৪র্থ হিজরী সন

 হিজরী চতুর্থ সন

এ বছর মুহাররম মাসে আবু সালামা ইবন আবদুল আসাদ আবূ তুলায়হা আসাদীর নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরিত হয়। তাঁরা “কাতান” নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। এ প্রসংগে ওয়াকিদী বলেন, উমার ইবন উছমান বর্ণনা করেছেন, সালামা ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন উমার ইবন আবু সালামা প্রমুখ থেকে। তাঁরা বলেছেন যে, হযরত আবূ সালামা উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে তিনি বাহুতে প্রচণ্ড আঘাত পান। এক মাস যাবত চিকিৎসা চলে। হিজরতের ৩৫ মাসের মাথায় মুহাররম মাসে রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে ডেকে বললেন, এই অভিযান নিয়ে তুমি বের হও। আমি তোমাকে ওদের নেতা মনোনীত করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে পতাকা বেঁধে দেন। তিনি বললেন, নির্ধারিত মুজাহিদদেরকে নিয়ে তুমি যাত্রা কর। বনু আসাদ গোত্রে পৌঁছে তোমরা ওদেরকে আক্রমণ করবে। রাসূলুল্লাহ (সা) আবু সালামা এবং তাঁর সাথীদেরকে তাকওয়া অবলম্বন ও সৎ কাজের উপদেশ দিলেন। ১৫০ জন মুজাহিদ নিয়ে আবু সালামা “কাতানে” শিবির স্থাপন করেন। সেটি ছিল বনূ আসাদ গোত্রের একটি জলাশয়। ওখানে অবস্থান করছিল শত্রুপক্ষ খুওয়াইলিদের পুত্রদ্বয় তুলায়হা আসাদী এবং তার ভাই সালামা। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে বনূ আসাদ গোত্রের সকল মিত্র গোত্রকে একত্রিত করেছিল। ওদেরই একজন লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তুলায়হা ও তার ভাইয়ের নেতৃত্বে যুদ্ধ প্রস্তুতির সংবাদ তাঁকে জানায় । ওই লোকের সাথেই তিনি আবু সালামার নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করেন ।

মুসলিম বাহিনী ওখানে পৌঁছার পর শত্রুপক্ষ ভয় পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। তারা বহু ধন-সম্পদ ফেলে যায়। তার মধ্যে ছিল উট, বকরী ইত্যাদি। আবু সালামা (রা) ও তাঁর সাথীগণ ওইসব ধন-সম্পদ দখল করে নেন। তাঁরা তিনজন ক্রীতদাসকে বন্দী করেন। শত্রুপক্ষ পালিয়ে যাওয়ার পর দলবলসহ আবু সালামা (রা) মদীনার দিকে ফিরতি যাত্রা করেন। আসাদ গোত্রের যে

ব্যক্তি গোপন সংবাদ জানিয়েছিল গনীমতের মাল থেকে প্রচুর পরিমাণ সম্পদ তাকেও দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্য একটি ক্রীতদাস এবং বিধিমুতাবিক মোট সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ রেখে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট মালামাল অভিযানে অংশ গ্রহণকারী মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। তারপর তাঁরা মদীনায় ফিরে এলেন।

উমর ইবন উছমান বলেন, আবদুল মালিক উমর ইবন আবু সালামা (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, উহুদ যুদ্ধে যে কাফির আমার পিতাকে যখম করেছিল সে ছিল আবু উসামা জাশামী। প্রায় এক মাস যাবত আমার পিতা ওই যখমের চিকিৎসা করল। তারপর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে কাতান এলাকায় প্রেরণ করেন। সময়টি ছিল ৪র্থ হিজরীর মুহাররাম মাস। সফর উপলক্ষে দশ দিনের অধিককাল তিনি মদীনার বাহিরে ছিলেন। মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর তার ক্ষতস্থান আবার দগদগে হয়ে উঠে। অবশেষে জুমাদাল উলা মাসের তিনদিন অবশিষ্ট থাকতে তাঁর ইনতিকাল হয়। উমর ইব্‌ন আবু সালামা বলেন, আমার পিতার মৃত্যুতে আমার মা যথারীতি ইন্দত পালন করেন । ৪ মাস ১০ দিন ইদ্দত পালনের পর রাসূলুল্লাহ্-র সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। শাওয়াল মাসের শেষ দিকে তাঁদের বাসর হয়। এ প্রেক্ষিতে আমার মা বলতেন “শাওয়াল মাসে বিয়ে অনুষ্ঠান এবং বাসর উদযাপনে কোন দোষ নেই। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বিয়ে করেছেন শাওয়াল মাসে এবং ঐ মাসেই আমাদের বাসর হয়। বর্ণনাকারী বলেন, ৫৯ হিজরী সনের যিলকদ-মাসে উম্মু সালামা (রা)-এর ওফাত হয়। বায়হাকী (র) এটি বর্ণনা করেছেন। আমি বলি, ৪র্থ হিজরী সনের শেষের দিকের ঘটনাবলী উল্লেখ করার সময় শাওয়াল মাসে উম্মু সালামার সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বিবাহ এবং এতদ্‌সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় যেমন মায়ের বিয়েতে পুত্রের অভিভাবকত্ব, এ বিষয়ে উলামা-ই কিরামের মতভেদ ইত্যাদি উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।

রাজীর লোমহর্ষক ঘটনা

ওয়াকিদী বলেন, এই ঘটনাটি ঘটেছিল ৪র্থ হিজরী সনের সফর মাসে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওই জামাতকে প্রেরণ করেছিলেন মক্কাবাসীদের প্রতি। রাজী হল উছফান থেকে ৮ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত একটি কুয়ো । ইমাম বুখারী (র) বলেন, ইবরাহীম– আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদল গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন। তাদের নেতা মনোনীত করেছিলেন আসিম ইব্‌ন ছাবিতকে। আসম ইবন ছাবিত ছিলেন আসিম ইবন উমার ইবন খাত্তাবের নানা। তাঁরা রওয়ানা করলেন। মক্কা ও উছফান-এর মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছার পর বদ্যায়ল গোত্রের এক উপগোত্র বনূ লাহয়ান তাঁদের উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়। ফলে ঐ গোত্রের প্রায় একশ’ তীরন্দাজ ব্যক্তি ঐ মুসলিম জামাআতকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে বের হয়। তাঁদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে শত্রুপক্ষ অগ্রসর হয়। এক জায়গায় এসে তারা যাত্রা বিরতি করে। সেখানে তারা কতক খেজুর বীচি দেখতে পায়। তারা বলাবলি করতে লাগলো ওগুলো তো দেখছি মদীনার খেজুর। সফরের খাদ্য হিসেবে আসিম (রা) ও তাঁর সাথীরা সেগুলো সঙ্গে এনেছিলেন। দ্রুত বেগে তারা ঐ জামাআতের পশ্চাদ্ধাবন করে। তারা তাঁদের কাছে পৌঁছে গেল । আসিম ও তাঁর সাথিগণ উপায়ান্তর না দেখে ফদ ফদ নামক একটি উঁচু টিলায় উঠে যায়। শত্রুপক্ষ তাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। ওরা বলল, আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তোমরা যদি আমাদের নিকট আত্মসমর্পণ কর। তবে আমরা তোমাদের কাউকে হত্যা করব না। দলনেতা আসিম (রা) বললেন, আমি কখনো কাফিরের হাতে আত্মসমর্পণ করব না। হে আল্লাহ্! আমাদের এই সংকটপূর্ণ অবস্থা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অবগত করিয়ে দিন। এরপর তাঁরা কাফিরদের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। দলনেতা আসিম (রা)সহ ৭ জন সাহাবী কাফিরদের হাতে নিহত হন। খুবায়ব, যায়দ ও অন্য একজন লোক বেঁচে গেলেন। তাঁরা কাফিরদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে আত্মসমর্পণ করেন। কাফিরেরা যখন সাহাবী তিনজনকে পূর্ণ কাবুতে পেয়ে গেল তখন তারা তাদের ধনুকের ছিলা দিয়ে তাদেরকে বেঁধে ফেলে; তখন তৃতীয় ব্যক্তি বললেন, এটি হচ্ছে প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি ওদের সাথে যেতে অস্বীকার করেন। ওরা জোর জবরদস্তি করে নিয়ে যেতে চায়। তিনি যেতে অস্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত তারা তাকে শহীদ করে দেয়। যায়দ (রা) ও খুবায়ব (রা)-কে নিয়ে তারা যাত্রা করে। মক্কায় পৌঁছে তারা তাঁদের দুজনকে বিক্রি করে দেয়। হারিছ ইবন আমিরের পুত্রেরা হযরত খুবায়ব (রা) কে কিনে নেয়। বদর দিবসে তিনি হারিছকে হত্যা করেছিলেন। বন্দী অবস্থায় খুবায়ব (রা) তাদের নিকট রইলেন। শেষ পর্যন্ত তারা যখন তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল তখন হারিছের এক মহিলার নিকট থেকে তিনি ক্ষৌর কর্ম সম্পাদনের জন্যে একটি ক্ষুর চেয়ে নেন। মহিলাটি তাকে একটি ক্ষুর দেয়। মহিলাটির অসতর্ক মহূর্তে তার এক শিশু পুত্র খুবায়বের (রা) কাছে পৌঁছে যায়। তিনি শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। মহিলাটি বলে শিশুর এই অবস্থান দেখে আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়ি, খুবায়ব (রা) তা আঁচ করতে পারলেন। তখনও তাঁর হাতে ক্ষুর। তিনি বললেন, তুমি কি ভয় পাচ্ছ যে, আমি ওকে খুন করব? আমি ইনশাআল্লাহ্ তা করব না। হারিছের কন্যা প্রায়ই বলত যে, খুবায়ব (রা)-এর চাইতে ভদ্র কোন বন্দী আমি কখনো দেখিনি। আমি তাঁকে দেখেছি যে, তিনি আঙ্গুর ছড়া থেকে আঙ্গুর খাচ্ছেন অথচ তখন মক্কায় আঙ্গুরের মওসুম ছিল না। তদুপরি তিনি লোহার শিকলে বাঁধা ছিলেন। নিশ্চয়ই ওই আঙ্গুর ছিল তাঁর জন্যে আল্লাহর পাঠানো বিশেষ রিক স্বরূপ। হত্যার উদ্দেশ্যে তার তাঁকে হারাম শরীফের বাইরে নিয়ে যায়। তিনি বললেন, আমাকে দু’ রাকআত নামায আদায় করার সুযোগ দাও। পরে তিনি তাদের নিকট ফিরে এলেন। তিনি বললেন, তোমরা ধারণা করবে যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে দীর্ঘ নামায আদায় করছি এরূপ আশংকা না থাকলে আমি নামায আরও দীর্ঘায়িত করতাম। নতুবা নিহত হওয়ার পূর্বে দু’রাকআত নামায আদায় করার রীতি সর্ব প্রথম তিনিই চালু করেন। তিনি বললেন :

হে আল্লাহ! আপনি ওদেরকে জনে জনে গুণে রাখুন এবং ওদের প্রত্যেককে ধ্বংস করুন। তারপর তিনি বললেন : 1

যখন মুসলিম অবস্থায় আমি নিহত হচ্ছি তখন আমার কোন পরোয়া নেই যে, কোন পাশে কাত থাকা অবস্থায় আমার মৃত্যু হলো।

আমার মৃত্যুতে হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্যে। তিনি চাইলে আমার খণ্ড বিখও দেহের প্রতিটি জোড়ায় জোড়ায় প্রতিটি সংযোগ স্থলে বরকত দিবেন। এরপর উকবা ইবন হারিছ তাঁর দিকে এগিয়ে যায় এবং তাঁকে হত্যা করে। বর্ণিত আছে যে, কুরায়শের লোকেরা প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল যাতে তারা চিনতে পারে আসিমের (রা) শরীরের এমন কোন অংশ নিয়ে আসার জন্যে। কারণ, হযরত আসিম (রা) ওদের খ্যাতিমান এক নেতাকে বদর দিবসে হত্যা করেছিলেন। এখন তাঁর শরীরের অংশের অবমাননা করে তার প্রতিশোধ নেয়া ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু তাঁর পবিত্র দেহকে ওদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা মেঘের ন্যায় এক ঝাঁক মৌমাছি পাঠিয়ে দিলেন। মৌমাছি গুলো চারিদিক থেকে তাঁকে ঘিরে রেখে ওদের হাত থেকে তাঁর দেহকে বৃক্ষা করে। তারা তাঁর দেহ স্পর্শ-ই করতে পারেনি।

বুখারী বলেন, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মুহাম্মাদ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) বলতেন যে, খুবায়ব (রা)-কে হত্যা করেছিল কাফির আৰু সারোআ । আমি বলি, তার নাম উকবা । সে হারিছের পুত্র। অবশ্য পরে সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। “দুধ পান” বিষয়ে তার বর্ণিত একটি হাদীছও রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, আবু সারোআ আর উা দুজন সহোদর ভাই ছিলেন। আল্লাহ্ ভাল জানেন। বুখারী (র) তাঁর সহীহ গ্রন্থে মাগাযী অধ্যায়ে রাজী এর ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি এই ঘটনাটি তাওহীদ অধ্যায়ে এবং জিহাদ অধ্যায়ে যুহরী ন্নি ভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করেছেন। তাঁর একটি ভাষ্য এই : রাসূলুল্লাহ্ (সা) ১০ জনের একটি গুপ্তচর দল প্রেরণ করেছিলেন। তাদের নেতা মনোনীত করেছিলেন আসিম ইবন ছাবিত ইব্‌ন আবু আফলাহূকে। অবশিষ্ট বর্ণনা পূর্বের ন্যায়। বর্ণনার কোন কোন অংশে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক, মূসা ইবন উব্বী এবং উরওয়া ইবন যুবায়র দ্বিমত পোষণ করেছেন। উভয় প্রকারের বর্ণনার মধ্যে কতটুকু তারতম্য ও ব্যবধান রয়েছে তা স্পষ্ট করার জন্যে আমরা ইবন ইসহাকের বর্ণনাটিও উল্লেখ করব। কারণ, ইতিহাস বিষয়ে ইবন ইসহাক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যেমন ইমাম শাফিঈ (র) বলেছেন, মাগাযী বা যুদ্ধ শাস্ত্রে যে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করতে চায় সে নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের মুখাপেক্ষী।

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেছেন, আসিম ইবন উমার ইবন কাতাদা আমাদের নিকট বলেছেন যে, উহুদ যুদ্ধের পর আযল ও কারাহ গোত্রদ্বয়ের কতক লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আগমন করে। তারা বলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। আপনি আপনার সাহাবীদের মধ্য থেকে একদল লোক আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন যারা আমাদেরকে দীনের জ্ঞান দান করবে, কুরআন শিক্ষা দেবেন এবং ইসলামের বিধানাবলী সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর ছয়জন সাহাবী (রা)-কে তাদের সাথে প্রেরণ করলেন। তাঁরা হলেন- (১) মারছাদ ইবন আবু মারছাদ গানাবী (রা), ইনি হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিবের মিত্র ছিলেন। ইবন ইসহাকের মতে ইনি ছিলেন দলনেতা। (২) খালিদ ইবন বুকায়র লাইছী (রা), তিনি বনূ আদী গোত্রের মিত্র। (৩) আসিম ইবন ছাবিত ইব্‌ন আকূল আফলাহ (রা)। ইনি বনূ আমর ইবন আওফ গোত্রের লোক ছিলেন। (৪) খুবায়ব ইবন আদী (রা), ইনি বনূ জাহজাবাঈ ইবন কালফা ইবন আমর ইবন আওফ গোত্রের লোক ছিলেন। (৫) যায়দ ইবন দাছিন্না (রা), তিনি বনূ বিয়াদা ইবন আমির গোত্রের লোক ছিলেন। (৬) আবদুল্লাহ্ ইবন তারিক (রা), ইনি যাফর গোত্রের মিত্র ছিলেন। ইবন ইসহাক এরূপই বলেছেন যে, তাঁরা ছিলেন ছয় জন, মূসা ইবন উবা ও তাই বলেছেন, ইবন ইসহাক যে নামগুলো উল্লেখ করেছেন মূসা ইবন উকবাও সেগুলো উল্লেখ করেছেন। বুখারীর (র) মতানুসারে প্রতিনিধি দলে ছিলেন ১০ জন । তিনি আরো বলেছেন যে, তাদের দল নেতা ছিলেন আসিম ইবন ছাবিত ইবন আকুল আফলাহ! আল্লাহই ভাল জানেন।

ইবন ইসহাক বলেন, আগত লোকদের সাথে যাত্রা করলেন এই প্রতিনিধি দল। তাঁরা গিয়ে পৌঁছলেন রাজী’ এলাকায়। রাজী হল হাদ’আ থেকে ফেরার পথে হিজায্য প্রান্তের একটি কূয়। হুযায়ল গোত্রের তত্ত্বাবধানে ছিল এ কুয়োটি। সেখানে পৌঁছার পর ঐ লোকজন বিশ্বাসঘাতকতা করে। মুসলিম জামাতটির উপর হামলা করার জন্যে তারা হুযায়ল গোত্রকে আহ্বান জানায়। কিন্তু তাদের হাতে তরবারি থাকায় স্থানীয় লোকজন সে সাহস করেনি। অথচ তারা ঐ জামাতকে ঘিরে রেখেছিল। মুসলমানগণ শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে তরবারিগুলো হাতে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান। তখন তারা বলে যে, আল্লাহর কসম! আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আসিনি । আমরা বরং এটি চেয়েছিলাম যে, আপনাদেরকে মক্কাবাসীর নিকট প্রেরণ করে বিনিময়ে কিছু আর্থিক সুবিধা আদায় করব। আপনাদের সাথে আমরা অঙ্গীকার করছি যে, আমরা আপনাদেরকে হত্যা করব না। হযরত মারছাদ (রা), খালিদ ইবন বুকায়র (রা) এবং আসিম ইবন ছাবিত (রা) বললেন, আল্লাহর কসম, মুশরিকদের কোন অঙ্গীকার আমরা বিশ্বাস করব না এবং ওদের সাথে কোন চুক্তিতে আমরা আবদ্ধ হব না, এ প্রসংগে আসিম ইব্‌ন ছাবিত (রা) বললেন :

আমার কোন ওযুর ও দুর্বলতা নেই। আমি একজন শক্ত-সামর্থ তীরন্দাজ যুবক! আমর ধনুকে রয়েছে মযবুত ছিলা।

সেটির পিঠ থেকে নীর পড়ে যায় । মৃত্যু চির সত্য আর জীবন হল অসার।

যা নাযিল হবে বলে আল্লাহ্ তা’আলা স্থির করেছে, তা মানুষের উপর নাযিল হবেই। মানুষ সে দিকে আসবেই।

আমি যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করি তবে আমার মা অপ্রকৃতিস্থ বলে গণ্য হবেন। হযরত আসিম (রা) আরো বলেন :

আবূ সুলায়মান সীমালংঘনকারী ও পথভ্রষ্ট যেন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড।

শোক প্রকাশকারিণী মহিলাগণ যখন তাদের শয্যা পেতে কাঁদতে থাকে তখনও আমি কোন ভয় পাইনা; বরং ষাড়ের চামড়ায় তৈরী ঢাল নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হই।

আর আমি মুহাম্মাদ (সা)-এর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থাশীল, তিনি আরো বলেন,

আবূ সুলায়মান ও আমার দৃষ্টান্ত এই যে, আমরা দুজন তীরন্দাজ ও বর্শা নিক্ষেপে পারদর্শী। আর আমার গোত্র হল সম্মানিত গোত্র।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর তিনি লড়াই অব্যাহত রাখেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এবং তাঁর সাথীদ্বয় শহীদ হন। তিনি নিহত হওয়ার পর হুযায়ল গোত্রের লোকেরা চেয়েছিল তাঁর মাথা কেটে নিয়ে মক্কী মহিলা সুলাফা বিনত সা’দ ইবন সুহায়লের নিকট বিক্রি করতে। কারণ, উহুদ দিবসে হযরত আসিম (রা) ওই মহিলার দু’ পুত্রকে হত্যা করেছিলেন । মহিলাটি মানত করেছিল যে, সে যদি কোন দিন আসিমের মাথার খুলি হাতে পায় তবে তাতে করে সে শরাব পান করবে। একদল মৌমাছি এসে হযরত আসিম (রা)-এর পবিত্র লাশ ঘিরে ফেলে এবং ওদের ইচ্ছা পূরণে বাধা সৃষ্টি করে। নিরুপায় হয়ে তারা বলে যে, আপাতত থাকুক সন্ধ্যা হলে মৌমাছিগুলো নিজ নিজ মৌচাকে ফিরে যাবে। আমরা তখন তার মাথা কেটে নেব । সন্ধ্যাবেলা আল্লাহ্ তা’আলার নিদের্শে উপত্যকায় ঢল নামে এবং হযরত আসিমকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল । হযরত আসিম (রা) আল্লাহ্ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে, তাঁকে যেন কোন মুশরিক স্পর্শ করতে না পারে এবং তাকেও যেন কোন মুশরিককে স্পর্শ করতে না হয়। কেননা, মুশরিকরা নাপাক। মৌমাছি এসে হযরত আসিম (রা)-কে রক্ষা করেছে এই সংবাদ শুনে হযরত উমার (রা) বলতেন, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে রক্ষা করে থাকেন। আসিম (রা) মানত করেছিলেন যে, কখনো তিনি কোন মুশরিককে স্পর্শ করবেন না এবং তাঁকেও যেন কোন মুশরিক জীবনে স্পর্শ করতে না পারে। বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা’আলা জীবন কালে যেমন আসিমকে মুশরিক লোকের স্পর্শ থেকে রক্ষা করেছেন মৃত্যুর পরও তেমন রক্ষা করেছেন।

ইবন ইসহাক বলেন, হযরত খুবায়ব (রা) যায়দ ইবন দাছিন্না এবং আবদুল্লাহ ইবন তারিক কিছুটা নম্রতা দেখালেন এবং জীবন বাঁচাতে চাইলেন। তাঁরা ওদের নিকট আত্মসমর্পণ করলেন । তারা তাদেরকে বন্দী করে ফেলল এবং মক্কায় নিয়ে বেঁচে দেয়ার জন্যে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করল । মাররুয যাহরান পৌঁছার পর আবদুল্লাহ্ ইবন তারিক কৌশলে তাঁর হাত মুক্ত করে নিলেন। তারপর তার তরবারি হাতে নিয়ে শত্রুদের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন। তারা সকলে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গেল । এরপর সকলে মিলে তাঁকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপে তারা তাঁকে হত্যা করল । তাঁর কবর মাররুয যাহরানে অবস্থিত।

তারা খুবায়ব ইবন আদী (রা) এবং যায়দ ইবন দাচ্ছিন্না (রা)-কে মক্কায় নিয়ে আসে। তারপর কুরায়শদের হাতে বন্দী দুজন হুযায়লী লোকের মুক্তির বিনিময়ে তাদেরকে কুরায়শদের হাতে তুলে দেয়। ইবন ইসহাক বলেন, হুজায়র ইবন আবু ইহাব তামীমী হযরত খুবায়ব (রা)-কে কিনে নেয়। হুজায়র ছিল বনু নাওফিল গোত্রের মিত্র। তার পিতা আবু ইহাব হল হারিছ ইবন আমিরের বৈপিত্রীয় ভাই। হুজায়র হযরত খুবায়ব (রা)-কে কিনেছিল উব্বা ইবন হারিছের নিকট হস্তান্তর করার জন্যে যাতে সে খুবায়ব (রা)-কে হত্যা করে তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে । যায়দ ইবন দাছিন্নাহ (রা)-কে ক্রয় করেছিল সাফওয়ান ইবন উমাইয়া । সে তাঁকে ক্রয় করেছিল তাঁকে হত্যা করে তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে । হত্যার নির্দেশ দিয়ে সে তার ক্রীতদাস নাসতাস কে যায়দ ইবন দাছিন্না সহকারে হারাম শরীফের বাহিরে তানঈম নামক স্থানে পাঠায় । সেখানে কতক কুরায়শী লোক একত্রিত হয়। তাদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ইবন হারবও ছিল। মৃত্যুর মুখোমুখি যায়দ ইবন দাছিন্না (রা)-কে সে বলেছিল “হে যায়দ! এখন তোমার যে অবস্থান মুহাম্মাদকে ধরে এনে সে অবস্থানে রেখে আমরা যদি তাকে হত্যা করি বিনিময়ে তোমাকে মুক্তি দিই, তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে থাক তা কি তুমি পসন্দ করবে? হযরত যায়দ (রা) বললেন, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (সা) এখন যে অবস্থানে আছেন সেখানে যদি তাঁর পবিত্র দেহে একটি কাটার খোঁচা লাগে আর আমি আমার পরিবারের মধ্যে থাকব তা আমি কখনও পসন্দ করব না। আবু সুফিয়ান বলল, মুহাম্মদের (সা) সাহাবীগণ তাকে যেমন দৃঢ়ভাবে ভালবাসে কোন মানুষ অন্যকে তেমন ভালবাসতে আমি দেখিনি। তারপর নাসতাম কাফির এসে তাঁকে হত্যা করে।

বর্ণনাকারী বলেন, খুবায়ব ইব্‌ন আদী (রা) সম্পর্কে আবদুল্লাহ্ ইবন আবু নাজীহ্ হুজায়র ইবন আবূ ইহাবের ক্রীতদাসী মাবিয়া থেকে বর্ণনা করেন, পরবর্তীতে মাবিয়া ইসলাম গ্রহণ করেন। বস্তুত মাবিয়া বলেছেন যে, খুবায়ব (রা) বন্দী অবস্থায় আমার নিকট আমার গৃহে অবস্থান করছিলেন। একদিন হঠাৎ আমি তার দিকে উঁকি মেরে দেখি । তার হাতে আঙ্গুরের থোকা। মানুষের মাথার মত বড় ছিল ওই আঙ্গুরগুলো। তিনি ওই থোকা থেকে আঙ্গুর খাচ্ছিলেন। তখন পৃথিবীর কোথাও আঙ্গুর পাওয়া যায় বলে আমার জানা ছিল না।

ইবন ইসহাক বলেন, আসিম ইবন উমার ইব্‌ন কাতাদা এবং আবদুল্লাহ্ ইবন আবু নাজীহ্ দুজনেই আমাকে জানিয়েছেন, যে মাবিয়া বলেছেন, খুবায়ব (রা)-এর মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে আসায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমাকে একটি ক্ষুর দাও। আমি যেন মৃত্যুকে বরণ করার জন্যে পাক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়ে নিতে পারি। মাবিয়া বলেন, এরপর ক্ষুর সহ ছোট্ট একটি বালককে আমি তাঁর নিকট পাঠাই এই বলে যে, তুমি ক্ষুরটি নিয়ে গৃহে আবদ্ধ লোকটির নিকট যাও। ক্ষুর নিয়ে বালকটি সেদিকে যাত্রা করার পরই আমার বোধ উদয় হল যে, আমি যা করলাম তাতে তো খুবায়বের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ তৈরী করে দিলাম। প্রতিশোধ স্বরূপ তিনি বালকটিকে হত্যা করে ফেলতে পারেন। তাহলে ১ জন মুসলিমের প্রতিশোধরূপে ১জন কাফিরকে হত্যা করা হবে। বালকটি ক্ষুর নিয়ে তাঁর নিকট পৌঁছার পর তিনি সেটি নিজ হাতে নিলেন এবং বললেন, হায়, তোমার মা যখন ক্ষুর সহ তোমাকে আমার নিকট পাঠিয়েছে তখন সে কি ভয় পায়নি? এরপর তিনি শিশুটিকে বিদায় দিয়ে দিলেন।

ইবন হিশাম বলেন, শিশুটি ছিল ওই মহিলারই পুত্র সন্তান। ইবন ইসহাক বলেন যে, আসিম বলেছেন, এরপর কাফিরেরা হযরত খুবায়ব (রা)-কে নিয়ে বের হল তাঁকে শুলিতে চড়ানোর জন্যে। তারা “তানঈম এসে পৌঁছল। তিনি বললেন, তোমরা যদি আমাকে দু’ রাক’আত নামায আদায়ের অবকাশ দিতে রাযী হও তবে তাই কর। তারা বলল, ঠিক আছে তুমি নামায আদায় করে নাও। তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে ও পূর্ণতার সাথে দু’ রাকআত নামায আদায় করলেন । তারপর শত্রুদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা যদি এ সন্দেহ পোষণ না করতে যে, মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে আমি দীর্ঘক্ষণ নামায পড়ছি তবে আমি তা আরো দীর্ঘায়িত করতাম । হযরত খুবায়ব (রা) প্রথম ব্যক্তি যিনি মুসলমানদের জন্যে নিহত হওয়ার পূর্বে দু’ রাকআত নামায আদায়ের সুন্নত প্রবর্তন করে গেলেন। এরপর তারা খুবায়ব (রা)-কে সংশ্লিষ্ট কাঠে চড়িয়ে মযবুতভাবে বেঁধে ফেলল। খুবায়ব এই দু’আ পাঠ করলেন —

হে আল্লাহ! আমরা আপনার রাসূলের রিসালাতের বাণী পৌঁছিয়েছি। এখন আমাদেরকে নিয়ে যা যা করা হচ্ছে তার সংবাদ আপনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ভোরেই পৌঁছিয়ে দিন। তারপর তিনি বললেন —

–হে আল্লাহ্! ওদের সবাইকে আপনি গুণে নিন। তাদের সকলকে ধ্বংস করুন। ওদের কাউকেই অবশিষ্ট রাখবেন না।) এরপর তারা তাঁকে হত্যা করল ।

মুআবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান বলতেন “সেদিন আবু সুফিয়ানের সাথে অন্যান্যসহ আমিও ছিলাম। আমি দেখেছি যে, হযরত খুবায়ব (রা)-এর বদ দু’আয় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আমার পিতা আবু সুফিয়ান আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছিলেন। তারা মনে করত যে, কারো জন্যে বদ দু’আ করা হলে সে যদি মাটিতে শুয়ে যায় বা কাত হয়ে পড়ে তবে ওই বদ দু’আ তার উপর থেকে টলে যায় ।

মূসা ইবন উকবার মাগাযী গ্রন্থে আছে যে, হযরত খুবায়ব (রা) এবং যায়দ ইবন দাচ্ছিন্না (রা) নিহত হয়েছিলেন একই দিনে । যেদিন তাঁরা নিহত হয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় অবস্থান করে তাঁদের আর্জি শুনতে পাচ্ছিলেন। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের দুজনের প্রতি সালাম । অথবা একথা বলেছিলেন, হে খুবায়ব! তোমার প্রতি সালাম। কুরায়শগণ খুবায়বকে হত্যা করে ফেলল” বর্ণিত আছে যে, শত্রুরা হযরত ইবন দাচ্ছিন্না (রা)-কে শুলিতে চড়িয়ে তাঁর প্রতি তীর নিক্ষেপ করছিল। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল তিনি দীন ত্যাগ করুন, কুফরীতে ফিরে আসুন। কিন্তু তাতে তাঁর ঈমান ও আত্মনিবেদন আরো সুদৃঢ় হল।

উরওয়া এবং মূসা ইবন উবা উল্লেখ করেছেন যে, তারা হযরত খুবায়ব (রা)-কে শুলির কাঠের সাথে বেঁধে ডেকে ডেকে বলছিল, তুমি কি এটা চাও যে, তোমার স্থানে মুহাম্মাদ থাকুক, তুমি মুক্তি পাও? তিনি বলছিলেন না, না, কখনো নয়। মহান আল্লাহর কসম! আমার মুক্তির বিনিময়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পবিত্র পায়ে একটি কাঁটা বিধুক তাও আমি পসন্দ করি না। তাঁর উত্তর শুনে তারা সকলে হাসাহাসি করছিল । যায়দ ইবন দাচ্ছিন্না (রা) সম্পর্কেও ইবন ইসহাক এরূপ বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

মূসা ইব্‌ন উক্রা বলেন, লোকদের ধারণা যে, আমর ইবন উমাইয়া হযরত খুবায়ব (রা)-কে দাফন করেছেন। ইবন ইসহাক বলেন, ইয়াহয়া ইবন আববাদ উকবা ইবন হারিছ সূত্রে বলেছেন, উ বলেছেন, আল্লাহর কসম! খুবায়ব (রা)-কে হত্যা করা আমার জন্যে সম্ভব ছিল না। আমি তখন একান্তই ছোট ছিলাম । কিন্তু বনূ আবদুদ দার গোত্রের আবু মায়সারা একটি বর্শা নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। এরপর সে আমার হাতে থাকা বর্শা এবং আমার হাত এক সাথে ধরে ওই বশ দ্বারা খুবায়ব (রা)-কে আঘাত করে। শেষ পর্যন্ত আঘাতে আঘাতে তার মৃত্যু হয়।

ইবন ইসহাক বলেন, আমার জনৈক সাথী আমাকে বলেছেন যে, হযরত উমার (রা) সিরিয়ার একটি স্থানে প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন সাঈদ ইবন আমির ইবন হুযায়ম জুমাহীকে, কোন কোন সময় এমনও হত যে, লোকজনের সম্মুখেই তিনি বেহুশ হয়ে যেতেন। হযরত উমারের () নিকট এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করা হল যে, প্রশাসক সাঈদ ই আমির একজন অসুস্থ মানুষ । কোন এক কাজে সাঈদ (রা) এসেছিলেন খলীফা হযরত উমরের (রা) নিকট। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে সাঈদ! তোমার যে, এ অবস্থা হয় তা কী জন্যে? সাঈদ বললেন, হে

আমীরুল মু’মিনীন! মূলত আমার মধ্যে কোন রোগ নেই। তবে হযরত খুবায়বকে হত্যা করার সময় যারা সেখানে উপস্থিত ছিল আমি তাদের একজন। তাঁর দু’টি আমি নিজ কানেই শুনেছিলাম । সে থেকে কোন মজলিসে বসলে ওই বদ দু’আর কথা স্মরণ হলেই আমি বেহুশ হয়ে যাই। এরপর থেকে হযরত উমরের (রা) নিকট তাঁর মর্যাদা আরো বেড়ে যায় ।

উমাভী– ইবন ইসহাক সূত্রে বলেছেন যে, হযরত উমর (রা) বলেছিলেন, যদি কেউ তুলনাহীন ও অনন্য ব্যক্তিকে দেখতে চায় সে যেন সাঈদ ইবন আমির (রা)-কে দেখে।

ইবন হিশাম বলেন, হযরত খুবায়ব (রা) তাদের হাতে বন্দী ছিলেন। নিষিদ্ধ মাসগুলো শেষ হবার পর তারা তাকে হত্যা করে।

বায়হাকী (র)– আমর ইবন উমাইয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) একদা তাঁকে গুপ্তচর রূপে প্রেরণ করেন। বর্ণনাকারী বলেন, যে কাঠে বেঁধে হযরত খুবায়ব (রা)-কে হত্যা করা হয়েছিল আমি চুপি চুপি ওখানে গেলাম। সেটিতে উঠলাম । ওদের পাহারাদারগণ আমাকে দেখে ফেলে নাকি ভয় পাচ্ছিলাম। আমি তাঁর বাধন খুলে দিলাম। তাঁর লাশ মাটিতে পড়ে গেল। আমিও লাফ দিয়ে নীচে পড়ে গেলাম। আমি একপাশে গিয়ে একটুখানি বসলাম। তারপর তাকিয়ে দেখি কিছুই নেই। খুবায়বের (রা) কোন চিহ্ন নেই। যেন মাটি তাকে গিলে ফেলেছে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত হযরত খুবায়রে (রা) লাশের এমনকি তার কোন হাড়ের সংবাদ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ইব্‌ন ইসহাক– ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, রাজী-এর ঘটনায় যারা শহীদ হলেন মুনাফিকরা তাঁদের সম্পর্কে কটুক্তি করে বলেছিল আহ! এরা শুধু শুধু মারা গেল। না তারা নিজেদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে থাকতে পারল, আর না তারা রাসূলের রিসালাতের বাণী পৌঁছাতে পারল। মুনাফিকদের এই আচরণ উপলক্ষে আল্লাহ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াত ও তার পরবর্তী আয়াত নাযিল করলেন :

মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে পার্থিব জীবন সম্পর্কে তার কথাবাতা তোমাকে চমৎকৃত করে এবং তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। প্রকৃতপক্ষে সে কিন্তু প্রচন্ড ঝগড়াটে। (২-বাকারা : ২০৪)। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পক্ষ থেকে প্রেরিত মুসলিম দল সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :

t

t

মানুষের মধ্যে অনেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে আত্ম-বিক্রয় করে থাকে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। (২-বাকারা : ২০৭)।

ইন ইসহাক বলেন, এই যুদ্ধে যে সব কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছিল তার অন্যতম হল হযরত খুবায়ব (রা)-এর নিম্নোক্ত কবিতা, শত্রুপক্ষ যখন তাকে হত্যা করার জন্যে পূর্ণ প্রস্তুত তখন তিনি এ কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। (ইবন হিশাম বলেন, এ কবিতা খুবায়ব (রা)-এর একথা কেউ কেউ মানতে রাযী নন।)

সকল দল আমার চারদিকে একত্রিত হয়েছে। তারা সবগুলো গোত্রকে ডেকে এনেছে এবং পরিপূর্ণভাবে জমায়েত হয়ে রয়েছে।

ওদের সকলে আমার প্রতি শত্রুতা প্রকাশ করছে, আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কারণ, আমি এখন চামড়া কাটার যন্ত্রে আবদ্ধ।

তারা তাদের পুত্র কন্যা এবং স্ত্রীদেরকে একত্রিত করেছে। আমাকে একটি সুদীর্ঘ ও মযবুত কাঠের নিকট নিয়ে আসা হয়েছে।

আমার এই একাকীত্বের কথা, আমার এই দুঃখ-দুর্দশার কথা এবং আমার মৃত্যুর জন্যে শত্রু পক্ষ যে যে ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে এ বিষয়ে আমি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ফরিয়াদ করছি।

হে আরশ অধিপতি! ওরা যা করতে চাইছে তার মুখে আপনি আমাকে ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দান করুন। ওরা আমার গোশত কেটে ফেলেছে এখন আমার বাঁচার সকল আশা শেষ হয়ে গিয়েছে।

আমার এই অবস্থা তো মহান আল্লাহর পথে। তিনি চাইলে আমার কর্তিত প্রতিটি অঙ্গের জোড়ায় জোড়ার বরকত প্রদান করবেন।

ওরা আমাকে কুফরী অবলম্বনের অন্যথায় মৃত্যুকে আলিঙ্গনের প্রস্তাব দিয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নীরবে ও শান্তচিত্তে আমার দু চোখ অশ্রুপাত করছে।

মৃত্যুভয় আমার নেই। কারণ, আমার মৃত্যু হবে তা নিশ্চিত। তবে আমি ভয় করি সর্বগ্রাসী লেলিহান জাহান্নামের আগুনকে।

আল্লাহর কসম! আমি যখন মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করছি তখন আমার মৃত্যু কোন কাতে হচ্ছে তার ভাবনা কিসের?

আমি শত্রুদের প্রতি বিনয় বা অস্থিরতা কিছুই প্রকাশ করছি না, কারণ, আমি নিশ্চিত যে, মহান আল্লাহর দিকেই আমি প্রত্যাবর্তন করছি।

এই কাসীদার দুটো পংক্তি সহীহ বুখারীতে উল্লেখ করা হয়েছে। যা ইতোপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে সে দুটো হল :

ইবুন ইসহাক বলেন, হযরত খুবায়ব (রা)-এর প্রতি শোক প্রকাশ করে হযরত হাস্সান ইবন ছাবিত (রা) বলেন : পংক্তি

তোমার চোখের কী হল? অশ্রুপাত করছে না কেন? বিক্ষিপ্ত মুক্তোর ন্যায় অশ্রু ঝরছে না কেন বুকের উপর?

অশ্রু ঝরছেনা কেন খুৰায়বের জন্যে? তিনি তো এক নওজোয়ান, টগবগে যুবক । তাঁর সাক্ষাতে তারা জেনে ফেলেছে যে, তিনি কাপুরুষও নন, দুর্বলও নন।

হে খুবায়ব! তুমি চলে যাও। আল্লাহ্ তা’আলা বিনিময়ে তোমাকে উত্তম পুরস্কার দিবেন এবং দিবেন চিরস্থায়ী জান্নাত যেখানে থাকবে বন্ধুদের মধ্যে হর-গিলমান।

তাঁর সম্পর্কে তোমরা আর কী বলবে, যেখানে তোমাদের নবী (সা) বলেছেন যে, তাঁর সম্মানে ফেরেশতাগণ চারিদিক থেকে তাঁর নিকটে এসে পৌঁছেছে।

হে শত্রুপক্ষ! আল্লাহর পথে শহীদ এই লোকটির তোমরা কেন খুন করলে? তোমরা তাঁকে খুন করেছ এমন এক লোকের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে যে ছিল শহরে নগরে এবং বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে একজন খোদাদ্রোহী ব্যক্তি।

ইবন হিশাম বলেন, আমরা কবিতার কিছু কিছু অমার্জিত অংশ ছেড়ে দিয়েছি। বনূ লিহয়ান গোত্রের যারা রাজী এর ঘটনায় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিল তাদের নিন্দায় হযরত হাসসান ইবন ছাবিত বলেন —

তোমার অন্তর নিখাঁদ গাদ্দারীতে ভর্তি। (সেখানে প্রতিশ্রুতি পালনের লেশমাত্রও নেই) তুমি রাজী’ অঞ্চলে যাও এবং লিহয়ান গোত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর ।

ওরা এমন এক সম্প্রদায় যে নিজেদের প্রতিবেশীকে খাওয়ার জন্যে একে অন্যকে ডেকে এনেছে। মূলতঃ কুকুর, বানর এবং ওই মানুষগুলো একই পর্যায়ের ।

বন্য (পাঁঠা) যদি কখনো কথা বলতে পারত তবে সে দাঁড়িয়ে তাদেরকে বক্তৃতা শুনাত এবং ওই ছাগল তাদের মধ্যে মর্যাদাবান ও সম্মান যোগ্য হত।

রাজী’ অঞ্চলে প্রেরিত সাহাবা-ই-কিরামের (রা) প্রতি হুযায়ল ও লিয়ান গোত্র যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার নিন্দায় হযরত হাস্সান ইবন ছাবিত (রা) বলেন :

হযরত খুবায়ব ও আসিম (রা)-এর ব্যাপারে হুযায়ল গোত্র যে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে তার আলোচনা ও ইতিহাস গোত্রপতি হুযায়ল ইব্‌ন মুদরিকের সুনাম ভুলুণ্ঠিত করে দিয়েছে–

লিহয়ান গোত্রের ঘটনা তাদেরকে নিকৃষ্ট ও হীনতর স্তরে নামিয়ে দিয়েছে। লিহয়ান গোত্রের লোকেরা অপরাধী জঘন্য অপরাধী ।

যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা ওই গোত্রের প্রকৃত বীরদের তুলনায় খুব নীচ ও নিকৃষ্ট স্তরের লোক। অগ্রবর্তী ও নেতৃস্থানীয় লোকদের মুকাবিলায় এরা একেবারেই পেছনের সারির লোক।

রাজী দিবসে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার তত্বাবধানে থাকা পূতঃপবিত্র সম্ভ্রান্ত ও মহান চরিত্রের অধিকারী লোক গুলোকে তারা শত্রুর হাতে সমর্পণ করেছে।

ওরা বিশ্বাসঘাতকতা করে হস্তান্তরিত করে দিয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রেরিত দূতদেরকে। হুযায়ল গোত্র মন্দ ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করেনি।

অতিসত্বর তারা তাদের পরাজয় দেখতে পাবে। তারা পরাজিত হবে তাদের উপর অন্যরা জয়ী হবে। এজন্যে যে, তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে যার দেহ রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে এসেছিল ভীমরুলের দল।

বোলতা ও মৌমাছির একটি বিরাট দল। তারা তাঁর পবিত্র লাশের চারিদিকে সমবেত হয়েছিল। তারা রক্ষা করেছে এমন এক ব্যক্তির দেহকে যিনি ছিলেন সত্যের অন্যতম সাক্ষ্য দাতা যুদ্ধের প্রখ্যাত সেনাপতি।

তাঁকে হত্যা করার কারণে নিশ্চয় হুযায়ল গোত্র তাদের জন্যে দেখতে পাবে তাদের হত্যাকান্ডের স্থান। যেখানে মরে পড়ে থাকবে তাদের লোকজন অথবা তারা দেখতে পাবে দুঃখজনক পরিণতি।

এই অপরাধের কারণে আমি তাদের উপর একটি প্রচণ্ড আক্রমণের আশা করছি। হজ্জ মওসূমের অশ্বারোহিগণ ওই আক্রমণের মাধ্যমে এই অপকর্মের সমুচিত জবাব দিবে ।

মুসলমানদের এই দল তো ওখানে গিয়েছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দূত তো একজন বুদ্ধিমান ও চতুর লোকের ন্যায় কাজ করেছেন । তিনি লিহয়ান গোত্র সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

ওরা এমন এক গোত্রের লোক যারা প্রতিশ্রুতি পালনের কোন গুরুত্ব দেয় না। ফলে ওরা যখন নির্যাতিত হয় তখন তারা যালিমের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে না ।

সব মানুষ সমতল ভূমিতে অবস্থান নিলে তুমি ওদেরকে দেখবে যে, ওরা খাড়া পর্বতের ঝর্ণা ধারায় অবস্থান করে পানির স্রোতের সাথে তলিয়ে যাচ্ছে ।

ওদের বাসস্থান হল ধ্বংসের আখড়া। সংকটময় মুহূর্তে তাদের মনোভাব ও অভিমত হয়। জন্তু-জানোয়ারের মনোভাবের ন্যায়।

ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, রাজী’ এর ঘটনায় যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের প্রশংসা করে এবং কবিতায় তাঁদের নাম উল্লেখ করে হযরত হাসান ইবন ছাবিত (রা) বলেন–

রাজী’-এর ঘটনায় যারা নবী (সা)-এর নির্দেশ পালন করেছেন মহান আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি দয়া করুন। বস্তুতঃ তাঁরা সম্মানিত হয়েছেন এবং পুরস্কৃত হয়েছেন।

ওই অভিযানের প্রধান ও আমীর ছিলেন মারছাদ (রা)। তাদের ইমাম ছিলেন ইব্‌ন বুকায়র (রা) ও খুবায়ব (রা)।

ইবন তারিক এবং ইব্‌ন দাছিন্না ওই দলে ছিলেন। নির্ধারিত মৃত্যু সেখানে তাঁকে পেয়ে বসে।

ওই রাজী’র ঘটনায় নিহত হয়েছেন আসিম (রা), তিনি বহু উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি মর্যাদা অর্জনকারী ।

প্রতিশোধ গ্রহণকারীদেরকে তিনি তাঁর পিঠ স্পর্শ করা থেকে বিরত রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তরবারি পরিচালনা করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন এক অভিজাত পুরুষ।

ইন হিশাম বলেন, উপরোক্ত কবিতা যে হযরত হাসান (রা)-এর অনেকেই তা স্বীকার করেন না।

আমর ইবন উমাইয়া দিমারীর (রা) অভিযান

ওয়াকিদী বলেন, ইব্রাহীম ইবন জাফর আবদুল ওয়াহিদ ইবন আবু আওফ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মক্কায় আবু সুফিয়ান ইবন হারব কুরায়শী কতক লোককে ডেকে বলেছিল, এমন কেউ কি নেই যে কূট কৌশলে মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারে? মুহাম্মাদ তো স্বাভাবিক। ভাবে হাটে-বাজারে চলাফেরা করেন। তা হলে আমাদের প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যেতো। জনৈক বেদুইন তার এ ঘোষণা শুনে তার বাড়ীতে এলো। সে তাকে বলল, আপনি যদি আমার পাথেয় ও প্রয়োজনীয় বাহনের ব্যবস্থা করেন তবে আমি মুহাম্মাদের উদ্দেশ্যে বের হব এবং কূট কৌশলে তাকে হত্যা করব। পথঘাট আমার নখ দর্পনে। আমার সাথে আছে শকুনের চঞ্চুর মত একটি খঞ্জর। আবু সুফিয়ান বলল, তুমি আমাদের কাংখিত বন্ধু বটে । সে তাকে একটি উট এবং পর্যাপ্ত পাথেয় দিয়ে বলল, তোমার ব্যাপারটি খুবই গোপন রাখবে । কারণ, আমার আশংকা আছে- যে কেউ এটা জানতে পারলে মুহাম্মাদকে জানিয়ে দেবে । বেদুইনটি বলল না, কেউই তা জানতে পারবে না, সওয়ারীতে চড়ে সে রাতের বেলা যাত্রা করল। পাঁচ দিন পথ চলার পর ষষ্ঠ দিনের ভোরবেলা সে গিয়ে পৌঁছে “যাহরুল হাই”১ [১. টীকা : বায়যাবীতে শব্দটি হাবা বলে উল্লিখিত হয়েছে] গোত্রের নিকট । এবার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে করতে সে এগিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে সে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নামাযের স্থানে এসে পৌঁছে। জনৈক লোক তাকে জানায় যে, তিনি তো বনূ আশহাল গোত্রের নিকট গিয়েছেন। আগন্তুক তার সওয়ারী চালায় ওই গোত্রের দিকে। সেখানে এসে সে সওয়ারী বেঁধে রেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খোঁজে বের হয়। সে তাকে দেখতে পেলো । তিনি তখন মসজিদে সাহাবীদের সমাবেশে কথা বলছিলেন, সে সেখানে প্রবেশ করলো । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে দেখে ফেলেন । তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, এর মতলব ভাল নয় । লোকটি বিশ্বাসঘাতকতার উদ্দেশ্যে এসেছে। তার উদ্দেশ্যে পূরণে আল্লাহ্ তা’আলা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন। লোকটি দাঁড়াল এবং বলল, আবদুল মুত্তালিবের বংশধরটি কে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমিই আবদুল মুত্তালিবের বংশধর। সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে গোপনে কথার ভান করে তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়ছিল । উসায়দ ইবন হুযায়র তাকে টেনে ধরেন এবং বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে দূরে সরে দাঁড়াও। তিনি তার পায়জামার ভেতরের অংশ টেনে ধরতেই তার খঞ্জরটি বেরিয়ে পড়লো । তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ তো দেখছি বিশ্বাসঘাতক! দুষ্কৃতিকারী। আরব বেদুইনটির মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে গেল । সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমাকে প্রাণে রক্ষা করুন। আমাকে বাঁচান। উসায়দ ইবন হুযায়র তাকে জাপটে ধরলেন। তাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সত্যি করে বল, তুমি কে? এখানে এসেছ কোন উদ্দেশ্যে? সত্য বললে তোমার লাভ হবে। তার যদি মিথ্যা বল তবে জেনে রেখ তোমার উদ্দেশ্য কি তা আমার অজানা নেই। বেদুইনটি বলল, সত্য বললে আমি কি নিরাপত্তা পাব? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হাঁ তুমি নিরাপত্তা পাবে। আবু সুফিয়ান তাকে যা বলেছে, যে জন্যে পাঠিয়েছে এবং তাকে যা যা পাথেয় ও উপহার দিয়েছে তার সবই সে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে খুলে বলল । এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশে তাকে উসায়দ ইবন হুযায়রের তত্বাবধানে বন্দী করে রাখা হয়। পরের দিন ভোর বেলা রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমি তোমাকে নিরাপত্তা দিলাম। এখন তোমার যেখানে যেতে মন চায় তুমি যেতে পার। তবে এর চাইতে তোমার জন্যে অধিক কল্যাণকর একটি পথ কি তুমি গ্রহণ করবে? সে জিজ্ঞেস করল, সেটি কী? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তুমি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই এবং এ সাক্ষ্য দিবে যে, আমি আল্লাহর রাসূল। সে বলল ।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং হে মুহাম্মাদ (সা)! আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল ।) হে মুহাম্মাদ (সা)! আমি তো মানুষের পাশ দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম। কিন্তু যখনই আপনাকে দেখলাম আমার বুদ্ধি-বিবেক ও অনুভুতি লোপ পেয়ে গেল । আমি দুর্বল হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা আমার স্মরণ হল । তখনই আপনি আমার মতলবের কথা বলে দিলেন। অথচ অন্য কেউ আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত ছিল না। আমি তখনই বুঝে নিয়েছি যে, আপনি সুরক্ষিত । আপনি সত্যের উপর আছেন। আর আবু সুফিয়ান ও তার দলবল শয়তানের দল । তার কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুচকি মুচকি হাসছিলেন। কয়েকদিন সে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট অবস্থান করে। এরপর তিনি তাকে অন্যত্র যাওয়ার অনুমতি দেন। সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবার ছেড়ে পথে বের হয়।

এই প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমর ইবন উমাইয়া দিমারী এবং সালামা ইবন আসলাম ইবন হুরায়সকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, তোমরা দুজনে অভিযানে বের হও। তোমরা আবু সুফিয়ান ইবন হারবের নিকট যাবে এবং সুযোগ পেলে তাকে হত্যা করবে। আমর (রা) বলেন, আমি আর আমার সাথী দুজনে যাত্রা করি। ইয়াজিজ নামক প্রান্তরে এসে আমরা যাত্রা বিরতি করি এবং আমাদের উট বেঁধে রাখি। আমার সাথী আমাকে বলল, হে আমার! আপনি কেমন মনে করেন যে, এই সুযোগে আমরা মক্কায় গিয়ে সাতবার তাওয়াফ করি এবং দু’রাক’আত নামায আদায় করি। আমি বললাম, মক্কায় অধিবাসীদেরকে আমি তোমার চাইতে বেশী চিনি। সন্ধ্যা হলে তারা ঘাস-পাতা বিছিয়ে তার মধ্যে বসে থাকে। মিশ্রবর্ণের ঘোড়াকে চেনার চেয়েও আমি মক্কা শহর বেশী চিনি। আমার সাথী তার কথায় অটল থাকল । আমার কথা শুনল না। আমরা যাত্রা করে মক্কায় পৌঁছি। সতিবার বায়তুল্লাহ্ শরীফের চারিদিকে তাওয়াফ করি । দু’ রাকআত নামায আদায় করি। সেখান থেকে বের হবার পর আবু সুফিয়ানের পুত্র মুআবিয়ার আমাদের সাথে দেখা হয় । আমাকে চিনে ফেলে । সে বলল, তোমার জন্য দুঃখ হয়, হে আমর ইবন উমাইয়া! মক্কাবাসীদের–কে উদ্দেশ করে আমাদের ব্যাপারে সে সর্তক করে দিল এবং বলল, আমরের মতলব ভাল নয় ।

জাহেলী যুগে আমর বেপরোয়া ও লড়াকু প্রকৃতির ছিলেন । মুআবিয়ার ডাক শুনে মক্কাবাসীরা বেরিয়ে এল এবং এক জায়গায় জড়ো হল । এদিকে ওদের অবস্থা দেখে আমর ও সালামা (রা) দুজনে পালিয়ে গেলেন। ওরা তাঁদের খোঁজে বের হল । পাহাড়ে পাহাড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজলো । আমর বলেন, আমি দ্রুতবেগে একটি গুহায় ঢুকে পড়ে তাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যাই, ভোর পর্যন্ত আমি ওখানে ছিলাম। তারা সারা রাত পাহাড়ে আমাদেরকে খুঁজে বেড়ায় আল্লাহ তাআলা তাদের নিকট মদীনার পথ অজ্ঞাত রেখেছিলেন। পরদিন পূর্বাহ্নে উছমান ইবন মালিক ইবন উবায়দুল্লাহ্ তামীমী সেখানে ঘোড়ার জন্যে ঘাস সংগ্রহ করতে আসে। আমার সাথী সালামা ইবন আসলামকে আমি বললাম যে, উছমান যদি আমাদেরকে দেখতে পায় তবে সে মক্কাবাসীদেরকে আমাদের কথা জানিয়ে দিবেএখনতো ওরা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ঘাস সংগ্রহ করতে করতে উছমান আমাদের গুহার একেবার নিকটে চলে আসে। আমি গুহা থেকে বের হই এবং তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেই। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং আর্তনাদ করতে থাকে । মক্কাবাসিগণ চারিদিকে চলে গিয়েছিল। তার চীৎকার শুনে সবাই সেখানে একত্রিত হল । আমি আমার গুহায় লুকিয়ে রইলাম । আমার সাথীকে বললাম, খবরদার, একটুও নড়াচড়া করবে না। ওরা সকলে উছমানের নিকট এল এবং তাকে আঘাত করেছে কে তা জিজ্ঞেস করল। সে বলল, আমাকে আঘাত করেছে আমর ইবন উমাইয়া দিনমারী। আবু সুফিয়ান মন্তব্য করল যে, আমি আগেই বলেছি সে কোন ভাল মতলবে মক্কায় আসেনি । উছমানের তখন মুমূষু অবস্থা। তাই সে আমাদের অবস্থান ওদেরকে জানাতে পারেনি । কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তারা আমাদের খোঁজে মনোযোগ দিতে পারেনি । ওরা তাকে তুলে নিয়ে গেল । ওই জায়গায় আমরা দু’রাত অবস্থান করি। আমাদেরকে খোঁজার চাঞ্চল্য যখন স্তিমিত হয়ে পড়ল তখন আমরা ওই গুহা ছেড়ে তানঈম গিয়ে পৌঁছলাম । আমার সাথী আমাকে বলল, আচ্ছা আমরা যদি হযরত খুবায়বের হত্যাকান্ডের স্থানে যাই এবং তাঁর শুলের কাষ্ঠ থেকে তাঁকে নামিয়ে আনি তাহলে কেমন হয় : আমি বললাম, খুবায়ব (রা) এখন কোথায়? সে বলল, তিনি তো শুলিবিদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন। শত্রুপক্ষের প্রহরীগণ তাঁর লাশ পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, তুমি আমাকে একাকী যাওয়ার সুযোগ দাও! তুমি দূরে সরে থেকো। শত্রুপক্ষের আশংকা সৃষ্টি হলে তুমি তোমার উটে চড়ে সোজা মদীনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে যাবে এবং আমাদের সকল সংবাদ তাকে অবহিত করবে। আমার ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না। কারণ, আমি মদীনার পথ ঘাট চিনি। আমি খুবায়বের (রা) লাশ খুঁজতে লাগলাম। এক পর্যায়ে তা পয়েও গেলাম । সুযোগ বুঝে তাঁকে পিঠে তুলে নিলাম। ২০ হাতের মত পথ চলার পর প্রহরীরা ঘুম থেকে জেগে গেল এবং আমার পদচিহ্ন অনুসরণ করে আমাকে ধরার জন্যে এগুতে লাগল । কাঠসহ হযরত খুবায়বের (রা) লাশ আমি মাটিতে রেখে পায়ে মাটি টেনে তা ঢেকে দিলাম। তখন ওই কাঠ থেকে একটি শব্দ বের হয়েছিল। ওই শব্দ আমি এখনও ভুলতে পারি না। তাঁকে মাটি চাপা দিয়ে আমি সাফরার পথে অগ্রসর হলাম। ওরা আমার নাগাল পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। আমি জীবিত ছিলাম বটে; কিন্তু তখন আমার দেহে কোন অনুভূতি ছিল না। আমার সাথী সালামা ইবন আসলাম তাঁর উটে চড়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে যায় এবং সকল সংবাদ তাঁকে অবহিত করে। আমি মদীনার পথে অগ্রসর হলাম, চলতে চলতে আমি এসে পৌঁছলাম যাজনান গোত্রের মরুদ্যানের নিকট। সেখানে আমি একটি গুহায় আশ্রয় নেই। আমার সাথে ছিল আমার ধনুক, তীর এবং খঞ্জর। আমি গুহায় ছিলাম। এমতাবস্থায় বানূ দায়ল ইবন বকর গোত্রের একজন দীর্ঘদেহী চেঁরা চোখা লোক তার ছাগপাল নিয়ে এগিয়ে এল । সে গুহায় মধ্যে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে হে? আমি বললাম, আমি বানূ বকর গোত্রের লোক। সে বলল, আমিও বকর গোত্রের লোক। এরপর সে হেলান দিয়ে মনের সুখে নিম্নেক্ত কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল ।

আমি মুসলমান নই। যতদিন বেঁচে থাকি মুসলমান হবো না। আমি মুসলমানদের ধর্ম মানি না ।

আমি মনে মনে বললাম, আমি তো তোমাকে খুন করব । সে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি তাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করলাম। আমি গুহা থেকে বেরিয়ে পথে নেমে এলাম । আমার সাথে কুরায়শদের প্রেরিত দু’জন গুপ্তচরের দেখা হয়। ওদের উদ্দেশ্যে আমি বললাম, তোমরা দুজনে আত্মসমর্পণ কর। ওদের একজন তা মেনে নিতে অস্বীকার করল। আমি তৎক্ষণাৎ তীর নিক্ষেপে তাকে হত্যা করলাম। এটি দেখে অন্যজন আত্মসমর্পণ করলো। আমি ভালভাবে তাকে বেঁধে নিলাম। তারপর তাকে নিয়ে রওয়ানা করলাম রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্দেশ্যে। আমি যখন মদীনায় এসে পৌঁছি তখন খেলাধুলায় মগ্ন আনসারী শিশুরা আমার নিকট উপস্থিত হয়। বয়স্ক লোকদেরকে যখন তারা বলতে শুনল যে, “এই আমর” “এই আমর” তখন শিশুরা দৌড়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে সংবাদ জানালো । আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি ওই লোকটিকে । আমার ধনুকের ছিলা দ্বারা মযবুত করে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি বেঁধে রেখেছিলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতি তাকিয়ে দেখি যে, তিনি হাসছেন। তারপর তিনি আমার জন্যে দু’আ করলেন। আমর (রা)-এর মদীনায় পৌঁছার তিনদিন পূর্বে সালামা ইবন আসলাম মদীনায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। বায়হাকী (র) এটি বর্ণনা করেছেন।

ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, আমর (রা) হযরত খুবায়ব (রা)-কে শুলি কাষ্ঠ থেকে নামানোর সাথে সাথে তাঁর শরীর কিংবা শরীরের কোন অংশ দেখতে পাননি। সম্ভবতঃ যে স্থানেই তাঁর পবিত্র দেহ পড়েছিল সেখানেই তাঁর দাফন হয়ে গিয়েছিল । আল্লাহই ভাল জানেন।

ইবুন ইসহাক এই অভিযানের কথা উল্লেখ না করলেও ‘ইবন হিশাম এই অভিযানের কথা উল্লেখ করেছেন। ওয়াকিদী যেমনটি বর্ণনা করেছেন, ইবন হিশামও তেমনটি করেছেন। তবে তাঁর বর্ণনায় আছে যে, এই অভিযানে আমর ইবন উমাইয়ার (রা) সাথী ছিলেন জাব্বার ইবন সাখর। আল্লাহই ভাল জানেন। সকল প্রশংসা তাঁরই জন্যে।

বি’র-ই-মাঊনার অভিযান

এ ঘটনাটি ঘটেছিল ৪র্থ হিজরীর সফর মাসে। মাকহুল (র) এ বিষয়ে একটি একক মন্তব্য করেছেন যে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল খন্দক যুদ্ধের পর। বুখারী (র) বলেন, আবু মামার— আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ৭০ জন সাহাবী সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিলেন। তাঁরা কুরা বা কুরআন বিশেষজ্ঞ রূপে পরিচিত ছিলেন। মাউনা কুয়ো নামে একটি কূয়োর নিকট বনূ সুলায়ম গোত্রের রি ‘ল ও যাকওয়ান নামে দুই উপগোত্র তাঁদের উপর আক্রমণ করে। সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহর কসম! আমরা তো তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা বের হয়েছি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটি বিশেষ কাজে। কাফিরেরা তাদের কথায় কর্ণপাত করলো না। তারা তাদেরকে হত্যা করলো। এ প্রেক্ষিতে একমাস যাবত রাসূলুল্লাহ (সা) ফজরের নামাযে কুনুত-ই-নাযিলা পাঠ করে তাদের জন্যে বদ দু’আ করেন। তখন থেকেই কুনুত পাঠের সূচনা হয়। ইতিপূর্বে আমরা কুনূত পাঠ করতাম না।

মুসলিম (র) হাম্মাদ ইবন সালামা আনাস (রা) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এরপর বুখারী (রা) বলেছেন, আব্দুল আ’লা ইব্‌ন হাম্মাদ– আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রিল, যাকওয়ান উসাইয়া এবং বনূ লিয়ান গোত্রের লোকেরা তাদের শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহায্য প্রার্থনা করল । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের সাহায্যার্থে ৭০ জন সাহাবী প্রেরণ করেন। আমরা তাদেরকে কিরআত বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করতাম । সহজ সরল এই সাহাবীগণ দিনভর কাঠ সংগ্রহ করতেন জীবিকা অর্জনের জন্যে। আর সারারাত নামায আদায় করতেন। তাঁরা বি’র-ই-মাঊনা নামক কূয়োর নিকট পৌঁছার পর উল্লিখিত গোত্রের লোকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং এই সাহাবীদলকে হত্যা করে। এই দুঃসংবাদ পৌঁছে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট। অপরাধী ও বিশ্বাসঘাতক আরব গোত্র রিল, যাকওয়ান, উসায়্যা ও বনূ লিয়ান গোত্রের জন্য বদ দু’আ করে রাসূলুল্লাহ (সা) এক মাস ব্যাপী ফজরের নামাযে কুনূত পাঠ করেন । আনাস (রা) বলেন, ওই সাহাবীদের উপলক্ষ করে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছিল, আমরা তা পাঠ করতাম। পরবর্তীতে ওই আয়াতগুলো রহিত করে নেয়া হয়েছে। ওই আয়াত এই –আমাদের সম্প্রদায়কে এই সংবাদ পৌঁছে দাও যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট এসে গিয়েছি। তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আমাদেরকেও সন্তুষ্ট করেছেন ।)

এরপর বুখারী (রা) বলেছেন, মূসা ইবন ইসমাঈল– আনাস ইব্‌ন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর প্রেরিত ৭০ জনের মধ্যে উম্মু সুলায়মের ভাই হারামকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তখনকার মুশরিকদের নেতা ছিল আমির ইবন তুফায়ল । সে তার প্রস্তাবিত তিনটি বিষয়ের যে কোন একটি গ্রহণের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলেছিল। সে বলেছিল, হে মুহাম্মাদ (সা)! আপনি গ্রামাঞ্চলের নেতা থাকুন আর আমাকে শহর এলাকার নেতৃত্ব দিন । অথবা আমাকে আপনার খলীফা নিযুক্ত করুন যে, আপনার মৃত্যুর পর আমি আপনার খলীফা হবো অথবা আমি গাতফান গোত্রের হাজার হাজার লোক নিয়ে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো । তারপর “উম্মু ফুলান” নাম্মী এক মহিলার বাড়ীতে অবস্থানকালে সে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়। তার ঘাড়ে বড় রকমের ফোঁড়া দেখা দেয়। সে বলেছিল, অমুক লোকের বংশধরের জনৈক মহিলার ঘরে আমি রোগাক্রান্ত হলাম। ঘাড়ে উটের কুঁজের মত ফোঁড়া দেখা দিল । তোমরা তাড়াতাড়ি আমার ঘোড়া এনে হাযির কর । আমি তাতে চড়ে এখান থেকে সরে যাই। ওই ঘোড়ার পিঠেই তার মৃত্যু হয়।

আলোচ্য অভিযানে উম্মু সুলায়মের ভাই হারাম, অন্য একজন খোঁড়া লোক এবং অমুক বংশের একজন লোক মোট তিনজন অগ্রসর হলেন। হারাম (রা) তাঁর দু’সাথীকে বললেন, আপনারা আমার কাছাকাছি থাকবেন । আমি ওদের নিকট যাব। ওরা যদি আমাকে নিরাপত্তা দেয় তবে আপনারা আরো নিকটে অগ্রসর হবেন। পক্ষান্তরে যদি ওরা আমাকে খুন করে ফেলে তবে আপনারা নিজ দলের নিকট ফিরে আসবেন।

হারাম (রা) শত্রুপক্ষের নিকট গেলেন । তিনি ওদেরকে বললেন, তোমরা কি আমাকে নিরাপত্তা দেবে যাতে করে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছাতে পারি। তিনি এ বিষয়ে ওদের সাথে আলাপ করছিলেন। ওরা জনৈক ব্যক্তিকে ইশারা করেছিল, সে পেছন দিক থেকে এসে হারাম (রা)-কে বর্শা দ্বারা আঘাত করে। বশায় তাঁর দেহ এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তিনি বলে উঠলেন? aski। ।

কা’বার প্রতিপালকের কসম, আমি সফলকাম হয়েছি। হারামের (রা) সাথী লোকটি এ। অবস্থা প্রত্যক্ষ করে নিজ সঙ্গীদের নিকট ফিরে এলেন । কিন্তু কাফির দল এসে তাদের সকলকে হত্যা করল। রক্ষা পেয়েছিলে শুধু খোঁড়া লোকটি। তিনি একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আত্মগোপন করেছিলেন । এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের আয়াত নাযিল করেছিলেন। পরে অবশ্য আয়াতগুলো মানসূখ (রহিত) হয়ে যায় । আয়াতগুলো এই

আমরা আমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত করেছি। তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তিনি আমাদেরকে সন্তুষ্ট করেছেন। এই প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সা) রিল, যাকওয়ান, বনূ লিহয়ান ও উসাইয়া গোত্রসমূহের জন্যে বদ দু’আ করেন ৩০ দিন যাবত ফজরের নামাযে কুনুতে নাযিলা পাঠের মাধ্যমে। ওরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করেছিল ।

বুখারী (র) বলেন, হিব্বান– আনাস ইবন মালিক (রা) বলেছেন, হারাম ইবন মিলহান যিনি হযরত আনাসের (রা) মামা ছিলেন । শত্রুপক্ষের তীরে আঘাতে আহত হলেন। বস্তুত বি’র-ই- মাউনার ঘটনায় যখন তিনি আহত হলেন তখন তিনি ক্ষতস্থান থেকে রক্ত নিয়ে মাথায় ও মুখে ছিটিয়ে উঠে বলেছিলেন “কাবার মালিকের কসম, আমি সফলকাম হয়েছি।”

বুখারী (র) বলেন, উবায়দ ইবন ইসমাঈল– হিশাম ইবন উরওয়া থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে জানিয়েছেন যে, বির-ই-মাঊনার ঘটনায় যখন সাহাবীগণ। শহীদ হলেন এবং আমর ইবন উমাইয়া দিমারী বন্দী হলেন, তখন কাফির নেতা আমির ইবন তোফায়ল একজন নিহত ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিল, এই লোকটি কে? উত্তরে আমর ইবন উমাইয়া বললেন, ইনি আমির ইবন ফুহায়রা। আমর ইব্‌ন তোফায়ল বলল, এই লোক নিহত হওয়ার পর আমি দেখেছি যে, তাকে আকাশে তুলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি আমি যেন তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম যে, সে আসমান ও যমিনের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করছে। তারপর তাকে পুনরায় পৃথিবীতে রেখে দেওয়া হয়েছে। এরপর তাদের মৃত্যুর সংবাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জানানো হল । তিনি সাহাবীদের মধ্যে ওই সংবাদ ছড়িয়ে দিলেন । তিনি বললেন, তোমাদের সাথিগণ বিপদের মুখোমুখি হয়েছে। তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট এ বলে নিবেদন করেছিল যে, হে প্রভু। আপনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আমরা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছি এ শুভ সংবাদটি আমাদের সাথীদেরকে জানিয়ে দিন । বস্তুত ওই শহীদদের অবস্থা আল্লাহ্ তা’আলা জীবিত সাহাবীদেরকে জানিয়ে দিলেন। ওই দিন আসমা ইবন সালত-এর পুত্র উরওয়া শহীদ হয়েছিলেন। তাঁর নাম অনুসারে উরওয়া (রা) কে ওই নামে ডাকা হয়। সেদিন মুনযির ইবন। আমর ও শহীদ হয়েছিলেন। পরে তাঁর নামে মুনযির (রা)-এর নাম রাখা হয়। এই বর্ণনাটি সহীহ্ বুখারীতে এরূপই উরওয়া (রা) থেকে মুরসালরূপে বর্ণিত হয়েছে।

বায়হাকী– হযরত আইশা (রা) সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন। তিনি হিজরতের হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং শেষ দিকে ততটুকু অতিরিক্ত সংযোজন করেছেন যা ইমাম বুখারী এখানে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

ওয়াকিদী (র)— উরওয়া সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন। তিনি এই ঘটনা, আমির ইবন যুহায়র-এর শাহাদত বরণ এবং তাঁকে আকাশে উঠানো হয়েছিল বলে আমির ইব্‌ন তোফায়লের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, যে ব্যক্তি আমির ইবন ফুহায়রাকে হত্যা করেছিল তার নাম জাব্বার ইবন সালমা কিলাবী। সে বলেছে যে, সে যখন তাঁকে বশ দ্বারা আঘাত করে তখন তিনি বলেছিলেন : —

কাবা গৃহের মালিকের কসম, আমি সফলকাম হয়েছি। তারপর জাব্বার জিজ্ঞেস করেছিল যে, “আমি সফলকাম হয়েছি” দ্বারা আমির ইবন ফুহায়রা কি বুঝাতে চেয়েছিলেন? সাহাবীগণ বললেন, তিনি বুঝিয়েছেন যে, তিনি আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে জান্নাত লাভে ধন্য হয়েছেন, জাব্বার বলল, হাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটেই পরবর্তীতে জাব্বার ইবন সুলমা ইসলামে দীক্ষিত হয়।

মূসা ইবন উবা সংকলিত মাগাযী গ্রন্থে উরওয়া থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন আমির ইবন ফুহায়রার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সকলের ধারণা যে, ফেরেশতাগণ তাঁর লাশ অন্তর্হিত করে ফেলেন। ইবন ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে ইউনুস বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উহুদ যুদ্ধের পর শাওয়াল মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো, যিলকদ, যিলহাজ্জ এবং মুহাররম মাস মদীনায় অবস্থান করেছিলেন। এরপর উহুদ যুদ্ধের চার মাসের মাথায় সফর মাসে বি’র-ই-মাউনার অভিযানে সাহাবীদেরকে প্রেরণ করেন । আবু ইসহাক ইবন ইয়াসার আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, মুগীরা ইবন আবদুর রহমান এবং আবদুর রহমান ইবন আবু বকর প্রমুখ থেকে। তাঁরা বলেছেন যে, আবু বারা আমির ইবন মালিক মদীনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। সে ইসলাম গ্রহণও করেনি আবার সরাসরি প্রত্যাখ্যানও করেনি। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি আপনার সাহাবীদের একটি দল নজুদ অঞ্চলে প্রেরণ করতেন আর তারা ওদেরকে যদি আপনার প্রচারিত ধর্মের দাওয়াত দিত তবে আমার আশা যে, ওরা ইসলাম কবুল করত। আপনার ডাকে সাড়া দিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, নজদের লোকেরা আমার সাহাবীদের উপর আক্রমণ করতে পারে বলে আমি আশংকা করছি । আবু বারা বলল, না-না আমি বরং আপনার সাহাবীদের নিরাপত্তা বিধান করব। রাসূলুল্লাহ (সা) বনূ সাঈদা গোত্রের মুনযির ইবন আমর সহ উচ্চ পর্যায়ের ৪০ জন সাহাবীর একটি দল প্রেরণ করলেন। মুনযিরকে আল মুআন্নিক লিয়ামূত বা মৃত্যুকে আলিঙ্গনকারী বলা হতো। ওই দলে আরো যারা ছিলেন তাঁরা হলেন- হারিছ ইবন সাম্মাহ বনূ আদী গোত্রের, হারাম ইবন মিলহান-ইনি, উরওয়া ইবন আসমা ইবন সাত সুলামী, নাফি ইবন বুদায়ল ইবন ওয়ারকা খুযাঈ এবং আবু বকর (রা)-এর আযাদকৃত দাস আমির ইবন ফুহায়রা (রা) প্রমুখ । তাঁরা রওয়ানা করলেন। বি’র-ই-মাঊনা নামক কূয়োর নিকট গিয়ে তাঁরা যাত্রা বিরতি করলেন । এ স্থানটি ছিল বনূ আমির গোত্রের সমতল ভুমি এবং বনূ সুলায়ম গোত্রের মরুভূমি এর মধ্যবর্তী এলাকা। এ পর্যায়ে হারাম ইবন মিলহান বাহক মারফত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর একটি চিঠি পাঠালেন সেখানকার কাফির নেতা আমির ইবন তোফায়লের নিকট। পত্র বাহক তার নিকট পৌঁছার সাথে সাথে সে তাকে হত্যা করে। পত্রে কী লেখা ছিল তা সে তাকিয়েও দেখেনি। তারপর সে বনূ আমির গোত্রের লোকজনকে আহ্বান জানায় সাহাবী দলের উপর আক্রমণ করার জন্যে। কিন্তু ওই গোত্রের লোকেরা তার আহ্বানে সাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলেছিল, আবূ বারা’ ওদেরকে নিরাপত্তা দানের যে অঙ্গীকার করেছেন আমরা তা লঙ্ঘন করতে পারব না। এদের পক্ষ থেকে নিরাশ হয়ে আমির ইবুন তোফায়ল বানূ সুলায়ম গোত্রের উসাইয়া, রিল, যাকওয়ান ও কারাহ শাখা গোত্রসমূহের লোকদেরকে আক্রমণের জন্যে আহ্বান জানায়। ওরা তার ডাকে সাড়া দেয়। তারা নেমে এসে সাহাবীদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। অগত্যা সাহাবাগণ তরবারি ধারণ করেন এবং শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। যুদ্ধ করতে করতে বনূ দীনার গোত্র কা’ব ইব্‌ন যায়দ ব্যতীত সকলেই শহীদ হয়ে যায়। শত্রুর আঘাতে কা’ব ইবন যায়দ মৃত প্রায় হয়ে পড়েছিলেন । নিহতদের সারিতে তিনি জীবন্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছিলেন । মৃত মনে করে ওরা তাঁকে ফেলে চলে যায়। ফলে তিনি বেঁচে যান এবং খন্দক যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। আমর ইবন উমাইয়া দিমারী ও আমর ইবন আওফ গোত্রের জনৈক আনসারী ব্যক্তি সাহাবীদলের পক্ষে অবস্থা পর্যবেক্ষণে ছিলেন। সাহাবী দলের ভাগ্যে যা ঘটেছে তা তাঁরা জানতেন না। দূর থেকে হঠাৎ তাঁরা দেখেন যে, সাহাবীদলের অবস্থান ক্ষেত্রের উপর পাখী উড়ছে। তাতে তাঁরা বললেন যে, এই পাখীগুলোর নির্দিষ্ট একটা নিয়ম রয়েছে এবং নিশ্চয়ই ওখানে কিছু একটা ঘটেছে। অবস্থা জানার জন্যে তাঁরা দুজনে এগিয়ে এলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন তাঁদের লোকজন রক্তাক্ত অবস্থায় নির্জীব পড়ে রয়েছেন। আর আক্রমণকারী শত্রুপক্ষ তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমির ইবন উমাইয়ার উদ্দেশ্যে আনসারীটি বললেন, এখন কী করা যায়? আমির বললেন, আমি মনে করি এখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গিয়ে সকল সংবাদ তাঁকে জানানো-ই ভাল হবে। আনসারী ব্যক্তি বললেন, যে স্থানে মুনযির ইবন আমর (রা) নিহত হয়েছেন সে স্থান থেকে সুস্থ দেহে জীবিত ফিরে যাওয়া এবং এই সব বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির মৃত্যুর সংবাদ বহন করা আমি ভাল মনে করি না। একথা বলে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শহীদ হয়ে যান। আমির ইবন উমাইয়া দিমারী শত্রুর হাতে বন্দী হন। আমর ইবন উমাইয়া মুদার গোত্রের লোক ছিলেন বলে অবহিত হবার পর আমর ইবন তোফায়ল তাঁর মাথার চুল কেটে তাঁকে মুক্ত করে দেয়। কারণ, তার মায়ের মুদার গোত্রের একটি ক্রীতদাস মুক্ত করার মানত ছিল। বস্তুত মুক্তি লাভের পর আমর ইবন উমাইয়া মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কানাত অঞ্চলের মধ্যবর্তী কারকারায় এক ছায়াময় স্থানে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ পর্যায়ে বনূ আমির গোত্রের দুজন লোকও ওই ছায়ায় বিশ্রাম নিতে আসে। আমির গোত্রের এই দুজন লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে চুক্তি বন্ধনে আবদ্ধ এবং নিরাপত্তা প্রাপ্ত ছিল। আমর ইবন উমাইয়া (রা) তা জানতেন না। তাদের উপস্থিতির সময় তিনি তাদের বংশ ও গোত্র পরিচয় জেনে নিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন যে, তাঁরা আমির গোত্রের লোক। তিনি তাদেরকে সুযোগ দিলেন। তাঁরা ঘুমিয়ে পড়ল। আমির গোত্রের লোকেরা সাহাবী দলের উপর যে যুলুম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তার প্রতিশোধ হিসেবে একই গোত্রের এই দুজন লোক হত্যা করে তিনি তার প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে ঘুমের মধ্যে তিনি ওই দু’জনকে হত্যা করে ফেললেন। আমর ইবন উমাইয়া রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে এসে সকল সংবাদ তাঁকে জানান। তিনি আমির গোত্রের দুজন লোককে হত্যা করেছেন তাও তিনি জানালেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “তুমি যে দুজন লোককে হত্যা করেছ আমার তো তাদের রক্তপণ পরিশোধ করতে হবে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “এটি আবু বারা এর কর্ম। আমি আগে থেকেই শংকিত ছিলাম। এই অভিযান প্রেরণে আমি আগ্রহী ছিলাম না।” রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এই মন্তব্য আবু বারা-এর নিকট পৌঁছে যায়। আমির ইবন তোফায়ল তার নিরাপত্তা চুক্তি নষ্ট করায় এবং তারই নিরাপত্তার দায় গ্রহণের প্রেক্ষিতে সাহাবীগণ যে, করুণ পরিণতির সম্মুখীন হন তার জন্যে আবূ বারা মর্মাহত হন। আমির ইবন তোফায়ল কর্তৃক আবূ বারা-এর নিরাপত্তার দায় নষ্ট করার কথা উল্লেখ করে এবং এজন্যে আমিরের উপর প্রতিশোধ নিতে আবু বারার ছেলেদেরকে উৎসাহিত করে হযরত হাস্সান ইবন ছাবিত তার কবিতায় বলেন–

হে উম্মুল বানীন এর বংশধররা! তোমরা তো নজদ-অধিবাসীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তোমাদেরকে কি বিচলিত করেনি।

তোমাদেরকে কি বিচলিত করেনি আবু বারা সম্পর্কে আমিরের মেন্যায় পদক্ষেপ? তার নিরাপত্তার দায় নষ্ট করার জন্যে। ভুল তো সজ্ঞানেকৃত কর্মের সমতুল্য হতে পারে না।

হে পথিক! উদ্যমী রাবী’আকে তুমি এ কথা জানিয়ে দাও যে, আমার পরে তুমি যুব সমাজের মাঝে কী অবদান রেখেছ?

তোমার পিতা তো যুদ্ধ-পারদর্শী, শীর্ষস্থানীয় যোদ্ধা আবু বারা। আর তোমার মামা হচ্ছেন অভিজাত ব্যক্তিত্ব হাকাম ইবন সা’দ।

ইবন হিশাম বলেন, উম্মুল বানীন হল আবু বারা এর মা। সে আমর ইবন আমির ইবন রাবীআ ইবন আমির ইবন সা’সাআ’ এর কন্যা। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাবীআ ইবন আমির ইবন মালিক একদিন আমর ইবুন তোফায়লের উপর আক্রমণ চালায়। এক আঘাতে তাকে খুন করতে গিয়ে ভুলবশত তিনি আঘাত করে বসেন তার ঊরুতে। সে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। সে বলে এটি নিশ্চয়ই আবূ বারা-এর অপকর্ম! তার পক্ষে কেউ এ কাজ করেছে। আমির আহত অবস্থায় এও বলছিল যে, আমি যদি মারা যাই তবে আমার রক্তপণ পাবে আমার চাচা। অন্য কেউ যেন তা দাবী না করে। আর আমি যদি এ যাত্রায় বেঁচে যাই তবে কী সিদ্ধান্ত দেব তা পরে ভেবে দেখব।

মূসা ইবন উব্বা যুহরী সূত্রে মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের ন্যায় বর্ণনা করেছেন। মূসা উল্লেখ করেছেন যে, ওই সাহাবীদলের দলপতি ছিলেন মুনযির ইবন আমর । কেউ বলেছেন যে, দলপতি ছিলেন মারছাদ ইবন আবু মারছাদ।

ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন যে, বির-ই-মাঊনার ঘটনায় নিহত সাহাবীদের জন্যে শোক প্রকাশ করে হাস্সান ইবন ছাবিত কেঁদে কেঁদে নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেছেন ।

হে আমার চোখ! অশ্রু বিসর্জন করে শোক প্রকাশ কর বির-ই-মাঊনার ঘটনায় নিহত সাহাবীদের জন্যে। অশ্রু ঝরাও প্রবল বেগে, একটুও কমতি করোনা ।

অশ্রু বিসর্জন দাও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রেরিত অশ্বারোহী বাহিনীর জন্যে যারা ভোরবেলায় শত্রুপক্ষের মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর তখনই তাদের জন্যে নির্ধারিত মৃত্যু তাদেরকে পেয়ে বসে।

এমন এক সম্প্রদায়ের কারণে তাদের উপর মৃত্যু নেমে আসে যারা সম্পাদিত চুক্তিকে ওয়াদা ভঙ্গের মাধ্যমে বিশ্বাস ঘাতকতায় পরিণত করেছে।

আহ্! আমার দুঃখ হয়, মুনযিরের জন্যে। তিনি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং ধৈর্যের সাথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন।

আমার দুঃখ ওই দিন সকাল বেলার ঘটনার জন্যে। তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি সুদর্শন, শ্রদ্ধাভাজন এবং আমর (রা)-এর অন্তরঙ্গ ।

বনূ নাযীরের যুদ্ধ

এ প্রসংগে সূরা হাশর নাযিল হয়।

সহীহ্ বুখারীতে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি এই সূরাকে সূরা বনু নাযীর নামে আখ্যায়িত করতেন। বুখারী (রা) যুহরী সূত্রে উরওয়া থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন যে, বদর যুদ্ধের ছয় মাস পরে এবং উহুদ যুদ্ধের পূর্বে বনূ নাযীর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় । ইব্‌ন আবূ হাতিম তাঁর তাফসীর গ্রন্থে তাঁর পিতা– যুহরী থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হাম্বল ইবন ইসহাক– যুহরী থেকে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে । যুহরী বলেছেন যে, ২য় হিজরীর ১৭ই রমযান বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তারপর বনূ নাযীর যুদ্ধ । তারপর তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তারপর ৪র্থ হিজরীর শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বায়হাকী (র) বলেন যে, যুহরী বলতেন, বনূ নাযীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় উহুদ যুদ্ধের পূর্বে। অপর একদল ঐতিহাসিক বলেন যে, বনূ নাযীর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় উহুদ যুদ্ধের এবং বি’র-ই- মাউনা অভিযানের পর।

আমি বলি, ঐতিহাসিক ইবন ইসহাক তাই উল্লেখ করেছেন যে, বনূ নাযীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে উহুদ যুদ্ধ ও বির-ই-মাউনা অভিযানের পর। কারণ, বি’র-ই-মাঊনার ঘটনা, সেখান থেকে আমর ইবন উমাইয়া দিমারীর পালিয়ে আসা, আমর গোত্রের দুজন লোককে হত্যা করা যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিরাপত্তা চুক্তি ছিল অথচ আমর ইবন উমাইয়ার তা জানা ছিল না, তাই রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন “আমাকে তো ওদের রক্তপণ পরিশোধ করতে হবে। এ সব ঘটনা উল্লেখ করার পর ইবন ইসহাক বলেছেন যে, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বনু নাযীর গোত্রের নিকট গেলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আমর ইবন উমাইয়া নিরাপত্তা চুক্তিপ্রাপ্ত আমির গোত্রের যে দু’জন লোককে হত্যা করেছে তাদের রক্তপণ পরিশোধে বনূ নাযীর গোত্রের সহায়তা কামনা করা । বনূ নাযীর ও বনূ আমির গোত্রের মধ্যে পরস্পর মৈত্রীও নিরাপত্তা চুক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে তারা আশ্বস্ত করল যে, আমরা ওই রক্তপণ পরিশোধে আপনাকে সাহায্য করব। এরপর তারা একান্তে মিলিত হল, এবং নিজেরা পরামর্শ করল যে, মুহাম্মাদ (সা)-কে হত্যা করার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর আমরা পাব না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন তাদের একটি ঘরের দেয়ালের পাশে বসা ছিলেন। তারা বলল, কে আছে যে, ছাদে উঠে ওখান থেকে একটি পাথর ফেলে দিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যা করে আমাদেরকে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি দেবে? আমর ইবন জাহাশ এগিয়ে এসে বলল, আমি এ জন্যে প্রস্তুত আছ। সে মতে পাথর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে সে ছাদে উঠে । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখনও সেখানে একদল সাহাবীসহ বসা ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত আবু বকর (রা) উমর (রা) এবং আলী (রা)। ওদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আসমানী সংবাদ এসে যায়। তিনি কাউকে কিছু না বলে উঠে পড়েন এবং মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দীর্ঘক্ষণ ঘটনাস্থলে ফিরে না আসায় সাহাবীগণ তার খোঁজে বের হন, মদীনার দিক থেকে আগত এক লোককে দেখে তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কথা তাকে জিজ্ঞেস করে । সে ব্যক্তি বলেছিল যে, আমি তো তাঁকে মদীনায় প্রবেশ করতে দেখেছি। এ সংবাদ পেয়ে সাহাবীগণ সকলে মদীনায় ফিরে এলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট সমবেত হলেন। তিনি ইয়াহুদীদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা তাদেরকে অবহিত করলেন।

ওয়াকিদী বলেন, এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ (সা) মুহাম্মাদ ইবন মাসলামাকে এ বার্তাসহ বনূ নাযীর গোত্রের নিকট প্রেরণ করেন যে, তারা যেন তাঁর নিকটস্থ এলাকা এবং তাঁর শহর ছেড়ে চলে যায়। অন্যদিকে মুনাফিকরা ওদের নিকট এ সংবাদ পাঠায় যে, তারা যেন কোনক্রমেই ওই স্থান ত্যাগ না করে! ওখানে অবস্থান করার জন্যে তারা ইয়াহূদীদেরকে উৎসাহিত করে, এবং তাদেরকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেয়। মুনাফিকদের প্ররোচণার কারণে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ইয়াহূদী নেতা হুয়াই ইবন আখতাব আত্ম-অহমিকায় স্ফীত হয়ে উঠে। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট খবর পাঠায় যে, তারা ওই স্থান ছেড়ে যাবে না। তারা এও জানায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে তাদের সম্পাদিত চুক্তি তারা প্রত্যাহার করেছে।

এ অবস্থায় তিনি তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্যে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেন। ওয়াকিদী বলেন, মুসলিম বাহিনী বনূ নাযীর গোত্রকে একাধারে পনের দিন অবরুদ্ধ করে রাখেন।

ইন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বনূ নাযীর গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ এবং যুদ্ধ যাত্রার নির্দেশ দিলেন। ইবন হিশাম বলেন, ওই সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) (আবদুল্লাহ) ইবন উম্মি মাকতুম (রা)-কে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। এ ঘটনা ঘটেছিল রবীউল আওয়াল মাসে। ইবন ইসহাক বলেন, মুসলিম বাহিনী যাত্রা শুরু করে ওদের নিকট পৌঁছেন। তাঁরা ওদেরকে ছয়দিন অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময়ে মদ পান হারাম হওয়ার বিধান নাযিল হয়। ইয়াহূদীরা তাদের সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় নেয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুসলিম বাহিনীকে ওদের খেজুর বাগান কেটে ফেলার এবং তা পুড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। এ সব দেখে ওরা দুর্গের ভেতর থেকে ডেকে ডেকে বলে, হে মুহাম্মাদ (সা)! আপনি তো ফাসাদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টিতে বারণ করেন, যে ব্যক্তি তা করে তাকে দোষারোপ করেন এখন দেখি আপনিই খেজুর বাগান কেটে ফেলছেন এবং তা পুড়িয়ে দিচ্ছেন, ব্যাপার কী?

বর্ণনাকারী বলেন, বনূ আওফ গোত্রের আবদুল্লাহ্ ইবন উবাই, ওয়াদি’আহ, মালিক, সুওয়াইদ ও দাইস সহ একদল লোক ইয়াহুদীদের নিকট এ বলে সংবাদ পাঠায় যে, তারা যেন ওখানে থেকে যায়। অন্যত্র না যায়। নিজ নিজ বাসস্থানে থেকে আত্মরক্ষা করে। তারা এ-ও বলে যে, আমরা তোমাদেরকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রাখব না । তোমরা যদি যুদ্ধের মুখোমুখি হও তবে আমরা তোমাদের সাথী হয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তোমাদের যদি বহিষ্কার করা হয় তবে আমরাও তোমাদের সাথে এ অঞ্চল ত্যাগ করে বেরিয়ে যাব । অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকাকালে ইয়াহুদীগণ প্রতিশ্রুত সাহায্যের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু মুনাফিকরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি । আল্লাহ্ তা’আলা ইয়াহূদীদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট দেশ ত্যাগের সুযোগদানের অনুরোধ জানাল এবং এ আবেদন করল যেন তাদেরকে প্রাণে মারা না হয়। তারা প্রস্তাব পেশ করে যে, যাওয়ার সময় তারা উটের পিঠে যতটুকু মালামাল বহন করা যায় শুধু ততটুকু নিয়ে যাবে, তবে কোন অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে যাবে না ।

আওফী বর্ণনা করেছেন ইবন আব্বাস (রা) থেকে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ওদের প্রতি তিনজনকে একটি করে উট বরাদ্দ করেছিলেন যে, ওরা পালাক্রমে ওই উঠের পিঠে মাল বহন করবে। বায়হাকী এটি বর্ণনা করেছেন। ইয়াকূব ইবন মুহাম্মাদ– মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বনূ নাযীর গোত্রের নিকট পাঠিয়েছিলেন এ নির্দেশ দিয়ে যে, ওরা যেন তিন দিনের মধ্যে দেশত্যাগ করে। বায়হাকী প্রমুখ উল্লেখ করেছেন যে, ওদের কিছু মেয়াদী ঋণ বিভিন্ন জনের কাছে পাওনা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ওগুলো ছেড়ে দাও এবং তাড়াতাড়ি দেশত্যাগ কর। অবশ্য এই বর্ণনাটির বিশুদ্ধতা প্রশ্নাতীত নয় । আল্লাহই ভাল জানেন।

ইবন ইসহাক বলেন, উটের পিঠে যে পরিমাণ বহন করা সম্ভব ছিল ওই পরিমাণ মালামাল নিয়েই তারা চলে যায়। তাদের কেউ কেউ নিজ গৃহের দরজার চৌকাঠ ভেঙ্গে উটের পিঠে তুলে নেয়। এরপর তাদের কিছু সংখ্যক খায়বারে এবং কিছু সংখ্যক সিরিয়ায় চলে যায়। যারা খায়বারে গিয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সালাম ইবন আবুল হুঁকায়ক, কিনানা ইব্‌ন রাবী ইব্ন আবু হুঁকায়ক, হুয়াই ইবন আখতাব প্রমুখ। এরা খায়বরে গিয়ে পৌঁছলে সেখানকার অধিবাসীরা এদেরকে নেতারূপে বরণ করে নেয়। আবদুল্লাহ্ ইবন আবূ বকর বলেছেন। যে,সেখানকার মহিলা, শিশু সহ সর্বস্তরের লোকজন হাতি-ঘোড়া, ঢোল-তবলা, বশী-গায়িকা সহকারে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানায়। গৌরব ও অহংকার, আনন্দ ও খুশীতে ওরা সদ্যাগত ইয়াহূদী নেতাদেরকে যেভাবে সম্বর্ধনা জানিয়েছিল সে যুগে কোন ব্যক্তি ও গোত্রের প্রতি তেমন সম্বর্ধনা দেয়া হয়নি। বর্ণনাকারী বলেন, ওরা নিজেদের ধন-সম্পদ তথা খেজুর বাগান ও ফসলাদি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে ছেড়ে যায়। সুতরাং এটি ছিল তার একান্তই নিজ সম্পদ। নিজ ইচ্ছামত তিনি তা ব্যয় করার অধিকারী ছিলেন। তিনি ওই ধন-সম্পদ প্রথম স্তরের মুহাজিরদের মধ্যে বন্টন করে দেন। আনসারদেরকে এ যাত্রায় কিছু দেননি। তবে সাহল ইবন হুনায় এবং আবু দুজানা আনসারী ছিলেন ব্যতিক্রম। তারা দুজনে নিজনিজ অভাব ও দারিদ্র্যের কথা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ইতিপূর্বে জানিয়েছিলেন। সে প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে এ থেকে কিছুটা দান করেন। (কেউ কেউ এ দু’জনের সাথে হারিছ ইবন সাম্মাহ্-এর নামও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এটি বর্ণনা করেছেন সুহায়লী)।

ইবন ইসহাক বলেন, বনূ নাযীর গোত্রের দু’জন লোক ব্যতীত কেউই ইসলাম গ্রহণ করেনি। ইসলাম গ্রহণকারী দু’জন হলেন ইয়ামীন ইবন উমায়র ইব্‌ন কা’ব এবং আবু সা’দ ইবন ওয়াহব । ইয়ামীন হলেন আমর ইবন জাহহাশের চাচাত ভাই। তারা নিজ নিজ ধন-সম্পদ নিজ দখলে রেখেছিলেন ।

ইবন ইসহাক বলেন, ইয়ামীনের পরিবারের জনৈক ব্যক্তি আমাকে জানিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইয়ামীনকে বলেছিলেন, তোমার চাচাত ভাই আমর ইবন জাহ্হাশের পক্ষ থেকে আমি কেমন কষ্টের মুখোমুখি হচ্ছি এবং আমার সাথে সে কী আচরণ করছে তা কি তুমি দেখছ না? ইয়ামীন জনৈক লোককে কিন্তু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমর ইবন জাহাশকে হত্যা করার জন্যে নিযুক্ত করেন। সে ঐ অভিশপ্ত ব্যক্তিটিকে হত্যা করল ।

ইবন ইসহাক বলেন, বনূ নাযীর গোত্রকে উপলক্ষ করে আল্লাহ্ তা’আলা পূর্ণ সূরা হাশর নাযিল করেন । ওদের বিরুদ্ধে আল্লাহ্ তা’আলা কিভাবে প্রতিশোধ নিলেন, কেমন শাস্তি দিলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে কেমন করে বিজয়ী করলেন এবং তিনি ওদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিলেন তা

সবই আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত সূরাতে উল্লেখ করেছেন। এরপর ইব্‌ন ইসহাক উক্ত সূরার তাফসীর করেছেন। আমরা তাফসীর গ্রন্থে ওই সূরার বিস্তারিত ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছি।

বস্তুতঃ আল্লাহ তা’আলা বলেন : ”আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবগুলোই আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় । তিনিই কিতাবীদের মধ্যে যারা কাফির তাদেরকে প্রথম সমাবেশেই তাদের আবাসভূমি হতে বিতাড়িত করেছেন । তোমরা কল্পনাও করনি যে, ওরা নির্বাসিত হবে এবং ওরা মনে করেছিল ওদের দুর্ভেদ্য দুর্গগুলো আল্লাহর শাস্তি থেকে ওদেরকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহর শাস্তি এমন একদিক হতে আসল যা ছিল ওদের ধারণাতীত এবং তাদের অন্তরে তা ত্রাস সৃষ্টি করল। ওরা ধ্বংস করে ফেলল নিজেদের বাড়ীঘর নিজেদের হাতে এমনকি মুমিনদের হাতেও। অতএব হে চক্ষুষ্মনরা! তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। আল্লাহ্ ওদের নির্বাসনের সিদ্ধান্ত না নিলে ওদেরকে পৃথিবীতে অন্য শাস্তি দিতেন। পরকালে ওদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি। তা এ জন্যে যে, ওরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। এবং কেউ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করলে আল্লাহ্ তো শাস্তি দানে কঠোর। তোমরা যে খেজুর বৃক্ষগুলো কর্তন করেছ এবং যেগুলো কাণ্ডের উপর স্থির রেখেছ তা তো আল্লাহরই অনুমতিক্রমে; তা এজন্যে যে, আল্লাহ্ পাপাচারীদের লাঞ্ছিত করবেন। উক্ত আয়াত সমূহে মহান আল্লাহ নিজে নিজের পবিত্রতা ও মহিমার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ঊর্ধ্বাকাশ ও পাতালে অবস্থানকারী তথা সকল সৃষ্টিকুল তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি অপ্রতিরোধ্য, পরাক্রমশালী। তিনি স্ব-রক্ষিত । তাঁর সম্মান ও মর্যাদা বিনষ্টের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন এবং যা বিধি বিধান জারী করেছেন তার সর্বক্ষেত্রেই তিনি প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি প্রজ্ঞাময়। তাঁর প্রজ্ঞার অনন্য উদাহরণ যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও ঈমানদার বান্দাদেরকে তাদের শত্রু ইয়াহূদীদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেছেন । ইয়াহূদীরা তো আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তার শরীআত প্রত্যাখ্যান করেছিল। ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার যে প্রেক্ষাপট সেটি সৃষ্টিতেও মহান আল্লাহর হিকমতের পরিচয় পাওয়া যায় । মহান আল্লাহর হিকমত ও প্রজ্ঞার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাথিগণ ইয়াহূদীদেরকে আবদ্ধ করে রাখেন। সেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভয়-ভীতি জারী করে দেয়া হয়। বস্তুতঃ রসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আল্লাহ্ তা’আলা এক মাসের অতিক্রমযোগ্য দূরত্ব থেকে ভীতি সৃষ্টির ক্ষমতা দিয়ে সাহায্য করেছেন। এতদ্সত্ত্বেও ঘটনাস্থলে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সশরীরে এবং সাহাবীগণকে নিয়ে ওদেরকে একাধারে ছয়দিন অবরোধ করে রাখেন। এর ফলে তাদের পক্ষ থেকে আক্রমণ আসার আশংকা পুরোপুরিই দূর হয়ে গেল। তারা উপায়ান্তর না দেখে সন্ধি সম্পাদনে বাধ্য হল জান বাঁচানোর জন্যে। তারা চুক্তি করল যে, এই শর্তে তারা প্রাণে রক্ষা পাবে যে, যাবার সময় শুধু ততটুকু মালামালই নিয়ে যাবে যতটুকু উটের পিঠে করে নেয়া সম্ভব। তবে কোন অস্ত্র শস্ত্র তারা নেবে না । এই চুক্তি তাদের জন্যে অবমাননাকর ও লাঞ্ছনাদায়ক বটে। এরপর তারা নিজেদের হাতে এবং মু’মিনদের হাতে নিজেদের ঘর-বাড়ী ভেঙ্গে ফেলা শুরু করে। সুতরাং হে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর ।

এরপর আল্লাহ্ তা’আলা উল্লেখ করেছেন যে, ওরা যদি নির্বাসনে না যেত অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতিবেশীত্ব ছেড়ে মদীনা ছেড়ে চলে না যেত তবে তারচেয়ে কঠিন শাস্তি অর্থাৎ দুনিয়াতে খুন ও হত্যার শাস্তি তাদেরকে ভোগ করতে হত। পরকালীন শাস্তি নির্ধারিত যন্ত্রণাদায়ক আযাব তো থাকবেই ।

এরপর আল্লাহ্ তা’আলা ওদের খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দেয়া এবং কতক খেজুর বৃক্ষ অক্ষত রাখার বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, উকৃষ্ট খেজুর বৃক্ষের যেগুলো তোমরা কেটে ফেলেছ এবং যেগুলো দন্ডায়মান রেখেছ তার সবইতো আল্লাহর অনুমোদনক্রমে হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা ভাগ্য নির্ধারণ এবং নির্দেশ প্রণয়নের মাধ্যমে এ কাজ করার অনুমতি প্রদান করেছেন । তাই এ কাজে তোমাদের কোন দোষ নেই। এ ক্ষেত্রে তোমরা যা করেছ তা ফাসাদ বা বিশৃংখলার পর্যায়ে পড়ে না। দুষ্ট লোকেরা অবশ্য এটাকে ফাসাদ বলেই গণ্য করে। এটি ছিল বরং মুসলিম বাহিনীর শক্তির বহিঃপ্রকাশ এবং কাফিরদের লাঞ্ছনা ও অবমাননার নিদর্শন স্বরূপ।

বুখারী ও মুসলিম দু’জনে কুতায়বা– ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বনূ নাযীর গোত্রের খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দিয়েছেন এবং কতগুলো গাছ কেটে ফেলেছেন। ওই বাগানের নাম ছিল বুয়ায়রা। এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন–

“তোমরা যে খেজুর বৃক্ষগুলো কেটেছ এবং যেগুলো কাণ্ডের উপর স্থির রেখে দিয়েছ তাতো আল্লাহরই অনুমতিক্রমে; তা এজন্যে যে, আল্লাহ্ পাপাচারীদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।” (৫৯ হাশর ও ৫)

বুখারী জুওয়াইরিয়া ইবন আসমা সূত্রে ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বনূ নাযীর গোত্রের এবং বুওয়াইরা খেজুর বাগান পুড়িয়ে দেন বা কেটে ফেলেছেন। এ প্রসংগে হযরত হাস্সান ইবন ছাবিত তাঁর কবিতায় বলেন :

বুওয়ায়রা বাগান পুড়ে যাওয়া এবং বৃক্ষ গুলো ছাই হয়ে যাওয়াকে বনূ লুওয়াই গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকেরা নিতান্ত হাল্কাভাবে গ্রহণ করেছে।

হযরত হাসানের উপরোক্ত কবিতার উত্তরে তৎকালীন কাফির নেতা আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিছ বলেছিল :

আল্লাহ্ তা’আলা এই অপকর্ম দীর্ঘস্থায়ী রাখতেন এবং বুওয়ায়রা বাগানের আশে পাশের এলাকায় স্থায়ী জ্বালানো-পোড়ানোর ব্যবস্থা করবেন ।

অতি সত্বর তুমি জানতে পারবে যে, আমাদের মধ্যে কে রক্ষা পাবে এবং তুমি আরো জানতে পারবে আমাদের কোন্ অঞ্চলে আমরা ধ্বংস সৃষ্টি করি ।

ইন ইসহাক বলেন, বনূ নাযীর গোত্রকে বহিষ্কার এবং কবি ইবন আশরনাযীর হত্যার কথা উল্লেখ করে কা’ব ইবন মালিক কবিতায় বলেন ।

বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ইয়াহূদী পণ্ডিতরা অপমানিত হয়েছে। যুগ এ রকমই পরিবর্তনশীল যা চক্রাকারে আবর্তিত হয়।

তা এ জন্যে হল যে, তারা মহান প্রতিপালকের প্রতি কুফরী করেছে। তারা অমান্য করেছে তাঁর নির্দেশ। অথচ তাঁর নির্দেশ হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ।

অথচ তাদেরকে দেয়া হয়েছিল বোধশক্তি ও জ্ঞান। আর তাদের নিকট এসেছিলেন মহান সতর্ককারী (মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা)।

তাদের নিকট এসেছেন সত্যবাদী সতর্ককারী। তিনি পৌঁছিয়েছেন একটি কিতাব এবং সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ। এগুলো আলো ঝলমল দেদীপ্যমান।

তারা তাকে বলেছিল, আপনি কোন সত্য বিষয় নিয়ে আসেননি। আমাদের পক্ষ থেকে আপনি প্রত্যাখ্যাত হওয়ারই উপযুক্ত।

তিনি বললেন, আমি বরং সত্য এবং হক বিষয়ই প্রচার করেছি পৌঁছিয়ে দিয়েছি। ওয়াকিফহাল ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিবর্গ সর্ব অবগত মহান আমার সত্যায়ন করেন।

যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে সে সকল প্রকারের হিদায়াত ও সত্য পথের দিশা পাবে। আর যে ব্যক্তি তাকে প্রত্যাখ্যান করবে তবে কাফিরেরা তো লাঞ্ছিতই হবে ।

বিশ্বাসঘাতকতা ও কুফরী যখন তাদের স্বভাবে-প্রকৃতিতে মিশে গিয়েছে এবং সত্যচ্যুতি ও সত্য থেকে পলায়ন যখন তাদের স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ।

তখন আল্লাহ্ তা’আলা নবী (সা)-কে সত্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাওফীক প্রদান করলেন। আল্লাহ্ তা’আলা মীমাংসা করেন এমন মীমাংসা যাতে কোন প্রকারের যুলুম ও অবিচার থাকে না।

আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে সাহায্য করলেন এবং ওদের উপর বিজয়ী করলেন । আল্লাহ্ যাকে সাহায্য করেন সে অন্যতম উৎকৃষ্ট সাহায্যপ্রাপ্ত।

তাদের মধ্যে কা’ব ইবন আশরাফ জঘন্যভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এরপর তার মৃত্যুর পরে বনূ নাযীর গোত্র একেবারেই লাঞ্ছিত হয়ে পড়ে।

তারা দু’হাত জোড় করে আত্মসমর্পণ করে । কাব-এর উপর আমাদের প্রসিদ্ধ বীর পুরুষগণ বিজয়ী হন।

মুহাম্মাদ (সা)-এর নির্দেশে কাব-এর ভাই রাতের বেলা তার নিকট যায় (হত্যা করার জন্যে)।

সে তার সাথে কূট-কৌশল অবলম্বন করে। তাকে নীচে নামিয়ে আনে। তার সাথে ছিল সাহসী ও বিশ্বস্ত সাথী মাহমুদ।

এই বনূ নাযীর গোত্র অবস্থান গ্রহণ করছিল মন্দ অবস্থানে। তাদের অপরাধের কারণে ধ্বংসকারী তাদেরকে ধ্বংস করেছে।

একদিন সকাল বেলা। সশস্ত্র মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে ধীর পদক্ষেপে তাদের নিকট উপস্থিত হলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)। তাদের সকল কর্মকাণ্ড তাঁর গোচরীভূত ছিল।

সাহসী গাসসান গোত্র শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁর সহযোগিতাকারী ছিল । (উপস্থিত হল তারাও) তারা ছিল গাসসান গোত্রের পরামর্শদাতা।

তিনি গিয়ে বললেন, সাবধান! তোমরা আত্মসমর্পণ কর। কিন্তু তারা উল্টোপথ অনুসরণ করল। মিথ্যা ও অসারতা তাদের কর্মকাণ্ডকে ভুলপথে পরিচালিত করল।

ফলে তারা তাদেরকে ভুল পদক্ষেপের জন্যে খেসারত দিতে হল। বেরিয়ে গেল প্রতি তিনজনে একটি করে উট নিয়ে।

তারা স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে চলে গেল কায়নুকা গোত্রের সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে। তারা রেখে গিয়েছিল খেজুর বাগান ও বহু ঘর-বাড়ী।

উপরোক্ত কবিতার প্রত্যুত্তরে সিমাল ইয়াহূদী যে কবিতা আবৃত্তি করেছিল ইবন ইসহাক তা উল্লেখ করেছিলেন। আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে তা বাদ দিয়েছি। ইবন ইসহাক বলেন, বনূ নাযীর যুদ্ধ সম্পর্কে ইবুন লুকায়ম আল-আবাসী নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেন। কেউ কেউ বলেছেন যে এটি কায়স ইবন বাহ্র ইবন তারীক আশজাঈ-এর কবিতা ।

আমার পরিবার কুরবানী হউক এমন এক লোকের জন্যে যিনি ধ্বংস হবার নন। যিনি ইয়াহুদীদেরকে জোরপূর্বক অপরিচিত স্থানে যেতে বাধ্য করেছেন ।

ইয়াহুদীগণ এখন উঁচু-নীচু অমসৃণ পাথুরে অঞ্চলে শয়ন করে। আর ফলদার খেজুর গাছের পরিবর্তে তারা পেয়েছে কচি কচি খেজুরের চারা।

মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে আমার যে ধারণা তা যদি সত্যি হয় তবে তোমরা দেখতে পাবে যে, তাঁর অশ্ববাহিনী সালা ও ইয়ারামরাম অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।

ওই অশ্বারোহী দিয়ে তিনি আমর ইব্‌ন বাহছাহকে পরাজিত করবেন । ওরা তো শত্রু পক্ষ । বন্ধু গোত্র কখনো শত্রু ও অপরাধী গোত্রের ন্যায় হয় না।

ওই অশ্বারোহীর নেতৃত্বে থাকবে সাহসী বীর পুরুষগণ, যারা যুদ্ধের ময়দানে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেন। শত্রুপক্ষের মযবূত ও কঠিন বশগুলোকে তাঁরা অনায়াসে ভেঙ্গে খান খান করে ফেলেন।

ওই বীরদের হাতে থাকবে দুধার তীক্ষ্ণ ভারতীয় তরবারি । আ’দ ও জ্বরহুম গোত্র থেকে বংশ পরম্পরায় তারা ওগুলোর মালিক হয়েছে।

আমার পক্ষ থেকে কুরায়শদেরকে একটি বাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার কেউ আছে কি? আমি ওদেরকে বলি যে, ওদের জন্যে মর্যাদা ও সম্মানের আর কিছু কি অবশিষ্ট আছে?

তারা জেনে রাখুক যে, তাদের ভাই মুহাম্মাদ (সা) তাঁর উছিলায় হাজ্বন ও যামযাম এলাকা বৃষ্টিস্নাত হয়ে উঠবে।

তোমরা যথার্থভাবে তাঁর অনুসরণ কর। তাহলে তোমাদের সকল কাজ কর্ম সু-সংগঠিত ও সুন্দর হবে। দুনিয়াতে সকল উচ্চ ও মর্যাদার স্থানে তোমরা আরোহণ করতে পারবে।

তিনি এমন এক নবী যিনি সার্বক্ষণিক আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত প্রাপ্ত হন। তবে কোন অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে তোমরা তাকে জিজ্ঞেস করো না।

হে কুরায়শ গোত্র! তোমাদের জন্যে তো শিক্ষা রয়েছে বদর যুদ্ধের মধ্যে এবং গোলাকার কুয়োগুলোর মধ্যে।

স্মরণ কর সেই সকালের কথা যখন তিনি এলেন খাযরাজ গোত্রে। তোমাদেরকে হিদায়াত করার উদ্দেশ্যে। মহান ও মর্যাদাবান আল্লাহ্ তা’আলার অনুগত হয়ে।

তিনি এলেন পবিত্র আত্মা জিবরাঈল (সা)-এর সহযোগিতা পুষ্ট হয়ে। শত্রুর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে এবং বিভিন্ন নিদর্শনে সমুজ্জ্বল হয়ে দয়াময় আল্লাহর সত্য রাসূল রূপে।

তিনি এসেছেন দয়াময় আল্লাহর রাসূল হিসেবে। আল্লাহর কিতাব তিলওয়াত করেন তিনি । সত্য যখন উদ্ভাসিত ও আলোকময় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তখন সর্বত্র পৌঁছতে আর সময় লাগে না।

আমি মনে করি তার বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে প্রসারিত ও বর্ধিত হবে। মহান আল্লাহ্ যেটিকে হক ও সত্যরূপে প্রেরণ করেছেন সেটিকে বিজয়ী করার জন্যে।

ইবন ইসহাক বলেন, আলী ইবন আবু তালিব এ প্রসংগে নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ইবন হিশাম বলেন, এটি অন্য কোন মুসলমানের কবিতা। এটিকে আলী (রা)-এর কবিতারূপে অভিহিত করেন এমন কাউকে আমি পাইনি।

আমি উপলব্ধি করেছি। যে কেউ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখবে সেই উপলব্ধি করতে পারবে। আমি সত্যরূপে বিশ্বাস করেছি। আমি সত্যবিমুখ হইনি।

আমি মযবূত ও সুদৃঢ় বাণীগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিইনি। এগুলো তো এসেছে পরম দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে।

এগুলো আল্লাহর বাণী। মুমিনদের মধ্যে এগুলো পাঠ ও আলোচনা করা হয়। এগুলো দিয়েই আহমদ (সা)-কে মনোনীত করা হয়েছে।

তাই আহমদ (সা) আমাদের মধ্যে প্রিয় পাত্রে পরিণত হলেন। তিনি সকল স্থানে প্রিয় ও শক্তিমান ব্যক্তিরূপে আবির্ভূত হলেন।

সুতরাং হে লোক সকল! যারা তাকে ভয় দেখাতে চাও অজ্ঞতাবশত। অথচ তিনি কখনো কোন অন্যায় করেননি এবং কারো সাথে কঠোর আচরণ করেননি।

তোমরা কি ভয় কর না নিকটবর্তী আযাবকে। আল্লাহ যাকে নিরাপত্তা দেন সে তো ভয় প্রাপ্তের ন্যায় নয়।

তোমরা কি ভয় কর না যে, তোমরা তাঁর তরবারির আঘাতে ধরাশায়ী হবে। যেমন ধরাশায়ী হয়েছে আবু আশরাফ কা’ব।

একদিন ভোরবেলা। আল্লাহ তাআলা তার সত্যদ্রোহিতা দেখলেন। এও দেখলেন যে, সে অবাধ্য উটের ন্যায় সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

সুতরাং তাকে হত্যার আদেশ সহকারে তিনি জিবরাঈল (আ)-কে প্রেরণ করলেন তাঁর দরদী বান্দা মুহাম্মাদ (সা)-এর নিকট।

রাসূল মুহাম্মাদ (সা) রাতের অন্ধকারে গোপনে তার এক দূত পাঠালেন স্বচ্ছ-সুতীক্ষ্ণ ও খাপ খোলা তলোয়ার সহ।

তাঁর পক্ষ থেকে কতক গুপ্তচর সে রাতে রাত কাটিয়েছিল নিদ্রাহীনভাবে। তারা অপেক্ষায় ছিল কখন কা’বের মৃত্যু সংবাদ শোনা যাবে। কখন এই সংবাদে অশ্রু ঝরবে।

ক্রন্দনকারিণীরা আহমদ (সা)-কে বললো, আমাদেরকে একটু অবকাশ দিন। এখনো আমরা যথেষ্ট মাতম করে সারিনি।

বস্তুত তিনি ওই ইয়াহূদীদেরকে দেশ ছাড়া করলেন। তারপর বললেন, তোমরা চলে যাও লাঞ্ছনা, অপমানসহ ।

তিনি বনূ নাযীর গোত্রকে বিতাড়িত করলেন এক অপরিচিত ও বিরান ভূমিতে। অথচ তারা ছিল এক সুসজ্জিত ও চমৎকার মহল্লায়।

তাদেরকে নির্বাসিত করে পাঠিয়ে দিলেন সিরিয়ার আযরু’আত নামক স্থানে। তারা একের পেছনে এক সারিবদ্ধভাবে যাচ্ছিল দুর্বল ও ক্ষীণকায় সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করে ।

সিমাল ইয়াহুদী এই কবিতার যে উত্তর দিয়েছিল আমরা তা উল্লেখ থেকে বিরত রইলাম ।

আল্লাহ্ তা’আলা এই সূরায় ফায় তথা বিনা যুদ্ধে অর্জিত শত্রু সম্পদ বণ্টনের নীতিমালা বর্ণনা করেছেন। তিনি বনূ নাযীর গোত্রের সকল সম্পদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মালিকানাধীন বলে ঘোষণা দিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আল্লাহর ইচ্ছানুসারে ওই সম্পদ ব্যয় করলেন। এ প্রসংগে সহীহ্ বুখারী ও মুসলিমে হযরত উমর (রা)-এর একটি হাদীছ রয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, বনূ নাযীর গোত্রের রেখে যাওয়া ধন-সম্পদ ফায় তথা বিনা যুদ্ধে অর্জিত সম্পদ রূপে আল্লাহ্ তা’আলা তার রাসূলের মালিকানায় প্রদান করলেন। এটি অর্জনে মুসলমানগণ ঘোড় বা উটে চড়ে যুদ্ধ করেননি। তাই এটি এককভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মালিকানায় ন্যস্ত হল । তিনি ওখান থেকে তার পরিবারের এক বছরের ভরণপোষণের অর্থ আলাদা করে রাখতেন। আর অবশিষ্ট সম্পদ ব্যয় করতেন জিহাদের জন্যে অস্ত্রশস্ত্র ও বাহন সংগ্রহে। এরপর আল্লাহ্ তা’আল ফায়-এর বিধান বর্ণনা করে বলেন যে, তাতে মুহাজির ও আনসারদের এবং তাদের অনুসারিগণের হিস্যা রয়েছে আরো হিস্যা রয়েছে! রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের । যাতে এই সম্পদ শুধু ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ করবে এবং যা থেকে বারণ করেন তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা।

ইমাম আহমদ বলেন, আরিম ও আফফান– আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হিজরতের প্রথম দিকে মদীনার লোকজন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে নিজেদের মালামাল থেকে কতক খেজুর গাছ বা অন্য কিছু প্রদান করেছিলেন । তাঁর পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের জন্যে। পরবর্তীতে বনূ কুরায়যা ও বনূ নাযীর গোত্রের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিজয় লাভ করলেন। অন্যদের দেয়া খেজুর গাছ ও অন্যান্য সম্পদ তিনি ফেরত দিতে শুরু করলেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, আমার পরিবারের লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে যা দিয়েছিল তা কিংবা তার কিছু অংশ ফেরত আনার জন্যে আমাকে পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওই মালামাল কিংবা আরো কিছু উম্মু আয়মানকে দিয়ে দিয়েছিলেন । হযরত আনাস (রা) বলেন, আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট তা চাইলাম। তিনি তা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এমন সময় সেখানে উম্মু আয়মান এসে উপস্থিত হলেন। তিনি আমার গলায় কাপড়ে পেঁচিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো, না-না, আল্লাহর কসম! ওই মালামাল আমি তোমাকে দেবনা, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তা তো আমাকেই দিয়ে দিয়েছেন। তিনি হয়ত এরকম আরো কিছু কথাবার্তা বলেছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বলছিলেন। হে উম্মু আয়মান! তোমাকে এটা এটা দিলাম। এটা এটা তোমার জন্যে। কিন্তু উম্মু আয়মান বলতেই থাকলেন, না না, এটা আমি ওকে দিব না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলছিলেন। এটা এটা তোমার জন্যে। কিন্তু উম্মু আয়মান আবারো বলছিলেন, আমি এটা ওকে দেব না। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলছিলেন, ওটা নয় বরং এটা এটা তোমার জন্যে। হযরত আনাস (রা) বলেন, এভাবে দিতে দিতে আমার মনে হয় রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে দশগুণ বা তার কাছাকাছি পরিমাণ সম্পদ দান করেছিলেন । ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) প্রায় এ রকমই বর্ণনা করেছেন।

এরপর আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের নিন্দা করেছেন যারা গোপনে গোপনে বনূ নাযীর গোত্রের লোকদেরকে প্ররোচণা দিয়েছিল। তারা ওদেরকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কোন সাহায্যই তারা করেনি। বরং ইয়াহুদী গোত্র যখন সাহায্যের জন্যে অধিকতর মুখাপেক্ষী ছিল তখন তারা ওদেরকে হতাশ করেছে, লাঞ্ছনার পথে ঠেলে দিয়েছে এবং সাহায্যের অঙ্গীকার দিয়ে প্রতারণা করেছে। এ প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেন :

আপনি কি মুনাফিকদেরকে দেখেননি? তারা কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদের সে সব সঙ্গীকে বলে তোমরা যদি বহিষ্কৃত হও আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেশত্যাগী হব এবং আমরা তোমাদের ব্যাপারে কখনো কারো কথা মানব না। যদি তোমরা আক্রান্ত হও আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব । কিন্তু আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ওরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। বস্তুতঃ তারা বহিষ্কত হলে মুনাফিকরা তাদের সাথে দেশ ত্যাগ করবেনা এবং ওরা আক্রান্ত হলে এরা ওদের সাহায্য করবে না। এরা সাহায্য করতে এলেও অবশ্যই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। অতঃপর তারা কোন সাহায্যই পাবে না। (৫৯ হাশর ও ১১, ১২)।

এরপর আল্লাহ্ তা’আলা ওই সূরাতে মুনাফিকদের কাপুরুষতা, মুখতা ও নির্বুদ্ধিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর শয়তানের সাথে তাদের উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন, শয়তান মানুষকে বলে কুফরী কর। অতঃপর সে যখন কুফরী করে শয়তান তখন বলে, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, আমি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি । ফলে উভয়ের পরিণাম হবে জাহান্নাম। সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এটিই যালিমদের কর্মফল।

আমর ইবন সুদা আল কুরাযী-এর ঘটনা

আমর ইবন সু’দা আল কুরাযী বনূ নাযীর গোত্রের মহল্লায় গিয়েছিলেন। সেটি তখন ছিল জন মানববিহীন বিরান এলাকা। সেখানে ডাকারও কেউ ছিল না উত্তর দেয়ারও কেউ ছিল না। অথচ বনূ নাযীর গোত্র ছিল বনূ কুরায়যার তুলনায় শক্তিশালী ও মর্যাদাবান। বনূ নাযীর গোত্রের এ পরাজয় ও দুঃখজনক পরিণতি আমর ইবন সুদাকে ইসলাম গ্রহণে এবং তাওরাতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা)–এর পরিচিতি প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে।

ওয়াকিদী বলেন, ইবরাহীম ইব্‌ন জাফর তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বনূ নাযীর গোত্র মদীনা থেকে নির্বাসিত হবার পর আমর ইবন সু’দা তাদের বাসস্থানে আসে এবং ঘুরে ঘুরে সেই বিধ্বস্ত বাড়ীঘর দেখতে থাকে। এই ধ্বংসস্তূপ নিয়ে সে চিন্তা-ভাবনা করে। এরপর সে বনু কুরায়যা গোত্রের এলাকায় যায়। সে তাদেরকে তাদের উপাসনালয়ে সমবেত দেখতে পায়। সে তাদের উপাসনালয়ের শিঙ্গায় ফুঙ্কার দেয়। বনু কুরায়যার সকল ইয়াহূদী সেখানে জমায়েত হয়। তাকে উদ্দেশ্য করে যুবায়র ইবন বাতা বলল, হে আবু সাঈদ! এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন? সে মূলত সব সময় উপাসনালয়ে থাকত। ইয়াহুদী ধর্মে সে একজন নামযাদা উপাসক ছিল। সে বলল, আমি আজ একটি বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় দেখেছি এবং সেখান থেকে আমি শিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমি আজ আমাদের ধর্মীয় ভাই বনূ নাযীর গোত্রের বাসস্থানগুলো দেখে আসলাম । দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, শৌর্য বীর্যের অধিকারী ওই ইয়াহূদী ভাইদের ঘরবাড়ীগুলো আমি দেখলাম একেবারে বিধ্বস্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত। তারা তাদের ধন-সম্পদ রেখে চলে গিয়েছে। অন্যেরা তার মালিক হয়েছে। ওরা বেরিয়ে গিয়েছে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে। আসমানী কিতাব তাওরাতের কসম! যে জাতির উপর এমন করুণ পরিণতি চাপিয়ে দেওয়া হয় তেমন জাতির আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। ইতোপূর্বে সম্ভ্রান্ত ইয়াহুদী ব্যক্তিত্ব কা’ব ইবন আশরনাযীর উপর লাঞ্ছনাকর পরিণতি এসেছে। ইয়াহূদীদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ইবন সুনায়না-এর উপর ও দুঃখজনক পরিণতি নেমে এসেছে। বনূ কায়নুকা গোত্রও লাঞ্ছনাকর পরিণামের মুখোমুখি হয়েছে । ওরা অত্যন্ত শক্তিমান ও সম্ভ্রান্ত ইয়াহুদী গোত্র ছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ (সা) ওদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন। ওদের তো অস্ত্রশস্ত্রের কোন কমতি ছিল না। তা সত্ত্বেও মুহাম্মাদ (সা) তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। যে-ই মাথা বের করেছে তাকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আপোসে এসেছে উভয়পক্ষ। ইয়াছরিব থেকে তাদের বহিষ্কারের শর্ত মেনে নিয়ে তারা প্রাণে বেঁচে গেছে।

হে ইয়াহূদী গোত্র কুরায়যা সম্প্রদায়! যা দেখার তোমরাতো দেখেছ। এবার তোমরা আমার কথা মেনে নাও। চল সবাই গিয়ে মুহাম্মাদ (সা)-এর আনুগত্য অবলম্বন করি । আল্লাহর কসম! তোমরা তো অবশ্যই জ্ঞাত আছ যে, তিনি সত্য নবী। ইয়াহুদী পণ্ডিত ইবন হায়বানু আবূ উমায়র এবং ইবন হিরাশ আমাদেরকে তাঁর আগমন সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই সুসংবাদ দিয়েছেন। তার পরিচয় জানিয়েছেন। ওরা দু’জন ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান জ্ঞানী ব্যক্তি। তারা দু’জন তো আমাদেরকে মুহাম্মাদ (সা)-এর আগমনের প্রতীক্ষায় থাকতে বলেছিলেন। এবং তার আবির্ভাব হলে তাঁর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁরা দু’জন আমাদের নিকট এসেছিলেন বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে। তারা আমাদেরকে বলেছিলেন, মুহাম্মাদ (সা)-কে তাদের পক্ষ থেকে সালাম জানানোর জন্যে। এরপর তারা দুজন ওই ধর্মমত নিয়ে মারা গেছেন। আমাদের পণ্ডিতগণ তাদেরকে দাফন করেছেন। আমর ইবন সুদার বক্তব্য শুনে সবাই চুপ মেরে গেল। কেউই কোন কথা বলল না, এরপর সে তার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলো এবং তাদেরকে যুদ্ধ গ্রেপ্তারী এবং দেশত্যাগের ভয় ভীতি দেখাল । এবার যুবায়র ইবন বাতা মুখ খুলল, সে বলল, আসমানী কিতাব তাওরাতের কসম! বাতার নিকট রক্ষিত মূসা এর উপর নাযিল কৃত তাওরাতে আমি মুহাম্মাদ (সা)-এর পরিচিতি ও গুণাবলী পাঠ করেছি। তবে আমরা “মাছানী” নামের যে তাওরাত তৈরী করেছি তাতে ওই সব বর্ণনা নেই। এবার কাব ইবন আসাদ তাকে বলল, তাহলে আপনি হে আবু আবদুর রহমান! ওই নবীর অনুসরণ করছেন না কেন? সে বলল, নবীর অনুসরণে আমার বাঁধা তো হে কাব, আপনি নিজে। কা’ব বলল, তা কেমন করে? তাওরাতের কসম! আমি তো কখনো আপনার এবং ওই নবীর মাঝখানে অন্তরায় হইনি। এবার যুবায়র বলল, হাঁ, ঠিক তাই। আপনি হলেন আমাদের চুক্তি ও অঙ্গীকারে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আপনি ওই নবীর অনুসরণ করলে আমরাও তাঁর অনুসরণ করব। আপনি তাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমরাও প্রত্যাখ্যান করব। আমর ইবন সুদা কা’ব-এর মুখোমুখি হল এবং ওদের উভয়ের আলোচনার জের ধরে বলল, হে কাব! ওই নবীর অনুসরণের ব্যাপারে আমার বক্তব্য তাই যা আপনি বলেছেন যে, “কারো অনুসরণকারী ও অনুষঙ্গী হতে আমার মন চায় না।” বায়হাকী (র) এটি বর্ণনা করেছেন।

বনূ লিহয়ান অভিমুখে অভিযান

বায়হাকী দালাইল গ্রন্থে এ ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। ইবন ইসহাক (রা) হিশাম সূত্রে যিয়াদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, খন্দকের যুদ্ধ এবং বনূ কুরায়যার যুদ্ধের পরবর্তী দ্বিতীয় বছরের জুমাদাল ঊলা মাসে এই অভিযান সংঘটিত হয়। এ বর্ণনাটি বায়হাকীর বর্ণনার চাইতে অধিকতর গ্রহণযোগ্য। আল্লাহই ভাল জানেন। বায়হাকী বলেন, আবু আবদুল্লাহ্— আহমদ ইবন আবদুল জাব্বার প্রমুখ বলেছেন, খুবায়ব (রা)ও তাঁর সাথিগণের শাহাদতের পর বনূ লিয়ান গোত্র থেকে রক্তপণ উসূল করার দাবী নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনা থেকে বের হলেন । বাহ্যত তিনি সিরিয়ার দিকে যাত্রা করলেন। যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, তিনি মূলত: বনূ লিহয়ানের গোত্রের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। বনূ লিহয়ানের হুযায়লের এলাকায় গিয়ে দেখতে পেলেন যে, ওরা আক্রমণের আশংকায় সতর্কতাস্বরূপ পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, এখন আমরা যদি উছফান অঞ্চলে অবতরণ করি তাহলে কুরায়শরা মনে করবে যে, আমরা মক্কা আক্রমণের উদ্দেশ্যে এসেছি, তিনি ২০০ অশ্বারোহী নিয়ে যাত্রা করলেন । উছফান অঞ্চলে এসে তিনি তাঁবু খাটালেন। দু’জন অশ্বারোহীকে তিনি প্রেরণ করলেন। তারা কুরা আল-গামীম অঞ্চলে আসে। তারপর ফিরে যায় ।

আবু আইয়াশ যুরাকী বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উছফান নামক স্থানে সালাতুল খাওফ বা ভয় কালীন নামায আদায় করেছিলেন । ইমাম আহমদ (রা) বলেন, আবদুর রাযযাক— ইবন আইয়াশ বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে উছফান নামক স্থানে ছিলাম । মুশরিকরা সেখানে আমাদের মুখোমুখি হয়। ওদের নেতৃত্বে ছিল খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ। আমাদের আর কিবলার মধ্যস্থানে তারা অবস্থান করছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে নিয়ে যুহরের নামায আদায় করলেন। একই সাথে নামাযরত দেখে মুশরিকগণ বলাবলি করতে লাগলো তখন এমন একটা সময় ছিল যে, আমরা ওদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করলে ওদেরকে পরাজিত করে মালপত্র দখল করে নিতে পারতাম,তারা আরো বলল যে, একটু পরে ওদের অপর একটি নামাযের সময় আসবে যে নামায ওদের নিকট আপন প্রাণ এবং আপন পুত্রকন্যার চেয়েও প্রিয়। ওই নামাযে দাঁড়ালে আমরা ওদের উপর আক্রমণ করব। এই প্রেক্ষাপটে ভয়কালীন নামায সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত নিয়ে যোহর আর আছরের মাঝামাঝি সময়ে হযরত জিবরাঈল (আ) অবতীর্ণ হলেন। সে আয়াতটি হল, ( — ) এবং আপনি যখন ওদের মাঝে অবস্থান করবেন ও তাদের সাথে সালাত কায়েম করবেন তখন তাদের একদল আপনার সাথে যেন দাঁড়ায় এবং তারা যেন সশস্ত্র থাকে। তাদের সিজদা শেষ হলে তারা যেন আপনাদের পেছনে অবস্থান করে, আর অপর একদল যারা সালাতে শরীক হয়নি তারা আপনার

সাথে যেন সালাতে শরীক হয়। এবং তারা যেন সতর্ক ও সশস্ত্র থাকে। কাফিরগণ কামনা করে যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্পর্কে অসতর্ক হও, যাতে তারা তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যদি তোমরা বৃষ্টির জন্যে কষ্ট পাও অথচ পীড়িত থাক তবে তোমরা অস্ত্র রেখে দিলে তোমাদের কোন দোষ নেই। কিন্তু তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করবে। আল্লাহর কাফিরদের জন্যে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। (৪-নিসা : ১০২)। আসর নামাযের সময় হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশে সকলে সশস্ত্র অবস্থায় থাকলেন। আমরা তার পেছনে দু’সারিতে দাঁড়ালাম। তিনি রুকূ করলেন আমরা সকলে তার সাথে রুকূতে গেলাম। তিনি রুকূ থেকে মাথা তুললেন। আমরা সকলে মাথা উঠালাম। তিনি ১ম সারিস, সজদায় গেলেন । ২য় সারি সিজদায় গেলনা। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন । ১ম :নারি সিজদা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ২য় সারি বসে ওদের জায়গায় সিজদা দিলেন। এবার ১ম সারি গেলেন ২য় সারিতে আর ২য় সারি গেল ১ম সারিতে। রাসূলুল্লাহ (সা) দ্বিতীয় রাক’আতের জন্যে রুকূতে গেলেন। উভয় সারি রুকূতে গেল। তিনি রুকূ থেকে মাথা তুললেন সকলে মাথা তুললেন। এরপর এখনকার ১ম সারি সহ তিনি সিজদায় গেলেন । ২য় সারি দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল । ১ম সারি সিজদা থেকে উঠে বসল। এবার ২য় সারি বসে সিজদাবনত হল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করলেন। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ভয়কালীন নামায বা সালাতুল খাওফ দু’বার পড়েছেন, একবার উছফান অঞ্চলে, আরেকবার বনূ সুলায়ম গোত্রে।

ইমাম আহমদ (র) জুনদার– মানসূর থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আবু দাউদ (র) ও নাসায়ী নিজ নিজ সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এই হাদীছের সনদদ বুখারী ও মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ হবে, তারা এটি উদ্ধৃত করেননি। তবে মুসলিম (র) আবু খায়ছামাহ— জাবির (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথী হয়ে জুহায়না সম্প্রদায়ের একটি গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যথাসময়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) জামাতের সাথে যুহরের নামায আদায় করেন। এ অবস্থায় কাফিরগণ বলেছিল, আমরা যদি ওই সময়টুকুতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম তাহলে ওদেরকে ছত্রভঙ্গ ও পরাজিত করে দিতে পারতাম। তাদের কথোপকথন জিবরাঈল (আ) এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জানিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তা আমাদেরকে অবগত করলেন। তিনি বললেন যে, মুশরিকরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিল যে, অবিলম্বে মুসলমানদের নিকট আরেকটি নামাযের সময়, উপস্থিত হবে যে নামায ওদের কাছে নিজ নিজ সন্তান-সন্ততিদের চাইতেও বেশী প্রিয়। এরপর হাদীছের অবশিষ্ট অংশ পূর্বের ন্যায় বর্ণনা করেছেন ।

আবু দাউদ তায়ালিসী বলেন, হিশাম বর্ণনা করেছেন আবু যুবায়র এর বরাতে জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক খেজুর বাগানে সাহাবীগণকে নিয়ে যোহরের নামায আদায় করেছিলেন। মুশরিকরা তাঁদের উপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল । তারপর নিজেরাই বলাবলি করে যে, এ বেলা থাকুক মুসলমানদের আরেকটি নামায আছে এই নামাযের পর । সেটি তাদের নিকট নিজেদের সন্তান-সন্ততি অপেক্ষা অধিকতর প্রিয়। ওই নামাযের সময় আমরা হামলা করব । হযরত জিবরাঈল (আ) অবতীর্ণ হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট তা অবহিত করলেন। ফলে তিনি সাহাবীগণকে দু’সারিতে দাঁড় করিয়ে আসরের নামায আদায় করলেন। তিনি দাঁড়ালেন সবার সামনে। তার সম্মুখ দিকে শত্রু দল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকবীর-ই তাহরিমা বললেন, সবাই তকবীর বললেন। তিনি রুকূ করলেন সবাই রুকূতে গেলেন। তিনি সিজদায় গেলেন তার সাথে সিজদায় গেল শুধু প্রথম সারি। দ্বিতীয় সারির লোকজন দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রথম সারি সিজদা থেকে উঠার পর তারা পাহারায় থাকল, ২য় সারি সিজদায় গেল। এরপর স্থান বদল করে ১ম সারি গেল ২য় সারির স্থানে আর ২য় সারি গেল ১ম সারির স্থানে। সবাই এক সাথে তাকবীর বলল । সবাই এক সাথে রুকূ করল । এরপর এখনকার ১ম সারি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সিজদায় গেল আর ২য় সারি দাঁড়িয়ে রইল । সিজদারত সারি সিজদা শেষে মাথা উঠানোর পর ২য় সারি সিজদায় গেল। বুখারী তার সহীহ গ্রন্থে হিশাম সূত্রে জাবির (রা) থেকে বর্ণিত এই হাদীস উল্লেখ করে এর সালাতুল খওফের) দলীল পেশ করেছেন।

ইমাম আহমদ (র) বলেন, আবদুস সামাদ— আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক সফরে গিয়ে দাজনান ও উছফান স্থানদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে তাঁবু খাটালেন । মুশরিকরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল যে, মুসলমানদের এমন একটি নামায আছে যা তাদের নিকট নিজেদের সন্তানাদি ও তাদের কুমারী কন্যাদের চাইতেও প্রিয়তর। সেটি হল আসরের নামায। তোমরা প্রস্তুত থাক। ওদের নামাযের সময় একযোগে আক্রমণ চালাবে। এই পরিস্থিতিতে হযরত জিবরাঈল (আ) এলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট । তিনি সাহাবীগণকে দুভাগে ভাগ করিয়ে নামায আদায়ের নির্দেশ দিলেন। এক সারি নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নামায আদায় করবেন । অপর সারি পেছনে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে। ওরা থাকবে পূর্ণ সতর্ক এবং সাথে থাকবে অস্ত্রশস্ত্র । ১ম দলের এক রাক’আত শেষে হবার পর ২য় দল নামাযে এসে দাঁড়াবে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে। ১ম দল চলে যাবে ২য় দলের স্থানে এবং পূর্ণ সতর্কতা গ্রহণ ও অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকবে। তাহলে প্রত্যেক দলের রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে এক রাক’আত করে আদায় করা হবে আর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হবে দু’রাক’আত। (পরে প্রত্যেক দল নিজেরা এক রাক’আত করে আদায় করে মোট দু’রাক’আত পূর্ণ করবে)। ইমাম তিরমিযী ও নাসাঈ (র) এই হাদীছ আবদুস সামাদ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিরমিযী (রা) বলেছেন, এটি হাসান এবং সহীহ হাদীছ ।

আমি বলি, বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা (রা) যদি উক্ত ঘটনায় উপস্থিত থেকে থাকেন তবে বলতে হবে যে, এই ঘটনাটি ঘটেছে খায়বার যুদ্ধের পর। নতুবা এটি সাহাবী থেকে বর্ণিত মুরসাল হাদীছ। জমহুর তথা অধিকাংশ উলামা-ই-কিরামের মতে এ প্রকারের মুরসাল বর্ণনা দোষাবহ নয়। আল্লাহই ভাল জানেন। ইমাম মুসলিমের উদ্ধৃত হযরত জাবির (রা)-এর হাদীছে এবং আবু দাউদ তায়ালিসীর উদ্ধৃত হাদীছে উছফান অঞ্চলের কথাও নেই খালিদ ইবন ওলীদের কথাও নেই। তবে স্পষ্ট বুঝা যায় ঘটনা অভিন্ন। তবে বিচার্য বিষয় হল, উছফানের অভিযান খন্দকের যুদ্ধের পূর্বে পরিচালিত হয়েছে না কি পরে পরিচালিত হয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র) প্রমুখ আলিমগণ বলেছেন যে, সালাতুল খাওফ এর বিধান এসেছে খন্দকের যুদ্ধের পরে। কারণ, খন্দক যুদ্ধের দিন মুজাহিদগণ যুদ্ধের প্রচণ্ডতার কারণে নির্ধারিত ওয়াক্তের পরে নামায আদায় করেছেন । তখন সালাতুল খাওফের বিধান থাকলে তারা খন্দকের যুদ্ধের দিন নামায বিলম্বিত না করে সালাতুল খাওফের নিয়মে নামায আদায় করতেন। এ জন্যে কতক যুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাসবিদ বলেছেন যে, বনূ হিয়ান যুদ্ধ, যে যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা) উছফান অঞ্চলে ভয়কালীন নামায আদায় করেছেন ওই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বনূ কুরায় যুদ্ধের পর।

ওয়াকিদী আপন সনদে খালিদ ইবন ওয়ালীদ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুদায়বিয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন যে যাত্রায় ওই যাত্রায় উছফান অঞ্চলে আমি তাঁর মুখোমুখি হই। এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই। তিনি আমাদের মুখোমুখি হয়ে সাহাবীদেরকে নিয়ে যুহরের নামায আদায় করেন। পরের নামাযে আমরা তার উপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে অবহিত করে দেন। ফলে তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে আসরের নামায আদায় করেন সালাতুল খাওফ এর বিধান অনুযায়ী।

আমি বলি, রাসূলুল্লাহ (সা) উমরা আদায়ের নিয়্যতে হুদায়বিয়া পৌঁছেছিলেন যার সূত্রে হুদায়বিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা ছিল ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলকদ মাসে খন্দকের যুদ্ধ ও বনূ কুরায়যার যুদ্ধের পর, এর বিস্তারিত বিবরণ পরে আসবে। অন্যদিকে আবু আইয়াশ যুরাকীর বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, ভয়কালীন নামায সম্পর্কিত আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে বনূ লিহয়ান অভিযানে উছফান যুদ্ধের দিবসে। এবং এদিনের ভয়কালীন নামায-ই ইতিহাসের প্রথম ভয়কালীন নামায। আল্লাহই ভাল জানেন। সালাতুল খাওফ-এর নিয়ম কানুন ও এতদ্‌সম্পর্কিত বিভিন্ন বর্ণনা আমরা ইনশা আল্লাহ্ “কিতাবুল আহকামুল কাবীর” গ্রন্থে উল্লেখ করব। সকল নির্ভরতা আল্লাহর উপর।

যাতুর রিকা অভিযান

ইবন ইসহাক বলেন, বনূ নাযীর যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) রবিউল আউয়াল, রবিউছ ছানী এবং জুমাদাল উলা মাসের কয়েক দিন মদীনায় অবস্থান করেন । তারপর নজদ অঞ্চলের দিকে যাত্রা করেন। গাতফান গোত্রের বনূ মুহাবির ও বনূ ছালাবা উপগোত্রদ্বয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যেই তিনি এ অভিযানে বের হয়েছিলেন। এ সময়ে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত করে যান হযরত আবু যারর গিফারী (রা)-কে। ইবন হিশাম বলেন, কারো কারো মতে, তখন উছমান ইবন আফফান (রা)-কে।

ইবন ইসহাক বলেন, মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে পথ চলতে চলতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক খেজুর বাগানে এসে শিবির স্থাপন করেন। এই যুদ্ধ যাতুর রিকা’ নামে পরিচিত। এই নামের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে ইবন হিশাম বলেন, মুজাহিদগণ টুকরো টুকরো কাপড় জোড়া দিয়ে তাদের পতাকা তৈরী করেছিলেন বলে ওই যুদ্ধ যাতুর “রিকা’ জোড়া তালি বিশিষ্ট যুদ্ধ” নামে প্রসিদ্ধ। কেউ কেউ বলেন, ওখানে যাতুর রিকা’ নামে একটি গাছ ছিল বলে সেটি যাতুর রিকা যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছে। ওয়াকিদী বলেন, ওখানে একটি পাহাড় ছিল। সেটির কিছু অংশ ছিল লাল কিছু অংশ কাল এবং কিছু অংশ ছিল সাদা। বিভিন্ন রংয়ের সমন্বিত রূপ ছিল বলে পাহাড়টির নাম ছিল যাতুর রিকা। হযরত আবু মূসা আশআরী (রা)-এর হাদীছে আছে যে, ওই অভিযানে প্রচণ্ড তাপ ও গরমের কারণে মুজাহিদগণ পায়ে কাপড়ের টুকরা ও পট্টি বেঁধেছিলেন বলে ওই যুদ্ধকে যাতুর রিকা’ বলা হয় ।

ইবন ইসহাক বলেন, মুসলিম বাহিনী ওই স্থানে গিয়ে গাতফান গোত্রীয় শত্রুদের মুখোমুখি হয়। পরস্পর একে অন্যের উপর আক্রমণ করার উপক্রম হয়। তবে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। উভয় পক্ষ একে অন্যকে ভয় পেয়েছিল। ওখানে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীগণকে নিয়ে সালাতুল খাওফ আদায় করেন।

ইবন হিশাম (র) সালাতুল খাওফ এর হাদীছটি আবদুল ওয়ারিছ– জাবির (রা) থেকে এবং আবদুল ওয়ারিছ– ইবন উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তবে এই হাদীছে নজদের যুদ্ধ কিংবা যাতুর রিকা যুদ্ধ কোনটাই উল্লেখ করেননি। তেমনি এই ঘটনার সময়-স্থান কিছুই উল্লেখ করেননি। অবশ্য গাতফান গোত্রের বনু মুহারিব ও ছালাবাকে শায়েস্তা করার জন্যে পরিচালিত যাতুর রিকা যুদ্ধ যদি খন্দকের যুদ্ধের পূর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলা হয় তবে তা প্রশ্নাতীত নয়। বুখারী বলেছেন যে, যাতুর রিকা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে খায়বার যুদ্ধের পর । তিনি এভাবে দলীল পেশ করেছেন যে, হযরত আবু মূসা আশআরী (রা) ওই ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন। অথচ আবূ মূসা আশআরী (রা) হযরত জাফর ও অন্যান্যদের সাথে মদীনায় এসে উপস্থিত হন খায়বার যুদ্ধের সময়ে। অনুরূপ একটি দলীল হল হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর হাদীছ । তিনি বলেছেন নজদ অঞ্চলে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সালাতুল খাওফ আদায় করেছি। এছাড়া যাতুর রিকা যুদ্ধ যে খন্দক যুদ্ধের পরে হয়েছে তার একটি দলীল হযরত ইবন উমার ও এর হাদীছ । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে যুদ্ধ করার প্রথম অনুমতি দেন খায়বারের যুদ্ধে। ইবন উমার (রা) থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথী হয়ে নজুদের যুদ্ধে

অংশ নিয়েছি। এ প্রসংগে তিনি সালাতুল খাওফের ঘটনা বর্ণনা করেন । ওয়াকিদী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ৪০০ কিংবা ৭০০ মুজাহিদ নিয়ে ৫ম হিজরীর মুহাররম মাসের ১০ তারিখ শনিবার রাতে যাতুর রিকা’-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। তার এই বক্তব্য আলোচনা সাপেক্ষ। সালাতুল খাওফ খন্দকের যুদ্ধের পর বিধিবদ্ধ হয়েছে শুধু এটুকু বলে উপরোক্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। কারণ, খন্দকের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রসিদ্ধ মতানুসারে ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে। কেউ বলেছেন, খন্দকের যুদ্ধ হয়েছিলেন ৪র্থ হিজরী সনে। এই ব্যাখ্যানুসারে ইবন উমার (রা)-এর হাদীছের প্রশ্নের সমাধা হয়; কিন্তু আবু মূসা (রা) ও আবু হুরায়রা (রা)-এর হাদীছ থেকে উদ্ধৃত সমস্যার সমাধান হয় না ।

গাওরাছ ইবন হারিছের ঘটনা

যাতুর রিকা যুদ্ধ প্রসংগে ইবন ইসহাক বলেন, আমর ইবন উবায়দ– জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণিত। বনু মুহারিব গোত্রের এক লোক তার নাম ছিল গাওরাছ। সে তার স্বীয় সম্প্রদায় গাতফান ও মুহারিব গোত্রকে বলেছিল আমি কি তোমাদের পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ (সা)-কে হত্যা করব? ওরা বলল, হাঁ, তুমি তাই করবে, তবে কীভাবে তুমি তা করবে? সে বলল, আমি কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাকে হত্যা করব। বর্ণনাকারী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একটি গাছের ছায়ায় বসা ছিলেন। তাঁর তরবারিটি ছিল তার কোলে। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমি কি আপনার তরবারিটি দেখতে পারি? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হ্যাঁ, দেখতে পার। সে তরবারিটি হাতে নিল এবং সেটি নাড়া চাড়া করতে লাগল । আল্লাহ্ তাকে অপদস্ত করলেন। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনি কি এখন আমাকে ভয় পান না? তিনি বললেন, না। আমি তোমাকে ভয় পাচ্ছি না। সে বলল, আশ্চর্য, আমার হাতে তরবারি রয়েছে তবু আপনি আমাকে ভয় করছেন না। তিনি বললেন, না, মোটেই ভয় পাচ্ছি না। মহান আল্লাহ্ তোমার হাত থেকে আমাকে রক্ষা করবেন। এরপর সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তরবারি তাকে ফেরত দেয় এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করলেন :

“হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন এক সম্প্রদায় তোমাদের বিরুদ্ধে হস্ত উত্তোলন করতে চেয়েছিল। তখন আল্লাহ্ তাদের হাত সংযত করেছিলেন এবং আল্লাহকে ভয় কর। আর মু’মিনদের আল্লাহর উপরই নির্ভর করা বাঞ্ছনীয় (৫ মায়িদা : ১১)।

ইবন ইসহাক বলেন, ইয়াযীদ ইবন রূমান আমাকে জানিয়েছেন যে, উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল বনূ নাযীর গোত্রের আমর ইবন জাহাশ ও তার ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা উপলক্ষে । এভাবে ইবন ইসহাক গাওরাছের ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন গোমরাহ ফিরকাহ্ কাদরিয়্যাহ্ সম্প্রদায়ের নেতা আমর ইবন উবায়দ কাদারী থেকে। হাদীছে মিথ্যাচারের অভিযোগে সে অভিযুক্ত না হলেও যেহেতু সে একটি বিদআতের অনুসরণকারী এবং মানুষকে সেদিকে আহ্বানকারী সেহেতু তার থেকে হাদীছ বর্ণনা করা উচিত নয়। অবশ্য আলোচ্য হাদীছ তার নিকট থেকে বর্ণনা হওয়া ছাড়াও অন্যান্য সনদে বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এই হাদীছ রয়েছে। সকল প্রশংসা আল্লাহর, হাফিয বায়হাকী (র) বিভিন্ন স্থান থেকে এই হাদীছের একাধিক সনদ উল্লেখ করেছেন । সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এটি বর্ণিত হয়েছে যুহরী– জাবির (রা) সূত্রে । হযরত জাবির (রা) বলেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে নজদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফেরার পথে তাঁর খুবই তন্দ্রা পায়। স্থানটি ছিল বড় বড় কাঁটা বিশিষ্ট বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ। সাহাবা-ই-কিরাম বিভিন্ন বৃক্ষের ছায়ায় গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রামরত ছিলেন। তাঁর তরবারি ঝুলানো ছিল ওই গাছের সাথে । হযরত জাবির (রা) বলেন, আমরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে ডাকছেন। আমরা তাঁর নিকট এলাম। সেখানে দেখতে পেলাম একজন আরব বেদুঈন বসে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, এই বেদুঈন লোক আমার তরবারিটি কোষমুক্ত করেছিল। আমি ছিলাম ঘুমন্ত। ঘুম থেকে জেগে দেখি তার হাতে আমার খাপমুক্ত তরবারি, সে আমাকে লক্ষ্য করে বললো, আমার হাত থেকে এখন আপনাকে কে রক্ষা করবে? আমি বললাম, “রক্ষা করবেন আল্লাহ্।” সে আবার বলল, আপনাকে রক্ষা করবে কে? আমি বললাম, রক্ষা করবেন আল্লাহ্। এবার সে তরবারিটি খাপবদ্ধ করে বসে পড়ে। সে এত গুরুতর অপরাধ করা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে কোন শাস্তি দেননি।

মুসলিম (র) বর্ণনা করেছেন, আবু বকর ইব্‌ন আবূ শায়বা– জাবির (রা) থেকে। তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সফরে বের হলাম, যাতুর রিকা’ নামক স্থানে এসে পৌঁছলাম আমরা। আমাদের নিয়ম ছিল যে, কোন ছায়াময় বৃক্ষ পেলে সেটি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্যে ছেড়ে দিতাম। তিনি ওই ছায়ায় বিশ্রাম নিতেন। এই যাত্রায় তিনি ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেখানে উপস্থিত হয় জনৈক মুশরিক ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তরবারিটি গাছের সাথে ঝুলানো ছিল । সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর তরবারিটি হাতে তুলে নিয়ে কোষমুক্ত করে এবং ওই খোলা তরবারি উঁচিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলে, আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন? তিনি উত্তর দিলেন, না। ভয় পাচ্ছি না। সে বলল, আমার হাত থেকে এখন আপনাকে কে রক্ষা করবে? তিনি বললেন, আমাকে রক্ষা করবেন, আল্লাহ। এমতাবস্থায় সাহাবীগণ এসে তাকে ধমক দেন এবং সে কোষবদ্ধ করে তরবারিটি ঝুলিয়ে রাখে। বর্ণনাকারী বলেন, তখন নামাযের আযান দেওয়া হল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) একদল সাহাবীকে সাথে নিয়ে দু’রাকআত নামায আদায় করলেন! এরপর তাঁরা পেছনে সরে গেলেন । অপর দল এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে জামাতে শরীক হলেন। তিনি এ দলকে সাথে নিয়ে দু রাকাআত আদায় করলেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ৪ রাকআত পূর্ণ হল আর প্রত্যেক দলের হল ২ রাকআত ২ রাকআত করে। ইমাম বুখারী (র) জোরালো শব্দ ব্যবহার করে এই হাদীছ সনদ বিহীনভাবে আবান সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

বুখারী বলেন, মুসাদ্দাদ– আবু আওয়ানা থেকে বর্ণিত যে, ওই মুশরিক ব্যক্তির নাম ছিল গাওরাছ ইবন হারিছ। বায়হাকী (র) আবূ আওয়ানাহ্— জাবির (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এক খেজুর বাগান অঞ্চলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুহারিব ও গাতফান গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করেন। শত্রুপক্ষ কৌশলে ও প্রতারণা করে মুসলমানদেরকে পরাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, গাওরাছ ইব্‌ন হারিছ নামে তাদের জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আসে হাতে তরবারি নিয়ে। সে বলল, আমার হাত থেকে এখন আপনাকে রক্ষা করবেন কে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমাকে রক্ষা করবেন আল্লাহ্। একথা শুনে তার হাত থেকে তরবারি খসে পড়ল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওই তরবারি হাতে নিয়ে বললেন, এবার আমার হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করবে কে? সে বলল, “আপনি সর্বোত্তম তরবারি ধারণকারী হোন।” রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি কি এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই? সে বলল, না। তবে আমি অঙ্গীকার করছি যে, আমি কখনও আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না এবং যারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে আমি তাদের দলে থাকব না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে ছেড়ে দিলেন। সে ফিরে গেল তার সাথীদের নিকট। সে বলল, আমি এখন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটির নিকট থেকে এসেছি। এরপর বর্ণনাকারী যাতুর রিকা অঞ্চলে সালাতুল খাওফ আদায়ের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) উভয় দলকে সাথে নিয়ে দু রাকআত করে নামায আদায় করেছেন । ফলে ওদের হল দু’রাকআত করে আর তার হল চার রাকআত।

বায়হাকী (র) যাতুর রিকা অঞ্চলে সালাতুল খাওফ আদায়ের ঘটনা বর্ণনা করেছেন সালিহ্ ইবন খাওয়াত ইবন জুবায়র সূত্রে সাহল ইব্‌ন আবু হাছামাহ থেকে। তিনি সালিম সূত্রে তাঁর পিতা থেকে বর্ণিত নজদ অঞ্চলে সালাতুল খাওফ আদায় সম্পর্কিত যুহরীর হাদীছটিও উল্লেখ করেছেন। এগুলো আলোচনার উপযুক্ত স্থান হল “কিতাবুল আহকাম” আল্লাহই ভাল জানেন।

এ অভিযানে এক সাহাবীর ইবাদতে একাগ্রতা ও একটি পাখী ডাকার ঘটনা

মুহাম্মাদ ইব্‌ন ইসহাক বলেন, আমার চাচা সাদাকা ইবন ইয়াসার– জাবির ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথী হয়ে যাতুর রিকা অভিযানে বের হলাম। যাতুর রিকা অঞ্চলটি ছিল প্রচুর খেজুর বৃক্ষ বিশিষ্ট। জনৈক সাহাবী এক মুশরিকের স্ত্রীকে বন্দী করেন। অভিযান শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মদীনার উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা করলেন তখন ওই মুশরিক ব্যক্তি বাড়ী আসে। মহিলাটিকে বন্দী করার সময় সে বাড়ী ছিলনা। বাড়ীতে এসে সে তার স্ত্রী বন্দী হবার ঘটনা শুনতে পায়। সে শপথ করে বলে যে, ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে সে মুহাম্মাদ (সা)-এর সাহাবীদের মধ্যে কারো না কারো রক্তপাত ঘটাবে। সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পদচিহ্ন অনুসরণ করে অগ্রসর হয়। এদিকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক জায়গায় এসে শিবির স্থাপন করেন। সাহাবীগণের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন “কে আছ আজ রাতে আমাদেরকে পাহারা দিবে?” সাথে সাথে একজন মুহাজির ও একজন আনসারী সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমরা পাহারা দেব। তিনি নির্দেশ দিয়ে বললেন, তবে তোমরা গিরিপথের প্রবেশ দ্বারে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ কর। সাহাবী দুজন ছিলেন আম্মার ইবন ইয়াসির ও আব্বাদ ইবন বির। গিরিপথের প্রবেশ দ্বারে গিয়ে আনসারী সাহাবী তার মুহাজির ভাইটিকে বললেন, আপনি রাতের কোন অংশে বিশ্রামের সুযোগ নেবেন আর আমি দায়িত্ব পালনকরব? মুহাজির সাহাবী তখন বললেন, রাতের প্রথম অংশে আপনি আমাকে বিশ্রামের সুযোগ দেবেন। তারপর তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। আনসারী সাহাবী নামাযে দাঁড়ালেন। উক্ত মুশরিক ব্যক্তি সেখানে এসে পৌঁছে। নামাযরত সাহাবী দেখে সে বুঝে নিয়েছিল যে এ ব্যক্তি পাহারাদার । সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তীর তার গায়ে বিদ্ধ হয়। তিনি দেহ থেকে তীরটি খুলে ফেলে দেন এবং নামাযেই দাঁড়িয়ে থাকেন । ওই ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে দ্বিতীয় বার তীর নিক্ষেপ করে। তীরটি সাহাবীর দেহে বিদ্ধ হয়। এবারও তিনি তীর খুলে পাশে রেখে দিলেন এবং যথারীতি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে থাকলেন। মুশরিক ব্যক্তিটি তাকে লক্ষ্য করে তৃতীয় বার তীর নিক্ষেপ করল। সেটি তাঁর শরীরে বিদ্ধ হল। এবারও তিনি তীরটি খুলে পাশে রেখে দেন। এবং নিয়ম মাফিক রুকূ সিজদা করে নামায শেষ করেন । তারপর তার সাথী আনসারী সাহাবীকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, উঠুন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। তাদের দুজনকে কথা বলতে দেখে মুশরিক ব্যক্তি ধারণা করে যে, তারা তাকে ধরার জন্যে পরামর্শ করছেন। সে দ্রুত পালিয়ে যায়। যখন আনসারী সাহাবী দেখলেন যে, মুহাজির সাহাবীর দেহ থেকে রক্ত ঝরছে। তখন তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! আপনি আমাকে প্রথম তীর বিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে জাগাননি কেন? মুহাজির সাহাবী বললেন, আমি একটি বিশেষ সূরা পাঠ করছিলাম। সূরাটি শেষ না করে তিলাওয়াত ছেড়ে দিতে আমার মন চায়নি। কিন্তু সে যখন বার বার তীর নিক্ষেপ করছিল তখন আমি রুকু সিজদার মাধ্যমে নামায শেষ করি । আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে গিরিপথ পাহারার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা পালনে ত্রুটি হবার আশংকা থাকলে আমি নামায পড়েই যেতাম এবং সূরাটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিলাওয়াতে ক্ষান্ত দিতাম না। তাতে আমার মৃত্যু হলেও কোন পরোয়া ছিলনা। ইবন ইসহাক তার মাগাযী গ্রন্থে এরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবু দাউদ এই হাদীছ আবু তাওবা– ইবন ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ওয়াকিদী আবদুল্লাহ্ উমারী– খাওয়াত সূত্রে সালাতুল খাওফের দীর্ঘ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীছে বর্ণনাকারী বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওই অভিযানে শত্রুপক্ষের বহু মহিলাকে বন্দী করেন। বন্দী মহিলাদের মধ্যে জনৈকা সুন্দরী দাসী ছিল। তার স্বামী তাকে খুব ভালবাসত । স্ত্রীর বন্দীর সংবাদ শুনে সে শপথ করে বলেছিল সে মুহাম্মাদ (সা)-কে খুঁজে বের করবে এবং ওদের কারো না কারো রক্ত প্রবাহিত না করে অথবা নিজের স্ত্রীকে উদ্ধার না করে সে ঘরে ফিরবে না। এর পরের বর্ণনা মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের বর্ণনার অনুরূপ।

ওয়াকিদী বলেন, হযরত জাবির (রা) বলতেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ছিলাম। জনৈক সাহাবী একটি পাখীর ছানা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো রাসূলুল্লাহ (সা) সেদিকে তাকিয়েছিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে ছানাটির বাবা-মা অথবা তাদের কোন একটি সেখানে উড়ে এসে সংশ্লিষ্ট সাহাবীর হাতে এসে বসে পড়ে। এ ঘটনায় উপস্থিত সাহাবীগণ বিস্মিত হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, পাখীটির অবস্থা দেখে তোমরা অবাক হচ্ছ? তোমরা তার ছানাটি নিয়ে এসেছ আর সন্তান বাৎসল্যের কারণে পাখীটি নিজের জীবন তুচ্ছ জ্ঞান করে তোমাদের সম্মুখে লুটিয়ে পড়েছেন। জেনে নাও, আল্লাহর কসম করে বলছি- এই ছানাটির প্রতি পাখীটির মমতা যতটুকু তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রভু ও মালিক আল্লাহ্ তা’আলার দয়া তার চাইতে বহুগুণ বেশী ।

হযরত জাবির (রা)-এর উটের ঘটনা

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, ওয়াহব ইবন কায়সান আমার নিকট বর্ণনা করেছেন জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ সূত্রে তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে যাতুর রিকা অভিযানে বের হই। আমি বের হয়েছিলাম আমার একটি দুর্বল উটের পিঠে চড়ে। অভিযান শেষে ফেরার পথে আমার সাথী-সঙ্গীরা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। আর আমি দুর্বল উটের কারণে বার বার পিছিয়ে পড়ছিলাম। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) পেছনে থেকে অগ্রসর হয়ে আমার নিকট পৌঁছে গেলেন। তিনি আমাকে বললেন, জাবির! ব্যাপার কী? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমার এই উট আমাকে পেছনে ফেলে রেখেছে। তিনি বললেন, উটটিকে বসাও। জাবির (রা) বলেন, আমি আমার উটটিকে বসালাম এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর বাহন থামালেন। তিনি আমাকে বললেন, তোমার হাতের ছড়িটি আমাকে দাও অথবা একটি গাছের ডাল ভেঙ্গে এনে আমাকে দাও। আমি তাই করলাম। তিনি সেটি দ্বারা উটকে কয়েকটি খোঁচা মারলেন । তারপর আমাকে বললেন, এবার তুমি উটের পিঠে উঠে বস। আমি উটের পিঠে উঠলাম। উটটি চলতে শুরু করল । যে মহান সত্তা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন তাঁর কসম করে বলছি, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উটের সাথে সাথে তখনই আমার উটটিও চলতে থাকে। আমি চলতে চলতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে আলাপ করছিলাম। তিনি বললেন, হে জাবির! তুমি কি এই উট আমার কাছে বিক্রি করবে? আমি বললাম, জ্বী না বিক্রি করব না; বরং সেটি আপনাকে উপঢৌকন স্বরূপ দিয়ে দেব। তিনি বললেন, না দান নয়; বরং সেটি আমার নিকট বেচে দাও। এবার আমি বললাম, তবে মূল্য নির্ধারণ করুন। তিনি বললেন, ঠিক আছে এক দিরহামের বিনিময়ে আমি উটটি গ্রহণ করলাম। আমি বললাম, না ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! তাহলে আমি ঠকে যাব। তিনি বললেন, তবে দু দিরহামে? আমি বললাম, না তাও নয়। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) অনবরত দাম বৃদ্ধি করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত বললেন, এক উঁকিয়ার তথা (চল্লিশ দিরহামের) বিনিময়ে। আমি বললাম, তাতে কি আপনি খুশী? তিনি বললেন, হাঁ আমি খুশী। আমি বললাম, তবে এই উটের মালিক হলেন আপনি। তিনি বললেন, হাঁ আমি তা গ্রহণ করলাম। এরপর তিনি বললেন, হে জাবির! তুমি কি বিয়ে করেছ? আমি বললাম, জ্বী হাঁ। ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! তিনি জিজ্ঞেস করলেন কুমারী বিয়ে না কি বিবাহিতা? আমি বললাম, বিবাহিতা। তিনি বললেন কুমার বিয়ে করলে না কেন? তাহলে তুমি ওর সাথে আনন্দ করতে সে তোমাকে নিয়ে আনন্দ করত। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! আমার আব্বাজান উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তিনি ৭টি কন্যা সন্তান রেখে গিয়েছেন। তাই আমি একজন বয়স্কা মহিলা বিয়ে করেছি যাতে সে ওদেরকে দেখা শোনা ও তত্ত্বাবধান করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এটি তুমি ইনশাআল্লাহ্ ঠিক কাজটি করেছ। আমরা যখন সিরার নামক স্থানে পৌঁছব তখন আমি উট যবাই করার নির্দেশ দেব। সেখানে উট যবাই হবে এবং একদিন সেখানে আমরা থাকবো। ওই দিন আমরা ওখানে থাকব। তোমার স্ত্রী আমাদের আগমন সংবাদ শুনলে তার গদিগুলো ঝেড়ে নেবে, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমাদের তো কোন গদি নেই। তিনি বলেন, এখন না থাকলেও তখন থাকবে! আর তুমি যখন স্ত্রীর নিকট যাবে তখন বুদ্ধিমত্তার সাথে বিবেচনা সম্মত কাজ করবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সহ আমরা “সিরার” নামক স্থানে এলাম, তিনি উট যবাই করার নির্দেশ দিলেন। উট যবাহ করা হল। আমরা সেদিন ওখানে থাকলাম। সন্ধ্যাবেলা রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও আমরা সকলে মদীনায় প্রবেশ করলাম। বাড়ী গিয়ে আমার স্ত্রীকে আমি সব খুলে বলি, সে বলল, ঠিক আছে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশ শিরোধার্য। সকাল বেলা আমি উটটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। তার দরজায় গিয়ে আমি উটটিকে বসিয়ে দিই । তারপর নিজে মসজিদে গিয়ে তার কাছেই বসি! রাসূলুল্লাহ্ (সা) হুজরা থেকে বের হয়ে উটটি দেখতে পান। তিনি বললেন, এটি কার উট? ব্যাপার কী? লোকজন বলল, এটি জাবিরের উট। তিনি নিয়ে এসেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, জাবির কোথায়? আমাকে ডাকা হল। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ভাতিজা! তুমি তোমার উটটি ধর এবং নিয়ে যাও। এটি তোমারই থাকবে। এরপর তিনি হযরত বিলাল (রা)-কে ডেকে বললেন, যাও, জাবিরকে এক উঁকিয়া (৪০ দিরহাম) দিয়ে দাও। হযরত জাবির (রা) বলেন, আমি বিলালের সাথে গেলাম। তিনি আমাকে এক উঁকিয়া দিলেন বরং কিছুটা বেশী দিলেন । আল্লাহর কসম! সেটি আমার নিকট ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল । আমার পরিবারের মধ্যে মুদ্রাটির একটি আলাদা মর্যাদা ছিল। অবশেষে ‘হাররা’ দিবসের বিশৃংখলায় সেটি হারিয়ে যায়। ইমাম বুখারী (র) এই হাদীছ উবায়দুল্লাহ ইব্‌ন উমার আমরী– জাবির (রা) সূত্রে অনুরূপ উদ্ধৃত করেছেন।

সুহায়লী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত জাবির (রা)-কে তাঁর পিতা সম্পর্কে যে সুসংবাদ দিয়েছিলেন এই হাদীছে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন যে, আল্লাহ তা’আলা জাবির (রা)-এর পিতা আবদুল্লাহকে শহীদ হওয়ার পর জীবিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, তুমি তোমার আকাংখা ব্যক্ত কর । এ জন্যে যে, তিনি ছিলেন শহীদ। শহীদদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন :

আল্লাহ্ তা’আলা মু’মিনদের নিকট হতে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, তাদের জন্যে এর বিনিময়ে রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, নিধন করে এবং নিহত হয়। তাওরাত ইনজীল ও কুরআনে এ সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ্ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে রয়েছে? তোমরা যে সওদা করেছ সেই সওদার জন্যে আনন্দ কর এবং সেটিই মহা সাফল্য। (৯-সূরা তাওবা : ১১১) অন্য এক বাণীতে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের জন্যে আরো অধিক পুরস্কারের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন :

যারা ভাল কাজ করে তাদের জন্যে আছে কল্যাণ এবং আরো অধিক । (১০- ইউনুস ও ২৬)। এরপর তিনি তাদেরকে মাল ও মূল্য অর্থাৎ উভয় বিনিময় প্রদান করেছেন। তিনি তাদের থেকে ক্রয় করা রূহগুলো তাদের নিকট ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :

যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত মনে করো না। তারা বরং জীবিত। তাদের প্রতিপালকের নিকট জীবিকাপ্রাপ্ত। (৩- আলে ইমরান : ১৬৯)।

মানুষের জন্যে রূহ হল বাহনের ন্যায়। উমর ইব্‌ন আবদুল আযীয তাই বলেছেন। সুহায়লী বলেন, এ জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) জাবির (রা) থেকে উটটি ক্রয় করেছিলেন সেটি ছিল তার বাহন। এরপর উট ও দিলেন, মূল্যও দিলেন এবং কিছুটা অতিরিক্তও দিলেন, এ ঘটনার মধ্যে তাঁর পিতা সম্পর্কে দেয়া সুসংবাদের বাস্তব প্রতিফলন দেখা গেল। সুহায়লী এখানে যে মন্তব্য করেছেন তা অবশ্য খুবই সূক্ষ্ম ইঙ্গিত এবং অভূতপূর্ব চিন্তাধারা। আল্লাহ্ তা’আলাই ভাল জানেন।

বায়হাকী (র) তার দালাইল গ্রন্থে এই যুদ্ধের অধ্যায়ে উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা শিরোনাম তৈরী করেছেন। তিনি বলেছেন, এই যুদ্ধে জাবির (রা)-এর উটকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রকাশিত বরকত ও নিদর্শনসমূহ বিষয়ক পরিচ্ছেদ। হযরত জাবির (রা) থেকে এই হাদীছ বিভিন্ন সনদে এবং বিভিন্ন পাঠে বর্ণিত হয়েছে। উটের মূল্য এবং নির্ধারিত শর্ত বিষয়ে হাদীছটিতে বিভিন্ন প্রকারের মতভেদ রয়েছে। অবশ্য এগুলো নিয়ে বিস্তারিত ও পরিপূর্ণ লেখার স্থান হল বিধি-বিধান অধ্যায়ের ক্রয়-বিক্রয় পর্ব। আল্লাহই ভাল জানেন। কোন বর্ণনায় আছে যে, এ ঘটনা এই যুদ্ধে ঘটেছে আবার কোন বর্ণনায় আছে যে, অন্য যুদ্ধে ঘটেছে। একই ঘটনা বার বার ঘটেছে তার সম্ভাবনা একান্তই ক্ষীণ। আল্লাহই ভাল জানেন।

দ্বিতীয় বদর যুদ্ধ

এটি ছিল সেই প্রতিশ্রুতি যুদ্ধ উহুদ থেকে ফেরার পথে যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল । ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যাতুর রিকা অভিযান শেষে মদীনায় ফিরে এলেন। জুমাদাল উলা মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো, জুমাদাল উখরা মাস এবং রজব মাস তিনি মদীনায় অবস্থান করেন। আবু সুফিয়ানের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধ মুকাবিলার জন্যে তিনি বদরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন শাবান মাসে।

ইবন হিশাম বলেন, এ অভিযানকালে মদীনার দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল আবদুল্লাহ (রা) ইবন আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সালকে। ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ । সা) বদর প্রান্তরে এসে শিবির স্থাপন করেন এবং আবু সুফিয়ানের আগমন অপেক্ষায় ৮ দিন এখানে অবস্থান করেন। মক্কাবাসীদেরকে নিয়ে আবু সুফিয়ান যুদ্ধের জন্যে বের হয়। যাহরানের এক পাশে মাজিন্না নামক স্থানে এসে তারা শিবির স্থাপন করে। কেউ কেউ বলেছেন যে, তারা উছফান পর্যন্ত এসেছিল । তারপর সে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে সে বলল, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! স্বচ্ছলতার বছর ছাড়া যুদ্ধ করা সমীচীন হবে না। বরং যে বছর তৃপ্তি সহকারে পশুপালকে ঘাসপাতা খাওয়াতে পারবে এবং তোমরা ইচ্ছামত দুধ পান করতে পারবে সে বছরই যুদ্ধ করা ভাল হবে। এই বছরটি বড় দুর্ভিক্ষের। আমি এখন ফিরে যাচ্ছি তোমরাও ফিরে যাও। ফলে কুরায়শরা ফিরে গেল । ফিরে যাওয়া সেনাদলকে মক্কাবাসিগণ উপহাস করে “ছাতুবাহিনী” নামে ডাকত। আর বলত যে, তোমরা তো ছাতু খেয়ে খেয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলে ।

এক পর্যায়ে মাখশা ইবন আমর দিমারী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়। ওয়াদ্দান যুদ্ধের সময় সে বানু দিমারা গোত্রের পক্ষে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেছিল। সে বলল, হে মুহাম্মাদ! কুরায়শদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে কি আপনি এখানে এসেছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ওহে বানু দিমারা গোত্রের লোক আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি। তোমাকে এও জানিয়ে দিচ্ছি যে, তোমাদের সাথে আমাদের যে চুক্তি ছিল ইচ্ছা করলে তোমরা তা প্রত্যাহার করে নিতে পার। আর তখন আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব যতক্ষণ না আল্লাহ্ আমাদের ও তোমাদের মাঝে ফায়সালা করে দেন। সে বলল, না হে মুহাম্মাদ! আল্লাহর কসম! ওই চুক্তি প্রত্যাহারের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনায় ফিরে আসেন। ফিরতি পথে কোন ষড়ষন্ত্র ও প্রতারণার সম্মুখীন হননি।

ইবন ইসহাক বলেন, মুসলমানগণ আবু সুফিয়ানের অপেক্ষায় থাকা এবং সৈন্যবাহিনী সহ আবু সুফিয়ানের ফিরে যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা) নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেন। ইবন হিশাম বলেন, আবু যায় আমাকে জানিয়েছেন যে, নিম্নের কবিতাটি আসলে কা’ব ইবন মালিকের। কবি বলেন :

আমরা আবু সুফিয়ানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম বদর প্রান্তরে উপস্থিত হবার। কিন্তু আমরা তার প্রতিশ্রুতির সত্যতা পাইনি। সে প্রতিশ্রুতি পালনকারী ছিল না ।

আমি কসম করে বলছি, তুমি যদি আমাদের মুখোমুখি হতে তবে অবশ্যই মুখোমুখি হতে উপযুক্ত প্রতিপক্ষের। তখন তুমি ফিরে যেতে মন্দ ও করুণ অবস্থায় আর হারিয়ে ফেলতে তোমার সাহায্য সহযোগিতাকারী যোদ্ধাদেরকে।

আমরা বদর প্রান্তরে রেখে গিয়েছিলাম (প্রথম বদর যুদ্ধে) উতবা ও তার পুত্রের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আমরা সেখানে আরো রেখে এসেছি উমর তথা আবু জাহলের গলিত দেহ।

তোমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অবাধ্য হয়েছ। ধিক তোমাদের ধর্মের জন্যে, ধিক তোমাদের ভ্রান্ত ও মন্দ কর্মকান্ডের জন্যে।

তোমরা আমার প্রতি বিরূপ আচরণ করলেও আমি নিশ্চিতভাবে বলি যে, আমার পরিবার পরিজন ও ধন-সম্পদ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্যে নিবেদিত।

বরং অনন্য। তিনি আমাদের পথ-নির্দেশক। তিনি আমাদের জন্যে অন্ধকার রাতের আলোক–বর্তিকা।

ইবন ইসহাক বলেন, এ প্রসংগে হাস্সান ইবন ছাবিত (রা) কবিতায় বলেন :

ওরা ছেড়ে দিয়েছে সিরিয়ার শস্যক্ষেতসমূহ। সেগুলোর বিপরীতে রয়েছে বিস্তৃত শিলাভূমি যেন প্রসূতি উস্ত্রীর মুখ।

এমন সব লোকের হাতে ছেড়েছে যারা হিজরত করেছে তাদের প্রতিপালকের দিকে। তারা প্রকৃতই তাঁর সাহায্যকারী এবং তারা ছেড়েছে ফেরেশতাদের হাতে।

তারা যখন মরুভূমির বালুচর হয়ে নিম্নাঞ্চলের দিকে যাত্রা করবে তখন তাদেরকে বলে দিও যে, পথ সে দিকে নয়।

আমরা রাস্ পাহাড়ে অবস্থান করেছি আট দিন। সাহসী সেনা দল নিয়ে। সাথে ছিল বড় বড় উট- ঘোড়া ।

আমাদের সাথে ছিল লাল-কালো মিশ্রিত রংগের ঘোড়া সে গুলোর অর্ধেক দেহ জুড়ে ছিল রসদ পত্র । সাথে ছিল লম্বা লম্বা তরবারি বড় বড় ছুরি ।

তুমি দেখতে পাবে গলির স্কুপে, বালি পথে ধীরে চলা উষ্ট্র পালের পদচিহ্ন।

আমাদের যাত্রাপথে ও শত্রু অন্বেষণের সময়ে যদি ফুরাত ইবন হাইয়ানের সাথে দেখা হয়ে যায় তবে যেখানে দেখা হবে সেখানেই সে বন্দীত্ব বরণ করবে।

আর যদি ইমরাউল কায়সের পুত্র কায়সের সাথে সাক্ষাত হয় তবে তার দেহের কালো রং আরো কালো হয়ে যাবে। তার দুশ্চিন্তা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

সুতরাং আবু সুফিয়ানকে আমার পক্ষ থেকে একটি বার্তা পৌঁছিয়ে দাও যে, তুমি হলে প্রসিদ্ধ একজন মিসকীন।

ইবন ইসহাক বলেন, নিম্নোক্ত কবিতার মাধ্যমে আবু সুফিয়ান ইবন হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিব উপরোক্ত কবিতার জবাব দিয়েছিল। অবশ্য এ ব্যক্তি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

ওহে হাস্সান! হে কাঁচা খেজুর ভক্ষণকারী মহিলার সন্তান! তোমার দাদার কসম, আমরা এভাবেই বোকাদেরকে ধোঁকা দিয়ে থাকি।

আমরাও অভিযানে বের হয়েছিলাম। আমাদের মুখোমুখি হলে আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে তোমাদের মত হরিণ গুলো একটাও প্রাণে রক্ষা পেতে না।

আমরা যদি বিশ্রামস্থল থেকে উটগুলো তুলতাম তাহলে তুমি বুঝতে যে আমরা প্রচন্ড যোদ্ধা, মওসুমে সমবেত সকল লোককে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতাম।

তুমি রাস্ পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছিলে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। অপরদিকে তুমি যদি আমাদেরকে খুঁজে পেতে তাহলে খেজুর বাগানে আমাদেরকে রেখে তোমরা পালিয়ে যেতে।

আমাদের অশ্ব এবং উটেরদল ফসলাদি পদদলিত করে চলাচল করে। ওগুলো কোন কঠিন পাথুরে ভূমি মাড়ায় না।

আমরাও অভিযানে বেরিয়ে তিনদিন অবস্থান করেছিলাম সালাফারি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে আমাদের সাথে ছিল হাল্কা পশমের অশ্বদল আর ভারী পায়ে চলাচলকারী উষ্ট্ৰপাল।

তোমাদের ধ্বংস যখন নিকটবর্তী ছিল তখন তোমরা নিজেদেরকে খুব শক্তিশালী মনে করেছিলে। যেমন দুর্বল ও অসুস্থ যুবককে তোমরা শক্তিশালী মনে করে থাক।

সুতরাং হাল্কা পশম বিশিষ্ট অশ্বগুলোকে প্রেরণ করোনা; বরং শক্তি অর্জনকারী মুসিম যেমন বলেছে তুমিও ওগুলোকে তেমনটি বলে দাও।

তাতে তোমরা ভাল থাকবে এবং অন্যরাও ভাল থাকবে। ওই অশ্বারোহীদেরকে মনে হচ্ছে ফিহ্র ইবন মালিকের বংশধর অশ্বারোহী।

তুমি যে হিজরতের কথা বলেছ তুমি তো ওই হিজরতকারীদের অন্তর্ভুক্ত নও। আর তুমি দীনেরও অনুসারী নও।

ইবন হিশাম বলেন, অন্তমিলের বৈপরীত্যের কারণে আমরা কতক পংক্তি বাদ দিয়েছি।

মূসা ইব্‌ন উকবা যুহরী ও ইবন লাহিয়া উরওয়া ইবন যুবায়র থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সাহাবীগণকে গণহারে উপস্থিত হবার ডাক দিয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে মুকাবিলার লক্ষ্যে বদর প্রান্তরে উপস্থিত হবার জন্যে। মুনাফিকরা। লোকজনকে যুদ্ধে যেতে নিরুৎসাহিত করেছিল। তবে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বন্ধুদেরকে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে বদর প্রান্তরের দিকে যাত্রা করেন। তাঁদের সাথে ছিল ব্যবসায়িক পুঁজি তাঁরা বলাবলি করছিল, আবু সুফিয়ানকে উপস্থিত পেলে আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব আর তাকে না পেলে এ পুঁজি দিয়ে বদর অঞ্চলের মওসুমী মালপত্র কিনে আনব। এরপর মূসা ইবন উকবা ইবন ইসহাকের ন্যায় আবু সুফিয়ানের মাজিন্না উপস্থিতি, সেখান থেকে তার প্রত্যাবর্তন, দিমারীর কথাবার্তা ও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পক্ষ থেকে চুক্তি প্রত্যাহারের প্রস্তাব এবং তার তা প্রত্যাখ্যান বিষয়ক ঘটনাগুলো উল্লেখ করেছেন।

ওয়াকিদী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) প্রায় ১৫০০ সাহাবী নিয়ে বদর অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। মদীনার শাসনভার দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ্ ইবন রাওয়াহা (রা)-কে। তিনি যাত্রা করেছিলেন ৪র্থ হিজরী সনের যুল কাদা মাসের প্রথম দিকে । বিশুদ্ধ অভিমত হল ইবন ইসহাকের বক্তব্য যে, ৪র্থ হিজরী সনের শাবান মাসে তিনি এ অভিযানে বের হয়েছিলেন। ইবন ইসহাক ও মূসা ইব্‌ন উকবা এ ব্যাপারে একমত যে, অভিযান পরিচালিত হয়েছিল শাবান মাসে। তবে ইবন ইসহাক বলেছেন, ৪র্থ হিজরী সনের শা’বান মাস, মূসা ইব্‌ন উকবা বলেছেন, ৩য় হিজরীর শাবান মাস। তৃতীয় হিজরী বলাটা নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, এই যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল উহুদ যুদ্ধ শেষে। আর উহুদ যুদ্ধই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৩য় হিজরী সনে। এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা হয়েছে।

ওয়াকিদী বলেন, তাঁরা সেখানে বদর বাণিজ্য মেলার প্রাক্কালে ৮ দিন অবস্থান করেন। এরপর তারা ফিরে আসেন। ওই ব্যবসায় তারা ১ দিরহামে ২ দিরহাম হারে মুনাফা অর্জন করেন। অন্যরা বলেছেন যে, তারা ফিরে এলেন আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া অর্জন করে। এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন :

তারপর তারা আল্লাহর নিয়মত ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল। কোন অনিষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেনি। আল্লাহ্ যাতে রাযী তারা তারই অনুসরণ করেছিল এবং আল্লাহ্ মহা অনুগ্রহশীল । (৩ আলে ইমরান : ১৭৪)।

৪র্থ হিজরীর অন্যান্য ঘটনা

ইন জারীর বলেন, এ বছরের জুমাদাল ঊলা মাসে হযরত উছমান ইবন আফফান-এর পুত্র আবদুল্লাহ্ মারা যান। আবদুল্লাহ্ ছিলেন রাসূল তনয়া রুকাইয়ার সন্তান । মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর । রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর জানাযায় ইমামত করেন। পিতা হযরত উছমান তাঁর কবরে নেমেছিলেন, ওই বছরেই জুমাদাল উলা মাসে ইনতিকাল করেন আবু সালামা আবদুল্লাহ্ ইবন আবদুল আসাদ ইবন হিলাল ইব্‌ন আবদুল্লাহ ইবন উমার ইবন মাখযুম কুরাশী মাখযুমী। আবু সালামার মায়ের নাম ছিল বাররা, ইনি ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কন্যা এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ফুফু। অন্যদিকে আবু সালামা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুধ ভাই। আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবা তাদের দুজনকে দুধ পান করিয়েছিলেন, আবু সালামা, আবু উবায়দা, উসমান ইবন আফফান ও আরকাম ইব্ন আবু আরকাম (রা) তাঁরা সকলে প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তারা সকলে একই দিনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবু সালামা এবং তার স্ত্রী উম্মু সালামা দু’জনেই আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। এরপর মক্কায় ফিরে এসেছিলেন। আবিসিনিয়ায় অবস্থান কালে তাদের একাধিক সন্তান-সন্ততির জন্ম হয়। তারপর আবু সালামা (রা) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। স্ত্রী উম্মু সালামা (রা) ও পরবর্তীকালে হিজরত করেন। উম্মু সালামা যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে বদর এবং উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। উহুদ যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন। এই আঘাতেই তার মৃত্যু হয়। মুসীবত ও বিপদাপদের সময় ইন্নালিল্লাহ্ …. পাঠ করা সম্পর্কে তার একটি হাদীছ রয়েছে। “রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে উম্মু সালামার বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনায় হাদীছটি আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

ইবন জারীর বলেন, ৪র্থ হিজরীর শা’বান মাসের কয়েক রাত অতিবাহিত হবার পর এক রাতে হযরত ফাতিমা (রা)-এর গর্ভে হযরত আলীর (রা) পুত্র ইমাম হুসায়ন (রা)-এর জন্ম হয় । এ বছর রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যায়নাব বিন্ত খুযায়মাকে বিবাহ করেন। যায়নাবের বংশ লতিকা এরূপ। যায়নাব বিনত খুযায়মা ইবন হারিছ ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন আমর ইব্‌ন আব্দ মানাফ ইবন হিলাল ইবন আমির ইবন সাসা’আ আল হিলালিয়্যা। আবু উমার ইবন আবদুল বার আলী ইবন আবদুল আযীয সূত্রে বলেন যে, যায়নাব ছিলেন হযরত মায়মূনা বিন্ত হারিছ এর বোন। পরে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এ বর্ণনা একান্তই বিরল, অন্য কেউই এ রকম বর্ণনা করেছেন বলে আমি দেখিনি। ইনি গরীব-দুঃখীদের প্রচুর দান করা, এবং তাদের প্রতি সীমাহীন মমত্ববোধ ও কল্যাণ সাধনের প্রেক্ষিতে উম্মুল মাসাকীন বা মিসকীনদের মা নামে খ্যাত। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে হযরত যায়নাবের (রা) বিয়ের মাহর ধার্য হয়েছিল সাড়ে বার উঁকিয়া। ৫০০ শ’ দিরহাম। তাদের বাসর হয় রমযান মাসেই। এর পূর্বে যায়নাব (রা) তুফায়ল ইবন হারিছের স্ত্রী ছিলেন। তুফায়েল তাঁকে তালাক দেন।

আবূ উমার ইবন আবদুল বার আলী ইবন আবদুল আযীয় জ্বরজানী সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, তুফায়লের পর তার ভাই উবায়দা ইবন হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিব ইবন আব্দ মানাফ যায়নাবকে বিয়ে করেন। উসদুল গাবাহ” গ্রন্থে ইবনুল আছীর-এর বর্ণনা মতে যায়নাব (রা)-এর পূর্ব স্বামীর নাম ছিল আবদুল্লাহ্ ইবন জাহাশ তিনি উহুদ যুদ্ধে শহীদ হন। আবু উমর বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জীবদ্দশাতেই যে যায়নাব (রা) ইনতিকাল করেছিলেন তাতে কোন দ্বিমত নেই। কেউ কেউ বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে ১২ কিংবা ৩ মাসের দাম্পত্য জীবন শেষে তাঁর ইনতিকাল হয়।

ওয়াকিদী বলেন, এ বছরের শাওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সা) উম্মু সালামা (রা)-কে বিবাহ করেন । উম্মু সালামা (রা)-এর পিতার নাম ছিল আবু উমাইয়া । আমি বলি, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে বিয়ে হওয়ার পূর্বে উম্মু সালমা (রা) ছিলেন আবু সালামা ইব্‌ন আবদুল আসাদের স্ত্রী। উম্মু সালামা (রা)-এর ঘরে জন্ম নেয়া সকল সন্তানের পিতা হলেন আবূ সালাম। আবু সালামা উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ওই যুদ্ধে তিনি আহত হন। দীর্ঘ এক মাসের চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। এরপর অন্য একটি অভিযানে তিনি অংশ নেন। ওই অভিযানে প্রচুর ধন-সম্পদ ও উৎকৃষ্ট দ্রবাদি গনীমতের মালরূপে পান। এরপর তিনি ১৭ দিন জীবিত ছিলেন। তারপর ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং তাতে তিনি মারা যান। ৪র্থ হিজরীর জুমাদাল উলা মাসের তিনদিন বাকী থাকতে তাঁর ইনতিকাল হয়। শাওয়াল মাসে উম্মু সালামা (রা)-এর ইদ্দত শেষ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজের বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে হযরত উমার (রা)-কে উম্মু সালামা (রা)-এর নিকট পাঠান । হযরত উমর (রা) একাধিকবার তাঁর নিকট গমন করেন। উম্মু সালামা তাঁর নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনি একজন আত্ম অভিমানী মহিলা, তদুপরি তিনি বিপদগ্রস্ত । অর্থাৎ তিনি একাধিক সন্তান-সন্ততির মা । ওদের দেখাশুনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সেবা শুশ্রূষার ত্রুটি হতে পারে। এ ছাড়াও বাচ্চাদের খাবার সংগ্রহের জন্যে তাঁকে কাজকর্ম করতে হবে। তখন হযরত উমর (রা) বললেন, বাচ্চাদের ব্যাপারটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ন্যস্ত। অর্থাৎ ওদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব আপনার উপর থাকবে না। আর আত্ম অভিমানের কথা বলছেন? সেজন্যে আল্লাহর নিকট দুআ করুন আল্লাহ্ তা দূর করে দিবেন। এরপর তিনি বিয়েতে সম্মতি দিলেন। হযরত উমর (রা)-কে তিনি সর্বশেষ যে কথাটি বলেছেন তা হল “উঠুন প্রিয়নবীর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিন।” অর্থাৎ আমি বিয়েতে রাযী । আমি এর অনুমতি দিলাম। এ বক্তব্যের সূত্র ধরে কোন কোন আলিম বলেছেন যে, উম্মু সালামা তাঁর পুত্র উমর ই আবু সালামাকে একথাটি বলেছিলেন অথচ উমর ইবন আবু সালামা তখন ছিলেন বালক মাত্র । এমন বয়সের যে, বিবাহের অভিভাবক হওয়ার উপযুক্ত ছিলেন না। এ বিষয়ে আমি একটি পৃথক পুস্তিকা রচনা করেছি। সেখানে সঠিক ও সত্য অভিমতটি আমি প্রতিষ্ঠা করেছি। সকল প্রশংসা আল্লাহর। তবে এই বিয়েতে উম্মু সালামা (রা)-এর অভিভাবক হয়েছিল তাঁর বড় ছেলে সালামা ইবন আবু সালামা। এটি শুদ্ধ হল এজন্যে যে, সালামার পিতা আবু সালামা ছিলেন তাঁর সময়ের সালামার চাচাত ভাই । সুতরাং এরূপ পুত্র তার মাতার অভিভাবকত্ব লাভ করবে যদি সেই পুত্র পুত্রত্ব ব্যতীত অন্য কোন কারণে ওই অধিকার লাভ থাকার এই বিষয়ে সকল ইমাম একমত। দ্রুপ পুত্র যদি মুক্তি দানকারী কিংবা বিচারক হয়। পক্ষান্তরে পুত্র যদি পুত্রত্ব ব্যতীত অন্য কোন দিক হতে এই অধিকার লাভ না করে তাহলে ইমাম শাফিঈ এর মতে সে অভিভাবক হতে পারবে না। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা, মালিক ও আহমদ (র) বলেন, শুধু পুত্রত্বের কারণেও পুত্র মায়ের বিয়েতে অভিভাবক হতে পারবে। এ বিষয়ে আলোচনার স্থান এটা নয় । আহকাম আল কাবীর গ্রন্থের বিবাহ অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

ইমাম আহমদ (র) বলেছেন, ইউনুস উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, একদিন আবু সালামা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবার থেকে আমার নিকট এসেছিলেন । তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মুখে একটি কথা শুনেছি। তাতে আমি খুবই খুশী হয়েছি। তিনি বলেছেন, “কোন মুসলমানের উপর বিপদ এলে ওই বিপদের সময় সে যদি পাঠ করে :

আমরা আল্লাহরই মালিকানাধীন এবং আমরা তাঁরই নিকট ফিরে যাব।” এর পর বলে, “ আল্লাহ! আমার এই বিপদ থেকে আমাকে মুক্তি দিন এবং এর পরিবর্তে আমাকে ততোধিক কল্যাণ দান করুন। তাহলে আল্লাহ্ তা’আলা তার জন্যে তাই তাকে করবেন ।

উম্মু সালামা (রা) বলেন, আমি ও দু’আটি মুখস্থ করে রেখেছিলাম। যখন আমার স্বামী আবু সালামার (রা.) মৃত্যু হয় তখন আমি ইন্না লিল্লাহ পাঠ করি এবং এই দুআ করি —

পরে আমি নিজেই নিজের মনে বলেছি” আবূ সালামা অপেক্ষা ভাল মানুষ আমি আর কোথায় পাব? আমার ইদ্দত যখন শেষ হল তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমার গৃহে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। আমি তখন একটি চামড়া শোধন করছিলাম। হাত ধোয়ার পাতা দিয়ে আমি হাত ধুয়ে নিলাম । আমি তাঁকে ভিতরে আসতে বললাম। ভেতরে গাছের ছাল এবং উপরে চামড়া দিয়ে তৈরী একটি গদী তাঁর জন্যে বিছিয়ে দিলাম। তিনি সেটির উপর বসলেন এবং আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। তাঁর বক্তব্য শেষ হবার পর আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার প্রতি আমার আগ্রহের কমতি নেই, কিন্তু কথা হল, আমি একজন ভীষণ আত্ম অভিমানী মহিলা । আমার ভয় হচ্ছে এজন্যে যে, নাজানি আমার পক্ষ থেকে আপনি এমন কোন আচরণের সম্মুখীন হন যার কারণে মহান আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিবেন । আর আমি তো ইতোমধ্যে বার্ধক্যের কোঠায় পৌঁছে গিয়েছি। তদুপরি আমার রয়েছে অনেক ছেলে মেয়ে (যাদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা আমাকেই করতে হয় ।) রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি আত্ম অভিমানের যে কথা বলেছ, আল্লাহ্ তা’আলা তা দূর করে দিবেন। তুমি বার্ধক্যের কথা বলেছ, আমিও তো সে পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছি। আর পোষ্য ছেলে-মেয়ের কথা যা বলেছ সে ক্ষেত্রে তোমার পোষ্য যে সে তো আমারই পোষ্য। এবার উম্মু সালামা (রা) বললেন, তবে আমি নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্যে সোর্পদ করলাম। এরপর উম্মু সালামা আপন মনে বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে আবু সালামার উত্তম বিকল্পরূপে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে মঞ্জুর করেছেন।

ইমাম তিরমিযী ও নাসাঈ (র) উক্ত হাদীছ হাম্মাদ ইবন সালামা— আবু সালামা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম তিরমিযী (র) বলেছেন, এটি একক বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীছ । ইমাম নাসাঈ (র) ছাবিত আবু সালামা সূত্রেও এটি উদ্ধৃত করেছেন । ইবন মাজা এই হাদীছটি উদ্ধৃত করেছেন আবু বকর ইব্‌ন আবূ শায়বাহ্— উমার ইবন আবী সালাম। থেকে ।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রতিশ্রুত বদর প্রান্তরে উপস্থিত হবার পর যথাসময়ে মদীনায় ফিরে গেলেন। এরপর তিনি যিলহজ্জ মাসের শেষ পর্যন্ত মদীনতেই অবস্থান করেন। এ বছরও মুশরিকগণ হজ্জের তত্ত্বাবধানে ছিল। ওয়াকিদী বলেন, ৪র্থ হিজরী সনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) যায়দ ইবন ছাবিত (রা)-কে ইয়াহূদীদের কিতাব পাঠ শিখে নেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি বলি, বিশুদ্ধ সনদে যায়দ ইব্‌ন ছাবিত (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, মাত্র পনের দিনে আমি তা শিখে নিই । আল্লাহই ভাল জানেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *