছিলেন রাসূলের অনুগত এবং বাধ্য।

ভয়ে তারা ফিরে যায়নি, শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের দলে মিশে যায়, আর নির্ধারিত আয়ুকে কেবল মৃত্যুই কর্তন করতে পারে।

কারণ, তারা নবীজির শাফাআতের আশা পোষণ করে, যখন নবীরা ছাড়া আর কোন সুপারিশকারী থাকবেন না ।

ভাই হে আল্লাহর নেক বান্দারা! এটাই ছিল আমাদের পরীক্ষা আর আমরা সাড়া দেই আল্লাহ সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। আমাদেরকে মেনে নিতে হবে আল্লাহর হুকুম, আর মৃত্যুতো অবধারিত।

তোমার পানেই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ, আর আমাদের পশ্চাতে রয়েছে আল্লাহর দীনের তরে আমাদের অনুগমনকারীরা।

আমরা জানি যে, রাজত্ব কর্তৃত্ব কেবলমাত্র আল্লাহর, আর আল্লাহর সিদ্ধান্ত অবশ্যই কার্যকরী হবে! আবদুল্লাহ্ আবদুল্লাহ্

আবু রাফি ইয়াহুদীর হত্যার ঘটনা

ইবন ইসহাক (র) বলেন : খন্দক যুদ্ধে এবং বনু কুরায়যার ঘটনার পর আবু রাফি সালাম ইবন আবুল কায়ক ছিল রাসূল (সা)-এর বিরুদ্ধে যারা সম্মিলিত বাহিনীকে একত্র করে তাদের অন্যতম । ওহুদ যুদ্ধের পূর্বে আওস গোত্রের লোকেরা কা’ব ইব্‌ন আশরাফকে হত্যা করে। তখন খাযরাজ গোত্রের লোকেরা সালাম ইবন আবুল কায়ককে হত্যা করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমতি প্রার্থনা করে। সে অবস্থান করছিল খায়বরে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে অনুমতি দান করেন। ইবন ইসহাক (3) মুহাম্মাদ ইবন যুহরীর সূত্রে আবদুল্লাহ ইবন কা’ব ইবন মালিক.-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা রাসূল (সা)-এর নিমিত্ত এমন ব্যবস্থা করে দেন যে, আনসারদের দুটি গোত্রই আওস এবং খারাজ রাসূল (সা)-এর সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করতো, আওস ক্ষেেত্র কোন কার্য সাধন করলে খাযরাজ গোত্রের লোকেরা বলতো? আল্লাহর কসম! এরা যেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আমাদের চেয়ে অগ্রগামী না হয়ে যায়। ওদের মত কিছু একটা না করা পর্যন্ত তারা থামতো না। আর বনূ খারাজের কোন ব্যক্তি ভাল কিছু করলে আওস গোত্রের লোকেরা অনুরূপ করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো।

ইবন ইসহাক () আরো বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণের অপরাধে আওস গোত্রের লোকেরা কাব ইব্‌ন আশরাফকে হত্যা করলে খাযুজ গোত্রের লোকেরা বলে– আল্লাহর শপথ, তারা কখনো আমাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। কোন লোক কাব ইব্‌ন আশরাফের মতো রাসূল (সা)-এর প্রতি শুক্রতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে, সে বিষয়ে তারা ভাবতে থাকে। এ প্রসঙ্গে তারা খায়বরে অবস্থানরত ইবন আবুল কায়ক সম্পর্কে আলোচনা করে। একে হত্যা করার জন্য তাঁর রাসূল (সা)-এর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনি অনুমতি দান করেন। তদনুযায়ী খাজ গোত্রের বনূ সালিমা শাখা থেকে পাঁচ জন লোক বেরিয়ে পড়েন। এরা হলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন আতীক, মাসউদ ইবন সিনান, আবদুল্লাহ ইব্‌ন উনাইস; আবু কাতাদা হারিছ ইবন রিবৃঈ এবং আসলাম গোত্র থেকে তাদের মিত্র বিঈ ইবন আসলামী। এরা হত্যার উদ্দেশ্যে বহিগত হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবদুল্লাহ ইবন আতীককে দল নেতা নিযুক্ত করে কোন নারী এবং শিশুকে হত্যা করতে নিষেধ করে দেন। তারা যথারীতি বহির্গত হন এবং খায়বরে পদার্পন করে রাত্রি বেলা ইব্‌ন আবুল হুঁকায়কের বাড়ীর চৌহদ্দীতে পৌঁছে সেখানকার বাসিন্দাদের গমনাগমনের পথ বন্ধ করে দেন। ইবন ইসহাক (র) বলেন যে, সে ছিল তার ঘরের উপর তলায়। উপরে আরোহণের খেজুর গাছ নির্মিত সিঁড়ি ছিল। তারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে অনুমতি চাইলে তার স্ত্রী বের হয়ে জিজ্ঞাসা করে। কে তোমরা? তাঁরা বলেন আমরা আরবের কতিপয় লোক। আমরা এসেছি খাদ্যের খোঁজে। সে বললোঃ এই তো তোমাদের সাহেব, ভেতরে প্রবেশ করে তার কাছে যাও। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলে গোলযোগের আশংকায় সে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ইবন ইসহাক (র) বলেন : তা লক্ষ্য করে তার স্ত্রী চিৎকার জুড়ে দেয়। আমরা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বিছানায় তার জীবন-লীলা সাঙ্গ করি। আমরা তরবারির আঘাতে তাকে বধ করেছিলাম। আল্লাহর কসম, রাত্রির অন্ধকারে কেবল তার পুত্র দেহ পরিলক্ষিত হচ্ছিল তা যেন ছিল সাদা রঙ্গের কিবতী চাদর। তিনি বলেন, তার স্ত্রী চিৎকার জুড়ে দিল। আমাদের কোন ব্যক্তি তলোয়ার উঁচিয়ে তার দিকে ছুটে যায়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিষেধের কথা স্মরণ করে সে হাত গুটিয়ে নেয়। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিষেধ বাণী না থাকলে আমরা রাত্রিকালেই তার কাজও সারা করতাম। তিনি বলেন আমরা তরবারি দ্বারা তার উপর হামলা চালাবার পর আবদুল্লাহ্ ইবন উনাইস তার উদরে তরবারি স্থাপন করে তা বিদীর্ণ করে ফেলেন। এ সময় তিনি বলছিলেন ব্যস হয়েছে। ব্যস হয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, আমরা বেরিয়ে নিচে নেমে আসি। আবদুল্লাহ্ ইবন আতীক ছিলেন ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি সিঁড়ি থেকে পড়ে যান এবং এতে এতে মারাত্মক আঘাত পান। আমরা তাঁকে বয়ে নিয়ে পানির একটা নালায় প্রবেশ করি। তারা আগুন প্রজ্জ্বলিত করে চারিদিকে হন্যে হয়ে আমাদেরকে খুঁজতে থাকে। তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। তারা যখন ফিরে যায় তখন তার প্রাণ যায় যায় দশা। তিনি বলেন, তখন আমরা বললাম, আমরা কি করে জানবো যে, আল্লার দুশমন মারা গেছে। তখন আমাদের মধ্যে একজন বললো, আমি যাচ্ছি, পরিস্থিতি যাচাই করে তোমাদেরকে অবহিত করবো। তিনি বলেন, লোকটি গিয়ে লোকজনের সাথে মিশে যায় এবং ফিরে এসে জানায় যে, আমি তার স্ত্রী এবং আরো কিছু লোককে তার আশে পাশে দেখতে পাই। এরা সকলেই ছিল ইয়াহুদী! তার স্ত্রীর হাতে একটি বাতি ছিল। সে নিহত ব্যক্তির চেহারার দিকে তাকিয়ে সমবেত লোকজনকে বলছিলঃ আল্লাহর শপথ! আমি আবদুল্লাহ ইবন আতীক এর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি। তারপর আমি নিজের ধারণাকে মিথ্যা ঠাউরে মনে মনে বলি : ইবন আতীক এখানে গামা থেকে কেমন করে আসবে। তারপর সে শ্রসর হয়ে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে- য়াহুদীদের উপাস্যের শপথ, সে নিহত হয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি আমার নিজের জন্য এর চেয়ে শ্রুতিমধুর কোন কথা শুনিনি। তিনি বলেন, এরপর তিনি আমাদের নিকট আগমন করে আমাদেরকে সংবাদ দিলে আমরা আমাদের সঙ্গীকে বয়ে নিয়ে রাসূলুয়াহ্ (সা)-এর নিকট সাক্ষাৎ করতে যাই এবং আল্লাহর দুশমনকে হত্যার সুসংবাদ তাঁকে দেই। তাকে হত্যা কে করেছে এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং আমাদের প্রত্যেকেই তাকে হত্যা করার দাবী করে। ইবন ইসহাক (র) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : আমার নিকট তোমাদের তলোয়ার নিয়ে এসো। আমরা তরবারি হাযির করলে তিনি আবদুল্লাহ্ ইবন উনাইসের তলোয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন : আমি দেখছি এর তরবারিটিই তাকে হত্যা করেছে আর তাতে আহার্যের চিহ্ন রয়েছে। ইবন ইসহাক (র) বলেন, এ প্রসঙ্গে হাস্সান ইবন ছাবিত নিম্নের কবিতা রচনা করেন :

হে হুকায়কের পুত্র! ওহে আশরফের পুত্র! সাবাস সে দলকে যাদের দেখা তোমরা পেয়েছে। তারাতো তোমাদের কাছে গিয়েছিল রাতের বেলা হালকা তরবারি নিয়ে দর্পভরে। গভীর বনের সিংহের মতো; শেষ পর্যন্ত তারা আগমন করে তোমাদের দেশের চৌহদ্দীতে, আর তীক্ষ্ণধার তলোয়ার দ্বারা সাঙ্গ করে তোমাদের জীবন লীলা। নবীর দীনকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে, যেকোন ভয়ংকর আঘাতকে তুচ্ছ জ্ঞান করে।

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) এ রকমই উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী ইসহাক ইবন নসর– বারা ইবন আযিব সূত্রে বর্ণনা করেন :

আবু রাফি য়াহূদীকে হত্যা করার জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছোট্ট একটি দলকে প্রেরণ করেন। আবদুল্লাহ্ ইবন আতীক রাতের বেলা তার ঘরে প্রবেশ করে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে হত্যা করেন। ইমাম বুখারী (র) ইউসুফ ইবন মূসা– — বারা সূত্রে বর্ণনা করে বলেন ।

ইমাম বুখারী (র) ইউসুফ ইবন মূসা– বারা সূত্রে বলেন; রাসূলুল্লাহ্ (সা) কতিপয় আনসারী ব্যক্তিকে আবু রাফি য়াহদীর প্রতি প্রেরণ করেন এবং আবদুল্লাহ ইবন আতিক (রা)-কে তাদের আমীর নিযুক্ত করেন। এ লোকটি রাসূল (সা)-কে কষ্ট দিত এবং তার বিরুদ্ধে লোকদেরকে প্ররোচিত করতো, হিজাযের একটি দুর্গে সে অবস্থান করতো, তারা যখন দুর্গের নিকট পৌঁছেন। তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে এবং লোকজন তাদের পশুপাল নিয়ে বাড়ী ফিরেছে। আবদুল্লাহ্ বললেন : তোমরা এখানেই অবস্থান কর। আমি যাচ্ছি, দারোয়ানকে কৌশলে ভুলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার উপায় বের করা যায় কিনা দেখি। তিনি এগিয়ে যান এবং দরজার কাছে গিয়ে কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন যেন তিনি প্রস্রাব করার জন্য বসেছেন। ইতোমধ্যে লোকেরা ভেতরে প্রবেশ করে আর দারোয়ান চিৎকার করে বলে? হে আল্লাহর বান্দা! তুমি ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রবেশ কর। কারণ, আমি দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি, তাই আমি ভেতরে প্রবেশ করে আত্মগোপন করে থাকি। সকলে ভেতরে প্রবেশ করলে সে দরজা বন্ধ করে চাবিগুলো এক স্থানে ঝুলিয়ে রাখেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি উঠে দাঁড়াই এবং চাবিগুলো নিয়ে দরজা খুলি। আর আবু রাফির বাড়ীতে রাতের বেলা গল্পের আসর জমতো এবং সে বাস করতো উপর তলায়। আসরের লোকজন বিদায় নিলে আমি উপরে আরোহণ করি এবং একটা একটা করে দরজা খোলামাত্র ভেতর থেক বন্ধ করতে থাকি। আমি মনে মনে বলিঃ লোকজন আমার ব্যাপারে জানতে পারলেও তারা আমার নিকট পৌঁছার পূর্বেই, আমি তাকে হত্যা করে ফেলবো।

অবশেষে আমি তার কাছে পৌঁছে গেলাম, সেছিল একটা অন্ধকার গৃহে স্বজন পরিবেষ্টিত। আমি জানতাম না গৃহের কোথায় সে আছে। আমি আবু রাফিকে তার নাম ধরে ডাক দিলাম। সে জিজ্ঞাসা করলো, কে? আমি আওয়ায শুনেই সেদিকে ছুটে যাই এবং তলোয়ার দারা তাকে আঘাত করি। আমি ছিলাম বিচলিত। আমার আঘাতে কোন কাজ হলোনা। সে চিৎকার দিলে আমি ঘর থেকে বের হলাম। কিছুক্ষণ বাইরে অবস্থান করে আমি পুনরায় তবে প্রবেশ করি । আমি বললাম ও আবূ বাফি! এটা কিসের আওয়াম! সে বললো? তোমার মায়ের জন্য দুর্ভোগ, এক ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করে তরবারি দিয়ে আমাকে আঘাত করেছে । রাবী বলে, আমি তাকে সজোরে আঘাত করি, কিন্তু তাতেও সে মারা যায়নি। এরপর আমি তরবারী ফলা তার পেটে স্থাপন করি, যা পিঠ পর্যন্ত ভেদ করে যায়। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি তাকে হত্যা করতে পেরেছি। এরপর আমি এক এক করে সবগুলো দরজা খুলে কক্ষের সিঁড়ি পর্যন্ত পৌহি। আমি সিঁড়িতে পা স্থাপন করি। আমি ধারণা করলাম যে, আমি শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছেছি। চাঁদনী রাতে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাই এবং এর ফলে আমার পায়ের নলা ভেঙ্গে যায়। আমি পাগড়ি দিয়ে পা বেঁধে নেই । আমি হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়িতে পৌঁছে সেখানে বসে পড়ি। আমি মনে মনে বলি, তার হত্যা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে আজ রাতে বের হবোনা! ভোরে মোরগ ডাক দিলে মৃত্যু সংবাদ দানকারী দেয়ালে আরোহণ করে ঘোষণা দেয় যে, আমি হিজাবাসীদের সাহায্যকারী আবু রাফি মারা যাওয়ার কথা ঘোষণা করছি, এ কথা শুনে আমি আমার বন্ধুদের নিকট গিয়ে তাদেরকে বলি, রক্ষা পেয়েছি। আল্লাহ্ তা’আলা আৰূ রাফি’কে ধ্বংস করেছেন। আমি নবী (সা)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে গোটা ইতিবৃত্ত অবহিত করলে তিনি বলেন, তোমার পা বাড়াও। আমি পা বাড়ালে তিনি তাতে হাত বুলান। এতে আমার মনে হলো যেন পায়ে কোন কষ্টই ছিল না।

ইমাম বুখারী (র) আহমদ ইবন উসমান। আবু ইসহাক সূত্রে অনুরূপ হাদীছ বর্ণনা করেন। এতে বলা হয়েছে :

ইমাম বুখারী (র) বারা সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদল লোকসহ আবদুল্লাহ ইবন উতবা এবং আবদুল্লাহ ইবন আতীককে সাকূ রাফি-এর প্রতি প্রেরণ করেন। তারা অগ্রসর হয়ে দুর্গ পর্যন্ত পৌঁছেন। তখন আবদুল্লাহ ইবন আতীক তাদেরকে বললেন : তোমরা এখানে অবস্থান কর, আমি গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। তদনুযায়ী আমি ভেতরে প্রবেশ করার ফন্দি আঁটি। এ সময় তাদের একটা গাধা খোয়া যায় । তারা আলো নিয়ে গাধার খোঁজে বের হয়। আমার আশংকা হলো, তারা আমাকে চিনে ফেলতে পারে। তাই আমি মস্তক আবৃত করে বসে পড়ি, যেন আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য বসেছি, আর কি! তখন দারোয়ান বললো : যে ভেতরে প্রবেশ করতে চায়, প্রবেশ করুক। দরজা বন্ধ করার আগেই তাকে প্রবেশ করতে হবে। তাই আমি ভেতরে প্রবেশ করে দুর্গের দরজার নিকটে গাধার আস্তাবলে লুকিয়ে থাকি। দুর্গের লোকেরা আবূ রাফি,এর নিকটে আহার করে এবং রাতের কিছু সময় অবধি গল্পগুজব করে। তারপর তারা নিজ নিজ গৃহে ফিরে যায়। যখন কোলাহল থেমে গেল এবং আমি কোন সাড়াশব্দ শুনতে পেলাম না তখন আমি বের হলাম। তিনি বলেন, আমি দারোয়ানকে কোথায় সে দুর্গের চাবি রেখেছে তা লক্ষ্য করি। আমি সেখান থেকে চাবি নিয়ে দুর্গের দরজা খুলি। আমি মনে মনে বলি। কেউ আমাকে দেখে ফেললে আমি তৎক্ষণাৎ রেরিয়ে পড়বো। এরপর গৃহের দরজার দিকে এগিয়ে বাইরে থেকে তা বন্ধ করে দেবো। এরপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আমি আবু রাফি এর কাছে পৌঁছি। অন্ধকার গৃহ, বাতি নিবে গেছে। লোকটি কোথায়, তা আমি ঠাহর করতে পারছিলাম না। আমি তার নাম ধরে ডাক দিলাম, হে আবু রাফি! সে বলে, কে? আমি আওয়াযের দিকে এগিয়ে যাই এবং তাকে আঘাত করি। কিন্তু আঘাতে কোন কাজ হলো না। সে চিৎকার করে। ব্যর্থ চিৎকার। তারপর আমি তার শুভার্থী সেজে তার কাছে যাই। আমি বলি, আবু রাফি! তোমার কী হয়েছে। আমি তখন আওয়ায বদলে ফেলি। সে বলে, না, তোমার জন্য আমাকে অবাক হতে হয়। তোমার মায়ের জন্য ধ্বংস। এক ব্যক্তি আমার গৃহে প্রবেশ করে তরবারি দ্বারা আঘাত করেছে। তিনি বলেন, পুনরায় আমি তার দিকে এগিয়ে যাই। পুনরায় তার উপর আঘাত হানি। কিন্তু এবারও আঘাতে কোন কাজ হলো না সে চিৎকার জুড়ে দেয় এবং তার পরিবারের লোকজন জেগে উঠে। তারপর আমি কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে শুভার্থীর মতো এগিয়ে যাই। দেখি, সে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আমি তার পেটের উপর অস্ত্র স্থাপন করি এবং তার উপর প্রচন্ড চাপ দেই। যাতে তার পৃষ্ঠদেশের হাঁড়ের আওয়ায শুনতে পাই। এরপর আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ি এবং নিচে নামার উদ্দেশ্যে সিঁড়ির কাছে গমন করি। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে আমার পা ভেঙ্গে যায়। আমি পা বেঁধে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমার বন্ধুদের কাছে আসি এবং তাদেরকে বলি? তোমরা যাও এবং নবী করীম (সা)-কে সুসংবাদ দাও। আমিতো মৃত্যুর সংবাদ না শোনা পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করবো। প্রত্যুষে মৃত্যু সংবাদ ঘোষণাকারী প্রাচীরে আরোহণ করে বলে ও আমি আবু রাফি’ এর মৃত্যুর কথা ঘোষণা করছি। তিনি বলেন, সাথে সাথে আমি উঠে দাঁড়াই এবং রওয়ানা হয়ে পড়ি। এ সময় আমার পায়ে কোন ব্যথা ছিলনা। আমার বন্ধুরা রাসূল করীম (সা)-এর নিকট পৌঁছার পূর্বেই আমি পথিমধ্যেই তাদেরকে গিয়ে ধরতে সমর্থ হই আর আমি রাসূল করীম (সা)-কে এ সুসংবাদ দান করি।

এসব বিস্তারিত বিবরণ দানের ক্ষেত্রে সিহাহ সিত্তাহ্ তথা ৬টি বিশুদ্ধ হাদীছ গ্রন্থের মধ্যে ইমাম বুখারী (র) একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

ইমাম যুহরী (র) উবাই ইবন কাব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূল করীম (সা) যখন মিম্বরে উপবিষ্ট ছিলেন তখন তাঁরা আগমন করেন। রাসূল করীম (সা) বলে উঠলেন : চেহারাগুলো সফল হয়েছে। অর্থাৎ তারা সফলকাম হয়ে ফিরে এসেছে। তিনি বললেন–

হে আল্লাহর নবী (সা)! আপনার চেহারা সফল হোক। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি তাকে হত্যা করেছ? তারা বললেন, জ্বী হাঁ। তিনি বললেন, আমার কাছে তরবারি নিয়ে এসো। তিনি কোষ থেকে তরবারি বের করে দেখালে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হাঁ। এ হলো তরবারি ধারে তার আহার্যের চিহ্ন রয়েছে।

আমি বলি, হতে পারে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আতীক যখন সিঁড়ি থেকে পড়ে যান তখন তাঁর পায়ের জোড়া স্থানচ্যুত হয়, গোড়ালি ভেঙ্গে যায় এবং পায়েও মোচড় লাগে; কিন্তু যখন তা বেঁধে দেয়া হয় তখন ব্যথা দূর হয়ে যায় এবং চলাচলে আর কোন কষ্ট অবশিষ্ট থাকেনি। কারণ, ব্যাপারটি খুবই স্বাভাবিক এবং অতি স্পষ্ট। তিনি যখন হাঁটা-চলার অভিপ্রায় করেন তখন এজন্য তাঁকে সাহায্য করা হয়। কারণ, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে কল্যাণকর জিহাদ। তারপর তিনি যখন রাসূল করীম (সা)-এর নিকট পৌঁছেন এবং তিনি স্বস্থি ফিরে পান তখন পুনরায় ব্যথা ফিরে তাসে এবং তিনি পা ছড়িয়ে দিলে রাসূল করীম (সা) তাতে হাত বুলিয়ে দেন। ফলে অসুবিধা দূর হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে দেখা দিতে পারে এমন ব্যথাও আর অবশিষ্ট ছিল না। এভাবে উভয় বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্য সাধিত হয়। আল্লাহ্-ই ভাল জানেন। মূসা ইবন উবা তদীয় মগাষী’ গ্রন্থে ইবন ইসহাক অনুরূপ বর্ণনা করেছেন এবং ইব্রাহীম ও আবু উবায়দের মতো তিনিও তাদের এ অভিযানে অংশ গ্রহণকারী সাহাবীগণের নাম উল্লেখ করেছেন।

খালিদ ইবন সুফিয়ান হুলনী হত্যার ঘটনা

হাফিয বায়হাকী (র) দালাইল গ্রন্থে আবু রাফি-এর হত্যার ঘটনা উল্লেখ করার পর ইমাম আহমদ (র)-এর বরাতে ইয়াকূব– আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন উনাইস তদীয় পিতা সূত্রে বর্ণনা করে বলেন :

রাসূল করীম (সা) আমাকে ডেকে বললেন : আমি জানতে পেরেছি যে, খালিদ ইবন সুফিয়ান ইবুন নাবীহ্ হুযালী আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য লোকজনকে সমবেত করেছে। এখন সে উরানা নামক স্থানে অবস্থান করছে। তুমি সেখানে গিয়ে তাকে হত্যা কর । তিনি নিবেদন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার জন্য তার কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করুন, যাতে আমি তাকে চিনতে পারি। তিনি বললেন, তুমি যখন তাকে দেখবে, তখন লক্ষ্য করবে যে, সে কম্পন ব্যাধিতে আক্রান্ত আছে। তিনি বলেন, আমি তলওয়ার কোষবদ্ধ করে উরানায় তার কাছে গিয়ে পৌঁছি। তখন ছিল আসরের নামাযের সময়। রাসূল (সা) তার কম্পনের যে বর্ণনা দেন, আমি তাকে তেমনটিই পেলাম । তখন সে স্ত্রীদেরকে নিয়ে বাসস্থানের সন্ধানে ছুটাছুটি করছিল। আমি তার দিকে এগিয়ে যাই। আমার আশংকা হয় যে, আমার এবং তার মধ্যে ধস্তাধস্তি হতে পারে। যা আমাকে যথাসময়ে সালাত আদায় থেকে বিরত রাখতে পারে । তাই আমি তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ইশারায় সালাত আদায় করলাম। মাথার ইশারায় আমি রুকূ সিজদা আদায় করছিলাম। আমি তার কাছে পৌঁছলে সে জিজ্ঞেস করলো কে? আমি বললাম, আমি একজন আরব। এ ব্যক্তির উপর হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে আপনার লোকজন সমবেত করার কথা শুনতে পেয়ে এ উদ্দেশ্যে আপনার কাছে এসেছি। সে বললো, হ্যাঁ, আমিতো সে চেষ্টায় প্রবৃত্ত আছি। আমি কিছু দূর তার সঙ্গে অগ্রসর হই। সুযোগ বুঝে আমি তরবারি চালিয়ে তাকে হত্যা করি এবং তার স্ত্রীদেরকে সেখানে ফেলে রেখে বেরিয়ে আসি। তার স্ত্রীরা তার জন্য বিলাপ করছিল। আমি রাসূল করীম (সা)-এর নিকট এগিয়ে গেলে আমাকে দেখে তিনি বলেন : চেহারা এতো দেখছি সফল হোক। কর্ম সিদ্ধ হয়েছেত? তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাকে হত্যা করেছি। তিনি বললেন, সত্য বলছ? এরপর রাসূলুল্লাহ্ আমার পাশে দাঁড়ালেন এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গৃহে প্রবেশ করলেন। আমার হাতে একটা লাঠি দিয়ে বললেন : হে আবদুল্লাহ ইবন উনাইস! এটি তোমার কাছে রাখবে। তিনি বলেন, লাঠিটি নিয়ে জনসমক্ষে উপস্থিত হলে লোকজন জিজ্ঞেস করে, এ লাঠির ব্যাপারটি কি? আমি বললাম : রাসূল (সা) আমাকে এটি দিয়ে বলেছেন যে, এটি তোমার কাছে রাখবে। তারা বললো : তুমি কি রাসূল করীম (সা)-এর কাছে ফিরে গিয়ে এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করবে না? তিনি বলেন, আমি রাসূল করীম (সা)-এর নিকট ফিরে গিয়ে আরয করলাম ও ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে কেন এটি দিয়েছেন? তিনি বললেন, কিয়ামতের দিন এ লাঠি তোমার আর আমার মধ্যে নিদর্শন হবে, সেদিন খুব কম লোকই এমন সৌভাগ্য লাভ করবে। যারা এরূপ লাঠির উপর ভর করে আসবে। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ্ এ লাঠিটি আমৃত্যু তাঁর তরবারির সঙ্গে রাখেন। এটি কাফনের সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং একই সাথে দুটিই দাফন করা হয়। ইমাম আহমদ (র) ইয়াহইয়া ইবন আদম– আবদুল্লাহ ইবন উনাইস সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম আবু দাউদ (র) আবু মামার— আবদুল্লাহ ইবন উমাইস তদীয় পিতার সূত্রে অনুরূপভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে হাকিম বায়হাকী (র) ও মুহাম্মাদ ইবন সালামা– আবদুল্লাহ্ ইবন উনাইস সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেন। উপরন্তু উরওয়া ইবন যুবায়র এবং মূসা ইবন উকবাও তদীয় মাগাযী’ গ্রন্থে মুরসালভাবে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইন হিশামের বর্ণনা মতে আবদুল্লাহ্ ইবন উনাইস খালিদ ইবন সুফিয়ানের হত্যা সম্পর্কে নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন :

আমি ইবন ছাওরকে উন্ত্রী শাবকের ন্যায় পতিত ছেড়ে এসেছি, আর তার চার পাশে বিলাপরতা নারীরা বস্ত্র বিদীর্ণ করছিল।

আমি তার উপর হামলা চালাই হিন্দুস্তানী চকচকে তরবারি দ্বারা, তার আর আমার পশ্চাতে ছিল রমণীকুল।

আমি তাকে বলছিলাম যখন তরবারি তার মস্তক চূর্ণ করছিল, আমি হলাম উনাইস তনয়, অশ্বারোহী কুলীন বংশের সন্তান।

আমি এমন লোকের সন্তান, যাকে মর্যাদা দানে কালের প্রবাহ কোন কার্পণ্য করেনি, আমি প্রশস্ত আঙ্গিনা বিশিষ্ট ঘরের সন্তান আমি নই কৃপণ।

আমি তাকে বললাম, মর্যাদাবানের আঘাত গ্রহণ কর। যে নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর দীনের জন্য সদা প্রস্তুত। নবী যখন কোন কাফিরকে হত্যার সংকল্প করেন; তখন আমি আর যবান তথা কাজেও কথায় তার দিকে এগিয়ে যাই।

আমি বলি, আবদুল্লাহ ইবন উনাইস ইবন হারাম আবু ইয়াহইয়া আল-জুহানী ছিলেন মহান মর্যাদার অধিকারী মশহুর সাহাবী। যেসব সাহাবী আকাবার বায়আত, উহুদ খন্দক ও পরবর্তী যুদ্ধসমূহে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, ইনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। প্রসিদ্ধ উক্তি অনুযায়ী ৮০ হিজরীতে সিরিয়ায় তিনি ইনতিকাল করেন। অবশ্য কারো কারো মতে তিনি ৫৪ হিজরীতে ইনতিকাল করেন। আল্লাহ্ তা’আলাই ভাল জানেন। আলী ইবন যুবায়র এবং খলীফা ইবন খাইয়্যাত পূর্বোক্ত আবদুল্লাহ ইবন উনাইস আবূ ইয়াহইয়া এবং আবদুলাহ্ ইবন উনাইস আবু ঈসা আনসারীর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। আর এই আবু ঈসা আনসারী সেই সাহাবী যিনি রাসূল (সা) থেকে এ মর্মে হাদীছ বর্ণনা করেন যে, রাসূল করীম (সা) উহুদ যুদ্ধের দিন একটি পাত্রে পানি আনতে বলেন। তিনি পাত্রের মুখ খুলে পানি পান করেন। ইমাম আবু দাউদ (র) এবং ইমাম তিরমিযী (র) হাদীছটি আবদুল্লাহ্ আল উমরী সূত্রে ঈসা ইবন আবদুল্লাহ ইবন উনাইস তদীয় পিতার বরাতে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য ইমাম তিরমিযীর মতে এ হাদীছের সনদ বিশুদ্ধ নয় এবং আবদুল্লাহ আল-উমরী স্মৃতি শক্তির দিক থেকে একজন দুর্বল রাবী।

হাবশা অধিপতি নাজাশীর সঙ্গে আমর ইবনুল আসের ঘটনা

আবু রাফি ইয়াহূদীর হত্যার ঘটনার পর মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক আমর ইবন আস এর যবানীতে উদ্ধৃত করে বলেন : খন্দক যুদ্ধের দিন আমরা যখন প্রত্যাবর্তন করি তখন আমি কুরাইশের কতিপয় সমমনা ব্যক্তিকে সমবেত করে বললাম, আল্লাহর শপথ, তোমরা জানলে, মুহাম্মাদের অনাকাঙ্খিত উন্নতি লাভ করছে। আর এ ব্যাপারে আমি একটা বিষয় স্থির করেছি; সে বিষয়ে তোমাদের মতামত কী? তারা জানতে চাইলো; তুমি কী স্থির করেছ? তিনি বললেন যে, আমরা নাজাশীর কাছে গিয়ে সেখানে অবস্থান করবো, মুহাম্মাদ (সা) আমাদের জাতির উপর জয়লাভ করলে আমরা নাজাশীর নিকটেই থেকে যাবে। আর আমাদের জন্য মুহাম্মাদের অধীনে থাকার চেয়ে নাজাশীর অধীনে থাকা অধিকতর প্রিয়; আর যদি আমাদের জাতি জয়ী হয় তবেতো সকলেই জানবে যে, আমরা কারা। এমতাবস্থায় তাদের পক্ষ থেকে আমাদের কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ হবেনী। একথা শুনে সকলেই বলে উঠলো; এটা হলো একটা কথার মত কথা। আমি বললাম : তাহলে নাজাশীকে উপঢৌকন সামগ্রী সগ্রহ কর। আমাদের দেশ থেকে সবচেয়ে প্রিয় যে বস্তুটা উপহার হিসাবে দেয়া যায়, তা হলো চামড়া, আমরা তার জন্য অনেক চামড়া সংগ্রহ করলাম। আমরা এসব উপহার সামগ্রী নিয়ে যখন তাঁর দরবারে পৌঁছি যেমন সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমর ইবন উমাইয়া দিসারী। রাসূল (সা) জাফর এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে একে নাজাশীর দরবারে প্রেরণ করেন। তিনি দরবারে প্রবেশ করে বেরিয়ে গেলে আমি আমার সঙ্গীদের বললাম : এ হচ্ছেন আমর ইবন উমাইয়া । আমি যদি নাজাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে তার নিকট চেয়ে নেই। আর তিনি তাকে আমার হাতে অর্পণ করেন তাহলে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেবো। আর আমি এ কাজ করলে কুরায়শরা দেখতে পাবে যে, আমি মুহাম্মাদের দূতকে হত্যা করে তাদের পক্ষ থেকেই কাজ করেছি। তিনি বলেন, আমি নাজাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাকে সিজদা করি, যেমন আমি ইতিপূর্বে করতাম, নাজাশী আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে জানতে চাইলেন, তোমার দেশ থেকে আমার জন্য কি কোন উপহার সামগ্রী এনেছ? আমি বললাম : জাহাপনা! এনেছি বটে। উপহার সামগ্রী হিসাবে আপনার জন্যে অনেক চামড়া নিয়ে এসেছি। আমি কাছে গিয়ে তা উপস্থাপন করলে তিনি তা খুব পসন্দ করেন, এরপর আমি আরয করলাম, জাহাপনা! আমি এইমাত্র দেখতে পেলাম যে, জনৈক ব্যক্তি আপনার দরবার থেকে বেরিয়ে গেল। সে লোকটি এমন এক ব্যক্তির দূত, যে আমাদের দুশমন। আপনি তাকে আমার হাতে ন্যস্ত করুন, আমি অবশ্যই তাকে হত্যা করবো। কারণ, সে আমাদের গণ্যমান্য ভদ্র ব্যক্তিদেরকে আহত ও নিহত করেছে। তিনি বলেন, এতে নাজাশী ক্ষুব্ধ হন এবং নিজ হস্তে আমার নাকে আঘাত করেন। এমন সজোরে আঘাত করেন, যাতে আমার ধারণা জন্মে যে, হয়তো আমার নাক ভেঙ্গে গেছে। এতে আমার মনের এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, মাটি ফেটে গেলে আমি তাতে প্রবেশ করতাম। অতঃপর আমি বললাম, জাহাপনা! আমি যদি জানতাম যে, একথা আপনার পছন্দ হবেনা তাহলে আমি এমন আবদার করতাম না, তারপর নাজাশী বললেন : তুমি কি এমন ব্যক্তির দূতকে হত্যা করার জন্য আমার নিকট দাবী জানাচ্ছ, যার কাছে এমন ফেরেস্তা আগমন করেন, যিনি আগমন করতেন মূসা (আ)-এর নিকট? আমি বললাম, জাহাঁপনা, সত্যিই কি তিনি এমন মর্যাদাবান? নাজাশী বললেন, হে আর! দুঃখ তোমার জন্য, আমার কথা শোন এবং তার আনুগত্য কর। কারণ, আল্লাহর শপথ, তিনি অবশ্যই সত্যের উপর রয়েছেন। প্রতিপক্ষের উপর তিনি অবশ্যই বিজয়ী হবেন, যেমন মূসা ইবন ইমরান বিজয়ী হয়েছিলেন ফিরাউন এবং তার বাহিনীর উপর । আমি আরয করলাম, আপনি কি তার জন্য আমার নিকট থেকে ইসলামের জন্য বায়য়াত গ্রহণ করবেন? তিনি বললেন, হাঁ। অতঃপর তিনি হস্ত প্রসারিত করলে আমি তার হাতে ইসলামের উপর বায়য়াত করলাম, আমি বের হয়ে বন্ধুদের নিকট আসলাম। তখন আমার পূর্ব মত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি বন্ধুদের নিকট আমার ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখি। এবং ইসলাম গ্রহণ করার অভিপ্রায়ে রাসূল (সা)-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পড়ি। খালিদ ইবন ওয়ালীদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি মক্কা থেকে আগমন করছিলেন আর এটা মক্কা বিজয়ের পূর্বের কথা । আমি বললাম, হে আবূ সুলায়মান! কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, পথতো স্পষ্ট হয়ে গেছে, তিনিতো আল্লাহর নবী (সা) আর আমিতো যাচ্ছি ইসলাম গ্রহণ করার জন্য। তাহলে আর কতকাল ইতস্তত করে কাটাবো? আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমিওতো এসেছি ইসলাম গ্রহণ করার জন্যই। তাই আমরা মদীনায় নবী করীম (সা)-এর খিদমতে উপস্থিত হলাম। আমার পূর্বেই খালিদ ইবন ওলীদ এগিয়ে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তিনি বায়আত করলে আমি নিকটে গিয়ে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন এ শর্তে আমি আপনার নিকট বায়আত করছি। ভবিষ্যৎ গুনাহের কথা আমি বলছিনা। তখন রাসূল (সা) বললেন : হে আমর! তুমি বায়আত কর; কারণ, ইসলাম অতীত পাপ মোচন করে, আর হিজরত অতীত পাপ মোচন করে। তিনি বলেন, অতঃপর আমি বায়আত করে চলে আসি। ইবন ইসহাক (র) বলেন, আমার আস্থাভাজন এমন রাবী আমাকে জানিয়েছেন, উছমান ইব্‌ন তালহা ইবন আবু তালহা তাদের সঙ্গে ছিলেন এবং দুইজন যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাদের সঙ্গে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন; এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবন আবু যাবআরী সাহমী নিম্নোক্ত বয়েত আবৃত্তি করেন :

উসমান ইবন তালহাকে আমি কসম দিচ্ছি; বৃক্ষ প্রস্তরের নিকট লোকদের জুতা খুলে রাখার স্থানের।

আর আমাদের পূর্ব পুরুষরা যে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছেন আর খালিদ এমন হালককে উপেক্ষা করার পাত্র নন।

তুমি কি চাও সে ঘর ছাড়া অন্য কোন ঘরের চাবি? আর তুমি চাওনা মর্যাদার গৃহ ছাড়া অন্য কোন আশ্রয়স্থল?

এরপর খালিদের ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত হবেনা, আর উসমান নিয়ে এসেছে এক মহা আপদ!

আমি বলি, এরা হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ইসলাম গ্রহণ করেন, আর এটা এজন্য যে, খালিদ ইবন ওলীদ তখন পর্যন্ত মুসলমান হননি, বরং মুশরিকদের অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। পরে সে বিষয়ে তাদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা পরবর্তীতে বর্ণনা করাই সমীচীন ছিল; কিন্তু আমরা এখানে আলোচনা করলাম ইবন ইসহাকের অনুসরণে । কারণ, নাজাশীর নিকট আমর ইবনুল আসের প্রথম দফা গমনের ঘটনা খন্দক যুদ্ধের পরবর্তীকালের । এটা স্পষ্ট যে, তিনি গমন করে থাকবেন হিজরী পঞ্চম সালের খন্দক যুদ্ধ পরবর্তী অবশিষ্ট দিনগুলোতে। মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

উম্মে হাবীবার সঙ্গে নবী করীম (সা)-এর বিবাহ

বায়হাকী (র) খন্দক যুদ্ধের ঘটনার পর কালবী সূত্রে ইবন আব্বাসের বরাতে মহান আল্লাহর বাণী :

যাদের সঙ্গে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে; সম্ভবত আল্লাহ্ এবং তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন, আল্লাহ, মহা শক্তির অধিকারী, এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (৬০, মুমতাহানা : ৭)

প্রসঙ্গে বলেন যে, এখানে উম্মে হাবীবা বিন্‌ত আবু সুফিয়ানের সঙ্গে নবী করীম (সা)-এর বিবাহের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে উম্মে হাবীবা মু’মিনীন কূলের জননীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হন আর মু’আবিয়া হয়ে যান মুমিনদের মামা। [টীকা- এরূপ সম্পর্ক শুধু উম্মুল মুমিনীনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাদের ভাই বোন বা অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। বায়হাকীর বরাতে কুরতুবী এরূপই উল্লেখ করেছেন। (মূল গ্রন্থের পাদটীকা দ্রঃ)] তারপর বায়হাকী (র) আবু আবদুল্লাহ্ আল হাকিম– উম্মে হাবীবা থেকে বর্ণনা করে বলেন যে, তিনি ছিলেন উবায়দুল্লাহ ইবন জাহাশের স্ত্রী। ইনি হিজরত করে নাজাশীর নিকট গমন করেন এবং সেখানে ইনতিকাল করেন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন উম্মে হাবীবাকে বিবাহ করেন তখন তিনি হাবশা তথা আবিসিনিয়ায় ছিলেন এবং বাদশাহ নাজাশী এ বিবাহ পড়ান এবং তাঁর মহরানা সাব্যস্ত করা হয় চার হাজার দিরহাম। শুরাহবিল ইবন হাসানার সঙ্গে তাঁকে নবী করীম (সা)-এর দরবারে প্রেরণ করা হয় আর বাদশাহ নাজাশী নিজের পক্ষ থেকে এ বিবাহের মহরানা পরিশোধ করেন। রাসূল করীম (সা) এজন্য কোন কিছু প্রেরণ করেননি; বায়হাকী (র) আরও বলেন যে, নবী করীম (সা) সহধর্মিণী গণের প্রত্যেকের মহরানা ছিল চারশ দিরহাম। আমি বলি যে, বিশুদ্ধ কথা এই যে, নবী করীম (সা) এর সহধর্মিণীগণের মহরানা ছিল সাড়ে বার উঁকিয়া আর এক উঁকিয়া ছিল চল্লিশ দিরহামের সমান আর এটা পাঁচশ’ দিরহামের সমপরিমাণ ছিল। এরপর বায়হাকী (র) ইবন লাহিয়া– উরওয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, উবায়দুল্লাহ ইবন জাহাশ খৃষ্টান থাকাকালে হাবশায় মারা যাওয়ার পর তারা স্ত্রী উম্মে হাবীবাকে রাসূল করীম (সা) বিবাহ কালে উছমান ইবন আফফান এ বিবাহ পড়ান। আল্লাহ্ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন!

আমি বলি, উবায়দুল্লাহ্ ইবন জাহাশের খৃষ্টধর্ম গ্রহণের বিষয়টা ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর এটা এভাবে হয় যে, মুসলমানরা হাবশায় হিজরত করলে শয়তান তার পদস্খলণ ঘটায় এবং খৃস্টধর্মকে তার দৃষ্টিতে শোভন করে তোলে ফলে সে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং আমৃত্যু খৃষ্টানই থাকে। এ ব্যক্তি এ বলে মুসলমানদেরকে ভসনা করতো যে, আমরাতো আলোর সন্ধান লাভ করেছি; আর তোমরা আলোর খোঁজে হাবুডুবু খাচ্ছ। হাবশায় হিজরত অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তার প্রতি আল্লাহর অভিশম্পাত। অবশ্য উছমান ইবন আফফান বিবাহ পড়ান বলে ওরওয়ার উক্তি রীতিমতো বিস্ময়কর। কারণ, উছমান (রা) ইতিপূর্বেই মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি মদীনায় হিজরত করেন এবং হিজরত কালে স্ত্রী রোকায়াও তার সঙ্গে ছিলেন। ইতিপূর্বে তাও আলোচনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহই ভাল জানেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক সূত্রে ইউনুস যা বর্ণনা করেছেন। তাই বিশুদ্ধ কথা। তিনি বলেন যে, উম্মে হাবীবার চাচাতো ভাই খালিদ ইবন সাঈদ ইবনুল আস ছিলেন তার বিবাহের ওলী। আমি বলি মুহাম্মাদ ইব্‌ন ইসহাক সূত্রে ইউনুসের বর্ণনা মতে নাজাশী বাদশাহ আসহামা নাজাশী ছিলেন বিবাহ কবুল করার ক্ষেত্রে রাসূল করীম (সা)-এর উকীল। আবূ জাফর মুহাম্মাদ ইব্‌ন আলী ইবনুল হুসাইন সূত্রে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, রাসূল করীম (সা) আর ইবন উমাইয়্যা দিমারীকে নাজাশীর দরবারে প্রেরণ করেন এবং তিনি উম্মে হাবীবা বিন্ত আবূ সুফিয়ানকে বিবাহ দেন এবং তার পক্ষ থেকে চারশ’ দীনার মহর পরিশোধ করেন।

সুরাইয়া ইবন বাক্কার মুহাম্মাদ ইবন হাসান– উম্মে হাবীবা বিনত আবু সুফিয়ান সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি হাবশা ভূমিতে ছিলাম, নাজাশী বাদশাহের দূত এবং সেবিকা ‘আবরাহা আমার কাছে না আসা পর্যন্ত আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আবরাহা’ এসে আমার নিকট উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলে আমি তাকে অনুমতি দেই। সেবিকাটি বললো : নাজাশী বাদশাহ জানাচ্ছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আমার নিকট এ মর্মে পত্র লিখেছেন যেন আমি তোমাকে তাঁর সাথে বিবাহ দেই। তখন আমি বললাম, আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দানে সন্তুষ্ট করুন। এছাড়া সে একথাও বলেন যে, আপনি আমার বিবাহের উকীল নির্ধারণ করুন। তিনি বলেন, খালিদ ইবন সাঈদ ইবনুল আস এর নিকট লোক প্রেরণ করে আমি তাকে বিবাহের উকীল মনোনীত করি এবং এ সুসংবাদ দানের জন্য আমি সেবিকা আবরাহাকে রূপার ২টা কাঁকন আমার পায়ের দুটি রূপার মল এবং আমার পায়ের আঙ্গুলসমূহের রুপার আংটিগুলো দান করি। আমাকে প্রদত্ত তার সুসংবাদ দানে আনন্দিত হলে আমি এসব দান করি। সন্ধ্যায় নাজাশী জাফর ইবন আবু তালিব এবং সেখানে অবস্থানরত মুসলমানদেরকে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দান করেন। নাজাশী বাদশাহ বিবাহের খুতবা পাঠ করেন —

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি একমাত্র রাজাধিরাজ অতিশয় পূত-পবিত্র, নিরাপত্তা তা ও মহাপরাক্রমশালী, প্রবল প্রতাপের অধিকারী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল এবং ঈসা ইব্‌ন মারইয়াম তারই আগমনের সুসংবাদ দান করেছেন। তারপর রাসূল করীম (সা) তাঁর সঙ্গে উম্মে হাবীবা বিন্ত আবূ সুফিয়ানকে বিবাহ দেয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি রাসূল করীম (সা)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়েছি এবং তাঁর বিবাহের মহর হিসাবে চারশ দীনার পরিশোধ করেছি। এ সময় তিনি দানারগুলো। সকলের সম্মুখে উপস্থিত করেন। তারপর খালিদ ইবন সাঈদ ইবনুল আস খুতবা পাঠ করেন :

আলহামদু লিল্লাহ্! সকল প্রশংসার মালিক আল্লাহ। আমি তাঁর প্রশংসা করছি এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আমি আরে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল । হিদায়াত আর সত্য দান সহকারে তাঁকে প্রেরণ করেছেন, যাতে সমস্ত দীনের উপর একে বিজয়ী করেন। যদিও মুশরিকরা তা পসন্দ করে না। এরপর তিনি বলেন : রাসূল (সা)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে আমি উম্মে হাবীবা বিন্‌ত আবূ সুফিয়ানের সঙ্গে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন করেছি। আল্লাহ্ তা’আলা রাসূল (সা)-কে বরকতে ধন্য করুন। নাজাশী দীনারগুলো খালিদ ইবন সাঈদের হাতে অর্পণ করলে তিনি সেগুলো হস্তগত করেন। তারপর বলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে সকলে উঠে দাড়াঁলে তিনি বলেন :

দয়া করে আপনারা সকলে একটু বসুন। কারণ, বিবাহের পর খাবার আয়োজন করা নবীগণের সুন্নাত। এরপর খাবার নিয়ে আসার জন্য বলা হলে আহার শেষে সকলে প্রস্থান করেন। আমি বলি যে, আমর ইবন আস আম্‌ ইবন উমাইয়াকে যে নাজাশীর দরবার থেকে বের হতে দেখেন, সম্ভবত তা ছিল খন্দক যুদ্ধের পর উম্মে হাবীবার বিবাহকে কেন্দ্র করে । আল্লাহই ভাল জানেন। অবশ্য বায়হাকী (র) বর্ণনা করেন যে, আবূ আবদুল্লাহ্ ইবন মান্দাহ, রাসূল করীম (সা)-এর সঙ্গে উম্মে হাবীবার ঘটনা ৬ষ্ঠ হিজরীতে সংঘটিত হয় বলে উল্লেখ করেছেন। আর উম্মে সালামার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিবাহ ৪র্থ হিজরীর ঘটনা বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। আমি বলি, এমত পোষণ করেন খলীফা ও আবু উবায়দুল্লাহ মামার ইবনুল মুসানা ও ইবনুল বারকী। আর উম্মে হাবীবীর বিবাহ সংঘটিত হয় হিজরী ৬ষ্ঠ সনে। কারো কারো মতে হিজরী ৭ম সনে। বায়হাকী (র) বলেন, এটাই অধিক এবং যুক্তিযুক্ত।

আমি বলি, ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, ৪র্থ হিজরীর শেষের দিকে উম্মে সালামার (রা) সঙ্গে রাসূল করীম (স)-এর বিবাহ সংঘটিত হয়। অবশ্য উম্মে হাবীবার সঙ্গে রাসূল করীম (সা)-এর বিবাহ-এর পূর্বে বা এর পরও সংঘটিত হতে পারে। খন্দক যুদ্ধের পর এ বিবাহ সংঘটিত হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। কারণ, ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমর ইবন আস আর ইবন উমাইয়া দিমারীকে নাজাশীর দরবারে দেখতে পেয়েছিলেন। তা উম্মে হাবীবার বিবাহ প্রসঙ্গের ঘটনা। আল্লাহ্ ভাল জানেন। অবশ্য হাফিয ইবনুল আসীর (র) উসদুল গাবা’ গ্রন্থে কাতাদা সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, উম্মে হাবীবা হাবশা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর রাসূল করীম (সা) তাঁর কাছে বিবাহের পয়গাম পাঠান এবং তাঁকে বিবাহ করেন। আবার কারো কারো মতে রাসূল করীম (সা) মক্কা বিজয় শেষে তাঁর পিতা আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ করার পর উম্মে হাবীবাকে বিবাহ করেন। মুসলিম শরীফে ইকরামা ইবন আম্মার আল ইয়ামানী ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীছটিকে এ মতের সমর্থকরা প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করেন। এ হাদীছে উল্লেখ আছে যে, আবু সুফিয়ান নবী করীম (সা)-এর নিকট বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনটি বিষয়। আমাকে দান করুন। রাসূল করীম (সা) বললেন, ঠিক আছে। তখন আবু সুফিয়ান বললেন : আমাকে মুসলিম বাহিনীর আমীর নিযুক্ত করুন, যাতে আমি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি যেমনটি ইতিপূর্বে আমি কাফির দলের হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছি। রাসূল করীম (সা) বললেন : ঠিক আছে। তিনি বললেন, মুআবিয়াকে কাতিব’ নিয়োজিত করুন। রাসূল করীম (সা) বললেন, ঠিক আছে। তিনি বললেন, আমার কাছে আছে আরবের সেরা সুন্দরী রমণী আমার কন্যা উম্মে হাবীবা । আমি তাকে আপনার কাছে বিবাহ দিতে চাই।– পূর্ণ হাদীছ।

ইবনুল আছীর (র) বলেন, এ হাদীছ দ্বারা ইমাম মুসলিমের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা হয় যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে আবু সুফিয়ান শপথ নবায়নের জন্য তাঁর কন্যা উম্মে হাবীবার গৃহে গমন করলে তিনি নবী করীম (সা)-এর বিছানা গুটিয়ে নিলে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন : আল্লাহ্ন কসম, আমার জানা নেই তোমার এ কর্ম আমাকে ঘৃণা করে করেছ, না কি আমার শ্রেষ্ঠত্ব আর ভালবাসার কারণে। তখন এর জবাবে উম্মে হাবীবা বলেছিলেন :–  বরং এটা রাসূল করীম (সা)-এর বিছানা, আর আপনি মুশরিক। জবাবে আবৃ সুফিয়ান বলেছিলেন :

আল্লাহর কসম, হে তনয়া মোর, আমার (নিকট থেকে আসার পর তোমাকে দেখছি মন্দ স্পর্শ করেছে। ইবন হাযম এর মতে এ বর্ণনাটি একটা জাল বর্ণনা । ইকরিমা ইবন আম্মার এর রচয়িতা। অবশ্য ইব্‌ন হামের এমতের সমর্থন আর কেউই করেননি। অন্যদের মতে আবু সুফিয়ান বিবাহ নবায়ন করতে চেয়েছিলেন মাত্র। কারণ, পিতার অনুমতি ছাড়া বিবাহ তাঁর অপমান হয়। আবার কারো কারো মতে, আবূ সুফিয়ান বিশ্বাস করে নেন যে, তার ইসলাম গ্রহণের ফলে কন্যার বিবাহ বাতিল হয়ে গেছে। এ ব্যাখ্যাগুলোর সবগুলিই দুর্বল। তবে সর্বোত্তম ব্যাখ্যা এই যে, আবু সুফিয়ান তাঁর অপর এক কন্যাকে রাসূল করীম (সা)-এর নিকট বিবাহ দেয়ার অভিপ্রায় করেছিলেন। কারণ, তিনি এটাকে নিজের জন্য মর্যাদার কাজ মনে করতেন। এ ব্যাপারে তিনি উম্মে হাবীবার সাহায্যও চেয়েছিলেন যেমনটি বুখারী মুসলিমে বর্ণিত আছে। অবশ্য তাকে উম্মে হাবীবা নামকরণ করা বর্ণনাকারীর ভ্রম মাত্র। আমি এ প্রসঙ্গে এক একক বর্ণনার উল্লেখ করেছি । আবু উবায়দ কাসিম ইবন সাল্লাম বলেন, হিজরী ৪৪ সানে উম্মে হাবীবা ইনতিকাল করেন। আর আবু বকর ইবন আবু খায়সামা বলেন, মু’আবিয়ার এক বছর পূর্বে তিনি ইনতিকাল করেন। হিজরী ৬০ সনের রজব মাসে মুআবিয়া ইনতিকাল করেন।

যয়নব বিনত জাহাশ এর সঙ্গে নবী করীম (সা)-এর বিবাহ

তাঁর বংশধারা এরকম উম্মুল মু’মিনীন যয়নব বিন্ত জাহাশ ইবন রিয়াব ইবন ইয়াসির ইবন সুবা ইবন মুররা ইব্‌ন কাবীর ইবন গানম ইবন দুদান ইবন আসাদ ইবন খুযায়মা আল আসাদিয়া। তার মা ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কন্যা এবং রাসূল করীম (সা)-এর ফুফু উমায়মা। ইতিপূর্বে তিনি ছিলেন রাসূল করীম (সা)-এর আযাদ করা গোলাম যায়দ ইবন হারিছার বিবাহ বন্ধনে। কাতাদা ওয়াকিদী এবং কোন কোন মদীনাবাসীর মতে রাসূল করীম (সা) হিজরী ৫ম সনে তাকে বিবাহ করেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, তা ছিল যিলকদ মাসে। হাফিয বায়হাকী (র) বলেন, বনূ কুরায়যা যুদ্ধের পর রাসূল করীম (সা) তাকে বিবাহ করেন। পক্ষান্তরে খলীফা ইবন খাইয়াত, আবু উবায়দা মামার ইবনুল মুসান্না এবং ইবন মান্দাহ বলেন যে, রাসূল করীম (সা) হিজরী তৃতীয় সনে যয়নব বিনত জাহাশকে বিবাহ করেন, প্রথম উক্তিটি সবচেয়ে পেশী প্রসিদ্ধ। ইবন জারীর তাবারীসহ একাধিক ঐতিহাসিক এ মত সমর্থন করেন। একাধিক মুফাসসির ফকীহ এবং ঐতিহাসিক নবী করীম (সা) কর্তৃক তাকে বিবাহ করার সম্পর্কে একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রা) তার মুসনাদ গ্রন্থে তা বর্ণনা করেছেন, অজ্ঞ মূরা যাতে এ কদর্য করতে পারে সে কারণে আমরা এখানে ইচ্ছা করেই তা উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকলাম।

মহান আল্লাহ্ তাঁর মহাগ্রন্থে বলেন :

স্মরণ কর, আল্লাহ যার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছ, তুমি তাকে বলছিলে- তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছিলে আল্লাহ্ তা প্রকাশ করছেন, তুমি লোক ভয় করছ; অথচ আল্লাহকেই ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত। এরপর যায় যখন তার (যয়নবের) সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করলো। তখন আমি তোমাকে তার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম। যাতে মুমিনদের পোষ্য পুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ সূত্র ছিন্ন করলে সেসব নারীকে বিবাহ করায় মু’মিনদের কোন বিপ্ন না হয়। আর আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে। আল্লাহ মুমিনের জন্য যা বিধিসম্মত করেছেন, তা করতে তার জন্য কোন বাধা নেই। পূর্বে যেসব নবী অতীত হয়ে গেছে, তাদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহর বিধান। আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত। (৩৩- আহযাব ৩৭-৩৮)

এ সম্পর্কে আমরা তাফসীর গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করছি। এখানে অর্থাৎ যার প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। অর্থ রাসূল করীম (সা)-এর আযাদকৃত গোলাম যায়দ ইবন হারিসা। ইসলাম দ্বারা আল্লাহ তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন আর রাসূল করীম (সা) তার

প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তাকে মুক্ত করে এবং তাঁর কাছে আপন ফুফাতো বোন যয়নব বিত জাহাশকে বিবাহ দিয়ে মুকাতিল ইবন হিব্বান বলেন : যায়দ ইবন হারিছা যয়নব বিন্ত জাহাশকে মোহরানা হিসাবে ১০ দীনার ৬০ দিরহাম, ১টা দোপাট্টা, একটি বড় চাদর, একটি জামা এবং ৬০ মুদ খেজুর দান করেন। যয়নব যায়দের কাছে প্রায় এক বছর বা এক বছরের কিছু বেশী সময় অবস্থান করেন, তারপর তাদের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়, স্বামী রাসূল করীম (সা)-এর নিকট অভিযোগ নিয়ে এলে রাসূল করীম (সা) তাঁকে বললেন : তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ্ বলেন, আর তুমি অন্তরে যা গোপন করছিলে আল্লাহ্ তা প্রকাশ করতে চান। আলী ইবন হুসাইন যয়নুল আবেদীন ও সুদ্দী বলেন : আল্লাহ জানতেন যে, তিনি নবী করীম (সা)-এর অন্যতম স্ত্রী হবেন। এটাই ছিল নবী করীম (সা)-এর অন্তরে। অতীত মনীষীদের অনেকে এখানে অনেক অদ্ভুত কথাবার্তা বলেছেন, এগুলো প্রশ্নাতীত নয়। সেসব আমরা পরিহার করেছি। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :

(যায়দ যখন যয়নবের সাথে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করলো তখন আমি তাকে তোমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দিলাম। এটা এভাবে যে, যায় তাকে তালাক দিলেন, তাঁর তালাকের ইদ্দত পূর্ণ হলে রাসূল করীম (সা) যথারীতি নিজে তাঁকে বিবাহ করার পয়গাম পাঠান এবং তিনি নিজেই যয়নবকে বিবাহ করেন। আর যিনি এ বিবাহ সম্পন্ন করিয়ে দেন তিনি হচ্ছেন রাব্বুল আলামীন নিজেই। সহীহ বুখারীতে আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে এ মর্মে হাদীছ বর্ণিত আছে। হাদীছে উল্লেখ আছে।

যে তোমাদেরকে বিবাহ দিয়েছেন তোমাদের পরিবারের লোকজন অভিভাবকরা, আর আমার বিবাহ সম্পন্ন করেছেন মহান আল্লাহ্ সপ্ত আকাশের উপরে যয়নব বিনত জাহাশ নবী করীম (সা)-এর অন্যান্য স্ত্রীদের উপর গৌরব করে একথা বলতেন। ঈমা ইবন তুহমান সূত্রে আনাস (রা)-এর অপর এক বর্ণনায় আছেঃ

যয়নব নবী করীম (সা)-এর স্ত্রীদের উপর গৌরব করে বলতেনঃ আল্লাহ তা’আলা আসমান থেকে আমার বিবাহের ব্যবস্থা করেছেন এবং তাঁর প্রসঙ্গেই পর্দার আয়াত নাযিল হয়েছে :

:. “হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে অনুমতি না দেয়া হলে তোমরা আহার্য প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না করে ভোজনের জন্য নবী গৃহে প্রবেশ করবে না। তবে তোমাদেরকে আহ্বান করা হলে প্রবেশ করবে এবং ভোজন শেষে দাঁড়িয়ে পড়বে; কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়বে না। (৩৩-আহযাব : ৫৩)

ইমাম বায়হাকী (র) হাম্মাদ ইবন যায়দ– আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। যায়দ যয়নৰ সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে এলে রাসূল করীম (সা) তাঁকে বলেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক বজায় রাখ । আনাস (রা) বলেন : রাসূল করীম (সা) আদৌ কোন কিছু গোপন করে থাকলে অবশ্যই তিনি এ আয়াতটি গোপন করতেন। যয়নব তো নবী করীম (সা)-এর অন্যান্য স্ত্রীগণের উপর গৌরব করে বলতেনঃ তোমাদের অভিভাবকরা তোমাদের বিবাহের ব্যবস্থা করেছেন, আর মহান আল্লাহ সপ্ত আসমানের উপর থেকে আমার বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। এরপর তিনি বলেন :

ইমাম বুখারী (র) আহমদ– হাম্মাদ ইব্‌ন যায়দ সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। অতঃপর ইমাম বায়হাকী (র) আফফান– আনাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। যায়দ (রা) যয়নবের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে রাসূল করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হলে নবী করীম (সা) তাকে বললেন : স্ত্রীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখ। তখন নাযিল হয়–

তুমি অন্তরে এমন বিষয় গোপন রাখছ যা আল্লাহ্ প্রকাশ করে দিচ্ছেন। অতঃপর ইমাম বুখারী (র) মুহাম্মাদ ইব্‌ন আবদুর রহীম–শাবী সূত্রে বর্ণনা করেন। আমি তিনটি বিষয় আপনার নিকট পেশ করছি, আপনার স্ত্রীদের মধ্যে কেউ আপনার নিকট এমন তিনটি বিষয় উপস্থাপন করতে পারে না। আমার এবং আপনার দাদা এক অর্থাৎ আবদুল মুত্তালিব। কারণ, তিনি নবী করীম (সা)-এর পিতার পিতা, আর যয়নবের মা উমাইমার পিতা ছিলেন আবদুল মুত্তালিব। আর মহান আল্লাহ্ আসমানে আপনার সঙ্গে আমার বিবাহ সম্পন্ন করে দিয়েছেন। এ বিবাহ সম্পন্ন করার কাজে দূতের ভূমিকা পালন করেছেন ফেেিশতা জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, ইমাম আহমদ (র) হাশিম– আনাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন :

ইমাম আহমদ (র) বলেন : “যয়নবের ইদ্দত সমাপ্ত হলে নবী করীম (সা) যায়দাকে বলেন : তুমি যয়নবের নিকট গিয়ে আমার কথা আলোচনা কর। তিনি তাঁর কাছে গেলেন; এসময় যয়নব আটা খামীর করছিলেন। যায়দ (রা) বলেন, তাঁকে দেখে আমার অন্তরে তার মহত্ত্বের ছাপ মুদ্রিত হয়। আমি তাঁর দিকে তাকাতে পারি না; তবে যেহেতু রাসূল করীম (সা) তার কথা উল্লেখ করেছেন। তাই আমি তাঁর দিকে পিঠ দিয়ে পেছনে ফিরে আসি এবং বলি? যয়নব, সুসংবাদ গ্রহণ কর। তোমার কথা স্মরণ করে রাসূল করীম (সা) আমাকে প্রেরণ করেছেন। তিনি বললেন : মহান রবের সঙ্গে পরামর্শ না করে আমি কোন কাজ করি না। এরপর তিনি নামাযের স্থানের দিকে গমন করলে কুরআন মজীদ নাযিল হল এবং রাসূল করীম (স) আগমন করে অনুমতি না নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করলেন। আনাস (রা) বলেন : রাসূল করীম (সা) যয়নবের সাথে বাসর সম্পন্ন করলে আমরা সেখানে ওলীমা উপলক্ষে গোশতরুটি আহার কবি । কিছু লোক বের হয়ে যায় এবং কিছু লোক বসে বসে কথা বলতে থাকে। এরা খাবারের পর গল্প করছিল। রাসূল করীম (সা) বের হলেন, আমিও তাঁর অনুসরণ করলাম। তিনি এক এক করে স্ত্রীগণের হুজরায় গমন করে সালাম জানালে তাঁরা আরয করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার নববধুকে কেমন পেলেন? আমার স্মরণ নেই এ সময় আমি তাঁকে খবর দিয়েছি আর লোকজন বের হয়ে গেছে, না অন্য কেউ। তাঁকে এ খবর দিয়েছিল। রাবী আনাস (রা) বলেন : তিনি গৃহে প্রবেশ করলে আমিও তার সঙ্গে প্রবেশ করি। তখন তিনি আমার এবং তার মধ্যস্থলে পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন। এ সময় পর্দার আয়াত নাযিল হলে –এর বিধান অনুমতি লোকদেরকে অবহিত করেন। ইমাম মুসলিম (র) এবং ইমাম নাসাঈ (র) সুলায়মান ইবন মুগীরা সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

যয়নবের ওলীমা উপলক্ষে পর্দার বিধান নাযিল হয়

উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের ইযত আবরু রক্ষার উদ্দেশ্যে যয়নব বি জাহাশের বিবাহের ভোজ উপলক্ষে পর্দার বিধান নাযিল হয় উমর ইবনুল খাত্তাবের অভিপ্রায় অনুযায়ী। ইমাম বুখারী (র) মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ রাকাশী– আনাস (রা) ইবন মালিক সূত্রে বর্ণনা করেন :

যয়নব বিন্ত জাহাশের বিবাহ উপলক্ষে রাসূল করীম (সা) লোকজনকে নিমন্ত্রণ করেন। লোকেরা খাওয়া দাওয়া শেষে বসে গল্প জুড়ে দেয়। রাসূল করীম (সা) দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত হলেও লোকেরা উঠে দাঁড়ালেন না। এ অবস্থা দেখে তিনি দাঁড়ালেন, তাঁকে দাঁড়াতে দেখে যে কেউ কেউ দাঁড়ালেন; কিন্তু তিনজনের এটা ক্ষুত্র দল বসেই থাকল। রাসূল করীম (সা) ভেতরে প্রবেশ করার জন্য আগমন করেন, তখনো তাঁরা বসে আছেন। এরপর তাঁরা উঠে প্রস্থান করেন। আমি এসে তাঁদের চলে যাওয়ার কথা নবী করীম (সা)-কে জানাই। তখন তিনি এসে গৃহে প্রবেশ করলে আমিও প্রবেশ করার জন্য উদ্যত হই। তখন তিনি তাঁর এবং আমার মধ্যখানে পর্দা ঝুলিয়ে দেন। এ সময় আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেন :

ইমাম বুখারী (র) অন্যত্র এবং ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ (র) বিভিন্ন সূত্রে মু’তামির থেকেও হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম বুখারী (র) আইউব– আনাস (রা) থেকেও এককভাবে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বুখারী (র) আবু মামার–… আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে বর্ণনা করে বলেন : যয়নব বিনত জাহাশের সঙ্গে নবী করীম (সা)-এর বিবাহ উপলক্ষে গোশতটি দ্বারা ভোজের আয়োজন করা হয়। লোকজনকে ডেকে আনার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয়। একদল আসেন এবং আহার করে চলে যান, আবার অন্য দল আসেন আর আহার করে চলে যান। আমি তোক জনকে ডাকতে থাকি। শেষ পর্যন্ত ডাকার জন্য কাউকে না পেয়ে আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! ডাকার জন্য আমি আর কাউকে পাচ্ছিনা। তিনি বললেন ও খাদ্য তুলে নাও। তখনো তিনজনের একটা দল গৃহে বসে কথা বলছিলেন। নবী করীম (সা) বের হয়ে আইশা (রা)-এর হুজরায় উপস্থিত হয়ে বললেন : আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। হে আহলি বায়ত! তিনি জবাবে বললেন :ওয়া আলাইকুমুস সালামু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে বরকত মণ্ডিত করুন। আপনার নববধূকে কেমন পেলেন? আল্লাহ্ আপনাকে বরকত দান করুন।এভাবে প্রত্যেক স্ত্রীর হুজরায় গমন করে তাঁদের প্রতি সালাম দিলেন এবং আইশা (রা)-এর হুজরায় গিয়ে যেমন বলেন অন্যদের হুজরায় গিয়েও তেমনি বললেন এবং তাঁরাও আইশা (রা)-এর মতোই জবাব দিলেন। এরপর নবী করীম (সা) ফিরে আসেন, তখনো তিনজনের দলটি গৃহে কথাবার্তায় রত ছিল। আর নবী করীম (সা) ছিলেন ভীষণ লাজুক প্রকৃতির। তিনি আইশা (রা)-এর হুজরার উদ্দেশ্যে গমন করেন। এরপর আমি অথবা অন্য কেউ তাঁকে বললো যে, লোকজন চলে গেছে। তখন তিনিও বের হলেন। তিনি এক পা গৃহের দরজার চৌকাঠের ভেতরে দিয়েছেন অপর পা তখনো বাইরে। এ সময় তিনি আমার এবং তার মধ্যস্থলে পদা ঝুলিয়ে দিলেন এবং পর্দার আয়াত নাযিল হয়। ইমাম বুখারী (র) এককভাবে এ সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে তিনি আবদুল্লাহ্ ইবন বুকাইর–… ইবন আনাস সূত্রেও হাদীছটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন। এতে ৩ ব্যক্তির স্থলে ২ ব্যক্তির উল্লেখ আছে। মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

ইমাম বুখারী (র) বলেন : ইব্রাহীম ইব্ন তুহমান– আনাস (রা) সূত্রেও অনুরূপ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইবন আবূ হাতিম– আনাস ইবন মালিক সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেন। এভাবে রাসূল করীম (সা) তাঁর কোন এক স্ত্রীর জন্য ভোজের আয়োজন করেন। এ উপলক্ষে উম্মে সুলায়ম (ঘি এবং খেজুর সংযোগে প্রস্তুতকৃত এক প্রকার সুস্বাদু আহার্য (হায়স) প্রস্তুত করেন। তা একটা পাত্রে ঢেলে আমাকে দিয়ে বলেন, রাসূল করীম (সা)-এর নিকট নিয়ে গিয়ে বলবে যে, আমাদের পক্ষ থেকে তার জন্য এটা মামুলী হাদিয়া মাত্র আমি তা নিয়ে এসে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটি উম্মে সুলায়ম আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। সালাম দিয়ে বলেছেন, এটি আপনার জন্য সামান্য হাদীয়া । আনাস বলেন, তখন লোকজন খুব অনটনে ছিল। তিনি সেটির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ঘরের এক কোণে রেখে দাও। এরপর আমাকে ডেকে বললেন : অমুক অমুক ব্যক্তিকে ডেকে আন। এসময় তিনি অনেক ব্যক্তির নাম ধরে বললেন : মুসলমানদের মধ্যে যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাকেই দাওয়াত দেবে। আমি ফিরে এসে দেখি যয়নবের ঘর, সুফফা এবং হুজরাসমূহ সবই লোকে লোকারণ্য। রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আক্ব উসমান! তাদের সংখ্যা কত ছিল? তিনি বললেন : তিনশর কিছু বেশী হবে। আনাস (রা) বলেন : রাসূল করীম (সা) আমাকে বললেন, খাবার নিয়ে এসো। আমি নিয়ে এলে তিনি তাতে হাত রাখেন দুআ করেন এবং বলেন, মাশআল্লাহ্! তিনি বললেন, দশজন দশজন কারে বৃত্তাকারে বসবে, বিসমিল্লাহ্ বলে প্রত্যেকে নিজের পাশ থেকে আহার করবে। তাঁরা বিসমিল্লাহ বলে আহার করা শুরু করেন এবং সকলেই আহার করলে তিনি আমাকে বললেন, খাদ্য তুলে রাখ। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, আমি এসে পাত্রটি উঠিয়ে নিলাম, তখন আমি পাত্রের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম না যে, যখন আমি স্থাপন করি তখন খাদ্য বেশী ছিল, না যখন তুলে রাখি তখন?

রাবী বলেন, কিছু লোক সকলে চলে যাওয়ার পরও রাসূল (সা)-এর গৃহে বসে বসে গল্প করেছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নববধূ দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে রয়েছিলেন। তাঁদের দীর্ঘ আলাপচারিতায় রাসূল (সা) বিব্রত বোধ করেন। আর তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী লজ্জাশীল। রাসূলের কষ্ট হচ্ছে এটা লোকেরা বুঝতে পারলে তারাও কষ্ট পেতেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) উঠে দাঁড়ান, হুজরাবাসী স্ত্রীদেরকে সালাম জানান। রাসূলুল্লাহ্ এসে গেছেন এটা দেখতে পেয়ে তারা বুঝতে পারেন যে, ব্যাপারটা রাসূলের নিকট কষ্টকর ঠেকেছে। তাঁরা তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়েন। তখন রাসূল করীম (সা) উপস্থিত হয়ে পর্দা টানিয়ে দেন এবং গৃহে প্রবেশ করেন। আমি তখন হুজরায়। রাসূল (সা) স্বল্প সময় হুজরায় অবস্থান করেন। এ সময় আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেন এবং নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতে করতে রাসূল করীম (সা) রেরিয়ে আসেন :

আনাস (রা) বলেন : রাসূল করীম (সা) সকলের আগে এ আয়াতগুলো আমাকে পাঠ করে শুনান এবং কালের বিবেচনায় আমিই এ আয়াতগুলোর সর্বপ্রথম শ্রোতা। মুসলিম (র), তিরমিযী (র) এবং নাসাঈ (র) এরা সকলেই সুলায়মান সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং তিরমিযী (র) হাদীছটিকে হাসান-সহীহ্ বলে অভিহিত করেছেন। অনুরূপভাবে মুসলিম ও ভিন্ন সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। বুখারী (র), তিরমিযী (র) এবং নাসাঈ (র) ও বিভিন্ন সূত্রে আবুল বাশার আহমাসী কূফীর বরাতে আনাস (রা) থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং ইবন আবূ হাতিম আবু নাযুরা আল-আবদীর বরাতে আনাস (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবন জারীর (র) আমর ইবন সাঈদ সূত্রে এবং ইমাম যুহরী (র) আনাস (রা) সূত্রেও অনুরূপভাবে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

আমি বলি, যয়নব বিনত জাহাশ (রা) ছিলেন সর্বপ্রথম হিজরতকারিণী নারীগণের অন্যতম এবং তিনি প্রচুর দান খয়রাত করতেন। তাঁর পূর্ব নাম ছিল বাা, নবী করীম (সা) তাঁর নামকরণ করেন যয়নব । তার কুনিয়াত বা উপনাম ছিল উম্মুল হিকাম অর্থাৎ জ্ঞান-বুদ্ধির জননী। তাঁর সম্পর্কে উম্মুল মু’মিনীন আইশা সিদ্দীকা (রা) মন্তব্য করেন :

দীনের ক্ষেত্রে উৎকর্ষে, তাকওয়ায়, সত্য ভাষণে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং আমানতদারী ও দান খয়রাতের ক্ষেত্রে যয়নব বিন্ত জাহাশের চেয়ে উত্তম কোন রমণী আমি কখনো দেখিনি। বিশুদ্ধ গ্রন্থদ্বয় অর্থাৎ বুখারী ও মুসলিমে প্রমাণিত হয়েছে এবং ই তথা অপবাদ আরোপের ঘটনা সম্পর্ক হাদীছে আসছে যে, আইশা (রা) বলেন :

রাসূল করীম (সা) আমার সম্পর্কে যয়নবকে জিজ্ঞাসা করেন। অথচ নবী করীম (সা)-এর স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই আমার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। আল্লাহ্ ভীতির কারণে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমিতো আমার চক্ষু কর্ণ হিফাযত করছি। তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া কিছুইতো আমার জানা নেই ।

আর মুসলিম (ইবন হাজ্জাজ) তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে মাহমুদ ইবন গায়লান– আইশা সূত্রে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন : রাসূল করীম (সা) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যার হস্ত সবচেয়ে দরাজ সে সকলের আগে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। তিনি বলেন, আমরা মেপে দেখতাম, আমাদের মধ্যে কার হাত সবচেয়ে বেশী লম্বা। তিনি আগে বলেন : যয়নবের হাত ছিল সবচেয়ে লম্বা। কারণ, তিনি নিজ হাতে কাজ করতেন এবং দান-খয়রাত করতেন। ইমাম মুসলিম (র) এককভাবে হাদীছটি বর্ণনা করেন।

ওয়াকিদী প্রমুখ সীরাত, মাগাযী ও ইতিহাস গ্রন্থকার বলেন : ময়নব বিন্ত জাহাশ হিজরী ২০ সালে ইনতিকাল করেন। আমীরুল মু’মিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তার জানাযার নামাযে ইমামতি করেন এবং জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে দাফন করা হয়। আর তিনি হলেন সর্বপ্রথম মহিলা যার জন্য প্রথম জানাযায় খাঁটিয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *