০৭. স্বামীজির অবিশ্বাস্য অ্যাকাউন্টিং পলিসি

স্বামীজির অবিশ্বাস্য অ্যাকাউন্টিং পলিসি

অকালমৃত্যু ও অকালবার্ধক্যের এই দেশে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কীভাবে শতবর্ষের সীমা পেরিয়ে কালজয়ী হল, তা একালের ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে এখনও কৌতূহলের বিষয়।

এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সঙ্ঘগুলি পূজ্যপাদ মহামানবদের স্পর্শে ধন্য হয়েও কিছুদিনের মধ্যে কেন টুকরো টুকরো হয়ে যায়, অথবা দলীয় দ্বন্দ্বের বিষে আত্মহননের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ এ দেশের প্রতিষ্ঠান-পরিচালকদের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জানা দরকার, শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্য বেলুড়মঠের সন্ন্যাসীসঙ্ঘ কোন শক্তির বলে এমনভাবে কালজয়ী হল এবং বৃহৎ অরণ্যবনস্পতির মতো সর্বশ্রেণির মানুষের সমর্থন ও বিস্ময় ধরে রাখতে সমর্থ হল? দার্শনিক, দেশপ্রেমী ও মানবপ্রেমী বিবেকানন্দকে নিয়ে গত একশো বছরে দেশেবিদেশে নেহাত কম আলোচনা হয়নি, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাবনা-চিন্তার প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে তেমন নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি।

অর্থ সম্বন্ধে, বিশেষ করে অপরের অর্থ সম্বন্ধে, স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও রেখেঢেকে কথা বলেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ তার অন্তিমপর্বে প্রিয়জন ও ভক্তজনের আর্থিক সাহায্যের উপর বিশেষ নির্ভরশীল হয়েছে, কিন্তু তিনি একবারও ভুলে যাননি অর্থ হল গৃহস্থের রক্ত এবং সেই অর্থের যথাযোগ্য সম্মান বিশেষ প্রয়োজন।

কোনও অবস্থাতেই অপচয় অথবা বাজে খরচ ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা হওয়া শ্রীরামকৃষ্ণের সমর্থন বা প্রশ্রয় পায়নি। অপরের কাছ থেকে অর্থ সংগৃহীত হলেই তার যে হিসেব প্রয়োজন, এই চিন্তা তরুণকালে অনভিজ্ঞ নরেন্দ্রনাথের মাথায় ঢোকেনি, তাই কাশীপুর-পর্বে ঠাকুরের অসুখের সময় খরচপাতির হিসেবপত্তর রাখা সম্পর্কে দাতাদের কথা ওঠায় তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। অতি সাবধানে নিতান্ত প্রয়োজনে যৎসামান্য খরচ করা হচ্ছে এই তো যথেষ্ট, যারা যথাসর্বস্ব দিতে এসেছে তাদের কাছে হিসেবের কথা তোলাকে অভিমানী নরেন্দ্রনাথ প্রসন্ন মনে নিতে পারেননি। তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। শোনা যায় কাশীপুরে নিতান্ত কঠিন মন্তব্য করে তিনি খাতাপত্তর ছুঁড়ে ফেলেছিলেন।

কিন্তু এই মানুষটিই পরবর্তীকালে স্বদেশে ও বিদেশের নানা অভিজ্ঞতার আলোকে বিস্তারিত হিসেবপত্তর রাখায় প্রবল বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। যাঁরা সামান্যতম অর্থ সাহায্যও করেছেন তারা অ্যাকাউন্ট চাইবার আগেই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হিসেব দাখিল করা যে সঙ্ঘস্বাস্থ্যের পক্ষে নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি মনেপ্রাণে অনুভব করেছেন। আর্থিক স্বচ্ছতা ও আর্থিক পরিচ্ছন্নতাকে সঙ্ঘজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করার জন্য যে ব্যাকুলতা স্বামীজি দেখিয়েছিলেন, তা মঠ ও মিশনের পরবর্তীকালের পরিচালকরা পরিত্যাগ করেননি।

ইদানীং কেউ কেউ বলছেন, এই হিসাব-পরিচ্ছন্নতা রামকৃষ্ণ মঠ মিশনকে এক বিশেষ মহিমায় আলোকিত করেছে। ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞরা এই আদর্শের সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্বন্ধে বিশ্লেষণকালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন থেকে অনেক নতুন তথ্যের ও তত্ত্বের সন্ধান পাবেন।

সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা নিজেরা অর্থ উপার্জন করেন না, কিন্তু অপরের আর্থিক সাহায্যে বহু বড় বড় কাজ করতে তারা সমর্থ হয়েছেন বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে। কিন্তু পরের অর্থ মানেই তো হিসেবের কড়ি। এর জন্যে নিয়মকানুনের বন্ধন প্রয়োজন, নিজের যৎসামান্য ব্যক্তিগত অর্থ ও সঙ্ঘের কাজের জন্য সংগৃহীত অর্থের মধ্যে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর দূরত্ব রাখাও প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার হিসেব সম্পর্কে স্বামীজির সেই মহামূল্যবান মন্তব্য, শাকের টাকা মাছে এবং মাছের টাকা শাকে খরচ করা চলবে না। হিসেব বিশেষজ্ঞরা আজকাল প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, যে কোনও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টিং প্রিন্সিপলের শেষ কথাটি এমন সহজভাবে পৃথিবীর কোনও ম্যানেজমেন্ট গুরু আজও বলে যেতে পারেননি!

স্বামী বিবেকানন্দের চিঠিপত্রে এবং কথাবার্তায় ব্যক্তিগত-অর্থ ও সঙ্ঘ অর্থের এই নৈতিক পার্থক্য ভীষণভাবে এসে গিয়েছে, এমনকী এর জন্য স্বামীজি নিজেও মৃত্যুর পরেও অসুবিধায় পড়েছে।

একেবারে শেষ পর্যায় থেকে শুরু করা যেতে পারে। বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২-এ স্বামীজির অপ্রত্যাশিত দেহাবসানের পরও হিসেবের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। দেহাবসানের ১৮ দিন পরে, ২২ জুলাই ১৯০২ মঠের ট্রাস্টিদের সভায় আলোচনার প্রথম বিষয় স্বামীজির ‘প্রাইভেট ফান্ড’, যা সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে গচ্ছিত রয়েছে। গভর্নমেন্ট পেপার ৩,৭০০ টাকা ও নগদ ১৭০০। স্বামীজির শেষ ইচ্ছা, টাকাটি তার গর্ভধারিণী জননী ভূবনেশ্বরী দাসীকে দেওয়া হয়। কিন্তু হিসেবের কড়ি! ট্রাস্টিরা সামান্য পরিমাণ অর্থ থেকেও বাদ দিলেন :

১) শান্তিরাম ঘোষের কাছে স্বামীজির ধার ৯ টাকা।

২) স্বামীজি তাঁর শিষ্যদের জন্য মশারি কিনতে দেন ২০ টাকা।

৩) স্বামী অদ্বৈতানন্দের চোখ অপারেশন করবার ফি দেওয়ার জন্য স্বামীজির নির্দেশ ৩০ টাকা। মোট ৫৯ টাকা।

.

মঠের অছিদের কাছে দ্বিতীয় প্রস্তাব, মার্কিন-নিবাসিনী মিসেস ওলি বুল স্বামীজিকে ৭০০ টাকার চেক দিয়েছিলেন জনৈক বিদেশিনী ভক্তের আমেরিকা ফিরবার জাহাজ-ভাড়ার জন্য। যদি এই ভাড়া অন্য কেউ দিয়ে দেন, তা হলে এই ৭০০ টাকাও স্বামীজির মা ভূবনেশ্বরী দাসীকে দেওয়া হবে।

শুরু থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনের হিসেবপত্তর কত কড়া তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই ৭০০ টাকা দিয়ে পরে সঙ্ঘগুরু স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামীজির মা’কে তীর্থ করান এবং দত্ত বাড়ির পারিবারিক মামলাতেও কিছু খরচ করেন।

বহু বছর আগে শ্রীমতী সরলাবালা সরকার রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে লিখে গিয়েছে, প্রত্যেক ব্যাপারের জন্য আলাদা-আলাদা ফান্ড। যে যে কাজের জন্য টাকা দিয়েছে, তা অন্য খাতে খরচ করা চলবে না। এ-বিষয়ে স্বামীজির বক্তব্য : “যদি তোমাকে অনাহারে মরতেও হয় তবু অন্য বাবদের টাকা থেকে একটা পয়সাও খরচ করবে না।” অর্থাৎ কাশীপুরের পরে বিরাট মানসিক পরিবর্তন।

দুর্বল হিসেব বোধহয় অনেকটা ব্লাড সুগারের মতো, যে-কোনও প্রতিষ্ঠানকে নিঃশব্দে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। শ্ৰীমতী সরলাবালার সংযোজন, “মঠ আর মিশন দুই-ই আলাদা। তাই যদি কোনও ভক্ত প্রণামী দেন বা ঠাকুরসেবার জন্য টাকা দেন, সেটি মঠের অর্থভাণ্ডারে সঞ্চিত হইবে, আর জনহিতকর কার্যের জন্য জনসাধারণ যে টাকা দান করিবে সেটি হইবে মিশনের টাকা। সেই টাকার পাই-পয়সার হিসাব পর্যন্ত হিসাব-পরীক্ষক দিয়া মিলাইয়া লইতে হইবে।”

মৃত্যুর পরেও বিষয়সম্পত্তি নিয়ে যাতে কোনও আইনি গোলমাল আরম্ভ না হয়, তার জন্য সুদূর মার্কিনদেশে পরিব্রাজক বিবেকানন্দের চিন্তার শেষ ছিল না। দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে যখনই তিনি বিব্রত হয়েছেন, তখনই তিনি চটপট নিজের হাতে একটি উইল লিখে ফেলেছেন, ব্যাঙের আধুলির কতটুকু কোথায় যাবে, কে তার দায়িত্ব নেবে তা স্পষ্ট ভাষায় বলে গিয়েছেন। স্বামীজির এইসব উইল সম্বন্ধে নানা পরিস্থিতিতে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু মানসপত্রগুলির নির্দেশগুলি খুঁটিয়ে দেখে আরও বিস্তারিত আলোচনা হলে দূরদর্শী সন্ন্যাসীটিকে আরও ভালভাবে জানা যেত। সাতপুরুষের উকিলবাড়ির ছেলে সন্ন্যাস নিলেও প্রয়োজন মতো যে কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করতেন না।

শুধু নিজের উপার্জিত সামান্য অর্থের জন্য নয়, অন্যের নামেও যেসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে, সে বিষয়ে সব রকম নিরাপত্তা নেওয়ার ব্যাপারে স্বামীজি যে বেজায় একগুঁয়ে ছিলেন, তারও যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিদেশিনী মিস হেনরিয়েটা মুলারের অর্থে বেলুড়ের যে-জমি কেনা হয়, তার বায়না করা হয় ১৮৯৮ সালে (১০০১ টাকা)। বাকি ৩৮,৯৯৯ টাকা দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয় ৫ মার্চ ১৮৯৮। এর মধ্যে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ তার ব্যক্তিগত উইল করেন ১৯ জানুয়ারি ১৮৯৮, কারণ বিবেকানন্দ বিদেশ থেকে সামান্য যা অর্থ এনেছিলেন, তা তিনি ব্রহ্মানন্দকেই দিয়েছিলেন। যদি স্বামী ব্রহ্মানন্দ লোকান্তরিত হন, তা হলে কী হবে, এই আশঙ্কায় এই ইচ্ছাপত্র।

“লিখিতং স্বামী ব্রহ্মানন্দ, দক্ষিণেশ্বরনিবাসী পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য, সন্ন্যাসী, সাকিন আলমবাজার মঠ, আলমবাজার, জেলা চৰ্বিশ পরগণা কস্য চরমপত্ৰমিদং– আমি এত দ্বারা নির্দেশ করিতেছি যে, আমার ত্যক্ত আমার স্বামী বা বেনামী নগদ অর্থ, গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি এবং স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি আমার অভাবে উক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য আলমবাজার মঠনিবাসী স্বামী তুরীয়ানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ সন্ন্যাসীদ্বয় পাইবেন এবং তাহাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তে ও অধীনে থাকিবে। আমি তাহাদিগকে এই উইলের একজিকিউটর নিযুক্ত করিলাম। এত দ্বারা স্বেচ্ছায় এই শেষ উইল বা চরমপত্র সম্পাদন করিলাম।”

স্বামী ব্রহ্মানন্দর এই উইলের সাক্ষী ছিলেন বিখ্যাত সলিসিটর প্রমথনাথ কর ও ডাক্তার বিপিনবিহারী ঘোষ।

হিসেবপত্তর সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দর দু’খানি মারাত্মক চিঠি বাংলায় লেখা হয়েছিল পরের বছর লন্ডন থেকে। বন্ধু ব্রহ্মানন্দকে লেখা প্রথম চিঠির তারিখ ১০ আগস্ট ১৮৯৯। নতুন কাগজ ‘উদ্বোধন’ সম্পর্কে প্রবল বিরক্তি দিয়ে এই চিঠির শুরু।– “মনে জেনো যে, আমি গেছি। এই বুঝে স্বাধীনভাবে তোমরা কাজ কর। টাকাকড়ি, বিদ্যাবুদ্ধি সমস্ত দাদার ভরসা’ হইলেই সর্বনাশ আর কি! কাগজটার পর্যন্ত টাকা আমি আনব, আবার লেখাও আমার সব– তোমরা কি করবে? সাহেবরা কি করছেন?

“আমার হয়ে গেছে! তোমরা যা করবার কর। একটা পয়সা আনবার কেউ নেই, একটা প্রচার করবার কেউ নেই, একটা বিষয় রক্ষা করবার বুদ্ধি কারু নেই। এক লাইন লিখবার… ক্ষমতা কারুর নাই– সব খামকা মহাপুরুষ!

“…তোমাদের যখন এই দশা, তখন ছেলেদের হাতে ছমাস ফেলে দাও সমস্ত জিনিস– কাগজ-পত্র, টাকা-কড়ি, প্রচার ইত্যাদি। তারাও কিছু পারে তো সব বেচেকিনে যাদের টাকা তাদের দিয়ে ফকির হও।

“মঠের খবর তো কিছু পাই না। শরৎ কি করছে? আমি কাজ চাই। মরবার আগে দেখতে চাই যে, আজীবন কষ্ট করে যা খাড়া করেছি, তা একরকম চলছে। তুমি টাকাকড়ির বিষয় কমিটির সঙ্গে প্রত্যেক বিষয়ে পরামর্শ করে কাজ করবে। কমিটির সই করে নেবে প্রত্যেক খরচের জন্য। নইলে তুমিও বদনাম নেবে আর কি!

“লোকে টাকা দিলেই একদিন না একদিন হিসাব চায়– এই দস্তুর। প্রতি পদে সেটি তৈয়ার না থাকা বড়ই অন্যায়। …ওইরকম প্রথমে কুঁডেমি করতে করতেই লোকে জোচ্চোর হয়। মঠে যারা আছে, তাদের নিয়ে একটি কমিটি করবে, আর প্রতি খরচ তারা সই না দিলে হবে না।– একদম! …আমি কাজ চাই, vigour (উদ্যম) চাই– যে মরে যে বাঁচে; সন্ন্যাসীর আবার মরা বাঁচা কি?”

.

তিন মাস পরে (২১ নভেম্বর ১৮৯৯) নিউ ইয়র্ক থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা আর এক চিঠি থেকে স্পষ্ট যে, হিসেবপত্তর সম্বন্ধে স্বামীজির মনোভাবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে তিনি আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টসের নিয়মকানুনে বাঁধতে উদগ্রীব।

স্বামীজি লিখছেন, “হিসাব ঠিক আছে। আমি সে-সব মিসেস বুলের হাতে সঁপে দিয়েছি এবং তিনি বিভিন্ন দাতাকে হিসাবের বিভিন্ন অংশ জানাবার ভার নিয়েছেন।

“আগেকার কঠোর চিঠিগুলিতে আমি যা লিখেছি, তাতে কিছু মনে করো না। প্রথমত ওতে তোমার উপকার হবে– এর ফলে তুমি ভবিষ্যতে যথানিয়মে কেতাদুরস্ত হিসাব রাখতে শিখবে এবং গুরুভাইদেরও এটা শিখিয়ে নেবে।

“দ্বিতীয়ত এই-সব ভৎর্সনাতেও যদি তোমরা সাহসী না হও, তা হলে তোমাদের সব আশা ছেড়ে দিতে হবে। আমি চাই তোমরা (কাজ করতে করতে) মরেও যাও, তবু তোমাদের লড়তে হবে। সৈন্যের মতো আজ্ঞাপালন করে মরে যাও এবং নির্বাণ লাভ কর, কিন্তু কোনও প্রকার ভীরুতা চলবে না।”

হিসেব সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন হওয়ার পিছনে স্বামী বিবেকানন্দের যে বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল, তা পরবর্তীকালে এডওয়ার্ড স্টার্ডিকে লেখা চিঠি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বামীজির বিদেশি অনুরাগীদের কেউ কেউ অজ্ঞাত কারণে তার সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। যে মিস হেনরিয়েটা মুলার বেলুড়ের জমি কেনার জন্য প্রধান অর্থ জুগিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বিবেকানন্দর প্রকাশ্য বিচ্ছেদের কথা রামকৃষ্ণ অনুরাগীদের অজানা নয়। আর একটি অপ্রীতিকর ঘটনা, স্টার্ডির অহেতুক সমালোচনার বিরুদ্ধে স্বামীজির পত্রবিস্ফোরণ। এই ধরনের ধৈর্যহীন বিস্ফোরণ স্বামীজির জীবনে কমই ঘটেছে, কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট, আর্থিক ব্যাপারে কোনওরকম অশোভন ইঙ্গিত তাঁকে গভীর বেদনা দিত।

স্টার্ডির সঙ্গে পত্রাবলী থেকে স্পষ্ট, ইংল্যান্ডের মাটিতে অসহায় মানুষটিকে কী কষ্ট পেতে হয়েছিল, অথচ বিদেশের অনুরাগীদের ভুল ধারণা, তাঁরা সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে যথেষ্ট সুখে রেখে দিয়েছেন। হিসেবপত্র প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্ক থেকে মিস্টার স্টার্ডিকে লেখা তারিখহীন চিঠিতে আসবার আগে নভেম্বর ১৮৯৯-তে স্বামীজির লেখা পরবর্তী চিঠির আলোচনা প্রয়োজন। আর্থিক সাহায্য যৎসামান্য হলেও সায়েবরা তার পরিবর্তে সন্ন্যাসীর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন, তা এই পত্র থেকে স্পষ্ট।

অপমানিত হয়ে বিবেকানন্দ সোজাসুজি প্রতিবাদ জানিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। ”বিলাসিতা, বিলাসিতা, গত কয় মাস থেকে কথাটি বড্ড বেশি শুনতে পাচ্ছি। পাশ্চাত্যবাদীরা নাকি তার উপকরণ জুগিয়েছে, আর সর্বক্ষণ ত্যাগের মহিমা কীর্তন করে ভণ্ড আমি নাকি নিজে সেই বিলাসিতা ভোগ করে আসছি। …তোমাদের সমালোচনায় আমার আর কোনও আস্থা নেই। এসব বিলাসব্যসনের কথায় আর কান দিই না…”

এর পরে কিছু অপ্রিয় সত্যের তিক্ত তালিকা। “ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও মিসেস সেভিয়ারের কথা বাদ দিলে ইংল্যান্ড থেকে আমি রুমালের মতো এক টুকরো বস্ত্র পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অথচ ইংল্যান্ডে শরীর ও মনের উপর অবিরত পরিশ্রমের চাপের ফলেই আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তোমরা, ইংরেজরা আমাকে এই তত দিয়েছ, আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছ আমাকে অমানুষিক খাঁটিয়ে। এখন আবার বিলাস-ব্যসন নিয়ে নিন্দা করা হচ্ছে।”

স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে বিরক্ত স্বামীজির লেখা আগের দুটি চিঠির কারণ বুঝতে হলে স্টার্ডির অন্তর্বর্তী পত্রগুলি পাঠ করা বিশেষ প্রয়োজন। রিজলি ম্যানর, নিউ ইয়র্ক থেকে লেখা চিঠিতে ঘুরেফিরে সেই হিসেবপত্রের কথা। স্বামীজি লিখছেন, “হিসেবপত্র পূর্বে পেশ করা হয়নি, কারণ কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি; সমস্ত ব্যাপারটা চুকে গেলে দাতার কাছে সম্পূর্ণ হিসাব দাখিল করব ভেবেছিলাম। টাকার জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার ফলে কাজ মাত্র গত বছর শুরু হতে পেরেছে এবং আমার নীতি হল, টাকার জন্যে হাত পেতে স্বেচ্ছায় দানের জন্য অপেক্ষা করা।”

শেষের লাইনটি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তারা এই নীতি নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলায় কোনও দিনই বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্য লাভ করেননি। কিন্তু কারণে-অকারণে সাহায্যের জন্য জনসাধারণের কাছে। হাতপাতা তাঁদের কালচারের বিরোধী। স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতার মনোভাবকে সন্ন্যাসীরা শত অভাবের মধ্যেও বিসর্জন দেননি। কিছুদিন আগে ভাটিকানে পোপের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় রামকৃষ্ণ মিশনের এক প্রবীণ সন্ন্যাসী বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীর তরুণতম, ক্ষুদ্রতম এবং নিঃসন্দেহে দরিদ্রতম সন্ন্যাসী সঙ্ঘের প্রতিনিধি হিসেবে আপনার কাছে এসেছি।”

সাধারণ ও অসাধারণ মানুষদের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা যথেষ্ট পরিমাণে মিললেও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ যে শতবর্ষের প্রবাহেও অর্থ বিষয়ে তেমন সম্পন্ন হতে পারেনি, এ বিষয়ে দ্বিমত হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও বাইরে থেকে অনেকের ধারণা, অপর্যাপ্ত অর্থ সন্ন্যাসীদের আয়ত্তে রয়েছে এবং সঙ্ঘসভ্যরা কোনওরকম অর্থচিন্তা ছাড়াই নিজেদের অভীষ্ট কাজ করে যেতে সমর্থ হচ্ছেন। এ-বিষয়ে যথাসময়ে আরও একটু আলোচনার প্রয়োজন হবে। অনুমানের উপর নির্ভর করে কোনও মতামত সৃষ্টি হলে সেখানে অবশ্যই ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে। যে জন্য স্বয়ং বিবেকানন্দও এক সময় দুঃখ করেছেন (২৮ জুন ১৮৯৪) “প্রভু মাদ্রাজীদের আশীর্বাদ করুন, তারা বাঙালিদের চেয়ে অনেক উন্নত, বাঙালিরা কেবল বোকা নয়–তাদের হৃদয় নেই, প্রাণশক্তি নেই।”

আরও আট মাস পরে (৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫) আপনজনদের ব্যবহারে ও বাক্যে অত্যন্ত ব্যথিত বিবেকানন্দের আর একটা ছবি পাওয়া যাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক থেকে বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালকে স্বামীজি লিখছেন, “আমি বাংলাদেশ জানি, ইন্ডিয়া জানি– লম্বা কথা কইবার একজন, কাজের বেলায় শূন্য… আমি এখানে জমিদারিও কিনি নাই বা ব্যাঙ্কে লাখ টাকাও জমা নাই। এই ঘোর শীতে রাত্তির দুটো-একটা পর্যন্ত রাস্তা ঠেলে লেকচার করে দু’ চার হাজার করেছি।”

একই বছরে বেদনার্ত বিবেকানন্দর আরও দুটি মন্তব্য নজর কেড়ে নেয়। “আমাকে সাহায্য করেছে এমন লোক তো আমি এখনও দেখতে পাইনি। বাঙালিরা–তাদের দেশে যত মানুষ জন্মেছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাজে সাহায্যের জন্যে কটা টাকা তুলতে পারে না, এদিকে ক্রমাগত বাজে বকছে; আর যার জন্যে তারা কিছুই করেনি, বরং যে তাদের জন্যে যথাসাধ্য করেছে, তারই ওপর হুকুম চালাতে চায়। জগৎ এরূপ অকৃতজ্ঞই বটে!”

ইংল্যান্ডের রিডিং থেকে গুরুভাই স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে মনের দুঃখে স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “লোক না পোক।…বাঙালিরাই আমাকে মানুষ করলে, টাকাকড়ি দিয়ে পাঠালে, এখনও আমাকে পরিপোষণ করছে- অহ হ!!!..যাঁর জন্মে ওদের দেশ পবিত্র হয়ে গেল, তার একটি সিকি পয়সার কিছু করতে পারলে না, আবার লম্বা কথা! বাংলাদেশে বুঝি যাব আর মনে করেছ? ওরা ভারতবর্ষের নাম খারাপ করেছে।”

এর পর নিজের জাত সম্বন্ধে সেই বিখ্যাত উক্তি যা একমাত্র স্বামীজির পক্ষেই সম্ভব : “রাম! রাম! খাবার পেঁড়িগুগলি, পান প্রস্রাব-সুবাসিত পুকুরজল, ভোজনপাত্র ছেঁড়া কলাপাতা এবং ছেলের মলমূত্রে-মিশ্রিত ভিজে মাটির মেঝে, বিহার পেত্নী-শাঁকচুন্নির সঙ্গে, বেশ দিগম্বর কৌপীন ইত্যাদি, মুখে যতো জোর! ওদের মতামতে কি আসে যায় রে ভাই? তোরা আপন কাজ করে যা।”

কিন্তু কেবল মনের দুঃখে জাতিনিন্দা নয়, প্রয়োজনে বাঙালির প্রশংসাতেও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ পঞ্চমুখ হয়েছেন। প্রথমবার আমেরিকা থেকে ফিরে দেশবাসীর অভিনন্দনের উত্তরে স্বামীজি বলেছিলেন, “লোকে বলিয়া থাকে, বাঙালি জাতির কল্পনাশক্তি অতি প্রখর, আমি উহা বিশ্বাস করি। আমাদিগকে লোকে কল্পনাপ্রিয় ভাবুক জাতি বলিয়া উপহাস করিয়া থাকে। কিন্তু বন্ধুগণ! আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, উহা উপহাসের বিষয় নহে। কারণ প্রবল উচ্ছাসেই হৃদয়ে তত্ত্বালোকের স্ফুরণ হয়। বুদ্ধিবৃত্তি– বিচারশক্তি খুব ভাল জিনিস, এগুলি বেশি দূর যাইতে পারে না। ভাবের মধ্য দিয়াই গভীরতম রহস্যসমূহ উঘাটিত হয়।”

রামকৃষ্ণ মঠ-মিশন স্থাপন করলেও, স্বামী বিবেকানন্দ এই সঙ্ঘের সম্পূর্ণ শৈশবও দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমস্ত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে যথাসময়ে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ যে বিরাট মহীরুহের মতো বিস্তৃত হল, তার পিছনে রয়েছে প্রতিষ্ঠাতার অবিশ্বাস্য দূরদৃষ্টি। সব অবস্থায় সভ্যদের কেমন আচরণ হবে, তা স্বামী বিবেকানন্দ স্পষ্টভাবে লিখে গিয়েছে, সঙ্রে কী কী বিপদ আসতে পারে, তাও তিনি আন্দাজ করে গিয়েছেন। ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে।

একসময় স্বামীজি বলেছিলেন, “To organize or not to organize? If I organize, the spirit will diminish. If I do not organize, the message will not spread.”

এপ্রিল ১৮৯৭ সালে আলমবাজার মঠে স্বামী বিবেকানন্দ বললেন, “এখন অনেক নূতন নূতন ছেলে সংসার ত্যাগ করে মঠবাসী হয়েছেন, তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট নিয়মে শিক্ষাদান করলে বড় ভাল হয়।”

নিয়মগুলি ডিকটেশন দেওয়ার আগে দূরদর্শী স্বামীজি যে মন্তব্য করেছিলেন, ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রের সেইটাই বোধহয় শেষ কথা। “দেখ এই সব নিয়ম করা হচ্ছে বটে, কিন্তু প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে এগুলি করবার মূল লক্ষ্য কী? আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সব নিয়মের বাইরে যাওয়া।”

সামাজিক ও সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের সম্বন্ধেও এটাই বোধহয় শেষ কথা। নিয়মের মধ্যে থেকেও কীভাবে সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী সব নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রতিষ্ঠানকে প্রাণবন্ত রাখা যায়। অর্থাৎ, অতিমাত্রায় নিয়মবন্ধন যেন স্বাধীনতাকে খর্ব না করে, আবার মাত্রাহীন স্বাধীনতা যেন শৃঙ্খলার সর্বনাশ না করে।

বিখ্যাত বই ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’-এ এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত চিন্তা আছে। অভিজ্ঞ স্বামীজি বলছেন শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে, “কালে সম্প্রদায় হবেই। এই দেখ না, চৈতন্যদেবের এখন দুতিনশো সম্প্রদায় হয়েছে; যীশুর হাজার হাজার মত বেরিয়েছে; কিন্তু ওইসকল সম্প্রদায় চৈতন্যদেব ও যীশুকেই মানছে।”

এই দুর্ভাবনার উত্তরও দিয়েছেন স্বামীজি। “আমাদের এই যে মঠ হচ্ছে, তাতে সকল মতের, সকল ভাবের সামঞ্জস্য থাকবে।…এখান থেকে যে মহাসমন্বয়ের উদ্ভিন্ন ছ’টা বেরুবে, তাতে জগৎ প্লাবিত হয়ে যাবে।”

বেলুড়ের মঠভূমিতে হোমাগ্নি প্রজ্বলিত করে হোমের পরে স্বামীজি উপস্থিত সকলকে আহ্বান করে বলেছিলেন, “আপনারা আজ কায়মনোবাক্যে ঠাকুরের পাদপদ্মে প্রার্থনা করুন, যেন মহাযুগাবতার ঠাকুর আজ থেকে বহুকাল বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ এই পুণ্যক্ষেত্রে অবস্থান করে এক সর্বধর্মের অপূর্ব সমন্বয়-কেন্দ্র করে রাখেন।”

রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অর্থের অভাবের কথা বুঝতে গেলে আরও একটু পিছিয়ে যাওয়া মন্দ নয়। আদিপর্বে বরাহনগরে রামকৃষ্ণতনয়দের অবস্থা এতই শোচনীয় ছিল যে, খাওয়া জুটতো না। বাইরে বেরোবার কাপড় নেই, না আছে জুতো। প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় জীবনযাপন।

এই অভাবের ছবি স্বামীজির মেজভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিকথা থেকে বিস্তারিভাবে পাঠ করে নেওয়া মন্দ নয়। “পরবার জন্য প্রত্যেকের কৌপীন ও একখণ্ড গেরুয়া বহির্বাস ছিল। অনেকে শুধু কৌপীন পরে থাকতেন। বাইরে কোথাও কাজকার্য যাওয়ার প্রয়োজন হলে সকলের ব্যবহারযোগ্য একটি বা দুটি সাদা ধুতি ও সাদা চাদর দেওয়ালের গায়ে টাঙানো থাকত। গেরুয়া বহির্বাস পরেই তারা ভিক্ষায় বেরতেন। প্রথম দিকে কয়েক জোড়া চটিজুতা ছিল। ক্রমে সেগুলি ছিঁড়ে গেলে মঠবাসীগণ খালিপায়ে চলাফেরা করতেন। তারা মাসে একবার দাড়িগোঁফ মুণ্ডন করতেন।

“বড় ঘরটির মেঝেতে বালন্দা পটপটির দু-তিনটি মাদুর পাতা থাকত। একপাশে থাকত একটি শতরঞ্চি। মাথার বালিশ ছিল চাটাইয়ের নীচে পাতা হঁট। মশার উৎপাত খুবই ছিল। একটা খুব বড় মশারি টাঙানো হত।”

সেই সময় মঠবাসীরা প্রায়ই একবেলা খেতেন। থালার বদলে ব্যবহার হত কলাপাতা বা মানকচুর পাতা। “যাবতীয় কায়িক পরিশ্রমের কাজ করতেন তাপসেরা। মঠপ্রাঙ্গণ ও ঘরদোর, সিঁড়ি ঝট দেওয়া, পুকুর থেকে জল তুলে পায়খানা সাফ করা ও শৌচের জন্য জল তোলা, বাসনপত্র মাজা, এ সকল কাজ তাদের করতে হত।”

স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, “তারকদা, আমি, লাটু, গোপালদাদা প্রভৃতি সকলে ভিক্ষায় বাহির হইয়া সামান্যভাবে যে চাউল পাইতাম তাহাই পালা করিয়া রান্না করিয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করিতাম। কোনও কোনওদিন শাকসবজি কোনওরূপ না পাইয়া তেলাকুচোর পাতা আনিয়া সিদ্ধ করিতাম ও তাহা দিয়া ভাত খাইতাম। অবশ্য আহার আমাদের একবেলাই জুটিত।”

মঠের মধ্যে মঠবাসী সাধকদের কৌপীনই ভরসা। একদিন কয়েকজন মহিলাকে বরাহনগর মঠের দিকে আসতে দেখে একজন বলে উঠলেন ‘দি মাগীজ আর কামিং’। অপর একজন প্রতিবাদ করেন। মাগীজ’ সংশোধিত হয়ে প্রথমে হল ‘মগীজ’, শেষে দাঁড়াল বার্মিজ’। অতঃপর অর্ধউলঙ্গ মঠবাসীগণকে সাবধান করে দেওয়া হত ‘দি বার্মিজ আর কামিং’ বলে। স্বামীজি এই পর্ব সম্বন্ধে নিজেই বলেছেন, “খরচপত্রের অনটনের জন্য কখনও কখনও মঠ তুলে দিতে লাঠালাঠি করতাম। শশীকে কিন্তু কিছুতেই এ বিষয়ে রাজি করাতে পারতাম না।” শশী মহারাজ (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) অর্থাভাব মেটানোর জন্য স্থানীয় ইস্কুলে সাময়িকভাবে মাস্টারি করতেন।

মঠের দুঃখদিনের দুই সহায়ক সুরেশ মিত্র ও বলরাম বসুর মৃত্যু হয় ১৮৯০ সালে। এঁরা নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন। বলরামবাবুর সাহায্য একসময় দাঁড়ায় মাসিক ৮০ টাকায়। এঁদের দেহাবসানের পর নরেন্দ্রনাথ স্বয়ং বারাণসীর প্রমদাদাস মিত্রের কাছে অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করেন। প্রমাদাস মিত্রের পরামর্শ, এখানে-ওখানে দু-চারজন করে ছড়িয়ে পড়।

অর্থকষ্ট এড়াবার জন্য বেশ কয়েকজন গুরুভাই তীর্থ করতে অথবা তপস্যা করতে বরানগর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। আর্থিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হয় আলমবাজার মঠে। আলমবাজার পরিস্থিতির অনেক বিবরণ বিশেষ ধৈর্য সহকারে সংগ্রহ করেছেন গবেষক স্বামী প্রভানন্দ তাঁর রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা’ নামক গ্রন্থে। এই লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি মন্দ হবেনা। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী লিখেছেন :”মঠে তখন কাজকর্মের লোক ছিল না। শশীমহারাজ ঠাকুরের ভোগ রান্না করতেন, কানাই মহারাজ বাসন মাজতেন, যোগীন মহারাজ, হরি মহারাজ ঘর ঝাঁট দেওয়া, কুটনা কাটা, মশলা বাটা প্রভৃতি কাজ করতেন।”

স্বামী অখণ্ডানন্দ আরও বিবরণ দিয়েছেন, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে উদ্ধৃতি দিয়ে। “মঠে এত অভাব যে, এমন অনেকদিন গিয়েছে ঠাকুরকে একটু মিছরি শরবত ভোগ দিবার জন্য দু-চার পয়সাও থাকিত না। একটা টেবিলে দুইটি টানা (ড্রয়ার) ছিল, তাহারই মধ্যে যাহা কিছু সামান্য পয়সাকড়ি থাকিত।”

মহেন্দ্রনাথ দত্তের মতে আলমবাজারে অর্থাভাব ছিল, তবে বরাহনগরের মতো নয়। লন্ডনে একবার স্বামীজি বলেছিলেন, “রাখালকে তখন বললাম যে, খেতড়ির রাজা মঠে মাসিক ১০০ টাকা করে দিতে রাজি হয়েছে, নে না; রাখাল তখন ঘোর বৈরাগ্য দেখাতে লাগল, নিলে না, কষ্টে মরতে লাগল। তাই আমি রাখালের ওপর চটে গেলুম।”

বিদেশ থেকে ১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মকালে স্বামীজি জানতে চান, “তোমাদের কি করে চলছে, কে চালাচ্ছে?” স্বামীজি নিজেও বিদেশ থেকে কিছু সাহায্য পাঠিয়েছেন। এই সময় আলাসিঙ্গাকে লেখা (১১ জুলাই ১৮৯৪) স্বামীজির আর্থিক খবরাখবর :

“ডেট্রয়েটের বক্তৃতায় আমি ৯০০ ডলার অর্থাৎ ২,৭০০ টাকা রোজগার করি, কিন্তু পাই মাত্র ২০০ ডলার। একটা জুয়াচোর বক্তৃতা কোম্পানি আমায় ঠকিয়েছিল। আমি তাদের সংশ্রব ছেড়ে দিয়েছি। এখানেও খরচ হয়ে গিয়েছে অনেক টাকা হাতে আছে মাত্র ৩,০০০ ডলার।”

পরের মাসে (৩১ অগস্ট ১৮৯৪) আলাসিঙ্গাকে লেখা আর-এক চিঠি থেকে টাকাকড়ি সম্বন্ধে স্বামীজির মানসিকতা আরও স্পষ্ট। “আমার হাতে এখন ৯,০০০ আছে তার কতকটা ভারতের কাজ আরম্ভ করে দেবার জন্য পাঠাব, আর এখানে অনেককে ধরে তাদের দিয়ে বাৎসরিক ও ষান্মাসিক বা মাসিক হিসাবে টাকাকড়ি পাঠাবার বন্দোবস্ত করব…”

স্বামী প্রভানন্দ জানিয়েছেন, ১৮৯৫ সালের প্রথম ভাগে স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছে, “তখন মঠে আমরা ডাল-ভাত ও চচ্চড়ি খাইতাম।” অখণ্ডানন্দের পরবর্তী রিপোর্ট :”এইবার মঠের দৈনন্দিন অবস্থা পূর্বাপেক্ষা অনেক ভাল।… ভক্তগণ যাঁহার যেমন অবস্থা, তেমনি খাদ্যদ্রব্য মঠে লইয়া আসিতেন। শতচ্ছিন্ন সতরঞ্চির অবসান ঘটাইয়া ভক্তগণ দুই-একটি নূতন সতরঞ্চি আনিয়া দিয়াছেন। একখানি ছোট চৌকি ও পড়ার একটি আলোও পাওয়া গিয়াছিল, মোটামুটিভাবে সকল সন্ন্যাসীদের পরিবার এক-একখানি কাপড় ও চাঁদরের সংস্থান হয়েছিল।”

এই উন্নতির পিছনে প্রধান ভূমিকা অবশ্যই ঠাকুরর শিষ্য (পরে সঙ্ঘ সভাপতি স্বামী, বিজ্ঞানানন্দ) এটাওয়ার ডিসট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের। স্বামী সুবোধানন্দের মুখে মঠের শোচনীয় অর্থাভাবের কথা শুনে হরিপ্রসন্ন নিয়মিত মাসে ৬০ টাকা পাঠাতে শুরু করেন।

নিজেদের অবস্থা যাই হোক, সন্ন্যাসীভ্রাতারা নরেন্দ্রনাথের মা-দিদিমার উপরে নজর রাখতেন সর্বদা।

স্বামীজির মেজাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত একবার রক্তপিত্তরোগে আক্রান্ত হন, তাঁকে আলমবাজারে আনিয়ে চিকিৎসা করানো হয় এবং পরে গাজীপুরে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য পাঠানো হয়।

আলমবাজার মঠের দ্বিতীয় পর্বে (১৮৯৪-১৮৯৭) অনেকগুলি অগ্নিগর্ভ চিঠি এসেছিল স্বামীজির কাছ থেকে। একটাতে তার ওয়ার্ড প্ল্যানের উল্লেখ ছিল : “তোলপাড় কর। তোলপাড় কর। একটাকে চীন দেশে পাঠিয়ে দে, একটাকে জাপান দেশে পাঠাও।”

স্বামীজির মতে সঙ্ঘ শব্দের তাৎপর্য ‘শ্রমবিভাগ। প্রত্যেকে আপনার কাজ করবে, যাতে সকল কাজ মিলে একটা সুন্দর ভাব সৃষ্টি হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ স্বামীজির প্রস্তাব : “কালীর (অভেদানন্দ) বিষয়বুদ্ধি পাকা। কালী হোক বিজনেস ম্যানেজার।”

পরের বছর (১৮৯৫) স্বামীজি কিন্তু মত পালটালেন : “শশী ঘরকন্না দেখুক, সান্যাল টাকাকড়ি, বাজারপত্রের ভার নিক, শরৎ সেক্রেটারি হোক।”

আর এক চিঠিতে স্বামীজির প্রস্তাব : “টাকাকড়ির ভার রাখাল (ব্রহ্মানন্দ) যেন লয়, অন্য কেহ তাহাতে যেন উচ্চবাচ্য করে।” অর্থ ও ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে রাখালের উপর বিবেকানন্দর ছিল পূর্ণ বিশ্বাস।

১৮৯৪ সালে আমেরিকা থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা তারিখহীন চিঠি : “মধ্যে যদি পারো অবিলম্বে হাওলাত করে কেদারবাবুর টাকা সুদসমেত দিও, আমি পত্রপাঠ পাঠাইয়া দিব। কাকে টাকা পাঠাই, কোথায় পাঠাই, তোমাদের যে হরিঘোষের গোয়াল।.কেদারবাবুর টাকা দ্বিগুণ পরিশোধ করিব, তাহাকে ক্ষুণ্ণ হইতে মানা করিবে। আমি জানিতাম, উপেন তাহা পরিশোধ করিয়াছে এতদিনে।”

“যে মহাপুরুষ–হুঁজুক সাঙ্গ করে দেশে ফিরে যেতে লিখছেন তাকে বলল কুকুরের মতো কারুর পা চাটা আমার স্বভাব নহে। যদি সে মরদ হয় তো একটা মঠ বানিয়ে আমায় ডাকতে বলল। নইলে কার ঘরে ফিরে যাব?…ঘরে ফিরে এস!!! ঘর কোথা?”

.

বিদেশ থেকে প্রথমবার কলকাতায় ফিরে স্বামীজি আলমবাজার মঠেই রাত্রিযাপন করতেন।

সেই সময় সম্বন্ধে স্বামী বিরজানন্দ পরবর্তী কালে লিখেছেন, “অন্য সকলের মতো তার বিছানা ভূমিতেই ছিল, সে সময়ে কারো তক্তপোশ ছিল না।”

আলমবাজার মঠে বসে যে নিয়মাবলী স্বামীজি মুখে-মুখে বলেছিলেন এবং স্বামী শুদ্ধানন্দ যা সাহস করে লিখে নিয়েছিলেন তার শক্তি সুদূরপ্রসারী। “নিয়ম করার মানে এই যে, আমাদের স্বভাবতই কতকগুলি কু-নিয়ম রয়েছে– সু-নিয়মের দ্বারা এই কু-নিয়মগুলি দূর করে দিয়ে শেষে সব নিয়মের বাইরে যাবার চেষ্টা করতে হবে।”

বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে স্বামী প্রভানন্দ জানিয়েছেন, স্বামীজি প্রথমে ২৩টি নিয়ম রচনা করেন। পরে আর একটি যোগ হয়ে, ২৪টি নিয়ম আজও আলমবাজার মঠের নিয়মাবলী বলে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

সন্ন্যাসীসঙ্ঘের সম্ভাব্য বিপদ-আপদ সম্পর্কে স্বামীজি যে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন, তা পরবর্তীকালের শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসীদের কথাবার্তা থেকেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দক্ষ-স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিতে দ্বিধা নেই দূরদর্শী সন্ন্যাসীদের : “হিন্দু সন্ন্যাসী হবেন ‘রিক্ত’ সাধু।..দু’জন সন্ন্যাসী একত্রে বাস করলে গড়ে ওঠে সন্ন্যাসী-মিথুন, তিনজনে হয় সন্ন্যাসীগ্রাম, চার বা ততোধিক জনে সন্ন্যাসীনগর, এসবই ত্যাজ্য। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ বিহারে একই গৃহে বাস করনে, কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসীর আদর্শ নিঃসঙ্গ জীবন।”

রামকৃষ্ণ মঠ স্থাপনের ব্যাপারে স্বামীজির মনোভাব বিভিন্ন চিঠিতে বেশ স্পষ্ট।নভেম্বর ১৮৯৭-এ তিনি লেখেন,”কলকাতায় একটি মঠহইলে আমি নিশ্চিন্ত হই। এত যে সারাজীবন দুঃখে-কষ্টে কাজ করিলাম, সেটা আমার শরীর যাওয়ার পর নির্বাণ যে হইবে না, সে ভরসা হয়।”

প্রথম দিকে গঙ্গার পশ্চিম দিক অপেক্ষা পূর্বদিকেই স্বামীজির নজর ছিল, যদিও বেলুড়ের জমির খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল জুলাই ১৮৯৭ নাগাদ। কিন্তু বায়না করা হয় ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮। এর আগে সেপ্টেম্বর ১৮৯৭-তে বাগবাজারের হরিবল্লভবাবুর বাটি বিশ হাজার টাকায় পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, কিন্তু অনেক ভাঙচুর করতে হবে এই আশঙ্কায় স্বামীজি এই সম্পত্তিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। কামারহাটিতেও মঠের জন্য একটা বাগান পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু অত্যধিক দূরত্বের জন্য অনেকের অপছন্দ।

উত্তরপ্রদেশের বড় সরকারি চাকুরি ছেড়ে হরিপ্রসন্ন মহারাজ মঠে যোগদান করায় আলমবাজারের সন্ন্যাসীসঙ্ঘ যে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছিল, তা এখন আর আমাদের অজানা নয়। তিনি প্রতি মাসে যে ৬০ টাকা পাঠাতেন তা এপ্রিল ১৮৯৭ থেকে বোধহয় বন্ধ হয়ে যায়।

পরের মাসের গোড়ায় স্বামীজি আলমোড়ায় চলে গেলেন। তিন দিন পরে মাদ্রাজে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে স্বামী প্রেমানন্দের চিঠি : ”এ মঠ ভিক্ষা করিয়া চালাইবার হুকুম গতকল্য আলমোড়া হইতে আসিয়াছে।” দেখা যাচ্ছে, আর্থিক স্বনির্ভরতার ব্যাপারে স্বামীজির চিন্তাধারা খুবই স্পষ্ট।

মঠমিশনের শাখা-প্রশাখা যখন বিস্তারিত হল তখনও প্রত্যেক কেন্দ্রে এই স্বনির্ভরতাই মূল মন্ত্র। কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা অর্থ জোগাবে না, নিতান্ত প্রয়োজনে যদি সাহায্য আসে, তা আসবে ধার হিসেবে। ধার সম্পর্কেও স্বামীজির চিন্তাধারা স্পষ্ট। নিজেও কোনও কারণে টাকা নিলে তার জন্য সঙ্ঘকে সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অর্থাৎ হিসেবের ব্যাপারে সামান্যতম শৈথিল্য নেই।

আলমবাজারের সম্পর্কে নির্দেশ যাই হোক, স্বামী বিবেকানন্দ উত্তরভারতে কিছু অর্থ তোলবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা তার চিঠি (১৫ নভেম্বর ১৮৯৭): “এখান হইতে মঠের খরচের জন্য বাবুনগেন্দ্রনাথ গুপ্তমহাশয় চাঁদা আদায় করিয়া পাঠাইবেন। রীতিমত receipt তাহাকে দিও। …টাকাকড়ি একটু হিসেব করে খরচ করো; তীর্থযাত্রাটা নিজের নিজের ওপর, প্রচারাদি মঠের ভার।”

খেতড়ির রাজা এই সময় স্বামীজিকে যে তিন হাজার টাকা দেন, তা-ও তিনি স্বামী সদানন্দ ও স্বামী সচ্চিদানন্দের মাধ্যমে মঠে পাঠিয়ে দেন। টাকা তোলবার চেষ্টা চালানোর সঙ্গে, প্রত্যেক প্রাপ্তির জন্যে রসিদ দেওয়ার ব্যাপারে সন্ন্যাসীরা তখন থেকেই সদা সজাগ। অর্থ সম্বন্ধে এই শৃঙ্খলা শতবর্ষ পরেও রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনে অটুট।

যে কাজের জন্যে যে-টাকা, তা অন্য খাতে খরচ করা রামকৃষ্ণ মিশনে নিষিদ্ধ সেই শুরু থেকেই। ত্রাণ কার্যের জন্য ভোলা টাকা সম্বন্ধে স্বামীজির স্পষ্ট নির্দেশ, “Famine ফান্ডে যে টাকা বাঁচিয়াছে, তাহা একটি পার্মানেন্ট ওয়ার্ক ফান্ড করিয়া রাখিয়া দিবে, অন্য কোন বিষয়ে তাহা খরচ করিবে এবং সমস্ত ফেমিন ওয়ার্কের হিসাব দেখাইয়া লিখিবে যে, বাকি এত আছে অন্য good work-এর জন্য।”

মঠের জন্য জমি সংগ্রহ করলেই শুধু চলবে না, মঠ পরিচালনার জন্যও যে অর্থের প্রয়োজন, তা স্বামীজি কখনও ভোলেননি। এ বিষয়ে তার প্রধান ভরসাস্থল বিদেশিনীরা। স্বামীজির একান্ত অনুগত গুডউইনের একটি চিঠি থেকে (২০ নভেম্বর ১৮৯৬) ব্যাপারটা স্পষ্ট হচ্ছে। মিসেস বুলকে লেখা চিঠির বক্তব্য : ”মঠের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মিস মুলার বছরে ২০০ পাউন্ড দেবেন, মিস সাউটার ১০০০ পাউন্ড দিচ্ছেন, মিস্টার স্টার্ডি ৫০০ পাউন্ড এবং স্বামীজি নিজে ২০০ পাউন্ড।” আরও কিছু অর্থের জন্য অনুগত গুডউইন লিখছেন স্বামীজির বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের কাছে।

নীলাম্বরবাবুর বাগানে সংসারত্যাগীরা বোধহয় ছিলেন দু’ভাগে বিভক্ত। স্বামীজির নাকি ইচ্ছা ছিল, মঠে দু’রকমের সাধু থাকবে–নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসী। প্রথম দলের নৈষ্টিক ব্রহ্মচারীরা আজীবন নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী থাকবে। তারা দাড়ি গোঁফ রাখবে ও আত্মপাকী হবে। নতুন ব্রহ্মচারী এলে স্বামীজি বেলুড়ের কাছাকাছি জায়গায় তাদের ভিক্ষে করতে পাঠাতেন। যা পাওয়া যেত তাই নিজে রান্না করে ঠাকুরকে ভোগ দিতে হত। অর্থাৎ কঠোর কঠিন জীবন থেকে পালিয়ে আসবার পথ নেই নবীন সন্ন্যাসীর।

আলমবাজারের নিয়মাবলীর সঙ্গে নীলাম্বরবাবুর বাগানে বসে স্বামীজি যে নিয়মাবলী রচনা করেন, তা একত্র করে গড়ে ওঠে ‘বেলুড়মঠের নিয়মাবলী। এখানেই স্পষ্ট যে জ্ঞান, ভক্তি, যোগ ও কর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে মঠবাসীদের চরিত্র। কিন্তু সব ভাল কাজের জন্যই যে প্রয়োজন অর্থের।

এক সময় নিয়মিত অর্থ বলতে খেতড়িরাজার মাসিক একশো টাকা। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ফান্ড থেকে টাকা ধার করে স্বামী ব্রহ্মানন্দ কোনওরকমে খরচ চালাচ্ছেন।

“অর্থাভাবই হচ্ছে প্রধান অসুবিধা, স্বামীজি নিজেই লিখেছিলেন মিস ম্যাকলাউডকে এক চিঠিতে। কিন্তু একই সঙ্গে স্বামীজির প্রধান চিন্তা ‘হিসে”। স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লন্ডন থেকে তিনি লিখছেন (১০ আগস্ট ১৮৯৯), “লোকে টাকা দিলেই একদিন না একদিন হিসেব চায়, এই দস্তুর। প্রতিপদে সেটি তৈয়ার না থাকা বড়ই অন্যায়।”

স্বামীজির ম্যানেজমেন্ট চিন্তার মূল কথা দুটি : “যতদূর সম্ভব অল্পখরচে যত বেশি সম্ভব স্থায়ী সৎকার্যের প্রতিষ্ঠা” এবং ত্রাণকার্যের আর্থিক হিসেব শুধু দিলেই চলবে না, তা পাবলিশ করতে হবে। প্রকাশ করবার এই নীতি নৈষ্ঠিকভাবে এখনও রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনে মেনে চলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে হিসাব বহির্ভূত টাকা সম্বন্ধে স্থির নীতি। যিনি টাকা দিচ্ছেন তার নাম-ঠিকানা চাই। রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান প্ল্যাটিনাম জুবিলির শেষ সভায় (২৭ জুলাই ২০০৮) মঠের জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী প্রভানন্দ প্রকাশ্যে বললেন, এক সময় যখন প্রচণ্ড অর্থাভাব, যখন সেবাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মাইনে দেবার অবস্থা নেই, তখন এক ভদ্রলোক ব্যাগে করে প্রচুর নগদ টাকা নিয়ে এলেন, কিন্তু বললেন তার নাম-ঠিকানা দেওয়া যাবে না। তরুণ সন্ন্যাসী প্রভানন্দ সেই দান নিলেন না, পরে সেক্রেটারি (স্বামী গহনানন্দ) ফিরে এলে সভয়ে তাকে ব্যাপারটা বললেন। স্বামী গহনানন্দ পরবর্তীকালে মঠের প্রেসিডেন্ট। তরুণ সন্ন্যাসীকে তিনি বললেন, “ঠিক কাজই করেছ। নীতিভ্রষ্ট হয়ে বড় কাজ করা যায় না। তাতে আমাদের অভাব না ঘুচলে কী করা যাবে?”

স্বামীজির জীবনকালে নিয়মকানুন ও হিসেবপত্তরের বন্ধন যথাসম্ভব কঠোর হওয়া সত্ত্বেও সব সমস্যার সমাধান হয়নি। মঠের জমি যাঁর টাকায় কেনা হয়েছিল, সেই মিস মুলারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়াটা এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। এ বিষয়ে কিছু আগাম ইঙ্গিত অবশ্য স্বামীজির চিঠিতেই রয়েছে। “মিস মুলার বিষম ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে… সকলের উপর মহারাগ, গালিম!… মধ্যে চাকরটা সকল চুরি করায় বিষম হাঙ্গামা হইয়াছিল।”

এরপরেই বিস্ফোরণ। ডিসেম্বর ১৮৯৮ মিস হেনরিয়েটা মুলারের ঘোষণা, তিনি স্বামী বিবেকানন্দের হিন্দুধর্ম প্রচারের আন্দোলনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছেন। কলকাতার বড় বড় সংবাদপত্রগুলি এই খবর রসিয়ে প্রচার করতে দ্বিধা করেনি।

.

স্বামীজির জীবনকালে মঠের উত্থানপতন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনাগত সময়ের দিকে তাকিয়ে তিনি সঙ্ঘের আইনকানুনগুলিও বিশেষজ্ঞদের আইনি পরামর্শে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করেছেন। লক্ষ্য এই যে, সময়ের খেয়ালি স্রোতে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রগতি যেন ভিন্নমুখী না হয়। জীবিতকালে বিশ্বজনের বিস্ময় সৃষ্টি করলেও, বাংলার স্থানীয় কিছু প্রতিষ্ঠান মিশনকে সব রকম বাধা দিতে লজ্জাবোধ করেনি। যেমন স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি বেলুড় মঠকে নরেন দত্তর বাগানবাড়ি’মার্কা করে মোটা টাকার ট্যাক্স ধার্য করে। ফলে প্রপার্টি ট্যাক্স নিয়ে লম্বা মামলা শুরু হয়, যার রায় শেষ পর্যন্ত মঠের পক্ষে যায়। স্বামীজির দেহাবসানের আগেই বেলুড় মঠের জমি নিষ্কর ঘোষিত হয়।

কলকাতা হাইকোর্টের এই রায়ের তারিখ ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০১। এই রায়ের দু’ সপ্তাহ আগে হাওড়া কোর্টে স্বামীজি মঠের দেবোত্তর দলিল রেজিস্ট্রি করেন (৮ ফেব্রুয়ারি ১৯০১) এবং চারদিন পরে বেলুড়ে স্বামীজির উপস্থিতিতে মঠের প্রথম সাধারণ অধিবেশন হয় ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯০১। ট্রাস্ট ডিড পড়া হয় সভায়, সভাপতি স্বামী অদ্বৈতানন্দ। ১১ জন ট্রাস্টির মধ্যে ৮ জন উপস্থিত ছিলেন, তাঁরাই ভোটে সভাপতি নির্বাচন করেন। সভাপতি পদের ভোটে স্বামী ব্রহ্মানন্দের পক্ষে ৫ ও বিপক্ষে ৩ ভোট, স্বামী সারদানন্দের পক্ষে ১ ও বিপক্ষে ৭ এবং স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পক্ষে ২ ও বিপক্ষে ৬ ভোট পড়ে। মনে হয়, স্বামীজি চেয়েছিলেন ভোটাভুটি হোক। কারণ প্রেসিডেন্ট পদে পরাভূত হয়েও স্বামী সারদানন্দ সর্বসম্মতিক্রমে সেক্রেটারি হন।

হিসেবের ব্যাপারে সন্ন্যাসীদের প্রথম থেকেই প্রবল সাবধানতা। শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মোৎসব ফান্ড ও স্বামীজির জন্মোৎসব ফান্ড আলাদা। এ বিষয়ে স্বামীজির কঠোর নির্দেশ, “যদি তোমাকে অনাহারে মরতেও হয়, তবু অন্য বাবদের টাকা থেকে এক পয়সাও খরচ করবে না।”

৪ঠা জুলাই ১৯০২ স্বামীজির অকালপ্রয়াণ যেন বিনামেঘে বজ্রপাত। এই কঠিন অবস্থা থেকে সঙ্ঘকে টেনে তুলে রাখা এবং বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবার প্রধান কৃতিত্ব স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দের। দূরদর্শী বিবেকানন্দ তার অবর্তমানে সঙ্ঘকে প্রাণময় রাখবার জন্য যেসব নিয়ম নির্দেশ করে গিয়েছিলেন, তা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করার দুর্লভ কৃতিত্বও তাদের।

স্বামী নিখিলানন্দ পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, স্বামীজির দেহত্যাগের পরে বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা স্বাভাবিকভাবে ভগ্নোদ্যোম হন এবং তাদের অনেকে কর্মত্যাগ করে নিভৃত জীবনযাপন করতে ইচ্ছা করেন। স্বামী সারদানন্দ তখন সন্ন্যাসীদের এক সভা আহ্বান করে শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘের গুরুদায়িত্বের কথা বিবৃত করেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন যে, এই বিশাল দায়িত্ব বহন করে চলতে হবে সকলকে? তিনি প্রশ্ন করেন, তিনি স্বামীজির মনোনীত সেক্রেটারি, তাকে সাহায্য করতে কে কে ইচ্ছুক আছেন? এবং কে কে তপস্যায় জীবন কাটাতে পছন্দ করেন? তিনি স্বয়ং পাঁচ বছর সঙ্ঘের কাজ করবেন বলে এগিয়ে আসেন। মাত্র একজন ব্যতীত অপর সন্ন্যসীরা সকলেই তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে সম্মত হন।

সঙ্ঘের পরিচালকরা দানের অর্থ সম্বন্ধে কি রকম সাবধানী ছিলেন, তার একটি উদাহরণ দিয়েছেন স্বামী নিখিলানন্দ। স্বামী সারদানন্দ সিগারেট খেতেন এবং ছাই ফেলতেন একটা সিগারেট টিনের কৌটোয়। একবার এক ধনী ভক্ত সারদানন্দকে কিছু উপহার দিতে চান। নিখিলানন্দ একটা কাঁচের ছাইদানি প্রস্তাব করেন যার দাম আট আনা। ভক্তের পয়সায় নিখিলানন্দ জিনিসটি কিনে তার বিছানার পাশে রেখে দেন।

“প্রাতঃকালে ওইটি দেখে কে দাম দিয়েছে জিজ্ঞাসা করেন। আমি ভক্তটির নাম বলি। তিনি বিরক্ত হন এবং গৃহস্থদের এইভাবে টাকা খরচ না করানোর বিষয়ে সাবধান করে দেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, আমরা সন্ন্যাসী এবং আমাদের উচিত সাধারণ জিনিসেই সন্তুষ্ট থাকা। তিনি বললেন আমি যেন ছাইদানি ফিরিয়ে দিয়ে পয়সা ফেরত আনি। আর যদি তা সম্ভব না হয় তবে ওই পয়সায় কাপড় কাঁচার জন্য সাধারণ সাবান কিনে আনি।”

অর্থের ব্যাপারে পরবর্তীকালের সঙ্ঘপ্রধানরাও অনেকে একই রকম সাবধানী ছিলেন। সাম্প্রতিককালে আর এক সঙ্ঘপ্রধান স্বামী ভূতেশানন্দ ধনী বংশের ছেলে, কিন্তু তিনি একটি ব্লেড়ে একমাস দাড়ি কামাতেন। একই রকমে গল্প আছে প্রয়াত সঙ্ঘসভাপতি স্বামী গহনানন্দ সম্পর্কে।

আর্থিক ডিসিপ্লিন কতই কঠোর ছিল, তার অবিশ্বাস্য নিদর্শন মেলে বারাণসীর দুটি পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান সেবাশ্রম ও অদ্বৈতাশ্রমে। সেবাশ্রমে যাঁরা কর্মী, তারা হাসপাতাল থেকে খাবার পাবেন। কিন্তু অদ্বৈতাশ্রম সাধনার স্থান, সেখানে যাঁরা তপস্যা করতে আসবেন, তাঁরা ভিক্ষা করে খাবেন, এই নিয়ম চালু ছিল। দারুণ অর্থাভাবে স্বামী শিবানন্দ এক সময়ে কাশীর গৃহস্থদের বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করেছেন।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ সমস্ত জীবনকাল সঙ্ঘসভাপতি ছিলেন কথাটি যে সম্পূর্ণ সত্য নয়, তা সরলাবালা সরকার এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। “একবার কোন কারণে যথারীতি ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না হওয়াতে বয়োজ্যেষ্ঠ সাধু স্বামী অদ্বৈতানন্দ বিনাভোটেই প্রেসিডেন্ট হন ১৯০৯ সালে।” ওই বছর ২৮ নভেম্বর স্বামী অদ্বৈতানন্দ দেহত্যাগ করলে ব্রহ্মানন্দ আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর মতো নেতা না থাকলে হয়তো সেই সময় মিশনের অস্তিত্ব বিপন্ন হত।”

শ্রীমতী সরলাবালা সরকার জানিয়েছেন, একসময় মঠের লোকসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু আহার্য কমছে। “ব্রহ্মচারী ছেলেরা সকালে মুড়ি জলখাবার পাইত, কিন্তু সেই মুড়ি এত শীঘ্র ফুরাইয়া যাইত যে, ঘণ্টার শব্দ আসিতে আসিতে অনেকের ভাগ্যে মুড়ি জুটিত না। স্বামী ব্রহ্মানন্দের আদেশ ছিল, তাঁহার ঘরে যাহা কিছু থাকিবে, যদি কেহ খাইতে না পাইয়া থাকে, সে যেন আসিয়া সেই জলখাবার লইয়া যায়।”

১৮৯৭ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা। স্বামীজি চাইতেন প্রতি বছর মিশনের সভা হবে এবং হিসেবপত্র প্রকাশ করা হবে। কিন্তু প্রথম কয়েক বছরের ছাপানো রিপোর্ট ও অ্যাকাউন্টস আমাদের নজরে আসেনি। প্রথম বাৎসরিক জেনারেল রিপোর্টের তারিখ বেশ কয়েক বছর পরে। ১৯০৯. সালে রামকৃষ্ণ মিশন সরকারি আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রি করা হয়।

স্বামী সারদানন্দর স্বাক্ষরধন্য মিশনের এই প্রথম রিপোর্টটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথেষ্ট। কী পরিবেশে এবং কী কঠিন অবস্থার মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনকে সেইসময় টিকে থাকতে হয়, তা মঠ-মিশনের প্রথম যুগের হিসেবপত্তরগুলি দেখলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাঠক-পাঠিকারা অধৈর্য না হলে প্রথম রিপোের্ট থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করা যায়।

গভর্নিং বডি কর্তৃক প্রস্তুত এই ফার্স্ট জেনারেল রিপোর্টে’ অডিটরের নাম শ্রী বি এন সান্যাল, সেক্রেটারি স্বামী সারদানন্দ ও ট্রেজারার স্বামী প্রেমানন্দ। একই প্রতিবেদনে ১৯১০, ১৯১১ ও ১৯১২ সালের হিসেবপত্তর রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে তখনকার ৩৫জন সন্ন্যাসীর নাম, যাঁদের বলা হয়েছে মনাস্টিক মেমবার্স’। সেই সঙ্গে ৩৫ জন ব্রহ্মচারীর নাম। মঠের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মিশনের ট্রেজারার স্বামী প্রেমানন্দ। স্বামী শিবানন্দ মিশন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ট্রাস্টি ১১ জন। এঁদের মধ্যে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ ও স্বামী বোধানন্দ মার্কিন-নিবাসী। ৩৫ জন ব্রহ্মচারীদের তালিকায় প্রথম নাম ব্রহ্মচারী জ্ঞান ও শেষ নাম পঞ্চানন, যিনি তিনকড়ি নামেও পরিচিত। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংবিধান তৈরির কাজ ১৯০৬ থেকে ঢিমেতালে চলেছিল। ৪মে ১৯০৯ যে মিশন রেজিস্ট্রি হয় তার প্রমোটার বেলুড় মঠের আটজন ট্রাস্টি। মেমোরান্ডাম অনুযায়ী মিশনের তিনটে প্রধান কাজ :

১। মিশনারি কাজ (প্রচার ও সংগঠন)

২। সেবাকর্ম

৩। শিক্ষা

রিপোর্টের একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য, স্বদেশিযুগের অশান্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ায় প্রকাশ্যে প্রচার বক্তৃতা ইত্যাদি গত ছ’ সাত বছর বন্ধ ছিল। স্বদেশে সাতটি শাখাপ্রশাখা। বিদেশে নিউ ইয়র্ক, পিটসবার্গ, ক্যালিফোর্নিয়া, বোস্টন, ওয়াশিংটনে ৫টি বেদান্ত সোসাইটি এবং বারাণসীর হোম অফ সার্ভিস, কনখল সেবাশ্রম ও বৃন্দাবন সেবাশ্রম ও ইলাহাবাদ সেবাশ্রমের সেবাকর্মের বিস্তারিত বিবরণও এই রিপোর্টে রয়েছে। বারাণসীতে মাসে পঞ্চাশ জন রোগীর চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্যে ৫০০ টাকা ধরা হয়েছে। অর্থাৎ মাথাপিছু মাসিক ১০ টাকা।

কাশী সেবাশ্রমের ১৯০০-১৯১২ সালের বিস্তারিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, বছরে ২৭৭ জন ইনডোর ও আউটডোর রোগী দিয়ে শুরু করে ১৯১১-১২তে ৮৩৪৪ জন রোগীর চিকিৎসা করা হয় সেখানে।

স্বদেশি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মিশনের প্রকাশ্য প্রচারকার্য উত্তর ভারতে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলেও দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে মাদ্রাজে ও বাঙ্গালোরে কাজ অব্যাহত থকে। উত্তর ভারতে বলবার মতন কাজ কেবল কয়েকটি শহরে সদ্য নিউইয়র্ক প্রত্যাগত স্বামী অভেদানন্দের বক্তৃতামালা। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, পাঁচটি ফান্ড ভোলা রয়েছে জনসাধারণের এককালীন দানের জন্যে। তার মধ্যে পুওর ফান্ড, এডুকেশন ফান্ড ও প্রভিডেন্ড রিলিফ ফান্ড উল্লেখযোগ্য।

১৯১০ সালেও রামকৃষ্ণ মিশনের আর্থিক অবস্থা কী শোচনীয় তার কিছু নমুনা দেওয়া যাক। প্রভিডেন্ট রিলিফ ফান্ডে বছরের বৃহত্তম দাতা (১০) কালীচরণ মিত্র, কলকাতা। চার্টার্ড ব্যাঙ্ক থেকে জুলাই-ডিসেম্বর ১৯০২ সালে প্রাপ্ত সুদ ১৩৪৫ টাকা ১১ আনা, ১৭ টাকা ১৩ আনা ৫ পাই। খরচখরচা বাদ দিয়ে বছরের শেষে ব্যালেন্স ১৩০৯ টাকা ৬ আনা। পরের বছর (১৯১১) সবচেয়ে বেশি দান করেছেন সিন্ধুপ্রদেশের (এখন পাকিস্তান) পি কে মেথুমল, পরিমাণ ৩০ টাকা। বোম্বাইয়ের পি ডি ব্রহ্ম দিয়েছেন ৫ টাকা। ত্রিলোচন ভট্টাচার্য দিয়েছেন ৫ আনা। বছরের শেষে ব্যালেন্স ১৪৯৯ টাকা ৫ আনা ১১ পাই।

পরের বছর ভাগলপুর প্লেগ রিলিফ কর্মীদের যাতায়াত বাবদ খরচ ৮ টাকা ১১ আনা ৬ পয়সা। বছরের শেষে হাতে টাকার পরিমাণ ১৫০৮ টাকা ১২ আনা ৫ পাই।

পুওর ফান্ড ১৯১০ ব্যালেন্স ৬০ টাকা ১৩ আনা ৯ পাই। বৃহত্তম দাতা টুটুচেরার ছোট্ট গোয়ালা (২১ টাকা)। জনৈক বৈকুণ্ঠনাথ দাসকে আর্থিক সাহায্য ৫ টাকা ১ আনা, একজন মহিলা সাহায্য পেয়েছেন ১ আনা। আর একজন মহিলা পেয়েছেন ৪ আনা।

রামকৃষ্ণ মিশনের মুদ্রিত জেনারেল অ্যাকাউন্টের হিসেব রয়েছে ১৯০৭ সাল থেকে। জমার পরিমাণ ৪৬৯ টাকা, খরচ ২৯৫ টাকা ১ আনা ৯ পাই। রামকৃষ্ণ মিশন নিয়মাবলী ছাপানোর কাগজ ও মুদ্রণ বাবদ ব্যয় ৬৫ টাকা ১ আনা।

প্রথম জেনারেল মিটিংয়ে জলখাবার বাবদ ব্যয় ১৪ টাকা ১ আনা ৬ পাই। রানিগঞ্জ পর্যন্ত জনৈক কুষ্ঠরোগীর ট্রেন ভাড়া বাবদ খরচ ১টাকা ৮ আনা ৩ পাই। গাড়িভাড়া বাবদ খরচা ৭ আনা। ১০০০ পোস্টকার্ড ছাপানোর জন্য খরচ ২ টাকা। রামকৃষ্ণপুরের ডাক্তার রামলাল ঘোষ দিয়েছে ১০৫ টাকা। কলকাতার কুমার কে নন্দী দিয়েছেন ১০৫ টাকা। ডায়মন্ড হারবারের শেখ মতিউদ্দীন দিয়েছেন ৫ টাকা।

১৯১০ থেকে ঝাঁপ দিয়ে এবার মার্চ ২০০৯-এ পৌঁছনো যাক। বেলুড় হেড কোয়ার্টার নিয়ে মঠ ও মিশনের তখন ১৭২টি কেন্দ্র। তারমধ্যে ভারতে ১২৯টি, বাংলাদেশে ১২টি, আমেরিকায় ১৩টি এবং অন্যান্য দেশে ১৮টি। মঠ-মিশনের অধীনে ১৫টি হাসপাতাল, শয্যাসংখ্যা ২২৪৯, ইনডোর রোগীর সংখ্যা ৯৯,৩৯২, আউটডোরে প্রায় ৩০ লক্ষ। ডিসেপেন্সারি ও চলমান মেডিক্যাল ইউনিটে রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। শিক্ষাকর্মে প্রায় বিপ্লব। ২৩২০টি শিক্ষাকেন্দ্রে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৪৮৪,৬৪৬। এছাড়া ৩টি বৃদ্ধাশ্রম ও ৭টি নার্সিং শিক্ষণ কেন্দ্র, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র ২টি। ত্রাণকাজের পরিমাণও বিশাল। ১৬৩৬টি গ্রামে ১০ লক্ষ দুর্গতের সেবায় ত্রাণের আর্থিক পরিমাণ ৬ কোটি টাকার ওপর।

২০০৯ সালের হিসেব অডিট করেছেন প্রখ্যাত রে অ্যান্ড রে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। বিশাল এই প্রতিষ্ঠান, যার অধীনে শত শত শিক্ষা ও সেবাকেন্দ্র, কিন্তু সবরকম দানের পরিমাণ মাত্র ৩৩ কোটি টাকা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে শিক্ষা, সেবা ও ব্ৰাণে সরকারি অনুদান–৯২ কোটি টাকা। যাঁদের ধারণা কোটি-কোটি ভক্তের উদার দানে রামকৃষ্ণ মিশন আর্থিক সমৃদ্ধির জোয়ারে ভাসছে, তারা জানলে কষ্ট পাবেন কয়েক বছর আগেও (১৯৯৫) দানের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ কোটি টাকা। ওই বছরেশত শত মিশন প্রোজেক্টে সরকারি সাহায্যর পরিমাণ ছিল ২৩ কোটি টাকা।

কোটি টাকার হিসেব দেখেও যাঁরা হতাশ হচ্ছেন, তাঁরা জানুন, ১৯৪০ সালেও মিশনে আসমুদ্র হিমাচলের জনসাধারণের ডোনশনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৩ লাখ টাকা। সে বছরে সরকারি অনুদানের পরিমাণ ছিল মাত্র ১০ লাখ টাকা। ১৯৫৮ সালেও জনসাধারণের ডোনেশনের পরিমাণ ৩৫ লক্ষ টাকা স্পর্শ করেনি, অথচ তখনই ভারতের কোথায় না মঠমিশনের কাজ চলেছে? ১৯৮০ সালেও জেনারেল ডোনেশনের পরিমাণ মাত্র ২৯ লক্ষ টাকা। এত অল্প অর্থে কী করে সন্ন্যাসীরা এত বৃহৎ সব কাজ করেছিলেন তা ভাবলে অবাক লাগে।

১৯২৬ সালে বেলুড় মঠে মঠ ও মিশনের যে ঐতিহাসিক কনভেনশন হয়েছিল, তা এক স্মরণীয় ব্যাপার। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের হিসেবটাও দেখা যেতে পারে। মোট ডোনেশন প্রাপ্তি ৬০৮৭ টাকা ৬ আনা ৬ পাই খরচ : খাওয়াদাওয়া ২৬৪১ টাকা ১৪ আনা ৩ পাই, প্যান্ডাল ১১৫ টাকা ১২ আনা ৯ পাই, কনভেনশন রিপোর্ট মুদ্রণ ১৮৬৩ টাকা ২ আনা। এই রিপোর্ট সই করেছেন তৎকালীন সেক্রেটারি স্বামী শুদ্ধানন্দ।

নিজের মুক্তির কথা না ভেবে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা বহুজনের হিত ও মঙ্গলের কথা ভেবেছিলেন কপর্দকহীন অবস্থায়। সামান্য যা কিছু সম্বল ছিল, তাও দুঃস্থ মানুষের সেবায় ও পূজায় বিক্রি করে দিতে কোনও দ্বিধা ছিল না তার মধ্যে। তার অকাল তিরোভাবের পরেও কিন্তু কাজের গতি স্তব্ধ হয়নি। ১৯১০ সালে ৩৫ জন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী যার কেন্দ্রবিন্দুতে, তা ঈশ্বরের আশীর্বাদে বাড়তে বাড়তে ২০০৮ সালে ১৫০০ সন্ন্যাসীতে পরিণত হয়েছে। নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীদের সংখ্যা আরও ৫০০ জন। এত কম অর্থে এত বড় বড় কাজ কী করে তারা করে চলেছেন, তা ভাবতে বিস্ময় লাগে।

অন্যান্য আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় রামকৃষ্ণ মিশন কত ক্ষুদ্র ও দরিদ্র তার একটা তুলনামূলক আলোচনা সম্ভব হলে মন্দ হত না। হাতের গোড়ায় ছোট্ট মার্কিন প্রতিষ্ঠান বিলি গ্রাহাম ইভানজেলিস্টিক অ্যাসোসিয়েশনের কিছু হিসেবপত্তর পাওয়া গেল। এই প্রতিষ্ঠান নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের হিসেবপত্র প্রকাশ করে থাকেন। বলাবাহুল্য এঁদের ব্যাপ্তি ও কর্মপরিধি মঠ-মিশনের এক শতাংশও নয়। সময় ২০০৬ সাল। ওই বছরে ওঁদের মোট উপার্জন সাড়ে বার কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ টাকার হিসেবে অন্তত ৬০০ কোটি। এঁদের সম্পদের পরিমাণ ওই বছরে ২০ কোটি ডলার, অর্থাৎ ৯০০ কোটি টাকা। বিলি গ্রাহামের এই তরুণ প্রচার সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা ১৯৫০ সালে, এঁরা ছোট্ট পরিধিতে নিজেদের আধ্যাত্মিক প্রচার চালান। এঁদের হিসেবের স্বচ্ছতা আছে, তাই জানা যায় এঁদের প্রধান উইলিয়াম ফ্রাংকলিন গ্রাহাম (তৃতীয়) বছরে পারিশ্রমিক নেন ৫ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রায় আড়াই কোটি টাকা। চেয়ারম্যান বিলি গ্রাহাম নেন ৪ লাখ ডলার অর্থাৎ পৌনে দুকোটি টাকা।

পোপের ভ্যাটিকান শহরের খরচাপাতি অনেকদিন প্রকাশিত হত না। পোপ জন পল দ্বিতীয় হিসাবপত্রে স্বচ্ছতা আনার প্রতিশ্রুতি দেন। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভ্যাটিকানের বাড়ি-ঘরদোর সম্পত্তির পরিমাণ নাকি ৭০ কোটি ইউরো, অর্থাৎ সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। ২০০৩ সালে আয়ের পরিমাণ ২৫ কোটি ডলার, ব্যয় ২৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে অবশ্য সুবিশাল মিউজিয়াম, ডাকটিকিট ইত্যাদির রোজগার ধরা হয়নি। ভ্যাটিকানের সম্পত্তির মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব। হিসেবে ওঁদের বিশাল বিশাল ভজনালয়গুলির মোট দাম ধরা হয়েছে মাত্র এক ইউরো।

এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর এক প্রতিষ্ঠানের এই ধরনের তুলনার মানে হয় না। যা বলার চেষ্টা করছি, লক্ষ-লক্ষ মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা পেয়েও, লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী ও রোগীর সেবাকর্মের দায়িত্ব নিয়েও এবং ত্রাণকার্যের জন্য সদা ব্যগ্র থেকেও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রকৃত অর্থে দরিদ্র থেকে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দ বোধহয় এরকমই চেয়েছিলেন। আজীবন তাঁর অবিচলিত আস্থা ছিল, কোনও ভাল কাজই টাকার জন্যে আটকে থাকবে না। সেইসঙ্গে পরবর্তী সঙ্ঘপরিচালকদেরও অবিচলিত প্রত্যাশা, দরিদ্র দেশের দরিদ্র মানুষরা সঙ্ঘের কাজ ঠিক চালিয়ে দেবেন। স্বামী বিবেকানন্দের বিশ্বাস ছিল যে, ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্য এই প্রতিষ্ঠানে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটবে এবং বারবার অসম্ভব সম্ভব হবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *